তিন মাস পর নরমাণ্ডির মুলাঁ দন্দের পাট চুকলো আমার। এবার কোথায় ফিরবো? ভাবতে আমার খারাপ লাগে যেসুইডেনে ফিরতে হবে, আবার দেখতে হবে সুয়েনসনের মুখ। সুইডেনে কোনও বাড়ি ভাড়া নিতেপারি। কিন্তু ওই দেশটার ওপরই ভীষণ একঅভিমান আমার। আসলে সুইডেন নামের দেশটাও আমার কাছে অসহ্য হয়ে উঠেছে। যে দেশে আমার একটিও বন্ধু নেই, শুভাকাঙ্ক্ষী নেই, যে দেশে অসহায় আমাকে সাহায্য করার একটিও প্রাণী নেই, যে দেশের ডাক্তারেরা তোমাকে হত্যা করেছে, সে দেশে কেন থাকবো আমি! ইওরোপে এক ফ্রান্সেই আমার সবচেয়ে বেশি বই ছাপা হয়েছে। ওখানেই মানুষ আমাকে সবচেয়ে বেশি চেনে, শ্রদ্ধা করে, ভালোবাসে। ফ্রান্স সুইডেনেরমতো দেশনয়, যেখানে আমাকে ব্যবহার করে বিশ্বে বাহবা জুটিয়ে ব্যস দিব্যি ভুলে গেছে, আমি মরে আছি না বেঁচে আছি, কোনও রাজনীতিকই আর জানতে চায়নি। লেখকগোষ্ঠীর ভেতরে দলাদলি, মারামারি এসব তো আছেই, নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্যই সকলে ব্যস্ত। কেউ যদি লিখে নাম করে, ব্যস আলাদা হয়ে গিয়ে নিজের লেখালেখিতে মন দেয়, আর লিখে নাম না করতে পারলে তো যাতে নাম হবে, বিভিন্ন সমিতি সংগঠনে আঠার মতো লেগে থেকে, তার চেষ্টাই অহর্নিশি করে যায়। এখন আমার কোনও কিছুতে নাম লিখিয়ে নাম করার কিছু নেই। ওসবের রুচি কোনওদিন ছিল না আমার, এখনও নেই। নামের কাঙাল আমি কোনওদিনই ছিলাম না, না চাইতেই নাম বলো, দুর্নাম বলোসর পেয়েছি।
সুয়েনসন একটা কাঠের বা লোহার তৈরি মানুষের মতো। নিজের স্বার্থ ছাড়া একবিন্দু কিছু বোঝে না। কোনও সহমর্মিতা বা সহানুভূতি বলে কিছু নেই কারও জন্য। হীনম্মন্যতা তার সর্বক্ষণিক সঙ্গী। তার সারাক্ষণই সংশয়, তাকে না আবার কেউ কোনওদিক দিয়ে মন্দ বলছে। এধরনের লোকের সঙ্গে এক ছাদের নিচে বাস করা মানে নিজের সর্বনাশ করা, আর কিছুনয়। তাছাড়া সুইডেনের ওই বাড়িতে বাস করা, যেখানে তোমার কষ্টের স্মৃতি আমাকে তাড়া করে, সম্ভব নয়। নরমাণ্ডিতে থাকাকালীনই সিদ্ধান্ত নিই, সুইডেনে থাকার যেহেতু কোনও ইচ্ছে নেই আমার, প্যারিসে থাকবো।
.
ক্রিশ্চান বেসকে বললামপ্যারিসে থাকবো। সুজানকেও বললাম। সুজান বললো প্যারিসে তার বাড়িতে অ্যাপার্টমেন্ট আছে। সেই অ্যাপার্টমেন্ট দেখেও এলাম। মিরিয়ামের প্রচণ্ড উৎসাহ যেন সুজানের বাড়ির ওই অ্যাপার্টমেন্টটি ভাড়া নিই। কিন্তু বাধ সাধলো ক্রিশ্চান। তার ঠিক করা অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নিতে হবে, তার আবদার। সুজানের অ্যাপার্টমেন্টটি সুন্দর হলেও, কম ভাড়ার হলেও, ভালো এলাকায় হলেও ক্রিশ্চানের অনুরোধে তার কোনও একডাক্তার বান্ধবীর ফেলে রাখা অ্যাপার্টমেন্টটিই ভাড়া নিতে হল। ভাবতে পারো মা, নিজের অত বড় বাড়ি ফেলে ছোট একটা ঘরে বাস করা! সুইডেনে গিয়ে আমার বই পত্র, কাপড় চোপড় সব প্যারিসে নিয়ে চলে আসি। এক দেশ থেকে আরেক দেশে এক বাড়ি জিনিসপত্র আনা খুব সহজ ব্যাপার নয়। খরচ যেমন, খাটনিও তেমন। সব একাই করি। সুয়েনসন তার স্বভাবের বদগুণে আমাকে কোনও সাহায্য করে না। তোমার জন্য টেলিফোন ডাইরেক্টরি খুঁজে ডাক্তার বের করতে না পারলেও মালামাল সরবরাহের আন্তর্জাতিক কোম্পানি খুঁজে বের করি। আসবাবপত্র কিছুআনিনি, আরও অনেক কিছুআনিনি। ওগুলো সুয়েনসনকে দান করে দিই। আসবাব এবং সংসারের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে নিয়েছিপ্যারিস থেকে। আমার নতুন সংসার শুরু হয় প্যারিসের পনেরো রুদ্য ভুইয়ে ঠিকানায়।
.
আমার রয়্যালটি জমা ছিল ক্রিশ্চানের কাছে। ক্রিশ্চান ধনীর মেয়ে। নিজেই ক্লিনিং কোম্পানির লোক ডেকে আমার রয়্যালটি থেকে পাঁচ হাজার ফ্রাঁ দিয়ে কার্পেট পরিষ্কার করালেন। কল্পনা করতে পারো, কেউ একজন পাঁচ মিনিটে দশ বাই বারো ফুট কার্পেট ভ্যাকুয়াম করে পাঁচ হাজার ফ্রাঁ অর্থাৎ প্রায় চল্লিশ হাজার টাকা নিয়ে চলে যায়! রয়্যালটির টাকা ওভাবেইনাশ হতে থাকে। অ্যাপার্টমেন্টে নাকি নতুন লাগানো হয়েছে ওভেন, ওই ওভেনের টাকা আমাকে দিতে হবে। প্রতিটি অ্যাপার্টমেন্টেই রেফ্রিজারেটর, হিটার, ওভেন, ডিশ ওয়াশার বা ওয়াশিং মেশিন এসব লাগানোই থাকে। ভাড়াটেদের কিছু কিনতে হয় না। কিন্তু এমন মন্দ কপালের ভাড়াটে সারা ফ্রান্সেপাওয়া যাবেনা। প্যারিসে থিতুহয়ে বসার পরপরই একদিন রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে পা মচকে গেল আমার। হাসপাতালে সেই পায়ে প্লাস্টার লাগানো, ফিজিওথেরাপি দেওয়া ইত্যাদি কাণ্ডতে আরও গেল টাকা। আমার হেলথ ইনসুরেন্স আছে সুইডেনে, আর তখনও আমার পাসপোর্ট রাষ্ট্রপুঞ্জের বা জাতিসংঘের, যে পাসপোর্ট ফেলে দিয়েছিলাম দেশে যাওয়ার আগে, সেটা ওরা নিজেরাই দেশ থেকে আমি ফেরার পর দিব্যি ফেরত দিয়েছে। এখানে ফ্রান্সে চিকিৎসায় যা খরচ হয়েছে, তা সুইডেনে নিয়ে দেখালে ওরা টাকা ফেরত দেবে, এরকম একটা আভাস পেয়েছিলাম। কিন্তু শেষ অবদি ওসব করাও হয়নি, টাকাও ফেরত পাওয়া হয়নি। টাকা যদি কেউ একবার নেয়, সেটা ফেরত নেওয়ার জন্য চেষ্টা করা কোনওদিন অন্তত আমার পক্ষে সম্ভব হয় না। ব্যক্তিগত ধারের টাকা ফেরত নেওয়ার চেষ্টা করার তো প্রশ্নই ওঠে না। দেড় দুবছরের পাওনা বেতনই তুলতে পারিনি মেডিকেল কলেজ থেকে। অফিস কাছারিতে টাকার জন্য, এমনকী পাওনা টাকার জন্য দৌড়োতে কোনওদিনই আমার ইচ্ছে করেনি। যা গেছে গেছে ভেবে অন্য কাজে মন দিই। এই টাকা জিনিসটা খুব চমৎকার, আবার খুবই বিচ্ছিরি। এটি আমার তীরে জলের মতো এসেছে, জলের মতো চলেও গেছে। আমার তো আবার খাল কাটায় জুড়ি নেই। খাল কেটে কেটে যথেষ্টই কুমীর এনেছি প্যারিসে থাকাকালীন।
.
ক্রিশ্চান বেস আমার জন্য ফরাসি সংস্কৃতি দপ্তর থেকে একটা চমৎকার স্কলারশিপ জুটিয়ে ফেললেন, দেড় লাখ ফ্রেঞ্চ ফ্রাঁ। প্যারিসের একটা ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খুলে সে টাকা জমা রাখা হল। টাকাটা উড়িয়ে ফেলতে বেশিদিন অবশ্য সময় যায় না। সুইডেনের বড় বাড়ি ফেলেপ্যারিসে ছোট একটা অ্যাপার্টমেন্টে থাকা, তাতে কী! ওখানেই শান্তি পেতাম। আমার যেমন ইচ্ছের জীবনে কেউ বাধা দেওয়ার নেই। এর চেয়ে আনন্দ আর কী আছে মা! যেদিন প্যারিসের অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকেছি সেদিনই আমার ইন্টারনেট চাই। ১৯৯৮ সাল। তখনও প্যারিসে লোকের ঘরে ঘরে কম্পিউটার ছিল না। ইন্টারনেটে আমি অভ্যস্ত অনেককাল আগে থেকেই। মোবাইল ফোনও তখন এত হাতে হাতে ছিল না। কিন্তু যে কোনও নতুন প্রযুক্তি শুরু হওয়ার শুরু থেকে তাআমার চাই। বিজ্ঞানের লোকশুধু নই, বিজ্ঞানে অগাধ বিশ্বাস থেকেই প্রযুক্তিরওপর কোনওদিন আস্থা হারাইনি। কমপিউটারকে এত বিশ্বাস করি, সম্ভবত মানুষের চেয়ে বেশি, তাই ব্যাক আপ রাখা বলে যে একটা কথা আছে, ওটাও রাখিনা। সারাদিন মগ্ন হয়ে থাকতাম কমপিউটারেতাস খেলায়। সারারাত আমার সময় সিগারেটের ধোঁয়ার সঙ্গে উড়ে যেতো। আমি আমি ছিলাম না মা। একসময় শরীর শরীর করে ব্যস্ত হয়ে উঠলাম। হাহাকারকে আর নেবার ক্ষমতা থাকে না মনের, তখন শরীরে সুখ দিয়ে সেই হাহাকারকে আপাতত দাবিয়ে রাখা জরুরি হয়ে ওঠে। হরমোনের হইচই আচমকা বেড়ে যায়, হয়তো শরীরই এভাবে নিজগুণে সামলাতে চায় কষ্টের বানে ভাসিয়ে নিতে থাকা জীবন। তাই মনে হয় আমার। সম্ভবত ভেতরের কষ্টগুলোকে লাঘব করার জন্য, অথবা ভুলে থাকার জন্য আমি নই, আমার শরীরই শরীরের বর্ম ভেঙে বেরিয়ে আসে। হঠাৎ খুব পুরুষের জন্য শরীর কাতর হতে শুরু করলো। ব্যস্ত থাকতাম নেটের চ্যাট সাইটগুলোয়। অচেনা কারুর সঙ্গে বিছানায় যেতে চাওয়ায় আমার একটুও দ্বিধা হত না, ঘেন্না হত না। এরকম আগে কখনও দেখিনি। তোমার অসুখের পর থেকেই আমার ভেতরের সুশৃঙ্খল সুসভ্য মানুষটি যেন নীতি দুমড়ে রীতি ভেঙে বেরিয়ে গেল। আমিই, অবাক হয়ে দেখলাম, ক্রমশ নয়, আকস্মিকভাবে আমার অবাধ্য হয়ে উঠলাম আমি। আমারই অচেনা আমি। ভেতরের হাহাকার আর বিশাল এক শূন্যতাপূরণ করার জন্যই সম্ভবত এই তীব্র যৌনকাতরতা হাঁমুখ করে বসে থাকে। তোমাকে নিয়ে যে আমার প্রচণ্ড অপরাধবোধ ছিল, ব্যথা বেদনা ক্ৰোধ কান্না ছিল, তা থেকে মুক্তি পেতেই কি এই করি? নিজের বিরুদ্ধে নিজেই প্রতিশোধ নিই! কিন্তু নিজের পাপের প্রায়শ্চিত্তকি ওভাবে করা যায়! আমার বোধহয় আর কোনও উপায় ছিল না। নিজের ভেতরটা ভেঙে গেলে বোধহয় নিজের বাহিরটাও ভেঙে ফেলতে ইচ্ছে হয়। অথবা আপনাতেই সব ভেঙে পড়ে। নিজেকে প্রবোধ দেওয়ার কোনও শক্তি আমার মধ্যে ছিল না।
কিন্তু চিন্তাশক্তি লোপ পেয়ে যাওয়া, শরীরে উত্তপ্ত হতে থাকা, মন পাথরের মতো শীতল হয়ে ওঠা এ সবই সাময়িক। ভোগবাদী দেশে বাস করলেও ভোগে আমার রুচি হয় না অল্প কিছুদিন পরই। ভেতরের সভ্য সুন্দর মানুষটি আমাকে একটা সময়ে আমারই সামনে এসে অনড় দাঁড়ায়। খুব বেশি উজ্জ্বল হওয়া আমার পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠেনা। আমার যখন চূড়ান্ত ডিপ্রেশন চলছে, প্যারিসে অনেকে আসতো আমার সঙ্গে দেখা করতে, অবশ্য সেপ্যারিস বলেই আসতো। শহর দেখানোর দায়িত্ব ছিল আমার। ম্যাট চেরি এসেছিলো। ম্যাট আমার একটি ইংরেজ বন্ধু, মানববাদী, হিউম্যানিস্ট এণ্ড এথিক্যাল ইউনিয়নের কর্মকর্তা। আমাকে এই সংগঠন শ্রেষ্ঠ মানববাদী হিসেবে পুরস্কারও দিয়েছে। ম্যাট তার ম্যানচেস্টারের বাড়ি ছেড়ে আমেরিকায় পাড়ি দিয়েছে, ওখানে সেন্টার ফর ইনকোয়ারিতে চাকরি করে। সেই আমেরিকার বাফেলো থেকে চলে এলো আমার সঙ্গে দেখা করতে। দুজনে মানববাদ নিয়ে, নাস্তিকতা নিয়ে সিরিয়াস সিরিয়াস কথা বলি। কিন্তু কোথায় থাকতে দিই বলল, একটি মাত্র ঘর। ভেতরের অতিথিপরায়ণ বাঙালি জেগে ওঠে। অতিথি নারায়ণতুল্য। অতিথিকে তাই বিছানা দিয়ে নিজে আমি মেঝেয় বিছানা করে শুই। কিন্তু দুরাত ওভাবে কাটাবারপর চেনা একজন ফরাসিমানববাদীর বাড়িতে ম্যাটকে রেখে এলাম, আমার পক্ষে ওভাবে কষ্ট করে ঘুমোনো সম্ভবনয়। সম্ভব হত, যদি ম্যাট কোনও সমবেদনা দেখাতো, যদি নিজেই বলত, তুমি বিছানায় শোও, আমি মাটিতে শুই বা কোনও হোটেলে চলে যাই। অথবা আমরা দুজনেই শুতে পারতাম বিছানায়। জানিনা ম্যাটের ওভাবে আমার কাছে আমেরিকা থেকে প্যারিস চলে আসার কারণ কী ছিল! একটি ঘর জেনেও তার কেন ইচ্ছে হয়েছিল, আমার সঙ্গে ওই একটি ঘরেই থাকার! ম্যাটের কি গোপনে প্রেম করার ইচ্ছে ছিল আমার সঙ্গে! ম্যাট দেখতে এমন কোনও সুদর্শন নয় যে ম্যাটের প্রেমে আমি পড়তে পিরবো। গুণে জ্ঞানে ম্যাট টইটম্বুর তাঠিক, কিন্তু দেখতে ভালো না হলে আমার পক্ষে প্রেম করা সম্ভব হয় না। যদি জনমনুষ্যিবিহীন কোনও মরুভূমিতে বাস করতে বাধ্য হতাম, তাহলেই হয়তো প্রেম করতে বাধ্য হতাম। শখের প্রেম চারদিকের সুন্দরের ভিড়ে কোনও এক অসুন্দরের সঙ্গে হয় না। ঢাকার প্রকাশক মেজবাহউদ্দিন এসেছিলেন প্যারিসে, উনি মেঝেয়বিছানা পেতে ঘুমিয়েছেন। আমি ভুলেও তাকে বলিনি বিছানায় শুতে। বাড়তি লেপ ছিল না, বড় জোর তার জন্য একটি লেপ কিনে দিয়েছি। অতিথিকে খাওয়াচ্ছি দাওয়াচ্ছি, নিজের পয়সায় প্যারিস দেখাচ্ছি, আর রাতে ঘরে ফিরে কিনা মাটিতে শোবো! এত ত্যাগ পোষায় না। তাছাড়া আরও একটা কারণে আমি ত্যাগ করিনা, কারণ মেয়েরাই পুরুষের জন্য নিজের আরাম আয়েশত্যাগ করবে, এটাই যেন জগতের নিয়ম। এই নিয়মকে আমি ভাঙি। অতিথিকে আপ্যায়ন করি, সাধ্যের বাইরেও তাদের জন্য করি, তাদের প্রাণের আরাম দিই। কিন্তু অতিথিকে নারায়ণ জ্ঞান করার ইচ্ছে আমার নেই। অতিথিকেনারায়ণের আরাম দেওয়া থেকে নিজেকে বিরত রাখি। কে আমার জন্য করে বলো! মেজবাহ আমার বই যে ছাপাচ্ছেন, কোনও রয়্যালটি দেওয়ার নামগন্ধ নেই। সব সমর্থন কেবল কথায়, কাজে নয়। মেজবাহ বলেন আমার বই নাকি এখন বাংলাদেশে মোটেও চলে না। আমার অবাক লাগে ভাবতে, একসময় পাগলের মতো লোকে বই কিনতো, পড়তো। আর যেই না দেশ থেকে দূর করে দিল সরকার, অমনি পাঠক মুখ ঘুরিয়ে নিল, বই পড়া বন্ধ করে দিলে! মৌলবাদীরা যখন বিরুদ্ধে ছিল, পাঠক তো আমার বইপড়া থেকে বিরত থাকেনি। সরকার আমার বিরুদ্ধে গেলে বইপড়া বন্ধ করে দেবার কারণ কী! এসবের কোনও উত্তর মেজবাহউদ্দিনের জানা নেই। শুধু পাঠক নয়, পত্রিকার সম্পাদকরাও শত্রু হয়ে যায়। যখনই সরকার আমাকে পিষে মারতে শুরু করলো বা দেশ থেকে তাড়িয়ে দিল, সব কাগজেই একযোগে আমার লেখা ছাপানো বন্ধ হয়ে গেল। কলকাতা থেকে শিবনারায়ণ রায় বেড়াতে এসেছিলেন। তাঁকে হোটেলে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছি। যত জাদুঘর আছে, সব দেখিয়েছি। সুইডেন থেকে সুয়েনসন এসেছিল, তাকেও শহর দেখিয়েছি। এত কাল বিদেশে আমি অর্ধেক-তুমি অর্ধেক সংস্কৃতি দেখেও আমার শেখা হয়নি। আমিই একা ঢেলে দিই। ফরাসি বন্ধুরাও জানে বন্ধুদের নিয়ে রেস্তোরাঁয় বা ক্যাফেতে খেলে আমি একাই বিল মেটাই। গুনে গুনে নিজের পয়সা বের করে নিজের ভাগটুকু আলাদা করে দেওয়া আমার একেবারে পছন্দ হয় না। আমি একদিন খাওয়ালাম সবাইকে। পরের বার নিশ্চয়ই আমাকে সবাই খাওয়াবে। খাওয়ালাম বলে ধন্যবাদ বলে গালে চুমু খেয়ে খেয়ে সবাই চলে যায়। কিন্তু তারপর আবার যখন রেস্তোরাঁয় গেলাম, যাদের খাইয়েছিলাম, তারা যার যার পয়সা মেটায়, আমারটা আমাকেই মেটাতে হয়। কত হাবিজাবি লোককে যে খাইয়েছি মা, কী বলবো। এসব তোমার চরিত্র থেকে পাওয়া। টাকা ফুরিয়ে তলানিতে এসে গেলেও এই স্বভাব আমার যায় না। চেষ্টা করেছি, এবার থেকে নিজেকে আর বোকা বনতে দেব না। পণ করি বটে, কিন্তু রক্তে যদি স্বভাবটা থাকে, কী করে বদলাবো বলো। আসলে কী জানো মা, যারা আমার জন্য ত্যাগ করে, তাদের বেশির ভাগের জন্য আমার কিছু করা হয় না। দেখেছি, যাদের জন্য করি, তাদের জন্য শুধু করেই যাই ত্যাগ। তারা কোনওদিন বিন্দুমাত্র ত্যাগ তো করেইনি, বরং ফাঁক ফোকর পেলেই ঠকিয়েছে। বন্ধু ভাগ্য আমার খুব ভালো নয়। আমি লক্ষ করেছি, যারা আমার বন্ধু হয়, তারা আমাকে বন্ধু হিসেবে নির্বাচন করে। এখানেই ভুলটি আমি করি। আসলে তার সঙ্গেই আমার মেশা উচিত, যাকে আমার ভালো লাগে। প্রেমিক বলো, বন্ধু বলো কাউকেই আমি নির্বাচন করি না। এ কি কোনও কমপ্লেক্স থেকে, কে জানে? সুপিরিওরিটি অথবা ইনফিরিওরিটি। কিছু একটা হবে। আমার অনেক সময় মনে হয় আত্মবিশ্বাস কম থাকার কারণে যাকে আমার পছন্দ, তার কাছে আমার যাওয়া হয় না। আমাকে যদি তার পছন্দ না হয়, আমাকে যদি সে ভালো না বাসে এই অনিশ্চয়তা থেকেই। অপমানিত হওয়ার ঝুঁকি আমি নিতে চাই না। তার চেয়ে যারা আমার সঙ্গে বন্ধুত্ব করার জন্য উন্মাদ হয়ে ওঠে, দিনরাত যারা জপ করে নাম, লেগে থাকে জোঁকের মতো, তাদের সঙ্গেই ধীরে ধীরে বন্ধুত্ব হয়। উন্মাদের দলে সত্যিকারের উন্মাদও বেশ কিছু জুটে যায়।
.
আর প্রেমের জন্য যেরকম পুরুষ আমার পছন্দ, সেরকম পুরুষ কি চাইলেই আমি পেতে পারি। অনেকেপায়। আমার পাওয়া হয়নি কোনওদিন। তুমি তো সারাজীবন পাওনি। বাবাকেইপাওনি। আর কাউকে তো পেতে চাওনি। বাবাকেই এক চেয়েছিলে। আর বাবা, তোমাকে ছাড়া পৃথিবীর সব মেয়েকেই চেয়েছিল। কতটা পেয়েছে কী পেয়েছে কে জানে, যাদের পেয়েছিল, তারা কি কেউ তোমার চেয়ে ভালো ছিল! তোমার প্রতি জানি না কী কারণে বাবার অনাসক্তি ছিল। একটা ভালোবাসাহীন সংসারে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত থেকে গেলে। তোমার মতো জীবন আমি যাপন করিনি। ভালোবাসাহীন কোনও সংসারে আমি থাকিনি। তার চেয়ে বরং একা থাকাটাকেই মেনেছি। এর মতো স্বস্তির কিছু আর নেই। কোনও পুরুষের সঙ্গে বাস করা কোনও সচেতন মেয়ের পক্ষে সম্ভব নয়, সে পুরুষ যদিনা মনে প্রাণে নারীর স্বাধীনতা একশ ভাগবিশ্বাস করে, এবং সেই বিশ্বাসকে নিজের জীবনে প্রমাণ না করে। কিন্তু খুব বেশি পুরুষের মধ্যে এই গুণটি আমি দেখিনি। অনেককাল আগে যেসব দেশে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠিত, সেসব দেশের অনেক পুরুষের মধ্যে এই গুণটি আছে, কিন্তু মনের মতো বিদেশি কোনও পুরুষ পাওয়া একটি দেশি মেয়ের পক্ষে খুব কি সম্ভব! প্রথম কথা, আমি তো খুঁজতে বসিনি কোনওদিন। ওসব আমার স্বভাবের বাইরে। স্বভাবের বাইরে বেরোনো আমার পক্ষে কোনওকালেই সম্ভব নয়। বিশেষ করে যে স্বভাবগুলো ভেতরে পুঁতে দেওয়া। এই স্বভাব বোধহয় তোমার কাছ থেকে পেয়েছিমা। তুমিও কোনও পুরুষের দিকে ফিরে তাকাতে না। যদিও বোরখার আড়ালে জীবনের প্রায় সবটা সময়ই কাটিয়ে দিয়েছে, কিন্তু আড়াল থেকে কাউকে হয়তো দেখেছো, কিন্তু তোমাকে তো দেখেনি কেউ। ’তোমাকে ভালোবাসি’ এই কথাটা তুমি কোনওদিন কারও কাছ থেকে শোনোনি। ভাবলে আমার খুব কান্না পায়। বাবা তো বলেইনি তোমাকে কোনওদিন। জানিনা কোনওদিন আমাণুদ্দৌলা বলেছিলো কিনা। আমার কেন যেন মনে হয়, বলেনি। আমাণুদ্দৌলার বিয়ে করার রোগছিলো। একইসঙ্গে কয়েকটা শহরে কয়েকটা বউ রাখতো। যেখানে বিয়ে করার সম্ভাবনা আছে, সেখানেই ভিড়তো। তোমার কাছে ভিড়তে চেয়েছিলো, সে তো বিয়ের জন্য নয় নিশ্চয়ই। আহ, জীবনে যদি তুমি কোনও সৎ পুরুষের দেখা পেতে মা! যদি জানতে, কেউ তোমাকে ভালোবাসে! ভালোবাসি শব্দটা আমি অনেক শুনেছিমা, আমার কোনও অতৃপ্তি নেই। তোমার শরীরটাকেও তুমি তৃপ্ত করতে পারোনি। চারটে সন্তান জন্মেছে বটে তোমার। সে খুব। সুখের মিলনে জন্মেছে বলে আমার মনে হয় না। জন্মানোর দরকার ছিল বলেই হয়তো জন্মেছে। সমাজের বাধা তো আছেই, মনের বাধাও কি কম? আমি সমাজের আর মনের সব বাধাই ডিঙিয়েছি। কিন্তু তারপরও কোথায় যেন হেরে যাই। জীবনের অনেকটা পথ পেরিয়ে এসে দেখি, আমি হয় নোবডি নয় সেলিব্রিটি। নোবড়ি আর সেলিব্রিটির প্রেমে সাধারণত কেউ পড়ে না। নোবডিকে লোকে তুচ্ছ করে, আর সেলিব্রিটির কাছ ঘেঁষতে দ্বিধা করে, ভেবেই নেয় যে ও নিশ্চয়ই যে কারও প্রেমে পড়বে না। যত মনের জোর আর সাহস থাকুক না কেন আমার, লক্ষ করেছি, কোনও পুরুষকে আগ বাড়িয়ে আমি বলতে পারি না, না দেশে না বিদেশে, তোমাকে ভালো লাগে বা এধরনের কিছু। জগতে বোধহয় আর কোনও আধুনিক মেয়ে নেই, যে কিনা এত দীর্ঘদীর্ঘদিন যৌনগন্ধহীন সন্ন্যাস জীবন কাটায়। আমাদের বোধহয় সমস্যা একইরকম ছিলো, সত্যিকার প্রেম আমরা পাইনি। পাইনি বলে যেন তেন কাউকে মেনে নিতেও পারিনি। এ নিয়ে তুমি কি আফশোস করো নীরবে, নিভৃতে? আমি করি। মাঝে মাঝে মনে হয়, আমার এই জীবন যদি আবার শুরু থেকে পেতাম, অন্য রকম করে যাপন করতাম। আসলে অনেকেরই এই ইচ্ছেটা হয়, শুধু আমার নয়। সংবেদনশীল মানুষ হলে অতৃপ্তিটা মৃত্যু অবধি থাকে।
.
ফরাসি একটি ছেলের সঙ্গে আমার সম্পর্কহয়। সম্পর্কটা শুরু হয় শরীরের আকর্ষণের কারণে, একে প্রেম জানি না বলা যায় কি না। ছেলেটা সুন্দর দেখতে। সুদর্শন সুপুরুষ বলতে ঠিক যা বোঝায়, তা। বয়সে আমার চেয়ে ছ বছরের ছোট। একসময় ভাবতাম বয়সে ছোটর সঙ্গে বুঝি প্রেম হতে পারে না। ভাবতাম বাংলায় কথা যে না বলতে পারে, তার সঙ্গে কখনও প্রেম হতে পারে না। সম্পূর্ণ ভুল। যে কোনও ভাষাতেই প্রেম সম্ভব। ছেলেটা ইংরেজি জানে। ইংরেজিতেই কথা হয় আমার সঙ্গে। ফরাসি ভাষা যেটুকু শিখেছি তাতে বেশিক্ষণ কথা চালানো যায় না। যখন ফরাসিতে তার প্রেমের কথা শোনাতে থাকে, খুব ভালো লাগে শুনতে। ফরাসি ভাষা, অনেকে বলে, প্রেমের জন্য চমৎকার ভাষা। ছেলেটা সত্যি বলতে কী, মা, আমাকে শরীরের প্রেম শিখিয়েছে। কত যে অশিক্ষিত ছিলাম শরীরের ব্যাপারে। নিজের শরীর, অথচ এই শরীরই কত অচেনা ছিল আমার। ছেলেটা আমার প্রেম পাবার জন্য দিন দিন অস্থির হয়ে ওঠে। ছেলের বউ বাচ্চা আছে, কিন্তু বউএর সঙ্গে নাকি শারীরিক সম্পর্ক নেই। এসব আমি বিশ্বাস করি না। কারণ সব বিবাহিত পুরুষই অন্য মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক করতে গেলে এসব কথা বলে। আমার কোনও অসুবিধে নেই সে ছেলে আর কারও সঙ্গে শুলে। আমি আমার একলা জীবনে মাঝে মাঝে যদি শরীরের তৃষ্ণা মেটাতে কোনও এক চমৎকার সুপুরুষকে পাই, যে আমাকে প্রচণ্ড ভালোবাসছে বলছে, কেন নয়, বলো? ছেলে দূরের একটা শহর থেকে প্রায়ই চলে আসতো, দু টো তিনটে দিন আমার সঙ্গে কাটিয়ে যেত। বিমানবাহিনীর পাইলট। আমিই প্যারিস শহরে তাকে নিয়ে ঘুরে বেড়াতাম। মেট্রো সবাই চড়ছে। আমার আবার পাতালে যেতে ইচ্ছে করে না। ট্যাক্সিতে সব জায়গায় যাওয়া চাই আমার। টাকা পয়সার প্রতি কোনও আকর্ষণ নেই বলেই হয়তো ওভাবে খরচ করতাম। ছেলেটা আমার কাণ্ড অবাক হয়ে দেখতে।
দেশ থেকে নির্বাসিত হওয়ার পর ছ বছর ভারতীয় দূতাবাসের দ্বারে দ্বারে ঘুরেও ভারত যাওয়ার অনুমতি পাইনি। বাংলাদেশ তো আমাকে ঢুকতেই দেয় না দেশে, ভারতে যেতে চাইছি কতকাল, সেইভারতও আমাকে ভারতে ঢোকার অনুমতি দিচ্ছেনা। শেষঅবধি নিরানব্বইএর শেষ দিকে আমাকে ভারতের ভিসা দেওয়া হয়। কী যে আনন্দ হয়েছিলো তখন। অন্তত দেশে না হোক, দেশের কাছাকাছি কোনও দেশে তো পৌঁছোতে পারবো। কলকাতা তো শুধুই আর পাশের দেশের কোনওশহরনয়! কলকাতার কত মানুষই তো আমার বন্ধু, শুভাকাঙ্ক্ষী। অনেকে বলে বিজেপি ক্ষমতায় এসেছে বলেই ভিসা পেয়েছি। কোন দল সরকারে এলো, সে নিয়ে আমার ভাবনা নেই, আমার ভারত যাওয়া নিয়ে কথা। বিজেপি যদিছ বছরের নিষেধাজ্ঞা ঘোচায়, তবে বিজেপিকে ধন্যবাদ জানানোর কোনও কারণ নেই। আমার ভারত যাওয়া মানে, কলকাতায় যাওয়া। কলকাতায় যাবো, খুশিতে নাচছি আমি। ফরাসি প্রেমিক, লরোঁ নাম, বললো, সেও যেতে চায় সঙ্গে। আমার আপত্তি নেই। খুশিতে সেও নাচলো। কিন্তু নিজের টিকিট করার সময় ছেলে বললো তার টাকা নেই টিকিটের পেছনে খরচ করার! বলে কী! ফরাসি যুবক, বিমান বাহিনীতে পাইলটের কাজ করেছে, ওদিকে আবার তুলুজ নামের শহরের নামকরা কলেজে বৈমানিক প্রকৌশল বিদ্যা শিখছে, তার টাকা নেই? অবাক হলাম বটে, কিন্তু আমিই টিকিট করলাম দুজনের। এয়ার ফ্রান্সে বোম্বে হয়ে কলকাতা। আমি ছাড়া কে করবে এসব! আমার মতো আবেগ সর্বস্ব বুদ্ধিহীন মেয়েমানুষ ছাড়া! ওই তোমার মতোই। আমি ঠিক জানি, তুমি আমার জায়গায় হলে তাই করতে। ইয়াসমিনও করতো। আমরা এই তিনজন হয়তো আঘাত পাওয়ার জন্যই জন্মেছি। ছেলেকে বিশাল সম্মান জানিয়ে সবখানে আমার সঙ্গে রাখলাম। এমনকী জ্যোতি বসুর সঙ্গে যখন দেখা করলাম, যে ঘরে অন্য কারও ঢোকা নিষেধ ছিল, ফরাসিকে ঢোকালাম। ফরাসি মনের আনন্দে সব নেমন্তন্ন, সব সংবর্ধনা, সব আনন্দ, সব সুখ উপভোগ করলো। প্রচুর উপঢৌকনও পেয়েছিল শুধু আমার প্রেমিক হওয়ার কারণে।
শুধু ফরাসি যুবক নয়, ফরাসি ওয়াইন নিয়েও গিয়েছিলাম। তাজ বেঙ্গলে একটা সুইট ভাড়া নিয়েছিলাম। দিনে বারো হাজার টাকাই যার ভাড়া। আসলে কী জানো, প্রাণের টানে যে জায়গায় এসেছি, সেখানে আর যা কিছুরই হিসেব করি, টাকার করি না। আমি সবসময় বলি, আমাকে বলো লক্ষ টাকা দান করতে, করবো। কোনও আপত্তি নেই আমার। কিন্তু আমাকে ঠকিয়ে যদি দুপয়সা নিতে চাও, আমি মানবো না। বলি বটে, কিন্তু তাও মেনে নিতে বাধ্য হতে হয়। প্রথম রাতেই আমার হোটেলের ঘরে কলকাতার পুরোনো চার বন্ধু এসেছিল ওয়াইন খেতে। অনেক রাত পর্যন্ত আড্ডা হল, খাওয়া হল। ফ্রান্স থেকে আনা ওয়াইন শেষ হয়ে গেলে হোটেলের রিসিপশানে ফোন করে ফরাসি ওয়াইন থাকলে দিতে বলি। লোক এসে দুবোতল ওয়াইন খুলে দিয়ে যায়। পরদিন সকালে ওই ওয়াইনের বিল দেখালো এক লক্ষ টাকারও বেশি। অত দামি ওয়াইন দিতে গেলে তার দামটা তো আগে বলে নেবে! আমার প্রশ্নের কোনও উত্তর নেই। বলেছিলাম, যেন দাম কমিয়ে রাখে। রাখেনি। ওই টাকা আমাকে একাই দিতে হয়েছে। ওয়াইন খেয়ে অনেক রাতে যখন বন্ধুরা চলে যাচ্ছে, আমার দ্বিগুণ বয়সী একজন বিদায় আলিঙ্গন করার নামে অযথাই আমার স্তন টিপে গেল। কী সুখ পেলো কে জানে। আমি হতবাক দাঁড়িয়ে রইলাম। এসবেপুরুষের কোনও লজ্জা হয় না, লজ্জা আমার হয়। আমার শুধু লজ্জা হয় না, রাগও হয়। কিন্তু আমি জানি, সব মানুষ এক রকম নয়। ভালো লোক মন্দ লোক সব দেশেই আছে। তবে জানো তো, মন্দ লোক আমি সহজে চিনতেপারি না। স্বভাব-গুণে অথবা দোষে সবাইকে ভালো লোক বলেই ভাবি। যখন মুখোশ খুলে পড়ে ওদের, বিস্মিত হই, দুঃখ পাই। ছোট একটা কবিতা লিখেছিলাম সেদিনের সেই বিস্মিত বিষাদনিয়ে।
রাস্তার ছেলে আর কবি।
এ গল্প আগেই করেছি, ওই যে ছোটবেলায় একদিন নদীর ধারে হাঁটছিলাম
আর ধাঁ করে উড়ে এসে এক
রাস্তার ছেলে আমার স্তন টিপে
দৌড়ে পালিয়ে গেল, অপমানে নীল হয়ে বাড়ি ফিরে সারারাত কেঁদেছিলাম।
এ গল্প এখনও করিনি যে বড় হয়ে, কবিতা লিখতে শুরু করে
কবিদের আড্ডায় যেই না বসি,
হাতির মতো কবিরা স্তন টিপে
দিয়ে চলে যায়।
পরদিন দেখা হলে বলে, কাল খুব মদ পড়েছিল পেটে।
মদের দোহাই দিয়ে কবিরা
বাঁচে,
কবিতার দোহাই দিয়েও পার
পায় বটে।
মন খারাপ হয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে তা ঠিক, কিন্তু মন ভালো হওয়ারও অনেক কিছু ঘটেছে। শান্তিনিকেতনেকণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে, যার গান শুনে আমার কৈশোর আর আমার যৌবন কেটেছে, যার গান আমাকে বিদেশ বিভুইয়ে বাঁচিয়ে রেখেছে, দেখা হল। মুগ্ধতা আমাকে নির্বাক করে রেখেছিলো। উনি গান শোনালেন। গান শুনে কী জানি কী কারণে আমার চোখ ভরে ওঠে জলে। আড়াল করি চোখের জল। আসলে কী জানো মা, তোমার বয়সি কেউ যদি আমাকে নিঃস্বার্থ ভাবে ভালোবাসে, আমাকে স্নেহ করে, আদর করে কথা বলে, চোখের জল রোধ করতে পারি না। সাংবাদিকদের ভয়াবহ ভিড়। কী বলবোমা, লেখক তো নই, যেন বোম্বে থেকে সিনেমার স্টার এসেছি। আমার এত আলো, এত সাংবাদিক, এত প্রশ্ন ভালো লাগে না। বার বার ওদের বলেছি, ক্যামেরা দূরে সরাতে। বারবার বলেছি সাক্ষাৎকার দেব না। কে শোনে আমার কথা। বুঝি ওরা ভালোবাসে। ভালোবাসার মূল্য আমি না দিয়ে পারি না। এই একটি ব্যাপারে আমি খুব বোকা হয়ে পড়ি। শুধু তোমার ভালোবাসারই মূল্য দিইনি, জানি।
.
কত কিছু যে ঘটে কলকাতায়। অন্নদাশংকর রায়, শিবনারায়ণ রায়, অম্লান দত্তের মতো বড় মনীষীরা আমাকে স্নেহ করছেন, ভালোবাসছেন, তাঁরা আমার লেখাকে, লেখার জন্য আমার নির্বাসনকে ঐতিহাসিক বলে মত দিচ্ছেন। নিজের সম্পর্কে এত বড় ধারণা আমার নিজেরই কোনওদিন ছিল না, বা নেই। কিন্তু বড় মানুষদের ঔদার্য দেখে ভালোও লাগে, কুণ্ঠিতও হই। নিজে আমি সাধারণ এক মানুষ। সাধারণের মধ্যে থেকেই আমি স্বস্তি বোধ করি। অসাধারণ মানুষের ভিড়ে আমি বুঝি যে আমি নিতান্তই ক্ষুদ্র তুচ্ছতৃণ। তারপরও বড় বড় মানুষেরা আমাকে ভালোবাসা বা প্রশ্রয় দিতে মোটেও কার্পণ্য করেন না। নিখিল সরকার বটবৃক্ষের মতো দাঁড়িয়ে থাকেন। তাঁর মহানুভবতার তুলনা হয় না। তিনি আমাকে পরমাত্মীয়র মতো কাছে টেনে নিজের দেশ, নিজের বাড়িঘর, নিজের আত্মীয় স্বজন সব হারিয়েছি বটে, কলকাতা আমাকে সব ফিরিয়ে দেয় কদিনেই।
আমি অবাক হয়ে লক্ষ করি, আমাকে এক পলক দেখার জন্য, আমার অটোগ্রাফ নেওয়ার জন্য, আমার সঙ্গে কথা বলার জন্য কলকাতায় শুভাকাঙ্ক্ষীর ভিড়। সেই যে চুরানব্বই সালের মে মাসে প্যারিস হয়ে ঢাকা ফেরার পথে কলকাতায় গিয়েছিলাম, তার পর এই প্রথম আমি কলকাতায়। কলকাতা আমাকে বুকে টেনে নিল ভালোবেসে। অথচ পাশেই নিজের দেশ। যে দেশে আমাকে মানুষ ঘৃণা করে, অথচ বাঙালি ওরাও, বাঙালি এরাও। পশ্চিমবঙ্গের মানুষের ভালোবাসা পেয়ে আমার দীর্ঘ নির্বাসনের কষ্ট অনেকটাই মোচন হয়। যারা ভালোবাসে, তাদেরই আমার স্বজন, আমার আত্মীয় বলে মনে হয়। এদিকে ফরাসিটা চারদিকে আমার জনপ্রিয়তা দেখে কই খুশি হবে না তো কালকেউটের মতো ফণা তুলছে। এক রাতে, সারাদিনের হৈ চৈ এর পর পরদিন আমার অনুষ্ঠান, অনেকদিন বাংলা না বলে না পড়ে অনেকটা ভুলে যাওয়ার মতো অবস্থা, তারপর কী পড়বো, কোন কবিতা, কী বলবো নতুন বই নিয়ে, কিছুই ঠিক নেই, একবার দেখে নিতে চাইছি, মনোযোগ লেখায়, পড়ায়। না, লরে আমাকে কিছুইপড়তে দেবে না, লিখতে দেবে না, ভাবতে দেবে না। তাকে সময় দিতে হবে, তার দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে, তার সঙ্গে গল্প করতে হবে, তার সঙ্গে প্রেম করতে হবে, তার শরীরে সাঁতার কাটতে হবে। আমি সেদিনই সিদ্ধান্ত নিয়েছি এই আপদকে জীবন থেকে সরাতে হবে। যে প্রেমে শ্রদ্ধা থাকে না, সে প্রেমকে আমি প্রেম বলি না। এত স্বার্থপর, হিংসুক, হীনম্মন্য লোককে নিয়ে চলাফেরা করার কী প্রয়োজন আমার! শরীরে সুখ হয় তা ঠিক। কিন্তু অন্যের ইচ্ছের খাঁচায় বন্দি হয়ে সে সুখ নেওয়ার কোনও শখ নেই আমার। ফরাসির জায়গায় কোনও বাঙালি পুরুষহলেও সম্ভবত একইভাবেঈর্ষা করতো। পুরুষের ঈর্ষা যে কী ভয়ংকর, তা আমি হাড়ে মজ্জায় টের পেয়েছি। জীবনে যে কজন পুরুষের সঙ্গে আমি সম্পর্ক গড়েছি, ওই একটি কারণেই মূলত সে সম্পর্ক ভেঙেছে, ঈর্ষা। লোকে বলে, মেয়েরা নাকি ঈর্ষাকাতর। পুরুষের তুলনায় মেয়েরা সামান্যও তা নয়। দেশে দেশে যত অপরাধ ঘটছে, তার সিংহ ভাগপুরুষের ঈর্ষার কারণে। মেয়েদের শরীরে অ্যাসিড ছুঁড়ছে, মেয়েদের গুলি করে, কুপিয়ে, পিটিয়ে, গলা টিপে হত্যা করছে পুরুষেরা। ঈর্ষায়। কটা পুরুষকে মেয়েদের ঈর্ষার কারণে জীবন দিতে হয়, কটা পুরুষের সর্বনাশ মেয়েরা করেছে, বলো?
.
এতদিন পর কলকাতায় এলাম, যেন দেশে ফিরলাম, যেন বাড়ি ফিরলাম। মা তুমি কখনও দেখনি মানুষ আমাকে ভালোবাসে। জীবনভর তুমি দেখেছো মানুষ আমাকে ঘৃণা করে, কাগজে কাগজে আমার বিরুদ্ধে কুৎসা রটায়, আমাকে অতর্কিতে আক্রমণ করে মেলায়, আমার বিরুদ্ধে মিছিল করে শহরে, আমাকে মেরে ফেলতে চায়, মাথার দাম ঘোষণা করে। কলকাতায় মানুষের ভালোবাসা দেখে আমার খুব তোমার কথা মনে পড়ছিল। আরও অনেক দেশে যখনই মানুষের ভালোবাসা, মানুষের উচ্ছ্বাস, আর আবেগ দেখেছি, শুধু তোমার কথা মনে পড়েছে, মনে মনে বলেছি, দেখ মা, তোমার মেয়েকে কত মানুষ ভালোবাসে। দেখতে কি পেতে কিছু! আমার কেন যেন বিশ্বাস করতে ভালো লাগতো, হয়তো দেখছো, যে কোনও কোথাও থেকে হয়তো দেখছো, দেখে হয়তো তোমার মনে আনন্দ হচ্ছে, হয়তো তোমার চোখে জল চলে আসছে। শিশির মঞ্চে আবৃত্তিলোক আমাকে সংবর্ধনা দিয়েছিলো। একা আমারই কবিতা পাঠের অনুষ্ঠান ছিল। আমার এক পাশে বসেছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, আরেক পাশে শঙ্খ ঘোষ। একসময় যখন আমার ‘মায়ের গল্প’ নামের কবিতাটা পড়তে শুরু করলাম, কণ্ঠ বুজে এল, কিছুতেই পারছিলাম না পড়ে যেতে। সুনীল সান্ত্বনার একটি হাত রাখলেন পিঠে। কোনও সান্ত্বনা আমার দুঃখ দূর করতে পারেনা, মা। কোনও সান্ত্বনা আমার গ্লানি থেকে আমাকে মুক্ত করতে পারে না। তুমি যদি জীবনে সুখে থাকতে একটুখানি, আনন্দে থাকতে, তুমি যদি সামান্য ভালোবাসা পেতে আমাদের, তবে এই কষ্ট আমার হত না মা। মরে তো কত মানুষ যায়। তোমার মতো এত কষ্ট পেয়েকজন যায় বলো! সেই জন্মেরপর থেকে কষ্ট করছে। ভেবেছিলে কষ্ট বুঝি দূর হবে কোনও একদিন। তোমার চেয়ে ওই দুলুর মা বা আনুর মাও অনেক ভালো ছিল। তুমিও বুঝতে যে ওরা ভালো আছে, কেউ না কেউ আছে ওদের ভালোবাসার। তোমার তো কেউ ছিল না। এই যে কেউ ছিল না তোমার, সেটি আমি সইতে পারি না। নিজেকে ক্ষমা করতে পারি না আমি। কোনওদিনই পারবো না।
.
তুমি আর জাগলে না, চোখ খুললে না, কথা বললে না সম্ভবত জানুয়ারির এগারো তারিখে। জানি না এই তারিখটা কেন আমার মনে আছে। আমি মনে রাখতে চাই না, তারপরও মন থেকে তারিখটা কেন উবে যায় না! কত কিছুই তো মনে রাখতে পারি না, এই তারিখটা কেন মনে রাখি, জানি না। না, বছর বছর এগারো জানুয়ারি এলে আমি কিছুই করি না, হয়তো তারিখটি এসে চলে গেলে মনে পড়ে তারিখটি এসেছিলো। তিনশ পঁয়ষট্টি দিনের মধ্যে একটি দিন ওই দিনটি। ওই দিনটিতে আলাদা করে তোমাকে মনে করার, দুঃখ পাওয়ার আমি কোনও কারণ দেখি না। তিনশ পঁয়ষট্টি দিনই আমি তোমাকে মনে রাখতে চাই। বছরে তিনশ পঁয়ষট্টি দিনই আমি তোমাকে ভালোবাসতে চাই, তোমার মতো হাজারো মাকে চাই, মানুষকে চাই। তিনশ পঁয়ষট্টি দিনই নির্যাতিত সব মেয়েদের জন্য দু ফোঁটা চোখের জল ফেলতে চাই। তাদের জন্য মুষ্টিবদ্ধ করতে চাই হাত অথবা তাদের দিকে বাড়িয়ে দিতে চাই নিজের দুহাত। যদি আলাদা করে কোনও দিন তারিখের কথা আমাকে মনে রাখতেই হয়, আমি শুধুমনে রাখতে চাই তোমার জন্মের তারিখ। কোনও সাল তারিখ জানা ছিল না জন্মের। শুধু জানতে কোনও এক ঈদে তুমি জন্মেছিলে। তাই তোমার নাম রাখা হয়েছিল ঈদুল। নানা, নানি বড়মামা আর বাবা তোমাকে ঈদুন বলে ডাকতো। ল কেন যেন হয়ে গিয়েছিল ডাকার বেলায়!
তোমাকে হারিয়ে আমি নিজেকে হারালাম, মা। আমার কাছে পৃথিবীটাকে আর মূল্যবান কিছু মনে হল না। জগৎ তার সৌন্দর্য, তার হৃদয় সব নিমেষে হারিয়ে ফেললো। পড়ে রইলো নোংরা নর্দমার মত, পুঁজ আর পচা রক্তের মতো প্রাণহীন, দুর্গন্ধ, কুৎসিত। এই জগতে আমি একা বসে করবোটা কী, বলো তো! অপরাধবোধ আমাকে দিনে সাত টুকরো করে, রাতে সাত টুকরো করে। আমিটুকরোহই, রক্তাক্ত হই, তারপরও দেখি বেঁচে আছি। এই বেঁচে থাকা আমিটার জন্য আমার কোনও ভালোবাসা জন্ম নেয় না। ঘৃণা জন্ম নেয়। নিজের জন্য এই ঘৃণাটা আমি পুষে রাখি নিজের ভেতর। ঘৃণাটা আগুনের মতো, একবার হাওয়া লাগলে নিজেকে পুড়িয়ে ফেলে। আমি পুড়তে থাকি। প্রতিদিন। প্রতিরাত। এরকম ভাবেই আমি বেঁচে থাকি, যেখানেই থাকি।
.
বইমেলায় ঝড় বৃষ্টির রাতেও রীতিমত লাইনে দাঁড়িয়ে ‘আমার মেয়েবেলা’ বইটা কিনেছে পাঠক। তুমি সুইডেনে আসার পর যে বইটা দিনভর, রাতভর আমি লিখতে শুরু করেছিলাম, সেই বই। যে বইটা লিখছি বলে তোমাকে সময় দেওয়ার সময় হয়নি আমার, সেই বই। তোমার সাহায্য না পেলে যে বইটা আমার লেখা হতো না, সেই বইয়ের জন্য আমি পেলাম আনন্দপুরস্কার। এই বইএর কিছু তথ্যপড়েও খুব দুঃখ করেছিলে। কিন্তু তোমার দুঃখ তো তোমার দুঃখ। ও আমার দুঃখ নয়। তাই কোনও তথ্য আমি বদলে দিইনি। তুমিও সুইডেন ছাড়লে, আমার লেখাও শেষ হলো। পাণ্ডুলিপি পড়ে ফ্রান্সের প্রকাশক ক্রিশ্চান বেস এত বেশি আপ্লুত যে অনুবাদ হয়ে যাওয়ার পর, অল্প কিছু জিনিস সংশোধন করার জন্য নিউইয়র্কে আমার কাছে পাঠিয়েছিলেন অনুবাদক ফিলিপ বেনোয়াকে। কিছু শব্দ, আর বাক্য বিশেষ করে আরবি ফারসি যে শব্দগুলো ব্যবহার করেছি, তাদের অর্থ জেনে নিয়ে সে শহর বেড়াতে বেরিয়ে পড়তো। সেই ফিলিপ বেনোয়া প্যারিসে ফিরে যাওয়ার পরপরই বই বেরোলো এডিশনস স্টক থেকে। ‘আমার মেয়েবেলা’ প্রথম বেরিয়েছে ফরাসি ভাষায়। বাংলায় বেরোলো অনেক পরে। মূল ভাষার পাণ্ডুলিপি যথারীতি আনন্দ পাবলিশার্সকে দেওয়া হয়েছিলো। যেহেতু আনন্দই আমার বই ছাপায়। কিন্তু পাণ্ডুলিপি পড়ে আনন্দ সিদ্ধান্ত নিল যে এ বই তাদের পক্ষে ছাপানো অসম্ভব। শুনেছি, দেশ, সানন্দাইত্যাদি পত্রিকা বাংলাদেশে যাচ্ছে, এখন আমার বই প্রকাশ করে বাংলাদেশ সরকারকে ক্ষেপিয়ে দেওয়ার ইচ্ছে আনন্দ পাবলিশার্সের নেই। কেউ চাইছেনা, দেশ আর সানন্দা বাংলাদেশে আমার কারণে নিষিদ্ধ হয়ে যাক। আর, ইসলাম নিয়ে যেসব কথা বইতে আছে, তাতে বাংলাদেশ সরকার আপত্তি করতেই পারে। যদি আনন্দ বই ছাপায়, তবে কিছুকিছু অংশ বিশেষ করে ধর্ম নিয়ে মন্তব্য বাদ দিতে হবে। আনন্দ এর আগে এমন আবদার করেনি, অবাক হই, কিন্তু কোনও কিছু বাদ দিতে আমি রাজি হই না। না রাজি হলে আনন্দ ছাপাবে না বই। ওরা এর আগে আমার কোনও বই ছাপাতে আপত্তি করেনি। এবার করেছে, এর পেছনে আরও এক কারণ আমি শুনেছি, ওরা ঢাকায় আনন্দ পাবলিশার্সের একটা শাখা খুলবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে এ নিয়ে কথাও হয়ে গেছে। ইসলাম সম্পর্কে সমালোচনা আছে আমার এমন কোনও বই যদি এখন ছাপায়, তাহলে ঢাকায় ওদের নতুন শাখার ওপর মৌলবাদী আক্রমণ হওয়ার আশংকা আছে।
নিখিল সরকার তখন চেষ্টা করলেন অন্য প্রকাশককে বই দিতে। স্ত্রী নামের একটি প্রকাশনী সংস্থা এগিয়ে এলো। লেখক অমিতাভ ঘোষের সঙ্গেও নিখিল সরকারের এ নিয়ে কথা হয়। তিনিই চেয়েছিলেন স্ত্রীকে দেওয়া হোকপাণ্ডুলিপি। কিন্তু নিখিল সরকার শেষ পর্যন্ত দিলেন না, বললেন স্ত্রীও পারবেনা বাদ না দিয়ে বই প্রকাশ করতে। তাঁর বন্ধুদের মাধ্যমেই পিবিএস নামের ছোটখাটো একটি প্রকাশনীর খোঁজপাওয়া গেল। ওই প্রকাশনীকেই নিখিল সরকার দিয়ে দিলেন বই। পিবিএস নিজেদের আদর্শের বাইরের কোনও বই ছাপায় না। আমার বই পরীক্ষা নিরীক্ষা করে তবে পিবিএস এর কর্তারা এক মত হয়েছেন যে এই বই তাঁদের আদর্শের পরিপন্থী নয়। পিবিএস ছোট প্রকাশক। আনন্দের মতো বড় প্রকাশকবই ছাপাতে নারাজ শুনে অন্য বড় প্রকাশকও ভয়ে পিছিয়ে গেছে। পিবিএসএর ভয় ডর কমই। ছোট বলে নয়। আদর্শের কারণে। সমাজতন্ত্র, সমতা, সততা, সমানাধিকার, এসআমারও যেমন বিষয়, তাদেরও। আজকাল তো আর সব থাক, এই আদর্শটাই নেই মানুষের। মানুষ ক্রমে ক্রমে বিচাত হচ্ছে মানবতাবোধ থেকে। নিখিল সরকার বই থেকে বেশ কিছু শব্দ বাক্য কেটে বাদ দিয়েছেন। তাঁর আশংকা, ওগুলো পড়ে মুসলমানরা আমাকে মেরে ফেলবে। আমি মৃত্যুর ভয় করি না। সেই বাদ দেওয়া শব্দ বাক্যগুলো যখন চোখেপড়ে, রীতিমত যুদ্ধ করেওগুলোআবার আমি ঢুকিয়ে দিয়েছিবইয়েরপরের সংস্করণে। পিবিএস এর কর্তারা নিজেরা ধর্মমুক্ত হওয়ায় কোনও ঝামেলা করেনি। নিখিল সরকার নিজে ধর্মমুক্ত হলেও আমার কোনও ক্ষতি হতে পারে আশংকায় আমার অতি-সাহসে অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন। কিন্তু তাঁকে শ্রদ্ধা করলেও আমি কাটাছেঁড়ার ব্যাপারটি মেনে নিতে পারিনি। বিশাল এক প্রকাশনা উৎসব হয়েছিলো বইয়ের, সম্ভবত ওটাই আমার লেখা কোনও বইয়ের প্রথম প্রকাশনা উৎসব।
বইটি তোমার কারণেই লেখা হয়েছিল, মা। ছোটবেলার কত ঘটনা তুমি আমাকে বলেছো। অপ্রিয় কত সত্য কথাই তো তুমি বলেছো। তুমি যেরকম লুকোওনি, আমিও লুকোইনি। বই লিখছি জেনেও তো তুমি তোমার মেয়েবেলার সব দুঃখ সুখের কথা বলেছো, তোমার যৌবনের, তোমার সংসার জীবনের সব। তুমি না বললে আমি লিখতে পারতাম না আমার মেয়েবেলা, তুমিই শুরু করে দিয়ে গেলে আমার আত্মজীবনী লেখা। নির্বাসনের কারণে আমার লেখালেখি যেমন বন্ধ ছিল, তেমন বন্ধই থাকত। তুমি এলে, তোমার উপস্থিতিতে আমার আমিকে আমি নতুন করে যেন আবিষ্কার করলাম। তুমি আমাকে দেখতে না এলে আমার অতীতের দিকে আমি তাকাতাম না, বই লেখার কথা আমার ভাবনার মধ্যে আসতো না। তুমি যখন এসেছিলে, তুমি তোমার আঁচলে করে শিউলি ফুলের মতো আমার শৈশব কৈশোর নিয়ে এসেছিলে। তোমার গা থেকে শিউলির সেই ঘ্রাণই ভেসে আসতো। এখনও চোখ বুজে তোমাকে ভাবলে সেই ঘ্রাণ পাই আমি। বড় চেনা ঘ্রাণ। বড় হারিয়ে যাওয়া, আবার না যাওয়াও।
আমার মেয়েবেলা বইটা বাবাকে উৎসর্গ করেছিলাম, তোমার সম্পর্কে কম কুকথা ছিল ও বইটায়! তখনও তো তুমি ছিলে, বেঁচে ছিলে। দ্বিতীয় আর তৃতীয় খণ্ড উতল হাওয়া আর দ্বিখণ্ডিত বইদুটোতে তোমার দিকে অন্য চোখে তাকালাম। সত্যি বলতে কী, তাকালাম তোমার দিকে। এতকাল তো তাকাইনি। তোমাকে নিয়ে হাসি ঠাট্টা করেছি, মজা করেছি। তাকাইনি। আমার মেয়েবেলা যখন বাংলায় বের হলো, অনুতাপ আমাকে এমনই কাঁদাচ্ছিলো যে তোমাকেই বইটা উৎসর্গ করলাম। বইয়ের ফরাসি সংস্করণটি কিন্তু বাবাকে উৎসর্গ করা। কী নামে ডাকবে তুমি এই অস্থিরতাকে? আচমকা যেন আমার চেতনার কবাট খুলে গেছে। আচমকা যেন আমি নিজেকে আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে প্রথম নিজের আসল চেহারাটি দেখছি। নিজের ওপর কি কম ঘেন্না আমার হয়েছে! কিছুতেই নিজের গ্লানিকে একবিন্দুআমি মুছতে পারি না। আমার ভেঙে যাওয়া, সব ছেড়ে ছুঁড়ে আমার সন্ন্যাস বরণ দেখে বন্ধুরা বলেছিলো, গ্লানি থেকে মুক্ত হও, গ্লানি মানুষকে ধ্বংস করে ফেলে। ফেলুক, তাই তো চাইছিলাম। আমি তখন মরে গেলেও আমার কিছু যেতো আসতো না।
.
কলকাতা থেকে ভিসা ফুরোলে চলে যেতে হল প্যারিসে। প্যারিসে আমার কাজ কী বলো। শুধু বসে থাকাই তো। এইপ্যারিসেই আমাকেরানির মতো রেখেছিলো, আমার গাড়ির সামনে পেছনে প্যাঁপু বাজিয়ে গাড়ি যেতো। প্যারিসের অর্ধেক রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হত আমি রাস্তায় চলবো বলে। আর সেই একই আমিপ্যারিসের রাস্তায় হেঁটে বেড়াই, যে কোনও মানুষের মতো, বাদামি রঙের মেয়ে, এশিয়ার, ভারতীয় উপমহাদেশের, গরিব দেশের বাদামি মেয়ে, কেউ ফিরে তাকায় না। অথচ এই আমাকে দেখার জন্য এই শহরেই একসময় মানুষ উপচে পড়তো, বইয়ে সই নেওয়ার জন্য ভিড় বাড়তো। নিরাপত্তা পুলিশের বাধায় কত কত মানুষ আমাকে এক পলক। দেখারও সুযোগ পায়নি। যখন মনে পড়ে ওসব কথা, মা, হাসি পায়। ওই উত্থানটা সত্যি ছিল, না এই পতনটা সত্যি! আমার এসবকে উত্থান বা পতন বলে মনে হয় না। যেখানে ছিলাম আমি, সেখানেই আছি। আমি খুব সাধারণ মানুষ, তোমার মতোই সাধারণ, নিরীহ। মাঝে মাঝে আমাকে অসাধারণ বলে প্রদর্শন করা হয়, আমার জীবনের এই সংগ্রামের জন্য, আমার লেখার কারণে, আমার আদর্শের কারণে। যে মানুষটি আমি রাস্তায় একা হাঁটি, বাসে বা মেট্রোয় চড়ি, বা ট্যাক্সিতে, তাকে মানুষ চেনে না বলে ঘিরে ধরে না। যদি জানতো আমি কে, ছুটে আসতো। এই যে দেখলে চেনে না, তা আমার জন্য একরকম ভালো। আমি নিজের মতো করে জীবন যাপন করতে পারি। ওই অসাধারণ জীবন, ওই খ্যাতি আমাকে অস্বস্তি দেয়। ভীষণ চাপ ওই জীবনে। দেবীর ভূমিকায় বেশিক্ষণ তিষ্ঠোনো যায় না। ওই জীবনটা ক্ষণস্থায়ী, এই জীবনটাই আসল। প্যারিসে আমি একটা ভীষণ ভুল করি। ক্রিশ্চান বেস আমাকে ভালোবাসছেন, বলেছেন তিনি আমার মায়ের মতো। অমনি আমি তোমার গলার হারটি দিয়ে দিই ওকে। মা, মা কি সবাই হতে পারে, নাকি হয়? যেই না আদর দেখায়, খুব, আমার পা ভেঙেছে বলে আমার অ্যাপার্টমেন্টে এসে ঘর দোর পরিষ্কার করতে শুরু করে, তখনই খুব আপন ভাবতে শুরু করেছিলাম। কত মানুষকে যে আমি আপন ভাবি। পরে অবশ্য বোধোদয় হয়। তবে আমার বোধোদয় হতে সবসময়ই খুব দেরি হয়।
প্যারিস শহরে থাকতে থাকতেই আমি বুঝতে পারি, বেশির ভাগ মানুষ যাদের আমি বন্ধু বলছি, তারা আসলে আমার বন্ধু নয়। খুব সহজে কয়েকদিনের পরিচয়ের পর আমরা স্বচ্ছন্দে সবাইকে বন্ধু বলে ডাকি। আমার খ্যাতি, অর্থ আর উদারতা–এ তিনটেকে ভাঙিয়ে তাদের নিজেদের সুবিধে স্বার্থের জন্য যা কিছু পারে, দুহাত ভরে নেবে। এ ছাড়া আর কোনও উদ্দেশ্য নেই। মানুষের কৃত্রিমতাকে, বেশ কয়েক বছর, ধরে নাও, যে, আমি বুঝবো না। যে যত বড় অভিনেতা হবে, কৃত্রিমতা দিয়েই বছর পার করবে। অভিনয়ে কাঁচা হলে হয়তো কয়েক মাসেই ধরতেপারবো। মুলাঁ দন্দের মিরিয়াম অভিনয়ে খুব পাকা ছিল। যেই না দেখলো, আমাকে সে ভালোবাসছে আর আমি তার ভালোবাসায় সাড়া দিচ্ছি না, প্রতিশোধ নিল। কানাডার সেই লেখক পিয়ের লরুর সঙ্গে মুলাঁ দন্দে ছেড়ে চলে আসার পরও আমার যোগাযোগ আছে, এমিরিয়ামের সহ্য হয়নি। একদিন পিয়েরকে আমি নিয়ে গিয়েছিলাম রেস্তোরাঁয়। পিয়ের আমার কাছে দুহাজার ফ্রাঁ ধার চেয়েছে, এসব আমি নিজেই মিরিয়ামকে জানিয়েছিলাম। শুনে সে সোজা ক্রিশ্চান বেসের শরণাপন্ন হল, পিয়ের ভালো লোক নয়, পিয়ের আমাকে বোকা পেয়ে ধোঁকা দিচ্ছে। ক্রিশ্চান বেস মনে করেন আমি কোনও অঘটন ঘটিয়ে ফেলবো, বুদ্ধিমান কিছু লোকের সাহায্য ছাড়া আমি চলতে পারবো না। তিনি হামলে পড়লেন, না এসব চলবে না। কিছুতেই পিয়েরকে টাকা ধার দেবে না, ওর সঙ্গে আজই এখনই সম্পর্ক ছেদ করো। ওকে তোমার ধারে কাছে আসতে দেবে না। ঠিকমিরিয়াম যা চেয়েছিল, যেভাবে, ঠিক সেভাবেই সে ঘটনাটা ঘটালো। ক্রিশ্চানের অনুমতি নিয়ে পিয়েরকে সে আমার হয়ে গুডবাই জানিয়ে দিল। তখন পিয়ের আর আমি দুজনের কেউইমুলাঁ দন্দে নেই, দুজনইপ্যারিসে। পিয়েরের টাকার অভাব ছিল, চাইতেই পারে সে টাকা, আমি দিতেই পারি তাকে। মিরিয়ামের কেন এত জ্বালা। আমাকে সে খুব ভালোবাসে? আমার টাকা পয়সা সে খুব বাঁচাতে চায়? আসলে ওসব কাণ্ড করার মূল উদ্দেশ্য পিয়ের নামের হবু প্রেমিককে আমার ত্রিসীমানা থেকে বিদেয় করা। আমার ভাঙা পা দেখতে পিযের আসতো মাঝে মাঝে। দাবা নিয়ে আসতো, খেলতো আমার সঙ্গে। ক্রাচ নিয়ে এসেছিলো। প্যারিসের একলা ঘরে শুয়ে থাকা আমাকে সে সঙ্গ দিত। একদিন ওয়াইন নিয়ে এলো। ফ্রান্সের ক্লোদ লোলুর মতো চিত্রপরিচালক পিয়েরের গল্প নিয়ে ছবি করেছে। আমরা দুজনে সিনেমার গল্প লেখার পরিকল্পনা করি। খেতে খেতে গল্প। অমন আশ্চর্য সুন্দরের দিকে তাকিয়ে আমার মন জুড়োত। সেই পিয়েরকে কায়দা করে মিরিয়াম তাড়ালো। কারণ মিরিয়াম আমাকে চায়। আমি অবাক হয়ে দেখেছি এরা ভালোবাসতে যেমন পারে, প্রতিশোধ নিতেও পারে। ভালোবাসা এদের উদার করে না, হিংস্র করে তোলে। পিয়েরের সঙ্গে যখন মুলাঁ দন্দে থেকে যে রাতে চাঁদের আলোয় হাঁটতে গিয়েছিলাম, মিরিয়াম সারারাত কেঁদেছে আর মদ খেয়েছে। তার সহ্য হয়নি পিয়েরের প্রতি আমার আকর্ষণ। সে রাতেই চুরি হয়ে যায় আমার ঘরে রাখা কয়েক হাজার ডলার। আমার ঘরের একটা চাবি মিরিয়ামের কাছে থাকতো। মিরিয়াম ওই বিশাল মুলাঁ দন্দের পরিচালনার দায়িত্বে ছিল বলে অবাধ অধিকার ছিল সব কিছুতে। কে নিয়েছের প্রশ্ন উঠলে মিরিয়াম বলে হয়তো ঘর পরিষ্কার করতে আসা মেয়েরা। ওই মেয়েরা তিন মাসে কোনওদিন আমার ওই বাক্সে হাত দেয়নি, যে বাক্সে ডলার আর তোমার সোনার গয়নাগুলো ছিলো। মিরিয়ামকে আমার –কখনও সন্দেহ হয়নি। কিন্তু পরে একটি ঘটনা ঘটায় আমি বুঝি কে আসলে ছোটলোকি ওই প্রতিশোধটা নিয়েছে। মিরিয়ামের ঈর্ষা যেমন ভয়ংকর, প্রেমও ভয়ংকর। ব্রাজিলের সাও পাওলো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হল বক্তৃতা দিতে। আমি রাজি হয়েছিলাম যেতে। ওরা টিকিটও পাঠিয়ে দিয়েছিল। মিরিয়াম বললো, সেও যাবে আমার সঙ্গে। মুলাঁ দন্দের কাজ ফেলে সে নিজের টিকিট করে ফেললো। তারপরআমারপামচকালো, আমি শুয়ে আছি। ব্রাজিলকে জানিয়ে দিলাম, যেতে পারছি না। মিরিয়াম একাই চলে গেল ব্রাজিল। একাই সে হোটেলে বসে বসে আমার কথা ভাবলো আর কাঁদলো। ফিরেই সে সোজা আমার কাছে। আমার সেবা করবে, আমাকে ভালোবাসবে। মুলায় তার মন বসে না। ওখানে গেলেও সে প্রতিরাতে চলে আসে প্যারিসে আমার বাড়িতে, ভোরে ঘুম থেকে উঠে চলে যায়। মুলাঁ থেকে গাড়ি চালিয়ে প্যারিস আসতে তিন ঘণ্টা সময় নেয়। এতার কাছে কিছুই নয়। আমার জন্য যত তার আবেগ, আমার তার জন্য কিছুই নেই। মাঝে মাঝে আমার নির্লিপ্তি দেখে সে ফুঁসে ওঠে। চেঁচায়। কাঁদে। আমার কী করার আছে বলো। মিরিয়ামের শরীরের প্রতি, সে শরীর যতই সুন্দর হোক, আমার কোনও আকর্ষণ জন্মায় না। আমার প্রেম পেতে মিরিয়াম মরিয়া হয়ে ওঠে। নিজেকে সে সমকামী বলে না। এর আগে যাদের সঙ্গে সে প্রেম করেছে, সকলেই পুরুষ ছিল। এই প্রথম সে নাকি এক মেয়ের প্রেমে পড়লো। হয়তো তাই। কিন্তু ও একা প্রেমে পড়লে তো হবেনা, আমাকেও পড়তে হবে। এক গভীর রাতে মুলাঁ দন্দের ঘরে আমার বিছানায় আচমকা এসে আমার শরীরের প্রতিটি রোমকূপে উষ্ণ নিঃশ্বাস ফেলছিলো। সেনা হয় অন্যরকম এক রাত দিয়েছিল আমাকে। কিন্তু প্রতি রাতে তার দাবি করলে চলবে কেন! আমার শরীর বা হৃদয় কোনওটাই আমি তাকে দিতে পারি না। বন্ধুত্বই শুধু পারি দিতে, কিন্তু শুধু বন্ধুত্বে তার চলে না। দিন দিন উন্মাদ হয়ে ওঠে মিরিয়াম। আমি তখন ঘর সাজাচ্ছি প্যারিসে, সে চলে আসতো নিজের কাজ ফেলে। আমাকে নিয়ে গাড়ি করে সেই ইকিয়ায় যাওয়া, আমার খাট চাই, সোফা চাই, বইয়ের আলমারি চাই, টেবিল চাই, চেয়ার চাই, খাবার টেবিল চাই, চেস্ট অব ড্রয়ার চাই, থালা বাসন চাই। আমি যে মিরিয়ামকে ডাকিতানয়। নিজেই সে গাড়ি করে আমাকে দোকানে নিয়ে যায়। নিজেই আসবাব পত্র টেনে ঘরে ওঠায়, জোড়া লাগিয়ে দেয়। এত সব তার করার কথা নয়, কিন্তু করে। মুলার কাজ ফাঁকি দিয়ে সে করে এসব। ঘরে জায়গা হয় না বলে, তার ওপর এত বিদেশ ভ্রমণ করতে হয় আমার, ঘরে দামি জিনিসপত্তর রাখা নিরাপদ নয় বলে লাল সুটকেসে সব ভরে মিরিয়াম নিজেই বলে সুটকেসটা তার বাড়িতেই রেখে দেবে সে। নিয়েও যায়। এই মিরিয়ামকে একদিন আমার দূরে সরাতে হল, তাকে বলে দিলাম আমার পক্ষে সম্ভব নয় তার সঙ্গে প্রেম করা, বা শরীর মেলানো। বহুঁকাল অভুক্ত থাকলে মেয়েদের স্পর্শে হয়ত জেগে উঠতে পারি। তার মানে এই নয় যে আমি সমকামী। মিরিয়াম ক্ষুব্ধ হতে লাগলো। আমার জন্য তার ক্রন্দন সীমা ছাড়াতে লাগলো। বিদেয় তাকে শেষপর্যন্ত হতেইহল। ফরাসি প্রেমিকের সঙ্গে প্রথম রাত কাটানোর দিন মিরিয়াম এসেছিলো আমার কাছে। তাকে আমি ঘরে ঢুকতে দিইনি। অনেকক্ষণ দরজায় বেল বাজিয়ে সেচলে যায়। চলে সেসম্পূর্ণ যায়নি। সারারাত সে রাস্তায় তার গাড়িতে বসেছিলো। এমনভাবে বসেছিলো, যেন গাড়ির জানালা দিয়ে সে ঘরের জানালা দেখতেপায়। আর বারবারই আমাকে ফোন করে অভিযোগ করছিল, চিৎকার করছিল, কাঁদছিলো। আমি বারবারই তাকে চলে যেতে বলি। বলি যে আমার এক বন্ধুর সঙ্গে সময় কাটাচ্ছি আমি, আজ তার সঙ্গে দেখা করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আসলে আমি চাইনি যে সুদর্শন যুবকের সঙ্গে আমার আশ্চর্য সুন্দর একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, তাকেও মিরিয়াম তাড়াক, যেভাবে পিয়েরকে তাড়িয়েছিল। এরপর কয়েক মাস গেলে, একদিন সুটকেসে রাখা কোনও জিনিস খুঁজতে গিয়ে পাতিপাতি করে খুঁজে
পাওয়ার পর মনে পড়লো, লাল সুটকেসে ছিল ও জিনিস, আর সেই সুটকেস মিরিয়ামের বাড়িতে। ওকে ফোন করলাম, আমার সুটকেসটা চাই। মিরিয়াম বললো, কিসের সুটকেস? সেই যে আমার লাল সুটকেস, ঘরে জায়গা নেই বলে বা ঘর নিরাপদ নয় বলে যেটি তুমি নিয়ে গিয়েছিলে! মিরিয়াম বললে কোনও সুটকেস টুককেস তার কাছে নেই। সে কিছুই নেয়নি। আমি ভাবলাম, বোধহয় একটু মজা করছে আমার সঙ্গে। কিন্তু আবার বলাতে সে আবারও সাফ বলে দিল, কোনও সুটকেসই সে নেয়নি। তার কাছে আমার কিছু নেই। ফোন রেখে দিল। এভাবেই প্রতিশোধ সে নিল তার সঙ্গে প্রেম না করার। বড়লোক মানুষ এরা, অথচ দেখ কত নিচে নামতে পারে। ওর ভালোবাসা কি ভালোবাসা ছিল মা? আমি তো কাউকে একবার ভালোবাসলে, সেই ভালোবাসা উবে গেলেও এত নিষ্ঠুর হতে পারতাম না। আর ভালোবাসার দরকার কী, কোনও ঘোরশত্রুর সঙ্গেও কি এই অন্যায় করতে পারবো আমি! অসম্ভব। প্রতিশোধ নিতে গিয়ে লরোঁকে দেখেছি সে কী করেছে। লরোঁ বলতো আমাকে সে ভীষণ ভালবাসে। আমার বিশ্বাস হত না। কলকাতা থেকে ফিরে লরোঁকে বিদেয় করে দিই, কিন্তু তারপরও ঠিক বিদেয় করা হয় না। রাতদিন ফোন করে হু হু করে কাঁদতো, আমাকে ছাড়া নাকি বাঁচবেনা। ছুটি পেলেই ছুটে আসতো আমার কাছে। একবার তো আমাকে ওর বাবা মার বাড়ি আর বোনের বাড়িতে নিয়ে গেল। ওদের সঙ্গে আমাকে ওর প্রেমিকা হিসেবেই পরিচয় করালো। আমাকে ওরা নামে চিনতো, পেয়ে মহা খুশি। ওর বাবা মা আমাকে আর লরোঁকে এক ঘরে ঘুমোতে দিল রাতে। বাবামার বাড়িতে প্রেমিকা নিয়ে যাওয়া পশ্চিমের দেশগুলোতে খুব বড় ব্যাপার। সম্পর্ক অতীব গুরুত্বপূর্ণ না হলে এঘটনা ঘটে না। নিজের বউকে প্রথম দিনই আমাদের সম্পর্কের কথা জানিয়ে দিয়েছিলো। প্রয়োজনে ফোন করে লরোঁকেনা পেলে আমার বাড়িতেই ফোন করতে লরোঁর বউ। লরোঁ বউ বাচ্চা ছেড়ে আমার সঙ্গে বাকি জীবন থাকার স্বপ্ন দেখছিলো। বার বার আমাকে বলেছে আমি যেন প্যারিস ছেড়ে তুলুজ চলে গিয়ে ওর সঙ্গে জীবন যাপন শুরু করি। শহরে আলাদা একটা অ্যাপার্টমেন্টও সে ভাড়া নিয়ে নিয়েছে। কিন্তু কখনও মন সায় দেয়নি আমার। ওর বাড়িতে গিয়ে ওর সঙ্গে বাস করার ইচ্ছে আমার হয়নি। খুব যেতে বলায় একবার দিন পাঁচেকের জন্য বেড়াতে গিয়েছিলাম। লরোঁকে আমি ভালোবাসতাম কিনা জানি না, তবে ওর সুন্দর শরীরটার দিকে তাকালে তাকিয়েই থাকতে ইচ্ছে করতো। কলকাতার হোটেলে প্রথম ওকে আমি জীবন থেকে বিদেয় করার কথা ভাবি। দ্বিতীয়বার ভাবি লন্ডনের কমপিউটারের দোকানে। আমি একটা ল্যাপটপ দেখছি কেনার জন্য। আমি যেটাপছন্দকরছি, সেটা সে কিছুতেই আমাকে নিতে দেবে না। বলে, এত দাম দিয়ে এটা কিনো না। তোমাকে ঠকাচ্ছে এরা। কম দামে কমপিউটার কিনে সব হার্ডওয়্যার সফটওয়্যার লাগিয়ে নেবে। আমি বললাম, এটাই আমি কিনবো, এটাই আমারপছন্দ হয়েছে। শুনে সেফুসতে শুরু করলো। উপদেশনা শুনলে পুরুষদের আবারভীষণ রাগ হয়। রাগেফুসতে থাকে বুনো মোষের মতো, আর বলতেই থাকেআমি বোকার মতো কাজ করেছি। আমি ঠাণ্ডা গলায় বললাম, হ্যাঁ করেছি, আমারইচ্ছেহয়েছে করেছি। ডিনারেও যখন দেখলাম, তার আদেশ বা উপদেশ না মানার কারণে তার ফুঁসে থাকা বহাল রয়েছে, আমি শান্ত কণ্ঠে বললাম, এই সম্পর্কটা অনেক আগেই শেষ হয়ে যাওয়ার কথা ছিল, মনে হয় শেষ হয়ে যাওয়াই উচিত। রাতে হোটেলে ফিরে এলে লরোঁ বারবার জিজ্ঞেস করতে লাগলো, তুমি কি সত্যিই শেষ করে দেবে সম্পর্ক? সত্যিই আমাকে ছেড়ে চলে যাবে? বলি, হ্যাঁ। অমনি সে নমি কি ত্য পা, নমি কি ত্য পা বলে কাঁদতে লাগলো, এরপর দেয়ালে মাথা ঠুকতে লাগলো। মাথা ফেটে রক্ত বেরোবে এবার ছেলের। দেয়াল থেকে আমি টেনে আনলাম লরোঁকে। সে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলতে লাগলো, নমি কি ত্য পা, ছেড়োনা আমায়। এরপর আমাকে আদর করলো বেঘোরে। শরীর চায় ওকে, শরীরই বলে। কিন্তু মন চায় না। পরদিন লণ্ডন থেকেপ্যারিসে ফেরার পথে ইংলিশ চ্যানেল পার হয়ে ওর বোনের বাড়িতে আমরা রাত কাটাই। রাতেও একই প্রশ্ন, তুমি কি সত্যিই ছেড়ে যাবে আমাকে? বললাম, হ্যাঁ যাবো। যতবার প্রশ্ন করে, একই উত্তর পায়। একসময় লরোঁর ভেতরের বুনো মোষটি ধারালো শিং বাগিয়ে তাড়া করে আমাকে। আমাকে সে বেরিয়ে যেতে বলে বাড়ি থেকে। আমি যত বলি, সকালে বেরোবো, এখন নয়। সে বলে, এক্ষুনি। কাপড়ের ব্যাগটা নিয়ে সে আমাকে বাড়ির বাইরে বের করে দিয়ে আসে। রাত তখন দেড়টা বোধহয়। রাস্তার মাতাল বদমাশ একলা মেয়েকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কী করবে লরোঁ একবারও ভাবেনা। না, ও সময় কোথায় ট্রেন, কোথায় বাস, কোথায় ট্যাক্সি জানি না। প্যারিস অনেক দূর, কোনও পথেই প্যারিসে যাওয়ার উপায় নেই। শেষে বেল টিপলাম বাড়ির। অন্তত লরোঁর বোন এভলিন ঘুম থেকে উঠে তার দাদার কাণ্ড দেখুক। কিন্তু বেল বাজার সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে দেয় লরোঁ। আমি বলি, আমাকে রাতটা এখানে থাকতেই হবে। সকালে বেরিয়ে যাবো। রাত কাটিয়ে সকালে একা বেরোতে নিলে লরো সঙ্গে যায়। পথে পাগলকে আমি আর ছেড়ে যাওয়ার কথা কিছু বলি না। শুধু স্তব্ধতার মধ্যে কাটে আমার দীর্ঘ সময়। আমার প্যারিসের অ্যাপার্টমেন্টে সেও ঢোকে। অপেক্ষা করি তার চলে যাওয়ার। লরোঁ বলে, আমাকে বিদেয় করার জন্য অস্থির হচ্ছো তাইনা! মনেমনে বলি, হচ্ছি। লরোঁ অস্থির পায়চারি করতে থাকে ঘরে, আর আমি ভয় পেতে থাকি। ভালোয় ভালোয় আপদ বিদেয় হলে বাঁচি। আবার যেন কোনও অঘটন না ঘটায়। তার সমস্ত রাগ গিয়ে আবার দেয়ালে পড়ে। প্রচণ্ড এক ঘুষি মেরে দেয়াল দাবিয়ে দেয়। আমি চোখ বুজে শুয়ে থাকি। একসময় বাথরুম থেকে অদ্ভুত শব্দ এলে গিয়ে দেখি লরোঁ বাথটাবের জলে শুয়ে আছে, হাতে তার ছুরি। সে হাতের শিরা কাটছে। আমি তড়িঘড়ি হাতে ব্যাণ্ডেজ করে লরোঁকে টেনে তুলে আনি জল থেকে। বিদেয় শেষ পর্যন্ত তাকে হতেই হবে। তাকে তুলুজ ফিরতে হবে। লরোঁ বেরিয়ে যাওয়ার পর দরজা বন্ধ করি। কী যে আমার স্বস্তি হয় মা, তোমাকে বোঝাতে পারবো না। মনে হয় দীর্ঘ সময় আমি এক বদ্ধ পাগলের সঙ্গে এক খাঁচায় বন্দি হয়ে ছিলাম। সবেমুক্তি পেলাম। মুক্তির আনন্দ অসীম। এরপর লরোঁ অনেক ফোন, ইমেইল, ইত্যাদিতে অনেক চেষ্টা করেছে যোগাযোগ করতে, আমি সাড়া দিইনি। যখন বুঝেছে কোনও আর উপায় নেই আমাকে পাওয়ার, তখনই সে চিঠি লিখতে শুরু করে। দেশে বিদেশে আমার যত বন্ধু আছে, যাদের সঙ্গে তার দেখা হয়েছে, অথবা হয়নি, ক্রিশ্চান বেস থেকে শুরু করে কলকাতার ছোটখাটো সাংবাদিক সবাইকেই। তার মূল উদ্দেশ্য, আমাকে ধ্বংস করা। ধ্বংস করতে গেলে আমার যারা চেনাপরিচিত বন্ধু, যারা আমাকে ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে, স্নেহ করে, তাদের মনে আমার সম্পর্কে বিরূপ ধারণা দিতে হবে, আমার সম্পর্কে মন্দ কথা বলতে হবে, যেন বন্ধুরা আমাকে ত্যাগ করে। লরোঁর স্বপ্ন সার্থক হয়নি। কেউ আমাকে ত্যাগ করেনি। চিঠির খবরটা আমার বন্ধুরাই আমাকে দিয়েছে। আমি জানি, মিরিয়ামের চেয়েও লরো অনেক বেশি ভয়ংকর। প্রতিশোধপ্রবণতা, কুৎসিত ঈর্ষা, হিংসে, মানুষকে আর মানুষ রাখে না।
প্রেম ও যৌনতা আমাকে প্রভূত আনন্দ দিতে পারে, কিন্তু নিজের স্বাধীনতায় কেউ নাক গলাতে এলে যত বড় প্রেমিক হোক, যত নিখুঁত যৌনসঙ্গী হোক, আমার কোনও দ্বিধা হয় না তাকে গেট আউট বলতে। এই সম্পর্কটি শেষ হবার পর আবার তুমি, জীবন জুড়ে তোমার না থাকা। যৌনতা তোমাকে ভুলিয়ে রাখে। যৌনতার ছুটি হয়ে গেলে তোমার মৃত্যু আমাকে হতাশার অতলে টেনে নিয়ে যায়। যেখানে শুধু নেই, নেই আর নেই। আমি কাতরাতে থাকি তোমার শোকে। এদিকে আরশোলায় বাড়ি ভরে ওঠে। অবাধে আমার গায়ে রাতে হাঁটাহাঁটি করে। আমার শরীরও তাদের উৎসবের চমৎকার ঘরবাড়ি হয়ে ওঠে। পরিবারের সবার প্রতি আমার অভিমানে নিজেকে সবার কাছ থেকে সরিয়ে এনে অদ্ভুত এক আঁধারে ডুবে যেতে থাকি। কারও সাধ্য নেই আমাকে সেই আঁধার থেকে তোলে। অদৃশ্য মাটি এসে জীবন্ত আমাকে কবর দিয়ে যায়।
.
মৃত্যুময় নিস্তব্ধতার মধ্যে ভাসতে থাকি। খা খা করে বুকের ভেতর, বড় খালি খালি লাগে। কবিতা লিখতে থাকি। অদ্ভুত এক ঘোরের মধ্যে কবিতাগুলো লিখি! বাড়ি এলোমেলো পড়ে থাকে। ওর মধ্যেই আমি শুয়ে থাকি। ওর মধ্যেই আমার সারাদিন, ওর মধ্যেই সারারাত। কারও কোনও ফোন ধরি না। কারও সঙ্গে কথা বলি না। জগৎ একদিকে, আর তোমার না থাকা নিয়ে আমি অন্যদিকে। রান্না করি না। বাইরে থেকে তৈরি খাবার কিনে কমপিউটারে লিখতে লিখতেই খাই, এঁটো বাসনপত্র টেবিলে বিছানায়, মেঝেয়, রান্নাঘরে এলোমেলো পড়ে থাকে। কাগজের ঠোঙায় ঘর ভরে যায়। আরশোলারা অবাধে আনন্দ করে। তুমি কিভাবতেপারো তোমাকে নিয়ে কবিতা লিখেছি আমি। যেখানেই থাকো, কবিতাগুলো পড়োমা। তোমার নিশ্চয়ই বিশ্বাস হচ্ছে না মা। কবে যেন হঠাৎ রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে দেখি এক মহিলা সামনে হাঁটছেন, ঠিক তুমি যেমন করে হাঁটতে, মুখের ডানদিকটা সামান্য এক ঝলক যেটুকু দেখা গেছে, মনে হল, ঠিক তোমার মুখের ডানদিকটার মতো। আমি জানি না কী কারণে দ্রুত হাঁটতে শুরু করলাম, যেন মহিলার কাছাকাছি পৌঁছোতে পারি। দ্রুত, প্রায় দৌড়ে, মহিলার সামনে গিয়ে মুখটা দেখতে চাইছিলাম। একসময় গতি শ্লথ হয়ে এলো আমার। হঠাৎ লক্ষ করি, চোখ উপচে জল বেরোচ্ছে আমার। হাতের তেলোয় সেই জল মুছে মুছে হেঁটেছি, তারপর যতটাই হেঁটেছি।
তোমাকে মনে করে আগে লিখিনি কোনওদিন কিছু। তোমাকে ভালোই তো বাসিনি কোনওদিন। তুমি না চলে গেলে তুমি কী ছিলে, কী যন্ত্রণা তুমি জীবনভর পেয়ে গেছে, তা আমি হয়তো টের পেতাম না। ওভাবেই তোমাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে যেতাম। যেভাবে করছিলাম। তুমি কে ছিলে, মানুষ হিসেবে কত বড় ছিলে, হঠাৎ যেন টের পেলাম, হৃদয়ে, মস্তিষ্কে, টের পেলাম হাড়ে মজ্জায়। বোধাদয় হলো আমার। চোখের সামনে থেকে সরে গেছে ভারি একটা কালো পর্দা। এসব কবিতা নিয়ে জলপদ্য নামের যে বইটা বেরিয়েছিল, ওর ভূমিকায় লিখেছি, মা বলেছিলো বছরের প্রথম দিনে কাঁদিস না, কাঁদলে সারা বছর কাঁদতে হবে। মা নেই, সারা বছর আমি কাঁদলেই কার কী? মা, তোমার কেমন লাগছে জেনে যে তোমার জন্য দিনের পর দিন কেঁদেছি আমি! বিশ্বাস হচ্ছে না? মা, সত্যি অনেক কেঁদেছি। জীবন কেমন বীভৎস রকম শূন্য হয়ে গেলো হঠাৎ। তুমি ছিলে, মনে হতো চিরকালই তুমি থাকবে। তুমি তো কবিতা ভালোবাসতে খুব। এগুলোকে ঠিক কবিতা বলবো না। তোমার না থাকার দীর্ঘশ্বাস এসব, না থাকার হাহাকার।