০৩. বঙ্কিমচন্দ্র এক অদ্ভুতকর্মা পুরুষ

তিন

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ছিলেন একজন অদ্ভুতকর্মা পুরুষ, একথা বলার অপেক্ষা রাখে না। আধুনিক যুগের গোটা বাঙালি সমাজে এরকম ব্যক্তিত্ব দ্বিতীয়টি জন্মগ্রহণ করেনেনি। বঙ্কিমের প্রভাব বাঙালি রাজনৈতিক এবং সামাজিক ইতিহাসে এতোদূর প্রভাব বিস্তারী হতে পেরেছে, অন্য কোনো ব্যক্তির সঙ্গে তাঁর তুলনা চলতে পারে না। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠবে তাঁর চরিত্রের কোন্ বিশেষ গুণটির জন্য তিনি বাঙালির একমেবাদ্বিতীয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছিলেন।

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় মানুষ ছিলেন একজন, কিন্তু পরিচয় অনেকগুলো। কোনো পরিচয় হেলাফেলা করার মতো নয়। প্রায় সবটাই গুরুত্বপূর্ণ। যুগান্তকারী সাহিত্য স্রষ্টা, আধুনিক বাংলা উপন্যাস শিল্পের জনয়িতা বঙ্কিম, সত্যদ্রষ্টা যুগন্ধর পুরুষ ঋষি বঙ্কিম, অসাধারণ মনধীতাসম্পন্ন আধুনিক বিজ্ঞান চিন্তার অনুসারী বঙ্কিম, পুরাতাত্বিক বঙ্কিম: এই এক মানুষের ভেতর এতোগুলো বৈশিষ্ট্য একটা আরেকটার গায়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এই গুণগুলো তাঁকে তাঁর যুগের অন্যান্যদের চাইতে বিশিষ্ট এবং আলাদা করেছে; একথা সত্য বটে। কিন্তু সেগুলো তার বাঙালি সমাজে অমোঘ ভাগ্যবিধাতায় পরিণত হওয়ার কারণ বলে মান্য করা যায় না।

আধুনিক বাংলার ইতিহাসে উনবিংশ শতাব্দী এক আশ্চর্য সময়। উনবিংশ শতাব্দীতে বাঙালি হিন্দু সমাজে যে বহুমুখী জাগরণের সূত্রপাত হয় সেটাকে রেসেসাঁ না বললেও গুরুত্ব কোনো মতেই খাটো করে দেখা যাবে না। শিল্প, সাহিত্য, ধর্মতত্ব বিজ্ঞান এবং সংস্কৃতি বিষয়ক যে সকল জিগগাসা উনবিংশ শতাব্দীর মন মানসে আলোড়নের সঞ্চার করেছিলো সেগুলোই বাঙালি সমাজকে আবেগ এবং গতি দান করে সমাজের চালিকা শক্তিতে পরিণত হয়েছিলো। উনবিংশ শতাব্দীর পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী সময়ের মধ্যখানে একটি বিভাজন রেখা অবশ্যই স্থির করে নিতে হবে। পূর্ববর্তী শতাব্দীগুলোতে বাঙালি সমাজ যে বিশেষ ধারাটি অনুসরণ করে বিকশিত হয়ে আসছিলো, উনবিংশ শতাব্দীতে এসে দেখা গেলো সেটি একটি নতুন খাতে বইতে আরম্ভ করেছে। এই নতুন ধারাটিকে অনেক অনেক সমাজ বিজ্ঞানী বেঙ্গল রেনেসাঁ হিসেবে চিহ্নিত করার প্রয়াস পেয়ে আসছিলেন, যদিও পরবর্তীকালের পণ্ডিতদের বেশিরভাগ সেটাকে একটা অতিকথার অধিক গুরুত্ব দিতে রাজি নন।

উনবিংশ শতাব্দীর সন্তান রামমোহন একটি নতুন ধরনের একটি ধর্মমত প্রচার করতে আরম্ভ করেছিলেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয় আধুনিক বাংলা গদ্যের জন্য সম্ভাবিত করে নিষ্ক্রিয় থাকেননি, সমাজ সংস্কারের ভূমিকায়ও তিনি অবতীর্ণ হয়েছিলেন। মাইকেল মধুসূদন দত্ত নতুন সাহিত্য চিন্তায় তাড়িত হয়ে ইউরোপে মহাকাব্য লেখার যুগ অবসিত হওয়ার পরও বাংলা ভাষায় মহাকাব্য রচনা করতে প্রয়াসী হয়ে উঠলেন। অক্ষয় দত্ত এবং তাঁর মতো আরো কিছু নিবেদিত প্রাণ মানুষ বিজ্ঞান ভাবনায় ভাবিত হয়ে জীবন এবং জগতের নানান জিগগাসাকে নতুনভাবে ঝালাই করে নিচ্ছিলেন। উনবিংশ শতাব্দীতে সর্বতোমুখী পরিবর্তনের ঝোড়ো হাওয়া প্রবল বেগে বইতে আরম্ভ করেছিলো, যা ছিলো সমাজের একটি সীমিত অংশের সর্বব্যাপ্ত লক্ষণ। নতুন এবং পুরাতনের মধ্যবর্তী দ্বন্দ্বের তীব্রতা এতোদূর বৃদ্ধি পেয়েছিলো যে সমাজের একেবারে রক্ষণশীল অংশও নিছক আত্মরক্ষার প্রয়োজনে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে নিশ্চুপ বসে থাকতে পারেননি। এই রক্ষণশীল অংশ একজন রাজা রাধাকান্ত দেবকে শুধু সমাজপতির আসনে প্রতিষ্ঠিত করেনি; এই ধারাটি পরমপুরুষ রামকৃষ্ণদের মতো একজন উজ্জ্বল চরিত্রের সাধকের জন্মও সম্ভাবিত করে তুলেছে।

প্লেখানত প্রতিভার সংজ্ঞা নির্ণয় করতে গিয়ে বলেছেন, মানুষের অন্তর্নিহিত শক্তির সামাজীকিকরণের ক্ষমতাই হলো প্রতিভা। প্রতিভা বলতে যে অলোকসামান্যতার ধারণা আমাদের মনে উদয় হয়, সেই সংজ্ঞায় তার হয়তো সবটুকু স্থান করে নিতে পারেনি, তবু এটাকে প্রতিভার একটা গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা হিসাবে মান্য করতে আপত্তি থাকার কথা নয়। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় উনিশ শতকী বাঙালি সমাজের জাগ্রত জিগগাসাসমূহের অনেকগুলোই ধারণ করেছিলেন। সেসকল গুণ ও বৈশিষ্ট্য উনবিংশ শতাব্দীর সন্তানদের অমরতার বসনে আবৃত করেছিলো, বঙ্কিম সেরকম গুণ ও বৈশিষ্ট্যের অধীকারী হয়ে উঠতে পেরেছিলেন।

তাঁর মধ্যে রাজা রামমোহন রায়ের কিছু ছিলো, বিদ্যাসাগরেরও কিছু ছিলো। রাজা রামমোহন রায়ের মতো সমাজে তিনিও একটা নায়কসুলভ আসন অধিকার করেছিলেন। বিদ্যাসাগরের বাংলা ভাষা চর্চার যোগ্য উত্তরসুরীর ভূমিকা তিনি পালন করেছিলেন। মাইকেল মধুসূদন দত্ত যে নতুন সাহিত্য চিন্তার উন্মেষ ঘটিয়েছিলেন, বঙ্কিম তাতে অনেকখানি অগ্রসরমানতা দিতে পেরেছিলেন। অক্ষয় দত্ত প্রমুখ বিজ্ঞান কর্মীদের মনে যে বিজ্ঞান চিন্তা ঝিলিক দিচ্ছিলো, সে বস্তু জিগগাসাও অল্প অল্প পরিমাণে বঙ্কিমের অভিনিবেশের বিষয়বস্তু হয়ে উঠতে পেরেছিলো। পরমপুরুষ রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের সাধক সুলভ তন্ময়তা, তাঁর মানসপরিমণ্ডলে একটা কুহেলিকা এঁকে দিয়েছিলো। কিন্তু বঙ্কিমকে যে জিনিশটি উনবিংশ শতাব্দীর অন্যবিধ মনীষীদের চাইতে আলাদা এবং স্বতন্ত্র করে বাংলা তথা আধুনিক ভারতের রাষ্ট্রগুরু হিসেবে ইতিহাসের পাদপীঠে স্থাপন করেছে, সেটি হলো বঙ্কিমের রাষ্ট্রচিন্তা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *