হেঁটে যাই জনমভর – ৬

 ধীরে ধীরে ও উঠে বসে। গেট ধরে উঠে দাঁড়ায়। বুঝতে পারে, শরীর খানিকটুকু ধাতস্থ হয়েছে। কোথাও মানুষের কণ্ঠস্বর শোনা যায় না। এমনকি নিজের ভেতরের স্বরটিও স্তব্ধ হয়ে আছে। কারণ ও নিজেকেই এখন আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে। চারদিকে তাকিয়ে বিব্রত বোধ করে। বুঝতে পারে, নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া খুবই কঠিন। যদি সেই বোঝাপড়া নিজেকে ফাঁকি না দেওয়া থেকে উঠে আসে। মানুষের ওপর অধিকার খাটানোর আগে মানুষকে বুঝতে হবে। তার ভালো-মন্দের সঙ্গে নিজের অবস্থানকে এক করতে হবে। নইলে অধিকার ফলাও করা জুলুমের শামিল হয়।

 এভাবে নিজেকে কিছুক্ষণ শাসিয়ে ও নিজের ঘরে যায়। তালা খোলে। ঘরে ঢুকে সুইচ টেপার সঙ্গে সঙ্গে এক শ পাওয়ারের বাল্বটি দপ্ করে জ্বলে উঠে নিভে যায়। ও বুঝতে পারে, বাল্বটি ফিউজ হয়ে গেল। অন্ধকার হাতড়ে কাপড় বদলায়। তারপর বিছানায় যায়। অল্পক্ষণ শুয়ে থেকে উঠে পড়ে। ঘুম আসছে না। শুয়ে থাকতেও ভালো লাগছে না। জানালা খুলে চেয়ার টেনে বসে থাকে। কৈশোর হারিয়ে যাওয়া বালকটি এখন ওর মাথায়। ওর চোখ, ওর নাক, ওর কপাল, গাল, চুল ইত্যাদি সবুজ হয়ে গেছে এবং ও একটি ব্যাঙ হয়ে অল্প পানিতে লাফাচ্ছে। ওর স্বপ্ন নেই। বেঁচে থাকা অর্থহীন। এভাবেই কি ও বড় হবে? নাকি ওকে বাঁচানোর কোনো উপায় বের করা যাবে? ওসমান আলী চেয়ারে মাথা ঠেকায়।

ঘরের ভেতর নেংটি ইঁদুর ছোটাছুটি করছে। কিচকিচ শব্দে বোঝা যায় ওর ছুটে বেড়ানোর আনন্দ। একসময় ঘুম আসে ওর। চেয়ারে বসেই ঝিমোয়। তারপরও ওর বিছানায় যেতে ইচ্ছা করে না। অনেক দিন বিছানার চাদরটি ধোয়া হয়নি। নোংরা হয়ে আছে। রাতের অন্ধকারে নোংরা চাদর বোঝা যায় না। আসলে ও নিজেকে গোছাতে পারছে না। প্রবল অস্থিরতা ওকে কুরে খাচ্ছে। ও বদরুলকে নিয়ে সাজেক ভ্যালি যাবে বলে ঠিক করেছে। জলফুকে নিয়ে যাবে কি? নিতে চাইলেই কি নেওয়া যাবে? ও কি যেতে রাজি হবে? ওসমান আলি ক্লান্তি বোধ করে। মনে হয়, ইঁদুরটা দরজার ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে গেছে। কিচকিচ শব্দ নেই অনেকক্ষণ। মশা ভিড় করেছে। দুই হাতে মেরেও শেষ করা যাচ্ছে না। রাতে আর বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে না। কাল একটি বাল্ব কিনতে হবে। ও ভাবে, এসব ভাবনার মানে কী? বুঝতে পারে, আসলে ও নিজেকে গোছাতে পারছে না। বড় কষ্ট। এই কষ্টের রাত ওর স্মৃতি। কোনো দিনই মাথা থেকে নামবে না। ও হাই তোলে। সোজা হয়ে বসে। বাথরুমে যাওয়ার জন্য ঘরের বাইরে আসে। মনে হয়, রাতের আর বেশি বাকি নেই। খুবই অস্পষ্টভাবে দিনের আলো ছড়াচ্ছে চারদিকে। ওসমান এই প্রথম নিজের তারুণ্যের জন্য ব্যথিত হয়। ভাবে, শুধু লেখাপড়া শেখাই যথেষ্ট নয়, যদি না তার সঙ্গে আরো নানা কাজ যুক্ত করা যায়। এই মুহূর্তে জলফু ওর সামনে দাঁড়িয়ে আঙুল নাড়াচ্ছে। ওকে সবুজ ব্যাঙ ডাকা বা এক-দুবেলা ভাত খাওয়ানো যথেষ্ট নয়, যদি না ওর সবটুকু দেখভাল করা যায়। ওসমান বাথরুমের দরজা বন্ধ করতে করতে মনের ভেতরে নিজের জন্য করুণার পাহাড় গড়ে। বলে, হায় বেঁচে থাকা।

 তিন দিন পরে দিনের বেলায় জলফুর খোঁজে কবরস্থানের গেটে গেলে জমিরুদ্দিনের সঙ্গে দেখা হয়। ওর জন্য একটা টান লাগছিল সেদিনের পর থেকে। জমিরুদ্দিন ওর দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। ও অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, কী হয়েছে জমির ভাই?

 আপনে তো রাইতে আসেন, আইজ দিনের বেলা আসছেন ক্যান?

 জলফুকে খুঁজতে। ভাবলাম ওকে দেখে যাই। ও কেমন আছে?

 কেমন আর থাকব? ভালাই আছে। কেমন আছে আপনেরে দেহাই। আহেন।

 জমিরুদ্দিন কবরস্থানের ভেতরে ঢোকে। নতুন কবরের পাশে দাঁড়িয়ে কেউ কেউ দোয়া পড়ছে। কোথাও একজন নারী কেঁদেকেটে নিজের ভেতরটুকু নিঃশেষ করছে। বড় নিঃশব্দ কান্না। তারপরও ফোঁপানির শব্দ শোনা যায়। ওসমান চারদিকে তাকায়। কোথাও জলফু নেই। জলফু ওকে দেখলে দৌড়ে কাছে আসত। ও ঘাড় ঘুরিয়ে জমিরুদ্দিনকে বলে, জলফু তো এখানে নেই। দেখছি না তো?

 আছে। আসেন।

 জমিরুদ্দিন নির্বিকার কণ্ঠে কথা বলে। যেন এই আবাসস্থলে যারা আছে তারা সবাই ওর চেনা। ও কখনো কাউকে হারিয়ে যেতে দেখেনি। ও জানে এখানে যারা আছে, তারা সবাই ভালো আছে। শান্তিতে আছে। একজীবনে যারা কষ্টভোগ করেছে তাদের সেই জীবন আর নেই। সব কিছু অবসানের পরে এখন তাদের অপার শান্তি। জমিরুদ্দিন ওর আগে আগে হাঁটছে। শেষ মাথায় গিয়ে নতুন কবরটি দেখিয়ে বলে, এই যে এইহানে আপনার ব্যাঙ। ঘুমাইতাছে। বেওয়ারিশ লাশ হইয়া আসছে।

 মানে! ওসমান হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। কাঁদতে কাঁদতে বসে পড়ে কবরের ধারে। জমিরুদ্দিনও বসে। হাত বাড়িয়ে কবরের মাটি ছোঁয়। ওসমানের কান্নার বেগ কমে এলে বলে, কেউ অর লাগি কান্দে নাই। আপনেই পত্থম।

 ওসমান আলী দুই হাতে চোখ মোছে। তারপর মৃদুস্বরে বলে, ও তো বেওয়ারিশ লাশ হবেই,ওর কেউ না থাকতে পারে, কিন্তু ওর তো এভাবে মৃত্যু হওয়ার কথা নয়। কোথায় পাওয়া গেছে ওর লাশ?

 কামরাঙ্গীচরের খানাখন্দে। মানুষজন পুলিশরে খবর দিলে হেরা অরে মর্গে লইয়া গেছে। আধা বেলা ওইখানে পইড়া ছিল। হেরপর আঞ্জুমান মফিদুল ইসলামের গাড়িতে কইরা এখানে আইনলে আমি অরে চিনা ফালাই।

 তুমি কি আঞ্জুমান মফিদুল ইসলামের লোকদের বলেছিলে যে আমি ওকে চিনি। ও আমাদের জলফু। পোলাটারে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া একজন ছাত্রও চেনে। ওরে অনেক আদর করে।

 এবারও জমিরুদ্দিন নির্বিকার কণ্ঠে বলে, না কাউরে কিছু কই নাই। কইয়া কী লাভ। মইরাই তো গেছে। অহন ওরে চেনা না চেনা সমান।

 কেউ তাকে চিনত এটা প্রমাণ হতো। লোকেরা জানতো যে এই শহরে ওর কেউ আছে। ও পরগাছা না।

 থোন, এইসব ধানাইপানাই। পথের পোলার আবার পরিচয়। তয় অরে আমি যত্ন কইরা ধোয়াইছি। কাফনের কাপড় পরাইছি। আতর মাখাইয়া দিছি। নিজে অরে কবরে নামাইছি।

 ওসমান আবার কাঁদতে কাঁদতে জমিরুদ্দিনের গলা জড়িয়ে ধরে বলে, শেষ বেলায় ও কারো যত্ন পেয়েছে। এটুকুই আমার জন্য সান্ত¡না।

 না, আপনের লাগি কনু সান্ত¡না নাই। পথের পোলারে ভালোবাসতে কে কইছে আপনেরে?

 ওসমান আলী সরাসরি তাকিয়ে বলে, তুমি কি আমাকে আরো দুঃখের কথা বলবে?

 জমিরুদ্দিন অন্যদিকে তাকায়। ওসমান উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলে, তুমি কি কাউকে সন্দেহ করো? কে ওকে মারতে পারে?

 হেইডা আমি ক্যামনে কমু। জানি না।

 তোমাদের আশপাশের কেউ? তুমি কি জানো ও কার সঙ্গে থাকত?

 জমিরুদ্দিন নির্বিকার কণ্ঠে বলে, না, জানি না।

 নাকি বলতে চাও না জমির ভাই?

 আপনে আমারে পুলিশের মতো জেরা করেন ক্যান? আপনে কি পুলিশ? যত্তসব। চলেন বাইরে যাই।

 ওর শরীরে কোথাও আঘাত ছিল জমির ভাই?

 জমিরুদ্দিন চুপ করে থাকলে ওসমান আবার বলে, কোথায় কোথায় মেরেছিল জানলে-

 আপনে তো অর কেউ না। এত কথা জিগান ক্যান? খবরদার আর কিছু জিগাইবেন না।

 শুধু বলো ওর মাথা কি ফাটিয়ে দিয়েছিল?

 না, মাথা ঠিক আছিল। চেহারা দেইখা মনে অইছিল ও ঘুমাইয়া আছে।

 ওর বুক-পিঠ ঠিক ছিল?

 হ, ঠিক ছিল। আপনে আমারে আর কিছু জিগাইবেন না। চলেন, বাইরে যাই।

 তোমার মুখ দেখে মনে হচ্ছে তুমি আমার কাছে কিছু লুকাচ্ছ। তুমি আমাকে তোমার শেষ কথাটা বলো জমির ভাই। জলফুর কেন মরতে হলো?

 জমিরুদ্দিন চারদিকে তাকিয়ে নিচুস্বরে বলে, শেষ গোসল দিবার সময় আমি দেইখলাম ওর অন্ডকোষ থেঁতলানো। সব কিছু থেঁতলানো। যেন কেউ মুগুর দিয়া থেঁতলাইছে। না হইলে হাতুড়ি দিয়া। না হইলে ইট দিয়া থেঁতলাইছে।

 ওহ মাগো! ওসমান আলী দুহাতে মাথা ঝাঁকায়। জমিরুদ্দিন নির্বিকার কণ্ঠে বলে, আর কিছু জিগাইবেন? জিগান? আইজ বেহানে পানি খান নাই? এত জ্বালা ক্যান?

আমি হোটেলের ওই লোকটাকে পুলিশে দেব।

 আপনের পরমান কী? কিছুই পরমান কইরতে পাইরবেন না। পড়ালেহা করতাছেন পড়ালেহা শ্যাষ করেন। যেইটা মরছে হেরে শান্তিতে থাকতে দ্যান। আমি যত দিন বাঁইচা থাকমু তত দিন ওই কবরে দোয়া পড়মু। বেশি দিন তো ওইডা ওর একলার কবর থাকব না। আবার কারো কবর হইব ওই কবরে। যাই। দুনিয়াদারি আন্দার লাগে।

 ওসমান আলী একা একা আবার ফিরে আসে কবরের কাছে। বসে দোয়া পড়ে। শেষে বলে, তুই জান্নাতবাসী হবি রে সবুজ ব্যাঙ। আল্লাহ তোকে বেহেশতবাসী করুক।

 আত্মীয়স্বজনহীন এই ঢাকা শহরে একা একা বাস করতে থাকা ওসমান আলীর মনে হয়, আজ বুঝি ও নিজের কৈশোরও হারাল। কাকে বলবে এসব কথা? কার সঙ্গে ভাগাভাগি করবে? কারো সঙ্গে ভাগাভাগি করার ইচ্ছা নেই। সবাই নিজ নিজ চিন্তায় ব্যস্ত। ও আবার নিজের মধ্যে গুটিয়ে যায়। মন দিয়ে ক্লাস করে। স্যারদের লেকচার শোনে। ফিরে এসে দোকানে গিয়ে চা খায়। টিউশনি করতে যায়। তার পরে নিজের লেখাপড়া। কোনো ছেলে নোট চাইলে দেয়। পড়াও বুঝিয়ে দেয়। এত কিছুর পরও ওসমান নিজের সময় কাটানো মুখ বুঁজে সেরে ফেলে। মাঝে মাঝে নিজের সঙ্গে পেরে ওঠে না। যাকে দিগন্তের কাছে যাওয়ার রাস্তা পায়ে হেঁটে পার হতে হয় তার তো শক্তির অবশিষ্ট কমই থাকে। গ্রামে বড় ভাই অপেক্ষা করছে ওর পরীক্ষা পাসের খবরের জন্য। চাকরি পেলে তার ছেলেমেয়ের পড়ালেখা হবে, এই আশায় দিন গুনছে বড় ভাই। ভালো রেজাল্টের পরে ভালো চাকরি একটি অসাধারণ রেজাল্ট করলে বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি হতে পারে। এই আশায় পাঠের সময় নিজেকে আর কোনো কিছুর কাছে সমর্পণ করে না। মোবাইল বাজলেও ধরে না। মোবাইলে শুধু ওর ভাইয়ের সঙ্গে কথা হয় রোজ। মাঝে মাঝে মিরপুর থেকে ফোন আসে। যেদিন শাওনের পড়তে ইচ্ছে করে না সেদিন ও যেতে না করে। কিন্তু ওর কথা শুনে না গেলে চলবে না। ওর মা একটা খাতা দিয়েছে। সেই খাতায় সাইন করতে হয়। না গেলে সেদিনের টাকা কাটা হয়। তারপরও ও টিউশনিটা ছাড়ে না। কারণ অন্য জায়গার তুলনায় টাকার অঙ্ক বেশি। ওর প্রয়োজন মেটানোটাই ওর উদ্দেশ্য।

 গত বছর একটা প্যান্ট-শার্ট পরে ক্লাস করেছে। এখন আরো দুটো প্যান্ট-শার্ট হয়েছে। ওসমান আলী ঘরের দরজা বন্ধ করে দাঁড়ালে মনে হয়, ঘরের কাচের দেয়ালে ফুটে আছে ওর ফেলে আসা জীবনের সবটুকু। দেয়ালে ভিডিও চলছে। শোনা যাচ্ছে বাবার কণ্ঠস্বর, বাবা রে তোর জন্য কিছু করতে পারলাম না। তুই আমারে মাফ করে দিস। ও তাকিয়ে থাকে বাবার দিকে। ভ্যানচালক বাবার সাধ্যই বা কী। মানুষের সীমিত সাধ্যকেও স্যালুট করা উচিত। তাতে মানুষকে হেয় করা হয় না। মানুষকে হেয় না করতে শেখা উচিত সবার। ওসমান দেখতে পায় মাকে। কোমর বাঁকা করে ইটের ঝুড়ি টানছে। পোঁটলায় করে নিয়ে আসা রুটি-গুড় বের করে দিয়ে ওকে বলছে, বাবা এইটুকু খা। সইন্ধ্যাবেলা ভাত রাঁধুম। ও ভুলে যেত, দুপুরে একবার খাবার সময় হয়। সে কথা ভুলে থাকার জন্য মা ওকে কাছে টেনে আদর করে, আঁচল দিয়ে মুখ মুছিয়ে দেয়।

 ও সেদিকে তাকিয়ে বলে, মাগো আমি পরীক্ষায় ফার্স্ট ক্লাস পাব। স্যার-ম্যাডামরা বলেন, আমার খাতায় লাল দাগ দেওয়া যায় না। মাগো তোমার ইচ্ছা আমি পূরণ করব, তুমি তা দেখে গেলে না। তোমাকে আমি খুঁজব না। আমি জানি তুমি কোথায় আছ। সেখানে আমি গিয়ে বলব, দেখো তোমার ওসমু এসেছে। তোমার হাত আমার মাথার ওপর রাখো মাগো।

 খুশির হাসিতে ও নিজেকে গুঁটিয়ে নিলে কাঁচের দেয়াল সরে যায়। ছোট ঘরে অল্প পাওয়ারের বাল্ব জ্বলে। পড়ার টেবিলে বসলে দরজায় টুকটুক শব্দ হয়। ও উঠতে চায় না। কে এলো এই সময়? যখন-তখন কেউ না কেউ আসবে এটা ওর পছন্দ না। ওর একাকিত্বই তো সবার সঙ্গে ওর সঙ্গ। এই সঙ্গের উপভোগ ভাগাভাগি করা যায় না। এর আনন্দ সামনাসামনি আড্ডা দেয়ার চেয়ে কম নয়। একাকিত্বের উপভোগ মধ্যরাতে হয়, সূর্য ওঠার আগে হয়, পথে হেঁটে যেতে হয় কিংবা বাসের জানালা দিয়ে দিগন্ত দেখার সময় হয়, বইপড়ার সময়ও হয়, এমন কি ক্লাসে বসে থাকলেও আনমনা চিন্তা ওকে অন্য কোথাও নিয়ে যায়। ভাবে, এ এক গভীর আনন্দ। সামনাসামনি বসে বসে গ্যাঁজাতে হবে এটা কোনোভাবে নিছক বন্ধুত্ব না। ওই গ্যাঁজানোতে চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার হয় একেকজনের। এসব ও পছন্দ করে না। ও জানে কেউ কেউ বলে, ভ্যানচালকের পোলা তো, এই জন্য সবার সঙ্গে মিশতে পারে না। মেশার জন্য সোশ্যাল স্ট্যাটাস লাগে।

 এসব কথা ও গায়ে মাখে না। ও জানে, যে নিজের অবস্থান তৈরি করতে পারে, তার পেছনেই সার বেঁধে দাঁড়াবে সোশ্যাল স্ট্যাটাসের মানুষ। যেমন জেলের ছেলে আবদুল কালাম ভারতের রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন। তাঁর জ্ঞান দিয়ে, শিক্ষা দিয়ে জয় করেছিলেন সোশ্যাল স্ট্যাটাস। আর এখন এই সময়ে চা-বিক্রেতা বালক ভারতের প্রধানমন্ত্রী। নরেন্দ্র মোদি দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন ক্ষমতার রাস্তা। দুই পাশে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সোশ্যাল স্ট্যাটাসের লোকেরা। হ্যাঁ, সোশ্যাল স্ট্যাটাস।

 তখন দরজার শব্দ জোরে বাজে। ও বুঝতে পারে এটা বদরুলের ডাক। ও সব সময় বন্ধুত্বের অধিকার খাটায়। তখন ভেসে আসে বদরুলের কণ্ঠ ওই নেংটি ইঁদুর দরজা খোল। কী করছিস? বিদ্যার ধানের গোলা কাটছিস? দরজা খোল নেংটি ইঁদুর।

 ওসমান আলী দরজা খোলে। বদরুলকে ওর পছন্দ, খোলামেলা, প্রাণখোলা। দরজা খুলেই বলে, চেঁচাচ্ছিস কেন?

 চেঁচাবোইতো। না চেঁচালে তোর ধ্যান ভাঙে না। দরজায় তালা নেই, তার মানে তুই ঘরে আছিস। তাহলে দরজা খুলতে এত দেরি হবে কেন?

 কৈফিয়ত চাইছিস?

 চাইতেই পারি। বন্ধুত্বের ভালোবাসা আছে না? আমি কি তোর কাছে বাইরের লোক? অ্যাঁ, কি বলিস? তোর জন্য ডালপুরি এনেছি।

 আয়, ভেতরে আয়।

 তুই আমার ঘরের লোক।

 সে জন্যই তো তোর নোট পড়ে পরীক্ষায় পাস করি।

 বদরুল বিছানার ওপর পা গুটিয়ে বসে ঠোঙা থেকে ডালপুরি বের করে ওসমানকে দেয়। ওসমান ওর মুখোমুখি চেয়ারে বসে। ডালপুরি খায়, পাঁচটা ডালপুরির তিনটাই ও সাবাড় করে। খেতে খেতে বদরুল বলে, সামনের ক্রিসমাসের ছুটিতে সাজেক ভ্যালিতে যাব। তুই বলেছিলি। ভাবলাম, আমারও ওই দিকে যাওয়া হয়নি। এবার যাব। কী বলিস?

 ঠিক আছে যাব। শাওনের বাবা বলেছে, এই ছুটিতে ওরা সিঙ্গাপুরে বেড়াতে যাবে। আমি প্রায় পনেরো দিনের ছুটি পাব। এবারই যাওয়ার সময়।

 গুড। তাহলে ব্যবস্থা নেই। কীভাবে যাব, এই খোঁজখবর আমি করব। তোর টিকিটের টাকা আমি দেব।

 কেন, তুই দিবি কেন? আমি দেব আমারটা।

 তুই আমার লেখাপড়ায় হেল্প করিস। কিছু না বুঝলে বুঝিয়ে দিস। তুই আমাকে নোট দিস। সেই নোট পড়ে আমি পরীক্ষায় পাশ করি। এইটুকু খাতির তো আমি তোকে করবই। বাপের ভাঁড়ার থেকে পড়ালেখার খরচ পাই। আমার চিন্তা কী।

 বদরুলের এই কথায় আনমনা হয়ে যায় ওসমান। কেউ যদি কারো বাবার কথা বলে, তখন উদাস হয়ে যায় ও। বাবার সঙ্গে সম্পর্কটা তৈরি হওয়ার আগেই বাবা ওকে ছেড়ে চলে গেছে। বাবার গল্প ঠিকমতো জমেনি ওর জীবনে।

 কী রে, চুপ মেরে গেলি যে?

 সাজেক ভ্যালি তো অনেক দূর। যাব কি না ভাবছি।

 ভাবাভাবির কিছু নেই। যেতে হবে। আমি বাসের টিকিট কাটতে গেলাম। তুই কি ঘরে থাকবি?

 হ্যাঁ। ও নির্বিকার জবাব দেয়।

 থাক। তোর সঙ্গী-সাথি তো বই। তোর একটা ল্যাপটপ থাকলে আরো মজা হতো।

 ইন্টারনেট? না বাপু, অত মজার মধ্যে আমি নেই। যা, ভাগ।

 বেরিয়ে যায় বদরুল। ওসমান ভাবে, জলফুর জীবনে বই ছিল না, ল্যাপটপও না। জীবনের শূন্য জায়গাটা আর পূরণই হলো না। ছোটবেলায় একবার একটি রাস্তার কুকুরকে ও পথের ধারে কাতরাতে দেখেছিল। কুকুরটির জন্য এক টুকরো মাংস খুঁজতে বাজারে গিয়েছিল। পায়নি। বাড়ি বাড়ি গিয়েছিল। পায়নি। ফিরে এসে দেখেছিল, কুকুরটি মরে গেছে। তখন মনে হয়েছিল, একটি প্রাণীর জীবনের শূন্য জায়গা পূরণ করা হলো না। ও টেবিলের ওপর রাখা একটি বই টেনে নেয়। পাঠ্যবই না। সাধারণ জ্ঞানের বই। বিশ্বের বড় মানুষের জীবনী আছে সেখানে। যেখানে একটি বাণী এমন : ‘রিয়াল লিভিং ইজ লিভিং ফর আদারস।’ জলফুর মৃত্যু যখন ওর সামনে আসে, তখন মনে হয় বেঁচে থাকা অর্থহীন। কিছুই তো করা হলো না এই জীবনে। না মানুষের জন্য, না প্রাণীকুলের জন্য। বেঁচে থাকার পরিসর তো কম হয়নি। আর কবে ও রিয়াল লিভিংয়ের মর্ম বুঝবে?

 ওসমান পড়ার টেবিলের সামনের খোলা জানালা দিয়ে তাকালে নিজেকে এক ধূসর পৃথিবীর বাসিন্দা ভাবে। তরুণ জীবনের এই পর্যায়ে বড় অর্জনের কোনো চিহ্ন নেই। আর কত দিনে এমন একটি পর্যায়ে পৌঁছাবে, যখন বলতে পারবে কিছু তো করতে পেরেছি আমার এতটুকু সাধ্যই ছিল।

 ওসমান আর বদরুল এখন সাজেক ভ্যালির রাস্তায়। গতকাল খাগড়াছড়িতে এসেছে। রাতে একটি হোটেলে ছিল। পরদিন চাঁদের গাড়ি ভাড়া করে বদরুল। ও এমনই ছেলে। যখন যা মাথায় ঢোকে তখন তা করেই ছাড়ে। অনেকে নিষেধ করেছিল যেতে। বলেছিল, দুর্গম এলাকা। পাহাড়ি-বাঙালি মারামারি লাগলে জীবন নিয়ে ফিরে আসতে পারবে না। বদরুল হাসতে হাসতে বলেছিল, পাহাড়ের একটি ঝরনার ধারে মারা পড়লে মন্দ হবে না। ঝরনার স্বচ্ছ পানিতে আমার শেষ গোসল হয়ে যাবে।

 মাজেদ খোঁচা দিয়ে বলেছিল, গোসল হবে, কিন্তু কবর হবে না। কয় দিন পড়ে থেকে কাদায় মিশে যাবি। নইলে বন্য প্রাণী খাবে তোকে?

 আমাকে খেয়ে প্রাণীকুলের পেট ভরলে মন্দ কী? ভাবতে পারব যে কারো খিদে মিটিয়েছি।

 বানর একটা।

 মাজেদ ক্রুদ্ধ স্বরে চেঁচিয়ে উঠেছিল।

 হা-হা হো-হো করে হেসেছিল আশপাশে দাঁড়িয়ে থাকা অন্যরা। হেসেছিল ওসমান আলী নিজেও। বলেছিল, ফিরতে যদি না পারি তাহলে অন্যের জন্য জায়গা ছেড়ে দেওয়া হবে। আমরা যারা ফার্স্ট ক্লাসের লাইনে আছি, সেখানে আর একজন ঢুকতে পারবে।

 ওরা বলেছিল, দুটোরই মাথা গরম হয়ে গেছে। ওদের সঙ্গে কথা বলা বৃথা। চল, সরে পড়ি। রমনা পার্কে গিয়ে ঝালমুড়ি খেয়ে আসি।

 ওরা চলে গেলে দুজনেরই মনে হয়েছিল, ওরা অ্যাডভেঞ্চার বোঝে না।

 এখন এই পাহাড়ি পথের সৌন্দর্য অভিভূত করে দুজনকে। বাঘাইহাট আর্মি চেকপোস্ট পার হতে হলো। প্রথমে তারা যেতে দিতে চায়নি। বলেছিল, এই দুর্গম এলাকায় হারিয়ে গেলে আমাদের খুঁজে পেতে কষ্ট হবে।

 বদরুলের একটাই উত্তর আমাদের খুঁজবেন না। ফিরতে না পারলে বুঝবেন, গভীর অরণ্যের কোথাও ঢুকে ছিলাম। বুনো হাতির পায়ের নিচে পিষ্ট হয়েছি। আমাদের জীবনের দায় আমরা অন্যের ওপর চাপাব না।

 ব্রেভো। ওরা হাসতে হাসতে বদরুলের পিঠ চাপড়ে ওদের ছেড়ে দিয়েছিল। ওসমান বলেছিল, আমাদের জন্য দোয়া করবেন। ভালোয় ভালোয় যেন ফিরে আসতে পারি।

 বদরুল ক্রেডিট নেয়ার ভাঙ্গিতে বলে, আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। ওর নাম ওসমান আলী। খুব মেধাবী ছেলে। ফার্স্ট ক্লাস পাবে। বিভাগের টিচার হবে। ও আমাদের গর্ব।

 একজন হাসতে হাসতে বলে, আপনি আমাদেরও গর্ব। একজন শিক্ষকতো ছাত্রছাত্রীদের অভিভাবক। শিক্ষার অভিভাবক।

 দু’জনে চমকিত হয়ে তার দিকে তাকিয়েছিল। দু’জনের চোখের দুষ্টি তার হাতে রাইফেলের ওপর স্থির হয়ে গিয়েছিল। ওসমানের প্রবলভাবে মনে হয়েছিল জহির রায়হানের স্টপ জেনোসাইডের কথা। বিশ্বের সব মানুষইতো জানে ওই যন্ত্রটি দিয়ে জেনোসাইড সংঘটিত হয়। সাজেক ভ্যালির আসাধারণ নিসর্গে ও জহির রায়হানকে খুঁজবে। বলবে, আপনি আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে উচ্চস্বরে বলুন, স্টপ জেনোসাইড।

 দাঁড়িয়ে থাকা চারজন সেনা ওর সঙ্গে হ্যান্ডশেক করে বলেছিল, কংগ্রাচুলেশনস।

 ও নিঃসঙ্গতার ভারী কন্ঠে বলেছিল, আপনাদের অভিনন্দন নিচ্ছি। তবে এখনো পথ বাকি আছে। যেতে হবে শেষ মাথায়। আমি জানি না কতটা যেতে পারব।

 পারবেন, পারবেন। পুরো পথই যেতে পারবেন।

 ওদের রাইফেলের নল আকাশের দিকে উঠে গিয়েছিল।

 আচ্ছা আসি।

 ওসমানের বিষণ্ণ কণ্ঠস্বর পাহাড়-বেষ্টিত এলাকায় গুমগুম করে। হয়তো কোথাও গিয়ে আছড়ে পড়ে কিংবা ঝরনার জলে ভেসে যায়। যে জ্বলে ব্যাঙ আছে, পোকা আছে, পতনের শব্দ আছে।

 বিভিন্ন চেকপোস্ট পার হয়ে চাঁদের গাড়ি চলতে শুরু করে। কখনো ওপরের দিকে ওঠে, কখনো নিচের দিকে যায়। বদরুল বলে, ছোটবেলায় মুখস্থ করেছিলাম যাওয়া-আসার পথের ধারে। এখানে বলতে হবে ওঠানামার পথের ধারে। ওর হাসির সঙ্গে নিজের হাসি মেলাতে পারে না ওসমান। অপলক তাকিয়ে থাকে। এত অপরূপ প্রকৃতি এ দেশেরই সম্পদ, এখানে না এলে জানা হতো না। অনেক দূরে দূরে দু-একটা বাড়ি দেখা যায়। বাড়ি ঠিক নয়, কুঁড়েঘরের মতো বসবাস উপযোগী। পরিচ্ছন্ন। সুন্দর। তবে লোক চলাচল কম। ওরা জানে, সাজেক ভ্যালিতে লুসাইরা থাকে। বড় দা নিয়ে জঙ্গলে মরা ডাল কাটতে দেখা যাচ্ছে দু-চারজনকে। গাড়ি যখন পাহাড় বেয়ে ওপরে ওঠে, তখন মনে হয় হাত বাড়ালেই আকাশ ছোঁয়া যাবে। ওরা এক জায়গায় গাড়ি থামিয়ে চাঁদের গাড়ির ছাদে উঠে বসে। গাড়ির ভেতরে বসে যে দৃশ্যটি দেখা যাচ্ছিল ছোট আয়তনে, ছাদে ওঠার ফলে তার আয়তন বিশাল হয়ে যায়। দুজনের চোখের পাতা পড়ে না যেন।

 কাছের-দূরের ছোট-বড় সব পাহাড়ের মাথায় তুলোর মতো মেঘ জমে আছে। ছোটবেলায় শুনেছিল তুলোর মতো মেঘ, বিশেষ করে শরতকালে ভেসে যায় আকাশে, সেইসব মেঘ এখন ওদেরক চারদিকে। মনে হয় হাত বাড়ালে ছোঁয়া যাবে, মাথার ওপর বসে ভিজিয়ে দেবে চুল। বদরুল গলা ছেড়ে গান গাইছে। ওসমান ওর গানে কান দেয় না, ভাবে এখানে চোখের দাবি বেশি। এই দৃশ্য না দেখে মরে যেতে হলে জীবনের আফসোস ঝুলে থাকতো বাড়ির কাছে তেঁতুল গাছে। ভাবতেই দমফাটা হাসিতে নিজেকে ভরিয়ে তোলে ওসমান। হারানো শৈশবের জন্য ওর আর দুঃখ থাকে না।

 বদরুল ঘাড় ঘুরিয়ে বলে, হাসছিস যে?

 পথের ধারের বাচ্চাদের দেখে নিজের কথা মনে হলো। ভাবলাম, ওদের মধ্যে আমি আছি। ওদের দেখে নিজের শৈশব খোঁজা আমার আজ থেকে শেষ হলো।

 ঠিক বলেছিস। আমারও মনে হয়েছে ওদের মধ্যে আমি আছি। ভাবতে ভালোলাগছে যে দূর থেকে গাড়ির শব্দ শুনে ওরা ছুটে আসে রাস্তার পাশে, তারপর হাসিমুখে হাত নাড়ে। দারুণ দৃশ্য।

 ওসমান অভিভূত কন্ঠে বলে, এখানে না এলে আমি আমার শৈশব হারানোর দুঃখ ভুলতে পারতাম না। হায়, প্রিয় সাজেক। হায় আমার মাতৃভূমি।

 ওসমানের দু’চোখ বেয়ে পানি গড়ায়। ওর পানিভরা দৃষ্টি ছুঁয়ে থাকে পাহাড়ের মাথা। যেন শিশুদের মাথা ওই পাহাড়সমান উঁচু। উপর থেকে নিচ থেকে ওর বলছে, বেড়াতে এসেছ আমাদের কাছে। তোমাদেরকে স্বাগতম। ওসমান বিড়বিড়িয়ে বলে, স্বাগতম ছোটরা, তোমরাই আমি। তোমারে কাছের কেউ। ভালোবাসা নাও, মেঘভরা ভালোবাসা।

 চাঁদের গাড়ি যেখানে এসে থামে, সে জায়গার নাম রুইলুইপাড়া। খাগড়াছড়ি ছাড়ার পরে ওরা পেরিয়ে এসেছে দীঘিনালা, বাঘাইহাট, মাসালাং বাজার। প্রায় দুই হাজার ফুট পাহাড়ে উঁচুতে রুইলুইপাড়া। দূরে দূরে আদিবাসীদের বসতি। ছবির মতো উপত্যকা। এখানে দাঁড়িয়ে মেঘের দিকে তাকালে মনে হয় ওগেলো মেঘ নয়, নদী কিংবা সরোবর – ঝিল কিংবা জলাভূমি। ও ঢাকা থেকেই জেনে এসেছে যে বেশি উঁচু পাহাড়গুলো রাঙামাটির সাজেক ইউনিয়নের নয়, মিজোরামের সঙ্গে যে সীমান্ত টানা আছে সেই মিজোরামে। উপর থেকে তাকালে সীমান্ত মুছে যায়, দাঁড়িয়ে থাকে মানুষের বেঁচে থাকার অবিস্মরণীয় জীবন-সত্য। বলতে চাই পৃথিবীজুড়ে সীমান্ত নেই। মানুষই এক, মানুষই সীমান্ত, মানুষই দেশ। আবার হা-হা করে হাসি। ভাবি, এমন আবাস্তব চিন্তাই বা কেন করব। দূরের পাহাড়ে, সীমান্তের ওপারের পাহাড়ের ঘরবাড়ি, ঝরণা, গির্জা দেখা যাচ্ছে। ছোট আকারের মানুষের চলাফেরা দেখতে পাচ্ছি। জানি ওখানে গান আছে, নিজের ভাষার গান। নিজেদের সঙ্গীত। মানুষের এই বৈচিত্র্য নিয়েইতো এক হতে হবে। বলতে হবে, উৎসব যার যার, মিলন সবার। উৎসবের মিলন মানুষের প্রাণের টান।

 বদরুল ওসমানে হাত ধরে টেনে বলে, হাঁ করে তাকিয়ে আছিস যে? এখানে এলে দেখা ফুরোবে না রে। দেখে শেষ করা যায় না। ওই দেখ, আমার বন্ধু অহন আসছে।

 অহন? ওসমান ভুরু কুঁচকে তাকায়। এখানে পরিচিত কাউকে পাওয়া যাবে তাতো তুই বলিসনি?

 বদরুল কপাল উঁচিয়ে বলে, তোকে সারপ্রাইজ দেব বলে বলিনি। নতুন জায়গায় বেড়ানোর আনন্দের মাত্রা বাড়াতে চেয়েছি।

 ও কিছু বলার আগে অহন এসে কাছে দাঁড়ায়।

 ওসমানের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে, গুড মর্নিং। আমি অহন। এখানকার প্রাইমারি স্কুলে পড়াই। বদরুল আমার বন্ধু।

 গুডমর্নিং অহন। আপনার কথা বদরুলের কাছে শুনেছি।

 বদরুল ওকে জড়িয়ে ধরে বলে, তুই কেমন আছিস অহন?

 ভালো আছি। দিন কেটে যায়। চল যাই।

 ওসমানের দিকে তাকিয়ে বদরুল বলে, আমরা ওর বাড়িতে দুই রাত থাকব। ওর বাবা-মা-দাদু কংলাকপাড়া গেছে। বাড়িতে ও একা।

 বেশ মজা, আমরা অহনের অতিথি। নিজেরা যা পারি ব্যবস্থা করে খাব, বাড়ির কাউকে ডিস্টার্ব করা হলো না।

 খুশিমতো লাফাতে-ঝাঁপাতে পারবি। দৌড়াতে পারবি। অহন গিটার বাজায়। রাতভর ওর গিটার বাজনা শুনতে পারবি। বাজনায় এমনই মুগ্ধ হয়ে যাবি যে ঘুম আসবে না। নিজও তাল ঠুকবি।

 ব্যস অনেক পাওয়া হয়েছে। এখানে এসে আমার জীবন ধন্য।

 ওসমান দু’হাত উপরে তুলে নিজের আনন্দ প্রকাশ করে। দ্রুতপায়ে হেঁটে যায় পাহাড়ের কিনারে, নিচের দিকে তাকিয়ে থাকে। প্রকৃতির এই সৌন্দর্য দেখে ভালোলাগার প্রকাশ ওর কাছে অবান্তর মনে হয়। তাকিয়ে থাকটাই একমাত্র সত্য। চোখ ফেরানোর উপায় নেই। কিন্তু বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা সম্ভব হয় না। সৌন্দর্যের সবটুকু চোখে রেখে আবার ফিরে আসে। বলে, অহন তোমার বাবার নাম কি?

 বাবার না ক্ষান্তিময় লুসাই। মা রোজলিনা। আমরা তিন ভাইবোন। আমার দিদি বড়। আমি মেজো। আমার ছোট ভাই রাঙামাটিতে বি.এ. পড়ে। বদরুল হাসতে হাসতে বলে, হ্যাপি ফ্যামিলি।

 হ্যাঁ, আমার হ্যাপী ফ্যামিলি।

 তুই বিয়ে করবি না, অহন? প্রেমে পড়িসনি?

 প্রেমে পড়ার পর্ব শেষ করেছি। মাইসাদের বাড়ি কংলাকপাড়ায়।

 বিয়ে কবে করবি তাই বল।

 ডেট ঠিক হয়নি। হলো তোদের জানাব।

 আমরা আসব। ওসমান তালি দিতে দিতে বলে। তোমাদের বিয়ের উৎসব হবে অন্যরকম। বাঙালিদের বিয়ের উৎসবের মতো না। এই উৎসব দেখে ফিরে যাওয়া আমার অসাধারণ স্মৃতি হবে। বলতে পার সারা জীবনের সঞ্চয়। সঙ্গে থাকবে তোমার গিটারের সুর।

 অহন মৃদু হাসে। ওসমানকে কটাক্ষ করে বদরুল ফোড়ন কাটে, সবকিছুতেই তোর বেশি উচ্ছ্বাস। এখানে বসে নিজের বিয়ের কথাও ভাব।

 বদরুলের কথা উপেক্ষা করে ওসমান চারদিকে তাকাতে তাকাতে বলে, এখানে পাখি নেই কেন?

 নেই, তা নয়। আছে। তবে সবসময় দেখা যায় না।

 দেখার জন্য অপেক্ষা লাগে, না রে অহন?

 হবে হয় তো, আমি জানি না। সাজেক ভ্যালি আমার চিরকালের ভূমি। এখানকার যা কিছু তারজন্য আমার অপেক্ষা। আমি একটা একটা করে কোনোকিছু খুঁজিনা। আমার আছে এসব মিলিয়ে সব।

 ব্রেভো-হুরুরে-অহনের সব আছে।

 ওসমান হাততালি দিয়ে ওঠে। অহন চেঁচিয়ে বলে, না, সব নাই। এখানে গুলির শব্দ আছে, সেটা আমার না।

 ওসমান ঘুরে দাঁড়িয়ে বলে, কে গুলি ফোটায়?

 শুনলে বুঝবে কে ফোটায়।

 সঙ্গে সঙ্গে বদরুল চেঁচিয়ে বলে, দেখ দেখ একঝাঁক ময়না উড়ে যাচ্ছে। উহ্ কি অপূর্ব লাগছে।

 ওসমান ঘাড় উঁচু করে দেখতে দেখতে বলে, এখানে না এলে এমন সুন্দর দৃশ্য দেখা হতো না।

 অহন মৃদু হেসে বলে, শহরতো শহরই। গাড়ি-বাস-মানুষের রাস্তা এবং ধোঁয়াভরা আকাশ। ওখানে কি আর ময়না দেখা যাবে!

 আমার বাড়ি গ্রামে, সেখানেও নেই।

 সমতল ভূমিতে এত গাছ নেই রে ওসমান, কেমন করে এমন একঝাঁক পাখি উড়বে। বদরুলের কন্ঠে আফসোস।

 ঠিক বলেছিস। ওসমানের কন্ঠে আফসোস।

 তোমাদের ক্ষিদে পায়নি?

 দু’জনে একসঙ্গে বলে, পেয়েছোতো।

 আমি তোমাদের জন্য চিঁড়া ভিজিয়ে রেখেছি। আর পাকা পেঁপে আছে।

 আমাদের জন্য তোমার বেশি ভাবতে হবে না অহন। আমরা বেশ কিছু শুকনো খাবার নিয়ে এসেছি।

 আমাদের এখানে সবচেয়ে বেশি সমস্যা জল।

 বাড়িগুলো এত দূরে দূরে কেন?

 জলের জন্য। যেখানে ঝিরি আছে, তার চারপাশে মানুষ ঘর বানায়। রুইলুইপাড়া থেকে সারা দিন হেঁটে যেতে হয় কংলাক পাড়ায়। ওই যে দূরের দিকে তাকান, ওই দিকে আছে ভারতের মিজোরাম। ওখানে কয়েকটি ছোট-বড় পাহাড়ের মধ্যে কংলাক পাহাড় সবচেয়ে উঁচু। তাকিয়ে দেখ, ছোট একটি দল যাচ্ছে। ওরা ওখানে যাবে। আমার মা-বাবা, ভাই-বোনরা ওখানে গেছে। তোমরা চলে গেলে আমিও ওখানে যাব। কয়েক দিন থেকে আসব। এখন আমি তোমাদের লুইরুই পাহাড় হেডম্যানের কাছে নিয়ে যাব। আমি তাঁর কাছ থেকে তোমাদের এখানে থাকার পারমিশন নিয়েছি। তারপরও তোমাদের হেডম্যানের সঙ্গে দেখা করতে হবে। এটাই এখানকার নিয়ম।

 একটানা কথা বলে থামে অহন। তিনজনে হেডম্যানের কাছে আসে। তিনি হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করেন। বলেন, আমাদের ভ্যালিতে দুদিন থাকা আপনাদের জন্য সুন্দর হোক। আপনারা সুস্থ থাকুন। আমাদের বন-ঝরনা-পানির ফোয়ারা-পশুপাখি আপনাদের জন্য আনন্দময় হোক। অহন, ওদের আতিথ্য দেওয়ার জন্য নিয়ে যাও। বদরুল বলে, থ্যাংকু। আপনিও ভালো থাকুন।

 সবাই মিলে অহনের বাড়িতে যায়। ছিমছাম সুন্দর বাড়ি। বারান্দায় বসলে পুরো এলাকার মায়াময় দৃশ্য অভিভূত করে রাখে। ওরা অহনের জন্য আনা মিষ্টি ও শুকনো খাবার ব্যাগ খুলে বের করে। অহন বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, এত কিছু!

 তোমার পরিবারের জন্যও এনেছি। শুকনো খাবারগুলো রেখে দিলে নষ্ট হবে না। আমরা এখন কী করব অহন?

 আগে চিঁড়া-পেঁপে খাবে। তারপর আমরা মিজোরামের দিকের পাহাড়ি এলাকায় যাব। এলাকাটা বেশ নিচু। পাহাড় বেয়ে নামতে তোমাদের ভালো লাগবে।

 ওই পথে অনেক রকম গাছ আছে?

 গাছই তো এখানকার প্রাণ। তোমরা দেখে শেষ করতে পারবে না।

 কত রকম পাখি আছে?

 অনেক রকম। ময়নার ঝাঁক তো দেখলে। কখনো এক-দুই শ ময়না একসঙ্গে থাকে। মনে হবে, ওগুলো ময়না না। গাছের পাতা।

 সত্যি! ওসমান উচ্ছ্বসিত স্বরে বলে। আমার জীবন ধন্য। বদরুল তোকে-

 থাক থাক, আর ন্যাকামি করিস না।

 অহন চিঁড়া আর পেঁপে নিয়ে আসে। তিনজনে বসে খায়। বেশ জমিয়ে খায়। ঢাকা থেকে আনা মিষ্টি খেয়ে অহন খুশিতে বাগবাগ। আকাশে উড়ে যায় টিয়া পাখির ঝাঁক। ওই দিকে তাকিয়ে ওসমান অহনকে জিজ্ঞেস করে, তোমাদের ঝরনায় ব্যাঙ ডাকে অহন?

 ব্যাঙ? অহন পুরো মিষ্টি মুখে ঢোকায়।

 হ্যাঁ, সবুজ ব্যাঙ? তুমি কখনো দেখেছ?

 ও প্রবলভাবে না-সূচক মাথা নাড়ে। তারপর মিষ্টি খেয়ে বলে, ঝরনার ধারে ব্যাঙ আছে। কিন্তু আমি কখনো সবুজ ব্যাঙ খুঁজে দেখিনি। তুমি খুঁজবে?

 হ্যাঁ, আমি খুঁজব। একটা সবুজ ব্যাঙ পেলে ছোট একটি মাটির ভাঁড়ে পানি দিয়ে ব্যাঙটিকে আমি ঢাকায় নিয়ে যাব। তারপর আমাদের গ্রামের বাড়িতে নিয়ে পুকুরে ছেড়ে দেব।

 বদরুল চোখ বাঁকা করে তাকিয়ে বলে, তাতে কী হবে? কোন উদ্ধারের জন্য ব্যাঙ নিয়ে যাবি এখান থেকে?

 আমার শৈশব খুঁজে দেখার জন্য।

 ব্যাঙের মধ্যে শৈশব খুঁজবি?

 ওই রকমই। যাদের শৈশব হারায়, তাদের খোঁজার শেষ থাকে না।

 এই এক প্যাঁচাল আর কতকাল পাড়বি?

 ওসমান আলি বদরুলের কাছ থেকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে আকাশের দিকে নিয়ে যায়। এতটা বয়স পর্যন্ত এভাবে আকাশ দেখা হয়নি ওর। পাহাড়ের কত উঁচুতে ওরা আছে, তার নিচ দিয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে তুলোর মতো মেঘ। মিজোরাম আর সাজেকের মাঝখানে জমে আছে মেঘ। পাহাড়ের মাথা থেকে অনেক নিচুতে। এসব অসাধারণ দৃশ্য একজীবনে দেখে শেষ করা যায় না। ছোটবেলায় যখন মায়ের সঙ্গে রাস্তার ধারে কাজ করেছে. তখন মনে হয়নি এমন দৃশ্য দেখার সুযোগ হবে এবং বেঁচে থাকার ধারণায় যোগ হবে রঙিন কিছু। আসার পথে আদিবাসী শিশুদের মাঝে নিজের শৈশব দেখে ভেবেছিল শৈশব খোঁজা ফুরালো। ওদের উজ্জ্বল হাসিমুখ, হাত নেড়ে অতিথিদের স্বাগতম জানানো এবং পাহাড়ি রাস্তায় গাড়ির শব্দ মিলিয়ে যে শৈশবের মুখ দেখা হয়েছে তা আড়ালে চলে যায়। হারানো শৈশবের জন্য বুকের ভেতর কষ্ট জমাট বেঁধেই থাকে। সাজেক ভ্যালির এমন অসাধারণ প্রকৃতির মাঝে এসেও বুকের কষ্ট তাড়ানো গেলোনা, নিজের জন্য খুব মায়া হয় ওসমানের।

 খাবারের বাটিবুটি ঘরের মধ্যে গুছিয়ে রেখে অহন বলে, চলো, আমরা যাই।

 কোন দিকে যাব রে?

 মিজোরামের দিকে নিচু পাহাড়ি এলাকার দিকে যাব। ওখানে ঝিরি আছে। ঝিরিতে স্নান করতে পারবে।

 তাহলে তো কাপড় নিয়ে যেতে হবে। ম্লান তো করবই। ঝিরিতে না ভিজলে এলাম কেন?

 অহন হাসতে হাসতে বলে, গায়ের কাপড় গায়ে শুকাবে। এটা আরো মজা হবে।

 ঠান্ডা লেগে জ্বর আসবে না তো?

 এমন রোদের মধ্যে থাকলে কাপড় তো তাড়াতাড়ি শুকিয়ে যাবে। ঠান্ডা লাগবে না।

 ভালো বলেছ। চলো যাই।

 বদরুল লাফ দিয়ে বারান্দা থেকে নামে। ওসমান খানিকটা হেঁটে সামনে এগিয়ে যায়। মনে করে, এমন সৌন্দর্য দেখার পরে ওর মৃত্যু হলে কোনো দুঃখ থাকবে না। ভাববে, মৃত্যু ঠিক সময়ে হয়েছে। পরক্ষণে ওর মনে হয়, মৃত্যু কি এমনই হবে যে ও কোনো কিছু ভাবার সুযোগ পাবে? ও চায় ঘুমের মধ্যে ওর নিঃশব্দ মৃত্যু হবে। যেমন ওর মায়ের হয়েছিল। ভোরবেলা মাকে ডাকতে গিয়ে দেখেছিল, মা সাড়া দিচ্ছে না। শরীরে হাত দিয়ে ঠেলে তুলতে গিয়ে দেখেছিল, মায়ের শরীর ঠান্ডা হয়ে গেছে। চিৎকার করে বড় ভাইকে ডেকেছিল ও। সবুর আলী ওকে কাছে টেনে বলেছিল, আমাগো মা মইরা গেছে। সেদিন থেকে ও মৃত্যু নিয়ে ভাবতে শিখেছিল। এখনো ভাবে। ‘হোটেল রুয়ান্ডা’ সিনেমা দেখে ওর মৃত্যু নিয়ে আতঙ্ক হয়েছিল। মৃত্যু এত ভয়াবহ হতে পারে, তা ওর অভিজ্ঞতায় ছিল না। ওই ছবি দেখে ও গণহত্যা বুঝেছে। সেই সঙ্গে মৃত্যুর ব্যাখ্যা করতে শিখেছে।

 অহন এসে ওর পাশে দাঁড়ায়।

 ওসমান চলো। এখানে এসে তুমি খুব মগ্ন হয়ে গেছ। তোমার দৃষ্টি এখানকার প্রকৃতি থেকে সরাতেই পারছনা, দেখছি।

 অহন, আমি ভাবছি পড়ালেখা শেষ হলে আমি সাজেক ভ্যালির মানুষের জীবন নিয়ে একটা সিনেমা বানাব। এত সুন্দর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আমাকে নতুন জীবন দিয়েছে। আমি অনেক দিন বাঁচতে চাই, অহন।

 তুমি এখানে সিনেমার সুটিং করতে পারবে না।

 পারব না? কেন?

 আর্মি ক্যাম্প থেকে পারমিশন পাবে না।

 ও, তাইতো। এখানে ঢুকতেও তো পারমিশন লাগে।

 বিষণ্ণ হয়ে যায় ওসমান আলী। কিন্তু মৃত্যু ওর মাথায় স্থির হয়ে থাকে। মৃত্যু-ভাবনা ও মাথা থেকে সরাতে পারে না। এ অবস্থায় ওরা তিনজন পাহাড় বেয়ে নামতেই থাকে। চারদিকে ঝোপজঙ্গল, গাছপালা। মাঝখান দিয়ে পায়ে চলার সরু পথ। ওসমানের মনে হয়,নামছে তো নামছেই। পাহাড়ের ঢালু ফুরায় না। কত ছোট ছোট খুদে পোকামাকড় চারদিকে ছোটাছুটি করছে! প্রজাপতির রঙে চমক লাগে। মাঝে মাঝে থমকে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকে।

 বদরুল হাসতে হাসতে বলে, বেশ মজা পাচ্ছিস না রে, ওসমান?

 পাচ্ছি তো। একটা প্রজাপতি ধরতে পারলে আরো ভালো লাগত।

 প্রেমেই তো পড়তে পারলি না। কার খোঁপায় আর প্রজাপতি বসাবি?

 ইয়ার্কি করিস না। আমি একটি সিনেমার কথা ভাবছি।

 সিনেমা? এই বুনো পাহাড়ি এলাকাটাই তো একটি সিনেমা। হা হা করে হাসে বদরুল। ওর হাসি প্রতিধ্বনিত হয় পাহাড়ি এলাকায়। থমকে দাঁড়ায় ওসমান আলী। এখানে কোথাও কি জহির রায়হান আছেন? একাত্তর সালের একত্রিশে জানুয়ারি বিহারিরা কি তঁাঁকে ধরে এনেছিল এখানে? কোন পাহাড়ে খুঁজে পাওয়া যাবে তাঁকে? তখন ওর কানে আসে ঝরনার শব্দ। পাহাড় থেকে জলপ্রপাত বইছে। ও বদরুলের দিকে তাকিয়ে বলে, শুনতে পাচ্ছিস?

 পাচ্ছি। চল দৌড়াই।

 তিনজনে দৌড়াতে শুরু করে। বেশিদূর যেতে হয় না। ঝরনাটি কাছাকাছিই ছিল। ওপর থেকে কলকল শব্দে নিজের কথা জানান দিচ্ছে। ওরা দূর থেকেই দেখতে পায়, একজন বুড়ো গোসল করছে। মনের আনন্দে পানির ধারায় ছেড়ে দিয়েছে নিজেকে। শুধু একটু গোসল করার জন্য এত পথ পাড়ি দিয়ে আসা! ওসমান বৃদ্ধের দিকে তাকিয়ে থাকে। একমাথা সাদা চুল। হাড়গোড় বেরিয়ে আসা শরীর। বোঝা যায়, পানির সঙ্গে তার মনের আনন্দ অনিঃশেষ। ওদের দেখে ঝিরি ছেড়ে বেরিয়ে আসে। শরীর থেকে পানি গড়ায়।

 দাদু, আপনি কখন এসেছেন?

 অনেকক্ষণ। এখানে না আসতে পারলে শান্তি পাই না রে। জল তো আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে।

 ওরা আমার বন্ধু, দাদু। ঢাকা থেকে এসেছে।

 বেশ বেশ। তা দাদুরা, তোমরা তো জলে ভিজবে?

 ভিজব। আপনি কী করবেন?

 আমি ওই পাথরখন্ডের ওপর বসে থাকব। তোমাদের ভেজা শেষ হলে একসঙ্গে লুইরুই পাড়ায় ফিরব।

 আপনি বসেন, দাদু। অহন তাকে হাত ধরে এগিয়ে দেয়। ফিরে এসে আস্তে করে ওদের বলে, দাদুকে একা একা এখানে আসতে নিষেধ করি, দাদু শোনে না। কোন দিন দেখত পাব পাহাড়ের ঢালুতে মরে পড়ে আছে। শেয়াল-কুকুরে টানাটানি করছে মরদেহ।

 আহ্! অহন, চুপ কর। এভাবে বলিস না।

 তিনজনে ঝিরির নিচে গিয়ে দাঁড়ায়। বদরুল বলে, আমি এই প্রথম ঝরনার পানিতে ভিজছি।

 ওসমান বলে, ভেজা দূরের কথা, আমি তো কখনো ঝরনাই দেখিনি। আমি যেখানে বড় হয়েছি, সেটা তো একটা সমতল ভূমি। আমি পাহাড় দেখিনি। অরণ্যও দেখিনি।

 আমি সব দেখেছি। পাহাড়, অরণ্য, সমতল ভূমি,নদ-নদী কিছু দেখা বাকি নেই।

 তুই আমাদের চেয়ে ভাগ্যবান। তোর ভাগ্যের জন্য আমার ঈর্ষা হচ্ছে।

 ওসমানের কথায় অহন বলে, ভাগ্যের কথা বলবে না তোমরা। তোমরাই ভাগ্যবান। তোমাদের চারদিকে তো এত আর্মি ক্যাম্প নেই।

 বদরুল আর ওসমান দুজনেই চুপ করে থাকে। কথাটা তো সত্যি। প্রসঙ্গ ওঠালে নানা কথা উঠবে। এর অনেক বিষয় ওদের নিজেদের জানার মধ্যে নেই। অনেক বিষয় ওদের ন্যায্য দাবি। তখন ওরা সবাই দেখতে পায়, বুড়ো মানুষটি মাথায় গামছা পেঁচিয়ে হাঁটতে শুরু করেছে।

 অহন বলে, আমি ভেবেছি দাদু আমাদের সঙ্গে যাওয়ার জন্য বসে থাকবে।

 বয়সে বড় হলে কী হবে, শক্তিতে আমাদের চেয়ে যুবক।

 আসলে তা নয়। এ পথে হাঁটতে হাঁটতে তারা অভ্যস্ত হয়ে গেছে। আমরা বারো শ ফুট নেমে ভাবছি কত না হাঁটলাম। তারা মনে করে, এই তো নামলাম আর উঠলাম। নাকি রে, অহন?

 হ্যাঁ, অনেকটা এ রকমই। গতকালই আমার বাড়ির সবাই কংলাকপাড়া গেল। রুইলুই থেকে কংলাকপাড়া সারা দিন হাঁটার পথ। আমার দাদুও গেছে। আমরা তো এভাবেই চলাফেরা করি। এ ছাড়া আমাদের উপায় নেই।

 পাহাড় কেটে রাস্তা তো হতে পারে।

 পারে। পারবে না কেন? সরকারকে দায়িত্ব নিতে হবে। আগে তো সাজেক পর্যন্ত আসার কোনো রাস্তাই ছিল না। মাসালং থেকে হেঁটে সাজেক আসতে হতো। এখন তো রুইলুই পর্যন্ত আর্মির জিপ চলাচল করে। চাঁদের গাড়িও আসে। এখানে পর্যটন কেন্দ্র হওয়ার তোড়জোড় চলছে।

 কাজ শুরু হয়েছে দেখছি। আস্তে আস্তে অনেক কিছু হবে রে, অহন।

 কে জানে কত কিছু হবে। কতকালেই বা হবে।

 ওসমান বুঝতে পারে, নানা কিছু নিয়ে অহনের ক্ষোভ আছে। প্রকাশটা তীব্র নয়, হয়তো বন্ধুত্বের খাতিরে বলছে না। তবে যেটুকু বলছে, তা শ্লেষের সঙ্গেই বলছে।

 তিনজনে ঝিরি ছেড়ে বেরিয়ে আসে। এবার ফেরার পালা। ভেজা কাপড় গায়ে শুকাবে বলে কিছুক্ষণ পাথরখন্ডের ওপর বসে থাকে। বেশ আরাম লাগছে। শরীর ঝরঝরে লাগছে। ঢাকা থেকে এ পর্যন্ত আসার পথের ক্লান্তি মুহূর্তে উবে গেছে।

 এই স্বর্গ ছেড়ে যাব না। মনে হয় শুয়ে থাকি।

 ওসমানের কথার রেশ ধরে বদরুল বলে, পাথরের খন্ডগুলো জোড়া লাগিয়ে চৌকির মতো করতে পারলে মন্দ হতো না।

 কেন, ঘাসের বিছানা খারাপ কী?

 খুদে পোকারা কানের ভেতর ঢুকে প্রেম করতে চাইবে, বুঝলি রে গাধা।

 অহন হেসে গড়িয়ে পড়ে। বলে, তোমাদের এত ভালোলাগা দেখে ভাবছি তোমাদেরকে অনেক দিন রেখে দিই।

 তা রাখতে পারো। খেতে আর ঘুমুতে দিলে আমরা রাজি।

 না, এত বড় বোঝা টানতে পারব না। গায়ে অত জোর নেই।

 তাহলে বল, সাধ আছে সাধ্য নাই।

 তিন তরুণের হা হা হাসিতে তিনজনই মনে করে, এই সময় আমাদের। ওরা সময়কে ঘাড়ে নিয়ে পাহাড় বাইবে, সমতলে হাঁটবে। রুখবে কে?

 তিনজনের হাসি থেমে যায়। গায়ের জামা আলগা করে বদরুল বলে, প্রায় শুকিয়ে গেছে। এখন আমরা ঘাসে গড়াতে পারি।

 তা পারো। এই ঝরনাটা আমাদের স্নানের জায়গা। সবাই আসে স্নান করতে। যার যখন খুশি। আবার একসঙ্গেও অনেকে আসে।

 তাহলে এটাকে বলা যায় ঝিরি-আনন্দ।

 হ্যাঁ, তা বলা যায়। কাপড় শুকানোর সময়টায় বাচ্চারা জামাগুলো ওড়াতে থাকে। রংবেরঙের জামাগুলো যখন ওড়ে, খুব সুন্দর দেখায়। বড়রা বসে তালি দেয়।

 বদরুল হাসতে হাসতে বলে, আমাদের সামনে জামার বেলুন নাই। তবু আমরা তো তালি বাজাতে পারি।

 তিনজনে মিলে তালি বাজায়। যার যার মতো গান গায়। একসময় ওসমান কান খাড়া করে বলে, কোথাও থেকে গুলির শব্দ শুনতে পেলাম?

 শুনতেই পারো, অহন তীব্র কণ্ঠে বলে, তোমাদের বুকেও ঢুকতে পারে গুলি। কে জানে? তখন বেশ মজা হবে।

 মজা কেন? বদরুলের কণ্ঠে বিদ্রূপ।

 অহন নির্বিকার কণ্ঠে বলে, তখন আমরা তোমাদের লাশ নিয়ে মিছিল করব।

 দুজনে চুপ করে থাকে। ওদের পাংশু মুখের দিকে তাকিয়ে অহনও আর কথা বাড়ায় না। বদরুল খানিকটা হেঁটে গিয়ে ঘাসের ওপর শুয়ে পড়ে। প্রায় শুকনো জামা দিয়ে মুখ ঢেকে রাখে। একটু পরে জামা সরিয়ে বলে, আমাকে কেউ ডাকবে না। আমি যতক্ষণ খুশি ততক্ষণ শুয়ে থাকব।

 ঘুমিয়ে পড়লে?

 তা-ও ডাকবি না। যতক্ষণ খুশি ততক্ষণ ঘুমুব।

 সন্ধ্যা হলে?

 হলে হবে।

 দেখা যাক কী হয়। বনের সন্ধ্যা দেখব আমি।

 অহনের হাত ধরে টেনে নিয়ে ওসমান পাথরের ওপর বসে। মৃদু স্বরে জিজ্ঞেস করে, তুমি কি গুলিবিদ্ধ কাউকে দেখেছ, অহন?

 দেখেছি। কয়েকবারই দেখেছি। এখানে থাকব আর দেখব না, তাতো হয় না।

 তোমার নিজের কেউ?

 সবাই তো আমার আপনজন। কাউকে বাদ দিয়ে কেউ না। আমাদের একজন কমলে মনে হয় দশজন কমে গেছে।

 অহনের কথায় স্তব্ধ হয়ে যায় ওসমান । ও কাউকে গুলিবিদ্ধ হতে দেখেনি। ও জলফুর মৃত্যু দেখেছে। সেই মৃত্যু ওর বাবা-মায়ের সরল মৃত্যুর মতো নয়। ও এমন মৃত্যু দেখতে চায় না। অহন যে মৃত্যু দেখেছে, সে মৃত্যু ও দেখতে চায় না। ওসমান নিজের মৃত্যু-ভাবনায় অন্যমনস্ক হয়ে যায়। দেখতে পায়, গাছের ওপর থেকে একটি বানর লাফ দিয়ে নেমে ওদের সামনে এসে থমকে দাঁড়ায়। ওসমান হাততালি দেয়। বানরটি নড়ে না। অহন বলে, ও তোমাকে দেখছে।

 দেখবেই। অপরিচিত মুখ তো। দেখুক। হাতে একটা কলা থাকলে ওকে দিতে পারতাম।

 ও বনের কলা খেতে পারবে। ওর অসুবিধে নেই।

 তাহলে ও কি পানি খেতে এসেছে?

 হবে হয়তো। আমাদের দেখে আর এগোচ্ছে না।

 তাহলে চলো, আমরা চলে যাই।

 তা-ই চলো। এখানে আর বেশিক্ষণ থাকা ঠিক হবে না। বদরুলকে ডাকি।

 বদরুলের কাছে বসে অহন গায়ে হাত দিয়ে ডাক দেয়।

 কী রে, ঘুমিয়েছিস?

 তোদের সব কথা শুনতে পাচ্ছি। পাখির ডাক শুনলে ঘুমাতে পারতাম। কিন্তু পাখির ডাক শুনতে পাচ্ছি না। সে জন্য মন খারাপ। এত ঘন বনে পাখি এত কম কেন?

ওরা বন্দুকের গুলি ভয় পায়।

 অহন মাঝে মাঝে এমন নির্বিকার উত্তর দেয়।

 বদরুল সঙ্গে সঙ্গে বলে, শহরের পাখি বন্দুকের গুলি ভয় পায় না। আমাদের হলের কাছের গাছে কোকিল ডাকে। টিয়া দেখা যায়। দোয়েল শালিক চড়–ই তো সব সময় দেখতে পাই।

 ওরা বন্দুকের তফাত বোঝে। গুলির শব্দও বুঝতে পারে।

 বদরুল উঠে দাঁড়ায়। অহনের দিকে একমুহূর্ত তাকিয়ে থেকে বলে, বুঝেছি। চল যাই।

 ওসমান বানরটির প্রায় কাছাকাছি গেলে বানরটি লাফ দিয়ে গাছে উঠে যায়।

 ও হাততালি দিয়ে বলে, কী রে, ভয় পেলি কেন? আমার হাতে তো বন্দুক নেই। আমি তোকে মারতেও চাইনি, আয় নেমে আয়।

 কী হবে ওকে ডেকে। ও আসবে না।

 ঠিক আছে, না আসুক। আমরা তাহলে প্রজাপতি আর ফড়িং দেখতে দেখতে পাহাড় বাইতে শুরু করি।

 খানিকটুকু এগোলে অনেক দূরে সেই বুড়োকে দেখা যায়। গায়ের জামাটা মাথায় বাঁধা। বেশ দ্রুত হেঁটেই উঠে যাচ্ছে।

 ওসমান অবাক হয়ে বলে, বুড়োর গায়ে এখনো অনেক শক্তি। বাব্বা, কত দূর চলে গেছে!

 বদরুল বলে, আমার মনে হয় এটা অভ্যাস। ছোটবেলা থেকেই এসব চেনা পথে ওঠানামা শুরু হয়েছে। আমাদের মতো তারা তো এই প্রকৃতির ভূমিতে স্ট্রেঞ্জার নয়।

 হা হা করে হাসে অহন। বলে, ঠিক বলেছ। আমরা স্ট্রেঞ্জার নই। ফুল-ঘাস-লতাপাতা-পশুপাখি সব আমাদের বন্ধু।

 হাসে অন্যরা। হাসিতে মেতে উঠে ওসমান বলে, এমন বন্ধু পাওয়া কঠিন। আমাদের চারপাশের পাখিরা বন্ধু নয়।

 অহন কথা লুফে নেয়। নির্দ্বিধায় বলে, ওরা তোমাদের হাত থেকে বাঁচার তাড়নায় অস্থির থাকে। বন্ধু হবে কী করে?

 তোমার সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্ব হয়েছে। আমরা বেশ আনন্দে সময় কাটাচ্ছি। নিজের দেশের সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হয়েছি। আমাদের পুণ্যলাভ হয়েছে।

 ওসমানের পুণ্যলাভের কথা শুনে উৎফুল্ল হয়ে বদরুল বলে, যেখানেই যাব সেখানেই এই পুণ্যের কথা বলব। তোমাকে আমরা ভুলব না, বন্ধু।

 আকস্মিকভাবে অহনকে বুকে জড়িয়ে ধরলে ও হকচকিয়ে যায়। বলে, ছাড়ো ছাড়ো। পাহাড়ের ঢালে এমন জড়াজড়ি করলে গড়িয়ে পড়তে হবে।

 মন্দ না, এটাও ভিন্ন মজা। গড়িয়ে গড়িয়ে ঝিরির কাছে পৌঁছে যাওয়া।

 অহন বলে, চৈত্র মাসে এই সব ঝিরির কাছে বসে আমরা প্রার্থনা করি। কারণ শুষ্ক মৌসুম শুরু হলে পানির জন্য আমাদের হাহাকার শুরু হয়। তখন ঝরনাকে বলি, তুমি আমাদের মায়াবী ঝিরি। তোমার ঝরনা জলে ভরিয়ে দাও। তখন পাড়ার মানুষকে এক কলসি পানির জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। রোদে-গরমে জল সংগ্রহ করা কঠিন হয়ে পড়ে।

 হঠাৎ করে পাহাড়ি ময়নার ঝাঁক উড়ে আসে মাথার ওপরে। লাফিয়ে ওঠে বদরুল, পাখি! পাখি! উহ্, কী সুন্দর! তাহলে ওরা আমাদের বন্ধু, ভেবেছ অহন?

 তোমরা পাখি নেই বলেছিলে, সে জন্য ওরা উড়ে এসে বলছে, দেখো আমাদের। আর একসঙ্গে এত শত পাখি তোমরা দেখতে পাও না। পাহাড়ি ময়না তো নয়ই।

 ঠিক বলেছ। দুজনে মাথা পেছনে হেলিয়ে তাকিয়ে থাকে। বনের ওপর দিয়ে দূর আকাশের কত দূর চলে যায়, তা বোঝা ওদের সাধ্যে নেই। ওরা মাথা সোজা করলে অহন বলে, ওই দেখো তোমাদের আরেক বন্ধু তাকিয়ে আছে।

 কাঠবিড়ালি। উহ্, কী সুন্দর! ওরা ঠিক আমাদের ভয় পাবে না। আমরা দূর থেকেই ওদের দেখব।

 একে একে আরো চার-পাঁচটা কাঠবিড়ালি এক জায়গায় জড়ো হয়। ছোটাছুটি করে। গাছে ওঠে। আবার নামে। ওসমান বিড়বিড়িয়ে বলে, আমার কপালে এত কিছু দেখার ছিল! উহ্, কী যে সুন্দর! ওরাও একেকটা ঝরনা। শুধু পানি দেয় না। আনন্দ দেয়।

 কাঠবিড়ালিগুলো বিভিন্ন দিকে চলে গেলে ওরা আবার উঠতে শুরু করে। ওরা জানত, নামার চেয়ে ওঠা কঠিন। তারপরও দম নেওয়ার জন্য দাঁড়ায় না। ওসমানের মনে হয়, তাহলে বয়সের কাছে হার মানা। অহনের সামনে হার মানা যাবে না। বোঝাতে হবে, আমরাও পারি। জীবনের সঙ্গে যা কিছু ওতপ্রোতভবে জড়িত, তাকে বরণ করে বুকে রাখা প্রকৃতির ধর্ম। নইলে এই পাহাড়ি এলাকায় বসতি গড়ে উঠত না। নিরিবিলি নির্ঝঞ্ঝাট জীবন – দুমুঠো ভাত আর পানি যেমন চায়, তেমন চায় নিজেদের সংস্কৃতির মাঝে নিজেদের আনন্দ ধরে রাখতে। এও এক গভীর জীবনসত্য। মানুষ এ সব কিছুর বাইরে থাকতে পারে না। কৌম সমাজ বেঁচে থাকার আচরণ নির্ধারণ করে।

 রুইলুইপাড়ায় উঠলে অহন বলে, আমাদের হেডম্যানের কাছে নিয়ে যাব তোমাদের। তাঁর সঙ্গে দেখা করা এখানকার রীতি। আমি অবশ্য তোমরা যে এক রাত থাকবে, সে অনুমতি নিয়ে রেখেছিলাম।

 দুজনেই জানে যে এদের সমাজব্যবস্থা নিজেদের নিয়মে চলে। একজন হেডম্যান ও একজন কার্বারি থাকে। নিজস্ব নিয়ম যা আছে, তা সবাইকে মানতে হয়। হেডম্যানের বাড়ির পথে যেতে যেতে ওসমান বলে, আমি এখানে ব্যাঙের ডাক পেলাম না। আমার সবুজ ব্যাঙকে কোথায় খুঁজব আর? ‘স্টপ জেনোসাইড’ বলার কথা কে আমাকে শেখাবে?

 এসব কথা এখন থাক, ওসমান। তোর কথা শুনলে অহনেরও মনে হবে, ওর জীবনেরও অনেক কিছু হারিয়েছে। কোথায় খুঁজবে সেসব।

 যাদের আমি খুঁজছি, তারা আছে সবখানে। মাঝে মাঝে বুকের ভেতর প্রবল টান লাগে। সামলাতে কষ্ট হয় আমার। এখানে আসার পরে বারবারই মনে হয়, জহির রায়হান যদি এই পাহাড়ি জনপদ নিয়ে একটি সিনেমা বানাতেন, তাহলে আমরা গুলিবিদ্ধ লাশের স্বরূপ বুঝতাম।

 বদরুল কথা বাড়ায় না। ওসমানের এমন অনেক কথার সঙ্গে ও নিজের ভাবনা যোগ করতে পারে না। বুঝতে পারে, দুজনের উপলব্ধিতে ফাঁক আছে। ওসমান যেভাবে ভাবতে চায়, সে ভাবনার সঙ্গে ওর সংযোগ নেই। তার পরও দুজন কাছাকাছি হতে পারে, যেটাকে কাছের বন্ধু হিসেবে দেখা যায়। সেই বন্ধুত্বের সঙ্গেই এখন বসবাস।

 হেডম্যানের সঙ্গে কথা বলে দুজনে ফিরে আসে অহনের বাড়িতে। বারান্দাটি চমৎকার। এখানে বসে দূরের মনোরম দৃশ্য উপভোগ করার তুলনা হয় না। অহন বলেছে, সন্ধ্যায় গির্জায় প্রার্থনা হবে। ও গির্জায় যাবে। প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে প্রার্থনা চলবে।

 হেডম্যান ওদের রাতের খাবারের জন্য নেমন্তন্ন করেছে। ওদের বারান্দায় বসিয়ে অহন ওদের আনা মিষ্টি-বিস্কুট নিয়ে আসে। বলে, এখন এসব খেলে হবে না?

 অবশ্যই হবে।

 আমরা রাতে ভাত খাব। অহনের মৃদু হাসিতে দূরের তারার হাতছানি দেখা যায়। দূরের দিকে তাকিয়ে ওসমান কয়েকটি ঘর দেখতে পায়।

 মানুষের ঘরবসতি অত দুর্গম জায়গায় কেন? যাওয়া-আসার রাস্তা আছে বলে তো মনে হয় না।

 জল,জলের জন্য। যেখানে জল, সেখানে জীবন। জল ছাড়া তো মানুষ বাঁচবে না।

 তাইতো। সভ্যতা গড়ে উঠেছে নদীর ধারে। মানুষ তো শুরুতে নদীপথে যাত্রা শুরু করেছিল। আবিষ্কার করেছে দেশ-মহাদেশ। ভাবনার মাঝে বিস্কুট-মিষ্টি খায়। নিজেদের খিদে লাগাকে ঠাণ্ডা করে। ওসমানের চোখের সামনে জেগে ওঠে জলফু। দাঁড়িয়ে আছে কবরস্থানের গেটে। বলছে, তুমি তো জোনাকি। জ্বলো আর নেভো। এখন তুমি কি জ্বলে আছ, না নিভে আছ?

 আমি এখন জ্বলে আছি রে, সবুজ ব্যাঙ। তোর ডাক শোনার জন্য তোকে খুঁজছি। তুই ঝরনায় নাই, জঙ্গলে নাই, মাটিতে নাই, ঘরে নাই। তুই কি তাহলে মেঘে আছিস? নাকি চাঁদে?

 শোনা যায় অহনের কণ্ঠস্বর, আমি গির্জায় যাচ্ছি। তোমরা অন্ধকারেই বসে গল্প কর। প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখার তো দরকার নেই?

 না রে দাদা, একটুও দরকার নেই। এমন সুন্দর চাঁদনি রাত। চাঁদের আলোয় মাতাল হয়ে যাচ্ছি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *