হেঁটে যাই জনমভর – ৯

 ঘরে ঢুকে কিছুক্ষণ বসে থাকে বৈঠকখানায়। কতক্ষণ পরে কে জানে উঠে রান্নাঘরে আসে। জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢালে। গ্লাস নিয়ে ডাইনিং টেবিলে এসে বসে। পানিতে চুমুক দেয়া হয় না। টেবিলে মাথা ঠেকালে মর্গে শুয়ে থাকা মঈন যেন চোখ খোলে। আবার ছটফটিয়ে চেয়ার ছেড়ে দাঁড়ালে মনে হয়, ওতো এই পাশেই আছে। বলছে, সিনেমা ভাঙলে দেরি করব না স্যার। তাড়াতাড়ি চলে আসব।

 আসবি বলে চলে গেলি, কিন্তু আসছিস না কেন? তোর জন্য আমি কতরাত জেগে থাকব মঈন?

 ও ডাইনিং টেবিলের লাইট বন্ধ দকরে না। ড্রইংরুমের, রান্নাঘরেরও না। সব ঘরের লাইট জ্বালিয়ে রেখে ও শোবার ঘরে আসে। বিছানায় বসার সঙ্গে সঙ্গে শুয়ে পড়ে। মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা। ঝিমুনিতে আচ্ছন্ন হয়ে যায় একসময়।

 মধ্যরাতে স্বপ্নের ঘোরে জেগে ওঠে মশিরুল। মাথা ঝিমঝিম নিয়ে উঠে বসে। পা ফেলে মেঝেতে। ভীষণ পিপাসা পেয়েছে। রান্নাঘরে ঢুকে গ্লাস নিয়ে ফ্রিজ খুলে পানির বোতল বের করে। এই মধ্যরাতে ওর শরীর পানি চাচ্ছে।

 যেন এই বাড়ি এই মুহূর্তে পূর্ববঙ্গ। এখানে সহস্র নদীর ভাঙাগড়া চলছে। ও একা দাঁড়িয়ে এই ইতিহাসের সাক্ষী হয়েছে। ওর বাবা বলছে, বাংলাদেশ ও বাঙালির সমভূমিতে নদীর প্রবাহ পথ বারবার বদলেছে। প্রাচীনকালে যেমন হয়েছিল, বর্তমানেও এই ভাঙাগড়া আছে। ছেলেটির মৃত্যু মানেই তো এই বাড়ির ঘরগুলোতে ভাঙনের চিহ্ন। যে জীবনপ্রবাহ নিয়ে এই বাড়িতে ও বসবাস করত তার বাঁক বদল হয়নি। ওর জীবনপ্রবাহ রুদ্ধ হয়ে গেছে। বাবা বলতেন, ইতিহাসে কোশী একটি বিস্ময়কর নদী। বাঁক বদল করেছে অসংখ্যবার। বাঁক বদল করতে করতে পূর্ব থেকে পশ্চিমে সরে গেছে। পরিত্যক্ত করেছে ইতিহাসের বিখ্যাত জায়গা। যেগুলোর নাম-নিশানা এক সময় মুছে গেছে।

 এই মুহূর্তে মঈনের মৃত্যু কি সেই কোশী নদী, যে মৃত্যুকে স্বীকার করতে চায় না একজন পুরুষ? ওর মা এবং বোনের কাছ থেকে আড়াল করে রাখার জন্য মৃত্যুর মহিমা নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার মধ্যে ডুবে যায়? যে মৃত্যু অজ্ঞাতনামা চেতনায় বিলুপ্ত করে মানুষের পরিচয়? মঈনের কবর হয়েছে। কিন্তু মশিরুলের কাছে ও পরিণত হয়েছে নদীর বাঁক বদলের ফলে পরিণত হওয়া নিচু জলাভূমিতে। যে জলাভূমি থেকে মানুষের বসতি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। ও ঢকঢক করে কয়েক গ্লাস পানি খায়। ভেতরে শুকিয়ে থাকা বুকে জোয়ারের জল প্রবেশ করে। ও বাথরুমে যায়। লাইট অফ করে। বিছানায় গেলে ওর ঘুম আসে। নিবিড় ঘুম। ওর স্বপ্নে জেগে ওঠে মঈন। দু’জনে হাত ধরে হেঁটে যাচ্ছে মেঘনা নদীর পাড় দিয়ে। ওরা এখন ভোলার মনপুরায়।

 পরদিন ঘুম ভাঙলো অনেক বেলায়।

 দিনের আলোয় ভরে আছে ঘর। আলো দেখে আন্দাজ করতে পারে যে সূর্য মধ্যগগনে।

 ও বিছানায় উঠে বসে। পা গুটিয়ে রাখে। মনে হয় নামার তাড়া নেই। মনে হয় পা নামালে সেটি একটি নিচু ভূমির জলকাদায় ডুবে যাবে। পরক্ষণে মনে হয় আসলে তা নয়। মনে হচ্ছে ও কোনো কিছু মনে করতে পারছে না। কত কিছু যেন হারিয়ে ফেলেছে! বই-খাতা-পেন্সিল-ব্যাগ সব। মা ওকে খুব বকছে। বলছে, এমন দুষ্টুমি করলে পিটিয়ে ভর্তা বানাব।

 ও চারদিকে তাকায়। ঘরের সবকিছুই তো ঠিক আছে। আলমারি, ড্রেসিং টেবিল, আলনা, দেয়ালে টাঙানো ছবি কোনো কিছুই হারায়নি। তাহলে হারালো কী? ও চিৎকার করে বলে, হারিয়েছে জীবন।

 না, জীবন হারায় না। দেখো আমাকে। আমি জীবনের পক্ষের মানুষ। জীবনকে হারাতে দিতে পারি না। শহীদ হয়েছি সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য। সম্মান বেঁচে থাকার জয়গান।

 মশিরুল দেখতে পায় ঘরের চারদিকে কাঁচের দেয়াল। দাঁড়িয়ে আছে লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন। ও বিপুল বিস্ময়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। কৈশোরের সেই মানুষ, যাকে ও প্রতিদিন দেখেছে, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামী হিসেবে গ্রেফতার হওয়ার আগে পর্যন্ত। কথাও হতো তার সঙ্গে। মাঝে মাঝে ওর মাথায় হাত রেখে বলতো, তুই খুব লক্ষ্মী ছেলে রে মশু।

 চাচা, আপনি শুধু আমাকে মশু নামে ডাকেন।

 তোর পছন্দ হয় না নামটা।

 খুব পছন্দ হয়। খুব ভালোলাগে। আমি মাকে বলি, চাচা আমাকে খুব ভালোবাসে।

 মাঝে মাঝে বিদেশ গেলে ওর জন্য চকলেট আনতেন। কি যে মজা ছিল সেইসব চকলেট খাওয়ার দিন। কোনো কোনো সময় জীবনের জন্য অন্যরকম সময়। ওর কৈশোর একটি আশ্চর্য সময়, যে সময়ে স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ হয়েছিল, শহীদ হয়েছিলেন স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা। ২৬ মার্চের সেই মৃত্যু দেখার পরে বাবা ওদেরকে নিয়ে গ্রামে চলে গিয়েছিল। মুক্তিবাহিনীর ছেলেদের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছিল। কৈশোরের দিনগুলো এখনো ওর বুকের ভেতর শিহরণ তোলো। ভাবে, এমন আশ্চর্য সময় আর দেখা হবে না।

দেখো আমাকে।

 কাঁচের দেয়ালে ভেসে ওঠে তাঁর ছবি। তিনি কুর্মিটোলার স্পেশাল ট্রাইবুনালে দাঁড়িয়ে আছেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিচার কাজ চলছে। মশিরুল বড় হয়ে জেনেছিল ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য’ মামলাটি ছিল ঐতিহাসিক মামলা। সেদিন তাকে বন্দী করে রাখা হয়েছিল কুর্মিটোলা সেনানিবাসে তৃতীয় পাঞ্জাব মেসে। এই মেস থেকে একটি বড় গাড়িতে করে তাদের নিয়ে যাওয়া হতো স্পেশাল ট্রাইবুনালে। তিনি দাঁড়িয়ে আছেন মাথা উঁচু করে।

 মশিরুল তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকে। দেয়ালজুড়ে ভেসে ওঠা ট্রাইবুনাল ওর বাবা দেখেনি। সে সময়ে ওখানে যাওয়ার সুযোগ ছিল না। ও ভাবে, এই দেয়ালচিত্র ইতিহাসের সময়কে ধরে রেখেছে। এভাবে ওর সামনে হাজির হয় নিখোঁজ হয়ে যাওয়া মানুষেরা।

 তখন ওর চারদিক তোলপাড় করে। আসলে দরজায় কেউ এসেছে। সে কড়া নাড়ছে। ও উঠে গিয়ে দরজা খোলে। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে একজন অপরিচিত ছেলে।

 আপনি মশিরুল হক?

 হ্যাঁ। আপনি?

 আমাকে চিনবেন না। আমি মনপুরা থেকে এসেছি। আমার নাম মঈনুল। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। আমাদের বাড়িতে রান্নার কাজ করেন হাফিজা খাতুন। তিনি আপনাকে এই চিঠিটা দিয়েছেন।

 ছেলেটি ওকে চিঠি দেয়। বলে, আমার টেলিফোন নাম্বারটি আপনি সেভ করে রাখেন। মঈন নামে সেভ করেন।

 মঈন! মশিরুল চোখ বড় করে তাকায়।

 ওই আর কি, মঈনুল থেকে মঈন। ছোট করে নামটা বললাম। হাফিজা খাতুনের বিষয়ে কিছু জানতে চাইলে আমাকে ফোন করবেন। তিনি আমাকে বলে দিয়েছেন আপনার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে। আমার কোনো প্রয়োজনেও আমি আপনার কাছে সাহায্য চাইতে পারি।

 ও হ্যাঁ, অবশ্যই। আপনার কোনো দরকার হলে আপনি আমার এখানে চলে আসবেন। আমি সাধ্যমতো চেষ্টা করব আপনাকে সাহায্য করার জন্য।

 আচ্ছা যাই। ছেলেটি হাসিমুখে বিদায় নেয়।

 মশিরুল কাগজের কোণায় লিখে রাখা সেল নাম্বার নিজের মোবাইলে মঈন নামে সেভ করার সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে বলে, তুই এভাবে আমার কাছে ফিরে এলি হারামজাদা! তোর আত্মা পাব আমি, তোর শরীর না।

 সারা দিন ওর আচ্ছন্নের মতো কাটে। হাফিজা খাতুন লিখেছে, দাদাভাই, আপনে কখন মনপুরা আসবেন? মোর পোলাডা সারাক্ষণ আপনের কথা জিগায়। মুইও আপনেরে দেখতে চাই। আপনের লাগি মোর মন পোড়ে। মুই অহন মঈনগো বাড়ির কামের বেডি। আপনে মঈনরে দেখাশোনা কইরেন। পোলাডার লেহাপড়ায় মাথা ভালা। আমার পোলা আপনের কাছে একডা লাল জামা চাইছে। মনপুরা আসলে আনবেন। আপনের বইন হাফিজা খাতুন।

 চিঠি হাতে নিয়ে বসে থাকে কতক্ষণ। ভেতর থেকে আরিফুর রহমান বলে, এভাবেই একের মধ্যে অনেক। এভাবেই আমি কখনো ওসমান আলী। কখনো মশিরুল। ঘরে যাও।

 মশিরুল চিঠিটা যত্ন করে পড়ার টেবিলের ড্রয়ারে রাখে। ওর বাবার সঙ্গে আরও যে দু’জন মানুষ নিখোঁজ হয়েছিল তাদের একজন ছিল হাফিজা খাতুনের স্বামী। এই দুই পরিবারের সঙ্গে ওর মা যোগাযোগ রেখেছিল। ওদেরকে নানাভাবে সাহায্য করত। মায়ের মৃত্যুর পর দায়িত্বটা ও নিয়েছে। হাফিজার বড় মেয়েটির বিয়েতে সাহায্য করেছে। মেয়েটির স্বামী রিকশা চালায়। তখন মেয়েটি ওর জন্য পিঠা পাঠায়। দুতিন রকমের পিঠা। খেতে ও মজাই পায়। মঈন বলতো, বুয়ার পিঠা খেলে মনে হয় আমার মা বানিয়েছে। আমার মায়ের শরীরে এখন বল নাই।

 মশিরুল ঠিক করে আগামী বুধবারে মনপুরা যাওয়ার জন্য বেরিয়ে পড়বে। আচ্ছন্ন ভাব কাটিয়ে উঠে ও টেবিলে গিয়ে বসে।

 সেদিন বিকেলে মাইশা জিজ্ঞেস করে, কাকু মঈন ভাই কোথায়?

 মঈন? মঈন তো হারিয়ে গেছে।

 নাকি তুমি ওকে বাসা থেকে তাড়িয়ে দিয়েছ?

 না, মামণি আমি ওকে তাড়িয়ে দিইনি। ও হারিয়ে গিয়েছে।

 মিছে কথা বলছ। তুমি একটা খারাপ লোক।

 মশিরুল ভাবে, সেদিন ওকে সিনেমা দেখতে না যেতে দিলে কি ও ভালো লোক হতো? এই ছোট্ট মেয়েটি ওকে একটি নির্দিষ্ট সংজ্ঞায় আইডেনটিফাই করেছে। ও খারাপ-ভালোর বিচার শিখেছে।

 মঈন ভাই বলেছিল, আমাকে একটি দোয়েল পাখি ধরে দেবে। মঈন ভাই হারিয়ে গেলে দোয়েল পাখি কি আর ধরতে পারবে?

 না, মামণি। মঈন আর কখনো তোমাকে দোয়েল পাখি ধরে দিতে পারবে না।

 তাহলে কে ধরে দেবে? তুমি ধরে দাও।

 সিঁড়ির মাথা থেকে শরীফ ওকে ডাকে। কর্কশ কণ্ঠস্বরে ধমকায় মেয়েকে।

 মাইশা, তুমি নিচে নেমেছো কেন? উপরে উঠে আস।

 আমি তো দোয়েল পাখি খুঁজতে এসেছি।

 আবার কথা! উঠে আস বলছি।

 মাইশা দৌড়ে সিঁড়ি বাইতে থাকে। মশিরুল ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে। ভেবেছিল শরীফকে ভোলা যাওয়ার কথা বলে যাবে। কিন্তু তার কর্কশ কণ্ঠস্বর শুনে ওর নিজেরও মেজাজ বিগড়ে যায়। দরজার ছিটকিনি লাগাতে লাগাতে বলে, বর্বর একটা। মেয়েটিরও ছাড় নেই ওর কাছে।

 সে সন্ধ্যায় ভোলাগামী লঞ্চে ওঠে ও।

 নদীপথ ওর প্রিয়। নৌকা চড়ার আনন্দ বেশি উপভোগ করে। অনেক সময় মাঝির কাছ থেকে বৈঠা নিয়ে নিজেও নৌকা চালিয়েছে। পূর্ববঙ্গের নদ-নদীর পথে এই দেশে বিদেশি লুটেরারা ঢুকেছে। বিদেশি শাসকরাও ঢুকেছে। লঞ্চের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে থাকলে বিবর্ণ-মলিন বুড়িগঙ্গা ওর বুকের পাড়ে ভাঙন ঘটায়। কতকাল আগে বুড়িগঙ্গা যাত্রা শুরু করেছিল তার ঠিক নেই। নীহাররঞ্জন রায় তাঁর বইয়ে বলেছেন, ‘পদ্মার প্রাচীনতম প্রবাহপথের নিশানা সম্বন্ধে নিঃসংশয়ে কিছু বলা যায় না। মনে হয়, রাজশাহীর রামপুর-বোয়ালিয়ার পাশ দিয়া চলনবিলের ভিতর দিয়া ধলেশ্বরীর খাত দিয়া ঢাকার পাশ দিয়া মেঘনা খাড়িতে গিয়া পদ্মা সমুদ্রে মিশিত। ঢাকার পাশের নদীটিকে যে বুড়িগঙ্গা বলা হয়, তাহা এই কারণেই। ওই বুড়িগঙ্গাই প্রাচীন পদ্মা-গঙ্গার খাত। ’ তিনি আরও লিখেছেন, ‘ঢাকা আর গঙ্গা-পদ্মার উপর অবস্থিত নয়। পদ্মা এখন অনেক দক্ষিণে নামিয়া গিয়াছে, ঢাকা এখন পুরাতন গঙ্গা-পদ্মার খাত অর্থাৎ, বুড়িগঙ্গার উপরে অবস্থিত।’

 মশিরুল এই প্রসঙ্গের সূত্র ধরে অনুপ্রাণিত হয়। এই বুড়িগঙ্গা কত শতাব্দী আগে পদ্মা-গঙ্গার খাত ছিল। এই সময়ের মানুষ সেই নদীর যত্ন করেনি। উল্টো নষ্ট করেছে তার স্রোত। ও চেয়ার নিয়ে বসে থাকে। অপলক তাকিয়ে থাকে নদীর দিকে। অন্ধকার গাঢ় হয়ে নেমেছে স্রোতের ওপর। চাঁদপুরের কাছে গিয়ে পাওয়া যাবে মেঘনাকে। পদ্মা-ব্রহ্মপুত্রের প্রবাহ মিলিত হয়েছে গোয়ালন্দের কাছে। চাঁদপুরের কাছে মেঘনার সঙ্গে মিলে সন্দ্বীপের কাছ দিয়ে সমুদ্রে পড়েছে। রাতের অন্ধকারে মশিরুলের কাছে নদীর ইতিহাস নদীর থাকে না। সেটা বদ্বীপের ইতিহাস হয়। গাঙ্গেয় বদ্বীপ। নদী কি আবার এই ভূখন্ডকে ভেঙেচুরে নিয়ে যাবে অন্য কোথাও? অন্য কোনো দিকে? পূর্ব-পশ্চিমে-উত্তর-দক্ষিণের কোনো মাত্রায়? কে জানে!

 মশিরুল এখন হাফিজা খাতুনের গ্রামে। বাবা নিখোঁজ হওয়ার পরে অনেকবারই এসেছে এই গ্রামে। মা বেঁচে থাকতে বছরে একবার তো আসা হয়েছে। এখনও হয়। বুড়িগঙ্গার বুড়ো জীবন এখন ওর মাথার ভেতর। এই বইটি না পড়লে নদীর ইতিহাস জানা হতো না ওর। প্রিয় নদী মেঘনাকে চেনা হতো না। সেই মেঘনার কোন অতলে ডুবে আছে ওর বাবা! শান্তির ঘুম। যে ঘুম মানুষ একবারই ঘুমোয়। নিশাতের কথা মনে হয়। ও অনেকবারই বলেছে, ইচ্ছে হয় তোমার হাত ধরে মেঘনা পাড়ে হাঁটি।

 একজীবনে সব সুযোগ পায় না কেউ।

 মাঝে মাঝে তুমি খুব রূঢ় কথা বলো মশরু।

 সত্যি কথা বলা এমনই শোনায় নিশু।

 সত্যি হোক যাই হোক সব কথা খুব কাছের মানুষের কাছ থেকে শুনতে ইচ্ছে করে না। বুঝলে?

 হ্যাঁ বুঝলাম। বুঝব না কেন? কাছের মানুষের কথা না বোঝা তো বোকামি।

 সেদিন নিশাত মশিরুলের পিঠে দুমদুম কিল দিয়েছিল। মশিরুল হাসতে হাসতে বলেছিল, বেশ লাগছে। আনন্দ পাচ্ছি।

 কিসে তোমার আনন্দ, কিসে তোমার দুঃখ বোঝা মুশকিল। নদীতে ঘুরে ঘুরে তোমার বোঝায় জলবায়ু পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে।

 হা হা হাসিতে সেই দুপুরে দু’জনের হুটোপুটিতে ফুটে উঠেছিল প্রায় নিরিবিলি শব্দহীন দুপুর। এখন মেঘনা পাড়ের বাদল জলদাসের বাড়িতে যাবে ও। ওর বাবার সঙ্গে নিখোঁজ তিনজনের একজন বাদল জলদাস। লাশ না পাওয়া গেলে সরকারি সাহায্য পাওয়া যায় না। এই দুঃখ নিয়ে দিন কাটে অতল জলদাসের।

 ওর সঙ্গে দেখা হলেই অতল জলদাসের হাহাকার বেড়ে যায়। বলে, বাপ মোগ ভালা চায় নাই। কী ক্ষতি হইত ভাইসা উঠলে! মোরা তো সরকারের কাছ থেইকা টাহা পাইতাম। অহন লাশও নাই, টাহাও নাই।

 দুঃখ করিস না অতল। এখন তো নিজে কিছু কামাই করে সংসারটা দাঁড় করিয়েছিস।

 সংসারের লাইগা তো মোর পড়ালেহা হইল না।

 কী আর করবি? সবই ভাগ্য!

 হ, ভাগ্য। জাইলার পোলা অহন কামলা খাটি।

 তুই না বলেছিলি বাপেরে নদী গিলছে, মুই আর নদীত যামু না। ডাঙায় কাম করুম।

 হ, কইছিলাম। তহন নদীর উপর মোর রাগ আছিল। রাগ আছিল দুই রহম।

 দুই রকম? কী বলছিস?

 একরহম রাগ আছিল এইজন্যি যে বাজানরে ক্যান খাইল। আর একরহম রাগ আছিল এই জন্যি যে বাজানরে ক্যান ভাসাইল না! তাইলেতো টাহা পাইতাম।

 অতল, চল তোকে ভাত খাওয়াব। কী দিয়ে ভাত খাবি বল তো? মুরগি, না ইলিশ মাছ?

 দুইডাই খামু। কতদিন খাই নাই।

 আয়। মশিরুল ওর হাত ধরে হোটেলে নিয়ে গিয়েছিল।

 আজকে ও চারদিকে তাকিয়ে অতলকে খোঁজে। ভাবে, পথে দেখা হয়ে গেলে বেশ হয়। পরিচিত লোকজন এগিয়ে আসে।

 কেমন আছেন? কখন আসলেন?

 এমন প্রশ্নের উত্তর অনেকবার দিতে হলো। তবে হাঁটতে বেশ লাগছে। স্নিগ্ধ বাতাস ছুঁয়ে যাচ্ছে চোখেমুখে। উড়ছে চুল। জিন্সের প্যান্ট আর বেগুনি রঙের টি-শার্ট পরে আছে। মশিরুল অতলের বাড়িতে এসে দেখল, ওর মা মুড়ি ভাজছে। ওকে দেখে খুশিতে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে, কহন আসছো বাজান?

 এই কিছুক্ষণ আগে লঞ্চ থেকে নেমেছি।

 ভালো আছ তো বাজান?

 হ্যাঁ, ভালা আছি মাসী। অতল কই?

 কোনহানে যে গেছে মুই তো জানি না।

 ওর বউ-বাচ্চা কই?

 বউ তো অর বাপের বাড়ি গেছে। দশ দিন থাকব। আওনের অহনও তিন দিন বাকি।

 তাহলে আমি আসি মাসীমা।

 না, বাজান, এটটু বস। মুড়ি মাখায়ে দি?

 আচ্ছা দেন।

 মশিরুল পিঁড়ি পেতে বসে। কাঁচামরিচ-পেঁয়াজ-সরষের তেল মাখানো মুড়ি খায়। খেতে বসে ভালোই লাগে। অনেকগুলো মুড়ি খেয়ে ও বেশ চাঙ্গা হয়ে ওঠে।

 তোমার মায়ের কথা খুব মনে হয় বাজান।

 মশিরুল উত্তর দেয় না। এসব কথা শুনলে ওর বুকের ভেতর ভাঙনের শব্দ হয়। মায়ের মৃত্যুর পরে প্রতিদিনই মনে হতো, এই শব্দ নিয়ে বেঁচে থাকা কঠিন হবে। আস্তে আস্তে সয়ে এসেছে। মায়ের জীবনে মৃত্যু অনেক। ওর জন্মের আগে তিনটি ভাইবোন ছিল ওর। সবাই অল্প বয়সে মারা যায়। ওর মাকে আগলে রেখেছিল ওর বাবা। বাবার মৃত্যু মাকে ধসিয়ে দিয়েছিল। এখন মনপুরার একজন নারীর মুখে মায়ের কথা শুনে ওর ভালো লাগে। ভাবে, আমার দুঃখী মাকে যে স্মরণ করে তার কপালে ফুল-চন্দন পড়ুক।

 বাজান, তোমার মা একদিন মোরে কইছিল, বোনরে, তোমার শত বছরের আয়ু হোক। মেঘনা নদীর ধারে যার বাড়ি তার ঘরে লক্ষ্মী থাকবে। কিন্তু বাজান রে, ঘরে লক্ষ্মী রাখতে তো পারলাম না। বউডা আমার পোলাডারে ভাতের খোঁটা দ্যায়। তহন পোলাডা ওর বাপের উপর রাগ ঝাড়ে। কয়, ভাইসা যদি উইঠতে না পারবা তাইলে মইরতে গেলা ক্যান? এইডা শুইনা বউডা খুব মজা পায়। খিলখিল কইরা হাসে।

 মশিরুল চুপ করে থাকে।

 জীবনের এ এক অন্য গল্প। যতদিন অতল বিয়ে করেনি, ততদিন ওর মুখে এসব কথা ছিল না। অতলের জন্য বিথীর প্রেম নেই? কেন ওকে এমন করে খোঁচায়? এসব প্রশ্নের মীমাংসা অন্যের কাছে নেই। মশিরুল নিজেকে সামলায়।

 এইসব দেইখা মোর আর বাঁচতে ইচ্ছা করে না। মনে অয় মেঘনা নদীতে ডুইবা যাই। দেহি মানুষডা কোনহানে তলাইয়া আছে।

 মাসী, এমন কথা ভাববেন না। আপনার নাতি-নাতনি আছে না। ওরা তো আপনাকে দুঃখ দেয় না।

 বাজান, ভাতের খোঁটা বড় খোঁটা। পোলাডা রাতদিন খাটাখাটনি করে। যা পায় তা বউর হাতে তুইলা দেয়। তাও শান্তি নাই।

 শেষ কথাটা বলার সময় তার গলা ধরে আসে। চোখ মোছে। মশিরুল উঠে দাঁড়ায়। পাঁচশটি টাকা বের করে মাসীর হাতে দিয়ে বলে, আপনি একটা শাড়ি কিনবেন। আর অতলকে বলবেন আমার সঙ্গে যেন দেখা করে। আমি ইউনিয়ন পরিষদের ডাকবাংলায় আছি। এখন হাফিজা খালার বাড়িতে যাব।

 আহা রে, সে তো আরেক হতভাগী!

 মশিরুল কথা বাড়ায় না। বিদায় নিয়ে চলে আসে।

 একটা রিকশা নিয়ে মেঘনা পাড়ে এসে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। যেন চোখের সামনে ভাসে নদীর বাঁকবদল। সরে যাচ্ছে নদী। জেগে উঠেছে ভূখন্ড। ছোটবেলা থেকে বাবা যে ইতিহাসের গল্প বলেছেন, বই পড়িয়েছেন, সেই নদীই বাবাকে টেনে নিয়েছে। এখন নদীর তৈরি করা ভূখন্ডে ঘুরে বেড়িয়ে ও বেঁচে আছে জীবনসত্যের দর্শন নিয়ে। কতটুকু সম্ভব মানুষের কাছে থাকা? অতল যখন ছোট তখন ওর নিজের কোনো সাধ্য ছিল না ওকে লেখাপড়া শেখানোর। হাফিজার ছেলেটিকে চেষ্টা করেছিল কিন্তু ওর মন ছিল না পড়ালেখায়। ঠিক করে এখন অতলকে বাঁচাতে হবে পারিবারিক সংকট থেকে। ওর সঙ্গে বুঝতে চায় কী করলে এই সংকট কাটবে।

 হাফিজার বাড়িতে গিয়ে পৌঁছালে গাছপালায় ঢাকা ছোট কুঁড়েটি স্নিগ্ধতার সাদা আলোয় নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে। দূর থেকেই দেখে বারান্দার খুঁটিতে হেলান দিয়ে বসে আছে হাফিজা। রশীদ উঠোনে বসে শুকনো ডালপালা ভেঙে একপাশে জড়ো করছে। ওকে দেখে এক লাফে ছুটে এসে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে। বারান্দায় পিঁড়ি পেতে দেয় হাফিজা।

 বসো বাজান। মঈনুল তোমারে মোর চিডি দিছিল?

 হ্যাঁ, চিঠি পেয়েছি। মঈনুল নিজেই আমার বাসায় দিয়ে এসেছিল।

 পোলাটারে দেখবা। য্যান পড়ালেহা শ্যাষ করে। মাস্তান অয় না য্যান।

 আপনার কি মনে হয়, মঈনুল মাস্তান হতে পারে?

 এটটু এটটু মনে অয়। অর বাপ-মায়ের মুহেতো হেইরহম কাতাবাত্তা হুনি। জোরেশোরে কয় না। তয় হেরাও সন্দ করে। মেলা টাহাপয়সা উড়ায়।

 মশিরুল থমকে যায়। ছেলেটি নিশ্চয়…। না থাক, ওকে না দেখে আগেই ওর বিষয়ে মন্দ ধারণা তৈরি করা উচিত না। তাছাড়া বাড়ির গৃহকর্মী এমন একটি কথা বললে ওটা তো ওর পছন্দ হবে না। ছেলেটি তো চিঠিটি ওকে পৌঁছে দিয়েছে। নিশ্চয় ওর ভেতরে কিছু শুভবোধ আছে। ওর ওই জায়গাটা বিচার না করে উড়িয়ে দেয়া ঠিক হবে না। মশিরুল নিজের সিদ্ধান্তে স্থিত হয়।

 কী ভাবো বাজান? তুমি কী খাইবা?

 পানি। পানির পিপাসা পেয়েছে।

 মুই আনতাছি মা। আপনে বহেন।

 রশীদ গ্লাস নিয়ে কলসি থেকে পানি ঢেলে আনে। মাটির কলসির পানি ও কখনো পান করেনি। আজ গ্লাসে চুমুক দিয়ে বেশ লাগে। বলে, এই পানিতে আমার মায়ের স্নেহ আছে। পানি যখন গলা দিয়ে নেমেছে তখন মা বলেছে, গলাটা এমন শুকিয়ে রাখিস না বাবা।

 রশীদ হা-হা করে হাসতে হাসতে বলে, এমুন কথা মুই জীবনে হুনি নাই। এইডা কেমুন কথা হইল!

 থাম, থামরে পোলা। হাফিজা খাতুন দ্রুত কণ্ঠে বলে, এই কথা হইল মায়ের লাগি পরান পোড়ার কথা। মা যার পরানে তড়পায় হেই এমুন কথা কয়। বুঝছস!

 হ বুঝছি। আপনেও মোর পরানের গহিনে আছেন মাগো।

 তুই মোরে পরানে রাখছস বাজান, কিন্তু মোর পরানে শান্তি নাই।

 হাফিজা খাতুন মশিরুলের দিকে তাকিয়ে বলে, পোলাডা বিয়া কইরতে চায় না। কয়, বউয়ের লগে মায়ের যদি বাজাবাজি অয় তাইলে মুই কী করমু? আমি কই, বাজাবাজি অইব না। মুই এক কোনায় পইড়া থাকুম। তোমাগো সংসারে হাতই থুমু না। পোলা তাও মোর কথা হুনতে চায় না। এইডা একডা জ্বালা না বাজান?

 হ্যাঁ, জ্বালা তো বটেই। কী রে রশীদ

 আপনেও তো বিয়া করেন নাই ভাইজান

 আমি তো একা থাকব ঠিক করেছি।

 মুইও একা থাকুম। মা মইরা গেলে মুই মেঘনা নদীতে ডুইবা যামু।

 কী কস বাজান! চিৎকার করে ওঠে হাফিজা। তারপর কেঁদে বুক ভাসায়।

 মশিরুল ওর দিকে কঠিন চোখে তাকিয়ে বলে, মাকে কষ্ট দিচ্ছিস কেন? বোকার মতো কথা বলছিস। গাধা একটা।

 রশীদ অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে। পরমুহূর্তে কাঁদতে কাঁদতে বলে, বাজান হারায়ে গেল ক্যান? বাজানের কবর থাকব না?

 মশিরুল ওর ঘাড়ে হাত দিয়ে বলে, চল বাজারে যাই। আমি এখন আসি খালা। পরে আবার আসব।

 দু’জনে বেরিয়ে আসে। ওর সঙ্গে কথা বলার কিছু নেই। তার পরও জিজ্ঞেস করে, ঘুঘুর ডিম আছে কোন গাছে রে? বাচ্চা ফুটিয়েছে?

 জানি না। কইতে পারুম না।

 তুই তো আগে পশুপাখির খোঁজ রাখতি। আমি এলে কোন গাছে কোন পাখি বাসা বেঁধেছে তার কথা বলতি। কোন বাসায় বাচ্চা-পাখি চিঁ-চিঁ করছে সেকথা জানাতি না রে?

 অহন আর ভাল্লাগে না।

 তোর কী হয়েছে রে? এই বয়সে যদি এমন কথা বলিস তাহলে জীবনভর কি বলবি? সামনে কতশত দিন পড়ে আছে না? বল, তোর কি হয়েছে?

 কী অইব? কিছু অয় নাই। মোর বিয়া করার ইচ্ছা নাই। কী অইব বিয়া কইরা? অহন নিজের মতো থাহি। ইচ্ছা অইলে কাম করি। দিনমজুরির কাম। ইচ্ছা না অইলে করি না। পুহুরের ধারে বইয়া মাছ ধরি। মায়েরে মাছ ধইরা দিলে মা রান্দে। দুইজনে মিলা খাই। দিন তো কাইটা যায়। খুব ভালা কাইটা যায়।

 বুঝেছি। তুই খুব ভালো আছিস। তোর দিন সুখেই কাটছে।

 হা-হা করে হাসে রশীদ। হাসিতে ওর ভালো থাকার প্রাণস্পন্দন ধ্বনিত হয়। মশিরুলের নিজের ভেতরে একই স্পন্দন মাতিয়ে তোলে ওকে। ও ভাবে, ও এখন নতুনভাবে জেগে ওঠা সহস্র বছর আগের পূর্ববঙ্গ। বুকের ভেতর হাজার নদীর কল্লোল।

 কয়েকদিন থেকে মশিরুল ফিরে আসে ঢাকায়।

 মেইন গেট বন্ধ। গেটের চাবি একটি ওর কাছে আছে, অন্যটি শরীফের কাছে। ও চাবি বের করে তালা খোলে। ঘরে ঢোকে। নিশাত ওকে বলেছিল, ওরা সিলেটে বেড়াতে যাবে। গেছে হয়তো। নিশাত ওকে ফোন করেনি। রাগ করেছে কি? নাকি সুযোগ করতে পারেনি? মশিরুল রান্নাঘরে ঢুকে চারদিক দেখে। ঠিক আছে ঘরের সবটুকু। বারান্দায় মঈনের কাপড়-চোপড় ভাঁজ করে কাঠের তাকের ওপর রাখা আছে। ও বেশ শৌখিন ছেলে ছিল। নানা রঙের প্যান্ট-শার্ট, বিভিন্ন রকমের টি-শার্ট, এমনকি পাঁচ-সাত রকমের লুঙ্গিও ওর শখের ছিল। নিজের একটি স্যুটকেসে কাপড়গুলো যত্ন করে রাখবে বলে ঠিক করে। বেডরুমে ঢুকে চারদিকে তাকায়। সবই ঠিক আছে। ব্যাগটা এক কোনায় রেখে বাথরুমে ঢোকে ও। শাওয়ারের নিচে দাঁড়ালে প্রবল শূন্যতা অনুভব করে। পানির ধারা গড়িয়ে পড়ে শরীরে। ভাবে, নতুন দিনের সূচনা করা যায় না? বেঁচে থাকার অন্যকিছু আবিষ্কার? যেখানে নিজের উপলব্ধিকে অন্যের সঙ্গে ভাগাভাগি করা হবে? বাবা ওকে লিখতে বলতেন। বলতেন, চিন্তা করতে শেখো। দেখবে, খুঁজে পাবে অন্য পৃথিবী। বেঁচে থাকাকে অর্থপূর্ণ করত হয় বাবা।

 সেই কৈশোরে বাবার স্বপ্নের জায়গা বুঝতে পারেনি ও। এখন মনে হয় অনেক সময় গড়িয়েছে। এবার একটা কিছু করা দরকার। ইতিহাসের পূর্ববঙ্গ- পূর্ববঙ্গে নদ-নদী মানুষের বেঁচে থাকার লড়াই নিয়ে একটি বড় বই লিখবে। তেমন প্রস্তুতি কি বুকের মধ্যে ছিল? হবে হয়তো। নইলে এই শাওয়ারের পানির নিচে দাঁড়িয়ে কেন বড় লেখার পটভূমি জেগে উঠছে মনে? ও শাওয়ার বন্ধ করে। গায়ের পানি মোছে। রান্নাঘরে গিয়ে চুলোয় ভাত বসায়। ডাল রান্না করবে। সঙ্গে ডিম ভাজি। আপাতত এ-ই চলবে। খেয়েদেয়ে বই নিয়ে বসবে।

 ও এখন কাঁচের ঘরের মানুষ। কাঁচের দেয়ালে ভেসে উঠেছে ওর কৈশোরের একজন মানুষ। ছত্রিশ নম্বর এ্যালিফ্যান্ট রোডের বাড়িতে থাকতেন। বাড়িটি তাঁর নিজের ছিল না, ছিল ভাড়া বাড়ি। সেদিন সূর্য ওঠার আগে ওই বাড়িতে এসেছিল পাকবাহিনীর ছাব্বিশ নম্বর ইউনিট কর্নেল তাজের নেতৃত্বে। সেদিন পাক সেনা সদস্য তাকে পাঁচটি গুলিতে বিদ্ধ করেছিল। মশিরুল শুনতে পায় ডাক, দেখো আমাকে।

 আমি আপনাকে দেখছি শহীদ বীরযোদ্ধা।

 সেদিন আমি বলেছিলাম আমার সামনে আছে, একদফা। স্বাধীনতা – বাঙালির মুক্তির পথ।

 ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আমি ইতিহাসের এসব বিষয় জেনেছি বীরযোদ্ধা।

 হা-হা করে হাসেন তিনি। হাসি থামিয়ে বলেন, স্বাধীনতার পথ কঠিন। নির্মম। সাহসের। এবং বিজয়ের।

 এ সত্যও আমি বুঝেছি। তারপরও আমি আপনাকে খুঁজি। জানি আপনি ইতিহাসের পাতায় আছেন। তারপরও মনে হয় যদি আপনি কোথাও থাকেন, কোনো অদৃশ্যলোকে – আকাশে বা পাতালে। যদি আমি আপনার হাত ধরতে পারি।

 আবার প্রবল হাসিতে চৌচির হয় কাঁচের দেয়াল। মশিরুলের সামনে আর একটি অন্যরকম দৃশ্য তৈরি হয়। দেখতে পায় তিনি হেঁটে যাচ্ছেন। পেছনে সারিবদ্ধ সেইসব নতমুখ মানুষ যারা স্বাধীনতার যুদ্ধের সঙ্গে বিশ্বাসঘতকতা করে মানবতাবিরোধী অপরাধে দন্ডিত। মশিরুল বড় করে স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ে। সেই নিশ্বাস যুক্ত হয় স্বাধীনতার স্বপ্নের সেই সব নিখোঁজ মানুষের হৃৎপিন্ডের ধুকপুক শব্দের সঙ্গে। ও নিজের রান্না করা খাবার নিয়ে ডাইনিং টেবিলে বসে। কিন্তু খেতে পারে না। মঈনের জন্য চোখের পানি গড়ায়। বলে, এমন করে তোকে মরতে হবে তা আমার স্বপ্নে অতীত ছিল রে মঈন। স্বাধীন দেশের মানুষ এত নির্মম হয় কী করে। কীভাবে তারা একজনের হৃৎপিন্ড পা দিয়ে চেপে ধরে?

 ভাত খান স্যার। আপনার খিদে পেয়েছে।

 না, আমার খিদে পায়নি।

 সামনে আপনার অনেক কাজ। ভাত না খেলে কেমন করে করবেন। ভাত খান স্যার।

 তুই বলছিস? মঈন তুই বলছিস?

 হ্যাঁ বলছি। আপনি খাওয়া শেষ না করা পর্যন্ত বলতেই থাকব।

 মশিরুল ঘরের চরদিকে তাকায়। কোথাও কেউ নেই। জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। ইলেকট্রিক তারের ওপর বসে আছে তিনটি কাক। মশিরুলও কয়ে চামচ ভাত প্লেটে করে এনে বারান্দার কোণায় ঢেলে দেয়। কাকগুলো উড়ে আসে। ও ডাইনিং টেবিলে ফিরে আসে। শুনতে পায় কাকদের ডাক, পাখা ঝাপটানি, এমনকি ভাতের মাঝে ঠোঁটের শব্দ। ও ভাত খেতে পারে না। আনমনা হয়ে বসে থাকে। টের পায় একসময় ভাত খাওয়া শেষ করে কাকেরা উড়ে যায়। দুপুর শেষ হয়ে বিকেল গড়িয়েছে।

 বেশ সময় কেটে যায়। ভাত খাওয়া হয়ে ওঠে না। প্লেট-বাটি-গ্লাস গুছিয়ে রান্নাঘরে রেখে আসে। বারান্দা ঝাড়– দেয়। কাকেরা ভাতগুলো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে খেয়েছে। পুরো বারান্দাজুড়ে ভাতের দানা পড়ে আছে। মন খারাপ হয় ওর। ঝাড়– শেষ করে দাঁড়িয়ে থাকে। ওর আর একজন মঈন দরকার। কোথায় পাবে? না, মঈন পাবে না। পাবে অন্য কাউকে, সালাম বা ইদ্রিস। ওদের সঙ্গে প্রাণের টানের সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। আবার মঈনের ভাবনা বুকের সমতলে পলিমাটি ভরে দেয়। ও বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশ দেখে। দুপুরের পর থেকে লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেনকে মনে পড়ছে। স্মৃতির বয়স কম ছিল না যে তাঁর চেহারা ভুলে যাবে। কৈশোরের সেই বয়সে দেখা মানুষটিকে খুব মনে পড়ছে। বাবার প্রতিবেশী শুধু ছিলেন না, বন্ধুত্বও ছিল দু’জনের। নানা গল্প হতো। দেশের রাজনীতি বিষয়ে বেশি। তখন অনেক কিছু বোঝার বয়স ওর ছিল না। এখন অনেক কিছুই বিশ্লেষণ করতে পারে। কৈশোরের স্মৃতিকে জাগিয়ে তোলার জন্য পড়ার ঘরে আসে। যেসব বই পড়ে সেগুলো পড়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত ওর টেবিলে থাকে। সঙ্গে থাকে বই থেকে উল্লেযোগ্য কিছু পয়েন্ট নোট করার জন্য কাগজ-কলম। ঘরের লাইট অন করে। আবার ভেসে ওঠে কাঁচের দেয়াল – দেখা যায় বয়ে যাচ্ছে নদী? ও জিজ্ঞেস করে, নিজের নাম বলো?

 আমি আগুনমুখা।

 তোমার নাম নীহাররঞ্জন রায়ের বইয়ে নেই আগুনমুখা।

 আমি তোমার স্মৃতিতে আছি। তুমি আমার বুকের ওপর দিয়ে নৌকায় যাওয়ার সময় লালদিয়ার চরে গিয়েছিলে।

 হ্যাঁ, গিয়েছিলাম। আমার মনে আছে। এখন তোমার কলকল ধ্বনি শুনতে আমার খুব ভালোলাগছে। তোমার নামটি খুব সুন্দর।

 মশিরুলের মনে হয় নদীর প্রবাহ দ্বিগুণ হয়ে গেছে। ওর ঘরের ভেতরে এই মুহূর্তে নদীর কল্লোল ছাড়া আর কিছু নাই। ওর সময় নদী হয়ে বঙ্গোপসাগরের দিকে ছুটছে। ও এখন আরিফুর রহমান, ওসমান আলী। নিজের বিস্তারে খুশি হয়ে খুলে রাখা বই হাতে উঠিয়ে নেয়।

 ‘বাঙালীর ইতিহাস’ বইয়ের পাতা উল্টে ‘দেশ-পরিচয়’ অধ্যায়ের শেষ পৃষ্ঠায় এসে থমকে যায় ও। ও পড়তে থাকে ‘কিন্তু গৌড় নাম লইয়া বাংলায় সমস্ত জনপদগুলিকে ঐক্যবদ্ধ করিবার যে চেষ্টা শশাঙ্ক, পাল ও সেন রাজারা করিয়াছিলেন সে চেষ্টা সার্থক হয় নাই। সেই সৌভাগ্যলাভ ঘটিল বঙ্গ নামের, যে বঙ্গ ছিল আর্য সভ্যতা ও সংস্কৃতির দিক হইতে ঘৃণিত ও অবজ্ঞাত, এবং যে-বঙ্গ-নাম ছিল পাল ও সেন রাজাদের কাছে কম গৌরব ও আদরের। কিন্তু, সমস্ত বাংলাদেশের বঙ্গ নাম লইয়া ঐক্যবদ্ধ হওয়া হিন্দু আমলে ঘটে নাই, তাহা ঘটিল তথাকথিত পাঠান আমলে এবং পূর্ণ পরিণতি পাইল আকবরের আমলে, যখন সমস্ত বাংলাদেশ সুবা বাংলা নামে পরিচিত হইল। ইংরাজ আমলে বাংলা নাম পূর্ণতর পরিচয় ও প্রতিষ্ঠা লাভ করিয়াছে, যদিও আজিকার বাংলাদেশ আকবরী সুবা বাংলা অপেক্ষা খর্বীকৃত।’

 বইয়ের এই অধ্যায় এখানেই শেষ। এই অধ্যায়ের সঙ্গে যুক্ত হয় মোয়াজ্জেম হোসেনের স্মৃতি। সময়ের ইতিহাস বিকশিত হয় মাথায়। গৌড় থেকে বঙ্গ হয়েছে এটাই বাঙালির শক্তি। বঙ্গ থেকে বাংলাদেশ হয়েছে এটাও বাঙালির শক্তি। ও বঙ্গ বঙ্গ করে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলে, আপনাকে আমি খুঁজে পেয়েছি মোয়াজ্জেম হোসেন। আমার কিশোরবেলায় দেখা আপনি এখন বুকটান করে দাঁড়িয়ে থাকা বিশাল মানুষ। ইতিহাসবিদ সুবা বাংলাকে খর্বীকৃত বলেছেন। আপনার জীবনদান স্বাধীন বাংলাদেশকে বিশাল আকৃতি দিয়েছে। ইতিহাসের অনেক মানুষ স্বাধীন বাংলাদেশ দেখেনি। আপনার রক্তের বিনিময়ের স্বাধীনতা আমাকে খর্ব আকারে ডুবিয়ে রাখে না। আপনি আমার কাছে নিখোঁজ মানুষ নন।

মশিরুল ওর প্রিয় বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। দেখতে পায় ছেলেরা বল নিয়ে খেলার জন্য জড়ো হচ্ছে। ওদের চিৎকার-উচ্ছ্বাস ধ্বনিত হচ্ছে চারদিকে। ওর কানের তটে এসেও পড়ছে সে ধ্বনি। ধ্বনি ওর সামনে মেঘনা নদী। সন্দ্বীপ হয়ে বঙ্গোপসাগরে মিশেছে। বাবা বলতেন, নদীর ইতিহাস আমাকে খুব আনন্দ দেয়। তোরা তো জানিস না যে নদীর ইতিহাস পড়তে পড়তে আমি মগ্ন হয়ে যাই। পড়া একবারে শেষ করি না। আবার পেছনে রেখে যাওয়া পৃষ্ঠায় ফিরে আসি। পড়ার সময় নদী আমার বুকের ভেতর থাকে।

 বাবার এমন কথা শুনলে ওর খুব হাসি পেতো। ও জোরে জোরে হাসলে রেগে যেতো ওর বাবা। ধমক দিয়ে বলতো, গাধা একটা।

 বড় হওয়ার পরে ও ভেবে দেখছে যে, বাবার আনন্দের সঙ্গে ওর আনন্দ এক নয়। ওর জীবনে নদীর সঙ্গে মানুষ দেখার আনন্দ আছে। বাবা নদী দেখেছে। মানুষ দেখেনি। মানুষের জীবন বাবাকে ভাবায়নি। ও মানুষের কথা ভেবেছে : রিয়াল লিভিং ইজ লিভিং ফর আদার্স এই ব্রতকে ও সত্য মেনেছে। মঈনের লাশ কবরে নামিয়েছে; মনপুরায় হাফিজা খাতুন, অতল জলদাসকে দেখেছে, যে নিশাত পারিবারিক নির্যাতনে দিন কাটাতে কাটাতে অবৈধ সন্তানের মা হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করে তাদের জীবনের সঙ্গে যোগ হবে পূর্ববঙ্গ, তারপর বাংলাদেশ।

 মশিরুল টেবিলে এসে বসে। কাগজ-কলম টেনে নেয়।

 লিখিত হতে থাকে জীবনের জলছবি।

 ইতিহাসের বিশাল ক্যানভাসে গড়ায় চলমান স্রোত।

 নাজমা আখতার ডাকে, বাবা ঘুমুবি না?

 আর একটু পরে মা। তুমি ঘুমিয়ে পড়।

 অনেক রাত হয়েছে বাবা।

 মাগো, তুমিতো জানো আমার কাছে রাতদিন সমান।

 জানি, জানি। তুইতো আমার একমাত্র সন্তান যে আমার কলজেটা ভরিয়ে দিয়েছে। আমি চাই না তোর কোনো অসুখ করুক।

 মাগো, আমি ভালোই অছি। আমাকে নিয়ে ভেবো না।

 তোর জন্য দোয়া করি।

 মশিরুল চারদিকে তাকায়। আবার কাগজের ওপর মগ্ন হয়। রচিত হচ্ছে একটি ভূখন্ডের হয়ে ওঠার লেখা – নদীমাতৃক দেশ। নদীর সঙ্গে মানুষের বেঁচে থাকার সম্পর্ক। গল্প লেখা হচ্ছে ভাঙাগড়ার জীবনের। যেখানে যুদ্ধ আছে, মৃত্যু আছে, শহীদের ত্যাগ আছে – বেঁচে থাকার নিরন্তর লড়াই আছে।

 আকস্মিকভাবে ও খেয়াল করে ঘরের কাঁচের দেয়ালে ভেসে উঠেছে কোটি কোটি মানুষ। যারা একের মধ্যে অনেক-একের মধ্যে অজস্র। নাম বদলায়, ঠিকানা বদলায় কিন্তু জলপ্রপাতের মতো ধারাবাহিক মানুষের স্রোতে বয়ে যায়।

 কেন মায়ের ডাক ওর কানে এলো? আসলে ও ঘোরের ভেতর ঢুকেছে। চরিত্র হয়ে ফিরে আসছে ফেলে আসা মানুষের ছায়া। জীবনের জলছবিতে রঙ লাগছে।

 মশিরুলের সামনে থেকে রাতের হিসেব মুছে যায়। ও ভুলে যায় যে ও মধ্যরাতে এসে কাগজের ওপর ঝুঁকে আছে।

 আমি আরিফুর রহমান। বয়স ছিয়াত্তর।

 ওসমান আলী, মশিরুলের ছায়ার সীমান্ত পেরিয়ে ফিরে আসি নিজ বলয়ে। ভবিষ্যতে আবার অন্য চেহারায় ঢুকে যাব নতুন সীমান্তের কাঁটাতার পেরিয়ে। পা রাখবো বাঁচা-মরার লড়াইয়ের পথে। হাঁটাই আমার নিয়তি।

 গতকাল দুজন যুদ্ধাপরাধীর বিচারের রায় কার্যকর হলে সারা রাত আমি নিঃসাড় ঘুমাই। একঘুমে রাত কাটিয়ে জানালা দিয়ে ভোরের নতুন আলো দেখি। আলোয় ভরে গেছে ঘর। বুঝতে পারি শহীদ বন্ধুদের আর খুঁজতে হবে না। ওরা মিশে থাকবে জনজীবনের সবখানে।

 ফায়জা কখন উঠে গেছে আমি টের পাইনি। চুপচাপ শুয়ে থাকলে ও ফিরে আসে। আমি উঠে বসি। ফায়জা সামনে দাঁড়িয়ে বলে, চা খাবে।

 আমি ওর হাত ধরে বলি, না। চলো আমরা বেরিয়ে পড়ি।

 কোথায়? গত পরশু সুষমার বিয়ে হলো। ওদের দুজনকে বাড়িতে খাওয়াতে হবে। কিছু আয়োজন তো লাগে। করব না?

 করবে। অবশ্যই করতে হবে। তার আগে আমি বিভিন্ন জায়গায় যাব।

 কোথায় যাবে?

 তোমাকে বলেছি না পথে পথে হাঁটা আমার নিয়তি।

 বেলফুল হত্যার বিচার চেয়ে লড়াইটা শুরু করেছি। এখনই ঢাকার বাইরে যাব?

 আমাদের সামনে অনেক কাজ আছে ফায়জা।

 গতকাল তোমার শহীদ বন্ধুদের আত্মার শান্তি হয়েছে।

 আমার আত্মাও শান্তি হয়েছে। তাই আমাদের সামনে অনেক কাজ। যেতে হবে পথে পথে।

 আমার কথা শেষ হয় না। ফায়জার মোবাইল বাজে। ও মোবাইল অন করার আগে বলে, জুয়েলের ফোন।

 মোবাইল নিয়ে ও বারান্দায় যায়। শুনতে পাই ওর কন্ঠস্বর। হাসির শব্দও শুনতে পাই। জুয়েল হয়তো ওকে কোনো নতুন কথা শোনাচ্ছে। ওর পরিচয়হীন জীবনে ফায়জা খুব কাছের কেউ। আমাদের বিয়ে হওয়ার পরে আমি খেয়াল করেছি জুয়েল আমার থেকে খানিকটুকু দূরে সরে গেছে। ফায়জা ওর অনেক বেশি আপন। একদিন নাকি ফায়জাকে বলেছে, ঘরে আমার একজন মা আছে। আপনি আমার আর এক মা। আপনি বেলফুলের হত্যার বিচার চেয়েছেন। আমি আপনার সঙ্গে থাকব। বেলফুলের কষ্ট আমি মেনে নিতে পারি না। আমি বিচার চাই। সেদিন কেঁদেকেটে অস্থির হয়ে গিয়েছিল জুয়েল। ফায়জার পায়ে মাথা ঠুকেছিল। কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল, বেলফুল এমন করে মরবে কেন? এ কেমন মৃত্যু?

 ফায়জা ওকে বুকে তুলে নিয়েছিল। বলেছিল, তুই আমার সন্তান। আমরা বেলফুল হত্যার বিচার পাবই।

 সেদিন আমি নিজেকে বলেছিলাম, আমিও বিচার চাই। বেলফুল তুই আমার মাকড়সার বাসা। তোর কষ্ট আমার বুকের মাকড়সার জালে আটকে আছে।

 আমি জানালার সামনে দাঁড়াই। আমার চারদিকে কাঁচের দেয়াল। আমি এখন জনস্রোতে মিশে থাকা আরিফুর রহমান। একের ভেতর অনেক জীবন কাটিয়েছি। দেখেছি বেঁচে থাকার রূপ কত বিচিত্র।

 আমার আর ফায়জার জীবনে ভালোবাসার নদীর বিস্তার ঘটেছে। ও আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, আমি তোমাকে কী নামে ডাকব?

 তোমার যা খুশি। তুমি কি কিছু ভেবেছ?

 হ্যাঁ ভেবেছি, চকচক করছিল ফায়জার মুখ। মৃদু হেসে বলেছিল, পৃথিবীর যত বড় বড় মানুষ আছে তাদের নামে ডাকব। সে নাম নারীর হতে পারে, পুরুষেরও হতে পারে।

 বাহ্, দারুণ। এখন কী নামে ডাকবে?

 সক্রেটিস।

 আমি মুগ্ধ হয়ে মাথা নাড়ি।

 রাতে ঘুমুতে যাবার আগে ডাকব স্যাফো। বেশি খুশি হলে প্লেটো হবে, নয়তো নিউটন।

 তোমার ভালোবাসা আমার ঘরের চার দেয়াল। সেই দেয়ালে ফুটে উঠবে সক্রেটিস, প্লেটো, স্যাফো….. আরও অনেক।

 আমি ওর কপালে চুমু দিয়ে বলেছিলাম, অক্ষয় হোক মানবজনমের সৌন্দর্য।

 আমার যে সত্তাটি মশিরুলের ভেতর দিয়ে বয়ে গেছে সেখানে মর্মঘাতী বেদনা আছে। নিশাত আমাকে বলেছিল, আমি তোমার কাছে একটি সন্তান চেয়েছিলাম, দাওনি। এখন আমি একজন মৃত নারী। শরীফ আমাকে সিলেটে বেড়াতে নিয়ে হোটেলের ঘরে গলা চেপে মেরে ফেলেছিল। আমি চেঁচিয়ে ডাকি, নিশাত! আমি আমার লেখার মগ্নতা ধরে রাখতে পারিনি। বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছিলাম। দেখেছিলাম বিদ্যুৎহীন পুরো শহর। গাঢ় অন্ধকারে ডুবে আছে। জনস্রোতে মিশে গেলে রাস্তার পাশে পড়ে থাকতে দেখি নিশাতকে – মৃত এবং রক্তাক্ত।

 জুয়েলকে আমি কাছে টেনেছিলাম। জন্ম পরিচয়হীন ধর্মহীন মানুষ হয়ে ও আমার চেতনায় আলো ফেলেছে। বেঁচে থাকার প্রকৃত সত্য ও আমাকে দেখিয়ে দিয়েছে। আমি ওর কাছে আমার ভেতরের ওসমানকে তুলে ধরেছিলাম।

 সেদিন ও আমাকে বলেছিল, আমিই ওসমান। আমার শৈশব নাই। আমিই ওসমান। আমাকে অন্যায় মৃত্যুর শিকার হতে হয়। আমিই ওসমান। আমি সারা দেশে আছি। ভোলার মেঘনার পাড়ে আছি। সাজেক ভ্যালির পাহাড়ের চূড়োয় আছি। আপনি আমাকে খুঁজবেন না স্যার। শুধু জানবেন আমি সবখানে আছি। যেখানে হাত রাখবেন সেখানেই আমার বুকের ধুকপুক শব্দ পাবেন।

 আমি নিজেকে বলেছিলাম, জুয়েল আমার ভেতরে আমি তোকেও দেখি। আমার ভেতরের ওসমান আর মশিরুলের তুই শিক্ষক। তুই ওদেরকে শেখাচ্ছিস। আমি তাঁদের দেয়ালের দিকে তাকালে দেখতে পাই বিশাল প্রান্তরে দৌড়ে যাচ্ছে জুয়েল। ওর কাঁধে একটি ঝোলা। আমি জানি ওই ঝোলায় বেলফুলের হত্যাকান্ড আছে, ওসমানের মৃত্যু আছে, মঈনের নৃশংস মৃত্যু আছে, নিশাতের কষ্টের দিন আছে, মাইশার পাখি খোঁজার চোখ আছে। জলফুর কবর আছে। আর কি?

 তখন ফায়জা এসে আমার পেছনে দাঁড়ায়। বলে, আমি জুয়েলকে বললাম, তোর স্যার আর আমি সারা দেশের পথে পথে ঘুরব, তুই যাবি আমাদের সঙ্গে? ও কি বললো জানো?

 কি? আমি অন্যরকম কিছু শোনার জন্য ফায়জার দিকে তাকিয়ে থাকি। ফায়জা আমার উপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে জানালার বাইরে তাকায়। কন্ঠস্বর তীক্ষ্ণ করে বলে, ও বলেছে, হ্যাঁ, আমি পথে হাঁটতে যাব। আমিতো পথেরই ছেলে। ফুটপাতে বসে মানুষের জীবন সেলাই করি।

 আমি আঁতকে উঠে বলেছিলাম, কি বললি?

 জুয়েল ভারী কন্ঠে বলেছে, মাগো আমি মানুষের জীবন সেলাই করি। আমি তো স্যারের স্যান্ডেল সেলাই করিনি শুধু। জীবন সেলাই করেছিলাম বলেইতো স্যারের ঘরে ঢুকতে পেরেছিলাম। আপনার সঙ্গেও আছে আমার জীবন সেলাইয়ের কথা।

 ফায়জা একমুহূর্ত চুপ থেকে বলে, ও ভীষণ মেধাবী ছেলে। পড়ালেখার বাইরে চিন্তার কত যে তীক্ষ্ণতা থাকতে পারে ও আমার কাছে সেই মগজ। তোমাকে থ্যাঙ্কু সক্রেটিস। তুমি ছেলেটিকে আমাদের একজন করেছিলে।

 আমি ফায়জাকে বলি, এখন আমাদের ব্যাগ গোছাতে হবে। তুমি কি রেডি?

 হ্যাঁ রেডি। কি নেবে? তুমি বলতে থাকো, আমি ঢুকিয়ে ফেলি।

 ঢোকাও একুশের ভোর। প্রভাতফেরী। গানের সুর। আলতাফ মাহমুদ। উনসত্তরের গণআন্দোলন। শহীদ আসাদ, মতিউর। সাতই মার্চের ভাষণ। ছাব্বিশে মার্চের সকাল। লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন। স্টপ জেনোসাইড। জহির রায়হান। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায়। মৃত্যুদন্ড কার্যকরের দৃশ্য।

 এসব নিয়ে আমাদের মানুষের মাঝে যেতে হবে। কিন্তু কতদিন হাঁটব?

 আমি দু’হাত উপরে তুলে বলি, জনমভর।

 তখন দরজায় টুকটুক শব্দ হয়। ফায়জা আমার দিকে তাকিয়ে বলে, বোধহয় জুয়েল এসেছে।

 আমারও তাই মনে হয়। আমি ইতিহাস-ভরা ব্যাগ কাঁধে নিয়ে দরজা খুলতে যাই। দেখতে পাই জুয়েল দাঁড়িয়ে আছে। ফায়জা ওকে যে কাপড়ের ঝোলাটি দিয়েছিল সেটি ওর কাঁধে। ঝোলাটি শক্ত করে চেপে ধরেছে আর এক হাত দিয়ে।

 আমি ওকে বলি, ভেতরে আয়।

 ও বলে, না। আমাদেরতো যেতে হবে।

 ফায়জা আমার হাত ধরে বলে, চলো।

*****

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *