হেঁটে যাই জনমভর – ৩

 জুয়েল রান্নাঘরে ঢোকে। ওর জন্য একটি গ্লাস ও প্লেট আলাদা করা আছে। বেলির জন্যও আছে। যে বুয়া রান্না করে তারজন্য নেই। যে কাপড় ধোয়ার কাজ করে তারজন্যও না। ওরা জানে এই বাড়িতে ওদের জন্য আলাদা জায়গা আছে – সে জায়গায় পুষি বেড়ালের ম্যাঁও আছে, নেংটি ইঁদুরের কুচকুচি আছে, আরশোলার ওড়াউড়ি আছে, মাকড়সার বাসা বুনন আছে – আর কি? জুয়েল একমুহূর্তে ভাবে, বোঝে আরও অনেক কিছু, কিন্তু সে ভাবনা ওর একার নয়। ও সুষমার দিকে তাকায়। চেহারায় ক্লান্তির ছাপ নেই, খুশির আভা আছে, বুঝতে পারে না খুশিটা কেন? থাক, বোঝার দরকার নেই, প্রয়োজনের বাইরে ও কেন আর একজনের খুশি-অখুশি মাথার ভেতর ঢোকাবে? জুয়েল রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকে। সুষমা ডাইনিং টেবিলের ওপর খাবারের বক্সগুলো খোলে। প্রতিটি বক্সের ঢাকানা খুলে টেবিলের ওপর গোছায়। জুয়েলের দিকে তাকিয়ে বলে, তোর প্লেট নিয়ে আয় জুয়েল। জুয়েল ওর প্লেট নিয়ে এলে ওকে প্লেট ভর্তি করে বিরিয়ানি দেয়। মাংসের রেজালা দেয়। জিজ্ঞেস করে, বেগুনের দোলমা দেব রে?

 না, না আর কিছু দেবেন না। এর অর্ধেক খাবার আমি পলিথিনের করে মায়ের জন্য নিয়ে যাব। মা খুব খুশি হবে। বলবে, ছেলেটা আমাকে ছাড়া ভালো কিছু খেতেই পারে না। মা যখন এমন কথা বলে, তখন মাকে পরীর মতো দেখায়। মায়ের চুলগুলো সব অমার সামনে বকুল ফুল হয়ে যায়। মাথাভর্তি বকুল ফুল দেখে আমি আমার জন্মের কথা ভুলে যাই।

 তুই যে কেমন করে এতকিছু ভাবতে পারিস তা আমি বুঝি না। তুই একটা অন্যরকম ছেলে। আমি এমন ছেলে দেখিনি রে জুয়েল। আমরাতো জানি তোর মা তোকে খুব ভালোবাসে। তোর দুই দিদিরতো বিয়ে হয়ে গেছে না রে?

 হ্যাঁ, খালামণি। ওরা খুব ভালো আছে। দুই বোনের দু’টো বাচ্চা আছে। ওদের বাড়িতে গেলে বাচ্চা দু’টো আমাকে ছাড়তেই চায় না। জোর করে বের হয়ে আসলে ওরা কেঁদে বাড়ি মাথায় তোলে।

 কথা বলে লাজুক হাসিতে নিজেকে ভরিয়ে তোলে ও। একই ভঙ্গিতে সুষমার দিকে তাকালে সুষমা ওর আনন্দ উপভোগ করে, ভাবে বিয়ের পরপরই ওর একটি বাচ্চা হলে ও হয়তো জুয়েলের কাছাকাছি বয়সের হতো, জুয়েলের ভেতরে খুঁজে পাওয়া আনন্দ ও নিজের সন্তানের মাঝেই পেতো, ছেলে বা মেয়ে যেই হোক না কেন। ওর চোখে পানি এসে পড়ে তারপরও নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে মৃদু হেসে বলে, ওরা তোকে বিয়ে দেবে না?

 বিয়ের কথায় ও লজ্জা পায় না। প্রবলভাবে মাথা নেড়ে বলে, আমি ঠিক করেছি যে বিয়ে করব না। একটি কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে পারার তারুণ্যে ও এখন কঠিন-চোয়ালের যুবক। বদলে যায় ওর চেহারা।

 সুষমা আবারও মুগ্ধ চোখে দেখে ওকে। এক মেধাবী ছেলে। ওর চিন্তায়-প্রকাশে কখনোই মনে হবে না যে ওর বিদ্যালয়ের শিক্ষা নেই। আমি দূর থেকে সুষমা আর জুয়েলের আলাপ শুনি। জুয়েলের মেধা নিয়ে আমার সংশয় নেই। বুঝতে পারি ও দারুণ মেধাবী, শুধু পড়ালেখার সুযোগ পায়নি। ওকে নিয়ে আমার ভাবনার শেষ নেই। সুষমার কথার প্রসঙ্গ ধরে বলি, কেন রে, বিয়ে করবি না কেন? এর আগে আমি কখনো ওকে এ ধরণের প্রশ্ন করিনি। ইচ্ছে করেই করিনি ভেবেছি, ওর আর কিইবা বয়স হয়েছে। ও আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। আমি আবার প্রশ্ন করি, বিয়ে করবি না কেন? জীবনের সবকিছু গুছিয়ে চলতে হবে। বাউন্ডেলে হতে পারবি না। আমার কাছে থাকলে আমার কথা শুনতে হবে। খালামণির কথাও শুনতে হবে।

 কি হবে বিয়ে করে স্যার? যে কদিন বাঁচি সে কদিন একা একা থাকব। বাবা-মা মরে গেলে আমি পথে বেরিয়ে যাব স্যার।

 সুষমা নরম কন্ঠে বলে, এসব কি বলছিস তুই?

 আমি এমনই ভেবে রেখেছি। যেটুকু আয়-রোজগার করি তা দিয়ে সংসার হবে না। সংসারের কথা ভাবতে আমার ভালোলাগে না।

 তোর বাবা-মা জানে? তারা জানলে খুব দুঃখ পাবে। তারাতো চাইবে ছেলের বিয়ে হবে। ঘরে নাতি-পুতি আসবে।

 না, তাদেরকে কখনো বলি না।

 তারা তোকে বিয়ের কথা বলে না?

 বলে। আমি বলি, আগে তোমাদের জন্য একটা বাড়ি বানাব। তারপর নিজের কথা ভাবব। মা খুব রেগে যায়। বলে, আমাদের জন্য বাড়ি বানাতে হবে না। তোকে বিয়ে দিয়ে বউ নিয়ে বাড়িতে উঠব আমরা। ওটা তোর বউয়ের বাড়ি হবে।

 আমিও তাই মনে করি। বাড়ি কি সোজা কথা। আমার ভাইয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি শেষ করার পরে রিটায়ারমেন্টের টাকা পেয়েছে তাই দিয়ে এই ফ্ল্যাট কিনেছেন।

 জুয়েল হাসতে হাসতে বলে, স্যারের চেয়ে কঠিন কাজ আমি করব। রাস্তার ধারে বসে জুতা সেলাই করে বাড়ি বানাব।

 আমি হা-হা করে হাসতে হাসতে বলি, তুই আমার চেয়ে সাহসী ছেলে। এজন্যইতো তোকে আমার ভালোলাগে।

 সুষমা খাবারের থালাটা ওর হাতে দিয়ে বলে, নে। খেয়ে ফেল। ভাইয়া তুমি কি এখন খাবে?

 আমি তোর সঙ্গে খাব। তুই এখন খাবি?

 ঠিক আছে। চলো খেয়ে ফেলি। অফিসের কিছু কাজ বাড়িতে নিয়ে এসেছি। গিয়ে সেগুলো শেষ করতে হবে। তুমি বোস। আমি হাতমুখ ধুয়ে আসি।

