০১. সিঁড়ি দিয়ে বেশ কয়েকটা মেয়ে

উৎসর্গ

সায়মা ছবি আঁকে, কবিতা লেখে, গণিত অলিম্পিয়াডে পুরস্কারও পায়। একদিন সে আমার সাথে ফোনে যোগাযোগ করেছে, আমি তখন হতবাক হয়ে জানলাম, তার জীবনটি তছনছ হয়ে গেছে। অ্যাকসিডেন্টে সে পুরোপুরি চলৎশক্তিহীন, নিঃশ্বাসটুকুও নিতে হয় যন্ত্র দিয়ে। সারা শরীরে সে শুধু একটি আঙুল নাড়াতে পারে। সেই আঙুল দিয়েই সে ছবি আঁকে, কবিতা লেখে। মোবাইল টেলিফোনে এসএমএস করে, সে আমাকে তার ভারি সুন্দর কবিতাগুলো পাঠাত। আমি তাকে বলেছিলাম, যখন বেশ কিছু কবিতা লেখা হবে, তখন একুশে বইমেলায় তার একটি বই বের করে দেব।

কিছুদিন আগে তার এক বান্ধবী আমাকে ফোন করে জানিয়েছে, সায়মা মারা গেছে; তার কবিতার বইটি আর বের করা হলো না।

যারা সায়মার মতো কখনো জীবনযুদ্ধে পরাজিত হতে জানে না, এই বই তাদের উদ্দেশে।

০১.

সিঁড়ি দিয়ে বেশ কয়েকটা মেয়ে হাসতে হাসতে কথা বলতে বলতে নেমে আসছে, রাফি একটু সরে গিয়ে তাদের জায়গা করে দিল। মেয়েগুলো রাফিকে প্রায় ধাক্কা দিয়ে হাসতে হাসতে নিচে নেমে গেল, তাকে ভালো করে লক্ষও করল না। লক্ষ করার কথা নয়—সে আজ প্রথম এই ডিপার্টমেন্টে লেকচারার হিসেবে যোগ দিতে এসেছে, মাত্র ডিগ্রি শেষ করেছে, তার চেহারায় এখনো একটা ছাত্র-ছাত্র ভাব, তাই তাকে ছেলেমেয়েরা আলাদাভাবে লক্ষ করবে, সেটা সে আশাও করে না। দোতলায় উঠে করিডর ধরে সে হাঁটতে থাকে, ছেলেমেয়েরা ইতস্তত ছড়িয়ে-ছিটিয়ে গল্পগুজব করছে, সাহসী একটা মেয়ে নির্বিকারভাবে রেলিংয়ে পা তুলে বসে আছে। তাকে কেউ চেনে না, তাই কেউ তার জন্য জায়গা ছেড়ে দিল না, রাফি ছেলেমেয়েদের মাঝখানে জায়গা করে করে সামনের দিকে হেঁটে যায়।

করিডরের শেষ মাথায় হেড অব দ্য ডিপার্টমেন্টের রুম। দরজাটা খোলা, রাফি পর্দা সরিয়ে মাথা ঢুকিয়ে।একনজর দেখল। বড় একটা সেক্রেটারিয়েট টেবিলে পা তুলে দিয়ে প্রফেসর জাহিদ হাসান তাঁর চেয়ারে আধা শোয়া হয়ে একটা বই দেখছেন। রাফি এক মুহূর্ত ইতস্তত করে বলল, আসতে পারি, স্যার?

প্রফেসর জাহিদ হাসান চোখের কোনা দিয়ে তাকে দেখে আবার বইয়ের পাতায় চোখ ফিরিয়ে বললেন, আসো।

রাফি বুঝতে পারল, প্রফেসর জাহিদ হাসান তাকে চিনতে পারেননি। সে এগিয়ে টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে বলল, স্যার, আমি রাফি আহমেদ।

প্রফেসর জাহিদ হাসান বই থেকে চোখ না তুলে বললেন, বলো রাফি আহমেদ, কী দরকার?

স্যার, আমি এই ডিপার্টমেন্টে জয়েন করতে এসেছি।

প্রফেসর হাসান হঠাৎ করে তাকে চিনতে পারলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তিনি টেবিল থেকে পা নামালেন এবং খুব একটা মজা হয়েছে, সে রকম ভঙ্গি করে বললেন, আই অ্যাম সরি, রাফি! আমি ভেবেছি, তুমি একজন ছাত্র!

রাফি মুখে একটু হাসি-হাসি ভাব ধরে রাখল। প্রফেসর জাহিদ হাসান হঠাৎ ব্যস্ত হওয়ার ভঙ্গি করে বললেন, বসসা, বসো রাফি, তুমি দাঁড়িয়ে আছ কেন?

রাফি সামনের চেয়ারটায় বসে। চোখের কোনা দিয়ে প্রফেসর জাহিদ হাসানের অফিস ঘরটি দেখে। বড় সেক্রেটারিয়েট টেবিলটি কাগজপত্র, বইখাতায় বোঝাই, সেখানে তিল ধারণের জায়গা নেই। শুধু যে টেবিলে বইখাতা, কাগজপত্র তা নয়, প্রায় সব চেয়ারেই বই, খাতাপত্র রয়েছে। পাশে ছোট একটা টেবিলে একটা কম্পিউটার, পুরোনো সিআরটি মনিটর। চারপাশে শেলফ এবং সেখানে নানা রকম বই। শেলফের ওপর কিছু কাপ, শিল্ড আর ক্রেস্ট। ডিপার্টমেন্টের ছেলেমেয়েরা দৌড়-ঝাঁপ করে সম্ভবত এগুলো পেয়েছে।

প্রফেসর জাহিদ হাসান বললেন, তুমি কখন এসেছ? কোনো সমস্যা হয়নি তো?

সকালে পৌঁছেছি। কোনো সমস্যা হয়নি।

কোথায় উঠেছ?

গেস্ট হাউসে। গুড।

প্রফেসর হাসান গলা উঁচিয়ে ডাকলেন, জাহানারা, জাহানারা।

পাশের অফিস ঘর থেকে হালকা-পাতলা একটা মেয়ে হাতে কিছু কাগজপত্র নিয়ে ঢুকে বলল, জি স্যার। এ এই হচ্ছে রাফি আহমেদ। আমাদের নতুন টিচার। তুমি এর জয়েনিং লেটারটা রেডি করো।

জি স্যার।

আর রাফি, তুমি জাহানারাকে চিনে রাখো। কাগজে-কলমে আমি এই ডিপার্টমেন্টের হেড, আসলে ডিপার্টমেন্ট চালায় জাহানারা। ও যেদিন চাকরি ছেড়ে চলে যাবে, আমিও সেদিন চাকরি ছেড়ে চলে যাব।

জাহানারা নামের হালকা-পাতলা মেয়েটি বলল, স্যার, আপনি যেদিন চাকরি ছেড়ে চলে যাবেন, আমিও সেদিন চাকরি ছেড়ে চলে যাব।

গুড। তাহলে আমিও আছি, তুমিও আছ। প্রফেসর জাহিদ হাসান উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, চলো, তোমার সঙ্গে অন্য সবার পরিচয় করিয়ে দিই।

রাফি উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ঠিক আছে, স্যার।

প্রফেসর হাসান তার অফিস থেকে বের হয়ে করিডর ধরে হাঁটতে থাকেন, একটু আগে যে ছেলেমেয়েগুলো ভিড় করে দাঁড়িয়ে উচ্চস্বরে কথা বলছিল, তারা এবার তাদের গলা নামিয়ে ফেলল। তারা হাত তুলে প্রফেসর হাসানকে সালাম দেয় এবং দুই পাশে সরে গিয়ে তাকে জায়গা করে দেয়। যে সাহসী মেয়েটি রেলিংয়ের ওপর নির্বিকারভাবে বসেছিল, সেও তড়াক করে লাফ দিয়ে নিচে নেমে মুখে একটা শিশুসুলভ নিরীহ ভাব ফুটিয়ে তোলে। প্রফেসর হাসান একটা ঘরের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে গেলেন, ঘরের চার কোনায় চারটা ডেস্ক, তিনটিতে যে তিনজন বসেছিল, তারা তাঁকে দেখে দাঁড়িয়ে যায়। দুজন ছেলে এবং একজন মেয়ে, এরাও শিক্ষক, এবং এদেরও দেখে শিক্ষক মনে হয় না, চেহারায় একটা ছাত্র-ছাত্র ভাব রয়ে গেছে। প্রফেসর জাহিদ হাসান বললেন,এই যে, এ হচ্ছে রাফি আহমেদ। আমাদের নতুন কলিগ!

ও! বলে তিনজনই তাদের ডেস্ক থেকে বের হয়ে কাছাকাছি চলে আসে। প্রফেসর হাসান পরিচয় করিয়ে দিলেন, এ হচ্ছে কবির, এ হচ্ছে রানা আর এ হচ্ছে সোহানা। এর বাড়ি সিলেট, তাই নিজের নামটাও ঠিক করে উচ্চারণ করতে পারে না। বলে সুহানা।

সোহানা নামের মেয়েটি ফিক করে হেসে ফেলল। বলল, স্যার, আমি ঠিকই সোহানা উচ্চারণ করতে পারি। কিন্তু আমার নাম সোহানা না, আমার নামই সুহানা! তা ছাড়া আমার বাড়ি সিলেট না, আমার বাড়ি নেত্রকোনা।

প্রফেসর হাসান হাসলেন। বললেন, আমি জানি। একটু ঠাট্টা করলাম। তারপর রাফির দিকে ঘুরে তাকিয়ে বললেন, এরা তিনজনই আমার ডিরেক্ট স্টুডেন্ট। নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার হয়েছে তো, তাই এদের ভেতর হালকা একটু মাস্তানি ভাব আছে, তাই এদের একটু তোয়াজ কোরো, না হলে এরা কিন্তু তোমার জীবন বরবাদ করে দেবে।

কবির নামের ছেলেটি বলল, স্যার, মাত্র এসেছে, আর আপনি আমাদের মাস্তান-টাস্তান কত কিছু বলে দিলেন!

প্রফেসর হাসান হাসলেন, ডন্ট ওরি। রাফি খুব স্মার্ট ছেলে, শুধু শুধু আমি তাকে টিচার হিসেবে নিইনি। সে ঠিকই বুঝে নেবে, আসলেই তোমরা মাস্তান হলে আমি তোমাদের মাস্তান হিসেবে পরিচয় করাতাম না। ঠিক কি না?

রাফি কী বলবে বুঝতে না পেরে হাসি হাসি মুখ করে মাথা নাড়ল। সে টের পেতে শুরু করেছে, তার বুকের ভেতর ভারটা আস্তে আস্তে নেমে যাচ্ছে। নতুন জায়গায় প্রথমবার কাজ করতে এসে কীভাবে সবকিছু সামলে নেবে, সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তা ছিল, সেই দুশ্চিন্তা ধীরে ধীরে উবে যেতে শুরু করেছে। ডিপার্টমেন্টের শিক্ষকদের মধ্যে খুব সহজ একটা সম্পর্ক আছে, সেটা সে বুঝতে শুরু করেছে। এ রকম সময় দরজার পর্দা সরিয়ে আরেকজন মাথা ঢোকাল, কবির নামের ছেলেটি তাকে ডাকল, স্যার আসেন, আমাদের নতুন টিচার জয়েন করেছে।

পর্দা সরিয়ে বিষণ্ণ চেহারার একটা মানুষ ভেতরে এসে ঢোকে। রাফির কাছাকাছি এসে বলে, তুমি তাহলে আমাদের নতুন টিচার? গুড। আইসিটি কনফারেন্সে তুমি নিউরাল কম্পিউটারের ওপর একটা পেপার দিয়েছিলে?

রাফি মাথা নাড়ল। বলল, জি স্যার।

ভালো পেপার, পালিশ-টালিশ করলে ভালো জার্নালে পাবলিশ হয়ে যাবে। কাজটা কে করেছিল? তুমি, না তোমার স্যার?

আইডিয়াটা স্যার দিয়েছিলেন, কাজটা আমার। আর প্রথম যে আইডিয়াটা ছিল, সেখান থেকে অনেক চেঞ্জ হয়েছে।

তা-ই হয়। তা-ই হওয়ার কথা।

প্রফেসর জাহিদ হাসান বললেন, ইনি হচ্ছেন ডক্টর রাশেদ। আমাদের নতুন ইউনিভার্সিটি, সিনিয়র টিচারের খুব অভাব। ষোলোজন টিচারের মধ্যে মাত্র আটজন ডক্টরেট। রাশেদ হচ্ছেন সেই আটজনের একজন।

রাফি বলল, জানি স্যার। যখন ইন্টারভিউ দিতে এসেছিলাম, তখন সব খোঁজখবর নিয়েছিলাম।

গুড। তাহলে তো ভালো।

রাশেদ জিজ্ঞেস করল, একে কোথায় বসতে দেবেন, স্যার?

তোমরা বলো।

রানা নামের ছেলেটি বলল, মহাজন পট্টিতে সোহেলের রুমটা খালি আছে।

মহাজন পট্টিতে পাঠাবে?

মহাজন পট্টি শুনে রাফির চোখে-মুখে দুশ্চিন্তার একটু ছায়া পড়ল, সেটা দেখে বিষণ্ণ চেহারার রাশেদ হেসে ফেলল, হাসলেও মানুষটির চেহারা থেকে বিষণ্ণভাব দূর হয় না। হাসতে হাসতে বলল, মহাজন পট্টি শুনে তোমার ভয় পাওয়ার কিছু নেই। তিনতলায় যে এক্সটেনশন হয়েছে, সেখানে করিডরটা সরু, তাই সবাই নাম দিয়েছে মহাজন পট্টি।

এবার রাফিও একটু হাসল, বলল, ও আচ্ছা। আমাদের হোস্টেলেও একটা উইংয়ের নাম ছিল শাঁখারী পট্টি।

ঠিক এ রকম সময় দরজার পর্দা সরিয়ে জাহানারা উঁকি দেয়, স্যার, আপনাকে ভিসি স্যার খুঁজছেন। ফোনে আছেন।

আসছি। প্রফেসর হাসান কম বয়সী ছেলেমেয়ে তিনজনকে বললেন, তোমরা রাফিকে অন্যদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দাও। ওর অফিসটাও দেখিয়ে দাও। আর রাশেদ, তুমি একটু আসো আমার সঙ্গে।

প্রফেসর হাসান রাশেদকে নিয়ে বের হয়ে যাওয়ার পর কবির, রানা আর সোহানা তাদের ডেস্কের সামনে রাখা চেয়ারগুলো ঘুরিয়ে নিয়ে বসে, রাফির দিকেও একটা চেয়ার এগিয়ে দিয়ে বলল, বসো রাফি।

রাফি চেয়ারটায় বসে চোখের কোনাটি দিয়ে ঘরটি লক্ষ করল, এই বয়সী চারজন ছেলেমেয়ে এ রকম একটা ঘরে বসলে ঘরটির যে রকম দুরবস্থা হওয়ার কথা ছিল, তা হয়নি। বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। একজনের ডেস্কে একটা ল্যাপটপ, অন্য তিনটিতে এলসিডি মনিটর। পেছনে স্টিলের আলমারি, দেয়ালে খবরের কাগজের ফ্রি ক্যালেন্ডার স্কচটেপ দিয়ে লাগানো।

কবির রাফির দিকে তাকিয়ে বলল, স্যার তোমার কথা বলছিলেন, আমাদের ইউনিভার্সিটিতে বহুঁ দিন বাইরের কাউকে নেওয়া হয়নি। এবার তোমাকে নেওয়া হলো।

রানা জিজ্ঞেস করল, তুমি এ রকম হাইফাই ইউনিভার্সিটি থেকে আমাদের ভাঙাচোরা ইউনিভার্সিটিতে চলে এলে, ব্যাপারটা কী? যা রাফি মাথা নাড়ল, আমাদের ইউনিভার্সিটি মোটেও হাইফাই ইউনিভার্সিটি না। আর আপনাদের ইউনিভার্সিটিও মোটেই ভাঙাচোরা ইউনিভার্সিটি না! তা ছাড়া বাইরে আপনাদের ইউনিভার্সিটি, বিশেষ করে আপনাদের ডিপার্টমেন্টের একটা আলাদা সুনাম আছে।

সুহানা বলল, জাহিদ স্যারের জন্য।

রাফি বলল, জাহিদ স্যারকে আমার বেশ পছন্দ হয়েছে।

সুহানা মাথা নাড়ল। বলল, হ্যাঁ, স্যার খুব সুইট।

স্যার যেভাবে আপনাদের সঙ্গে কথা বলছিলেন, আর আপনারা যেভাবে স্যারের সঙ্গে কথা বলছেন, আমার ইউনিভার্সিটিতে আমরা সেটা কল্পনাও করতে পারব না। আমাদের ইউনিভার্সিটিতে গাদা গাদা সব প্রফেসর। কেউ কোনো কাজ করে না, কিন্তু সবার সিরিয়াস ইগো প্রবলেম।

রানা বলল, একেকটা ইউনিভার্সিটির একেক রকম কালচার। আমাদের ইউনিভার্সিটি তো নতুন, তাই এখনো এ রকম আছে, দেখতে দেখতে ইগো প্রবলেম শুরু হয়ে যাবে। যাই হোক, তুমি কোথায় উঠেছ?,

গেস্ট হাউসে।

কোথায় থাকবে, কী করবে, কিছু ঠিক করেছ?

না। এখনো ঠিক করিনি। আপনাদের একটু হেল্প নিতে হবে।

নো প্রবলেম।

কবির ঘড়ির দিকে তাকিয়ে হঠাৎ লাফ দিয়ে উঠল। বলল, আমার একটা ক্লাস আছে। রানা, তুই রাফিকে তার অফিসটা দেখিয়ে দিস।

সুহানা বলল, অফিসটা খালি দেখিয়ে দিলেই হলে নাকি? সোহেল অফিসটা কীভাবে রেখে গেছে, জানিস? আমাকে যেতে হবে।

কবির হা হা করে হাসল। বলল, ঠিকই বলেছিস। ভুলেই গেছিলাম যে সোহেলটা একটা আস্ত খবিশ ছিল!

রানা বলল, ওই অফিসে আধখাওয়া পিজা থেকে শুরু করে মড়া ইন্দুর—সবকিছু পাওয়া যাবে!

সুহানা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আমি অফিস থেকে চাবি নিয়ে আসি।

রানা বলল, আমি দেখি, গৌতমকে পাই নাকি। ঘরটা একটু পরিষ্কার করতে হবে।

কবির ক্লাস নিতে গেল, সুহানা গেল অফিসের চাবি আনতে আর রানা বের হয়ে গেল গৌতম নামের মানুষটিকে খুঁজে বের করতে, সম্ভবত এই বিল্ডিংয়ের ঝাড়ুদার। রাফি উঠে দাঁড়িয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। একটু দূরে এক সারি কৃষ্ণচূড়াগাছ, গাছের নিচে অনেকগুলো টংঘর, সেখানে ছেলেমেয়েরা আড্ডা মারছে, চা খাচ্ছে। রাফি অন্যমনস্কভাবে সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ একটা ব্যাপার আবিষ্কার করল। সে যে ইউনিভার্সিটি থেকে এসেছে, সেখানে সবাই অন্য রকম—কাউকে কোনো দায়িত্ব দেওয়া হলে প্রথমেই সে চেষ্টা করবে, কোনো একটা অজুহাত দিয়ে সেটা থেকে বের হয়ে আসতে। সবার ভেতর যে হাবাগোবা, শেষ পর্যন্ত তার ঘাড়ে সেই দায়িত্বটা পড়ে এবং খুবই বিরস মুখে সে সেই কাজটা করে। কোথাও কোনো আনন্দ নেই। এখানে অন্য রকম। কবির রানাকে বলল অফিসটা দেখিয়ে দিতে। সুহানা নিজে থেকে বলল তাকেও যেতে হবে। রানা তখন গেল ঝাড়ুদার খুঁজতে। খুবই ছোট ছোট কাজ কিন্তু এই ছোট ছোট কাজগুলো দিয়েই মনে হয় মানুষের জীবনটা অন্য রকম হয়ে যায়।

 

মহাজন পট্টিতে সোহেল নামের খবিশ ধরনের ছেলেটির অফিসটিকে যত নোংরা হিসেবে ধারণা দেওয়া হয়েছিল, সেটি মোটেও তত নোংরা নয়। টেবিলে এবং ফ্লোরে অনেক কাগজ ছড়ানো। ড্রয়ারে অন্যান্য জিনিসের সঙ্গে ময়লা একটা দুই টাকার নোট এবং নাদুসনুদুস একটি মেয়ের সঙ্গে সোহেলের একটা ছবি ছিল। সেটা নিয়েই সুহানা এবং রানা নানা ধরনের টিপ্পনী কাটল। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘরটি পরিষ্কার হয়ে গেল এবং গৌতম নামের মানুষটি ঝাড়ু দিয়ে জঞ্জাল পরিষ্কার করে নেওয়ার পর সেটি রীতিমতো তকতকে হয়ে ওঠে সুহানা একটি পুরোনো টাওয়েল দিয়ে ডেস্কটি মুছে একটি রিভলভিং চেয়ার টেনে নিয়ে বলল, নাও, বসো।

রাফি বসতে বসতে বলল, আমাকে কী ক্লাস নিতে হবে, জানেন?

কোয়ান্টাম মেকানিকস!

সর্বনাশ!

সর্বনাশের কিছু নেই, ইনট্রোডাক্টরি ক্লাস। এই ব্যাচের পোলাপানগুলো ভালো। আগ্রহ আছে।

ক্লাসের রুটিন কোথায় পাব, বলতে পারবেন?

সুহানা বলল, আমাদের সঙ্গে আপনি আপনি করার দরকার নেই, আমরা একই ব্যাচের!

থ্যাংক ইউ। ক্লাসের রুটিন কোথায় পাব, বলতে পারবে?

অফিসে আছে, জাহানারা আপু এতক্ষণে নিশ্চয়ই তোমার জন্য সবকিছু রেডি করে ফেলেছে। শি ইজ এ সুপার লেডি!

হ্যাঁ। জাহিদ স্যারও বলছিলেন।

রানা বলল, তাহলে চলো, তোমাকে আমাদের ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে পরিচিত করিয়ে দিই।

হ্যাঁ। সুহানা হেসে বলল, বাথরুমগুলো কোথায়, কোন টয়লেটের দরজা ভাঙা, মেয়েদের কমনরুম কোথায়!

রানা বলল, তার সঙ্গে সঙ্গে ল্যাবগুলো কোথায়, অন্য টিচাররা কে কোথায় বসে!

এবং কোন কোন টিচার থেকে সাবধানে থাকতে হবে!

রানা অর্থপূর্ণভাবে চোখ টিপে বলল, এবং কেন সাবধানে থাকতে হবে?

 

ডায়াসের ওপর দাঁড়িয়ে রাফি সামনে বসে থাকা জনাপঞ্চাশেক ছাত্রছাত্রীর দিকে তাকিয়ে একটু নার্ভাস অনুভব করে। এই মাত্র প্রফেসর জাহিদ হাসান।

তাকে ক্লাসের সামনে পরিচয় করিয়ে দিয়ে গেছেন। প্রথম দিন জয়েন করে দুই ঘণ্টার মধ্যেই তাকে জীবনের প্রথম ক্লাস নিতে হবে, সে বুঝতে পারেনি। প্রফেসর জাহিদ হাসান অবশ্যি তাকে ক্লাস নিতে বলেননি, তার ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে একটু পরিচিত হতে বলেছেন। রাফি জীবনে কখনো কোনো ক্লাস নেয়নি। কাজেই প্রায় পঞ্চাশ জন ছাত্রছাত্রীর সামনে দাঁড়িয়ে তাদের সঙ্গে পরিচিত হওয়া আর তাদের ক্লাস নেওয়ার মধ্যে তার কাছে খুব বড় কোনো পার্থক্য নেই! সে তার গলাটা একটু পরিষ্কার করে বলল, এটা আমার জীবনের প্রথম ক্লাস। আজকের এই ঘটনার কথা তোমরা সবাই ভুলে যাবে কিন্তু আমি কোনো দিন ভুলব না।

দুষ্টু টাইপের একটা মেয়ে বলল, স্যার, এখন আপনার কেমন লাগছে?

সত্যি কথা বলব?

এবার অনেকেই বলল, জি স্যার, বলেন।

আমার খুব নার্ভাস লাগছে।

ক্লাসে ছোট একটা হাসির শব্দ শোনা গেল। দয়ালু চেহারার একটা ছেলে বলল, নার্ভাস হওয়ার কিছু নাই, স্যার।

থ্যাংকু। কিন্তু তুমি যদি কোনো দিন স্যার হও, তখন তুমি যদি কোনো দিন ছেলেমেয়েভর্তি ক্লাসে দাঁড়িয়ে লেকচার দেওয়ার চেষ্টা করো, তখন তুমি আমার অবস্থাটা বুঝতে পারবে!

আবার ক্লাসের ছেলেমেয়েরা শব্দ করে হেসে উঠল। হাসির একটা গুণ আছে, মানুষ খুব সহজেই সহজ হয়ে যায়। রাফিও অনেকটা সহজ হয়ে গেল। বলল, আজ যেহেতু একেবারে প্রথম দিন, তাই আজ ঠিক পড়াব না, কীভাবে পড়াব বরং সেটা নিয়ে তোমাদের সঙ্গে কথা বলি।

ক্লাসের ছেলেমেয়েরা উৎসুক দৃষ্টিতে রাফির দিকে তাকিয়ে একটু নড়েচড়ে বসল। রাফি বলল, আমি তোমাদের যে কোর্সটা নেব, সেটার নাম ইনট্রোডাকশন টু কোয়ান্টাম মেকানিকস। আমি যখন এই কোর্সটা। প্রথম নিই, তখন যে স্যার এই কোর্সটা আমাদের পড়িয়েছিলেন, তিনি ছিলেন বুড়ো এবং বদমেজাজি। এখন আমার সন্দেহ হয়, আমার সেই স্যার মনে হয় বিষয়টা কোনো দিন নিজেও বোঝেননি। শুধু কিছু ইকুয়েশন মুখস্থ করে রেখেছিলেন। ক্লাসে এসে বোর্ডে সেগুলো লিখতেন। আমরা সেগুলো খাতায় লিখতাম। ক্লাসে প্রশ্ন করার কোনো সুযোগ ছিল না!

রাফি একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, পরের সেমিস্টারে যে ম্যাডাম এই কোর্সটা নিলেন, তিনি ছিলেন কম বয়সী এবং হাসিখুশি। তাকে কোনো প্রশ্ন করলে তিনি এত নার্ভাস হয়ে যেতেন যে আমাদের মায়া হতো। তাই আমরা কোনো দিন তাঁকে প্রশ্ন করিনি। সেমিস্টারের শেষে ম্যাডাম দশটা প্রশ্ন বোর্ডে লিখে দিতেন, তার থেকে পরীক্ষায় ছয়টা প্রশ্ন আসত! সে জন্য সবাই সেই ম্যাডামকে খুব ভালোবাসত।

সামনে বসে থাকা দুষ্টু টাইপের মেয়েটি বলল, এ রকম স্যার-ম্যাডামকে আমরাও খুব ভালোবাসি!

তার কথা শুনে ক্লাসের সবাই হেসে ওঠে। রাফিও হেসে বলল, আমি জানি, এ রকম স্যার-ম্যাডামকে ছেলেমেয়েরা খুব ভালোবাসে। যা-ই হোক, যেটা বলছিলাম, আমি এই সাবজেক্টটা কোনো ভালো টিচারের কাছে পড়তে পারিনি! কাজেই কীভাবে ভালো করে এই সাবজেক্টটা পড়াতে হয়, আমি জানি না। তবে আমি একটা জিনিস জানি! রাফি একটু থেমে সারা ক্লাসের ওপর চোখ বুলিয়ে বলল, কেউ বলতে পারবে, আমি কী জানি?

ক্লাসের ছেলেমেয়েরা বলতে পারল না। রাফি বলল, কীভাবে এই সাবজেক্টটা পড়ানো উচিত নয়, আমি সেটা জানি!

ক্লাসের ছেলেমেয়েরা আবার হেসে উঠল। রাফি বলল, কাজেই আমি নিজে নিজে যেভাবে এটা শিখেছি, আমি তোমাদের সেভাবে শিখাব। ঠিক আছে?

ক্লাসের সবাই মাথা নাড়ল। বলল, ঠিক আছে। রাফি সারা ক্লাসে একবার চোখ বুলিয়ে বলল, তবে এ ব্যাপারে একটা বড় সমস্যা আছে। সমস্যাটা কী, জান?

ছেলেমেয়েরা মাথা নেড়ে জানাল, তারা জানে না। রাফি বলল, আমি মাত্র পাস করে এসেছি। কাজেই আমি কিন্তু খুব বেশি জানার সুযোগ। পাইনি। তোমরাও আর দুই-তিন বছর পর আমার জায়গায় আসবে! আমার নলেজ—রাফি দুই আঙুল দিয়ে ছোট একটা গ্যাপ দেখিয়ে বলল, তোমাদের নলেজ থেকে বড়জোর দুই ইঞ্চি বেশি! কাজেই তোমরা যখন দুই ইঞ্চি শিখে ফেলবে, তখন আমাকেও দুই ইঞ্চি বেশি শিখে আবার তোমাদের ওপর দুই ইঞ্চি যেতে হবে। তার মানে বুঝেছ?

ছেলেমেয়েরা মাথা নাড়ল। বলল, বোঝেনি।

তার মানে, তোমাদের লেখাপড়া করে যতটুকু পরিশ্রম করতে হবে, আমাকেও সব সময় তার সমান না হলেও তার থেকে বেশি পরিশ্রম করতে হবে। সব সময় দুই ইঞ্চি ওপরে থাকতে হবে!

রাফির কথাগুলো ছেলেমেয়েরা বেশ সহজেই গ্রহণ করল বলে মনে হলো। রাফি টেবিলে হেলান দিয়ে বলল, কাজটা ঠিক হলো কি না, বুঝতে পারলাম না।

ছেলেমেয়েরা জানতে চাইল, কোন কাজটা, স্যার?

এই যে আমি বললাম, দুই ইঞ্চির কথা! এর ফল আমার জন্য খুব ডেঞ্জারাস হতে পারে।

কী ডেঞ্জারাস, স্যার?

আমার নাম হয়ে যেতে পারে দুই ইঞ্চি স্যার!

সারা ক্লাস আবার একসঙ্গে হেসে ওঠে। রাফি হাসি থেমে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করে, তারপর বলে, আজ যেহেতু প্রথম দিন, আমি তাই কোয়ান্টাম মেকানিকস নিয়ে কিছু বলব না। শুধু কোয়ান্টাম মেকানিকস যাঁরা বের করেছেন, সেই বিজ্ঞানীদের নিয়ে কয়েকটা গল্প বলি। ঠিক আছে?,

সবাই মাথা নেড়ে রাজি হয়ে গেল। রাফি তখন আইনস্টাইনের গল্প বলল, নীল ববারের গল্প বলল, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় তাকে লুকিয়ে সরিয়ে নেওয়ার সময় তার বিশাল মস্তিষ্ক নিয়ে কী সমস্যা হয়েছিল, তা বলল, শর্ডিংগারের গল্প বলল, ডিরাকের বিখ্যাত নিগেটিভ মাছের গল্প বলল এবং শেষ করল বাঙালি বিজ্ঞানী সত্যেন বসুর গল্প দিয়ে। এগুলো তার প্রিয় গল্প, সে বলল আগ্রহ নিয়ে। সব মানুষেরই গল্প নিয়ে কৌতূহল থাকে, তাই পুরো ক্লাস গল্পগুলো শুনল মনোযোগ দিয়ে। যেখানে হাসার কথা, সেখানে তারা হাসল; যেখানে ক্রুদ্ধ হওয়ার কথা, সেখানে তারা ক্রুদ্ধ হলো; আবার যেখানে ছোট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলার কথা, সেখানে তারা ছোট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

 

বিকেলে রাফি তার অফিস ঘরে যখন কাগজপত্র বের করে গুছিয়ে রাখছিল, তখন দরজা খুলে কবির তার মাথা ঢোকাল। বলল, চলো, চা খেয়ে আসি।

চা?

হ্যাঁ।

কোথায়?

টঙে।

চলো।

অফিস ঘরে তালা মেরে রাফি বের হয়ে আসে। কবির বলল, যখন আমরা ছাত্র ছিলাম, তখন এই টঙে চা খেতাম। মাস্টার হওয়ার পরও অভ্যাসটা ছাড়তে পারিনি। এখন আমাদের দেখাদেখি অনেক টিচারই আসে, ছাত্ররা খুবই বিরক্ত হয়।

হওয়ারই কথা!

করিডরের গোড়ায় বেশ কয়েকজন দাঁড়িয়ে আছে, সবাই তাদের সমবয়সী। রাফি তাদের মধ্যে সুহানা আর রানাকে চিনতে পারল। কবির অন্যদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল, এ হচ্ছে রাফি। আমাদের ডিপার্টমেন্টে নতুন জয়েন করেছে।

সুহানা রাফির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, রাফি, আজ তুমি ক্লাসে ছাত্রছাত্রীদের কী বলেছ?

কেন, কী হয়েছে?

তারা খুব ইমপ্রেসড।

তাই নাকি?

হ্যাঁ।

কীভাবে বুঝলে?

সুহানা হাসল। বলল, আমাকে বলেছে।

কী বলেছে?

ছাত্রীরা বলেছে, তুমি নাকি খুব কিউট!

রানা মুখভঙ্গি করে বলল, হুম! সাবধান রাফি। ছাত্রীরা যখন বলে কিউট, তখন সাবধানে থাকতে হয়।

সবাই মিলে হেঁটে হেঁটে টঙের দিকে যেতে থাকে। পাশাপাশি অনেকগুলো টং। রানা খানিকটা ধারাবিবরণী দেওয়ার মতো করে বলল, এই যে টংগুলো দেখছ, তার মধ্যে প্রথম যে টংটা দেখছ, সেখানে কখনো যাবে না।

কেন?

এটা যে চালায়, সে হচ্ছে জামাতি। এইখানে রড-কিরিচি এগুলো লুকিয়ে রাখা হয়। যখন হল অ্যাটাক করে, তখন এখান থেকে সাপ্লাই দেওয়া হয়।

ইন্টারেস্টিং!

পরের টংগুলোতে যেতে পারো। সেকেন্ড টং খুব ভালো পেঁয়াজো ভাজে। থার্ড টঙের রং-চা ফার্স্ট ক্লাস। ফোর্থ টঙে গরম জিলাপি পাবে। আমরা সাধারণত এই জিলাপি খেতে যাই। তুমি জিলাপি খাও তো?

হ্যাঁ, খাই।

কম বয়সী লেকচারাররা দল বেঁধে আসার সঙ্গে সঙ্গে যেসব ছাত্রছাত্রী সেখানে বসেছিল, তারা উঠে একটু পেছনে সরে গেল। যে মানুষটি জিলাপি ভাজছে, সে গলা উঁচিয়ে বলল, এই শারমিন, স্যারদের বেঞ্চ মুছে দে।

বেঞ্চগুলো মোছর কোনো প্রয়োজন নেই। কিন্তু এটি এক ধরনের তোষামোদ। শারমিন নামের মেয়েটি একটা ন্যাকড়া দিয়ে বেঞ্চগুলো মুছে দিল। মেয়েটির বয়স বারো কিংবা তেরো—মায়াকাড়া চেহারা, এই বয়সে মেয়েদের চেহারায় এক ধরনের লাবণ্য আসতে শুরু করে।

কম বয়সী লেকচারাররা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে, প্লেটে করে গরম জিলাপি আনা হয়। সবাই খেতে খেতে গল্প করে।

হঠাৎ রানা বলে, ওই যে সমীর যাচ্ছে। ডাকো সমীরকে। একজন গলা উঁচিয়ে ডাকল, সমীর! জিলাপি খেয়ে যাও।

সমীর অন্যদের সমবয়সী, উশকোখুশকো চুল এবং মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। রানা গলা নামিয়ে বলল, সমীর হচ্ছে আমাদের মধ্যে হার্ডকোর সায়েন্টিস্ট। বায়োকেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টের। ভাইরাস আর ব্যাক্টেরিয়া ছাড়া কোনো কথা বলে না।

রানার কথা সত্যি প্রমাণ করার জন্যই কি না কে জানে, সমীর এসেই বলল, তোরা আজকের খবরের কাগজ দেখেছিস?

রানা জানতে চাইল, কেন, কী হয়েছে?

খুব বাজে একটা ভাইরাস ডিটেক্ট করেছে। ইনফ্যাক্ট, এটা ভাইরাস না প্রিওন, তা এখনো সিওর না।

প্রিওনটা কী জিনিস?

কবির বলল, থাক থাক! এখন প্রিওন-ফ্রিওনের কথা থাক। জিলাপি খা। গরম জিলাপি খেলে সব ভাইরাস শেষ হয়ে যাবে।

ঠাট্টা নয়, খুব ডেঞ্জারাস।

সমীর খুব গম্ভীর মুখে বলল, সরাসরি ব্রেনকে অ্যাফেক্ট করে। আমাদের দেশের জন্য ব্যাড নিউজ।

কেন, আমাদের দেশের জন্য ব্যাড নিউজ কেন?

কোনো রকম প্রটেকশন নেই। কোনোভাবে ইনফেক্টেড একজন আসতে পারলেই এপিডেমিক শুরু হয়ে যাবে।

কবির বলল, থাক থাক, পৃথিবীর সব ভাইরাসের জন্য তোর দুশ্চিন্তা করতে হবে না, অন্যদেরও একটু দুশ্চিন্তা করতে দে। তুই জিলাপি খা।

সমীর খুব দুশ্চিন্তিত মুখে জিলাপি খেতে থাকে। সবাই উঠে পড়ার সময় কবির জিলাপি তৈরি করতে থাকা মানুষটিকেজিজ্ঞেস করল, আমাদের কত হয়েছে?

মানুষটা কিছু বলার আগেই শারমিন নামের মেয়েটি বলল, একেক জনের তেরো টাকা পঞ্চাশ পয়সা।

সুহানা জিজ্ঞেস করল, সব মিলিয়ে কত?

চুরানব্বই টাকা পঞ্চাশ পয়সা।

আমি দিয়ে দিচ্ছি।

কবির বলল, তুই কেন দিবি?

আজ আমাদের নতুন কলিগ এসেছে, তার সম্মানে।

রানা বলল, আর আমরা এত দিন থেকে আছি, আমাদের কোনো সম্মান নেই?

সম্মান দেখানোর মতো এখনো কোনো কারণ খুঁজে পাইনি! সুহানা তার ব্যাগ থেকে এক শ টাকার একটা নোট বের করে শারমিনের হাতে দিয়ে বলল, নাও। বাকিটা তোমার। মেয়েটির মুখে একটা হাসি ফুটে ওঠে।

সবাই মিলে যখন ওরা হেঁটে হেঁটে ফিরে যাচ্ছে, তখন সুহানা রাফিকে বলল, শারমিন মেয়েটাকে দেখেছ?

হ্যাঁ। কী হয়েছে?

কত বিল হয়েছে জানতে চাইলেই সে একটা আজগুবি সংখ্যা বলে দেয়। কেন বলে, কে জানে!।

রাফি অন্যমনস্কভাবে মাথা নাড়ল। টঙের কাছে গাছের ওপর একটা কাগজে জিলাপি, সিঙাড়া, বিস্কুট এবং চায়ের দাম লেখা আছে। সে ভেবেছিল, বিলটা দিয়ে দেবে, তাই মনে মনে হিসাব করছিল, কত হয়েছে। সবাই মিলে যা খেয়েছে, সেটা হিসাব করলে সত্যিই চুরানব্বই টাকা পঞ্চাশ পয়সা হয়। সাতজনের মধ্যে ভাগ করলে সেটা আসলেই মাথাপিছু তেরো টাকা পঞ্চাশ পয়সা হয়। শারমিন আজগুবি কিছু বলেনি, নিখুঁত হিসাব করেছে।

 

রাফি তখনো জানত না, এই বাচ্চা মেয়েটির কারণে আর কিছুদিনের মধ্যেই তার জীবনের সবচেয়ে ভয়ংকর ঘটনাটি ঘটবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *