দশ
আমি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ওপর এই নাতিদীর্ঘ রচনাটি লেখা যখন প্রায় শেষ করে এনেছি, সেই সময়ে ভেতর থেকে তাগাদা অনুভব করতে থাকি, একই রচনায় আমাকে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে কিছু কথা বলতে হবে। দীর্ঘদিন ধরে রবীন্দ্র-সাহিত্য পঠনপাঠন এবং রবীন্দ্রনাথকে কেন্দ্র করে নানা সময়ে যে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে সেগুলো নিবিড়ভাবে অনুধাবন করে আমি অনেকটা স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলাম যে বাঙালি সমাজে রবীন্দ্রনাথের চাইতে বঙ্কিমের প্রভাব অধিকতরো গভীর এবং বাঙালি সামাজিক রাজনৈতিক জীবনে বঙ্কিমের অধিকতররা প্রভাব রাখতে পেরেছেন। অদ্যাবধি সেই ধারণার বিশেষ পরিবর্তন হয়নি। কিন্তু তারপরেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলার সাহিত্য সংস্কৃতির বিকাশে যে একটা মঙ্গলকর ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছেন সেই জিনিশটিরও সামাজিক রাজনৈতিক প্রেক্ষিত থেকে সঠিকভাবে শনাক্ত হওয়া প্রয়োজন।
রবীন্দ্রনাথের নিজের দেয়া কৈফিয়ত দিয়েই শুরু করা যাক। তিনি বলেছিলেন, আমি যখন সাহিত্য রচনা করতে এসেছি বাংলা সাহিত্যে তখন রাজপুতনার যুগ চলছে। ওপরের বাক্যের বক্তব্যটা রবীন্দ্রনাথের, ভাষাটা আমার। রবীন্দ্রসাহিত্য পাঠকের অজানা থাকার কথা নয়। টডের রাজস্থান গ্রন্থ থেকে কাহিনী আহরণ করে তাঁর বড়ো বোন স্বর্ণকুমারী দেবী অনেকগুলো উপন্যাস রচনা করেছেন বর্ণকুমারী দেবীর সঙ্গে। রবীন্দ্রনাথের মতামতের অনেক অমিলের সংবাদও অনেকে জানেন। এই মতানৈক্যের মূল কারণ আদর্শগত। টডের রাজস্থান গ্রন্থ থেকে কাহিনী চয়ন করে উপন্যাস, আখ্যায়িকা, নাটক এবং কাব্য রচনার ধুম পড়ে গিয়েছিলো উনবিংশ শতাব্দীতে। বিংশ শতাব্দীতে এসেও তার ঢেউ থামেনি। স্বর্ণকুমারী দেবী, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ ঠাকুর বাড়ির প্রতিভাবান পুত্র-কন্যারাও রাজস্থানে আর্য গৌরব আবিস্কারে বিরত ছিলেন না। আর্য গৌরব মানে হিন্দু গৌরব। রবীন্দ্রনাথের ভাগিনেয়ী সরলা দেবী চৌধুরানী বাংলার ইতিহাসে হিন্দু মহিমা সন্ধান করতে গিয়ে প্রতাপাদিত্যের সাক্ষাত পয়েছিলেন। বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতীক হিসেবে প্রতাপাদিত্যের ভাবমূর্তি উজ্জ্বলভাবে তুলে ধরার জন্য প্রতাপাদিত্য উৎসব চালু করেছিলন। রবীন্দ্রনাথ প্রতাপাদিত্য উৎসবের বিরোধিতা করেছিলেন। প্রতাপাদিত্য যে আসলে একজন স্বৈরাচারী রক্তপিপাসু শাসক সে সব বিষয় বাখান করে প্রতাপাদিত্যের জীবনী অবলম্বনে বৌঠাকুরানীর হাট উপন্যাসটি রচনা করেছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মও উনবিংশ শতাব্দীতে। উনবিংশ শতাব্দীতে যে নানামুখী জাগরণের সূত্রপাত ঘটে, ঠাকুর পরিবার তার সঙ্গে পুরোপুরি জড়িত হয়ে পড়েছিলেন। রামমোহন রায়ের নেতৃত্বে যে ধর্ম এবং সমাজ সংস্কার আন্দোলন জন্ম নিয়েছিলো ঠাকুর পরিবার তাতে একটি প্রণিধানযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে। রামমোহনের অবর্তমানে রবীন্দ্রনাথের পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর কাণ্ডারি হিসেবে ব্রাহ্ম সমাজের হাল ধরেছিলেন। ব্রাহ্ম ধর্মের আবির্ভাব এবং ব্রাহ্ম সমাজের উথান তো উনবিংশ শতাব্দীর হিন্দু জাগরণের ফসল। একটা সময়ে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি ব্রাহ্ম সমাজ এবং ব্রাহ্ম ধর্ম আন্দোলনের কেন্দ্র বিন্দু হয়ে দাঁড়িয়েছিলো।
অতীত ভারতের মহিমা পুনরুদ্ধার করে নতুন ভারত নির্মাণের প্রাথমিক প্রয়াস ঠাকুরবাড়ি থেকেই স্কুরিত হয়েছিলো। রাজনারায়ণ বসুর পুনর্জাগরণমূলক রচনা বৃদ্ধ হিন্দুর আশা প্রথম ঠাকুর বাড়ির উৎসাহেই লিখিত হয়েছিলো। ঠাকুরবাড়ির লোকদের উৎসাহ উদ্দীপনা এবং আর্থিক সহায়তায় হিন্দুমেলার আয়োজন সম্ভব হয়েছিলো। ভারতের জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার পূর্ব পর্যন্ত হিন্দু মেলাকেই ধরা হয় ভারতীয়দের উদ্যোগে সংঘঠিত একটা রাজনৈতিক সামাজিক সঙ্কট সম্ভাবনা বিচারের সার্বজনীন মঞ্চ। এই হিন্দু মেলাতে কবিতা পাঠ করে রবীন্দ্রনাথ সর্বপ্রথম জনসমক্ষে কবি পরিচয় প্রকাশ করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের বড় ভাই সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর মিলি সব, ভারত সন্তান, গাও গান ভারতের যশোগাথা; এই গানটি রচনা করেছিলেন। সে একটা সময় যখন ভারতের জনগোষ্ঠীর জাগরণ বলতে হিন্দু জনগোষ্ঠীরই জাগরণ বোঝাতো। এই হিন্দু জাগরণের প্রাথমিক উত্তাপের আঁচ যে রবীন্দ্রনাথের গায়েও লাগেনি সে কথা ঠিক নয়।
রবীন্দ্রনাথ ছিলেন ব্রাহ্ম ধর্মের অনুসারী। তাঁর বাবা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রাহ্ম সমাজের আচার্যের ভূমিকা পালন করেছেন এবং রবীন্দ্রনাথও স্বল্প সময়ের জন্য ব্রাহ্ম সমাজের আচার্য ছিলেন। যদিও ব্রাহ্ম সমাজের পক্ষে হিন্দু সমাজের সম্পর্ক পুরোপুরি ছিন্ন করা সম্ভব হয়নি, তথাপি হিন্দু সমাজ এবং ব্রাহ্ম সমাজের মধ্যে একটা সামাজিক সংঘাত আসন্ন হয়ে উঠেছিলো। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় স্বীকার করতেন, ব্রাহ্ম সমাজের লোকদের অবদানে বাংলা ভাষা এবং সাহিত্য সমৃদ্ধ হয়েছে। রুচি সংস্কৃতির বিকাশে ব্রাহ্ম সমাজ যে একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে তা বঙ্কিমের সপ্রশংস অনুমোদন লাভ করেছে। তরুণ রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য কর্মের প্রতি বঙ্কিমের ছিলো অনুরাগ এবং প্রশ্রয়। আর রবীন্দ্রনাথও বঙ্কিম প্রতিভার বিরাটত্ব এবং মহত্বের প্রতি পুরোপুরি শ্রদ্ধা পোষণ করতেন। তারপরেও কিন্তু বঙ্কিমের সঙ্গে হিন্দু ব্রাহ্ম সমাজ আদর্শের শ্রেষ্ঠত্বের প্রশ্নে। প্রায় অপ্রীতিকর বিতর্কে প্রবৃত্ত হতে কুণ্ঠিত হননি। বঙ্কিম প্রচারিত হিন্দু আদর্শটি থেকে রবীন্দ্রনাথ কতোদূরে সরে এসেছিলেন, সে বিষয়ে একটা ধারণা দেয়ার জন্য পেছনের কথাগুলো বলা হলো। একেশ্বরবাদী ব্রাহ্ম এবং কবি চিত্তের মুক্ততা এ দুটোর মধ্যে কোনটা তাঁকে হিন্দুত্বের মুগ্ধতা থেকে বাইরে টেনে নিয়ে এসছিলো বলা মুশকিল। খুব সম্ভব কবিচিত্তের মুক্ততাই এজন্য দায়ী। তাঁর আপন ভাই বোন এবং পরিবারের মানুষেরা আর্য তেজের উত্তাপে যখন ফুলকো লুচির মতো ফুলে ফুলে উঠছেন, সেই সময়েও দেখা যাবে রবীন্দ্রনাথ সবল কাণ্ডজ্ঞানের ওপর ভরসা করে পারিবারিক সংস্কারের বলয় ভেদ করে জোরের সঙ্গে পথ কেটে বেড়িয়ে আসছেন। বৃটিশ উপনিবেশিক শাসনের প্রভাবে সৃষ্ট সাস্কৃতিক সামাজিক বৃত্তটির মধ্যে রবীন্দ্রনাথ কখনো স্বেচ্ছায় ধরা দেননি। বরাবরই বাইরে থাকার চেষ্টা করেছেন। তাঁর অপরিসীম সৃষ্টিশক্তি এবং কল্পনাবৃত্তির শুদ্ধতা বার বার তাঁকে একটি মানবিক আদর্শ সন্ধান করে নিতে উদ্বুদ্ধ করেছে। প্রাচীন ভারত সম্পর্কে একটা মুগ্ধ বিষ্ময়বোধ রবীন্দ্রনাথের সব সময়েই ছিলো, কিন্তু কোনো প্রাচীন আঁটোসাঁটো ধর্মীয় আদর্শের মধ্যে আত্মসমর্পন। করার কথা রবীন্দ্রনাথ একবারও চিন্তা করেছেন কিনা সন্দেহ। রবীন্দ্রনাথ উপনিষদের ওপর অনেক বেশি আস্থা স্থাপন করেছিলেন, কারণ উপনিষদের মধ্যে ডগমা বা বদ্ধচিত্ততার কোনো স্থান নেই। উপনিষদের বাণী চিত্তকে সঙ্কীর্ণ, বুদ্ধিকে আড়ষ্ট করে না, বরং মানুষের সত্য অনুসন্ধানের প্রবৃত্তি তীক্ষ্ম করে। ভারতের অতীত ইতিহাস সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের একটা সহজাত অন্তর্দৃষ্টি ছিলো। অন্তদৃষ্টি মাত্র অধিক কিছু নয়। ভারতের ইতিহাস সম্পর্কিত যে সকল মতামত তিনি প্রকাশ করেছেন, একজন ঐতিহাসিক সেগুলো যথার্থ বলে মেনে নিতে রাজি হবেন না।
যা হোক, আমাদের আসল বিষয়টিতে ফিরে আসি। উপনিবেশিক শাসনের প্রভাবে হিন্দু সমাজ এবং মুসলমান সমাজের ব্যবধান দুস্তর পারাপারের আকার ধারণ করেছে। প্রবল সমাজের আদর্শ দুর্বল সমাজের আদর্শটিকে ফুটি টিপে ধরতে উদ্যত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ এই বিভেদাত্মক পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে এসে ভিন্ন রকম একটা মানবিক আদর্শ খাড়া করার জন্য প্রাণপণ প্রয়াস চালিয়ে গিয়েছেন। প্রাচীন ভারতের কথা যখনই এসেছে তিনি বার বার বুদ্ধদেবের কথা স্মরণ করেছেন। বৌদ্ধ কাহিনী অবলম্বন করে কবিতা, নাটক এবং গীতিনাটক রচনা করেছেন। মারমুখী হিন্দু সমাজ আদর্শের প্রতাপ থেকে আত্মরক্ষা করার জন্য সন্ত কবীর এবং বাউল দর্শন আঁকড়ে ধরে তাঁর ভিন্ন রকম আবস্থানটি নানাভাবে স্পষ্ট করতে চেষ্টা করেছেন। সমাজ সংস্কৃতির যে স্তরসমূহ উপনিবেশিক শাসনের নির্মম পীড়নে বিকলাঙ্গ আকার ধারণ করেনি, রবীন্দ্রনাথ বার বার সেই সমস্ত স্তর থেকে শক্তি সঞ্চয় করে একটি সমান্তরাল সামাজিক সাংস্কৃতিক পরিপ্রেক্ষিতের প্রতি আঙ্গুলি নির্দেশ করেছেন। ভারতীয় জনগণের বৃটিশ বিরোধী সংগ্রামে রবীন্দ্রনাথের ভূমিকা ছিলো অনেকটা প্রতীকী ধরনের। রাজনীতির প্রভাব এড়ানো তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি। কিন্তু দীর্ঘকাল রাজনীতির সঙ্গে লেগেও থাকতে পারেননি। তাঁকে সরে আসতে হয়েছে। তাঁর দৃষ্টি এবং অঙ্গীকার ছিলো সমাজের প্রতি। উপনিবেশিক শোষণের যাঁতাকলে পৃষ্ঠ হয়ে গ্রামীণ জনগোষ্ঠী দারিদ্র্যের ভারে প্রপীড়িত, অশিক্ষা, কুসংস্কারের অসহায় শিকার। কিন্তু তারা কোনো পর্যায়ে উপনিবেশিক সরকারের শোষণ প্রক্রিয়ার সহায়তা করেনি। ভারতের মধ্যশ্রেণীভুক্ত রাজনৈতিক নেতৃত্ব যা বৃটিশবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দান করেছিলো, তাঁদের উথান ঘটেছে উপনিবেশিক শাসনের পাটাতনে। উপনিবেশিক শাসকদের শোষণের ফলে সৃষ্ট সেই কেন্দ্রবিন্দু যা শক্তি সঞ্চয় করে বৃটিশ শাসনের বিরোধিতা করতে লেগেছে, সেখান থেকে অনেক দূরে গ্রামীণ কৃষক সমাজে তার কর্মকাণ্ড প্রসারিত করে উপনিবেশিক পাটাতনের একটি বিকল্প পাটাতন নির্মাণ করে দেশকে ভেতর থেকে জাগিয়ে তুলেছিলেন। খুব সম্ভবতো মহাত্মাগান্ধীর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের এইখানেই দৃষ্টিভঙ্গীগত বিরোধের সূচনা। মহাত্মা গান্ধীও গ্রামীণ সমাজের প্রতি অঙ্গীকারসম্পন্ন। ছিলেন। তিনি গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কাছে রবীন্দ্রনাথের চাইতে বহুগুণ গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ শেষ বয়সে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন। দুজনের দৃষ্টিভঙ্গীগত পার্থক্যটি অনেকটা এরকম।
মহাত্মা গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর সাহায্যে শহুরে মধ্যবিত্তদের রাজনৈতিক সংগ্রামটি জয়যুক্ত করতে চাইতেন। তিনি গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে মধ্যবিত্তের রাজনৈতিক সংগ্রামের কনিষ্ঠ শরিকে পরিণত করেছিলেন। তাঁর সাফল্য অভাবনীয়। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর ওপর মহাত্মার প্রভাব মন্ত্রশক্তির মতো কাজ করেছে। ভারতের বৃটিশ বিরোধী রাজনীতিতে মহাত্মা গান্ধীর ভাগ্যবিধাতা হয়ে ওঠার উৎস এইখানে। রবীন্দ্রনাথ রাজনৈতিক সংগ্রামের চাইতে গ্রাম সমাজকে নতুনভাবে গঠন করতে চাইতেন এবং একাজে শহরের মানুষকে টেনে আনতে প্রয়াসী ছিলেন। অসাধারণ দূরদৃষ্টি বলে তিনি অনুভব করেছিলেন, উপনিবেশিক প্রভাবদুষ্ট পাটাতনের বিকল্প একটি পাটাতন নির্মাণ করতে না পারলে স্বাধীনতা স্বরাজ ওগুলো একেকটা কাগুঁজে শব্দের অধিক কোনো তৎপর্য বহন করবে না।
গ্রাম সমাজ পুনর্গঠন, গ্রামীণ দারিদূরীকরণ, গ্রাম উন্নয়ন ইত্যাদি যে সকল শব্দ হরহামেশা শোনা যায় রবীন্দ্রনাথ কতো আগে সে সবের সূচনা করেছিলেন, চিন্তা করলে বিস্মিত না হয়ে উপায় থাকে না। যেহেতু রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রতিভার আলোকে উপনিবেশিক পাটাতনের বাইরে আরেকটি পাটাতনের সন্ধান পেয়ে গিয়েছিলেন, গ্রাম সমাজ পুনর্গঠন, গ্রামোন্নয়ন ওসব কাজ শুরু করতে তাঁকে খুব বেগ পেতে হয়নি। একটা মানসিক প্রস্তুতি তাঁর বরাবরই ছিলো। আর তাঁর সে সুযোগও ছিলো।
উপনিবেশিক পাটাতনের বাইরে আরেকটি মানসিক অবস্থান আবিষ্কার করতে পেরেছিলেন বলেই তাঁর সৃষ্টির পরিমাণ মতো বিপুল হয়ে উঠতে পেরেছিলো। তাঁর গ্রামোন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড, শান্তিনিকেতন আশ্রম তৈরি, বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠা এগুলো নিশ্চয়ই তাঁর বিশাল ব্যক্তিত্বের সম্প্রসারণ। বঙ্কিমের অভীষ্ট ছিলো একটি হিন্দু রাষ্ট্র সৃষ্টি করা। রবীন্দ্রনাথের উপনিবেশিক সমাজের বদলে একটি স্বদেশী সমাজ সৃষ্টি করাই ছিলো লক্ষ্য। যেহেতু রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিকর্ম বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনকে পাশ কাটিয়ে গেছে বাঙালি জনগণের রাজনৈতিক সংগ্রামের অগগ্রতিতে তাঁর ভূমিকা নিতান্তই সামান্য। যেটুকু তাও প্রতীকী। রাজনৈতিক বিকাশ প্রক্রিয়ার মধ্যে বঙ্কিমের যে অনপনেয় প্রভাব, রবীন্দ্রনাথ সরাসরি তার বিরোধিতা করেননি। অনুভূতির ক্ষেত্রে ভাষারীতির প্রবর্তনের। ক্ষেত্রে, রুচির পরিশুদ্ধতা সাধনের ক্ষেত্রে, বিশ্বমানবিকতার উদ্বোধনের ক্ষেত্রেই রবীন্দ্রনাথের বিচরণ। কোনো কোনো মহল থেকে রবীন্দ্রনাথকে বৃটিশের ধামাধরা হিসেবে চিহ্নিত করার প্রবণতা, বোধকরি এটিই তার কারণ।
রবীন্দ্রনাথের সমস্ত আয়ুষ্কালটা উপনিবেশিক শাসনামলের মধ্যদিয়েই অতিবাহিত হয়েছে। উপনিবেশিক চিন্তাচেতনা তাঁর সৃষ্টিকর্মে ছাপ ফেলেনি একথা সত্যি নয়। অনেকের বিচারে গোরা শুধু রবীন্দ্রনাথের সর্বশ্রেষ্ঠ উপন্যাস নয়, বাংলা সাহিত্যর শ্রেষ্ঠতম উপন্যাসসমূহের একটি। সমস্ত উপন্যাসটাই উপনিবেশিক পাটাতনের ওপর ভিত্তি করে রচিত। গোরা চরিত্রটিকে অনেকে ভারতবর্ষের জনসমাজের প্রতিনিধি বলে চিহ্নিত করেছেন। প্রশ্ন উঠবে গোরাকে যদি যথার্থই ভারতবর্ষের জনসমাজের প্রতিনিধি হিসেবে গণ্য করা হয়, রবীন্দ্রনাথ আইরিশ পরিবারে তাঁর জন্ম দিলেন কেননা? কোনো ভারতীয় পরিবারে গোরার জন্ম হলো না কেন? রক্ত মাংসের উপাদানে যিনি ভারতীয় নন, তিনি ভারতের জনগণের মুক্তির জন্য সর্ব পণ করে বসেন। পূর্বাপর চিন্তা করে। দেখলে ব্যাপারটা তেমন অস্বাভাবিক মনে হয় না। নিবিষ্ট পাঠকের মনে হবে সিস্টার নিবেদিতাকে পুরুষ চরিত্রে রূপান্তরিত রূপে গোরাকে সৃষ্টি করেছেন রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথ উপনিবেশিক পরিবেশেই মানুষ হয়েছেন। তাঁর জীবন এবং চিন্তা চেতনায় এক প্রান্ত উপনিবেশিক পাটাতনের মধ্যেই প্রোথিত। কিন্তু অন্য প্রান্ত একটা সমান্তরাল বিপরীত পাটাতনের সন্ধান করেছে।