০৬. কাকারা এলো একদিন

কাকারা এলো একদিন। গ্রাম থেকে আরও কয়েকজন এসেছিলো তোমাকে দেখতে। তোমার চেয়ে বয়সে বড়রা দিব্যি সুস্থ বেঁচে আছে। অতিথিদের বসার জন্য যে চেয়ার রেখেছিলাম তোমার সামনে, সেখানে বসে রিয়াজউদ্দিন কাকা বললো, ভাবী, মাফ সাফ করে দিয়েন। শুনে আমার কী যে রাগ হল। তোমাকে বুঝিয়ে দিতে চাইছে যে তুমি মারা যাচ্ছে। তাই মাফ চাইতে এসেছে। সারাজীবন তুমি এদের মাটির চুলোয় কুঁকনি ফুকে, গায়ে কাপড়ে কালি ঝুলি লেগেছে খেয়াল করোনি, রান্না করে খাইয়েছে। বিনিময়ে কারও কাছ থেকে কোনওদিন কিছু পাওনি। রিয়াজউদ্দিন কাকা যাওয়ার সময় তার শুকনো চোখদুটো অযথাই ডলতে শুরু করলো, আর একটা দীর্ঘশ্বাসও ফেললে আমাকে দেখিয়ে, দীর্ঘশ্বাসটা নকল, বুঝি। তোমাকে যেন কেউ বুঝতে না দেয় যে

তুমি মারা যাচ্ছো, আমি সতর্ক করে দিতাম সবাইকেই যারাই তোমাকে দেখতে আসতো। কিন্তু কে শোনে কার কথা! আমাকে নিতান্তই অবুঝ একটা মেয়েমানুষ বলে ভাবে। যে মেয়েমানুষ মত্যুর আগে আগে কী করতে হয় জানে না। জানে না, মত্যুপথযাত্রীর কাছে নিজেরা যত অপকর্ম এ যাবৎকরেছে, সব কিছুর জন্য মাফ সাফ চেয়ে সাফসুফ হয়ে থাকতে হয়। এখন তুমি ওপরে যাচ্ছো, ওপরে তুমি আল্লাহর কাছে তাদের বেহেসতের জন্য তদবির করবে, তাদের সালাম পৌঁছে দেবে পয়গম্বরকে! স্বজনপ্রীতিটা ভালো চলে পরকালে, তাই তোমার কাছে ধর্না দেওয়া। আমি অবুঝ মেয়েমানুষ, আমি চাই না তুমি একটুও টের পাও যে তোমার দিন ফুরোচ্ছে।

একদিন আমানুদ্দৌলার বউ এসেছিলো ছেলেমেয়ে নিয়ে। আমাণুদ্দৌলার বউএর নজর আমার দিকে। তুমি কেমন আছো, কেমন বোধ করছো, এ নিয়ে তার কোনও উৎসাহ নেই। ইনিয়ে বিনিয়ে বলতে শুরু করলো তার সংসারের নানা সমস্যার কথা। তার মেয়ে জুয়েল কলেজ পাশ করেছে, এখন ওর জন্য একটা চাকরির ব্যবস্থা আমার না করে দিলেই নয়। আমাণুদ্দৌলার বউ ক্রমাগত বলেই চললো এক কথা। আমি তাকে আমি কী করে চাকরির ব্যবস্থা করবো, আমার তো এই ক্ষমতা নেই’ বলার পরও সে থামলো না। ‘ঠিক আছে চেষ্টা করবো’ বলেও থামাতে পারি না তাকে। তুমি তখন বউএর দিকে তাকিয়ে বললে, ‘এত চাই চাই কেন তোমাদের! একটু মানবিক হও, একটু নিঃস্বার্থ হও।‘ না, মা। তোমার এই উপদেশের মর্মার্থ বোঝা তার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি খসরুকে চিঠি লিখে দিয়েছিলাম জুয়েলকে একটা চাকরি দেওয়ার জন্য। খসরু তাকে চাকরি দিয়েছে। জুয়েল ঢাকা শহরে বহাল তবিয়তে আছে। নিঃস্বার্থ ওরা কেউ হয়নি মা। চাকরি পাওয়ার পর আমাকে ওরা খবরটাও দেয়নি যে চাকরি পেয়েছে। বছর কয়েক পর দাদা কথায় কথায় বলেছিলো যে জুয়েল খসরুর বিশাল অফিসে বেশ ভালো মাইনের চাকরি করছে।

একদিন আমাণুদ্দৌলা এলো। তোমাকে আগে জিজ্ঞেস করে নিলাম, তুমি ওর সঙ্গে দেখা করতে চাও কিনা। কাছের আত্মীয় ছাড়া অন্য কেউ এলে জিজ্ঞেস করে নিই তোমাকে। আমাণুদ্দৌলার সঙ্গে আদৌ দেখা করতে না চাইলে তাকে দেখা করতে দেব না, সে যত বড় প্রেমিকই হোক না কেন। তুমি মাথা নেড়ে বললে, হ্যাঁ। আমাণুদ্দৌলাকে ঘরে ঢুকিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। খুব বেশিক্ষণ সে থাকেনি তোমার ঘরে। আমি চেয়েছিলাম আরও কিছুক্ষণ থাকুক, আরও কিছুক্ষণ তোমার হাত ধরে সে বসে থাকুক, আরও কিছুক্ষণ সে দীর্ঘশ্বাস ফেলুক, আরও কিছুক্ষণ সে, যদি ভালোবাসে, বলুক ভালোবাসে।

.

তুমি যেহেতু এক ফোঁটা জলও আর খেতে পারছিলে না, তোমার নাকে নল ঢোকালাম তরল খাদ্য খাওয়ানোর জন্য। তোমার অসহ্য লাগতো ওই নাকের নল। কিন্তু তোমাকে আদর করে পেটে কিছুনাপড়লে তুমি যে শরীরে শক্তি পাবে না বলে বলে রাজি করালাম। রাজি তুমি তোমার জন্য নয়, আমার জন্যই হলে। একসময় শরীরে জল শুকিয়ে এলো এত যে স্যালাইন দিতে হল। তোমার চোখ লক্ষ করছি হলুদ হয়ে উঠছে। শরীরের ভেতর কী যে হচ্ছে তোমার, ভাবলে আমার মাথা বনবন করে ঘুরতে থাকে। সারারাত জেগে থাকি, তোমার অসহ্য ব্যথা হলে পেথিডিন দেবো। সারাদিন জেগে থাকি, তাকিয়ে থাকি তোমার দিকে। তুমি পাশ ফিরতে চাইতে। কিন্তু ফিরতে গেলেই বলতে তুমি পড়ে যাচ্ছো, যেন একটু ধরি। পেট এত ফুলে উঠেছিল যে, ধীরে ধীরে এপাশ ওপাশ ফেরার শক্তিও হারিয়ে ফেলেছিলে। তোমার গা মুছে গায়ে যে জামা পরিয়ে দিতাম, প্রয়োজনে তা আর পাল্টে দেওয়াও সম্ভব হচ্ছিল না। একদিন কেটে বের করে নিলাম জামা, তুমি জামা ছাড়াই রয়ে গেলে। শুধু লেপ বা কাঁথায় ঢেকে রাখলাম পেট ফুলে ওঠা তোমার কংকালসার শরীর।

এর মধ্যেই যেদিন সকালে তোমার শ্বাসকষ্ট শুরু হলো, সুহৃদকেপাঠিয়ে দিলাম নানিবাড়িতে, মামাদের সবাইকে ডেকে আনতে। সুহৃদ রিক্সা করে গিয়ে খবর দিয়ে এলো। এক এক করে মামারা সবাই এলো। তোমাকে অক্সিজেন দিলাম মা। অক্সিজেন আনিয়েছিলাম, প্রয়োজন হলে ব্যবহার করবো বলে। সেদিন প্রয়োজন হল মা। তোমার শ্বাসকষ্ট ওই অক্সিজেনে কিছুই কমলো না। ডাক্তার ডেকে আনালাম। কাছাকাছি আমার যে ডাক্তার বন্ধুরা থাকে, সবাইকেই ডেকে পাঠালাম। আমার ওপরের ক্লাসে পড়তো সেলিম, খুব ভালো ছাত্র ছিল, তাকে ডাকিয়ে আনলাম ছটকুকে দিয়ে। সবাই দেখলো, কেউ কোনও আশার কথা শোনালোনা। সবাই দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তারপরও আরও বড় ডাক্তার এলো। বললো, বাড়ির সবাই উনার কাছে বসে থাকো। সারাদিন তুমি শ্বাসকষ্টে ভুগলে। ধীরে ধীরে তুমি চেতন হারালে। ওই অচেতন অবস্থাতেও তুমি শুধু প্রাণপণে শ্বাস নিতে চাইছো। স্যালাইনে দিতে লাগলাম জীবন বাঁচানোর স্টেরোয়েড। স্টেরোয়েডেরপর স্টেরোয়েড। রাতের দিকে স্টেরোয়েড শেষ হয়ে গেল। সুহৃদকে পাঠালাম চড়পাড়ার ওষুধের দোকান থেকে আরও কিছু নিয়ে আসতে। কেন আনতে পাঠালাম মা, আমি কি বুঝতে পারছিলাম না কী হতে যাচ্ছে? পারছিলাম মা।

সকালেই যখন তোমার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে দেখলাম, চিৎকার করে বাড়ির সবাইকে জানিয়েছিলাম সে কথা। শুনে দাদা ছুটে এসেছিলো, বিছানায় তোমার পাশে কিছুক্ষণ বসে থাকার পর নেমে গিয়ে অযু করে পাজামা পাঞ্জাবি আর মাথায় একটা টুপি পরে এলো, হঠাৎ করে তার পোশাক পাল্টাবার কী হল, বুঝলাম না। তাহলে কি দাদা ধরেই নিয়েছে যে তুমি মারা যাচ্ছো? খানিকপর দাদা আবার নেমে গেল বিছানা থেকে। সম্ভবত যে কারণে বিছানায় তোমার মাথার কাছে বসে ছিলো দাদা, যে শেষ নিশ্বাস একেবারে নিজের চোখের সামনে দেখবে বলে, সেই শেষ নিশ্বাসটিই তুমি তাকে দেখতে দিলে না সারা সকাল। নানি সেই আগের মতোই তোমার শিয়রের কাছে বসেপড়ে যাচ্ছে কোরান। নানির চোখ থেকে জলপড়েপড়ে কোরানের লেখাগুলো ঝাঁপসা হয়ে যাচ্ছে। মামারা জোরে জোরে আসোলামু আলায়কুম ইয়া রহমতুল্লাহ না কী কী সব বলে যাচ্ছে। আমার ভয় করছিল মা, খুব ভয় করছিল আমার। যারাই দেখতে আসছিল তোমাকে, বলে যাচ্ছিল তুমি যেন তাদের সালাম পৌঁছে দাও নবীজিকে। এর চেয়ে বীভৎস কোনও দৃশ্য আমি দেখিনি কোনওদিন মা। আমি চেষ্টা করছিলাম তোমাকে আরও জীবন বাঁচানো ওষুধ দিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে। আমি কোনও ভগবান আল্লাহ বা কোনও রকম ঈশ্বরে বিশ্বাস করি না। বিজ্ঞানে বিশ্বাস করা আমি একটি অলৌকিক কিছু চাইছিলাম, অনেকে তো মৃত্যুর দুয়ার থেকেও বেঁচে ওঠে মা। কত কেউ তো বেঁচেছে। তুমিও এরকম হঠাৎ কোমা থেকে ফিরে আসতে পারো না জগতে? সবাইকে অবাক করে দিয়ে চোখ মেলে তাকাও যদি আবার! আমি প্রকৃতির কাছে ভিক্ষে চাইছিলাম তোমাকে ফিরিয়ে দিতে, তোমার অচেতনতাকে ভেঙে দিতে। তোমার মাথা থেকে আগুন বেরোচ্ছিল, ছোট একটা ফ্যান চালিয়ে মাথা ঠাণ্ডা করতে চাইছিলাম। তোমার পায়ের পাতা দুটো বরফের মতো ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছিল। তোমার পায়ের কাছে বসে আমি ইস্ত্রিতে কাপড় গরম করে করে সে কাপড় চেপে ধরে তোমার পা দুটো থেকে ঠান্ডা সরাচ্ছিলাম। লাভ নেই, তারপরও। তুমি কী আর বুঝতে পারছিলে তোমার শরীরের কোথাও তাপমাত্রা কমে যাচ্ছে! বাইরের তাপ দিয়ে আমি আর কতটুকু কী উষ্ণ করতে পারবো! আমার ভয় হচ্ছিল। খুব কথা বলতে ইচ্ছে করছিল তোমার সঙ্গে আমার। শেফালিকে পা গরম করতে দিয়ে আমি তোমার হাত দুটো ধরে শুধু বসে রইলাম। সেই হাতে তাপ ছিল, সেই হাতে তুমি ছিলে না মা। তুমি কিছু টের পাচ্ছিলে না। হাতে তোমার কোনও জোর ছিল না। আমার খুব ভয় হচ্ছিল। খুব ভয়। সবাই ভাবছিল এই বুঝি তুমি আর নিঃশ্বাস নেবে না। কিন্তু তুমি নিচ্ছিলে। প্রাণপণে তুমি বাঁচতে চাইছিলে। শ্বাসে কোনও ছন্দ ছিল না, কিন্তু নিচ্ছিলে। তোমার শরীর কোনও আর অক্সিজেন চাইছিল না নিতে, তোমার ফুসফুস বাধা দিচ্ছিলো, কিন্তু নিচ্ছিলে তুমি। তোমার হৃৎপিণ্ড বাধা দিচ্ছিল, কিন্তু তুমি শুনছিলে না। যে করেই হোক নিচ্ছিলে। তোমার ভেতরের সব ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছিল, সবপচে গিয়েছিল, তোমার অন্ত্র, তোমার পাকস্থলী, তোমার যকৃত, তোমার কিডনি, কিন্তু শ্বাস নিচ্ছিলে। মানুষ তোমাকে বিদায় দিচ্ছে, তোমারই স্বামী, পুত্র, নাতি, তোমারই ভাই বোন তোমাকে বিদায় দিচ্ছে, তুমি বিদায় নিতে চাইছে না। তুমি এই পৃথিবী ছেড়ে তোমার সংসার তোমার স্বজন ছেড়ে কোথাও যেতে চাইছিলে না, মা। কার জন্য থাকতে চাইছিলে মা? এই জগৎ সংসারে তোমার কে ছিলো যে তুমি ছেড়ে যেতে চাইছিলে না? তোমার জায়গায় আমি হলে সম্ভবত মরে শান্তি পেতাম, মরে বাঁচতাম। ভালোবাসা বুঝি তোমার দেবার কিছু বাকি ছিল আমাদের যে থেকে যেতে চাইছিলে?

আমি তোমার কাছে বসছি, একবার বারান্দায় যাচ্ছি, একবার ঘরে ঢুকছি। মামারাও এক এক করে যাচ্ছে, আবার আসছে। কে ঠিক কী করবে বুঝতে পারছে না। ওই সকালেই নাকি দুপুরের দিকটায় হাসু খালু বলতে শুরু করলো আমরা তো তৈরি হয়েই এসেছি, লাশ নিয়ে যাবার জন্য যারা যারা আসার কথা, সবাই এসে গেছে জাতীয় কথা। আমার কানে যেন গরম লাভা পড়লো মা। বাবাকে বলি তোমার কাছে বসার জন্য। বাবাকে খুব ধীর স্থির লাগছিলো, বাবা কি সত্যিই নিস্পৃহ ছিল, নাকি বাবারও আমার মতো ভীষণ ভয় হচ্ছিল, বাবাও ভীষণ একা হয়ে যাচ্ছিল, যে কথা আমার মতো বাবাও কাউকে বুঝতে দিতে চাইছিলো না! দাদাকেও বলেছি যেন কাছে এসে বসে, যেন ধরে থাকে তোমার শরীর! কী যে কষ্ট করছো তুমি প্রতিটি নিঃশ্বাস নিতে। জীবন বেরিয়ে যাচ্ছে তোমার জীবন বাঁচাতে। ওদিকে দুপুর থেকেই আবার বৈঠক ঘরে দাদা আর বাবার চিরাচরিত বৈঠক। বাবা দাদাকে, অথবা দাদা বাবাকে ক্রমাগত বলে যাচ্ছে কবর, কোদাল, জানাজা, কাফন এসব কুৎসিত আর অশ্লীল শব্দযুক্ত বাক্য। তার চেয়ে বধির হয়ে যেতাম, তার চেয়ে অন্ধ হয়ে যেতাম। আমাকে দেখতে হত না এই ভয়ংকর দৃশ্য, শুনতে হত না নোংরা শব্দগুলো। তুমি এখনও শ্বাস নিচ্ছ মা, তুমি এখনও মরে যাওনি। কারও চোখে এক ফোঁটা জল নেই। হাসিনা তার ছেলেদের নাওয়া খাওয়া বিশ্রাম ইত্যাদির তদারকি করছে, যেমন করে প্রতিদিন। বাড়িতে একটি মানুষ যে কোনও মুহূর্তে আর নিশ্বাস নিতে পারবে না, কে বিশ্বাস করবে! ঠিক কী করবো বুঝতে পারছি না। কোথায় যাবো, কার সঙ্গে কথা বলবো কিছুই জানি না। মা, মা, মা বলে তোমাকে ডাকছি, যেন তুমি অন্তত কথা শোনো আমার। তুমি ছাড়া আর কেউ নেই আমার তখন। আমার সেদিন অনেকবার মনে হয়েছে, তার চেয়ে এই যন্ত্রণাটা তুমি না পাও, তার চেয়ে নিশ্বাস তুমি আর না নাও। কার জন্য নিতে চাইছো, এই সংসারে কে আছে তোমার! আমিই বা কী করেছি তোমার জন্য সারাজীবন! জীবনে যা করা উচিত ছিল করিনি, এখন উজাড় করে দিচ্ছি মত্যুর সঙ্গে রোজ যখন তোমার পাঁচবেলা দেখা হচ্ছে। যখন জীবন বলে সত্যিকার কিছু নেই, তখন। তুমি বিছানায় মিশে যাচ্ছো। বসার, হাঁটার, চলার, খাওয়ার কিছুরই উপায় তোমার নেই যখন, তখন। মা, তখন তুমি সবই মেনে নিচ্ছো। তোমার জীবন তুমি ছেড়ে দিয়েছো আমার হাতে। যেন আমার এই হাতই, এই অভিজ্ঞ এবং আন্তরিক হাতই মৃত্যুর মুখ থেকে ছিনিয়ে আনবে তোমাকে। এরকম তো কত গল্প শুনেছো কত বাঁচার। ডাক্তার আসছে, কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে চলে যাচ্ছে। অন্য ঘরে কবরের গল্প হচ্ছে। তুমি একা পড়ে আছো, চোখ বোজা, নাকে অক্সিজেন, হাতে স্যালাইন। নিশ্বাস নেওয়ার জন্য যুদ্ধ করেই যাচ্ছে। সকাল গড়িয়ে দুপুর হচ্ছে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল। সকালের দিকে একটা ভিড় হয়েছিল তোমার পাশে, সেই ভিড় হালকা হয়ে গেল। কার সময় আছে মৃত্যু দেখার জন্য অত সময় অপেক্ষা করার। তুমি মরে গিয়ে ওদের সময় যদি বাঁচাতে, খুশি হত ওরা। আমি স্তব্ধ বসে আছিমা। তোমাকে খাওয়াবার, পেচ্ছাব পায়খানা করাবার, গা মুছিয়ে দেবার, কাপড় পাল্টে দেবার কোনও কাজ আমার নেই। কাউকে ডেকে এনে তোমার সঙ্গে দেখা করাবার নেই। তোমার মন ভালো করার জন্য নানারকম আয়োজন করারও কিছু নেই। আমি শুধু স্তব্ধ বসে আছি। স্তব্ধ বসে আছি শুধু। মা, তুমি একা একা কষ্ট পেয়ে যাচ্ছো। তুমি হারিয়ে যাচ্ছো। সন্ধে হলে টেলিভিশন ছাড়া হল। শুভ আর সৌখিন দেখবে। বাবাও বোধহয়। নাকি বাবা তোমার দাফন কাফন নিয়ে দাদার সঙ্গে ক্রমাগতপরামর্শ করে যাচ্ছে কে জানে। টেলিভিশনের নাচ গান বিজ্ঞাপনের শব্দের নিচে হারিয়ে যাচ্ছে তোমার শ্বাস কষ্টের শব্দ। জানি না কেন বারান্দায় গিয়ে স্তব্ধ রাত্তিরের দিকে তাকিয়ে আমি মা মা মা বলে চিৎকার করলাম। ওই বারান্দায় দাঁড়িয়ে সেই শৈশব থেকে মা মা বলে ডেকেছি, আর যেখানেই ছিলে তুমি, রান্নাঘরে, শোবার ঘরে, ছাদে বা উঠোনে, ডাক শুনে ছুটে এসেছে। আর যে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমি চিৎকার করে তোমাকে ডাকছি, বাড়ির সবাই শুনছে, পাড়াপড়শি শুনছে, পথচারি শুনছে, একেবারে কাছের ঘরটায় শুয়ে আছো তুমি, শুধু তুমিই শুনছে না।

বাবা তখনও বৈঠক ঘরে ব্যস্ত দাদার সঙ্গে প্রতিদিনের মতো খুঁটিনাটি আলোচনায়। কাকে কাকে খবর দিতে হবে, কী করতে হবে। বাড়ির কারও চোখে জল নেই মা, না, আমার চোখেও নেই। সত্যি বলছি মা, আমি চাইছিলামও তুমি ওই শ্বাস আর না নাও। কারণ ওই শ্বাস তোমাকে শ্বাস ফিরিয়ে দেবে না। অক্সিজেন কি খুলে দেব? স্যালাইনের নলে আর কি ধীরে ধীরে ঢালবো না ওষুধগুলো! ভাবি ঢালবো না, কিন্তু না ঢেলেপারি না। যতক্ষণ বেঁচে থাকতেপারো, যেভাবেই পারো, বাঁচো। জীবন তো একটাই মা, পরকাল বলে কিছু আছে বলে যদিবিশ্বাস করতাম, তোমাকে বিদায় দিতে কোনও কষ্ট হত না।

বাবা তোমার দশ বছর বয়স থেকে তোমার সঙ্গে। এত বছর মানুষটার সঙ্গে এক বাড়িতে কাটিয়েছে বাবা, কোনওদিন ভালোবাসেনি বরং সারাজীবন কষ্ট দিয়েছে। যে অসুখটা সারাতে চাইতে, সেই অসুখের কথায় বাবা মুখ ভেংচে টিটকিরি দিয়েছে তোমাকে, সেই অসুখে চিকিৎসাহীন অবস্থায় আজকে তুমি মারা যাচ্ছ, আর একটু পরেই সব কষ্ট সব যন্ত্রণার অবসান হবে। বাবা আজ কী করে স্থির থাকছে, তোমাকে মাটিতে পুঁতে দেওয়ার পরিকল্পনা করে যাচ্ছে, আমি ভাবতে পারি না। মানুষের দীর্ঘ বছরের সম্পর্ক কি এমনই ঠুনকো হয় নাকি হতে পারে! সম্পর্ক নামের জিনিসটা তবে কী! দাদার চোখেও তো একফোঁটা জল নেই। এই দাদাকে শিশু ছিলে যখন, বা অল্প বয়সি কিশোরী ছিলে, জন্ম দিয়েছিলে, এই দাদার কারণে তুমি তোমার শৈশব কৈশোর কিছুই উপভোগ করতেপারোনি। দাদাকে আনাড়ি হাতে একা একা মানুষ করেছো। সেই তুমি চলে যাচ্ছ, অভাগা তুমি। দাদার চোখে জল নেই, দাদা ব্যস্ত তোমাকে মাটিতে পুঁতে ফেলার আয়োজনে, কাকে কাকে জানাজায় খবর দেবে তার তালিকা তৈরি করছে। ফকরুল মামা ঢাকা থেকো এলো রাতে, এসেই শ্বাসকষ্ট হতে থাকা অচেতন তোমাকে দেখলো। দাদার ঘরে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে কেঁদেছে কেন সে দেরি করলো, কেন আগে সে এলো না, বলে বলে। এ বাড়িতে প্রথম একজন কেউ কাঁদলো। অন্তত একজন মানুষের কান্নার শব্দ আমাকে স্বস্তি দেয় মা। আসার তো ফকরুল মামার কথাই ছিল, তাকে পাঁচশ টাকা তোমার হাত দিয়েই গাড়িভাড়ার কথা বলে দিয়েছিলাম, যেন আসে তোমাকে দেখতে। এলো, সে যে এলো তুমি দেখতে পেলে না। ফকরুল মামার টাকার অভাব নেই, তারপরও আমি ভেবেছিলাম যদি কখনও আবার ভেবে বসে যে আসবে না, গাড়িভাড়াটা হাতে থাকলে অন্তত একটা তাগাদা থাকবে আসার জন্য, তাই দেওয়া। ঝুনু খালা আসেনি। বড় মামাও না। তোমাকে এখন দেখতে এসেই বা কী লাভ! তোমার মৃত্যু দেখতে কি মানুষকে আসতে বলেছিলাম! তখনই তোমার প্রয়োজন মানুষের উপস্থিতর, যখন কথা বলতে পারতে, কাছের মানুষদের কাছে পেয়ে ভালো লাগা পেতে পারতে। এখন কী দরকার! সারাজীবন তো মানুষ তোমার অনেকটা বেঁচে-না-থাকার মতো বেঁচে থাকা দেখেছে। মৃত্যুময় জীবন দেখেছে। এখন তাকিয়ে তাকিয়ে তোমার মৃত্যু উপভোগ করার প্রয়োজন কেন তাদের! মারা যখন যাচ্ছোই, একা একাই যাও। সবাইকে এত দুঃসহ দুর্ভোগ দেখাবে কেন! সারা জীবন ধরে তারা তো দেখেইছে যা দেখার। একটা সময়, মা, আমি কিছু আর উপলব্ধি করি না। আমি তাকিয়ে থাকি তোমার দিকে। মানুষগুলোর দিকে। বাইরের কালো উঠোনের দিকে। বাবা আর দাদার আলোচনার দিকে। হাসিনার হাসি হাসি মুখের দিকে। শুভ আর সৌখিনের প্রতিদিনের রুটিনের দিকে।

জানিনা কেন সবাইকে আবারও কাছে আসতে বললাম। তখন শ্বাস নেওয়ায় ছন্দপতন হচ্ছিল, যখন বিরতি বেড়ে উঠছিলো, প্রথম নিঃশ্বাস থেকে দ্বিতীয় নিঃশ্বাসের মধ্যে। যখন ভেঙে ভেঙে যাচ্ছিল শ্বাস, আবার দীর্ঘ হয়ে উঠছিলো, যখন খুব সময় নিয়ে শ্বাস নিচ্ছিলে; এভাবে নিতে নিতে আর নেবেনা শ্বাস, জানি। সবাই এলো, দাদা তোমার শিয়রের কাছে গিয়ে বসলো। না, আমি বিছানায় উঠিনি। বাবা দূরে দাঁড়িয়ে রইলো ঘরে। ঘরে একটু একটু করে ভিড় বাড়তে শুরু হল। এবার নিশ্চয়ই তুমি মরতে সময় নেবে না। না সময় নাওনি, মা। সারাদিন নিয়েছে, রাতে আর নাওনি। রাতে তো সবাই রাতের খাবার শেষে যার যার শুভ্র বিছানায় শুতে যাবে, সেসবে আর ব্যাঘাত ঘটাওনি। দাদা হঠাৎ চিৎকার করে উঠলো, নাসরিন, কী হইব। মা নাই! দাদার চিৎকারে সামান্যও চমকে উঠি না। তোমার হাতের আঙুলগুলো খুব মন দিয়ে নাড়ছিলাম আমি। নেড়ে যাচ্ছিলাম। তোমার নখগুলো অনেকদিন কাটা হয়নি দেখছিলাম, আঙুলগুলোয় কয়েকদিন লোশন পড়েনি, দেখছিলাম। সুহৃদ ওষুধ নিয়ে ঢুকলো তখন। এসেই সে তোমাকে দুহাতে জড়িয়ে জোরে কেঁদে উঠলো। কান্নার সুহৃদকে সঙ্গে সঙ্গে ফকরুল মামা তুলে নিয়ে থামাতে চেষ্টা করলো। আমি বুঝতেপারিনা সুহৃদের কান্না থামানোর তার কী প্রয়োজন! তোমার দেবশিশু যদি আজ না কাঁদে কবে কাঁদবে? সুহৃদের জীবনের সবচেয়ে বেশি ঋণ তত তোমার কাছেই। সেই তুমি মারা যাবে, আর সুহৃদ কাঁদতে পারবে না! কারও কাঁদা উচিত নয়, কে এই নিয়ম তৈরি করেছে? সমাজ, নাকি ধর্ম। মনে আছে ফজলি খালা কারও মৃত্যুতে কাঁদতে বারণ করতো। বলতো, আল্লাহর জিনিস আল্লাহর কাছে যাচ্ছে, এতে দুঃখ করার কিছু নেই। কাঁদলে নীরবে চোখেরপানি ফেল, কিন্তু শব্দ করো না। শব্দ করে কাঁদলে, বুক থাপড়ালে, কপাল চাপড়ালে আল্লাহ খুব অখুশি হবেন। কিন্তু ফকরুল মামা তো ধর্ম মানে না। সুহৃদের সশব্দ ক্রন্দন তাকে পীড়া দিল কেন! নাকি সে ভাবছিলো, কেঁদে আবার সুহৃদনিজের কোনও ক্ষতি না করে ফেলে। কত আর ক্ষতি হয় কাঁদলে! বাকিজীবন যে ভেতরে বাইরে আমি কেঁদে চলেছি, কী ক্ষতি আমার হচ্ছে! মানুষকে কাঁদতে হয়, অন্যের প্রতি নিজের এবং অন্যান্যের নীচতা, নিষ্ঠুরতা, তঞ্চকতা দেখে কাঁদতে হয়। না কাঁদলে মানুষ মানুষ হবে কী করে!

.

তুমি আর শ্বাস নিলে না মা। রাত তখন দশটা অথবা সাড়ে দশটা কিছু বাজে। ঘরের ভিড় কমলে আমি তোমাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকি। তুমি তখন ঠাণ্ডা হয়ে গেছ। আর কোনও কষ্ট নেই। শ্বাস নেবার দায় নেই। তোমাকে ক্লান্ত কিন্তু ভারমুক্ত বলে মনে হচ্ছিল। বিশ্বাস হচ্ছিল না তুমি আর জেগে উঠবে না, তুমি আর কথা বলবে না বা হাসবে না। তোমার নরম শরীরটা আর নরম নেই। শুয়ে হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছিলাম মা। প্রায় চার মাসের একটানা অবসাদশরীরে। হঠাৎ কিছুর শব্দ পেয়ে চমকে উঠি। কী! ফজলি খালা ঘরে এসেছে, চেয়ারে বসে বিছানায় নিথর নিস্তব্ধ তোমার দিকে তাকিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। আমি চিৎকার করি, চিৎকার আমি করবো এই পরিকল্পনা করে চিৎকার করিনি, ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছে চিৎকার, ওই চিৎকার, বাড়ি কাঁপানো চিৎকার, জানালার কাঁচে ঝিনঝিন শব্দ হতে থাকা চিৎকার, আকাশ বাতাস কাঁপানো চিৎকার। যে গালি আমি দিই না, সেই গালি, যে ঘৃণা আমি ছুড়ি না, সেই ঘৃণা আমার ভেতর থেকে বোমার মতো বেরিয়েছে। যে বোনকেতুমি ভালোবাসতে, যে বোনেরপায়ের শব্দ শোনার জন্য তুমি কান পেতে ছিলে, সেই প্রিয় তোমার বোনকে উদ্দেশ্য করে কেন এসেছে শুয়োরের বাচ্চা এখানে, কী দেখতে এসেছে। বেরিয়ে যা, এক্ষুনি। এক্ষুনি বেরিয়ে যা। এক্ষুণি বেরো এই বাড়ি থেকে। হারামজাদি আজকে এসেছে, মড়া দেখতে এসেছে। শুয়োরের বাচ্চা মজা করতে এসেছে। বেরো এক্ষুনি এই মুহূর্তে। আমি আমি ছিলাম না মা। আমার সহ্য হয়নি ফজলি খালার এই উপস্থিত। কত যে তাকে তোমাকে দেখতে আসার জন্য ডেকেছি। ফজলি খালা ছিল তোমার সবচেয়ে আদরের বোন। অসুস্থ জেনেও, মরে যাবে জেনেও একদিনও সে দেখতে আসেনি নিজের বোনকে। কারণ হচ্ছি আমি। আমি নাস্তিক, তাই যে বাড়িতে নাস্তিক আছে, সে বাড়িতে তার মতো পবিত্র আস্তিক পা রাখতে পারে না। ছটকুকে দিয়ে, শরাফ মামাকে দিয়ে, টুটু মামাকে দিয়ে, ফেলু মামাকে দিয়ে, রুনু খালাকে দিয়ে দিনের পর দিন অনুরোধ করেছি। বলেছিনাস্তিক তোমার চোখের সামনে থাকবেনা, তুমি শুধু তোমার বড়বুকে দেখতে এসো, শেষ দেখা দেখতে এসো, তোমাকে দেখে শান্তি পাবে তোমার বড়বু। না, ফজলি খালা আসেনি। এলো ঠিকই, তুমি জানলে না যে এসেছে। এই আসার কী দরকার। তার এই আসা, তোমার স্থবিরশরীর, তোমার বরফের মতো ঠাণ্ডা কঠিন শরীর দেখতে আসা আমার সইবে কেন! আমার সমস্ত ক্রোধ, রাগ, সমস্ত অভিমান, দুঃখ, আমার শত শোক সে রাতে আগুন হয়ে ঝরলো। তুমি শুয়ে আছে। কিছুই তোমাকে আর স্পর্শ করছে না। জগতের নিষ্ঠুরতা অনেক দেখেছো। বেঁচে থাকতে আমার নিষ্ঠুরতাও দেখেছো অনেক। তুমি দিব্যি মরে রইলে, আর আমি অবাধে নিষ্ঠুরতা করলাম। তবে এই প্রথম তোমাকে ভালোবেসে একটি কুৎসিত নিষ্ঠুরতা করলাম, মা। ফজলি খালাকে আমি ক্ষমা করতে পারিনি। তুমি পারো ক্ষমা করতে অনেক কিছু। আমিও কি কম করেছি ক্ষমা এ জীবনে! সে রাতে পারিনি। ফজলি খালা আমার চিৎকারে বেরিয়ে যেতে বাধ্য হল। এরপর তোমার শরীর নিয়ে কত যে কাণ্ড শুরু হল। সেই রাতেই তোমাকে কলের পাড়ে নিয়ে গিয়ে গোসল করিয়ে গায়ে সাদা কাপড় পেঁচিয়ে দেওয়া হল। কাপড়ে রক্ত লেগে রইলো। তা লাগুক। আমি গোসলেরপূতপবিত্রতায় বিশ্বাস করিনা। যারা মনে করে তুমি এখন আল্লাহ বাপয়গম্বরের কাছে যাচ্ছে তারা হয়তো এসব গোসল, সাদা কাপড়, সুরমা বা আতরে বিশ্বাস করে। গোসল করাবার জন্য কোত্থেকে সব মেয়ে ভাড়া করে আনা হয়েছে। হাসিনা মহা উৎসাহে ছুটোছুটি করছে, একবারদাদা বা বাবার কাছেআরেকবার কলপাড়ের লোকদের কাছে। মনে আছে তুমি একবার বলেছিলে, তুমি মারা যাওয়ারপরফজলি খালারননদ জোহরা, তুমি চাও, যেন তোমাকে গোসল করায়। জোহরার মধ্যে সততা আর সারল্যের সন্ধান পেয়েছিলে হয়তো। আমি ও নাম নিইনি। বেচে থাকতে তোমার কোনও ইচ্ছেপূরণ হয়নি। মরে গেলে তোমার ধর্মবিশ্বাস থেকে প্রসূত ইচ্ছেগুলোর কী হল, তা আমার জানতে ইচ্ছে করে না। তোমার ওই প্রাণহীন শরীরটি তুমিনও হাসিনা, দাদা, বাবা এরা তো তোমার জীবন নিয়ে কিছুভাবেনি, মৃত্যু নিয়ে ভেবেছে। মধ্য রাত্তিরে কী করে এত কিছুঘটে যাচ্ছে জানিনা। ব্যবস্থাপনায় কেছিল, কারা ছিল জানি না। যা কিছু হয়েছে, আমার আড়ালেই হয়েছে। সবকিছুর ব্যবস্থাপক যে বাবা, অনুমান করতে পারি। কী সুন্দর আগরবাতির গন্ধ চারদিকে। আগরবাতি আগে থেকে ঠিক করা ছিল তবে! কাফনের কাপড়টিও আগে থেকেই কেনা ছিল! আমার শুধু সারারাত মনেপড়েছে, সারাদিন মনেপড়েছে তোমার দুঃসহ জীবনের কথা। বাড়িতে এখন উৎসব লেগেছে। উঠোনে আলো। কোত্থেকে একটি কাঠের সস্তা খাঁটিয়া না কী নিয়ে এসেছে কে জানে, সাদা কাপড়ে মোড়ানো তোমাকে ওতে শুইয়ে বৈঠকঘরে এনে রাখা হল। এখন তুমি বাবার আর দাদার সম্পত্তি। আমার কিছু নও। তোমার শরীর নিয়ে এখন কী করা হবে, কী করা উচিত, তা আমার কাছে কেউ আর জানতে চাইছেনা। যখন শ্বাস নিয়েছে, আমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত আমি করতে চেয়েছি, তোমাকে ভালোবেসেছি, পাশে থেকেছি, তোমারশরীর ভালো করার কোনও উপায় আমারছিল না, তোমার মন ভালো করার জন্য, তোমার মনে সামান্য সুখ দেওয়ার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করেছি। শ্বাস আর নিচ্ছেনা, আমার ছুটি, হ্যাঁ মা, ছুটিই। তোমাকে বৈঠকঘরের মেঝেয় শুইয়ে দেবার পর কি ওরা টেলিভিশন চালিয়েছিল! মনে নেই। চালালেও অবাক হওয়ার আমার কিছুছিলনা। আমার সব অবাক হওয়া, সব দুঃখ পাওয়া, কষ্ট পাওয়া তোমার মতোই স্থবির পড়ে আছে, প্রাণহীন। সকালে অদ্ভুত সব কাণ্ড হতে লাগলো। সবই বাবার মস্তিষ্ক প্রসূত। রিক্সা করে কে যেন বাইরে মাইকে ঘোষণা করছে, ডাক্তার রজব আলীর স্ত্রী গতকাল রাত সাড়ে দশ ঘটিকায় ইন্তেকাল করেছেন, ইন্নালিল্লাহে কিছুএকটা রাজেউন। দুনিয়ার লোককে তোমার মৃত্যু সংবাদ জানিয়ে দেওয়ার কী প্রয়োজন আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না। আমার খুব অস্বস্তি হয় ওই ঘোষণা শুনতে। তোমার নিঃশব্দেচলে যাওয়া সশব্দে প্রচারিত হচ্ছে। মানুষ যার যার জীবন নিয়ে সবাই ব্যস্ত। তারা তোমার মৃত্যুর খবর জেনে কী করবে, উৎসব করবে, নাকি কাঁদতে বসবে? কজন আর চিনতো তোমাকে! তুমি বোরখা পরেই চিরকাল বাইরে বেরিয়েছে। কেউ তোমারমুখটাও কোনওদিন দেখেনি। পাড়ার কারও সঙ্গে তোমার তো খুব সখ্য ছিল না। কিন্তু বাবার এসব কার্যকলাপে বাধা দেওয়ার ক্ষমতা আমার নেই। তুমি যেই না চোখ বুজলে, এ বাড়িতে আমি মুহূর্তে অস্পৃশ্য হয়ে উঠলাম। মূল্যহীন হয়ে উঠলাম। আমার কোনও পরামর্শ বা চাওয়া না চাওয়ার কোনও দাম নেই তখন।

আমি লাশ শব্দটা উচ্চারণ করি না, কবর শব্দটাও আমি উচ্চারণ করি না। মরে গেছে শব্দটা আমি লক্ষ করি আমি উচ্চারণ করি না। আমি শুধু বাবাকে বলি, মা অবকাশে থাকবে, অবকাশ থেকে মাকে বাইরে বের যেন না করা হয়। অবকাশে মা মার হাতের লাগানো কোনও গাছের তলায় থাকুক। আমি পাগলের প্রলাপ বকছি বাবা ভেবেছে। বাবা ব্যস্ত। অবকাশে প্রথম কেউ মারা গেল। কত দায়িত্ব, কত কর্তব্য তার। তোমাকে নাকি আকুয়ার কবরখানায় রেখে আসা হবে। কী রকম যেন অদ্ভুত লাগে সমস্ত ব্যাপারটা। তোমার মরে যাওয়া, ওদের ছুটোছুটি, ওদের মাইকের ঘোষণা, ওদের কাফনের কাপড় কেনা, ওদের মাটি খোঁড়া, তোমাকে বাড়ি থেকে নিয়ে যাওয়া, তোমাকেপুঁতে দেওয়া, তোমাকে ফেলে আসা, তোমাকে একা ফেলে আসা, অন্ধকারে, গর্তে-সবকিছুকেই চরম নিষ্ঠুরতা ছাড়া আর কিছু মনে হয় না। মা। আমি তাকাতে পারি না ওসবের দিকে। মানুষগুলোকে আমার মনে হয় আমি চিনি না। শুধু তোমাকে চিনি, শুয়ে থাকা তুমি, যদিও শ্বাস ফেলছো না, যদিও চোখ খুলছে না, তোমাকেই চিনি।

যে বিছানায় যে চাঁদরে শুয়েছিল, সেই বিছানায় তোমার স্পর্শ লাগা চাঁদরে আমি শুয়ে থাকি। ওদিকে তোমারশরীর নিয়ে উৎসব চলছেই। ছোটদাকে ফোন করে আগেইমৃত্যুর খবর জানিয়েছে বাবা। ছোটদা বলে গিয়েছিল, ‘কিছু হলে’ তাকে যেন ফোন করা হয়। কিছুটা এতদিনে হয়েছে। কিছুটার জন্য এখন ছোটদা আসবে অবকাশে, কিছু হলে যে জিনিসগুলো করতে হয়, সে জিনিসগুলো করবে ছোটদা। এই আড়ম্বর, এই অভিনয় আমার খুব হাস্যকর লাগে। যে ছোটদার কোনওদিন সময় হয়নি তোমার চেতন থাকা অবস্থায় তোমাকে সঙ্গ দিতে, এখন অচেতন তোমাকে, ঠাণ্ডা পাথর তোমাকে, মৃত তোমাকে হিরোর মতো দেখতে আসবে সে। সে হিরো। হিরোরা সবসময় দূর থেকে আসে, হিরোদের কাছাকাছি কোথাও থাকতে নেই। হিরোর জন্য তোমাকে শুইয়ে রাখা হল। জানাজাপড়ানোরজন্য শুনলাম মামারা আর দাদা মসজিদেমসজিদে ইমাম বা মৌলবী খুঁজেছে। শহরের কোনও মসজিদ থেকে কোনও ইমাম আসবে না জানিয়ে দিয়েছে। দাদা বললো, ‘তোর জন্য। যত ইমাম আছে সবাই একবাক্যে একটা কথাই বলেছে, নাস্তিকের মার জানাজা তারা পড়বে না।‘

.

আমার ইচ্ছে করে তোমাকে বরফে ডুবিয়ে রাখি, কোনওদিন যদিমানুষ বাঁচানোরপদ্ধতি আবিষ্কার হয়, বাঁচাবো তোমাকে। কিন্তু কে শুনবে আমার কথা! তোমার শরীর ওরা আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। বৈঠক ঘরে তুমি শুয়ে আছে, আর ওদিকে কালো ফটক খুলে দেওয়া হয়েছে, তোমাকে পাড়ার স্ত্রী পুরুষ যার ইচ্ছে হচ্ছে দেখে যাচ্ছে। যে কেউ এসে দেখে যেতে পারছে। সবার জন্য আজ বন্ধ দুয়ার খুলে গেছে। মৃত্যু যে দেখার বিষয় হয় কোনওদিন, জানা ছিল না। বেঁচে যখন ছিলে, কজন দেখতে এসেছে? প্রতিবেশীরা বেশির ভাগই হিন্দু। বাবা বড় পাঁচিল তুলে দিয়েছিলো বাড়ির সামনে, প্রতিবেশী থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার জন্য। রাস্তার অচেনা লোকেরই বা বাড়ি ঢুকে প্রাণহীন একটি মানুষকে দেখার প্রয়োজনটা কী? তুমি তো আর কোনও রাজনীতির লোক ছিলে না। তুমি ছিলে বোরখা পরা একটি মেয়ে। আজ অনাবৃত করা হয়েছে তোমার মুখ। আজ আর তোমার বোরখার প্রয়োজন নেই। জীবিত থাকলে তোমাকে ঢেকে রাখতে হবে, তোমাকে লুকোতে হবে, মরলেই তোমার সব বন্ধন মুক্ত, মরলেই তোমার মুক্তি। না মরে তোমার বোধহয় মুক্তি ছিল না, কোনও মেয়েরই কি আছে! আমার ভালো লাগে না বাড়ির আয়োজন। হাসিনাকে কেউ একজন বলে গেছে যেদিন কেউ মারা যায়, সেদিন বাড়িতে রান্না চড়াতে হয় না। রান্না না চড়ানোটাও উৎসবের ব্যাপার। পিকনিক পিকনিক আনন্দ। আমি ঠিক জানি না বাইরে থেকে কারা খাবার দিয়েছিলো, আমি খাইনি কিছু। খাওয়ার কোনও রুচি হয়নি। উঠোনের পেছন দিকটায় হেঁটেছি। তোমার হাতে লাগানো ফুল ফলের গাছগুলো দেখেছি। ফলের গাছগুলো ফল দিচ্ছে, সব ফুলগাছে ফুল। কী ভালোই না বাসতে এই অবকাশের সব কিছু। অথচ এবাড়িতেই তোমার থাকা হয়নি। তোমাকে থাকতে দেওয়া হয়নি। হাসিনার হাতে সর্বময় ক্ষমতা দিয়ে তোমাকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছিল বাবা। তারপরও তুমি এ বাড়িতে অনাহুতের মতো আসতে। আঘাত পেতে সবার ব্যবহারে কাঁদতে। তারপরও মায়া যায়নি। এই গাছগুলোই ছিল তোমার আপন। গাছগুলোয় জল সার দিতে। গাছগুলোর সঙ্গে মনে মনে কথা। বলতে। সেই গাছগুলোর কাছে গিয়ে যেন কেউ না দেখে, কাঁদলাম। কান্না এলো মা। তোমার জন্য তো তোমার অসুখ ধরা পড়ার পর থেকে কাঁদছি। আগে কাঁদিনি। আগে একা কেঁদেছো তুমি। আর অসুখেরপর? একটুও কাঁদোনি। যেন তোমার মতো সুস্থ আর কেউ নয়। সুস্থ মানুষের অভিনয় করেছে, একই সঙ্গে একা যুদ্ধ করেছো। তুমি তো হেরে গেছো যুদ্ধে। তুমি হেরেছো, নাকি আমরা হেরেছি, মা? আমার মাঝে মাঝে মনে হয় আমাকে আর বাবাকে তুমি চরম হারিয়ে দিয়েছে। আমাদের ডাক্তারি বিদ্যে দিয়ে যে আশংকাটি আমরা করতে পারিনি, কোনও ডাক্তারি বিদ্যে ছাড়াইতুমি সেই আশংকা করেছে। আমাদের কোনও সাহায্য ছাড়াইতুমি বলেছো, তোমার বড় একটা অসুখ হয়েছে। আমাদের জ্ঞানকেই শুধু তুমি হারাওনি, আমাদের মনুষ্যত্বকেও হারিয়েছে। আমাদের মতো নির্মম নিষ্ঠুর মানুষেরা তোমার মহত্বের কাছে হেরেছি। কী ভীষণ স্বার্থপর চারদিকের মানুষগুলো। বলছে তোমাকে নাকি এখন নিয়ে যাওয়া হবে বাড়ি থেকে। ওই বৈঠকঘরের ভিড়ের মধ্যে তোমাকে ঘিরে সার্কাস চলছে। সার্কাসে বড় বিরক্তি আমার। খাঁটিয়ায় শুয়ে থাকা তুমি অথচ তুমি-নওকে দেখার মোটে ইচ্ছে নেই আমার। কিন্তু কারা যেন আমাকে টেনে নিয়ে গেল ওঘরে, তোমার কাছে। তোমাকে শেষ দেখা দেখার জন্য। বড় মামাই বোধহয়। আমি শুধু হাঁটু গেড়ে বসে তোমার মুখে, তোমার গালে, বুজে থাকা চোখে, তোমার কপালে আলতো হাত বুলোলাম। ঠাণ্ডা পাথর হয়ে থাকা তোমার মুখ। জলে উপচে উঠেছে চোখ, যতটা পেরেছি আড়াল করেছি। বড় মামা পাশে দাঁড়িয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠেপকেট থেকে রুমাল বের করে বললো যে ওই রুমালটা তুমি তাকে দিয়েছিলে। ওই রুমালে বড়মামা নিজের চোখের জল মুছলো মা। তোমার দেওয়া রুমালে। তুমি তো তাকে মিয়াভাই বলে আর ডাকবে না। হঠাৎ তোমাকে কারা যেন উঠিয়ে নিয়ে চলে গেল। সম্ভবত মামারা। আমি হতবাক দাঁড়িয়ে রইলাম দরজায়। এই অবকাশে, এই বাড়িতে তুমি আর ফিরবে না মা। তুমি আর কোনওদিন আবদার করবে না এক বাটি দুধ, দুটো কলা আর একটা ডিমের জন্য, তোমার ভেঙে যাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য বাবার কাছে আর কোনও আবদার করবে না। দাদার কাছে আর আবদার করবেনা কোনও একটা ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবার জন্য, বা গাড়িটা একটু চড়তে দেওয়ার জন্য। তোমার ছেঁড়া লেপ আর নষ্ট হয়ে যাওয়া তোশক পাল্টানোর জন্য কাউকে অনুরোধ করবে না। ভেঙে যাওয়া খাটটি সারাবার জন্যও আর কাউকে না। ডাব বিক্রি করতে এসে আর তুমি দেখবে না হাসিনা সব বিক্রি করে ফেলেছে। আর তোমাকে মশার কামড়ে বাইরের বারান্দার মেঝেতে রাত কাটাতে হবে না। এই অবকাশ থেকে আর অপমানিত হতে হতে প্রত্যাখ্যাত হতে হতে তোমাকে চোখের জলে বিদেয় নিতে হবে না। তুমি মুক্তি দিয়ে গেলে সবাইকে। সবাই এখন সুখে শান্তিতে বেঁচে থাক। সবাই এখন হাসি আনন্দে জীবনের গান গেয়ে যাক।

.

অবকাশ দেখে কেউ বুঝবে না আজ এ বাড়ি থেকে মা নামের একজন চলে গেল, এই চলে যাওয়া মানে কখনও আর ফিরে আসা নয়। সন্ধেবেলায় যথারীতি টেলিভিশন চালালো কেউ। নাচের গানের অনুষ্ঠান হচ্ছে। নাটক হচ্ছে। বড় মামা তার মেয়েকে নিয়ে এসেছিল, থেকে যেতে বললাম। ফকরুল মামাও থাকলো। নানিও সেদিনটা রইলো। আমার জন্যই বোধহয় রইলো। আমি না থাকলে তোমার যে কী করুণ অবস্থা হত, তাই বললো সবাই। আমি ছিলাম বলে জীবনের শেষ কটা দিন তুমি আমার সেবা পেয়েছ। আমি তো জানি, এসব সেবার কোনও মূল্য নেই। সত্যিকার সেবা করা হত, যদি আমি সময় মতো তোমার চিকিৎসা করতে পারতাম। যখন দুরারোগ্য ব্যাধি বাসা বেঁধেই ফেলেছে তোমার শরীরে, তখন যে সেবাআমি করেছি, সেই সেবার কী মানে, বলো? চেয়ে চেয়ে তোমার মরে যাওয়া দেখা ছাড়া আর কিছু নয়। না, মা, আমি ক্ষমা চাইনি তোমার কাছে। ক্ষমা আমি চাইবো না কোনওদিন। আমাকে তুমি ক্ষমা কোরো না। বাবা তোমার চিকিৎসা করেনি, বাবা তোমাকে কোনওদিন ভালো বাসেনি। আমি তো তোমার কন্যা ছিলাম মা, আমাকে তুমি প্রচণ্ড ভালোবাসতে। কত শত মানুষের চিকিৎসা করেছি। রাত জেগে জেগে হাসপাতালের কঠিন কঠিন রোগের চিকিৎসা করে সুস্থ করে তুলেছি কত অসুস্থ মানুষকে। তোমাকে কেন করিনি মা। তুমি যে অভিযোগগুলো করতে, ওই রক্তপাতের অভিযোগ, তা অন্য কেউ করলে আমি তো অবহেলা করিনি। নানারকম পরীক্ষা করিয়েছি। কেবল তোমার বেলায় গা করিনি। আর সবাইকেই ক্ষমা করে দিলেও আমাকে কোরো না মা।

.

পরদিন মুন্নি এসেছিল অবকাশে। আমার সঙ্গে অনেকক্ষণ গল্প করে গেল। বললো, মার কথা সারাজীবনই মনে পড়বে। মাকে কখনও ভোলা হয় না। মুন্নি ঠিক কথা বলেছিলো মা, এই দেখ, আজ দশ বছর তুমি নেই। তোমাকে তো একটি দিনের জন্যও ভুলে থাকিনি। এখনও দেখ, চিঠি লিখতে গিয়ে চোখের জল রোধ করতে পারছি না। মানুষের কষ্টে কষ্ট পাওয়া, উজাড় করে কেবল দেওয়া আর দেওয়া, নিজে নিঃস্ব হয়ে যাওয়া–তোমার এই জীবনবোধ, বাকিটা জীবন, অবচেতনেই আমি চর্চা করবো জানি। তোমার বোধের এই উত্তরাধিকার, আমি অহংকার করে বলি, আমার।

শুনেছি তোমাকেআকুয়ারকবরখানায় কবর দেওয়া হয়েছে। শুনেছি তোমার জানাজা হয়েছে, জানাজা শেষ পর্যন্ত পড়িয়েছে ফজলিখালার ছেলে মোহাম্মদ, যে মোহাম্মদ তোমাকে দেখতে এসে পীরের মতো তোমাকে তোমার মেয়ের বিরুদ্ধে, মেয়ে কী করে দোযখের আগুনে পুড়বে, আর তার সঙ্গে সম্পর্ক রাখলে তুমিও যেপুড়বে দোযখের আগুনে, সেসব ভয়াবহ কথা সুর করে করে বলে গিয়েছিলো। শুনে তোমার খুব মন খারাপ হয়েছিল। ধর্মের নিষ্ঠুরতা দেখতে দেখতে আমার বিশ্বাস, ধর্মে তোমার বিশ্বাস হারিয়েছিল। তোমার মতো ভালোবাসা আর দয়া আর করুণা আর স্নেহ শ্রদ্ধায় যার হৃদয়পূর্ণ সে কী করে পারে নিষ্ঠুরতা মেনে নিতে! মোহাম্মদ চলে যাওয়ার পর আমি ছুটে এসেছিলাম তোমার কাছে, ভেবেছিলাম তোমার মুখে দেখবো তৃপ্তির হাসি। পীর আমিরুল্লাহর মৃত্যু হওয়ার পর, আমিরুল্লাহরসবেধনপুত্ররও মৃত্যু হবারপর, তারপুত্র মোহাম্মদ এখনপীর বাড়িরনতুনপীর। এই নতুনপীরের নছিহত পেয়ে তোমার তো খুশি হওয়ার কথা, কিন্তু বিষঃ তুমি বললে, এই এখনকার ছেলেরা আসলে কিছু জানে না।

আমি না হয় সারাজীবন তোমার সঙ্গে অন্যায় করেও জীবনের শেষ কটা দিন তোমাকে একটু শান্তি দিতে চেয়েছিলাম। বাবা করলো তুমি অবকাশ থেকে জন্মের মতো চলে যাওয়ার পর। বাইরের মাঠে বড় সামিয়ানা টাঙিয়ে কী সব মিলাদটিলাদপড়া হল। প্রচুর খাওয়া দাওয়ার আয়োজন হল। ভিখিরিদের খাওয়ানো হল। খরচ বাবাই করলো। তাঁর মতো পাঁড় নাস্তিকের হঠাৎ ধর্মীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন করার কারণ কী আমি জানিনা। বাবা যেভাবে বলছে, দাদা সব করছে। আমিও দাদাকে যা আদেশ করেছিলাম, পালন করেছিলো। তোমার সামনে বসে একদিন অনেক হাসির গল্প শোনাতে বলেছি। দাদা শুনিয়েছে, প্রচুর হেসেছো তুমি। আমিও হেসেছি। হাসতে হাসতে, তোমার নির্মল হাসি দেখতে দেখতে চোখে জল এসেছে আমার। যেন নিজেরহাসিরকারণে চোখেজল এসেছে, এমনকরে চোখের জল মুছেছি। আমার ফুটফরমাশ দাদা বাধ্য ছেলের মতো শুধু ঢাকায় নয়, ময়মনসিংহেও খেটেছে। দাদাকে দিয়ে শীতলপাটি, এটাসেটা, গুলকিবাড়িরপীর আর তার মুরিদদের জন্য প্রেসক্লাবের বিরিয়ানি, অক্সিজেন সিলিণ্ডার, স্যালাইন, ওষুধপত্র সব আনিয়েছি। ছোটদাকে দিয়ে এসব কাজ সম্ভব হত না। সে উড়ে এসেছে। তোমাকে মাটি দেওয়ার জন্য, জানাজা পড়ার জন্য। তখন তার ছুটি, এমনকী অবকাশেও দুটো দিন বেশ কাটিয়ে দিল। তুমি বেঁচে থাকতে দেয়নি। আর আমি যখন তোমার কবরে একটি শ্বেত পাথরের এপিটাফ আর তোমার শিয়রের কাছে একটি শিউলি ফুলের গাছ পুঁতে দেওয়ার আয়োজন করছি, এত আদিখ্যেতা ছোটদা মোটেও পছন্দ করেনি। বিশেষ করে পছন্দ করেনি আমি যখন শরাফ মামাকে দিয়ে স্বদেশী বাজারে পাঠিয়ে সত্যি সত্যি তোমার এপিটাফ লিখিয়ে আনলাম, যেখানে লেখা ছিল–অনাহারে, অবহেলায়, অপমানে, অনাদরে যার সারা জীবন কেটেছে সেই দুঃখবতী নারী শুয়ে আছে এখানে। বেগম ঈদুল ওয়ারা। বয়স ষাট। শরাফ মামা লিখিয়ে আনলো, তবে ওপরে আরবিতে কিছু একটা জুড়ে দিয়ে। কী? না, কবরের ফেরেসতাকে সালাম জানানো, ওটা নাকি দিতেই হয়, সব এপিটাফেই দেওয়া থাকে। শরাফ মামার এ কাজটা সংগত কারণেই আমার ভালো লাগেনি। বড় মামারও লাগেনি। শরাফ মামাকে বললোও বড় মামা ‘তোকে তো আরবিতে সালাম জানানোর কথা লিখতে বলা হয়নি। এটা তো বিশ্বাস ভঙ্গ করা।’ শরাফ মামার নিজের বিশ্বাস শ্বেতপাথরে চাপিয়ে দেওয়া হল। ছোটদার বক্তব্য আমি পরিবারের মাথা নিচু করে দিতে চাইছি, মা অনাহারে ছিলো না, মাকে অবহেলা কেউ করেনি, মা সারাজীবন খুব সুখে কাটিয়েছে। এত বড় মিথ্যে আমি লিখেছি কেন, এই এপিটাফ কোথাও যাবে না। আমি বললাম, যাবে। ছোটদার প্রচণ্ড বিরোধিতা সত্বেও টুটু মামা, শরাফ মামা আর ছটকুর সহযোগিতায় কাজটা করি আমি। ওই এপিটাফই একটি স্তম্ভ বানিয়ে লাগানোহল। একটু হলেও স্বস্তি পাই। বড় মামা এপিটাফে তোমার ষাট বছর বয়স দেখে চমকে উঠেছে। বয়সতিন বছর বাড়িয়ে দিয়েছি আমি। বয়স তখনও বড়মামারইষাট হয়নি। বড় মামার আর তোমার জন্ম সাল লেখাপুরোনো নথি বের করে দেখালেন, বয়স তোমার সবে সাতান্ন হয়েছিলো। মামাদের বলেছিলাম, শ্বেতপাথরে লেখার লোক এনে ষাটকে সাতান্ন করে দিতে। জানিনা দিয়েছে কী না। জানি না তোমার শিয়রেপুঁতে দেওয়া গাছটিতে ফুল ফুটেছে কিনা। কবরে আমার আকর্ষণ নেই। তুমি ওখানে নেই মা। ওই মাটির নিচে কবেই তোমার ঠান্ডা শরীরটাপচে গেছে। তোমার হাতপামুখ, তোমার পা, পায়ের আঙুল, জন্ম থেকে চেনা তোমার ওই শরীর আমিশত চাইলেও দেখতে পাবো না। তুমি কোথাও নেই মা। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কোথাও নেই মা। এপিটাফ, শিউলি ফুলের গাছ সবই আমার জন্য, আমার শান্তির জন্য। আমার প্রায়শ্চিত্তের জন্য।

.

দুদিন পর নানি বাড়ি গিয়েছিলাম। নানির সঙ্গে বিছানায় শুয়ে শুয়ে বলেছি তোমার কথা। নানি ক্রমাগত কেঁদেই চলেছে। কেঁদে কেঁদেনানি একটাই কথা বলে, ঈদুন তো নাই, আমারে দেখার কেউনাই। নানিবাড়িতে সবাই আমাকে খুব আদর করলো। আদর করলোকারণআমি নিরন্তর তোমাকে সঙ্গ দিয়েছি, সবার কাছে অভাবনীয় যে সেবা, সে সেবা করেছি। কেউ কেউ বললো, তুমি নাকি খুব ভাগ্যবতী, আমার সেবা পেয়েছে। এসব শুনলে আরও অপরাধ বোধ জাগে, আর কেউ না জানলেও আমি তো জানি, এই সেবা অর্থহীন। নানিবাড়ি থেকে তোমার লেখা আরবি গ্রামারের বড় বড় খাতা নিয়ে এলাম। অবকাশে তোমার নতুন রং করা আলমারিতে তোমার সব জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখলাম, তোমার বই খাতা, তোমার কাপড়চোপড়, তোমার ব্যবহারের জিনিসপত্র। তোমার লেখা চিঠিপত্র। চিরকুট। মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে লেখা পত্রিকায় পাঠানো চিঠির খসড়া। তুমি চিঠি লিখতে, আমার মা হিসেবে নয়, পাঠক হিসেবে, একজন সচেতন মানুষ হিসেবে লিখতে, তসলিমার ফাঁসি যারা চেয়েছে, তারা ইসলামের কিছুই জানে না। তারা মুসলমান নামের কলংক। একজন সংবেদনশীল সৎ লেখককে আজ বাধ্য হয়ে দেশ ছাড়তে হয়েছে। আর দেশের ভেতর ইসলামের নামে যে অসহিষ্ণু মোল্লাতন্ত্র মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে, তারাই ইসলামের ক্ষতি সবচেয়ে বেশি করছে। ইসলামকে তসলিমা বিপন্ন করেনি, মোল্লাতন্ত্র করছে। সরকারের কাছে আমরা দাবি জানাচ্ছিতসলিমাকে দেশেফিরিয়ে আনুন। তসলিমাকে তার মায়ের কোলে ফিরিয়ে দিন। …এসব পড়ে চোখ আমার বারবার জলে ভিজেছে। কেউ কি ভালোবেসেছে আমাকে অমন করে, সংসারের কেউ? তুমি ছাড়া আমার কেউ ছিলো না। এ কথা আমি কোনওদিন জানিনি, যে, তুমি ছাড়া আমাকে ভালোবাসার কেউ ছিল না। কী যে খালি খালি লাগছিল আমার। কী যে শূন্য লাগছিল জগৎ। কী যে অন্ধকার লাগছিলো চারদিক, কী করে বোঝাবো তোমাকে। এখনও লাগে মা, এখনও। আমি আমার শূন্যতার কথা ভেবে কাঁদি না। যখন কাঁদি, জীবনে যে কষ্ট তুমি করেছে, সে কথা ভেবেই কাঁদি। তোমার কষ্ট লাঘব করার কত সুযোগ আমার ছিল, লাঘব করিনি। সেই বেদনায় কাঁদি আমি।

মা, অবকাশ থেকে তুমি চলে যাওয়ার পর দুলুর মা এসেছিল। এই দুলুর মাকে সারা শহর লোক দিয়ে খুঁজিয়েছি। কোথাও তাকে পাওয়া যায়নি। আশেপাশের যত বস্তি আছে, সব বস্তিতে শুধু দুলুর মাকে কেন, আনুরমাকেও খুঁজিয়েছি। আনুর মা, তুমি বলেছিলে, নদীর পাড়ের কোনও এক বস্তিতে থাকে। কত জনকে বস্তি খোঁজ করতে পাঠিয়েছিলাম। খোঁজ করে ওদের পাওয়া যায়নি। ওরা এমনিতেই তোমার সঙ্গে দেখা করতে অবকাশে এসে শোনে যেতুমি নেই। দুলুর মা, আনুর মা দুজনই আকুল হয়ে কেঁদেছে তোমার জন্য। লোক দেখানো কান্না নয়, সত্যিকারের কান্না। মা, তোমার অনেক আত্মীয়র চোখে ওই জল দেখিনি, দেখেছি ওই দীন দরিদ্রর চোখে। ওরাই তোমার সত্যিকারের আপন ছিল, মা। ওরাই হয়তো তোমাকে বুঝতো। হয়তো তুমি দরিদ্র ছিলে, তাই।

.

মা, তুমি ফিরিয়ে নিয়েছিলে আমাকে দেশে। আর কারও পক্ষে সম্ভব হয়নি। এক তুমিই পেরেছিলে। কিন্তু তুমি জানোনা, যে, দেশ থেকে আমাকে দ্রুত বেরিয়ে যেতে হয়েছে। তুমি জানো, এখনও আমি দেশেই আছি। এটুকুই তো জেনে ছিলে। জীবন দিয়ে আমাকে আগলে রেখেছিলে। যেন কারও স্বার্থপরতা আমাকে স্পর্শ না করতে পারে। না, মা। দেশে থাকা আমার সম্ভব হয়নি। আমার নিরাপত্তার জন্য যেসব রক্ষী সরকার থেকে দেওয়া হয়েছিল, তাদের ঠেলে সরিয়ে যে কেউ আমাকে হত্যা করতেপারত। ময়মনসিংহের বারান্দার ঘরটার সোফায় বসেওরা ঘুমোতো। পায়ের কাছে পড়ে থাকতো ওদের লম্বা লম্বা পুরোনো রাইফেল। যে কেউ এসে রাইফেল তুলে নিয়ে দৌড় দিলে বোঝার ওদের কোনও উপায় ছিলো না। আমার মনে হয় না ওরা ঠিক জানত, ওরা ঠিক কী করতে এ বাড়িতে এসেছে। বাবা ওদের যত্ন করতো খুব, চা নাস্তা দিত। যখন ঢাকা যাবো, পুলিশের কারও সঙ্গে যাবার নিয়ম নেই। আমার তো কাজ নেই আর ময়মনসিংহে। তুমি নেই। অবকাশেআমার ঘরটি এখন শুভরঘর। ইয়াসমিনের ঘরটি সৌখিনের ঘর। বাবারঘরটিতেই হয়তো থাকা যেত। কিন্তু কদিন! অবকাশের সর্বময় কী এখন হাসিনা। বাবা হাসিনার হাতে সংসার ছেড়ে দিয়েছে, এ সংসারে আমি নিতান্তই ক্ষণিকের এক অতিথি। কিছুই আমার নয়। আমি এ বাড়িতে তোমার মতোই বাড়তি লোক। বড় একটি গাড়ি ভাড়া করে ওতে মামাদের নিয়ে, দাদা আর বাবাকে তুলে ঢাকা চলে গেলাম একদিন। টুটু মামা নিজ দায়িত্বে এনেছে লোহার ডাণ্ডা টাণ্ডা, তার ভাষায় অস্ত্র, সস্ত্র, মেঝেয় ঢাকা দেওয়া কালো কাপড়ে। আমার নিরাপত্তা রক্ষীর কাজ তারাই করছে। এতে নিরাপদ বোধ করেছি কিছুটা, বাকিটা স্বস্তি। স্বজনদের সতেজ সমর্থন আমাকে সবটাই স্বস্তি দেয়। মামারা আমাকে কাছের মানুষ বলে বেশি মনে করছে। যেশরাফ মামাকে মালোয়েশিয়া থেকে আমার বাড়িতে একদিন আশ্রয় দিয়েছিলে বলে হেন কটু কথা নেই তোমাকে বলিনি, সেই শরাফ মামাকে তোমার সামনে আমি যত্ন করে খাইয়েছি। ওই পাপের প্রায়শ্চিত্ত করেছি, মা। তোমার মনে কষ্ট দেওয়ার প্রায়শ্চিত্ত। তুমি যে তোমার আদরের বাবা মা ভাই বোনের চেয়েও আমাকে বেশি ভালোবাসতে, তা আমার বোঝা হয়েছে তুমি যখন কাউকেই আর কাছে ভিড়তে দিতে চাওনি। এমন কি নানিকে, ঝুনু খালাকেও। ওরা তো তোমার আপন ছিল খুব। তুমি ভেবেছিলে, ওরা বোধহয় ওদের স্বার্থের কারণে, ।আমার কাছ থেকে টাকা পয়সা নেবার কারণে তোমাকে দেখতে আসছে। আর আমি যেহেতু খুব দরদী, আমার যা আছে সব উজাড় করে দেব ওদের জন্য। না, মা। ওই আশংকাতুমি না করলেও পারতে মা। তোমার মা বা বোন কেউ অত স্বার্থান্ধ নয়, যত তোমার নাড়িছেঁড়াপুত্রধন কামাল, আমার ছোটদা। তোমার মা, বোন কেউ আমার কাছে কিছু চায়নি।

আমি তো দেশে ফিরেছিলাম মা। তুমি আমাকে ফিরিয়েছিলে। দেশেই থাকতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তুমি জানো না কী ভীষণ কাণ্ড ঘটেছে হঠাৎ একদিন। ভালো যে, ঘটনাটা তুমি দেখোনি। দ্বিতীয়বারের দেশ ছাড়াটা তোমাকে যে দেখতে হয়নি, তা একদিক থেকে ভালো। কবি শামসুর রাহমানের বাড়িতে কে বা কারা রাতের অন্ধকারে ঢুকে অতর্কিতে কুড়োল টুড়োল নিয়ে আক্রমণ করেছিল, মেরে ফেলা উদ্দেশ্য ছিল, উনি অল্পের জন্য বেঁচে গিয়েছেন। কিন্তু পুলিশ ওই আততায়ীদের ধরে হাজতে নিয়েছে, এবং যা আবিষ্কার করেছে, তা শুনে তুমি চমকে উঠবে। আততায়ীরা হরকাতুল জেহাদ নামের একটি ধর্মীয় সংগঠনের লোক। নতুন এইইসলাম-বাঁচাও দল গড়ে উঠেছিল সেইনব্বই দশকের প্রথম দিকে। এই হুজির সন্ত্রাসীদের পেটের খবর পুলিশ নিয়েছে, এবং পকেটে যে ওদের সেই কাগজটা পাওয়া গেছে, যাদের হত্যা করার আদেশ ওদের নেতারা দিয়েছে। যাদের হত্যা করতে হবে, তারা হল, ১. তসলিমা নাসরিন, ২. শামসুর রাহমান, ৩. কবীর চৌধুরী আর ৪. ইসলামিক ফাউণ্ডেশনের একজন, মাওলানা আবদুল আওয়াল। তুমি বলতে পারো আমাদের মধ্যে আবার মাওলানা কেন। হতেই পারে। এই মাওলানার সঙ্গে হুজির ইসলামপন্থীদের মতপার্থক্য আছে, তাই। আমার নাম একনম্বরে। পত্রিকাগুলোর সবচেয়ে বড় সংবাদ এটি। আমি সত্যি বলতে কী মা, ভয় পেলাম। যদি হুজির সন্ত্রাসীরা আমার বাড়িতে এসে আমাকে মেরে ফেলে! কে আটকাবে? কোনও পুলিশ নেই বাড়ির সামনে বা দরজার সামনে। আর থাকলেই বা কী! যে কেউ ঢুকতেপারে বাড়িতে পুলিশ কাউকে কোনও বাধা দেয় না। তারা ঠিক জানেও না কী কারণে তাদের বসানো হয়। আগে যখন পুলিশ ছিলো, ওদের বলেছিলাম, দিব্যি ঘুমোচ্ছিল, ঘুম থেকে ডেকে তুলে, কী কারণে আপনারা এখানে বসেছেন? ওরা সরল মুখে বললো, থানা থেকেপাঠিয়েছে। কী কারণে পাঠিয়েছে, জিজ্ঞেস করায় বললো, তারা জানে না। যারা এ বাড়িতে ঢুকতে চায় তাদের তল্লাশি করার কোনও কথা কি বলেছে? ভালো মানুষ পুলিশেরা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে বললো, না। আমার নাম বললাম, এই নামের কারও কথা কি তারা শুনেছে? তাও বললো, না। এমনই আতংক এসে নাছোড়বান্দার মতো বসেছিলো যে কবীর চৌধুরীকে ফোনে জিজ্ঞেস করলাম, তাঁর বাড়িতে আমি চলে যাব কী না। আমার বাড়িতে মোটেও স্বস্তি বোধ করছি না। কবীর চৌধুরীর বাড়িতে পুলিশ পাহারা বসেছে। এদিকে দূতাবাস থেকে আমাকে ক্রমাগতই জানোনো হচ্ছে যে এক্ষুনি আমাকে দেশের বাইরে চলে যেতে হবে, কারণ তাদের কাছেও খবর এসেছে যে আমাকে মেরে ফেলারসবরকমপরিকল্পনা করা হয়ে গেছে।

.

ফরাসি রাষ্ট্রদূত বাড়িতে এসে বলে গেলেন দেশ ছাড়তে। কী একটা আমন্ত্রণপত্রও দিয়ে গেলেন। ফ্রান্সের ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি থেকে আসা আমন্ত্রণপত্র, যার কথা আগেই বলে তাগাদা দিয়েছিলেন আমাকে। এর মধ্যেই হঠাৎ নতুন একটি মামলা উঠলো আমার বিরুদ্ধে। নির্বাচিত কলাম বইটা লেখার অপরাধে, গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হল। ওই একই মামলা, ২৯৫ এ। লোকের ধর্মীয় অনুভূতিতে আমি আঘাত দিয়েছি। মত প্রকাশের বিরুদ্ধে একটি গণতান্ত্রিক দেশে এই আইন কী বিচারে থাকে, জানি না। আমাকে আবারও কোর্টে যেতে হল জামিন নিতে। আবারও সেই হুড়োহুড়ি করে জীবনের প্রচণ্ড ঝুঁকি নিয়ে কোর্ট থেকে দৌড়ে পেছনের দরজা দিয়ে গাড়িতে ওঠা। মিডিয়া আর মৌলবাদীর হাত থেকে বাঁচা। বই লেখার অপরাধে আমার বিরুদ্ধে অনেক মামলাই অনেক মৌলবাদী করেছে। কিন্তু হুলিয়া জারি হয়নি খালেদা সরকারের করা মামলা ছাড়া। এই আইন খাঁটিয়ে যখন মামলা করা হয়, অদ্ভুত জিনিস হল, সরকারি অনুমতি ছাড়া এই মামলা করার অধিকার কারও নেই। শেখ হাসিনার অনুমতি নিয়ে মামলা করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী এ দেশে আমাকে বাস করতে দেবেন না। বুঝি না, ক্ষমতায় এলেই কেন এঁরা দেশটাকে নিজের সম্পত্তি বলে মনে করেন। দেখমা, মানুষ খালেদা জিয়ারশাসনে এবং শোষণে অতিষ্ঠ হয়ে শেখ হাসিনাকে চাইছিলো। কী পার্থক্য হাসিনা আর খালেদায়! তাঁদের নিজেদের মধ্যে মতবিরোধ থাকতে পারে, একজন আরেকজনের দুচোক্ষের বিষ হতে পারেন, নিরবধি চুলোচুলি করতে পারেন, একজনের পান থেকে চুন খসলে আরেকজন লাফিয়ে উঠে আরেকজনের গলা টিপে ধরতে পারেন, কিন্তু আমার ব্যাপারে তাঁরা একশভাগ একমত। আমাকে মেরে কেটে আমার সর্বনাশ করে তবে তাঁদের শান্তি। রাজনীতির লোক না হয়েও কী করে আমাকে রাজনৈতিক সন্ত্রাসের শিকার হতে হলে আমি ভাবি। ভেবেছিলাম এভাবেই থেকে যাবো দেশে। কিন্তু হুজির গোপন খুনের তালিকায় আমার নাম প্রথমে থাকা আর দূতাবাসগুলোর একই সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের চাপ সবই আমাকে আবার ঘরছাড়া করলো। ভালো যে তুমি এই ভয়ংকর ঘটনাটি দেখার আগেই চোখ বুজেছো। দেখলে তুমি যে কী ভয়ংকর কষ্ট পেতে, ভেবে আমি শিউরে উঠি।

দেশ ছাড়ার সিদ্ধান্তটি নিতে আমি শেষপর্যন্ত বাধ্য হই। যাবার দিন সন্ধেয় শরাফ মামা আর টুটু মামাকে কুড়ি হাজার টাকা দিই। আর বাকি কজনের জন্য সামান্য পাঁচ হাজার টাকা করে উপহার। আমি জানি, এই টাকাটা তাদের অনেক কাজে লাগবে। বিদেশের ভালো কোনও রেস্তোরাঁয় একবেলা খেলেই তো আমার দশ হাজার টাকা খরচ হয়ে যায়। বাবা আর দাদারা অসন্তুষ্ট মামাদের আমি টাকা দিয়েছি বলে। যত টাকা বাড়তি ছিলো হাতে, তা বাবার পকেটে ঢুকিয়ে দিয়েছি। মামাদের সব মিলিয়ে যা দিয়েছি, তার চেয়েও বেশি বাবাকে। বাবা তো টাকা পয়সা খরচ করে না। বাবাকে যা দিই, সবই হয় দাদা নয়তো ছোটদার পকেটে চলে যায়।

আমি তখন না জানলেও এখন তো জানি যেতুমি সবচেয়ে বেশি আপন ছিলে। তুমি নেই। বাবাকে আপন যত ভাবি, বাবা হয়তো তত ভাবে না। তারপরও, বাবার অমঙ্গল আমি কিছুতেই কামনা করতে পারিনি। চেয়েছি বাবা সুস্থ থাকুক, ভালো থাকুক, আনন্দে থাকুক। যেভাবেই থাকুক, খুশি থাকুক।

.

আবার সেই আগের মতো। ঢাকা থেকে স্টকহোম। চুরানব্বই সালের আগস্ট মাসে এভাবেই দেশ থেকে বেরোতে হয়েছিল। যেসুইডেনে তুমি ছিলে, আমারপক্ষে সেই সুইডেনে, সুয়েনসনের যে বাড়িতে তুমি ছিলে, আমার পক্ষে সেই বাড়িতে বাসা করা অসম্ভব হয়ে উঠলো। তোমার স্মৃতি, তোমার অসুখ, তোমার চিকিৎসা না হওয়া, তোমাকে বড় চিকিৎসকের কাছে না দেখিয়ে বাড়িতে বসিয়ে রাখা, গ্রামেরপথেপথে অনর্থক ঘোরাঘুরি করা, তোমাকে কষ্ট দেওয়া সব মাকড়শার জালের মতো আমাকে আঁকড়ে ধরে আমাকে খেয়ে ফেলতে লাগলো। ওই জালে তড়পাচ্ছি, আর তখন আমন্ত্রণ এলো ফ্রান্স থেকে। ক্লদ ভাইজ নামের এক ফরাসি চলচ্চিত্র পরিচালক তাঁর সিনেমা-পরিচালক সংস্থার পক্ষ থেকে আমাকে আমার শোধ বইয়ের চিত্রনাট্য লেখার জন্য ফ্রান্সের নরমাণ্ডির মুলাঁ দন্দেতে আমন্ত্রণ জানালেন তিন মাসের জন্য। ওখানে বসে আমাকে চিত্রনাট্য লিখতে হবে সিনেমার জন্য। জীবনে কোনওদিন চিত্রনাট্য লিখিনি, কিন্তু রাজি হয়ে গেলাম, রাজি হলাম সুইডেন নামের নিষ্ঠুর দেশটাকেআর সইতে পারছিলাম না বলে। সুইডেনের ওই বাড়িতে তোমার স্পর্শ লেগে থাকা তোমার বিছানা বালিশ, তোমার গুছিয়ে রাখা কাপড়চোপড় দেখে আমার দম বন্ধ দম বন্ধ লাগছিলো। মনে হচ্ছিল ওই বাড়িটাকে আগুনে পুড়িয়ে দিই। নিজের বাড়ি হলে হয়তো তাই করতাম। একবার তোমার স্মৃতির জন্য ইচ্ছে করে থেকে যাই ওই বাড়িতে। আবার ওই একই স্মৃতির জন্য ইচ্ছে করে পালাই। আনন্দ বেদনা দুইই দেয় স্মৃতি। কাছে আসতে চাই, আবার দূরেও সরতে চাই। যেটুকু সুখ পেয়েছিলে সেটুকুই নিয়ে, ইচ্ছে করে, থেকে যাই। আবার বেদনার স্মৃতিগুলো আমাকে দূরে, অনেক দূরে সরে যেতে বলে। মনে হয় পৃথিবীর অন্য পারে গেলে হয়তো স্বস্তি মিলবে। ইচ্ছে করে সুয়েনসনকে কুড়োল দিয়ে কুপিয়ে মেরে ফেলি, আবার মনে হয় কী লাভ মেরে ফেলে! দোষ তো আমারই। আমি কেন তার সাহায্যের আশায় বসে ছিলাম। দোষ আমার নির্বুদ্ধিতার। আমি না হয় নির্বোধ, লোকটা যদি ওই সময় সামান্য সহযোগিতা করতো, তুমি আজ বেঁচে থাকতে পারতে। সুয়েনসনের চেহারা দেখতে শুধু রাগ নয়, আমার ঘেন্না হচ্ছিল। আমি ফ্রান্সে চলে গেলাম।

.

ফ্রান্সের নরমান্ডিতে জীবন শুরু হল আমার। সে অন্যরকম জীবন। আমি মুলাঁ দন্দেতে এলাম বটে, কিন্তু আর যা কিছুই লিখি, চিত্রনাট্য লেখা আমার আর হয়ে ওঠে না। বিশাল এলাকা জুড়ে সুজান লিপনস্কি নামের এক সুন্দরী ফরাসি মহিলা মুলাঁ বা মিল বা কারখানার মালিক। আমাদের দেশে না হলেও ইওরোপের সভ্য দেশগুলোয়পুরোনো বাড়িঘর বা ইতিহাসের মূল্য হীরের চেয়েও বেশি। পুরোনো আমলে জলের ওপর বড় কাঠের চাকা বসানো হত, সেই চাকা জলের স্রোতে ঘুরলে, চাকার সঙ্গে লাগানো কাঠের গুঁড়িতে স্রোতেরশক্তিটা এসে বসতো, সেই শক্তি কাজে লাগিয়ে গম ভাঙিয়ে আটা করতে লোকে। আরও অনেক কাজে ওই শক্তি ব্যবহার করা হত। মেশিন আবিষ্কার হওয়ার পর ওই মিলগুলোপুরোনো দিনের ইতিহাস হয়ে রয়ে গেছে। জলের ওপর সেই চাকাগুলো ছবির মতো স্থির হয়ে আছে। এক একটি মিলই এখন এক একটি জাদুঘর। প্যারিস শহরে মুলাঁ রুজ বলে একটি বিখ্যাত ক্যাবারে আছে। সেই ক্যাবারে বাড়ির মাথার ওপর মাথা উঁচিয়ে আছে লাল চাকা। নরমাণ্ডির মিলটি উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছেন সুজান। কিন্তু এলাকা জুড়ে প্রচুর ঘরবাড়ি উনি নিজের কাজে ব্যবহার না করে, বিক্রি না করে শিল্পীদের বাড়ি বানিয়েছেন। ঘরবাড়িগুলো এখন শিল্পী সাহিত্যিকদের বাসভবন। তিন মাস থেকে শুরু করে এক বা দু বছর এখানে সঙ্গীতশিল্পী, চলচ্চিত্র পরিচালক, চিত্রনাট্যকার, লেখক বাস করবেন। থাকা খাওয়ার জন্য খরচ দিতে হয়, দিতে পারলেই যে তোমাকে নির্বাচন করা হবে তা নয়। অনেকে আবেদন জানায়, কেউ কেউ নির্বাচিত হয়। আমার খরচ পোষাবেদ ভাইজের সিনেমা পরিচালক সংস্থা। আমাকে মুলাঁ দন্দেতে চমৎকার একটা ঘর দেওয়া হয়। ঘরে যা কিছু দরকার লেখালেখির জন্য, সবই দেওয়া হয়। কমপিউটার, প্রিন্টার। টেবিল চেয়ার তো আছেই, বিছানা বালিশ সব। কাজের লোক আছে, অনেকটা হোটেলের মতো। ঘর দোর সাফ করে দিয়ে যায়, বিছানার চাঁদর পাল্টেদিয়ে যায়, স্নানঘরে তোয়ালে দিয়ে যায়। সেইন নদীর পাড়ে বাড়িগুলো। বাড়িগুলোর মাঝখানে বিশাল খাবার ঘর, ওখানে দিনে তিনবেলা সবাই বসে এক সঙ্গে খায়। কড়িকাঠ বসানোপুরোনো বাড়িগুলো দেখতে পর্যটকের ভিড় জমে যায়। লোকে দেখতে আসে মিল। বিখ্যাত ফরাসিপরিচালক ফ্রাসোয়া তুফোর বিখ্যাত ছবি জুলি এণ্ড জিমের সুটিংও এখানে হয়েছিল। ছবিটি মিলে বসেই দেখেছি। মিলে সিনেমা দেখার ঘরও আছে। প্রচুর ভিডিও ক্যাসেট আছে সিনেমার। সিনেমার সঙ্গে জড়িত লোকদের মধ্যে অনেকেই সত্যজিৎ রায়ের কথা জানে। উচ্চারণ করে শেতাজিত রায়। জেনেছি সত্যজিতের জলসাঘর ছবিটা ওদের সবচেয়ে পছন্দের ছবি। আধুনিক একটি অডিটোরিয়াম আছে, ওখানে ধ্রুপদী সঙ্গীতের আসর বসে। নানা দেশ থেকে সঙ্গীত বিশারদরা আসেন। সেইন নদীর পাড়ে গাছগাছালিতে ছাওয়া এইপুরোনো মিলের বাড়িগুলোয় নিশ্চিন্তে নিরাপদে নির্ভাবনায় নিরিবিলিতে শিল্পীরা কাজ করে যাচ্ছেন, আর দেখ এমন সুন্দর জায়গায় বসে আমার লেখা হয় না। আমার শুধু তোমার কথা মনে পড়ে। রাশিয়ার শিল্পী ম্লাদিমির এর সঙ্গে আলাপহল, ও ওখানেইঅনেক বছর ধরেআছে। কেউ কেউ সারাজীবনের জন্য থেকে যায়। মরিস নামের ফরাসি এক লেখক আমি যে দোতলার ঘরে থাকি, তাঁর নিচের তলাতেই থাকেন। ওঁর এটাই বাড়িঘর, এখানেই বাকি জীবন কাটাবেন। যারা এখানে জীবনভর থাকবেন বলেপণ করেছেন, এই শিল্পী-বাড়ির পরিচালনার দায়িত্বও তাদের কিছুনা কিছু দেওয়া হয়েছে। ব্লাদিমিরকে দিয়ে তোমার একটি বড় পোট্রট করিয়েছি মা। তেল রঙের ছবি। পাঁচ হাজার ফ্রাঁ নিয়েছে। তুমি তো আর নেই। তোমাকে সামনে বসিয়ে ছবি আঁকার সৌভাগ্য ম্লাদিমিরের হয়নি। তোমার একটা ছবি দিয়েছিলাম ওকে, সেই ছবিটাই ছিলো শিল্পীর সম্বল। তোমার ছবির দিকে অপলক তাকিয়ে থাকতে থাকতে ভাবি, কী সুন্দর ছিলে তুমি। মা, তুমি কি এখন শুধুই ছবি!

মিলে যে শিল্পীরা থাকেন, তাঁরাই যে খাবার খান তা নয়। প্যারিস থেকেও অনেক শিল্পীরা আসেন দুপুর বা রাতের খাবার মিলের শিল্পীদের সবার সঙ্গে বসে খাওয়ার জন্য। এই মিলেই প্রতি খাবারের সময় ফরাসিদের মতো ওয়াইন আর পনির খাওয়া আমার শেখা হয়। ফরাসি খাবারের প্রতি ভালোবাসা এই মিলেই জন্ম নেয়। ফরাসি অনেকের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়। আমি ফরাসি দেশে এক জনপ্রিয় লেখক। জনপ্রিয়তাটা টের পাই। আমার সঙ্গে কথা বলার জন্য ফরাসিরা উন্মুখ হয়ে থাকে। কিন্তু ওদের যেমন ভাষা সমস্যা, আমারও। ওরা শুধু ফরাসি জানে, এদিকে আমি ফরাসির কিছুই জানি না। আমাকে ফরাসি ভাষা শেখানোর গুরু দায়িত্ব মিরিয়াম মর্তু, শিল্পী-বাড়ির পরিচালক, সুজানের সহকর্মী নিজেই নিয়েছে। আমার বেশ সখ্যও গড়ে ওঠে মিরিয়ামের সঙ্গে। এই গড়ে ওঠার পেছনে পরিশ্রম একা মিরিয়ামের। সারাক্ষণ, দিন রাত, সে আমাকে নিয়ে ব্যস্ত। পরিচালকের কাজ, সে কী কম কাজ! কিন্তু কিছুই সে করবে না। আমার অনেকগুলো বই কিনে এনেছে, সেগুলোপড়ছে। বাকিটা সময় আমাকে নিয়ে বেড়াতে বেরোচ্ছে, ফ্রান্সের উত্তরে যে শহর বা গ্রাম আছে, সব দেখাচ্ছে। আর আমার সঙ্গেই তার দিন রাত। আমার মতো সিগারেট ফোঁকে সে। তবে আমার চেয়ে দ্বিগুণ ফোঁকে। এর মধ্যে এই মেয়ে আবার আমার গভীর প্রেমে পড়ে বসে আছে। এদিকে কানাডার এক লেখক পিয়ের লরু, অসাধারণ সুন্দর দেখতে যুবক, তার দিকে চোখ পড়ে আমার। সে যুবকেরও চোখ পড়ে আমার দিকে। দুজন আমরা এক সঙ্গে হাঁটতে বেরোই। ফাঁক পেলেই গল্প করি। মিরিয়ামের কিছুতে সহ্য হয় না এসব। পিয়ের আমার ঘরে একদিন শ্যাম্পেন নিয়ে এলো, আমার জন্মদিন নাকি ওর জন্মদিন পালন করবে, মিরিয়াম এসে পিয়েরকে তাড়ালো। সে কিছুতেই আমার আশে পাশে নিজেকে ছাড়া অন্য কাউকে সহ্য করে না। দিন দিন অবাক হতে থাকি মিরিয়ামের অতিপ্রেমের নির্লজ্জ প্রকাশ দেখে। কিন্তু পিয়ের ছাড়া আর কারও জন্য আমার প্রেমের উদ্রেক হয় না। ইমানুয়েল নামের এক ফরাসি সঙ্গীতরসিক ভদ্রমহিলা আমাকে তার বাড়িতে নেমন্তন্ন করতে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। ইমানুয়েলের সঙ্গেও আমার বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। মিরিয়ামের তাও পছন্দ হয় না। কারও সঙ্গে মিশলেই তার সম্পর্কে মিরিয়াম আমাকে মন্দ কথা বলবেই বলবে। এরকম চরিত্র বাংলাদেশে মেলে জানতাম, এমন চরিত্র যে সুসভ্য দেশের ততোধিক সুসভ্য শিক্ষিত শিল্পী-বাড়িতেও মেলে, তা জানতাম না!

শিল্পী-বাড়িতে আমার খেয়ে দেয়ে গল্প করে গান শুনে সিনেমা দেখে আর ঘুরে বেড়িয়েই কাটে। যেখানেই যাই, যে কোনও সুন্দর জায়গায়, মনে হয়, আহ তুমি যদি দেখতে। যা-ই দেখি, মনে মনে তোমার চোখ দিয়ে দেখি। সমুদ্রের পাড়ে গেলাম একদিন। মন হু হু করে উঠলো। তোমাকে চেয়েছিলাম সমুদ্র দেখাতে, নিউইয়র্কে যখন ছিলে, ওয়ারেন অ্যালেন স্মিথকে বলেছিলাম আমার মাকে সমুদ্র দেখাতে চাই। শুনেই একটা গাড়ি যোগাড় করে নিয়ে এলো, প্রায় আশি বছর বয়স, ওই বয়সে নিজেই গাড়ি চালালো। কিন্তু মাইলের পর মাইল পাড়ি দিয়ে সমুদ্র নামের যে জায়গাটায় নিয়ে এলো, দেখেই আমার মন খারাপ হয়ে গেল। ঘিঞ্জি কনি আইল্যান্ড, বাচ্চারা চেঁচিয়ে খেলছে, রোলার কোস্টার চড়ছে, সমুদ্র অনেক দূরে। ওই সমুদ্রের কিনারে হেঁটে যাওয়াও তোমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। দূর থেকে এক চিলতে সমুদ্র দেখার কী মানে! আসলে ওয়ারেন সমুদ্র বলতে ওই জায়গাটা কেন বেছে নিয়েছিলো কে জানে, তুমি তো আর রোলার কোস্টার চড়বে না। ওয়ারেনের বুদ্ধিতে যা কুলিয়েছে, তাই করেছে সে। খুব বুদ্ধি করে সে আবার একখানা হুইল চেয়ার নিয়ে এসেছিলো, যেন তোমাকে ওই চেয়ারে বসিয়ে আমরা সমুদ্রের পাড়ে নিয়ে যেতে পারি। বালির ওপর দিয়ে ওই চেয়ার চালানো সম্ভব হবে না, তাছাড়া তুমিও চাওনি যেতে। হয়তো বিরক্ত হয়েছিলে হই চইএর বাজার দেখে। আমি ওয়ারেনকেও যে ধমকে বলবো ভুল জায়গায় এনেছো কেন। বলিনি। ওর আন্তরিকতা ছিল, এতে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু যেরকম চেয়েছিলাম, একটা উদার একটা উতল, অথৈ জলে যেন জগৎ ডুবে আছে, যেখানে স্নান করতে নেমে সূর্য তার আগুন নিবিয়ে ফেলে সন্ধেবেলা, এমন কিছু দেখাতে। আমার সেই সাধ অতলান্তিকের পাড়ের আমেরিকায় বসেও পূরণ হয়নি। ফ্রান্সের উত্তরে এত্ৰেতেত এর সমুদ্র দেখে তোমার কথা বড় মনে পড়ে। জল দেখতে দেখতে চোখ ভরে ওঠে জলে। চোখের জলের এক একটি কণায় তোমাকে হারানোর কষ্ট। নরমাণ্ডির অনেক জায়গায় চরকির মতো ঘুরি মিরিয়মের সঙ্গে। রুয়োঁয় গিয়ে জোয়ান অব আর্কের সেই গির্জা, যে গির্জার আঙিনায় ওকে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল, দেখে অবাক দাঁড়িয়ে থাকি। ধর্মের লোকেরা শতাব্দীরপর শতাব্দী এভাবেই মেয়েদের অত্যাচার করেছে, পুড়িয়ে মেরেছে। আজ না হয় এসব দেশে ধর্মের অত্যাচারের অবসান হয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে, শুধু আমাদের দেশে নয়, যে দেশগুলোয় মুসলমানের বাস, এখনও ভয়ংকর নিষ্ঠুরতা বহাল তবিয়তে বেঁচে আছে। জোয়ান অব আর্ক ছেলেদের পোশাক পরেছিলো বলে ওকে জেলে ভরেছে লোকে। সেদিনও সুদানে এই একবিংশ শতাব্দীতে লুবনা আহমেদ নামের এক মেয়ে ট্রাউজার পরেছিলো বলে ওকে জেল খাটতে হয়েছে। ওকে জোয়ানের মতো পোড়ানো হয়নি, তবে ওকে চাবুক মারার আদেশ দেওয়া হয়েছে।

নরমাণ্ডিতে জিভারনি নামের গ্রামে ফ্রান্সের বিখ্যাত শিল্পী ক্লদমনের বাড়ি দেখতেও ভালো লাগতো, ওটি এখন জাদুঘর, সেসব দৃশ্য এখনও আছে, শুধু ক্লদ মনে নেই, সেই বাগান, সেই লেক, সেই পদ্মপাতা, সেই মাঠ, সেই নদী দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, মানুষ থাকে না, কিন্তু মানুষের কাজ থেকে যায়। আমার লেখা, আমি মরে যাওয়ার পর টিকে থাকবেকী থাকবে না, অনেকে এ নিয়ে জল্পনা কল্পনা করে। এসবে আমার আগ্রহ একেবারেই নেই। বেঁচে থাকলে থাকবে, না থাকলে থাকবেনা। আমি অমরত্বে বিশ্বাস করি না। জীবনে যা দেখবো, জীবনে যা পাবো, তার মূল্যই আমার কাছে বেশি। মৃত্যুর পর কী হবে না হবে, তা নিয়ে আমার ভাবতেও ইচ্ছে করে না। বরং এই পৃথিবীর, এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কোথায় কী ঘটবে, বিবর্তন মানুষকেই বা কতদূর নেবে, এসব জানতেইচ্ছে করে। অনেকেতৃপ্তি পায় ভেবে তার শিল্প বেঁচে থাকবে হাজার বছর। এইপৃথিবীটাইকদিন বেঁচে থাকে দেখ। পৃথিবীর সবুজ যেহারে বিনাশ করা হচ্ছে, যেভাবে দূষণ ছড়াচ্ছে সবখানে, পাঁচ বিলিয়ন বছর আর অপেক্ষা করতে হবে না সূর্যের আলো ফুরিয়ে যাওয়ার জন্য। তার আগেই পৃথিবী ধ্বংস হবে। পৃথিবীতে এপর্যন্ত যত প্রজাতি জন্মেছে, তার নিরানব্বই ভাগই নিমূল হয়ে গেছে। নিয়ানডারথাল নামে একধরনের মানুষও ছিলোপৃথিবীতেও। আড়াইলক্ষ বছর বেঁচে থেকেওরাও জাতসুদ্ধ নেই হয়ে গেছে। মানুষ বলতে হোমোসাপিয়ানই আছে। এই মানুষই সভ্যতা গড়ে তুলেছে, অন্য সব প্রাণীর চেয়ে বুদ্ধি ধারণ করে বেশি, এই মানুষই মানুষ ভালোবাসে, আবার এই মানুষই মানুষ ধ্বংস করে। তুমি তো আফগানিস্তান বা ইরাকের যুদ্ধ দেখে যাওনি মা। যদি দেখতে, মানুষগুলোর জন্য কাঁদতে, যারা মরেছে, বা যুদ্ধে যারা সব হারিয়েছে। তুমি খুব অবাক হতে যারা দেশে দেশে বোমা ফেলে তাদের নিষ্ঠুরতা দেখে। তুমি তো মাটির মানুষ ছিলে। মানুষের এত নির্মমতা দেখেছো, তবু মানুষের নির্মমতা তোমাকে কাঁদায়। তুমি যেমন শক্ত হতে পারোনি, পাথর হতে পারোনি, আমিও পারিনি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *