০৯. বাসাটা খুঁজে বের করে

বাসাটা খুঁজে বের করে বেল টেপার সঙ্গে সঙ্গে দরজাটা খুলে গেল, মনে হলো দরজার ওপাশেই যেন মাজু বাঙালি রাফির জন্য দাঁড়িয়ে ছিল। রাফি শারমিনের হাত ধরে ভেতরে ঢোকে, ছোটখাটো একটা অ্যাপার্টমেন্ট, এখানে শুধু পুরুষ মানুষ থাকে, সেটি একনজর তাকালেই বোঝা যায়।

মাজু বাঙালি বলল, আমার নাম মাজহার। আমি যখন কবিতা লিখি, তখন নাম লিখি মাজু বাঙালি।

ইন্টারেস্টিং নাম। আমি রাফি আহমেদ। আমার সঙ্গে যে বাচ্চা ছেলেটা আছে, তার নাম হচ্ছে শামীম।

আহা, বেচারা! সারা রাত জার্নি করে কাহিল হয়ে গেছে। রাফি মাজহারের দিকে তাকাল, ঈশিতার ব্যাপার নিয়ে কথা বলার জন্য এসেছে, সে নিশ্চয়ই সবকিছু জানে। তাকে নিশ্চয়ই বিশ্বাস করা যায়। তাকে শারমিনের পরিচয়টা দিয়ে রাখা ভালো। রাফি বলল, ঈশিতা কি আপনাকে শারমিন নামের একটা মেয়ের কথা বলেছিল?

হ্যাঁ, বলেছিল। মানুষ কম্পিউটার। অসাধারণ জিনিয়াস।

হ্যাঁ। আমাদের শামীম আসলে সেই অসাধারণ জিনিয়াস মানুষ কম্পিউটার শারমিন। তার ওপর হামলা হচ্ছে, তাই তাকে ছেলে সাজিয়ে এনেছি। সুন্দর লম্বা চুল ছিল, আমি কেটে কেটে ছোট করেছি। চুল কাটা এত কঠিন, বুঝতে পারিনি।

মাজহার ভালো করে শারমিনের দিকে তাকাল। অবাক হয়ে বলল, তুমিই তাহলে সেই মেয়ে?

শারমিন কোনো কথা না বলে একটু মাথা নাড়ল। মাজহার বলল, তোমাকে দেখে খুব টায়ার্ড মনে হচ্ছে। তুমি বাথরুমে একটু হাত-মুখ ধুয়ে ওই সোফায় কয়েক মিনিট শুয়ে নাও। আমি রাফি সাহেবের সঙ্গে একটু কথা বলে একসঙ্গে নাশতা করব।

শারমিন আবার মাথা নেড়ে ভেতরে গেল। মাজহার রাফির দিকে তাকায় এবং হঠাৎ করে তার মুখটা গম্ভীর হয়ে যায়। সে একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমি জানি না, ঈশিতা মেয়েটা এখনো বেঁচে আছে কি না।

রাফি কিছু বলল না, কী বলবে বুঝতে পারছিল না। খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আমার এখন নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে। আমি যদি তাকে ভেতরে ঢোকার ব্যবস্থা না করে দিতাম, তাহলে এই সর্বনাশ হতো না।

মাজহার বলল, হতো। অন্য কোনোভাবে হতো। মেয়েটাকে আমি খুব কম সময়ের জন্য দেখেছি, কিন্তু যেটুকু দেখেছি, তাতেই বুঝতে পেরেছি, এর জীবনটাই হচ্ছে বিপজ্জনক। আপনি নিজেকে অপরাধী ভাববেন না। আমি লিখে দিতে পারি, সে নিজেই ভেতরে ঢুকতে চেয়েছে, আপনি তাকে নিষেধ করেছেন।

সেটা সত্যি।

দুজনে সোফায় গিয়ে বসে এবং কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। কী বলবে, সেটা যেন ঠিক করে উঠতে পারছে না মাজহার হঠাৎ সোজা হয়ে বসে বলল, আমি পুরো ব্যাপারটা চিন্তা করে দেখেছি। আপনার সঙ্গে একটু শেয়ার করি। ঈশিতা ইজ রাইট—এনডেভার শুধু যে এ দেশে এফটি টোয়েন্টি সিক্স ভাইরাস ছড়িয়েছে তা নয়, তারা চিকিৎসার নাম করে অসুস্থ মানুষগুলোর ব্রেন নিজেদের কাজে ব্যবহার করেছে। আমরা সেটা জানি কিন্তু সেটা নিয়ে থানা পুলিশ করতে পারছি না। আপনি তাদের সিস্টেমে ঢুকেছেন, নিজের চোখে দেখেছেন কিন্তু সেই কথাটা কাউকে বলা যাচ্ছে না, কারণ আপনি ঢুকেছেন বেআইনিভাবে। আপনার কথা কেউ বিশ্বাস করবে না, উল্টো আপনি বিপদে পড়ে যাবেন। শারমিন বিপদে পড়ে যাবে। তা ছাড়া এ দেশে এনডেভারের অনেক সুনাম, মিডিয়া এনডেভারের প্রশংসায় পঞ্চমুখ, তাদের সম্পর্কে একটা খারাপ কথা কাউকে বিশ্বাস করানো যাবে না। এনডেভার ভয়ংকর অন্যায় করতে পারে, কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু আমরা ছোটখাটো বেআইনি কাজও করতে পারব না।

মাজহার রাফির দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করল, রাফি কী ভাবছে। রাফি বলল, আমরা যেটা করেছি, তাদের পাসওয়ার্ড ভেঙে সিস্টেমে ঢুকেছি, সেটা বেআইনি হতে পারে, কিন্তু পুরো বিষয়টা সবাই জানতে পারলে সেটাকে কেউ অনৈতিক বলবে না। পৃথিবীতে অনেকবার এ রকম হয়েছে, কোনো একজন সাংবাদিক একটা অনেক বড় অন্যায়-অবিচার প্রকাশ করে দিয়েছে। সে জন্য জেলও খেটেছে, কিন্তু সারা জীবন মাথা উঁচু করে থেকেছে।

কিন্তু আমাদের সময় খুব কম। ঈশিতাকে এর মাঝে মেরে ফেলেছে কি, আমি জানি না। যদি মেরে ফেলে না থাকে তাহলে যেভাবে হোক ভেতরে পুলিশ-র্যাব-সাংবাদিক পাঠাতে হবে।

কীভাবে পাঠাবেন?

আমি ওদের বিল্ডিংয়ে বিশাল একটা বিস্ফোরণ ঘটাতে চাই।

বিস্ফোরণ? বিল্ডিংয়ে?

হ্যাঁ।

কীভাবে?

ওদের বিল্ডিংয়ের অক্সিজেন সাপ্লাইয়ের দায়িত্ব আমার। আজকে ওখানে সাপ্লাই নিয়ে যাব। ওদের যে রুমে কোনো মানুষ থাকে না, শুধু যন্ত্রপাতি, সেসব রুমে আমি অক্সিজেন লিক করিয়ে দেব।

রাফি মাজহারকে বাধা দিয়ে বলল,কিন্তু অক্সিজেন দিয়ে তো বিস্ফোরণ হয় না। সেটা জ্বলতে সাহায্য করতে পারে, কিন্তু বিস্ফোরণের জন্য এক্সপ্লোসিভ কিছু দরকার—

মাজহার মাথা নাড়ল। বলল, হ্যাঁ, সে জন্য আমি অক্সিজেন লেখা সিলিন্ডারে করে মিথেনও নিয়ে যাব। ঘরের ভেতরে একেবারে সঠিক অনুপাতে মিথেন অক্সিজেন লিক করিয়ে দেব।

তার পরেও তো একটা স্পার্ক দরকার—

আমি যেসব ঘরে লিক করাব, সেখানে ভারী ইলেকট্রিক যন্ত্রপাতি রয়েছে, বন্ধ হচ্ছে, চালু হচ্ছে, সেখানে স্পার্ক কোনো ব্যাপার নয়। আমি যেহেতু অক্সিজেন সাপ্লাই নিয়ে কাজ করি, আমাকে সবার আগে শেখানো হয়েছে নিরাপত্তা। সেফটি। আমি নিরাপত্তার যা যা শিখেছি, তার সব কটি আজকে ভায়োলেট করাব।

রাফি মাথা নাড়ল, আপনি মনে হচ্ছে পুরোটা চিন্তা করে দেখেছেন।

হ্যাঁ, করেছি। কিন্তু আমার মনে হলো, আরও একজনের সঙ্গে পুরো ব্যাপারটা একটু শেয়ার করা দরকার। সে জন্য আপনাকে ডেকেছি।

থ্যাংকু।

আপনার যদি কোনো আইডিয়া থাকে, বলেন।

রাফি কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করে বলল, না, এই মুহূর্তে আমার কোনো আইডিয়া নেই। শুধু একটি ব্যাপার–

কী?

আমরা সব সময়ই বলছি, এনডেভার এ দেশের পুলিশ-র্যাব—সবাইকে কিনে রেখেছে। কিন্তু এটা তো হতে পারে না যে এখানে কোনো ভালো মানুষ, সৎ মানুষ নেই। যাকে কেনা সম্ভব না।

নিশ্চয়ই আছে। সব জায়গায় থাকে। সেই জন্যই দেশটি চলছে।

কাজেই আমাদের চেষ্টা করা উচিত। আমি তাই ভাবছি, আমি শারমিনকে নিয়ে যাব। চেষ্টা করব, একজন গুরুত্বপূর্ণ মানুষের সাথে দেখা করার জন্য। যদি দেখা করতে পারি, তাহলে চেষ্টা করব তাকে বোঝাতে। যদি বোঝাতে না-ও পারি, তাহলে অন্তত একটা জিডি করিয়ে আসব।

গুড আইডিয়া। মাজহার মাথা নাড়ল।

আপনার এখান থেকে বের হয়েই আমি থানায় চলে যাব।

ঠিক আছে। মাজহার বলল, এখন আপনি বাথরুমে গিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে আসেন। নাশতা করি।

 

রাফি আর শারমিন যখন মাজহারের বাসায় নাশতা করছিল, ঠিক তখন ঈশিতার ছোট ঘরটি খুলে একজন মানুষ তার জন্য নাশতা নিয়ে আসে। তাকে সারা রাত যে ঘরে আটকে রেখেছে, সেই ঘরটি ছোট এবং আধুনিক, সঙ্গে খুব ছোট এবং অসম্ভব পরিষ্কার একটি বাথরুমও আছে কিন্তু আর কিছু নেই। সে ঘরের কোনায় বসে দেয়ালে হেলান দিয়ে আধো ঘুম আধো জাগ্রত অবস্থায় রাত কাটিয়েছে।

মানুষটা নাশতার ট্রে-টি মেঝেতে রেখে কোনো কথা না বলে দরজা খুলে বের হয়ে গেল। বাইরে থেকে দরজায় আবার তালা মেরে দিয়েছে, সে তার শব্দটাও ভেতরে বসে শুনতে পেল। নাশতার জন্য তাকে যে খাবারগুলো দিয়েছে, সেগুলো খুব চমৎকার করে সাজানো। এক গ্লাস অরেঞ্জ জুস। দুই স্লাইস রুটি, মাখন, জেলি, ডিম পোচ, কলা, আপেল, এক গ্লাস দুধ আর পানির বোতল। ঈশিতা সকালে নাশতা করতে পারে না—অনেক দিন সে শুধু একটা টোস্ট বিস্কুট কিংবা একমুঠো মুড়ি খেয়ে দিন শুরু করে। ঈশিতা ভেবেছিল, সে নাশতা করতে পারবে না। কিন্তু দেখা গেল, তার বেশ খিদে। পেয়েছে এবং সে বেশ তৃপ্তি করেই নাশতা করল। খাওয়া শেষ তার, চায়ের তৃষ্ণা হলো কিন্তু কথাটি সে কাউকে বলতে পারল না। ছোট আধুনিক একটা ঘরের দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে সে নিঃশব্দে অপেক্ষা করতে থাকে।

এ রকম সময়ে খুট করে দরজা খুলে গেল, আগের মানুষটি একটা ট্রে নিয়ে ভেতরে ঢুকল। ট্রের ওপরে একটা ছোট পট। একটা সুন্দর পোর্সেলিনের কাপ, একটা পিরিচে টি-ব্যাগ, চিনির প্যাকেট এবং একটা দুধদানিতে দুধ। মানুষটি ট্রে-টি মেঝেতে রেখে দরজাটা বন্ধ করে দেয়। তার গলা থেকে একটা ব্যাগ ঝুলছে, ব্যাগটা মেঝেতে রেখে সে বাথরুমে ঢুকে যায় এবং অনেক রকম শব্দ করে বাথরুম ধোয়া শুরু করে দেয়।

একটু পর বাথরুম থেকে বের হয়ে তার নাশতার ট্রে-টি নিয়ে কোমর থেকে ঝোলানো চাবি দিয়ে তালা খুলে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। ঈশিতা আবার শুনতে পেল, বাইরে থেকে তালা দেওয়া হয়েছে। ঈশিতা একটা ছোট নিঃশ্বাস ফেলল এবং হঠাৎ করে লক্ষ করল, মানুষটি তার ব্যাগটা ভুল করে ফেলে গেছে। সে ব্যাগটা টেনে এনে খোলে, ভেতরে একটা সিগারেটের প্যাকেট, লাইটার, কিছু কাগজপত্র, খুচরা টাকা এবং একটা সস্তা মোবাইল টেলিফোন। ঈশিতা কাঁপা হাতে মোবাইল টেলিফোনটা নেয়, বাইরে কাউকে ফোন করার এ রকম একটা সুযোগ পেয়ে যাবে, সে কল্পনাও করতে পারেনি। কাকে ফোন করতে পারে? তার পত্রিকার সম্পাদক নুরুল ইসলামকে, নাকি তার হোস্টেলের রুমমেটকে? নাকি রাফিকে? কিংবা মাজু বাঙালিকে? ঈশিতা আবিষ্কার করল যে কারও টেলিফোন নম্বরই তার মুখস্থ নেই। রাফিকে নানা টেলিফোন থেকে অনেকবার ফোন করেছে বলে আবছা আবছাভাবে তার নম্বরটা একটু বেশি মনে আছে। ঈশিতা কাঁপা হাতে নম্বরটা ডায়াল করল।

ঠিক সেই সময় রাফি মাজহারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে শারমিনের হাত ধরে বের হয়ে এসেছে। বাইরে ঢাকা শহরের অবাস্তব ভিড়। মানুষজন অফিসে যাওয়ার জন্য বের হয়েছে, তাদের ব্যস্ত ছোটাছুটি দেখে মনে হচ্ছে তারা কেউ বুঝি মানুষ নয়, সবাই যেন একটা খাঁচায় আটকে থাকা ইঁদুরের। বাচ্চা। মনে হচ্ছে, হঠাৎ বুঝি কেউ খাঁচাটা খুলে দিয়েছে এবং ইঁদুরের বাচ্চাগুলো দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছোটাছুটি করছে। রাফি রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে থেকে অনেকক্ষণ চেষ্টা করে একটা হলুদ রঙের ক্যাবকে থামাতে পারল। ক্যাবের ভেতর উঠে রাফি আর শারমিন মাত্র বসেছে, ঠিক তখন তার টেলিফোন বেজে উঠল। টেলিফোনে অপরিচিত একটা নম্বর।

রাফি টেলিফোনটা ধরে বলল, হ্যালো।

সে শুনল অপর পাশ থেকে ঈশিতা বলছে, রাফি, আমি ঈশিতা।

রাফি সঙ্গে সঙ্গে সোজা হয়ে বসে, ঈশিতা? তুমি? কোথায়?

আমি এনডেভারের ভেতর। আমাকে ধরে ফেলেছে।

ধরে ফেলেছে?

হ্যাঁ, আমি খুব বিপদের মাঝে আছি।

তুমি তাহলে টেলিফোনে কীভাবে কথা বলছ?

ঈশিতা বলল, একজন মানুষ ভুল করে তার ব্যাগটা আমার ঘরে ফেলে গেছে। ভেতরে এই টেলিফোনটা ছিল। মানুষটি কখন টের পেয়ে যাবে, জানি। টের পেলেই ফোনটা নিয়ে নেবে। আমি তাড়াতাড়ি কয়েকটা কথা বলি।

ঈশিতা তাড়াতাড়ি কথা বলতে থাকে, যদিও সে জানত না যে তার তাড়াতাড়ি কথা বলার কোনো প্রয়োজন ছিল না। ব্যাগটা মোটেও ভুল করে ফেলে যাওয়া হয়নি, ইচ্ছে করে রেখে যাওয়া হয়েছে। সস্তা টেলিফোনটা আসলে মোটেও সস্তা টেলিফোন নয়, এটি সরাসরি স্যাটেলাইটের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে aঈশিতা যখন রাফির সঙ্গে কথা বলছিল, তখন সেই কথা বলার সিগনালটা ট্র্যাক করে রাফিকে খুঁজে বের করা হচ্ছিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই রাফির ইয়েলো ক্যাবটাকে ট্র্যাক করা হলো এবং তখন একাধিক স্যাটেলাইট থেকে সেটাকে চোখে চোখে রাখা শুরু হয়ে গেল। শহরের বিভিন্ন জায়গায় রাখা এনডেভারের সিকিউরিটি গাড়িগুলোকে সেই খবর পৌঁছে দেওয়া হলো এবং তারা রাফির ইয়েলো ক্যাবটিকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলল।

ঈশিতার সঙ্গে কথা বলে রাফি যখন টেলিফোনটা রেখেছে, তখন আবার টেলিফোনটা বেজে উঠল, রাফি দেখল, সুহানা ফোন করেছে। সে ফোনটা কানে লাগিয়ে বলল, হ্যালো, সুহানা।

সুহানা অন্য পাশ থেকে রীতিমতো চিৎকার করে উঠল, কী হলো, রাফি? তুমি কোথায়? নয়টার সময় তোমার ক্লাস, এখন বাজে নয়টা পনেরো। তোমার ছাত্রছাত্রীরা পাগলের মতো তোমাকে খুঁজছে। বিশেষ করে তোমার ছাত্রীরা। তোমাকে পনেরো মিনিট দেখতে পায়নি, তাতেই তাদের হার্ট বিট মিস হতে শুরু করেছে।

রাফি বলল, সুহানা। শোনো। আমি অসম্ভব বড় একটা ঝামেলার মাঝে পড়েছি।

সুহানা সাথে সাথে অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে পড়ে, কী হয়েছে, রাফি?

আমি এখন ঢাকায়। একটা ইয়েলো ক্যাবে থানাতে যাচ্ছি। আমার সঙ্গে আছে শারমিন। থানাওয়ালারা আমার কথা শুনবে কি না, আমি বুঝতে পারছি না—

রাফি তার কথা শেষ করার আগেই পেছন থেকে একটা বড় গাড়ি তার ক্যাবে ধাক্কা দিল, সাথে সাথে ঠিক সামনে একটা গাড়ি এসে দাঁড়িয়ে গেল। কিছু বোঝার আগেই পাশে আরও একটা গাড়ি থেমে যায়, সেখান থেকে কয়েকজন মানুষ নেমে এসে ক্যাবের দরজা খুলে রাফি আর শারমিনকে হ্যাচকা টান দিয়ে বের করে আনে। তারা কিছু বোঝার আগেই তাদের একটা ফোর হুঁইল ড্রাইভ জিপে তুলে নেওয়া হয় এবং সেটা টায়ারে কর্কশ শব্দ তুলে সামনে এগিয়ে যায়, ব্যস্ত রাস্তায় সেটা ইউ টার্ন নিয়ে উল্টোদিকে ছুটতে থাকে।

রাফি হতবাক হয়ে গাড়ির ভেতর তাকাল, পেছনের সিটে সাফারি কোট পরা দুজন মানুষ বসে আছে। একজনের হাতে একটা বেঢপ রিভলবার, সে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, তোমার ছাত্ররা আমার নিজের রিভলবারটা ছিনতাই করে নিয়ে গেছে। এরা কী রকম ছাত্র, আর্মস ছিনতাই করে?

রাফি কোনো কথা না বলে মানুষটির চেহারা ভালো করে দেখার চেষ্টা করে। মাঝবয়সী নিষ্ঠুর চেহারার মানুষ। মানুষটি হাতের রিভলবারটা শারমিনের মাথায় চুঁইয়ে বলল, চুল ছোট করে কাটলেই মেয়ে কি ছেলে হয়ে যায়?

রাফি কোনো কথা না বলে মানুষটির দিকে তাকিয়ে রইল। মানুষটি বলল, এই মেয়েটার মগজ নাকি মিলিয়ন ডলার কেজিতে বিক্রি হবে। ইচ্ছে করছে, গুলি করে খুলি ফুটো করে সেই মগজটা দেখি—মিলিয়ন ডলারের মগজ দেখতে কী রকম!

খুব উঁচুদরের রসিকতা করেছে, সে রকম ভঙ্গি করে মানুষটি হা হা করে। হাসতে থাকে। রসিকতাটা নিশ্চয়ই উঁচুদরের হয়নি, গাড়ির আর কেউ তার। হাসির সঙ্গে যোগ দিল না। মানুষটি সে কারণে একটু মনঃক্ষুন্ন হলো বলে মনে হলো। মুখটা শক্ত করে বলল, শোনো, মাস্টার সাহেব আর তোমার ছাত্রী, এই গাড়ির ভেতরে তোমরা কুঁ শব্দ করবে না। গাড়ির কাচ কালো রঙের, বাইরের কেউ তোমাদের দেখবে না। গাড়ি সাউন্ডপ্রুফ, চেঁচিয়ে গলা ভেঙে ফেললেও কেউ শুনতে পারবে না। তার পরও যদি বাড়াবাড়ি করো, আমি দুজনকে অজ্ঞান করে রাখব। অনেক আধুনিক উপায় আছে, আমি সেসবে যাব না, রিভলবারের বাট দিয়ে মাথার পেছনে শক্ত করে। মারব—অনেক পুরোনো পদ্ধতি কিন্তু ফার্স্ট ক্লাস কাজ করে।

রাফি বুঝতে পারল, মানুষটি তার সঙ্গে ঠাট্টা করছে না। কাজেই সে চুপ করে বসে রইল। কিছুক্ষণ আগেই সে ঈশিতার জন্য দুশ্চিন্তা করছিল, এখন সে নিজে ঠিক ঈশিতার জায়গায় এসে পড়েছে। তার জন্য এখন কে দুশ্চিন্তা করবে? কেউ কি আছে দুশ্চিন্তা করার?

 

রাফির জন্য কেউই দুশ্চিন্তা করছিল না, সেটি অবশ্য সত্যি নয়। সুহানা যখন রাফির সাথে কথা বলছিল, তখন ঠিক কথার মাঝখানে সে শুনতে পেল। একটা বিকট শব্দ এবং তারপর কিছু উত্তেজিত কণ্ঠস্বর। হঠাৎ করে টেলিফোনটা নীরব হয়ে গেল—আর কিছু বুঝতে না পারলেও অস্বাভাবিক কিছু একটা ঘটেছে, সেটা বুঝতে সুহানার অসুবিধা হলো না।

সে রাফির ক্লাসে গিয়ে ছাত্রছাত্রীদের ছুটি দিয়ে দিল, তারপর সে অন্যদের খোঁজাখুঁজি করল। কাউকে না পেয়ে সে গেল নেটওয়ার্কিং ল্যাবে। রাফি আর শারমিনকে সেদিন এখানে একটা কম্পিউটারে বসে কিছু কাজ করতে দেখেছে—তারা কী কাজ করছিল, সেটা একটু বুঝতে চায়।

প্রফেসর হাসান এলে তার সঙ্গে কথা বলতে হবে, স্যার অনেক মানুষকে চেনেন, পুলিশকে হয়তো খবর দিতে পারবেন। তাদের কথাকে কেউ গুরুত্ব দেবে না, প্রফেসর হাসানকে নিশ্চয়ই গুরুত্ব দেবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *