টঙে বসে চা খেতে খেতে রাফি শারমিনকে লক্ষ করে। যারা চা খেতে আসছে, সে কাপে করে তাদের চা দিয়ে আসছে। প্লেটে করে শিঙাড়া, জিলাপি, বিস্কুট দিচ্ছে। চা খাওয়ার পর কাপ-পিরিচ নিয়ে আসছে, বিল দেওয়ার সময় হলে সে নিখুঁতভাবে কার কত টাকা বিল দিতে হবে, বলে দিচ্ছে। একসঙ্গে অনেকগুলো মানুষের কার কত টাকা বিল হচ্ছে, সে কেমন করে মনে রাখছে, কে জানে।
রাফির কাপ-পিরিচ নেওয়ার সময় সে জিজ্ঞেস করল, আমার কত বিল হয়েছে?
শারমিন একটুও চিন্তা না করে বলল, সতেরো টাকা।
ঠিক করে হিসাব করেছ?
শারমিন লাজুক মুখে মাথা নাড়ল। শারমিনের বাবা একটি গ্যাসের স্টোভে কড়াইয়ে জিলাপি ভাজছিল, রাফির দিকে তাকিয়ে বলল, শারমিন হিসাবে ভুল করে না।
ভেরি গুড। রাফি পকেট থেকে একটি বিশ টাকার নোট বের করে শারমিনের হাতে দিয়ে বলল, বাকিটা তোমার।
মেয়েটির মুখে হাসি ফুটে উঠল। এই দেশের মানুষ এখনো মুখ ফুটে ধন্যবাদ বলা শুরু করেনি। যখন ধন্যবাদ বলার কথা, তখন সেটা মুখের হাসি দিয়ে বোঝাতে হয়।
শারমিনের বাবা গরম জিলাপি কড়াই থেকে তুলে চিনির সিরায় ড়ুবাতে ড়ুবাতে বলল, আমার শারমিন যেকোনো হিসাব মাথার মাঝে করে ফেলতে পারে।
সত্যি?
হ্যাঁ।
রাফি শারমিনের দিকে তাকিলে বলল, সত্যি পার?
শারমিন ঘাড় নেড়ে জানাল, সে পারে। রাফি বলল, বলো দেখি, সতেরোকে তেরো দিয়ে গুণ করলে কত হয়?
শারমিন একটু হকচকিয়ে গেল, ইতস্তত করে বলল, জানি না।
তাহলে যে বললে, সব হিসাব মাথার মাঝে করে ফেলতে পার?
শারমিনের বাবা বলল, আসলে আমার এই টঙে চা-নাশতার হিসাব করতে পারে। যোগ-বিয়োগ পারে না।
রাফি একটু অবাক হয়ে বলল, যোগ-বিয়োগ পারে না, কিন্তু চানাশতার হিসাব করতে পারে! ঠিক আছে, তাহলে চা-নাশতার হিসাবই করতে দিই। রাফি শারমিনের দিকে তাকিয়ে বলল, একটা বিস্কুট কত?
শারমিন বলল, এক টাকা।
সতেরোজন এসেছে বিস্কুট খেতে। একজন তেরোটা করে বিস্কুট খেয়েছে। কত টাকা বিল হবে, বলো?
শারমিন কোনো চিন্তা না করে সঙ্গে সঙ্গে বলল, দুই শ একুশ টাকা।
রাফি মনে মনে হিসাব করে দেখল, ঠিকই বলেছে। শারমিন ঠিকই গুণ করতে পারে। কিন্তু গুণ বলতে কী বোঝায়, সে জানে না। রাফি জিজ্ঞেস করল, যদি তেতাল্লিশজন লোক এসে সবাই তেতাল্লিশটা করে বিস্কুট খায়, তাহলে কত টাকার বিস্কুট খাবে?
শারমিন বলল, আঠারো শ ঊনপঞ্চাশ টাকা।
রাফিকে এবার কাগজে লিখে হিসাব করে দেখতে হলো, শারমিন ঠিক বলেছে কি না। অনুমান করেছিল, সঠিক হবে এবং দেখা গেল সত্যিই সঠিক হয়েছে। রাফি এবার একটু অবাক হতে শুরু করেছে, মেয়েটি কত পর্যন্ত যেতে পারে, তার দেখার ইচ্ছে হলো। জিজ্ঞেস করল, নয় শ রিরাশি জন এসে সবাই সাত শ একুশটি করে বিস্কুট খেয়েছে। বলো দেখি, কত টাকার বিস্কুট খেয়েছে?
সত্তুর শ আশি শ বাইশ টাকা।
শারমিনের উত্তরটা বিচিত্র, রাফি আবার জিজ্ঞেস করল, কী বললে?
সত্তুর শ শ, আশি শ বাইশ টাকা
রাফি কথাটা বুঝতে পারল না, কিন্তু তার পরও সে কাগজে লিখে ফেলল। তারপর নয় শ রিরাশিকে সাত শ একুশ দিয়ে গুণ করতে শুরু করে। কয়েক মিনিট পর উত্তর বের হলো, সাত লাখ আট হাজার বাইশ। শারমিন সাত লাখকে বলে সত্ত্বর শ শ আর আট হাজারকে বলেছে আশি শ। অন্যরকমভাবে বলেছে কিন্তু ভুল বলেনি। রাফি অবাক হয়ে শারমিনের দিকে তাকিয়ে দেখল, মেয়েটি মুখে হাত চাপা দিয়ে খিল খিল করে হাসছে। রাফি জিজ্ঞেস করল, হাসো কেন?
কেউ যদি সাত শ একুশটা বিস্কুট খায়, তাহলে তার পেট ফেটে যাবে! শারমিনের কথা শুনে রাফিও হেসে ফেলল। শারমিন ভুল বলেনি, সাত শ একুশটা বিস্কুট খেলে সত্যিই পেট ফেটে যাওয়ারই কথা। এই মুহূর্তে রাফি অবশ্যি সেটা নিয়ে মাথা ঘামাল না। মেয়েটি কত পর্যন্ত হিসাব করতে পারে, সেটা সে দেখতে চাইল। বলল, পেট ফাটলে ফাটুক, সেটা নিয়ে তুমি চিন্তা করো না। তুমি আমাকে বলো, যদি দুই হাজার তিন শ বাইশ জন এসে সবাই সাত হাজার নয় শ আটচল্লিশটা করে বিস্কুট খায়, তাহলে কত টাকা বিল হবে?
শারমিনকে একটু ইতস্তত করতে দেখা গেল, বলল, দুই হাজার? হাজার মানে কী?
রাফি বুঝতে পারল, মেয়েটি এর আগে কখনো হাজার কথাটি ব্যবহার করেনি। তার দৈনন্দিন হিসাব কখনোই কয়েক শয়ের বেশি যায় না। তাই সে হাজার শব্দটি ব্যবহার না করে জিজ্ঞেস করল, তেইশ শ বাইশজন সবাই উনাশি শ আটচল্লিশটা করে বিস্কুট খেয়েছে, কত টাকা বিল?
শারমিন এক মুহূর্ত দ্বিধা না করে বলল, আঠারো শ শ শ পয়তাল্লিশ শ শ বাহান্ন শ ছাপ্পান্ন।
রাফিকে এবারে তার পকেট থেকে মোবাইল টেলিফোন ব্যবহার করে সেখানে ক্যালকুটরে হিসাব করে দেখতে হলো, শারমিন তার এক থেকে এক শ পর্যন্ত সংখ্যার জ্ঞান নিয়ে উত্তরটা নিখুঁতভাবে বলেছে। অবিশ্বাস্য। সে অবাক হয়ে শারমিনের দিকে তাকিয়ে রইল, জিজ্ঞেস করল, তুমি এইভাবে কত পর্যন্ত পার?
কত পর্যন্ত? শারমিন ইতস্তত করে বলল, যত পর্যন্ত দরকার।
ঠিক আছে, বলো দেখি, বত্রিশ হাজার চুয়ান্ন শ সাতষট্টিজন মানুষ এসে সবাই নয় হাজার আট শ তেরোটা করে বিস্কুট খেয়েছে প্রশ্নটা শেষ করার আগেই তার মনে পড়ল, মেয়েটি হাজার শব্দটা জানে না। কাজেই হাজার শব্দটা ব্যবহার না করে কীভাবে বলা যায়, চিন্তা করছিল। তার আগেই শুনতে পেল শারমিন বলছে, তিন হাজার হাজার হাজার এক শ তিরানব্বই হাজার হাজার আট শ পঁচানব্বই হাজার নয় শ আটাশি টাকা।
রাফি ভুরু কুঁচকে বলল, তুমি না এক্ষুনি বললে, হাজার জানো না?
এখন জানি।
কেমন করে জানলে?
এই যে আপনি প্রথমে বললেন, দুই হাজার তিন শ বাইশ, তারপর সেটাকে বললেন তেইশ শ বাইশ। তার মানে দশ শ হচ্ছে হাজার।
রাফি শারমিনের দিকে তাকিয়ে রইল। এই মেয়েটি শুধু যে মাথার মধ্যে গুণ করতে পারে, তা-ই নয়, নিজে নিজে শিখেও নিতে পারে। শারমিন যে সংখ্যাটা বলেছে, রাফি সেটা কাগজে লিখে নিল। তার মোবাইল টেলিফোনের ক্যালকুলেটরে সেটা সঠিকভাবে দেখাতে পারবে না। তার ক্যালকুলেটর নয় অঙ্কের বেশি দেখাতে পারে না। অন্যভাবে গুণটা করে দেখতে হবে, কিন্তু রাফির কোনো সন্দেহ রইল না যে সংখ্যাটি সঠিক। যে বিষয়টা বিস্ময়কর সেটা হচ্ছে, মাথার মধ্যে হিসাব করতে এই মেয়েটি এক মুহূর্তও সময় নিচ্ছে না। প্রত্যেকবারই সঠিকভাবে বলে দিচ্ছে।
রাফি শারমিনের হাত ধরে জিজ্ঞেস করল, তুমি কোন ক্লাসে পড়ো? শারমিন কোনো কথা না বলে বিব্রতভাবে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল, প্রশ্নের উত্তর দিল তার বাবা। বলল, লেখাপড়া করে না।
রাফি হতবাক হয়ে বলল, লেখাপড়া করে না?
না। আমি কম চেষ্টা করি নাই। করতে চায় না।
রাফি হিসাব মেলাতে পারল না, যে মানুষ অবলীলায় যেকোনো সংখ্যার সঙ্গে অন্য যেকোনো সংখ্যা গুণ করে ফেলতে পারে, সে লেখাপড়া করতে চাইবে না কেন? রাফি শারমিনের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি লেখাপড়া করতে চাও না?
শারমিন কোনো কথা না বলে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। রাফি লক্ষ করল, তার মুখে লজ্জা এবং বেদনার ছাপ। রাফি গলার স্বর নরম করে বলল, করতে চাও না?
শারমিন অস্পষ্ট স্বরে বলল, চাই। কিন্তু—
কিন্তু কী?
এবারও রাফির প্রশ্নের উত্তর দিল শারমিনের বাবা। বলল, ওর কথা আর বলবেন না। যখন পড়তে যায়, তখন নাকি বইয়ের লেখা উল্টা হয়ে যায়—তারপর নাকি নড়েচড়ে লাফায়, সে নাকি পড়তে পারে না।
রাফি চোখ বড় বড় করে বলল, ডিসলেক্সিয়া!
শারমিন আর তার বাবা দুজনই রাফির দিকে তাকাল। বাবা ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, কী বললেন?
ডিসলেক্সিয়া। যাদের ডিসলেক্সিয়া থাকে, তাদের এ রকম হয়, লেখাপড়া করতে পারে না। পৃথিবীর অনেক বিখ্যাত মানুষ আছে, যারা খুবই স্মার্ট কিন্তু লেখাপড়া জানে না।
শারমিন রাফির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, এই রোগের চিকিৎসা নাই?
এটা তো রোগ না, এটা হচ্ছে ব্রেনের এক ধরনের সমস্যা। বিদেশে বাচ্চাদের ডিসলেক্সিয়া থাকলে তাদের স্পেশাল স্কুল থাকে। আমাদের দেশে সেরকম কিছু নেই, বাবা-মা, মাস্টাররা মনে করে, বাচ্চাটা দুষ্টু, পড়ায় মনোযোগ নেই, বকাঝকা করে মারধর করে।
শারমিন নিচু গলায় বলল, স্কুলেও আমাকে অনেক মারত।
শারমিনের বাবা অপরাধীর মতো বলল, আমিও কত মেরেছি।
রাফি বলল, মারধর ইজ নো সলিউশন। শারমিনের কোনো দোষ নেই। বেচারি পারে না। ওর ডিসলেক্সিয়া।
শারমিন রাফির কাছে এসে আবার জিজ্ঞেস করল, বিদেশে এই রোগের চিকিৎসা আছে?
মেয়েটির গলার স্বরে এক ধরনের ব্যাকুলতা। রাফির খুব মায়া হলো, নরম গলায় বলল, এটা তো রোগ না, তাই এর চিকিৎসা নেই। কিন্তু যেহেতু এটা একটা সমস্যা, তাই এই সমস্যাটাকে বাইপাস করার উপায় নিশ্চয়ই বের করেছে। যারা অন্ধ, তারাও তো লেখাপড়া করে, তাহলে তুমি পারবে না কেন?
শারমিন ফিসফিস করে, শোনা যায় না, এ রকম স্বরে বলল, স্যার, আমার খুব লেখাপড়া করার ইচ্ছা।
রাফি বলল, নিশ্চয়ই তুমি লেখা পড়া করবে। আমি দেখব।
রাফি টং থেকে উঠে আসার সময় লক্ষ করল, আশপাশে দাঁড়িয়ে থাকা ছাত্রছাত্রীদের বেশ কয়েকজন শারমিনকে ঘিরে দাঁড়িয়েছে। একজন উচ্চস্বরে জিজ্ঞেস করছে, বল দেখি, তিন শ বাইশকে সাত শ নয় দিয়ে গুণ করলে কত হয়?
রাফি হেঁটে চলে গেল বলে শারমিন কী বলল, সেটা ঠিক শুনতে পারল। ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে গেলে এই বাচ্চা মেয়েটির জন্য একটি সমস্যা হতে পারে।
দুই দিন পর রাফি সমস্যার মাত্রাটা টের পেল। নিজের অফিস ঘরে গভীর মনোযোগ দিয়ে ক্লাস লেকচার ঠিক করছে, তখন দরজায় একজন মানুষের ছায়া পড়েছে। রাফি মাথা তুলে তাকিয়ে দেখে লুঙ্গি পরা আধবুড়ো একজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। রাফি জিজ্ঞেস করল, কে? আমার কাছে?
জি।
আসেন।
মানুষটা কুষ্ঠিতভাবে ভেতরে এসে ঢোকে। রাফির কাছে মানুষটিকে চেনা চেনা মনে হয়, কিন্তু সে ঠিক চিনতে পারে না। তখন মানুষটি নিজেই পরিচয় দিল। বলল, স্যার, আমি শারমিনের বাবা।
ও আচ্ছা! হ্যাঁ, বসেন। রাফি নিজেই অবাক হয়ে যায়, সে কেমন করে শারমিনের বাবাকে চিনতে পারল না। এর আগেও এ রকম ব্যাপার ঘটেছে, যে মানুষটিকে যেখানে দেখার কথা, সেখানে দেখলে কখনোই চিনতে ভুল হয় না। কিন্তু যেখানে থাকার কথা না, সেখানে দেখলে চট করে চিনতে পারে না।
শারমিনের বাবা বসল না। কাচুমাচু মুখে বলল, স্যার, বড় বিপদে পড়েছি।
কী বিপদ!
শারমিনকে নিয়ে বিপদ।
রাফি ভুরু কুঁচকে বলল, শারমিনকে নিয়ে?
জি স্যার। বিপদটা কী সেটা না বলে মানুষটি বিব্রত মুখে দাঁড়িয়ে রইল।
রাফি বলল, বলেন, শুনি।
শারমিনের বাবা একটি নিঃশ্বাস ফেলে বলল, অনেক খুঁজে আপনার কাছে এসেছি। আপনি স্যার নতুন এসেছেন, সবাই চিনে না, সে জন্য খুঁজে বের করতে সময় লেগেছে।
হ্যাঁ, আমি নতুন এসেছি।
স্যার, মনে আছে, আপনি সেদিন শারমিনকে অনেক কিছু জিজ্ঞেস করলেন? শারমিন তার উত্তর দিল।
হ্যাঁ। মনে আছে।
তখন অনেক ছাত্রছাত্রী দাঁড়িয়েছিল, তারা ব্যাপারটা দেখেছে। এখন তারা শারমিনকে আর কোনো কাজ করতে দেয় না। বলতে গেলে দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা তাকে জ্বালায়।
জ্বালায়?
জি স্যার।
রাফি জিজ্ঞেস করল, কীভাবে জ্বালায়?
সারাক্ষণ তাকে জিজ্ঞেস করে, গুণ দিলে কত হয়, যোগ দিলে কত হয়—এসব। ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে যাচ্ছে।
রাফি একটু হাসল, বলল, এইটা দুনিয়ার নিয়ম। যে যেটা পারে তাকে সবাই সেটা করতে বলে। যে গান গাইতে পারে তাকে সবাই গান গাইতে বলে। যে হাত দেখতে পারে তাকে দেখলে সবাই হাত বাড়িয়ে দেয়! শারমিনকে একটু সহ্য করতে হবে।
সেইটা সমস্যা না।
রাফি একটু অবাক হয়ে বলল, তাহলে কোনটা সমস্যা? শারমিনের বাবা একটু ইতস্তত করে বলল,স্যার, আপনাকে কীভাবে বলি বুঝতে পারছি না। জানাজানি হলে আমার বিপদও হতে পারে—
রাফির কাছে এবার ব্যাপারটা রহস্যময় মনে হতে থাকে। সে মানুষটির দিকে খানিকটা বিস্ময় এবং অনেকখানি কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে থাকে। মানুষটি একবার মাথা চুলকালো, তারপর গাল চুলকালো, তারপর নিচু গলায় বলল, স্যার, আমরা যে এই টংঘরগুলো চালাই সেই জন্য আমাদের নিয়মিত চাঁদা দিতে হয়।
চাঁদা? কাকে চাঁদা দিতে হয়?
ছাত্রনেতাদের। তারা এসে যখন খুশি ফাও খায়, আবার দৈনিক চাঁদা নেয়।
কী আশ্চর্য!
না স্যার, এর মধ্যে আশ্চর্যের কিছু নাই। এইটাই নিয়ম, যখন যেই দল ক্ষমতায়, তখন সেই দলকে চাঁদা দিই। সেইটা সমস্যা না। সেইটা আমরা সবাই মেনে নিয়েছি।
তাহলে সমস্যাটা কী?
শারমিনের বাবা আরেকটু এগিয়ে এসে এদিক-সেদিক তাকিয়ে বলল, ক্যাম্পাসে এখন যে সবচেয়ে বড় ছাত্রনেতা, তার নাম হান্নান। অনেক বড় মাস্তান, সবাই ডাকে ভোটকা হান্নান।
কী করেছে ভোটকা হান্নান?
সেই দিন আমার টংয়ে এসে আমারে জিজ্ঞেস করে, এই, তোর মেয়ে নাকি অঙ্কের এক্সপার্ট। আমি বললাম, সেইটা তো জানি না, তাকে যোগবিয়োগ করতে দিলে করতে পারে। তখন ভোটকা হান্নান শারমিনকে টেস্ট করল। যেটাই গুণ দিতে বলে শারমিন করে দেয়। তখন, তখন মানুষটি হঠাৎ কথা বন্ধ করে থেমে গেল।
তখন কী?
ভোটকা হান্নান এখন শারমিনরে তুলে নিতে চায়।
তুলে নিতে চায়? রাফি তার চেয়ারে সোজা হয়ে বসল। বলল, তুলে নিতে চায় মানে কী?
শারমিনরে নাকি ঢাকায় নিয়ে যাবে, টেলিভিশনে দেখাবে। শারমিনের বাবা একেবারে কাঁদো কাঁদো হয়ে গেল। বলল, স্যার, আপনি যদি আমারে বলতেন শারমিনরে ঢাকায় টেলিভিশনে নিবেন, স্যার আমি তাহলে খুশি হয়ে রাজি হতাম। আপনি সেদিন মেয়েটারে বলেছেন, তাকে লেখাপড়ার ব্যবস্থা করে দেবেন। মেয়েটা কী খুশি! বাড়িতে গিয়ে তার মাকে কতবার সেই কথাটা বলেছে। স্যার, আপনাদের ওপর ভরসা করে আমরা থাকি। তাই বলে ভোটকা হান্নান? সে কেন আমার এই ছোট মেয়েটার দিকে নজর দিবে?
রাফি মাথা নাড়ল। বলল, না না, এটা তো হতেই পারে না। আমি দেখি কী করা যায়।
কিন্তু স্যার ভোটকা হান্নান যদি জানে আমি আপনার কাছে নালিশ দিয়েছি, তাহলে স্যার আমার লাশ পড়ে যাবে স্যার।
তাহলে কেমন করে হবে? আমি যদি ইউনিভার্সিটির প্রক্টর বা কাউকে বলতে যাই–
না না স্যার, সর্বনাশ! কাউরে বলা যাবে না।
তাহলে?
স্যার, আপনি বলেছিলেন না শারমিনের একটা ব্যারাম আছে। কঠিন ব্যারাম—ডিষ্টিমিষ্টি না কী যেন নাম।
ব্যারাম নয়, একটা ডিজঅর্ডার, ডিসলেক্সিয়া।
জি স্যার। আমি ভোটকা হান্নানকে সেটা বলেছি। আমি বলেছি, আপনি তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করছেন। আপনার পারমিশন ছাড়া শারমিনকে কোথাও নেওয়া যাবে না।
গুড। রাফি হাসি হাসি মুখে বলল, ভেরি গুড। বুদ্ধিমানের মতো কথা বলেছেন।
ভোটকা হান্নান যদি আপনার কাছে আসে, আপনি তারে বলবেন, শারমিনকে কোথাও নেওয়া ঠিক হবে না।
ঠিক আছে বলব। আপনি চিন্তা করবেন না।
শারমিনের বাবা চলে যাওয়ার পরও রাফি চুপচাপ তার ডেস্কে বসে রইল। এই দেশে সাধারণ মানুষের জীবনটা বড় কঠিন।
মঙ্গলবার বিকেল পাঁচটার পর ডিপার্টমেন্টের সব শিক্ষক তাদের সাপ্তাহিক মিটিং করতে বসে। এই মঙ্গলবার মিটিংটা শুরু করার পর দেখা গেল আলোচনা করার মতো গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয় নেই। রাশেদ স্যার সুযোগ পেলেই জটিল একটি গবেষণার বিষয় নিয়ে কথা বলতে শুরু করবেন বলে কম বয়সী লেকচারাররা একটার পর একটা হালকা বিষয় নিয়ে আলাপ করতে শুরু করল। প্রফেসর হাসান সেই বিষয়গুলো সমান উৎসাহে আলোচনা করতে থাকলেন। একসময় রোফির দিকে তাকিয়ে বললেন, তারপর রাফি তোমার ক্লাস কেমন চলছে?
রাফি বলল, ভালো স্যার।
সুহানা বলল, ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে ভীষণ পপুলার। বিশেষ করে ছাত্রীদের মধ্যে।
সব শিক্ষক শব্দ করে এক ধরনের উচ্ছ্বাস প্রকাশ করল। প্রফেসর হাসান ভুরু কুঁচকে বললেন, কী ব্যাপার? একজন ইয়ং হ্যান্ডসাম মানুষকে তার ছাত্রীরা পছন্দ করছে—তাতে তোমরা এত হিংসা করছ কেন?
রানা বলল, না স্যার, আমরা মোটেও হিংসা করছি না—শুধু একটু সতর্ক করে দিতে চাইছি।
কী নিয়ে সতর্ক করবে?
ওদের হাইফাই ইউনিভার্সিটির ছাত্রীরা লেখাপড়া ছাড়া কিছু বোঝে —সবাই হচ্ছে লেবদু টাইপের। আমাদের ইউনিভার্সিটির ছাত্রীদের অসম্ভব তেজ!
কবির বলল, সুহানাকে দেখলেই বোঝা যায়!
সুহানা প্রতিবাদ করে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই প্রফেসর হাসান রাফিকে জিজ্ঞেস করলেন, নতুন জায়গা, নতুন পরিবেশ, তোমার কোনো সমস্যা হচ্ছে না তো? আমি খোঁজও নিতে পারছি না—
না স্যার কোনো সমস্যা হচ্ছে না। সবাই খুব হেল্পফুল। ক্লাসও খুব ইন্টারেস্টিং, ক্লাসের বাইরেও খুব ইন্টারেস্টিং।
সুহানা জানতে চাইল, ক্লাসের বাইরে ইন্টারেস্টিং কী হলো?
রাফি বলল, আমরা যে টংয়ে চা খেতে যাই, সেখানে শারমিন নামের একটা ছোট মেয়ে আছে। সেই মেয়েটা যেকোনো ডিজিটের সংখ্যা দিয়ে যেকোনো ডিজিটের সংখ্যা গুণ করে ফেলতে পারে। আমার মোবাইলে যে ক্যালকুলেটর আছে সেটা নয় ডিজিটের—আমি সেটা দিয়ে টেস্ট করেছি।
রাশেদ বললেন, নয় ডিজিট তো অনেক।
রাফি বলল, হ্যাঁ। আমরা দুই ডিজিটের সংখ্যাকে কষ্ট করে পারি। ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হচ্ছে, মেয়েটার এক মুহূর্ত দেরি হয় না—তাকে কিছু করতে হয় না, সঙ্গে সঙ্গে বলে দেয়।
রানা বলল, আশ্চর্য তো! আমাদের শারমিন? টংয়ের শারমিন?
হ্যাঁ।
সুহানা বলল, আমরা চা-শিঙাড়া খেলেই সে বিল বলে দেয়। আমি মনে করতাম, বানিয়ে বানিয়ে বলছে।
রাফি বলল, ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হচ্ছে, মেয়েটার কোনো ফরমাল লেখাপড়া নেই। এক শ পর্যন্ত গুণতে পারে। যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগ—এসবের কনসেপ্ট নেই। এমনি গুণ করতে বললে পারে না—একটু ঘুরিয়ে বলতে হয়। এতজন মানুষ এতগুলো বিস্কুট খেয়েছে, বিল কত হবে—এভাবে!
রাশেদ মাথা নাড়লেন, বললেন, মোস্ট ইন্টারেস্টিং!
রাফি বলল, আমি লেখাপড়ার কথা জিজ্ঞেস করলাম। ওর বাবা বলল, শারমিন লেখাপড়া করতে পারে না। কথা শুনে মনে হলো ডিসলেক্সিয়া।
সুহানা জিজ্ঞেস করল, ডিসলেক্সিয়া কী?
রাফি ইতস্তত করে বলল, এক ধরনের লারনিং ডিজঅর্ডার। কাগজের লেখা মনে হয় উল্টে গেছে।
প্রফেসর হাসান মাথা নাড়লেন, বললেন, হ্যাঁ। আসলে আমরা যে লেখাপড়া করি, এটা কিন্তু খুবই নতুন একটা ব্যাপার—হয়তো মাত্র কয়েক শ বছরের ব্যাপার। আদিম মানুষ লেখাপড়া করত না। কাজেই বলতে পারো আমাদের অনেকের ব্রেন সেটার জন্য রেডি হয়নি—সেটা হচ্ছে ডিসলেক্সিয়া। আমরা যে রকম লেখা পড়তে পারি, অর্থাৎ আমাদের ব্রেন যেভাবে একটা গ্রাফিক সিম্বলকে ইন্টারপ্রেট করতে পারে, ডিসলেক্টিক মানুষেরা পারে না।
সুহানা জানতে চাইল, এর চিকিৎসা নেই স্যার?
ঠিক চিকিৎসা নেই, তবে এটাকে মেনে নিয়ে মানুষজন অন্যভাবে লিখতে-পড়তে শেখে। এর সঙ্গে আইকিউয়ের কোনো সম্পর্ক নেই। অনেক স্মার্ট মানুষ আছে, যাদের ডিসলেক্সিয়া। আমার ধারণা, বাদশাহ আকবরের ডিসলেক্সিয়া ছিল!
কেন স্যার?
আকবর খুব স্মার্ট মানুষ ছিল, কিন্তু লেখাপড়া শেখেনি! মনে হয়, শিখতে পারেনি ডিসলেক্সিয়ার কারণে।
রাফি জিজ্ঞেস করল, ডিসলেক্সিয়া হলে কীভাবে লেখাপড়া করে?
আমি ঠিক জানি না। অনেক দিন আগে টেলিভিশনে একটা প্রোগ্রাম দেখেছিলাম। একদল রিসার্চারের ধারণা, সাদার ওপরে কালো লেখাটা হচ্ছে সমস্যা। সাদার বদলে লাল কাগজে লিখলেই অনেক ডিসলেক্টিক মানুষ পড়তে পারে। যদি লাল কাচের চশমা পরে কিংবা লাল আলোতে চেষ্টা করে, তাহলে অনেকেই নাকি পড়তে পারে।
রাফি অবাক হয়ে বলল, ইন্টারেস্টিং!
প্রফেসর হাসান বললেন, তবে টেলিভিশনের সব কথা বিশ্বাস করতে নেই। বেশির ভাগই ভুয়া।
কবির বলল, কিন্তু শারমিনের নয় ডিজিটের সংখ্যা গুণ করার ক্ষমতাটা তো খুবই ইন্টারেস্টিং! আমাদের এত দিন ধরে চা খাওয়াচ্ছে আমরা জানি না, আর রাফি এসে এক দিনে বের করে ফেলল।
সুহানা বলল, তোদের গলায় দড়ি দিয়ে মরা উচিত।
আমি একা কেন, তোদেরও গলায় দড়ি দিয়ে মরা উচিত।
ঠিকই বলেছিস, আমাদের সবার গলায় দড়ি দিয়ে মরা উচিত।
প্রফেসর হাসান বললেন, মরতে চাইলে মরো, কিন্তু তার আগে সবাই নিজের নিজের পরীক্ষার খাতা দেখে কমিটির কাছে জমা দেবে।
রানা বলল, স্যার, আপনার জন্য আমরা শান্তিতে মরতেও পারব না?
না। পারবে না।
সুহানা বলল, শারমিন মেয়েটির যদি ডিসলেক্সিয়া না থাকত তাহলে অনেক বড় ম্যাথমেটিশিয়ান হতে পারত?
প্রফেসর হাসান বললেন, নো নো! ডোন্ট গেট ইট রং। মাথার ভেতরে বড় বড় গুণ করে ফেলার ক্ষমতা আর ম্যাথমেটিশিয়ান হওয়া এক জিনিস না। এক শ টাকার ক্যালকুলেটরও বড় বড় গুণ করতে পারে। তার মানে এই না যে এক শ টাকার ক্যালকুলেটর খুব বড় ম্যাথমেটিশিয়ান!
তার মানে এই গিফটার কোনো গুরুত্ব নেই?
যদি শুধু বড় বড় গুণ করতে পারে আর কিছু পারে না, তাহলে সে রকম। গুরুত্ব নেই। ইন্টারেস্টিং কিন্তু সে রকম গুরুত্বপূর্ণ না। মাঝেমধ্যেই এ রকম মানুষ পাওয়া যায়। কম্পিউটার আবিষ্কার হওয়ার আগে এ রকম মানুষ খুব ইউজফুল ছিল। গাউস তার জীবনে এ রকম মানুষকে ব্যবহার করে অনেক ক্যালকুলেশন করেছেন।.
রাশেদ বললেন, অনেক অটিস্টিক স্যাভেন্ট আছে যারা এ রকম পারে। আর কিছু পারে না, কিন্তু এ রকম ক্যালকুলেশন করতে পারে। পাইয়ের মান কয়েক শ ডিজিট পর্যন্ত বের করে ফেলতে পারে!
তাই? সুহানার কেমন যেন মন খারাপ হলো। বলল, আমি আরও ভাবছিলাম শারমিন এখন ফেমাস হয়ে যাবে। এত কিউট একটা মেয়ে কত কষ্ট করে, তার টাকা-পয়সার সমস্যা মিটে যাবে।
প্রফেসর হাসান বললেন, সেটা হয়তো হতে পারে। আজকালকার টিভি চ্যানেলগুলো যদি খবর পায়, তাহলে তাকে নিয়ে প্রোগ্রাম শুরু করে দেবে—কিন্তু ইন দ্য লং রান ব্যাপারটা ভালো হয় না। ছোট বাচ্চাদের। ফেমাস বানানো ঠিক না। ক্ষতি হয়।
রাফির মুখ নিশপিশ করছিল ভোটকা হান্নানের কথা বলার জন্য, কিন্তু সে বলল। শারমিনের বাবা খুব করে বলে দিয়েছে সে যেন কাউকে না বলে। তবে বিষয়টি নিয়ে প্রফেসর হাসানের সঙ্গে কথা বলা যায়—এই মানুষটি অনেক কিছু জানেন। তাকে বললে মনে হয় ঠিক ঠিক সাহায্য করতে পারবেন। ইউনিভার্সিটিতে নতুন এসেই সে ভোটকা হান্নানদের সঙ্গে ঝামেলা করতে চায় না।
মিটিং শেষে যখন সবাই চলে গেল, তখন রাফি প্রফেসর হাসানের কাছে গিয়ে বলল, স্যার আপনার সঙ্গে একটু কথা ছিল।
প্রফেসর হাসান বললেন, নিরিবিলি?
জি স্যার। নিরিবিলি।
বল।
কথাটা শারমিন নামের মেয়েটিকে নিয়ে।
প্রফেসর হাসান বললেন, কী কথা?
আমি যখন শারমিনের গুণ করার ক্ষমতাটা টেস্ট করছি, তখন আশপাশে অনেক ছাত্রছাত্রী ছিল, তার ব্যাপারটা জেনে গেছে।
তারা এখন মেয়েটাকে জ্বালাচ্ছে?
তা একটু জ্বালাচ্ছে, কিন্তু সেটা সমস্যা না। সমস্যা অন্য জায়গায়।
কোন জায়গায়?
একটা মাস্তান ছাত্রনেতা শারমিনকে তুলে নিতে চাচ্ছে।
প্রফেসর হাসান ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন, শারমিনের বয়স কত?
দশ-এগার হবে।
এত ছোট মেয়েকে তুলে নিতে চাচ্ছে কেন?
তাকে টিভি চ্যানেলে নিয়ে যাবে।
প্রফেসর হাসান হতাশার ভঙ্গি করে মাথা নাড়লেন, বললেন, মাস্তানের নাম কী? নাম কী?
রাফি বলল, তার বাবা কাউকে বলতে না করেছে, সেই জন্য সবার সামনে বলিনি। নাম হান্নান। সবাই ডাকে ভোটকা হান্নান।
কখনো নাম শুনিনি। যাই হোক মেয়ের বাবাকে বলো চিন্তা না করতে। উই উইল টেক কেয়ার।
আপনাকে হয়তো কিছু করতে হবে না, শারমিনের বাবা হান্নানকে বুঝিয়েছে শারমিনের খুব কঠিন অসুখ। অসুখের নাম ডিসলেক্সিয়া। আমি তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করছি। কাজেই আমি অনুমতি না দিলে তাকে কোথাও নেওয়া যাবে না।
প্রফেসর হাসান হাসলেন, ভালোই বলেছে। স্মার্ট ম্যান।
কাজেই মনে হয় আমার কাছে ওই মাস্তান আসবে। আমি বোঝানোর চেষ্টা করব। আপনাকে জানিয়ে রাখলাম।
ভালো করেছ। দরকার হলে আমি দেখব। ওই মাস্তানদের কোনো পাত্তা দেবে না।
রাফি মাথা নাড়ল। বলল, না স্যার পাত্তা দেব না।
পরদিন সকালে রাফি ইন্টারনেটে ডিসলেক্সিয়া নিয়ে পড়াশোনা করছে, অবাক হয়ে দেখল আইনস্টাইন, পাবলো পিকাসো, টমাস এডিসন থেকে শুরু ওয়াল্ট ডিজনি, টম ক্রুজ—সবাই নাকি ডিসলেক্সিক! মনে হচ্ছে। ডিসলেক্সিয়া না হওয়া পর্যন্ত কোনো সৃজনশীল কাজ করা যায় না।
ঠিক এ রকম সময় দরজা থেকে নাকি গলার স্বরে কে যেন বলল, আসতে পারি?
রাফি তাকিয়ে দেখে অসম্ভব শুকনো একজন ছেলে, টেলিভিশনে এইডসের রোগীদের অনেকটা এ রকম দেখায়। গালভাঙা এবং কোটরাগত চোখ, তবে মাথায় বাহারি চুল। রাফি বলল, আসো।
ছেলেটি ভেতরে ঢুকে বলল, আপনার সঙ্গে একটা বিষয় নিয়ে কথা বলতে এসেছি।
তুমি কে?
ছেলেটি একটু থতমত খেয়ে বলল, আমার নাম হান্নান।
তুমি কি আমাদের ডিপার্টমেন্টের ছাত্র?
না। আমি ফিলোসফি ডিপার্টমেন্টের। ফোর্থ ইয়ার সেকেন্ড সেমিস্টার।
কী ব্যাপার। বলো।
আমাকে চিনেছেন স্যার? ক্যাম্পাসে সবাই আমাকে চিনে।
আমি নতুন এসেছি সবাইকে চিনি না।
আমি তো স্যার ছাত্র সংগঠন করি, আমাকে অনেকে ভোটকা হান্নান বলে।
রাফি এবার কষ্ট করে তার বিস্ময় গোপন করল। বলল, ও আচ্ছা। তোমাকে ভোটকা হান্নান ডাকে?
ছেলেটি একটু হাসল, তার প্রয়োজনের চাইতে বেশি দাত, দাঁতের রং হলুদ, মাঢ়ির রং কালো। বলল, জি স্যার।
নামটা ঠিক হয়নি।
জানি স্যার।
সময় কী বলবে বলো।
ভোটকা হান্নান কীভাবে কথাটা শুরু করবে, রাফি সেটা শোনার জন্য আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে।
ভোটকা হান্নান গলা খাকাড়ি দিয়ে বলল, আমাদের যে টংগুলো আছে। সেখানে মাহতাবের একটা টং আছে। খুবই গরিব স্যার, আমরা হেল্প করার জন্য এই টংটা বানিয়ে দিয়েছি।
রাফি বলল, ভেরি গুড।
মাহতাবের ছোট মেয়ে তার বাবাকে সাহায্য করে, আমরাও দেখেশুনে রাখি। সেই মেয়ে নাকি বড় বড় গুণ মুখে মুখে করে ফেলে। আমি ভাবলাম, মেয়েটাকে একটু সাহায্য করি।
ভোটকা হান্নান তার মুখে একটা গাম্ভীর্য ধরে রেখে বলল, ঢাকায় টিভি চ্যানেল, পত্রিকার সঙ্গে আমার যোগাযোগ আছে। আমি ভাবছি কয়েকটা চ্যানেলে প্রোগ্রাম করিয়ে—
রাফি এবার তাকে থামাল। বলল, দেখো হান্নান, ওই মেয়েটা যে এভাবে গিফটেড সেটা কেউ জানত না। আমি বের করেছি। আমি আরও একটা জিনিস বের করেছি, সেটা হচ্ছে মেয়েটা সিরিয়াসলি ডিসলেক্টিক। ওই মেয়েটার সাহায্য দরকার, রেডিও-টেলিভিশনে তার এক্সপোজারের কোনো দরকার নেই।
কিন্তু স্যার যদি টেলিভিশনে দেখিয়ে সাহায্য চাওয়া যায়—
ছিঃ! সাহায্য চাইবে কেন? সাহায্য মানে তো ভিক্ষা, এই বাচ্চা মেয়ে ভিক্ষা করবে কেন?
ভোটকা হান্নান একটু থতমত খেয়ে গেল। টাকা-পয়সা তার কাছে সব সময়ই অমূল্য জিনিস, সেটা চাঁদাবাজি করেই আসুক আর ভিক্ষে করেই আসুক, সেটাকে কেউ এভাবে ছিঃ বলে উড়িয়ে দিতে পারে, আগে বুঝতে পারেনি। সে আবার চেষ্টা করল। বলল, টেলিভিশনে দেখালে একটা পরিচিতি হবে–
রাফি এবার একটু কঠিন মুখ করে বলল, দেখো হান্নান, তুমি আমার কাছে কেন এসেছ জানি না। আমি এই ইউনিভার্সিটির সবচেয়ে জুনিয়র টিচার, এক সপ্তাহও হয়নি জয়েন করেছি। এই মেয়েটিকে নিয়ে তুমি টিভিতে যাবে, না সিনেমাতে যাবে সেটা নিয়ে আমার সাথে কথা বলার দরকার থাকার কথা নয়। কিন্তু ঘটনাক্রমে যে কারণে তুমি তাকে টিভিতে নিতে যাচ্ছাে, সেই কারণটা আমি বের করেছি। কাজেই আমার একটু দায়দায়িত্ব এসে পড়েছে। বুঝেছো?
জি স্যার, কিন্তু–
আমার কথা আগে শেষ করি। রাফি মুখ আরও কঠিন করে বলল, আমি এই মেয়ের গার্জিয়ান না, কিন্তু যে গার্জিয়ান তাকে বলল, যদি সে মেয়ের ভালো চায়, যেন কোনোভাবেই তাকে রেডিও-টেলিভিশনে না পাঠায়।
কিন্তু স্যার, আমি অলরেডি চ্যানেলে, খবরের কাগজে যোগাযোগ করেছি, তারা রাজি হয়েছে।
আবার যোগাযোগ করো। করে বলো সম্ভব নয়।
ভোটকা হান্নান এবার তার নিজের মুখটা কঠিন করে বলল, না স্যার, আমি সেটা করব না। যেহেতু কথা দিয়েছি, কথা রাখতে হবে স্যার।
ভেরি গুড। কিন্তু তুমি আমার কাছে কেন এসেছ? যদি জোর করে এই মেয়েকে তুলে নিতে চাও, সেটা তোমার ব্যাপার। বাচ্চা মেয়ে গার্ডিয়ানের অনুমতি ছাড়া তুলে নিয়ে স্ট্রেট শিশু অপহরণের মামলায় পড়ে যাবে।
ভোটকা হান্নান তার কালো মাঢ়ি এবং দুই প্রস্থ হলুদ দাঁত বের করে হেসে বলল, আমার বিরুদ্ধে মামলা দেওয়ার সাহস কেউ করবে না! আপনি নতুন এসেছেন তাই জানেন না। এমনি এমনি আমার নাম ভোটকা হান্নান হয়নি।
ঠিক আছে ভোটকা হান্নানতুমি যেটা করতে চাও করো। আমি আমাদের হেডকে জানাব। স্যার। যদি চান প্রক্টর, ভিসি, পুলিশকে জানাবেন। তুমি তোমারটা করবে, আমি আমারটা করব।
ভোটকা হান্নানকে এবার একটু দুর্বল দেখাল, মাথা চুলকে বলল, আমি ভাবলাম গরিব ফ্যামিলি সাহায্য করি। আপনি দেখি উল্টা কথা বলছেন।
এটা উল্টা কথা না, এটা সোজা কথা। ছোট বাচ্চাকে ছোট বাচ্চাদের মতো থাকতে দিতে হয়। টেলিভিশনে টানাটানি করতে হয় না।
কিন্তু স্যার অলরেডি মোবাইল করে দিয়েছি।
আবার মোবাইল করে দাও। যাও।
ভোটকা হান্নানকে কেমন জানি মনমরা দেখাল। সে তার গাল চুলকাতে চুলকাতে বের হয়ে গেল।