হেঁটে যাই জনমভর – ৪

 এবার আমরা নতুন মানুষ আনব, আমি কথাটি বলে ওর দু’হাত আমার গালে চেপে ধরি। কতক্ষণ এভাবে ছিলাম জানিনা। ডালিয়ার মাথা আমার বুকের মধ্যে, ফিসফিসিয়ে বলে, হ্যাঁ, নতুন মানুষ চাই। আমাদের খুনসুটিতে সময় চলে যায়। জানালার কার্নিশে বসে কাক ডাকে, আমরা বিরক্ত হইনা। মনে হয় কাকের সঙ্গীতও মানুষের বুকে নদী হয়। মনে মনে ভাবি, কাকটা আজ ডাকতেই থাকুক। ডেকে ডেকে বলুক, তোমাদের এই সুখের সময় চিরকালের হোক। তোমাদের সুখের সময় কোনোদিনই শেষ হবে না। কতক্ষণ চলে যায় আমি জানিনা। অনন্ত সময় আমার বুকের মধ্যে স্তব্ধ হয়ে থাকে। আমি নিবিষ্ট চিত্তে নিজের মধ্যে মগ্ন হই। ডালিয়ার কন্ঠস্বর শুনতে পাই। বলছে, যে ভালোবাসার কথা আমাকে বলেছ তা কিন্তু অন্য কাউকে বলবে না। আমার মাথা চক্কর দিয়ে ওঠে। ধাম করে মাথা সোজা করে বলি, তুমি আমাকে অপমান করলে ইরাবতী নদী।

 অপমান করিনি। তবে এটাও সত্যি পুরুষ মানুষের কোনোকিছু ঠিক থাকে না।

 আমি আরও রেগে গিয়ে বলেছিলাম, আমার শব্দ ভান্ডার এত কম নয় যে তোমার জন্য বলা ভালোবাসার কথা একইভাবে আর একজনকে বলতে হবে। বললে, নতুন কথাই বলব।

 তারপর সাত দিন ডালিয়া আমার সঙ্গে কথা বলেনি। আমিও ওর অভিমানের তোয়াক্কা করিনি। ভেবেছিলাম অন্যায় ও করেছিল, অপরাধও ওর। তবে আমি কেন মান ভাঙাবো! আমি নিজের সিদ্ধান্তে অনড় ছিলাম সে সময়ে। পরে ডালিয়াই বলেছিল, স্যরি আমি কথাটা ঠিক বলিনি। তুমি দুঃখ পেয়ো না।

 আমার দুঃখ তুমি আর ঘোচাতে পারবে না ডালিয়া। তুমি সব পুরুষকে এক পাল্লায় ওঠালে কেন?

 আমি স্যরি বলেছি মাছরাঙা। আর কোনোদিন বলব না।

 আমি চুলের ভেতর হাত ডোবাই। পাঁচ বছরেরও আগে ডালিয়ার বলবনা শব্দটি বন্ধ হয়ে গেছে। অবশ্য ও যতদিন সক্রিয় ছিল ততদিন ঐ কথা আমাকে আর বলেনি। অজস্র কথার মাঝে আড়াল হয়েছিল ওর ওইসব কথা। যতদিন প্রাণের ধুকধুকি আছে ততদিন ও আর বলবে না। আমার চোখে পানি আসে। আমি দু’হাত দিয়ে চোখের পানি আড়াল করি।

 সুষমা কাছে দাঁড়িয়ে ডাকে, ভাইয়া কফি।

 বোস। তোর যাবার তাড়া নেই তো? আমি উদগ্রীব হয়ে ওর দিকে তাকাই। আমার ইচ্ছে ও আরও কিছুক্ষণ এই বাড়িতে থাকুক। আমার সময় কাটুক আনন্দে।

 ও সোফায় বসতে বসতে বলে, তোমার কথা থাকলে শুনব। আমার তাড়া নিয়ে ভেবো না। জানোইতো আমি সময় ম্যানেজ করতে পারি।

 আমি গভীর ঔৎসুক্য নিয়ে ওর দিকে তাকাই। আমার ভেতরে সুষমার নতুন করে শুরুর জানার ইচ্ছা প্রবল হয়ে ওঠে। নিজের ভেতরে কেন এই অস্থিরতা তা আমাকে প্রশ্নের মুখোমুখি করেছে। বলি, আমি তোর নতুন জীবনের কথা শুনতে চাই। যে ভালোবাসার কথা তুই মবিনকে বলেছিস সেসব কথা তো তুই তৈমুরকে বলিসনি। না রে?

 হ্যাঁ, তাতো বটেই। একজনকে বলা কথা আমি অন্যজনকে কেন বলব? ভাইয়া আমার জীবন থেকে আমি মবিনকে মুছে ফেলতে পারব না, কিন্তু তৈমুরের সঙ্গে শুরু আমাকে বসন্তের নতুন গজানো পাতার স্নিগ্ধতা দেবে। আমি নতুন করে সম্পর্ক গড়ে তুলব।

 ডিভোর্স হওয়ার পরও তুই বলতি তুই মবিনকে ভালোবাসিস। আমার মনে হতো তুই বাড়াবাড়ি করছিস। বিষয়টি আমি মানতে পারতাম না।

 মনের ভেতরে সেতো থেকেই ছিল ভাইয়া। কারণ আমি আমারটুকু নিয়ে কথা বলেছি। ওরটুকুতো আমি কবেই ঝেড়ে ফেলেছি। তার কিছু অবশিষ্ট নাই। আমারটুকু বাদ দিলে আমার জীবনের একটা চ্যাপ্টার অন্ধকার হয়ে যায়। আমি তা চাই না। আমার যা কিছু তাকে আমি আমার ভেতরেই রাখব। সতেজ রাখব। আড়াল করব না।

 সুষমা থামে। আমি কফিতে চুমুক দেই। পরপর কয়েকবার চুমুক দেই। মনে হয় আমার ভেতরে ভীষণ তৃষ্ণা। আমাদের মধ্যে আর কথা হয় না। সুষমাও ওর কফি শেষ করে বলে, ভাবির বালিশের পাশে কিছু বকুল ফুল রেখেছি। সন্ধ্যা হলে ফেলে দিও ভাইয়া। নইলে পোকা আসতে পারে।

 তুইতো জানিস আমি সারাদিনে কয়েকবার ওর বিছানা ঝেড়ে দেই।

 তোমার তুলনা শুধু তুমিই। আমি আজ যাই। দেখে এসেছি রান্নাঘরে সবকিছু ঠিকঠাক আছে। রাতের রান্নার জন্য বিকেলেতো বুয়া আসবে, না?

 হ্যাঁ আসবে। একটু পরেই এসে যাবে।

 তুমি এখন কি করবে ভাইয়া?

 হারমোনিয়াম নিয়ে বসব। এখনতো গানই আমার ডালিয়া। গানের মধ্যে ওকে খুঁজে ফেরা।

 ভাবি তোমার গানের খুব অনুরাগী ছিল। মাঝে মাঝে মনে হতো ভাবি বুঝি তোমাকে ছাড়া আর কাউকে গায়কই মনে করে না। ভাবি যখন গদগদ স্বরে তোমার গানের কথা বলতো, আমি হেসে গড়িয়ে পড়তাম। মাঝে মাঝে ভাবি রেগে গিয়ে বলত, হাসছ কেন? আমি কোনো উত্তর দিতাম না, আমিতো জানি আমার উত্তর দেয়ার কিছু নেই।

 গান শুনেইতো প্রেম। ও এমন মুগ্ধ ভাষায় আমার গানের কথা বলতো যে মনে হতো আমার সামনের পুরো জগৎই ডালিয়া।

 প্রেম! সুষমা হেসে গড়িয়ে পড়ে। প্রেম বারবার ফিরে আসে ভাইয়া। তোমার জীবনেও কি তেমন কিছু ঘটবে?

 জানি না। আমি দ্বিধা নিয়ে বলি। সুষমা এমন একটি প্রশ্ন করবে তা আমি ভাবিনি। আমার ভেতরে কাঁপুনি জাগে।

 এলে আমি খুশি হবো। তোমার নিঃসঙ্গতা আমাকে খুব কষ্ট দেয়। ছেলেমেয়েরা কাছে থাকলে তুমি খানিকটুকু স্বস্তিতে থাকতে। ওদের বাচ্চা নিয়ে তোমার সময় কেটে যেত।

 আমার কাছে নিঃসঙ্গতা শুধু একটি শব্দ মাত্র নয়। এটা জীবনের ব্যাপকতাও রে বোন। আমি এক উদাস ভঙ্গিতে কথাটা বলি যেন জীবনের কাছে আমার কোনো পরাজয় নেই।

 সুষমা আমার কথা শোনে, কিন্তু আমার দিকে তাকায় না। একই ভঙ্গিতে বলে, তোমার জীবনযাপনে আমি সেটাই দেখতে পাচ্ছি। আজ গেলাম। আবার কবে আসব তা তোমাকে ফোনে জানাব। আর যদি তোমার দরকার হয় তাহলে ফোন দিও।

 আমার দরকার হলে ফোন দেব সেটা ভিন্ন ব্যাপার, কিন্তু তৈমুরের সঙ্গে আমার পরিচয় হবে কবে?

 তুমি চাইলে তাকে নিয়ে আসব। যখন বলবে তখনই আনব। অবশ্য তার যদি অন্য কোনো অ্যাপায়েন্টমেন্ট না থাকে সেটাও দেখতে হবে। তুমি আমাকে ফোন দিও ভাইয়া, তোমার চাওয়া আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ।

 আমিতো চাই। আমি আনন্দের হাসি ছড়িয়ে কথাটা বলি। আমার চাওয়া তোর কাছে বড় পাত্তা পাবে সেটা আমি জানি। কথাটা বলে আমি হাসি। সুষমাও হাসে, আমরা বুঝে যাই যে আমাদের জীবনের জানালাগুলো খুলে গেছে। আমরা দুই ভাইবোন বুক ভরে নিশ্বাস নিচ্ছি।

 আচ্ছা, ঠিক আছে। আজ যাই। সুষমা ঘাড় নেড়ে দরজা খুলে বেরিয়ে পড়ে। আমি সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে ওর চলে যাওয়া দেখি। খুট করে পাশের ফ্ল্যাটের দরজা খুলে যায়। বেরিয়ে আসেন মিসেস সাদেক। হাজব্যান্ড মারা যাওয়ার পরে তিনি বছর দেড়েক আমেরিকায় ছেলের কাছে ছিলেন। কবে ফিরেছেন তা আমার জানা ছিল না। আমাকে দেখে হাসিমুখে বললেন, কেমন আছেন আরিফ ভাই?

 এইতো ভালো। আপনি কবে এলেন? আমি জানতে পারিনি। আমার বাড়ির লোকজন আসা-যাওয়ার মধ্যে থাকে। সেজন্য পাশের বাড়ির খবর আমি ঠিকমতো জানতে পারি না।

 গতকাল এসেছি। আমিও কারও সঙ্গে যোগাযোগ করিনি। পথের ধকল কাটিয়ে উঠতে সময় লাগে। আপনার সাড়া পেয়ে দরজা খুললাম।

 ভালো আছেন তো? ছেলে-নাতিপুতিরা ভালো আছে তো?

 ছেলে-নাতিপুতিরা ভালো আছে। আমার আর ভালো থাকা। সাদেক নেই এটা মেনে নেয় আমার জন্য খুব কষ্টের। বিদেশ গিয়েও থাকতে পারলাম না। ছেলে জোর করে আটকে রেখেছিল। নইলে অনেক আগেই ফিরে আসতাম। এখন দেশেই থাকব। আর যাব না বিদেশে।

 ভালোই করেছেন। নিজের দেশইতো মানুষের আসল জায়গা।

 আমার কন্ঠে উচ্ছ্বাস একটু বেশি ধ্বনিত হয়। আমি নিজেকে সামলে নেই। সাদেক সাহেবের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল বেশ ফর্মাল। প্রতিবেশির উর্ধে আন্তরিক সম্পর্ক ছিল না। ডালিয়া অসুস্থ হলে আমাকে বেশ সহযোগিতা করেছিলেন। তারপর একদিন হার্ট অ্যাটাকে মারা গেলেন। হাসপাতালে নেয়ারও সুযোগ পেল না পরিবারের কেউ। শুনতে পাই ফায়জা সাদেকের কন্ঠস্বর।

 ভাবি কি এখনো তেমনই। কথা শেষ না করে থেমে গেলেন তিনি।

 আমি বললাম, হ্যাঁ, তেমনই আছে। এভাবেই বেঁচে থাকা। আমার দীর্ঘশ্বাস বাতাসে উড়ে যায়।

 দেখতে আসব। শরীর ঠিক আছে?

 শরীর আর ঠিক থাকবে কীভাবে? দিন দিন নেতিয়ে যাচ্ছে। আচ্ছা আসি।

 আমি এমন আকস্মিকভাবে বিদায় নেয়াতে তিনি খানিকটা হতবাক হয়ে চুপ করে থাকেন। আমি ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করি। মাথা ঝিমঝিম করছে, কিছু ভালোলাগছে না। আবার পুরো বাড়ির সব ঘরে আয়না দেখতে পাই। আয়নায় ভেসে ওঠে আমার কল্পনার রঙতুলিতে আঁকা পেইন্টিং। এ আমার এক আশ্চর্য জগৎ। নিজের এই জগতে আমি একা বাসিন্দা। এই একাকী জগতের ভূপৃষ্ঠে আমি ছবি আঁকি। আমার এই ছবি আঁকা আমার অস্তিত্ত্ব খোঁজার অংশ। রায়নার ঘরে গেলে দেখতে পাই ওকে কখনো পড়ার টেবিলে কিংবা খাটে। কখনো ল্যাপটপ নিয়ে বসে ইন্টারনেটে সার্চ করছে। আমার মনে হয় ওকে কি আমি খুঁজছি? ওতো আমার সামনে নেই। কবে কখন ওর জীবনে রোদ-বৃষ্টি নেমেছিল আমি জানি না। আমার জানার সময় ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজের নানাকিছু নিয়ে আমার প্রবল ব্যস্ততা ছিল। লেখাপড়ায় প্রচুর সময় দিতাম। মেয়েটি রাগ করে বলতো, বাবা তুমি কি আমাদের কেউ না?

 ডালিয়া ওকে আদর করে বলত, বাবা তোমাদের সব। তোমাদের কাছে বাবার চেয়ে বড় কেউ না।

 রায়না সেদিন আমার নাকের ডগার উপর আঙুল রেখে বলেছিল, বাবা মা তোমাকে এমন করে দেখে কেন? মায়ের কি দশটা চোখ আছে?

 হয়তো আছে। শুধু দশটা না দশ হাজার চোখ আছে।

 কোথায় আছে? আমরা দেখতে পাই না কেন?

 সবার বুকের ভেতরে অন্যরকম চোখ থাকে। ওটা দেখতে পাওয়া যায় না, বুঝে নিতে হয়। মাগো মানুষকে বোঝার আগে নিজেকে বুঝতে হয়।

 বাবা তুমি খুব কঠিন কথা বলো। তোমার চিন্তার জায়গাটা জটিল। তোমার বন্ধু সুরকার শহীদ আলতাফ মাহমুদকে খুঁজে ফেরাও তোমার জন্য এক জটিল মানসিক অবস্থা। আমি নিজেকেই বলি, সুরকারকে আমার তো খুঁজতেই হবে রে মেয়ে। তাকে আমি না পেলে তুই খুঁজবি। তোর সন্তান খুঁজবে। তোর সন্তানের সন্তানেরা খুঁজবে। আমাদের বেঁচে থাকার শক্তির জায়গা তারা তৈরি করেছিল তাদেরকেতো আমাদের অনবরত খুঁজতেই হবে। তারা আমাদের বুকের ভেতর থাকলেও সেখানে আমাদের হাত যাবে। আমরা ছুঁয়ে দেখব তাঁদেরকে।

 আমার চারদিকের দেয়ালে আলতাফ মাহমুদ। আমরা জানি না দেশের মাটির কোন অতলে আছে মাহমুদ। বাতাসে ভেসে আসে একুশে ফেব্রুয়ারির গান। আমার তখন বুকের ভেতর সাহিত্যের তৃষ্ণা জেগে ওঠে। যে মার্ক্সীয় অর্থনীতি আমার জীবনসত্যকে আচ্ছন্ন করে রাখে এই বয়স পর্যন্ত তার নানা মাত্রা আমি খুঁজে বেড়াই। আমি ইশতিকের ঘরে গিয়ে বই খুঁজি। গুন্টার গ্রাসের ‘টিন ড্রাম’ অনায়াসে চোখের সামনে পড়ে। আমি সেটা নিয়ে ড্রইংরুমে আসি। অনেক আগে পড়েছিলাম, এখন থেকে চুয়াল্লিশ বছর আগে। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়, যে বছরে আলতাফ হারিয়ে গেল। এই বইটি হাতে নিয়ে সোফায় চুপ করে বসে থাকি। আমার ভেতরে নানা ভাবনা কাজ করে। অর্থনীতি পড়িয়ে আমি কয়জনকে মার্ক্সীয় দর্শনে বিশ্বাসী করাতে পেরেছি জানি না। পুঁজিবাদের ডামাডোলে ভেসে যাচ্ছে দুনিয়া। ভোগ-বিলাসের নিমজ্জিত হওয়ার অবিশ্বাস্য আকাঙ্ক্ষা ক্ষুদ্র থেকে বৃহতের মধ্যে বিপুল বেগে প্রবাহিত। যারা এখনও স্বপ্নের শেষটুকু ধরে রাখার আপ্রাণ চেষ্টায় অক্লান্ত শ্রমিক তাদেরকে আমার খুঁজতে হচ্ছে। আমি এই নির্জন বাড়ির একক পথিক। হাঁটছি, ঘুরছি আর নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া করছি। আমিই বা কীভাবে জানব যে বিশ্বাসের জায়গা ছুঁয়ে রেখে হারাচ্ছে কতজন! কি তাদের পরিণতি! নানা এলোমেলো ভাবনায় নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা যখন করছি তখন আমার মিসেস সাদেকের কথা মনে হয়। বেশ একটি লম্বা সময় বিদেশে কাটিয়ে আসার কারণে চেহারায় অন্যরকম দ্যুতির আভা। কি হতো এই পড়ন্ত বিকেলের শেষ আলোয় যদি দু’জনে বসে মগ্ন হয়ে গল্প করতে পারতাম। দ্রুত সময় কেটে যেতো, আমার মগ্ন চৈতন্যে শিস বাজাতো আশ্চর্য দোয়েল পাখি। তখন আমি একজন বিশ্বখ্যাত কবির মায়ের কথা ফায়জাকে বলতে থাকি। তিনি সামনাসামনি মিসেস সাদেক, কিন্তু তার নাম যে ফায়জা তা আমি জানি। ডালিয়া তাকে ফায়জা ভাবি বলে ডাকতো। আমি ফায়জাকে বলি, ফায়জা কনফ্লিক্টের সময় নারীরা যেভাবে অরক্ষিত হয়ে যায় সেভাবেই অরক্ষিত হয়েছিলেন সেই কবির মা। সময়টা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। আর কবির সময় ছিল তার শৈশব, তিনি মনে করেন তার হারিয়ে যাওয়া শৈশব। মায়ের স্মৃতি তার শৈশবে হয়নি, হয়েছে অনেক পরে। তার মা কতবার সৈনিকের দ্বারা ধর্ষনের শিকার হয়েছিলেন তা তিনি জেনেছিলেন মায়ের মৃত্যুর পরে। বিষয়টি তিনি জেনেছিলেন বড় বোনের কাছ থেকে। বোন বলেছিল, আমাকে বাঁচানোর জন্যই মা ওদের কাছে নিজেকে সমর্পন করেছিলেন। বলেছিলেন, আমার মেয়েটিকে তোমরা নির্যাতন করো না। ও ছোট। ওর এ সবের ধারণা নেই। ও আমার কাছে এখনো এক দেবশিশু। সৈনিকরা মাকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল। কতবার এমন ঘটনা ঘটেছিল তার হিসাব আমি রাখিনা। সেদিন আমি দেবশিশু হওয়ার প্রতিজ্ঞা করেছিলাম। ঈশ্বরের আশীর্বাদে আমি দেবশিশু থাকতে পেরেছি। আমি যৌবনে নান হয়েছিলাম, পরে সেবিকা পেশায় আসি। মনে করি এভাবে জীবনের ভার কমাতে পারব, জীবনের কোনো অন্যায় আমার কাছে মুখ থুবড়ে থাকবে না।

 মৃত্যুর সময় মা তোমাকে কিছু বলেছিল?

 বলেছিল। বোনের চুপ করে থাকা দেখে সেদিন সে প্রশ্ন করেছিল, কি বলেছিল?

মা বলেছিল বিষয়টি যেন তোকে জানাই। আর তুই যেন জীবনভর এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করিস। তোকে অনবরত বলতে হবে, নো সেক্সচুয়াল ভায়োলেন্স ইন আর্মড কনফ্লিক্ট।

 ছেলেটি বড় হয়ে জেনেছিল মানুষের স্বভাবকে বশে আনা কঠিন। জেনেছিল মানুষ বামন-আকারে জন্মালে মানুষের পাপক্ষয়ের চিন্তা থাকে। মানুষ তার আকৃতির বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সাহস রাখে। যদি সে সাহস দিয়ে জয় করতে চায় বিরুদ্ধ শক্তির যাবতীয় অপকর্ম।

 আমি একসময় বুঝি আমি মিছেই ফায়জার কথা মনে করছি যে সে এই ঘরে আছে। আমরা মুখোমুখি বসে আছি, যেন আমাদের দীর্ঘ সম্পর্কের সূত্র আছে, আমরা একে অপরকে গভীরভাবে জানি। কোনোদিন ফায়জাকে বলেছিলাম, ফায়জা তোমার হাত ধরে হেঁটে যাব অনেকদূরে। ফায়জা হাসতে হাসতে বলেছিল, কতদূর যেতে চাও? পারব কি অতদূর যেতে? আমি বলেছিলাম, এতো শারীরিকভাবে যাওয়া নয়, এ যাওয়ার স্বপ্ন আছে, ভালোবাসা আছে, যৌথ জীবনযাপনের দর্শন আছে। ধরে নাও কতদূর যেতে পারব সেটা আমাদের ইচ্ছা – ইচ্ছার ফুল ফুটিয়ে সৌরভ গায়ে মাখা। এখন আমরা এই ঘরে জমিয়ে গল্প করছি। আমার অবচেতন এমন ভাবনা কেন আচ্ছন্ন করছে? আমি কেন তাকে মনে করে নারী বিষয়ে ভাবছি? আমি ফায়জার সামনে আর্মড কনফ্লিক্টের বিষয়টি তুলে ধরেছি। নারীর চিন্তা ওর কাছ থেকে বুঝতে চেয়েছি। আসলে এই অলস ভাবনার সম্পর্ক-সূত্র আমার গুন্টার গ্রাস। তার ‘টিন ড্রাম’ উপন্যাস। সাহিত্য আর অর্থনীতি আমার কাছে পরস্পর-সংলগ্ন বিষয়। আর সে সাহিত্যের লেখক যদি হয় বাম রাজনীতির কেউ তবে তার সাহিত্যের গুরুত্ব আমার কাছে অনেক বেশি। আমি ধরে নেই বিষয়ের পারস্পরিক সংলগ্নতা পাঠকের চিন্তার জায়গা উজ্জীবিত করে। পাঠক তার সূত্রকে রঙিন জলে ভাসায় আমি ‘টিন ড্রাম’ উপন্যাসের পাতা ওল্টাই। এক পৃষ্ঠা পড়ার পরে আমি যুদ্ধের ইতিহাসে ফিরে যাই। কেমন করে যুদ্ধ মানুষকে ছেঁচে ফেলে, কেমন করে লোভী দানবেরা হিংস্র আচরণ করে, কেমন করে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের পতন ঘটে। আমি এমনই মানুষ, চিন্তার ধার কেটে নিজেকে খন্ড খন্ড করি। মাড়িয়ে যাই রক্তমাখানো কাদাজল।

 বিকেলে ফায়জাকে দেখার পরে আমার ভেতরের প্রবল নস্টালজিয়া আমাকে বিভিন্ন সূত্রে নিয়ে যাচ্ছে। বলছে দেখো। সেজন্য এখন আমি যুদ্ধের ইতিহাসে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। কিন্তু এমন একটি ভাবনার পরে আমি নিজেকে আবার গুটিয়ে নেই। কোলের ওপর ‘টিন ড্রাম’ রেখে বসে থাকি। বারবার উপন্যাসের নায়ক অসকারের কথা মনে হয়। অনেক আগে পড়া বইটির অনেক কিছু ভুলে গেছি। ভুলিনি তার ড্রাম বাজানো এবং গলা চিরে গানের ধরনের চিৎকার, যে চিৎকারে ফেটে চৌচির হয় জানালার কাঁচ। সাহিত্যের জায়গা থেকে যখন চিন্তা করি দেখি গুন্টার গ্রাস উপন্যাসে নায়কের ধারণা ভেঙে দিয়েছিলেন। তার নায়ক অসকারই বলেছে, ব্যক্তির একক সত্তার যুগ শেষ হয়ে গেছে। এখন সমষ্টির সময়। সমষ্টি দিয়ে তৈরি হবে মানবসমাজের সামগ্রিক রূপ। মানুষের এই শক্তিকে ব্যবহার করেই মানুষকে এগোতে হবে। বামপন্থী রাজনীতির এই দর্শনকে সম্বল করে তিনি মানবমুক্তির স্বপ্ন দেখেছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পশ্চাৎভূমি বিশ্লেষণ করলে মানব-ধ্বংসের আগ্রাসী মনোভাব কীভাবে মুখ থুবড়ে পড়ে সেটা বোঝা যায়। সেই যুদ্ধে জার্মান বন্দি-শিবিরে এক কোটির বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়। রাশিয়া অজস্র সৈনিকের মৃত্যু দেখে আর মিত্রবাহিনীর বিমান হামলায় বিধ্বস্ত জার্মানি আত্মসমর্পন করতে বাধ্য হয়। পুঁজিবাদের বলয় থেকে বেরিয়ে আসা লেখক আমার সামনে এক আশ্চর্য শক্তি, গভীর বিশ্বাস। আমি ‘টিন ড্রাম’ উপন্যাসের অসকারের মতো নিজেকে ভাবতে পারিনা। আমি জানি আমার অন্তরশক্তিতে তত দাপট নেই, যে দাপট দিয়ে একজন মানুষ নিজের কন্ঠস্বরের গর্জন দিয়ে জানালার কাঁচ ভাঙতে পারে, যে কাঁচ ঝনঝন শব্দে চারদিকে গড়িয়ে পড়বে। আমি উপন্যাসের প্রথম অধ্যায়ে চোখ রাখি, অধ্যায়ের নাম দ্য ওয়াইল্ড স্কার্ট। অসকারের নানী আন্না ব্রনস্কি এমন একটি স্কার্ট পরে আলু ক্ষেতের কাছে বসে কয়লার আগুনে আলু পুড়িয়ে খাচ্ছিল। সে সময় একজন ব্যক্তি পুলিশের তাড়া খেয়ে আন্নার ফোলানো-ফাঁপানো স্কার্টের আড়ালে আশ্রয় নেয়। আমি হা-হা করে হাসি। হাসতে হাসতে আবার পড়তে শুরু করি। পালিয়ে আসা লোকটির নাম জোসেফ। আন্নার সঙ্গে পরে তার প্রেম ও বিয়ে হয়।

 হঠাৎ করে আন্না আমার সামনে স্যাফো হয়ে ওঠে, কেন তার কোনো ব্যাখ্যা নেই। এই ব্যাখ্যাহীন অবাস্তবতায় আমি ডুবে গেলে জোরে জোরে কলিং বেল বেজে ওঠে। আমি শুনি এবং বসে থাকি, উঠে দরজা খোলার তাড়া অনুভব করি না, তখন চিৎকার শুনতে পাই, স্যার স্যার আমি জুয়েল। স্যার দরজা খোলেন। ওর কন্ঠস্বরে একই সঙ্গে ভয় ও উত্তেজনা আমি টের পাই। আমি পাশের টেবিলে বই রেখে দরজা খুলতে যাই। ছিটকিনিতে হাত দিলে আমার হাত অবশ লাগে। ভাবি, কতকাল যেন ছিটকিনি খুলিনি। এই হাত কি ছিটকিনি খুলতে পারবে? আমি কি কোনোদিন দরজা খুলে দাঁড়িয়েছিলাম? দেখেছিলাম পৃথিবীর আলো-হাওয়া? নাকি অসকারের মতো জন্মের পরে চোখ খুলে বুঝতে শিখেছিলাম ষাট পাওয়ারের বাল্বটিই আমার দেখা প্রথম আলো? একজন লেখক কীভাবে চিন্তার জগতে বিস্তার ঘটান এ এক পরম বিস্ময় আমার কাছে। আমি উপন্যাস জুড়ে ফুটে থাকা অস্কারকে নিজের ভেতরে দেখতে পাই। লেখকের অনুভব আমাকে কেন আলোড়িত করে সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজি। বুঝতে পারি পাঠক আলোড়িত হবে বলেইতো তার কাছে সাহিত্যের মাত্রা। এভাবে সাহিত্য আমার ভেতরে নানা প্রশ্নের জন্ম দেয়। আমি নতুন ভাবনায় ঢুকি। এ আমার এক প্রিয় অভ্যাস।

 স্যার আমি জুয়েল। এবার ওর কন্ঠস্বরে কান্নার শব্দ, একসময়ে ও ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। কাঁদতে কাঁদতে বলে, স্যার আমি জুয়েল। স্যার, দরজা খোলেন।

 আমার অবশ হাতে শক্তি ফিরে আসে। আমি দরজার ছিটকিনি খুলি। ও আমার পায়ের ওপরে পড়ে, পা জড়িয়ে ধরে কান্নায় বুক ভাসায়। কান্নার শব্দ শুনে হয়তো মুখোমুখি দরজা খুলে বেরিয়ে আসে ফায়জা।

 ফায়জা নিচু হয়ে ওকে টেনে ওঠাতে চায়। বলে, কি হয়েছে? কোনো দুর্ঘটনা রে জুয়েল? ওঠ, কি হয়েছে বল।

 ও মাথা ওঠায়। দু’হাতে চোখ মুছে বলে, দুর্ঘটনার চেয়ে বেশিকিছু খালাআম্মা। গুন্ডারা বেলিকে ধর্ষণ করে খুন করে ফেলে গেছে।

 আমি আঁতকে উঠে বলি, কি বললি? আমার শরীর থরথর করে কাঁপে। আমি দরজায় হাত ঠেকিয়ে নিজেকে সামাল দেই।

 জুয়েল দু’হাতে চোখ মুছে উঠে দাঁড়ায়। বলে, স্যার, আপনি আমার সঙ্গে হাসপাতালে যাবেন। তারপর থানায় যাব। জিডি করতে হবে।

 তুই কোথায় থেকে এত খবর পেলি? ফায়জার কন্ঠস্বরে প্রবল আর্তনাদ।

 খালাআম্মা আমি সব পরে বলব। আগে মর্গে যাই। আমাদেরকে অনেক কাজ করতে হবে। স্যার না গেলে আমি একা কিছু করতে পারব না।

 ফায়জা আমাকে বলে, আপনি ওর সঙ্গে যান আরিফ ভাই। আমি ডালিয়া ভাবিকে দেখব। আপনি কোনো চিন্তা করবেন না। যত রাতই হোক আপনি কাজটা শেষ করে আসবেন। আমি এই ফ্ল্যাটেই আপনার অপেক্ষায় থাকব।

 অপেক্ষা! একটি শব্দে আমার ভেতর নড়ে ওঠে। দ্রুতকন্ঠে বলি, আমার দেরি হলে ডালিয়াকে স্যুপ দেবেন?

 ফায়জা আবার বলে, আমার ফ্ল্যাটে তালা দিয়ে আমি আপনার ফ্ল্যাটে থাকব আপনি ফিরে না আসা পর্যন্ত। ভাবিকে স্যুপ দেয়াতো আমার জন্য কঠিন কাজ না। আমি তো দেখেছি কীভাবে স্যুপ দিতে হয়। আপনি বেলির কি হয়েছে তা দেখুন। জুয়েল তোর খিদে পেয়েছে?

 না, আমার খিদে পায়নি। আমার আর কোনোদিন খিদে পাবে না খালাআম্মা, ও আবার হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে।

 তুই বোস জুয়েল, আমি রেডি হয়ে আসছি।

 আমি ঘরে ঢুকে দ্রুত কাপড় বদলাই। শুনতে পাই ফায়জা ওকে জিজ্ঞেস করছে, কি হয়েছিল বলতো?

 আমি সবটুকু জানি না। ওদের একজন আমাকে চিনতো। আমাদের বাড়ির কাছে আমি চায়ের দোকানে ছিলাম। সেই ছেলেটি আমাকে এসে বললো, বেলিকে দিয়েছি সাবাড় করে। যা তুলে নিয়ে আয়। নইলে কুকুরে টেনে নিয়ে যাবে। যে আমাদের কথা শুনবে না তার এমনই হবে।

 কোথায় ও কে সাবাড় করলি শুয়োরের বাচ্চা?

 ওই জলার দিকে। ওই দিকে যা, জলায় গিয়ে দেখ।

 তুই একা গিয়েছিলি?

 না, আমি একা যাইনি। আমার চিৎকারে লোক জড়ো হলে ও পালিয়ে যায়। অন্যদের আমি ঘটনার কথা বলি। আমার সঙ্গে অন্য লোকেরা ফাঁড়ির পুলিশের কাছে যায়। পুলিশ গিয়ে বেলিকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। ডাক্তার ওকে মৃত ঘোষণা করলে ওকে মর্গে পাঠানো হয়। এরপরই আমি এখানে আসি।

 ওদের কথার মাঝে আমি ডালিয়ার কপালে হাত ছুঁইয়ে বেরিয়ে আসি। ফায়জা আবারও বলে, আপনি বাড়ি নিয়ে চিন্তা করবেন না। যতক্ষণ সময়ই লাগুক না কেন ওর ব্যাপারটা দেখবেন। বেলির জন্য আমার নিজের খুবই খারাপ লাগছে। শয়তানগুলোর শাস্তি হয় যেন। দরকার হলে আপনার সঙ্গে আমিও থাকব। লড়াই চাই।

 ফায়জা আমাকে বিস্মিত করে। আমি ওর দিকে তাকিয়ে বলি, আচ্ছা আসি। ফ্রিজে খাবার আছে। আমার ছোট বোন দুপুরে দিয়ে গেছে। ইচ্ছে হলে খাবেন।

 আমাকে নিয়ে ভাববেন না। আপনি আসুন। আপনার সামনে অনেক দায়িত্ব।

 আমি বেরিয়ে আসি। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে আমার ভেতরে কি যেন হয় এই ভেবে যে ফায়জা আমার জন্য অপেক্ষায় থাকবে। পাঁচ বছরেরও বেশি সময় পরে কেউ আমার জন্য অপেক্ষায় থাকবে। এই প্রথম, ওহ কি সুন্দর রাত, একটি ধর্ষিত বালিকার মৃত্যুর খবর শোনার পরে বেঁচে থাকার ভালোলাগা আমাকে ভূপতিত করে না। ধর্ষণ ও মৃত্যুর বিপরীতে এই চিত্র আমার সামনে এসে হাজির হয়। আমি এটা যে নিজে নিজে তৈরি করেছি তাতো নয়, এটি এই সময়ের রিয়ালিটি। ফায়জা আমাকে দায়িত্বের কথাও মনে করিয়ে দিয়েছে। আমার সঙ্গে লড়াই করার কথা বলেছে। ও আমার সঙ্গে এভাবে যুক্ত হলে আমার বেঁচে থাকার পরের দিনগুলোতে শিউলি ফুল ফুটবে। শিউলির কমলা রঙের বোঁটায় শিশির জমবে। আমার ভেতরে প্রবল ভালোলাগার স্রোত বয়ে যায়। একটি ধর্ষণের ঘটনা এবং একটি বালিকার মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে শিউলি ফুলের ঘ্রাণ কি আমাকে টেনে নিয়ে যাবে কোথাও, যেখানে শোক এবং বিষণ্ণতা আমাকে আচ্ছন্ন করে রাখবে? আমি প্রশ্নের উত্তর খোঁজার মতো পরিস্থিতিতে নেই বলে মনে করতে পারি এখন। সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এই মুহূর্তের রিয়ালিটির সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করতে চাই। আমি জুয়েলের হাত ধরে বলি, এই ঘটনায় তোর খুব কষ্ট হচ্ছে জুয়েল?

 আমার মনে হচ্ছে আমি মরে যাই। আমি আর বেঁচে থাকতে চাই না। বেলি কেন এভাবে মারা যাবে? ও কি অপরাধ করেছিল?

 ওর ভেতরে কান্না এবং প্রতিবাদের বিষয় একসঙ্গে ফুটে ওঠে। বুঝতে পারি ওর ব্যাকুলতা।

 বেলিকে তুই কতদিন ধরে চিনতি?

 ছয় মাস হবে। ও তখন থেকেই ফুল বিক্রি করতে আসত।

 তুই ওর বাড়িতে গিয়েছিল?

 ওর মায়ের দুর্ঘটনার পরে গিয়েছিলাম। সেদিন বেলি কাঁদতে কাঁদতে আমাকে বলেছিলো, আপনি আমাকে বাঁচাবেন জুয়েল ভাই। আমি বলেছিলাম, তুই আমার আর একটা বোন হলি। আমার দুই দিদি আছে, তোকেও আমি দিদি ডাকব। আমিতো ওকে বাঁচাতে পারলাম না স্যার। ও কেন গুন্ডাদের নজরে পড়ল? ওতো দুষ্টামী করত না? ওর যত আবদার ছিল আমার কাছে স্যার। আমি রাখতে পারব না, এমন কোনো আবদার ও করত না।

 আবার কাঁদতে শুরু করে জুয়েল। আমি ওকে নিয়ে রিক্সায় উঠি। দু’কান ভরে কান্নার শব্দ শুনি। আমি জানি ও বেদনায় জর্জরিত একটি ছেলে। জেনেছে জন্মের পরিচয় নেই। যে মেয়ে ওর কাছে আশ্রয় চেয়েছিল তাকে ও বাঁচাতে পারেনি। ওর এই মানবিক সততার জায়গায় আজ থেকে শুরু হলো কষ্টের দহন। আমি নিঃশব্দে ওর পিঠের ওপর আমার ডান হাত রাখি। চিন্তা করি আজ রাতেই আমি আর ও বেলির লাশ নিয়ে কবরস্থানে যাব। থানায় কাল সকালে যাব। কিংবা কবরস্থান থেকে ফিরে সময় থাকলে থানায় ঢুকব।

 স্যার। জুয়েলের কান্নাভেজা কন্ঠস্বর শুনতে পাই।

 বল রে, কি বলবি। আমি আমার হাত দিয়ে ওর পিঠে চাপ দেই। আলতো করে কাছে টানি, যেন ও মনে করে ওর আশ্রয়ের জায়গা আছে।

 আমিতো কোনো অপরাধ করিনি স্যার, তবে আমার এত দুঃখ কেন?

 দুঃখ তোর কাছে চ্যালেঞ্জ জুয়েল। আমি তো দেখছি দুঃখ কাঁধে নিয়ে তুই শক্ত পায়ে দাঁড়াতে জানিস। বেলির জন্য তোর যে কষ্ট –

 জুয়েল শব্দ করে কেঁদে ওঠে। আমি আর কথা বাড়াই না। ওকে শক্ত করে চেপে ধরি। মনে করি ও রিকসা থেকে পড়ে যেতে পারে, ওর উথালপাতাল আবেগ ওকে স্থির থাকতে দিচ্ছে না। রিক্সা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ইমার্জেন্সির সামনে এসে থামে। আমি ডিউটি ডাক্তারের কাছে যাই। তাকে ঘটনার কথা বলি। বলি, ও বেওয়ারিশ লাশ হবে না। পোস্টমর্টেম হলে আমি তাকে কবর দেয়ার দায়িত্ব নেব। ওকে আমি নাতনির মতো স্নেহ করতাম।

 ডাক্তার সরাসরি তাকিয়ে বলে, আপনাদের কে হয় মেয়েটি? জুয়েলকে দেখিয়ে বলি, এই ছেলেটি ওর ভাই। এক মুহূর্তে থমকে যাই, মিথ্যা বললাম কি? না, মিথ্যা হবে না, যে ছেলের জন্মের পরিচয় নাই তার কাছে ঔরস এবং গর্ভ দু’টোই অনির্ধারিত। প্রয়োজনও নাই। যাকে ও বোনের মতো স্নেহ করেছে তারজন্য এতকিছুর দরকারও নেই। ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে আবার বলি, মেয়েটি আমার বাসায় কাজ করত। রাস্তায় ফুল বিক্রি করত। আমি আন্ডারটেকিং দিয়ে লাশ নিয়ে কবরস্থানে যাব বলে ও আমাকে নিয়ে এসেছে। আমিই ওর ভরসার জায়গা।

 আর কেউ লাশ নিতে আসবে না তো?

 গরীব মানুষের মেয়ে। আত্মীয়স্বজন যারা আছে তারা আমার উপরে কথা বলবে না। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। অবসরে আছি।

 ডাক্তার কপালে হাত তুলে বলে, সালামওয়ালাইকুম স্যার। আমাদের তো কিছু ফরমালিটিস –

 সব আমি জানি। আপনার নথির জন্য যা দরকার সব করুন। আমি অপেক্ষা করব।

 পোস্ট মর্টেম হয়েছে?

 হয়েছে স্যার। সব রিপোর্ট এসেছে।

 আপনার বাকি কাজ যা আছে তা সেরে ফেলুন। আমি বাইরে আছি।

 স্যার আপনি এখানেই বসেন।

 আমি দাঁড়াই না। বলি, মর্গে গিয়ে ওকে একটু দেখে আসি। ওর মৃত্যু আমার বুকের দেয়ালে ফাটল ধরিয়েছে। আমি এই মৃত্যুর বিচার চাইব।

 ডাক্তার আমার কথার উত্তরে কিছু বলে না। বারান্দায় বের হলে জুয়েল বলে, বিচার চাওয়া কঠিন কাজ স্যার। সামনে লম্বা লড়াই থাকবে। আপনার এতকিছুর মধ্যে ঢুকার দরকার নাই।

 তুই কি ভেবেছিস ততদিন আমি বাঁচব না?

 তা হতেও পারে। যদি বিশ বছর লাগে তাহলে কি আপনি বাঁচবেন স্যার?

 আমি ওর দিকে ঘুরে মুখোমুখি দাঁড়াই। বলি, ঠিক বলেছিস। আমরা বিচারহীনতার সংস্কৃতির মধ্যে আছি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করতেই চল্লিশ বছর লেগেছে। এখনো শেষ হয়নি। কবে শেষ হবে জানি না। তারপরও আমি চাইব বেলি-হত্যার বিচার হোক। গুন্ডা কয়টাকে জেলে পুরতে পারলেও আমার খানিকটুকু পাওয়া হয়েছে মনে হবে। একটাকেতো তুই চিনিস?

 চিনি। কিন্তু ও তো আর আমার সামনে নেই। পালিয়েছে।

 ধরা পড়বে। চিন্তা করিসনা। আয়।

 আমি জুয়েলের হাত ধরি। ওর এই হাতটি জুতো সেলাই করে। ওর এই হাতের মধ্যে হৃদয় আছে, কেঁদে বুক ভাসিয়ে দেয়। ওর হাতে সাহস আছে, সন্ত্রাসীর প্রতিরোধে রুখে ওঠে। ওর হাতে আমি নিজে ভরসার জায়গা খুঁজে পাই, আস্তে করে ডাকি, জুয়েল।

স্যার। আমি আপনার সঙ্গেই আছি। আমরা এখন মর্গের দরজায় দাঁড়িয়ে আছি। ভেতরে বেলি ছাড়া আর কোনো লাশ নেই।

 আমার সামনে এ এক নতুন বেলি।

 আপনাকে ও খুব ভালোবাসতো। বলতো, উনি মোর সত্যিকারের নানা। শুধু নানা না, আমার দাদা-দাদী-চাচা-চাচী-খালা-খালু-মামা-মামী-ফুপু-ফুপা – আমার বাবা-মা – আমার সব। ও বলতো এমন মানুষ দুনিয়ায় একজনই অয়।

 তুই আমাকে কাঁদিয়ে দিচ্ছিস জুয়েল। আমি এতক্ষণ কাঁদিনি ওর জন্য। আমি অন্যায় হত্যার জন্য চোখের পানি ফেলতে চাই না।

 জুয়েল কথা বলে না। ওর কান্নার ফোঁসফোঁস শব্দ শুনতে পাই। আমার মনে হচ্ছে, আমি খুব মনোযোগ দিয়ে ওর কান্নার শব্দ শুনছি, যেন এমন শব্দ আমার চুয়াত্তর বছরের জীবনে আমি কোনোদিন শুনিনি। মর্গ কোনো সাধারণ ঘর নয়। এটি এক অলৌকিক জায়গা। এখানে মায়াবী পরীরা উড়ে বেড়ায় – যারা বর্বরতার হিংস্রতায় প্রাণ দেয় তাদের বলে, ভয় পেয়ো না। প্রতিশোধের স্পৃহায় জেগে ওঠো। নির্মমতার বিরুদ্ধে তোমাদের জেগে ওঠা হোক সত্যের সঙ্গে রাখীবন্ধন।

 আমি কতক্ষণ দাঁড়িয়ে আছি জানি না। আসলে লাশকাটা ঘরের মধ্যে আমি কতক্ষণ দাঁড়িয়ে আছি জানি না। আমার চোখের সামনে বেলি নেই। শূন্য ঘরে বাতাস হা-হা ফেরে।

 স্যার। স্যার। স্যার।

 মনে হয় জুয়েলের ডাক আমার কাছে কোনো এক দূরাগত ধ্বনি, এমন কন্ঠস্বর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে আমার কাছে ভেসে আসছে। বলছে, টিন ড্রাম উপন্যাসের নায়ক বামন-অসকার এখন তুমি নিজে। কিছুই করতে পার না, মগজভরা বাজে ভাবনায় তলিয়ে থাকা মানুষের ভিড়ে বোকার মতো দাঁড়িয়ে আছ। পড়ালেখা করাই শেষ কথা না, যদি তা কোনো সমাজ-ভাবনার বড় কাজে না আসে। তুমি বাড়ি যাও আরিফুর রহমান। ডালিয়াকে দেখাশোনা করে বাকি দিনগুলো শেষ করো। গান গাইতে, গানের মানুষ হয়েছিলে, সেটাও নিঃশেষ হয়ে গেছে তোমার জীবনে।

 স্যার। জুয়েলের কান্নাভেজা স্বর।

 তুই একটা ভ্যানগাড়ি জোগাড় কর। আমি ডিউটি ডাক্তারের কাছে যাচ্ছি। কাগজপত্র নিয়ে আসি।

 আমার সামনে দিয়ে দৌড়ে বেরিয়ে যায় জুয়েল।

 কত রাতে বাড়ি ফিরি আমি জানি না। ঘড়ি দেখার ইচ্ছা আমার হয়নি। জুয়েল ওর বাড়িতে চলে গেছে। রিকসার ভাড়া চুকিয়ে দেয়ার সময়ে দেখতে পাই দোতলায় আমার ফ্ল্যাটে আলো জ¦লছে। ফায়জা বসে আছে। এবার আমার আর কোনো অনুভূতি হয় না। ফায়জার স্নিগ্ধ চেহারায় আমার কিছু যায় আসে না। একজন মানুষ অনুরোধ রক্ষা করছে, করতেই পারে তার দায়িত্বের জায়গা থেকে। এরপর ও বেলির হত্যার জন্য লড়াই করবে, আইনি লড়াই। সন্ত্রাসীদের সর্বোচ্চ শাস্তি পেতে চাইবে-হত্যার বদলে মৃত্যুদন্ড এবং মৃত্যুদন্ড রায়ের কার্যকর দেখার অপেক্ষায় থাকবে। আমি ভাবি, ও পাশে থাকলে আমার লড়াইয়ে একটি শক্ত হাত যুক্ত হবে। মর্গে বেলির লাশ দেখে আসার অনুভব আমাকে শক্ত করে দেয়। আমার চোখ ভিজে ওঠেনা। আমি সিঁড়িতে পা রাখি এবং সিঁড়ি গুণে গুণে উঠতে থাকি – এক, দুই, তিন, বারো, চৌদ্দ । তোর বয়সকে আমি হিসেব করছি, আমি অর্থনীতি পড়াই, হিসেবের সঙ্গে আমার গভীর যোগ রে বেলি। আমি হিসেব বুঝি, শুধু বুঝিনা এই বয়সে তোকে মরতে হলো কেন, অপরাধ ছাড়া একটি অন্যায় মৃত্যু? আমার মাথায় ইতিহাস ঢুকে যায়। আমি শ্রেণি বৈষম্যের জায়গা থেকে মৃত্যুকে দেখি – এই উপমহাদেশের স্বাধীনতার লড়াই শুরুর মৃত্যু। আমার গুরু কার্ল মার্কস উপমহাদেশের মানুষের অভাব-নিপীড়ন-ক্ষুধা-দারিদ্র্যের সঙ্গে নিজের চিন্তাকে মিলিয়েছিলেন। তাদের অবস্থাকে নিজ দর্শনে স্থাপন করে চেঁচিয়ে ডেকেছিলেন, জাগো মানুষ। মানুষতো জাগবেই। বিপরীতে অন্য মানুষেরা জেগে উঠতে চাওয়া মানুষদের গলার ওপর পা রাখে। আমার সামনে জুয়েল জেগে ওঠা মানুষ – মানবিক শক্তিতে জেগে ওঠা মানুষ। আমারতো ওর পাশে থাকতেই হবে। সেই ১৮৫৭ সালে জেগে ওঠা সিপাহীদের বিদ্রোহের সঙ্গে নিজেকে এক কাতারে রেখেছিলেন কার্ল মার্কস। সিপাহিদের সঙ্গে বর্বর আচরণ করা ইংরেজদের তিনি কুকুর বলে গালি দিয়েছিলেন। স্বদেশী যারা ওই কুকুরদের পক্ষে ছিল তিনি তাদেরকে দালাল বলে ধিক্কার দিয়েছিলেন। যাদের তিনি ধিক্কার দিয়েছিলেন তারা কেউ জুয়েল আর বেলি ছিল না। ছিল এই আরিফুর রহমান, যাদের জীবনে জ্ঞানের ভন্ডামি আছে, শ্রেণি-বৈষম্য খুবলে খাওয়ার বিলাস আছে, গভীর রাতে নিজের বাড়ির সিঁড়ি গুণে গুণে ওঠার বিলাস আছে এবং হত্যার বিচারের দাবিতে ফায়জাকে পাশে পাওয়ার বাসনা আছে। হাঃ, আরিফুর রহমান তাহলে তুমিও কি সেই কুকুর, যাদেরকে মার্কস গালি দিয়ে ক্ষান্ত হতে পারেন না। ক্রোধের আগুনে পুড়ে পুড়ে অনবরত বৈষম্যের চিত্রে নিজেকে সেঁটে রাখেন!

 আমি অবসন্ন বোধ করি। নিজেকে ধ্বিক্কার দেয়ার পরও আমার অবসাদ কাটে না। আমি দরজার সামনে এসে দাঁড়াই। কলিং বেলে আঙুল রাখি এবং কলিং বেলের শব্দ শোনার পরও আমার অবসাদ কাটে না। মনে হয় আমি বাড়িতে পৌঁছাইনি – আমি জানিনা আমার বাড়ি কোথায়, আমি জানি না আমকে কতটা পথ যেতে হবে। আমি জানি না আমার বাড়ি খুঁজে পাব কিনা। আমি দরজার ছিটকিনি খোলার শব্দ পাই।

 আমাকে দেখে চমকে ওঠে ফায়জা।

 আপনার কি হয়েছে আরিফ ভাই?

 কিছুতো হয়নি। আমি একদম ঠিক আছি। আপনার দেখার ভুল। নাকি আমার সামনে কোনো ভয়াবহ খবর আছে?

 আপনাকে কেমন জানি দেখাচ্ছে।

 ভূতের মতো লাগছে?

 ভূত আমি দেখিনি, তবে সেরকমই লাগছে।

 আমি মাথা ঝাঁকিয়ে নেই। নিজেকে সুস্থির করার চেষ্টা করি। বলি, লাশকাটা ঘর আমি আগে দেখিনি। বেলিকে আমি পথ থেকে ডেকে এনেছিলাম। ওর হাতে গোলাপ ফুল থাকত। লাল-সাদা-হলুদ গোলাপ। সেই বেলি আর ফুলের মতো বেলি নেই। সেই বেলি একটি পোকা হয়ে একটি ঘরে পড়ে আছে। মৃত লাশ, বেওয়ারিশ লাশ হয়ে যেত যদি জুয়েল নামের একটি বেজন্মা ওর পাশে না থাকত।

 আপনার কি হয়েছে আরিফ ভাই?

 আমার কিছু হয়নি। আপনাকে একটু আগেও বললাম, আমি ঠিক আছি। শরীরে এবং চিন্তায় ঠিক আছি।

 আপনার জন্য একটি খবর আছে।

 খবর? এই মধ্যরাতে? মধ্যরাতে খবর শোনার সৌভাগ্য আমার হয়নি। আসলে মধ্যরাতে কিছু ঘটে যাওয়া আমার কাছে ম্যাজিকের মতো।

 যে খবরের কথা বলছি। সেটি ম্যাজিক নয়, রিয়ালিটি। ফায়জার কন্ঠস্বর অন্যরকম লাগে, যেন ফায়জা দূর দেশ থেকে আমার সঙ্গে কথা বলছে। বিষাদভরা কন্ঠে খবর জানাচ্ছে, আপনি ডালিয়া ভাবির ঘরে আসুন।

 ডালিয়াকে স্যুপ খাইয়েছেন তো? ওকে সময় ধরে স্যুপ খাওয়াতে আমার ভুল হয়নি।

 ফায়জা আমার চোখে চোখ রেখে বলে, খাওয়াতে পারিনি। সময়ের কোনো হেরফেরও হয়নি।

 কেন?আমি চিৎকার করে উঠি। আপনি তো জানেন কীভাবে স্যুাপ খাওয়াতে হয়।

 নল দিয়ে স্যুপ তার মুখের ভেতর যাচ্ছিলনা। গড়িয়ে পড়ে যাচ্ছিল মুখ থেকে।

 আমি দ্রুতপায়ে দরজার কাছে এসে থমকে যাই। সেখানে দাঁড়িয়ে দেখতে পাই সাদা চাদর দিয়ে ডালিয়াকে ঢেকে রেখেছে ফায়জা। পাঁচ বছরের বেশি সময় পরে এই প্রথম আমি ওর মুখ দেখতে পাচ্ছি না। বোঁজা চোখ নিয়ে নিশ্চুপ শুয়ে থাকত। ধীরে ধীরে সেই মুখের আদল একটু একটু করে ভেঙে যাচ্ছিল। আমি বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি।

ফায়জা বলে, চাদরটা সরিয়ে দেই?

 না। আমি চিৎকার করে উঠি এবং আকস্মিকভাবে ফায়জাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকলে ও আমার পিঠের ওপর হাত রাখে।

 এটি একই গল্পের অন্যরকম শুরু। নায়ক আরিফুর রহমানই, তার ভেতরের অন্য কেউ কিংবা তার চারপাশের কেউ যাদের ছায়া জীবন ঘঁষে বের করে আনা আগুনের শিখা। তারা জীবনের ঘাটে ঘাটে আগুন জ¦ালিয়ে শীত নিবারণ করে। এখন গল্প আর একজন আরিফুর রহমানের, তার নাম ওসমান আলি, যে শৈশব হারিয়ে বড় হয়ে ওঠা একজন যুবক। যে খুঁজে বেড়ায় জহির রায়হানকে, যিনি ‘স্টপ জেনোসাইড’ চলচ্চিত্রের শিল্পের নতুন মাত্রা তৈরি করে স্বাধীনতার আকাশে বোমারু ছিলেন। স্বাধীনতার পরে শহীদ হলেন, নিখোঁজ হয়ে গেল তাঁর মরদেহ। কিন্তু ওসমান আলি তাঁকে স্মরণ করে পূর্বসূরীকে সঙ্গে রাখার চেতনায়, যেন অনন্তকাল ধরে হেঁটে আসা মানুষের ছায়া জড়িয়ে থাকে তার বেঁচে থাকার ভুবনে। অপেক্ষা করে একটি ডাকের, বলতে চায় এইতো আমি এখানে। আমি আপনার উত্তরসূরী, নিয়ে যাব আপনাকে আগামী দিনের মানুষের কাছে। আমি ততোদিন আপনাকে খুঁজব যতদিন এ দেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শেষ হবে না। আমরা আপনার অকৃতজ্ঞ পূর্বসুরী নই যে আপনাকে যারা হত্যা করেছে তাদের বিচার চাইব না। স্বাধীন দেশে আমার বেঁচে থাকা আপনার মৃত্যু, জহির রায়হান। আমি আপনার মৃত্যুকে স্বরণের দীপশিখায় অমলিন রাখি। জানালার গ্রিলে কপাল ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে ওসমান। ওর ভাবনার জগত যত বড়, কথার জগত ততই ছোট। ও কথা বলতে ভালোবাসে না, প্রয়োজনের অতিরিক্ত কথা তো নয়ই।

 নিঃসঙ্গতা ওর কাছে একটি শব্দ মাত্র নয়।

 বন্ধুরা যখন ওকে জিজ্ঞেস করে তুই এত চুপচাপ থাকিস কেন? ও উত্তর দেয় না। কেউ কেউ বলে, তোর ভেতরে বোধ হয় একটি মাকড়সা আছে, যেটি অনবরত সুতো ছড়ায়। নাকি রে? ও উত্তর দেয় না। প্রসঙ্গ এড়িয়ে যায়। ও তো জানে ও নিঃসঙ্গতা উপভোগ করে। যে বালকের শৈশব-কৈশোর বালকের মতো থাকে না নিঃসঙ্গতা তার বিনোদন। শৈশবে খাটুনির শুরু। রোজগারের খাটুনি। শৈশবে যাকে উপার্জন করতে হয় সে তো বড় মানুষ হয়ে যায়। তার স্মৃতি থাকে না। শৈশবের বোধই হারিয়ে যায়। এখন এই বয়সে এসে ওর কাছে নিঃসঙ্গতা মানে নিজের সঙ্গে খেলা।

 ও বলতে পারে না যে ও চুপচাপ থাকে না। চুপচাপ না থাকার রকমফের আছে। কেউ কথা বলে নিজেকে উজাড় করে, কেউ নিশ্চুপ থেকে কোলাহলে ডুবে যায়। আসলে বিষয়টি হচ্ছে কে কীভাবে নিজের অনুভব ভরিয়ে তোলে সেটিই দেখা। ও নিঃসঙ্গতা ভালোবাসে। শৈশব থেকে শুরু করে তারুণ্যের এই সময় পর্যন্ত নিঃসঙ্গতার অনুভব নিয়ে বড় হওয়ার আনন্দ ওর ভেতরে আছে। ও যেসব বিপর্যয়ের ভেতর দিয়ে হেঁটে এসেছে সবটাই ওর অসাধারণ স্মৃতি। জীবনের ধানের গোলায় তার সবটুকুই অভিজ্ঞতার সঞ্চয়। এই সবকিছু নিয়ে ও হেঁটে যাবে পৃথিবীর পথে পথে।

 এখন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। বয়স তেইশ।

 বাবা ওর নাম রেখেছিল ওসমান আলী। মা ডাকতেন ওসমু বলে। এখন এই নামে কেউ ডাকে না। হারিয়ে যাওয়া শৈশবের সঙ্গে নামটাও হারিয়ে গেছে। শুধু ও জমিয়ে রেখেছে স্মৃতির পাতায়। ওর কাছে ওসমু তিতপুঁটির আঁশের ওপর লাল রং। কৈশোরের পরে ওর আর তিতপুঁটি দেখা হয়নি। স্লুইস গেট হওয়ার কারণে খালের পানি শুকিয়ে গেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসার পরে ওর মনে হয়েছিল শৈশবে বাবা মারা না গেলে ওর জীবনটা হয়তো অন্য রকম হতো। তাই কি? বোধ হয় না। বাবাও তো দিনমজুর ছিল। সারা দিনের রোজগারের পরে চাল আসত বাড়িতে। মা সেই চাল হাতে নিয়ে চুলোয় বসিয়ে রাখা হাঁড়ির নিচে আগুন জ্বালাত। গামলায় চাল ঢেলে কলসির পানিতে ধুয়ে হাঁড়িতে ছাড়ত। টগবগিয়ে উঠত ভাত। এর বেশি আর ওর বাবা কি করতে পারত! কিচ্ছু না। ওর জন্য মা যা করেছে ওর বাবাও তাই করত। ওসমান দীর্ঘশ্বাস ফেলে না। দীর্ঘশ্বাসকেও ও শৈশবে ছেড়ে এসেছে। দীর্ঘশ্বাস এখন স্মৃতির মাধুর্য। মনে করে না যে দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে দুঃখ মিশে আছে, ভাবে যা কিছু কষ্টের তার দিকে পিঠ ফিরিয়ে হেঁটে যাওয়া।

 শৈশবে বাবা মারা যাওয়ার পরে মা পথের ধারে বসে ইট ভাঙার কাজ করত। নইলে ধানের কলে যেত ধান ভাঙার কাজ করতে। নইলে মানুষের বাড়ির ছাগল চরানোর কাজ করত। মায়ের খুব ইচ্ছা ছিল ওসমুকে লেখাপড়া শেখানোর। এই দিনমজুরির জীবনে ছেলের লেখাপড়া হবে কি না সেটা ভাবতে ভাবতে একদিন সরকারি প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি করে দেয়। ওকে নানা রকমের প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে স্কুলের টিচার খুশি হয়। ওর পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলে, শাবাশ ছেলে। ওর মা হুরমুতুন বানুর দিকে তাকিয়ে বলে, তোমার ছেলের মাথা আছে গো বুয়া।

 হুরমুতুন বানু তো আগে থেকে খুশি হয়ে গিয়েছিল। দেখেছিল ছেলেটিকে যা জিজ্ঞেস করা হচ্ছে তার সব উত্তর দিতে পেরেছে ও নদীর নাম বলতে পেরেছে। পূর্ব-পশ্চিম কোন দিকে তা দেখাতে পেরেছে। কোন উপজেলায় ও থাকে সেটাও ম্যাপে দেখাতে পেরেছে। দশ পর্যন্ত মুখস্থ বলতে পেরেছে। কোনো দিন স্কুলে না গিয়ে যে ছেলে এত প্রশ্নের ঠিক উত্তর দিতে পারে তাকে তো স্কুলে ভর্তি করবেই টিচার। হুরমুতুন বানুর খুশির অন্ত নেই।

 টিচার হাসমত মিয়া বলেছিল, তোমার ছেলেকে আর ছাগল চরানোর কাজে নিও না বুয়া। ও লেখাপড়ায় ভালো করবে। অনেক বছর ধরেইতো মাস্টারি করি, এমন একটি ছেলে দশ বছরে দেখিনি।

 হুরমুতুন ভেবেছিল, ওর হাতের মুঠোয় কি আকাশ ঢুকে গেছে। শুধু ছেলের দিকে তাকিয়েছিল। ওর বয়স হিসেব করেছিল সেদিন মাকে উত্তর দিতে দেয়নি ওসমান আলি। সঙ্গে সঙ্গে বলেছিল, আমি মায়ের লগে কাম করুম। নইলে মায়ের মেলা কষ্ট অইব। মা জিরানের টাইম পাইব না। মা জিরাইতে না পারলে ভাত রাঁধব কে?

 টিচার ছেলেটিকে দেখে মনে মনে প্রশংসা করেছিল। মুখে কিছু বলেনি। অবাক হয়েছিল মায়ের জন্য ওর এমন অনুভব দেখে। বলেছিল, আল্লাহ তোরে রহম করুক রে ওসমান।

 এই ভাবনার সঙ্গে সঙ্গে ও শুনতে পায় মা ওকে ডাকছে, ওসমু, ওসমু রে-

 আপনে কোনহানে মাগো, আপনেরে তো আমি খুঁইজা পাইতাছি না।

 যার শৈশব হারায় সে আর কীভাবে মাকে খুঁজে পাবে। সবই তো হারিয়েছে। ওর এটুকু মনে আছে যে থ্রি থেকে ফোরে ওঠার সময় ওকে ফার্স্ট হতে দেখে হাউমাউ করে কেঁদেছিল ওর মা। মাকে কাঁদতে দেখে কেঁদেছিল অন্য দুই ভাইবোন। টিচার বলেছিল, কাঁদ কেন ওসমানের মা। আজ তোমার খুশির দিন। তোমার পোলা ফার্স্ট হয়েছে। ওকে দিয়ে আমাদের স্কুলের সুনাম হবে। দেখবে ও একদিন অনেক বড় হবে। ও আমাদের গর্ব হবে।

 হেড মাস্টারের হাসিমুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়েছিল ওর মা। আর মায়ের মুখ দেখে বিহ্বল হয়ে গিয়েছিল ওসমান। এসব মুহূর্তে কি করা উচিত তা বুঝতে পারছিল না।

 হুরমুতুন বানু কান্না জড়ানো কণ্ঠে বলেছিল, ও আমার সোনার পোলা রে- তোরে দিয়া আমি আর কাম করামু না। তুই অহন থাইকা কেবলই স্কুলে যাবি। অহন থাইকা কেবলই লেহাপড়া। আর কিছু না।

 মা ভাত খামু না?

 খাবি বাজান খাবি। ভাত তো খাঅন লাগব।

 আপনে একলা চাল কিনতে পারবেন?

 পারমু বাজান, পারমু। তুই ভাবিস না।

 আশেপাশে দাঁড়িয়ে থাকা অন্যরা হেসে গড়িয়ে পড়ে। কেউ কেউ ওসমানের পিঠ চাপড়ে দেয়। কিন্তু ওদের দিকে খেয়াল না করে ওসমান উদ্বিগ্ন স্বরে মাকে জিজ্ঞেস করে, মা আপনে কান্দেন ক্যান?

 খুশির কান্দা কান্দি বাজান। আইজ আমার ঈদের দিন। গরিবের ঈদ না, বড়লোকের ঈদ।

 মায়ের কথায় ওসমান নিজেও উজ্জ্বল মুখে ঘনঘন মাথা নাড়ে। স্কুল থেকে মায়ের হাত ধরে বাড়ি ফেরে। আজ ও মেঠোপথে হাঁটতে হাঁটতে ফড়িং ধরতে ছুটে যায়। পথের ধারে ফুটে থাকা বুনোফুল ছিঁড়ে এনে মায়ের হাতে দেয়। মা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, আহারে, মোর সোনার পোলা …।

 কিন্তু মায়ের আদরের সঙ্গে বাস্তবতা ভিন্ন। ওকে ঠিকই কাজ করতে হয়েছে। কয়েকটা টাকা বেশি রোজগার হয়েছে। ফাঁকে ফাঁকে স্কুলে গিয়েছে। রাতের বেলা হারিকেন জ্বেলে পড়া মুখস্থ করেছে। প্রতিবছর ক্লাসে ফার্স্ট হয়েছে। প্রাইমারি পরীক্ষায় বৃত্তি পেয়েছে। টিচাররা প্রশংসা করেছে। বলেছে, গোবরে পদ্মফুল। না-না কুঁড়েঘরে চাঁদের আলো। নাকি উলুবনে মুক্তা একটা। ওসমানের এত কিছু বোঝার সাধ্যি ছিল না। টিচার ওর মাথায় হাত দিলে ও খুশিতে গদগদ হয়ে যেত। বুঝতে পারত না যে ওর দরিদ্র অবস্থার জন্য তাদের বিদ্রুপ আছে। ও যখন প্রবল তৃষ্ণায় ওর শৈশব খুঁজতে থাকে। বুঝতে পারে না যে শৈশব কোথায়? শৈশব কাকে বলে? কেমন করে শৈশব কাটাতে হয়? কে যেন ডাকছে, ওসমান ওসমান। বাবা তুমি কোথায়? তোমাকে আমি খুঁজে পাচ্ছি না। তুমি কি ধানক্ষেতে নাকি রাস্তায় মাটি কাটছ? নাকি ঘরের চালে ছাউনি দিচ্ছ? বাবা গো-তুমি কেন এভাবে হারিয়ে যাও। তখন ভেজিয়ে রাখা দরজাটা ধাক্কা দিয়ে খুলে ঘরে ঢোকে বদরুল আর বাশার।

 ওমা তুই তো ঘরেই আছিস। তবে কথা বলিস না কেন? কতক্ষণ তোকে ডাকাডাকি করলাম। জোরেইতো ডাকলাম।

 আমার ইচ্ছে হয়নি সাড়া দিতে। ডাকলেই উত্তর দিতে হবে নাকি?

 জানি তো তুই এমনই। এভাবে থাকলে একদিন তুই সাইকিক হয়ে যাস কি না সেই ভয় পাই। এত চুপচাপ কি করে থাকিস? তোর মনে কি অনেক দুঃখ?

 না। দুঃখ আবার কী! এই সব আমি বুঝি না। দুঃখ-ফুঃখ আমার ধাতে নাই। বোগাস।

 ন্যাকা। প্রেমে পড়লে বুঝবি। প্রেমিকা তোর গায়ের চামড়া উঠিয়ে ছাড়বে। তখন বুঝবি শরীরের হাজার হাজার ফুটো দিয়ে দুঃখ ঢুকে যাচ্ছে।

 প্রেমে চটকি খেলে বুঝব, নইলে বুঝব কেন? সবই গা-সওয়া। ভাবিস না আমার কিছু হবে।

 বেশি কথা বলিস। চুপ থাক বেটা।

 এই না বললি, আমি কথা বলি না।

 বাশার ওকে ঘুষি দেখায়। ও কিছু বলে না। ও জানে বন্ধুরা ওর সঙ্গে এমনই করে। বন্ধুদের নানা প্রশ্নের সামনে দাঁড়াতে হয় ওকে। কখনো উত্তর দেয়। কখনো চুপ করে থেকে এড়িয়ে যায়। নানা কথা উড়িয়ে দিয়ে আকাশে হাউইবাজি দেখে। ভাবে, বেঁচে থাকা দারুণ একটি খাল। সেই খালের স্বচ্ছ জলে ভেসে বেড়ায় তিতপুঁটি। সে পুঁটির আঁশে লাল দাগ জ্বলজ্বল করে। সেই লাল রঙের সঙ্গে হারিয়ে যাওয়া শৈশব-কৈশোর মিশে থাকে। আসলে জীবন কাটানোকে উপভোগ করতে শিখতে হয়। শিখতে না পারলে বেঁচে থাকার নিঃসঙ্গতা উপভোগ করা যায় না। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পরে ও একটি ক্যামেরা কিনেছে। ক্যামেরায় ছবি তুলে ভরে রাখে। এটাও হারিয়ে যাওয়া বিষয়ের প্রতিবিম্ব, আয়নার মতো। যেদিকে তাকালে নিজের সময়কে দেখা যায়। ও ক্যামেরা নিয়ে ঘোরে। নতুন জায়গা এবং বিষয় খোঁজে।

 খুঁজতে খুঁজতে শুনতে পায় মায়ের ডাক, ওসমু পান্তা খাইতে আয়। পুঁটি মাছের তরকারি রানছি।

 তুমি তো জান আমি পুঁটি মাছ খাই না। ওই মাছ আমার দেখার জন্য। ছোট খালের পানিতে ভেসে বেড়ায়। আমি খালে নামলে ওগুলো হারিয়ে যায়। আমি আর খুঁজে পাই না।

 কই গেলি ওসমু? তোর থালায় পান্তা বাড়ছি।

 আমি পান্তা খাব না মাগো। আমি গরম ভাতে ঘি মাখিয়ে খাব। তোমার নিজের হাতে বানানো ঘি, তুমি কিন্তু আমাকে বলবে না যে তোমার বাড়িতে গরু নেই।

 ওসমু কোনহানে গেলি রে? আমি তো বইসা আছি।

 তুমি আমাকে ওসমু নামে ডাকবে না। পুরো নামে ডাক।

 আমার ওসমান আলী কোনহানে গেলি?

 আমি তিতপুঁটি ধরতে এসেছি। এখনো একটাও পাইনি। এগুলো যে কোথায় লুকিয়ে থাকে!

 ওসমান আলী, ওসমান আলী…

 মা আমি একটি ব্যাঙ খুঁজছি।

 ব্যাঙ কী করবি রে সোনা? ওরে মোর সোনার পোলা …

 আমি ব্যাঙের ডাক শুনব মাগো। ব্যাঙ নিয়ে পৃথিবীর এক মাথা থেকে আরেক মাথায় ঘুরব। ও ডাকতে থাকবে আর মানুষজন আমার দিকে তাকিয়ে বলবে, দেখ দেখ একটা পাগল যাচ্ছে। কেউ ঝোলায় ব্যাঙ নিয়ে পথে হাঁটে? হা হা। আমার হাসি পায়। আমি তো পাগলই হয়ে যাই যখন মা আমাকে পান্তা খেতে ডাকে। আমার মনে হয় পান্তা ভাতের হাঁড়িতে ব্যাঙ থাকে। হাজার রকম ব্যাঙ। সেগুলোর কোনোটাই এক রকম না। কেমন ঘোরের মধ্যে দিনের পাড়ি জমাই সূর্যাস্তের দিকে। তারপর আর একটি দিনের শুরু দেখি। মায়ের সঙ্গে তো আমি এভাবেই কথা বলি। মা আমার সামনে নেই তো কি হয়েছে, আমার বুকের ভেতরের ডাক তো মায়ের জন্য থাকবেই। আমি যেখানে যে অবস্থাতেই থাকি না কেন!

 বদরুল বলে, কি রে কি ভাবছিস? আমিতো জানি নিজের সঙ্গে কথা বলতে তুই খুব ভালোবাসিস। চল, ওঠ। চল ঘুরে আসি।

 কোথায় যাবি? তোদের সঙ্গে সব জায়গায় যেতে আমার ইচ্ছে হয় না।

 ঠিক আছে।

 যেদিকে দুচোখ যায় সেদিকে যাই। কোনো জায়গা ঠিক না করে বের হলে সেটা অ্যাডভেঞ্চার হয়।

 এসব রোমান্টিক কথা আমার একটুও পছন্দ না। আমার পড়া আছে। এখন বের হব না।

 সবাই জানে তুই ফার্স্ট ক্লাস পাবি। তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবি। তোর ভাগ্যের গিঁটটু দেওয়া হয়ে গেছে। আমি হলাম গিয়ে ভ্যাগাবন্ড। কোথায় গিয়ে যে ঠেকব, কে জানে!

 তুই কি থামবি? এসব ফালতু কথা শুনতে মোটেই ভালোলাগছে না।

 ওসমান আলী কড়া চোখে তাকায়, যেন ক্রোধের বিশাল ব্যাপ্তি ওর চোখে ভর করেছে।

 এমন করে তাকিয়েছিস যেন গিলে ফেলবি? কি দোষ করেছি আমি?

 মৃদু হেসে ওসমান বলে, তুই আমার বন্ধু রে। আমার টিউশনিটা তো তুই জোগাড় করে দিয়েছিস। নইলে তো গাঁয়ে ফিরে দিনমজুরি করতে হতো।

 যেই মেধা নিয়ে এত দূর এগিয়েছিস তোর আর পিছিয়ে যাওয়ার পথ নেই রে। তোর রাস্তা এখন সামনে। যেতেই থাকবি যেতেই থাকবি। দেখবি তোর পথ আটকে দাঁড়িয়ে কেউ নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *