০৬. রাফি তার ক্লাস লেকচার ঠিক করছে

রাফি তার ক্লাস লেকচার ঠিক করছে, তখন সে শুনল চিকন গলায় একজন বলল, আসতে পারি, স্যার?

রাফি মুখ তুলে তাকিয়ে দেখল, শারমিন অনেকগুলো বই বুকে চেপে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। রাফি বলল, এসো শারমিন।

শারমিন ভেতরে এসে বইগুলো টেবিলে রেখে বলল, আপনার বইগুলো।

সব পড়া শেষ?

শারমিন মাথা নাড়ল, বলল, জি।

শারমিন পড়া শেখার পর রাফি তাকে বই সাপ্লাই দেওয়ার চেষ্টা করছে। মেয়েটির পড়ার জন্য সর্বগ্রাসী ক্ষুধা। রাফি তাল সামলাতে পারছে না। লাইব্রেরিতে অনেক বই, কিন্তু মেয়েটির বয়স কম, তাই সব বই দিতে পারছে না। রাফি বইগুলো ড্রয়ারে রাখতে রাখতে বলল, ভেরি গুড শারমিন। আমি এর আগে কাউকে এত তাড়াতাড়ি বই পড়তে দেখিনি।

শারমিন হাসি হাসি মুখ করে দাঁড়িয়ে রইল। রাফি বলল, তুমি সত্যি সত্যি পড়ছ, নাকি আমাকে বোকা বানাচ্ছ?

সত্যি সত্যি পড়ছি।

ভেরি গুড।

আমাকে তো কেউ পড়তে শেখায়নি, তাই নিজের মতো করে পড়ি।

সেজন্য মনে হয়, তাড়াতাড়ি হয়ে যায়।

নিজের মতো করে? সেটা কী রকম?

একটা একটা শব্দ না পড়ে একসঙ্গে পুরো পৃষ্ঠা।

একসঙ্গে পুরো পৃষ্ঠা?

শারমিন মাথা নাড়ল। রাফি অবাক হয়ে বলল, কী বলছ তুমি? সেটা কীভাবে সম্ভব?

শারমিন লাজুক মুখে বলল, আমি পারি।

দেখি। রাফি একটা বই শারমিনের হাতে তুলে দিয়ে বলল, পড়ো দেখি।

শারমিন বইটা হাতে নিয়ে একটার পর একটা পৃষ্ঠা উল্টাতে থাকে। রাফি বলল, পড়ো।

পড়ছি তো।

পড়ছ?

হ্যাঁ।

তুমি যে কয় পৃষ্ঠা উল্টেছ, সেই কয় পৃষ্ঠা পড়ে ফেলেছ?

হ্যাঁ।

রাফি বইটা হাতে নিয়ে বলল, বলো দেখি, কী লেখা আছে প্রথম পৃষ্ঠায়।

শারমিন পুরো পৃষ্ঠাটা অবিকল বলে গেল, দাড়ি-কমাসহ। রাফি কিছুক্ষণ অবাক হয়ে শারমিনের দিকে তাকিয়ে থাকে, তারপর অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বলল, আমি তোমাকে নিয়ে কী করব জানি না শারমিন!

আমাকে নিয়ে কিছু করতে হবে না। খালি আমাকে প্রতিদিন পড়ার জন্য কয়েকটা করে বই দিবেন।

দিব, নিশ্চয়ই দিব।

শারমিন কথা বলতে বলতে চোখের কোণা দিয়ে রাফির টেবিলে রাখা কম্পিউটার মনিটরটা দেখছিল, শেষ পর্যন্ত সাহস করে জিজ্ঞেস করে ফেলল, স্যার, আপনার টেবিলের এইটা কি কম্পিউটার?

হ্যাঁ। এইটা কম্পিউটার। রাফি মনিটরটা দেখিয়ে বলল, এইটা হচ্ছে মনিটর। এখানে দেখা যায়। আসল কম্পিউটারটা নিচে। আর এইটা হচ্ছে কী-বোর্ড আর মাউস।

শারমিন চোখ বড় বড় করে কিছুক্ষণ সবকিছু দেখল। তারপর ইতস্তত করে বলল, কম্পিউটার দিয়ে কীভাবে কাজ করে, আমাকে একদিন দেখাবেন?

অবশ্যই দেখাব। কিন্তু তুমি নিজেই তো একটা কম্পিউটার, তুমি এই কম্পিউটার দেখে কী করবে?

শারমিন কোনো কথা না বলে একটু হাসার ভঙ্গি করল। রাফি বলল, আমি তোমাকে ইচ্ছে করলে এখনই দেখাতে পারি—বাচ্চাকাচ্চাদের যেভাবে দেখাই। তোমাকে বলতে পারি, এটা দিয়ে টাইপ করে, এটা দিয়ে ছবি আঁকে, এটা দিয়ে গেম খেলে—এ রকম। কিন্তু তুমি হচ্ছ একটা প্রডিজি। তুমি হচ্ছ সুপার ড়ুপার জিনিয়াস। তোমাকে তো এভাবে দেখালে হবে না, ঠিক করে দেখাতে হবে। তার জন্য তোমার একটু ইংরেজি শিখতে হবে। জানো ইংরেজি?

একটু একটু। বাংলা কম্পিউটার নাই?

একেবারে নাই বলা যাবে না, কিন্তু তোমার জন্য দরকার আসল খাঁটি কম্পিউটার। বই দিয়ে তুমি যে খেলা দেখিয়েছ, এখন কম্পিউটার দিয়ে না। জানি কী দেখাবে!

আমাকে কখন দেখাবেন?

আমার তো এখন একটা ক্লাস আছে। ক্লাসটা নিয়ে এসে তোমাকে দেখাই?

শারমিনের মুখে আনন্দের একটা ছাপ পড়ল। বলল, আমি ততক্ষণ এখানে বসে থাকি?

বসে থেকে কী করবে?

কিছু করব না। আমি কিছু ছোঁব না। শুধু তাকিয়ে থাকব।

রাফি হেসে ফেলল। বলল, শুধু তাকিয়ে থাকতে হবে না। তুমি একটু ছুঁতেও পারো। এই যে এটা হচ্ছে মাউস, এটা নাড়াচাড়া করে একটু টেপাটেপি করতে পারো।

কিছু নষ্ট হয়ে যাবে না তো?

সেটা নির্ভর করে তুমি কী টেপাটেপি করছ তার ওপর। হ্যাঁ, তুমি চাইলে আমার বারোটা বাজিয়ে দিতে পারো।

তাহলে আমি কিছু ধরব না।

রাফি বলল, ভয় নেই। ধরো। টেপাটেপি করো। আমি দেখি, এক ঘণ্টায় তুমি এই কম্পিউটার থেকে কী বের করতে পারো।

শারমিনের মুখে বিচিত্র একটা হাসি ফুটে উঠল। বলল, আপনি রাগ হবেন না তো?।

না, রাগ হব না। আমার সবকিছু ব্যাকআপ থাকে, আমি মাঝেমধ্যে মানুষকেও বিশ্বাস করি, কিন্তু কম্পিউটারকে বিশ্বাস করি না।

এক ঘণ্টা পর রাফি এসে দেখে, শারমিন আরএসএ সাইটে ঢুকে একশ ডিজিটের একটা কম্পোজিট সংখ্যাকে দুটি উৎপাদকে ভাগ করে বসে আছে। রাফিকে দেখে লাজুক মুখে হেসে বলল, এখানে ইংরেজিতে কী লিখেছে, বুঝতে পারছি না।

রাফি পড়ে বলল, এই সাইট থেকে তোমাকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেছে, তুমি যে কম্পোজিট সংখ্যাকে ফ্যাক্টরাইজ করেছ সেটা যদি দশ বছর আগে করতে তাহলে তুমি এক হাজার ডলার পুরস্কার পেতে!

শারমিন অবাক হয়ে বলল, এ-ক-হা-জা-র ডলার?

রাফির অবাক হওয়ার ক্ষমতাও নেই, সে নিঃশ্বাস আটকে বলল, এক হাজার না দশ হাজার ডলার সেটা নিয়ে আমার এতটুকু কৌতূহল নেই। আমি জানতে চাই তুমি এক ঘণ্টার মধ্যে কেমন করে ব্রাউজিং করে একেবারে তোমার উপযুক্ত একটা সাইটে ঢুকেছ—

ঢুকতে পারিনি।

পেরেছ। ঢুকে ফ্যাক্টরাইজ করেছ।

আমি অন্য একটা জায়গায় ঢুকতে চেয়েছিলাম। ঢুকতে দেয়নি, বলে পাসওয়ার্ড লাগবে। আমি যদি আন্দাজ করে পাসওয়ার্ড দিই তাহলে ঢুকতে

আন্দাজ করে পাসওয়ার্ড দেওয়া যায় না। পাসওয়ার্ড জানতে হয়।

কিন্তু–শারমিনকে একটু বিভ্রান্ত দেখায়, আমি কয়েক জায়গায় আন্দাজে পাসওয়ার্ড দিয়ে ঢুকে গেছি!

রাফি চোখ কপালে তুলে বলল, কী বললে? কী বললে তুমি? আন্দাজে পাসওয়ার্ড দিয়ে ঢুকে গেছ?

শারমিন ভয়ে ভয়ে বলল, কেন স্যার? এটা করা কি ভুল?

টেকনিক্যালি ইয়েস। অন্যের পাসওয়ার্ড দিয়ে ঢুকে যাওয়া বেআইনি কাজ। রিয়েলিস্টিক্যালি এটা অসম্ভব। তুমি কেমন করে করলে?

শারমিন শুকনো মুখে বলল, এখন কি কোনো বিপদ হবে?

সেটা নির্ভর করছে তুমি কোন কোন সাইটে ঢুকে কী কী করেছ তার ওপর।

আমি কিছু করিনি। শুধু ঢুকেছি আর বের হয়েছি। হবে কোনো বিপদ?

রাফি হেসে বলল, না, কোনো বিপদ হবে না। আর যদি হয় সেটা তোমার হবে না। সেটা হবে আমার!

আমি স্যার বুঝতে পারিনি। আমি ভেবেছি–

শারমিন, তোমার ব্যস্ত হওয়ার কোনো কারণ নেই। কিন্তু আমার মনে হয় আমাদের এখন একটু সাবধান হওয়ার ব্যাপার আছে। তুমি আসলে এখনো টের পাওনি তুমি কী। যদি বাইরের মানুষ খবর পায় তাহলে তোমাকে নিয়ে টানাটানি পড়ে যাবে। কাজেই এখন আমরা খুব সতর্ক হয়ে যাব। তুমি কাউকে কিছু বলবে না।

শারমিন ভয়ে ভয়ে বলল, বলব না।

প্রথমে আমার একটু আন্দাজ করতে হবে তোমার আসল ক্ষমতা কতটুকু। পারব কি না জানি না, কিন্তু চেষ্টা করব।

শারমিন কোনো কথা না বলে ভীত চোখে রাফির দিকে তাকিয়ে রইল। রাফি বলল, রামানুজন নামে একজন খুব বড় ম্যাথমেটিশিয়ান ছিলেন, তার কোনো ফর্মাল এড়ুকেশান ছিল না। হার্ডি নামে আরেকজন বড় ম্যাথমেটিশিয়ানের সঙ্গে যখন রামানুজনের দেখা হলো, তখন হার্ডি খুব বিপদে পড়েছিলেন।

কী বিপদ?

তাকে কতটুকু কী শেখাবেন সেটা নিয়ে বিপদ। কোনো কিছু জোর করে শেখাতে গিয়ে যদি রামানুজনের স্বাভাবিক প্রতিভার কোনো ক্ষতি হয়ে যায়, সেই বিপদ। তোমাকে নিয়ে আমারও সেই একই অবস্থা—তোমাকে কতটুকু শেখাব? কী শেখাব?

শারমিন নিচু গলায় বলল, আমাকে কিছু শেখাতে হবে না, শুধু আমার জন্য প্রত্যেক দিন কয়েকটা বই দেবেন।

হ্যাঁ। বই তো দেবই। কিন্তু তোমার ক্ষমতাটা একটু তো ব্যবহারও করতে হবে। রাফি চিন্তিতভাবে তার গাল ঘষতে ঘষতে বলল, তবে আজকে তুমি কম্পিউটারে যে খেলা দেখিয়েছ, তাতে মনে হচ্ছে তোমার ক্ষমতাটা পুরোপুরি বোঝা আমার সাধ্যে নেই।

শারমিন ভয়ে ভয়ে রাফির দিকে তাকিয়ে রইল। রাফি গম্ভীর মুখে বলল, তবে তুমি আমাকে কথা দিচ্ছ তো, তোমার যে এ রকম ক্ষমতা আছে সেটা তুমি কাউকে বলবে না।

বলব না।

তোমার আব্বুকেও বলবে না।

বলব না।

আম্মুকে না, ভাইবোন কাউকে না।

আম্মুকে না। ভাইবোনকে না।

স্কুলের টিচার, বন্ধুবান্ধব কাউকে বলবে না।

বলব না, কাউকে বলব না।

গুড।

শারমিন দাঁড়িয়ে বলল, আমি তাহলে এখন যাই?

যাও। শারমিন, আবার দেখা হবে।

শারমিন শুকনো মুখে বের হয়ে গেল। সে বুঝতে পারছে তার অস্বাভাবিক একটা ক্ষমতা আছে, কিন্তু সেই ক্ষমতাটা তার জন্য ভালো হলো, না খারাপ হলো সেটা এখন আর সে বুঝতে পারছে না।

 

রাত সাড়ে এগারোটার দিকে রাফির একটা টেলিফোন এল। অপরিচিত নম্বর। এত রাতে কে ফোন করেছে ভাবতে ভাবতে রাফি টেলিফোন ধরল, হ্যালো।

রাফি? আমি ঈশিতা। এত রাতে ফোন করলাম কিছু মনে কোরো না।

মনে করার কী আছে? যতক্ষণ জেগে আছি, ফোন ধরা সমস্যা নয়। ঘুমিয়ে পড়লে অন্য কথা। কী ব্যাপার? তোমার নিজের ফোন কী হলো? কোথা থেকে ফোন করছ?

আমার ফোন ট্যাপ করছে, তাই ওটা ব্যবহার করা ছেড়ে দিয়েছি। ওই ফোন থেকে যাকে ফোন করি, তার বারোটা বেজে যায়।

কী বলছ বুঝতে পারছি না।

প্রত্যেক দিন একটা করে নতুন সিম জোগাড় করি, কয়েকবার ব্যবহার করে ফেলে দিই! এখন বুঝতে পারছি জঙ্গিদের এতগুলো করে সিম থাকে কেন!

রাফি ভুরু কুঁচকে বলল, তুমি তো আমাকে চিন্তার মধ্যে ফেলে দিলে! এ চিন্তারই ব্যাপার। যাই হোক, কদিন থেকে খুব চাপের মধ্যে আছি—কারও সঙ্গে কথা বলে একটু হালকা হওয়ার ইচ্ছে করছিল। সেই জন্য তোমাকে ফোন করেছি। একটু কথা বলি তোমার সঙ্গে?

বলো।

শারমিন কেমন আছে?

ভালো। আমরা শুধু তার ম্যাথ ক্যাপাবিলিটি দেখেছি। কম্পিউটারের সামনে বসিয়ে দিলে সে অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটিয়ে ফেলে। না বুঝে সে ওয়েবসাইট হ্যাক করে ফেলতে পারে।

সত্যি?

হ্যাঁ। কীভাবে করে সেটা একটা মিষ্ট্রি। যাই হোক, তোমার কথা শুনি। তুমি কী নিয়ে এত চাপের মধ্যে আছ?

ঈশিতা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, হ্যাঁ, আমার মনে হয় তোমাদের মতো কয়েকজনকে বিষয়টা বলে রাখা ভালো। আমার যদি কিছু হয় তাহলে তোমরা যেন জানো তোমাদের কী করতে হবে।

তোমার কিছু একটা হবে কেন? কী হবে?

বলছি। তোমাকে এনডেভারের কথা বলেছিলাম, মনে আছে?

হ্যাঁ মনে আছে।

তোমাদের বায়োকেমিস্ট্রির টিচার সমীরের এফটি টুয়েন্টি সিক্স ভাইরাসের কথা মনে আছে?

রাফি বলল, মনে আছে।

টিঅ্যান্ডটি বস্তিতে সেই ভাইরাসের এপিডেমিক হলো মনে আছে?

হ্যাঁ, মনে আছে। এনডেভারে তাদের চিকিৎসা হচ্ছে।

আমার হাইপোথিসিস এ রকম। এনডেভার যে নিউরাল কম্পিউটারের কথা বলে, সেটা আসলে ভাঁওতাবাজি। তারা নিউরাল কম্পিউটার তৈরি করে সত্যিকারের মানুষ দিয়ে। মানুষের ব্রেনে তারা কিছু একটা করে তাকে কম্পিউটার হিসেবে ব্যবহার করে।

রাফি বলল, ঠিক বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে না। কিন্তু বলতে থাকো।

কাজেই এনডেভারের হাইফাই মাইক্রোপ্রসেসর মেমোরির দরকার নেই। তাদের দরকার মানুষ। মানুষের ব্রেন। তাই তারা এসেছে বাংলাদেশে। তাদের ধারণা, এই দেশের গরিব মানুষের ব্রেন তারা ব্যবহার করতে পারবে। তারা শুরুও করেছে।

রাফি বলল, তোমার ধারণা এফটি টুয়েন্টি সিক্স ভাইরাসটা এনডেভার ছড়িয়েছে?

এক্সাক্টলি। যারা এফেক্টেড হয়েছে তাদের চিকিৎসার নাম করে নিজেদের বিল্ডিংয়ে নিয়ে গেছে। কাউকে কাউকে ভালো বলে ছেড়ে দিচ্ছে। কাউকে কাউকে রেখে দিচ্ছে।

রেখে দিচ্ছে মানে? বস্তির মানুষ গরিব থাকতে পারে, তাই বলে নিজের ছেলেমেয়ে, আত্মীয়স্বজনকে রেখে দেবে? মারাও যদি যায় তাহলেও তো ডেডবডি এনে জানাজা পড়াবে।

ঈশিতা বলল, সেটা সত্যি। আর এ রকম একটা ব্যাপার দিয়েই আমি নিশ্চিত হয়েছি।

কীভাবে।

একজন মহিলার বাচ্চার কোনো খোঁজ নেই। মহিলা বলছে এনডেভারের অ্যাম্বুলেন্স তাকে নিয়ে গেছে। কিন্তু রোগীর লিস্টে তার নাম নেই। মহিলা যখন চেঁচামেচি শুরু করেছে, তখন তাকে মেরে ফেলল।

কী বললে? রাফি আর্তনাদ করে বলল, মেরে ফেলল?

হ্যাঁ। পত্রিকায় খবর এসেছে সুইসাইড, কিন্তু আমি জানি এটা মার্ডার। আমার কাছে বাচ্চার একটা ছবি আছে। মহিলা মারা যাওয়ার আগে তার কাছ থেকে নিয়েছি। আমি খোঁজ নিয়ে কনফার্মড হয়েছি, বাচ্চাটা ভেতরে আছে। ডিপ কোমায়—কিন্তু বেঁচে আছে।

তুমি কেমন করে কনফার্মড হলে?

সেটা অনেক লম্বা স্টোরি। তোমার সঙ্গে সামনাসামনি দেখা হলে সেটা বলব! খুবই ইন্টারেস্টিং স্টোরি।

রাফি বলল, ঈশিতা। আমি তোমাকে যতই দেখছি ততই অবাক হয়ে যাচ্ছি।

ঈশিতা হাসল, বলল তুমি আর আমাকে কখন দেখেছ? বলো, যতই শুনছি ততই অবাক হয়ে যাচ্ছি।

ঠিক আছে, যতই শুনছি ততই অবাক হয়ে যাচ্ছি। যাই হোক ঈশিতা, ড়ু ইউ নো—

নো হোয়াট?

এখন আমার মনে হচ্ছে তোমার হাইপোথিসিস সত্যি হওয়ার সম্ভাবনা আছে। তার কারণ—

কারণ?

টিঅ্যান্ডটি বস্তিতে বাচ্চাদের ভাইরাস ইনফেকশনের পর যখন তাদের এনডেভারে নিয়ে গেছে, তার পরপরই একটা প্রেস রিলিজ দিয়েছে। সেই প্রেস রিলিজে–

ঈশিতা রাফিকে কথা শেষ না করতে দিয়ে বলল, আমিও তোমাকে সেই কথাটা বলতে যাচ্ছিলাম। তারা এনাউন্স করেছে নিউরাল কম্পিউটারে তারা একটা মাইলফলক অতিক্রম করেছে। কীভাবে করেছে বুঝতে পারছ তো?

মানুষের ব্রেনের ভেতরে কিছু একটা করে?

হ্যাঁ। যাদের ধরে নিয়েছে তাদের প্রথমবার ব্যবহার করেছে। সাকসেসফুল এক্সপেরিমেন্ট!

রাফি লম্বা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, এখন তোমার কী প্ল্যান?

এনডেভারকে ধরিয়ে দেওয়া।

কীভাবে ধরাবে?

জানি না। কেউ আমার একটা কথাও বিশ্বাস করবে না। তার কারণ সবই আমার স্পেকুলেশন, না হয় শোনা কথা। আমার কাছে কোনো প্রমাণ নেই। সারা দেশে এনডেভারের গুড উইল খুব উঁচুতে। কেউ যদি এনডেভারের বিরুদ্ধে একটা কথা বলে সঙ্গে সঙ্গে দেশের মানুষ তাকে ক্রিমিনাল হিসেবে ধরে নেবে। সবচেয়ে বড় কথা—

কী সবচেয়ে বড় কথা?

এনডেভার টাকা দিয়ে অনেক বড় বড় লোককে কিনে নিয়েছে। ইন্টেলিজেন্সের লোকজন তাদের পক্ষে কাজ করছে। আমি কাউকে সন্দেহের কথাটা বলতেও পারব না। বলামাত্রই আমাকে খুন করে ফেলবে।

রাফি তার গাল ঘষতে ঘষতে বলল, তাহলে?

আমার প্রমাণ দরকার। প্রমাণ প্রমাণের জন্য আমার এনডেভারের ভেতরে ঢোকা দরকার। নিজের চোখে সবকিছু দেখা দরকার। ফটো তোলা দরকার, ভিডিও করা দরকার।

তুমি কেমন করে এনডেভারের ভেতরে ঢুকবে?

জানি না। এর থেকে বাঘের খাঁচায় ঢোকা বেশি সহজ আর বেশি নিরাপদ।

সেটা ঠিকই বলেছ।

যাই হোক রাফি, আমি টেলিফোনটা রাখি। তোমার সঙ্গে কথা বলে বুকটা একটু হালকা হলো। তুমি চিন্তা করে আমাকে একটু আইডিয়া দাও। ওপরের দিকে তোমার যদি লাইনঘাট থাকে আমাকে জানিও।

রাফি বলল, সরি ঈশিতা। ওপরের দিকে আমার কোনো লাইনঘাট নেই।

তাহলে চিন্তা করে একটা আইডিয়া দাও।

ঠিক আছে।

বাই রাফি।

বাই ঈশিতা। ভালো থেকো।

টুক করে লাইনটা কেটে গেল।

 

রাফি অনেকক্ষণ চুপ করে বসে থাকে। সে টের পাচ্ছিল তার শরীরের ভেতর এক ধরনের ক্রোধ পাক খেয়ে বেড়াচ্ছে। এনডেভারের মতো একটা প্রতিষ্ঠান এই দেশে এসেছে মানুষের মস্তিষ্কের জন্য, তারা কেটেকুটে ইলেকট্রনিক ইমপ্লান্ট বসিয়ে এক ধরনের নিউরাল কম্পিউটার তৈরি করবে। কিন্তু সেই কথাটা তারা কাউকে জানাতেও পারবে না, এটি কী রকম কথা?

রাফি ঘর থেকে বের হয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। তার এই ছোট বাসাটার সামনে এক চিলতে বারান্দা আছে, সেই বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশ দেখা যায়। রাফি দেখল, আকাশে মেঘ এবং সেই মেঘের মাঝে বিদ্যুৎ খেলা করছে। দূরে কোথাও বৃষ্টি হয়েছে এবং সেখান থেকে এক ঝলক ঠান্ডা বাতাস এসে তার শরীরকে শীতল করে দিল। ঠিক তখন তার শারমিনের কথা মনে পড়ল! শারমিনকে ঠিক করে ব্যবহার করতে পারলে সে নিশ্চয়ই এনডেভারের ডেটাবেসে ঢুকে সব তথ্য বের করে আনতে পারবে! ব্যাপারটা আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে অসম্ভব, কিন্তু শারমিনের পক্ষে এটি সম্ভব হতে পারে। সারা পৃথিবীতে মনে হয় শুধু এই বাচ্চা মেয়েটিই এই অসম্ভব। কাজটি করতে পারবে। রাফির মনে হলো যে এক্ষুনি ফোন করে সে ঈশিতাকে কথাটা বলে, কিন্তু ঘড়ি দেখে সে শেষ পর্যন্ত ফোন করল না। তা ছাড়া ঈশিতা তার টেলিফোন নিয়ে যে রকম ভয়ভীতি দেখিয়েছে এভাবে হুঁট করে ফোন করা হয়তো ঠিকও হবে না। কাল পরশু উইকএন্ড, ইউনিভার্সিটি বন্ধ, কাজেই শারমিনকে নিয়ে সে এনডেভারের সাইটটাকে হ্যাক করার চেষ্টা করবে! যদি সত্যি সত্যি করতে পারে তাহলে ঈশিতার সঙ্গে যোগাযোগ করবে। ভোরবেলা তারা শারমিনের বাসাটি খুঁজে বের করতে হবে-কাজটি খুব কঠিন হওয়ার কথা নয়।

রাফির মস্তিষ্ক নিশ্চয়ই উত্তেজিত হয়েছিল। কারণ, সারা রাত সে এনডেভারের ওয়েবসাইট স্বপ্নে দেখল। তার ভেতরে গোলকধাঁধার মতো একটা জায়গায় শারমিন আর সে আটকা পড়ে গেছে; বের হওয়ার চেষ্টা করছে, কিন্তু বের হতে পারছে না। সে শুনতে পাচ্ছে, ঈশিতা চিৎকার করছে, কিন্তু সে তার কাছে যেতে পারছে না। বারবার চেষ্টা করছে, কিন্তু অদৃশ্য একটা দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসছে।

 

ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে দ্রুত নাশতা করে রাফি বের হয়ে পড়ে। ক্যাম্পাসের দারোয়ানদের জিজ্ঞেস করতেই তারা শারমিনের বাসার ঠিকানা বলে দিল। রাফি রিকশা করে সেখানে হাজির হলো। ছোট টিনের ছাপড়া ঘর। কাছাকাছি। অনেক বাসা, বাইরে ছোট ছোট বাচ্চারা ধুলায় গড়াগড়ি দিয়ে খেলছে। শারমিনের কথা জিজ্ঞেস করতেই একজন রাফিকে তাদের বাসায় নিয়ে গেল।

শারমিন তার মায়ের সঙ্গে কলতলায় বসে থালা-বাসন ধুচ্ছিল। রাফিকে দেখে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল, আনন্দে তার মুখে হাসি ফুটে ওঠে, স্যার! আপনি এসেছেন।

রাফি বলল, হ্যাঁ, আমি এসেছি। শারমিন তার মায়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়, মা, যে স্যার আমাকে লাল রঙের চশমা দিয়ে পড়ালেখা করতে শিখিয়েছেন, ইনিই হচ্ছেন সেই স্যার।

মা শাড়ির আঁচল মাথায় তুলে হাসিমুখে বললেন, আপনার লেখাপড়া শেখা মেয়ে এখন দিনরাত খালি পড়ে আর পড়ে। সংসারের কোনো কাজ করতে চায় না।

রাফি ঠিক বুঝতে পারল না এই মহিলার কি তার মেয়ের ক্ষমতা সম্পর্কে কোনো ধারণা আছে কি না সে হাসি হাসি মুখ করে বলল, ভালো তো! যত পড়বে তত শিখবে!

মা বললেন, আমরা গরিব ঘরের মানুষ। আমাদের এত লেখাপড়ার দরকার কী!

রাফি বলল, কী বলেন আপনি? শারমিন কত ব্রাইট একটা মেয়ে, আপনি জানেন, দেখবেন, সে কত বড় হবে!

রাফির গলার স্বর শুনে ভেতর থেকে শারমিনের বাবা বের হয়ে এল, খুব ব্যস্ত হয়ে ভেতর থেকে একটা কাঠের চেয়ার টেনে এনে তাকে বসতে দিল। রাফি চেয়ারে বসে বলল, আমি একটা কাজে এসেছি।

বলেন, কী কাজ।

কম্পিউটারে আমার কিছু কাজ ছিল, আমি সেখানে শারমিনের একটু হেল্প নিতে চাই।

বাবা হেসে ফেলল। বলল, শারমিন আপনাকে সাহায্য করতে পারবে? ও তো জীবনে কম্পিউটার দেখেই নাই।

রাফি বলল, সেটা নিয়ে আমি মাথা ঘামাচ্ছি না। তাকে যতটুকু শেখাতে হবে, আমি সেটা শেখাব।

বাবা শারমিনের দিকে তাকিয়ে বলল, এই মেয়ে তো আপনার কাছে যাওয়ার জন্যে একপায়ে খাড়া। আপনি প্রথম তার ক্ষমতাটা বের করেছেন—আপনি তার ব্রেনের সমস্যা দূর করে লেখাপড়া করতে শিখিয়েছেন, আপনি তাকে বইপত্র পড়তে দিচ্ছেন, সেদিন আপনি আপনার কম্পিউটার তাকে ব্যবহার করতে দিলেন—সবই তো আপনিই করেছেন। এই মেয়ে যতখানি আমার, ততখানি আপনার।

গুড। আপনার মেয়ের ব্রেনটাকে আমি আজকে আর কালকে একটু ব্যবহার করব!

কোনো সমস্যা নাই।

রাফি বলল, শুধু একটা ব্যাপার।

কী ব্যাপার? আমি যে শারমিনকে দিয়ে এসব কাজ করাচ্ছি, আপনি সেগুলো কাউকে বলবেন না।

শারমিনের বাবা বলল, মাথা খারাপ! ভোটকা হান্নানের পর আমার শিক্ষা হয়ে গেছে। আমি কাউকে কিছু বলি না।

হ্যাঁ, বলার দরকার নেই।

রাফি তখন তখনই শারমিনকে নিয়ে বের হতে চাইছিল, কিন্তু তাকে চা খেতে হলো এবং একটু পায়েস খেতে হলো। পায়েস রাফির প্রিয় খাবার নয়, গরিব মানুষের ঘরের পায়েসও ভালো হয় না, কিন্তু রাফি অবাক হয়ে দেখল, পায়েসটা চমৎকার।

রিকশায় উঠে রাফি শারমিনকে বলল, আমি তোমাকে এখন যে কথাগুলো বলব, তুমি সে কথাগুলো কাউকে বলবে না।

শারমিন মুখ শক্ত করে বাধ্য মেয়ের মতো বলল, বলব না।

তুমি ছোট একটি মেয়ে, কিন্তু এখন আমি তোমার সঙ্গে কথা বলব বড় মানুষের মতো। বুঝেছ?

শারমিন মাথা নাড়ল। রাফি বলল, আমাদের দেশে এনডেভার নামে একটা কম্পিউটারের কোম্পানি এসেছে বিশেষ এক ধরনের কম্পিউটার বানানোর জন্য। মানুষের ব্রেন যেভাবে কাজ করে, এই কম্পিউটারগুলো সেভাবে কাজ করবে। কিন্তু এরা কম্পিউটার না বানিয়ে কী করছে, জানো?

কী?

সত্যি সত্যি মানুষকে ধরে নিয়ে তাদের ব্রেন দিয়ে কম্পিউটার বানাচ্ছে।

শারমিন চমকে উঠে বলল, সর্বনাশ!

হ্যাঁ, সর্বনাশ! রাফি বলল, ঢাকা থেকে একজন সাংবাদিক আপা এসেছিল, মনে আছে তোমার?

হ্যাঁ, ঈশিতা আপু।

সেই ঈশিতা আপু এই জিনিসটা জানতে পেরেছে, কিন্তু মুশকিল হয়েছে কি, জানো?

কী?

সেটা কোনোভাবে প্রমাণ করা যাচ্ছে না। আর প্রমাণ করা না গেলে এনডেভারকে ধরা যাচ্ছে না। আর এনডেভারকে ধরা না গেলে তারা এ দেশে বসে গরিব মানুষের বাচ্চা-কাচ্চাকে ধরে ধরে তাদের ব্রেনকে ব্যবহার করবে। বুঝছো?

শারমিন মাথা নেড়ে বলল, বুঝেছি।

এখন আমি তোমাকে কেন নিয়ে এসেছি, বুঝেছো?

শারমিন মাথা নাড়ল, বলল, না, বুঝি নাই।

তুমি এনডেভারের ওয়েবসাইটে ঢুকবে। তখন আমরা সেখান থেকে এনডেভারের সব তথ্য বের করে আনব।

আমি পারব?

হ্যাঁ, পারবে। আমি তোমাকে বলে দেব, কী করতে হবে। একটা ওয়েবসাইটে ঢুকতে হলে কিছু বেআইনি কাজ করতে হয়। আমরা সেই বেআইনি কাজ করব, কেউ জানবে না সেটা তুমি করেছ। যদি জানতেও পারে, সেটা হবে আমার কম্পিউটার। কাজেই দোষ হলে সেটা হবে আমার। তোমার কোনো ভয় নেই।

শারমিন হেসে বলল, আমার কথা জানলেও ক্ষতি নাই! আমি ভয় পাই।

তার পরও তোমাকে এই ঝামেলা থেকে দূরে রাখব। মাঝে মাঝে কিছু জটিল সমস্যা থাকবে, তোমাকে তার সমাধান করে দিতে হবে।

কী রকম সমস্যা?

তুমি এর মধ্যে এগুলো করেছ। বড় একটা সংখ্যাকে দুটি উৎপাদকে। বের করা। কিংবা একটা পাসওয়ার্ডকে গোপন করে রাখা আছে, সেটা বের করা। এ রকম কাজ—অন্য যেকোনো মানুষের জন্য সেটা অসম্ভব, কিন্তু আমার ধারণা, তুমি পারবে।

 

ছুটির দিন বলে ইউনিভার্সিটিতে মানুষজন খুব বেশি নেই। রাফি শারমিনকে নিয়ে তাদের নেটওয়ার্কিং ল্যাবে ঢুকল। বিকেলের দিকে এই ল্যাবে কাজ করার জন্য কিছু ছাত্র আসে, এখন কেউ নেই। কেউ আসার আগে রাফি এনডেভারের ওয়েবসাইটটা হ্যাক করে ফেলতে চায়। _ শারমিনকে বিষয়টা বোঝাতে খুব বেশি সময় লাগল না। কোথা থেকে হ্যাক করছে, যেন জানতে না পারে, সে জন্য আইপি অ্যাড্রেসটাকে একটু পরে পরে বানোয়াট আইপি অ্যাড্রেস দিয়ে পাল্টে দিতে হচ্ছিল। সিকিউরিটি অসম্ভব কঠিন। একবার মনে হচ্ছিল বুঝি, ডেটাবেসে ঢোকাই যাবে না, কিন্তু শারমিন কীভাবে জানি ঢুকে গেল। সেখানে সিকিউরিটির নানা পর্যায়ের এনক্রিপটেড সংখ্যাগুলো পাওয়া গেল। শারমিন সেগুলো নিয়ে কাজ করতে থাকে। একটা সুপার কম্পিউটার কয়েক মাস চেষ্টা করে যেটা বের করতে পারত, শারমিন ঘণ্টা খানেকের মধ্যে সেটা করে ফেলল। শারমিন যদিও রাফিকে কিছু বলল না, কিন্তু রাফি বুঝতে পারল, তার অসম্ভব পরিশ্রম হয়েছে। সে যখন কম্পিউটার মনিটরে দীর্ঘ সংখ্যাগুলোর দিকে একদৃষ্টে নিঃশব্দে তাকিয়ে থাকে, তখন তাকে দেখে মনে হয়, সে বুঝি অন্য জগতের মানুষ। তার চোখমুখ কঠিন হয়ে যায়, জোরে জোরে নিঃশ্বাস নেয় এবং কখনো কখনো দুই হাত দিয়ে তার মাথা চেপে ধরে রাখে। রাফির ভয় হয়, এই অমানুষিক একটা কাজ করতে গিয়ে তার মাথার ভেতরে রক্তের কোনো ধমনি না ছিঁড়ে যায়।

শেষ পর্যন্ত এনক্রিপশনটা ভেঙে শারমিন বলল, স্যার, এই যে এটা করেছি। দেখেছেন, হয়েছে কি না?

দেখছি। তুমি একটু রেস্ট নাও।

আগে দেখেন, যদি হয়ে থাকে তাহলে রেস্ট নেব।

রাফি কাঁপা হাতে দুই শ পঞ্চাশ ঘর লম্বা একটা সংখ্যা খুব সাবধানে প্রবেশ করাল। কয়েক মুহূর্তের জন্য কম্পিউটার মনিটরটি স্থির হয়ে থাকে। তারপর হঠাৎ করে তার সামনে এটি উন্মুক্ত হয়ে যায়। রাফি নিঃশ্বাস বন্ধ করে কি-বোর্ডে দু-একটি অক্ষর লিখে পরীক্ষা করে। শারমিন উৎকণ্ঠিত গলায় বলল, হয়েছে?

হ্যাঁ, হয়েছে। রাফি শারমিনের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, চমৎকার শারমিন। ফ্যান্টাস্টিক। রাফি দেখল, শারমিনের মাথাটা আগুনের মতো গরম হয়ে আছে, কী আশ্চর্য!

শারমিন দুর্বল গলায় বলল, আমি একটু বিশ্রাম নিই?

নাও।

রাফির কথা শেষ হওয়ার আগেই শারমিন টেবিলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ল। রাফি শারমিনকে ধরে ল্যাবের পেছনে রাখা সোফায় শুইয়ে দিল। তারপর নিঃশব্দে সে নিজে এনডেভারের ডেটাবেসে ঘুরে বেড়াল। অত্যন্ত জটিল একটি সিস্টেম। প্রতিটি মানুষের সব তথ্য রয়েছে। কোন মানুষের কতটুকু সিকিউরিটি ক্লিয়ারেন্স, তা ঠিক করে দেওয়া আছে। পুরো বিল্ডিংটি অসংখ্য সিসি ক্যামেরা দিয়ে নজরে রাখা হয়েছে। ইচ্ছে করলে সে যেকোনো কিছু দেখতে পারে। রাফি ইচ্ছে করলে এখন যেটা ইচ্ছে সেটা পরিবর্তন করে দিতে পারে, কিন্তু সে কোনো কিছু স্পর্শ করল না। এনডেভারের কেউ যেন বুঝতে না পারে, সে ভেতরে ঢুকেছিল, সে জন্য তার কোনো চিহ্ন না রেখে সে আবার বের হয়ে এল।

শারমিন ঘণ্টা খানেক পর হঠাৎ করে জেগে উঠে এদিক-সেদিক তাকাতে থাকে। তাকে দেখে মনে হয়, সে বুঝতে পারছে না, সে কোথায়। রাফি বলল, কী হলো, শারমিন, তোমার ঘুম ভাঙল?

শারমিন লাজুক মুখে বলল, হায় খোদা! আমি কতক্ষণ ঘুমিয়েছি?

প্রায় এক ঘণ্টা।

এক ঘণ্টা! স্যার, আপনি আমাকে জাগিয়ে দিলেন না কেন?

রাফি বলল, তোমার ঘুমটার দরকার ছিল। মানুষের ব্রেন কীভাবে কাজ করে, এখনো মানুষ জানে না। আর তোমার মতো ব্রেন সম্পর্কে তো আরও কিছু জানে না। তুমি যখন ওই অসাধ্য কাজটা করেছ, তখন তোমার ব্রেনে খুব চাপ পড়েছে। তাই ঘুমটার দরকার ছিল।

শারমিন কিছু বলল না, মাথা নাড়ল। রাফি বলল, আমার অনুমান যদি ঠিক হয়, তাহলে তোমার অসম্ভব খিদে পাওয়ার কথা।

শারমিন আবার মাথা নাড়ল। রাফি বলল, আমার আগেই বিষয়টা খেয়াল করা উচিত ছিল। তোমার জন্য কিছু খাবার আনা উচিত ছিল।

শারমিন বলল, না না। লাগবে না। আমি বাসায় গিয়ে খাব।

বাসায় গিয়ে নিশ্চয়ই খাবে। তার আগে চলো, আমি আর তুমি অন্য কিছু খাই। আজ তো ছুটির দিন, ক্যাম্পাসে ক্যানটিন বন্ধ। বাইরে গিয়ে খেতে হবে। বলো শারমিন, তুমি কী খেতে চাও। তুমি যত বড় কাজ করে দিয়েছ, তোমাকে ফাইভ স্টার হোটেলে নিয়ে খাওয়ানো উচিত!

শারমিন বলল, কাজ হয়েছে, স্যার?

তুমি এনডেভারে ঢোকার ব্যবস্থা করে দিয়েছ, এখন কাজ হবে। কঠিন কাজটা শেষ। এখন বাকি শুধু ছোট ছোট কাজ। সেখানেও তোমাকে লাগবে। কালকে আবার বসব। ঠিক আছে?

ঠিক আছে।

শারমিনকে নিয়ে একটা চায়নিজ রেস্টুরেন্টে খেতে খেতে রাফি ঈশিতাকে ফোন করল। ঈশিতা ফোন ধরল না। কিন্তু এক মিনিটের মধ্যে অন্য একটা নাম্বার থেকে তাকে ফোন করল। রাফি বলল, ঈশিতা, তুমি কোথায়?

অফিসে।

তুমি এই মুহূর্তে এখানে চলে আসো।

এই মুহূর্তে তো পারব না। আসতে আসতে কাল ভোর হয়ে যাবে। রাফি বলল, ঠিক আছে। কাল ভোরের ভেতর আসো।

কেন, বলবে?

না। শুধু জেনে রাখো, তোমার সমস্যার সমাধান হয়েছে।

আমি আসছি।

ঈশিতা খুট করে লাইন কেটে দিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *