ঘরটিতে ঢুকে ঈশিতা হতভম্ব হয়ে গেল। গতকাল কালো টেবিলটার যে মাথায় সে বসেছিল, আজকে সেখানে বসে আছে রাফি ও শারমিন। শারমিনের চুল ছেলেদের মতো করে কাটা, কিন্তু সে জন্য তাকে চিনতে কোনো সমস্যা হলো না। সে তার নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারল না—মাত্র কিছুক্ষণ আগে সে রাফির সঙ্গে কথা বলেছে। ঈশিতা কয়েকবার চেষ্টা করে বলল, রাফি, তুমি?বই কম।
রাফি দুর্বলভাবে হাসার চেষ্টা করল। বলল, হ্যাঁ।
কেমন করে?
রাফি কিছু বলার আগে সাফারি কোট পরা চুল ছোট করে ছাঁটা মধ্যবয়স্ক মানুষটি বলল, তুমি যখন তার সঙ্গে পিরিতের কথা বলছিলে, তখন তাকে ট্র্যাক করেছি। এ জন্য যখন-তখন পিরিতের কথা বলতে হয় না। মানুষটি হা হা করে আনন্দে হাসতে থাকে। তার কথা বলার অশালীন ভঙ্গিটি পুরোপুরি উপেক্ষা করে ঈশিতা রাফির কাছে গিয়ে বলল, তোমাকেও ধরে এনেছে? কী সর্বনাশ!
রাফি জোর করে মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, হ্যাঁ, খুব ঝামেলার মাঝে পড়ে গেলাম মনে হচ্ছে।
টেবিলের অন্য পাশে বব লাস্কি বসেছিল, সে ইংরেজিতে বলল, বস। কোনো রকম পাগলামি করার চেষ্টা করো না। তার কারণ, তোমাদের পেছনে যে দুজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে, তারা আর্মড। কিন্তু তাদের আর্মড থাকার প্রয়োজন নেই, তারা খালি হাতেই দু-চারটা মানুষ খুন করতে পারে।
রাফি পেছনে তাকাল, নিঃশব্দে তার পেছনে একজন সাদা এবং একজন কুচকুচে কালো মানুষ কখন এসে দাঁড়িয়েছে, সে লক্ষ করেনি। শারমিন রাফির হাত ধরে ভয় পাওয়া গলায় বলল, এই মানুষটা কী বলছে?
রাফি বলল, আমাদের চুপ করে বসে থাকতে বলেছে।
মানুষটা এখন আমাদের কী করবে?
আমি জানি না। দেখি, কী করে।
বব লাস্কি বলল, তোমাদের সঙ্গে যে বাচ্চাটা বসে আছে, সেই কি অসাধারণ প্রতিভাধর বাচ্চা, যে আমাদের এনক্রিপটেড কোড ভেঙেছে?
রাফি কিংবা ঈশিতা কেউই কথার উত্তর দিল না। বব লাস্কি একটু কঠিন গলায় বলল, আমার কথার উত্তর দাও।
রাফি বলল, তার আগে আমি কি তোমাকে এক-দুটি প্রশ্ন করতে পারি?
কী প্রশ্ন?
আমাদের এভাবে ধরে আনার অধিকার তোমাকে কে দিয়েছে?
বব লাস্কি শব্দ করে হেসে ওঠে, তোমার ধারণা, আমার সে জন্য কারও কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে?
রাফি কঠিন মুখে জিজ্ঞেস করল, আমাদের তোমরা কী জন্য ধরে এনেছ? এ বব লাস্কি বলল, বোকার মতো কথা বলো না। তোমরা খুব ভালো করে জানো, তোমাদের কী জন্য ধরে এনেছি। ধানাই-পানাই না করে সোজাসুজি কাজের কথায় চলে এসো।
ঈশিতা জিজ্ঞেস করল, কাজের কথাটি কী?
বব লাস্কি হাত তুলে শারমিনকে দেখিয়ে বলল, এই মেয়েটাই কি সেই মেয়ে? শারমিন?
চুল ছোট করে ছাঁটা সাফারি কোট পরা মধ্যবয়স্ক মানুষটি বলল, হ্যাঁ, বস। এইটাই সেই মেয়ে। আমি জানি।
বব লাস্কি বলল, তুমি কেমন করে জানো?
আমি যখন তাকে ধরে আনছিলাম, ইউনিভার্সিটির কিছু বখা ছেলে ছিনিয়ে নিল।
বব লাস্কি চোখ লাল করে বলল, তোমার বলতে লজ্জা করে না যে ইউনিভার্সিটির কিছু বখা ছেলে তোমার হাত থেকে বাচ্চা একটা মেয়েকে ছিনিয়ে নিল? তুমি এই ঘর থেকে বের হয়ে যাও। আর আমি না ডাকলে তুমি কখনো এই ঘরে ঢুকবে না।
সাফারি কোট পরা চুল ছোট করে ছাঁটা মানুষটির মুখ অপমানে কালো হয়ে উঠল। ঈশিতা মানুষটির দিকে তাকিয়ে বলল, আশা করছি, এই ধরনের অপমান সহ্য করার জন্য এরা তোমাকে যথেষ্ট টাকা দেয়।
মানুষটা কোনো উত্তর না দিয়ে গটগট করে বের হয়ে গেল। বব লাস্কি গজগজ করে বলল, এই পোড়া দেশে বিশ্বাসযোগ্য কাজের মানুষের এত অভাব!
রাফি বলল, তোমার তো কাজের মানুষ দরকার নেই, তোমার দরকার ঘাঘু ক্রিমিনাল, নিজের দেশ থেকে নিয়ে এলে না কেন?
বব লাস্কি রক্তচক্ষু করে রাফির দিকে তাকাল, কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল। শারমিন রাফির হাত ধরে ফিসফিস করে জানতে চাইল, এই মানুষটা এখন কী নিয়ে কথা বলছে?
তোমাকে নিয়ে। জানতে চাইছে, তুমি কি সেই মেয়েটা নাকি, যে সবকিছু করতে পারে।
কেন জানতে চাইছে?
এখনো বুঝতে পারছি না।
বব লাস্কি তার সামনে রাখা ছোট খেলনার মতো কম্পিউটারটির কি-বোর্ডে চাপ দিয়ে সেখানে নিচু গলায় কিছু একটা বলল এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘরের ভেতর বেশ কয়েকজন মানুষ এসে ঢুকল। ঈশিতা মানুষগুলোকে চিনতে পারে। গতকাল তাদের সবার সঙ্গে দেখা হয়েছে। শারমিন একটু অবাক হয়ে বিদেশি মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। সে আগে কখনো মানুষ দেখেনি। মানুষগুলো কালো টেবিলের দুই পাশে এসে বসে। বব লাস্কি তাদের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমরা যে মেয়েটিকে খুঁজছিলে, এটি সেই মেয়ে।
দাড়ি-গোঁফের জঙ্গল মানুষটি বলল, দেখে মনে হচ্ছে, একজন ছেলে।
বব লাস্কি বলল, কেউ যেন চিনতে না পারে, সে জন্য তাকে এভাবে সাজিয়েছে।
হাউ ইন্টারেস্টিং!
নীল চোখের মানুষটি বলল, আমরা মেয়েটিকে একটু পরীক্ষা করতে চাই।
করো।
মানুষটা শারমিনের দিকে তাকিয়ে ইংরেজিতে বলল, তুমি কি ইংরেজি জানো?
রাফি শারমিনের হয়ে বলল, না, জানে না।
নীল চোখের মানুষটি তার ল্যাপটপের ক্যালকুলেটরে কিছু একটা হিসাব করে বলল, তুমি তাকে জিজ্ঞেস করো, বারো মিলিয়ন আট শ নয় হাজার দুই শ একচল্লিশের বর্গমূল কত?
শারমিন জিজ্ঞেস করল, স্যার, কী করতে বলেছে?
একটা সংখ্যা বলে তার বর্গমূল জানতে চাইছে।
সংখ্যাটা বুঝতে পেরেছি। বর্গমূল মানে কী?
কোনো সংখ্যাকে সেই সংখ্যা দিয়ে গুণ করলে এটা পাবে।
তিন হাজার পাঁচ শ উনআশি।
রাফি সংখ্যাটি বলল এবং সব বিদেশি মানুষ তখন তাদের জায়গায় নড়েচড়ে বসল। দাড়ি-গোঁফের জঙ্গল মানুষটি ল্যাপটপে কিছু একটা লিখে সেদিকে তাকিয়ে থেকে শারমিনকে জিজ্ঞেস করল, চৌত্রিশ হাজার সাত শ একানব্বইকে ছাপ্পান্ন হাজার নয় শ বত্রিশ দিয়ে গুণ করলে কত হয়?
শারমিন বলল, এক বিলিয়ন, নয় শ আশি মিলিয়ন সাত শ একুশ হাজার দুই শ বারো।
দাড়ি-গোঁফের জঙ্গল মানুষটিব লাস্কির দিকে তাকিয়ে বলল, এটাই সেই মেয়ে। আমাদের কোনো সন্দেহ নেই।
বব লাস্কি জানতে চাইল, এখন কী করতে চাও?
অনেক কিছু। প্রথমে ওর ব্রেনের থ্রি ডি একটা স্ক্যান করতে চাই। তারপর ইমেজিং। সবার শেষে ইমপ্ল্যান্ট বসিয়ে ইন্টারফেসিং।
গুড। শুরু করে দাও।
মানুষগুলো উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আমরা তাহলে মেয়েটিকে নিয়ে যাই।
যাও।
রাফি চমকে উঠে বলল, কোথায় নিয়ে যাবে?
নীল চোখের মানুষটি বলল, আমরা তোমার কথার উত্তর দিতে বাধ্য নই। আমাদের ঝামেলা কোরো না।
রাফি শারমিনকে শক্ত করে ধরে রেখে বলল, না। আমি শারমিনকে নিতে দেব না।
সরে যাও।
রাফি হিংস্র স্বরে বলল, তোমরা সরে যাও।
মানুষটা একপাশে এসে শারমিনের হাত ধরে বলল, ছেড়ে দাও।
রাফি বুকে ধাক্কা দিয়ে মানুষটিকে সরিয়ে দিয়ে বলল, তুমি ছেড়ে দাও।
রাফির ধাক্কা খেয়ে মানুষটি পড়তে পড়তে কোনোভাবে নিজেকে সামলে নিয়ে অবাক হয়ে রাফির দিকে তাকাল, তারপর হিস হিস করে বলল, তুমি অনুমানও করতে পারছ না, তুমি কোথায় আছ। তোমার একটা দ্রুত যন্ত্রণাহীন মৃত্যুর ব্যবস্থা করতে পারতাম, এখন মনে হচ্ছে, তার প্রয়োজন। নেই।
বব লাস্কি উঠে দাঁড়িয়ে বলল, বাচ্চাদের মতো হাতাহাতি করার কোনো প্রয়োজন নেই। সরে দাঁড়াও। আমাদের ফাইভ ডিগ্রি ব্ল্যাক বেল্ট তোমাদের ব্যবস্থা করে দিচ্ছে। সে একটু ইঙ্গিত করতেই কুচকুচে কালো মানুষটি রাফির দিকে এগিয়ে আসে এবং কিছু বোঝার আগেই রাফি অনুভব করল, কেউ একজন তার ঘাড়ে আঘাত করেছে, মুহূর্তে চারদিক অন্ধকার হয়ে যায়। ঈশিতা রাফিকে ধরার চেষ্টা করল, ভালো করে ধরতে পারল না। রাফি টেবিলের কোনায় ধাক্কা খেয়ে নিচে পড়ে গেল। ঈশিতা চিলের মতো চিৎকার করে রাফিকে ধরল, মাথা কেটে রক্ত বের হচ্ছে। প্রথমে হাত দিয়ে, তারপর নিজের কাপড় দিয়ে রক্ত থামানোর চেষ্টা করল।
নীল চোখের মানুষটি খ করে শারমিনের হাত ধরে তাকে হ্যাচকা টান দিয়ে সরিয়ে নিতে থাকে। শারমিন ভয় পেয়ে চিৎকার করে বলল, যাব না। আমি যাব না। কেউ তার কথায় ভ্রুক্ষেপ করল না। শারমিন কোনোভাবে চেষ্টা করে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ঈশিতার দিকে ছুটে আসে। ঈশিতা উঠে দাঁড়িয়ে শারমিনকে ধরার চেষ্টা করল, কিন্তু দুই দিক থেকে তখন দুজন মানুষ উঠে দাঁড়িয়েছে। পাহাড়ের মতো কালো মানুষটি ঈশিতাকে ধরে বলল, তুমি আর একটু নড়েছ কি তোমার অবস্থা হবে তোমার বন্ধুর মতন।
ঈশিতা নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করল, পারল না। যে মানুষটি তাকে ধরেছে, তার গায়ের জোর মোষের মতন, আঙুলগুলো লোহার মতো শক্ত। বেশ কয়েকজন মিলে শারমিনকে ধরেছে, সে চিৎকার করে কাঁদছে। সেই অবস্থায় তাকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যেতে থাকে। ঈশিতা শারমিনের দিকে তাকিয়ে ছটফট করতে থাকে। ক্রোধ, ভয়ংকর-ক্রোধ তার ভেতরে পাক খেতে থাকে। অসহায় ক্রোধের মতো যন্ত্রণা বুঝি আর কোথাও নেই। সে বব লাস্কির দিকে তাকিয়ে হিংস্র গলায় চিৎকার করে বলল, তোমাকে এর মূল্য দিতে হবে।
বব লাস্কি সহৃদয় ভঙ্গিতে হেসে বলল, তুমি ছোট একটা ভুল করেছ, মেয়ে। আমাকে মূল্য দিতে হবে না, আমাকেই মূল্য দেওয়া হবে। এটা দেখার জন্য তুমি থাকবে না, সেটাই হচ্ছে দুঃখ।
রাফির মনে হলো, অনেক দূর থেকে কেউ তাকে ডাকছে, রাফি, এই রাফি ঘুমের মধ্যে তার মনে হলো মানুষটিকে সে চেনে। কিন্তু কে, ঠিক বুঝতে পারছে না। মানুষটি আবার ডাকল, এই রাফি, চোখ খুলে তাকাও—
গলার স্বরটি একটি মেয়ের। রাফি চোখ খুলে তাকাল, ঠিক তার মুখের ওপর ঈশিতা ঝুঁকে আছে, তার চোখেমুখে ভয়ের ছাপ। ঈশিতা জিজ্ঞেস করল, কেমন আছ, রাফি?
রাফি তখনো পরিষ্কার করে চিন্তা করতে পারছে না, আবছা আবছাভাবে তার সবকিছু মনে পড়তে থাকে এবং হঠাৎ করে তার সবকিছু মনে পড়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে সে উঠে বসতে গিয়ে আবিষ্কার করল, মাথায় প্রচণ্ড ব্যথা। সে মাথায় হাত দিতেই অনুভব করে, সেখানে চটচটে রক্ত। রাফি ঈশিতার দিকে তাকিয়ে বলল, আমরা কোথায়?
একটা ঘরে। কাল রাত আমাকে এই ঘরে আটকে রেখেছিল।
শারমিন?
জানি না। সবাই মিলে ধরে নিয়ে গেছে।
রাফি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমার জন্য এই বাচ্চা মেয়েটার এত বড় সর্বনাশ হলো।
ঈশিতা বলল, কেন, তোমার জন্য কেন?
আমি যদি বের না করতাম যে শারমিন একটা প্রডিজি, যদি তার ডিসলেক্সিয়ার একটা সমাধান বের করে না দিতাম, তাহলে তো সে এখনো বেঁচে থাকত। তাহলে কেউ তার মাথা কেটে ব্রেন বের করে নিতে পারত না।
সেটি তো তোমার দোষ নয়। এই পৃথিবীতে যে দানবেরা আছে, সেটা
কী তোমার দোষ?
রাফি কোনো কথা বলল না। ঈশিতা জিজ্ঞেস করল, এখন আমরা কী করব?
রাফি বলল, আমাদের শেষ ভরসা মাজু বাঙালি।
মাজু বাঙালি কী করবে?
এই ঘরের ভেতর নিশ্চয়ই তিরিশটা টেলিভিশন ক্যামেরা আমাদের দিকে মুখ করে রেখে দেখছে, আমরা কী করি। আমরা কী বলি। কাজেই আমি এখন। কিছু বলব না।
ঠিক আছে। দুজনে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকে। রাফি হঠাৎ ছটফট করে উঠে বলল, আমি আর পারছি না। কিছু না করে চুপচাপ বসে থাকা অসম্ভব একটা ব্যাপার।
ঈশিতা মাথা নাড়ল। বলল, আমি জানি, এর চেয়ে বেশি কষ্ট আর কিছুতে না। কাল সারাটা রাত আমার এভাবে কেটেছে। কিন্তু করবে কী? এটুকুন একটা ঘরে তুমি কী করবে?
রাফি বলল, জানি না। কিন্তু দেখি! সে উঠে দাঁড়াল, সাথে সাথে মাথায় প্রচণ্ড ব্যথা করে ওঠে। সে দাঁতে দাঁত চেপে ব্যথার ধাক্কাটা সহ্য করে। ব্যথাটা একটু কমার পর সে ঘরটি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল। একটা দরজা ছাড়া এখানে ঢোকার কিংবা বের হওয়ার অন্য কোনো পথ নেই। ছোট একটা বাথরুম, সেখানে একটা সিংক আর টয়লেট, আর কিছু নেই। রাফি ওপরে তাকাল, ঘরের ভেতরে আলোগুলো আসছে ফলস সিলিংয়ের ভেতর থেকে। লাইট বাল্ব দেখা যাচ্ছে না—শুধু নরম একটা আলো ঘরে ছড়িয়ে পড়ছে। নিচ্ছিদ্র একটা ঘর, দরজা কিংবা দেয়াল ভেঙে এখান থেকে বের হওয়ার কোনো উপায় নেই।
এ রকম সময় দরজায় শব্দ হলো, খুট করে একটা শব্দ হলো এবং খাবারের ট্রে হাতে একজন মানুষ এসে ঢুকল। সকালে যে মানুষটি এসেছিল, এটি সেই মানুষ নয়। অন্য একজন, অন্য মানুষটির মতোই এর ভাবলেশহীন মুখ। ঘরে যে দুজন মানুষ আছে, সেটি যেন সে লক্ষও করছে না। ট্রে দুটি মেঝেতে রেখে সে যন্ত্রের মতো পুরো ঘরটি একবার দেখে, বাথরুমে যায়, অকারণে ট্যাপ খুলে দেখে এবং টয়লেট ফ্লাশ করে তারপর ঘর থেকে বের হয়ে যায়।
রাফি খাবারগুলো দেখে বলল, এগুলো খেতে হবে? আমাদের কি এখন খাওয়ার মুড আছে?
নেই। কিন্তু তুমি অবাক হয়ে যাবে যে তুমি তার পরও কী পরিমাণ খেতে পারবে। এ রকম অবস্থায় যখন শরীরের কিছু একটা হয়, তখন প্রচণ্ড খিদে পায়।
রাফি অবাক হয়ে দেখল, সত্যি সত্যি তার খিদে পেয়েছে এবং গোগ্রাসে সে সবকিছু খেয়ে শেষ করে ফেলল। নিজেরটা শেষ করে সে ঈশিতার আপেলটা খেতে খেতে গলা নামিয়ে শোনা যায় না, এভাবে ফিসফিস করে বলল, একটু পর লোকটা খালি ট্রে নিতে আসবে না?
হ্যাঁ।
তখন দুজন মিলে লোকটাকে অ্যাটাক করলে কেমন হয়?
ঈশিতা এক মুহূর্ত দ্বিধা না করে বলল, চমকার হয়। ওরা এমনিতেই আমাদের মেরে ফেলবে, ভালো মানুষ হয়ে লাভ নেই।
গুড।
কী দিয়ে অ্যাটাক করবে?
এই ট্রে দুটি মোটামুটি ভারী। একসঙ্গে নিয়ে মাথায় বাড়ি দিতে পারি।
চিনামাটির প্লেট, পিরিচ, থালা এগুলোও ভেঙে টুকরো টুকরো একটা ব্যাগে ভরে মাথায় বাড়ি দিতে পারি–
ব্যাগ? রাফি বলল, ব্যাগ কোথায় পাবে?
আমার এই ওড়নাটা দিয়ে বেঁধে নিতে পারি।
ভেরি গুড। তাহলে কাজ শুরু করে দিই।
হয়তো টেলিভিশনে আমাদের দেখছে।
বাথরুমে নিয়ে যাই, সেখানে নিশ্চয়ই ক্যামেরা নেই।
রাফি বলল, এত নিশ্চিত হয়ো না—কিন্তু কিছু করার নেই। চলো, কাজ শুরু করি।
কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা প্রস্তুত হয়ে নিল। প্লেট, হাফ প্লেট, পিরিচ, কাপ, গ্লাস মিলে অনেক কিছু ছিল। সেগুলো ভেঙে ওড়নায় বেঁধে নেওয়ার পর সেটা যথেষ্ট ভারী একটা অস্ত্র হয়ে দাঁড়াল, এটি দিয়ে ঠিকভাবে মারতে পারলে মানুষটিকে অচেতন করা কঠিন হওয়ার কথা নয়।
রাফি আর ঈশিতা এবার দরজার কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকে। দরজা খোলার পর তারা দরজার আড়াল থেকে বের হয়ে আসবে, প্রথমে রাফি মারবে তার ঘাড়ে, তারপর ঈশিতা। ঘাড়ে ঠিক করে মারলে যে মানুষ অচেতন হয়ে যায়, সেটা রাফি আজ সকালেই দেখেছে। তারা ফিফথ ডিগ্রি ব্ল্যাক বেল্ট নয়, কিন্তু যখন কেউ একেবারে মৃত্যুর মুখোমুখি এসে দাঁড়ায়, তখন সে হয়তো ব্ল্যাক বেল্ট থেকেও ভয়ংকর হয়ে যেতে পারে।
রাফি ঈশিতার পিঠে হাত রেখে বলল, ঈশিতা।
বলো।
কিছুক্ষণের মধ্যে এখানে কী ঘটবে, একটু পর কী হবে, আমরা জানি। আমি তোমাকে আবার কিছু বলার সুযোগ পাব কি না, সেটাও জানি। তাই তোমাকে এখন একটা কথা বলি।
বলো।
তুমি খুব চমৎকার একটা মেয়ে।
থ্যাংকু।
আমি যদি তোমার মতো একটা মেয়ের কাছাকাছি বাকি জীবনটা কাটাতে পারতাম, তাহলে আর কিছু চাইতাম না।
ঈশিতা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, যদি আমরা দুজনেই এখন মরে যাই, তাহলে এক অর্থে তোমার কথাটা সত্যি হবে।
রাফি হেসে ফেলল। বলল, কিন্তু আমি সেই অর্থে এটা সত্যি করতে চাই না। আমি চাই সত্যিকার অর্থে—
ঠিক তখন দরজায় খুট করে শব্দ হলো, তারপর চাবি দিয়ে দরজা খুলে মানুষটি ভেতরে ঢুকল। সে কিছু বোঝার আগেই রাফি আর ঈশিতা তার ওপর চিতা বাঘের ক্ষীপ্রতা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। মানুষটি কিছু বোঝার আগেই কাটা কলাগাছের মতো মেঝেতে পড়ে যায়।
দরজাটা বন্ধ করে তারা মানুষটিকে দেখে, সত্যি সত্যি অচেতন হয়ে আছে। রাফি তার পকেটে হাত ঢুকিয়ে ছোট একটা রিভলবার পেয়ে যায়। সে কখনো রিভলবার ব্যবহার করেনি—ট্রিগার টানলেই গুলি হয়, নাকি আগে অন্য কিছু করতে হয়, সে জানে না। গল্প-উপন্যাসে সেফটি ক্যাচের কথা পড়েছে। সেটি কী, কে জানে!
রাফি ঈশিতাকে বলল, চলো, বের হই।
চলো। রিভলবারটা আছে তো?
রাফি মাথা নাড়ল, আছে। তুমি?
আমার হাতে তোমার ওড়না দিয়ে বানানো মুগুরটা থাকুক। জিনিসটা যথেষ্ট কার্যকর, সেটা তো পরীক্ষা করে দেখলাম।
হ্যাঁ, সেটা দেখেছি। রাফি হাসার চেষ্টা করল কিন্তু হাসিটি খুব কাজে এল না।
দুজনে বের হয়ে আসে। বাইরে থেকে ঘরটিতে তালা মেরে তারা করিডর ধরে হাঁটতে থাকে। তাদের শ্বাপদের মতো তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, সমস্ত শরীর ইস্পাতের মতো টান টান হয়ে আছে উত্তেজনায়।