 আমি ডাইনিং টেবিল সাজাই। প্লেট-গ্লাস আনি। সুষমার খাবারের বাটি একটা একটা করে ওভেনে ঢুকিয়ে খাবার গরম করি। ডালিয়া সুস্থ থাকতে এসব কাজ আমি ডালিয়ার সঙ্গে করতাম। ও খুশি হতো। বলতো এমন পুরুষ মানুষই আমি চাই। যার চিন্তা স্বচ্ছ। যার ভাবনায় দ্বিধা নাই। হায় ডালিয়া, আমাদের প্রবল সমতার জীবনে এখন গভীর ফাটল। পানির তোড়ে ভেসে যায় ঘরবাড়ি। আমি একা মানুষ দিনের প্রহরে আলোর রেখা দেখি না। মাঝে মাঝে মনে হয় রাস্তার পাশে বসে জুতো সেলাই করে যাচ্ছি। আমার সুঁই-সুতোয় কোনো জুতোই জোড়া লাগে না। ফাঁক হয়ে থাকে। লোকেরা দেখতে পায় না। খুশি মনে জুতো পায়ে বাড়ি যায়। ডালিয়া, আমি এখন তুষের আগুন। ধিকিধিকি জ¦লছি। তোমার সঙ্গে কোনোকিছু শেয়ার করতে না পারাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় পরাজয়। তুমি কি আমার অসহায়ত্ব বুঝতে পার ডালিয়া! আমি ডাইনিং টেবিল রেডি করে নির্দিষ্ট চেয়ারে বসে সুষমার জন্য অপেক্ষা করি। ডাইনিং রুমের চারদিকের কাঁচের দেয়ালে ভেসে ওঠে ডালিয়ার যৌবনকালের ছবি। ঘর গোছাচ্ছে। ডাইনিং টেবিল ভর্তি খাবার। নিজেই রান্না করেছে। তরকারির বাটি থেকে ভাঁপ উঠছে। আর আমাকে ডাকছে, মেঘপাখি খেতে আস। নইলে সব ঠান্ডা হয়ে যাবে। ছেলেমেয়েরা ইউনিভার্সিটিতে। বাড়িতে আর কেউ নেই। কাজের মেয়েটি ওর গাঁয়ের বাড়িতে গেছে। আমি ভাবছি, খেতে না গেলে কি হয়? আমার পরীক্ষার খাতা দেখতে হচ্ছে। এই সময় খাতা রেখে উঠে যাওয়া মানে মিস ইউজ অফ টাইম। আমার রাগ হয়। আমি আরও গভীর মনোযোগ দিয়ে খাতা দেখায় মগ্ন হয়ে যাই। ভুলে যাই যে ডালিয়া আমাকে খেতে ডেকেছে। তারপর যা হবার তাই হয়। দু’দিন কথা বলা বন্ধ। তৃতীয় দিনে রায়না বলে, তোমাদের কি হয়েছে মা? বাড়িতে দম আটকে আসছে। কোথাও কোনো বাতাস নেই।

 ডালিয়া অবাক হয়ে মেয়ের দিকে তাকায়। কিছু বলে না। রায়না আবার বলে, আমার চোখকে ফাঁকি দিতে পারবে না। আমি বুঝতে পারছি তোমাদের কিছু হয়েছে।

 বুঝতে পারলেতো ভালোই। যা বুঝেছ তা নিজের মধ্যে রাখ। জিজ্ঞেস করে কেন বাড়ি মাথায় তুলছো।

 রায়না চেঁচিয়ে বলে, বাড়িতে একটা কিছু ঘটলেতো বাড়ি মাথায় তুলবই। আমি বাড়ির একজন বাসিন্দা। যেটুকু বুঝেছি তা আমার কাছে শেষ কথা না। তোমার কাছ থেকে শুনতে হবে। নইলে বোঝাটা ঠিক হবে না।

 আমি হাসতে হাসতে বলি, এটাও কি তোর রিসার্চের অংশ মা?

 বাবা আমাকে ফাঁকি দিতে পারবে না। তুমি আমার প্রশ্নের উত্তর দাও। না, এটা কোনো রিসার্চ না। এটা ইমোশনের জায়গা। মানুষের ইমোশনে ঘা লাগলে সেটা রঙ বদলায়। অন্যরা তা বুঝতে পারে না।

 ডালিয়া হাসতে হাসতে বলেছিল, আমাদের মেয়েটার অনেক বুদ্ধি। ও আমাদের চেয়ে বেশি বোঝে। ওর সঙ্গে পারবে না।

 রায়না রেগেমেগে বলে, বুঝেছি তোমাদের কাছ থেকে উত্তর পাব না। আমি গেলাম। মনে রেখো এরপর যদি তোমরা কথা বন্ধ রাখ তাহলে আমি এই বাড়িতে থাকব না।

 আমি হো-হো করে হাসতে হাসতে বলি, যেদিকে দু’চোখ যায়, সেদিকে যাব। ঠাঁই কোথাও না কোথাও মিলবে।

 সেখানেও মন খারাপ করে দেয়ার আচরণ পাবি না। মানুষ তো মানুষই। ফেরেশতা না।

 আমি সব মানুষের আচরণ দেখতে যাব না বাবা। আমার সামনে মানুষ দু’জন, আমার বাবা আর মা।

 মেয়ের কথায় ডালিয়া হাসিতে ভেঙে পড়ে। মায়ের হাসির শব্দ মাথায় নিয়ে ঘর ছাড়ে রায়না।

 আমি বুঝেছিলাম ডালিয়ার রাগ ভেঙেছে। ওর হাসিতে নদীর স্রোত ধ্বণিত হচ্ছে। এই ধ্বণি আমার খুব প্রিয়। আমি বুঝতে পারি তখন যে ডালিয়া আবার নিজের ফর্মে এসেছে। যে অভিমান কিংবা অভিযোগ নিয়ে আমার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল সে বাঁধটি ভেঙে গেছে। এভাবে ও আমার জীবনে নদী হয়। নদীর সবটুকু অনুষঙ্গ নিয়ে।

 রায়না আবার ফিরে এসে বলে, তোমরা আমার প্রশ্নে উত্তর দিচ্ছ না কেন?

 মেয়েটির মাথায় একটা কিছু ঢুকলে ওখান থেকে ও কিছুতেই সরে আসে না। আমার এমন কথায় রায়না আমার দিকে ভুরু কুঁচকে তাকায়। কোমরে হাত দিয়ে এমন ভঙ্গি করে যে উত্তর না দেয়ার অপরাধের জন্য ও আমাকে ক্ষমা করবে না।

 ডালিয়া আমার দিকে তাকিয়ে বলে, সেজন্যইতো ও আমাদের বুদ্ধিমতী মেয়ে।

 ছোটবেলা থেকেই ও বুদ্ধিমতী। পাঁচ বছর বয়সে ও একবার আমাকে বলেছিল, বাবা তুমি আমাকে খুকুমণি ডেক না। খুকুমণি শুনলে আমি অনেক ছোট্ট হয়ে যাই। আমি অনেক বড় হয়েছি না বাবা?

 রায়না কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে একই ভঙ্গিতে বলে, তোমরা আমার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছ না। আমার মাথার ভেতরে ভূমিকম্প শুরু হয়েছে। চারদিক ভাঙছে।

 ডালিয়া অন্য কথায় না গিয়ে বলে, বুঝতে পারছি তুমি এখন আমাদের ছোট্ট রায়না। তুমি মোটেই বড় হওনি। তাহলে শোন ছোট্ট খুকু, দু’দিন আগে দুপুরবেলা আমি তোর বাবাকে খেতে ডেকেছিলাম। তোর বাবা টাইমমতো খেতে আসেনি। খাতা দেখায় ডুবেছিল। তাই আমি রাগ করেছিলাম।

 রায়না হাসতে হাসতে কাঁচের ঘরের আয়নায় প্রতিফলিত হয়েছিল। আমি ওর ভিন্ন রকম হাসি শুনেছিলাম। ও একসময় হাসি থামিয়ে বলেছিল, মায়ের অভিমান ঠিক ছিল বাবা। তুমিতো খাতাগুলো রেখে উঠতে পারতে। খেয়েদেয়ে আবার এসে বসতে। তোমার কাজের কোনেই ক্ষতি হতো না।

 মানুষের দিন কি ঘড়ি? ঘড়ির কাঁটার মতো টিকটিক করে চলতে হবে? মানুষইতো সময়ের ওলোটপালোট করবে, যেমন খুশি তেমন। নইলে মানুষের ইচ্ছা পাখা মেলবে কেমন করে?

 ঘড়ি ঠিকমতো না চললেতো কাঁটা বন্ধ হয়ে যাবে বাবা।

 মাঝে মাঝে কাঁটা একটু-আধটু সময় বন্ধ হবেই, তারপর আবার তোর মায়ের নদীর স্রোতের মতো হাসি শুনতে পাব।

 এবার ইশতিক সামনে এগিয়ে আসে। তালি বাজাতে বাজাতে বলে, বাবার কথাই সবচেয়ে বড় কথা। রাগও থাকবে, নদীর স্রোতেরও থাকবে। মাগো, তুমি আমার সোনামণি মা। রাগতো তোমার হবেই। সেদিন তুমি অনেকগুলো রান্না করেছিলে। ইউনিভার্সিটি থেকে ফিরে অতো খাবার দেখে আমার খিদে আমাজন নদীর মতো বড় হয়ে গিয়েছিল। কি যে মজা করে খেয়েছিলাম। কিন্তু তোমাকে কিছু জিজ্ঞেস করিনি। ধরে নিয়েছিলাম সেদিন বোধহয় তোমার সঙ্গে বাবার প্রেমের প্রথম দিন ছিল।

 আবার সবার হাসিতে উচ্চকিত হয়ে উঠেছিল বাড়ি। রায়না বলেছিল, ইশতিক ঠিকই বলেছে বাবা। কারণ তোমাদের জন্মদিন আর বিয়ে বার্ষিকীর তারিখতো আমাদের মুখস্ত। অন্য কোনো বিশেষ দিন না হলে মা কেন অত আইটেম রাঁধবেন?

 সেদিন খুশিতে ডালিয়ার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। বলেছিল, আমার হীরের টুকরো মানিকেরা।

 আমি ভেবেছিলাম, এভাবে ছেলেমেয়েরা বাবা-মায়ের বন্ধু হয় বলে সম্পর্কের সুতো ছিঁড়ে যায়, বয়সের হিসেব দূর হয়। ছোট-বড় ভেদ থাকেনা। আমার ডাইনিং রুমের চারপাশের আয়নায় এখন সে ছবিই ভাসছে। এভাবেই নিজেকে খুঁজে পাওয়া হয়। আকস্মিকভাবে সে পাওয়ার মধ্যে তৃপ্তি নেই, ক্লান্তি আছে। এই মুহূর্তে ক্লান্তি আমার আনন্দ। কারন আমি ক্লান্তিতে ডুবে থেকে ক্লান্তিকে জয় করেছি। আমার জীবনে চাওয়া-পাওয়া ফুরিয়ে গেছে। অনুভবের ক্লান্তিতে ভরে আছে সময়ের সরোবর। আমার সুখদুখের বোধের কাছে আমি পরাজিত হইনি। বিষণ্ণতা এখন আমার সবচেয়ে প্রিয় অনুভব। আমি ক্রমাগত বিষণ্ণ হতে থাকি, চোখ বুঁজে আসে। তারপর বুঝতে পারি আয়না থেকে সরে যাচ্ছে স্মৃতি। আবার আমি হারাচ্ছি। আমি কোথায় যাচ্ছি জানি না। আমার সামনে পথ নেই, মাঠ নেই, দিগন্ত বলে কোনে শব্দ আমি শুনেছি বলে মনে পড়ে না। আমি চারদিকে তাকাই, বিশ্বব্রহ্মান্ডের অসীম শূন্যতা আমাকে প্লাবিত করে। আয়নায় দেখতে পাই আমার বিষাদভরা মুখায়বে শিশির জমেছে। দু’চোখে ভর করেছে নক্ষত্রের আলো। একইসঙ্গে আমার ভেতরে আনন্দ আর বেদনার ফুলঝুরি দপদপিয়ে ওঠে। আকস্মিকভাবে আমার মনে হয় দম আটকে আসছে। অস্ফুট শব্দ করে দু’হাতে মুখ ঢাকি আমি। আমার পাশে সুষমা আর জুয়েল এসে দাঁড়ায়। সুষমা আমার মাথায় হাত রাখে চুল এলোমেলো করে দেয়। মৃদুস্বরে ডাকে।

 ভাইয়া।

 বুঝতে পারি সুষমা ডাকছে। আমি ওর দিকে তাকাই না। মুখ থেকে হাত সরাই না। আমি প্রাণপণে নিজেকে সামলাই। আমার ভেতরে এখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় নদী কষ্টের আমাজান।

 স্যার।

 জুয়েল ডাকছে। আমি ওর দিকেও তাকাই না। স্যার আপনার কি শরীর খারাপ লাগছে? স্যার আমি আপনার পা চেপে দেব?

 আমি মাথা ঝাড়া দিয়ে তাকাই। মনে হয় কে যেন আমাকে প্রবল ধাক্কা দিয়ে জাড়িয়ে দিয়েছে। আমি অনন্তকালের ঘুমে আবচেতন ছিলাম। দ্রুত কন্ঠে বলি, এখন আমার পায়ে কোনো ব্যাথা নেই রে জুয়েল। আমি তো ভালোই আছি। দেখ, আমাকে দেখ।

আমি আপনাকে দেখছি স্যার। আপনাকে তো আমি রোজই দেখি। দেখতে দেখতে ভাবি পড়ালেখা শিখতে পারিনি তো কি হয়েছে, একদিন আমি আপনার মতো হবো। গান শিখব, বই পড়ব। দেশের সবখানে ঘুরে ঘুরে মানুষ দেখব। তারপর নিজেকেই বলব, মানুষ দেখা শেষ হবে না রে তোর। মানুষ দেখে শেষ করতে পারবি না। আজকে আপনাকে অন্যরকম লাগছে। মনে হচ্ছে – মনে হচ্ছে –

 তুই কিছু একটা বলতে চাচ্ছিস। ঠিক আছে, আজ বলতে হবে না। আর একদিন বলবি।

 আমার ইচ্ছা আপনার সঙ্গে কোনোদিন কোথাও যাই। যুদ্ধের সময় হারিয়ে যাওয়া যে মানুষদের আপনি খোঁজেন তাদের আমিও খুঁজব।

 ঠিক আছে একদিন তোকে নিয়ে কোথাও যাব। তুই বিরিয়ানি খেয়েছিস।

 জুয়েল মাথা ঝাঁকায়, না খাইনি স্যার।

 তাহলে বাড়িতে নিয়ে যা। বাবা-মায়ের সঙ্গে মিলে খা। সুষমা ওকে আরও কিছু বিরিয়ানি দিয়ে দে।

 আমার আর বিরিয়ানি লাগবে না। এতেই হবে। মায়ের হাঁড়িতে ভাত আছে। আমি যাচ্ছি।

 জুয়েল বেরিয়ে যায়। নিঃশব্দে দরজাটা মুখে মুখে লাগায়। সিঁড়িতে ওর পায়ের শব্দ পাওয়া যায়। সুষমা বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে বলে, ও কেমন করে এমন হলো ভাইয়া?

 আমি হাত উপরের দিকে তুলে বলি, ঈশ্বরের দান।

 ঠিক বলেছ। মাঝে মাঝে মনে হয় ও এক অলৌকিক বালক। ও বোধহয় বেশিদিন বাঁচবে না।

 আমি সুষমার সঙ্গে কথা যোগ করতে পারি না। বসেই থাকি। কখনো এমন সময় হয় আমার। দ্বিতীয় কিছু ভাবতে অনেক সময় নেই। জুয়েলের কাছে যুদ্ধের কথা শুনে আলতাফ মাহমুদ আমার মাথায় জেগে ওঠে। ও এখন আর আমার বন্ধু শুধু না। ও আমার ইতিহাস। আমার স্বাধীন দেশ। আমি ওর গানের সুরে নিজেকে ভরাতে দেখি। আমার বিষণ্ণতা কাটতে থাকে।

 সুষমা আমাকে হাত ধরে টানে, ওঠো ভাইয়া। খাবার রেডি করেছি। তোমার সঙ্গে দুপুরের খাবার খেয়ে আমি অন্য জায়গায় যাব।

 তোর তাড়া আছে?

 তা একটু আছে। তাছাড়া রাস্তার যানজটও মাথায় রাখতে হয়।

 হ্যাঁ, যানজট এখন এই শহরের রিয়ালিটি। আমাদের জীবনযাপনকে নানাভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। থাকগে। মনে হচ্ছে কোথায় আমার বাড়িতে আমি তোকে খাওয়াব, না তুই এসেছিস আমাদেরকে খাওয়াতে।

 এসব কথা থাক ভাইয়া। এসো। উঠে পড়ো। আমি জানি তোমার খিদে পেয়েছে।

 আমাকে প্লেটে বিরিয়ানি দিতে দিতে সুষমা বলে, কার কথা ভেবে তোমার মন খারাপ হয়েছে?

 ছেলেমেয়েদের। ওরা কাছে থাকলে আমি আর একটু স্বস্তিতে থাকতে পারতাম। ওরা নেই বলে আমার কষ্ট দ্বিগুণ হয়। অভিমান হয় ওদের ওপর। আবার নিজের যুক্তির কাছে ফিরে আসি। ভাবি, হায় ওদের জীবনতো ওদের মতোই হবে। কেন আমি ঝামেলা করব। আমার জীবনের দায় আমার কাছেই থাকুক। হায় আমার ছেলেমেয়েরা গভীর দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে আমার বুকের গভীর থেকে।

 শুনতে পাই সুষমা বিড়বিড়িয়ে বলে, ছেলেমেয়ে! ও আমার দীর্ঘশ্বাস শোনেনি। ও আমার ছেলেমেয়ের কথা ভাবছে না। ওর বুকের ভেতরে অন্য শব্দ শুকনো পাতার মতো ঝরছে কারন ওর কোল জুড়ে কেউ আসবে না। ওর মনের বাসনা পূরণ হবে না। আমি ওর দিকে তাকাই।

 বুঝতে পারি ওর গলা ভারী হয়ে এসেছে। জল জমেছে চোখের কোণায়। আমাকে বেগুন ভাজির টুকরা তুলে দিতে দিতে বলে, তোমরা সন্তানের আনন্দ পেয়েছ। আমার জীবনে সেটাও হলো না। ভাইয়া জীবনের হিসেব যে কত রকমের সেটা বুঝতে বুঝতেই বেঁচে থাকার অর্দ্ধেক রাস্তা পার হয়ে এলাম। দেখলাম যে একদিন ভালোবাসার কথা বলে কাছে এসেছিল নিজের স্বার্থের প্রয়োজনে সে কত নিষ্ঠুর!

 আমার মাথা প্লেটের ওপর নেমে আসে। আমি আর সুষমার মুখের দিকে তাকাই না। বিরিয়ানির ছোট এক লোকমা মুখে পুরি। শুনতে পাই সুষমা বলছে, ওরা তোমার কাছে নেই। কিন্তু ওরা আছে। এটা কোনো গল্প না, সত্যি। ওদের এই থাকার জন্য তুমি আল্লাহর কাছে শোকর করো।

 আমি এবার সরাসরি সুষমার দিকে তাকাই। বলি, ডালিয়া আমার কাছে আছে, কিন্তু কোথাও নেই। এটাও সত্যি। এমন অনেক শত সত্যির সঙ্গে আমাদের নিত্য দিনের ওঠাবসা।

 এই কথাতো আমিও বলতে পারি ভাইয়া যে মবিন এই শহরে আছে, কিন্তু আমার কাছে নেই। এটাও সত্যি।

 আমাদের জীবন জটিল সুতোর গিটঠু হয়েছে সুষমা – আমি কথা শেষ না করে প্লেটটা ঠেলে সামনে এগিয়ে দেই। হাত গুটিয়ে নেই। গ্লাসের পানি একটানে শেষ করি। অবাক হয়ে ভাবি, আমার প্রিয় বিরিয়ানি আজ গলা দিয়ে নামছে না কেন? কেমন করে যেন কথার চাতাল তৈরি হয়েছে এই ডাইনিং টেবিলে।

 আমি স্যরি ভাইয়া। সুষমার চোখ ছলছল করে।

 আমিও স্যরি। আমরা দু’জনে চাইনি কথাগুলো আমরা এভাবে বলব।

 তাহলে তুমি থালাটা সামনে ঠেলে দিলে কেন? তুমি কি আমার উপর রাগ করেছ?

 রাগ তো হয়েছেই। কারণ মবিনের সঙ্গে তোর সম্পর্ক চুকে গেছে আমার সঙ্গে ডালিয়ার সম্পর্ক –

 থামো আর বলতে হবে না। জানি তোমাদের সম্পর্ক আরও গভীর হয়েছে। ভাবি অবচেতনে আছে তো কি হয়েছে, সম্পর্কের বন্ধনে তো আছে। না ভাইয়া?

 সুষমা তীব্র দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকায়। আমি প্লেটটা কাছে টেনে খানিকটুকু বিরিয়ানি মুখে পুরি। পরপর কয়েক লোকমায় বেশ খানিকটা খেয়ে ফেলি। সুষমার তীব্র দৃষ্টির আঁচ আমার মুখে এসে লাগে। আমি এক চুমুক বোরহানি খাই, পরে একটানে সবটাই খেয়ে ফেলি। আমার ভেতরে এক শীতল প্রবাহ বয়ে যায়। আমি সুষমাকে দুঃখ দিয়েছি একথা ভাবতেই আমার ভেতরটা খচখচ করে। দেখতে পাই ও বেশ মনোযোগ দিয়ে খাসির মাংসের একটি টুকরো ছিঁড়ছে। বিরিয়ানি মুখে পুরেছে কিনা তা আমি দেখিনি। বুঝতে পারি ওর মন খারাপ, দীর্ঘ সময় ধরে ওর মন খারাপের সঙ্গে আজকের একটুখানি সময় তার সঙ্গে যুক্ত হলো। নিজেকে অপরাধী ভাবার সঙ্গে সঙ্গে জোর করে নিজের মুখে হাসি ফুটিয়ে উৎফুল্ল কন্ঠে বলি, বিরিয়ানি দারুণ রেঁধেছিস। বোরহানিতে চুমুক দিয়ে ভাবলাম, তোর রান্নার তুলনা তুই একাই। মা কি তোকে নিজের হাতে শিখিয়েছিলেন?

 সুষমা মৃদু হেসে বলে, তুমি আলোচনার বিষয়টি অন্যদিকে ঘোরালে। সম্পর্কের বন্ধনই জীবনের শেষ কথা নয় ভাইয়া। তোমাকেও মনে করতে হবে যে জীবনের বিস্তার অনেক বড় দিগন্ত ছুঁয়ে থাকে।

 আমি দ্রুতকন্ঠে বলি, আমি জানি। আমাকে বোঝাতে হবে না। আয় আমরা এই দারুণ খাবার আনন্দের সঙ্গে খাই। আনন্দে ভরিয়ে দেই সময়। বলি, জয়তু বেঁচে থাকা।

 সুষমা আমার দিকে সরাসরি তাকিয়ে বলে, আমার জীবনে আনন্দ নাই। তুমি চেষ্টা করছ আমার কষ্ট ভোলাতে। তোমার কন্ঠস্বরও স্বতঃস্ফূর্ত নয় ভাইয়া, খুব মেকী লাগছে। আজ তোমাকে জুয়েল বলেছে অন্যরকম লাগছে। ও আমাদেরকে ওর মনের ভাব বোঝাতে পারেনি। চেষ্টা করেছে। আসলেই তোমাকে মেকী লাগছে।

 তা লাগতে পারে, তাছাড়া ডালিয়া যে অবস্থায় আছে তা দেখে আনন্দে থাকা যায় না। কিন্তু তুইতো বলেছিস এখনও তুই মবিনকে ভালোবাসিস। ভালোবাসাইতো আনন্দ সুষমা।

 হ্যাঁ, ওকে আমি ভালোবাসার কথা বলি ঠিকই, পাশাপাশি এটাও জানি ও বলেছে আমার সঙ্গে কাটানো পুরো সময়টা ওর জীবনে জিরো। এমন মর্মান্তিক কথার মুখোমুখি হওয়া মানে ওর সঙ্গে কাটানো পুরো সময়টাই অপচয়। ডালিয়া ভাবি তোমাকে এমন কথা বললে তুমি কি বলতে ভাইয়া?

 আমি ওর এ কথায় সাড়া দেই না। এমন নির্মম কথাটি আমাকে খুবই আলোড়িত করে। বুঝে উঠতে পারি না যে কি করে একজন মানুষ এমন কঠিন কথা বলতে পারে? মানুষের কৃতজ্ঞতাবোধও কি কখনো এভাবে শূন্য হয়ে যায়। প্রসঙ্গটি আলোচনায় না রাখার জন্য আমি মনোযোগ দিয়ে বিরিয়ানি মাংস আমার রুটিন খাবারের চাইতে বেশি খাই। কীভাবে খেতে পারি তাও আমি বুঝি না। আজ দুপুরের ডাইনিং টেবিল আমার সামনে দানবের পাহাড় হয়ে যায়। খেয়াল করি সুষমা বেশ অন্যমনস্ক, খাচ্ছে কিন্তু খাওয়াতে মনোযোগ নেই। বেঁচে থাকার জন্য খাওয়া প্রয়োনীয় কিছু নয়, উপলক্ষ মাত্র। এই মুহূর্তে সুষমা আমার সামনে শূন্যতার বলয়, ওখানে ঢোকা যায় না কিংবা ওই বলয়কে নিজের অনুভবে আপন করা যায় না। সুষমা এই মুহূর্তে আমার শৈশবের বোন, কাছে বসে বিনুনি গাঁথছে আর বলছে, ভাইয়া আমার এই বেণিতে কতগুলো চুল আছে বলতে পারবি?

 আমি হাত গুটিয়ে বসে থাকি।

 খাওয়া শেষ হলে সুষমাকে বলি, তোর জীবনে নতুন করে ভাবার সময় ফুরিয়ে যায়নি সুষমা। তোর সামনে অফুরন্ত সময়, যেতে হবে অনেক দূরে, মেঠোপথ মাড়িয়ে কিংবা কংক্রীটের সড়কে, দূরন্ত কোনো হিসেবের সংখ্যা মাত্র নয়। আমি আবার বলি, নতুন করে ভাবার সময়ে নিজেকে স্থির করতে হবে।

 কি বললে? সুষমা বিস্ময়ে চমকে তাকায়। অন্যমনস্কতার কারণে হাতের ধাক্কায় গ্লাস কাত হয়ে পড়ে গেলে পানি গড়ায় টেবিল থেকে নিচে। আমরা দু’জনের কেউই পানির দিকে মনোযোগ দেই না। পানি গড়িয়ে আমাদের পায়ের পাতা ভিজিয়ে দেয়, টেবিলের ওপর গড়িয়ে নানা দিকে ছড়ায়।

 আমি টেবিলের পানিতে বাম হাতের তর্জনি ডুবিয়ে বলি, অনেক ভেবে বুঝেশুনেই তোকে বলেছি সুষমা। মবিন যদি আর একটি বিয়ে করতে পারে তবে তুই পারবি না কেন? বেঁচে থাকার জন্য ভালোবাসার জায়গা খুঁজতে হয়। ভালোবাসার সরোবরে ফোটাতে হয় স্নিগ্ধ পদ্ম। কবিতার মতো কথা বলে আমি হো-হো করে হাসি। সুষমাও হাসে। হাসতে হাসতে বলে, আজ তাড়া আছে যাই। সামনে যেদিন আসব সেদিন ভালোবাসার পদ্মের কথা বলব।

 আমি ভুরু উঁচিয়ে তাকিয়ে বলি, তাই?

 হ্যাঁ, তাইতো। সুষমা দ্রুতহাতে টেবিলের প্লেট-বাটি গোছায়। রান্নাঘর থেকে ন্যাকড়া এনে টেবিলের পানি মোছে। বলে, আজ আমার যেতে হবে, তাড়া আছে?

 কিসের তাড়া? আমি কৌতূহলী হয়ে উঠি।

 কাজের, কাজের তাড়া। সুষমা রান্নাঘরে আসা-যাওয়া করে। আমি ওকে বলি, তোকে এসব করতে হবে না, আমি করব। তুই আমার একটা কথার জবাব দিবি?

 বলো, তবে বেশি পার্সোনাল প্রশ্ন করবে না। আমি এসব প্রশ্নের উত্তর দেয়ার মুডে নাই।

 বুঝেছি। আমি হো-হো করে হাসি, প্রাণখোলা হাসি। হাসতে আমার ভালো লাগছে।

 আমি হাসতে হাসতে বলি, কেউ তোকে পছন্দ করেছে? তোর সঙ্গে সমঝোতা হয়েছে?

 ও ঘাড় নাড়িয়ে বলে, সে রকমই।

 সে রকম কী রে? বল করেছে। এই সময়ের নারী হয়ে তোর এত সংকোচ কেন? তাও আবার আমার সামনে, যে তোর বড় ভাই হলেও বন্ধুর মতো। বল তিনি কে? তোর অফিসের কেউ?

 আমি এখন যাচ্ছি। পরে আসব।

 ও আজ নিজের জিনিসপত্র গোছায় না। রান্নাঘরে টাল করে রেখে বেরিয়ে যায়। আমি খোলা দরজায় দু’হাত ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। সুষমা চলে গেছে, ভাবছি আমরাও কি কোনো নতুন সময় আসবে, যে সময়কে নিয়ে অন্য ভাবনায় ডুবে মনে করবো জীবনের বিস্তার অনেক – শৌর্যে, কর্মে, মগ্নতায়, দীপ্রতায়, আবেগে, অনুভবে, স্বপ্নে, মন্থরতায়? শব্দগুলো আমার সামনে হুড়মুড়িয়ে ঝরতে থাকে, আমি ভাবি আমি এক বিপন্ন মানুষ একজন অবচেতন নারীর নির্বাক উপস্থিতি আমার প্রবল অনুভূতি স্থবির করে রেখেছে। আমি দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে সিঁড়িটিকে দেখি। একটু আগে নেমে গেছে সুষমা, আবার কেউ উঠবে – ওঠানামা সিঁড়িকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়, যেখানে সিঁড়ি নেই সেটি সরল পথ, হেঁটে যাওয়ার ধর্ম নিয়ে টিকে থাকে। এখন এই পথের রেখা আমার সানে, আমাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে কি আমি চাই? কোথাও কি যাব? কোথাও কি পাব কাউকে যে বলবে এই বয়সেও আমরা হাত ধরতে পারি? বলতে পারি যেটুকু পথ পেরিয়ে এসেছি তা যথেষ্ট নয়, যাওয়ার আরও জায়গা আছে। চলো যাই।

 আমি দরজা বন্ধ করে ড্রইংরুমে এলে কাঁচের দেয়ালে ফুটে ওঠে আলতাফ মাহমুদ। হাসিমুখে হাত ওঠায়।

 কেমন আছিস আরিফ? তোর বুকের ভেতর গানের শব্দে মনে হচ্ছে তুই বেঁচে থাকার স্বপ্নে তারার ফুল দেখতে যাচ্ছিস। আয় আমরা একসঙ্গে গান করি।

 একসঙ্গে গান? আমিতো রবীন্দ্রসঙ্গীত গাই।

 আমি অন্য গানের গায়ক হলে কি হবে রবীন্দ্রসঙ্গীত আমাদের সবার গান।

 ও হা-হা করে হাসে। আমি জানি ওর হাসি ছড়াচ্ছে দেশের সবখানে। ও আমার ঘরের দেয়ালে ফুঠে আছে। আমার ঘর এখন হল অফ মিরর এফেক্ট। আমার শিল্প সাধনার কাঁচের আয়না। আলতাফ এখন আমার থেকে অনেক দূরে আছে, এ দেশের মাটিতে শায়িত আছে, কোথায় তা কেউ জানে না। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান বাহিনী ওকে তুলে নিয়ে বন্দি করেছিল, নির্যাতন করে রক্ত ঝরিয়েছিল, তুব ও হার মানেনি। ও এখন ইতিহাসের পৃষ্ঠায় একজন অমর সুরকার শুধু নয় স্বাধীনতার বেদীতে জীবন দানকারী যোদ্ধা।

 কথা বলছিস না কেন আরিফ?

 ভাবছি আমি কি বেঁচে আছি?

 তোর কন্ঠে তো এমন কথা শোভা পায় না রে। তুই কি খুব ক্লান্ত আরিফ?

 তুই আমার প্রাণশক্তি মাহমুদ। তোকে বুকের ভেতর নিলে আমি নিজের সবটুকু খুঁজে পাই। মনে হয় আমার কোথাও কিছু হারায়নি।

 হা-হা করে হাসে আলতাফ, অবিকল সেই হাসি যখন আমরা দুজনে রমনা পার্কের ভেতর দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে কখনো গলা ছেড়ে দুই লাইন গান গাইতাম কিংবা কোনো গাছের নতুন ফুলের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকতাম। তোর দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলতাম, কোনটা বেশি সুন্দর, এই ফুল না গানের সুর? তুই বলতি একটার সঙ্গে আরেকটা বাঁধা। সবই সুন্দর। ফুল-গাছ-মাটি-মানুষ সব। সবকিছুই এক তারে বাধা থাকে, একটি নড়ালে সুর কেটে যায়। জীবন এমন গভীর সাধনা আরিফ।

 তোর সঙ্গে পারা যায় না। সঙ্গীত তোর সাধনা, বিস্তার, মানুষ-মাটি সব। বলতো ভবিষ্যতে তুই কি করবি?

 কি আবার গানে সুর করব, গান শেখাব। ছেলেমেয়েদের গান শিখিয়ে বলব দেশের গান গাও।

 তোর স্বপ্ন অনেক বড়।

 ভবিষ্যতে তুই কি করবি আরিফ?

 শিক্ষকতা করব। আর নিজের জন্য গান শিখব। অন্যের জন্য না। ঘরে গাইব, বন্ধুদের মাঝে গাইব, এই টুকুই। এর বেশিকিছু না।

 বেশ। আমি গানের শিক্ষক, তুই হবি লেখাপড়ার শিক্ষক।

 আমরা দুজনে একসঙ্গে হাসতাম। হাসতে হাসতে দেখতাম হাসির শব্দে ঝটপট উড়ে যাচ্ছে কোনো পাখি – মনে হতো দোয়েল কিংবা বুলবুলি। আকশের দিকে ঘাড় উঁচিয়ে তাকাতাম, দেখতাম উড়ে যাওয়া পাখি।

 কি ভাবছিস আরিফ? আলতাফ চোখ বড় করে তাকায়।

 আমাদের যৌবনের কথা। আয়নায় ওর দিকে তাকিয়ে আমি নিজেকেই উত্তর দেই। আমিতো জানি আমি ওকে খুঁজি। ফেব্রুয়ারি মাসে যখন ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি -।’ গান বেজে ওঠে তখন ওকে খুঁজে ফেরার পালায় একটি দাগ পড়ে, লাল রঙের দাগ – রক্ত এবং মৃত্যুর সঙ্গে সেই দাগের মাখামাখি। ভাবি, যে মানুষ ইতিহাস হয়ে যায় তাকে খুঁজে ফেরা যায় না। তাকে বুকের ভেতরে রেখে তার অর্জনে মাথা রাখতে হয়। আলতাফ মাহমুদের অর্জনে মাথা রাখলে আমার চারপাশের কাঁচের দেয়াল অদৃশ্য হয়। আমি নিজেকে দেখতে পাই সোফার ওপর মাথা রেখে পা গুটিয়ে রাখা অবস্থায়। নাকি আমি আর ও হেঁটে যাচ্ছি ঢাকা শহরের রাস্তায়, আমাদের সামনে খোলা প্রান্তর, প্রবল স্বদেশভূমি – আলতাফ মাহমুদ একসময়ে বলে, আরিফ আমরা কি পুরো দেশ দেখার জন্য এই শহর থেকে বের হবো? হেঁটে যাব কিন্তু, নিদেন পক্ষে একটা সাইকেলে চড়তে পারি, নয়তো গুরু গাড়ি কিংবা নদী পার হওয়ার জন্য নৌকায়? যাবি?

 যাব, যাব – আমি চেঁচিয়ে গানের সুরে বলি।

 তখন হাত বাড়াই, ছুঁতে চাই আলতাফকে, দেখি আমার হাতের ছোঁয়ার মধ্যে ও নেই। ওর প্রিয় মাতৃভূমির সবখানে পৌঁছে গেছে ও। আমার শূন্য হাত ওকে ছুঁতে পারবে না। শুনতে পাই ওর কন্ঠস্বর। বলছে, আমি তোর হাতের কাছেই আছি আরিফ, তোর বইয়ে, তোর গানে। তোর গুন্টারগ্রাসের ভেতরেও আছি। ঘরজুড়ে ওর হাসি শুনে আমার খুব ভালোলাগে। ওর এভাবে থাকাকে আমি নিজের বেঁচে থাকার সঙ্গে মেলাই। ভাবি, আসলেইতো ওর সামনে আর সীমান্ত নেই। ওর গানের ভুবনের অর্জন ওকে নিয়ে গেছে ইউনেস্কোর অফিস হয়ে বিশ্বভুবনে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’-এর ছায়ায়। ওর স্বাধীনতার জন্য জীবনদান উদাহরণ হয়েছে প্রতিক্রিয়াশীলদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে। হুররে, আমি চেঁচিয়ে উঠে নিজের হারমোনিয়াম নিয়ে আসি। আমার গানের সুর ছড়িয়ে যায় ঘরে।

 সেই সুরের আবহে কাঁচের ঘরে ফুটে ওঠে আলতাফের মুখ। বলে, এখনো যুদ্ধাপরধীদের বিচার পাইনি। আমি যুদ্ধপরাধীদের বিচার চাই। আমি এই দাবি নিয়ে হেঁটে যাব পথে পথে।

 থেমে যায় আমার গান।

 আমি বলি, আমিও তোর সঙ্গে যাব। চিৎকার করে বলব, মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য আমি অপরাধীর বিচার চাই।

 মিলিয়ে যায় আলতাফের মুখ। ভেসে ওঠে জনপদ – ভেসে ওঠে আমাদের হেঁটে যাওয়া। পথে পথে তৈরি হয় মানুষের স্রোত। আমি হারমোনিয়ামের ওপর কনুই রেখে গালে হাত দিয়ে বসে থাকি।

 কতক্ষণ পার হয়েছে জানি না, খেয়াল করি ডালিয়াকে দেখাশোনা করার জন্য নার্স মেরিনা দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। মেরিনা প্রতিদিন আসে। ডালিয়ার শারীরিক অবস্থা দেখে ডাক্তারের কাছে রিপোর্ট করে। ওকে দেখে আমি সোজা হয়ে বসি।

 ও মৃদুস্বরে বলে, আসব স্যার?

 আসুন। আপনার জন্য আমার দরজা দিনরাত খোলা। ঢোকার জন্য জিজ্ঞেস করতে হবে না।

 না, মানে আপনার গান – শুনতে খুব ভালোলাগছিল। আমি কিছুক্ষণ দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে শুনছিলাম। আমি একটা কথা জিজ্ঞেস করব স্যার?

 অবশ্যই জিজ্ঞেস করবেন। বলুন।

 গান শুনে মনে হয়েছিল আপনার সামনে কেউ নেই কিন্তু আপনি তার জন্য গান গাইছেন।

 হ্যাঁ, তার জন্যই গান। আমার বন্ধু আলতাফ মাহমুদ।

 আলতাফ মাহমুদ! আমাদের একুশের গানের সুরকার। শহীদ মুক্তিযোদ্ধা।

 আমার বুক ভরে গেল যে আপনি ওর কথা জানেন।

 জানব না? এতবড় একজন মানুষ।

 আমি মাথা নাড়ি, হ্যাঁ তাই। ওকে সবার জানতে হবে।

 মেরিনা মাথা নেড়ে ডালিয়ার ঘরে যায়। আমি জিজ্ঞেস করতে পারিনা যে তুমি কেমন করে আমার বন্ধুর কথা জানলে, তোমাকে কে বলল ওর কথা? এখনতো আমরা দেশের মানুষের খোঁজ বেশি রাখি না। আমি থমকে যাই, ভাবলাম ভুল ভাবনায় ডুবে আছি আমি, এভাবে ভাবা আমার উচিত হয়নি। এমনতো হতে পারে যে ওর পারিবারিক শিক্ষা আছে, ও ছোটবেলা থেকে শিশু-সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিল। মায়ের হাত ধরে গান শিখতে যেত, কিংবা নাচ। ও হয়তো একুশের দিনে প্রভাতফেরিতে যেত, শহীদ মিনারে ফুল দিত এবং গলা ছেড়ে স্কুলের অনুষ্ঠানে গাইত ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি-’। দরজার কাছে এসে দাঁড়ালে দেখতে পাই ডালিয়ার চুল আঁচড়ে বেণী করছে মেরিনা। আমি ফিরে আসি ড্রইংরুমে, হারমোনিয়ামের ওপর দু’হাত রেখে চুপ করে বসে থাকি। আমার সামনে বায়ান্নো সালের রমনা পার্ক, উড়ে যাচ্ছে দোয়েল কিংবা বুলবুলি, তখন বসন্তের শুরু ফুটে আছে অজস্র রঙিন ফুল। আশ্চর্য এক চিরযৌবন বসন্ত আমাকে সজীব করে রাখছে। আমার বুকের ভেতরে অকারণ ধুকপুক শব্দ নেই।

 কাজ শেষ করে ডালিয়ার ঘর থেকে বেরিয়ে আসে মেরিনা। ওর পরনে নার্সের পোশাক, ওকে আমি প্রতিদিনের কাপড়ে আমার বাসায় আসতে নিষেধ করেছি। আমি ফর্মাল ড্রেস চাই, যেন ডালিয়ার শরীরে হাত দিলেই ও টের পায় কেউ ওকে শিক্ষিত হাতে পরিচর্যা করছে, এটা কোনো আনাড়ি হাতের সেবা নয়। ডালিয়া জানবে কত যত্ন দিয়ে আমি ওর বেঁচে থাকার শেষ দিনগুলো এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। আমি ঘড়ির দিকে তাকাই, এখনো সময় হয়নি। আটটার সময় ডালিয়াকে স্যুপ খাওয়াব। কাজটি আমি খুব যত্ন নিয়ে করতে পারি। আমার অভ্যাস হয়ে গেছে। আমি বাথরুমে ঢুকে সাবান দিয়ে হাত ধুতে থাকি। একজন অবচেতন মানুষকে নিয়ে পুরো বাড়ির প্রবল শূন্যতায় আমার অবস্থান। আমি ক্রমাগত নিজের ভেতরে ক্ষয়ের মধ্যে তলিয়ে যাচ্ছি, আমি কীভাবে বের হবো, এভাবে বেঁচে থাকা কি জীবন? শুনতে পাই ফোন বাজছে, ছুটে গিয়ে দেখি রায়নার ফোন। কন্ঠস্বর চেপে আসে, তারপরও গলা ঝেড়ে বলি, হ্যালো মা।

 তুমি কেমন আছ বাবা?

 আকস্মিকভাবেই আমি বলি, আমি বাঁচা-মরার সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখছি।

 তুমি কখনো এভাবে আমাদের সঙ্গে কথা বলোনি বাবা। তোমার মন কি ভালো নেই বাবা?

 পাঁচ বছর ধরে তো আমি মনের সঙ্গে লড়াই করছি। আমার কি ভালো থাকার উপায় আছে? তোমরা এসে কি মায়ের দায়িত্ব নেবে?

 কেমন করে আসব বাবা, রায়না কাঁদতে শুরু করে। কাঁদতে কাঁদতে বলে, তুমি এমন করলে আমি মরে যাব। আমি তোমার দিকে তাকিয়ে -। ও আর কথা বলে না। ফোন কেটে যায়। আমি বারান্দায় আসি। বারান্দায় রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে থাকি। ফোনটা আবার আসে।

 বাবা তুমি কি আমার সঙ্গে রাগ করেছ?

 না রে মা, আমি নিজের সঙ্গে রাগ করেছি।

 বুঝতে পারছি আজ তোমার মন ভালো নেই। সুষমা ফুপু আজকে আসেনি? ফুপুকে আসতে ফোন দাও। ফুপু এলে তোমার মন ভালো হবে।

 ও আজই এসেছিল। আমাকে খাবার দিয়ে গেছে, তোর মাকে খাইয়ে গেছে। আমার রাতের খাবার ফ্রিজে রেখে গেছে।

 বেলফুল কেমন আছে বাবা?

 ও ভালো আছে, জুয়েলও। ওরা আছে বলেইতো দিন কাটাতে পারছি।

 আমি জানি বাবা। তুমি ওদেরকে ভালোবাসো। আমাদের চেয়ে বেশি ভালোবাসো।

 দূরে বসে অনেককিছু ভাবতে পারছিস দেখছি। আমি তো ওদের জন্য ওদেরকে ভালোবাসি না, নিজের স্বার্থে ওদেরকে ভালোবাসি। কারণ ওরা আমাকে আর তোর মাকে দেখেশুনে রাখছে। ওদের ছাড়া আমার অন্য কোনো উপায় নেই।

 আমি যতক্ষণ কথাগুলো বলি রায়না চুপ করে শোনে। আমি থামলে মৃদুস্বরে বলে, আই লাভ ইউ বাবা। এই ভিনদেশে তোমার কথা মনে করে আমার বেঁচে থাকা পূর্ণ হয়। বাবা মাঝে মাঝে ভয়ে কুঁকড়ে থাকি। তুমি আছ বলে কথা বলতে পারি, না থাকলে কার কাছে আদরের জন্য মাথা নিচু করে দাঁড়াব।

 আমি ওর কথা শুনে চুপ করে থাকলে ও আবার বলে, আই লাভ ইউ বাবা। কাল আমি তোমাকে আবার ফোন করব। আজ তোমার মন খারাপ, সেজন্য ঠিকমতো কথা বলতে পারছ না।

 ভালো থাকিস মা। তোর জন্য অনেক দোয়া।

 লাইন কেটে যায়। মোবাইলটা টেবিলে রেখে ডালিয়াকে দেখতে আসি, তাকিয়ে থাকি ওর দিকে। একদিন ওর সঙ্গে জীবনের সময়ে খুনসুটি ছিল – বাক-বিতন্ডা ছিল – ভালোমন্দের আলোচনা ছিল আজ কিছু নাই। তারপরও বয়ে যায় সময়। একদিন বেলি আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, মানুষ এমুন কইরা বাঁইচা থাহে ক্যান নানা? যে মানুষ তাকাইতে পারে না হের বাঁচামরা কি! এ প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে নাই। বেলি আমাকে এমন প্রশ্নের উত্তর দিতে প্রায়ই বলে, আমি খেয়াল করেছি যেদিন ওর মন খারাপ থাকে সেদিন বেশি করে। আমি উত্তর না দিলে চোখ গরম করে বলে, মুই আর এই বাড়িতে আসমু না। এহানে আসতে মোর ভালালাগে না, ডর করে।

 আমি মৃদু হেসে বলি, তুই আমাকে ভালোবাসিস না বেলফুল?

 ও ফিক করে হেসে বলে, আপনের কাছ থাইকা বেলফুল শুনতে খুব ভালালাগে। নিজেরে ফুলের লাহান মনে অয়। কিন্তু মুই তো একডা পোকা, আমি নিজেরে ফুলের মতো নিমু ক্যান?

 খবরদার তুই নিজেকে পোকা বলবি না। মার খাবি আমার কাছে আর কোনোদিন যদি শুনি।

 আপনে মোরে কহনো মাইরবেন না। মুই ঠিকই জানি, না হইলে ফুল বিক্রি করা মাইয়ারে ঘরে লইয়া আসতেন না।

 সে রাতে আমি বেলিকে স্বপ্ন দেখি। কাদামাটি থেকে কেঁচো তুলে ও কোঁচড় ভর্তি করে দৌড়াচ্ছে। বাতাসে ওর চুল উড়ছে, শুকনো পা-জোড়া কখনো বুঝি বাঁকা হয়ে যাচ্ছে। লিকলিকে হাত দিয়ে দু’হাতে আঁকড়ে ধরে আছে কোঁচড়। আমি ওকে দেখতে পাই কিন্তু ও আমাকে দেখে না। আমি হাঁ করে তাকিয়ে থাকি একটি উড়ন্ত বালিকার দিকে, যার কোঁচড় থেকে কেঁচো বেরিয়ে ওর শরীরের সবখানে ছড়িয়ে যাচ্ছে। একটুপরে ও আর বালিকা থাকবে না, একটি উড়ন্ত পোকা হবে। আমার ঘুম ভেঙে গেলে আমি অন্ধকারে তাকাই, জানালা দিয়ে রাস্তার আলোর খানিকটুকু আমার ঘরে ছড়িয়ে পড়েছে। আমি উঠে বাথরুমে যাই, পানি খাই। ঘুম আসবে না বুঝতে পেরে ড্রইংরুমে আসি। শুনতে পাই আলতাফের কন্ঠস্বর, মানুষ পোকা হবে না আরিফ। মানুষকে পোকা ভাবাও উচিত নয়। মানুষ মানুষই থাকবে বলে তো স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেছিলাম।

 একই স্বপ্নতো আমিও দেখি রে বন্ধু। কিন্তু মাঝে মাঝে তল খুঁজে পাই না। স্বপ্নের মধ্যে পোকা খুঁজে পাই, ঘুণ পোকা বেঁচে থাকার সবটুকু কেটে ছারখার করছে। অবিরল ঝরছে কেটে-ফেলা গুঁড়োর কুচি। মাঝে মাঝে সেই কুচির গন্ধ আমাকে মর্মাহত করে, তখন আমি দুহাত বাড়িয়ে শুধু তোকেই খুঁজতে থাকি বন্ধু। তোর মতো সাহসী, তোর মতো বীর যোদ্ধা, দেশের জন্য একশোভাগ ভালোবাসায় স্নাত মানুষ, যে যোগ্য হাতে ঠিক করবে মানবিক চেতনার জয়গা। বন্ধু তুই আমাকে বল কোথায় আছিস তুই, আমি ফুল দিয়ে ছেয়ে দিতে চাই তোর শুয়ে থাকার জমিনটুকু। বন্ধু পাব কি তোর খোঁজ?

 পাবি। শুনতে পাই ওর কন্ঠস্বর, যে কন্ঠস্বর যৌবন কাল থেকে শুনেছি – শুনেছি কথায়, সঙ্গীতে শাসনে, দ্রোহে, স্লোগানে, মিছিলে, ঘরে – কোথায় না?

 তুই যেটুকু চিন্তা করেছিস তার সবখঅনেই তো আমি আছি। বন্ধু এখন আমাকে আলাদা করে খুঁজবি? খুঁজিস না। শুধু যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হলে বুঝবি তোর খোঁজা শেষ হয়েছে। থেকে যায় কন্ঠস্বর, বাড়ে আমার বুকের ধুকপুকি। আমার দুই ছেলেমেয়েকে স্বরণ করার চেষ্টা করি। ওরা দূরদেশে নিরীহ জীবনযাপন করছে, আমার নতুন ভাবনায় ওদের কোনো যোগ নেই – কিন্তু ওরা ইতিহাসের সঙ্গে সম্পৃক্ত। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায়ের অপেক্ষায় আছে – দু’জনেই ইন্টারনেটে বিষয়টির খোঁজ রাখে। আমি স্বস্তির নিশ্বাস ফেলি। আমার বেঁচে থাকা পূর্ণ হয়ে যায়। আমি সোফায় বসে ঘুমিয়ে পড়ি। একঘুমে রাত কেটে যায়।

 মাসখানেকের মাথায় একদিন বিকেলবেলা সুষমা হঠাৎ করে আসে। বলে, হঠাৎ এলাম। আসার কোনো প্ল্যান ছিল না। এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম ভাবলাম ভাবিকে দেখে যাই।

তোকে একদম অন্যরকম লাগছে। উৎফুল্ল। আমাকে বলার মতো কোনো খবর আছে। সেদিন একটু বলেছিলি মাত্র।

 আগে ভাবিকে দেখে আসি। ভাবির গায়ে পারফিউম ছিটিয়ে আসি।

 সুষমা আসার পর থেকে দাঁড়িয়েছিল, বসেনি। দ্রুত পায়ে ডালিয়ার ঘরে যায়। ওর শরীর থেকে পারফিউমের গন্ধ ভেসে আসছে। আমি জানি দীর্ঘদিন এই বাড়িতে ও গায়ে পারফিউম লাগিয়ে আসেনি, অন্তত আমার সামনেতো আসেইনি। হয়তো অফিসে বা কোনো পার্টিতে পারফিউম লাগাতে পারে, যেটা আমি জানি না। আজ ওর পারফিউমের গন্ধে আমি নড়েচড়ে বসি, ভাবি ওর হয়তো নতুন দিনের সূচনা হয়েছে। তাই ওর আছে বুকভরা আনন্দ। পারফিউমের ব্যবহার সে আনন্দের প্রকাশ। আমি খুশি হই। ওর ফিরে আসার অপেক্ষায় থাকি। ভাবছি,ও ডালিয়ার কপালে হাত রাখছে। চুল ঠিক আছে কিনা দেখছে। ওর বালিশের পাশে একটি লাল গোলাপ রেখেছে। ও এলে এমনই করে। এখন ডালিয়াকে স্যুপ দেয়ার সময় নয়, নইলে ও স্যুপ দিত ডালিয়ার নলে। আমি যে শূন্যতায় নিজেকে ডুবিয়েছিলাম সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছি। ভাবি, ওর মতো আমারও সামনে নতুন দিন আসছে, আমিও হয়তো খুঁজে পাব গানের কোনো নতুন কলি, বেজে উঠবে হারমোনিয়াম। আমি বেলফুলকে গান শেখাব। ও অনেক দিন আমাকে বলেছে, নানা আমারে গান শেহান। গান শিখতে মোর খুব ভালালাগে। নানা আমারে গান শেখাইবেন?

 সেদিন আমি ওকে বলেছিলাম, হ্যাঁ তোকে আমি গান শেখাবো। কিন্তু আর শেখানো হয়নি। ও কাজ শেষ করে দৌড় দিয়ে চলে যায় রাস্তায় ফুল বিক্রি করতে। গান শেখার চেয়ে ফুল বিক্রি ওর কাছে জরুরি কাজ। ফুল বিক্রি করে টাকা নিয়ে যেতে হয় বাড়িতে। এই মুহূর্তে ওর গান শেখার আগ্রহ আমাকে চাঙ্গা করে। আমি ভাবি, ওর বেতনের টাকা কিছু বাড়িয়ে দিয়ে ওকে গান শেখানোর জন্য আটকাবো। ওর সুরেলা কচিকন্ঠ এই বাড়ির আনাচে-কানাচে আটকে থাকবে, ঠিক মাকড়সার জালের মতো, কিংবা তেলাপোকার দৌড়ে বেড়ানোর মতো, তখন এই বাড়ির কোনোকিছুতে ওর আর ভয় থাকবে না।

 সুষমা আমার কাছে এসে বসে। বলে, ভাইয়া কি ভাবছো?

 ভাবছি তোর পারফিউমের কথা। গন্ধটা খুব মিষ্টি। আমাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। বলতে পারিস মগ্ন হয়ে বসে আছি। কোথায় পেয়েছিস এই সুগন্ধী?

 তৈমুর দিয়েছে। সুষমার শারীরিক স্নিগ্ধতায় চাঁদনি রাত নেমে এসেছে, মনে হচ্ছে ও এক আশ্চর্য নারী, যার শরীরজুড়ে পৃথিবীর সবটুকু মোহনীয় মুগ্ধতা এই মুহূর্তে আমার ঘরে। আমি আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এক অপরূপ নারীকে দেখি যাকে আমি কখনো দেখিনি।

 কি হলো ভাইয়া? তুমি কি অন্যকিছু ভাবছ?

 ভাবছি বেলফুলকে গান শেখাব।

 বেশতো, ভালো কথা। পথশিশু মেয়েটি নতুন জগৎ পাবে।

 ঠিক তোর মতো কি? তুই যেমন পেয়েছিস? ভালো হবে না?

 খুব ভালো হবে ভাইয়া। ও নতুন জগৎ পাবে। তুমিও নতুন কাজ পেলে, সারাদিন একা একা থাকার খানিকটুকু পূরণ হবে।

 ওর কথায় আমি গভীর নিশ্বাস ছাড়ি। সুষমা আমার মুখোমুখি বসে। বলি, তোর কি যাবার তাড়া আছে? নাকি বসবি কিছুক্ষণ? তোর জন্য আমি চা বানাব। ফ্রিজে পেস্ট্রি আছে।

 ঠিক আছে আজ তোমার হাতেই চা খাবো। তুমি আমাকে চা-স্ন্যাক্স দিচ্ছ রোজকার মতো আমি তোমাকে দিচ্ছি না।

 কাজতো উল্টোতেই হবে। ডালিয়া আবচেতন হয়ে গেলে আমিতো ঘরের কাজ শিখেছি। আজ তৈমুরের গল্প শুনব। ও কি তোর অফিসের কেউ?

 না, আমার অফিসের কেউ না। পাশ করার পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছিলেন। পিএইচডি করতে বিদেশে যান। তারপর আর দেশে ফিরেননি। আমেরিকাতেই থেকে যান। তবে দেশে ফিরতেন প্রায়ই।

 তোর সঙ্গে কোথায় দেখা হলো?

 তিনি আমার প্রতিবেশি। রোজই দেখা হয়, আমি যখন সকালে হাঁটতে বের হই তখন।

 আমি হা-হা করে হেসে বলি, বাহ দিনের প্রথম আলোয় ফুরফুরে বাতাস গায়ে মেখে স্নিগ্ধ আমেজে -। চমৎকার শুরু। তো কতদিনের ঘটনা রে?

 মাস তিনেক। সুষমার লাজুক ভঙ্গি আমার বেশ লাগে, মনে হচ্ছে আমি তরুণি সুষমার মুখোমুখি হয়েছে। জিজ্ঞেস করি, তৈমুরের আর কে আছে?

 স্ত্রী মারা গেছে বছর দু’য়েক আগে। দুই ছেলে, ওরা আমেরিকাতেই থাকবে। দুজনেই বিদেশি বিয়ে করেছে। একজনের বৌ পোল্যান্ডের, আর একজনের বৌ মেক্সিকোর। দু’জনেরই দু’টো মেয়ে আছে। ঢাকায় যে ফ্ল্যাটে তৈমুর থাকেন সেটা তার নিজের। আমার সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পরে বলেছেন আমেরিকায় আর ফিরবেন না।

 তুই কি ভাবছিস রে? এত দেখছি সরাসরি প্রস্তাব।

 আমি এখনো কিছু ভাবিনি ভাইয়া। সিদ্ধান্ত কি নেব সেজন্য সময় নিচ্ছি। তোমারও অনুমতি লাগবে তো -। নাকি?

 আমি হাসতে হাসতে বলি, তুই ভেবেছিস রে। তোর চোখমুখের ভাষা ভাবার কথাই বলছে। তোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। কংগ্রাচুলেশনস সুষমা। আমি খুব খুশি হয়েছি। একদিন আমার কাছে নিয়ে আসবি তৈমুরকে। চুটিয়ে আড্ডা দেব তিনজনে। তৈমুরকে গান শোনাব। ও কি গান শুনতে ভালোবাসে? আচ্ছা ঠিক আছে আমি জিজ্ঞেস করে নেব। বিয়েটা আমার বাড়িতে হবে। সব ববস্থা আমি করব। ওর ছেলেরা বাবার বিয়েতে এলে সেটা একটা দারুণ ঘটনা হবে।

 ভাইয়া -। সুষমা টেনে উচ্চারণ করে। আমার চাইতে তোমার খুশি অনেক দেখছি।

 তুই খুশি প্রকাশ করছিস না, আমি করছি। ক্ষতি নেই, খুশি প্রকাশ হলেই হয়।

 তুমিতো কিছুই জানতে চাইলে না। আগেই বিয়ের কথা বলছ, মনে হচ্ছে বিয়ে আমার নয় তোমার।

 কি বললি? আমি চমকে ওর দিকে তাকাই। বুকের মধ্যে গুড়গুড় করে শব্দ, বিয়ে আমার নয় তোমার।

 সুষমা হাসতে থাকে। হাসতে হাসতে আবার বলে, তুমিতো ঠিক করে কিছুই জানতে চাইলে না?

 আমার তো জানার দরকার নেই। জানবি তুই, বুঝেশুনে পা ফেলবি, তারপর সিদ্ধান্ত নিবি। আমি হবো অনুষ্ঠানের আয়োজক। ঠিক আছে? তবে হ্যাঁ, অনুষ্ঠানের আয়োজনের আগে তৈমুরের সঙ্গে দেখা করতে হবে। যেদিন তুই ওকে এই বাড়িতে নিয়ে আসবি সেদিন আজকের পারফিউম শরীরে ছড়িয়ে আসবি। ঠিকতো?

 আমি আলতো করে ওর ঘাড়ে হাত রাখি। বলি, তোকে কি আমি বিব্রত করেছি সুষমা?

 মোটেই না। এমন কথা তুমি বলতেই পার। আমরা সাত ভাইবোন। তোমার সঙ্গে আমার মনের টান বেশি। অন্যদেরকে কথাটাতো তোমাকেই জানাতে হবে ভাইয়া।

 গুড। আমি খুব খুশি হয়েছি। চল ডাইনিং টেবিলে বসে আরও কথা বলব।

 তুমি যাও। আমি কফি বানিয়ে আনছি।

 দেখতে পাই ওর মুখে খুশির আভা। ভাবি, এবার ও মবিনকে একটা জবাব দিতে পারবে। একজন মানুষের জীবনে জিরো সময় বলে কিছু থাকতে পারে তা আমার ভাবনায় আসে না। আমি অপমানিত বোধ করি। আগেও করেছি। কিন্তু নিজের মনোভাব সুষমার কাছে প্রকাশ করিনি। আজ প্রাণখোলা ডাকের সাড়া পাচ্ছি। আমার বুকের ভেতরে তোলপাড় করে ওঠে সময়। আমার সময় ডালিয়ার সঙ্গে। আমার সময় ভালোবাসার সঙ্গে। আমি ডাইনিং রুমের দেয়ালের আয়নায় আমাকে আর ডালিয়াকে দেখতে পাই। পশ্চাশ বছরেরও বেশি সময়ে আগের আমরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের কোয়াটারে উঠেছি, মনের আনন্দে ঘর সাজাচ্ছি, এটা-ওটা কিনে আনছি। ড্রইংরুমের নতুন সোফায় বসে ডালিয়া আমার আঙুল মটকাতে মটকাতে বলেছিল, বিয়ের দু’বছর পরে আমরা নতুন একটি ফ্ল্যাটে এলাম। বেশ লাগছে, মনে হচ্ছে নতুন জীবন শুরু হলো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *