০৪. তোমাকে নিয়ে এলাম বটে বাড়িতে

তোমাকে নিয়ে এলাম বটে বাড়িতে। কিন্তু কী করবো! বুকের ধুধু প্রান্তর জুড়ে হাহাকারের ঝড়। আমি তো তোমাকে সর্বাধুনিক চিকিৎসা দেবার জন্য দেশ থেকে নিয়ে এসেছি এই দূর দূরান্তে। এত দূর এসেছো, চিকিৎসা তো আমাকে করাতে হবে। উৎসুক অপেক্ষা করছে, জানি। তুমি বাঁচতে চাইছে, জানি। কতটুকু দুর্বল তুমি ভেতরে, কতটুকু শক্ত হয়ে আছো বাইরে, হাসছে, কথা বলছো, খাচ্ছো, গল্প করছো, বুঝি। মাঝে মাঝে মনে হয় চিৎকার করে সারা শহর ফাটিয়ে কাঁদি। কেউ নেই আমাকে সাহায্য করার। কেউ নেই তোমাকে বাঁচাবার। ডাক্তার আমাকে পরামর্শ দেয়নি নতুন ওষুধটি তোমাকে দেওয়ার। কিন্তু ডাক্তার বললেই আমি শুনবো কেন? সুইডেনের সাদা ডাক্তারদের আমি দেখে এসেছি কেমন চমৎকার তাদের চিকিৎসা। আমার ওই সাদা-মোহ আর নেই। ডাক্তারদের বিশ্বাস করাও আমি জানি যে আমার উচিত নয়। ডাক্তারের ওই তিন মাস বাঁচার ঘোষণা আমাকে দুমড়ে মুচড়ে, ভেঙে চুরে, আমার হৃৎপিণ্ড পিষে, আমার রক্ত শুষে নিয়ে, আমার মস্তিষ্ক কামড়ে, আমার ত্বক কেটে কেটে, আমার হাড়ে মজ্জায় আগুন ধরিয়ে, আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় ছিদ্র করে আমাকে ভয়াবহ মৃত্যুর সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়। যেন তুমি নও, আর মাত্র তিন মাস আয়ু আমার। যেন তোমার নয়, এ আমার মৃত্যুসংবাদ। নরকের গহ্বরে। কেউ আমাকে পেছন থেকে আচমকা ধাক্কা মেরে যেন ফেলে দিল। তার চেয়ে বোধহয় এই ভালো ছিল এই কুৎসিত খবরটি না জানা। তার চেয়ে বোধহয় এই ভালো ছিল আশায় আশায় থাকা। দেশেই থাকতে, কিমোথেরাপি চলতে থাকতো। জানতাম, অপারেশন হয়েছে, কিমোথেরাপিও কাজ করছে, জানতাম তুমি সুস্থ হয়ে উঠছো, উঠবে। দুঃসংবাদ শোনার চেয়ে না শোনাই ভালো। নিষ্ঠুর সত্য জানার চেয়ে সুন্দর মিথ্যে জানাও হয়তো ভালো। যদি এও না জানতাম, যে, তোমার ওই রোগটির নাম ক্যানসার! যদি না জানতাম লিভার পর্যন্ত ছড়িয়ে গেছে তোমার রোগ, যদি মূখের মতো সুখে থাকতে পারতাম! মা।

সারারাত আমি ঘুমোতে পারি না। বাবাকে ড্রইংরুমে শুতে দিয়ে আমি তোমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমোই। যে আদর তোমাকে সারাজীবন করিনি, সেই আদর করি। আমার বিশ্বাস হতে চায় না ক্যানসার হাসপাতালের ডাক্তারের কথা, আমি সবলে সর্বশক্তি দিয়ে অস্বীকার করতে চাই ডাক্তারের ভবিষ্যদ্বাণী। আমার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় না ঢাকার ডাক্তারের ডায়াগনোসিস। যদি ভুল হতো সব! টিউমারপরীক্ষা করতে গিয়ে এমন তো হয়প্যাথোলজির লোক ভুল করেছে। অ্যাডেনোকারসিনোমা বলেছে, আসলে অ্যাডেনোকারসিনোমা নয়, ক্যানসার নয়। লিভার মেটাসটাসিস বলছে, আসলে তা নয়। প্রতিদিন তো ডাক্তাররা রোগীর রোগ ধরতে ভুল করছে। তোমার রোগ ধরতেই কম ভুল তো ডাক্তাররা এ যাবৎ করেনি। তবে কেন এখন ভুল হবে না! কেন সব ডাক্তার হঠাৎ করে নির্ভুল হয়ে গেল। দেশে বিদেশে সবখানে!

পরদিন তোমাকে স্লোন কেটেরিং হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে সেই ট্রায়াল চিকিৎসাটি নিই তোমার জন্য। জাপানের কী একটা উদ্ভিদের নির্যাস। নাম, সিপিটি ইলেভেন। ইনজেকশন নিতে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হয় না। আমার সিদ্ধান্ত আমি নেব। টাকা দিচ্ছি, ইনজেকশন দাও। বিদেশে তোমার চিকিৎসা হচ্ছে, তোমার চেহারায়তি ফিরে এলো। বেশ খুশি মনেই হাসপাতালে গেলে। ভাবছিলে, চিকিৎসা নিশ্চয়ই আছে তোমার রোগের। রোগটা কী, এ পর্যন্ত তোমার সামনে কেউ উচ্চারণ করেনি। হয়তো ভেবেছিলে যে অপারেশনেরপরও যে পেটে একটা অস্বস্তি রয়ে গেছে, সেটা কাটাতে নিউইয়র্ক এনে চিকিৎসা করাতে হচ্ছে। ভেবেছিলে নাকি ঠিকই বুঝতে পেরেছিলে কী অসুখ হয়েছে তোমার! তখন না মনে হলেও এখন মনে হয় তুমি প্রথম থেকে ঠিকই বুঝেছিলে সব। এমনকী তুমি তো বলছোই যে ঢাকায় কিমোথেরাপি নেওয়ার পর শরীরটা তোমার ভালো লাগতো। ওইবিষ শরীরে নেওয়ারপর তোমার শরীর ভালো লাগার তো কোনও কারণ নেই, ভালো লেগেছিলো তোমার মন। কিছু একটু চিকিৎসা হচ্ছে, চিকিৎসা হওয়া মানেই কোনও না কোনও একদিন ভালো হয়ে ওঠা, গোপনে এই একটি বিশ্বাস তোমার ভেতরে কাজ করতো। অথবা কোনও আশা নেই, কিন্তু প্রাণপণে একটু আশার সন্ধান করতে। মা। খুব বাঁচতে চাইতে তুমি। সারাজীবন তুমি মৃত্যুর কথা বলেছো, আর যেদিন মৃত্যু সত্যি সত্যিই উপস্থিত হলো, একবারও উচ্চারণ করোনি মৃত্যুর কথা। জীবনের কথা বলতে। ভবিষ্যতের কথা বলতে। তুমি কি আমাদের ফাঁকি দিতে চাইতে, বোঝাতে চাইতে তুমি আদৌ জানো না কী রোগে আক্রান্ত তুমি? তোমাকে আমরা বুঝতে দিতে চাইতাম না তোমার অসুখের কিছু, তুমিও অভিনয় করতে যেন কিছুই জানো না। তুমি আমাদের স্বস্তি দিতে চাইতে না বোঝার অভিনয় করে। তোমাকে ওই অভিনয়টুকু করতেই হয়তো হয়েছিলো। নিজের জীবন দিয়ে আমাদের মুখে হাসি ফোঁটালে, নিজের জীবন দিয়ে আমাদের তুমি সুখ আর স্বস্তি দিয়ে গেলে। অবুঝের মতো থেকে গেলে। তুমি তো কিমোথেরাপির কথা বলেছো। বলেছো অপারেশনের পর তোমাকে ‘কিমো’ দেওয়া হচ্ছে। তুমি তো জানো হাশেম মামার লিভার ক্যানসার হয়েছে, তাকে কিমোথেরাপি দেওয়া হয়। সংক্ষেপে যাকে হাশেম মামা আর অন্যরা কিমো বলতো। কিমো শব্দটি তো ক্যানসার ছাড়া অন্য কোনও অসুখের চিকিৎসার বেলায় ব্যবহার করা হয় না। তুমি যে তোমার বেলায় দিব্যি ব্যবহার করলে! কাউকেই তো প্রশ্ন করোনি, তোমাকে স্যালাইনে ভরে যে ওষুধটি দেওয়া হচ্ছে। সেটিকে কি কারণে কিমো বলা হয়, কিমো তো ক্যানসারের ওষুধ! কাউকে অপ্রস্তুত করতে চাওনি বুঝি!

সিপিটির বিষ তোমার শরীরে বিষের ক্রিয়াই করেছিলো। স্যালাইনে একটু একটু করে ওই বিষ তোমার শরীরে ঢুকেছে। ট্যাক্সিতে যখন হাসপাতাল থেকে ফিরছিলাম, তোমার গা গুলিয়ে ওঠা শরীর নিয়ে তুমি চুপ হয়ে বসে ছিলে। মনের জোরে বসেছিলে মা। যখন জিজ্ঞেস করেছি, খারাপ লাগছে কি না। তুমি মুখে বলোনি, মাথা নেড়ে উত্তর দিয়েছো যে তুমি ঠিক আছে। আসলে তুমি প্রাণপণ চেষ্টা করছিলে, বিষ ধারণ করতে শরীরে। মনের শক্তি কি শরীরের ওপর সত্যিই খাটে! খাটলে তোমার বেলায় খাটতো। সুইডেনে না হয় ছোট ডাক্তাররা তোমাকে দেখেছিলো। আমেরিকায় তো সবচেয়ে বড় হাসপাতালের বড় বিশেষজ্ঞ তোমাকেপরীক্ষা করেছে। মনে তোমার তো শক্তি পাওয়ারই কথা। ডাক্তার তোমাকে সিপিটি ইনজেকশন দেওয়ার কথা বলেনি, এ আমার একার সিদ্ধান্ত, কিছুই তোমাকে বলিনি। তুমি তো ভেবেছিলে, ডাক্তারের পরামর্শে আমি তোমাকে ইনজেকশন দিচ্ছি। তোমাকে কত কিছু যে লুকিয়েছি! তোমাকে বুঝতে দিতে চাইতাম না যে আর কোনও চিকিৎসা তোমার নেই। বিশেষজ্ঞর পরামর্শ আমি মানিনি বটে, কিন্তু মনে মনে কি ধারণা করিনি যে ডাক্তার ভুল কথা বলছেনা! কিন্তু তারপরও হয়তো আমার অলৌকিকে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়েছিল। অথবা এ ছাড়া আমার কোনও পথ ছিল না। তাই বলে যে তোমাকে ঝাড় ফুক দেওয়ার কথা বলবো, তা তো নয়। তুমি যখন ট্যাক্সি থেকে নেমে আমাকে ভর করে হাঁটছিলে আমার সাত তলার অ্যাপার্টমেন্টের দিকে, আমাকে বলেছিলে, ‘এখন থেকে তোমার কাছেই থাকবো আমি। বাকি জীবন তোমার কাছেই। আমি আর কোথাও যাবো না তোমাকে ছেড়ে। কেন বলেছিলে? কারণ তোমার চিকিৎসা নিয়ে আমার ব্যস্ততা, ছুটোছুটি দেখে তোমার মনে হয়েছিল, তোমাকে খুব ভালোবাসি! তোমার কি মনে হয়েছিল, যে ভালোবাসে তার কাছেই তোমার থেকে যাওয়া উচিত। ভালোবাসাকেই মনে হয়েছিল তোমার আশ্রয়! আমার মনে হয় না আমাকে তুমি খুশি করতে ও-কথা বলেছিলে। তোমার তো সংশয় হওয়ার কথা বাকি জীবন আমার কাছে থেকে যেতে চাওয়ায় আমি চমকিত হতে পারি, কিন্তু পুলকিত হব না। সম্ভবত তোমার দৃঢ় বিশ্বাস জন্মেছিলো যে তোমাকে না ভালোবাসলে তোমার জন্য আমি কাঁদতে পারতাম না, আর তোমাকে দূর বিদেশে এনে অঢেল টাকা ঢেলে তোমার চিকিৎসা করতাম না। তুমি আমাকে খড়কুটোর মতো আঁকড়ে ধরেছিলে। কিন্তু বাড়ি ফিরে খুব বেশিক্ষণ তুমি ভালো থাকার অভিনয় করতে পারোনি। এমন বীভৎসভাবে বমি করলে যেন ভেতরে যা কিছু আছে সব ছিঁড়ে বেরিয়ে আসছে। সামনে দাঁড়িয়ে ওসব দেখার সাহস আমার হয়নি। বাবা তোমার শুশ্রূষা করেছে। ভীষণ জ্বর হলো রাতে। পরদিন স্লোন কেটেরিংএর ইমারজেন্সিতে নিয়ে গেলাম, ওই অসুস্থ তোমাকে, জ্বরে পুড়ে যাওয়া তোমাকে, শরীরে জল কমে গিয়ে যে তুমি প্রায় অবশ হাত পা পড়ে আছে। একটা স্যালাইন চালিয়ে দেওয়া হলো। স্যালাইন শেষ হবার পর ডাক্তার বললো তোমাকে যেন বাড়ি নিয়ে যাই। তুমি এত ক্লান্ত, উঠতে চাইছিলে না। তোমাকে বলেছি, বিছানা খালি করে দিতে হবে। যে তুমি সব কষ্ট সইতে পারো, আমার সব আবদার মেনে নাও, সে রাতে তুমি মানতে চাওনি। কতটুকু কষ্ট শরীরে হলে তুমি ওইনাছোড়বান্দার মতো থাকতে চাইতে পারো, সে বুঝি। বাকিটা রাত তুমি ভিক্ষে চাইছিলে মা, শরীরে তোমার এক ফোঁটা শক্তি ছিল না বিছানা থেকে ওঠার। তুমি কাতর অনুনয় করলে রাতটা যেন যেখানে আছে সেখানেই থাকতেপারো। হাঁপাচ্ছিলে, কথা ঠিকমতো বলতে পারছিলে নীলকণ্ঠ তুমি। আমি কাকে অনুরোধ করবো! কেউ জানে না আমি নিজে একজন ডাক্তার, কেউ জানে না আমি একজন লেখক। কেউ জানে না আমি কোনও অখ্যাত কিছুনই। এ দেশ থেকে দু দুটো বই বেরিয়েছে আমার। এদেশের বড় বড় পত্রিকায় আমার প্রশংসা করে প্রচুর লেখালেখি হয়েছে। এমনকী নিউ ইয়র্ক টাইমস, লস এঞ্জেলেস টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্টের মতো কাগজে সম্পাদকীয় লেখা হয়েছে আমাকে নিয়ে। কিন্তু যে লোকগুলো আমাকে চেনে না, তাদের কাছে গরিব দেশের বাদামি রঙের মেয়ে ছাড়া আমার আর কোনও পরিচয় নেই। আমার অসুস্থ মাকে ধাক্ক দিয়ে বেড থেকে নামাবেনা তো কী! অথচ এই শহরেই আমার বক্তৃতা শুনতে লোক ভিড় করেছে। এই দেশে আমি তো অচেনা কিছু নই। কত তো আমার পাঠক শুভাকক্ষী আছে। তারা সব কোথায়! তারা কোথায় আমি জানি না। আমি কারও কোনও খবর জানি না। সমগ্র বিশ্বে একটা বিন্দুর মতো আমি একা। আর তুমি, আমার মা, আমাকে নিশ্চিন্তি দেবে, নির্ভাবনা দেবে বলে নিজের অসুখের কথা বলেও যখন দেখেছো আমাকে ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে তোমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে, তুমি আর বলোনি। তুমি জোর করোনি। বলেনি যে তোমাকে ছোটখাটো ডাক্তার দেখালে চলবে না, বড় ডাক্তার দেখাতে হবে। তুমি আমাকে বিরক্ত করতে চাওনি। মৃত্যুকেই তুমি বেছে নিয়েছে। নিজের জীবন বিসর্জন দিয়েছে আমাকে ভারমুক্ত করতে, মা। তা ছাড়া আর কী, বলো। সে রাতে, ক্যানসার হাসপাতালের ইমারজেন্সিতে জ্বরে প্রায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকা তোমাকে একটা রাত শুধু মাত্র আর কয়েক ঘণ্টা শুয়ে থাকার অনুমতি যত চাইছি, তারা ততই বলে দিল, না হবে না, বেড খালি করে দিতে হবে। কী সুবিধে পাওয়ার জন্য এত টাকা অগ্রিম দিলাম তাহলে! না, ইমারজেন্সির ডাক্তার কিছুতেই শুনবেনা। হাসপাতালে ভর্তি করাবে না তোমাকে। শুধু লাত্থি দিয়ে তোমাকে নামাবে। এ সময় পাশে কেউ নেই। পাশে কেউই নেই মা। আমার মতো হতবুদ্ধি আর অসহায় তখন কেউ ছিল না। বিছানা থেকে করুণ ক্লান্ত তোমাকে নামিয়ে আনলাম। রাত তিনটেয় ট্যাক্সি ডেকে বাড়ি ফিরতে হলো। সারাপথ আমি কোনও কথা বলতে পারিনি তোমার সঙ্গে, পৃথিবীটাকে শুধু নির্মম মনে হয়নি, বড় নোংরা মনে হয়েছে।

আকাশের নক্ষত্ররাজির দিকে তাকিয়ে ভাবি তোমার কথা, খুব অনুতাপ করি তোমার সেরাতের কষ্টের জন্য। যদি তোমাকে ওভাবেই রাখতাম, বিছানা থেকে না নামিয়ে নিতাম, যদি ওই ডাক্তারের গালে জোরে একটা চড় কষাতে পারতাম, যদি পুলিশ ডাকতাম, যদি মামলা ঠুকে দিতাম! কিছুই করিনি। সুইডেনে তোমাকে চিকিৎসা করাতে গিয়ে আমি টাকার অভাব বোধ করেছিলাম। তখন থই থই কৃপণতা আমার। আর যখন তোমার চিকিৎসা না করিয়ে তোমাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিলাম, তখন আমি উদার হস্ত, আমার মতো দরদি আর দুটি নেই। তোমার অসুখ ধরাপড়ারপর আমাকে যদি কেউ বলতো তোমার মার ভালো চিকিৎসা হতে পারে, তোমার মা বেঁচে উঠবে, তোমার যা আছে সহায় সম্পদ সব দিয়ে দাও। আমি হয়তো তক্ষুণি সব দিয়ে দিতাম।

শ্লোন কেটেরিংএর আশা আমাকে বাদই দিতে হল। তোমার অবস্থা দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। সিপিটির বিষে তুমি নীল হয়ে যাচ্ছে প্রতিদিন। ইমারজেন্সির স্যালাইনও তোমাকে সুস্থ করতে পারলো না। আবার জ্বর হল তোমার। আবার বমি। তোমাকে অ্যাম্বুলেন্স ডেকে পাশের হাসপাতালে নিয়ে গেলাম, ওখানেও সারারাত ধরে স্যালাইন দেওয়া হল। তোমার গা থেকে জল হাওয়া হয়ে যাচ্ছে, কোথায় যাচ্ছে কেন যাচ্ছে কে জানে। শরীরের রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতাও কমে গেছে, বার বার কোথাও না কোথাও ইনফেকশন হচ্ছে তোমার, তাই জ্বর। ক্যানসার, মেটাসটেসিস, ভুল অপারেশন, কিমোথেরাপি, সিপিটি নামের জাপানি বিষ –সব তোমাকে গিলে খাচ্ছিল। অন্তত এই বোধটুকু আমার হয়েছে যে দেশ থেকে অতদূর বিদেশে এসে তোমার ক্ষতি ছাড়া লাভ কিছু হয়নি। আমি তো ক্ষতি তোমার করেইছিলাম দেশে, সুইডেনে, আবার অতদূরপথ পাড়ি দিয়ে আমারই ক্ষতির শিকার তোমাকে হতে হল। তোমার শরীরে আর যে ওই বিষ ঢোকানো চলবে না, সে আমি হাড়ে হাড়ে বুঝি। তিন মাস আয়ুর ভবিষ্যদ্বাণী আমাকে কানে বারবার হায়েনার হাসির মতো বাজতে থাকে। আমারও যেন গা থেকে জল কমে যাচ্ছে, সারা শরীর আমার কাঁপে, আশংকায়।

আমি তখন সেই কাজটি করি মা। তুমি জানো না কী করে আমি ফোন করতে শুরু করলাম দেশে। দেশে ডঃ কামাল হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। বললাম তোমার কথা, বললাম তোমাকে দেশে ফেরত যেতে হবে, বললাম, আমাকেও দেশে ফিরতে হবে। ডঃ কামাল হোসেন বললেন তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলবেন। জানি না তিনিই নাকি অন্য কেউ আমাকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ফোন নম্বর দিয়েছিলেন। আমি নিজেই ফোন করলাম তাঁকে। রফিকুল ইসলামকে আমি চিনি বৈকি। মুক্তিযোদ্ধা, বীর উত্তম খেতাব পেয়েছেন। একদিন আমার শান্তিবাগের বাড়িতে এসে মুক্তিযুদ্ধের ওপর তাঁর নিজের লেখা কিছু বই দিয়েছিলেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে যখন বললাম, যে, আমার মা অসুস্থ, আর মাত্র তিনমাস বাঁচবেন বলে ডাক্তার জানিয়ে দিয়েছেন, মার সঙ্গে তাঁর জীবনের শেষ দিনগুলো আমি কাটাতে চাই। মাকে নিয়ে আমি দেশে ফিরবো, যে করেই হোক আমাকে ফিরতে হবেই। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বললেন আমি নিশ্চয়ই ফিরতে পারি, কোনও অসুবিধে নেই। তারপরও, বললেন, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে নিতে চান। এর দুদিন পর তিনি আমাকে জানিয়ে দিলেন, যে, শেখ হাসিনার সঙ্গে কথা হয়েছে তাঁর। তিনি তাঁকে আমার মার আর মাত্র তিন মাস বাঁচার কথা বলেছেন কিন্তু হাসিনা চান না আমি দেশে ফিরি। সুতরাং, আমার ফেরা সম্ভব নয়। ফিরলে আমাকে বিমান বন্দর থেকেই বিদেশে ফেরত পাঠানো হবে, দেশে ঢুকতে দেওয়া হবে না। কী কারণ, কী অন্যায় আমি করেছি? নিরুত্তর ওদিকটা। অন্যায় আসলে কে কার সঙ্গে করছে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারেন। তাঁর ইচ্ছেয় হোক, অনিচ্ছেয় হোক আমাকে তিনি প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ জানিয়ে দিলেন, কোনও অবস্থাতেই যেন দেশে না ফিরি। বিমূঢ় বসে রইলাম। তোমাকে তো ফিরতেই হবে। তোমাকে দেশে ফেরত পাঠানোর কথাবার্তা চলছে শুনে লেমার বিস্মিত দুচোখ, দেশে কেন পাঠাবো, তোমাকে তো চিকিৎসার জন্য এদেশে আনিয়েছি, তবে চিকিৎসা না করে বিদেয় করতে চাইছি কেন? তোমার এই প্রশ্নটির উত্তর আমি তোমাকে দিতে পারিনি। কী দেব উত্তর, আমি কী বলবো মা, তোমার কোনও আর চিকিৎসা নেই? তোমাকে এখন দেশে গিয়ে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হতে হবে? বিদেশের মাটিতে তোমার মরার দরকার নেই, দেশে গিয়ে আত্মীয় স্বজনের মাঝখানে বসে তোমাকে মরতে হবে। আমার মনে হত, আত্মীয় স্বজনের ধরা ছোঁয়ার মধ্যে মত্যু হলে সেই মত্যু বুঝি চমৎকার হয়। কেন আমার মনে হয়েছিল ওসব? তোমার দুটো মেয়ে বিদেশে, তুমি কার কোলে মাথা রেখে মরার জন্য দেশে ফিরবে! কে আর কোল পেতে বসে আছে তোমার জন্য! যে আদর বাবা তোমাকে কোনওদিন করেনি, সে আদর করছে সে অসুখ ধরা পড়ার পর থেকে। বাবা তোমার সঙ্গে এক বিছানায় ঘুমোচ্ছে। তোমাকে রাতে রাতে উঠে বাথরুমে নিচ্ছে। তোমার সারা গায়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে, তোমার সঙ্গে নরম গলায় কথা বলছে, এসব ছেড়ে তোমার আর কোথায় যাওয়ার প্রয়োজন! বিশেষ করে সেই দেশে যে দেশে ফিরে গেলে তুমি আমাকে পাবে না, ইয়াসমিনকেপাবে না। কিন্তু জানিনা, আমার কেবলই মনে হচ্ছিল, দেশের আর সব আত্মীয়দের তুমি দেখ, চোখ বোজার আগে তোমার জন্য ফেলা তাদের চোখের জলও তুমি দেখ। তুমি দেখ, তোমাকে শুধু আমি নই, আরও মানুষ আছে ভালোবাসার।

কিন্তু দেশে ফিরে গেলে শেষ কটা দিন তোমার পাশে কে থাকবে মা! পৃথিবীটায় যে তুমি ভালোবাসা পেয়েছে, শুধুই আঘাত পাওনি, এ তোমাকে কে বোঝাবে? আমি সারাদিন ছটফট করি, সারারাত এপাশ ওপাশ করি। আমার আঙুলে একের পর এক সিগারেট পুড়তে থাকে। ভাবনা জট পাকিয়ে যায়, ভাবনাকে খুলে খুলে আলাদা করি। আবার জটপাকায়। তোমার যেমন সময় নেই, আমারও সময় নেই হাতে। নিউইয়র্কের সুইডিশ অ্যামবেসিতে ছুটে যাই, বলি আমি আপনাদের রাজনৈতিক আশ্রয় নিজ দায়িত্বে বাতিল করতে চাইছি, রাজনৈতিক শরণার্থীর জন্য জাতিসংঘের যেপাসপোর্ট আমার আছে, তাও আমি নিজ দায়িত্বে ত্যাগ করছি, আমাকে আমার বাংলাদেশের পাসপোর্টটি ফেরত দিন। জরুরি। দূতাবাস থেকে বলা হল, তাহলে আপনি কিন্তু আর ফিরেপাবেন না আপনার রাজনৈতিকশরণার্থীর সম্মান, এই জাতিসংঘের ট্রাভেল ডকুমেন্টও আর জুটবে না। আমি থোড়াই পরোয়া করি ওসবের। জীবনের ঝুঁকি আমি নেব, তবু আমার মার পাশে আমি থাকবো। নিরাপদ বিদেশ আর ততোধিক নিরাপদ বিদেশি পাসপোর্টে আমার কোনও মোহ নেই। আমি সমস্ত ত্যাগ করতে পারি নিমেষে। সুইডেনের দূতাবাস দ্রুতই আমার কথা রাখলো। সুইডেন থেকে জরুরি তলবে আনিয়ে দিল আমার পাসপোর্ট। ফেরত নিয়ে নিল জাতিসংঘের নথিপত্র। তখনও আয়ু আছে ওই পাসপোর্টের। এখন কিনতে হবে আমার দেশে যাওয়ার টিকিট। অন্য কোনও বিমানে আমার যাওয়া চলবে না, যেতে হবে বাংলাদেশ বিমানেই। কারণ তোমার আর বাবার বাংলাদেশ বিমানেরই ফেরত যাত্রার টিকিট। কিন্তু বিমানের টিকিট কাটতে আমি যদি বিমান অফিসে যাই, মুহূর্তে রাষ্ট্র হয়ে যাবে আমি দেশে ফিরছি। অন্য কাউকে দিয়ে টিকিট কাটালেও আমার নাম নিয়ে সমস্যা। এ নাম তো জগতে দ্বিতীয় কোনও ব্যক্তির নেই, এক আমার ছাড়া! মিলনকে পাঠালাম টিকিট কাটতে, তসলিমা নাসরিন নামে নয়, যেন টি, নাসরিন নামে টিকিট কাটে। তাই হল, বিমান অফিসের কেউ বুঝলো না এই টি. নাসরিনটি যে আসলে আমি। হতে পারে তৌহিদা নাসরিন, হতে পারে তাবাসসুমা নাসরিন। আমার যাবার খবরটি শুধু হাতে গোনা কজন জানে। বাবা, তুমি, ইয়াসমিন, মিলন, সুহৃদ। একজনের বাইরে আর কাউকেই আমি জানতে দিইনি। ছোটদার সঙ্গে প্রতিদিন ফোনে কথা হচ্ছে, তাকেও বলিনি যে আমি যাচ্ছি। বাংলাদেশে কোনও প্রাণী এ খবর জানুক আমি চাইনি। জানাজানি হয়ে গেলে মৌলবাদীদের প্রয়োজন হবে না, হাসিনা সরকারই আমাকে ছিঁড়ে খেয়ে ফেলবে, সরকারি আদেশ অমান্য করার অপরাধ কী যে সে অপরাধ!

ইয়াসমিন আর মিলন গেল বিমান বন্দরে বিদায় জানাতে। ইয়াসমিনকে বলেছি, এ তোর শেষ দেখা মাকে। শেষবার দেখে নে, ছুঁয়ে নে, মাকে যে ভালোবাসিস বারবার বল। যে কথা আমরা কোনওদিন বলিনি, সে কথা বলে দে। শেষবার। ইয়াসমিন কাঁদলো। তবে জানি না তুমি যে কদিন ছিলে নিউ ইয়র্কে, আমার বাড়িতে সে কেন অতিথির মতো আসতো, কিছুক্ষণ থেকেই তার যাই যাই শুরু হত। এক রাতও সে তোমার সঙ্গে ঘুমোয়নি! দিনে সে কাজ করতো। মুদির দোকানের ছোট কাজ। অনেক বলেছি কাজ টাজ বাদ দে, মার কাছে থাক। থাকেনি। তার টাকার দরকার। প্রচুর টাকা নাকি ধার করেছে দেশে যেতে গিয়ে, সুতরাং ধার শোধ করতে হবে। ধারের টাকা কত বল, আমি দিয়ে দিই, তবু মার কাছে থাক। মাকে আর কদিন পাবি। ডাক্তার বলে দিয়েছে তিন মাস মাত্র মা আছেন। তিন মাসের খবরটি যখন ছোটদাকেও জানিয়েছিলাম, কোনও প্রতিক্রিয়া দেখিনি। কী জানি, ওদের কাছে তিন মাসকে তিন যুগের মতো মনে হয়েছিল কি না। ইয়াসমিন তার কাজ থেকে ফিরে ভালোবাসাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠতো, ওর নাওয়া খাওয়া, ওর ঘুম, ওর কাপড় চোপড়। ভালোবাসাকে নিয়েই এখানে থাক, সবাই একসঙ্গে। না, ইয়াসমিনের যুক্তি ও খুব জ্বালায় সবাইকে। তা জ্বালাক। মার তো সঙ্গ চাই, মা তো ভালোবাসার জ্বালায় জ্বলছে না, তবে কেন! ইয়াসমিন একদিন তোমাকে নেমন্তন্ন করলো তার বাড়িতে। এতদিনে ওই একদিনেই সাত তলা থেকে তিনতলায় ওর বাড়িতে গিয়েছিলে। প্রচুর রান্না কান্না করেছিলো, সেসব খাওয়ালো সবাইকে। বাড়ি বলতে একটি মাত্র ঘর। মিলন ছোট কাজ করে, সে নিজেও ছোট কাজ ধরেছে। একটি ঘর ছাড়া কোনও বড় অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নেওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। ও খুশি হত ও যদি তোমাকে তার ঘর, তার দারিদ্র না দেখাতে পারতো। ও বোঝাতে চায় না যে ওর অল্প টাকা আয়, বোঝাতে চায় না যে আমেরিকায় সে এমন কোনও ভালো অবস্থায় নেই। ওর দারিদ্র দেখে তুমি আর বাবা দুঃখপাবে, হয়তো সে কারণে। নাকি অর্থ কড়ি নিয়ে ওর নিজের অহংকার করার কিছু নেই বলে ওই হীনম্মন্যতা! তোর মা আর মাত্র কটা দিন বাঁচবে। তোর কী আছে কী নেই, সেটার হিসেব না করলে কি চলে না রে ইয়াসমিন! জানিনা ইয়াসমিনের হীনম্মন্যতার এও কোনও কারণ ছিল কি না যে আমি যেমন পারছি, ও তোমার জন্য তেমন খরচ করতে পারছে না। ওর দেনার দায়, এই দায় আমার নেই। এর নাম কি তবে ঈর্ষা? তুমি অসুস্থ আর হঠাৎ করে ওর এমন তীব্র সংসারী হয়ে ওঠা, তোমাকে সময় দেওয়ার সময় না পাওয়া কেন! আমি খুব বিরক্ত হতাম ওর আচরণে, ওর না আসায়, না থাকায়। তুমি অনুযোগ করতে না। ও যেতে চাইলে ওকে যেতে দিয়েছো, বাধা দাওমি। একদিন জামার ওপর ও একটা ওড়না পরে এসেছিলো, আমি সঙ্গে সঙ্গে বললাম, এটা কোথায় পেয়েছিস, এটা তো আমার শাড়ি ছিলো। হ্যাঁ দেশে গিয়ে ও আমার শাড়ি কেটে ওড়না বানিয়েছে। শাড়ি দিয়ে কী করবো আমি মা, পাঁচশ শাড়ি পড়ে আছে দেশে। বিদেশে তো আমি শাড়ি পরি না। ওই পুরোনো সুতির সস্তা একটা শাড়ি কেটে যদি ও একটা ওড়না বানায়, যে জিনিসগুলো ব্যবহার হচ্ছেনা, সে যদি আমারই ছোট বোন ব্যবহার করে, তবে খুশিই তো আমার হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আমি বিরক্ত হয়ে বলেছিলাম, যেভাবে আমি আমার জিনিসপত্র রেখে এসেছি, সব সেভাবেই থাকুক আমি চেয়েছিলাম, এই চাওয়াটাকে মোটে মূল্য দিলি না। কেন বলেছিলাম মা? আগে না হয় বলেছি, দেশে ফেলে আসা আমার ঘর দুয়োর আমি সব আগের মতো ফিরে পাবো, এই স্বপ্ন হয়তো অনেক বড় স্বপ্ন নির্বাসিত এক মানুষের জন্য। কিন্তু তোমার ভয়াবহ অসুখটি হওয়ার পর, ডাক্তার তোমাকে হাতে গুনে কদিন বাঁচবে তা বলে দেওয়ার পর জিনিসপত্র, ঘর বাড়ি, বা কোনও কিছুর কি মূল্য আর থাকার কথা! আমার যা আছে, সব কিছু তো ইয়াসমিনের নামেই লিখে দিয়ে যাবো, তবে কেন ওই স্মৃতিকাতরতা আমার! নির্বাসিতার স্বপ্ন টপ্নও কি তখন তুচ্ছ হওয়ার কথা নয়! তুমিই যদি বেঁচে না থাকে, তবে কোথায় আমি আর ফিরবো? আমার জিনিসপত্রের কাছে, বাড়িঘরের কাছে? ওইইটকাঠসিমেন্ট কংক্রিটকাপড়চোপড় কি দেশের আরেক নাম। তুমিই যেখানে স্মৃতি হয়ে উঠবে আর কদিন পর, কোন স্মৃতি আছে জগতে, যে স্মৃতি তোমার স্মৃতির চেয়ে মূল্যবান? ইয়াসমিনের সঙ্গে অমন ব্যবহার যদি করেইছিলাম, তোমার সামনে করেছিলাম কেন, আমি যে খুব ছোট মনের একটা মেয়ে, স্মৃতি ফিরে পাওয়ার শখে অসভ্যের মতো আকুল, তা তোমাকে দেখিয়ে কি তোমার কিছু ভালো করেছিলাম আমি! যতই আমি তোমাকে শুধু প্রশান্তি দেব, শুধু ভালোবাসার কথা শোনাবো ভাবি, রূঢ় রুক্ষ বাস্তব এসে সব এলোমেলো করে দেয়।

ছোটদাকে সময় তারিখ দিয়ে জানিয়ে দিলাম তোমাকে আর বাবাকে ঢাকার বিমান বন্দর থেকে তুলে নেওয়ার জন্য সে যেন প্রস্তুত থাকে। বাংলাদেশ বিমানে অনেকেই আমাকে চিনে ফেলে, কাছে এসে জিজ্ঞেস করে, কোথায় যাচ্ছেন? এই প্রশ্নের উত্তর যথাসম্ভব এড়িয়ে যাই। কেউ ভাবতে পারছেনা আমি দেশে যাচ্ছি। উত্তর না পেয়ে আবার প্রশ্ন, ব্রাসেলস? আমি হ্যাঁ বা না দুটোই হয়, এমনভাবে মাথা নাড়ি। বিমানের ভেতরের কাউকেই আমি জানতে দিতে চাইনা যে আমি ঢাকায় নামবো। দেশে যে আমাকে ঢুকতে দেওয়া হবে না তা প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, ডঃ কামাল হোসেন আমাকে জানিয়ে দিয়েছেন, সুতরাং দেশের আশা আমার না করাই উচিত। তোমাকেও বলেছি, তুমিও যেন আশা না করো, যদি দেখ ঢাকায় ঢুকতে আমাকে বাধা দেওয়া হচ্ছে, তখন যেন নিষ্ঠুর বাস্তবকে মেনে নেওয়ার শক্তি তোমার থাকে মা। এই দীর্ঘ আকাশ যাত্রায় আমরা একসঙ্গে আছি, অন্তত এটুকুই না হয় আমাদের পাওয়া হোক। তুমি কখনই বুঝে পাওনি, কেন মানুষ এত নিষ্ঠুর হয়। কেন আমার মতো একজন নিরীহ মানুষকে মানুষ দেশছাড়া করে। কেন তার অসুস্থ মার পাশে থাকার জন্য তার আবেদনও অগ্রাহ্য করে। বিমানের যে লোকগুলো ভেবেছিলো আমি ব্রাসেলসে নেমে যাবো, তারা বিস্ফারিত চোখে দেখলো ব্রাসেলসে আমি নামিনি। সম্ভবত ভেবেছে দিল্লিতে নেমে যাবো। দিল্লিতেও নামিনি। তখন কিছু কিছু চোখে স্থির হয়ে ছিল বিস্ময়। আমার পরনে ছিল সাদা সালোয়ার কামিজ। পর্দানশীন মেয়ের মতো মাথায় ওড়না। মাথা ঢাকলেইকি আমার পাসপোর্টের নাম পাল্টতে পারবো! আমি না হয় দেখতে আগের চেয়ে অনেকপাল্টে গেছি, সহসা কেউ আমাকে আমি বলে চিনতে পারবেনা কিন্তু আমি তত আমিই আসলে। বিমান যখন বাংলাদেশের আকাশের ওপর, আঁধার কেটে সব আলো ফুটছে, একটু একটু করে দেশটা ভেসে উঠছে, আমার এই দেশ, এই মাটি জন্ম জন্ম চেনা। কত সহস্র মাইল দূরের নির্বাসন থেকে আজ আমি ফিরছি দেশে, সেদিন যদিতুমি আমার সঙ্গে না থাকতে, তোমার অসুখ যদি না থাকতো, তবে এই দেশের আকাশ থেকে কতকাল না দেখা দেশটার জন্য ফোঁটা ফোঁটা চোখের জল ঝরতো আমার। কিন্তু না মা, চোখে জল আমার ঠিকই ছিল, কিন্তু ওই দেশটার জন্য নয়, এতকাল পরে নিজের দেশের মুখ দেখার সুযোগ পেয়ে নয়। চোখে জল তোমাকে ভেবে, সব থেকে যাবে, ওই অরণ্য, ওই নদী, ওই মানুষ, ঘরবাড়ি, শুধু তুমিই থাকবে না। ঢাকার বিমান বন্দরে নেমে আমি সোজা আর সব যাত্রীর মতো হেঁটে যাই ইমিগ্রেশনের দিকে। আমি জানি আমাকে যে কোনও মুহূর্তে পেছন থেকে, বা ডান বা বাঁ দিক থেকে খপ ধরে ফেলবেপুলিশের লোক। আমি জানি ইমিগ্রেশনেই ওঁত পেতে আছে আমার পথ আটকে দেওয়ার লোক। এই বিমান বন্দরের ইমিগ্রেশনই একবার আমাকে দেশ থেকে বেরোবার পথ রোধ করে দাঁড়িয়েছিলো। আর আজ দাঁড়াবে আমার দেশে ঢোকার পথ রোধ করে। একটা মানুষের ওপর আর কত বছর অন্যায় চলবে! আমার চোয়াল শক্ত হতে থাকে। জানিনা দুর্যোগের সময় এক শরীর শক্তি আমি কোত্থেকে পাই। আমার হাঁটায় দৃঢ়তা, আমার পিঠ টান টান, আমার মাথা উঁচু। হ্যাঁ আমি দেশে ফিরছি, আমার নিজের দেশে, এ দেশ তোমাদের কেনা নয়, এ দেশের আর সবার মতো এ দেশ আমারও। এ দেশ শেখ হাসিনার একার দেশ নয়, এ দেশ খালেদা জিয়ার বাপের সম্পত্তি নয়, এ দেশ আমারও। এ দেশ মৌলবাদীদের বধ্যভূমি নয়, এ দেশ আমার মতো সৎ ও সাহসী মানুষের দেশ। আমি কোনও অন্যায় করিনি, যারা অবৈধ ভাবে আমাকে ঢুকতে দেবে না দেশে, অন্যায় তারা করবে। মা, তোমাকে দেখছিলাম তুমি আমার মতোই মাথা উঁচু করে হাঁটছো। বাবা বোধহয় বারবার পিছিয়ে পড়ছিলো। তুমি আর আমি হেঁটে যাচ্ছিলাম আর সবার মতো। ইমিগ্রেশনের লোকের হাতে তিনটে বাংলাদেশের পাসপোর্ট আমি নিজেই দিই। তুমি আমাকে আলগোছে আড়াল করে দাঁড়ালে। তোমার বুক কি ঠাণ্ডা হয়ে ছিলো নাকি তুমিও দাঁতে দাঁত চেপে সাহসে বুক বেঁধেছিলে! আমরা কেউ কোনও কথা বলছিলাম না। আমি প্রার্থনা করছিলাম এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড, এই জগৎ, এই প্রকৃতি, এই জীবনের কাছে, তুমি যদি মানবিক হও, তোমার ক্রুরতা থেকে আজ নিজেকে মুক্ত করো, আমার বঞ্চিত, নিপীড়িত, আমার দুঃখিনী মাকে আজ একটু করুণা করো। মাথা নিচু করে বসে থাকা লোকটি মুখ তোলেনি, তিনটে পাসপোর্টেই খটাশ খটাশ টাশ করে সিল মেরে দিল। ঠিক ওই মুহূর্তকে জীবনের শ্রেষ্ঠ মুহূর্ত বলে মনে হয়েছিল আমার। যত দ্রুত সম্ভব, বিমান বন্দর থেকে বেরোই। গাড়ি নিয়ে বাইরে অপেক্ষা করছে ছোটদা। আমাকে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো। তা তো উঠবেই। তার তো গভীর বিশ্বাস ছিলো জীবনে কখনও আমি দেশে ফিরতে পারবো না। রাষ্ট্রও করে দিয়েছিলো যে বাংলাদেশের মাটিতে আমার ফেরা অসম্ভব। তুমি মুষড়ে পড়তে ছোটদার অদ্ভুত উচ্চারণে। তুমিই আমাকে ফিরিয়েছো মা। কোনও রাজনীতিবিদ, কোনও কবি সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবী আমাকে ফেরায়নি। তুমিই তোমার ঘরের মেয়েকে ঘরে ফিরিয়েছো। আত্মীয় স্বজন সবাইকে পেয়ে, নিজের দেশ, নিজের বাড়ি ফিরে পেয়ে আমার অদ্ভুত আনন্দ হয়, একই সঙ্গে বিষাদ এসে ঘিরে রাখে আমাকে। তুমি আমার দেশে ফেরার আনন্দে যেন অনেকটাই সুস্থ হয়ে ওঠো, ভুলে যেতে থাকো নিজের অসুখের কথা। পরদিন দেশের সব পত্রিকায় ছাপা হয়ে গেল যে আমি দেশে ফিরেছি। সাংবাদিকদের ভিড় গেইটের সামনে, বলে দেওয়া হল আমার বাড়ি তালাবন্ধ, ভেতরে কেউ নেই। দেখেছো তো রাতে ঘরের আলো জ্বালাতাম না, দরজা জানালা বন্ধ থাকতো, যেন বাইরে থেকে বোঝার কোনও উপায় না থাকে বাড়ির ভেতর কোনও প্রাণী আছে। কথাও বলতাম আমরা প্রায় নিঃশব্দে। মানুষ খবর চায় আমার, কিন্তু পাবে কী করে। পত্রিকাগুলো প্রতিদিন গল্প ছাপাতে শুরু করলো। আমি নাকি ময়মনসিংহে, কাল নান্দাইলে গিয়েছি বাবার পৈত্রিক বাড়িতে। আবার অন্য পত্রিকায় লেখা আমাকে নাকি দেখা গেছে ডঃ কামাল হোসেনের বাড়িতে ঢুকছি, দেখা গেছে শ্যামলীর দিকেনীল একটি গাড়ি করে লাল একটি শাড়িপরে কোথায় কোন আত্মীয়ের বাড়ির দিকে যাচ্ছি। এসব গল্পে একটা লাভ হয়, কেউ আমার শান্তিনগরের বাড়িতে আর ভিড় করে না। তুমি চাও আমি যা লিখেছি তার জন্য ক্ষমা চেয়ে আবার আগের মতো নিরাপদ জীবন যাপন শুরু করি। চাও সাংবাদিকদের যেন জানিয়ে দিই যে আমি ক্ষমা চাইছি। সে আমি করবো কেন, আমি কোনও ভুল করিনি, আমি কোনও মিথ্যে বলিনি, ক্ষমা চাওয়ার তো প্রশ্ন ওঠে না। তুমিও হয়তো জানতে যে আমি ভুল করিনি, কিন্তু আপোস করতে চেয়েছিলে, আমার নিরাপত্তার কথা ভেবেই চেয়েছিলে তুমি। তুমি জানো মৌলবাদীরা এখন ওদের তরবারিতে শাণ দিচ্ছে, সরকার পুলিশ লেলিয়ে দিয়েছে আমাকে পাকড়াও করার জন্য। পত্রিকার গল্পের সূত্র ধরেপুলিশ নাকি নানা জায়গায় আমার খোঁজ করছে। যেখানে আমার যত আত্মীয় আছে তাদের বাড়িতে বাড়িতে তো যাচ্ছেই। যেখানে যত বন্ধু ছিল আমার, তাদের বাড়িতেও হানা দিচ্ছে। যখন আর লুকোনোর উপায় নেই যে আমি দেশে, পত্রিকা অফিসকে পুলিশ যখন তথ্যের সত্যতা জানিয়েই দিয়েছে যে হ্যাঁ আমি দেশে, তখন বন্ধু সাংবাদিক ফরিদ হোসেনকে আর বাধা দিইনি আমার সঙ্গে দেখা করতে। ফরিদকে তুমি বলেও দিলে, যে, তোমার মেয়ের হয়ে তুমি দেশবাসীর কাছে ক্ষমা চাইছো, তারা যেন তোমার মেয়েকে ক্ষমা করে দেয়, এবং মেয়েকে নিজের দেশে নিরাপদে বাস করতে দেয়। ফরিদ ছাপিয়েছিলো এমন একটা খবর, কিন্তু এরপর কি মৌলবাদীরা আমাকে ক্ষমা করেছিলো মা? বলে দিয়েছে আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করতে পারে, কিন্তু তারা করবে না। এই আল্লাহ খোদায় বিশ্বাসীদের, আমি লক্ষ করেছিলাম, তুমি যেন খুব একটা বিশ্বাস করছে না। তুমি জানো পীর বাড়ির লোকেরা তোমাকে কী করে জঘন্য অপমান করে তাড়িয়েছে। তাদের মতে তুমি একটা ক্ষমার অযোগ্য পাপ করেছে, আমার মতো নাস্তিককে জন্ম দিয়েছো। তোমার একটাই অপরাধ, তুমি আমার মা। তুমি যদি অস্বীকার করতে তুমি আমার মা নও, আমাকে তুমি আর মেয়ে বলে স্বীকার করো না, তাহলে ওরা তোমাকে পীর বাড়িতে ঢুকতে দিতো। ওদের ওই চাপ সত্ত্বেও তুমি আমার বিরুদ্ধে কোনও শব্দ উচ্চারণ করোনি। তুমি আমাকে নয়, বরং ওদের ত্যাগ করেছে। আমার সততা আর উদারতার প্রসঙ্গ টেনে বরং ওদের সঙ্গে তুমি তর্ক করেছে। হাদিস কোরানের কথা শুনতে তুমি গুলকিবাড়ির একটা বাড়িতে যেতে, যেখানে এক মহিলা ভালোবেসে তোমাকে কাছে টেনেছিলো। হয়তো ভালোবাসাকেই মূল্য দিতে বেশি। তুমি ভালোবাসাকেই মূল্য দিতে বেশি। ধর্মের নামে নিষ্ঠুরতা, নির্মমতা, অসহিষ্ণুতা, অন্যায় তুমি নিজেও মেনে নিতে পারোনি। তাই এতকাল ধরে বিচরণ করা পীরবাড়ির আঙিনা ছেড়ে আসতে কোনও দ্বিধা করোনি।

সরাসরি সৌদি আরব থেকে এনে তার এক ছাত্রী তাকে উপহার দিয়েছে, সেই কোরান পাঠের ক্যাসেটগুলো ঝুনু খালা তোমার জন্য এনেছিলো, ওই ক্যাসেট আমি সারাদিন চালিয়ে রাখতাম, যেন তুমি শোনো। আমি কোনওদিন লক্ষ করিনি তুমি ওগুলো মন দিয়ে শুনছো বা শুনতে চাইছো। কোনও কোনও সময় বলতে যেন এবার একটু বন্ধ করি ওসব। তুমি আমাকে পাশে নিয়ে বসে গল্প করতে চাইতে। আমি তোমাকে আনন্দ দিতে তখন মরিয়া হয়ে উঠেছি, তোমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে সেই ছোটবেলায় পড়া সুরাগুলো আওড়েছি, ভুলগুলো তুমি সুদ্ধ করে  দিতে, হয়তো খুশি হতে দেখে যে, যে কাজটা আমাকে একসময় তুমি করতে বলতে, করিনি, আর আজ আমি স্বেচ্ছায় তা করছি। তোমার চুল পাখার হাওয়ায় উড়তে আর তোমাকে কী যে পরিতৃপ্ত মনে হত। পরে আমি লক্ষ করেছি, এমন কী তোমার প্রিয় কোনও সিনেমার গান গাইলেও তুমি একই রকম খুশি হও। একদিন তো টেলিভিশনে সবার ওপরে নাকি শাপমোচন নাকি হারানো সুর কী একটা ছবি হচ্ছে, তুমি ড্রইং রুমে গিয়ে সিনেমাটা দেখছিলে, একসময় কী ভালোই না বাসতে তুমি উত্তম সুচিত্রার সিনেমা দেখতে। তোমাকে দেখতে আমার ভীষণ ভালো লাগছিল। অন্যরকম। ধর্মের আফিম খেয়ে যেমন সিনেমা দেখা বাদ দিয়েছিলে, টেলিভিশন দেখাও বন্ধ করেছিলে, কারণ পীর বাড়ি থেকে ওসব দেখার বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি হয়েছিল। সেই তুমি সব নিষেধ উড়িয়ে দিয়ে সেই তোমার তরুণী বয়সের মতো সিনেমা দেখছে। চোখে তোমার আগের মতো সেই উজ্জ্বলতা। বাড়িতে লোক চলে এলে অবশ্য তুমি উঠে গিয়েছো, একটু কি লজ্জা হয়েছিলো তোমার! কেন মা? ধার্মিক হিসেবে তোমাকে সবাই জানে বলে কি তোমার যা ভালো লাগে তা তুমি করবে না? আমার এখন অনুশোচনা হয়, কেন আমি তোমার প্রিয় প্রিয় সিনেমাগুলোর ভিডিও ক্যাসেট বা ডিভিডি এনে তোমাকে দেখাইনি? কেন আমি ওই কোরান আবৃত্তি দিনের পর দিন ছেড়ে রাখতাম! তুমি তো কোরান পড়তে দোযখে যেতে হবে, সেই ভয়ে। তুমি তো সিনেমা দেখতে কোনও ভয়ে নয়, আনন্দে। তোমাকে আনন্দ দেওয়াই যদি আমার উদ্দেশ্য হয়, তবে কেন আমি ও কাজটা করিনি! সারাদিন তোমাকে অসুস্থ মানুষের মতো শুইয়ে রাখতে চাইতাম। কিন্তু সারাদিনই তুমি বিছানায় শরীর ছোঁয়াতে চাইতে না। একদিন বাড়িতে ক্যারম খেলা হচ্ছিল। তুমি এলে ক্যারম খেলতে। আমার উৎসাহ পেয়ে তুমি আরও যেন কিশোরী হয়ে উঠেছিলে। তুমি যেন ছুটে ছুটে যেতে চাইছিলে তোমার শৈশবে, কৈশোরে, তোমার যৌবনে। বাড়ির কেউ তোমাকে কোনওকিছু নিয়ে বিদ্রূপ করছে না, ঘৃণা করছে না, তোমার কেন ছুটতে ইচ্ছে করবে না, বলো।

মাঝে মাঝে ভাবি, যদি তোমার ভয়ংকর অসুখটা না ধরা পড়তো, এবং কেউ না জানতো যে আর কটা দিন পরই দুনিয়া থেকে তোমাকে বিয়ে নিতে হবে, তবে তোমাকে বোধহয় আগের মতোই অবহেলা অপমানে জীবনের শেষ দিনগুলোও পার করতে হত। বাবার মতো লোক যে কিনা ময়মনসিংহের চেম্বার ছাড়া আর অবকাশ ছাড়া এক মুহূর্তও কোথাও থাকতে চায় না, সে দিনের পর দিন মাসের পর মাস নিউইয়র্কে আর ঢাকায় পড়ে আছে, তোমাকে সঙ্গ দেবে বলে। অসুখটা না হলে পেতে বাবাকে এত কাছে? নিউইয়র্কের বাড়িতে বাবা তোমাকে পাশে নিয়ে খেয়েছে, রাত জেগে তোমার যত্ন করেছে, ঘুমোয়নি রাতের পর রাত। তোমার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলেছে। হ্যাঁ মা, হঠাৎকরে তোমার জন্য সবার ভালোবাসা উথলে উঠেছিলো। দাদা অবকাশ থেকে চলে এসে দিনরাত ফুটফরমাশ খাটছে। তাকে পাঠাচ্ছি বাইরের কাজগুলো করতে, ওষুধ আনা, ডাক্তার আনা, কিমোথেরাপি দেওয়ার লোক আনা, ডলার ভাঙানো, ব্যাংকের স্টেটমেন্ট আনা, বাজার করা। দাদা মুখ বুজে সব করে যাচ্ছে। বড় মামা, ফকরুল মামা, ঝুনু খালা তোমাকে দেখতে আসছে। যে নানিকেশত বলেও ঢাকায় আনা যায় না, সেই নানিও চলে এসেছে শান্তিনগরে। তোমাকে সঙ্গ দিতে। ছটকু আসে ময়মনসিংহ থেকে তোমাকে দেখতে। ফেলু মামা আর হাশেম মামার ছেলে সুমন এসেছিলো তোমাকে দেখতে, তাদের ঢুকতে দেওয়া হয়নি। শরাফ মামাকেও না। কেন যে ওদের ঢুকতে দেওয়া হল না! আবার কে না কে কাকে জানিয়ে দেয় যে আমি কোথায় আছি, সে কারণেই। হাশেম মামার মেয়ে সুলতানার বিয়ে হওয়ার পর ঢাকায় থাকে, ও একদিন বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে এসেছিলো তোমাকে দেখতে। আমি তখন লেখার ঘরে দরজা বন্ধ করে বসেছিলাম। এখন ভাবি, এদের নিয়ে আমার ভয় পাওয়ার কী ছিলো মা! আশংকা আমার চেয়ে বেশি হয়তো তোমার হতো। তুমি চাইতে আমার সঙ্গে কারও দেখা না হোক। আমাকে পেয়ে তোমার নিজের আত্মীয়দেরও তুমি বিশ্বাস করোনি। ওদের থেকেও দূরে থাকতে চেয়েছে। নানিও থাকুক তোমার সঙ্গে, চাওনি। অনেকবার নানিকে তুমি বলেছো যে বাড়িতে হাশেম মামা অসুস্থ, তাকে রেখে নানি কেন ঢাকায় এসেছে। তোমাকে আমরা কেউ বলিনি যে হাশেম মামা মারা গেছে। তুমি কষ্ট পাবে বলে বলিনি। নানিকে মিথ্যে কথা বলতে হল যে এখন হাশেম মামাকে দেখার লোক আছে। আমরা সবাই চাইছিলাম নানি তোমার কাছে থাকুক। বাবাও। নানি সারাদিন কোরানপড়ে তোমার মাথায় মুখে শরীরে ফুঁ দিয়ে দেয়। আমার মনে হয় না এসব ফুঁ টু তোমার ভালো লাগে। আগে হয়তো লাগতো, এখন আর লাগেনা। এখন তুমি কিমোথেরাপি নিতে চাও কাজ হয় না জেনেও কিমোথেরাপিদিই তোমাকে, তোমার ভালো লাগবে বলে দিই, কিছু একটা চিকিৎসা তোমার হচ্ছে এই ভেবে তোমার ভালো লাগে। কিমোথেরাপি দেওয়া হলে, না মা, তোমার শরীর ফুরফুরে লাগে বলে যা বলল, তা ভুল বললো, তোমার মন ফুরফুরে লাগে। কিন্তু তোমার রক্তের শ্বেত কণিকা এত কমিয়ে ফেলে এই বিষ যে দুদিনপরই তোমাকে হু হু জ্বরেপড়তে হয়। ওষুধ খাইয়েও, সারা গায়ে ঠাণ্ডা স্পঞ্জ করেও তোমার জ্বর কমাতে পারি না। পাশের বাড়ির ডাক্তার প্রজেশকে ডাকা হয়, প্রজেশ আমার শিক্ষক ছিলেন মেডিকেল কলেজে। তোমাকে দেখে বলে দেন হাসপাতালে ভর্তি করতে। তুমি ভর্তি হলে দাদা আর বাবা হাসপাতালে যাতায়াত করলো। আমি ঘরে। আমার পক্ষে তো তোমাকে দেখতে যাওয়ার উপায় নেই। মৌলবাদীরা কোথায় ওঁত পেতে আছে কে জানে, ওঁত না পেতে থাকলেও, দেখে আচমকা ঝাঁপিয়ে পড়ার লোকও কম নেই এ শহরে। হাসপাতালে তোমার জন্য খাবার পাঠানো ছাড়া বাড়িতে আমার তখন আর কাজ থাকেনা। অবশ্য খাবার তৈরি করে শেফালিই। শেফালি বাড়ির সব কাজ একাই করে, তোমার কাজও। তুমি যখন হাসপাতালে, আমাকে দেখতে শামসুর রাহমান আর নির্মলেন্দু গুণ এসেছিলেন। আমার একটুও মনে হয়নি ওঁদের সঙ্গে আমার বহু বছর পর দেখা হল, আগে যেমন আড্ডা হত, তেমনই হলো আমার লেখার ঘরে বসে। আড্ডার বিষয় ছিলো মূলত রাজনীতি আর একটু আধটু সাহিত্য। কাছের কিছু মানুষকে আমার জানাতেই হয়েছে আমি কোথায় আছি। দেশ বিদেশের সাংবাদিকদের মধ্যে এক বিবিসির ডেভিড সেসানকেই সাক্ষাৎকার দিয়েছি, আমি কোথায় আছি সে খবর গোপন রাখবে এই শর্তে। সাক্ষাৎকারে বলেছি, দেশ থেকে বেরোনোর কোনও ইচ্ছে আমার নেই। মৌলবাদীদের ফতোয়া বা তাণ্ডবের আমি পরোয়া করি না। লেখার মাধ্যমে সমতা আর সমানাধিকারের জন্য সংগ্রাম করছি। যাদের জন্য লিখি সেই মানুষ থেকে এবং যে ভাষায় লিখি, সে ভাষা থেকে দূরে সরে গেলে লেখালেখি সম্ভব নয়। এদিকে শুনি পুলিশ খুঁজছে আমাকে। যে ইমিগ্রেশনের লোকটি আমাকে দেশে ঢুকতে দিয়েছিলো তার নাকি চাকরিও গেছে। মতিঝিল থানা থেকে পুলিশ এসে বাড়ি পাহারা দিচ্ছে। দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশগুলো জানেও না কেন তারা এখানে, আমার জন্য গুপ্তচর না কি আমার জন্য পাহারা, আমিই কী আর জানি! আমার বিরুদ্ধে নতুন কোনও ফতোয়া জারি হয় না, কোনও মিছিল বেরোয় না রাস্তায়। কিছু যদি দুর্ঘটনা না ঘটতে থাকে, তবে সাহস এসে ভর করে মা। আমি একদিন রাত বিরেতে চলে গেলাম ঝুনু খালার বাড়িতে। আবার একদিন বারডেম হাসপাতালে দেখতে গেলাম তোমাকে। ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বললাম। ইনসুলিন দিচ্ছে তোমাকে। কী আর খাচ্ছো তখন যে এত এত ইনসুলিন দিতে হয়! নার্সরা যখন সুঁই ফোঁটায় তোমার গায়ে, আমি অন্যদিকে তাকিয়ে থাকি। দেখলে মনে হয় সুই যেন আমার গায়ে ফোঁটালো। সুঁই তো নিজেই তুমি নিজের গায়ে ফোঁটাও যখন নিজে তুমি দিনে তিনবেলা ইনসুলিন নাও। আমি বুঝে পাই না কী করে পারো তুমি। তোমার অভ্যেস হয়ে গেছে, নিজের গায়ে সুঁই ফোঁটাতে তোমার আর কষ্ট হয় না। কিন্তু বুঝি না, তুমি নিতান্তই সামান্য কিছু মুখে দিচ্ছ, কেন তবু তোমার রক্তের চিনি উঁচুতেই উঠে থাকে। সম্ভবত তোমার অসুখটিই চিনিকে কমতে দেয় না, দিনের পর দিন তুমি উপোস থাকলেও। কিমোথেরাপির লোক এসে যখন বাড়িতে তোমার হাতের শিরা বের করে সুই ঢোকাতে চাইতো, আমি চাইনি তুমি কোনও ব্যথা পাও, জায়গাটা অবশ করার জন্য একটা মলম কিনেছি, সেটা লাগিয়ে তারপর সুই ঢোকাতে দিয়েছি। কেন অমন করেছি মা? সুইএর ব্যথা কি তোমার কাছে আদৌ কোনও ব্যথা, তোমার তো ক্রমাগতই ব্যথা হচ্ছে পেটে। মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করেছি ব্যথা কি কমেছে? তুমি ম্লান হেসেছে। উত্তর দিয়ে আমার মন খারাপ করতে চাওনি। তবে কোনও কোনও সময় বলেছে, যে, ব্যথা সবসময় আছেই। একদিন বললে, ব্যথা নয়, ব্যথার চেয়েও বড় কিছুতুমি অনুভব করো। সেটা যে কী তুমি কোনও শব্দে বা ভাষায় বোঝাতেপারোনি। আমার তো বোঝার ক্ষমতাই নেই। কী করে থাকবে, আমার কি সারা শরীর ছাওয়া ক্যানসারে! একটু একটু করে আমি তো বুঝতে পারছিলাম তোমার শরীর বদলে যাচ্ছে, তোমার পেটে পানি আসছে, পেট ফুলে যাচ্ছে, তুমি ওড়না দিয়ে পেট ঢেকে রাখো। কেন মা? কেন আমাকে বলোনি যে তোমার পেট ফুলে উঠছে দিন দিন? জিজ্ঞেস করলে তুমি নিজেকে আড়াল করো। তুমি কি আমাকে বুঝতে দিতে চাইতে না? অসুখ লুকোতে চাইতে মা? কাকে খুশি করতে? কেন চিৎকার করে বলোনি, তোমার তো চিকিৎসা হলো, সাড়ে চার ঘণ্টার একটা বড় অপারেশন হলো, শরীরে অনেক রক্ত দেওয়া হল, বিদেশের হাসপাতালে চিকিৎসা হল, তোমার তো ভালো হয়ে যাওয়ার কথা, তবে পেট ফোলে কেন, কেন ব্যথা দিন দিন বাড়ছে? কেন শরীরের অবস্থা ভালো হওয়ার বদলে আরও খারাপ হচ্ছে? কেন তোমার বিবমিষা, কেন খেতে পারছো না? একবারও তো কাউকে বলোনি, না আমাকে, না বাবাকে, না ডাক্তারকে, না তোমার মাকে, বা ভাই বোনকে! যখন তোমারপাইলসের রক্ত যাচ্ছিল, অভিযোগের সীমা ছিল না। চিকিৎসাপাওয়ার জন্য চিৎকার করতে। তখন কেউ আমরা তোমার চিৎকারের গুরুত্ব দিইনি। আর যখন তোমার একটি শব্দকেও আমরা গুরুত্ব দিচ্ছি, তোমার পাশে পাশে থাকছি, তোমাকে কী করে ভালো রাখা যায় তার চেষ্টা করছি, তখন তুমি একবারও তোমার শরীরের কোনও কিছু নিয়ে কারও সঙ্গে আর কথা বলছো না। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে হয় উত্তর দিচ্ছ না, এড়িয়ে যাচ্ছো, নয়তো ভালো আছি ধরনের কিছু বলে প্রসঙ্গ বদলাচ্ছো। কেন মা? বুঝতে পেরেছিলে তোমার অসুখ সেরে যাওয়ার অসুখ নয়! একটুও তো তখন মৃত্যুর কথা বলেনি। একটুও তো মুষড়ে পড়োনি, কাঁদোনি। একটুও তো ভয় পাওনি। শিউরে ওঠোনি। একটুও তো কোরান নিয়ে বসোনি। আগে তো মৃত্যুর কথা বলে বলে কাঁদতে, যখন সুস্থ ছিলে!

হাসপাতাল থেকে জ্বর খানিকটা কমানো হয়েছে কড়া অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে। তোমাকে বাড়ি আনা হল। কিমোথেরাপি শেষ পর্যন্ত বন্ধ করতে হলো। কারণ তোমার শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। তোমার ঘর আগপাশতলা ডেটল দিয়ে পরিষ্কার করে তোমাকে বিছানায় শোয়ালাম। তোমার ধারে কাছে যেন কেউ না আসে সেই ব্যবস্থা করলাম। কারও শরীর থেকে যেন কোনও জীবাণু গিয়ে তোমাকে না আক্রমণ করে। যারা তোমার ঘরে ঢুকতো, নিয়ম করে দিয়েছিলাম ঢুকবে পায়ের জুতো খুলে, হাতপা ধুয়ে। দূরে চেয়ারে বসতে দিতাম তোমাকে দেখার জন্য। বুঝি না কেন আমি তোমাকে সবার থেকে দূরে সরিয়ে রাখছিলাম। কী লাভ, শরীরের ভেতরটাতো তোমার ক্ষয়ে যাচ্ছিল। কটা দিন যেন বেশি বাঁচো? কিন্তু মানুষের স্পর্শ তোমাকে তো আনন্দ দিতে পারতো কিছুটা! স্পর্শের আশ্চর্য এক শক্তি আছে। আমিও আশংকায় তোমাকে স্পর্শ করিনি।

হঠাৎ করেই যেন শয্যাশায়ী হয়ে গেলে মা। অথচ নিউইয়র্ক থেকে ফিরে এসে দিব্যি তো ছিলে, বাজার আসছে, মাছ মাংস আলাদা করছে। কী রান্না হবে তা বলে দিচ্ছ, দেখিয়ে দিচ্ছ। আমি প্রথম প্রথম বলেছিলাম তুমি ঘরে গিয়ে শুয়ে থাকো, এসব আমি দেখছি। কিন্তু তুমি শোনোনি। বাড়ির দেখাশোনার দায়িত্ব তুমি নিলে। এখন বুঝি সেই নেওয়াটা কত প্রয়োজন ছিলো তোমার। তুমি অসুস্থ মানুষের মতো শুয়ে থাকতে চাওনি। শরীরের শেষশক্তি পর্যন্ত তুমি উঠেছো, হেঁটেছে, ব্যস্ত থেকেছে। আমার সংসার তখন তোমার সংসার। তোমার নিজের সংসার তোমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে তোমার ছেলের বউ, মেয়ের সংসারের দায়িত্ব শুধুনাওনি, মেয়ের টাকা পয়সা বাঁচাবার চেষ্টা করেছে খুব। প্রচুর টাকার বাজার করতে পাঠাতাম কিন্তু তুমি হিসেব করে রান্না করতে বলতে। এই হিসেবটা আমার ভালো লাগতো না। আমি চাইতাম প্রচুর রান্না হোক, বাড়িতে সবাই আমরা, তার ওপরনানি আছে, ঝুনু খালা আসছে, অন্যরাও আসছে। তোমার আত্মীয়রা সবাই আসুক তোমার কাছে, সবাই থাকুক। তোমাকে ঘিরে থাকুক সবাই, তোমাকে যারা ভালোবাসে, অথবা তুমি যাদের ভালোবাসোসবার ভালোবাসা পেয়ে তোমার যেন মন ভরে। শরীরের কষ্টটাকে কেউ তো আমরা দূর করতে পারবোনা। যতদিন বেঁচে আছো, যেন তুমি কোনও দুর্ঘটনা না দেখ, দুঃসংবাদ না শোনো, যেন কোনও কান্নার শব্দ, যেন কোনও হাহাকার, যেন ঝগড়া, যেন হিংসে, যেন কটুকথা না শোনো। শুধু ভরে থাকো হাসিতে আনন্দে। কিন্তু আমার চাওয়ার মতো সবকিছু ঘটে না। তুমি বলোনি কিন্তু বুঝতে পারতাম যে তুমি চাইতে

ঝুনু খালা আসুক এত ঘন ঘন। তুমি এমনকী নানিকেও বারবার বলছো যেন ময়মনসিংহে ফিরে যায়। তোমাকে কোনও প্রশ্ন করিনি। কিন্তু আমার খারাপ লাগতো। আমি লক্ষ করতাম দুপুর বা রাতের খাবারের সময় টেবিলে এসে বসছো। তুমি সবাইকে বেড়ে দিচ্ছ যার যার খাবার। এসবের কী দরকার ছিল! বলেছি, মা, তুমি নিজের খাবার খাও, আমরাই আমাদের খাবার বেড়ে নিতে পারবো। তুমি শোনোনি। যেহেতু আমি চেয়েছিলাম যেমনভাবে ভালো লাগে তেমন ভাবেই চলো। যা করতে ইচ্ছে হয়, তাই যেন করো। তাই তোমার থালায় খাবার বেড়ে দেওয়াকে বন্ধ করতে চাইনি জোর করে। এতে যদি আনন্দ পাও, পাও। নিজে তুমি খেতে না, তোমার খাওয়ার মধ্যে সকালে আধসেদ্ধ ডিম, দুপুরে তরল করে বানানো এক বাটি মুরগির স্যুপ, মাঝে মাঝে আধবাটি মুড়ি। আর কিছু পেটে নিতে তোমার ইচ্ছে করতো না। আমাদের সবার থালায় খাবার বেড়ে দেওয়ার সময় আমি লক্ষ করতাম, তুমি নানির থালায় ছোট এক টুকরো মাছ বা মাংসের টুকরো দিয়েছো, ঝুনু খালা বা ছেলের থালাতেও। আর আমার থালায় বিশাল কিছু একটা দিয়ে বসে আছে। দেখে আমার এত লজ্জা হত যে আমি মাথা নিচু করে খেতাম, মনে মনে ক্ষমা চাইতাম ওদের কাছে। বাড়িতে আরও বেশি রান্না হলেই তোপারে। এতগুলো লোকের কী এত কম রান্নায় হয়! কী হচ্ছে এসব? এসব নিয়ে চেঁচাতে ইচ্ছে হত আমার। কিন্তু তোমার যদি মন খারাপ হয়, তাই মুখ বুজে থাকতাম। আমি যা পছন্দ করি খেতে, তুমি তাই রাঁধতে বলতে। একবার লাটি মাছের ভর্তা করলে। সেও কেবল আমাকেই খাওয়াতে চাইলে। তোমার। চরিত্র, সত্যি বলছি, আমার খুব অচেনা ঠেকেছে। তুমি শুধু দিতেই মানুষকে, যত পারতে ঢেলে দিতে। সেই তুমি কী হয়েছে যে পাল্টেগেছ? নানিকে কেন তুমি চাওনি তোমার সঙ্গে থাকুক? তুমি কি আমার খরচ বাঁচাতে চাইতে? তুমি দেখেছো পনেরো হাজার ডলার আমি আমেরিকা থেকে এনেছি। দশ লাখ টাকারও বেশি। এসেই নতুন একটা রেফ্রিজারেটর কিনেছি, কী দরকার। ছিল কেনার আগের সেই সুন্দর লাল রেফ্রিজারেটরটা তত ছিলোই। কিন্তু তারপরও মা, মনে হয়েছিলো তুমি হয়তো খুশি হবে। আমি যে জাঁকিয়ে বসছি আমার সংসারে তা দেখে তোমার আনন্দ হবে, তোমার এতকালের স্বপ্ন আমাকে ঘরে ফেরানো, সেই স্বপ্ন পূরণের উৎসব কিছু একটা দিয়ে না হয় তোক। কেনার পেছনে আরও একটা উদ্দেশ্য ছিল যে বাড়িতে এখন তোমাকে দেখার জন্য আত্মীয় স্বজন চেনা পরিচিতরা আসবে, আতিথেয়তা ছিল তোমার সবচেয়ে বড় ধর্ম, যে ধর্মটা বাবার সংসারে থেকে তুমি পালন করতে পারোনি, পারোনি তোমার ভাই বোনকে অবকাশে নেমন্তন্ন করতে। তোমার মাকে ভালো ভালো রান্না করে খাওয়াতে পারোনি তোমার কোনও বান্ধবী বা কাউকে বাড়িতে আপ্যায়ন করতে। আজ যেন এই সংসারকে তোমার সংসার মনে করে তুমি যা করতে পারোনি আগে, তা করতে পারার অবাধ স্বাধীনতা ভোগকরো। আমি ডলারগুলো সব তোমার হাতেই তুলে দিয়েছি। অথচ আশ্চর্য, তোমার সেই স্বতঃস্ফূর্ততা আমি দেখছিলাম না। নানিকে কেন তুমি বারবার বলছিলে চলে যেতে, তোমার কি মনে হচ্ছিল নানি আমার টাকার লোভ করছে? না, মা, মোটেও করেনি। নানি সম্পূর্ণই তোমার পাশে থাকতে চেয়েছিলো। আর কোনও উদ্দেশ্য নানির ছিলো না। হাশেম মামাকে কবরে শুইয়ে নানি তোমার কাছে এসেছে, তুমিই ছিলে একমাত্র যেনানিকেনিঃস্বার্থ ভাবে সেবা করেছো, তুমিই ছিলে একমাত্র যে নানিকে প্রাণ দিয়ে ভালোবেসেছো, তোমার তিন মাস বাঁচার খবর তো নানি জানে, নানি কেন ছুটে আসবেনা, জগতের সব ফেলে ঘর বাড়ি সংসার, কেন তোমার কাছে থাকবেনা, মা? তুমি হয়তো ভাবছিলে বাড়িতে হাশেম মামাকে অসুস্থ রেখে নানির তোমার কাছে ছুটে আসা, নিরবধি তোমার সঙ্গে থাকার পেছনে কোনও উদ্দেশ্য আছে, যে উদ্দেশ্যটি খুবমহৎনয়। হাশেম মামার অসুখের চেয়ে তোমার অসুখ কেন নানির কাছে বড় হল, তাই নিয়ে হয়তো নানারকম অংক কষছিলে। হাশেম মামা দুরারোগ্য ক্যানসার রোগে আক্রান্ত। তোমার তো চিকিৎসা হয়েছে, তোমার পাশে তোমার স্বামী পুত্র কন্যা আছে! তোমার অসুখ তো দুরারোগ্য নয়। নানি বরং পাশে থেকে হাশেম মামাকে একটুখানি শরীরের আরাম না দিতে পারুক, মনের আরাম দিক। অথবা তোমার নিজের চেয়ে হাশেম মামাকে তুমি ভালোবাসতে বেশি, তা হাশেম মামার কাছে যেহেতু তুমি যেতে পারছে না, অন্তত নানি যেন পাশে থাকে, তাই চাইছিলে। হাশেম মামা যে আর নেই, সে কথাও তোমাকে বলা যাচ্ছে না। আমি আজও বুঝি না ঝুনু খালাকেও কেন তুমি চাইতে না যে আসুক, বাড়িতে থাকুক। তোমারই তো ছোট বোন, ওকে তো কত ভালোবাসতে তুমি। সম্ভবত ওদের হাত থেকে আমাকে বাঁচাতে চাইতে। কেন ওই কৃপণতাগুলো ছিলো তোমার। তোমার মতো বড় মনের মানুষের ওই ক্ষুদ্রতা দেখে আমি অবাক বনেছিলাম। আমি বুঝে পাচ্ছিলাম না কেন তুমি তোমার আত্মীয় স্বজনকে দূরে সরাতে চাইছো। ওরা এলে, ওরা থাকলে, তোমার অসুখকে দুরারোগ্য কোনও অসুখ বলে মনে হয় বলে? তাই কি তুমি চাইছিলে না কেউ এসে তোমার মাথার কাছে কোরান পড়ে পড়ে ফুঁ দিক, ওসব যেহেতু মৃত্যুপথযাত্রীর জন্যই মানুষ করে! তুমি নিজেকে ভাবতে চাইছিলে তুমি সুস্থ, তোমার অসুখ বিসুখ যা ছিল সব সেরে গেছে। তোমার অসুখটি যে খুব অদুরারোগ্য নয়, তা বিশ্বাস করতে চাইছিলে না? আজও আমি জানি, কী কারণ ছিলো তোমার ওই অসহিষ্ণুতার। নানি শেষ পর্যন্ত চলে যেতে বাধ্য হল, তোমাকে স্বস্তি দিতেই বাধ্য হল। তোমাকে লুকিয়ে আমি পাঁচশ টাকা দিয়েছিলাম নানিকে। মাত্র পাঁচশ, সম্ভবত তুমি চাইছো না বলে অত কম দিয়েছিলাম। আসলে আরও বেশি টাকা নানিকে দেওয়া উচিত ছিল, পথ ঘাটের বিপদ আপদের কথা ভাবা উচিত ছিল আমার। তোমার যে মার জন্য তুমি জীবন দিয়ে দিতে, সেই তোমার মাকে আমাকে লুকিয়ে টাকা দিতে হয়েছে, ভাবতে পারি না। আমার তো তোমাকে বলার কথা যে নানিকে আমি টাকা দিয়েছি। আগে যদি এমন ঘটতো, খুশি তো হতে তুমিই। কিন্তু যেদিন জিজ্ঞেস করলে, নানিকে কোনও টাকা দিয়েছি কি না। আমি না বলেছিলাম। তোমার কিনানির দিকে ঈর্ষা হতো মা? নানির চলে যাওয়ায় আমার বুক ভেঙে যাচ্ছিল। সংসারে নানির মতো এত বুদ্ধিদীপ্ত, এত পরিশ্রমী, এত দৃঢ়চিত্ত দ্বিতীয় কেউ নেই, তোমার প্রতি নানির ভালোবাসাকে, তুমি, নানা কিছু অনুমান করি হয়তো, আজও আমি সঠিক করে জানি না, কেন মূল্য দাওনি। নানিকে আর ঝুনুখালাকে আড়ালে ডেকে তোমার অদ্ভুত নির্লিপ্তি নিয়ে কথা বলেছি। জিজ্ঞেস করেছি তারা আদৌ বুঝতেপারছেকিনা তুমি যা কোনওদিন করোনি, সে তা কেন আজ করছো! ঝুনু খালা জানে না, কিন্তু নানি বললো, সম্ভবত আমাকে আগলে রাখতে চাইছো, আমার জন্য ভয় হচ্ছে তোমার। আমি না আবার অন্যের দুঃখে কষ্টে কাতর হয়ে নিজেকে নিঃস্ব করি। নানির কাছে তোমার হয়ে ক্ষমা চাইলাম আমি। বললাম, মা যত যাই বলুক, এসব নিয়ে নানি যেন একটুও মন খারাপ না করে, যেন ময়মনসিংহেনা ফিরে যায়, যেন বড়মামা বা ফকরুল মামার বাড়িতে কটা দিন থেকে আবার ফিরে আসে। মাকে বলা হবেনানি ময়মনসিংহে গিয়ে সব ঠিকঠাক করে রেখে এসেছে। ঝুনু খালার কাছে ক্ষমা চাইলাম। ঝুনু খালা রিউমাটয়েড আর্থাটাইসে ভুগছে অনেক বছর। শীতের সময় তার হাড়ের জোড়াগুলো সব তালাবন্ধ থাকে। এসময় তুমিইঝুনুখালাকে সাহায্য করতে। আর কেছিল তারপাশে দাঁড়ানোর। তুমিই জীবনভর ছিলে। আর বিশেষ করে ঢাকায় যখন ছিলে, তখন তুমিই ছিলে ঝুনুখালার সবচেয়ে বড় সহায়। তোমার মতো উদার হৃদয় তো ভাইবোনের মধ্যে আর কেউ ছিলো না। কিন্তু সেই তুমি কী করে বুনুখালার অসুখ নিয়ে মোটেও ভাবছিলে না! তোমার ভূমিকাটা আসলে আমিই নিয়েছিলাম। সম্ভবত তুমি চাওনি তোমার ভূমিকায় আমাকে দেখতে। যাবার আগে নানি আমাকে বলেছে, হতে পারে তুমি মায়া কাটাতে চাইছো, চলে যাওয়ার আগে কারও কারও নাকি এমন হয়। মা, বছর খানিক আগে তো নানি মরেই যাচ্ছিল। হাড়ে যক্ষ্মা হয়েছিলো। কোনও ডাক্তার ধরতে পারেনি। নানি বিছানা ছেড়ে উঠতে পারতো না, হাঁটতে পারতো না। কিছু খেতে পারতোনা, কথা বলতে পারতো না। পেচ্ছাবপায়খানায় যেতে পারতো না, সব বিছানায় করতো। তুমি তো তারপাশে থেকে তার পেচ্ছাবপায়খানাপরিষ্কার করতে। সারারাত জেগে জেগে কাটাতে। আর নানির জন্য আকুল হয়ে কাঁদতে। সবাই ভেবেছিলো নানি মারা যাচ্ছে। নানিকে শেষ বিদায় জানিয়ে দিয়েছিলো সবাই। কোথায় কবর দেওয়া হবে তাও ঠিকহয়ে গিয়েছিলো। কাফনের কাপড়ও কেনা হয়ে গিয়েছিলো। সেই নানির যক্ষ্মা রোগ ধরাপড়ার পর যক্ষ্মার দুটো ইনজেকশন পেয়ে প্রায় কবর থেকে উঠে আসার মতো উঠে এলো। সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠলো কদিনের মধ্যেই। তোমার মা তোমার চেয়ে সুস্থ, এ নিয়ে তো তোমার ঈর্ষা হওয়ার কথা নয়। তুমি তো ভীষণ ভালোবাসতে তোমার মাকে। তবে কি এই সত্য যে তোমার নিজের মা, যাকে তুমি প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসতে, সেই মায়ের চেয়েও আমি তোমার বেশি প্রিয়, আমাকে তুমি তার চেয়েও বেশি ভালোবাসো? আমার সামনে তোমার মা, তোমার ভাই বোন, সবাই তুচ্ছ! এ কথা ভাবতে আমার ভালো লাগে না, কিন্তু আমার ওরকমই মনে হয়েছে। ছোটদা বাড়িতে থাকতো না। ছুটি পেয়েও সে তোমার কাছে দুদণ্ড বসতো না। অনেক রাতে মদ খেয়ে বাড়ি ফিরতো। ফিরে আমার লেখার ঘরে বসে আরও মদ খেতো, খেতে খেতে ফোনে মেয়েদের সঙ্গে গল্প করতো। মেয়েরা জানিনা কী কারণে ছোটদাকে এত পছন্দ করে। আমি অবাক হয়ে দেখতাম, এই ছোটদা, তুমি বলেছো, যে, তোমাকে নাকি ভালোবাসে। এই কি ভালোবাসার নমুনা! তবে কি ছোটদা আমার দেশে ফেরায় খুশি হয়নি। এই প্রশ্নটা তোমারও মনে নিশ্চয়ই এসেছিলো। যেদিন সে আমার সঙ্গে বাড়ি ফাটিয়ে চিৎকার করে কথা বললো, যেহেতু বলেছিলাম, ব্যাংকের টাকাগুলো আমি চলে যাওয়ার পর কেন সে আমাকে না বলে সব তুলে নিয়েছে, তখন তুমিও অবাক হয়ে দেখলে ছোটদার ব্যবহার। তোমার জন্য ইয়াসমিন যখন এসেছিলো দেশে, তখন পাঠিয়েছিলাম ওর হাতে অনেক টাকা, যেন অপারেশন খরচ এবং আরও যা খরচ সব মেটানো হয়। আমি এলেও ছোটদা যখন বলেছেআরও বেশি টাকা লাগবে, তার নাকি তোমার জন্য আরও খরচ হয়েছে, যা চেয়েছে, যা দাবি করেছে সব দিয়েছি। দেখতে চাইনি কোনও হাসপাতালের বিল বা কিছু। বাড়ির চার বছরের ইলেকট্রিসিটি বিল, ফোন বিল সব মিটিয়ে দিয়েছি এসে। একটা মোবাইল ফোন নিয়েছি, তার জন্য যা চেয়েছে, ইন্টারন্যাশনাল লাইনের জন্য ডিপোজিট, সব দিয়েছি। টাকা টাকা টাকা। ছোটদা শুধু একটা জিনিসই চেনে। দাদাকে দিয়ে আমার ব্যাংক স্টেটমেন্ট আনিয়েছিলাম, কত টাকা আছে ব্যাংকে দেখতে। দেখে তাজ্জব হয়ে যাই যে আমি দেশ ছাড়ার পর সাড়ে সাত লাখ টাকা ছিল। আমেরিকার হিউমেন রাইটস ওয়াচ আমাকে একটি গ্র্যান্ট দিয়েছিল, ছ হাজার ডলারের গ্র্যান্ট। ওটিও জমা হয়েছিল অ্যাকাউন্টে। ছোটদা আমাকে জানায়নি। বরং যা টাকা ছিল, সব সে তুলে নিয়েছে ব্যাংক থেকে। কোনওদিন জানতেও পারিনি। তুমিও কখনও জানতে না যে ছোটদা আমার ব্যাংকের টাকা তুলে নেয়, একটি পয়সাও তুমি কোনওদিন দেখনি। আমি ভাবতাম ও তোমার হাত খরচে দরকার পড়ে হয়তো। হায় ভাবনা। তোমাকে একদিন পাঁচ শ ডলার পাঠিয়েছিলাম বিদেশ থেকে ছোটদার হাতে। তোমাকে চিঠিটা দিয়েছিল, তবে চিঠির খাম খুলে ডলারগুলো সরিয়ে নিয়ে, তারপর। তোমাকে ফোনে বোধহয় জিজ্ঞেস করেছিলাম, ডলার পেয়েছে কিনা, বললে চিঠি পেয়েছো শুধু। আর ব্যাংকের স্টেটমেন্ট দেখারপর কিছুক্ষণ হাঁ হয়ে থেকে যখন তোমাকে জিজ্ঞেস করেছি ব্যাংকের মাধ্যমে যে তোমাকে টাকা পাঠিয়েছি সেটা অথবা সেগুলো ঠিকঠাক পেয়েছে কিনা। তুমি মাথা নেড়ে বললে, আমি তোমাকে কোনওদিন টাকা পাঠাইনি। আমি হঠাৎ চুপ হয়ে গিয়েছিলাম। আমার তর্ক করতে ইচ্ছে হয়নি। ভাবতে চেষ্টা করেছি কোনওদিনও পাঠিয়েছি কি। নিশ্চয়ই পাঠিয়েছি, অন্তত একবার হলেও, কেন তবে জানো না! কারণ ওই টাকা সম্ভবত কোনওদিন ছুঁয়ে দেখার তোমার সুযোগ হয়নি। ছোটদাকেই তুমি চেকের বইএ সই করে দিতে। কেন নিচ্ছে, কত টাকা, এসব সেই জানতো। তোমার নিজের অ্যাকাউন্টের খবর তুমি নিজে রাখোনি, রেখেছে ছোটদা। তোমাকে কোনওদিন জানায়নি, কী তোমার আছে, কী তোমার যাচ্ছে। হাতে আমার প্রচুর ডলার। ডলারের দিকে জুলজুল করে তাকিয়ে থাকে ছোটদা। একদিন দেখি তোমার খালি ঘর থেকে বেরোচ্ছে। যে মানুষ আমি বা তুমি থাকলে ও ঘর মাড়ায়নি, ওখানে সে একা একা কী করছে! কী আর করবে, সম্ভবত দেখছে কোথাও ডলার আছে কিনা। কেন তার এত টাকার প্রয়োজন, আমি বুঝি না। যথেষ্ট টাকা উপার্জন করে ছোটদা। এর মধ্যে প্রায় সবটাই গীতাকে পাঠিয়ে দেয় বিদেশে। যে গীতার সঙ্গে তার আর মানসিক বা শারীরিক সম্পর্ক নেই, তাকে সেপুষে যাচ্ছে এখনও। আমার বাড়িতে থাকছে, আমার গাড়ি চড়ছে, বাপের হোটেলে খাচ্ছে। যে বান্ধবীদের নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, সবাই স্বনির্ভর। তারপরও ছোটদার টাকার লোভ দিন দিন আগুনের মতো বাড়ছে। আমার বাড়িটায় আমি যদি আবার থেকে যাই দেশে যখন ফিরেছি, তাই সে আমার দেশে ফেরাকেও পছন্দ করছে না। এ এক আশ্চর্য মানুষ। আমার সঙ্গে বদ্ধ মাতাল চেঁচিয়ে কথা বলছে। ওই চেঁচানোর, ওই কথার কোনও মাথামুণ্ডু ছিল না। বিকট চিৎকার। বোধহয় বলছিল, মার কাছে বসার আমার কোনও দরকার নেই, আমি যা করার করেছিমার জন্য, এইবার তুইকর। তুমি তখন খুব শান্ত গলায় ছোটদাকে বললে সে যেন আলাদা বাড়ি নিয়ে চলে যায়। আমি আজও জানি না কেন তুমি ছোটদাকে হঠাৎ চলে যেতে বলেছিলে, কার ওপর অভিমান করে, আমার ওপর, নাকি ছোটদার ওপর! আমি এমন চাইনি, আমি চাইনি তোমার আদরের ছেলেকে তুমি চলে যেতে বলে। আমার একটাই অনুরোধ ছিল সে যেন অনর্থক বাইরে বাইরে না ঘুরে তোমাকে একটু সময় দেয়। ছোটদার জন্য তোমার আদরআমি দেখেছি। আমার কাপড়চোপড়েরসুটকেসপড়ে ছিলো ড্রইংরুমে। আমারই আলমারির একটা অংশে ছোটদার কাপড়চোপড় রাখা। তুমি কিন্তু দেখেও একবারও ছোটদাকে বলোনি আমার আলমারি থেকে ছোটদার কাপড় সরাতে। আমিই একদিন নিজে বললাম, ছোটদা পরে ওগুলো তার যে একটা স্টিলের আলমারি এনে রেখেছিলো আমার বাড়িতে, ওতে রেখে দেয়। আজ ভাবি, কেন আমি বলতে গিয়েছিলাম তোমাকে আলমারি খালি করে দিতে। কী দরকার ছিলো। যেভাবে ছিলো, সেভাবেই থাকতো, আমার কি একটু ঈর্ষা হচ্ছিল, তুমি আমার চেয়ে বেশি তোমার ছেলেকে ভালোবাসো। যে ছেলে তোমার পাশে বসছে না, খবর নিচ্ছে না, যে ছেলে তোমার জন্য একটি পয়সা খরচ করে না, অপারেশনের টাকা দুদুবার করে নিয়ে গেল। সেই ছেলেকে কি ভালোবাসো কারণ সে তোমাকে বাবা আর দাদার মতো অত বেশি তুচ্ছ করেনি, অত অপমান করেনি বলে! নাকি ভালোবাসো তোমাকে উমরাহ করতে নিয়ে গিয়েছিলো বলে! সেও তো নিয়েছিলো বিনে পয়সায়। ঈর্ষা কেন করেছিলাম আমি, তোমার ভালোবাসার কি কোনও কমতি ছিলো আমার জন্য! তুমি তো উজাড় করে দিচ্ছিলে। সব কি আমি নিজের জন্য চাইছিলাম নাকি ছোটদারনিষ্ঠুরতা আমার আর সহ্য হচ্ছিলো না! কিন্তু ছোটদা যদি তোমার পাশে বসতো, ছোটদা যদি একটু ভালোবাসা প্রকাশ করতো তোমার জন্য, সব চেয়ে খুশি তো হতাম আমিই। যে করেই হোক চাইছিলাম তোমার মন ভালো থাক, তুমি ভালো থাকো। তুমিও কি ছোটদার ব্যবহারে কষ্ট পাওনি! হয়তো পেয়েছো! অথবা পাওনি। ছোটদার সঙ্গে এত ভালো মনের মিল ছিলো যে ছোটদা তোমার পাশে এসে না বসলেও জানো তুমি যে সে তোমাকে ভালোবাসে। তুমি তাকে তার মতো করেই থাকতে দিয়েছে। ছোটদাকে তোমার পাশে থাকার জন্য, কাছে আসার জন্য বলোনি, কিছুর দাবিই কারও কাছে করোনি। আমার বাড়ি থেকে যদি ছোটদাকে চলে যেতে হয়, সে তুমি বেঁচে থাকা অবস্থায় নয়। চারদিকের মনোমালিন্য, অহংকার, অভিযোগ, বিরোধ, বিদ্রোহ, রাগ, জেদ, এসব জাদুবলে উড়িয়ে দিতে চেয়েছি। অসুন্দর কিছু যেন স্পর্শ না করতে পারে তোমাকে, চেয়েছিলাম। চেয়েছিলাম মিথ্যে করে হলেও মানুষ বলুক তোমাকে ভালোবাসে। তুমি দেখ, সবাই মিলে মিশে আমরা হাসি আনন্দে আছি। তোমার শৈশবের না-পাওয়া-দোলনায় আমরা সুখের দোলা দুলছি। তুমি যাদের ভালোবাসো, তারা ভালো আছি। পরস্পরকে ভালোবাসছি। কিন্তু ছোটদাকে তুমি ঠাণ্ডা গলায় বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার কথা বলায় আমার হয়তো, যে অভিযোগ আমার ছোটদার বিরুদ্ধে, খুশি হওয়ার কথা। কিন্তু আমি খুশি হই না। অদৃশ্য একটা চাবুক এসে পড়ে আমার ওপর। ধনুকের মতো বেঁকে যায় আমার অহংকারের পিঠ।

.

ঝুনু খালা আর ফকরুল মামাকে পাঠিয়ে পুরোনো ঢাকার শাড়ির হোলসেল মার্কেট থেকে একশ শাড়ি আর লুঙ্গি কিনেছিলাম যেন তুমি গরিবদের দান করতে পারো ওসব। চিরকাল গরিবের অভাব ঘোচাতে চেয়েছে। কোথাও কোনও গরিব দেখলেই তোমার হাত নিশপিশ করেছেসাহায্য করার জন্য। টাকার অভাবে পারোনি। তোমার নিজের হাতে, আমি চেয়েছি, শাড়ি আর লুঙ্গি গরিবদের দান করো। চেয়েছি তোমার ভালো লাগবে বলে। নানি কিছু শাড়ি নিজের চেনা লোকদের দেবে বলে আলাদা করে রাখলো। নানিবাড়ির পাশেই বস্তিতে যে গরিবেরা থাকে, তারা তোমারও চেনা। তুমি তো নিশ্চয়ই ওদের দেবে। কোন শাড়ি খারাপ, কোন শাড়ি ভালো তা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়ে গেল নানি আর ঝুনুখালার মধ্যে, দূর থেকে তুমি দেখছিলে। নানি বলতেই পারে যে আত্মীয়দের মধ্যেই যারা গরিব আছে, তাদেরও দেওয়া হোক শাড়ি। শুনেছ, কোনও মন্তব্য করোনি। নানি যখন সাদা একটা ভালো শাড়ি দেখে বললো, ও শাড়ি নানি নিজেইপরতে পারবে, জানিনানির এই কথা শুনতে তোমার ভালো লাগেনি। পার্থিব জিনিসপত্র থেকে তুমি নিজেকে খুব দূরে সরিয়ে নিয়েছিলে। মৃত্যু এসে দরজার কাছে বসে থাকলে বোধহয় এসব জিনিসপত্রকে বড় তুচ্ছ মনে হয়, এ নিয়ে মানুষের আনোচনাকেও মনে হয় বড় অশ্রাব্য। শাড়িগুলো তোমার হাত দিয়েই গরিবদের দেওয়া হয়েছে। সারাজীবন যা করতে পারোনি, শুধু আশা করেছে, সেই কাজটা করাতে চেয়েছি আমি। জানি না কতটুকু ভালো লাগা দিতে পেরেছি তোমাকে। হঠাৎ অসুখ হওয়ার পর সবঅসম্ভবও যখন সম্ভব হয়ে গেল, তোমার কেমন লাগছিলো মা? আমাদের সবার ওপর রাগ হয়নি? তুমি রাগ দেখালে আমাদের ভালো লাগবে না বলে হয়তো রাগ দেখাওনি। না হলে তোমাকে খুশি করার এই নাটক দেখেও তুমি চুপ হয়ে ছিলে কেন? তোমার জায়গায় আমি হলে হয়তো এসব নাটক বন্ধ করতে বলতাম। বলতাম, যেভাবে অভাবে জীবন কাটিয়েছি, শেষ কটা দিন ওভাবেই কাটাতে দে।

আমার ভীষণ ইচ্ছে ছিল তোমার নামে একটা ইস্কুল করবো ময়মনসিংহে। ঈদুল ওয়ারা বালিকা বিদ্যালয়। চারদিকে খোঁজ খবরও নিয়েছিলাম। কিন্তু শেষ অবদি যা শুনলাম, ইস্কুল করতে গেলে প্রচুর সময় লাগবে। না, আমার সময় খুব কম। এই কম সময়ের মধ্যে কী কী করা যায়, তাই করতে আমি ঝাঁপিয়ে পড়ি। ইস্কুল না হয়পরে হবে, কিন্তু তুমি দেখতে পারো এমন কী করা যায়। দ্রুত ভেবে নিলাম যে তোমার নামে একটা বৃত্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করবো। সপ্তম থেকে দশম শ্রেণীর মেয়েদের, যারা গরিব, কিন্তু ভালো ছাত্রী, তাদের কয়েকজনকে। দাদাকে টাকা দিয়ে ময়মনসিংহেপাঠিয়ে দিলাম। মুকুল নিকেতনের আমিরুল ইসলাম রতন, যতীন সরকার, আর দুজন নামি শিক্ষক বিচারক হবেন। তারাই নির্বাচন করবেন ছাত্রী। ফোনে আমিরুল ইসলাম রতনের সঙ্গে কথাও বলেছি, তুমি আর অল্প কদিন আছো, তুমি যেন দেখে যেতে পারো বৃত্তির অনুষ্ঠান। পড়াশোনা করতে চেয়েছিলে তুমি, ক্লাসের সবচেয়ে ভালো ছাত্রী ছিলে, কিন্তু তোমাকে পড়তে দেওয়া হয়নি। ইস্কুল থেকে জোর করে ছাড়িয়ে নিয়ে আসা হয়েছে। আর যেন কোনও মেয়েকে বাল্যবিবাহের শিকার হতে না হয়, আর যেন কোনও মেয়েকে পূতিগন্ধময় পুরুষতান্ত্রিক পরিস্থিতির শিকার না হতে হয়। মেয়েদের শিক্ষিত হওয়া, আর স্বনির্ভর হওয়ার মূল্য কী, তা নিজের জীবন দিয়ে তুমি বুঝেছো। এখন থেকে প্রতিবছর তোমার আদর্শের প্রতি মাথা নুইয়ে ঈদুল ওয়ারা বৃত্তি গ্রহণ করবে মেয়েরা। তুমি যা পারোনি, তা যেন অন্যরা পারে। তুমি স্বপ্ন রচে দিয়ে গেলে সবার মধ্যে। তোমার কথাগুলোই লিখে আমি পাঠিয়ে দিই। আয়োজনটা খুব দ্রুত করার জন্য তাগাদা দিই। সবাই বুঝতে পারে তাড়াহুড়োর কারণ। অনুষ্ঠান করতে খুব বেশিদিন সময় নেয়নি। মোট পাঁচজনকে দশ হাজার টাকা করে বৃত্তি দেওয়া হয়। রীতিমত বড় সড় বৃত্তি দানের অনুষ্ঠান হয় মুকুল নিকেতনে। ময়মনসিংহের বুদ্ধিজীবিরা অনুষ্ঠানে তোমার প্রশংসা করে বক্তব্য রাখেন। দাদা সেসবের ভিডিও ক্যাসেট আর তোমার ছবি দিয়ে বানানো বিরাট ব্যানারটিও ঢাকায় নিয়ে আসে। ব্যানারে বড় বড় করে লেখা ঈদুল ওয়ারা বৃত্তি। সেগুলো তোমাকে দেখাই আমি মা। তোমার যেন অহংকার হয়, দেখাই। তোমার যেন ভালো লাগে, দেখাই। আমি জানি না তোমার চোখে খুব বিস্ময় ছিল নাকি বেদনা ছিল। ভিডিও দেখাতে গিয়ে বারবার আমাকে তা বন্ধ করে দিতে হয়েছে। কারণ বারবারই বক্তারা তোমার ক্যানসার আর তোমার আসন্ন মৃত্যুর কথা বলছিলেন। আমি চাইনি ওসবকথা তুমি শোনো। দাদার বক্তব্যের ওই কথাটা অবশ্য শুনলে, কিছু বলেনি। আমি চট করে বন্ধ করতে পারিনি। দাদা বলছিলো, আমার মায়ের শেষ ইচ্ছে.। নিশ্চয়ই ভেবেছো শেষ ইচ্ছে কেন হবে? তবে কি বাঁচবেনা? একবারও তুমি এই শেষ ইচ্ছে নিয়ে প্রশ্ন করোনি। একবারও আমাকে বলোনি, যতীন সরকার বা অন্যদের পুরো বক্তৃতা কেন তোমাকে শোনাচ্ছি না। বক্তৃতা দিতে গিয়ে তোমাকে মহীয়সী নারী, মহান মানুষ এসব বলছিলেন ওঁরা, শুনে কি তোমার বাঁচতে ইচ্ছে করছিলো মা, পৃথিবীটাকে খুব সুন্দর মনে হচ্ছিল, মা?

নানি বললেন, নিজেদের আত্মীয়ের মধ্যেই তো কত গরিব আছে, ওদের তো বৃত্তি দিলেও পারতাম। আমি বললাম, এটা বিচারকদের সিদ্ধান্ত। নানি আসলে বলতে চাইছিলেন টুটু মামার প্রথম বউএর ছেলে মেয়েরা চরম অভাবে দিন কাটাচ্ছে। টুটু মামা অন্য এক মহিলাকে বিয়ে করে নতুন সংসার পেতেছে, প্রথম বউকে তালাক দেওয়ারপর সেই বউ ছেলেমেয়ে নিয়ে বাপের বাড়িতে করুণ অবস্থায় পড়ে আছে। টুটু মামা তার ছেলে মেয়ের কোনও খবরই নিচ্ছে না। ওদের দারিদ্র যদি এই টাকায় ঘুচতো! শরাফ মামার ছেলেরাও আছে, অভাব যাদের ঘর থেকে কিছুতেই বিদেয় হতে চায় না। আসলে ওদের সাহায্য করা, আর তোমার নামে বৃত্তি প্রতিষ্ঠিত করা, দুটো তো আলাদা জিনিস। তুমি নানির মন্তব্যে খুশি হওনি। কিন্তু মা, নানি তো সারাজীবন নানার বেহিসেবী খরচ থেকে বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে বুদ্ধি করে ওভাবেই সংসার চালিয়েছে। আমি

তোমাদের একটা ঠান্ডা মনোমালিন্যকে চেষ্টা করি দূর করতে। তুমি শান্ত, স্থিত, স্নিগ্ধ। তোমার ভালো লাগছে কী লাগছে না, তা অনুমান করতে হচ্ছে আমার। প্রকাশ করছো না কিছু। যে তুমি এত আবেগপ্রবণ ছিলে, সে তুমি কীরকম ভীষণ ভাবলেশহীন হয়ে গিয়েছিলে। শয্যাশায়ী না হয়ে নিপুণ গৃহিণীর মতো সংসার তদারকি করছিলে। আমার জন্য কী রাঁধতে হবে, কার জন্য কী বাড়তে হবে, এইসব। যেন অন্য যে কোনওদিনের মতো দিন। ভালো লাগছে মা? হ্যাঁ লাগছে। জানি না কীরকম লাগতো ভেতরে তোমার। জানি অসহ্য যন্ত্রণা ছিলো শরীরে, তোমার শরীর সুস্থ করার ক্ষমতা ছিলো না আমার। শুধু মন নিয়ে তাই ব্যস্ত ছিলাম, মনটায় যদি একটু ভালো লাগা দিতে পারি। কোনও কারণে যেন তোমার মনে সামান্যও আঘাত লাগতে পারে, সেই কোনও কিছু না ঘটাতে আমি সদা ব্যস্ত। কিন্তু মা, একদিন তুমি ভেঙে পড়লে, একদিন তুমি কাঁদলে, চিৎকার করে কাঁদলে। দোষ কাকে দেব, শেফালিকে! শেফালিকেই দোষ দেব। সে আলগোছে শোবার ঘরের ফোনটা তোমাকে দিয়েছিল শুনতে। ড্রইংরুমে বসে বাবা কার সঙ্গে কথা বলছে, সে বাবার ব্যাপার। কিন্তু শেফালি তোমাকে রিসিভারটা কানে লাগিয়ে দেয় শোনার জন্য। তুমি রেখে দিতে পারতে, রাখোনি। তুমি তো আড়িপাততে চাওনি বাবার কথায়। শেফালির অতি উৎসাহে তুমি শুনছিলে বাবার গলা নামিয়ে বলা কথাগুলো। শুনছিলে কারণ বাবা তোমার সম্পর্কে কথা বলছিলো। এরপর তুমি ফোন রেখে আমার কাছে এলে। আমি আমার লেখার ঘরে বসে বই পড়ছিলাম। মা, তুমি ডুকরে কেঁদে উঠলে, কাঁদতে কাঁদতে বললে যে বাবা নাকি কাকে বলছে তুমি নাকি মরে যাবে কিছুদিনের মধ্যে, ডাক্তার নাকি বলেছে তিন মাসের বেশি বাঁচবে না, তুমি মরে গেলেই বাবা ঝামেলামুক্ত হয়ে যাবে। যে মহিলার সঙ্গে কথা বলছিলো, তাকে বিয়ে করবে বা এরকম কিছু। মা, বাবার চরিত্র তুমি তো জানোই, বাইরের মহিলাদের সঙ্গে প্রেম কি তার আজকের ব্যাপার! সে তো আমার জন্মের আগে থেকেই করছে। তবে কেন কেঁদেছিলে মা? তুমি মরে যাচ্ছো শিঘ্রি এই খবরটা শুনে তুমি তো আঁতকে ওঠোনি। তোমার ভেতর তো বিন্দুমাত্র ভয়ের কিছু দেখিনি। আমাকে একবারও জিজ্ঞেস করোনি যে ডাক্তার কি তিন মাস বাঁচার কথা বলেছে? বা তুমি কি সত্যি সত্যি মরে যাবে? বরং বাবার কোনও এক প্রেমিকার সঙ্গে তোমাকে চরম অপমান করে কথা বলায় এত কষ্ট পেয়েছিলে যে অসুখে ভুগে ইস্পাতের মতো হয়ে যাওয়া তুমিও চুরমার হয়ে গেলে। আর আমার এতদিনের তোমাকে আগলে আগলে রাখা, তোমাকে আশ্বাস দেওয়া সব তাসের ঘরের মতো এক তুড়িতে ধসে গেল। দেখ নানি অমন চরম অসুখ থেকে বেঁচে উঠেছে, দিব্যি সুস্থ, সেরকম তুমিও সুস্থ হয়ে উঠবে–সব আশ্বাস, সব আশা, সব ভরসা, তোমাকে সুখ দেবার সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে গেল। শেফালির ওপর সব রাগগিয়ে পড়ে আমার। বাবার ওপরও। বাবাকে আমি অপমান কম করিনি সেদিন। ধিক্কার দিয়েছি বারবার। বাবা মাথা নিচু করে বসে ছিলোপরদিন আমি তোমার নামে যে বৃত্তি হচ্ছে, বাবার নামে যে কোনওদিন হবে না, বাবার মতো দুশ্চরিত্র মানুষের নামে, তা তোমার সামনেই তাকে বললাম। বাবা যতই দুনিয়া বাদ দিয়ে এসে তোমার পাশে বসে থাকুক, যতই সে তোমার গায়ে হাত বুলিয়ে দিক, যতই সে তোমার সঙ্গে করা তার সারাজীবনের অন্যায়ের প্রায়শ্চিত্ত করতে চাক নিরন্তর তোমাকে সঙ্গ দিয়ে, আমি তাকে ক্ষমা করি না। আমি নিজেকেও কি ক্ষমা করি মা? বাবাকে যখন তোমার প্রয়োজন ছিল, তুমি পাওনি তাকে। আজ আর তাকে তোমার কিসের প্রয়োজন! তোমার তো আর চিকিৎসার প্রয়োজন নেই। শরীরের প্রয়োজনও ফুরিয়েছে। মনের যেটুকু ছিল অবশিষ্ট, অন্তত ভেবেছিলে যাকে সারাজীবন পাশে চেয়েছে, পাওনি, আজ পাচ্ছো, আজ সে জগৎ ভুলে তোমার সেবায় নিয়োজিত, তোমার পাশে ঘুমোয়, তোমাকে আদর করে দেয়–সামান্য সেই মনের আরামটুকুও সেদিন জন্মের মতো গেল। তোমার আর কী রইলো তবে?

দিন দিন তোমার পেট ফুলে উঠছে জলে, ফুলে উঠছে ফুঁসে উঠছে আর তুমি ঢেকে রাখছে। তুমি কাউকে বুঝতে দিতে চাইছে না যে কিছু একটা ভয়ংকর ঘটছে তোমার শরীরে। আমরা সবাই বুঝতেপারছি, কিন্তু বলছিনা তোমাকে। সবাই কি আমরা তোমার সঙ্গে অভিনয় করছিলাম, আর তুমিও অভিনয় করছিলে আমাদের সবার সঙ্গে! কিছু না বুঝতে পারার অভিনয়! মা!

বাড়িতে বড় মামা, ফকরুল মামা তোমাকে দেখতে এলে তোমাকে আর কতক্ষণ কে দেখতো, আসর বসে যেতো আমার লেখার ঘরে। ধর্ম, আল্লাহ খোদা, মোহাম্মদ, কোরান হাদিস নিয়ে আমাদের হাস্যরসের আসর। বড় মামা ছিল আমাদের গুরু। কোরানের ক থেকে চন্দ্রবিন্দুপর্যন্ত যার মুখস্ত। তুমি বড় মামার ওপর একসময় রাগ করতে, আমাকে নাকি আসকারা দেয় ধর্মের বিরুদ্ধে লেখার জন্য। বড় মামা আসকারা দেবে কেন, আমি নিজেই কি জানিনা ধর্ম কী এবং কেন! ধর্মের বিরুদ্ধে লিখি বলে ধর্মের জন্য তোমার মায়া হত না, মায়া আমার জন্য হত। তোমার আশংকা হত আমার বিপদ হবে। সে আমি এখন না হয় বুঝি, তখন তোমার আশংকাকে ধর্মভীরুতা বা ধর্মান্ধতা বলে মনে করতাম, আর কতরকম করে যে তোমাকে নির্বোধ ভাবতাম তখন। তখনও তো দেশছাড়া হইনি। তোমার আশংকাই শেষ অবদি সত্যি হয়েছিল মা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *