০৪. রাষ্ট্র : সর্বাধিক গুরুত্বসম্পন্ন বিষয়

চার

মানুষের যাবতীয় সৃষ্টিকর্মের মধ্যে রাষ্ট্রই হলো সর্বাধিক গুরুত্বসম্পন্ন বিষয়। রাষ্ট্রের অস্তিত্ব ব্যতিরেকে অন্যবিধ মানবিক গুণাবলীর উৎকর্ষের কথা চিন্তাও করা যায় না। গ্রীক দার্শনিক এরিস্টোটলের মতে মানুষ স্বভাবগতভাবেই সামাজিক জীব। এখানে গ্রীক পণ্ডিত সমাজকে রাষ্ট্র অর্থে প্রয়োগ করেছেন। তিনি বলেছেন যে মানুষ রাষ্ট্রে বাস করবে না, সে হয়তো অমানুষ, নয়তো অতি মানুষ। আরব দার্শনিক ইবনে খলদুন রাষ্ট্রকে অপ্রয়োজনের প্রয়োজনীয় বস্তু বলে অভিহিত করেছেন। দার্শনিক হেগেল মন্তব্য করেছেন, জনসমাজ যখন রাষ্ট্রীয় সমাজে রূপান্তরিত হয়, তখনই সে সাবালকত্ব অর্জন করে এবং বিশ্ব সমাজের অংশ হয়ে দাঁড়ায়।

বাঙালি হিন্দু সমাজের অগ্রসর অংশ ইউরোপীয় চিন্তার সংস্পর্শে এসে অনেক নতুন ভাবধারা, অনেক নতুন সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক উপলব্ধি আয়ত্ব করতে শিখেছিলো। এই নতুন ভাবনা চিন্তার অভিঘাতে তৎকালীন সমাজ শরীরে একটি সংঘাতও আসন্ন। হয়ে উঠেছিলো, একথা সত্যি বটে। কিন্তু রাষ্ট্র যে সমাজের সার্বজনীন কল্যাণের নিয়ন্তা সে জিনিশটি উনবিংশ শতাব্দীর কোনো কৃতবিদ্য ব্যক্তির মানস ফুড়ে জন্মাতে পারেনি। একমাত্র বঙ্কিমচন্দ্ৰই ছিলেন ব্যতিক্রম। আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার জনয়িতা হিসেবে বঙ্কিমের যে পরিচয়, সেই জিনিশটি অনেক দিন পর্যন্ত তাঁর অন্যবিধ কীর্তির বলয় ভেদ করে আসল স্বরূপে শনাক্ত হতে পারেনি।

বঙ্কিম অনেক কিছুই ছিলেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তিনি যে কর্ম হাতে তুলে নিয়েছেন তাতেই সফলতার স্বাক্ষর রেখেছেন। অনেক সময় এমন ঘটেছে তাঁর সাহিত্য সম্রাট পরিচয়ের অন্তরালে অন্যবিধ প্রণিধানযোগ্য বৈশিষ্ট্যসমূহ ঢাকা পড়ে গেছে। বাঙালি সমাজে বঙ্কিম মুখ্যতঃ সাহিত্য স্রষ্টা হিসেবেই সমধিক পরিচিত। এটা আক্ষরিক অর্থে সত্য এবং এতে দ্বিমতের কোনো অবকাশ নেই। কিন্তু কথা হলো, সাহিত্য স্রষ্টার পরিচয়টি প্রধান বলে কবুল করে নিলে, বঙ্কিম যে কারণে বাঙালি সমাজে সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করেছেন তার কোনো সদুত্তর পাওয়া যাবে না। এখানেই একটি প্রশ্ন অবশ্যই পরিষ্কার করে নিতে হবে। বঙ্কিম তাঁর রচিত সাহিত্যের মধ্যে দিয়েই রাষ্ট্র চিন্তার বীজটি চারিয়ে তুলেছিলেন। সাহিত্যের মাধ্যমে রাজনৈতিক ধারণার প্রকাশ ঘটানো বাংলা সাহিত্যের নিরিখে এটা একটা অভিনব কৌশল। কিন্তু ইউরোপে এই কৌশল বহু পূর্বে থেকেই অনুসৃত হয়ে আসছে। ভেলতেয়ার, রুশো, দিদেরোসহ ফরাসী এনসাইক্লোপিডিক আন্দোলনের তুখোর বুদ্ধিজীবীরা এই পদ্ধতি উদ্দেশ্য সাধনের উপায় হিসেবে প্রয়োগ করে আসছিলেন। বঙ্কিম বাংলা সাহিত্যে সেই টেকনিকটি নতুন করে প্রবর্তন করেছিলেন।

বঙ্কিম আধুনিক বাংলা উপন্যাস সাহিত্যের প্রথম সার্থক স্থপতি। বঙ্কিমের মতো বাকসিদ্ধ এবং বাকসংযম লেখক বাংলা সাহিত্যে আর জন্মগ্রহণ করেননি। তাঁর ব্যক্তিত্ববোধ এতো প্রবল ছিলো যে একটি মাত্র ভুকুটি দিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে মতের একটি জনসভা স্তব্ধ করে দিতে পারতেন। যে বিমূর্ত ভাবনা বঙ্কিম একটি বাক্যে প্রকাশ করতে সক্ষম ছিলেন, রবীন্দ্রনাথের মতো অমন সূক্ষ্মদর্শী মানুষের পক্ষেও ওই একই ভাবনা প্রকাশ করার জন্যে অনধিক এক পৃষ্ঠা ব্যয় করতে হতো। এ হলো বিষয়ের ওপর বঙ্কিমের যে অধিকার তথা অথরিটি তার প্রমাণ। তথাপি একথা সত্যি যে এই দেবদুর্লভ আশ্চর্য শিল্পপ্রতিভা বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে বাঙালি সমাজের বিধাতা পুরুষে রূপান্তরিত করেনি। যতোই ক্ষমতাসম্পন্ন হোন না কেনো, শুধুমাত্র লেখক পরিচয়ের ওপর যদি বঙ্কিমের প্রতিষ্ঠা হতো, তাঁকেও অন্য দশজন ক্ষণজন্মা লেখকের ভাগ্য বরণ করে নিতে হতো। একজন লেখক কিংবা কবি তাঁর সমাজে এবং সময়ে যে প্রভাবই বিস্তার করুন না কেননা, পরবর্তী প্রজন্মসমূহ সাহিত্যের ইতিহাসের অংশ। হিসেবেই তাঁর বিচার এবং মূল্যায়ন করতো। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় একজন ক্ষমতাবান লেখকের চাইতে অধিক কিছু ছিলেন এবং সেই বিষয়টিই বর্তমান পর্যালোচনার কেন্দ্রবিন্দু।

বঙ্কিম ছিলেন আধুনিক বাংলা তথা ভারতের সর্বপ্রথম রাষ্ট্রবেত্তা। তিনিই সর্বপ্রথম একটি হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছিলেন। বঙ্কিম ধর্ম চিন্তা, সংস্কৃতিচিন্তা, ইতিহাসচিন্তা, বিজ্ঞানচিন্তা এবং সাহিত্যচিন্তা সব ধরনের চিন্তাপ্রবাহের গতিমুখ রাষ্ট্র চিন্তার মূল বিন্দুকে ঘিরে বিকশিত করেছেন। রাষ্ট্রচিন্তাই তাঁর মুখ্য মনোযোগর বিষয়। অন্যবিধ চিন্তাসমূহকে রাষ্ট্র চিন্তার সহায়ক চিন্তা হিসেবে তিনি দাঁড় করিয়েছেন। তাঁর ছিলো একমুখী মন। যাই লিখুন না কেনো একটি হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন তাঁর মনে কম্পাসের কাঁটার মতো হেলে থাকতো। তিনি তাঁর সমস্ত কল্পনাশক্তিকে একটি হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কামানের গোলার মতো ছুঁড়ে দিয়েছিলেন।

বঙ্কিমের সাহিত্য এবং অন্যবিধ সৃষ্টিকর্মের মধ্যে থেকে তাঁর রাষ্ট্রচিন্তাকে আলাদাভাবে বিশ্লিষ্ট করা হলে বঙ্কিম মনীষার আসল স্বরূপটি জানা যেমন সহজ হবে, তেমনি তাঁর স্ববিরোধিতাসমূহও খুব সহজে শনাক্ত করা যাবে। বাঙালি সমাজে বঙ্কিমচন্দ্রের প্রভাব সর্বাধিক ক্রিয়াশীল হতে পেরেছে, তার মুখ্য কারণ বঙ্কিম রচিত সাহিত্য গ্রন্থের অনন্যতা নয়, বঙ্কিমের রাষ্ট্রচিন্তা। মনে রাখতে হবে বঙ্কিমের মৃত্যুর প্রায় সক্র বছর পরে তাঁর রচিত ‘সুজলং সুফলং মলয়জ শীতলং বন্দে মাতরম’ গানটি ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের দলীয় সঙ্গীত হিসেবে গৃহীত হওয়ার গৌরব অর্জন করেছিলো। এই গানটি বঙ্কিম স্বতন্ত্রভাবে আনন্দমঠ লেখার বছর তিনেক আগে রচনা করেছিলেন এবং পরে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় আনন্দমঠ পুস্তকের সঙ্গে জুড়ে দিয়েছিলেন। বাংলা তথা ভারতের বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের উন্মেষপর্বে বঙ্কিমের চিন্তা এমন একটা গভীর মর্মবেগ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিলো, অনুশীলন এবং যুগান্তর দুটি সন্ত্রাসপন্থী রাজনৈতিক সংগঠনের নেতা এবং কর্মীরা বঙ্কিমকে তাঁদের গুরু এবং আনন্দমঠ গ্রন্থটিকে প্রেরণাপুস্তক হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। বিদ্যা, বুদ্ধি এবং সংস্কৃতি চেতনার দিক দিয়ে তুলনামূলকভাবে অগ্রসর হিন্দু সমাজের স্বাধীনতা প্রয়াসী তরুণ বিপ্লবীরা হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে মরণপণ করে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। এই জিনিশটি বাংলা তথা ভারতের রাজনৈতিক বিকাশ প্রক্রিয়ার মধ্যে এমন একটি বিদারণ রেখা এমনভাবে বিধিয়ে দিতে পেরেছিলো যা আখেরে বাংলা তথা ভারতের খণ্ডিতকরণের বেলায় একটা নির্ণায়ক ভূমিকা পালন করেছে। বাংলাদেশ বিভাগ করার জন্য কোনো একজন ব্যক্তিকে দায়ী করতে হয়, তিনি অবশ্যই বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। অনেকে আপত্তি উত্থাপন করে বলতে পারেন, বাংলা এবং ভারত বিভাজনের মাল মসলাসমূহ এই দেশীয় সমাজ কাঠামোর অভ্যন্তরে আত্মগোপন করে অনুকূল পরিস্থিতির প্রতীক্ষা করেছিলো। ইতিহাসের চোরাগোপ্তা স্রোতসমূহ বঙ্কিম মানসের ওপর চাপ সৃষ্টি করে, তাঁকে দিয়ে ইতিহাসের ধাত্রীর ভূমিকা পালন করিয়ে নিয়েছিলো। বঙ্কিম ইতিহাসের যন্ত্রের কাজটিই করেছিলেন।

বঙ্কিম সম্পর্কিত এই রচনাটিতে সেই সুবিস্তৃত প্রেক্ষাপট স্পর্শ করার অবকাশ নেই এবং আমার বঙ্কিম সম্পর্কিত মতামত বয়ান করার জন্য তাঁর প্রয়োজন আছে, তাও মনে করিনে। আমি এই রচনাটিতে যে সিদ্ধান্তের দিকে অগ্রসর হচ্ছি তার সমর্থনে একটি মাত্র দৃষ্টান্ত সকলের সামনে তুলে ধরবো। সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীরা যে আবেগ এবং অনুরাগ সহকারে আনন্দমঠের ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে দেবতার আসনে বসিয়ে পুজো করতেন, এই দ্বুইয়ের দশকেও দেখা যাচ্ছে উত্তর ভারতে হিন্দু মৌলবাদীরা। একই আবেগ অনুরাগ নিয়ে বঙ্কিমকে শ্রদ্ধা নিবেদন করছেন। মাত্র তিনবার বছর আগে প্রয়াত সাংবাদিক গিরিলাল জৈনের সংবাদপত্রে প্রকাশিত ছড়ানো ছিটানো রচনাগুলো গ্রথিত করে একটি গ্রন্থে প্রকাশ করা হয়েছে। এই গ্রন্থটির নাম দ্যা হিন্দু ফিনোমেনন (The Hindu Phenomenon) উগ্র মৌলবাদী হিন্দুদের কাছে এই পুস্তকটি কি রকম জনপ্রিয়তা লাভ করেছে, এক বছরের মধ্যে চারটে সংস্করণের। নিঃশেষিত হওয়ার মধ্যেই তার প্রমাণ মেলে। উত্তর ভারতে হিন্দু মৌলবাদীদের কাছে গিরিলাল জৈনের এই গ্রন্থটি অনেকটা ধর্ম গ্রন্থের মর্যাদা লাভ করেছে। এই গ্রন্থে প্রকাশিত নানা রচনার মধ্য দিয়ে প্রয়াত লেখক একটি বিশেষ মতামতকে মূর্ত করতে চেষ্টা করেছেন। ভারতে বৃটিশ শাসন প্রবর্তিত হওয়ার পর থেকেই ভারতের আত্মবিস্মৃত হিন্দুরা হিন্দুসত্তা তথা ভারতীয় সত্তা ফিরে পেতে আরম্ভ করে। বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠে তার সূচনা এবং বাবরী মসজিদ ধ্বংসের মাধ্যমে হিন্দুসত্তা চূড়ান্ত সার্থকতার সাথে। বিরাট একটা প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করতে পেরেছে। একটি হিন্দু রাষ্ট্রের স্বপ্ন নির্মাণ করে ভারতীয় হিন্দুদের যথার্থ পথ প্রদর্শকের ভূমিকা পালন করেছেন বঙ্কিম। দেখা যাচ্ছে, আজকের ভারতবর্ষেও বঙ্কিমের রাষ্ট্রচিন্তা অসম্ভব রকম জীবন্ত। ঘোষিতভাবে ধর্মনিরপেক্ষ ভারত রাষ্ট্রের কর্ণধারদের পক্ষেও বঙ্কিমের চিন্তাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এই রচনার মধ্যবর্তী অংশে বঙ্কিমের সাহিত্যভাবনার সঙ্গে ভাবনা কিভাবে ওতপ্রোতভাবে মিশে গিয়েছে, সে ব্যাপারটি বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করবো। আমার ধারণা এই অনুসন্ধানের ভেতর থেকেই মুসলমান সমাজের একটা বিরাট অংশের মধ্যে যে একটা অন্ধ বঙ্কিম বিদ্বেষ রয়েছে এবং বঙ্কিম রচিত সাহিত্যের প্রতি তারা নানা সময়ে যে অশোভন এবং অসহিষ্ণুতা প্রদর্শন করেছেন, তার একটি মনস্তাত্বিক ব্যাখ্যা দাঁড় করানো যাবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *