০৮. ভারতবর্ষের ইতিহাসের অতীত বর্তমান এবং ভবিষ্যত

আট

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ভারতবর্ষের ইতিহাসের অতীত বর্তমান এবং ভবিষ্যতের একটা চেহারা কল্পনা করে নিয়েছিলেন। তাঁর দৃষ্টিতে প্রাচীনকালে আর্যরা বাইরে থেকে এদেশে এসে অপূর্ব সৃজনিশক্তির প্রকাশ ঘটিয়ে হিন্দু সভ্যতার ভিটা গঠন করেছিলেন। আর্য জাতির নানাবিধ কীর্তি গৌরবময় হিন্দু অতীতের স্বাক্ষর বহন করে। অনেক সময়েই বঙ্কিম হিন্দু এবং আর্য দু’টি শব্দ একই রকম ভাবার্থক বলে মনে করতেন। বঙ্কিম একা নন। উনবিংশ শতাব্দী এমনকি বিংশ শতাব্দীর অনেকেও তাঁর মতো চিন্তা করতেন। এই চিন্তাটা সঠিক নয়। ভারতীয় অধিবাসীরা হিন্দু হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে অনেক পরে। মুসলিম শাসন পাকাপোক্ত হয়ে বসার পরেই ভারতের অধিবাসীদের একটা বিরাট অংশ নিজেদের হিন্দু বলে পরিচয় দিতে থাকেন। মুসলিম শাসনের অবসানের পর যখন ইংরেজ শাসন কায়েম হয়, ভারতের হিন্দুদের মধ্যে যাঁরা চিন্তা ভাবনায় অগ্রসর এবং ইউরোপীয় ধ্যান ধারণার সংস্পর্শে এসে যাঁদের চোখ কান খুলতে আরম্ভ করে, তাঁদের একটা অংশ একটি হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে সেই সুপ্রাচীন আর্য সভ্যতা সংস্কৃতির নবজীবন দান করতে তৎপর হয়ে উঠেছিলো। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এই শ্ৰেণীটির নেতৃত্বদান করেছিলেন।

বাংলার নয় শুধু, সারা ভারতের কৃতবিদ্য ব্যক্তিদের এই অংশটি হিন্দুদের অতীত বলতেই সেই আর্য যুগের কথা স্মরণ করতেন। তাঁরা আরো মনে করতেন বাইরে থেকে মুসলমানেরা এসে ক্রম প্রবাহমান আর্য রাজত্বের ধারাবাহিকতার ছেদ ঘটিয়ে ভারতের ইতিহাসে জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসেছে। এই চিন্তাটিও অতিশয় প্রমাদপূর্ণ। ভারতীয় সভ্যতাকে এককভাবে আর্য সভ্যতা বলা ইতিহাসসম্মত নয়। ভারতের সমাজ সভ্যতা এবং সংস্কৃতির রূপায়ণে আর্য উপাদান যেমন আছে, তেমনি অনার্য উপাদানের পরিমাণও সেখানে বিস্তর। বরঞ্চ বলা চলে আর্য উপাদানের চাইতে অনার্য উপাদানের পরিমাণ অধিক। আর শুধু মুসলমান আক্রমণের ফলে আর্য সভ্যতার ধারাবাহিকতা ব্যাহত হয়েছে একথা বলাও উচিত হবে না। এদেশে মুসলমানদের আসার ঢের আগে গ্রীক বীর আলেকজাণ্ডার তাঁর বিশ্ববিজয়ী বাহিনী নিয়ে হানা দিয়েছিলেন। গ্রীকদের সংস্পর্শে এসে ভারতীয়রা জ্ঞানে বিজ্ঞানে লাভবান হয়েছিলেন। তারপর ভারতবর্ষে শক এবং হনেরা বারংবার আক্রমণ চালিয়েছে এবং স্থানীয় শাসকদের পরাজিত করে ভারতের অভ্যন্তরে অধিকার প্রসারিত করেছে। আধুনিক ইতিহাস গবেষকদের কাছে এটা পরিষ্কার যে হুনদের শাসন কায়েম হওয়ার পরেই ভারতের জ্ঞান বিজ্ঞান এবং সংস্কৃতি চর্চার ধারায় ছেদ পড়েছে। তার জন্য এককভাবে মুসলমানদের দায়ী করা চলে না।

বর্তমান রচনাটিতে আমি একটি তাৎপর্যপূর্ণ জিনিশ তুলে ধরতে চাই। পাটলিপুত্র থেকে গান্ধার অবধি বিস্তৃত ভূভাগ যেখানে আর্যরা চলাচল করতো, সমস্ত অঞ্চলটাকে আর্যাবর্ত ধরা হতো। গান্ধার রাজ্য আধুনিক আফগানিস্থানের সীমানার মধ্যে পড়েছে। বঙ্কিমচন্দ্র আর্য এবং হিন্দুত্ব এ দুটি বিষয়কে এক করে দেখেছেন বারবার। কিন্তু একটি বিষয় শুধু বঙ্কিম নন, আরো অনেক চিন্তাবিদদের দৃষ্টিই এড়িয়ে গেছে। বঙ্কিম কিংবা । উনবিংশ শতাব্দীর অন্যান্য পণ্ডিত ব্যক্তিদের জন্মের বহু শতো বছর আগে আর্যাবর্তের অধিবাসীদের একটা বিরাট অংশ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে মুসলমান হয়ে গেছেন। আধুনিক পাঞ্জাব, সিন্ধু, বেলুচিস্থান, সীমান্ত প্রদেশ এবং আফগানিস্থান এই সমস্ত অঞ্চল তো আযাবর্তেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই সমস্ত অঞ্চলের যে সমস্ত মানুষ, যাঁরা। মুসলিম হিসেবে পরিচিত হয়েছেন, তাঁরা তো আর্য জনগোষ্ঠীরই একটা বিরাট অংশ। বঙ্কিমচন্দ্র এবং অন্যান্য ব্যক্তিবৃন্দ যখন আর্যত্ব এবং হিন্দুত্বকে এক করে দেখেছেন, তাঁদের মনে ধর্মান্তরিত আর্যদের কথা একবারও উদয় হয়নি। হাল আমলে আফগানরা তাঁদের জাতীয় পতাকাবাহী বিমান সংস্থার নাম রেখেছেন আরিয়ানা আফগান ওয়ার লাইনস বাংলা করলে যা দাঁড়ায় আর্য আফগান এয়ার লাইন। রাজধানী কাবুলের প্রধান আকর্ষণীয় এলাকার নাম রেখেছেন আরিয়ানা স্কোয়ার অর্থাৎ আর্য চত্বর। এই সমস্ত নামকরণের মধ্য দিয়ে আফগানেরা পৃথিবীকে জানিয়ে দিতে চেয়েছেন তাঁরাও আর্য গৌরব এবং ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার ধারণ করে আছেন। এইভাবে সিন্ধী, পাঞ্জাবী এবং সীমান্তের পাঠানেরা একই রকমভাবে আর্য উত্তরাধিকার দাবি উত্থাপন করতে পারেন। সুতরাং ভারতের হিন্দুরাই আর্য ঐতিহ্যের একমাত্র উত্তরাধিকার দাবি করতে পারে না, আর্যাবর্তের মুসলিম প্রধান প্রদেশসমূহের মুসলমানেরাও একই রকম দাবি করতে পারেন। উনবিংশ শতাব্দীর হিন্দু চিন্তানায়কদের বেশিরভাগই আর্যত্ব এবং হিন্দুত্ব এক করে দেখার জন্য এক রকম আদাজল খেয়ে লেগেছিলেন।

ভারতবর্ষের অতীত বলতে হিন্দু চিন্তাশীল ব্যক্তিবর্গ আর্যযুগ বোঝাতেন। ভারতবর্ষের অতীত রাজন্যবর্গের সকলে অবিমিশ্র আর্যবংশোদ্ভূত ছিলেন এ কথাও সত্যি নয়। ভারতবর্ষের অতীত ইতিহাসের অনেকটাই আর্য-অনার্যে সংঘাতে পরিপূর্ণ। অনার্যেরা সকলে কৃষ্টি-সংস্কৃতিহীন অসভ্য ছিলেন, সেটা একেবারে অসত্য। ভারতবর্ষের অতীত গৌরবের সমস্তটা আর্যদের একচেটিয়া এই প্রবল মত উনবিংশ শতাব্দীতে এতোদূর বিস্তৃতি লাভ করেছিলো, তা হিন্দু সমাজের শিক্ষিত ব্যক্তিবর্গের অনুধ্যানের বিষয় হয়ে। উঠেছিলো।

আর্য ধর্ম ও সংস্কৃতিকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন জৈন ধর্মের প্রবর্তক মহাবীর। লিচ্ছবি বংশোদ্ভূত গৌতম বুদ্ধ বেদ ব্রাহ্মণের অসারতা প্রমাণ করে অষ্টাঙ্গিক মার্গ প্রথা চালু করেছিলেন। জৈন ধর্মের প্রচারক মহাবীর কিংবা বৌদ্ধ ধর্মের প্রবর্তক গৌতম বুদ্ধ বংশ পরিচয়ের দিক দিয়ে দু’জনের কেউই আর্য জনগোষ্ঠীর অংশ ছিলেন মনে হয় না। তথাপি একথা অবিসংবাদিত যে দু’জনের ধর্মমত ভারতবর্ষের জনসমাজে ব্যাপক। বিস্তৃতি লাভ করেছিলো। আচারের কড়াকড়ির কারণে জৈন ধর্ম সাধারণ মানুষের মধ্যে। তেমন গৃহিত হয়নি। তাই একটা বিশেষ জনগোষ্ঠির বাইরে মহাবীরের ধর্মমত বিশেষ প্রতিপত্তি লাভ করতে পারেনি। কিন্তু গৌতম বুদ্ধের প্রচারিত ধর্মমতের কথা স্বতন্ত্র। বুদ্ধদেবের জীবদ্দশাতেই তাঁর প্রচারিত ধর্ম ভারতবর্ষের জনসমাজ এবং রাজন্যবর্গের মধ্যে ব্যাপক আবেদন সৃষ্টি করেছিলো। প্রাচীন ভারতের যে সমস্ত কীর্তির কথা স্মরণ করে অনেকে শ্লাঘা অনুভব করতেন, তার একটা বিরাট অংশ বৌদ্ধরাই স্থাপন করেছেন। অনেকেই এ জিনিশটি ভুলে থাকতে পছন্দ করতেন।

এই ব্যাপারটি বঙ্কিমচন্দ্রের মধ্যেও ঘটেছে। তিনি নিরীশ্বরবাদী নাস্তিক বুদ্ধদের নামও শুনতে পারতেন না। কিন্তু অবলীলায় অজন্তা ইলোরাসহ সকল বৌদ্ধ পুরাকীর্তিকে হিন্দু তথা আর্য গৌরবের স্মারক হিসেবে গ্রহণ করতে তাঁর মোটেও আপত্তি ছিলো না। ভারতের প্রাচীন ইতিহাসের একটা অপব্যাখ্যা তাঁর মন-মানসে এমন আচ্ছন্নতা সৃষ্টি করেছিলো, মনে করতেন ভারতের অতীত ইতিহাসের সমস্ত আয়তনটাই আর্য কীর্তি এবং গৌরব দিয়ে ঠাসা। ব্রাহ্মণ্য ধর্ম পুনরুথানের পর ভারত জুড়ে বৌদ্ধ নিধন যজ্ঞ শুরু হয়েছিলো, তাদের বিহার এবং উপসনালয়সমূহ যেভাবে ধ্বংস করা হয়েছিলো, অথবা হিন্দু মন্দিরে পরিণত করা হয়েছিলো এবং যে সকল কারণে বৌদ্ধ ধর্ম আপন জন্মভূমি থেকে চিরতরে বিতাড়িত হয়ে গেলো, এগুলোকে বঙ্কিম এবং তাঁর। সমসাময়িক অনেক বিজ্ঞ ব্যক্তি ইতিহাসের অংশ বলে মেনে নিতে প্রস্তুত ছিলেন না। ভারতবর্ষের ইতিহাসে এতো অত্যাচার অনাচার ঘটেছে, বঙ্কিম তার অধিকাংশের জন্যই মুসলমান বিজেতাদের দায়ী মনে করতেন; যেনো মুসলিম রাজত্বের পূর্বে আর্যযুগে শুধু দুধ মধুরধারা প্রবাহিত হতো এবং হিমালয়ের শীর্ষ থেকে দলে দলে দেবতারা নেমে এসে আশিষধারা বিতরণ করতেন। টড রাজস্থানের ওপর লেখা গ্রন্থটা প্রকাশ করে উনবিংশ শতাব্দীর শিক্ষিত হিন্দুর সামনে স্বপ্ন ভাণ্ডারের দুয়ার খুলে দিয়েছিলেন। হিন্দু লেখকেরা দেদার আর্যগৌরবের নিদর্শন এই গ্রন্থের পৃষ্ঠা থেকে আহরণ করে এমন সব উপন্যাস, ইতিহাস, নাটক এবং কাব্য রচনা করতে লেগে গেলেন, সেগুলোই সাধারণ পাঠকের কাছে গরীয়ান অতীতের অভিজ্ঞান হিসেবে স্বীকৃতি অর্জন করলো। সেকালের রাজপুত বীর এবং বীরাঙ্গনাবৃন্দ আর্য শৌর্যবীর্যের প্রতীক হয়ে সকলের চোখে দেখা দিতে আরম্ভ করলেন। এই রচনায় অন্যত্রও এই প্রশ্নটি উত্থাপন করা হয়েছে, এই রাজপুতরা কারা? তাঁরা কি আর্যদের কেউ ছিলেন, তাঁদের ধমণীতে আর্য শোণিত কি প্রবাহিত ছিলো? ইতিহাসের জবাব হলো রাজপুতেরা ছিলেন হনদের বংশধর। এই হুনদের আরেকটি শাখা রোম সাম্রাজ্য আক্রমণ করে। রক্তপাত, হত্যা এবং ধ্বংসের প্লাবন বইয়ে দিয়েছিলো। যে শাখাটা ভারতে প্রবেশ করেছিলো তাঁদের কীর্তিও কম মহত্বের দাবিদার নয়। তারা ভারতীয় সভ্যতা এবং সংস্কৃতির ধারাবাহিকতার একটা বিরাট প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিলেন। তারপরও ভারতীয় হিন্দু কৃতবিদ্য সমাজের একটি বিরাট অংশ রাজপুতদের অর্থে গায়ে আঙরাখা চাপিয়ে হাজির করতে থাকেন, তার কারণ উপনিবেশিক শাসকদের ভেদনীতি, হঠাৎ আলোর ঝলকানি লাগা পরাধীন হিন্দুর বিক্ষুব্ধ চিত্তবৃত্তি, খণ্ডিত ইতিহাস চেতনা অনেক। কিছুর মধ্যেই সন্ধান করতে হবে।

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সন্ন্যাসী বিদ্রোহের পরিপ্রেক্ষিতের ওপর হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের সূচনাটি করেছিলেন, আনন্দমঠ উপন্যাসে। এই রচনাতেই বলা হয়েছে “আনন্দমঠকে যদি কমুনিস্ট মেনিফেস্টোর সঙ্গে তুলনা করা হয়, তাহলে ডাস ক্যাপিটালের সঙ্গে তুলনা করতে হবে কৃষ্ণচরিতকে”। কৃষ্ণচরিতে অবতার শ্রীকৃষ্ণের জীবনকে এমনভাবে উপস্থাপিত করেছেন, যাতে করে একটি ধর্ম রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে শ্রীকৃষ্ণের ভাবমূর্তি সাধারণের মনে গভীরভাবে রেখাপাত করে।

সেই পুরোনো প্রসঙ্গটি আবার নতুন করে অবতারনা না করে উপায় নেই। বৃটিশ শাসনের সূচনা পর্বে বঙ্গদেশে সন্ন্যাসী এবং ফকিররা মিলেমিশে বৃটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন। কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্র দেখালেন সন্ন্যাসীরা একাই বৃটিশের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। সেখানে ফকিরদের মোটেই অংশগ্রহণ নেই। বঙ্কিম প্রকৃত ইতিহাস জানতেন না, তা ঠিক নয়।বঙ্কিমচন্দ্র জেনে শুনে ইতিহাসের এই বিকৃতি সাধন করেছেন। কারণ তিনি মনে করতেন, নিজে হিন্দুর জন্য আলাদা এক প্রস্থ ঐতিহাসিক যুক্তি নির্মাণ করেছেন। সেগুলো সবই অসার এবং ভিত্তিহীন। তিনি সন্ন্যাসীদের সঙ্গে বৃটিশ শাসকদের লড়াই থেকে একটি আদর্শ হিন্দু রাষ্ট্রের উথান ঘটাতে চেয়েছেন। আসলে সন্ন্যাসীদের লড়াইয়ে ফকিররাও ছিলেন। তিনি তাঁদের কথা বেমালুম চেপে গেছেন। তারপর শ্রীকষ্ণকে আধুনিক হিন্দুদের রাষ্ট্রগুরু হিসেবে দাঁড় করাতে গিয়েছেন। তা করতে যেয়ে কৃষ্ণচরিতকে একটা অলীক ভিতের ওপর দাঁড় করাতে হয়েছে। তারপর ভারতীয় হিন্দুর অতীত নির্দেশ করতে গিয়ে আর্য যুগের একটা সোনালী ছবি তুলে ধরেছেন। কিন্তু প্রাচীন ভারতের ব্রাক্ষ্মণ্য ধর্মাবলম্বী আর্যদের একচ্ছত্র প্রতিপত্তি সব সময়ে বর্তমান ছিলো না। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরাও একটা দীপ্ত ধারার সভ্যতা নির্মাণ করেছিলেন, বঙ্কিম নিজের দাঁড় করানো তত্বের প্রয়োজন ছাড়া বৌদ্ধদের কোনো প্রসঙ্গই উত্থাপন করেননি। বঙ্কিম আর্যত্ব এবং হিন্দুত্ব এই দু’টি শর্ত অনেক সময়ে এক করে দেখেন। বঙ্কিমের জন্মের শতো বছর পূর্বে আর্যাবর্তের জনসমাজের একটি বিরাট অংশ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন, তাঁরাও আর্য গৌরবের দাবিদার; সেই জিনিশটি বঙ্কিমের মনে একবারও উদয় হয়নি। রাজপুতদের আর্যত্বের গৌরব দান করে বঙ্কিম প্রমাণ করলেন, ইতিহাসের ওপর একটা কপোলকল্পিত ভ্রান্ত ধারণাই তিনি আরোপ করেছেন।

আমি এই নাতিক্ষুদ্র রচনায় বঙ্কিমচন্দ্রের ইতিহাস বিচারের ত্রুটিসমূহ একের পর এক শনাক্ত করতে চেষ্টা করেছি। হ্যাঁ, তবে একটা কথা আছে, এই ভ্রান্ত ইতিহাস বিচারের পদ্ধতি অনুসরণ করার দায় দায়িত্ব সবটা বঙ্কিমের ওপর আরোপ করাটা ঠিক হবে না। বৃটিশের ভেদনীতির একটা ভূমিকা অবশ্যই কবুল করে নিতে হবে। বঙ্কিমের যুগটির কথা একেবারে ভুলে গেলেও চলবে না। গোটা যুগের চেহারাটা আর্য গৌরবে মুখরিত এবং মুসলিম নিন্দায় ভরপুর। বঙ্কিম তাঁর নিজ প্রতিভা বলে যুগ চেতনাকে একটি নতুন ইতিহাস বিনির্মাণের ধারাক্রমের মধ্যে ফেলে দিয়েছিলেন। এটুকুই বঙ্কিমের ব্যক্তিগত বিনিয়োগ।

বঙ্কিমচন্দ্র যে সমস্ত ধারণাকে ঐতিহাসিক সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে মরীয়া হয়ে উঠেছিলেন তার জন্য হিন্দু সমাজ তাঁকে ঋষির আসনে বসিয়েছিলো। অতীতের কুয়াশা কুহেলির আড়াল ঠেলে সে প্রতীতিসমূহ নতুন করে বিচার করলে মনে হয়, সেগুলো মরা জন্তু জানোয়ারের কঙ্কাল, সময়ের উষর মরুর এক নিভৃত প্রান্তে মানব অহমিকার নিদর্শন হয়ে পড়ে আছে। তার মধ্যে প্রাণ ও জীবনধারার কোনো সংযোগ নেই। তথাপি এটা কি জ্বলন্ত বাস্তবতা নয় যে বঙ্কিমের হিন্দু রাষ্ট্রের স্বপ্ন উত্তর পশ্চিম ভারতে হানা দিয়ে আতঙ্ক এবং অন্ধত্ব বিস্তার করে যাচ্ছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *