নিজেকে সঁপে দিয়েছিলে আমার কাছেই। আর আমি তোমাকে কী করলাম মা? তলপেটের বাঁ দিকে তোমার ব্যথা নিয়ে গেলাম বাড়ির কাছের বাজারের ভেতরে একটা ছোটখাটো ডাক্তারখানায়। ডাক্তার তোমার পেটের ওদিকটায় চাপ দিতেই তুমি কঁকিয়ে উঠলে। ডাক্তার তোমাকে পাঠালো আলট্রাসোনোগ্রাম করতে। ঠিক একইঞ্চি জায়গা বলে দিয়েছে ওই পরীক্ষাটা করতে। ইঞ্চি মেপে দেয় তো ওরা। ওরা মেপে সব কিছু করে। সুয়েনসন রান্না করতে গেলে যেমন মেপে চাল দেয়, বা জল দেয়, বা দুধ ঢালে। রান্নাঘরে এদের মশলা পাতি মাপার জন্য যেমন দাঁড়িপাল্লা থাকে, কাপ গেলাসেও মিলিলিটার ডেসিলিটারের দাগ বসানো থাকে। যে নার্স তোমার পেটের ওইইঞ্চি বা সেন্টিমিটারের জায়গাটুকুতে আন্ট্রাসোনোগ্রাম করছিল, তোমার মনে আছে কিনা জানি না আমি বলেছিলাম যন্ত্রটা আরেকটু এদিক ওদিক ঘোরাতে, দেখছেই যখন পেটের আরও কিছু জায়গা দেখে নিক। না, ডাক্তারের মাথায় কিডনি, শুধু কিডনিই দেখতে বলেছে। কিডনির এলাকার বাইরে এক সুতোও যাবে না নার্স। দেখা গেল কিডনি ভালো। ডাক্তারের ওই ছোট মাথায় শুধু ডায়বেটিস ছিল। ডায়বেটিসের কারণে কিডনি নষ্ট হতে পারে, তাই কিডনি দেখতে চাওয়া। তোমার রক্ত পরীক্ষায় নিশ্চয়ই কিডনি ভালো থাকার প্রমাণ ছিল। কতটুকু অশিক্ষিত হলে ডাক্তার কিডনিই শুধু দেখতে পায়। তুমি ব্যথায় উঁ করে উঠেছিলে, যখন ডাক্তার তোমার ওই তলপেটের বাঁদিকে চাপ দিয়েছিল। ডাক্তারের মাথায় গোবর না থাকলে মেপে দিত না ইঞ্চি। বলতো, পুরো পেটের আলট্রাসোনোগ্রাম করে নিয়ে এসো। তাহলেই তো ধরা পড়তো তোমার ওই ভয়ংকর অসুখটা, মা। আর, আমার মাথায় কী ছিল? বর্ণবাদ ছিল ঠাসা। না থাকলে আমি ডাক্তারের নির্বুদ্ধিতাকে গ্রহণ না করে নিজে আমি পয়সা দিয়ে তোমার পেটের পরীক্ষাটা করাতাম। পয়সা দিলে কী না হয়! একটা নিয়ম আছে জানি, ছোট ডাক্তারের কাছে আগে যেতে হয়, অসুবিধে দেখলে ছোট ডাক্তার পাঠিয়ে দেবে বড় ডাক্তারের কাছে। কিন্তু আমার ছোট ডাক্তার যদি অসুবিধেটা না বোঝে, তবে তো দায়িত্বটা নেওয়া উচিত ছিল আমার। কিন্তু আমি তো নিইনি মা। ছোট ডাক্তার বলে দিল কিডনি ঠিক আছে, কিচ্ছু হয়নি। তোমাকে আঁশ আছে এমন খাবার খেতে না করে দিল। ব্যস, শাক সবজি বন্ধ। তোমাকে শুধু মাছের সুপ গেলানো হচ্ছে। তুমি খেতে পারতে না ওইসব সামুদ্রিক মাছ। খেতে ইচ্ছে করতো না ওসব দুর্গন্ধ জিনিস। কিন্তু কী করবে মা, পৃথিবীর অন্যতম ধনী দেশে, বিদ্যাবুদ্ধির বিশেষজ্ঞ সাদা ডাক্তারদের চিকিৎসার সুবিধেপাচ্ছো, তোমার মতো ভাগ্যবতী কে আছে বলো। তোমাকে বলতাম আমি। মাছের সুপ খাইয়ে তোমাকে আমি বলতাম, নিশ্চয়ই এখন ওই ব্যথাটা তোমার জন্মের মতো গেছে। তুমি মলিন হাসতে। মাথা নেড়ে বলতে, এখনও আছে। এখনও আছে? বাজে কথা বলছো কেন? আমার অবিশ্বাস দেখে মনে মনে নিশ্চয়ই তুমি দীর্ঘশ্বাস ফেলতে। অথবা একা একা নিচের ওই খুপরি ঘরটায় গিয়ে কাঁদতে। সারাদিন না খেয়ে থাকলেও, তিনবেলা ইনসুলিন নিলেও তোমার ব্লাড সুগার যেমন উঁচুতে তেমন উঁচুতেই। এসবের কোনও কারণ জানার ইচ্ছে ওই সাদা ডাক্তারের হয়নি। তোমার বমি হয়ে যেত মাছের সুপ খেতে গিয়ে। ধমক দিয়ে বলতাম–এসবই তোমাকে খেতে হবে। এসব খেলেই তোমার অসুখ সারবে। তুমি নিশ্চয়ই ভয় পেতে আমাকে, তোমার অসুখের কিছুই বুঝতে পারেনি ডাক্তার–এ কথাটা বলতে ভয় পেতে। ভয় তোমার আমি বিরক্ত হব, আমার শান্তি নষ্ট হবে। তোমার মতো ক্ষুদ্র তুচ্ছ মানুষ আমার মতো বিশাল বিখ্যাতর শান্তি নষ্ট করলে চলবে কেন! তুমি আমাকে বললে না যে তোমার কোনও কষ্ট আর আছে, বললে না ব্যথাটা আছে। কিন্তু পেটে হাত রেখে যখন সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে, লক্ষ করে বলতাম, কী ব্যাপার, পেটে হাত কেন? ব্যথা এখনও আছেনাকি? তুমি অপ্রস্তুত হতে। ওষুধ দিয়েছে ডাক্তার ব্যথা কমার, সুপ খেতে বলেছে, ফাইবার বন্ধ। তারপরও ব্যথা না কমার তো কোনও কারণ নেই। মানে, দোষটা ডাক্তারের নয়, চিকিৎসার নয়, দোষটা ওষুধের নয়, দোষটা ফিস সুপের নয়, দোষটা তোমার। তোমার শরীরের। তোমার শরীর নিয়ে, তোমার নিজেকে নিয়ে তোমার কুণ্ঠার শেষ ছিল না। ওই দূর নির্বাসনে তুমি আমাকে আর অস্বস্তি দিতে চাওনি। তাই নিজের রোগশোক লুকিয়ে রাখতে। বলতে না যে কমোড ভরে যায় রক্তে। বলতে না, কারণ এসেই তোমার ডায়বেটিসের দুশ্চিন্তা আমাকে দিয়েছো, পেটের ব্যথার সমস্যা দিয়েছে। ডাক্তারের কাছে দৌড়োদৌড়ি করেও না কমানো যাচ্ছে তোমার ডায়বেটিস, না পেটের ব্যথা। আবার যদি রক্তপাতের সমস্যার কথা বলো, তাহলে পাগল হয়ে যাবো। তাই বলোনি মা। তাই গোপন রেখেছিলে ওই সমস্যা। তুমি বেশ বুঝতে পারছিলে, ওই রক্তপাতের সঙ্গে তোমার ওই ভয়ংকর অসুখের কোনও সম্পর্ক আছে আর ওই ভয়ংকর অসুখের সঙ্গে তোমার পেটের ব্যথাটিরও সম্পর্ক আছে। ডায়বেটিস আর কিডনি আর ফাইবার আর ফিস সুপ এসবঅহেতুক, এসব অনর্থক। কিন্তু আমি যেহেতু তোমার বলার পরও বুঝতে পারছি না, অথবা বুঝতে চাইছি না, তুমি আর যাই করো, শরীরের সমস্যার কথা বলে আমাকে বিপর্যস্ত করোনি। সাদায় আমার ভক্তি ছিল, তোমার কাছে সাদা-কালো-বাদামি মানুষ হিসেবে সবাই সমান ছিল। সাদা দেখলে তুমি ভক্তি শ্রদ্ধায় মাথা নোয়াতে না। সাদা ডাক্তাররা যে তোমার অসুখটা খুঁজে পায়নি, তা আমি বুঝিনি, তুমি বুঝেছিলে। তোমাকে কষ্ট কি কম দিয়েছি মা! পাড়ার ছোট ডাক্তার রক্ত পরীক্ষা করতে ক্যারোলিন্সকা হাসপাতালে পাঠিয়েছিল। ক্যারোলিন্সকা সুইডেনের বড় হাসপাতাল। ওখানকার ল্যাবরটরিতে রক্ত পরীক্ষা হয়েছে। ওখানকার ডাক্তার বলে দিয়েছে রক্তে কী একটা ভয়ংকর জীবাণু পাওয়া গেছে। ডাক্তার আমাকে জরুরি তলব করলো। তোমার যে কটা নষ্ট দাঁত আছে, সব নাকি ফেলে দিতে হবে। কেন? সেই জীবাণু নাকি পচা দাঁতে জন্ম নেয়, আর দাঁত থেকে সোজা দৌড়ে যায় হৃৎপিণ্ডে, হৃৎপিণ্ডে গিয়ে যা ইচ্ছে তাই করে। তুমি হাসলে শুনে। তোমাকে দাঁতের ডাক্তারের কাছে টেনে নিয়ে গেলাম, তোমার দাঁত পরীক্ষা করে ডাক্তার বললো, আমার দাঁতের চেয়ে তোমার দাঁত বেশি মজবুত, কোনও নষ্ট বা পচা দাঁত তোমার নেই। কিন্তু ছোট ডাক্তার ক্যারোলিন্সকার বড় ডাক্তারের উপদেশ শুনে বলে দিল, দাঁত যে করেই হোক ফেলতে হবে, তা না হলে হৃৎপিণ্ডে গিয়ে হৃৎপিণ্ড অচল করে দেবে ভয়ংকর ব্যাকটেরিয়া। তোমার দাঁতে কোনও সমস্যা ছিল না। তারপরও ভালো ভালো দাঁত একের পর এক তোলা হল। সাদা ডাক্তারদের চিকিৎসা। তোমাকে মানতেই হবে। তুমি না মানতে চাইলেও আমার জোর জবরদস্তিতে তুমি রাজি হলে। রাজি না হয়ে তোমার উপায় কী ছিল মা। দাঁতের ডাক্তারের খুব খারাপ লেগেছিল হয়তো ভালো দাঁতগুলো ওভাবে সাঁড়াশি দিয়ে তুলে তুলে আনতে। কিন্তু বাজে ব্যাকটেরিয়ার ব্যাপার। দাঁতের ডাক্তারের আর করার কী ছিল! হয়তো ভেবেছিলো কালো মানুষদের দাঁত থাকলেই কী, না থাকলেই কী। তাই প্রশ্ন করেনি। আফশোস করেনি। যন্ত্রের মতো মানুষদের মনে কী হচ্ছে, তা বোঝা সত্যিই শক্ত। মা, তোমাকে জোর করে দাঁত তুলিয়েই যে তোমাকে নিস্তার দিয়েছি তা নয়। তোমাকে তক্ষুণি ভর্তি করাতে বললো দানদিরুদ হাসপাতালে। দানদিরুদ হাসপাতালটা সংক্রামক রোগের জন্য। তোমার ওই ব্যাকটেরিয়া নির্মূল করতে হলে ওই হাসপাতালেই ভর্তি করতে হবে। করিয়ে দিলাম ভর্তি। সন্ধেবেলা সুয়েনসন বাড়ি ফিরলে ওর সঙ্গে একটুক্ষণের জন্য তোমাকে দেখতে যেতাম। তুমি চাইতে না আমি আমার সময় নষ্ট করি তোমার কাছে বসে থেকে। বলতে যেন বাড়ি চলে যাই। তুমি হয়তো ভেবেছিলে হাসপাতালে যখন ভর্তি হয়েছে, বড় বড় ডাক্তার তোমাকে দেখবে। তোমার ওই ভয়ংকর অসুখটা নিশ্চয়ই এবার ধরতে পারবে ওরা। কিন্তু ক্যারোলিন্সকার ল্যাবরটরিতে পাওয়া ওই ব্যাকটেরিয়া দূর করার দায়িত্ব শুধু ওরা নিয়েছে। ওরা তোমার কোনও অসুখ আবিষ্কারের জন্য তো বসে নেই। ওরা তোমাকে সাধারণ অ্যান্টিবায়োটিকের চেয়ে লক্ষ গুণ বেশি ক্ষমতার খুব কড়া কড়া অ্যান্টিবায়োটিক দিল স্যালাইনের সঙ্গে। তুমি কি ভেবেছিলে ওরকম স্যালাইনের সঙ্গে ওষুধ দিয়ে তোমার ভয়ংকর অসুখটাকে হয়তো নির্মূল করবে! না মা না। সাতদিন তোমাকে ভয়ংকর যন্ত্রণা দিল। সিরিঞ্জ ভরে ভরে প্রতিদিন তোমার রক্ত নিয়েছে আর ব্যাগ ভরে ভরে তোমার শরীরে ঢুকিয়েছে ভয়ংকর জীবাণু দূর করার জন্য ভয়ংকর জীবাণুনাশক। সাতদিন প্রায় একা একা তোমাকে থাকতে হল। তুমি থাকতে চাওনি হাসপাতালে, কারণ আমি ওই যে যাই তোমাকে দেখতে, ভেবেছো আমার স্বাভাবিক জীবন যাপনে ব্যাঘাত ঘটছে, তোমার জন্য বাড়তি ঝামেলা আমার হোক, তা মেনে নেবে কেন! তুমি বাড়ি ফিরে আসার পরদিন হাসপাতাল থেকে জানিয়ে দিয়েছে, ক্যারোলিন্সকা ল্যাবরটরির পরীক্ষায় যে ডেডলি ব্যাকটেরিয়া পাওয়া গিয়েছে বলা হয়েছিল, তা ভুল। ল্যাবরটরির ভুল। ওরকম কোনও ব্যাকটেরিয়া আসলে ছিল না রক্তে। কোথাও তাদের ভুল হয়েছিল। বাহ। তোমার দাঁতগুলো ফেলে দেওয়ারপর, তোমাকে জীবননাশ করা জীবাণুনাশক রক্তে প্রবেশ করিয়ে বলে দিল, ভুল। এই ক্যারোলিন্সকা ইনস্টিটিউট থেকে মেডিসিনে নোবেল প্রাইজ দেওয়া হয় মা। কী করবো, কোথায় যাবো। কারও বেলায় এমন হয় না, তোমার বেলায় হলো। ভুল শুধু তোমার বেলায় হয়। ভুগতে হয় তোমাকেই। হয় তোমার চিকিৎসা হয় না, যদি হলোও কখনও জীবনে, ভুল হলো। মাড়িতে দাঁত নেই, বলতে চিবোতে পারছো না খাবার। অভিযোগ করোনি, শুধু বলেছো। হেসেই বলেছো। সান্ত্বনা দিয়েছি, দাঁত গেলে এমন কী, বাঁধানো যাবে। তোমার চুলে কোনও পাক ধরেনি। ত্বকে কোনও ভাঁজপড়েনি। এত কম বয়সী একজনের দাঁত বিদেশি ডাক্তাররা মিছিমিছি তুলে নিল? আমেরিকায় হলে এই ডাক্তারদের বিরুদ্ধে ভুক্তভোগী রোগীরা বিলিয়ন ডলারের ক্ষতিপূরণ মামলা করতো। কিন্তু আমি কী করে কার বিরুদ্ধে মামলা করবো? মানুষ আমাকে সেলিব্রিটি ভাবে, বিশাল ক্ষমতাশালী কিছু একটা ভাবে, কিন্তু আমার মতো নিরীহ নিরুপায় মানুষ কজন আছে! নেই, সে কথা এখন জানি আমি। তখন জানিনি। দেশে থাকলে তোমার চিকিৎসা করাতে কোনও তো অসুবিধে হতো না মা। ওখানে আমার বন্ধুদের, বা পরিচিত ডাক্তারদের নিশ্চয়ই পেয়ে যেতাম যে কোনও হাসপাতালে। আর না পেলেও আমাকে তো সবাই চিনতো। সুইডেনে একসময় মানুষ সবাই আমাকে চিনেছিলো, খুব বড় খবর ছিলাম আমি। ধীরে ধীরে সবাই ভুলে গেছে। একসময় তো রাস্তাঘাটে চলতে গেলে মানুষ আমাকে দেখতে ভিড় করতো, দৌড়ে এসে অটোগ্রাফ চাইতো, নয়তো দূর থেকে অভিনন্দন বা শুভেচ্ছা জানাতো। এখন আমি যে কোনও সাধারণ মানুষের মতো। সারাক্ষণ যদি টিভিতে, পত্রিকার পাতায় ছবি না বেরোয়, তবে ভুলে যেতে আর কতক্ষণ এই মুখটি! রং সাদা নয় বলে যে কোনও অভিবাসীর মতোই আমি, অর্থনৈতিক সুবিধের জন্য গরিব দেশ থেকে যেমন হাজার হাজার লোক এসে ধনী দেশে আশ্রয় চায়, তাদের মতোই তো দেখতে আমি। আমার দিকে সাদারা নিশ্চয়ই তেমন চোখেই তাকায়, যেমন চোখে আর সব ডার্টি ইমিগ্রেন্টদের দিকে তাকায়। তবে নামটি শুনে এখনও লোকে স্মৃতি হাতড়ে তুলে আনে, তুমি তো লেখক, তাই না? আজকাল না বলি। নিজের পরিচয় দিতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু ডাক্তারদের কাছে তো তোমার নাম বলতে হয়েছে, আমার নাম নয়। আগ বাড়িয়ে নিজের নাম পরিচয় দিয়ে সুবিধে চাইবো, সে রুচি আমার কোনওদিনই ছিল না, তখনও হয়নি যখন তোমার জন্য সুবিধের বড় দরকার ছিল। তোমার জন্য ব্যক্তিত্বটা একটুখানি বিসর্জন দিয়ে যে নিজেকে চেনাবো, আমি যে ডার্টি কোনও ইমিগ্রেন্ট নই, রীতিমত একজন নামকরা লোক, মনে করিয়ে দিলেই লোকের মনে পড়বে, আমার মাকে ভালোভাবে দেখবে, ভালো চিকিৎসা করবে, তা তো করিনি। এমন স্বর্গের মতো দেশ, এমন সমতা আর সাম্যের দেশ, মনে হত সবাইকে সমান চোখেই নিশ্চয়ই দেখে এই দেশ। পরে এসব ভুল আমার ভেঙেছে মা। সুইডেনেও ওই একই, স্বজনপ্রীতি বলো, ক্ষমতা ব্যবহার বলো, সবই চলে। লেখক হলে, নামী দামী কিছু হলে খাতির জুটবেই। তুমি যখন ছিলে, এসব সত্য উদ্ধারের কোনও চেষ্টা আমি করিনি। নিজের নাম পরিচয় লুকিয়ে সাধারণ যে কোনও মানুষের মতো হাসপাতালে গিয়েছি। সবাই মিলে তোমাকে যন্ত্রণা দিয়েছি। দানদিরুদ হাসপাতালে ডাক্তার অ্যানডার্সকে দেখার পর নিজেকে সরিয়ে নিয়েছি যেন আমাকে দেখতে না পায়। ওখানেও ওই একই ব্যাপার হয়তো কাজ করেছিলো, কমপ্লেক্স। অ্যানডার্সকে গিয়ে যে বলবো আমার মা অসুস্থ, এই হাসপাতালে ভর্তি, বলিনি। যে অ্যানডার্স আমার ফোনের উত্তর দেয়নি, তার সঙ্গে কেন আমি কথা বলবো! হীনম্মন্যতা নাকি অহংকার কে জানে। অ্যানডার্স চোখের ডাক্তারের নাম ঠিকানা দিয়েছিলো বাবার চোখের ছানি কেটে যখন লেন্স পাল্টে দেওয়া হয়েছিল। বাবা চোখে কী ঝকঝকে দেখেছিল তারপর। প্রচুর টাকা লেগেছিলো সোফিয়া হেমেটের মতো বড় হাসপাতালে। পেন ক্লাবকে বলে দেবে টাকাটা দিয়ে দিতে, অ্যানডার্স বলেছিল। আমি সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করে বলেছি, পেন ক্লাব দেবে কেন, আমিই নিজেই বিল মেটাবো। পরদিনইপঁয়ত্রিশ হাজার ক্রোনার পাঠিয়ে দিয়েছিলাম ডাক্তারের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে। পরে অ্যানডার্স একদিন এসে আমাকে ডিনারে নিয়ে গিয়ে বলেছিলো, সব টাকা দিয়ে দিলে? নয় কেন? আমার বাবার চোখ অপারেশনের টাকা আমি দেব না তো কে দেবে? আমি কি ভিখিরি নাকি যে অন্যের কাছে চাইবো? সুইডিশ পেন ক্লাব থেকেপাওয়া কুর্ট টুযোলস্কি পুরস্কারের টাকা ওভাবেই খরচা করেছি। টেলিফোন বিলে, বাবার চোখ অপারেশনে, আর বাকিটা হাবিজাবিতে। টাকা উড়ে যেতে খুব বেশিদিন সময় নেয়নি। বাবার বেলায় তো এমন কাণ্ড ঘটেনি। বাবাকে একরাতও হাসপাতালে থাকতে হয়নি। যেদিন অপারেশন, সেদিনই বাড়ি ফেরা। রোগ ধরতে ডাক্তারদের কোনও অসুবিধে হয়নি। কোনও ভুল চিকিৎসা হয়নি। কী দোষ করেছিলে যার শাস্তি তোমাকে জীবনভর পেতে হলো! সম্ভবত দোষ করোনি বলেই শাস্তি পেতে হয়েছে। আমাকে নির্বাসনের শাস্তি পেতে হলো দোষ না করে, মানুষের ভালো করতে গিয়ে। তুমিও তো সারাজীবনে কেবল মানুষের ভালো করেছে, তাই সারাজীবনই তোমাকেযন্ত্রণা পোহাতে হয়েছে। সুখ পাওনি কারও কাছ থেকে। অন্যের ভালো করা যার স্বভাবে চরিত্রে রক্তে, তা কী করে কেদূর করবে! এর কারণে ভুগলেও স্বভাব কোথায় যাবে। মানুষের মার খাবে, তারপরও মানুষের জন্যই জীবন দেবে।
.
একদিন সকালে তোমার ওই নিচের তলার ছোট ঘরটিতে গিয়ে দেখি তুমি জ্বরে কাতরাচ্ছো। সারারাত আমাকে ডাকোনি। কপালে হাত রেখে দেখি গা তোমার পুড়ে যাচ্ছে। সেদিন আমি তোমার জন্য মায়ায় করুণায় কথা বলছিলাম কেঁদে কেঁদে, বলছিলাম, চলো, হাসপাতালে চলো। আমি তোমার জন্য কাঁদছি, তোমার এমন ভীষণ জ্বর হয়েছে বলে। ওই জ্বরের কষ্ট তুমি মুহূর্তে ভুলে গেলে, তোমার মুখে কী একটা দাতি ছিল মা। পরে তুমি আমার জন্য কাঁদছিলে মা? ” বলছিলে যখন, তোমার চোখ বেয়ে বৃষ্টির মতো জল ঝরছিল। ওই জ্বর-কাতর মুখে তৃপ্তি। প্রথম বোধহয় কাউকে জীবনে তোমার জন্য কাঁদতে দেখেছো। কতটুকু আর কেঁদেছি, কয়েক ফোঁটা চোখের জল। তোমাকে জ্বর থেকে বাঁচাতে হবে। জ্বর কমছিল না কিছুতেই তোমার। যাচ্ছে আসছে। ঠান্ডা জল-ভেজা তোয়ালে দিয়ে গা মুছিয়ে দিচ্ছি। ওষুধ দিচ্ছি। আবার আগুন হয়ে যাচ্ছে শরীর। শেষে হাসপাতাল। হাসপাতাল থেকে ফিরে তুমি দেশে ফিরে গেলে মা। আর থাকোনি। আমিও আর থাকতে বলিনি। তোমাকে ব্রাসেলসে ছোটদার কাছে দিয়ে এসেছিলাম। তোমাদের সঙ্গে একদিন থেকে, তোমাদের বিমান বন্দরে বিদায় জানিয়ে তবে আমি স্টকহোম ফিরেছি। বিদেশে একা একা চলা ফেরায় আমি ভীষণ অভ্যস্ত। তোমার হাতে বলেছিলাম আমি কিছুটাকা দিয়ে দেব। শেষ অবধি দিইনি মা। বলেছি, ‘ছোটদার খুব টাকার লোভ, ও তোমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেবে। ছোটদার স্বভাব থেকে সাবধান থাকার জন্য আমি কপর্দকশূন্য তোমাকে কপর্দকশূন্য হিসেবেই দেশেপাঠালাম। বলেছিলাম, তোমার হাতে না দিয়ে টাকা তোমার ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে পাঠিয়ে দেব। তুমিও গেলে, আমিও টাকা পাঠানোর কথা ভুলে গেলাম। তোমার হাতে কোনও টাকা পয়সা দেবার তো কেউ ছিল না মা কোনওদিন। আমার কাছে হয়তো আশা করেছিলে মনে মনে, কিন্তু পেলে না। আমি ইচ্ছে করলেই কি টাকা তোমাকে দিতে পারতাম না? আমার তো অভাব ছিল না মা! কেন তবে তুমি বলো যে জীবনের সবচেয়ে সুখের সময় তুমি সুইডেনে আমার সঙ্গে কাটিয়েছে, কেন বলো তোমাকে আমি ভালোবাসা দিয়েছি খুব! দিইনি মা, সারাজীবন ঠকেছো তুমি। তোমাকে তোমার মেয়ে আবারও ঠকালো। তুমি বোকা, চিরকালের বোকা, তাই বোঝোনি কিছু।
তুমি ছোটদার পক্ষ নিয়ে কথা বলতে, বলতে ও তোমাকে ভালোবাসে। এ আমার সইতে না। ছোটদা যে মোটেও ভালো ছেলে নয়, ও যে আমার উপদেশ অমান্য করে তার বউ ছেলেমেয়েকে আমেরিকায় পাঠিয়ে মস্ত ভুল করেছে, তা-ই তোমাকে আমি দিনের পর দিন বুঝিয়েছি। সুহৃদের মানসিক অবস্থা যে খুব খারাপ বুঝিয়েছি, সুহৃদকে যে এখনও তার মা শারীরিক মানসিক অত্যাচারের মধ্যে রাখে বুঝিয়েছি, সুহৃদ হয় পাগল হয়ে যাবে, নয় আত্মহত্যা করবে বুঝিয়েছি, সুহৃদকে মানুষ করতে হলে তার মার কবল থেকে যে তাকে বাঁচাতে হবে বুঝিয়েছি। তুমি মাথা নিচু করে বুঝেছো। ছোটদার ওপর তার পরও তোমার রাগ হয় না। তুমি তারপরও আমার মতো করে ছোটদাকে দোষ দাও না। দেখে তোমার ওপরই অসন্তুষ্ট হই আমি। তোমাকে বলেছিলাম ছোটদা যে সুহৃদের জীবনটা নষ্ট করে দিল, সে সম্পর্কে কিছু বলতে। ভিডিওতে আমাদের অনেক কথপোকথন রেকর্ড করার মতো তোমার মন্তব্যও রেকর্ড করতে চাইছিলাম আমি। ছোটদা যে একটা অপদার্থ আর লোভী গোছের পাষণ্ড সে সম্পর্কে কিছু বলো চাইছিলাম। তুমি বলেছিলে, ‘এসব কথা থাক। এ নিয়ে তুমি কিছু বলতে চাও নি। ছোটদার কাছে কৃতজ্ঞ ছিলে তুমি। আমাকে ঢাকায় যখন পুলিশের গ্রেফতার এড়াতে আর মৌলবাদীদের ফাঁসি এড়াতে দীর্ঘ দুমাস লোকের বাড়িতে বাড়িতে লুকিয়ে থাকতে হয়েছিল, ব্যারিস্টার সারা হোসেন খুব জরুরি হলে বাড়ির কাউকে ডেকে পাঠালে দাদা বা ছোটদা দুজনই যেত, যেহেতু দাদাকে আবার ময়মনসিংহে চলে যেতে হত, ছোটদাই অনেক সময় যেত দেখা করতে। সারা হোসেন রলে দিত, হাইকোর্টে আমার সারেন্ডার করার সম্ভাব্য তারিখের কথা। একবার ছোটদার সঙ্গে গোপন ফোনে কথা বলে তাকে রাতের অন্ধকারে ঝএর বাড়িতে আসতে বলেছিলাম। জগতের কেউ জানে না আমি কোথায়, শুধু ছোটদা জানে, তার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে। ছোটদারই ক্ষমতা আছে আমার সঙ্গে দেখা করার। তখন থেকেই তুমি ছোটদাকে ভগবানের উচ্চতায় বসিয়ে দিলে। ছোটদা বাড়িতে এসে ভাব দেখাতো যে সে বিশাল কিছু একটা করছে আমার জন্য। বিশাল কিছু আমার জন্য করতো ক, খ, গ, ঘরা, তুমি জানতে না। কিন্তু আমার সঙ্গে যেহেতু বাড়ির আর কারও যোগাযোগ নেই, শুধু ছোটদার সঙ্গেই আছে, তুমি ভাবতে, ছোটদাই বুঝি আমার এখন সবচেয়ে বড় ভরসা। ছোটদাই আমাকে জায়গায় জায়গায় লুকিয়ে রাখছে, ছোটদাই আমাকে মৌলবাদীদের হাত থেকে রক্ষা করছে, ছোটদাই ব্যারিস্টারদের সঙ্গে কথা বলে আমাকে বাঁচানোর ব্যবস্থা করছে। তুমি তখন ছোটদাকে রাজার আদরে তো বটেই, গীতাকেও রানির আদরে রেখেছিলে। সবাই তখন আমার শান্তিনগরের বাড়িতে। কোথায় ছোটদাকে সাহায্য করলাম আমি, ডেকে নিয়ে আমার ব্যাংক থেকে যত খুশি টাকা তোলার অধিকার লিখিতভাবে দিয়ে দিলাম, আর আমাকে সাহায্য করার নাম কামালো ছোটদা।
সুইডেনে শেষের দিকে তুমি অল্প কিছু খেতে, একসময় সেও আর খেতে পাচ্ছিলে না। প্রায়ই বলছিলে ক্ষিধে নেই। পেট ভরা ভরা লাগে, খেলে গা গুলিয়ে আসে। বমি ভাব হয়। ভাব কেন, বমিই হয় তোমার। খেতে পাচ্ছো না, খেলে বমি হয়ে যাচ্ছে। সুতরাং না খেয়ে কাটাবে স্থির করলে, আর আমিও তা মেনে নিলাম। এর নাম যদি ভালোবাসা, তবে অবজ্ঞা, অবহেলা, অপমান কাকে বলে মা? তোমার চলে যাওয়া ছাড়া আর কী উপায় ছিল। আমি লেখায় ব্যস্ত। তুমি যে কত বললে কত কাঁদলে যেন দেশে ফিরি, অবুঝ তুমি, তোমাকে বুঝিয়ে বললাম, আমার যাওয়া হবেনা দেশে। দেশে আমাকে ঢুকতেই দেবেনা। তখন আমার হাতে জাতিসংঘের ট্রাভেল ডকুমেন্ট। নিজের দেশের পাসপোর্টটি নেই আমার কাছে। ওটিকে আর নবায়ন করা হয় বাংলাদেশে দূতাবাস থেকে। তুমি আমাকে না নিয়ে দেশে ফিরবেনা, একথা প্রতিদিন বলতে, বারবার বলতে, সেই প্রথম দিন থেকে বলে আসছে। কিন্তু আমাকে না নিয়েই তোমাকে ফিরতে হলো মা। একা ফিরলে। তোমার দীর্ঘশ্বাসের কোনও শেষ ছিল না। কেঁদেছিলে খুব। আমি কি কেঁদেছিলাম? না মা, বরং হাতে করে নিয়ে যাওয়ার সুটকেসটায় এত বেশি কী জিনিস ভরেছো তাই নিয়ে আমি রাগ দেখাচ্ছিলাম। চাকাঅলা কোনও সুটকেস ছিল না তোমার। ব্রাসেলস এয়ারপোর্টে নিজেই তুমি বয়েছো সুটকেসটা। আমি তোমার ওই ভার বহন করিনি। আমার কিছু পুরোনো জুতো আমি ফেলে দিচ্ছিলাম, ওগুলো নিয়েছিলে দেশের গরিব মানুষকে দেওয়ার জন্য। নিজের জন্য কিছু নাওনি মা। নিজের জন্য একটা সুতোও তুমি নাওনি। যা কিনে দিয়েছিলাম, সব ধুয়ে পরিষ্কার করে ভাঁজ করে আমার আলমারিতে রেখে গেছো আমার জন্য। ওই অসুস্থ শরীরে হাবিজাবিতে ভরা ভারি সুটকেসখানি বইতে তোমার খুব কষ্ট হচ্ছিল। ওগুলো আমিই তোমাকে দিয়েছি, আবার ওগুলো এনেছো বলে আবার ফুঁসছি তোমার ওপর রাগে। অবশ্য ফুঁসছিলাম যতক্ষণ আমাকে বইতে হচ্ছিল। তোমার কাঁধে সুটকেস বহনের দায়িত্ব দেওয়ার পর আমার ফোঁসা কমে গেছে। একবারও কি ভেবেছিলাম তোমার তলপেটের যন্ত্রণার কথা! তোমার তো কোনও অসুখ নেই। ডাক্তাররা বলে দিয়েছে কিডনি ভালো, সুতরাং সব ভালো। বেশি বেশি করে ইনসুলিন দেবে, ডায়বেটিসটা কমাও, ব্যস সব ঠিক। আমি তো যাচ্ছি সুহৃদের দায়িত্ব নিতে আমেরিকায়। আমি তো ভালো, আমি তো প্রকাণ্ড হৃদয়বান। পরিবারে আমার মতো দায়িত্ববান আর কেউ আছে? কেউ নেই, তা প্রমাণ তো আমাকে করতেই হবে। যে তোমার মতো মানুষের একফোঁটা দায়িত্ব নিল না, সে ঠিক ঠিক চলে গেল আমেরিকায় অন্যের দায়িত্ব নিতে।
আমি তোমার কত কিছুই বুঝিনি মা। মাইকেল যেদিন তার মার বাড়িতে নিয়ে গেল আমাদের, যেহেতু তার মার আলজাইমার অসুখ, দূর অতীতের কথা মনে থাকলেও কাছের অতীতের কথা ভুলে যান, একই কথা বার বার যখন বলছেন, চায়ে চিনি দেবেন কী দেবেন না, এক বিস্কুট তোমাকে অন্তত পঁচিশবার নিতে বললেন, তুমি না শব্দটিও পঁচিশবার বলেছো, একটুও বিরক্ত হওনি। চা খাওয়ার মাঝখানে একবার তুমি বাথরুমে গেলে। বাথরুম থেকে মলিন মুখে এসে বসার পর জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে? বমি? তুমি স্নান হেসে মাথা নেড়েছিলে। না। হয়নি বমি। কিন্তু মা, তোমার তো ভীষণ রক্ত গিয়েছিল। একই রকম ব্রাসেলসের হোটেলেও কমোড ভরে রক্ত গিয়েছে। আমাকে বলোনি কিন্তু কিছুই বলোনি আমাকে, লুকিয়ে রেখেছে। যাবার আগে আমাকে আর বিব্রত করতে চাওনি। তুমি এই যে আমাকে নিতে এসেছিলে, বলেছিলে আমাকে ছাড়া তুমি দেশে ফিরবে না, তোমার এই আবদারকে আমি ছেলেমানুষি ভেবেছিলাম, আর সবার মতো, বাবা, দাদা, ছোটদা সবার মতো। তুমি কিন্তু একে ছেলেমানুষি বলে ভাবোনি। তোমার নিজের জীবনের চেয়েও তোমার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল আমার দেশে ফেরা। তাই ভেঙে গেলে, টুকরো টুকরো হয়ে গেলে, নিঃশেষ হয়ে গেলে, আমাকে তুমি শত চেষ্টা করেও দেশে ফেরাতে পারোনি। তারপরও আমাকে বলে এসেছো, অন্তত সুইডেন থেকে যেন যাই, আমেরিকায় যেতে চাইছি তাই যেন যাই, তবে যেখানেই থাকি, দেশে ফেরার চেষ্টা যেন করে যাই। নিজের বাড়িঘর, নিজের আত্মীয়স্বজন ছেড়ে যেন বিদেশ বিভুইএ না থাকি। মা, ব্রাসেলস এয়ারপোর্টে তোমাদের যখন বিদেয় দিচ্ছিলাম, খুব অসহায়, খুব মলিন লাগছিলো তোমার মুখ। মা, তুমি বিদেশের ঝকঝকে দালানকোঠা দোকানপাটের দিকে মোটেও তাকাওনি। কেবল আমার দিকে তাকিয়েছিলে। কী প্রচণ্ড ভালোবাসতে পারো তুমি মা! ভালোবেসে নিজের জীবন উৎসর্গ নাকি করে মানুষ, শুনেছি, কোনওদিন দেখিনি। তোমাকেই দেখলাম। আমাকে দুশ্চিন্তা দেওয়ার চাইতে নিজেকেই দিলে দুরারোগ্য ব্যাধি।
.
মাইকেল যখন তার মার চেয়ারের পেছনে দাঁড়িয়ে কাঁধে অল্প অল্প করে দুহাতে চাপ দিয়ে দিয়ে মালিশ করে দিচ্ছিল, তোমার বিস্মিত চোখ সে থেকে সরেনি, একসময় অঝোরে ঝরতে থাকা নিজের চোখের জল মুছতে শুরু করলে। কেন কাঁদছো জিজ্ঞেস করলে তুমি কোনও উত্তর দিতে পারোনি। যেন ভাবতে চেষ্টা করেছিলে কেঁদেছিলে কেন! আবারও জিজ্ঞেস করেছিলাম, দেশে চলে যাচ্ছে বলে? না। পেট ব্যথা করছিল? না। তবে কেন? মাইকেল তার মাকে খুব ভালোবাসে, এই দৃশ্যটা দেখতে ভালো লাগছিল, তাই। তাই কাঁদবে কেন? ভালো লাগলে মানুষ তো মাঝে মাঝে কাঁদেও। আনন্দাশ্রু। হ্যাঁ তাই। তোমার কি মনে হচ্ছিল, তোমাকে ওভাবে তো তোমার ছেলে মেয়েরা কেউ আদর করে দেয় না! কী গো মা, এত কাজ করছে, এসো তোমার পিঠটায় একটু মালিশ করে দিই, কেউ তো বলিনি কোনওদিন তোমাকে। কেউ তার মাকে আদর করছে দেখলে তোমার চোখে জল আসে কেন! কেউ তার মাকে ভালোবাসলে তোমার ভালো লাগে কেন এত! কী তুমি পাওনি, কী থেকে তুমি বঞ্চিত, তা নিশ্চয়ই তখন বুঝতে পারো। যে মায়েরা ছেলেমেয়েদের আদরপায় তাদের খুব ভাগ্যবতী বলে মনে হয় তোমার, তাই হয়তো ওদের ভাগ্য দেখে, ওদের আনন্দ দেখে তোমার চোখে আনন্দাশ্রু জমা হয়। তুমি কি মাইকেলের জায়গায় দাদাকে বা ছোটদাকে আর মাইকেলের মা’র জায়গায় তোমাকে কল্পনা করে নিয়েছিলে, তাই তোমার ওই ভালো লাগার বোধটা ছিলো? কিছুই বলেনি। তুমি যে কী নিখুঁত শিল্পী মা, কী যে উঁচু মানের মানুষ, কী যে শিক্ষিত, কী যে ভদ্র, কী যে আধুনিক, কী যে বুদ্ধিমতী তুমি–সুইডেনে ওই কটা মাস তোমাকে না দেখলে কোনওদিন জানতে হয়তো পেতাম না। তোমাকে আগে তেমন দেখিনি যেমন দেখেছিলাম। অথবা কী রকম যে তুমি, তা তখন না অনুধাবন করলেও পরে করেছি। এক এক করে যখন মনে পড়েছে তোমার সব হাসিখুশিকে, দুঃখবেদনাকে, মনে পড়েছে তোমার কথা, কাজ, তোমার বিচক্ষণতা, বুদ্ধিমত্তা। যাকে বোকা হিসেবে চিরকাল বিচার করেছি, তার বুদ্ধি দেখার পরও সেটাকে ঠিক বুদ্ধি বলে তক্ষুনি মনে হয় না। কোনও বাজে প্যাঁচাল, কোনও বাড়তি কথা বলেনি। অনর্গল বলেছি আমি। আজকাল যখনই পেছনের দিকে তাকাই, তোমাকে দেখি। তখন আমার চোখ থাকলে দেখতে পেতাম তোমাকে। স্থিত, স্নিগ্ধ তোমাকে। তুমি হয়তো বুঝতে পেরেছিলে আমাকে আর তোমার অসুখ সম্পর্কে বলে লাভ নেই। যে আমি বুঝতে পারছি না, সে আমি বুঝতে পারবোও না। দেশে ফিরে যাওয়ার আগের দিন তোমাকে ব্রাসেলস শহর থেকে খানিকটা দূরে নিয়ে গিয়েছিলাম, একটা গুহায়। গুহার ভেতর অসংখ্য স্ফটিক। হাজার বছর ধরে জল জমে জমে জল বরফ হয়ে শেষে ক্রিস্টাল হয়ে গেছে। গুহার ছাদ থেকে ঝুলে আছে, নানা আকারের ক্রিস্টাল। ভাবা যায় কোনও একসময় এরা শুধু জল ছিল! গুহাটা দেখতে প্রচুর লোক আসে। গুহায় যেতে হলে প্রচুর সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে হয়। নামতে চাইছিলে না তুমি। চাইছিলে না কারণ ওঠা নামা করলে তোমার প্রচণ্ড ব্যথা হয় পেটে। আমি তা শুনবো কেন! তোমাকে জগৎ দেখাবো। বিদেশ যে চমৎকার জায়গা তা তোমাকে না দেখালে আমার চলবে কেন? জোর করে নামালাম তোমাকে। বলতে বলতে নামালাম যে জীবনে এই জিনিসটা না দেখলে তোমার জীবন অপূর্ণ থেকে যাবে। কিন্তু ঘামতে ঘামতে হাঁপাতে হাঁপাতে কষ্টে গোঙরাতে গোঙরাতে নেমেছে বটে। উঠতে তো পারছে না। উঠতে গিয়ে কাঁদছো। কী অসহায় ছিলে তুমি! তোমাকে ক্রমাগত কঠিন কঠিন কথা বলে যাচ্ছিলাম যেন যে করেই হোক ওপরে ওঠো। তুমি সিঁড়ির রেলিং ধরে যন্ত্রণায় নীল হওয়া মা, ধীরে ধীরে ওপরে উঠলে আমার তাড়ায়। এরকম আগেও একবার তুলেছিলাম মা তোমাকে ওপরে, এক রাতে গিয়েছিলাম ইনসুলিনের পেনসিল-সিরিঞ্জ নিতে স্টকহোমের এক চেনা লোকের কাছ থেকে। সেই লোকের বাড়ি চারতলায়। তুমি উঠতে চাইছিলে না। বললে তুমি উঠে নিয়ে এসো, আমি এখানে দাঁড়াই। আমি তোমাকে বললাম না, না, ওঠো। কেন উঠিয়েই ছাড়লাম তোমাকে? তোমার না উঠতে চাওয়ার ইচ্ছেকে কোনও মূল্যই কেন দিইনি, দিতে চাইনি? তা আমি আজও ভাবি। ওর পেছনে বোধহয় একটিই কারণ, তোমাকে মানুষ মনে করিনি কোনওদিন। ভেবেছি তোমার একটিইপরিচয়–তুমি ইস্কুল কলেজপাশ করোনি, তুমি পরনির্ভর, দুনিয়ার কিছু জানোনা বোঝো না, তোমাকে চলতে হবে আমরা যেভাবে বলি সেভাবে। সেভাবেই তো চলেছো জীবনভর। সেভাবে ছাড়া তোমাকে মানাবে কেন মা? এর নাম আর যাই হোক মা, ভালোবাসা নয়। একে অন্তত ভালোবাসা বোলো না।
যতদিন ছিলে আমার সঙ্গে, কিছুই দেখনি তুমি, আমার খ্যাতি, প্রতিপত্তি, যশ, কিছুই। কোনও দেশ থেকেও আমার জন্য কোনও আমন্ত্রণ আসেনি। আমি যে কত দেশে বক্তৃতা করেছি, কত সম্মান পেয়েছি, কত পুরস্কার, কিছুই তোমার নিজের চোখে দেখা হয়নি। ওসবে তোমার আগ্রহ খুব বেশি নেই। তুমি মনের খবর নিতে চাও। ভালো আছি তো। সুখে আছি তো। আমার সুখ দেখতে চাও তুমি। আর কিছু না। আমার ভালো লাগতো না একটুও, যে, তুমি দেখছো না মানুষ কী করে কত হাততালি দেয় আমার বক্তৃতা শুনে। একটা কোনও স্বর্ণপদকও পেতে দেখনি। কী দেখেছো মা তুমি? বাবা তো দেখেছিলো অনেক, আমার সঙ্গে দেশও ঘুরেছিলো অনেকগুলো। আমার বাবা বলে বাবাকেও অনেক সম্মান করেছে মানুষ। তুমিই সম্মান পাওনি। তোমাকেই কোথাও নিয়ে যেতে পারেনি। অন্য লোকের বাড়ির নিচতলায় পড়ে ছিলে, যতদিন ছিলে। আমি যে ঠিক স্বনির্ভর নই, দেখে গেছে। আমার মতো একশ ভাগ স্বনির্ভর মানুষকে পরনির্ভর হতে দেখে তোমার খুব দুঃখ হয়েছে সম্ভবত। একবার, রোজার সময় তোমাকে বলেছিলাম চল তুরস্ক থেকে ঘুরে আসি। ওটা মুসলিম দেশ, রোজা রাখতে পারবে। তুমি রাজি। কিন্তু একটা গরিব দেশের পাসপোর্ট বহন করছে বলে তোমাকে তুরস্কের ভিসা দেওয়া হল না। আমরা ফিরে এলাম ঘরে। তোমার মন খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল। আমার হাতে রাষ্ট্রপুঞ্জের ট্রাভেল ডকুমেন্ট। বাংলাদেশ ছাড়া আর সব দেশে ভ্রমণ করার অধিকার আমার আছে। তুরস্কেও যেতে পারি। কিন্তু তোমার পাসপোর্টে ভিসাই দেওয়া হবে না তোমাকে। নিয়ম হলো ভিসা নিজের দেশ থেকে সংগ্রহ করতে হয়, অন্য দেশ থেকে ভিসা হয় না। কিন্তু মা, বাবাকে এই সুইডেন থেকেই জার্মানির ভিসা, ডেনমার্কের ভিসা, ইংলন্ডের ভিসা তখন করিয়ে দিয়েছিলাম। ওসব জায়গায় সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলাম। আসলে সরকার থেকে বা বড় কোনও প্রতিষ্ঠান থেকে যখন আমন্ত্রণ জানানো হয়, তখন বস্তাপচা নিয়ম কানুনগুলো খাটে না। এত যে বিদেশের নিয়ম কানুনের সতোর প্রশংসা করে মুখে ফেনা তুলে ফেলি, একটু তলিয়ে দেখলেই তো দেখি, মামা কাকার জোর এখানেও খাটে। সরকারের লোক সাহায্য করলে এখানেও অসম্ভবকে সম্ভব করা যায়। তুমি আমাকে দেখেছো পরনির্ভর তোমার মতোই, আমার সেই জেদ তেজ, আমার সেই অহংকার, আত্মবিশ্বাস, আশ্চর্য সৌন্দর্য, সেই প্রাণ, সেই প্রতাপ কিছুআর নেই। পথে যখন বেরোই, আমি সেই আমি নই যাকে একশ লোকে চেনে। দেখেছো কেউ হয়তো কনুই ঠেলে চলে গেল। এত যে লোক ছিলো, রাস্তায় আমি হাঁটলে কাছে এগিয়ে আসতো, তুমি যতদিন সঙ্গে ছিলে, কেউ আসেনি আমার কাছে। আমি আর তুমি বরফ ছাওয়া রাস্তায় হেঁটেছি, ধনী সাদাদের দেশে দরিদ্র কালোরা যেভাবে হাঁটে, সেভাবে পায়ে পায়ে আড়ষ্টতা, হীনম্মন্যতা, সংশয়, শংকা। অন্তত আমি হেঁটেছি ওভাবে, তোমার ভেতরে কালো সাদা নিয়ে আমি কোনও রকম হীনম্মন্যতা দেখিনি। তুমি যে আন্তরিক স্বরে কালোদের সঙ্গে কথা বলো, সাদাদের সঙ্গে একই স্বরে বলো। তুমি সাদা শরীর যেরকম হৃদয় দিয়ে স্পর্শ করো, কালো বা বাদামি শরীর একই ভাবে করো। সাদাদের বেশি আদর করার, বা তাদের বড় মনে করার কোনও রকম প্রবণতা তোমার মধ্যে দেখিনি। এত আধুনিক তো আমিও সামান্য হতে পারিনি মা।
একসময় সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, সুয়েনসনের সঙ্গে কোনও কিছু নিয়ে কথা কাটাকাটি হওয়ায় সম্ভবত, যে, ওর গাড়ি আর ব্যবহার করবো না। এই সিদ্ধান্তটি তুমি থাকাকালীন ভয়াবহ শীতকালটায় না নিলেও পারতাম। তুমি চলে যাওয়ার পর সিদ্ধান্ত তো ঠিকই বদলেছিলাম। তোমাকে নিয়ে বাইরে বাজার করতে গিয়েছি বাসে চড়ে, পিচ্ছিল বরফে পায়ে হেঁটে। ওই জমে যাওয়া ঠাণ্ডায় বের করে করে তোমার নিউমোনিয়া বাধিয়ে ফেললাম। মা, খুব কষ্ট দিয়েছিলাম তোমাকে। আমি ট্যাক্সি নিতে পারতাম। কিন্তু নেবো কেন? তুমি সুইডেনে আসারপর হাড়কিপ্টের মতো হঠাৎ টাকার হিসেব করতে শুরু করেছিলাম মা। জানি না কেন, তুমি বলেই কী? আমি তো অঢেল টাকা পাঠাচ্ছিলাম অনেককে। কলকাতার এক বন্ধুকে গাড়ি কেনার টাকা, বাবাকেও গাড়ি কেনার টাকা, মাঝে মাঝে অকারণে টাকা, সুহৃদকে থিয়েটার, কনসার্ট ইত্যাদি দেখার জন্য, বড় বড় রেস্তোরাঁয় খাওয়ার জন্য, জমিয়ে কালচার করার জন্য টাকা। সুহৃদের টাকা পাঠাতাম ওয়ারেন নামে আমার এক আমেরিকার বন্ধুর কাছে। ওকে দায়িত্ব দিয়েছিলাম সুহৃদকে মানুষ করার জন্য বা মস্ত একটা আঁতেল বানানোর জন্য।
.
আমাকে নিতে এসেছিলে, ফিরে গেছো একা। খালি হাতে। এ নিয়ে তোমার দুঃখ ছিল। আমার ছিল না। জাতিসংঘের পাসপোর্টে বাংলাদেশ যাওয়া যাবে না, এ কথা বলে তোমার সব ইচ্ছেকে দুমড়ে দিয়েছি। তুমি দেশে ফিরে গেলে। আমি রয়ে গেলাম, অন্যের বাড়িতে, অন্যের আশ্রয়ে, অন্যের আদেশ নিষেধ মেনে। অন্যের বাড়িতে বাড়ি ভাড়া দিতে হতো না, কিন্তু বাকি দায়িত্ব ছিল আমার। কেউ দেয়নি সে দায়িত্ব, নিজেই নিয়েছিলাম। বাড়ির জিনিসপত্র কেনা, ঘরে বাইরে খাওয়া দাওয়া, ঘোরাঘুরি, সব আমার টাকায়। মাঝে মাঝে ভাবি, যে টাকা খরচ হতো আমার, তা দিয়ে দিব্যি শহরে কোনও বাড়ি ভাড়া নিতে পারতাম, এবং নিজের মতো করে থাকতে পারতাম। কিন্তু মা, যে দেশের ভাষা জানি না, চেনা মানুষগুলো হাওয়া হয়ে গেছে, সরকারি শুভাকাঙ্ক্ষীগুলোও হাওয়া, তখন কেমন যেন ভয় হতো বিদেশ বিভুইএ একা বাস করতে। অবশ্য হাওয়া কি সত্যিই হয়েছিল? নিজ থেকে কারও সঙ্গে যোগাযোগ করার আমার অভ্যেস ছিল না, ওরা যোগাযোগ করলে তবে যোগাযোগ হবে। ওরা না করলে? আগ বাড়িয়ে আজ অবধি কারও সঙ্গে যেচে কথা বলা আমার পক্ষে সম্ভবহয় না। তুরস্কে তো তোমাকে যেতে দিল না। সুইডেনের কোথাও তোমাকে নিয়ে যাওয়া হয়নি। শুধু স্টকহোম শহরটা দেখেছে। ফিনল্যান্ডে নিয়ে যাবো তোমাকে, জাহাজে করে সারারাতে যাবো, সারাদিন হেলসিংকি শহরে ঘুরে ফিরে আসবোপরদিন, এই সিদ্ধান্ত নিলাম একদিন। তোমাকে নিয়ে যা কিছু করছি, রাজি তো তুমি হচ্ছই। যা কিছু করতে ইচ্ছে হয় করে যেন ফিরে যাই দেশে তোমার সঙ্গে, দেশে। ফিনল্যাণ্ডে যাওয়ার তিনটেটিকিট কাটলাম। সুয়েনসনকেও সঙ্গে নিয়েছিলাম। গাব্রিয়েলা নামের বিশাল জাহাজটি দেখে তোমার খুব ভালো লেগেছিলো। কিন্তু সকালে হেলসিংকিতে যখন থামলো জাহাজ, কী আশ্চর্য সবাই তরতর করে নেমে যাচ্ছে জাহাজ থেকে হেলসিংকি শহরে, শুধু আমার আর তোমার পাসপোর্ট দেখতে চাওয়া হল। জাহাজ ভর্তি লোক সবাই সাদা, শুধু আমার আর তোমার রংই অসাদা। সুয়েনসন পার হয়ে গেছে। আমিও জাতিসংঘের পাসপোর্ট দেখিয়ে পার পেয়ে গেলাম। কিন্তু তোমাকেই বাধা দেওয়া হল। তোমাকে স্পর্শ করতে দেওয়া হবে না ফিনল্যান্ডের মাটি। হায় মাটি, কত যে পবিত্র মাটি! তোমার মতো পাপী মানুষের পা সেখানে রাখতে দেওয়া যাবে না। পাপ করেছে গরিব দেশে জন্মে মা। সুয়েনসনকে বলেছিলাম, তুমি বলো যে তোমার সঙ্গে মাকে এনেছো। বললে, আমার বিশ্বাস ইমিগ্রেশনের লোকেরা তোমাকে শহর দেখতে যেতে দিত। তুমি নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছো, সুয়েনসন কিছু বলতে চায়নি। শত অনুরোধেও সে মুখ খোলেনি। এরা এমনই মা, ভেতরে ভেতরে সবাই বোধহয় বর্ণবাদী, শুধু বর্ণবাদীই নয়, ভীতু, হিংসুক, স্বার্থপর। অনেক তো দেখা হল, উদার মানুষ যে নেই তা নয়, প্রচুর আছে। আমার কপালেই শুধু জোটে এসব। আমি বেরোলাম জাহাজ থেকে, আর লোকটি হনহন করে চলে গেল আগে আগে। আমি তাকে পেছনে বারবার ডেকেও থামাতে পারিনি। দুপুরের জন্য কিছু খাবার কিনে, খাবার আর কী, কিছু স্যান্ডুইচ কিনে নিয়ে এলাম। হেলসিংকি শহরে আগে আমি এসেছি। সরকারি আমন্ত্রণে, লেখকদের আমন্ত্রণেও। একা একা দেখা শহর আবার নতুন করে দেখার কোনও ইচ্ছে আমার ছিল না। খুব ক্ষিধে পেয়েছিলো তোমার। বসে থেকেছো নতুন একটি দেশের নদীর কিনারে। জাহাজের ছোট ঘরে। কিছুই তোমার দেখা হয়নি। রাতে তোমাকে খেতে নেবো জাহাজের রেস্টুরেন্টে, অপেক্ষা করছি সুয়েনসনের। সুয়েনসন উদয় হল, তাকে নিয়ে রেস্টুরেন্টে গেলাম। চক্ষুলজ্জা নেই লোকটির, আমার টাকায় জাহাজে এলো, আমার টাকায় দিব্যি খেলো, যত দামি খাবার মন চায়, খেলো। সারাদিনের জন্য যে হাওয়া হয়ে গিয়েছিলো আমাদের একা ফেলে, একটুও কিন্তু অনুতাপ করলো না। তুমি উদার, তোমার উদারতা আমার রক্তে। কিন্তু সুয়েনসনের মতো লোক উদারতার বিন্দুমাত্র পায়নি কোথাও থেকে। এভাবেই তুমি আর আমি মানুষকে উজাড় করে দিয়ে যাই। আমি পৃথিবীর আর সবার প্রতি উদার হলেও তোমার প্রতি নই। আর তুমি কী না বলো আমি তোমাকে ভালোবেসেছি! জাহাজেও তুমি খেতেপারছিলে না। বমিভাব ছিল। বমি হয়তো করেওছিলো কিছু খেতে গেলেই বলতে একেবারে গলা পর্যন্ত ভরে আছে, ক্ষিধে নেই। আমার কি একবারও সন্দেহ হতো, যে তোমার পেটে হয়তো সত্যিই কোনও অসুখ আছে! না, মা, হতো না।
.
মা, তুমি আমার কাছে তোমার অসুখের চিকিৎসা করাতে এসেছিলে। অসহায় চোখে তাকিয়েছিলে যেন চিকিৎসা করি। ভিক্ষে চাইছিলে। চিকিৎসা ভিক্ষে চাইছিলে আমার কাছে, মা। যেন সুস্থ করে তুলি তোমাকে। না মা, তোমাকে আমি কিছুই করিনি। আমাকে আর কোনও বিরক্তি দিতে তুমি চাওনি। আর কোনও অসুবিধে, অশান্তি দিতে তুমি চাওনি। বুঝেছো যে অসুখ নিয়েই তোমাকে চলে যেতে হচ্ছে। তিনমাস আমার কাছে থেকেও, আমাকে বারবার অসুখের কথা বলেও দেখেছো কোনও লাভ হয়নি। আমি তোমার অসুখের কোনও উপসর্গকে কোনও উপসর্গ বলেই মনে করিনি। দেখলে আমি আমার লেখালেখি নিয়ে ব্যস্ত। দেশ ছাড়ার পর লিখিনি কিছু, বসে বসে সময় কাটিয়েছি, আর যেই না তুমি এলে, দিন রাত লেখা নিয়ে পড়ে থেকেছি। তুমি দেখলে আমার অন্যরকম বিদেশি জীবন নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত আমি। আমার ব্যস্ততায় তুমি ব্যাঘাত ঘটাতে চাওনি। চলে গেলে। যেতে বাধ্য হলে। কী করবে? আমি তো তোমাকে জানিয়ে দিয়েছি তোমার কোনও অসুখ নেই। তুমি দিব্যি সুস্থ। বড় বড় ডাক্তাররা দেখেছে তোমাকে। তোমার মতো ভাগ্য কজনের আছে! তুমি কি এই ভেবেও চলে গিয়েছিলে মা যে তোমার হয়তো সময় আর বেশিদিন নেই! হয়তো চিকিৎসা করাতেও আসেনি। তুমি বুঝতে পেরেছিলে তোমার ভেতরের ভীষণ অসুখটি তোমাকে বাঁচতে দেবে না, তাই তুমি আমাকে শেষ দেখা দেখতে এসেছিলে। আমাকে নিয়ে দেশে ফেরত যেতে চেয়েছিলে। যেন আমি ক্ষমা চেয়ে হলেও দেশে ফিরতে পারি। তুমি সবকিছুতে ব্যর্থ হলে।
মা তোমার তো কোনও শৈশব ছিলো না, কোনও কৈশোর ছিলো না। যখন বলতে, ক্লাস ফোরে যখন পড়ো, বিয়ে হয়ে গেছে, আমি সারাজীবন একবারও ভাবিনি তোমার ওই ন দশ বছর বয়সে বিয়ে হয়েছে। ভাবতাম, তুমি বোধহয় খারাপ ছাত্রী ছিলে, কুড়ি বছর বয়সে চতুর্থ শ্রেণীতে পড়েছে। বিয়ের পর ওই শিশু বয়সে তোমার ওপর শারীরিক কষ্ট গেছে। নিজে শিশু হয়ে শিশু জন্ম দিয়েছো। অভাবে অনাহারে কাটিয়েছে। স্বামী ডাক্তারি পড়ছে। তোমার বাবার দয়া দাক্ষিণ্যে তুমি বাঁচছো। শিশুর কোলে শিশু। যৌবনে পৌঁছেলে যখন, দেখলে স্বামী আসক্ত অন্য রমণীতে। কোনওদিন তোমার ভালোবাসা কী জিনিস জানা হয়নি। তোমার জীবনের কথা ভাবলে আমি কেমন শিউরে উঠি আজকাল। চারদিকে তাকিয়ে দেখি তোমার মতো অসহায়, তোমার মতো দুর্ভাগা আর দ্বিতীয় একটি মানুষ পৃথিবীতে আছে কী না। নেই মা। বস্তিতে বাস করা মেয়েগুলোও তোমার চেয়ে অনেক সুখী। তারাও কারও না কারও ভালোবাসা পায়, আদর পায়। ঘুঁটে কুড়োনি মেয়েরাও আমোদ আহ্লাদ করে। ইট ভাঙার কাজ করে যে মেয়েরা, তারাও নিজেরপয়সায় নিজের যা খুশি তাই করার সুযোগপায়। ভিখিরি মেয়েরাও তোমার মতো অসহায় নয়।
তুমি চলে যাওয়ার পর বেশিদিন থাকিনি সুইডেনে। নিউইয়র্কে গিয়ে ইয়াসমিন যে দালানে থাকে সেই দালানেরই সাত তলায় একটা অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নিলাম। গীতা আমাকে অনুরোধ করছিল অনেকদিন থেকেই, সেই সুইডেনে থাকাকালীনই, যেন সুহৃদকে নিয়ে যাই আমার কাছে। গীতা নাকি আর পারছে না ওকে রাখতে, ভাবতে পারো মা, যে সুহৃদকে কোনওদিন আমাদের কাছে আসতে দিত না, এখন সে স্বেচ্ছায় ওকে দিয়ে দিতে চাইছে, যেন নিয়ে যাই, যেখানে খুশি সেখানে। সুহৃদ থাকতে শুরু করলো আমার সঙ্গে। ওর জন্য জীবন প্রায় উৎসর্গ করলাম। সেই ছোট্ট সুহৃদ পাঁচ/ছ বছর বয়স অবদি অবকাশে বড় হয়েছে। তারপর তো ওকে ছিনিয়ে নিয়েছিলো ওর বাবা মা। কিন্তু বুঝি যে সুহৃদ এর মধ্যে অনেকটাই পাল্টে গেছে। পনেরো বছর বয়স, ভালো শিক্ষা পায়নি বলে বেয়াড়া, বেপরোয়া, বেয়াদপ হয়ে বেড়ে উঠেছে। আমার কাছে আছে বটে সুহৃদ, কিন্তু আমার কোনও উপদেশ শোনার তার কোনও ইচ্ছে নেই। বুঝি যে, সময় অনেকটাই চলে গেছে। সুহৃদ যদি তার বাবার কাছে বাংলাদেশে থাকে, তবেই হয়তো পড়াশোনা করে বড় হতে পারবে। পড়ার কোনও ইচ্ছে আমি দেখি না সুহৃদের আছে। আসলে আমি হয়তো তাকে আগের মতোই দেখতে চেয়েছিলাম। অবকাশের সেই সুহৃদকে চেয়েছিলাম দেখতে। ইওরোপে ছিলাম, কিন্তু যখনই আমেরিকায় এসেছি সুহৃদকে নিয়ে ওয়াশিংটন ডিসি, ম্যারিল্যান্ড, পেনসিলভেনিয়া, বাফেলো, নায়াগ্রা, ফ্লোরিডায় বেড়াতে নিয়ে গিয়েছি। ডিসনি ওয়ার্ল্ড, স্মিথসোনিয়াম, হেরিটেজ মিউজিয়াম, মেট্রোপলিটন, মডার্ন আর্ট মিউজিয়াম, সব দেখিয়েছি, ছেলেটার যেন মন ভালো থাকে, যেন জ্ঞান বিজ্ঞানে আকর্ষণ বাড়ে। ছোটদাকে বলি সুহৃদকে বাংলাদেশে নিয়ে নিজের কাছে রাখতে। ইয়াসমিন ছোটখাটো একটা কাজ করে, বড় কাজ আর ভালো কাজ করতে বারবার বলেও কোনও কাজ হয় না, ওর আত্মবিশ্বাস শূন্যতে এসে দাঁড়িয়েছে। ওর নিজের ওপর সামান্যও আর বিশ্বাস নেই। ভালোবাসাকে ছেড়ে দূরে কোথাও যাবে না। ঘরের কাছে ছোট কাজ, ছোট কাজ করেই ওর স্বস্তি। ভালোবাসাকে ইস্কুলে দিয়ে আসে, ইস্কুল থেকে নিয়ে আসে। রান্নাবান্না করে, ঘরে থাকে। আমার সঙ্গে যেরকম দেখা হবে ভেবেছিলাম, হয় না। ও কদাচিৎ আমার কাছে বেড়াতে আসার মতো আসে। কেন ঠিক এরকমটি হয়, জানি না। ওর অ্যাপার্টমেন্টে বাড়তি ঘর নেই বলে আমাকে ভাড়া নিতে হলো নতুন অ্যাপার্টমেন্ট। একটা সংসারে যা যা থাকা দরকার সব কিনে নিলাম। বিছানা, সোফা, ডাইনিং টেবিল, ডেস্ক, বুকশেল্ফ, চেয়ার, কমপিউটার, আলমারি, রান্না ঘরের ক থেকে চন্দ্রবিন্দু। জীবনে যে কতবার সংসার সাজাতে হল মা! বিদেশ বিভুইয়ে দুটো মাত্র বোন দেশ ছেড়ে, নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে পড়ে আছে, সেখানেও আলাদা থাকতে হয়! কী জানি, জানি না, কষ্ট কেন হয়। বুঝি যে ইয়াসমিন আমার মতো একা থাকেনা। একটা সংসার আছে ওর। কিন্তু ওর স্বামী সন্তান নিয়েই তো ঢাকায় আমার কাছে থাকতো। বিদেশ কি তবে আমাদের সবাইকে আলাদা করে দিল! দেশের আত্মীয়দের থেকে আলাদা, এমন কী বিদেশেও পরস্পর থেকে আলাদা, নিজেদের মধ্যেও দাঁড়িয়ে গেছে শক্ত দেয়াল। কে এই দেয়াল দাঁড় করায়, সময় নাকি অন্য কিছু! এই ব্যবধান, এই বিচ্ছেদ, এই বাধা, এই বিদেশ আমার মানতে ইচ্ছে করে না। মাঝে মাঝে চিৎকার করে মনে হয় কাঁদি। ভালো যে আমি কোনও পুরুষের সঙ্গে সংসার পাতিনি, তাহলে বোধহয় আমিও আর সবার মতো বৈষয়িক হয়ে যেতাম। আমার জগৎ সংসার ওই চার দেয়ালের মধ্যেই খাবি খেতো। তুমি থাকাকালীন কিছু না এলেও তুমি দেশে ফিরে যাওয়ার পর পরই আমার আমন্ত্রণ আসাও শুরু হলো বিভিন্ন দেশ থেকে। নিউইয়র্ক থেকেইতালি যাচ্ছি, স্পেন যাচ্ছি, ফ্রান্স যাচ্ছি, অস্ট্রিয়া যাচ্ছি, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে। যেদিন অস্ট্রিয়া থেকে নিউইয়র্ক ফিরে এলাম, সেদিন ফোন এলো ঢাকা থেকে। ছোটদা বললো, তুমি নাকি কিছু আর খেতে পাচ্ছিলে না, কিছু মুখে নিলেই বমি হয়ে যাচ্ছিল। ডাক্তার দেখিয়েছে, ডাক্তার বলেছে কোলোনোস্কোপি করতে। কোলোনোস্কপি করারপর খুব বড় টিউমার পাওয়া গেছে পেটে। বায়োপসির রেজাল্টও এসে গেছে। আমার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছিল, শুধু জিজ্ঞেস করলাম, ডায়াগনসিস কী লিখেছে? ছোটদা অসুখের নাম বললো, কোলনকারসিনোমা। তার মানে? তার মানে তোমার ক্যানসার হয়েছেমা। ক্যানসার। শুনে বিশ্বাস করো, দুনিয়া দুলতে শুরু করলো আমার সামনে। সারা জীবনে কি এর চেয়ে বড় কোনও দুঃসংবাদ আমি শুনেছিনাকি শুনবো! এই ক্যানসার নিয়েই তুমি আমার কাছে এসেছিলে মা, এই ক্যানসারকেই তুমি বলেছিলে খুব বড় এক অসুখ, ঠিক যে জায়গাটায় ক্যানসার, পেটের সে জায়গাটা তুমি আমাকে অনেক অনেক বার দেখিয়েছে, আমি তোমাকে বলেছি ও কিছুনা, বার বার বলেছিও কিছুনা, একটু বোধহয় তোমার খাদ্যনালীর চামড়ায় কিছুর ঘসা টসা লেগেছে, তাই ব্যথা। নিজের মেয়ে বলেছে তোমাকে। যে মেয়েকে আদর যত্ন করেছে ডাক্তারি যখন পড়েছে, বছরের পর বছর তার আদেশ আবদার সব মেনেছো, আদরে ভরিয়ে রেখেছো। তুমি বুঝতে পারছো, তোমার বড় কোনও অসুখ হয়েছে, তোমার আদরের ডাক্তার মেয়ে তা বোঝেনি। এতদিন থেকেছিলে আমার কাছে, আমি তোমাকে বুঝতে চেষ্টা করিনি। চেষ্টা করিনি বলে আমাকে একটুও চাপ দাওনি চেষ্টা করার জন্য। বাবা তোমাকে কোনও টাকা পয়সা দেয় না, দাদার দেবার তো প্রশ্ন ওঠে না, ছোটদা তো নেবে আরও, দেবে কী, যাদের ভূরি ভূরি আছে তাদেরই যখন আমি ঢেলে দিচ্ছি, তখন তোমাকে শূন্য হাতে ফেরত পাঠালাম। দেশে ফিরে তোমার সেই সমস্যাগুলো ক্রমশ বাড়ছিল মা। পরে সব জেনেছি যে বাড়ছিলো। তুমি ঢাকায় একা, তুমি অসুস্থ, তুমি খেতে পারছে না, যদিখাও কিছু, বমি হয়ে যাচ্ছে। ওইশরীর নিয়েই তুমি ময়মনসিংহে গেলে বাসে। এই বাসে করেই তো তুমি বাবার কাছ থেকে চাল ডাল তেল নুন নিয়ে ঢাকা এসেছে। অসুখ শরীরেও এসব তোমাকে করতে হয়েছে। ছোটদাকে রান্না করে খাওয়াবে। তুমি তার দায়িত্ব না নিলে নেবে কে? যখন আর পারছে না, হাতে কোনও টাকা নেই ঢাকায় কোনও ডাক্তার দেখানোর, তুমি ময়মনসিংহে গিয়ে বাবাকে বললে অসুখের কথা। কিছু খেলেই বমি হচ্ছে, পেট ফুলে আছে, ব্যথা হচ্ছে প্রচণ্ড। শুনে বাবা কটমট করে তোমার দিকে তাকালো। চেম্বার থেকে, যে চেম্বারে বসে রোগী দেখছিল, তোমাকেদূরদূর করে তাড়ালো। জ্বর কফ কাশির রোগীদের যত্ন করে দেখলো, তোমাকে দেখলো না। কেন ময়মনসিংহে এসেছো, ঢাকায় ছোটদার খাওয়া দাওয়ার অসুবিধে করে তোমাকে কে আসতে বলেছে ময়মনসিংহে, প্রচণ্ড গালাগালি খেলে তুমি। তোমার এই অসুখটসুখের কথা শুনতে ইচ্ছে করে না তার। বাবা বাড়ি ফিরলেও বারবার বলেছো, তোমার পেটের ভেতর কিছু একটা ভয়ংকর লুকিয়ে আছে। তাতে বাবার কী আসে যায়! বাবা জিজ্ঞেস করছিল, আমার কাছ থেকে কত টাকা এনেছো। তুমি যতবারই বলেছে যে আমি তোমাকে কোনও টাকা দিইনি, বাবা বিশ্বাস করছিল না, ভেবেছিলো তুমি মিথ্যে বলছে, বলেছে নাক মুখ খিঁচিয়ে যে তুমি মিথ্যে বলছে, প্রচুর টাকা নাকি আমি দিয়েছি। আল্লাহর কসম কেটে বলেছে, কোরান ছুঁয়ে বলেছে, কেঁদে কেঁদে প্রায় পায়ে পড়ে বলেছো যে না তোমার কাছে কোনও টাকা নেই, আমি তোমাকে একটি পয়সাও দিইনি। বাবার কী খুব হিংসে হচ্ছিল, রাগ হচ্ছিল! তোমার হাতে টাকা পয়সা থাকুক, তুমি স্বস্তিতে শান্তিতে থাকো, তা কি বাবা কোনওদিন চেয়েছিলো? না, বাবা তোমার কান্নাকে মোটেও কান্না বলে মনে করেনি। তুমি নানিবাড়িতে যাবে, রিক্সায় চড়তে পারো না, রিক্সার ঝাঁকুনিতে তোমার পেটে ভীষণ ব্যথা হয়। দাদাকে অনুরোধ করলে তার গাড়িটা দিয়ে একটু নানিবাড়িতে পৌঁছে দিতে। দাদা সোজা না করে দিল। তোমার অসুখ, তোমার পেটে কোনও কিছু এমনকী জল অবদি থাকছে না, পেটে প্রচণ্ড ব্যথা, তাতে দাদার কিছু যায় আসে না। যতরকম টিপ্পনি আছে, সব কাটলো দাদা। অপমান যতভাবে করা যায় করলো। গাড়ি দিল না তোমাকে। তুমি রিক্সা নিয়েই নানিবাড়ি গেলে। যখন ঝাঁকুনি খাচ্ছিল রিক্সা, তুমি সিট থেকে শরীরটাকে উঠিয়ে রাখলে, ভয়ংকর ব্যথা থেকে বাঁচতে। নানিবাড়িতে তো আর কোনও ডাক্তার নেই। কিন্তু বাড়ির সামনে সুলেখাদের বাড়ি। সুলেখার ছোট ভাই জাহাঙ্গীর ডাক্তারি পড়েছে। সে তো অন্তত বিনে পয়সায় তোমাকে দেখে দেবে। তোমার অসুখটা অন্তত বুঝতে পারবে। মা, তোমার নিজের মেয়ে তোমাকে দেখলো না, তোমার স্বামী দেখলো না, তোমার ছেলেরা দেখলো না। অনাত্মীয় একজন দেখলো। পাশের বাড়ির কেউ দেখলো। জাহাঙ্গীর বললো পেটের একটা এক্সরে করতে। এক্সরে করার টাকা কোথায় পাবে তুমি? কে দেবে টাকা! বাবাকে দাদাকে দুজনকেই বললে, এক্সরে করতে হবে। বাবা তো জাহাঙ্গীরকে অসুখ দেখিয়েছো শুনে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো। তোমাকে প্রায় ঘাড় ধাক্কা দিয়ে অবকাশ থেকে তাড়ায়। অসুখ নিয়ে তোমার বাড়াবাড়ি যে সীমা ছাড়িয়ে গেছে তাই বললো বাবা। এক্সরে করতে হবে! ’দাঁত মুখ খিঁচিয়ে বাবা তোমারপণ্ডিতিকে ব্যঙ্গ করলো। তুমি যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে সব শুনলে মা। এক্সরে করতে অনেক টাকা লাগে। ছটকুর কাছ থেকে কিছু টাকা ধার করে গেলে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ, যে কলেজের অধ্যাপক ছিল তোমার স্বামী, যে কলেজ থেকে পাশ করেছে তোমার মেয়ে, সেই কলেজের হাসপাতালের এমারজেন্সিতে। হাসপাতালে আর সব দরিদ্র রোগীদের সঙ্গে লাইনে দাঁড়িয়ে তুমি পেটের এক্সরে করালে মা। না, এতে তোমার কোনও গ্লানি হয়নি। দরিদ্রদের তুমি কখনও হেলা করোনি। তোমার তো ওদের সঙ্গেই ছিল বেশি ওঠাবসা। এক্সরে বাবাকে দেখাতে গেলে, বাবা দেখলোও না। অন্য কোনও ডাক্তারকে যে এক্সরে দেখাবে, সে টাকা তোমার ছিল না। ছটকুর কাছে লজ্জায় আরও টাকা চাইতে পারোনি। বাড়ির ডাবগাছগুলো থেকে ডাবনারকেল পাড়িয়ে বিক্রি করে দুশ তিনশ টাকা হতো তোমার। সেটাও তো হাতছাড়া হয়ে গেলো। ঢাকা থেকে এসে অবকাশের ডাবওয়ালাকে ডেকে পাঠাতে গিয়ে দেখলে দাদার বউ সব বিক্রি করে দিয়েছে। সে-ই টাকা নিয়ে বসে আছে। সামান্য যে অধিকারটুকু ছিল তোমার অবকাশে, সেটুকুও হাসিনা ছিনিয়ে নিলো। তুমি ফিরে এলে ঢাকায়। শয্যা নিলে। তোমাকে সুস্থ করার কেউ নেই। টয়লেট ভরে রক্ত, বেসিন ভরে বমি –এই চলছে। আর চলছে তোমার কান্না, তোমার অসহায়তা, তোমার ভয়াবহ একাকীত্ব। ছোটদা বিমানের বিদেশ ডিউটি করে এসে একদিন বাড়ির কাছের এক ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলো। ছোটদাই শেষ অবধি তোমার সহায় হল। তোমার প্রচণ্ড অসুস্থ শরীরটাকে কোনওভাবে নিয়ে ফেললো ডাক্তারের চেম্বারে। ওই ডাক্তারই পরীক্ষা করে বলে দিল, ক্যানসার। বারডেমে তোমার অপারেশন হবে। এসবের তো আমি কিছুই জানতাম না মা। পরে শুনেছি। তুমিই বলেছো অসুখ ধরা পড়ার আগে তোমার দুঃসহ দিনগুলোর কথা। বাবা আর দাদার দুর্ব্যবহারের কথা। আমি তো তোমাকে কোনও করিনি। তুমি দেশে ফিরে যাওয়ারপর তোমার ব্যাংকে সরাসরি টাকা পাঠিয়ে দেওয়ার যে কথা ছিল, সেটা পাঠালে তোমাকে তো বাবা আর দাদার কাছ থেকে চিকিৎসা ভিক্ষে করতে হত না, এক্সরে করার জন্য হাত পাততে হত না, নিজেই ডাক্তার দেখাতে পারতে। তোমাকে আমার চেয়ে বেশি আর কে ঠকিয়েছে মা? কেউ না। কেন আমাকে সব বুঝেও ক্ষমা করে দিয়েছিলে মা? আর যাকেই ক্ষমা করো, আমাকে করো না মা। আমি তো নিজেকে ক্ষমা করিনি। আজও করিনি। কোনওদিন করবো না। মা, তোমার অসুখের নামটা জানারপর তুমি যদি দেখতে কীভাবে স্তব্ধ হয়ে বসে থেকেছি, অনুশোচনার আগুনে কী করেপুড়েছি, কীভাবে কেঁদেছি দিনের পর দিন! মা, তোমার সঙ্গে ফোনে কথা বলতে গিয়েও চিৎকার করে কেঁদেছিমা। অপরাধবোধে সেই যে ভুগতে শুরু করেছি, আজও ভুগছি। কী রকম যেন শকুনে খেয়ে যাওয়া কিছুর মতো মনে হয়, যেন বধ্যভূমিতে পড়ে আছি কোনও খুলি, কোনও পাঁজর। বারডেম হাসপাতালের ডাক্তাররা সিদ্ধান্ত নিয়েছে, জরুরি অপারেশন করতে হবে। তোমার নিশ্চয়ই তখন ভালো লাগছিলো এই ভেবে যে, শেষ অবধি চিকিৎসা হচ্ছে। যে রোগের চিকিৎসা তোমার সতেরো বছর ধরে হয়নি, সেটির চিকিৎসা শেষপর্যন্ত হচ্ছে তোমার। হাসপাতালে তখন দাদাও এলো, বাবাও এলো। চারদিকে যত স্বজন আছে, সবাই এলো। তখন সবাই তোমার সেবায় নিয়োজিত। সেবা কিন্তু কোনও টাকা পয়সা দিয়ে সেবা নয়। চিকিৎসার খাতে যা খরচ হয়, সব আমিই দেব, টাকা পয়সার জন্য যেন কোনও কিছু আটকে না থাকে, তা বারবারই বাবা, দাদা, ছোটদা সবাইকে বলে দিয়েছিলাম। তোমাকে জানানো হয়নি কী অসুখ তোমার হয়েছে। শুধু বলা হয়েছে পেটে তোমার টিউমার হয়েছে। ফোনে আমাকে বলছিলে, মাগো, তোমাকে তো বলেছিলাম, বলেছিলাম না পেটে আমার ব্যথা হয়, আর ডাক্তার যখন পেটে চাপ দিয়েছিলে, আমি উ করে উঠেছিলাম ব্যথায়। তোমার মনে আছে? মনে আমার থাকবে না কেন মা? মনে না থাকার কোনও তো কারণ নেই। এই নিয়েই তো কত অশ্রদ্ধা করেছি তোমাকে, ভেবেছি বানিয়ে বানিয়ে অসুখের গল্প করছো। বলেছি ওইসব ফালতু ব্যথা ট্যাথার কথা ভুলে ডায়বেটিস নিয়ে ভাবো, ওটিই আসল রোগ। তুমি কী কম দীর্ঘশ্বাস ফেলেছো! সব দীর্ঘশ্বাস এখন আমি ফেলছি মা। যে তুমি ভিখিরির মত নিঃসঙ্গ ছিলে, তোমার ভয়ংকর অসুখটিকে শুধু সঙ্গী করে, সেই তুমি আর একা নও। এখন তোমাকে দিব্যি ঘিরে আছে তোমার আত্মীয় স্বজন। এতকাল একা একা ভুগেছো, এখন তোমারপাশেপরিবারের সবাই এসে দাঁড়িয়েছে।
যারা তোমার কিচ্ছুহয়নি, কোনও অসুখ হয়নি বলে অবজ্ঞা করেছে, তুমি নাকি বানিয়ে অভিযোগ করছে বলে অভিযোগ করেছে, তারা আজ সবাই স্বীকার করছে যে তোমার এমন এক বড় অসুখ হয়েছে, যে অসুখে হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে, এমনকী অপারেশন করতে হবে। হাসপাতালে তোমার অপারেশন হচ্ছে, দাদা অপরাশেন থিয়েটারের বাইরে দাঁড়িয়ে রইলো, ছোটদা রইলো, বাবা রইলো। বাবাও নাকি খুব চুকচুক করে দুঃখ করেছে, বাবাও নাকি মাথায় হাত দিয়ে বসে ছিল। ফোনে বাবাকে আমি খুব দোষ দিয়েছি, তুমি এত কাঁদারপরও বাবা তোমার অসুখ সারায়নি বলে। যে ডাক্তার শহরের নামকরা ডাক্তার, অন্য ডাক্তাররা রোগ ধরতে না পারলে যে ডাক্তার যে কোনও রোগ ধরতে পারে, সেই ডাক্তার বাবাকে আমি ধিক্কার দিই। বাবা বারে বারেই বললো, আমি তো বুঝতে পারিনি। আমাকেও একবার বললো, তোমার কাছে তো কয়েক মাস ছিলো, তুমি কেন চিকিৎসা করালে না? ’ এর কী উত্তরই বা আমি দেব! আমার কি কোনও ভাষা আছে কিছু বলার? মুখ দেখানোর মুখ কি আছে? আর যার যে প্রশ্নেরই যে উত্তর দিই না কেন, এই প্রশ্নের উত্তর আমি দিতে পারি না। তোমার কাছে কত বড় অপরাধী হিসেবে আমি যে দাঁড়ালাম, তা এক আমিই জানি। তোমার সঙ্গে যখন ফোনে কথা বলছিলাম, তোমার কণ্ঠস্বর কী যে শিশুর মতো শোনাচ্ছিল। তুমি জানছো যে তোমার পেটে টিউমার হয়েছে, অপারেশন করে সেই টিউমার ফেলে দিলেই তুমি আবার আগের মতো ভালো হয়ে উঠবে। তোমার এই জানাটা যে সত্য নয়, তা এক আমি জানি, আর বাবা জানে। পাইলস পাইলস করে সতেরো বছর চিকিৎসার জন্য কেঁদেছো। সতেরো বছর পর প্রথম তুমি চিকিৎসা পেয়ে এখন সুস্থ হয়ে উঠবে, তুমি তো খুশি হবেই। তোমার আনন্দই তো স্থবির দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে হবে আমাদের।
মা, তখন আমি তোমার কাছে প্রাণপণে যেতে চাইছি। কিন্তু আর যেকেউ যেতে পারলেও আমার যাওয়া সম্ভব নয়। প্রতিদিন ছটফট করছি। বারবার ফোন করছি। চার বছরে যে ফোন করিনি, চারদিনে তার চেয়ে বেশি করছি। অপরাধবোধ? হ্যাঁ নিশ্চিতই মা, অপরাধবোধ। এর চেয়ে বড় অপরাধ কি কেউ করে জীবনে! আমি টুকরো টুকরো হয়ে গেলাম গ্লানিতে। শত ধিক দিলাম নিজেকে। ভেসে গেলাম অনুতাপে, অনুশোচনায়, ডুবে রইলাম লজ্জায়, ঘৃণায়। নিজের ওপর ঘৃণা মা। অপারেশন যে ডাক্তার করবেন, তাঁর ফোন নম্বর দাদার কাছ থেকে নিয়ে ফোনে অনেকবারই তাঁর সঙ্গে কথা বলেছি। কী মনে হচ্ছে, সাদাসিধে কোনও টিউমার কি হতে পারে না? ডাক্তার বললেন কোলোনোস্কপি করে তা মনে হচ্ছে না। টিউমার সাদাসিধে হোক, অপারেশনের পর তুমি সুস্থ হয়ে ওঠো, আমি প্রাণপণে আশা করতে থাকি। আমার তো কোনও ঈশ্বর নেই প্রার্থনা করার মা। আমি এই নিষ্ঠুর প্রকৃতির কাছেই তোমার প্রাণভিক্ষা চাই। তোমার সততা, তোমার পবিত্রতা, তোমার অকৃত্রিমতাকে ঈশ্বর মেনে তার কাছে প্রার্থনা করি তোমার সুস্থ। সারাজীবন যে যন্ত্রণা পেয়েছে, যে কষ্ট তোমাকে কামড়ে খেয়েছে, সেই তোমাকে একটু আনন্দ দিতে আমি মরিয়া হয়ে উঠি। অসুখ তোমার কেউ সারায়নি বলে আশা ছেড়ে দিয়েছিলে। আমাকে শেষ দেখা দেখতে এসেছিলে মা, যে করেই হোক এসেছিলে। বাবা মা দুজনের জন্য ভিসার ব্যবস্থা করেছিলাম। বাবাকে না নিয়ে একা এসেছো বলে তোমাকে অপমান করেছি। বাবা যে নিজেই আসতে চায়নি, সে কথা আমাকে বলেছো, বলেছে যে বাবা ভালো আছে, তারপরও আমি বিশ্বাস করিনি যে বাবা ভালো আছে। তুমি ভালো আছো, বাবা ভালো নেই, এই বিশ্বাস নিয়েই ছিলাম আমি। আমার বিশ্বাস থেকে কেউ আমাকে নড়াতে পারেনি। সেই মিথ্যে জগৎ আমার ভেঙে চুর্ণ হয়ে গেল। কী বলে সান্ত্বনা দেব আমি আমাকে!
জীবনে প্রথম কোনও অপারেশন তোমার। ছোটদা তার এক বন্ধুর কাছ থেকে টাকা ধার করে চিকিৎসার খরচ দিচ্ছে, তাকে বলা আছে সব খরচ আমি মেটাবো। তুমি তো জানো সব। তোমার কি একবারও রাগ হয়নি, চিকিৎসার খরচ কেন বাবা দেবে না? বাবা এসেছে ঢাকায় অসুস্থ তোমার পাশে থাকতে, এটাই তোমাকে সব ভুলিয়ে দিয়েছে। বাবার মতো মানুষের এইটুকু ভালোবাসা পেয়েই বোধহয় ধন্য হলে। এত ক্ষমা জানি না কেমন করে করতে পারো তুমি।
অপারেশন যেদিন হচ্ছে, সেদিন আমি দিন রাত ফোন করছিলাম মা। দাদা, ছোটদা, বাবা সবার কাছ থেকে জানতে চাইছিলাম কী ঘটছে। এমনকী সার্জনের সঙ্গেও কথা বলেছিলাম। অপারেশন করে টিউমার বার করে তারপর বায়োপসি করতে হবে। যদি ওই টিউমারটি সাদাসিধে না হয়ে ম্যালিগনেন্ট হয়, যদি কারসিনোমাই হয়, বা ক্যানসারই হয়, তবে মেটাসটাসিস হয়নি তো! সাধারণত কোলন থেকে লিভারে মেটাসটাসিস হয়। লিভারের সবপরীক্ষা করানো হয়েছে। ডাক্তার বলে দিলেন, একেবারে পারফেক্ট আছে লিভার। কিডনি, হার্ট সব ঠিক আছে। কোথাও কোনও সমস্যা নেই। ডাক্তারের কথা সমুদ্রে ডুবে যেতে থাকা মানুষের জন্য খড়কুটোর মতো। রক্তপরীক্ষায় দেখা গেছে তোমার ওই এক কোলন ছাড়া শরীরের কোথাও কোনও অসুখ নেই। ডাক্তার বললেন, এই ক্ষেত্রে একটা র্যাডিক্যাল সার্জারি করতে হবে। অসুস্থ কোলনের আশেপাশে যা কিছু আছে, সব কেটে বাদ দিতে হবে। যখন তোমার অপারেশন হচ্ছিল, মামা খালারাও এসেছিলো। তোমার রক্তের দরকার হবে, ছটকু, শরাফ মামা সব দাঁড়িয়ে ছিল তোমাকে রক্ত দেওয়ার জন্য। তুমি দেখতে পাচ্ছো তোমার অনেক আত্মীয়কে। এত আদর করে তোমার সঙ্গে বোধহয় আগে কেউ কথা বলেনি। অপারেশন হল সাড়ে চার ঘণ্টা ধরে। আমি ফোন নিয়ে বসে আছি। অপেক্ষা করছি অপারেশন কেমন হলো, টিউমারের আকার আকৃতি চরিত্র স্বভাব কেমন, সেইসব খবর শোনার জন্য। কী যে অস্থির সেই অপেক্ষা। পায়চারি করছি ঘরময়। জল খাচ্ছি ঘনঘন, চোখের জল মুছছি ঘনঘন। শেষ পর্যন্ত ডাক্তার জানালেন খবর। আমি বাকরুদ্ধ বসে রইলাম সে খবর পেয়ে। অবিরল চোখের ধারাকে আমি বন্ধ করতে পারছিলাম না। ডাক্তার জানালেন, সাড়ে চার ঘণ্টা ধরে তোমার যা কিছু আছে পেটে সব কেটে বাদ দিয়ে, ক্ষুদ্রান্ত্রের, বৃহদন্ত্রের প্রায় সব ফেলে দিয়ে শুধু পাকস্থলির সঙ্গে সামান্য বৃহদন্ত্র জোড়া লাগিয়ে দিয়েছে। লিম্ফ নোড টোড সব ফেলে দিয়েছে। আশেপাশে যা থাকে, সব সাফ করার পর পেট সেলাই করার আগে লিভারটা হাত দিয়ে পরখ করেছে, দেখেছে তিনটেনড়ল। তার মানে লিভারে ধরে গেছে ক্যানসার। লিভারে যদি ধরেই যায়, তখন এভাবে সব ফেলে অপারেশন করতে হয় না। তখন খুব দ্রুত শুধু অন্ত্রের টিউমারটা বের করে পেট সেলাই করে দিতে হয়। দীর্ঘক্ষণ অপারেশন করা মানে, রক্ত দেওয়া মানে ক্যানসারকে সারা শরীরে ছড়িয়ে দেওয়া। ডাক্তাররা তাই করেছেন বাংলাদেশে। তোমাকে বাঁচানোর বদলে তোমাকে মেরেছেন। সবার শেষে নয়, পেট খুলেই অপারেশন শুরু করার আগে তাঁদের উচিত ছিল তোমার লিভার পরীক্ষা করে দেখা। তাই দেখেন যে কোনও অভিজ্ঞ ডাক্তার। কিন্তু ওঁরা ল্যাবরটরির লিভার পরীক্ষার ফলের ওপর ভরসা করে তোমার লিভারটা ওই বিরাট অপারেশন শুরু করার আগে পরখ করে নেননি। ওঁদের লিভার টেস্ট ভুল রিপোর্ট দিয়েছে মা। তুমি তো শুয়ে আছো, তুমি তো জানো তোমার এতদিনে চিকিৎসা হল, তুমি সুস্থ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কী যে ভয়ংকর ভুল চিকিৎসা হল তোমার, তুমি জানো না। তুমি জানো না তোমার ক্যানসার হয়েছে। জানো তোমার ওই অসুখটা সারার সব ব্যবস্থা করা। হচ্ছে। রক্ত দেওয়া হচ্ছে। ইন্টারনেট ঘেঁটে মেডিক্যাল জার্নাল যোগাড় করে তোমার অসুখ নিয়ে যত তথ্য আছে, সবপড়েছি। ভুলে যাওয়া ডাক্তারি বিদ্যেকে আবার ঝালিয়ে নিতে বিভিন্ন হাসপাতালের ওয়েব সাইট আমাকে সাহায্য করে। সারাদিন নেটেই ঝুঁকে থাকি। কোলন ক্যানসারকে খুব ভালো ক্যানসার হিসেবে বিচার করা হয়। যখন অন্ত্রে কোনও পলিপ দেখা দেয়, সেই পলিপ থেকে রক্তক্ষরণ হতে থাকে। সেই পলিপটাকে কেটে বিদেয় করে দিলেই পলিপ আর ক্যানসারে পরিণত হয় না। কিন্তু তোমার অন্ত্রের পলিপকে কেউ আমরা বিদেয় করতে সাহায্য করিনি। অচেনা অজানা কত শত মানুষেরপলিপ বিদেয় করেছি, মানুষকে বাঁচিয়েছি। পলিপ বহু বছর নেয় বড় হতে। খুব ধীরে ধীরে বড় হয়। রক্ত যায়, লোকে পাইলসের রক্ত ভেবে ভুল করে। কোলন ক্যানসার আগেভাগে চিকিৎসা করলে সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা অন্য যে কোনও ক্যানসারের চেয়েও বেশি। তুমি ওই যে অত দীর্ঘদিন কাটালে আমার কাছে, ওই সময় যদি ওই সুইডেনের গাধা-ডাক্তাররা ধরতেপারতো তোমার অসুখ, তুমি বাঁচতে, তখনও লিভারেনিশ্চয়ই এই সর্বনাশা রোগটি গিয়ে বাসা বাঁধেনি। মেটাসটাসিস না হলে, রোগটা কোলন থেকে বাইরে না গেলেও তো অন্তত কেমোথেরাপি দিয়ে দিয়ে ভালো থাকতে পারতে। কিছুই তুমি জানো না এসবের। সত্য লুকোনো হয়েছে তোমার কাছে। তোমাকে বলা হয়েছে, যে, অপারেশনের পরই তুমি ভালো হয়ে উঠবে।
ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করি, লিভারের অপারেশন করা যায় কি না। ডাক্তার বললেন, দেশে ওই অপারেশন হয় না। বিদেশে হবে? বললেন, হতে পারে, চেষ্টা করে দেখতে পারি। আমি অনুযোগ করলাম, কোনও লাভ নেই জেনেও করলাম, কেন র্যাডিক্যাল সার্জারি করতে গেলেন, এতে তো ক্যানসার আরও ছড়িয়েছে! ডাক্তার আর কী বলবেন, ওই লিভারের রিপোর্টকেই দোষ দিয়ে নিজের ভুলের কথা এড়িয়ে যান। এক বুক দীর্ঘশ্বাস নিয়ে আমি বসে থাকি, একা।
ছোটদার বান্ধবী জুই নিউইয়র্কে আসছে শুনে তোমার জন্য জ্যাকসন হাইটসের সোনার দোকান থেকে গয়নার সেট কিনলাম। গলার হার, কানের দুল, হাতের চুড়ি। জীবনে তোমার খুব শখ ছিল সোনার গয়না পরার। দাদা তার বিয়ের আগে তোমাকে দুটো অনন্তবালা গড়িয়ে দিয়েছিল। সে দুটো তুমি দিয়েও দিয়েছোপরে, একটা তোমার মাকে, আরেকটা তোমার মেয়েকে। ইয়াসমিনকে। ইয়াসমিনেরও অলংকারের সাধ। আমারই গয়নাগাটির সাধ আহ্লাদ কিছু নেই। মা, যে মানুষ জীবনে তোমার জন্য কিছুই কিনিনি, সে আমি কত দামি জিনিস অকাতরে কিনে ফেললাম! তোমাকে একটুখানি সুখ দিতে। সত্যি বলতে তোমার সময় আর বেশি নেই বলেই চাইছি তোমাকে আনন্দ দিতে, নিজের গ্লানি মোচন করতে নিজের অপরাধ ঢাকতে চাইছি। তা ছাড়া আর কী! যখন জুইকে তার হোটেলে গিয়ে দিতে চাই তোমার গয়নার বাক্স, কিছুতেই সে নিতে চাইছিল না। সে নাকি ছোটদার প্রেমিকা, তোমাকে না কি সে খুব ভালোবাসে। তাদের নাকি ইমিগ্রেশনে চেক হয়, বাড়তি কোনও জিনিস থাকলে খুব নাকি ঝককি পোহাতে হয়। অথচ দেখ প্রতিবারই বিদেশ এসে ক্রুরা বিস্তর জিনিস কিনে নিয়ে দেশে ফেরে, ওগুলো বেশি দামে বিক্রি করে যা টাকা ওরা রোজগার করে, তা ওদের চাকরির মাইনের টাকার চেয়েও বেশি। আর তোমার জন্য সামান্য ওইটুকু অলংকার নেওয়া জুইএর কাছে মনে হচ্ছিল যেন গোটা একটা হিমালয় বয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো। যখন অনেক বলে কয়ে রাজি করালাম, বিরক্ত কণ্ঠে বললো, বাক্সটা ফেলে দিয়ে গয়নাগুলো তাকে পরে নিতে হবে। নিক, যে করেই হোক নিক। আমি চাই তোমার মুখে হাসি ফোঁটাতে। তোমাকে সামান্য ভালো লাগা দিতে। সারাজীবনে ভালোবাসা তো কিছুই পাওনি। অন্তত তোমার এই অপদার্থ মেয়েটি তোমাকে ভালোবাসে -এই ভেবেও যেন তোমার সামান্য সুখ হয়। ক্যানসার নামের ভয়ংকর রোগে তুমি আক্রান্ত, তোমার অন্ত্র আক্রান্ত, ক্যানসারের চেয়েও ভয়ংকর হলো মেটাসটাসিস, তাতেও আক্রান্ত তুমি। এসবের কিছুই জানতে না তুমি। জানতো বাড়ির সবাই। জানতাম আমি। অনুতাপ আমাকে দিয়ে ইয়াসমিনকে বারবার অনুরোধ করালো। যা তুই মার কাছে যা। মার কাছে থাক। মাকে একটু আদর কর গেগিয়ে। মার তো কোনওদিন কিছু পাওয়া হয়নি আমাদের কাছ থেকে। মাকে অনেক কিছু উপহার দে। মাকে বোঝা যে ভালোবাসিস খুব। মা, তুমি তো জানো না ইয়াসমিনকে আমি বলে বলে পাঠিয়েছিলাম যেন সারাক্ষণ তোমার সঙ্গে সময় কাটায়। তোমার যেন ভালো লাগে। তোমার যেন আনন্দ হয়। কয়েক হাজার ডলার দিলাম তোমার জন্য। সব খরচ করে আয় মার জন্য। হায়, তোমার জন্য খরচ করার আর কী কিছু আছে! ধার কর্জ যা করেছে হাসপাতালের খরচ মেটাতে, সব যেন মেটায়। তোমার যা খেতে ইচ্ছে করে, যা করতে ইচ্ছে করে, সব যেন করতে পারো, খেতে পারো। দুজনই খুব দামি দামি জামা কাপড় কিনলাম তোমার জন্য। না, মা, টাকার হিসেব তখন আর করিনি। পারলে তোমাকে পৃথিবীর যত ভালো কিছু আছে, সব কিনে দিই। ইয়াসমিন তোমার কাছে যাওয়ার পর নির্ভার হলাম, অন্তত কিছুটা হলেও সুখ স্বস্তি তো পাচ্ছো। মেয়ে সঙ্গে আছে। ছেলেদের সঙ্গে থাকা আর মেয়ের সঙ্গে থাকার মধ্যে অনেক তফাৎ। ঠিক মনে নেই ইয়াসমিন কতদিন ছিল, ফিরে এলো যখন, দেখলাম ও খুব ঘুরেছে এর ওর বাড়ি, ভিডিও করেছে দেখালো, প্রচুর জিনিস কিনে এনেছে, গলায় তার চেইন, আল্লাহু লেখা লকেট। বললো, তুমি টাকা দিয়েছো কিনতে, কিনেছে। কোথায় ও তোমার জন্য করবে, নয়তো তুমিই ওকে আদর করে ওর জন্য খরচ করেছো। আমি সারাক্ষণই অস্থির তখন, কী করে যাবো তোমার কাছে। কী করে তোমাকে সুখ দেব, যে সুখ কোনওদিন পাওনি, সেই সুখ। তোমাকে অনেক অনেক ভালোবাসা দেবার জন্য হৃদয় পেতে বসে ছিলাম মা, তোমার কাছে পৌঁছোবার কোনও সাধ্য আমার ছিল না। দেশে গিয়েছিল বলে ইয়াসমিনকে ইমিগ্রেশনের লোকেরা প্রশ্নবাণে বিদ্ধ করেছে, আমেরিকায় রাজনৈতিক আশ্রয় পাওয়া মানুষ দেশে যাবে কেন, এর মানে কি এই যে দেশে তার কোনও রাজনৈতিক সমস্যা নেই! ইয়াসমিনের সমস্ত রাগ গিয়ে পড়লো আমার ওপর। বললো, আমিই নাকি ওর সর্বনাশ করেছি দেশে পাঠিয়ে। কী হবে ওর আমেরিকার গ্রিন কার্ড দিয়ে, পাসপোর্ট দিয়ে! কী জানি কেন যে নিজের মার জীবনের চেয়ে বেশি মূল্যবান মনে করে ওরা বিদেশের পাসপোর্টকে। কী হয়পাসপোর্ট দিয়ে? রাজনৈতিক আশ্রয় পেয়েছে, পাসপোের্ট একদিন না একদিন হবেই ওর। তাই বলে অনুতাপ করবে, কেন তোমাকে দেখতে দেশে গেল, কেন সে নিজের জীবনের এত বড় ক্ষতি করলো! কী অনুশোচনা! আমি যেন কোত্থেকে এক ডাইনি এসেছি ওকে মারতে! আমি শুধু নরম গলায় বলেছি, ‘আমি যেহেতু যেতেপারছি না, তাই তোকে বলেছি দেশে যেতে। আজ যে তুই আফশোস করছিস মাকে দেখতে গিয়েছিস বলে, আজ যে ভাবছিস মাকে দেখতে গিয়ে ভুল করেছিস, সেটা কোনও একদিন তুই করবি না। কোনও একদিন তোর মনে হবে, জীবনে কোনও যদি ভালো কাজ করে থাকিস, ওই ওটাই। অসুস্থ মার পাশে কিছুদিন কাটিয়ে এসেছিস, মার চিরতরে চলে যাবার আগেমার সঙ্গে থেকে মাকে একটুখানি সুখ দিয়েছিস।
ওদিকে ঢাকায় কিমোথেরাপি শুরু হয়ে গেছে তোমার। বাড়িতে লোক এসে দিয়ে যায় ইনজেকশন। ওসব ইনজেকশনে কোনও কাজ হয় না। তোমার লিভারে অসুখ ছড়িয়েছে। তারপরও কিমোথেরাপি নেওয়ারপর তুমি আশ্চর্য এক স্বস্তি পেতে। কিছু একটা চিকিৎসা তোমার হচ্ছে, এ ভেবেই বোধহয় পেতে। কিমোথেরাপির বিষ তোমার শরীরে যাওয়ারপর তোমার তো আরও অসুস্থ হয়ে পড়ার কথা। না, তুমি বরং বলতে যে তোমার এখন ভালো লাগছে। আসলে ও তোমার মনের ভালো লাগা, শরীরে কিমোথেরাপির ওষুধ কোনও ভালো লাগা দেয় না। বরং শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে ফেলে, চারদিকের ব্যাকটেরিয়া দ্বারা আগের চেয়ে আরও বেশি আক্রান্ত হতে থাকো। অত বড় অপারেশনের ধকলও কাটিয়ে উঠলে। তুমি ভাবছো তুমি সুস্থ হয়ে উঠছে। আমি তো বুঝতে পারছি, সুইডেনে তোমার অসুখ না ধরতে পারা, বাংলাদেশে তোমার ভুল অপারেশন করা সবকিছু তোমার অসুখ যত না ভয়ংকর, তার চেয়েও বেশি ভয়ংকর করে তুলেছে। ঘণ্টা বাজছে, সেই শব্দ আমি শুনতে পাচ্ছি। বাবা ডাক্তার, বাবাও নিশ্চয়ই শুনতে পাচ্ছিল। আমি মরিয়া হয়ে উঠলাম কোথাও কোনও আধুনিক চিকিৎসা আছে কিনা দেখতে। তোমাকে ভারতে নিয়ে যাওয়া যায় কিনা, সিঙ্গাপুরে, নাকি সুইডেনে, নাকি আমেরিকায়। ভারতের বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলে হাসপাতাল আর ডাক্তার সবই ঠিক করে ফেললাম, কিন্তু মুশকিল হল ও দেশ আমাকে ভিসা দেয় না। কীকরে যাবো! সিঙ্গাপুর আর সুইডেনে কোনও অসুবিধে নেই। কিন্তু সুইডেনের ওপর আমার প্রচণ্ড ক্ষোভ, তোমার অসুখ ধরতে পারেনি, তারপর তোমাকে দিনের পর দিন ভুল চিকিৎসা দিয়ে ভুগিয়েছে। আমেরিকায় কিছু পাওয়া যায় কি না তা দেখি। নেট ঘেঁটে নিউইয়র্কের মেমোরিয়াল স্লোন কেটেরিং হাসপাতালের সন্ধান পেলাম। নিউইয়র্ক শহরেই সেই ক্যানসার হাসপাতাল। কোলন ক্যানসারে যে লিভার মেটাসটাসিস হয়, তার বিশেষজ্ঞ আছে ওই হাসপাতালে। তারা নতুন একটি জাপানি উদ্ভিদের রস সরাসরি রক্তে ঢুকিয়ে কিছু কিছু ক্ষেত্রে নাকি ভালো ফল পাচ্ছে। আমি ওটিই ভাবলাম চেষ্টা করবো তোমার জন্য। শেষ চেষ্টা। তোমাকে বাঁচানোর জন্য পাগল হয়ে উঠলাম মা। ওই স্লোন কেটেরিং হাসপাতালে একদিন গিয়ে জেনে এসেছি নিয়ম কানুন। আমার আমেরিকান বন্ধু ওয়ারেন অ্যালেন স্মিথকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলাম। রোগীর সোশাল সিকিউরিটি নম্বর লাগবে, তবেই ওরা চিকিৎসা করবে। পরে ফোনে খবর নিয়ে জেনেছি, অন্য দেশের রোগীদের ক্ষেত্রে তেরো হাজার ডলার জমা দিতে হবে, ওরাই বিমান বন্দর থেকে রোগী নিয়ে আসা থেকে প্রয়োজন অনুযায়ী সব চিকিৎসা করবে। হাসপাতালেও ভর্তি হওয়ার ঘটনা ঘটতে পারে। এসব খোঁজ খবর নেওয়া, দিনে কুড়িবার করে দেশে ফোন করে আমেরিকার দূতাবাসে গিয়ে ভিসা যেন সময় মতোনাও তার তাগাদা দিচ্ছিলাম। পাশে কাউকেপাইনি আমাকে সাহায্য করার। ইয়াসমিন যখন শুনলো আমি তোমাকে আমেরিকায় আনছি চিকিৎসার জন্য, সে খুশি না হয়ে বরং উল্টেআমার সঙ্গে মেজাজ দেখালো। তুমি যদি আসবেই, তাহলে শুধু শুধু তাকে দেশে যেতে হলো কেন! কেন আমি তার আমেরিকার নাগরিকত্ব পাওয়ার বারোটা বাজিয়ে দিলাম! রাজনৈতিক আশ্রয় আমার বোন হিসেবেই সে পেয়েছে। তার বারোটার কিছুই বাজেনি মা, কিন্তু আমেরিকার নাগরিকত্ব পেতে আবার কোনও অসুবিধে হয় কি না এই আশংকায় সে বীভৎস হয়ে উঠলো। আমি যে কত একা ছিলাম দিন রাত, কত যে তোমার জন্য একা একা ভেবেছি, কেঁদেছি, সে আমিই জানি। তুমি আর বাবা এলে। বিমান বন্দরে আমি গেলাম, ইয়াসমিন যায়নি। সে কেন যাবে, সে তো ফুঁসছে। তোমার জন্য বাংলাদেশে গিয়ে ভীষণ ভুল সে করে ফেলেছে, সেই ভুলের সব দায় দায়িত্ব আমার, পারলে আমার মুখ দেখা সে বন্ধ করে দেয়। তার কাছে আমেরিকার নাগরিকত্বের চেয়ে বড় কোনও কিছু এই জগতে নেই। বাবা মা ভাই বোন তার কাছে আর বড় ব্যাপার নয়। তার নিজের আর তার স্বামী সন্তানের নাগরিক ভবিষ্যৎ নিয়েই তার যাবতীয় ভাবনা। ওর ভেতরে যে আবেগ ছিল, যে ভালোবাসা ছিল, সে কোথায় গেল, আমি বুঝে পাই না। আমেরিকার স্বপ্ন তাকে ছোটদা আর মিলন শিখিয়েছে দেখতে। তা না হলে ও একটা হৃদয়হীন মানুষের মতো এমন অসভ্য আচরণ করতো না। ওর নাগরিকত্ব পেতে সামান্যও কোনও ব্যাঘাত ঘটেনি মা। যখন পাওয়ার, নির্বিঘ্নে পেয়ে গেছে।
বাংলাদেশ বিমানে ছোটদাই ফ্রি টিকিটে তোমাদের নিয়ে এলো। এয়ারপোর্টে তোমাদের নামিয়ে দিয়ে আবার চলেও গেল। আমার পাঠানো গয়নাগুলো তুমি পরে এসেছে। না মা, তোমাকে সুন্দর দেখাবে বলে নয়, আমাকে খুশি করতে পরেছে। আমাকে খুশি করার জন্য তুমি আগেও যেমন সব করেছে, তখনও করেছে। আমি বোধহয় ওই প্রথম আমার জীবনে তোমাকে খুশি করতে চাইছিলাম। আমি কি পারছিলাম মা? তুমি অসম্ভব শান্ত, স্নিগ্ধ, তোমাকে দেখে একটুও মনে হচ্ছিল না যে প্রায় তিরিশ ঘণ্টার একটা দীর্ঘ ক্লান্তিকর যাত্রা সবে শেষ করেছো। বাড়ির পথে যেতে যেতে ট্যাক্সির জানালায় তোমাকে নিইউয়র্ক শহরটাকে দেখাতে চাইছিলাম। না, মা, তুমি শুধু আমার দিকেই তাকিয়েছিলে। আমার একটা হাত ধরে বসেছিলে, সেই হাতে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলে। পরেও যখন তোমাকে ম্যানহাটনের দিকে যেতে উঁচু উঁচু দালানগুলো দেখাতে চেয়েছি, তুমি একবার তাকিয়েই চোখ সরিয়ে নিয়েছে। পৃথিবীর সব লোকই এসে অবাক চোখে ওই উঁচু বাড়িগুলো দেখে, এসব দেখে তোমার কোনও বিস্ময় জাগে না। যেন তুমি এসব অনেক দেখেছো। এত নিস্পৃহ চোখে জগৎ দেখতে আর কাউকে দেখিনি আমি। এত উৎসাহ ভরে মানুষ দেখতেও আর কাউকে দেখিনি। তোমার কাছে মানুষ আর মানুষের হৃদয়ের দাম ছিল সবচেয়ে বেশি।
এই স্লোন কেটেরিংও যে আমাকে এত ভোগাবে কে জানতো। আমার কোনও ঘুম ছিল না মা, রাত দিন আমি কুঁদ হয়ে ছিলাম তোমার জন্য কোনও চিকিৎসা পেতে। খুঁজে খুঁজে যা পেয়েছিলাম, তাকেই বিশ্বাস করে তোমাকে বললাম চলে আসতে আমেরিকায়। তোমার আর বাবার ভিসার ব্যবস্থাও করলাম। কী করে যে এত সব করেছিলাম ভাবলে এখন অবাক হই। পেন আমেরিকার লেখকদের বলেই তোমার আর বাবার আমেরিকা আসার জন্য ভিসা করিয়েছিলাম। তুমি আসার আগে সাড়ে ছ হাজার ডলার জমা দিতে হয়েছিলো হাসপাতালে। তারপর যেদিন হাসপাতালে গেলাম ডাক্তার দেখাতে, অন্য সব রোগীদের সঙ্গে তোমাকে দীর্ঘ সময় বসে থাকতে হলো। সব রোগীকেই দেখছে, তোমার বেলায় বলা হলো, বিদেশি রোগী, বাকি টাকা জমা না পড়লে ডাক্তার দেখবে না। তখনই দৌড়ে হাসপাতালের বিদেশবিভাগে গিয়ে বাকি সাড়ে ছ হাজার ডলার জমা দিয়ে তোমাকে ডাক্তার দেখালাম। এমআরআই করা হয়েছিলো তোমার, তার রিপোর্ট দেখে আর তোমাকে খানিকটাপরীক্ষা করে ডাক্তার বলে দিল, লিভারে অনেকগুলো মেটাসটাসিসের নডল আছে। তিনটে থেকে এত দ্রুত কী করে অনেকগুলো হয়ে উঠলো, সে আমি অনুমান করতে পারি। তোমার ওই সাড়ে চার ঘণ্টার অপারেশন, আর ব্যাগের পর ব্যাগ রক্ত ঢালা, সে কারণেই। জিজ্ঞেস করলাম, লিভার অপারেশন করা যায় না? মেটাসটাসিস যেখানে যেখানে হয়েছে, সেসব জায়গা কেটে বাদ দেওয়া? ডাক্তার বললো, না। হবে না। লিম্ফ নোডে ছড়িয়েপড়েছে। বললো, লিভার অপারেশন করে লাভ নেই। তারপর খুব স্বাভাবিক কণ্ঠে, এতটুকু কাঁপলো না ডাক্তারের কণ্ঠস্বর, এতটুকু মায়া নেই তার কণ্ঠে, বললো আর মাত্র তিন মাস তুমি বাঁচবে। তিনমাস, এই শব্দটা আমার বুকে বিষমাখা তিরের মতো ছুটে এসে বিধতে তিন মুহূর্ত সময় নেয়নি। আর কোনও চিকিৎসা? আর কোনও কি চিকিৎসা নেই? আমি কাতর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলাম। পাথরের মতো মুখ ডাক্তারের। বললো, রোগীকে দেশে ফেরত পাঠান।
ডাক্তারের চেম্বারে শুয়ে থাকা তোমার কাছে ফিরে এসে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলাম। তুমি ফ্যাকাসে মুখে বললে, কাঁদছো কেন? কী বলেছে ডাক্তার? আমি মরে যাবো? ’আমি কিছু বলিনি নাকি মাথা নেড়ে না বলেছিলাম মনে নেই। তবে কাঁদছিলাম। চোখের জল থামাতে পারিনি অনেকক্ষণ। তুমি হয়তো যা বোঝার, বুঝেই নিয়েছে। বললে, খুব নরম স্বরে বললে, সবার মা কি আর সারাজীবন বাঁচে? তুমি কেঁদো না মা। তোমার চোখে একফোঁটা জল ছিল না।
ডাক্তারের ওই জবাব দিয়ে দেওয়ায় আমি কি তল্পিতল্পা গুটিয়ে বাড়ি চলে যাবো নাকি! আমি তার পেছন পেছন গিয়ে বললাম, আমি নিজে একজন ডাক্তার, আমাকে বলুন কিছু। লিভার মেটাসটাসিস হলে নতুন যে ট্রায়াল দেওয়া হচ্ছে এই হাসপাতালে, কিছু তো ভালো ফল পাওয়া গেছে। আমার মার জন্য সেই ট্রায়ালের ব্যবস্থা করলে কেমন হয়! সেই ডাক্তার, তুমি জানোনা মা, খেঁকিয়ে উঠে বললো, ”হেই তুমি কি ইংরেজি ভাষা জানো না? যা বলার বলেই দিয়েছি। দ্বিতীয়বার প্রশ্ন করে আমাকে বিরক্ত করো না। যাও। ডাক্তার সরে গেল, আমার সঙ্গে আর কোনও কথাই বলতে চায়নি। আমিও তো হাসপাতালে ডাক্তারি করেছি। কোনও রোগী বা রোগীর আত্মীয়র সঙ্গে এমন অকথ্য ব্যবহার নিজে তো করিইনি, কাউকে করতেও দেখিনি। যে মেয়ে এইমাত্র শুনলো যে তার মা আর তিন মাস পর মারা যাবে, তার সঙ্গে ডাক্তাররা কী ভাষায় কথা বলবে, তা ওই ডাক্তার শেখেনি। হাসপাতালের ওয়েবসাইট থেকে অনেক লিভার মেটাসটাসিস বিশেষজ্ঞরমধ্যে ওই মহিলাকে আমি পছন্দ করেছিলাম। অনেক ডিগ্রিতার, অনেক পড়াশোনা, অনেক অভিজ্ঞতা। আমার মনে হয় না কোনও সাদা রোগীর সঙ্গে অমন ব্যবহারের সুযোগ সে পেত। আমাকে বা তোমাকে ওই ডাক্তার মানুষ বলে মনে করেনি। মনে করেছে। কোন জঙ্গল থেকে জন্তু জানোয়ার কিছু গেছি হয়তো তার কাছে। এখন ভাবি আমার তো আমেরিকার কিছু লেখক কবিদের সঙ্গে পরিচয় ছিল। লেখক সংগঠন পেন আমাকে যথেষ্টই গুরুত্ব দিত। তাদের কাউকে আমি সঙ্গে নিয়ে গেলাম না কেন! সঙ্গে নিলে এই আচরণ থেকে অন্তত রেহাই পেতাম, কিন্তু তোমার কি আর কোনও চিকিৎসা পেতাম! অন্তত লিভার মেটাসটাসিসের যে চিকিৎসা চলছে, সে সম্পর্কে কিছুক্ষণ তো কথা বলতে পারতাম। আসলে কী জানো, বিদেশের ভাবসাব দেখে, বর্ণবাদের বিরুদ্ধে তাদের বিস্তর শ্লোগান টোগান শুনে বিশ্বাস হয়না সাদাদের বেশির ভাগের রন্ধ্রে রন্ধ্রেলুকিয়ে আছে বর্ণবাদ। বিশ্বাস হয় না যে সুযোগ পেলেই তারা তাদের ঘৃণা উগরে দেবে। ডাক্তার, সত্যি বলতে কী, আমাকে অনেকটা দূর করেই দিল তার চোখের সামনে থেকে। আমি যে ডাক্তার, তা বোধহয় বিশ্বাসও করেনি। আর, গরিব দেশের ডাক্তাররা যে ডাক্তার তা-ই বোধহয় মনে করে না। এই ব্যবহার পাওয়ার জন্য তেরো হাজার ডলার দিয়েছি।
তোমার অসুখের কথা আমি তোমাকে কিছু বলিনি। কী অসুখ, ডাক্তার কী বলেছে, তার কিছুই না। তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছিলে কিছু একটা খবর গোপন করছি আমি। গোপন করলে কোন খবরটা গোপন করতে পারি, তা অনুমান করার মতো বুদ্ধি তোমার আছে! ডাক্তারকে আগেই অনুরোধ করেছিলাম যা জানানোর আমাকে যেন জানায়, তোমাকে নয়। বিদেশে ডাক্তাররা রোগীদের সব জানিয়ে দেয় কী অসুখ, কোথায় অসুখ, বাঁচার আশা আছে কী নেই, থাকলে কদিন বা ক’মাস, সব। জানার পর রোগীরা নিজের জীবনের বাকি কাজগুলো ওই সময়ের মধ্যে সেরে নেয়। গুছিয়ে নেয় সব। তোমার তো কোনও সহায় সম্পদ নেই গোছাবার। তোমার তো কোনও জমি জায়গা নেই কাউকে লিখে দিয়ে যাবার। তুমি নিঃস্ব এক মানুষ। কী দরকার জেনে কদিন বাঁচবে তুমি। কী দরকার জেনে ওই অসুখটির নাম। কী দরকার আর কষ্ট পেয়ে, জীবনে কষ্ট তো তুমি কম পাওনি। বাকি দিনগুলো অন্তত এটুকু জেনে স্বস্তি পাও যে তোমার চিকিৎসা চলছে, তুমি সুস্থ হয়ে উঠবে শীঘ্র।
একদিন তোমাকে বলে দিলাম কত টাকা আমাকে হাসপাতালে জমা দিতে হয়েছে। সেটা তোমার জন্য কত লক্ষ টাকা খরচ করছি সেটা বোঝাবার জন্য নয়, তোমার জন্য কত ক্ষতি আমার হচ্ছে, সেটা বোঝাবার জন্য নয়। তোমাকে ভালোবাসি, তোমার সুস্থ হওয়াটা চাই, টাকা আমার কাছে তুচ্ছ, তোমার সুস্থ হওয়াটা বড়, এ কথাটা বোঝাবার জন্য। তুমি কি বুঝেছিলে? নাকি ভেবেছিলে টাকা খরচ নিয়ে আমার অনুশোচনা হচ্ছে। ভেতরে ভেতরে তুমি সাংঘাতিক অভিমানী মেয়ে ছিলে। সংবেদনশীল, স্পর্শকাতর। জানি না কী মনে হয়েছিলো তোমার। কেমন যেন চুপচাপ থাকতে। যেন তোমার কিছুই হয়নি, কোনও অসুখ হয়নি, যেন দিব্যি আছো। কার সঙ্গে অভিনয় করতে, মা? কাকে ফাঁকি দিতে? একবারও এরপর জিজ্ঞেস করোনি, ডাক্তার কী বলেছিলো যে আমি কাঁদছিলাম। একবারও কেন তুমি জানতে চাওনি। তুমি তো কত কিছুর খুঁটিনাটি জানতে চাইতো কী করে বিদেশে বাজার করি, কী করে রান্না করি, হাত পুড়ে যায় কিনা রাঁধতে গিয়ে, টাকা পয়সা ঠিক ঠিক আছে কিনা, হিসেব করে খরচ করি কিনা। দেশে ফেরার জন্য কোনও চিঠিপত্র লিখছি কী না দেশের সরকারকে, ব্যারিস্টার কামাল হোসেনকে জানাচ্ছি। কী না দেশে ফেরাবার ব্যবস্থা করার জন্য, সব।