০৯. স্বচ্ছ জীবনদৃষ্টিসম্পন্ন

নয়

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় উনবিংশ শতাব্দীর কৃতবিদ্য ব্যক্তিদের চাইতে বিদ্যাবুদ্ধিতে কতো দূর অগ্রসর ছিলেন, কি রকম স্বচ্ছ জীবনদৃষ্টিসম্পন্ন ছিলেন, চিন্তা করলে বিস্মিত হওয়ার উপায় থাকে না। বাঙ্গালার কৃষক রচনাটি তিনিই লিখেছিলেন। বাংলার কৃষক সমাজের দুর্দশার কথা তাঁর মতো এমন আবেগ অনুভূতি নিয়ে তাঁর সময়ে কিংবা তাঁর মৃত্যুর পরেও কোনো বাঙালি লেখক লিখতে প্রয়াসী হননি। প্রমথ চৌধুরীর লেখা রায়তের কথার সঙ্গে বঙ্কিমের রচনাটির কিছুটা মিল হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে। কিন্তু তা অনেক পরের ঘটনা। তারপরেও বস্কিমের রচনাটির ছত্রে ছত্রে যে অঙ্গীকার প্রকাশ পেয়েছে তুলনা করলে প্রথম চৌধুরীর রচনাটিকে মনে হবে বয়ানধর্মী। বঙ্কিম গ্রামীণ অর্থনীতির অন্ধিসন্ধি সম্পর্ক যেভাবে ওয়াকেবহাল ছিলেন, প্রমথ চৌধুরীর সে রকম পারঙ্গমতা ছিলো বলে মনে হয় না।

বঙ্কিম যে সময়ে সাম্য রচনাটি লিখেছিলেন এই একই বিষয়ে এই রকম আরেকটি রচনা লেখার মতো যোগ্য ব্যক্তি তামাম ভারতবর্ষে সন্ধান করলে একজনও পাওয়া যেতো কিনা সন্দেহ। তৎকালীন ইউরোপেও সাম্যবাদী চিন্তা বিশেষ বিস্তার লাভ করেনি। বঙ্কিম ইউরোপীয় রাষ্ট্রচিন্তা এবং সমাজচিন্তার সঙ্গে কতোদূর ঘনিষ্টভাবে পরিচিত ছিলেন, এই রচনাটি থেকেই তার প্রমাণ পাওয়া যাবে। বঙ্কিম পরবর্তী যে সকল ব্যক্তি সাহিত্য এবং সমাজচিন্তার ক্ষেত্রে নায়কতার ভূমিকা পালন করেছিলেন, তাঁদের কারো মধ্যেই বঙ্কিমের অনুসন্ধিৎসা এবং দুঃসাহসের চিহ্নমাত্রও খুঁজে পাওয়া যাবে না।

আধুনিক বিজ্ঞান বলতে কি বোঝায় সে সম্পর্কে বঙ্কিমের বিশদ ধারণা ছিলো। বিজ্ঞান রহস্য গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত প্রবন্ধসমূহে আধুনিক বিজ্ঞান এবং কৃত কৌশলের অগ্রযাত্রার প্রতি মুগ্ধ বিস্ময়বোধ প্রকাশ করেই বঙ্কিম সন্তুষ্ট ছিলেন না। তিনি বিজ্ঞান এবং কৃৎকৌশলকে সাবালক মানব মস্তিস্কের উপজাত ফসল হিসেবেই দেখেছিলেন। বাঙ্গালির অলস মস্তিস্কের তার্কিকতার প্রবণতা এবং চিত্তবৃত্তির উন্মার্গগামীতা এই সকল চারিত্র্যলক্ষণকে সুযোগ পেলেই তিনি ব্যঙ্গ বিদ্রুপে বিদ্ধ করতে ছাড়েননি। পশ্চিমা জাতিগুলো বিজ্ঞান সাধনার বলেই সমস্ত পৃথিবীকে তাদের শোষণের মৃগয়া ক্ষেত্রে পরিণত করেছে, একথা বঙ্কিম অনেকবারই দ্বিধা এবং জড়িমাহীন কণ্ঠে উচ্চারণ করেছেন।

বঙ্কিমের ইতিহাস সম্পর্কিত ধারণাও ছিলো অত্যন্ত স্বচ্ছ। যে কোনো জাতির ইতিহাস সে জাতির সর্বাঙ্গীন পরিচয়কে ধারণ করে। তাঁর বাঙ্গালার ইতিহাস এই অত্যন্ত ক্ষুদ্র প্রবন্ধটিতে যে বিজ্ঞাননিষ্ঠ মনের পরিচয় মেলে, তা থেকে তাঁর ইতিহাস বিচারের ধরনটি অনুমান করা যায়। ইতিহাস বলতে বঙ্কিম যথার্থ অর্থে জনগণেরই ইতিহাস বুঝতেন। জনগণই ইতিহাসের আসল স্রষ্টা। ইতিহাস রাজ রাজরাদের নামের তালিকা নয়, কিংবা এক বংশ থেকে অন্য বংশের লোকদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিবরণও। নয়। বাঙ্গালার ইতিহাস প্রবন্ধে ইতিহাসের গতিধারার প্রতি যে ধরনের ইঙ্গিত দান করেছেন, তার প্রাসঙ্গিকতা অদ্যাবধি অবসিত হয়নি। তিনি কবুল করে নিয়েছেন, বাঙালি একটা মিশ্র জাতি। বাঙ্গালির ইতিহাস মানে ওই মিশ্র জাতিরই ইতিহাস। আর্য, অনার্য, বিদেশাগত জনগোষ্ঠি এবং প্রান্তিক জনসমাজ সকলেরই ইতিহাস। সব বৃত্তির, সব পেশার, সব ধর্মের, সব সম্প্রদায়ের ইতিহাসই বাঙালির ইতিহাস।

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যেভাবে মুসলমান বিজেতাদের আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে তাঁদের পররাজ্য লোভী তস্কর, প্রজাপীড়ক, পরধর্ম বিদ্বেষী এবং লুণ্ঠনকারী বলে অভিযুক্ত করেছেন, তেমনটি অন্য কোনো লেখক করেননি। তথাপি তিনি বিজেতাদের সামরিক শ্রেষ্ঠতার প্রশংসা করেছেন। সুলতান মাহমুদ যে একজন দক্ষ সেনাপতি এবং বিচক্ষণ রণপণ্ডিত ছিলেন স্বীকার করে নিতে কোনো রকম কুণ্ঠা প্রদর্শন করেননি। আক্রমণকারী মুসলমান রাজাদের তুলনায় সামরিক শক্তির দিক দিয়ে ভারতীয় হিন্দু রাজন্যবর্গ অপেক্ষাকৃত হীনবল ছিলেন এবং তাঁদের সামরিক সংগঠন দুর্বল ছিলো, ওগুলো বঙ্কিম অম্লানবদনে কবুল করে নিয়েছেন। তাঁর জানাশোনার পরিধি এতো দূর প্রসারিত ছিলো যে তিনি পৃথিবীর বড়ো বড়ো জাতিগুলোর উথান পতনের ইতিহাস এবং কারণ জানতেন। একেকটি জাতি শক্তিশালী হয়ে ওঠার পেছনে নৈতিক শক্তির কি ভূমিকা, সঙঘশক্তির কি পরিমাণ বেগ এবং আবেগ প্রয়োজন, সে বিষয়ে বঙ্কিম বিলক্ষণ অবগত ছিলেন। বঙ্কিম যখন তাঁর ধর্মতত্ব গ্রন্থটিতে উচ্চারণ করেন, তিনি যে ধর্মবলের কথা বলছেন, সেই বলে বলীয়ান হয়ে উঠলে ভারতবর্ষের হিন্দুরাও হজরত মুহম্মদের সময়ের আরব এবং ক্রমওয়েলের সময়কালীন ইংরেজদের মতো শক্তিশালী হয়ে উঠবে, তা থেকে বঙ্কিমের ইতিহাস বীক্ষার সঠিক পরিচয়টি বেরিয়ে আসে।

বঙ্কিমের প্রাগ্রসর সম্মুখ দৃষ্টি, ইতিহাস সম্পর্কিত ধারণা, তৎকালীন ইউরোপীয় ধ্যান ধারণার সঙ্গে নিবিড় পরিচয় এবং বিজ্ঞান মনস্কতা এতো সব যোগ্যতা এবং পারঙ্গমতা, সেগুলোর সাহায্যে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর দেশ এবং সমাজের সামনে একটি ভিন্ন। রকম জাতীয় এবং সামাজিক আদর্শের দৃষ্টান্ত তুলে ধরতে পারতেন। কিন্তু বঙ্কিমকে পরিচিত হতে হলো হিন্দু রাষ্ট্রের স্বপ্নদ্রষ্টা আনন্দমঠ গ্রন্থের বন্দে মাতরম মন্ত্রের ঋষি। হিসেবে। এই ট্র্যাজেডি একা বঙ্কিমের নয়। এটা ভারতীয় সমাজের ট্রাজেডি।

আমাদের ভুলে গেলে চলবে না ব্যক্তিগত জীবনে বঙ্কিম ছিলেন বৃটিশের ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট। অধিকতর যোগ্যতা এবং দক্ষতা থাকা সত্বেও তাঁর কোনো পদোন্নতি ঘটেনি। যতোদিন চাকুরি করেছেন, তাঁর চাইতে অযোগ্য এবং অপদার্থ ব্যক্তিদের তাঁকে সালাম ঠুকতে হয়েছে। উপনিবেশিক শাসনের প্রধান একটি বৈশিষ্ট্য ছিলো গুণ এবং যোগ্যতা থাকা সত্বেও শাসিত জাতির মানুষ উচ্চতর পদ লাভ করতে পারে না। উপনিবেশিক শাসন ব্যক্তিকে যেমন খণ্ডিত করে, তেমনি তার চিন্তা ভাবনারও বিকলাঙ্গ একপেশে বিকাশ ঘটাতে বাধ্য করে। বঙ্কিমের ক্ষেত্রেও সেই জিনিশটি হয়েছিলো। তিনি মনে মনে হয়তো একটি স্বাধীন জাতীয় রাষ্ট্র চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর স্বপ্নের চেহারাটি একটি হিন্দু রাষ্ট্রের মোড়কে প্রকাশ করতে হয়েছিলো।

প্রসঙ্গতঃ আমরা উনবিংশ শতাব্দীর ইয়ং বেঙ্গল মুভমেন্টের সেই সব গনগনে তরুণ তুর্কী যুবকদের কথা বিবেচনায় আনতে পারি। হেনরী ডিরোজিয়োর মন্ত্রশিষ্য এই সকল তরুণ যৌবন বয়সে সব ধরনের হিন্দু সংস্কারের শৃঙ্খল ছিন্ন করার জন্য ব্যগ্র এবং উতলা হয়ে উঠেছিলেন। হিন্দু ধর্ম এবং সংস্কৃতির মধ্যে গ্রহণযোগ্য এবং প্রমাণ্য কিছু আছে এই তরুণেরা বিশ্বাস করতেন না। পশ্চিমই ছিলো তাঁদের ধ্যান জ্ঞান। পশ্চিমা ধাঁচের জীবন চর্চা আয়ত্ব করার জন্য তাঁরা উঠে পড়ে লেগে গিয়েছিলেন। দেশীয় চিন্তা চেতনার প্রতি তাদের উত্মা এবং বিরক্তি এতোদূর চরমে উঠেছিলো যে গো-মাংস ভক্ষণ করে নিছক মজা দেখার জন্য হাড়গোড় নিষ্ঠাবান হিন্দুদের বাড়ির আঙ্গিনায়। ছড়িয়ে দিতেন।

পরিণত জীবনে এই ইয়ং বেঙ্গল মুভমেন্টের ভাব বিপ্লবের মশালচিদের মধ্যে কি রকম পরিবর্তন ঘটে গিয়েছিলো, সেটা লক্ষ্য করার মতো বিষয়। এই তরুণদের অনেকেই সাধু হয়ে গিয়েছিলেন। ইয়ং বেঙ্গলের তরুণেরা যে আত্যন্তিক যত্ন সহকারে পশ্চিমা বিদ্যা রপ্ত করার জন্য বহ্নিশিখায় পতঙ্গের মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন; সেই জ্ঞান বিদ্যার সদ্ব্যবহার করার জন্য তাঁদের প্রায় সকলকেই বৃটিশের চাকুরি গ্রহণ করতে হয়েছিলো। বৃটিশের বেতনভোগী একজন কর্মচারীর যে স্বাধীনতা, সেটা হলো সাধু হওয়ার স্বাধীনতা। সমাজ সংসারের সমস্ত বন্ধন ছিন্ন করে ব্যক্তির অন্তঃস্থ সত্তাকে একটা সময়হীন শূণ্যতার মধ্যে নিক্ষেপ করার অপর নামই তো সাধুর খাতায় নাম সেখানেনা।

ডিরোজিয়ো শিষ্যদের বিদ্রোহের আগুন, হাওয়ার আতশবাজির মতো ফুর ফুর করে জ্বলে উঠে শূন্যে মিলিয়ে গেছে। বৃহত্তরো সমাজে তাঁদের সমাজচিন্তা, দর্শনচিন্তা দাবানল জ্বালিয়ে ভোলার কথা দূরে থাক, ডিরোজিয়ানরা নিজেরাও যৌবন দিনের সেই উত্তাপ, সেই অঙ্গীকার বুড়ো বয়স পর্যন্ত ধারণ করতে পারেননি। ব্যর্থ বিদ্রোহীকে একটা শাস্তি অবশ্যই ভোগ হরতে হয়। সেই শাস্তি রাজার তরফ থেকে আসুক কিংবা বেচ্ছা প্রণোদিত হোক। যে সকল তরুণ একদা প্রাণের উত্তাপে সমাজ সংসারের সমস্ত বন্ধন উপড়ে ফেলে সম্পূর্ণরূপে স্বাধীন হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন, তাঁর শেষ পর্যন্ত সাধু বনে গিয়ে নিরঙ্কুশ স্বাধীনতা ভোগ করার দশায় উপনীত হয়েছেন, এরকম একটা আত্মপ্রসাদ অনুভব করতে হলো। সাধুরা নিরঙ্কুশ স্বাধীন, কারণ সমাজ সংসারের কোনো সম্পর্ক তাঁদের শীকার করতে হয় না। সাধুত্বের নির্মোক তাঁদের দুনিয়াদারির ঝড়-ঝাঁপটা থেকে আলাদা করে রাখে। বৃটিশের পেনসনভোগী এই সকল ব্যর্থ বিদ্রোহী সাধু স্বাধীনতার একটা তুরীয় মার্গে অবস্থান করতে থাকলেন। হ্যাঁ, এক ধরনের স্বাধীনতা বটে। এটা অতীত দিনের নিজেদের আপন বিষ্ঠার ওপর পরমানন্দে শুয়ে থাকার স্বাধীনতা। উপনিবেশিক বৃটিশ সরকার এটুকু স্বাধীনতাই বিদ্রাহীদের জন্য মঞ্জুর করতে পারে।

বঙ্কিমের পক্ষে সাধু হওয়া অসম্ভব ছিলো। তাঁকে হতে হয়েছিলো ঋষি। কারণ তাঁর মতো এমন একজন সবল কাণ্ডজ্ঞান সম্পন্ন মানুষের পক্ষে সমস্ত বন্ধনহীনতার তুরীয় মার্গে আরোহণ করা অসম্ভব। তাঁর চিত্তবৃত্তিতে অধিকতররা কঠিন এবং ভারি উপাদান সঞ্চিত ছিলো। ধর্মকে জীবনের সর্বশেষ আশ্রয় কবুল করে নেয়ার পরও সমাজ সংসার ভুলে যাওয়া বঙ্কিমের পক্ষে সম্ভব হয়নি। বরং তিনি সমাজ সংস্কারের সমস্ত কিছুকে ধর্মের নিরিখে বিচার করতে আরম্ভ করলেন। জীবনের অন্তিম পর্যায়ে এসে বঙ্কিমকে ঘোষণা দিতে হলো, বিদেশের উৎকৃষ্টতরো বিজ্ঞানটির চাইতে দেশের প্রজাতির তুচ্ছতম সংস্কারটি অনেক ভালো।

চাকুরি জীবনে বঙ্কিমের লাঞ্ছনা, পারিবারিক দুর্যোগ, একমাত্র কন্যার অকালে অপঘাত মৃত্যু বঙ্কিমের ব্যক্তিগত জীবনকে হতাশায় এমন এক চূড়ান্ত পর্যায়ে ঠেলে দিয়েছিলো; একমাত্র ধর্মের মধ্যেই সান্ত্বনা সন্ধান করতে হয়েছিলো। তরুণ বয়সের সাধনা বলে বঙ্কিম চিন্তা করার যে অপূর্ব ক্ষমতা আয়ত্ব করেছিলেন, সেই জিনিশটিকে উল্টোদিকে প্রবাহিত করতে বাধ্য হলেন। বঙ্কিমের জীবনচরিত পাঠক তাঁর বিরদ্ধে কঠিন অভিযোগ উত্থাপন করার পরও দুঃখবোধ না করে পারবেন না। আহা! কি আশ্চর্য মানুষ। কি করতে পারতেন, আর কি করলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *