০২. তোমার সম্পর্কেও এমন কথা

তোমার সম্পর্কেও এমন কথা লিখেছি যে জানি না পড়লে কতটুকু কষ্ট পেতে। লিখেছি আমানউদ্দৌলার সঙ্গে তুমি বিছানায় ঘন হয়ে বসে সন্ধেবেলায় কথা বলতে। আমি খুব অপছন্দ করতাম ওই লোকটার সঙ্গে তোমার অমন গল্প করা। তোমাকে আমার ঘেন্না হত বাবা ছাড়া অন্য কোনও পুরুষের সঙ্গে ফিসফিস করে কথা বললে। সে তোমার দেবর, তাতে কী! দেবরের সঙ্গে অত মাখামাখির কী দরকার। সম্ভবত আমানউদ্দৌলার সঙ্গে তোমার কোনও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল না, তোমরা শুধু সুখ দুঃখের কথাই বলতে। সুযোগ কোথায় ছিল সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হওয়ার। কিন্তু মা, আজ আমি ভাবি, তোমাকে যদি আমানউদ্দৌলা কখনও কোনওদিন শরীরে আনন্দ দিয়ে থাকে, মনে তোমার খুশি দিয়ে থাকে, তবে সাত বছর বয়সী আমাকে একদিন ন্যাংটো করে ঘোরতর যে অপরাধ সে করেছিলো, তার সেই অমার্জনীয় অমানুষিক অপরাধও, তার সেই দানবিক দুষ্কর্মও আমি ক্ষমা দেব। আজ যে বোধ আমার, সে বোধ যদি তখন থাকতো, তবে আমি আলগোছে তোমার ঘরের ওই খোলা দরজা, কেউ যেন না দেখে, না বোঝে, বন্ধ করে দিতাম, যেন তুমি আমানউদ্দৌলার কাছে যা চাও, তা নির্বিঘ্নে পেতে পারো। যেন তোমার অতৃপ্ত শরীর তৃপ্ত হয়। আমানউদ্দৌলা কী স্বার্থে তোমার কাছে আসতো জানি না। লোকটা খারাপ, কিন্তু খারাপ লোকও তো কাউকে কাউকে ভালো লাগা দিতেপারে, কাউকে কাউকে ভালোবাসতে পারে। এই সান্ত্বনা পেতে চাই ভেবে, সে তোমাকে অন্তত কিছুদিনের জন্য হলেও সুখী করেছিলো। তবে এই আশংকাও আমার খুব, তোমাকে সে আঘাত ছাড়া আর কিছুই করেনি। হতে পারে তোমরা নিজেদের সুখ দুঃখের কথাই খানিকটা বন্ধুর মতো পরস্পরকে বলতে। দেবরদের সঙ্গে ভাবী বৌদির সম্পর্ক তো বন্ধুত্বেরই হয় সাধারণত। যারা আমরা দূর থেকে দেখতাম তোমাদের বন্ধুত্ব, ভেবে নিতাম এর মধ্যে নোংরামো আছে। অনাত্মীয় নারী পুরুষের সম্পর্ক মানেই নিষিদ্ধ যৌনতা, এমনই ধারণা পেয়ে এসেছি। যৌনগন্ধহীন বন্ধুত্ব যে তাদের মধ্যেও হতে পারে, এই শিক্ষা দেওয়ার কেউ ছিল না কোথাও।

তুমি আমার সেবা করতে, আর আমি নিশ্চিন্তে নির্ভাবনায় লিখতাম আমার আত্মজীবনীর প্রথম বই। ঠিক দেশের মতো জীবন যাপন শুরু হল বিদেশে। আমার জীবনের শুরু থেকে তুমি তো ওভাবেই সেবা করে গেছ, যখন ইস্কুলে, যখন কলেজে, এমনকী যখন চাকরি করি। খাওয়াতে, পরাতে, যত্ন করতে, আদর করতে, ভালোবাসতে। সব উদ্বেগ, সব উচাটন তোমার ওপর চাপিয়ে আনন্দ করে গেছি। ইস্কুল কলেজ ভালো ভাবে পাশ হল, চাকরি হল, সাহিত্যের লেখাপড়া শুরু হল, নাম হল। পেছনে যে আমাকে আমার বড় হওয়ায় নীরবে নিঃশব্দে নিরন্তর সাহায্য করে গেছে, সেতুমি। বাবার আদেশ উপদেশগুলোই চোখে পড়ে, কিন্তু তোমার পরিশ্রম কী সহজেই ভুলে যেতে পারি! টাকাটাকে সবচেয়ে বড় করে দেখি, ভালোবাসাকে দেখি না। বাবা টাকা দিত বলে বাবাকেই ঈশ্বর বলে মনে করতাম। তুমি যে নিঃস্বার্থ ভালোবাসা দিতে, সেটা কেন চোখে পড়েনি আমাদের কারওরই? যে আমি ভালোবাসাকে এত মূল্য দিই, রাস্তার বখাটে ছেলেদের তেরচা চোখের তাকানোকেও ভালোবাসা মনে করেছি, হৃদয় উপুড় করে দেওয়া তোমার ভালোবাসাকেও ভালোবাসা বলে মনে করিনি। অথবা মনে করলেও অর্থের মতো কঠিন পদার্থের সামনে ভালোবাসার মতো বায়বীয় পদার্থের আদৌ যে কোনও ওজন নেই, একে অসত্য ভাবার কোনও কারণ দেখিনি।

লেখালেখি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় তোমাকে নিয়ে বেশি কোথাও আমার যাওয়া হয়নি। একদিন ভাবলাম শহর দেখাবো। শহর বরফে ছাওয়া। শহরে কী একটা শীতের উৎসব হচ্ছে, ওতে তোমাকে নিয়ে গেলাম ঠাণ্ডার মধ্যে। এর মধ্যে তোমাকে বরফে হাঁটার জুতো, আর গরম ওভারকোট কিনে দিয়েছি, পুরু পশমের একটা রাশান টুপিওএসব পেয়ে তুমিও সেই আগের মতোই শুরু করলে, আমাকে পরতে হবে আগে। তুমি কোনও নতুন পোশাক কেন যে পরতে অস্বস্তি বোধ করতে! নতুন কিছু পরার মতো মূল্যবান নিজেকে কখনও তোমার মনে হয়নি! শহরের স্কানসেন নামের জায়গাটায় মেলা বসেছে, পিচ্ছিল বরফে হাঁটতে তোমার অসুবিধে হচ্ছে, সুয়েনসনকে বলেছিলাম ও যেন তোমাকে হাঁটতে সাহায্য করে। সাহায্য করতে নিলেই তুমি পিছলে পড়লে। তারপরও তোমাকে বরফে হাঁটালাম। আমি যে বরফে হাঁটতে শিখেছি, তা দেখাতেই কী তোমাকে ওই অতক্ষণ ওখানে রেখেছিলাম! দূর থেকে চিড়িয়াখানার কিছু প্রাণী দেখলে তুমি। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা হরিণ, বড় হরিণের মতো মুস, ষাঁড়ের মতো প্রাণী, খুব বেশি কিছু দেখনি, কিন্তু যা দেখেছো, তাতেই তুমি খুশি। কী অল্পতে খুশি হতে তুমি মা! তোমাকে কত অল্পতে খুশি করা যেত। ভালোবাসি এই বাক্যটি কোনওদিন তোমার জন্য কেউই উচ্চারণ করিনি। করলে তুমি কী করতে, তা আমি অনুমান করতেও পারি না। নিজের দেশটাই তোমার দেখা হয়নি, দেশের কোনও চিড়িয়াখানাতেই তুমি যাওনি কখনও, বিদেশের চিড়িয়াখানার দুটো সাদামাটা প্রাণী দেখে তুমি খুশিতে বাচ্চা মেয়ের মতো হাসলে। অবশ্য তোমার সব আনন্দ নষ্ট করে দিয়েছিলাম আমি, স্কানসেন থেকে বাড়ি ফেরারপথে যখন তোমার আঙুলের ওপর গাড়ির শক্ত ইস্পাতের দরজা প্রবল বেগে ছুঁড়ে দিয়েছিলাম। অবশ্য না জেনেই দিয়েছিলাম মা। আমি জানতাম না তুমি যে গাড়ি থেকে নামতে গেলে বা গাড়িতে উঠতে গেলে গাড়ির সামনে কোথাও ধরে নামো বা ওঠো। কঁকিয়ে উঠলে ব্যথায়। আরও হয়তো কঁকাতে, আমি তোমাকে ব্যথা দিয়েছি এই ভেবে আমি যদি কষ্ট পাই, তাই তাকাওনি। বাড়ি ফিরে মাখন তোলার একটি ছোট কাঠের চামচ আর দড়ি দিয়ে তোমার ওই থেতলে যাওয়া আঙুলটা সোজা করে বেঁধে দিয়েছিলাম। হাড় ভেঙে গিয়ে থাকলে আঙুলের নড়াচড়া বন্ধ রাখতে হয়। পরদিন এক্সরে করিয়ে আনলাম। আমার ওইটুকু শুশ্রূষা পেয়ে তোমার সমস্ত যন্ত্রণা দূর হয়ে গিয়েছিলো। এক তোড়া সুখ এসে বেদনার ভারি বোঝাকে তুলোর চেয়েও হালকা করে দিয়েছিলো। পারো কী করে, মা? আমার যদি ওরকম হতো তোমার কোনও ভুলের জন্য, আমি তোমার দিকে ছুঁড়ে দিতাম যত গালি আমি জানি, যত নিন্দা জানি, সব। তোমাকে এমন দোষী করতাম, যেন সারাজীবন তোমাকে কেঁদে কাটাতে হয়।

তোমার বিশ্বাস, তোমার কোনও একটা অসুখ হয়েছে। অসুখটা, তুমি ভাবতে খুব বড় কোনও অসুখ। তোমার এই অসুখের চিকিৎসার জন্য তুমি দ্বারে দ্বারে ঘুরেছে। কেউ তোমার অসুখ সারায়নি। তোমার অসুখ নিয়ে ভাবার কারও কোনও সময় ছিল না। বাবাকে বলেছে, দাদাকে বলেছো, বাবা আর দাদা তোমার অসুখ নিয়ে বিদ্রম্প করেছে। তুমি কি ভেবেছিলে আমিই হবো তোমার সহায়? হ্যাঁ ভেবেছিলে। তোমার শেষ ভরসা ছিলাম আমি। কিন্তু আমিও তো তোমার অসুখ নিয়ে ভাবিনি। অসুখের কথা শুনতে চাইনি। শুনতে চাওয়ার, ভাবার আমার সময় ছিল কি? ছিল না। তোমার জন্য সময় খরচ করে আমার অভ্যেস নেই। তুমি এসেছো বিদেশে আমাকে দেখতে। আমার জন্য রান্না করবে, আমাকে মুখে তুলে খাওয়াবে, আমার বাসন মাজবে, আমাকে চা করে দেবে, আমার কাপড় চোপড় গুছিয়ে দেবে, আমার বিছানা পরিষ্কার করে দেবে, যেমন করতে দেশে। দেশ থেকে বিদেশ এসেছি, তাই বলে মানুষটা তো বদলে যাইনি। স্বভাব চরিত্র যাবে কোথায়! হেসে উড়িয়ে দিয়েছি তোমার ওই ন্যাকামো। অসুখ আবার কী! ডায়বেটিস হয়েছে। ডায়বেটিসের জন্য ইনসুলিন নিচ্ছো, ব্যস। এখন খাওয়া কন্ট্রোল করো। ছোট গ্রামমতো জায়গাটির ছোটখাটো একটি ডাক্তারখানায় নিয়ে তোমার রক্তের চিনি মাপিয়ে এনেছি। ইনসুলিনেও কমছে না চিনি। তোমাকে সব অখাদ্য খাওয়ানোর আয়োজন করলাম। লিক নামের অখাদ্য তোমাকে খেতে হবে। আমিই কি কোনওদিন খেয়েছি লিক? গা গুলিয়ে উঠতো তোমার, তারপরও অখাদ্য গিলতে বাধ্য হতে। ভাবতে তোমার অসুখ বুঝি সেরে যাবে। আমি তোমার ডায়বেটিস নিয়ে চিন্তিত, কিন্তু তোমার ও নিয়ে অত ভাবনা নেই। আমাকে দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি দেওয়ার চিন্তা তোমার। তাই একরকম না খেয়ে, অল্প খেয়ে, অচেনা অখাদ্য খেয়ে আমাকে দুশ্চিন্তা থেকে রেহাই দিতে। তোমার চিনির মাত্রাটা স্বাভাবিক করার সংকল্প আমার, তাতেই ভেবে নিয়েছি তোমার অসুখের চিকিৎসা হবে। নিজের মেয়ের ডাক্তার হওয়ার সুফলটাও তুমি হাতে নাতে পেয়ে যাবে। কিন্তু মা, ডাক্তার হওয়ার পেছনে এই যে দীর্ঘ বছর ব্যয় করেছি, আর এই দীর্ঘ বছরে তুমি যে দিনরাত স্বপ্ন দেখে গেছো, মেয়ে ডাক্তার হচ্ছে, কোনও অসুখ বিসুখে মেয়ে

তোমাকে ভুগতে দেবে না, যে স্বপ্ন নিয়ে তুমি আমাকে পাঁচ বছর ডাক্তারি পড়ার সময় যত্ন করেছো, ডাক্তারি করার আটটা বছর সময় শুধু যত্নই করোনি, আশা নিয়ে আকুল চোখে তাকিয়ে থেকেছো আমার দিকে, কী লাভ হলো? কোনওদিন আমি তো তোমার ওই পাইলস নামক অসুখটিকে অসুখ বলে মনে করিনি। কোনওদিন বলিনি, চল তোমাকে একদিন হাসপাতালে নিয়ে যাবো বা কোনও ডাক্তার দেখাবো। আমিও আমার বাবার মতো তোমাকে বলে দিয়েছি, ওই পাইলস টাইলসের কোনও চিকিৎসা নেই। তুমি কি হতাশ হতে মা? নিশ্চয়ই হতে। অথবা নিজেকে বোঝাতে যে মেয়ে তো আর মিথ্যে বলছে না, বোধহয় চিকিৎসা নেই, বোধহয় এই অবিরাম রক্তস্রোতের মধ্যে ভেসে ভেসেই জীবন কাটাতে হবে, বোধহয় এ সমস্যা কোনও গুরুতর কোনও সমস্যা নয়। নিশ্চয়ই নয়, তা না হলে নিজের মেয়েই তো চিকিৎসা করাতো। স্বামী না হয় ভালোবাসে না, স্বামী না হয় ফিরে তাকায় না। কিন্তু নাড়িছেঁড়া ধন ব্যস্ততার জন্য হয়তো মার কাছে দুদণ্ড বসার, দুকথা শোনার সময় পায় না, তাই বলে কি চিকিৎসা করবে না, যদি পাইলসের ঘটনাটি স্বাস্থ্যের কোনও সত্যিকার সমস্যাই করতে! যতই রক্তপাত হোহাক, এ কোনও সমস্যা নয় –আমার এই বাণী তোমাকে স্বস্তি দিয়েছিল। হ্যাঁ, ডাক্তার-কন্যা থেকে পাওয়া আশ্বাস। এর চেয়ে বড় আর কী থাকতে পারে একজন মা’র জীবনে। আর কার ওপরই বা তুমি এত ভরসা করতে পারো!

মা, আমি কি ইচ্ছে করলেইপারতাম না তোমাকে বড় কোনও ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে? পারতাম। তুমি যখন বলেছিলে, তোমার একটা অসুখ আছে, আমি কি পারতাম না মন দিয়ে তোমার অসুখের উপসর্গগুলো শুনতে এবং বুঝতে? আমাকে যখন বলেছো তোমার একটা অসুখ আছে, হেসে উড়িয়ে দিয়েছি, জানতে চাইনি কী অসুখ। তুমি দেখিয়েছো তলপেটের বাঁদিকটায় তোমার ব্যথা। বলেছি, ও কিছুনা। বলেছি ‘ও সম্ভবত তোমার কনস্টিপেশনের কারণে হয়েছে। ফাইবার খাও ঠিক হয়ে যাবে। তোমার তো কোষ্ঠ কাঠিন্য নেই। তবে কিসের ব্যথা! হবে কিছুর। কিছুর না কিছুর তো হবেই। বলে দিলাম ওই জায়গাটায় পুরোনো মল জমে আছে, মল জমে তোমার অন্ত্রের দেওয়ালকে ছিঁড়ে ফেলেছে তাই ব্যথা। কিছু জমে থাকলে ব্যথা মাঝে মাঝে হবেই, ও কিছুনা। শুনে তুমি ঠিক বিশ্বাস করতে পারছিলে না হয়তো। কারণ মল নিষ্ক্রান্ত হওয়ার পরও দেখেছো ব্যথার কোনও কমে যাওয়া নেই। আমি এখনও বুঝি না এত দীর্ঘ বছর ডাক্তারি বিদ্যের মধ্যে ডুবে থেকে ব্যথা হওয়ার কারণ বলতে গিয়ে আমি কেন ভুল করি! এই যদি আমার ডাক্তারি বিদ্যের নমুনা, তবে আমার ডাক্তার পরিচয়টি তো জন্মের মতো মুছে ফেলা উচিত, এবং এই ভয়ংকর নির্বুদ্ধিতার শাস্তিও আমার পাওয়া উচিত। কে আমাকে শাস্তি দেবে! আমাকে তো শাস্তি দেওয়ার কেউ নেই। আমি নিজে মহামানব হয়ে বসে আছি। মা, নিজেকে, আমি ডাক্তার বলতে চাই না আর। বলতে আমার লজ্জা হয় এখন। আমি শতধিক দিই আমার ডাক্তারি জ্ঞানকে। শতধিক দিই আমার ডাক্তার পরিচয়কে।

তোমার কষ্ট হচ্ছিল কিন্তু অভিযোগ করলে আমি বিরক্ত হতে পারি, আমার আরাম আয়েশে ব্যাঘাত ঘটতে পারে, তাই তুমি অভিযোগ করোনি মা। তলপেটের বাঁ দিকে প্রচণ্ড যন্ত্রণা নিয়ে তুমি হাঁটতে, সিঁড়ি বেয়ে প্রতিদিন বারবারই উঠতে নামতে। তোমাকে তো নিচের তলায় দিয়েছিলাম থাকতে, সিঁড়ি বেয়ে ওপরে না উঠলে আমার নাগাল কী করে পাবে! ওপরে উঠতেই হতো তোমাকে, কষ্ট পেতেই হতো। তোমার বাথরুম নিচে, তোমার ঘর নিচে, নিচেও তোমাকে নামতে হত, না চাইলেও। তুমি মা। তুমি আমাকে প্রায় চার বছর পর দেখলে, তুমি ছুটে এসেছো বিদেশ বিভুইয়ে আমাকে দেখবে বলে, আমাকে যে করে তোক দেশে ফেরত নেবে বলে, তুমি মা, তুমি গোটা চার বছর প্রতিদিন কেঁদেছো আমার জন্য, প্রতিরাত কেঁদেছো। তুমি মা। তোমাকে আমি একটা বড় ডাক্তার দেখাইনি। তুমি নিজ মুখে বলেছো তোমার একটা বড় অসুখ আছে, তারপরও না। কারণ তোমাকে আমি বিশ্বাস করিনি। তোমাকে আমি মিথ্যে ডাক্তারি দিয়ে আমার ভুল আমার অজ্ঞতা আমার মুখ দিয়ে শান্ত করেছি। ওপরেশান্ত ছিলে, আমাকে বিরক্ত করোনি। ভেতরে যন্ত্রণাপুষে ওপরে হেসেছো। আমি তো এখন বুঝি। আমি ছিলাম একটা অপদার্থ হীনম্মন্য ভীতু ভীরু অমানুষের সঙ্গে। বড় ডাক্তার দেখাতে চাইলে ওই অমানুষের কাছ থেকে কোনও রকম সাহায্য পাওয়ার কোনও সম্ভাবনা ছিলো না। সাহায্য বলতে তো ওটুকুই। বিশেষজ্ঞের নাম ঠিকানা টেলিফোন ডিরেক্টরি থেকে বের করা। ওদের ফোন করে, ওরা ইংরেজি না জানলে সুইডিশ ভাষায় কথা বলে দেখা করার একটা তারিখ নেওয়া। এই তো! সুয়েনসন সাহায্য না করলেও অন্য কোনও সুইডিশ বন্ধুকে ডাকতে পারতাম এটুকুকরে দেওয়ার জন্য। আমি সুইডিশ ভাষা জানি না। আমার নিজের কোনও গাড়ি নেই। ডাক্তারের কাছে যাওয়ার নিয়ম টিয়ম শিখিনি। কারও না কারও ওপর নির্ভর করতেই হয় আমাকে। কিন্তু মা, এগুলোকে অতিক্রম কি

আমি করতে পারতাম না! মাইব্রিটকে কেন ডাকিনি? ও তো আমার অনেকদিনের বন্ধু। কেন আমি সুইডেনের সরকার বা সুইডেনের লেখক গোষ্ঠীর সঙ্গে যোগাযোগ করে বলিনি, খুব তো আমাকে বিশাল খবর করে এনেছিলে এ দেশে, তোমরা এখন কোথায়, আমারমার জন্য ডাক্তারের ব্যবস্থা করো। মেডিসিন সাঁ ফ্রন্টিয়ার্সের অনুষ্ঠানেও তো আমাকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল। ডাক্তারদের সংগঠন। অ্যানডার্স নামে একটা ডাক্তারের সঙ্গেও তো পরিচয় ছিল। ফোন করে তাকে একবারপাইনি। খবর রাখারপরও সে ফোন করেনি আমাকে, তাতেই অভিমান করেছিলাম, তাকেও তো সবঅভিমান ভুলে আবার ফোন করতে পারতাম! তুমি যখন দানদিরুদ হাসপাতালে, তখন তো দেখেওছিলাম তাকে ওখানে, বলিওনি, বরং পাশ কাটিয়ে গিয়েছি। আমাকে দেখতে পেলে হয়তো কথা বলতো। জানি গাড়ি চালিয়ে এখানে ওখানে নেওয়া ছাড়া সুয়েনসনের দ্বারা ভিন্ন কিছু করার মানসিক ক্ষমতা তার নেই। আমি চেষ্টা করলে পারতাম মা, আজ বুঝি যে পারতাম। কিন্তু চেষ্টাটাই তো করিনি। নিজের মার জন্য সামান্য এটুকু চেষ্টা তো যে কেউ করতো, দেশি বিদেশি যে কেউ। কেবল আমিই করিনি। চেষ্টা তো দূরের কথা, তোমার ধর্মবিশ্বাস নিয়ে সারাক্ষণ কটাক্ষ করতাম। মা তুমি কেন নামাজ পড়ো, কেন আল্লাহ বিশ্বাস করো? আল্লাহ বলে কিছু নেই কোথাও। ধরো, এত যে নামাজ রোজা করলে, গিয়ে যদি দেখ হাশরের ময়দান নেই, আখেরাত নেই, কোনও পুলসেরাত নেই? তুমি বলতে, না থাকলে তো নেইই। কিন্তু যদি থাকে? যদি থাকে, এই আশংকায় তুমি ধর্মকর্ম করো, যদি না থাকে কোনও পরকাল, তবে যে বৃথা হবে এই সময় নষ্ট, এর উত্তরে তুমি চুপ করে থাকতে। মৃদু হাসতে। না মা, বড় হওয়ার পর তুমি শুধু বলেছে, তওবা করে যেন নামাজ শুরু করি। তুমি এবার আমাকে আর নামাজ শুরু করতে বলোনি। শুধু বলেছো দেশে যেন ফিরি, যদি বলতে হয় যদি ঘোষণা দিতে হয় যে আমি আর ইসলাম বিরোধী কিছু লিখবো না, যেন সেই ঘোষণা দিয়ে হলেও, দেশের মেয়ে দেশে ফিরি। কিছু লিখবো না, এই ঘোষণা দিতে আমি নারাজ, আমি ভুল করেছি, এরকম কথাও বলবো না, তবে কী করে ফিরবো দেশে। তুমি মা কত কাউকে নিজে থেকে ফোন করেছো, তুমি বোরখা পরা মেয়ে, চিরকাল অন্দরমহলে কাটানো, পরপুরুষকে কোনওদিন নিজের মুখ না দেখানো মা তুমি শামসুর রাহমানের ফোন নম্বর যোগাড় করে তাঁকে ফোন করেছিলে, যেন, তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বলেন আমাকে দেশে ফিরিয়ে নিতে। বলেছিলে তোমাকে রূঢ় কণ্ঠে শামসুর রাহমান বলেছিলেন, আমি বললে কে বলেছেউনি ফিরিয়ে আনবেন! না আপনারা তো কাছে কাছেই থাকেন, তাই আপনারা বললে তো কাজ হবে। তোমার এই কথায় তিনি জবাব দিয়েছিলেন, কে বলেছে আমি কাছে কাছে থাকি! ’ শামসুর রাহমান ফোন রেখে দিলে তুমি কেঁদেছিলে। আর যাদেরই পাও, যাকেই পাও, তাদেরই, তাকেই হাতে পায়ে ধরেছো যেন আমাকে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। মা, এত ভালোবাসতে আমাকে তুমি! তুমি আমাকে ঘটনাগুলো বলার পরও আমি বুঝিনি তুমি যে ভালোবাসো।

তোমার ধর্মবিশ্বাস নিয়ে ব্যঙ্গ করা আমার কখনও ফুরোতো না। যেদিন রোজা রাখবে বললে, তোমার রোজা রাখার ইচ্ছেকে আমি যাচ্ছেতাই ভাষায় গুঁড়ো করে দিতে চাইলাম। তুমি যে তর্ক করবে, চিৎকার করবে তা কিন্তু করলে না, বরং মিষ্টি হেসে, আমার চুলে পিঠে হাতে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললে, জীবনের হয়তো শেষ রোজা মা, কোনওদিনই ভাঙিনি, এবার ভাঙবো না। আমায় রাখতে দাও মা। আমি হো হো করে খুব জোরে হেসে উঠতাম। আমার অট্টহাসি তোমাকে বিব্রত করতো। আমি চাইতাম তোমাকে বিব্রত করতে, আমি চাইতাম তুমি কষ্ট পাও। তোমার ওই ধর্মবিশ্বাসের অপরাধে ইচ্ছে করেই তোমাকে কষ্ট দিতে চাইতাম আমি। তোমার ধর্মবিশ্বাসকে, তোমার বোরখা পরাকে, তোমার ওই কোরান হাদিস পড়াকে, তসবিহ জপাকে সেই ছোটবেলা থেকেই ঘণা করতাম। তোমাকে মা হিসেবে মানতে আমার লজ্জা হতো। তোমাকে বোকা, বুদ্ধিহীন, গবেট, গদর্ভ ছাড়া কিছু মনে হয়নি। যাকে দেখতে নারি তার চরণ বাঁকা বলে একটা কথা আছেনা? তোমার কিছুই আমার পছন্দ হতো না। তোমাকে দেখতেও লাগতো খুব বিচ্ছিরি। তুমি আর নিজের দিকে তাকাবার সময় পেতে কোথায় মা? তোমাকে তো বাবা বলেই দিয়েছিল যে তুমি কুৎসিত। সুন্দর করে কুচি দিয়ে শাড়ি পরে, চুল আঁচড়ে, মুখে পাউডার লাগিয়ে বাবার সামনে দাঁড়িয়েও দেখেছো বাবা ফিরেও তাকায় না তোমার দিকে, বরং আরও জোরে সোরেই কুৎসিত বলে গালি দেয়। তুমি এরপর ছেড়েই দিয়েছিলে নিজের যত্ন নিতে। তোমার সময়ই বা কোথায় ছিল। সারাদিন তো রান্নাঘরেই যেতো তোমার। সবার জন্য রান্না, সবার জন্য বাড়া। সবাইকে খুশি রাখা। গোসল করে তোমার ভেজা চুল হাতের কাছে যা পেতে তাই দিয়ে, দড়ি বা গামছা, বেঁধে রাখতে। ওভাবে রাখতে রাখতেচুলপড়তে শুরু করলো, তাতেই বা তোমার ভূক্ষেপ হবে কেন? কে আর তোমাকে কবে কেশবতী বলবে! কুরূপা কুৎসিত নামই তো খোদাই করে জীবনে গেঁথে দেওয়া হয়েছে। ঠোঁট শুকিয়ে চড়চড় করতো। ধুলোবালি, আগুন, ছাই আর নোংরার মধ্যে থাকতে থাকতে তুমি জানতে না নিজের শরীর বলে কিছু আছে তোমার। নিজের জীবন বলে কিছু আছে। অন্যের গোলামি করার জন্য তোমার জন্ম। তোমাকে কুৎসিত বললে তোমার আর কোনও দুঃখ হতো না। তুমি নিজেও বলতে আমাদের, আমি তো কুৎসিত, কিন্তু তোমরা সুন্দর হয়ে থাকো। তোমার দুটো মেয়ে যেন প্রতিদিন গোসল করে, চুল শুকোয়, চুল আঁচড়ায়, মুখে ক্রিম দেয়, গায়ে অলিভ ওয়েল মাখে, ত্বকের যত্ন করে বলতে। নিজের কথা ভাবার তোমার কোনও প্রয়োজন ছিল না। আর নিজের যত্ন যদিকরতে চাইতে, তাহলে সংসারের কাজে ফাঁকি দিচ্ছ বলেই মনে করবে হয়তো, তাই যত্ন করতে হয়তো ভয়ও পেতে। সেই তোমাকে, সুইডেনে প্রথম বললাম আমি, মা, তুমি তো খুব সুন্দর। বললাম, কারণ তুমি আসলেই খুব সুন্দর। তুমি আমার কথা শুনে চমকে উঠেছে, বিশ্বাস করোনি। কারণ তুমি বিশ্বাস করো না যে সৌন্দর্যের ছিটেফোঁটা তোমার শরীরে কোথাও আছে। তোমার জীবনে তুমি বোধহয় আর কিছুতে অত খুশি হওনি, যত খুশি হয়েছিলে তোমাকে সুন্দর লাগছে বলায়। কোনওদিন যে কথাটি তুমি কারও কাছ থেকে শোনোনি, সে কথাটি তোমার, পঞ্চাশোর্ধ বয়সে প্রথম শুনলে, তোমার কন্যা বললো। আর কী চাই তোমার! ভালোবাসা এর চেয়ে বেশি তুমি কোনওদিন অনুভব করোনি। তুমি কুৎসিত, এই অপবাদ দিয়ে তোমার স্বামী তোমাকে সারাটা জীবন ছি ছি করেছে, পায়ে ঠেলেছে, ঝি চাকরের মতো ব্যবহার করেছে, বাইরে অন্য মহিলা নিয়ে ঘুরেছে, এমনকী বিয়েও করেছে তাদের, সেই তুমি শুনছো যে তুমি সুন্দর। আমার এই বাক্য, যদিও বিশ্বাস করোনি তুমি, চোখে তোমার জল এনেছে। বলেছো, তুমি তো ভালোবাসো আমাকে, তাই বলছে।

কে বলেছে তোমাকে ভালোবাসি আমি, মা? তোমাকে তো কোনওদিন ভালোবাসিনি। জার্মানি থেকে আনা তোমাকেশ্যাম্পুদিয়েছিলাম, বার বার বলেছি, খুব ভালো শ্যাম্পু। সারাজীবন দুদণ্ড সময় পাওনি নিজের শরীরের যত্ন করার, ভেজা চুল বেঁধে রেখে চুল উঠিয়েছে, চুলের বারোটা বাজিয়েছে, সেই চুলকেই যখন দেখতাম সুন্দর লাগতো, বলেছি, বাহ কেশবতী লাগছে। তোমাকে। আসলে তোমার চুলের প্রশংসা না করে আমি ওই বিদেশি শ্যাম্পুর প্রশংসা করতাম। তুমি চলে যাওয়ার অনেক পরে আমি নিচের তলার স্নানঘরে গিয়ে দেখেছিলাম আমার দেওয়া সেই বিখ্যাত শ্যাম্পুটিকে। আসলে ওটা ছিল কনডিশনার। শ্যাম্পু ছিল না। আমার তো জার্মান ভাষা বোঝার ক্ষমতা নেই, তাই তোমার কপালে ওই কনডিশনার জুটেছিল। আমি নিজে তো শ্যাম্পুই ব্যবহার করতাম, তোমাকে যখন দিলাম ব্যবহার করতে শ্যাম্পু, এই ভুলটা কেন হয়েছিল? আসলে আমি ইচ্ছে করে ওই ভুল করিনি। খুব তাড়াহুড়ো করেছিলাম নিশ্চয়ই, বুঝতে চেষ্টা করিনি, ও কি সত্যিই শ্যাম্পু নাকি অন্য কিছু। তুমি কি যে খুশি হয়েছিলে, বিদেশি ক্রিম বা শ্যাম্পু তোমাকে ব্যবহার করতে দিচ্ছি বলে। ওসবকেই তুমি ভালোবাসা বলে ভুল করেছিলে। আসলে বিদেশে তো বিদেশি জিনিসই মেলে মা। আমার তো সুইডেনের মতো দেশে দিশি সাবান শ্যাম্পু পাওয়ার কথা ছিল না। না মা না, ভালো তোমাকে কোনওদিন বাসিনি। বাসলে তোমাকে দেশে থাকাকালীনই ভালোবাসতাম। চার বছর বিদেশে থাকার পর তোমাকে হঠাৎ করে ভালোবাসবো, অত ভালো তো আমি নই মা। ভালোবাসলে তোমাকে আমি যে করেই হোক একজন বড় ডাক্তার দেখাতাম, আমার একটা বড় অসুখ আছে, তোমার ওই কথাকে আমি গুরুত্ব দিতাম, ভালোবাসলে তোমাকে নিয়ে আমি ভালো কোনও হোটেলে থাকতাম, শুধু তুমি আর আমি, অন্যের বাড়িতে অন্যের অঙ্গুলি নির্দেশে চলতাম না, ভালোবাসলে তোমাকে আমি টাকা পাঠাতাম, প্রচুর তো পাঠিয়েছি বাবাকে। যার ছিল তাকে দিয়েছি, যে কোনওদিন টাকা পয়সার মুখ দেখেনি, তাকে কেবল অন্যরাই বঞ্চিত করেনি, আমিও করেছি। ভালোবাসলে তোমাকে রান্নাঘরের দিকে ঠেলে দিয়ে আমি বই লিখতে বসতাম না। ভালোবাসলে তোমার ভালোবাসাকে আমি মূল্য দিতাম। কিছুই করিনি আমি। বরং এক ঘর অতিথির সামনে তোমাকে অশিক্ষিত বলেছি, যেহেতু তুমি সহজে ইংরেজি বলতেপারো না। ভালোবাসলে তোমাকে সামান্য হলেও শ্রদ্ধা করতাম আমি। অথচ এই তুমিই কি না বলেছো যখন সুইডেনে গিয়েছিলে আমি নাকিতখন প্রচুর ভালোবেসেছি তোমাকে, অথচ এই তুমিই বলেছো, তোমার জীবনের সবচেয়ে সুখের সময় তুমি কাটিয়েছো সুইডেনে। আহ মা, এমন কেন তুমি ভাবলে বলো তো! এক তুষার ছাড়া আর তো কিছু দেখনি। আর তো কিছু তোমাকে দেখাইনি। আর তোকিছুই তোমার জন্য করিনি। তুষার কী আমি দেখিয়েছিনাকি। ও তো আকাশ থেকে ঝরেছে বলে দেখেছো। তুষারপাত দেখে তোমার সে কী বিস্ময়। না, তোমার ওই মুগ্ধতার পেছনে আমার কোনও ভূমিকা নেই মা। আমি শুধু তুষারে বা বরফে তোমাকে ছেড়ে দিয়ে কিছু ছবি তুলেছি তোমার ভিডিও ক্যামেরা কিনেছিলাম, তোমার ওই বরফ বিস্ময় তুলে রেখেছি। এ ছাড়া আমি তো আর তোমার জন্য ভালো কিছু করিনি মা। যদি তোমার চিকিৎসা করাতাম, তুমি বেঁচে যেতে মা। তোমার ওই ভয়ংকর অসুখ থেকে বাঁচতে তুমি। আমি তো করিনি। আমি তো বাঁচাইনি তোমাকে, বরং মেরেছি। তুমি হয়তো স্বীকার করবে না যে আমি তোমাকে মেরেছি, কিন্তু আমি তো জানি মা। স্বীকার না করলেও মনে মনে তো জানো তুমি মা। তোমার স্বামী, তোমার দুই ছেলে, তোমার দুই মেয়ে, অবহেলা করতে করতে তোমাকে মেরেছে। চিকিৎসা না করাতে করাতে মেরেছে। তোমার খুব আশা ছিল আমার কাছে এলে আমি তোমার ডাক্তার মেয়ে, বোধহয় তোমার ওই ভয়ংকর অসুখের, যে অসুখকে অসুখ বলে কেউ মানিনি, কিন্তু তুমি বুঝতে, তুমি একাই শুধু বুঝতে, চিকিৎসা আমি করাবো। কিন্তু মা, তোমার শুধু আশায় বসতি। তোমার ডাক্তার মেয়ে, যাকে নিয়ে কত স্বপ্ন দেখতে, সে তোমার ওই অসুখের দিকে ফিরেও তাকায়নি। যতদিন সুইডেনে ছিলে, আমি শুধু বাবার কথাই বলেছি, বাবার অসুখের কথা। তুমি যখন বলতে বাবা ভালো আছে, বেশ ভালো আছে, তোমাকে আমি খুব হিংসুটে, কুচুটে এক মহিলা ভেবেছি, শুধু ভাবিইনি, প্রকাশও করেছি সে কথা। বাবার একবার হার্ট অ্যাটাক হয়ে গেছে, আবার যে কোনও সময় হতে পারে, তার রক্তচাপ বেশি, যে কোনও সময় যে কোনও একটা দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে বলে কত দুশ্চিন্তা করেছি, তোমাকে সামনে রেখে বসে বসে দুশ্চিন্তা করেছি, সরবেনীরবে। অথচ নিজেই তুমি আস্ত একটি দুর্ঘটনা হতে যাচ্ছো, সেই দুর্ঘটনার আশংকার দিকে একবারও তাকিয়ে দেখিনি, দেখতে কি চেয়েছিলাম, চাইলে তো ঠিকই দেখতাম! কুকুর বেড়ালের কষ্টের দিকে কত মায়া চোখে তাকিয়েছি, তোমার দিকে সামান্য করুণার চোখেও তাকানোর অভ্যেস কোনওদিনই আমার ছিল না। তুমি আমার কাছে এলে, তোমাকে আসতে বলিনি কোনওদিন, তারপরও এলে। আসতে বলতাম বাবাকে। তুমি একা কেন এলে, বাবা কেন এলোনা, এ নিয়েও তোমাকে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে জর্জরিত করেছি। যেন তুমি একা এসেছো, বাবা আসেনি, এ তোমার দোষ। তুমি ভয়ে ভয়ে আমার সঙ্গে কথা বলতে। অত দূর পথ পার হয়ে আমাকে দেখতে আসার স্পর্ধার জন্য ভয়। তুমি ছিলে আমার অনাকাঙ্ক্ষিত অতিথি। তুমি তো জানতে সে কথা, মা। তুমি বলোনি, কিন্তু বুঝতে। বাবাকে দেখলে যত খুশি আমি হতাম, তোমাকে দেখে তার সামান্যও হইনি। দিন রাত গেছে বাবার অসুখ নিয়ে আমার ব্যগ্রতায়, ব্যাকুলতায়। তুমি দেখেছো আমার উদ্বেগ। বাবার প্রতি আমার তীব্র ভালোবাসা দেখেছো, অপরিসীম শ্রদ্ধা দেখেছো। এত যে বলেছো বাবা তোমার হাতে একটা পয়সাও দেয় না, তুমি কী করে চলছে চলবে সে খবর বাবা রাখে না, এমনকী অবকাশের সম্পূর্ণ দায়িত্ব তোমার কাছ থেকে কেড়ে দাদার বউকে দিয়েছে, যে বাড়ি থেকে যে সংসার থেকে তোমাকে বাধ্য হয়ে বিদেয় নিতে হয়েছে, সে বাড়িতে ঢাকা থেকে মাঝে মাঝে গেলে বাবা তোমার দিকে রেগে মেগে তেড়ে আসে, বাড়ির সবচেয়ে ছোট ঘরটিতে যে খাটে তুমি ঘুমোতে, সে খাট ভেঙেপড়ে আছে, বাবা তা উঠোনে ফেলে রেখেছে, আর খাটে যে ছেঁড়া তোশকটা পেতে শুতে, সেটাও শতচ্ছিন্ন, বাবাকে শত বলেও খাট সারাতে পারোনি, শত বলেও কোনও একটা নতুন তোশক কোতে পারোনি, তুমি ঘুমোতে সামনের বারান্দায় মেঝেয়, মশার কামড় খেতে খেতে, রাস্তার অচল অক্ষম ভিখিরির মতো, বাবাও সামনে আসতো না, দাদাও না, হাসিনাও না, দাদার ছোট ছেলে সৌখিন একদিন বলেছিলো, ‘দাদু তুমি যে মাটিতে মশারি ছাড়া ঘুমাও, তোমার কষ্ট হয় না? ’ শুনে তুমি কেঁদেছে। অন্ধকারে চোখের জল বুঝি কারও চোখেপড়ে! সবাই তো বিছানায় আরাম করে সারা রাত্তির ঘুমিয়েছে, তুমি বারান্দায় একা, অন্ধকারে, মশার কামড়ে –এসব শুনেও আমি বাবা বাবাই করেছি। আমার একটুও বাবার ওপর রাগ হয়নি। দাদা বা হাসিনার ওপরও হয়নি। কেন হয়নি মা? তোমার গল্প কি আমি বিশ্বাস করিনি? নাকি তোমার গল্প আমার খুব চেনা গল্প! নাকি তোমার গল্পগুলো আমার গা সওয়া হয়ে গেছে! তুমি তো এমনই ব্যবহার পেয়ে এসেছো, আমি তো জন্ম থেকে দেখেছি। জন্ম থেকে চেনা হলে কোনও অন্যায়কে বোধহয় আর অন্যায় মনে হয় না। আশ্চর্য, কত কিছুরই তো জীবনে প্রতিবাদ করেছি, কেবল তোমার ওপর কোনও অন্যায়ের প্রতিবাদ আমি করিনি। তোমাকে ভালোবাসিনি কোনওদিন। জন্ম দিলেই বুঝি সন্তান ভালোবাসে মাকে? তুমি তো দাদাকেও জন্ম দিয়েছিলে, দাদাকে ভালো তো তুমি কম বাসোনি। দাদা তো কই বিয়ে করার পর বউ সঙ্গে নিয়ে তোমাকে জ্বালাতো। তোমার জ্বর হলে একটু ওষুধের জন্য যখন অনুরোধ করতে, পচাপুরোনোপ্যারাসিটামল এনে দিত, মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়া অচেনা দিশি কোম্পানির বাতিল অ্যান্টিবায়োটিক দিত। দাদার হাতেই ছিল বাবার ওষুধের দোকান আরোগ্য বিতানের দায়িত্ব। ওষুধপত্রের হিসেব নিকেশ দাদাই রাখতো। দাদাই তখন ডাক্তার। তোমার পেটের ছেলে, মা। তুমি ভাবতে ছোটদা তোমাকে খুব ভালোবাসে। কেন মা? যেহেতু সে বিমানের ডিউটি সেরে বাড়িতে বিমানের কিছু স্যান্ডুইচ, আপেল বা কমলার রস নিয়ে আসতো? ওসব তো গীতা থাকাকালীন তোমাকে কোনওদিন দেয়নি। গীতা ছিল না বলে অগত্যা তোমার হাতে পড়েছে। ওগুলোর জন্য তো একটি পয়সা খরচ হয়নি ছোটদার। ফ্রি জিনিস। বাড়তি জিনিস। ফেলে দেওয়া মাল। ক্রুরা বাড়িতে নিয়ে আসে বিমানেপড়ে থাকা জিনিস। আনতো বলে তুমি ভাবতে কী ভীষণই না ভালোবাসে ছোটদা তোমাকে। কেউ তোমাকে একবিন্দু দিলে তুমি তাকে এক সমুদ্র দিতে। তোমার তো টাকা পয়সা ছিল না দেওয়ার। তুমি অবকাশে গেলে বাবা আর দাদার সেবা করতে। আর ছোটদার জন্য বাবার কাছে চেয়ে চেয়ে নিয়ে আসতে চাল ডাল মাছ মাংস। ওগুলো আমার শান্তিনগরের বাড়িতে নিজে রান্না করে খাওয়াতে ছোটদাকে। বাবা থাকতে অবকাশে দাদার যত্ন করার জন্য, তোমার কাজ ছিল ঢাকায় বসে ছোটদার যত্ন করা। শুধু রান্না করে খাওয়ানো নয়, ছোটদার কাপড় কাঁচা, ইস্ত্রি করা, তার যাবতীয় সবকিছু গোছানো, সব দায়িত্ব তোমার। তোমার যত্ন কে করতো মা? ছোটদা বিমানের কাজে প্রায়ই বিদেশে চলে যেতো। তুমি থাকতে তার পথ চেয়ে। ফিরে এসে মা বলে ডাকবে, ঘরে ঢুকে হয়তো একটু জড়িয়ে ধরবে। জড়িয়ে ধরার অভ্যেস তার হয়েছে গীতাকে জড়িয়ে ধরতে ধরতে। ওই ওটুকু স্পর্শই তোমাকে আনন্দ দিত। ছোটদা কি আর বাড়িতে দুদণ্ড বসতো! কাপড় পাল্টেওই তো ছুটে যেতো বান্ধবীদের কাছে। কখনও বাড়ি ফিরতো গভীর রাতে, বেশির ভাগফিরতো না। মদ খাওয়ার অভ্যেস তো ইতিমধ্যে বেশ করে নিয়েছে। তুমি মদকে মদ বলতে না। বলতে কী সব যেন’। বিয়ারের ক্যানগুলোকে বলতে সবুজ কৌটোর কোক’। বুঝতে ওসব খাওয়া ভালো নয়, বুঝতে নিশ্চয়ই। ছোটদার বিরুদ্ধে তোমার কোনও অভিযোগ ছিল না। ছোটদা কেন আমার বাড়িতে থাকে, কেন সে অন্য কোথাও চলে যায় না এসব নিয়ে আমি কম চিল্লিয়েছি? তুমি চুপ করে শুনে গেছো, মন খারাপ হয়েছে তোমার। বলতে, বাবাও তোমাকে উঠতে বসতে অপমান করে, দাদাও করে। এক ছোটদাই তোমাকে ভালোবাসে, ছোটদা সেই ছোটবেলায় বিয়ে করে বাড়ি ছেড়েছিলো, গীতা কোনওদিন ছোটদাকে বাবা মার কাছে ভিড়তে দেয়নি, ছেলেমেয়ে নিয়ে গীতা আমেরিকায় চলে যাওয়ার পর ছোটদাকে এতকাল পর কাছে পেয়েছো, সে দূরে চলে গেলে তোমাকে দেখার কেউ নেই, কিন্তু আমার বাড়িতে কে থাকবে না থাকবে তার সিদ্ধান্ত তো আমিই নেব, তাও বুঝতে। তুমি অসহায় বসে থাকতে আমার আস্ফালন দেখে। তোমাকে কষ্ট দিচ্ছি জেনেই কষ্ট দিয়েছি। শান্তিনগরের যে বাড়িতে তোমরা থাকে, সে তো আমার বাড়ি, তা আমি চিৎকার করে, গালাগালি করে, যাচ্ছেতাই কথা বলে বোঝাবো। তা না হলে বুঝবে কী করে তুমি! তোমাকে তো বোঝাতে হবে আমার প্রতাপ। তোমার নরম মনটি যে কত নরম তা বোঝার সাধ্য কেন আমার হবে। আমি তো দুর্যোগ সইছি। দেশ ছাড়তে হয়েছে। তোমাদের সবাইকে ত্যাগ করতে হয়েছে। নিজের বাড়িগাড়ি, নিজের সাজানো ঘর, নিজের যা কিছুসব ত্যাগ করতে হয়েছে। যখন বললে যে হাশেম মামার বড় মেয়ে শাবানা তার স্বামী নিয়ে দুদিন এসেছিলো আমার বাড়িতে। আমি চমকে বললাম, শুনেছি ওই স্বামী লোকটা ইসলামি শিবিরের লোক! সে কেন এসেছে আমার বাড়িতে! মুখ তোমার মুহূর্তে বেগুনি হয়ে গেল, বললে স্বামী লোকটা নাকি আমার লেখার ঘরে বসে আমার একটি বই পড়ে আমার লেখার প্রশংসা করছিলো, সে হতে পারে ধার্মিক, কিন্তু মৌলবাদী নয়। আমি তো ধার্মিক আর মৌলবাদীতে পার্থক্য করিনা, তুমি করো। তোমাকে আমি দোষ দিয়েছিতুমি আমার শত্রুদের আমার বাড়িতে আপ্যায়ন করেছো বলে। আমার একটুও মনে হয়নি, একা একা যে বাড়িতে দিনের পর দিন কাটাও, সেখানে কেউ এলে, আত্মীয় স্বজন কেউ, তোমার ভালো লাগে। নিজের সংসার হারিয়ে মেয়ের সংসারকে নিজের বলে মনে করেছিলে। তা আমি মনে করতে দেব কেন! তুমি যে আমার বাড়িতে থাকছো, সে আমি করুণা করছি বলে সে বাড়িতে তুমি থাকতে পারছো, কিন্তু বাড়িতে কে ঢুকবে বা না ঢুকবে তার সিদ্ধান্ত আমি ছাড়া আর কারর নেওয়ার অধিকার নেই, তুমি মা হয়েছে তাতে কী, তোমারও নেই। সে কথা আমি তোমাকে তিরস্কার করে বোঝাই। শরাফ মামা মালোয়েশিয়া গিয়েছিল, মালোয়েশিয়াতে তাকে, জানিনা কী কারণে, সম্ভবত বৈধ পাসপোর্ট না থাকায় জেলে ভরে রেখেছিলো, সেই জেল থেকে ছাড়া পেয়ে ঢাকায় পৌঁছে আমার শান্তিনগরের বাড়িতে একটা রাত কাটিয়ে পরদিন ময়মনসিংহে চলে যায়। কিন্তু কেন আমার বাড়িতে শরাফ মামা এলো, তা নিয়ে আমি তোমাকে তুলোধুনো করলাম। শরাফ মামার মতো বদমাশ মৌলবাদী, যে আমার বিরুদ্ধে মিছিল করেছে, কেন ঢুকলো আমার বাড়িতে? তার উত্তরে তুমি মাথা নিচু করে থেকেছো। মাঝে মাঝে নরম স্বরে কেবল বলেছো, ও খুব অসহায়। বলেছো, মিছিল শরাফ করেনি। আমি যদি শুনে থাকি কোথাও, ভুল শুনেছি। ভাইএর পক্ষ নিয়ে কথা বলছো বলে তোমাকে আমি স্বার্থপর, মাথামোটা, বদ, বোকা –কত কথাই না বলেছি। হ্যাঁ বলেছি মা। তোমাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য বলেছি। তোমাকে আমি ভালোবাসি না বলে বলেছি। তুমি তো আমার ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য ছিলে না। তোমার মতো ধর্মভীরু মানুষকে শ্রদ্ধা করার বা ভালোবাসার আমার তো কোনও কারণ ছিল না। শরাফ মামার মতো দাড়িওলাটুপিপরা লোককে, যে শুনেছি আমার বিরুদ্ধে ময়মনসিংহে সে সময় মিছিল করেছিলো; সারাদেশ জুড়ে যখন দাবি উঠছে আমার ফাঁসির জন্য, যে মৌলবাদীতাণ্ডবের কারণে সরকার আমার বিপক্ষে গেল, আমাকে দেশ ছাড়তে হলো, যারা আমার ফাঁসি চেয়েছে সে হোক না আমার আত্মীয়, হোক না মামা, আমি তাকে ক্ষমা করবো কেন? আমার বাড়িতে সে কী সাহসে পা রাখে। এই পা রাখার সাহস তো আমি যদি ও বাড়িতে থাকতাম পেতো না। পেলো তুমি ছিলে বলে। তুমিই সব নষ্টের গোড়া। আমারই বাড়িতে আমার শত্রুকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। কী করে সইবো এ খবর আমি! তুমি আমাকে বোঝাতে চাইলে শরাফের কানাকড়ি কিছু নেই। যে করেই হোক মালোয়েশিয়া গিয়েছিল দুটো টাকা রোজগার করতে, যেন সংসার চালাতে পারে। তাও ভাগ্যে হলো না। শরাফ মামা শুধু একটা রাত কাটিয়েছে আমার বাড়িতে, দীর্ঘ যাত্রার পর বিমান বন্দর থেকে আবার বাসে করে ময়মনসিংহে যেতে তার শরীর কুলোচ্ছিল না, একটা রাতের বিশ্রাম দরকার ছিল। মালোয়েশিয়ার জেলে এমনকী মেরেছেও তাকে। কিন্তু আমি শুনবো কেন। আমার কেন মায়া হবে শরাফ মামার জন্য। আজ আমার মনে হয় না, বাবা যে বলেছিলো শরাফ মামা মিছিলে গিয়েছিল, সত্যিই সে গিয়েছিল। শরাফ মামা পরে আমাকে বলেছে মিছিলে যায়নি সে। বরং মিছিলের লোকদের চেষ্টা করেছিলো সরিয়ে নিতে। মামাদের কাউকে তো বাবা পছন্দ করতো না। তাই হয়তো বলেছিলো। যখন দেশে তাণ্ডব চলছিল, শরাফ মামা একবার আমার শান্তিনগরের বাড়িতে আসতে চেয়েছিলো দেখা করতে, ইন্টারকমে তুমি শুনেছো নিচে সে দাঁড়িয়ে আছে। খুব ভয় পেয়েছিলে, আবার খবর টবর নিতে এলো না তো! কোথায় আমি, কী করছি! তুমি শরাফ মামাকে বাড়িতে ঢুকতে দাওনি। আমার কোনও খবরইতুমি দাওনি তাকে। তুমি তো তোমার ভাইদের চেয়েও বেশি ভালোবাসতে আমাকে মা। আমি সব ভুলে গিয়েছিলাম, সব। তোমাকে কাঁদিয়েছি, দিনেরপর দিন তোমাকে কাঁদিয়েছি। তারপরও তুমি চোখ মুছে বলেছে, দেশে চল মা। কী করে পেরেছো আমাকে ক্ষমা করতে মা? কী করে আবার বুকে টেনে নিতে পেরেছো আমাকে মা। এত কষ্ট দিয়েছি, তারপরও বলো তুমি নাকি জীবনের সবচেয়ে সুখের সময় কাটিয়েছো আমার কাছে। আমি নাকি তোমাকে খুব ভালোবাসা দিয়েছি। তুমি না পেতে না পেতে এতই অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলে যে সামান্য ওই পাওয়াই তোমার স্বর্গসুখের মতো মনে, হয়। তোমাকে যে সুন্দর বলেছিলাম, তোমাকে যে দুটো গরম জামা জুতো কিনে দিয়েছিলাম সুইডেনের ভয়াবহ শীতকালটা কাটাতে, তোমার যে সামান্য কটা ছবি তুলেছিলাম, তাই বোধহয় বলেছে। তা না হলে আর কী! তোমাকে চিকিৎসা না করানো, ভালো ডাক্তার না দেখানো, তোমাকে কাঁদানো, তোমাকে যাচ্ছেতাই ভাষায় অপমান করা, কষ্ট দেওয়া সব ভুলে তুমি ওইটুকুই কেবল মনে রেখেছে। ওইটুকু সুখের স্মৃতি নিয়ে তুমি ফিরে গেছে। তুমি কিন্তু তোমার গরম জামা জুতো টুপি মোজা যা দিয়েছিলাম, কিছুই নিয়ে যাওনি, সব রেখে গেছে। শুধু তাই নয়, তোমার নিজের সালোয়ার কামিজ, তোমার নিজের নতুন সব জামা কাপড় সব রেখে গেছো আমার জন্য। আমি যেনপরি, যদি কোনওদিনপরতে ইচ্ছে হয়। আমাকে দেশে ফেরত নেওয়ার যে সংকল্প ছিল তোমার, স্বপ্ন ছিল সব কিছুকেপুড়িয়ে ছাই করে কবর দিয়ে দিয়েছি, নিজের চোখে দেখে গেছে। আরবদেশে উমরাহ করতে গিয়ে আমার জন্য হাতের চুড়ি আর আল্লাহু লেখা লকেট সহ সোনার চেইন কিনেছিলে, সবপরিয়ে গেছে আমাকে। ছোটদা বলেছিল আমার পাঠানো টাকা জমিয়ে নাকি তুমি ওই গয়না কিনেছো। আমার ফিক্সড ডিপোজিট থেকে যে ইন্টারেস্ট চলে যেত ইয়াসমিনের ব্যাংকে, ও আমেরিকা চলে যাওয়ার আগে ওই টাকাটা তোমার নামে একটা অ্যাকাউন্ট খুলে ওখানে সরাসরি যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। তিন মাসে ছ হাজার টাকা। ও কোনও টাকা হলো! তোমার হাত খরচের টাকা। আর ও টাকাই তুমি জমিয়ে আমার জন্য সোনার গয়না কিনলে। একটি টাকাও তুমি নিজের জন্য খরচ করোনি মা। সুইডেনের বাড়িতেও অনেকটা দাসীর মতো কাজ করতে। যাওয়ার আগে আমার আলমারি গুছিয়ে দিলে নিজের হাতে। কে জানতো যে তোমার যা কিছু ছিল, যা কিছু এনেছিলে সব রেখে যাচ্ছো তুমি। তুমি জিনিসপত্রের জন্য এসেছে, জিনিসপত্র কেনা হয়ে গেছে, এখন চলে যেতে চাইছো এসব বলে কম কাঁদিয়েছি তোমাকে। যেদিন বলেছি, সেদিন গিয়ে আকুল হয়ে কেঁদেছে। আমি ওপরতলা থেকে তোমার কান্নার শব্দ পাচ্ছিলাম। কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলে জিনিসপত্রের জন্য তুমি আসোনি। তুমি শুধু ফোনে ছোটদাকে জিজ্ঞেস করেছিলে কবে ছোটদা আসবে, কবে তোমাকে দেশে ফেরত নিয়ে যাবে। আর ওই শুনে আমার মাথায় রক্ত চড়লো। তখনই তোমাকে ওসব বলেছিলাম। লোভী ভেবেছিলাম তোমাকে। লোভী বলেওছিলাম তোমাকে। তোমার মতো মানুষকে। জগতের সবচেয়ে নির্লোভ, সবচেয়ে নিঃস্বার্থ মানুষকে নির্দ্বিধায় দোষী করেছিলাম। কী ভীষণ কষ্ট তুমি পেয়েছিলে মনে, আমি এখন অনুমান করার চেষ্টা করি। তোমার জায়গায় আমি হলে আমার মতো পাষণ্ড মেয়ের বুদবুদেঅহংকারে, কুৎসিত আত্মাভিমানে কষে লাথি মেরে চলে যেতাম। ও মেয়ের মুখ কোনওদিন দেখার প্রয়োজন আমি বোধ করতাম না। ছোটদাকে জিজ্ঞেস করেছিলে কবে ছোটদা তোমাকে নিতে আসবে, কারণ অসুখ নিয়ে খুব আশংকা হচ্ছিল তোমার। এখন আমি বুঝি, অসুখটা যে ভয়ংকর কোনও অসুখ তা তুমি ঠিক ঠিক বুঝতে পেরেছিলে। অসুখটা যে আমার বা আমার বাবার বা আমার দাদার ভাষায় কিছুই না, তা নয়। কিছুই।

কেন তুমি বলেছিলে তোমাকে খুব ভালোবেসেছি আমি? জীবনে সবচেয়ে সুখের সময় বুঝি ওই সময়? রোজা রাখতে চেয়েছিলে, জীবনের নাকি ও তোমার শেষ রোজা। আমি বলেছিলাম শেষ রাতে খাওয়ার কোনও নিয়ম ও বাড়িতে নেই, সুতরাং সেহরি খাওয়া চলবে না। শুনে বলেছিলে সন্ধেবেলায় তোমার ঘরে থালায় করে খাবার নিয়ে রাখবে, কাউকে জাগতে হবে না, আমার ঘুমের কোনও ব্যাঘাত ঘটবে না। না। তাতেও আমি রাজি হইনি। রোজা তোমাকে রাখতেই দেব না। যে দেশে শীতের সময় বড়জোর দুঘণ্টা আলো থাকে, তাও আবছা আলো, সেখানে রোজা তো দুঘন্টার চেয়ে বেশি হতে পারে না। সূর্যোদয় হয় বেলা এগারোটায়, দুপুর একটায় সূর্যাস্ত। তোমাকে বলেছিলাম, ভালো যে শীতকালে রোজা পড়েছে, বুঝতে গরমকালের রোজার মজা। সূর্যের কোনও অস্ত যাওয়া নেই। তোমাকে এও বলেছি তোমার ওই রোজার নিয়ম কানুন যারা তৈরি করেছিলো আরব দেশে, তাদের পৃথিবী সম্পর্কে কোনও ধারণাই ছিল না। পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধে যে সূর্যাস্ত আর সূর্যোদয়ের অবস্থা ভিন্ন, সে সম্পর্কে জ্ঞান থাকলে নিয়ম অন্যরকম হতো। অজ্ঞতার এর চেয়ে বড় উদাহরণ আর কী আছে! তোমাকে হঠাৎ আমি ধর্ম থেকে মুক্ত করতে চাইছিলাম। অজ্ঞ আর অশিক্ষিতদের কবল থেকে উদ্ধার করতে চাইছিলাম। অপমান করে, ভ্রূকুটি করে, গা-জ্বালা কথা বলে চাইছিলাম তোমাকে নাস্তিক বানাতে। তোমার আল্লাহতায়ালা যদি মহান কেউ হন, যদি দয়ালু কেউ হন, তাহলে যারা তার পায়ে মাথা নোয়াইনি, তার জপ করিনি, তাদেরপুঁজ রক্ত খাইয়ে, গায়ে গরম পানি ঢেলে, আগুনে পোড়াবেন কেন? এ কি ক্ষমাশীল হওয়ার, উদার হওয়ার, মহান হওয়ার নমুনা? তুমি চুপ করে থাকতে। জানি না তোমার মনে কোনও সংশয় জাগতো কি না। আল্লাহকে যে এত জপছো, এই আল্লাহ তোমাকে বেহেস্তে নেবেন ঠিকই, কিন্তু বেহেস্তে বাবাকেই পাবে তুমি সঙ্গী হিসেবে, যে বাবা তোমাকে সারাজীবন লাঞ্ছিত করেছে, আর বাবা পাবে সাতাত্তর জন হুরী সুন্দরী। ওদের নিয়ে বাবা ফুর্তি করবে তোমার চোখের সামনে, সব সইতে হবে তোমাকে। ইহকালেও ভুগলে, পরকালেও ভুগতে হবে। এ কেমন বিচার বলো? বাবা যেহেতু সারাজীবন ধর্ম পালন করেনি, বাবাকে যদি দোযখে পাঠানো হয়, তাহলে তো তোমাকে একাই থাকতে হবে অনন্তকাল। হেসে হেসে বলতাম, বেহেস্তে তো তোমাকে সব কুৎসিত কুচক্রী মোল্লাদের সঙ্গে কাটাতে হবে। আর, আমি, দোযখে তোমার সব প্রিয় প্রিয় নায়ক নায়িকাঁদের সঙ্গে থাকবো, তোমার উত্তম সুচিত্রা, তোমার পাহাড়ি সান্যাল, তোমার ছবি বিশ্বাস। ওরা হিন্দু বলে ওদের তো সবাইকে ধরে ধরে দোযখে পাঠানো হবে। বড় বড় বিজ্ঞানী, বড় বড় দার্শনিক যারা কোনওদিন ধর্মবিশ্বাস করেনি, তাদের সঙ্গে দোযখে কাটাবো, আমার আর চিন্তা কী! ্যাঁ উত্তম সুচিত্রার জন্য তো পাগল ছিলে। পালিয়ে পালিয়ে গিয়ে সিনেমা দেখতে। সেই তুমি কি না সিনেমা ছেড়ে সব ছেড়ে ধর্মে মন দিলে। দোযখের ভয় এমনই ধরানো হয়েছিল, যে, ভয়ে সিঁটিয়ে থাকতে, ধর্ম কর্ম বাধ্য হয়ে করতে। অভাগিনীর কী আছে আর, ধর্ম ছাড়া! কিন্তু বুদ্ধি খাটালে তো অসারতা টের পেতে মা। পেতে না?

আমি তোমাকে শ্রদ্ধা করিনি, করলে তোমার রোজা নিয়ে অত ঠাট্টা মশকরা করতাম না। বিয়ে হয়েছে বলে ইস্কুলে পড়তে দেয়নি তোমার বাবা, অথচ কত পড়তে চেয়েছো, এমনকী তোমার ছেলেমেয়েরা যখন মাধ্যমিক দিচ্ছে, ওদের সঙ্গে তুমিও প্রাইভেটে মাধ্যমিক পরীক্ষা চেয়েছে দিতে, এমনকী তোমার নাতিও যখন দিচ্ছে, চেয়েছে; সেই তোমাকে অশিক্ষিত বলে গালি দিয়েছি। অসুখ নিয়ে মেয়েকে শেষ দেখা দেখতে এসেছে সুইডেনে, ওখানেও লোকের সামনে তোমাকে তুচ্ছ করেছি। কী করে ভাবো তোমাকে ভালোবেসেছিলাম! জীবনে ভালো খাবার তোমার পাতে পড়েনি। ভালো খাবার তোমাকে খেতে দিইনি আমি। তোমার ডায়বেটিস, সুতরাং তোমাকেসব অখাদ্য খেতে উপদেশ দিতাম। লিককিনেছি, ব্রকলি কিনেছি। ডায়বেটিসের জন্য ভালো। এ দুটো তুমি জোর করে গিলতে। ব্রকলিকে চুলের মতো লাগতো, লিক খেতে ঘাসের মতো লাগতো। কিন্তু ওসব অখাদ্যই তোমাকে খেতে হয়েছে। মাঝে মাঝে মুরগি রান্না হয়েছে। অবশ্য তোমার পাতে রান তুলে দিয়েছি, দেখে তুমি অপ্রস্তুত হয়েছে মা। তুমি তো কোনওদিন বাড়িতে মুরগি রান্না হলে রান পাওনি খেতে। সব অন্যদের খাইয়েছো। রান খাবে মা? এ হয় নাকি। তোমার জন্য তো ছিল গলার হাড়, বুকের হাড়। এ ছাড়া কোনওদিন কি খেয়েছো ভালো কিছু? ওই রান খেতে দিয়েছিলাম বলেই হয়তো তুমি বলেছো ভালোবাসা পেয়েছো আমার। না মা, মুরগি হল বিদেশে সবচেয়ে সস্তার জিনিস। ওর চেয়ে সস্তায় আর কোনও খাবার মেলে না। বিশেষ করে ফ্রোজেন চিকেন। তোমাকে তো আর ফ্রেশ কিছু খাওয়াইনি। ফ্রেশ যে কেনা যায়, তাজা টাটকা কিছু যে কেনা যায়, কিনে যে বেশ সুস্বাদুকরে রান্না করা যায়, এ আমার ধারণাতেই ছিল না। যার বাড়িতে থাকতাম, সে সস্তার জিনিস কেনার জন্য চাপ দিত আমাকে। ওর নিজের যেমন কোনওদিন অভ্যেস ছিল না ভালো জিনিস কেনার, সস্তাপচা জিনিসে অভ্যস্ত ছিল, আমাকেও অভ্যস্ত করিয়েছিল। তুমি টমোটো ভালোবাসতে। অনেক রকম টমেটো ছিল বাজারে। খুব ভালো, মাঝারি ভালো, সাধারণ ভালো, আর প্রায় নষ্ট। আমি খুব ভালোগুলো বা মাঝারি ভালোগুলো কিনতে চাইলে সুয়েনসন তেড়ে আসতো, বলতো করছো কী, যেটার দাম কম, সেটা কেনো, তার মানে ওই প্রায় নষ্টগুলো, বাজে জাতেরগুলো কেনো। ওর ধারণা ছিল, ও কম পয়সায় জিনিস কিনে বুদ্ধিমানের কাজ করে। যারা দামি জিনিস কেনে, তারা বোকা। দোকানিরা তোক ঠকাতে চায়, আর সে কম দামি জিনিস কিনে দোকানিদের ঠকিয়ে আসে। এই বিশ্বাস নিয়েই সে বাঁচে। কিন্তু আমি তো পারতাম বলতে যে আমার মা এসেছে, তোমার ওই সস্তা নীতি আজ থেকে আমি মানবো না। আমি তো বলিনি! আমি তো তোমার জন্য কোনও অভ্যেসের প্রতিবাদ করিনি। বাজার তো সুয়েনসনের টাকায় হত না, বাজার আমার টাকায় হতো। আমার কি টাকার অভাব ছিল মা? ছিল না। আমি সুইডেনের কুর্ট টুখোলস্কি সাহিত্যপুরস্কার পেয়েছি, ইওরোপিয়ান পার্লামেন্ট থেকে শাখারভ পুরস্কার পেয়েছি, নান্তের এডিট দ্য নান্তপুরস্কার, ফরাসি সরকার থেকে পাওয়া মানবাধিকার পুরস্কার, এক একটা পুরস্কারের টাকা বাংলাদেশের টাকায় তিরিশ চল্লিশ লাখ। তারপর বইয়ের রয়্যালটির টাকা। ইওরোপের বিভিন্ন ভাষায় বই বের করার আগে প্রকাশকরা অগ্রিম রয়্যালটি দিয়েছে, সেও অনেক। প্রায় দু কোটি টাকা পড়ে আছে ব্যাংকে। কিন্তু টাকা আমি সবার জন্য খরচ করতে চাইলেও তোমার জন্য চাইনি। মুরগির রান পাতে পেয়ে তোমার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠতো। তুমি লজ্জা পেতে খেতে। আমার থালায় তুলে দিতে। কিন্তু রানের তো অভাব ছিল না। বাড়িতে খাবার লোক মোটে তিনজন। তোমার তো আর ছেলেমেয়ে ছিল না ও বাড়িতে যাদের জন্য রেখে দেবে। তুমি রান খেয়ে যে খুশি হতে তা নয়, তোমাকে আমি ভালোবাসি এ কথা ভেবে খুশি হতে। আমি যে তোমাকে সারাজীবন যা খেয়ে এসেছে সেই বুকের হাড় বা গলার হাড় দিইনি, বরং আমরা যা খেতাম, সেই রান খেতে দিয়েছি, সে কারণেই হয়তো তোমার মনে হতো তোমাকে ভালোবাসি। সে আর কতদিনই বা খেতে পেরেছো! একসময় তো মাছ মাংস বন্ধ করে শুধু তোমাকে সেদ্ধ শাক সবজি খাওয়ার অর্ডার দিলাম। খুব মাখন ভালোবাসতে, ও পদার্থ তোমাকে স্পর্শ করতে দিইনি। পনির খুবপছন্দ করতে। বাজারে একশ রকম পনির তুমি মুগ্ধ হয়ে দেখতে। আমি ধমকে তোমাকে পনিরের জায়গা থেকে সরিয়ে এনেছি। বলেছি এসব খাওয়া চলবে না তোমার, ডায়বেটিস বাড়বে। পনির একবার কিনেছিলাম অবশ্য, সেও বাজারের সবচেয়ে কম দামি, মোটেও খেতে ভালো নয়, এমন পনির। তুমি তো আর জানোনা, ভালো কী মন্দ, কিনেছি যে পনির, সে কারণেও হয়তো তোমার মনে হয়েছিল তোমাকে ভালোবাসি।

.

এত কম খেতে, বিস্বাদ বিদঘুঁটে জিনিস খেতে, এত কৃচ্ছসাধন, অথচ তোমার রক্ত থেকে চিনি কমতো না। আমি বিরক্ত হতাম। আমার এই বিরক্তি তোমাকে অস্বস্তিতে ফেলতো। তোমার জন্য তোমার মেয়ের দুর্ভাবনা হচ্ছে, মেয়ে তোমার সুগার নিয়ে দুশ্চিন্তা করছে, এ তোমার ভালো লাগতো না। তুমি না খেয়ে না খেয়ে চাইতে সুগার কমাতে, তোমাকে সুস্থতা দিতে নয়, আমাকে স্বস্তি দিতে। তুমি তোমার জন্য নয়, আমার জন্য ভাবতে। কারণ ডায়বেটিস নিয়ে তোমার দুশ্চিন্তা ছিল না, বিরক্তি ছিল হয়তো, কিন্তু আমাকে যেন বিরক্ত হতে না হয়, আমি যেন আমোদে প্রমোদে উৎকণ্ঠাহীন জীবন কাটাই, তা নিয়েই ভাবতে। তুমি তো জানো তোমার অন্য একটা বড় অসুখ আছে। আমি তো সে বড় অসুখের কথা একবারও ভাবিনি, ভেবেছি ডায়বেটিস নিয়ে। আমিই তো শুধু ভোগাইনি। বাজে বাজে ডাক্তারেরা তোমাকে কী ভীষণ ভুগিয়েছে মা। কী ভীষণ ভুগিয়েছে। ওইসব ডাক্তার, যেহেতু তাদের রং সাদা, যেহেতু তারা ধনী দেশের ডাক্তার, তোমাকে বলেছি, এরা বিদেশি ডাক্তার, অনেক বড়, অনেক ভালো, আমাদের গরিব দেশের ডাক্তাররা তো কিছুই জানে না, ডাক্তারিশাস্ত্র এদেরই আবিষ্কার, এরাই জানে সব, এরাই বোঝে সব, এদের চিকিৎসা পেলে তোমার সব অসুখ সেরে যাবে। আমার ভেতরে তখনও ওই হীনম্মন্য বোধটা ছিল। ভাবতাম সাদাদের জ্ঞান বেশি, বুদ্ধি বেশি। সাদারা আমাদের চেয়ে, কালো-বাদামি মানুষের চেয়ে অনেক বেশি বোঝে, সব কিছুতেই আমাদের চেয়ে পারদর্শী বেশি। দেখ না, দেশগুলো কী রকম বানিয়েছে! দেখলেই তা মনে হতো, স্বর্গ বানিয়ে রেখেছে, স্বর্গ। সুতরাং, আমাদের চেয়ে ওরা উন্নতমানের মানুষ। বুঝলে মা, সত্যিকার হীনম্মন্যতা। নিশ্চিতই একটা বর্ণবাদী ছিলাম, সুয়েনসনও বর্ণবাদী। দুজনেই ভাবতাম সাদারা কালোদের চেয়ে সবকিছুতে ভালো। এক বর্ণবাদী আরেক বর্ণবাদীকে তো বর্ণবাদী হিসেবে চিনতে পারে না। সাদাদের বড় মনে করতাম, না হলে সুয়েনসনের মতো লোকের সঙ্গে আমি কেন থাকি? কী যোগ্যতা ছিল তার আমার সঙ্গ পাওয়ার? যন্ত্রের মতো একটা মাথামোটা লোক, অনুভূতি বলতে লেশমাত্র কিছু নেই। একে হিংসুক, তার ওপর স্বার্থপর। তাকে কোনও উপহার দিলে রাগ করতো, ভাবতে বিনিময়ে বুঝি আমাকে কিছু দিতে হবে তার। কিছু নিতে চাইতো না, দিতে হবে এই ভয়ে। আমার তো আবার দেওয়ার অভ্যেস। দিয়ে দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছি, আমাকে না দিলেও চলবে। আমি ও দেশের ভাষা জানি না, কিচ্ছু না। বড় একজন ডাক্তারের দেখা কী করে পেতে হয়, আমি তার কিছু জানি না। আমাকে কোনও পথ সে দেখায়নি। জানে সে পথের কথা, তারপরও মুখ বুজে থেকেছে। একটা কাজই সে আমার জন্য করতে পারতো, গাড়ি চালিয়ে এখানে ওখানে নিয়ে যেতেপারতো। গাড়ি সে আমাকে ভালোবেসে বা আমার কোনও উপকার হবে বলে চালাতো না। চালাতে তার ভালো লাগতো বলে চালাতো। কত যে গ্রামের অলি গলিতে অনর্থক ঘুরেছে। ভেবেছি আমাদের নিয়ে সে বেড়াচ্ছে। আসলে সে একা একাই ওসব করে। বন্ধু বান্ধব কিছু নেই। হয় বই নিয়ে পড়ে থাকে, যতসব ক্রাইম স্টোরি আর ফ্যান্টাসি, নয় অনর্থক অলিগলিতে গাড়ি চালায়। আমি দুবছরেও যা বুঝিনি, তুমি দুদিনেই তা বুঝেছিলে। আমাকে বলতে দেশে যেন ফিরে যাই। তুমি কোনওদিন ভাবোনি সুয়েনসন আমাকে ভালোবাসে, বা তার বাড়িতে থাকার আমার কোনও প্রয়োজন আছে। আমার এক বন্ধু মাইকেলকেই বরং তোমার আপন মনে হয়েছিল। ওকে জড়িয়ে ধরে চলে যাবার আগের দিন কেঁদেছিলে, বলেছিলে, আমার মেয়েটাকে দেখে রেখো। তুমি কিন্তু ইংরেজিতেই বলেছিলে। সুইডেনে মাত্র কদিন থেকেই ইংরেজি শিখে গিয়েছিলে। ইস্কুলের গণ্ডি তোমার পেরোনো হয়নি বলে তোমাকে আমি কম তুচ্ছ করেছি! প্রয়োজনে ইংরেজি কেন, সুইডেনে আর কিছুদিন থেকে গেলে তুমি সুইডিশও বলতে পারতে, ফরাসি দেশে থাকলে দুদিনে ফরাসিও হয়তো বলতে পারতে। আমার মতো নির্বোধ তুমি তো নও। কেবল বাবার সংসারে থেকে তোমার প্রতিভার কোনও স্ফুরণ হয়নি। তুমি সমাজেরপুরুষতন্ত্রের নির্মম শিকার ছাড়া আর কী! কেউ তো তোমাকে গভীরভাবে দেখেনি, তোমাকে বুঝতে চেষ্টা করেনি। তোমার জ্ঞান বুদ্ধি, বিচক্ষণতার মূল্য কোনওদিন পাওনি। ধর্মে আশ্রয় নিয়েছিলে অভিমান করেই। এই জগতের প্রতি অভিমান। ধর্ম কি ভেতরে ভেতরে জানতে না তুমি যে কী রকম যুক্তিহীন! তুমি ভালোবাসতে জানতে, আবেগ ছিল প্রচণ্ড, তাই বলে একেবারে যুক্তিবুদ্ধিহীন ছিলে না তো! বর্ণবাদের লেশমাত্র তোমার ভেতরে ছিল না। ডাক্তারদের রং সাদা বলে, ধনী দেশের লোক বলে তাদের তুমি আমাদের গরিব দেশের কালো বা বাদামির চেয়ে বেশি বুদ্ধিমান বলে একবারও মনে করোনি। আবার কোনও সাদাকেও তুমি ছোট ভাবোনি। রাস্তায় একদিন একটা সাদা বাচ্চা-ছেলেকে দৌড়োতে গিয়ে পড়ে যেতে দেখে ছুটে গিয়ে আহারে ব্যথা পেয়েছে বলে উঠিয়ে দাঁড় করিয়ে হাঁটুর ধুলো মুছতে শুরু করে দিলে। আমি তোমাকে টেনে সরিয়েছি ওই মহৎ কাজ থেকে। প্যারামবুলেটরে কোনও বাচ্চাকে দেখলেও, সাদা কী কালো কী বাদামি, বাবুসোনা গো’ বলে আদর করতে চাইতে। তোমাকে বলেছি, অচেনা লোকের আদর এদেশের মানুষ গ্রহণ করে না। তোমার সরল মন বুঝে পেত না ভালোবাসার জন্য চেনা অচেনার প্রয়োজন কেন হয় বা হবে। তোমার ভেতরে এক বাচ্চা মেয়ে ছিল। এক শীতের বিকেলে বাচ্চাদের খেলার মাঠের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। তুমি দিব্যি ওখানে দোলনায় চড়ে দুলে দুলে গান গাইতে লাগলে, তোমার শৈশবের গান। শৈশবে শোনা কিছু গান তুমি মনে রেখেছো বটে। তোমার তো কোনও শৈশব ছিল না। যখন দোলনায় দুলে, ছুটে বেড়িয়ে, খেলাধুলা করে শৈশব কাটাবে, তখনই তোমাকে বিয়ে দিয়ে বয়স্ক করে দেওয়া হল, কোলে বাচ্চা দিয়ে মা করে দেওয়া হল। সংসার সন্তানের দুরূহ দায়িত্ব ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হল। দেশের কোনও দোলনায় তুমি চড়তে পারতে না, সে প্রশ্নই উঠতো না। অবকাশের মাঠে যখন বাবা আমাদের জন্য দোলনা বসিয়ে দিয়েছিল, তোমার নিশ্চয়ই ইচ্ছে করতো চড়তে! কোনওদিন তোমার ইচ্ছের কথা কাউকে বলোনি। তোমার কন্যাদের জন্য দোলনা, সেই দোলনায় তোমাকে চড়লে লোকে তোমাকে আস্ত পাগল বলবে! গভীর রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে তারপর যে দোলনায় চড়ে না পাওয়া শৈশবকে একটুখানি পাবে, তারও উপায় ছিল না। বাবা হা হা করে তেড়ে আসবে এই আশংকা ছিল তোমার। শুধু বাবা কেন, তেড়ে তো নিশ্চয়ই আমরাও আসতাম। পাগল ভেবে হয়তো তোমাকে শেকলে বেঁধে রাখার ব্যবস্থা হত। আহা, তোমাকে যদি টেনে এনে একদিন বলতাম, মা তুমিও দোলনা চড়ো। ইচ্ছেগুলোকে কী দীর্ঘ দীর্ঘকাল তুমি শাসন করেছো মা। স্বাধীনতার স্বাদ কখনও তুমি পাওনি। যদি ক্ষমতা থাকতো, তোমাকে তোমার শৈশব ফিরিয়ে দিতাম আমি। যে শৈশবে তুমি শিশু যেভাবে বেড়ে ওঠে, উঠতে, তোমার কৈশোরকে তুমি যাপন করতে, যৌবনকে উপভোগ করতে। কী দোষ করেছিলে যে জীবনের শুরুতেই এক গাদা বার্ধক্যের বোঝা ফেলে তোমাকে পিষে ফেলা হল!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *