হেঁটে যাই জনমভর – ২

আমি ড্রইংরুমে এসে সোফায় বসি। মনে হচ্ছে পায়ের নিচে দগদগে ঘা। সেই ঘা থেকে তীব্র ব্যথা উঠে আসছে মাথা পর্যন্ত। আমি দু’পা ঝাঁকাই। পায়ের পাতা উল্টে দেখি। কিন্তু কোথাও কোনো ঘা নেই। সচেতনভাবে আমি জানি আমার পায়ে ঘা নেই। তবে আমার মাথায় ব্যথার এমন তীব্র অনুভব কেন? কোথাও কি ঘন্টা বাজছে? কিংবা ঢোলের আওয়াজ হচ্ছে? নাকি রাজপথে হায় হোসেন – হায় হোসেন বলতে বলতে মহররমের মিছিল যাচ্ছে? অথবা কেউ কোথাও থেকে খুব সচেতনভাবে কোনো বার্তা পৌঁছাচ্ছে আমার কাছে। আমি সেটা পাচ্ছি না। সেই বার্তা আমার কাছে পৌঁছানোর আগেই এলোমেলো বাতাসে উড়ে যাচ্ছে। কোথায়? তা আমি ধরতে পারছি না। একসময় সব শব্দ থেমে যায়। আমি নিজের দিকে তাকাই। আমার চারদিকে আয়না। সে আয়নায় দেখা যাচ্ছে আমার বন্ধুর ছবি। ও যৌবনে একটি অসাধারণ গানের সুর করেছিল। সেই গান এখনও প্রভাতফেরিতে গাওয়া হয় বিশেষ দিনে। বহু বছর আমি আর ও খালি পায়ে সেই গান গাইতে গাইতে শহীদ মিনারে গিয়েছি।

 আমি আয়নায় ওর দিকে তাকালে ও মৃদু হেসে বলে, কেমন আছিস?

 ভালো নেই। আমি গম্ভীর স্বরে বলি।

 কেন? ভালো নেই কেন?

 চারদিকে ভাঙচুরের শব্দ পাচ্ছি।

 বেঁচে থাকলে এমন অনেক শব্দ শুনতে হয়।

 আমি তোকে খুঁজে পাচ্ছিনা কেন বলতো?

 হা-হা করে হাসে ও। এখন আমার মাথার মধ্যে হাসির শব্দ। তরঙ্গের মতো ধ্বণিত হয় সর্বত্র। শুনতে পাই ডালিয়া বলছে, আজ সকালে তোমার গলা সাধা হয়নি। ঘুম থেকে দেরি করে উঠলে।

 আমি আর কতকাল গলা সাধব ডালিয়া।

 যতকাল গান তোমার সঙ্গী থাকবে ততকাল গলা সাধবে।

 গান! হ্যাঁ, তাইতো। আলতাফও এমন কথা বলতো।

 কিন্তু এখন আমার জীবনে গান নাই। বন্ধুদের অনুযোগ শুনে আমি চুপ করেই থাকি। আমার চেয়ে বেশি কে জানে যে গান আমার কত প্রিয়! রবীন্দ্রসঙ্গীতের বানী আমার জীবনের ব্যাপ্ত পরিসর। কতভাবে অর্থ খুঁজেছি বাণীর শব্দে, বাক্যে। এখনও খুঁজি। তবে গুণগুনিয়ে গান করি। তখন প্রবল শূন্যতায় আমার চারদিক তোলপাড় করে। ড্রইংরুমের চারদিকে তাকিয়ে বুঝতে পারি আমার সময় এখন কাঁচের দেয়াল। দেয়ালজুড়ে ফুটে আছে আলতাফের মুখ। আমি আশ্চর্য হই না। বলি, তুই কেনম আছিস রে বন্ধু? কোথায় আছিস? শেষ ঠিকানাটা রেখে গেলি না। হো-হো করে হাসি আমি। নিজেকেই বলি, কোথায় নেই ও। ওর ঠিকানা আছে দেশের ইতিহাসে। আমার চারদিকে ঝোড়ো বাতাসের উথাল-পাতাল। বাইরে নিশ্চুপ প্রকৃতি।

 দরজায় দাঁড়িয়ে নেইলা বুয়া ডাকে, খালু।

 আমি শুনতে পাই ওর কন্ঠস্বর। কিন্তু চোখ তুলে তাকাই না। এই মুহূর্তে আমার কিছু ভালোলাগছে না। আমার প্রয়োজনে আমি কিছু লোক জড়ো করেছি। তাদের প্রত্যেকের জীবনে কিছু না কিছু ঘটনা আছে। আমি জানি নেইলা বুয়ার স্বামী হেকমত মিয়া দুর্ঘটনায় একটি পা হারিয়েছে। মেয়েটি তাকে কাঠের চাকাঅলা ছোট গাড়িতে বসিয়ে বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যায় ভিক্ষা করানোর জন্য। যা আয় হয় তা দিয়ে সংসার টেনেটুনে চলে। পাঁচটি ছেলেমেয়ের মধ্যে মেয়েটি বড়। নেইলা কখনো নিজে কাজে আসতে না পারলে মেয়েকে পাঠায়। একদিন মেয়েটি আমাকে বলেছিল, বাবারে এমুন কইরা টাইনা লইয়া যাইতে আমার একটুও ভালালাগে না। একদিন বাবারে লইয়া ট্রাকের নিচে পড়মু।

আমি বলেছিলাম, ঠিক আছে তোর মাকে বল তোর বাবাকে নিয়ে ভিক্ষা করতে যেতে। তুই আমার বাড়িতে কাজ কর।

 মেয়েটি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকেছিল। বুঝতে পারছিলাম ওর ভেতরে কোনো দ্বিধা কাজ করছে। অমি কিছু বলার আগেই নিজে মুখ খোলে।

 আপনেরে একটা কথা কমু দাদু, আপনে মায়েরে কিন্তু কইবেন না।

 এত গোপন আবার কি কথা রে?

 আপনের বাসায় কামের কথা আমি মায়েরে কইছিলাম। মায়ে আমার মারতে উঠছিল। কইছিল, যেই বাসায় বেড়া মানুষ একলা থাহে, হেই বাসায় তোর কামে যাঅনের কাম নাই। বেডা মানুষরে বিশ্বাস কি? সব বেডাই ভাল্লুক।

 হি-হি করে হেসেছিল মেয়েটি। ওর নাম জরিনা। আমি কোনো কথা না বলে ওকে হাসতে দিয়েছিলাম। একসময় থেমে ও বলেছিল, আপনে কিছু কইলেন না দাদু? আপনের মন খারাপ হইছে?

 হ্যাঁ, একটুতো হয়েছে। না, না একটু না। ভীষণ মন খারাপ হয়েছে।

 ক্যান? আপনেও ভাল্লুক তাই মনে কইরা? বলেই ও আবার হাসিতে ভেঙে পড়ে। আমি ওর হাসির শব্দে ভয় পাই। আমার মনে হয়েছিল এ হাসি ও না হাসলেই পারত। হাসিটি ওর বয়সী মেয়ের হাসি নয়। ও অনেক পেকেছে। বয়সের আগেই বিষয় বোঝার পাকা। আমার মন খারাপ হয়। এত দ্রুত কৈশোর হারিয়ে যাওয়া মানুষের জীবনের স্বাভাবিক বিকাশ নয়। মানুষ তার স্বাভাবিক আচরণের বাইরে বড় হবে কেন? আমি নিজেকে সান্তনা দিতে পারি না। জরিনা আমার দিকে তাকিয়ে একই উচ্ছ্বাসে বলে, দাদু আর একটা কথা –

 কি কথা? আমি বিষণ্ণ কন্ঠে বলি।

 রাস্তাঘাটের সব বেডারাই ভাল্লুক দাদু।

 ওর কথা বুঝতে আমার অসুবিধা হয় না। আমি একই বিষণ্ণ কন্ঠে বলি, তুই বাড়ি যা জরিনা।

 ও কথা না বলে উঠে দাঁড়ায় এবং দরজা খুলে বেরিয়ে যায়। দরজা খোলাই থাকে। অনেকক্ষণ পরে আমি উঠে দরজা লাগাই।

 নেইলা বুয়া আবার ডাকে, খালু।

 তোমার কি টাকা লাগবে বুয়া?

 হ। ঘরে চাউল নাই। মাইয়াডা দুইদিন ধইরা অর বাপরে লইয়া রাস্তায় যায় না।

 কেন যায় না। কি বলে?

 কিছু কয় না। কয় পারমু না।

 তোমার কয় টাকা লাগবে বুয়া?

 দুইশ টাকা দ্যান। মাস গেলে কাইটা রাইখেন।

 আমি মানি ব্যাগ বের করে বুয়াকে টাকা দেই। ও টাকা নিয়ে বলে, খালু পান্তা পামু?

 বোধহয় আছে। রান্নাঘরে গিয়ে দেখো। ভাত-তরকারি যা আছে তা নিয়ে যাও। হাঁড়ি-পাতিল ধুয়ে রাখো।

 আপনে দুপুরে কি খাইবেন খালু?

 ফ্রিজে কি আছে তা আমি দেখে নেব।

 টেবিলে গ্লাস থালা দিমু?

 না, আর কিছু করতে হবে না। যা লাগে আমি করে নেব।

 আচ্ছা। ও রান্নাঘরে ঢোকে। আমি সোফায় মাথা হেলাই। অল্পসময়ের জন্য মাত্র। টেবিলের ওপর থেকে ডাইরি তুলে পাতা ওল্টাই। বিকেলে কি করার আছে দেখার জন্য তারিখটা বের করি। পুরো পৃষ্ঠা সাদা। কিছু লিখলাম না কেন? আজ সন্ধ্যায় ছায়ানট মিলনায়তনে গানের আসর আছে। যাব কি যাব না ভাবছি, তখন ছোট বোন সুষমার ফোন আসে।

 হ্যালো ভাইজান?

 সুষমা, তুই? ভালো আছিস?

 ভালো আছি ভাইয়া।

 ভাবি কেমন আছে।

 বেঁচে আছে। নিশ্বাস ফেলছে। স্যুপ নেমে যাচ্ছে গলায়। কোথাও বাধা নেই।

 তুমি সবসময় এমন করেই উত্তর দাও।

 তোর প্রশ্নের উত্তর একই হলে আমি কি করতে পারি!

 রেগে আছ কেন?

 রেগে ওঠার মতো প্রশ্ন করিস সেজন্য।

 তুমি কেমন আছ?

 মরিনি এখনো। বেঁচে আছি।

 সুষমাও রেগে গিয়ে বলে, মরোনি ভালো করেছ। চাইলেইতো আর মরতে পারবে না। ভাবির জন্য স্যুপ করেছি। আমি নিয়ে আসব। তুমি কোথাও যাবে নাকি?

 তুই এলে যাব। তুই তোর ভাবির কাছে থাকবি।

 সুষমা হাসতে হাসতে বলে, এজন্যই একটু আগে মরার কথা বলেছিলে।

 চুপ কর শয়তান। আমিও হাসতে থাকি। ও আর আমি পিঠেপিঠি ভাইবোন। আমাদের সাত ভাইবোনের মধ্যে ওর সঙ্গেই আমার যোগাযোগ সবচেয়ে বেশি। ডালিয়ার সঙ্গে ওর বান্ধবীর মতো সম্পর্ক ছিল। ডালিয়ার এইভাবে বেঁচে থাকা ও সবচেয়ে বেশি ফিল করে। আমার বিষণ্ণতা কেটে যায়। ফুরফুরে মেজাজ নিয়ে কবি স্যাফোর কবিতা পড়ব বলে ঠিক করি। তখন দরজায় এসে দাঁড়ায় নেইলা বুয়া।

 খালু। ও সরাসরি আমার দিকে না তাকিয়ে ডাকে।

 বলো, কি বলবে। ও কিছু বলার আগেই আমি বলি, তুমি আর কিছুক্ষণ থেকে যাও বুয়া। একটুপরে জুয়েল বাজার নিয়ে ফিরবে। তুমি বাজার গুছিয়ে রেখে যেও।

 তাইলেতো ভালাই হইল। ফ্রিজে একজনের ভাতই আছিল। এক টুকরা বোয়াল মাছও আছিল। আমি খাইলাম। খাইয়া আমার পরাণ ঠান্ডা হইয়া গেল। খালু আপনের লাইগা অনেক দোয়া করছি।

 তোমার ছেলেমেয়ের জন্য কি ভাবলে?

 অগো লাইগা কিছু ভাবি নাই। এতো ভাইবা কুলাইতে পারি না। জীবনডাতো ভাবতে ভাবতে গেলো। পোলাপানের বাপ রিক্সা চালাইয়া আয়-রোজগার করত। তহন খারাপ আছিলাম না। অহন আমার অবস্থা খালাআম্মার মতো খালু।

 খালা আম্মার মতো? আমি বিস্ময়ে বুয়ার দিকে তাকাই। কি বলছো তুমি?

খালাআম্মা চোখ খোলে না। হাঁটে না, খায় না। কেবল শুইয়া শুইয়া শ্বাস ফেলে। তফাৎ এইডুকু। আমি চোখ খুলি, হাঁডি। ভাত খাই। তো লাভ কি? বাঁইচা মইরা থাকার মতো অবস্থা। আমি এমুন কইরা বাঁচতে চাই না। আল্লাহ্ আমারে নেয় না ক্যান?

 তুমি এসব কি বলছো বুয়া?

 ঠিকই কই খালু। খালাআম্মার কপালরে আমি হিংসা করি। আপনের মতো স্বামী পাইছে।

 নেইলা বুয়া আঁচলে চোখ মোছে। ও ডালিয়াকে নিজের সমান্তরালে চিন্তা করছে দেখে আমার রাগ হয়। পরক্ষণে ভাবি, আমি রাগ করছি কেন, ওর ভাবনার জগৎতো এতটুকুই হবে। ও নিজেকে মেলাবে ওর চারপাশের মানুষের সঙ্গে। এর বেশিকিছু ভাবার বিদ্যাবুদ্ধিতো ওর নেই। আমি নিজেকে সামলাই। এভাবে নিজেকে সামলানোর শক্তি আমি যে কোথায় থেকে পাচ্ছি তা আমি জানি না। নিজের ওপর আমার ভীষণ মায়া হয়। একজন অসহায় মানুষের চারপাশের যাবতীয় জীবনাচরণ থিতিয়ে যাওয়ার মায়া। বলি, হায় আরিফুর রহমান, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, একজন রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী। আজ আমি একজন নির্বাক মানুষে রূপান্তরিত হয়েছি। কারও প্রশ্নের মুখোমুখি হতে আমি ভয় পাই। আমার অসহায়ত্বের কোনো চেহারা নেই।

 শুনতে পাই গৃহকর্মীর কন্ঠস্বর।

 খালু, আপনে চুপ কইরা আছেন ক্যান? আমারে কিছু কইলেন না তো?

 ভাগ্যের কথা আমি তো কিছু বলতে পারব না বুয়া।

 আপনে না পোলাপানরে পড়ান? তো কইতে পারবেন না ক্যান? পোলাপান আপনেরে কিছু জিগাইলে আপনে কি চুপ কইরা থাইকতেন?

 যখন আমি ছেলেমেয়েদের পড়াতাম তখন আমার বউ বেঁচে ছিল। আমার চারদিকে মানুষ গমগম করত, আমি অনেক বই পড়াতম, গান গাইতাম। অনেক গানের অনুষ্ঠানে আমাকে যেতে হতো। রেডিওতে, টিভিতে গাইতাম। এখন আমি কিছু করি না। এখন আমার কথা বলতেও ভালোলাগে না।

 আমি থামলে বুয়া মিনমিনিয়ে বলে, মানুষ এমুন হইতে পারে? মানুষ এমুন হয় ক্যান? আমার স্বামী আমারে অনেক জ্বালাতন করে, হেরপরও আমি হ্যারে সহ্য করি। দিন কাডতে চায় না, তাও কাডাই। আপনের কি এমুন লাগে খালু যে দিন কাডতে চায় না, হেরপরও কাডান?

 না, আমার দিন কাটতে চায় না, এমন কখনো হয় না। আমার দিন আনন্দেই কাটে।

 ঘরে এমুন মরা বউ লইয়া দিন ক্যামনে আনন্দে কাটে খালু?

 আনন্দেই কাটে। তা তোমাকে বোঝানো যাবে না। তোমার স্বামী মরে গেলে তুমি তাকে ভালোবাসবে না?

 চুপ করে থাকে নেইলা নামের মধ্যবয়সী একজন নারী। ডালিয়া বেঁচে থাকতে এই বয়সী অনেক নারী এ বাসায় কাজ করেছে। তাদের নানা জনের নানা সমস্যার কথা আমি ডালিয়ার কাছ থেকে শুনেছি। কখনো কিছু টাকা দিয়ে সাহায্য করেছে ডালিয়া। কখনো কিছুই করা হয়নি তাদের জন্য। তারা নিজেরাই নিজেদের সমস্যার পথ খুঁজে চলে গেছে। আজ ডালিয়ার অসুস্থতায় এসব নারীদের কেউ আমার মুখোমুখি হয়েছে। আমার নিঃসঙ্গতা ওদেরকে সাহসী করেছে। আমি দেখতে পাই নেইলা দরজার উপর কপাল ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নিজেকেই প্রশ্ন করি, তুমি কি ডালিয়ার চেয়ে বেশি জীবিত? যার জীবনযাপনে দিন চলে না তাঁর বেঁচে থাকাই কি বা মরে যাওয়াই কি? বরং ডালিয়া বেঁচে আছে যত্নে-ভালোবাসায়-অনুভবে-স্মৃতিতে। প্রসঙ্গ থেকে প্রসঙ্গান্তরে স্রোতস্বিনী হয়ে বয়ে চলার ভাবনায়। হাঃ, নেইলা তুমি বেঁচে থাকা বোঝ না। ও ডাকে আমাকে, খালু।

 বলো। কি বলবে?

 আপনে আমারে মেলা শক্ত প্রশ্ন কইরলেন। ভালোবাসা কি হেইডাওতো আমি বুঝি নাই। দুইজনে একলগে থাকলেই কি ভালোবাসা অয়?

 আমি জোর দিয়েই বলি, না হয় না।

 তাইলে আমার কনু ভালোবাসা নাই। আমিও মরা মানুষ হইয়া বাঁইচা আছি। কেবল আমার লাইগা আপনের লাহান কেউ নাই।

 ও দ্বিতীয়বার একই প্রশ্ন উঠিয়ে আনে। আমি বুঝতে পারি জীবনভর যে কোনো প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পায়নি আজ তার উত্তর খোঁজার পালা। আবার এটাও সত্যি যে এ প্রশ্নের উত্তর ও কোনোদিনই খুঁজে পাবে না। খুঁজে পাওয়ার পরিসর ওর জীবনে নেই। কীভাবে মানুষ তার প্রতিটি জায়গা বুঝতে পারবে? আমি হাত ওল্টাই। আবার আমার চারপাশে শূন্যতা ভর করে। আমিই কি আমার সব প্রশ্নের উত্তর পেয়েছি? পাইনি। আমার অপূর্ণতায় আমার বুকের সরোবর জলহীন। আমি আর বেশি ভাবতে চাই না। যে নারী আমার কাছে একটি উত্তর খুঁজতে চেয়েছিল সে এখন এক নিরুপায় নারী। জীবনের ক্লাশের শিক্ষার্থীদের সামনে শিক্ষক নেই। অমি এক ক্ষুদ্র মানুষ। শুনতে পাই রান্নাঘরের বেসিনে পানি পড়ছে। বুয়া যখন কল ছাড়ে এমন জোরেই ছাড়ে। আমি ওকে কিছু বলি না। যাদের ওপর নির্ভর করে আমার দিন কাটাতে হয় তাদের সঙ্গে কত আমি ক্ল্যাশে যাব। সেজন্য অনেককিছু ছেড়ে দেই। এখনতো প্রতিদিনের রুটিন কাজে মাথা ঘামানোর ইচ্ছা নেই আমার । মাঝে মাঝে নিজেকে প্রশ্ন করি, আমি কি ইচ্ছা-অনিচ্ছার বাইরে চলে যাচ্ছি? আমার দিন কি শুধুই বৃষ্টি-বাদলের ছায়া? রোদ-সূর্য নেই? গ্রীষ্ম শরৎ নেই? থাক, এসব ভাববো না। কোনো মানুষেরই ভাবনার শেষ নেই, এক জীবন শুধু নয়, হাজার জীবন পার করলেও কেউ ভাবনাহীন জীবন কাটাতে পারবে না। এটা বেঁচে থাকার সত্য। কোনো না কোনো ভাবনার ভেতরে মানুষের গুটিয়ে থাকা তার বিস্তারের কথাই বলে। আমি বিচ্ছিন্ন ভাবনা মাথায় নিয়ে ইশতিকের ঘরে আসি। ও আমার একমাত্র ছেলে বিদেশে থাকবে বলে দেশ ছেড়েছে। বলেছে দেশে বেড়াতে আসবে কিন্তু বসবাসের জন্য ফিরবে না। দেশের দারিদ্র্য এবং গণমানুষ ওর স্বস্তি দেয় না। রাস্তায় গাড়ি থামলে ভিক্ষার জন্য ছুটে আসা শিশুদের ও সহ্য করতে পারে না। প্রতিবন্ধী মানুষেরা নাকি ওর কাছে আরও অসহ্য। ও আমার ভাবনাকে পর্যুদস্ত করে রাখে কারণ আমি ভাবতে পারি না যে কীভাবে এমন অন্ধ-ভাবনা একজনকে পিষে মারতে পারে। মানবিক বোধের চেতনার দিক থেকে পিষে মারে, আমি ওর ভাবনার মধ্যে নিজেকে ঢুকতে দিলে আমার চারপাশ তোলপাড় করে। আমি নির্জীব হয়ে পড়ি এবং প্রবল বিবমিষা আমাকে আচ্ছন্ন করে – জীবনের অপার সাগরপাড়ে দাঁড়িয়ে নিজের আত্মজের ক্ষুদ্র চিন্তা আমি সাগরে ছুঁড়তে পারিনা। ভাবি দূষিত হবে মানবিকতার সমুদ্র। ওটাকে মাটিতেও পুঁততে পারিনা ভাবি কলঙ্কিত হবে আমার সংস্কৃতির শেকড়। তারপরও ও আমার সন্তান। ওকে আমার ভাবনায় রাখতে হয়। দূরে ঠেলে দেয়ার উপায়তো আমার নেই। অমি নতুন ভাবনায় ঢোকার আগে নিজেকে সংযত করি।

 ইশতিক বিদেশ যাওয়ার পরে ওর ঘরটা আমার পড়ার ঘর বানিয়েছি। ওই ঘরে ঢুকলে আমি ওকে খুঁজি না। ওর বাস্তবতা আমার কাছে এতই ঘনিষ্ঠ যে আমার ওকে হারাবার ভয় নেই। ওর ক্ষুদ্র চিন্তা নিয়ে আমার কাছ থেকে দূরে যেতে পারে না। আমি ঠেলে রাখার চেষ্টাও করি না। ভাবি যেভাবে আছে থাকুক, জীবনে কষ্টের দায়ভার ছেড়ে আমি সুখের প্রাপ্তি খুঁজতে যাব না। ও আমার কষ্টের ভাবনা। আমি উঠে পড়ার ঘরে আসি। স্যাফোর কবিতার বই খুঁজতে থাকি, অনেক বই নামাই-ওঠাই। কিন্তু স্যাফোর বই খুঁজে পাই না। মেজাজ গরম হলে আমি র‍্যাক থেকে বই নামিয়ে মেঝেতে রাখি। মাঝে মাঝে র‌্যাক খালি হয়ে যায় সব বই মেঝেয় নামিয়ে ফেললে। বই মেঝেতে দেখলে বেলি হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করবে, নানা কাইল রাইতে কি আপনের মাথা খারাব হইছিল?

 হ্যাঁ, হয়েছিল রে। ভীষণ খারাপ হয়েছিল। মনে হয়েছিল এইসব বই বুকের ওপর রেখে ঘুমিয়ে থাকি।

 ক্যান, বই না পাইলে আপনের মেজাজ গরম অয় ক্যান?

 তুই বুঝবি না।

 হ, ঠিকই বুঝুম না। আমি তো লেহাপড়া শিহি নাই। বই বুজতে অইলে লেহাপড়া শিখন লাগে। আমি এইডা বুজি। নানাভাই মানুষ গরিব অয় ক্যান?

 আমি হা-হা করে হেসে বলেছিলাম, এটাও তুই বুঝবি না। তুই আমার সোনার নাতনি।

 সত্যি? তাইলে আমারে আইসক্রিম খাওয়াইবেন।

 হ্যাঁ খাওয়াব। তোকে টাকা দেব। তুই বাড়ি যাওয়ার পথে কিনে নিবি।

 তাইলে দুইডা আইসক্রিমের টাহা দিবেন।

 কেন? কাকে দিবি? বাবাকে?

 না, বাপেরে দিমুনা। জুয়েল ভাইরে দিমু। জুয়েল ভাই আমারে এইডা-ওইডা খাইতে দেয়। কয়, তোর কিছু শখ অইলে আমারে কবি। আমি কই না, আমার শরম করে। জুয়েল ভাইরে একডা আইসক্রিম দিলে আমার মান বাড়ব।

 কথা শেষ করে হি-হি করে হাসে বেলি। এই মুহূর্তে ওর হাসির শব্দ আমার ভাবনায় ঢোকে। আমি বইয়ের র‍্যাকে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়াই। হাসির শব্দ আমার ভেতরে বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। আমি এই মুহূর্তে বেলির ভাবনায় থাকতে চাই না। যদিও ওকে নিয়ে ভাবনার অনেককিছু আছে। ওর বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা দেখলে নিজেকে একজন অসহায় মানুষ মনে হয়। আমি কি পারতাম না ওকে স্কুলে যাওয়ার সুযোগ করে দিতে? ওতো রাস্তার ধারে ফুল বিক্রি করার মেয়ে না। সুযোগ পেলে ও নিজেকে কোথাও দাঁড় করাতে পারত। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শৈশব-কৈশোর পার করতে হচ্ছে। সুযোগহীন অসহায় বালিকা। আমার ভাবনা থেকে ওর উপস্থিতি বাষ্পের মতো উড়ে যায়। আমি স্যাফোর কবিতার বইয়ে ফিরে আসি। তাহলে ইশতিক কি বইটি নিয়ে গেছে নাকি ডালিয়া চায়নি আমার নাগালের মধ্যে বইটি থাকুক। মা-ছেলে দুজনে মিলে কি বইটি এই বাড়ি থেকে সরিয়ে দিয়েছে? ডাস্টবিনে অথবা অন্য কোথাও? আমি যখন পিএইচডি করার জন্য কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে ছিলাম তখন বইয়ের দোকান নোবেল অ্যান্ড বার্নস থেকে বইটি কিনেছিলাম। বিশ্ব জুড়ে সবাই জানে স্যাফোই পৃথিবীর প্রথম লেসবিয়ান কবি। তাঁর কবিতার মূল জায়গা নারীর যৌনতা। এই যৌনতা নারীর সঙ্গে নারীর। তাঁর কবিতা পড়লে আমার মাথা ঝিমঝিম করতো। মনে হতো পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে এক বিপুল দ্রোহ। শিল্পের সাধানায় একজন একক নারী পুরুষতন্ত্রকে চিহ্নিত করেছিলেন কত হাজার বছর আগে। সরাসরি বলেননি, বলেছেন নারীর অধিকারের জায়গা চিহ্নিত করে। আমি একে জ্ঞানের ডিসকোর্সে দেখি। আচরণের ডিসকোর্সে নয়। আমি জানি এ বিষয়ে আমার সঙ্গে একমত হয় না অনেকে। আজ পৃথিবীর অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে জেন্ডার স্টাডিস বিভাগে স্যাফোর কবিতা পাঠ্য। নিউইয়র্কে বসবাসের সময়ে ডালিয়া আমার উপর রেগে গিয়ে বলতো, কি ছাইপাশ পড়ো। আমি বলতাম, এই কবিতা নারী জীবন ব্যাখার বড় উপকরণ। এই জীবন নারীর একার নয়। এই জীবন সমাজ এবং রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কিত। বিষয়টি আলোচিত হলে মানুষের অনেক ভুল ধারণা ভাঙবে।

 তোমার বিষয় অর্থনীতি। তুমি জেন্ডার নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছো কেন? নিজেকে অর্থনীতির সীমানায় রাখো।

 বিষয়টি অর্থনীতির বাইরে নয়। একে অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত না করলে সমাজ কাঠামো এগোবে না। জেন্ডার আলোচনা বাদ দিয়ে অর্থনীতিকে দেখা একটি ভুল শিক্ষা। তোমার এটা জানতে হবে ডালিয়া।

 ব্যস, বক্তৃতা রাখো। আমি এসব শুনব না। আমি চাই অর্থনীতি আর রবীন্দ্র-সঙ্গীতই তোমার বিষয়। আর কিছু না। এই দুইয়ের মধ্যে থাকলে তোমার স্বস্তিতে থাকা হবে। নানা ভাবনায় তোমার মাথা গরম করতে হবে না।

 আমি ওকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলাম, তুমি আমার সবচেয়ে বড় বিষয়। গভীর বিষয়। যার তল আমি খুঁজে পাই না।

 সত্যি? আমি চাই তোমার এই খোঁজা সারাজীবন থাকুক। তুমি আমাকে খুঁজতেই থাক। কোনোদিনই খুঁজে পাবে না। তোমার জীবনে আমাকে খোঁজার প্রয়োজন যেন শেষ না হয়।

 দু’জনে সেদিন আর কথা না বাড়িয়ে গভীর আবিষ্টে ডুবে গিয়েছিলাম। সে এক অপূর্ব সময় ছিল আমাদের জীবনে। কখনো মুহূর্তের সময়ই চিরকালীন হয় যায়। ডালিয়া টুকরো টুকরো অনুভূতির প্রাচুর্যে ভরিয়ে রেখেছিল আমাকে। আমি বইয়ের র‌্যাকে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা থেকে নিজেকে টেনে তুলি। নিজেকেই বলি, তুমি আমার স্যাফো ডালিয়া। ভালোবাসার অনুভবে আমরা নিজেদের সময়কে ছাড়িয়ে স্যাফোর সময়কে আঁকড়ে ধরি। আমি পুরুষ, নারীর অনুভবে তোমাকে আঁকড়ে ধরি। কীভাবে যেন মাথার ভেতরে নারী হয়ে যাওয়ার সবটুকু আমাকে আচ্ছন্ন করে। এসব সময়ে আমার চেতনায় তুমি অন্য নারী হয়ে যাও, আমার স্ত্রী থাক না। ডালিয়াকে একথা বললে ও রেগে যেতো। রেগে অগ্নিমূর্তি হয়ে যাওয়া যাকে বলে, ঠিক সে রকম। অনেক সময় দেখা গেছে ও দু’দিন আমার সঙ্গে কথা বলেনি। কখনো তীব্র ভাষায় বলেছে, তুমি নষ্ট মানুষ। মানুষ কি করে এসব ভাবতে পারে তা আমার মাথায় আসে না। তুমি আর কখনো আমাকে এভাবে কথা বলবে না।

 আমি ওর কথা হজম করেছি, কিন্তু কখনো রাগ করিনি। আমি জানি আমি কি, কতটুকু আমার সাধ, কতটুকুই বা আমার সাধ্য! নিজের উপভোগের মাত্রা আমার নিজস্ব। কীভাবে উপভোগ করব সেটা আমার চিন্তা। এখানে কেউ মাথা গলাবে তা আমি চাই না। সে আমার যত কাছের প্রিয়জনই হোক না কেন!

 আমি আবার স্যাফোর কবিতায় ফিরে আসি। আকারণে বই ঘাঁটাঘাঁটি করি। অসংখ্য বই মেঝেতে নামিয়ে ফেলি। কিন্তু আমার মস্তিষ্ক সক্রিয়, স্যাফোর কবিতা সেখানে কাজ করছে। কবিতার নানা পংক্তি আমার ভাবনার জগতে ফুঠে উঠেছে। তোমার রাগ আমাকে থামাতে পারবে না। কারণ তোমার রাগের উর্ধে আমার কবিতার জগত। একই সঙ্গে ডালিয়ার কথা মনে হয় – তুমি এখন আমার মিসিসিপি নদী। মন খারাপ করোনা মিসিসিপি। আমার ভীষণ স্যাফোর কথা মনে হচ্ছে। স্যাফোর কবিতা আমাকে আলোড়িত করে। তোমার চেয়ে আর বেশি কে জানে যে সাহিত্য আমার প্রাণের বিষয়। অর্থনীতি আমার পড়াশুনা, চিন্তার জায়গা। তুমি আমার প্রিয় নদী আগুনমুখা। আমি যখন স্যাফোর কথা ভাবছি তখন আমি স্যাফোর দ্বীপের মধ্যে দিয়ে বয়ে যাওয়া কোনো নদীর নাম খুঁজছি। পাচ্ছি না। স্যাফো থাকতেন গ্রিসের লেসবোস দ্বীপে। অভিজাত পরিবারের সন্তান ছিলেন। একজন বিত্তশালী বণিকের বউ ছিলেন। একটি কন্যাসন্তানের মা ছিলেন। আর তাকে তাঁর কবিতার জন্য বেশ্যা বলে গালি দিত তার দ্বীপবাসীরা। তার পেপিরাস কাগজের ওপরে লাথি দিয়ে থুতু দিত। একসময় আবিষ্কার হয়েছিল তার দশ হাজার কবিতার লাইন। আমি কেমন করে তাঁকে আমার সাহিত্যবোধ থেকে ছুঁড়ে ফেলব ডালিয়া? তাঁর কোনো প্রিয় নদী ছিল কিনা তা আমি জানতে চাইনা। তাঁর কবিতাই আমার কাছে নদী। সে নদীর নাম স্যাফো নদী। তোমাকে আমি কোনোদিন স্যাফো নদী বলে ডাকিনি। জানি, তুমি তা পছন্দ করবে না। তোমার স্বাধীনতা আমার কাছে মর্যাদার বিষয়। তোমাকে আমি ভালোবাসি ডালিয়া। কিন্তু তুমি পছন্দ করবে না বলে আমি স্যাফোকে আড়াল করে ফেলব, তা হবে না। এখানেই তোমার সঙ্গে আমার চিন্তার সেতুবন্ধন। আমি আমার নিজেরটুকু সঞ্চয়ে রেখে তবেই আমি অন্যের কাছে গিয়ে দাঁড়াই। যেন কেউ আমার জায়গা থেকে আমাকে সরিয়ে দিতে না পারে। স্যাফো আমার সঞ্চয়ের ঝুলিতে বিশাল দ্বীপ।

 স্যাফো যে ভাষায় কবিতা লিখতেন সে ভাষা এখন আর গ্রিকরা পড়তে পারে না। তাঁর ভাষা ছিল ইয়োলিক ডায়ালেক্ট। আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে আমন্ত্রণে একবার এক সেমিনারে গিয়েছিলাম। সঙ্গে তুমি ছিলে। দু’জনে বেশ আনন্দে সময় কাটিয়েছিলাম আমার ইয়াংসি নদী। সেসময় কি কারণে যেন স্যাফো বিষয়ে আলোচনা উঠেছিল। আমার এখন আর ঠিক মনে নেই। একজন অধ্যাপক বলেছিলেন, ওর কবিতা পড়লে মনে হয় ‘আ-সেক্স-ক্রেজড হোর হু সিংস অব হার ওন ওয়ানটনেস।’

 আমি খানিকটুকু রাগত স্বরে বলেছিলাম, নিজের আকাক্সক্ষার কথা উঁচু স্বরে বললে বেশ্যা হবে কেন? এটা আপনি কি বললেন?

 তিনি একই ভঙ্গিতে বলেছিলেন, ‘আফ্রোদিতি’ নামে যে কবিতাটি লিখেছে সেটা পড়ে দেখুন। বেশ্যা ছাড়া কেউ এমন যৌন-কীর্তন করতে পারে না।

 ডালিয়া আমার হাত টেনে ধরে বলেছিল, তর্ক করতে হবে না। চলো। ডালিয়া আমাকে সরিয়ে নিতে চাইছিল।

 আমি ওর হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলেছিলাম, জেন্ডার স্টাডিজ ডিপার্টমেন্টে এই কবিতা পাঠ্য। কত হাজার বছর পরও স্যাফোর কবিতা বিশ্লেষিত হচ্ছে। ‘আফ্রোদিতি’ কবিতা আমি পড়েছি। আমি কবিতার শিল্প দেখেছি, সেক্স দেখিনি। আপনার মতো নেগেটিভ দৃষ্টিতে শিল্প-সাহিত্য পাঠের বিচার যথার্থ বলে আমি মনে করি না।

 সেই অধ্যাপক আমার দিকে চোখ বাঁকিয়ে বলেছিলেন, রিয়ালি!

 ভাবখানা এমন করেছিলেন যে, পৃথিবীর এমন একটি কথা তিনি কখনো শোনেননি। তাপরও আমি তাঁকে বলেছিলাম, আপনার বোধহয় জানা নেই যে প্লেটো স্যাফোকে ‘টেন্থ মিউজ’ বলেছিলেন। প্লেটো শিল্পের জায়গা মেনেই এমন প্রশংসা করেছিলেন। প্লেটো একজন জ্ঞানী মানুষ।

 তিনি হা-হা করে হেসে বলেছিলেন, আপনি দেখছি স্যাফো বিশারদ।

 তিনি লেসবিয়ান কবি কিনা তা নিয়ে আমার মাথা ঘামানোর কিছু নেই। তাতে একজন পাঠকের কিছু যায় আসে না। কিন্তু কবিতা ভালো না লাগলে পাঠকের যায় আসে। মনে রাখবেন। আমি কবিতা বুঝি। অকারণ আক্রমণ বুঝি না।

 তিনি ঘাড় বাঁকিয়ে হাত উল্টিয়ে বলেছিলেন, ওকে। মনে রাখব। জ্ঞান দেয়ার আর জায়গা পেলেন না। বলেই তিনি আর দাঁড়াননি। হনহন করে হেঁটে চলে যান। ভিড়ের আড়ালে চলে গেলে আমি মৃদুস্বরে উচ্চারণ করেছিলাম, বাস্টার্ড। তুমিও আমাকে ঝাড়ি দিয়েছিলে ডালিয়া। হাত ধরে হেঁচকা টান দিয়ে বলেছিলে, শুধু শুধু মাথা গরম করছো। চল। স্যাফো তোমার কে? মেজাজ খারাপ করছ কেন? আমি মৃদু হেসে বলেছিলাম, স্যাফো আমার কবিতার শিল্প।

 সেদিনের সেই স্মৃতি বইয়ের র‍্যাকের সামনে দাঁড়িয়ে আমার কাছে ফিরে আসে। বুকের বেতর নানাকিছু তোলপাড় করে। সময়, স্মৃতি, হাজার হাজার বছর আগের একজন নারী, তার কবিতা, বর্তমান সময়, আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়, সেমিনার, বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ – সব এক হয়ে আমার সামনে স্থির হয়ে যায়। কখনো ফেলে আসা সময়কে এভাবে অনুভব করা আমার অভ্যাস। এতে আমি বিরক্ত হইনা। পুরো বিষয়টা এনজয় করি। বেঁচে থাকার শর্ত পূরণই তো নিজেকে ফিরে ফিরে দেখা। আমি বেঁচে থাকার কোনো কিছু থেকে নিজেকে বঞ্চিত করতে চাই না। আমি র‍্যাক থেকে ‘প্লেটোর রিপাবলিক’ বইটি নিয়ে ড্রইংরুমে আসি। ড্রইংরুমের কাঁচের দেয়াল আমাকে তন্ময় করে। স্যাফোর পাঁচ খন্ডে প্রকাশিত কবিতার বই চারদিকে ছড়িয়ে থাকে। আমি চোখ ফেরাতে পারি না। দেখতে পাই পৃষ্ঠাগুলো খুলছে, বন্ধ হচ্ছে, কোনো কোনোটা বই থেকে বের হয়ে বাতাসে উড়ছে। বেশ মজার আনন্দ আমাকে আপ্লুত করে। আমার সময় দ্রুত কেটে যায়।

 একসময় শুনতে পাই রান্নাঘর থেকে কান্নার গুনগুন শব্দ ভেসে আসছে। আমি কান পেতে শুনি। কাঁচের দেয়াল থেকে স্যাফোর কবিতার বই সরে যায়। শূন্য দেয়ালে কান্নার ধ্বনি হা-হা ফেরে, মনে হয় ধ্বনিও দৃশ্য হয়েছে বুঝি। শূন্যতার মাঝে ধ্বনি এক অসাধারণ দৃশ্য, আমি পলকহীন তাকিয়ে থাকি। বুঝতে পারি নেইলা বুয়া কাঁদছে, ওতো কাঁদবেই। এই মুহূর্তে ও স্বামী আর মেয়েকে নিয়ে পারিবারিক সমস্যায় আছে। সমস্যাটা জটিল, শুধুই গরিব মানুষের সমস্যা না। সমস্যার মধ্যে মানবিক সম্পর্কের জটিলতার সূত্র আছে – সমস্যার মধ্যে আর্থিক বিষয় যেমন আছে, তেমন মানসিক বিষয়ও আছে। মানুষকে যেভাবে দেখলে তাকে বোঝার জায়গা তৈরি হয় আমি সেভাবে দেখতে চাই নেইলা বুয়াকে। ও আমার কাছে টাকা চেয়েছে, সেটা বড় হিসাব না। ওর বড় হিসাব স্বামীর উপার্জন, কয়দিন ধরে সেই উপার্জন বন্ধ। কেন বন্ধ সেটাও এক জটিল জিজ্ঞাসা। আমি ওর কাছে কান্নার কারণ জানতে চাইব কি চাইব না যখন ভাবছি তখন ও ড্রইংরুমের দরজার কাছে এসে দাঁড়ায়।

 খালু আমি যাইগা। পাকঘর গোছাইয়া রাখছি। আপনের আর কিছু লাগব?

 না, আমার কিছু লাগবে না। শুনতে পেলাম কাঁদছিলে। তোমার দুঃখ কি বুয়া?

 আমার ভাগ্যটা এত খারাপ ক্যান? এইডা ভাইবা আমার বুক ভাইঙা যায়। তহন কান্দন আহে। আপনের বাসায় বইসা আমি কতক্ষণ কানতে পারি। তহন মনে শান্তি পাই। রাস্তায় বা নিজের বাড়িত বইয়া কান্দে পারি না। মানষে নানা কথা হুনায়।

 ভাগ্যের উপর তো কারো হাত নাই বুয়া। যার ভাগ্যে যা আছে তা তাকে মানতে হবে।

 আমি অহন থাইকা আমার ভাগ্য খুঁজুম। দেখমু আমার ভাগ্যের কোনহানে আমার ভালা কিছু আছে কিনা!

 আমি চুপ করে থাকি। ওকে আমার কিছু বলার নাই। নিজেকেই প্রশ্ন করি, ভাগ্যের কতটুকু খুঁজে পাওয়া যায়? কাজটা কি সহজ। বুকের ভেতর ধড়ফড় করে। আমার ভাগ্যই কি ভালো। কত বছর ধরে অচেতন ডালিয়া আমার সঙ্গী! এটাই বা ভাগ্যের কোন বিচার!

 বুয়া পরক্ষণে বলে, আপনের মতো মানুষের বাড়িতে কাজ পাইছি এইটাই আমার ভাগ্য খালু। টেকা চাইলে দ্যান, বকাবকি করেন না। এই বাড়িডা মোর শান্তির জায়গা। নিজেরে লইয়া চিন্তাকরণ লাগে না। আপনে আমারে তাড়াইয়া দিয়েন না খালু।

 আকারণে তাড়াব কেন? তোমাদেরকে ছাড়া আমার দিন কাটবে কেমন করে? তোমরা না থাকলে আমি তো হিমসিম খেতাম। দরকারটা দু’পক্ষের। আমাকে যেমন তোমার দরকার, তোমাকেও আমার দরকার। তুমিও আমার কাজে আসা বন্ধ করে দিও না।

 বুয়ার মুখ হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। আমি দৃষ্টি ঘুরিয়ে হাতে নেয়া বইয়ের পাতা ওল্টাই। প্লেটোর ‘রিপাবলিক’ বইয়ের ওপর আমার চোখ আটকে থাকে। আমি যে বইয়ের পৃষ্ঠায় মনোযোগ দিয়েছি তা নয়। পড়ছিতো না-ই। শুধু নেইলা বুয়ার মুখোমুখি হওয়া থেকে আমি নিজেকে আড়াল করছি। কারণ ওর হাসিমুখ দেখলেও আমার মনে হয় এটা প্রকাশ্যে দৃশ্য দেখা না, আপাত হাসির অন্তারলটি গভীর এবং ভয়াবহ। এই মুহূর্তে যা কিছু অদৃশ্য তা আমার ভাবনায় জড়ো হোক তা আমি চাই না। সেজন্য আমার বিষয়ের অন্য জায়গায় যাওয়া দরকার।

 তখন ঝোলা ভর্তি বাজার নিয়ে বাড়ি ফেরে জুয়েল। পাল্লা দু’টো মুখোমুখি লাগানো থাকলেও দরজা আটকানো ছিল না। এটা আমারই নির্দেশ যে যখন ওরা কাজ করবে তখন কেউ দরজা আটকে রাখবে না। যে কেউ ধাক্কা দিলে যেন দরজা খুলে যায়। সেজন্যই বেল না চেপে জুয়েল ঢোকে এবং বুয়াকে দেখে তড়বড়িয়ে বলে, আসেন দুইজনে মিলে বাজারটা গুছিয়ে রেখে যাই। অনেক বাজার এনেছি। গোছাতে সময় লাগবে। আপনি হাত লাগালে তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে।

 তোর তাড়া আছে নি ছ্যামড়া?

 আছে তো। অনেক তাড়া। বাবাকে নিয়ে হাসপাতালে যাব।

 কি হইছে তোর বাপের?

 জানি না। কেবল পেট ব্যাথা করে।

 ডাক্তার দেহান লাগব না। এমনে এমনে সারব।

 হ্যাঁ, আপনাকে বলেছে। ডাক্তার দেখাতে না হলে ডাক্তারি বিদ্যার এমন কেয়ামত ক্যান ঢাকা শহর জুড়ে? আসেন, রান্নাঘরে আসেন।

 ওরা রান্নাঘরে ঢোকে। আমি দু’জনের কথা শুনি। কিন্তু ওদের কথায় ইন্টারফেয়ার করি না। তবে কেয়ামত শব্দটি আমি বেশ উপভোগ করি। মনে মনে হাসি। ছেলেটি এভাবে শব্দটি ব্যবহার করতে পেরেছে শুনে আমি ওর বুদ্ধিমত্তার চমকিত হই। ভালোই লাগে। জন্মের সূত্র জানা নেই বলে ওর ধর্ম নেই। কিন্তু কেয়ামত মানে ও জানে। জেনেছে পারিপার্শ্বিক জ্ঞান থেকে। নিঃসন্দেহে ধর্মীয় ওয়াজ শুনে কিংবা জিজ্ঞাসা করে নয়তো জানার আগ্রহ থেকে। এমনও হতে পারে যে সব ধর্মের খুঁটিনাটি জানার আগ্রহ নিজের ধর্ম পরিচায়হীনতার কারণে ওর ভেতরে ঘুরপাক খায়। এসব ভেবে আমি আনন্দ বোধ করি। প্লেটোর জ্ঞানের বইয়ের পাতা বন্ধ করে বইটা বুকে চেপে সোফার পেছনে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে রাখি। মনে হচ্ছে যা কিছু হারিয়েছি তার কিছুই আমার সঞ্চয়ে নাই। এভাবে একাকীত্বের আনন্দ প্রবল ঘূর্ণির মতো ঘোরে। চারপাশের লোকেরা আমার বেঁচে থাকার সূত্র তৈরি করে। আমি অনায়াসে সে পথে হেঁটে যাই বুকের ভেতরে স্বাচ্ছন্দ্যের জ্যোৎস্না নিয়ে। এতক্ষণে আমি বেশ প্রফুল্ল হয়ে উঠি। ভাবি আমি কি তখন অন্য গ্রহের কেউ হয়ে যাই? প্রাণী অথবা মানব সন্তান? কিংবা নদী অথবা পাহাড়? নিজেকে বলি, আমি এখন প্লুটোর গ্রহের সেই পর্বত যেটা বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছে। নাসার মহাকাশযান নিউ হরাইজন প্লুটোর যে ছবিটি পাঠিয়েছিল, সেভানে এই পর্বতের সন্ধান পাওয়া গেছে। বরফে ঢাকা পর্বত। পর্বতের উচ্চতার কথাও জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। তারা বলেছেন, পর্বতটি দশ কোটি বছর আগে গড়ে উঠেছিল। বেশ লাগছে ভাবতে যে আমি এখন সেই সময়। আমি মানুষ না, শুধুই সময়। আমি এক বিশাল সময়। ছুঁয়ে থাকি স্যাফো, প্লুটো – হয়ে যাই কোটি কোটি বছর আগের অন্য গ্রহের পর্বত। আমেরিকানরা ওই পর্বতের নাম রেখেছে তেনজিন নোরগে। তেনজিন নোরগে নেপালী। হিমালয়ে প্রথম এভারেস্টেট উঠেছিল এডমন্ড হিলারি। তেনজিং ছিল তার সঙ্গে হিমালয়ের চূড়ায় ওা আর একজন মানুষ। আমি মনে মনে ঠিক করি সুষমাকে বলব, আমাকে তেনজিং নোরগে ডাকতে।

 জুয়েল দরজাটা খুলে রেখেছে। বাতাস আসছে, সঙ্গে ধুলো। আমার চোখ কিচমিচ করে। আমার খুব অস্বস্তি হয়। সঙ্গে ভীষণ বিরক্ত বোধ করি, কিন্তু সংসারের একা মানুষ বলে ওদের সঙ্গে ঝামেলায় যাই না। চোখ জ্বলতে শুরু করলে মাথায় ঝাঁকুনি লাগে। আমি চশমা খুলে চোখ রগড়াই। খানিকটা স্বস্তি ফিরে আসে। বাথরুমের দরজার সামনে দাঁড়ালে দেখতে পাই আমার কাঁচের দেয়ালে বিজ্ঞানিদের পাঠানো প্লুটো গ্রহের ছবি। সেই ছবিতে ফুঠে আছে বরফ-ঢাকা পর্বত। এই মুহূর্তে আমার সামনে আর কিছু নেই। আমি হাঁ করে তাকিয়ে থাকি। প্রবল অন্যমনস্কতায় ডুবে থাকি আমি। একসময় আমার ঘোর কাটে। চশমা টেবিলের ওপর রেখে বাথরুমে গিয়ে চোখ ধুয়ে ফেলি। খোলা দরজা বন্ধ করার কথা ভাবতেই দেখি সুষমা এসে দাঁড়িয়েছে। দুই হাতে ব্যাগ। ও এভাবে ব্যাগ ভর্তি খাবার আনে আমার জন্য। আমার পছন্দের খাবার। আমি ওর দিকে তাকিয়ে হেসে বলি, আয়। ভালো আছিস?

 তোমার কথা ভাবলে আমার ভালোলাগা অন্যরকম হয়ে যায় ভাইয়া। আমাদের সাত ভাইবোনের মধ্যে তুমি আমার সবচেয়ে প্রিয়। সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি তোমার গান। তুমি যেভাবে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাও সেটা তোমার খুবই নিজস্ব ভাইয়া। অন্যদের ধারেকাছে যায় না।

 এবার থাম সুষমা। কি এনেছিস দেখা।

 প্রশংসা করলাম বলে লজ্জা পেলে? তোমার লাজুক ভাবটা আর গেলো না। ভাবির সঙ্গে তোমার কি করে যে প্রেম হয়েছিল আমি বুঝতে পারি না।

 থাম, থাম সুষমা। তুই এলেই বাড়ির পরিবেশটা প্রাণ পায়। তুই কথা না বললেও সেটা হয়।

 সুষমা হাসিতে ভেঙে পড়ে বলে, আমাকে তুমি একটি নতুন নামে ডাকলে বলো। নিজের জন্য কোনো নাম ঠিক করেছ কি? তোমার সঙ্গে এটা আমার মজার খেলা। কোনো নাম ঠিক করে থাকলে বলো।

 কয়েকদিন তুই আমাকে তেনজিং নোরগে ডাকবি।

 তেনজিংতো হিমালয়ের চুড়োয় ওঠা প্রথম নেপালি।

 হ্যাঁ তাই। নাসার বিজ্ঞানীরা প্লুটো গ্রহে যে পর্বত দেখতে পেয়েছে তার নাম রেখেছে তেনজিং নোরগে।

 খবরটা আমি পত্রিকায় পড়েছি তেনজিং দাদা।

 আমরা দুজনে হাসতে হাসতে সময় ভরে ফেলি।

 সুষমা ডাইনিং টেবিলের উপর ব্যাগ রেখে খাবারগুলো বের করে। যেগুলো লাঞ্চে খাব তা টেবিলে রেখে বাকিগুলো ফ্রিজে ঢুকিয়ে দেয়।

 ভাবি কেমন আছে ভাইয়া?

 তার আবার থাকা কি? যেমন থাকার তেমনই আছে। সকালে বিছানা বদলে দিয়েছি।

 এখনও তুমি ভাবিকে নদী ডাক?

 হ্যাঁ, ডাকি। নদীর নাম ধরেই ডাকি। এই ডাকতো শুধু ভালোবাসার মানুষকে খোঁজা নয়, নিজেকেও খোঁজা। দেখিস না তোকে বলি আমার পছন্দের একটি শব্দে ডাকতে, কিংবা অন্য কোনো নামে। আগে ডালিয়াকে বলতাম। এখন তুই আমার কাছের মানুষ সুষমা।

 তুমি নিজেকে নিয়ে নতুন করে কাউকে ভাবো না কেন ভাইয়া? যেভাবে দিন কাটাও তা দেখে আমার খুব কষ্ট হয়। মানুষ কি এভাবে বেঁচে থাকতে পারে!

 আমি হাঁ করে ওকে দেখি। তাকিয়েই থাকি। ও প্রায়ই এমন কথা বলে। আমিতো জানি ডালিয়ার মুমূর্ষ শরীর সামনে রেখে এমন কথা কখনোই ভাববো না। তাহলে কি ওর নিশ্বাস বন্ধ হলে থামবো!

 তাকিয়ে আছ কেন ভাইয়া? কিছু ভাবছ?

 তুই এমন কথা প্রায়ই বলিস।

 তুমি আর কতকাল এবাবে থাকবে? পথ থেকে ডেকে আনা মানুষেরা তোমার ঘর দেখছে। তুমি নিজে দেখছ। আমি এলে আমার বুক ফেটে যায়।

 তুইতো জানিস অচেতন ডালিয়াকে আমি এখনও নদীর নামে ডাকি। যতদিন দম ফুরিয়ে না যাবে ততদিন ডাকতেই থাকব রে।

 জানি। তারপরও জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হয়। কেন হয় তা আমি জানি না। হয়তো তোমার কাছ থেকে শুনতে ভালোলাগে সেজন্য। আজকে ভাবি তোমার কাছে কোন নদী?

 বিপাশা। ভারতের মহারাষ্ট্রের এই নদীর ধারে দাঁড়িয়ে ছিলাম আমরা। আমরা পুনেতে নিয়েছিলাম রাজমোহন গান্ধী আয়োজিত একটি সম্মেলনে। সেখান থেকে অন্য জায়গায় যেতে হয়েছিল নদীর ধারের রাস্তা দিয়ে। চমৎকার দিন ছিল। নদী দেখে ডালিয়াতো মহাখুশি। বলল, আমি এই নদীর ধারে একটুক্ষণ দাঁড়াতে চাই। ওর অনুরোধে গাড়ি থামিয়েছিল ড্রাইভার। ডালিয়া নিজেই বলেছিল, আমি তোমার বিপাশা হতে চাই। কি যে চমৎকার নদী ছিল সেটি।

 সুষমা হাসতে হাসতে বলে, সেই থেকে ভাবি তোমার বিপাশা। বেশ। তোমার দিনগুলো খুব সুন্দর ছিল ভাইয়া। এখন আর এসব কথা শুনব না। তোমার কষ্ট বাড়বে।

 তোর সঙ্গে কথা বললে আমার কষ্ট হয় না। আমি এনজয় করি। তুই ডালিয়াকে অনেক ভালো বুঝিস।

 এসব কথা থাক ভাইয়া। আমি ভাবিকে স্যুপ খাইয়ে আসি। তুমি গোসল করে নাও। বুয়া আর জুয়েল বাজারগুলো গোছাচ্ছে দেখলাম।

 হ্যাঁ, আজ ওরা আমাকে বেশি সময় দিয়েছে। ওরাইতো আমার দিনগুলো ঠিকঠাক রাখছে। আর আমার ভালোলাগার খাওয়া-দাওয়া সামলাচ্ছিস তুই সুষমা।

 এ আর কতটুকু। পারলে আরও বেশি করতাম। সময় পাইনা। অফিসে মেলা ঝামেলা। প্রায় প্রতিদিনই অফিস থেকে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। মাঝে মাঝে ছুটির দিনেও যেতে হয়। আরেকটা কথা কি জানো ভাইয়া কাজের প্রতি মনোযোগী হলে অন্যরা সুযোগ নেয়। মনে করে অমুকেইতো আছে, আমার না থাকলেও চলে।

 প্রমোশন পেয়ে তোর কাজের দায়িত্বও বেড়েছে না রে?

 আমি, আরিফুর রহমান ছোট বোনটির দিকে গভীর স্নেহে তাকাই, যেন ওর শৈশব দেখতে পাচ্ছি যখন বোনটি কোনো কারনে কেঁদে বুক ভাসাতো, চোখমুখ জুড়ে গড়াতে থাকত অশ্রুজল আর হাঁ করে কান্নার ভঙ্গি চেহারাটাকে অন্যরকম করে ফেলত। তখন আমি বলতাম, তোকে পরির মতো লাগছে। নাকি পেত্নীর মতো? বলতো কোনটা তুই? ও হঠাৎ করে কান্না থামিয়ে হাঁ করে তাকিয়ে থাকত।

 সুষমা ভাইয়ের প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে থমকে যায় প্রথমে, ভাবে ভাই তার অন্যকিছু ভাবছে। হয়তো ওকে নিয়ে কিংবা আর কাউকে। তারপরও মিনমিনিয়ে বলে, হ্যাঁ, তাতো বেড়েছে। সুষমা মৃদু হাসে। ভীষণ মিষ্টি লাগে ওর হাসি। ভারী স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে ওকে। ওর দিকে আড়চোখে তাকিয়ে চোখ নামাই আমি। ওকে আর দেখতে চাই না। পঁয়তাল্লিশের মতো বয়স হয়েছে ওর। সিগ্ধতার রেশ মুখজুড়ে জ¦লজ¦ল করে এখনও। মবিনের চোখে ওর সৌন্দর্যের কোনোকিছুই ধরা পড়েনি। বিয়ের শুরুর দিনগুলো থেকে কতদিন তাদের আনন্দে কেটেছে সে কথাটিও স্বীকার করতে চায়না মবিন। সুষমার একমাত্র অপরাধ ওর কোনো সন্তান হবে না। ডাক্তারি পরীক্ষায় এটাই ধরা পড়েছে। দু’বছর আগে ওদের ডিভোর্স হয়ে গেছে। একদিন সুষমা আমাকে বলেছিল, আমার সঙ্গে মবিনের বিবাহিত জীবনের পুরো সময়টাই নাকি জিরো। ও কিছুই পায়নি। মানুষের এই মিথ্যাচারের কোনো সংজ্ঞা আছে ভাইয়া?

 সংজ্ঞা থাকা না থাকা আমার কাছে মূল্যহীন। যে ব্যক্তির সততা নেই তাকে মূল্যায়ন করতে চাই না রে বোন। ও নিজেই আমার কাছে জিরো মানুষ।

 আমার কাছে ও কোনোদিন জিরো হবে না। ওকে আমি ভালোবাসি ভাইয়া, এখনও বাসি। ও সন্তান পাওয়ার জন্য আর একটি বিয়ে করেছে তারপরও ভালোবাসি।

 সুষমা শাড়ির আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে বলে, আমার বেতনের টাকার একটা বড় অংশ ওর জন্য ব্যয় করেছি। ওর ফ্যামিলির দু’টো ছেলের পড়ার খরচ দিয়েছি। সংসারের খাবার খরচ এক মাস ও দিত, আর এক মাসে আমি। ও আমার সঙ্গে হিসেব করেই চলেছে। হিসেবের বাইরে ওর আবেগের জায়গা আমি কমই দেখেছি।

 এসবতো আমি জানি সুষমা। তুই আমাকে অনেক বার বলেছিস। তোর চোখের জল আর ঝরবেনা এমন একটি জায়গা নিজের জন্য বানাতে হবে তোকে সুষমা। দীর্ঘ জীবন পথের এখনও অনেক বাকী।

 আমি এতকিছু করার পরও আমাদের জীবনের আট বছর শূন্য হয়ে গেল কেন? সন্তানের জন্মই কি সব? জীবনের আর সবদিক শূন্য? এটা কোনো জীবন-দর্শন নয় ভাইয়া। শূন্যতাকে জয় করাই জীবন। এটা যারা বোঝেনা তাদের প্রতি করুণা করলেও নিজেকে বঞ্চিত করা হয়। আমি এখন সেই বঞ্চনার মহাসমুদ্র পাড়ি দিচ্ছি।

 আমি জানি তুই কূলে পৌঁছাবি। পৌঁছাতেই তোকে হবে সুষমা। আমি ওর মাথায় হাত রাখি।

 সুষমা আবার চোখে আঁচল চাপা দেয়। কান্নার মৃদু শব্দ আসে। আমার কাছে এলেই ও নিজেকে উজাড় করে। একটি কথা অনেকবার বলেছে, আজও বলছে। হয়তো আরও বলবে। বলেই নিজেকে উজাড় করবে। বুঝতে পারি একেই বলে দুঃখ ভাগ করে নেয়া। আমি ওর মাথায় হাত রেখে বলি, সুষমা থাম। তোকে এভাবে দেখতে চাই না। তুই মেধাবী মেয়ে। আমি চাই তোর জীবনে নতুন ফুল ফুটুক। জীবনকে উপভোগের সময় ফুরিয়ে যায়নি।

 ও চোখ মোছে। স্যুপের বাটি গুছিয়ে ডালিয়ার কাছে যায়। নেইলা বুয়া খানিকটুকু দূরে দাঁড়িয়ে সুষমাকে দেখে। আস্তে করে বলে, খালার দুঃখু মোর চাইতেও বেশি। আমার ভাত কম, খালার ভাত বেশি। আমার জরায়ুতে ফুল ফুটছে, খালার জরায়ুতে ফুল ফোডে নাই। হায় রে মাবুদ।

 ঠিক আছে, তুমি বাড়ি যাও বুয়া। তোমার কথা শুনলে ও দুঃখ পাবে। আমি চাইনা যে ও অনবরত দুঃখ পাক।

 আপনে মোরে তাড়ান ক্যান খালু? আর একজনের দুঃখু দেইখলে মোর মন পোড়ে। আমিওতো পরের দুঃখ বুঝি খালু। প্যাডে ভাত নাইতো কি হইছে, মনে তো বল আছে।

 সুষমার দুঃখ তুমি বুঝবে না।

 ক্যান, বুঝুম না, বুঝিতো। তার পোলাপান নাই। আমারতো পোলাপান আছে।

 তুমি অনেক ভাগ্যবতী। অনেক সাহসী। তোমাদের জন্যইতো আমরাও বেঁচে আছি নেইলা বুয়া।

 হ, তাইতো। মোর ভাইগ্যতো অনেক ভালা। আমি ক্যান ভাইগ্য খুঁজমু। মোর কপালে ভাইগ্য জমা আছে। ওহ, আল্লাহরে, বাড়ি যাই। চাইল-ডাইল কিনা বাড়ি গিয়া আইজ খিচুড়ি রাঁধুম। আল্লাহ, মোরে হাজার বছর আয়ু দিব। ওই জুয়েল, তুই যাবি?

 আপনি যান, আমি পরে যাব। আমার কাম আছে। স্যারের পড়ার ঘরটা গোছায়ে দিব।

 আইচ্ছা থাক তুই। মোগ কপাল ভালা যে স্যারের মতো মানুষ পাইছিলাম।

 বেরিয়ে যায় নেইলা বুয়া। আজ ওর মন ভালো নেই। বেরিয়ে যাওয়ার সময় দরজাটা বন্ধ করে না। ওর হাঁটার মধ্যে অন্যমনস্ক ভঙ্গি। জুয়েল দরজা লাগাতে গিয়ে খেয়াল করে নেইলা বুয়া এক পা এক পা করে সিঁড়ি দিয়ে নামছে। একটু পরে কান্নার শব্দ শুনতে পায়। বুঝতে পারে না যে তার কি হয়েছে, ও মাথা না ঘামিয়ে শব্দ না করে দরজা বন্ধ করে দেয়। তারপর রান্নাঘরে ঢোকে।

 আমি ড্রইংরুমে বসে জুয়েলকে খেয়াল করি। আমি জানি আজ ওর একটি বিশেষ দিন। সুষমাকে দেখলে জুয়েল সেদিন বাসা থেকে নড়ে না। সুষমার আনা খাবারের জন্য বসে থাকে। আমি ওকে এই প্রশ্রয় দিয়ে থাকি। একটু ভালো খাবারের জন্য ওর বসে থাকা আমাকে নাড়িয়ে দেয়। যে ছেলেটির কাছে নিজের ধর্মের পরিচয় নেই তার কি নিজের পরিচয় খুঁজে ফেরা কোনোদিন ফুরোয়? নাকি ও এসবের ধার ধারে না? ও কেন বেঁচে থাকার অর্থ খুঁজবে, বেঁচে থাকা যার কাছে নিরন্তর লড়াই। তার কি নিজেকে খোঁজার সময় আছে? ওকে কেন আমি ঠিকমতো মূল্যায়ন করছি না? ওর নিজের চিন্তার ভুবন আছে, সেখানে ওর খেলাঘর আছে। খুনসুটির সুযোগ আছে। ও এক প্রাণবন্ত তরুণ। ওকে আমার বুঝতে হবে। আমি ওর অনেক কিছুই জানি না। কতটা জানলে একজন মানুষকে বোঝ হয় সে পরিমাপ আমার নেই। যেটুকু জানি তা দিয়ে ওর তল ছোঁয়ার সাধ্য আমার নেই। ওকে আমি আক্ষেপ করতে দেখি না। জীবনের বাজী ধরার লড়াইয়ে ও এগিয়ে আছে। আমি শুধু এটুকু বুঝি যে কোনো বাজী ধরে ও হারে নি। রাস্তার ধারে বসে যে ছেলে ছেঁড়া জুতো সেলাই করে তাকে আমি মমতার একটি জায়গা দিতে পারি। দেয়া উচিত বলে মনেও করি। আমি তো এটুকুই ওর জন্য করেছি। এর বেশি কিছু নয়। ও কাজ করে মাসিক বেতন পায়। ধার চাইলে দেই, ও শোধ করে দেয়। কখনো বলে না স্যার টাকাটা ফেরত না দিলে কি হয়? বাবার অসুখ, অনেক খরচ হয়েছে স্যার কামাই করতে পারিনি। রাস্তার পাশে না বসলে তো রোজগার হয় না। না ও কোনো অজুহাত দেখায় না। এই মুহূর্তে ওর দিকে তাকিয়ে আমি বিব্রত বোধ করি। নিজেকে সংশোধন করার কথা চিন্তা করি। তখন ও কাছে এসে দাঁড়ায়। আস্তে করে ডাকে, স্যার।

 কি রে কিছু বলবি? আমি পূর্ণ দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকাই। আমি তো জানি ও একটি হ্যান্ডসাম ছেলে। ওকে নতুন করে দেখার কিছু নাই। ওর বিকাশ সম্পূর্ণ হয়েছে।

 ও ইতস্তত করে বলে, রাস্তার ধারে আমি যখন পড়েছিলাম তখন খালামণি কেন আমাকে কুড়িয়ে পায়নি? আমি কি খালামণির বাচ্চার শখ মেটাতে পারতাম না? নাকি খালু আমাকে মানতো না। বলতো রাস্তার ছেলের মধ্যে আমি নিজের সন্তানের ছায়া দেখি না। একটুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বলে, আমি কি খালামনির ছেলে হতে পারতাম না স্যার?

 পারতি। খুব পারতি। আমি উত্তেজিত স্বরে বলি। বাঁকা করে রাখা শরীর সোজা করি। ওর দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলি, আয় আমার হাত ধর। ও সামনে এগিয়ে আসে না। যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। আমি থমকে থাকি। মনে হয় সুষমাকে বলি, সুষমা তুই জুয়েলকে নিয়ে বাড়ি যা। কিন্তু আমি জানি তা হবে না। জুয়েল যে পরিবারে আছে সেটাই ওর আপন পরিবার। ওখান থেকে ও কোনোদিনই বেরিয়ে আসবে না।

 ও আবার ডাকে, স্যার। আপনি কি আমার কথা শুনতে পেয়েছেন?

 আমি ওর দিকে তাকালে বলে, স্যার খালামণি কি বেলিকে বাড়িতে নিয়ে যাবে? ওর অনেক কষ্ট। সংসারের সব কথা ও আমাকে বলে। বলে, একদিন সংসার থেকে পালিয়ে রেললাইনের উপরে গিয়ে শুয়ে থাকবে। ট্রেনটা যখন কুউ-ঝিক-ঝিক করতে করতে চলে যাবে তখন ও চোখ বুঁজে কুউ-ঝিক-ঝিক গানের মতো গাইবে। মনে করবে ও পরির দেশে যাচ্ছে।

 আমি হাঁ করে ওর দিকে তাকিয়ে থাকি। চেঁচিয়ে বলি, এসব কথা ও বলতে শিখেছে? ওতো এখনো এসব ভাবনার জন্য বড় হয়নি জুয়েল।

 আপনি কি বলছেন স্যার, ও অনেক বড় হয়েছে। পাক্কু বুড়ি হয়েছে। অনেক কিছু শিখেছে। শিখবে না কেন স্যার? রাস্তাঘাটে থাকলে এসব কিছু তাড়াতাড়ি শেখা হয়ে যায়। এসব শিখতে একদিনও সময় লাগে না স্যার।

 তুইও কি এসব কথা শিখেছিস জুয়েল?

 আমিতো কবেই শিখেছি স্যার। বেলিরতো বাবা-মা আছে। আমিতো বেজম্মা। আমার শিখাতো ওর আগেই হবে। আমিতো ওর চেয়ে অনেক বড়।

 খবরদার নিজেকে বেজম্মা বলবি না। তোর মুখে এমন কথা আমি একদম শুনতে চাই না। জানিস না আমি তোকে কত ভালোবাসি। তাছাড়া তোর পালক বাবা-মা আছে না?

 আছে। জুয়েল অন্যদিকে মুখ ফেরায়। ওর চোখ ছলছল করে।

 ওরা তোকে সন্তানের মতো আদর দিয়েছে না?

 তাদের আদর-যত্ন পেয়েছি বলেইতো আমি জুয়েল হয়েছি। তারা আমার উপর কিছু চাপিয়ে দেয়নি। তাদের ধর্ম পর্যন্ত না। বলেনি, তুই আমার ধর্ম নিয়ে বড় হবি। কিংবা না বললেও পারত যে তুই আমার ধর্মের সন্তান না। আমার সঙ্গে সত্যি কথা বলেছে। সত্য বলেই আমাকে মানুষ করেছে। নইলে আমি অমানুষ হতাম। একটা সন্ত্রাসীতো হয়েই যেতাম।

 ওর কথা শুনে আমার মাথা এলোমেলো হয়ে যায়। আমি ওকে বুকে জড়িয়ে ধরি। ওর চোখের পানি মুছিয়ে দেই। নিজেরও চোখ মুছি। বলি, তোর জন্য আমার দরজা সবসময় খোলা থাকবে রে। মনে করবি এটাও তার বড় ঠাঁই।

 ও আমার কাছ থেকে সরে দাঁড়িয়ে বলে, আপনিও আমার বাবা। আপনি আমাকে ভালোবাসেন। আপনি আমাকে কাজের দরকারে ঘরে ডেকে এনেছেন। তা না হলে এমন ঘরের যত্ন আমার দেখা হতো না। আমার ভাগ্য খুবই ভালো স্যার। আমার মনে কোনো দুঃখ নাই। যেটুকু দুঃখ আছে তাও চলে যায় যখন খালামণিকে কাঁদতে দেখি। আমিতো জানি খালামণি যখন আপনার জন্য খাবার আনেন, তখন আমার জন্যও আনেন। আমি না থাকলে আপনি আমার জন্য ফ্রিজে রেখে দেন। খালামণি কান্না কবে শেষ হবে স্যার? খালামণির কান্না দেখলে আমার বুক ভেঙে যায়। জুতো সেলাইয়ের কাজ না থাকলে তখন আমার কান্না পায়। আমি কাঁদি। দুই হাতে চোখের জল মুছি। ও আবার বলে, খালামনির কান্না কবে শেষ হবে স্যার?

 আমি ওর প্রশ্নের উত্তর দিতে পারি না। ও আমাকে কঠিন প্রশ্ন করেছে। সুষমা মা হতে পারবে না এটা যেমন সত্যি, তেমন সত্যি নয় যে ওর কান্না ফুরোবে না। ওর কান্না ফুরনোর চিন্তা ওকেই করতে হবে। আর কাউকে ভালোবেসে, তার থেকে ভালোবাসা পেয়ে, হাসি-আনন্দে জীবনের বাকি সময় ভরিয়ে নিজের কান্নার স্রোত ওকেই বন্ধ করতে হবে। আমার গভীর বিশ্বাস ও তা পারবে। তারপরও জুয়েলের প্রশ্নের জবাব আমি দেই না। চুপ করে থাকি। আমার বিরক্ত লাগে ভাবতে যে ও এখনও মবিনকে ভালোবাসার কথা বলে। এত ভালোবাসা নিয়ে ও নিঃস্ব হবে কীভাবে? দেখতে পাই ডালিয়ার নলের ভেতর স্যুপ দেয়া শেষ করে ও বেরিয়ে আসছে। জুয়েল দৌড়ে গিয়ে ওর পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে।

 কেমন আছিস রে জুয়েল? তোকে দেখলে প্রাণ জুড়িয়ে যায়। মনে হয় আগের জন্মে তুই একজন জাদুকর ছিলি।

 ও হাসতে হাসতে বলে, আমি খুব ভালো আছি খালামণি। স্যারের বাড়িটা আমার শান্তির জায়গা।

 ভাবি সচল থাকলে তুই আরও আদর পেতি। দেখতি তিনি তোর জন্য কি করতেন।

 কথাটা বোধ হয় ঠিক না খালামনি। জুয়েল চটপট বলে।

 না! সুষমা বিস্ময় প্রকাশ করে। কেন তোর এমন কথা মনে হলো?

 খালা আম্মা অসুস্থ হয়েছেন বলেইতো রাস্তার পাশে বসে জুতো সেলাই করা ছেলেটিকে বাড়িতে ডেকে এনেছেন স্যার। নইলে কি আনতেন? কোনোদিনই আনতেন না। কেউই আমাকে ঘরে ঢুকতে দিতেন না।

 জুয়েল! আমরা দু’ভাইবোন একসঙ্গে ওর নামটি উচ্চারণ করি। সুষমা বলে, তুই এমন করে বলতে পারলি?

 কথাতো সত্যি খালামণি। আমার জন্মের সত্যি যখন বুঝতে শিখেছি তখন থেকে অমি সত্যি বলতে শিখেছি। সত্যি বললে কেউ যদি দুঃখ পায়তো পাবে। যা সত্যি তা আমি বলেই যাব। কেউ দুঃখ পাবে সেজন্য আমি সত্য বলা বন্ধ করব তা হবে না। আমাকে মেরেকেটে ফেললেও হবে না।

 আকস্মিকভাবে আমি ওর দিকে তাকিয়ে বিমূঢ় হয়ে থাকি। ওকে আমার গুন্টার গ্রাসের মতো লাগছে। জার্মান লেখক, নোবেল প্রাইজ পেয়েছেন, শেষ বয়সে লিখেছেন একটি অসাধারণ কবিতা। তার শিরোনাম ‘যে কথা বলতেই হবে।’ বিশ্ব জুড়ে তোলপাড় তুলেছে এই কবিতা। আমার মনে হয়েছে গুন্টার গ্রাসের যত কবিতা পড়েছি তার থেকে এই কবিতা ভিন্ন। এই মুহূর্তে আমাদের দু’জনের সামনে দাঁড়িয়ে সদ্য কৈশোর পেরোন এক যুবক তেমন কন্ঠেই সত্যের উচ্চারণ করছে। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছিলাম এমন করে কোনো কথা ক্লাশে বলেছিলাম কিনা তা আমাকে ভাবতে হবে। ও ফাইভ পর্যন্ত পড়া একটি ছেলে কীভাবে নিজের অবস্থান বুঝে নিয়েছে তা আমার কাছে বিস্ময়। মনে হচ্ছে এই জুয়েলকে আমি চিনি না। ও এই মুহূর্তে এক অপরিচিত ছেলে, যার যৌবনের শুরুটা ভিন্ন রকমের, তাকে সহজে চেনা কঠিন। আমাকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকতে দেখে ও মুখটা অন্যদিকে ফেরায় দৃঢ় ভঙ্গিটা অক্ষুন্ন রেখে।

 সুষমা ওর ঘাড়ে হাত রেখে বলে, তোর খিদে পেয়েছে জুয়েল?

 হ্যাঁ, অনেক খিদে পেয়েছে। সকালে তেমন কিছু খাইনি। মায়ের শরীর খারাপ বিছানা থেকে উঠতেই পারেনি।

 যা তোর প্লেটটি নিয়ে আয়। আমি তোকে খাবার দেব। যেসব খাবার এনেছি তা তোর পছন্দ হবে।

 আপনার আনা খাবারের জন্য আমার জিভ থেকে জল ঝরে খালামনি। যেদিন আপনার খাবার খাই সেদিন সময় খুব ভালো যায়। মনে হয় দিন বুঝি আজ ফুরোবে না।

আয় খেতে আয়। তোর পছন্দের খাবার এনেছি।

 স্যার খেয়ে নিক। তারপর আমি খাব।

 স্যারের কথা তোর ভাবতে হবে না। তুই তোর মতো খাবি। আমি তোকে ডাকছি। এখন তোকে আমার কথা শুনতে হবে। তোকে আবার কাজে যেতে হবে তো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *