০৪. অ্যাসিসট্যান্ট এডিটর

অ্যাসিসট্যান্ট এডিটর বাকের ঈশিতাকে বলল, এই যে নাও, এই চিঠিগুলো তোমার জন্য।

ঈশিতা বলল, থাক, আমি এমনিতেই বেশ আছি, তোমার চিঠি না হলেও চলবে!

বাকের প্রত্যেক দিন চিঠিগুলো থেকে উদ্ভট চিঠিগুলো আলাদা করে ঈশিতাকে পড়তে দেয়। সারা দেশ থেকে বিচিত্র বিচিত্র চিঠি আসে, কারও জিনের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও গ্রামে মানুষখেকো বিচিত্র প্রাণী, কেউ কবর দেওয়ার পর জীবন্ত হয়ে উঠে এসেছে, কারও গ্রামে দুই মাথাওয়ালা বাছুর জন্ম দিয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি। বাকের বলল, পড়ে দেখো। আজকের চিঠিতে তুমি পাবে মাত্র দশ হাজার টাকার মনুষ্যরূপী কম্পিউটার।

মনুষ্যরূপী কম্পিউটার? এবার ঈশিতা একটু কৌতূহল দেখাল, কোথায়, দেখি?

বাকের একটা খাম ঈশিতার দিকে এগিয়ে দিল। ঈশিতা চিঠি খুলে পড়ে। হেলাল নামের একজন লিখেছে—তাকে মাত্র দশ হাজার টাকা দিলেই সে খবরের কাগজে মানুষ কম্পিউটারের সঙ্গে ইন্টারভিউয়ের ব্যবস্থা করে দেবে। এই মানুষ কম্পিউটারের বিস্তৃত বর্ণনা দেওয়া আছে, সে বার বছরের বালিকা, চোখের পলকে যেকোনো সংখ্যার সঙ্গে অন্য যেকোনো সংখ্যা গুণ করে ফেলতে পারে। চিঠির নিচে একটা মোবাইল ফোনের নম্বর দেওয়া আছে।

বাকের জিজ্ঞেস করল, কী? মাত্র দশ হাজার টাকায় মানুষ কম্পিউটার কিনতে চাও? কোন অপারেটিং সিস্টেম দেবে বলেছে?

ঈশিতা হাসল। বলল, না হার্ড ড্রাইভের সাইজ কিংবা অপারেটিং সিস্টেম কিছুই দেওয়া নেই। তার পরও হয়তো আমি ফোন করতাম, কিন্তু এই দশ লাইনের চিঠিতে প্রায় দুই ডজন বানান ভুল। যে চিড়িয়া দন্ত্যস দিয়ে মানুষ বানান করে তাকে সিরিয়াসলি নেওয়া ঠিক না।

তারপরও ঈশিতা হেলাল নামের মানুষটির টেলিফোন নম্বরটা টুকে রাখল। কিছুদিন আগে এনডেভারের সঙ্গে তার সেই অভিজ্ঞতার পর থেকে যে কয়েকটা বিষয় নিয়ে তার কৌতূহল হয়েছে, তার একটা হচ্ছে নিউরাল নেটওয়ার্ক। বিষয়টা নিয়ে সে কিছুই জানত না। গত কিছুদিন থেকে সে পড়াশোনা করার চেষ্টা করছে। সে জার্নালিজমের ছাত্রী। বিজ্ঞান, গণিত, কম্পিউটার—এসব খুঁটিনাটি বিষয় ভালো বোঝে না। কী পড়াশোনা করবে, বুঝতে পারছে না। তাই ইন্টারনেট থেকে কিছু জিনিসপত্র ডাউনলোড করে পড়ার চেষ্টা করছে। ইন্টারনেটের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, সে ঠিক যে বিষয়টা জানতে চায় সেটা ছাড়া সেখানে অন্য সবকিছু আছে। যদি ঠিক সেই বিষয়টা পেয়েও যায়, তাহলে সেটা হয় এমন দুর্বোধ্যভাবে লেখা আছে, যা পড়ে মাথামুণ্ডু কিছু বোেঝার উপায় নেই, কিংবা হাস্যকর ছেলেমানুষিভাবে লেখা যে সেটা পড়ে পুরো বিষয়টা সম্পর্কে একটা ভুল ধারণা হয়ে যায়। তার প্রয়োজন একজন মানুষের যে এটি সম্পর্কে জানে এবং যে তাকে একটু সময় দেবে। ঈশিতার বয়স বেশি না, সেজেগুজে থাকলে তাকে মনে হয় বেশ ভালোই দেখায়, যদিও সে কখনোই সেজেগুজে থাকে না। কাজেই যাদের একটু সময় দেওয়া দরকার, দেখা যায় তারা প্রয়োজনের চেয়ে বেশি সময় দিচ্ছে এবং সময়টা দিচ্ছে ভুল জায়গায়!

ঈশিতা যদিও বলেছিল, দন্ত্যস দিয়ে মানুষ বানান করা হেলাল নামের সেই মানুষটিকে সিরিয়াসলি নেওয়া ঠিক না। তার পরও বিকেলের দিকে সে তাকে ফোন করল। যে ফোন ধরল, তার গলার স্বর আনুনাসিক, মনে হলো মানুষটির সর্দি হয়েছে। ঈশিতা জিজ্ঞেস করল, আমি কি হেলাল সাহেবের সঙ্গে কথা বলছি?

জে। কথা বলছি।

আমরা আপনার একটা চিঠি পেয়েছি। আপনি বলেছেন আপনি একজন মানুষ কম্পিউটারকে চেনেন, আপনাকে দশ হাজার টাকা দিলে আপনি তার সঙ্গে ইন্টারভিউ করার ব্যবস্থা করে দেবেন।

জি বলেছিলাম। কিন্তু—

কিন্তু কী? একটা সমস্যা হয়েছে।

কী সমস্যা?

সেটা শুনে লাভ নাই। আপনি বুঝবেন না। সোজা কথায় দশ হাজার টাকায় হবে না। মেয়েটার বাপ বেঁকে বসেছে।

ঈশিতা খুব মিষ্টি করে বলল, আসলে আমি কিন্তু একবারও বলিনি যে আমরা টাকা দিয়ে এই খবরটা পেতে চাচ্ছি। নীতিগতভাবে আমরা টাকা দিয়ে খবর কিনি না। মেয়েটার বাবা যদি রাজি না থাকেন তাহলে তো কিছু করার নেই।

আসলে মেয়ের বাপ মহা ধুরন্ধর।

ঈশিতা হঠাৎ করে প্রশ্ন করল, আপনি কী করেন?

আমি? আমি স্টুডেন্ট। ইউনিভার্সিটিতে পড়ি। কেন?

না না, এমনি জানতে চাইছি। কোন ইউনিভার্সিটিতে পড়েন?

ছেলেটি ইউনিভার্সিটির নাম বলল, মনে হলো একটু অহংকারের সঙ্গেই। মফস্বল শহরের ছোট ইউনিভার্সিটি, সেটা নিয়ে এই হাবাগোবা ছেলেটির এত অহংকার কেন কে জানে। ঈশিতা তার সাংবাদিকসুলভ কায়দায় শেষ চেষ্টা করল। সে জানে রথী মহারথী থেকে শুরু করে খুব সাধারণ মানুষ, সবারই পত্রিকায় ছবি ওঠানোর শখ থাকে। তাই সে বলল, আমরা টাকা দিয়ে কোনো খবর কিনতে পারব না, কিন্তু আপনি যদি এমনি আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেন রিপোর্টিং করার সময় আপনার ছবি রেফারেন্স দিতে পারি।

এই কথাটায় ম্যাজিকের মতো কাজ হলো। টেলিফোনের অন্য পাশে হেলাল নামের ছেলেটি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ঠিক আছে ম্যাডাম, আপনি যখন এভাবে বলছেন, দেখি চেষ্টা করে। সমস্যা হয়েছে একজন চ্যাংড়া টিচার নিয়ে।

কী হয়েছে এই চ্যাংড়া টিচারের?

এই হ্যানো ত্যানো বড় বড় কথা! বাচ্চা মেয়ে, তাকে রেডিওটেলিভিশনে নেওয়া ঠিক না—এই সব বড় বড় বোলচাল।

আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবেন— ঈশিতা বলল, আমি আপনার চ্যাংড়া টিচারকে ম্যানেজ করে নেব।

 

রাফি লেকচার তৈরি করতে করতে মুখ তুলে দেখে দরজায় ফতুয়া এবং জিন্স পরা তেজি ধরনের একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটির কাঁধ থেকে বিশাল একটা ক্যামেরা ঝুলছে। মেয়েটি ঈশিতা এবং রাফি ঘুণাক্ষরেও অনুমান করতে পারেনি সে তাকে ম্যানেজ করতে ঢাকা চলে এসেছে। রাফি থতমত খেয়ে বলল, আমার কাছে?

আপনি কি রাফি?

হ্যাঁ।

তাহলে আপনার কাছে। ঈশিতা ভেতরে ঢুকল, একটা চেয়ার টেনে বসল, ক্যামেরাটা টেবিলের ওপর রেখে বলল, আমার নাম ঈশিতা। আমি

একটা পত্রিকায় কাজ করি। ঢাকা থেকে এসেছি।

রাফি ঈশিতার দিকে তাকিয়ে থাকে। ঈশিতা হাসিমুখ করে বলল, পত্রিকার মানুষকে অনেকে ভয় পায়। আমাকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই।

রাফি বলল, না, আমি ভয় পাচ্ছি না। আমি মাকড়সা ছাড়া আর কিছু ভয় পাই না।

বলতেই হবে আপনি খুব সাহসী মানুষ। আমি তেলাপোকা, জোঁক, কেঁচো, সাপ এবং অন্য যেকোনো পিছলে জিনিস যেটা নড়ে সেটাকে ভয় পাই।

রাফি হাসার ভঙ্গি করে ঈশিতার দিকে তাকিয়ে অনুমান করার চেষ্টা করল, সে কেন তার কাছে এসেছে। ঢাকা থেকে একজন সাংবাদিকের তার কাছে চলে আসার খুব বেশি কারণ থাকার কথা নয়—সম্ভবত কোনোভাবে শারমিনের খোঁজ পেয়েছে।

ঈশিতা হঠাৎ মাথাটা একটু এগিয়ে গলা নামিয়ে বলল, আমি আসলে আপনাকে ম্যানেজ করতে এসেছি!

ম্যানেজ করতে? রাফি চোখ বড় বড় করে বলল, আমাকে?

হ্যাঁ। আপনাদের একজন ছাত্রের সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয়েছে, নাম হেলাল। সে আমাকে বলেছে, আপনাকে যদি আমি কোনোভাবে ম্যানেজ করতে পারি, তাহলে সে আমাকে একটা মানুষ কম্পিউটার দেখাবে!

আমাকে ম্যানেজ করলে?

হ্যাঁ।

কীভাবে ম্যানেজ করবেন, ঠিক করেছেন?

এখনো করিনি। সেই জন্য আগে আপনাকে একটু দেখতে চেয়েছিলাম!

দেখেছেন?

হ্যাঁ। এখন মনে হচ্ছে আসলে ম্যানেজ করার দরকার নেই। হয়তো ম্যানেজ না হয়েই আমাকে একটু সাহায্য করতে পারবেন।

কী সাহায্য?

ঈশিতা কয়েক মুহূর্ত কিছু একটা ভাবল, তারপর বলল, আমি জার্নালিজম পড়েছি। কম্পিউটার ব্যবহার করতে পারি, ই-মেইল পাঠাতে পারি, গুগলে সার্চ দিতে পারি, ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিতে পারি কিন্তু কম্পিউটার কীভাবে কাজ করে, তার কিছু জানি না। জানার দরকারও ছিল না, কোনো উৎসাহও ছিল না। কিন্তু–

কিন্তু?

কিন্তু এখন আমার হঠাৎ খুব জানার দরকার, কম্পিউটার কীভাবে কাজ করে। বইপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করে, ইন্টারনেটে ঠেলাঠেলি করে কিছু একটা হয়তো জানতে পারতাম—কিন্তু তাতে সমস্যা হচ্ছে যে আমি তখন ঠিক জিনিসটা শিখতে পারতাম না। আমার মনে হলো, যদি কেউ আমাকে একটু বলে দিত তাহলে আমি জিনিসটা ঠিক করে বুঝতে পারতাম।

রাফি ইতস্তত করে বলল, কম্পিউটার কীভাবে কাজ করে, সেটা আমার কাছ থেকে জানার জন্য আপনি ঢাকা থেকে চলে এসেছেন? আজকাল কত বই, কত কম্পিউটার সায়েন্স ডিপার্টমেন্ট, কত কম্পিউটার সেন্টার।

হ্যাঁ। আছে, কিন্তু তারা যে কম্পিউটার নিয়ে কথা বলে সেটা হচ্ছে। ডিজিটাল কম্পিউটার। আমার জানার দরকার নিউরাল কম্পিউটার।

রাফি এবার তার চেয়ারে হেলান দিয়ে শিস দেওয়ার মতো শব্দ করল, নিউরাল কম্পিউটার?

হ্যাঁ। ঈশিতা মাথা নাড়ল। বলল, বইপত্র, ইন্টারনেট ঘাঁটাঘাঁটি করে। আমি যেটা জেনেছি সেটা হচ্ছে, মানুষের ব্রেন আমাদের ল্যাপটপের মতো কাজ করে না—ল্যাপটপ হচ্ছে ডিজিটাল কম্পিউটার। মানুষের ব্রেনের মধ্যে আছে নিউরন, সেটা দিয়ে তৈরি হয়েছে নিউরাল নেটওয়ার্ক। নিউরাল নেটওয়ার্ক দিয়ে কেউ কম্পিউটার তৈরি করলে সেটা হবে নিউরাল কম্পিউটার। ঠিক বলছি?

রাফি মাথা নাড়ল। ঈশিতা বলল, অল্পবিদ্যা ভয়ংকরী হতে পারে। উল্টাপাল্টা কিছু বললে থামাবেন। আমি আপনার কাছে এসেছি দুটি কারণে। এক. গত আইসিটি আইটি কনফারেন্সে আপনি নিউরাল নেটওয়ার্কের ওপর একটা পেপার দিয়েছেন। পেপারটা আমি পড়েছি, একটা লাইন দূরে থাকুক, একটা শব্দও বুঝিনি।

রাফি বলল, সরি।

ঈশিতা বলল, আপনার সরি হওয়ার কোনো কারণ নেই। সেই পেপারটা দেখে আমি বুঝতে পেরেছি, আপনি নিউরাল কম্পিউটারে এক্সপার্ট।

আমি মোটেও এক্সপার্ট না।

যখন কারও লেখার একটা শব্দও বোঝা যায় না, তখন সে হচ্ছে এক্সপার্ট। আপনি অবশ্যই এক্সপার্ট। যাই হোক— ঈশিতা রাফিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বলল, আর দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে আপনার ইউনিভার্সিটির হেলাল নামে একটা ছেলে আমাকে বলেছে, এখানে একজন মেয়ে হচ্ছে মানুষ কম্পিউটার! আপনি নিশ্চয়ই সেই মেয়েটাকে চেনেন। নিশ্চয়ই জানেন মেয়েটা কেমন করে কম্পিউটার। গবেষণা করার একটা মানুষ কম্পিউটার আপনার কাছে আছে, যেটা অন্য কারও কাছে নেই। আমি আপনার কাছে জানতে চাই, মেয়েটা কেমন করে এটা করে!

ঈশিতা তার টানা বক্তব্য শেষ করে চেয়ারে হেলান দিল। রাফি কিছুক্ষণ ঈশিতার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, এত জিনিস থাকতে আপনি এই জিনিস পত্রিকায় লিখতে এত ব্যস্ত হলেন কেন?

ঈশিতা বলল, আমি মোটেও এটা নিয়ে পত্রিকায় আর্টিকেল লিখতে ব্যস্ত হইনি।

তাহলে?

আমি এটা জানতে চাই।

কেন?

ঈশিতা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, সেটা আমি আপনাকে বলতে পারব না। খুব যদি চাপাচাপি করেন তাহলে আমি বানিয়ে বানিয়ে কিছু একটা বলে দেব—আপনি টেরও পাবেন না যে আমি মিথ্যে কথা বলছি। আমি খুব সরল মুখ করে সিরিয়াস ব্লাফ দিতে পারি।

রাফি হেসে বলল, আপনাকে ব্লাফ দিতে হবে না। আমি চাপাচাপি করব না! তবে আপনি যেসব জিনিস জানতে চাইছেন, আমি যে তার সবকিছু জানি, তা না। শুধু যে জানি না, তা না। অনেক কিছু আছে যেগুলো আমি কেন, পৃথিবীর কেউই জানে না।

কিন্তু আপনি নিশ্চয়ই সেগুলো জানতে চাইছেন, চাইছেন না?

তা চাইছি।

আমার অনুরোধ, আপনি যদি কিছু জানেন সেটা আমাকে কষ্ট করে একটু বুঝিয়ে দেবেন। আর কিছু না।

রাফি বলল, ঠিক আছে। যদি আপনারা এই বাচ্চা মেয়েটাকে নিয়ে টানাহ্যাচড়া না করেন, তাহলে আমার কোনো সমস্যা নেই।

কথা দিচ্ছি টানাহ্যাচড়া করব না।

তাহলে ঠিক আছে।

ঈশিতা বলল, ভেরি গুড। আমি তাহলে এখন উঠি।

কোথায় যাবেন?

হেলাল নামক ছেলেটার সঙ্গে একটু কথা বলি। তাকে খুশি করার জন্য দু-চারটা ছবি তুলতে হবে। ঈশিতা চেয়ার থেকে উঠতে উঠতে বলল, এই হেলাল খুব করিৎকর্মা ছেলে হতে পারে, কিন্তু তার বাংলা বানানের জ্ঞান ভালো না। দন্ত্যস দিয়ে মানুষ লিখে।

রাফি হাসল, নেতা মানুষ বানান দিয়ে কী করবে?

ঈশিতা ভুরু কুঁচকে বলল, নেতা নাকি?

হ্যাঁ। সিরিয়াস নেতা।

তাহলে একটু সাবধানে ডিল করতে হবে।

ঈশিতা তার ক্যামেরা ঘাড়ে ঝুলিয়ে যখন বের হয়ে যাচ্ছে, তখন রাফি একটু ইতস্তত করে বলল, আজ বিকেলে আপনার কী প্রোগ্রাম?

কোনো প্রোগ্রাম নেই।

পাঁচটার দিকে ছাত্রদের বাসটা চলে যাওয়ার পর ক্যাম্পাস একটু ফাঁকা হয়। আমি ঠিক করেছিলাম তখন আপনার কম্পিউটার মেয়েটাকে নিয়ে একটু বসব। আপনি চাইলে তখন আপনিও আমার সাথে থাকতে পারেন।

অবশ্যই থাকব। একশবার থাকব।

তাহলে আপনি সাড়ে পাঁচটার দিকে চলে আসবেন আমার রুমে।

আসব।

শুধু একটা কন্ডিশন—

ঈশিতা বলল, মেয়েটাকে নিয়ে কোনো রিপোর্ট করা যাবে না!

হ্যাঁ।

আপনি নিশ্চিন্ত থাকেন। আমি রিপোর্ট করব না।

 

বিকেল বেলা রাফি তার ঘর থেকে ঈশিতাকে নিয়ে বের হলো। বের হওয়ার আগে সে টেবিল থেকে একটা বই নিয়ে নেয়—ক্লাস ওয়ানের বর্ণমালা শেখার বই।

ঈশিতা জিজ্ঞেস করল, এই বইটি কেন?

আপনাকে যে মেয়েটির কাছে নিয়ে যাচ্ছি সেই মেয়েটি বিশাল বিশাল সংখ্যাকে মুহূর্তের মধ্যে গুণ করে ফেলতে পারে, কিন্তু একটা অক্ষরও পড়তে পারে না!

ঈশিতা অবাক হয়ে বলল, তাই নাকি?

হ্যাঁ। মেয়েটার ডিসলেক্সিয়া।

ডিসলেক্সিয়া? ঈশিতা মাথা নেড়ে বলল, আমি এটার কথা শুনেছি। আজকাল দুষ্টু বাচ্চাদের ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলেই বলা হয় ডিসলেক্সিয়া, না হয় এডিডি-অ্যাটেনশন ডেফিশিয়েন্সি ডিজঅর্ডার। তারপর কিছু বোঝার আগেই প্রোজাক প্রেসক্রিপশন করে দেয়। দেখতে দেখতে চটপটে একটা বাচ্চা কেমন যেন ভেজিটেবলের মতো হয়ে যায়।

রাফি বলল, আমি যে মেয়েটার কাছে নিচ্ছি সে মোটেও দুষ্টু নয়, অ্যাটেনশনেরও সমস্যা নেই। মেয়েটা হচ্ছে একেবারে ক্ল্যাসিক কেস অব ডিসলেক্সিয়া। মেয়েটা সে জন্য পড়তে শেখেনি। আমি এই বইটা নিয়ে যাচ্ছি তাকে একটু টেস্ট করার জন্য!

ঈশিতা মাথা নেড়ে বলল, ইন্টারেস্টিং।

টংয়ের কাছে গিয়ে রাফি দেখল সেখানে খুব ভিড়। জিলাপি ভাজা হচ্ছে এবং অনেকে সেই জিলাপি খাচ্ছেন শারমিন প্লেটে করে জিলাপি দিচ্ছে, চা দিচ্ছে এবং কার কত বিল হয়েছে, সেটা জানিয়ে দিচ্ছে। রাফি ঈশিতাকে গলা নামিয়ে বলল, এই হচ্ছে সেই মেয়ে, নাম শারমিন।

কী সুইট মেয়েটা।

হ্যাঁ, অনেক সুইট।

রাফিকে দেখে শারমিনের বাবা একটু ব্যস্ত হয়ে পড়ল। শারমিনকে বলল, স্যারের জন্য বেঞ্চটা মুছে দে তাড়াতাড়ি।

রাফি বলল, বেঞ্চ মুছতে হবে না। বরং শারমিনকে আমার কাছে পাঠান পাঁচ মিনিটের জন্য।

জি স্যার! জি স্যার। বাবা আরও ব্যস্ত হয়ে পড়ল। শারমিনকে বলল, দেখ দেখি স্যার কী বলেন।

শারমিন সঙ্গে সঙ্গে তার ফ্রকে হাত মুছে কাছে এসে দাঁড়িয়ে বলল, জি স্যার।

রাফি বলল, আমি তোমার একটা জিনিস একটু টেস্ট করতে চাই। তুমি একটু আমার সঙ্গে আসো, আমরা ওই পাশে গিয়ে বসি।

রাফি ঈশিতাকে নিয়ে টংয়ের কাছে বড় একটা গাছের পাশে বসল। শারমিন বসল তাদের সামনে, তার চোখেমুখে এক ধরনের উত্তেজনা।

রাফি তার বইটা বের করে বলল, আমি একটা বই নিয়ে এসেছি, দেখি তুমি এটা পড়তে পার কি না।

শারমিনের মুখটা কেমন যেন কালো হয়ে গেল, সে ফিস ফিস করে বলল, আমি তো পড়তে পারি না স্যার।

আমি জানি। আমি দেখতে চাই তুমি কতটুকু পারো।

একটুও পারি না।

ঠিক আছে। তোমাকে পড়তে হবে না, তুমি আমাকে বলো তুমি কী দেখো। রাফি বইয়ের একটা পৃষ্ঠা খুলে বলল, এখানে কী আছে বলো।

শারমিনের মুখটা কেমন জানি শুকনো হয়ে যায়, জিব দিয়ে নিচের ঠোঁটটা ভিজিয়ে বলল, কয়েকটা আকাবাকা দাগ নড়ছে।

ঈশিতা অবাক হয়ে বলছে, নড়ছে?

শারমিন মাথা নাড়ল, হ্যাঁ।

কেমন করে নড়ছে?

ডানে-বাঁয়ে। মাঝে মধ্যে উল্টে যায়।

ঈশিতা অবাক হয়ে বলল, কী আশ্চর্য।

রাফি বলল, মোটেও আশ্চর্য না। এটা হচ্ছে ডিসলেক্সিয়ার লক্ষণ।

ঈশিতা বলল, হতে পারে, কিন্তু তবুও আশ্চর্য।

রাফি এবার বইয়ের ভেতর থেকে লাল রঙের একটা স্বচ্ছ প্লাস্টিক বের করে বইয়ের পৃষ্ঠার ওপর রেখে বলল, শারমিন। এখন কী দেখা যাচ্ছে?

শারমিনকে দেখে মনে হলো কেউ তাকে বুঝি ইলেকট্রিক শক দিয়েছে, তার চোখ বিস্ফারিত হয়ে যায়। নিঃশ্বাস আটকে আসে, সে কাঁপা গলায় বলে, নড়ছে না, এখন আর নড়ছে না! আমি এখন পড়তে পারি! পড়তে পারি!

রাফি বলল, তুমি যে অক্ষরটা দেখছ সেটা হচ্ছে পেটকাটা মূর্ধন্যষ!

এইটা পেট কাটা মূর্ধন্যষ? আমি কতবার শুনেছি এইটার কথা, কতবার দেখার চেষ্টা করেছি, দেখতে পারিনি!

রাফি শারমিনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, এখন মনে হয় তুমি দেখতে পারবে, পড়তেও পারবে।

ঈশিতা বলল, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না, কী হচ্ছে।

রাফি বলল, একটা অনেক বড় ব্যাপার ঘটেছে—আমরা মনে হয় শারমিনের ডিসলেক্সিয়ার সমস্যার সমাধান করে ফেলেছি!

কীভাবে? এই লাল প্লাস্টিক দিয়ে?

হ্যাঁ। রাফি মাথা নাড়ল, আমাদের হেড অব দ্য ডিপার্টমেন্ট প্রফেসর হাসান এই পদ্ধতিটার কথা বলেছিলেন। অনেক সময় দেখা গেছে, সাদার ওপর কালো লেখাটা হচ্ছে সমস্যা। লাল রঙের ওপর কালো লেখা হলে সমস্যা থাকে না। আমি ঠিক বিশ্বাস করিনি কাজ করবে! তবু ভাবলাম চেষ্টা করে দেখি। ভাগ্যিস চেষ্টা করেছিলাম, দেখাই যাচ্ছে কাজ করেছে।

শারমিন তখন লাল প্লাষ্টিকটা দিয়ে বইয়ের প্রত্যেকটা পৃষ্ঠা পরীক্ষা করে দেখছে, উত্তেজনায় তার মুখ চকচক করছে। মনে হচ্ছে সে বুঝি সাত রাজার ধন পেয়ে গেছে। ব্যাপারটা সে এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না। তার মনে হচ্ছে, একটু অসতর্ক হলেই হঠাৎ করে আবার বুঝি অক্ষরগুলো জীবন্ত পোকামাকড়ের মতো নড়তে শুরু করবে!

রাফি বলল, শারমিন এখন তুমি পড়তে পারবে।

শারমিন একটা অক্ষর দেখিয়ে বলল, এগুলো কী অক্ষর?

ঈশিতা উত্তর দিল, বলল, প্রথমটা ক, তার পরেরটা হচ্ছে ল, তার পরেরটা হচ্ছে ম। তিনটা মিলে হচ্ছে কলম।

শারমিন তার পরের শব্দটার দিকে আঙুল দিয়ে বলল, তার মানে এটা হচ্ছে কমল?

ভেরি গুড। হ্যাঁ এটা হচ্ছে কমল। তার পরের শব্দটা হচ্ছে কমলা। লএর পর আকার থাকায় এটা হচ্ছে না।

শারমিন বইয়ে লেখা শব্দগুলো দেখিয়ে বলতে থাকে, তার মানে এটা কাল? এটা লাল? এটা কলা? এটা কামাল? এটা মাকাল? এটা কালাম? এটা মালা? এটা কম? এটা মাল? এটা কাম? এটা মালা?

ঈশিতা হেসে ফেলল। বলল, আস্তে আস্তে! তিনটা অক্ষর আর আকার দিয়েই এত কিছু পড়ে ফেলতে পারছ, সবগুলো শিখে ফেললে কী হবে?

রাফি বলল, হ্যাঁ, এই বইটা ভারি চমৎকার, তিনটা অক্ষর আর আকার দিয়েই অনেক শব্দ শিখিয়ে দেয়!

ঈশিতা বলল, আমার ধারণা, পুরো ক্রেডিট বইটার না! আমাদের শারমিনকেও একটু ক্রেডিট দিতে হবে।

সে তো দিচ্ছিই!

শারমিন লোভাতুর দৃষ্টিতে অক্ষরগুলোর দিকে তাকিয়ে ছিল। ঈশিতা তার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি নাকি চোখের পলকে অনেক বড় বড় গুণ করে ফেলতে পারো?

শারমিন লাজুক মুখে মাথা নাড়ল। ঈশিতা বলল, বলো দেখি তেহাত্তরকে সাতানব্বই দিয়ে গুণ করলে কত হয়?

শারমিন বলল, সাত হাজার একাশি।

ঈশিতা রাফির দিকে তাকিয়ে বলল, ঠিক হয়েছে?

রাফি বলল, শারমিন যখন বলেছে, নিশ্চয়ই ঠিক হয়েছে।

ঈশিতা শারমিনের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি কেমন করে এটা করো?

শারমিন মাথা নাড়ল, বলল জানি না। আমি চিন্তা করলেই উত্তরটা জেনে যাই।

চিন্তা করলেই জেনে যাও?

হ্যাঁ। মনে হয় যেন দেখতে পাই।

দেখতে পাও? সংখ্যা দেখতে পাও?

শারমিন লাজুক মুখে মাথা নাড়ল, বলল, আমি তো লেখাপড়া জানি না, তাই কোন সংখ্যা দেখতে কেমন সেইটা জানি না! আমি নিজের মতন দেখি—কোনোটা গোল, কোনোটা লম্বা, কোনোটা চিকন, সেগুলো নড়ে।

কী আশ্চর্য!

শারমিন কিছু না বলে তার বর্ণমালার বই আর লাল প্লাস্টিকটা বুকে চেপে ধরে দাঁড়িয়ে রইল। এর মধ্যে কোনটা আশ্চর্য সে এখনো বুঝতে পারছে না। রাফি বলল, তুমি বলছ তুমি চিন্তা করলেই উত্তরটা জেনে যাও। তুমি কী চিন্তা করো?

গুণফলটা কী হবে সেটা চিন্তা করি।

তুমি মাথার মধ্যে গুণ করো না?

না। কেমন করে গুণ করতে হয় আমি জানি না।

রাফি ঈশিতার দিকে তাকিয়ে বলল, দেখলেন ব্যাপারটা? শারমিন কেমন করে গুণ করতে হয় জানে না, কিন্তু গুণ না করেই যেকোনো দুটি সংখ্যার গুণফল বের করে ফেলে!

কেমন করে?

আমি যদি জানতাম!

রাফি কথা বলতে বলতে টংয়ের দিকে তাকিয়ে দেখল, সেখানে হঠাৎ করে অনেকেই চলে এসেছে, শারমিনের বাবা একা সামাল দিতে পারছে না। রাফি শারমিনকে বলল, তুমি এখন যাও। তোমার আব্বুকে সাহায্য করো।

শারমিন তার বুকে চেপে রাখা বর্ণমালার বই আর লাল প্লাস্টিকটা দেখিয়ে বলল, এই বইটা?।

তোমার জন্য। তুমি নিয়ে যাও। বাসায় গিয়ে পড়ো। কাউকে বলো একটু দেখিয়ে দিতে। ঠিক আছে?

শারমিন মাথা নাড়ল, মুখে কিছু বলল না, কিন্তু তার চোখমুখ কৃতজ্ঞতায় ঝলমল করে উঠল। রাফি আগেও দেখেছে, এ দেশে মানুষেরা প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে ধন্যবাদ কথাটি উচ্চারণ করা শেখেনি, তাই চোখেমুখে সেটা প্রকাশ করতে হয়।

শারমিনের পিছু পিছু টংয়ে এসে রাফি দেখল, সেখানে একটা ছোটখাটো উত্তেজনা। উত্তেজনার কেন্দ্রস্থল সমীর—বায়োকেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টের লেকচারার। রাফি গলা নামিয়ে ঈশিতাকে বলল, ওই যে খোঁচা খোঁচা দাড়িওয়ালা ছেলেটাকে দেখছেন, সে হচ্ছে সমীর। কঠিন সায়েন্টিস্ট। সব সময় ব্যাক্টেরিয়া আর ভাইরাস নিয়ে কথা বলে ভয় দেখানোর চেষ্টা করে!

ঈশিতা বলল, ইন্টারেস্টিং!

হ্যাঁ। খুবই ইন্টারেস্টিং ক্যারেক্টার। চলেন গিয়ে শুনি আজকে কী নিয়ে কথা বলছে!

রাফি ঈশিতাকে নিয়ে এগিয়ে গেল, টংয়ের বেঞ্চে সমীর বসে আছে। সে হাত নেড়ে কথা বলছে এবং তাকে ঘিরে একটু জটলা। সবার মুখেই এক ধরনের হাসি, কেউ সেটা গোপন করার চেষ্টা করছে, কেউ করছে না। সমীর গলা উঁচিয়ে বলল, তোমরা হাসছ? আমার কথা শুনে তোমরা হাসছ?

একজন তার মুখের হাসিকে আরও বিস্তৃত করে বলল, কে বলল আমি হাসছি? মোটেই হাসছি না।

তোমরা আমার সঙ্গে ঠাট্টা করছ? তোমরা ভাবছ, আমি শুধু শুধু ভয় দেখাচ্ছি?

আরেকজন বলল, না সমীর! আমরা মোটেও সেটা ভাবছি না। আমরা সবাই জানি তুমি খুবই সিরিয়াস মানুষ।

সমীর বলল, আমার কথা বিশ্বাস না করলে তোমরা আজকের খবরের কাগজ দেখো। টিঅ্যান্ডটি বস্তি থেকে দশটা বাচ্চাকে মেডিকেলে নিয়েছে—পাঁচজনের ব্রেন হেমারেজ। একজন অলরেডি ডেড। একজন ডিপ কোমায়। ড়ু ইউ থিংক—এগুলো এমনি এমনি হচ্ছে?

রাফি জিজ্ঞেস করল, কীভাবে হচ্ছে?

ভাইরাস অ্যাটাক। আমি বলেছিলাম খুব খারাপ একটা ভাইরাস এসেছে। আমাদের দেশের জন্য ডেঞ্জারাস। যে সিম্পটমগুলো পড়েছি সেগুলো হুঁবহুঁ মিলে যাচ্ছে। কেউ নজর দিচ্ছে না। মিডিয়ার অনেক সিরিয়াসলি নেওয়া দরকার।

রাফি ঈশিতাকে দেখিয়ে বলল, সমীর, এর নাম ঈশিতা। খবরের কাগজের লোক। ওকে ভালো করে বুঝিয়ে দাও—খবরের কাগজে ফাটাফাটি রিপোর্টিং করে দেবে।

সমীর ভুরু কুঁচকে বলল, আপনি সাংবাদিক?

হ্যাঁ।

তাহলে আপনারা চুপচাপ বসে আছেন কেন? কেউ কিছু বোঝার আগেই তো সব সাফ হয়ে যাবে। কী ডেঞ্জারাস ভাইরাস আপনি জানেন?

ঈশিতা ইতস্তত করে বলল, আমরা কী করব?

সত্যি কথাটা জানাবেন। সবাইকে বলবেন বাংলাদেশ এখন ভীষণ একটা বিপদের মধ্যে আছে। টিঅ্যান্ডটি বস্তির বাচ্চাগুলো কোনো র্যান্ডম অসুখে অসুস্থ হয়নি। তারাসেই ভাইরাসে ইনফেক্টেড। এ মুহূর্তে যদি কোয়ারেন্টাইন করে প্রটেকশন না দেওয়া হয়, সর্বনাশ হয়ে যাবে!

ঈশিতা তার পকেট থেকে একটা নোট বই বের করে বলল, ভাইরাসটার নাম কী?

এখনো ফরমাল নাম দেয়নি। এটাকে বলছে এফটি টুয়েন্টি সিক্স। আপনাকে আমি ওয়েব লিংক দিতে পারি, সব ইনফরমেশন পেয়ে যাবেন।

ভেরি গুড। আমি কি আপনাকে রেফারেন্স দিয়ে রিপোর্ট করতে পারি?

সমীর হা হা করে হাসল। সে যে হাসতে পারে সেটা অনেকেই জানত না, তাই আশপাশে দাঁড়িয়ে থাকা অনেকেই একটু অবাক হয়ে তার দিকে তাকাল। সমীর যেভাবে হাসিটা হঠাৎ করে শুরু করেছিল, ঠিক সেভাবে হঠাৎ করে থামিয়ে বলল, আমি মফস্বলের একটা ইউনিভার্সিটির ফালতু একটা লেকচারার। আমার রেফারেন্স দিয়ে কী লাভ? কে আমার কথা বিশ্বাস করবে? আমার কলিগরাই বিশ্বাস করছে না, আর দেশের পাবলিক বিশ্বাস করবে?

ঈশিতা বলল, বিশ্বাস করা না করা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছি না! আপনি যখন প্রথম এই কথাটা বলছেন, সেটা ডকুমেন্টেড থাকুক। যদি দেখা যায় আসলেই আপনার আশঙ্কা সত্যি, তাহলে আপনার ক্রেডিবিলিটি এস্টাবলিশড হবে!

সমীর মুখ গম্ভীর করে বলল, ঠিক আছে!

ঈশিতা ক্যামেরাটা হাতে নিয়ে বলল, আপনার কয়েকটা ছবি তুলি?

তুলবেন? তুলেন।

সমীরকে ঘিরে দাঁড়ানো সবাই তাকে নিয়ে হাসি-তামাশা করতে লাগল এবং তার মধ্যে ঈশিতা তার ক্যামেরা দিয়ে খ্যাঁচ খ্যাঁচ করে অনেকগুলো ছবি তুলে ফেলল। ছবি তোলা শেষ করে ঈশিতা তার নোট বই নিয়ে সমীরের পাশে বসে তার সঙ্গে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে কথা বলে। এত দিন পর সত্যিকারের একজন শ্রোতা পেয়ে সমীর টানা কথা বলে যেতে থাকে। তাকে দেখে মন হয়, সে বুঝি নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্যও একটু বিরতি দেবে না!

 

দুই দিন পর খবরের কাগজে সমীরের ভাইরাস এফটি টুয়েন্টি সিক্সের ওপর বিশাল প্রতিবেদন বের হলো। খবরের কাগজের প্রথম পৃষ্ঠায় সমীরের ছবি। ঈশিতা খুব গুছিয়ে রিপোর্টিং করেছে, সারা দিন সমীরের কাছে টেলিফোন এল, বিকেলের দিকে একটা টেলিভিশন চ্যানেল পর্যন্ত চলে এল।

পরদিন ভোরে রাফি ক্লাসে যাওয়ার জন্য তার লেকচার ঠিক করছে, তখন সমীর এসে হাজির। তার উসকোখুসকো চুল, চোখের নিচে কালি এবং শুকনো মুখ। রাফি অবাক হয়ে বলল, কী হয়েছে সমীর?

সমীর জিব দিয়ে শুকনো ঠোঁট ভেজানোর চেষ্টা করে নিচু গলায় বলল, দরজাটা বন্ধ করি?

দরজা বন্ধ করবে? রাফি কারণটা জানতে চাইতে গিয়ে থেমে গিয়ে বলল, করো।

সমীর দরজা বন্ধ করে রাফির খুব কাছাকাছি এসে বসে ভাঙা গলায়। বলল, আমি খুব বিপদে পড়েছি।

কী বিপদ?

গতকাল এফটি টুয়েন্টি সিক্সের খবর বের হয়েছে—

হ্যাঁ দেখেছি। চমৎকার রিপোর্টিং—

চমকারের খেতা পুড়ি।

কেন, কী হয়েছে?

রাতে এগারোটার সময় আমার বাসায় দুজন লোক এসেছে। লম্বাচওড়া, চুল ছোট করে ছাঁটা। একজন মাঝবয়সী, আরেকজন একটু কম। দুজনেরই সাফারি কোট। এসে আমাকে জিজ্ঞেস করল, এই বাসায় আর কে থাকে? আমি বললাম, আর কেউ থাকে না। তখন লোকগুলো দুইটা চেয়ারে বসল। একজন পকেট থেকে একটা পিস্তল বের করে টেবিলে রাখল।

রাফি চমকে উঠে বলল, পিস্তল?

হ্যাঁ। আরেকজন আমাকে একটা চেয়ারে বসিয়ে আমার ঘাড়ে একটা হাত দিয়ে বলল, মালাউনের বাচ্চা, তুমি তোমার বাপের দেশে না গিয়ে এই দেশে পড়ে আছো কেন?

আমি বললাম, এইটাই আমার বাপদাদা চৌদ্দগুষ্টির দেশ। তখন লোকটা রিভলবারটা হাতে নিয়ে আমার কপালে ধরে বলল, এইটা যদি তোমার বাপের দেশ হয় তাহলে এই দেশের নিয়ম মেনে চলতে হবে। আমি বললাম, এই দেশের নিয়ম কী? লোকটা বলল, বেদরকারি কথা বলবা না। আমি বললাম, বেদরকারি কথাটা কী? লোকটা বলল, ভাইরাসের কথাটা হচ্ছে বেকারি, ফালতু কথা। খামোখা মানুষকে ভয় দেখানোর কথা।

সমীর একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমার তখন ভয়ে হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেছে, তবু সাহস করে বললাম, এটা ফালতু কথা না। এটা খুবই ডেঞ্জারাস কথা। লোকটা তখন রিভলবারের নল দিয়ে আমার মাথায় একটা বাড়ি দিয়ে বলল, চোপ ব্যাটা মালাউন। আমি যদি বলি এটা ফালতু, তাহলে এটা ফালতু। বুঝেছিস?

আমার এই কম কথাগুলো বলতে বলতে সমীরের মুখ শক্ত হয়ে যায়। সে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, তখন আমার মাথার মগজে রক্ত উঠে গেল। আমি দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বললাম, গেট আউট। গেট আউট আমার বাসা থেকে। লোক দুইটা তখন কেমন যেন হকচকিয়ে গেল, ওরা বুঝতে পারে নাই আমি এইভাবে রেগে উঠব। ওরা ভেবেছে আমাকে ভয় দেখালে আমি ভয়ে কেঁচো হয়ে থাকব।

রাফি একটু ঝুঁকে বলল, তারপর কী হলো?

লোক দুইটা তখন উঠে দাঁড়াল, যেইটা একটু বয়স্ক সেইটা বলল, শোনো ছেলে। এই ভাইরাস নিয়ে যদি আর একটা কথা বলো তাহলে তোমার লাশ পড়ে যাবে। খোদার কসম।

তুমি কী বললে?

আমি বললাম, আমার যদি বলার ইচ্ছা করে তাহলে আমি একশবার বলব। তোমার যদি ক্ষমতা থাকে লাশ ফেলে দেওয়ার, লাশ ফেলে দিয়ে। আমি ভয় পাই না! যদিও বলেছি ভয় পাই না—কিন্তু আসলে ভয়ে আমার হার্টফেল করার অবস্থা! মনে হয় অনেক জোরে চিৎকার করেছি। পাশের ফ্ল্যাট থেকে তখন কবির ভাই এসে দরজা ধাক্কা দিয়ে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে? চেঁচাচ্ছ কেন?

আমি তাড়াতাড়ি দরজা খুলে দিলাম, কবির ভাই ঢুকে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে? লোকটা ততক্ষণে রিভলবারটা লুকিয়ে ফেলেছে। সে বলল, কিছু হয় নাই। তারপর ঘর থেকে বের হয়ে গেল। কবির ভাই জানতে চইল, কী ব্যাপার। আমি কিছু বললাম না। কবির ভাই তখন আমাকে ঘাটাল না।

সমীর কিছুক্ষণ মুখ শক্ত করে রেখে বলল, সকালবেলা তোমার কাছে এলাম, আমার সেই ঈশিতা মেয়েটার সঙ্গে একটু পরামর্শ করা দরকার। তোমার সঙ্গেও বলি। কী করব বুঝতে পারছি না।

এরা কারা?

জানি না। রাতে বাসার সামনে বিশাল একটা গাড়িতে অনেকক্ষণ বসে থাকল। কোনো লুকোছাপা নেই, মনে হয় সরকারি লোক।

সরকারি লোক এ রকম করবে কেন? তোমাকে মালাউন ডাকবে কেন?

সমীর হাসার চেষ্টা করে বলল, আমাদের অনেকেই মালাউন ডাকে, তোমরা সেটা জানো না! যাই হোক, ঈশিতার নম্বরটা দাও, না হলে ফোন করে আমাকে লাগিয়ে দাও।

রাফি ঈশিতাকে ফোন করল, সেখানে একটা ইংরেজি গান রিংটোন। কিন্তু কেউ ফোন ধরল না। কিছুক্ষণের ভেতর একটা অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন এল, ফোন ধরতেই ঈশিতার গলা শোনা গেল, রাফি?

হ্যাঁ। এখানে একটা ব্যাপার ঘটেছে।

জানি।

জানো?

হ্যাঁ। আমি আমার ফোনে ধরিনি। এটা ট্যাপ করছে। অন্য নম্বর থেকে ফোন করছি। সমীর কেমন আছে?

সমীরের কথাই বলছিলাম। কাল রাতে দুজন লোক—

জানি। ওরা অসম্ভব ডেঞ্জারাস, আমি ফোনে সবকিছু বলতে পারব না। সমীরকে বোলো সাবধানে থাকতে। আজকে ভাইরাসের ওপর ফললাআপ নিউজ থাকার কথা ছিল, আমরা ড্রপ করেছি। সমীরকে বোলো কারও সঙ্গে কোনো কথা না বলতে।

সমীর এখানে আছে, তুমি কথা বলো।

সমীর কিছুক্ষণ ঈশিতার সঙ্গে কথা বলল। বেশির ভাগ সময় অবশ্যি কথা শুনল, হুঁ হাঁ করল, নিঃশ্বাস ফেলল। তারপর ফোনটা রাফির হাতে ফিরিয়ে দিল। রাফি ফোনটা কানে লাগিয়ে বলল, ঈশিতা।

হ্যাঁ। বলো।

এখন অন্য ঝামেলা শুরু হয়ে গেল, তাই বলার জন্য ঠিক সময় কি না বুঝতে পারছি না। মনে আছে, তুমি নিউরাল কম্পিউটার নিয়ে জানতে চাইছিলে?

হ্যাঁ।

আমি ফ্যান্টাস্টিক রিসোর্স পেয়েছি। তুমি বিশ্বাস করবে না। পৃথিবীর সেরা নিউরাল কম্পিউটার ফার্ম বাংলাদেশে অফিস খুলেছে। কোম্পানির নাম এনডেভার, টঙ্গীতে অফিস। ওয়েবসাইটটা চমৎকার ফ্রেন্ডলি। ওদের অফিসে গেলে—

ঈশিতা বলল, রাফি।

গলার স্বরে কিছু একটা ছিল। রাফি থতমত খেয়ে থেমে গেল। ঈশিতা ঠান্ডা গলায় বলল, আমি এনডেভারে গিয়েছিলাম। সে জন্যই নিউরাল কম্পিউটার সম্পর্কে জানতে চাইছি। যে দুজন লোক সমীরকে ভয় দেখিয়েছে, সেই দুজন আমাকেও ভয় দেখিয়েছে, আমি যেন এনডেভারের ওপর রিপোর্টিং না করি।

কেন?

জানি না। শুধু এটুকু জেনে রাখো, টিঅ্যান্ডটি কলোনিতে যারা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে, তাদের সবার চিকিৎসা করছে এনডেভার।

সত্যি? কেন?

আমারও সেই একই প্রশ্ন। কেন?

কোথায় চিকিৎসা হচ্ছে?

ওদের বিল্ডিংয়ে।

রাফি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, ওদের বিল্ডিংয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে?

হ্যাঁ। সেখানে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

কেন?

জানি না। শুধু মনে হচ্ছে, এনডেভার আগে থেকে জানত, এখানে এফটি টুয়েন্টি সিক্সের ইনফেকশন হবে!

রাফি অবাক হয়ে বলল, কেমন করে জানত?

শুধু একভাবে সম্ভব।

কীভাবে?

যদি নিজেরাই সেই ভাইরাসটা ছড়িয়ে থাকে।

কী বলছ?

ঈশিতা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, রাফি তুমি আমাকে কথা দাও, আমি যে কথাগুলো বলেছি, তুমি সেগুলো কাউকে বলবে না।

রাফি বলল, বলব না।

আমার গা ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করো।

টেলিফোনে গা ছোঁয়া যায় না।

জানি। তাতে কিছু আসে যায় না, প্রতিজ্ঞা করো।

করলাম।

যদি দেখো আমাকে মেরে ফেলেছে, তাহলে তুমি কোথা থেকে অগ্রসর হবে, সেটা জানিয়ে রাখলাম।

তোমাকে মেরে ফেলবে কেন?

বলিনি মেরে ফেলবে, বলেছি যদি মেরে ফেলে।

যদির কথাটি কেন আসছে?

জানি না, রাফি।

রাফি হঠাৎ করে একটা অশুভ আশঙ্কা অনুভব করে। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, সাবধানে থেকো ঈশিতা।

রাফির হঠাৎ মনে পড়ল, সে ঈশিতার সঙ্গে আপনি করে কথা বলত। কখন কীভাবে সেটা তুমি হয়ে গেছে, জানে না। ঈশিতাও সেটা লক্ষ করেছে বলে মনে হলো না। সেও খুব স্বাভাবিক গলায় বলল, চিন্তা কোরো না রাফি। আমি সাবধানে থাকব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *