হনন

হনন

এক

মাঘ মাসের মাঝামাঝি সময়ে হাড় কাঁপানো শীত পড়ার কথা। অথচ শীতের পরিবর্তে ঝোড়ো হাওয়ার তাণ্ডবে জগৎ অস্থির। সেই দমকা বাতাসেও কনকনে মিহি হিমের আমেজটুকু নেই, আছে অদ্ভুত এক ধরনের খেপাটে ভাব।

দিগ্‌ভ্রান্ত বাতাসেরা হাতে হাত রেখে চলতে-চলতে আচমকাই গোত্তা মেরে নেমে আসে চকের উপর। নরম-নরম ধানগাছগুলোকে ঠেসে ধরে মাটির সঙ্গে। কীসের চাপা আক্রোশে, কে জানে! তারপর আচমকাই হয়তো ওদেরকে মুক্তি দিয়ে ঘুরে যায় অন্য কোন দিকে।

ক্ষণে-ক্ষণেই এখানে-ওখানে জেগে ওঠে ধুলোর ঘূর্ণি।

পাগলা হাওয়ার তোড়ে পত-পত করে উড়তে থাকে কাকতাড়ুয়ার শরীরে পরানো বাহারী রঙের পুরনো জামা-কাপড়। মাঝে-মধ্যে হেঁচকা টানে সেগুলো খুলে আসে খড়ের পুতুলগুলোর শরীর ছেড়ে। তারপর কোথায় যে উড়ে গিয়ে পড়ে, তার হদিস কেউ পায় না।

কাঁচা রাস্তার ধারে একটা শতবর্ষী বটগাছ। তার হোঁৎকা মোটা গুঁড়ির আড়ালে দাঁড়ানো লতিফ মিয়া অনেকটা আপনমনেই বার কয়েক বিড় বিড় করে, ‘আউলা বাতাস! লক্ষণ ভালা না। লক্ষণ ভালা না।’

আশৈশব সে শুনে এসেছে, শীতকালের আউলা বাতাস ভীষণ রকম অলক্ষুণে। গ্রামে দুঃখ-দুর্দশা ডেকে আনে। খোলা শরীরে আউলা বাতাস লাগলে সহজে রোগ-বালাই পিছু ছাড়ে না। মসজিদের ইমামকে দিয়ে শরীর বন্ধ না করা থাকলে, আউলা বাতাসে ঘোরাঘুরি করা কোন কাজের কথা না। অশুভ শক্তির নজর পড়ে যায়।

একবার তাদের নজর পড়লে, কৰ্ম্ম কাবার। কপালের জোর ছাড়া প্রাণ বাঁচানো দায় হয়ে পড়ে। অন্তত একটিবারের জন্য হলেও, যমে-মানুষে টানাটানি হবেই হবে।

ট্যাবু

এহেন ক্ষমতাধর আউলা বাতাসের সামনে পড়ে লতিফ মিয়া বিচলিত হবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সত্যিকার অর্থে এই মুহূর্তে আউলা বাতাস নিয়ে খুব একটা ভাবছে না সে, তার সমস্ত মনোযোগ এখন মরাখালের ঘাটের দিকে।

সুদূর অতীতে মরাখালের নাম ছিল নারণী নদী। বর্ষায় পূর্ণযৌবনা সেই নদীর তর্জন-গর্জনে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে উঠত দশগাঁয়ের মানুষজন।

ভাঙনের হাত থেকে বাঁচার জন্য মন্দিরে পুজো দিত, মানত করত আর সাঁঝ ঘনালেই মসজিদের বারান্দায় জ্বেলে দিত সুগন্ধি আগরবাতি। একবার নারণী খেপে উঠলে কেবল ফসল নিয়েই ক্ষান্ত হত না, গোটা কয়েক প্রাণও কেড়ে নিত অবলীলায়।

কালের আবর্তে সবার চোখের সামনেই নারণী নদী ধীরে-ধীরে মরে গেল। দু’ধার চেপে এসে খরস্রোতা নদীটাকে গিলে নিল পুরোপুরি। সিটি কর্পোরেশনের ড্রেনের আকৃতি নিয়ে টিকে রইল কেবল শীর্ণ একখানা জলের ধারা। অবশ্য টিকে রইল না বলে, টিকিয়ে রাখা হলো বলাটাই বেশি যুক্তিসঙ্গত।

কারণ বহুরকমের কায়দা-কানুন করে আশপাশের মানুষজনই খালটাকে বাঁচিয়ে রেখেছে আজতক। খেত-খামারে সেচের কাজে ব্যবহার করা হয় এর জল; সেজন্যই বাঁচিয়ে রাখা। নদী মরে গিয়ে এই খালের জন্ম, তাই লোকমুখে নারণী নদী রূপান্তরিত হয়েছে মরাখালে। গ্রামের প্রায় সব বাড়ির গা ঘেঁষে বয়ে যেতে হচ্ছে তাকে।

লোকেরা নিজেদের সুবিধামত এখানে-ওখানে ছোট-বড় ঘাট বানিয়েছে। ফসলের মৌসুমে ধান-পাট ধোয়ার কাজটা সেরে নেয়া যায়, আর বাড়ির বউ- ঝি’রা সারা বছর সেখানে থালা-বাসন মাজে, কাপড় কাচে। বাঁশের কঞ্চি আর কলাপাতা দিয়ে ঘিরে নিলে গোসলটাও দিব্যি সেরে নেয়া যায় মরাখালে।

এই মুহূর্তে তেমনই একটা ঘাটের দিকে অপলক তাকিয়ে আছে লতিফ মিয়া।

শাড়ি-পেটিকোট হাতে মাখনলালের নতুন বউটা খানিকক্ষণ আগে বলতে গেলে একেবারে লতিফ মিয়ার চোখের সামনে দিয়েই ওখানটায় গিয়ে ঢুকেছে। গাছের আড়ালে ঘাপটি মেরে থাকায় লতিফ মিয়াকে দেখতে পায়নি সে।

আপনমনে কী যেন ভাবছিল মেয়েটা, চারপাশে কী হচ্ছে না হচ্ছে সেদিকে খুব একটা নজর ছিল না।

যে আউলা বাতাসের ভয়ে থরহরিকম্প দশা ছিল লতিফ মিয়ার, সেটাই শেষতক তার কপাল খুলে দিল। ঘাটের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বেখেয়ালে হেঁচকা টানে তুলে নিয়ে গেল খানিকটা পাতার আচ্ছাদন। আর তাতেই ঘাটের ভিতরের দৃশ্যটা এক লহমায় একেবারে লতিফ মিয়ার চোখের সামনে চলে এল। যা দেখতে চেয়েছিল তার প্রায় সবই দেখতে পাচ্ছে সে এখন, ফকফকা পরিষ্কার।

মাখনলালের বউটা আদতে এখনও কিশোরী, অন্তত ভরাযৌবনা বলা যাবে না তাকে কিছুতেই। তবুও তার স্নানের দৃশ্যটা উত্তেজিত করে তুলল লতিফ মিয়াকে।

মাখনলালের ভাগ্যে ঈর্ষান্বিত হয়ে, গোটা কয়েক অশ্রাব্য গালি দিল তাকে লতিফ মিয়া। ভুলিয়ে-ভালিয়ে বাচ্চা একটা মেয়েকে বিয়ে করে এনেছে হারামজাদা। কেন রে, ধাড়ি মেয়েছেলের বুঝি অভাব পড়েছে দেশে?

মেয়েটা এই গ্রামের কেউ না, উজান অঞ্চল থেকে তাকে বিয়ে করে এনেছে মাখনলাল। এর-ওর মালামাল গঞ্জে পৌঁছে দিতে প্রায় প্রতি সপ্তাহেই উজানে যেতে হয় তাকে। এটাই ওর পেশা, একখানা ছোট ডিঙি নৌকাই তার একমাত্র সম্বল।

কিছুদিন আগে এমনই একটা সফর শেষে মেয়েটাকে সঙ্গে নিয়ে গ্রামে ফিরেছে সে। বাপ-মা মরা মেয়ে, তিনকুলে আপন বলতে তেমন কেউ নেই। তাই স্বল্প পরিচিত মাখনলালের কাছে মেয়েটাকে বিয়ে দিতে কোন আপত্তি করেনি তার দূর সম্পর্কের কাকা।

পাত্র নিতান্ত হতদরিদ্র জেনেও তার সিদ্ধান্ত ইতিবাচকই ছিল। ঘাড়ের উপর থেকে আপদ বিদেয় হচ্ছে, এতেই যারপরনাই খুশি ছিল সে; বাছ-বিচারের ধার ধারেনি। তার নিজেরও বিবাহযোগ্যা মেয়ে আছে, পরের মেয়ের জন্য রাজপুত্তুর খোঁজার সময় কোথায় তার?

কোনরকম পণ ছাড়া, বলতে গেলে এক কাপড়েই নতুন বউকে ঘরে তুলেছিল মাখনলাল। তবে পরদিনই গ্রামের হাট থেকে সাধ্যমত আলতা-চুড়ি কিনে দিয়েছিল সে বউকে, কোন কার্পণ্য করেনি। অল্প সময়েই মেয়েটাকে ভালবেসে ফেলেছে সে, আপন বলতে তারও তো কেউ নেই ত্রিভুবনে।

মাখনলাল বাড়ি আছে কিনা সে খবরটা জানতেই এদিকটায় এসেছে লতিফ মিয়া। মেয়েটাকে বেআব্রু দেখাটা তার বাড়তি পাওনা।

গাঁয়ের একেবারে শেষমাথায়, মরাখালের কোলঘেঁষে এক টুকরো খাস- জমিতে বসত গেড়েছে মাখনলাল। ত্রিসীমানায় অন্য কোন জনবসতি নেই’।

জমি কেনার মুরোদ নেই, তাই নিতান্ত বাধ্য হয়েই খাস জমিতে সংসার পাততে হয়েছে তাকে। যা আয় তার, তাতে দুটো প্রাণীতে খেয়ে-পরে বাঁচা যায় ঠিকই, তবে জমি কেনার কথা কল্পনাতেও আনা যায় না।

আরেক দফা দমকা হাওয়া গায়ে লাগতেই টনক নড়ল লতিফ মিয়ার। বহুকষ্টে ঘাটের উপর থেকে নজর সরিয়ে, ফিরতি পথ ধরল।

কখন যে এতটা সময় পেরিয়ে গেছে, টেরই পায়নি সে। দেরি করার জন্য নিশ্চিত আজ মতি চেয়ারম্যানের খিস্তি শুনতে হবে।

তবে দেরি করার কারণটা চেয়ারম্যান সাহেবকে বলা যাবে না কিছুতেই। নয়তো পিটিয়ে তার হাড়গোড় সব গুঁড়ো করে ফেলবে দজ্জাল চেয়ারম্যান।

মাখনলালের বউটার জন্য খানিকটা আফসোসই হলো লতিফ মিয়ার। মাগীর কী দরকার ছিল ভর সন্ধ্যায় চেয়ারম্যান বাড়িতে পানি আনতে যাওয়ার? এক বেলা পানি না খেলে মরে যায় নাকি মানুষ? ভেজা কাপড়ে চেয়ারম্যানের সামনে না গেলে পেটের ভাত হজম হচ্ছিল না?

ঘরের দাওয়ায় জলচৌকিতে বসে আয়েশ করে হুক্কা টানছিল তখন মতি সেই সঙ্গে চোখ দিয়ে চাটছিল মেয়েটার সারা শরীর। চেয়ারম্যানের এহেন দৃষ্টি লতিফ মিয়ার বহুকালের চেনা। তখনই সে বুঝে গিয়েছিল, সর্বনাশ হতে চলেছে মেয়েটার। একবার কারও উপর মতি চেয়ারম্যানের নজর পড়লে, তার আর নিস্তার নেই।

দ্রুত পা চালাল লতিফ মিয়া। বাড়ি নেই মাখনলাল, সদাই-পাতি নিয়ে গঞ্জে গেছে; খবরটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চেয়ারম্যান সাহেবের কাছে পৌছানো দরকার!

দুই

মাঝরাতের পরপরই সন্তর্পণে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়ল মতি চেয়ারম্যান। বলা বাহুল্য, ছায়াসঙ্গী হয়ে তার সঙ্গে সেঁটে রইল লতিফ মিয়া। নিজে চলনদার হয়ে চেয়ারম্যানকে পথ দেখিয়ে এগিয়ে নিয়ে চলেছে সে।

আকাশে ঝুলছে ক্লান্ত চাঁদ। তবে রাতজাগা পাখিরা ডেকে চলেছে বিরামহীন। খাবারের সন্ধানে এখানে-ওখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে দলছুট খেঁকশেয়ালেরা; আলোর পিদিম বয়ে নিয়ে ওদেরকে সঙ্গ দিচ্ছে জোনাকির ঝাঁক।

কাঁটাঝোপ এড়িয়ে মেঠোপথ ধরে দ্রুতলয়ে হেঁটে চলেছে দু’জন মানুষ। ইতোমধ্যে জলদি পা চালানোর জন্য বার দুয়েক লতিফ মিয়াকে তাগাদা দিয়ে ফেলেছে মতি। আজ বহুদিন পর শিকারে নেমেছে সে, কিছুতেই যেন তর সইছে না তার। প্রবল উত্তেজনায় কাঁপছে গোটা শরীর, রক্তে যেন বান ডেকেছে। আদিম নেশাটা ঝালিয়ে নেয়ার সুযোগ কদাচিৎই মেলে; পুরোটা সময় রসিয়ে রসিয়ে উপভোগ করতে চায় সে।

বাঁশের বেড়ার দেয়াল, উপরে ছনের ছাউনি; ঘর বানানোর জন্য এর চেয়ে বেশি কিছু জোগাড় করার সামর্থ্য হয়নি মাখনলালের। একখানা চেলাকাঠ আড়াআড়ি করে গুঁজে দিয়ে ঘরের একমাত্র দরজাটা বন্ধ রাখা হয়।

চোর-ডাকাতের ভয় নেই, কেবল শেয়াল-কুকুরকে ঘরে ঢোকা থেকে বিরত রাখাটাকেই দরজাটার একমাত্র উদ্দেশ্য হিসেবে ধরা হয়।

লতিফ মিয়ার কাঁধের জোরাল এক ধাক্কায় পাটকাঠির মত মট করে ভেঙে গেল চেলাকাঠটা; পরক্ষণেই হাঁ করে খুলে গেল দরজাটা।

বিদ্যুৎ খেলে গেল মতি চেয়ারম্যানের দেহে, অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে ঘরের ভিতর সেঁধিয়ে গেল সে। উইয়ের ঢিবির মত প্রকাণ্ড ভুঁড়িটাকে অনুসরণ করল তার বাকি শরীর।

চেয়ারম্যানকে ঘরের অন্ধকারে হারিয়ে যেতে দেখল লতিফ মিয়া, পরের কয়েকটা মুহূর্ত কান খাড়া করে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল সে। পরক্ষণেই কানে এল কাঙ্ক্ষিত গোঙানির শব্দটা; মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল তার। হাত বাড়িয়ে দরজাটা ভেজিয়ে দিল সে, আপাতত আর চাঁদের আলোর দরকার নেই চেয়ারম্যান সাহেবের।

না তাকিয়েও ভিতরে কী হচ্ছে দিব্যদৃষ্টিতে দেখতে পাচ্ছে লতিফ মিয়া বিশাল থালার মত হাতের তালু দিয়ে মেয়েটার মুখ চেপে ধরেছে মতি চেয়ারম্যান। নিজের জগদ্দল পাথরের মত শরীরটা চাপিয়ে দিয়েছে মেয়েটার শীর্ণ দেহের উপর। ছাড়া পাওয়ার জন্য আরও কিছুক্ষণ চেষ্টা চালিয়ে যাবে মেয়েটা, তবে অচিরেই ক্ষান্ত দিতে হবে তাকে। বুঝে যাবে, এই দানবের হাত থেকে নিস্তার পাওয়া রীতিমত অসম্ভব।

মাঝারী আকারের একটা কদম গাছের তলায় ঘন হয়ে জন্মে আছে কিছু দূর্বাঘাস। গাছের গুঁড়িতে পিঠ ঠেকিয়ে ওখানটাতেই বসে পড়ল লতিফ মিয়া। লুঙ্গির কোঁচা থেকে প্যাকেট বের করে একখানা বিড়ি ধরিয়ে আয়েশ করে ধোঁয়া ছাড়তে লাগল; প্রশান্তির রেশ ছড়িয়ে পড়েছে তার গোটা অবয়বে।

শেষ কবে আস্ত এক প্যাকেট বিড়ির মালিক ছিল, অনেক চেষ্টা করেও মনে করতে ব্যর্থ হলো সে। অবশ্য এ নিয়ে তাকে খুব একটা দোষারোপেরও সুযোগ নেই; কারণ আদতে কখনওই তার পুরো এক প্যাকেট বিড়ি কেনার সৌভাগ্য হয়নি অতীতে।

আজও হত না, যদি না খুশির আতিশয্যে প্যাকেটটা তাকে উপহার দিত মতি চেয়ারম্যান! নির্দিষ্ট কোন বেতন পায় না সে, কাজ করে পেটে-ভাতে। চেয়ারম্যান বাড়ির একটা ঘুপচি ঘরে রাত কাটায়, নিজের বলতে গোটা কয়েক পুরনো কাপড় ছাড়া তেমন কিছুই নেই তার।

জ্ঞান হবার পর থেকে মতিকেই ভগবান মেনে এসেছে সে, যে কোন আদেশ পালন করেছে নির্দ্বিধায়।

শৈশবে গঞ্জের রাস্তায় ওকে কুড়িয়ে পেয়েছিল চেয়ারম্যান। কান্নারত নিষ্পাপ একটি বালককে অসহায়ের মত এখানে-ওখানে ঘুরতে দেখে তুলে এনেছিল নিজের বাড়িতে। তখনও চেয়ারম্যান হয়নি মতি, তবে মাস্তান হিসেবে ততদিনে বেশ নাম কামিয়ে ফেলেছিল সে।

টুকটাক ফুট-ফরমায়েশ খাটা, বিনিময়ে অন্ন-বস্ত্রের নিশ্চয়তা, কারও জন্যই হিসেবটা খুব একটা কঠিন ছিল না।

ধীরে-ধীরে লতিফ মিয়ার কাজের পরিধি বাড়তে থাকল, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকল পাপ! সেদিনের সেই ছোট্ট লতিফ মিয়া কালক্রমে হয়ে উঠল, মতি চেয়ারম্যানের ডানহাত, ভাল-মন্দ সমস্ত কাজের দোসর।

লতিফ মিয়া মনে করতে পারে না কে তার বাবা-মা, কী তার বংশ পরিচয়। তবে এ নিয়ে কোন যাতনা অনুভব করে না সে। মতি চেয়ারম্যানকে অভিভাবক হিসেবে পাওয়াটা রীতিমত ভাগ্যের ব্যাপার। গ্রামের অনেকেই এটা নিয়ে ঈর্ষা করে তাকে। যদি কোনদিন লতিফ মিয়ার কিছু হয়ে যায়, জায়গাটা নেয়ার জন্য আগ্রহী প্রার্থীর অভাব হবে না চেয়ারম্যানের।

পায়ের শব্দে মুখ তুলে তাকাল লতিফ মিয়া। চট করে দূরে ছুঁড়ে ফেলল আধপোড়া চতুর্থ বিড়িটা। বেরিয়ে এসেছে মতি। ঘর্মাক্ত, পরিশ্রান্ত; তবে চেহারায় ফুটে আছে প্রচ্ছন্ন পরিতৃপ্তির ছাপ।

‘হারামজাদী মইরা গেছে রে, লতিপ্পা।’

কয়েক মুহূর্ত মূক পশুর মত ঠায় দাঁড়িয়ে রইল লতিফ মিয়া। মাথা কাজ করছে না তার। এইমাত্র যা শুনেছে, ঠিক শুনেছে তো? সত্যিই কি মরে গেছে মেয়েটা?

‘গরিবের মাইয়া এমুন কমজোরি হইব, কেডা জানত! পুরা মজাড়াই মাডি কইরা দিল খানকি।’

‘অহন…? অহন কী করুম, চেরম্যান সাব?’ কোনমতে বলল লতিফ মিয়া। এখনও বিহ্বলতা কাটেনি তার।

‘হেইডাই ভাবতাসি। খাড়া। একটু ভাববার দে,’ পুরোপুরি নিষ্কম্প শোনাল মতির কণ্ঠ। কারণে-অকারণে এযাবৎকালে বহু মানুষ মেরেছে সে; মৃত্যু তার কাছে বিশেষ কোন গুরুত্ব বহন করে না। কেবলমাত্র নিজের জীবনই মূল্যবান তার কাছে, অন্যদের ব্যাপারে থোড়াই কেয়ার করে সে। পরম নির্ভরতায় তার দিকে তাকিয়ে রইল লতিফ মিয়া। তার জানা আছে, একটা না একটা বুদ্ধি ঠিকই বের করে ফেলবে মতি চেয়ারম্যান। বুদ্ধিতে তার ধারেকাছে ঘেঁষতে পারে, গোটা চৌহদ্দিতে এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। সাধে তো আর পর-পর চারবার চেয়ারম্যান হয়নি লোকটা!

আচমকা তার দিকে ফিরে তাকাল মতি, জ্বলজ্বল করছে দু’চোখের তারা। ‘লাশটা মরাখালে ফালাইয়া দিলে কেমুন হয়? ভাইস্যা চইল্যা যাইব অন্য গেরামে। কেডায় চিনব? বেবাকতে তো আর দেহে নাই মাখইন্যার নয়া বউরে। কী কস?’

প্রভুভক্ত কুকুরের মত মাথা দোলায় লতিফ মিয়া। ‘ভালা বুদ্ধি, চেরম্যান সাব। জব্বর বুদ্ধি।’ কথা না বাড়িয়ে তড়িঘড়ি কাজে নেমে পড়ে সে। চেয়ারম্যানের সাহায্য ছাড়াই রোগা-পাতলা মেয়েটাকে পাঁজাকোলা করে বের করে আনে ঘরের বাইরে। তারপর দ্রুত এগিয়ে যায় মরাখালের দিকে।

.

রাত পোহাবার খুব বেশি বাকি নেই আর। তাই ভিতর-বাড়িতে না গিয়ে কাছারি ঘরেই কাঁথামুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ে মতি।

বহুদিন বাদে সে রাতে খুব ভাল ঘুম হয় তার। কাছারি ঘরের শক্ত বিছানা আর পাতলা কাঁথার ওমটাকেই তার কাছে স্বর্গীয় মনে হয়, ছাড়া ছাড়া স্বপ্নও দেখে সে।

তবে নিজের ঘরে রাতের বাকি সময়টা নির্ঘুমই কাটে লতিফ মিয়ার। বিছানায় ক্রমাগত এপাশ-ওপাশ করে, দু’চোখের পাতা এক করতে ব্যর্থ হয় সে। তার কেবলই মনে হয়, কোথাও একটা ঘাপলা হয়ে গেছে!

খোলা জানালার গরাদের ফাঁকে চোখ রেখে ভোরের আলো ফোটার অপেক্ষায় থাকে সে।

তিন

সচরাচর সাতসকালেই লোকেদের আনাগোনা শুরু হয় চেয়ারম্যান বাড়িতে। নানা রকম তদবির, ছোট-বড় সালিশ; হাঙ্গামার কোন শেষ নেই।

আশপাশের দশ গাঁয়ের মাথা মতি চেয়ারম্যান, তার হুকুম ছাড়া গাছের একটা পাতাও নড়ার সাহস পায় না এই তল্লাটে। লোক মন্দ হলেও, নিতান্ত বাধ্য হয়েই তার কাছে আসতে হয় সবাইকে।

তবে আজকের ভিড়টা অন্যান্যদিনের চেয়ে আলাদা, কয়েকগুণ বড়। দেখে মনে হচ্ছে একজনও আর নিজেদের ঘরে বসে নেই, পুরো গ্রামের সব ক’জন ছেলে-বুড়ো এসে জমায়েত হয়েছে চেয়ারম্যান বাড়ির আঙিনায়!

ভিতর বারান্দায় শীতল পাটিতে বসে আয়েশ করে গরুর গোশত আর যবের রুটি চিবুচ্ছিল মতি চেয়ারম্যান, হন্তদন্ত হয়ে সেখানে গিয়ে হাজির হলো লতিফ মিয়া।

তার পাতিলের তলার মত কালো মুখটা দেখতেই মেজাজ খিঁচড়ে গেল মতির; দিনের শুরুতে কী দুঃসংবাদ নিয়ে হাজির হয়েছে হারামজাদা!

‘হইসেডা কিতা? সকাল-সকাল চেহারাডা কাউয়ার পুটকির মত কইরা রাখসস কিল্লাইগ্যা?’ খেঁকিয়ে উঠল চেয়ারম্যান।

ধমক খেয়ে লতিফ মিয়ার মুখের অন্ধকার বাড়ল বৈ কমল না। ইতস্তত করে বলল, ‘একটা লাশ পাওয়া গেছে, চেরম্যান সাব। মাখন মাঝির বউয়ের লাশ।’

‘কস কী!’ নিজের অজান্তেই চেঁচিয়ে উঠল মতি। হতভম্ব হয়ে লতিফ মিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে সে।

‘মাইনষে আফনের লগে কথা কইতে চায়। সবতে আইছে কাছারি ঘরের সামনে।’

নিজেকে ফিরে পেতে কয়েক মুহূর্ত সময় লাগল মতির। সদ্য মুখে দেয়া অচর্বিত গো’মাংস-রুটি কোঁৎ করে গিলে নিল সে। তারপর গ্লাসের পুরো পানিটুকু গলায় চালান করে দিয়ে সটান উঠে দাঁড়াল।

কাছেপিঠেই ছিল চেয়ারম্যানের বড় বউ রাহেলা। লতিফ মিয়ার কথাগুলো স্পষ্টই শুনতে পেয়েছে সে। পর্দার আড়াল থেকে জিজ্ঞেস করল, ‘ঘটনা কী, লতিফ মিয়া? ক্যামনে মরসে মাইয়াডা?’

চট করে একবার চেয়ারম্যানের দিকে তাকিয়েই চকিতে চোখ নামিয়ে নিল লতিফ মিয়া। নিচু গলায় বলল, ‘কইতে পারি না, আম্মা। লাশ পাওয়া গেসে মরাখালে। মীর্জা বাড়ির ঘাড়ে।’

দ্রুত পা চালিয়ে কাছারি ঘরের দিকে রওনা হলো মতি চেয়ারম্যান। বিনাবাক্যব্যয়ে তাকে অনুসরণ করল লতিফ মিয়া। আপাতত রাহেলার আর কোন প্রশ্নের উত্তর দিতে হচ্ছে না বলে যারপরনাই খুশি সে।

রাহেলাকে অজ্ঞাত কারণে ভীষণ ভয় পায় সে। অথচ আজ অবধি তার সঙ্গে কখনও উচ্চস্বরে কথা বলেনি রাহেলা, ধমক দেয়া তো পরের ব্যাপার।

লোকে বলে, চেয়ারম্যানের বড় বউ সাক্ষাৎ লক্ষ্মী। কেবল তার দিকে তাকিয়েই খোদা এখনও গজব ফেলেনি চেয়ারম্যানের উপর!

লতিফ মিয়া খেয়াল করে দেখেছে, রাহেলার সামনে চেয়ারম্যান সাহেবও কেমন যেন গুটিয়ে থাকে, হয়তো খানিকটা ভয়ও পায়। আর সেই ভয়টাই হয়তো স্থানান্তরিত হয়েছে লতিফ মিয়ার মনে। স্বয়ং গুরু যেখানে ভীত, শিষ্যর সেক্ষেত্রে কী-ই বা আর করার আছে!

.

কাছারি ঘরের সামনে বিশাল একটা জামগাছ আছে। দু’জন মানুষ মিলেও বেড় পাওয়া যায় না, এমনই গুঁড়ির গড়ন। অনেকদূর অবধি ছড়ানো-ছিটানো ডালপালার কারণে প্রখর রোদেও জায়গাটায় ছায়া পাওয়া যায়। সভা-সালিশের কাজগুলো সাধারণত এখানেই করে মতি চেয়ারম্যান।

তাকে হন্তদন্ত হয়ে মজলিশে ঢুকতে দেখে জমায়েতের মধ্যে স্থূল একটা পরিবর্তন হলো। নিমিষেই থেমে গেল সমস্ত কানাকানি-ফিসফাস, সবাই একযোগে তাকিয়ে রইল চেয়ারম্যানের দিকে।

বারান্দায় গদিআঁটা একখানা বেতের চেয়ার শোভা পাচ্ছে। ধীরেসুস্থে ওটায় আয়েশ করে বসল মতি। তারপর অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল অপেক্ষমাণ মুখগুলোর দিকে।

পুরো আঙিনা জুড়ে হোগলা বিছানো, তাতেই আসন পেতে বসেছে সবাই। অপেক্ষাকৃত বয়স্করা বসেছে সামনের সারিতে, চেয়ারম্যানের মুখোমুখি; এটাই নিয়ম।

‘ঘটনা কিতা? খুইল্যা কও দেহি,’ গম্ভীর’ কণ্ঠে বলল মতি। পুরোপুরি শান্ত দেখাচ্ছে তাকে। সামনের সারিতে বসা একজন বুড়োমতন লোক নড়েচড়ে বসল। মাথার চুলের বেশিরভাগই গত হয়েছে তার, যে কয় গাছি এখনও লড়াই করে টিকে আছে সেগুলোও ধবধবে সাদা। মুখের বলিরেখা গুণতে বসলে বেলা পড়ে যাবে, তবুও কাজটা শেষ হবে কিনা সন্দেহ আছে।

চরম উৎসাহে নিজের বয়ান দিতে শুরু করল লোকটা।

‘জগইন্য একখান ঘটনা হইসে, চেরম্যান সাব। মাখনলালের নয়া বউডার লাশ ভাইস্যা ওঠসে মরাখালে। মীর্জা বাড়ির ঘাড়ে ডোল কলমির দঙ্গলের লগে আটকাইয়া আছিল হেতির লাশটা। গতরে কোন কাফর নাই। এক্কেরে ল্যাংটা। শইলের জায়গায়-জায়গায় গর্ত হইয়া গেসে। কীয়ে খুবলাইয়া খাইয়া ফালাইসে কেডা জানে! মাখইন্যা তো নাও লইয়া চইলা গেছে গঞ্জে, হেতিরে কেডা মারসে খোদা মালুম! কেউই কিছু কইতে পারে না, চেরম্যান সাব।’

চেয়ারে নড়েচড়ে বসল মতি। বেশ অবাক হয়েছে সে। পরনে ব্লাউজ- পেটিকোট ছিল না সত্যি, কিন্তু শাড়িটা ভালমত শরীরে পেঁচিয়েই মেয়েটাকে মরাখালে ফেলা হয়েছে, উলঙ্গ ফেলা হয়নি। কাপড়টা খুলল কীভাবে?

তাছাড়া হিসেব মত লাশটা ভেসে যাওয়ার কথা খালিশপুরের দিকে; স্রোত ওদিকেই বইছিল। অথচ ওটাকে কিনা পাওয়া গেল সম্পূর্ণ উল্টোদিকে, মীর্জা বাড়ির ঘাটে!

এত তাড়াতাড়ি মেয়েটার মাংসই বা খেল কীসে? শিয়াল? ওরা কি পানিতে নেমেও লাশ খায় নাকি?

‘কী আজিব কারবার! পুরা আচানক হইয়া গেলাম। লাশটা অহন কই?’ চেহারায় গাম্ভীর্য ধরে রেখেছে মতি, গলার স্বরও কঠিন

‘মীর্জা বাড়ির উড়ানে রাইখ্যা আইছি। পুরান একটা কাফর দিয়া ঢাইক্যা দিসি। দুইন্নার বেড়িরা হেতিরে দেহনের লাইগ্যা মীর্জা বাড়িত জড় হইসে। হের লাইগ্যা জয়নাইল্যারে রাইখ্যা আইছি, ভিড় সামলাইব হেতে।’

‘কেডা পাইসে লাশটা? প্রথমে দেখসে কেডা?’

‘আই দেখসি, চেরম্যান সাব,’ কিন্নর কণ্ঠের জবাব এল জমায়েতের পিছন দিক থেকে। ধীরে-ধীরে ভিড় ঠেলে সামনে এগিয়ে এল এক কিশোর। খালি গা, পরনে আধছেঁড়া ময়লা একটা লুঙ্গি। নাক দিয়ে সিকনি ঝরছে, দেখলেই গা গুলিয়ে আসে। গলায় কালো সুতো দিয়ে বাঁধা মস্ত একখানা পিতলের তাবিজ।

‘খালের ধারে হাগতে গেসিলাম, চেরম্যান সাব। পরথমে বুইজতে পারি নাই জিনিসটা কিতা। ভাল কইরা দেহনের লাইগা কাছে আগাইয়া গেসিলাম। দেইখ্যা কিন্তুক বহুত ডরাইসি। গলা ফাডাইয়া এমুন এক চিক্কুর দিসি, হেই চিক্কুর হুইন্যা হগলে দৌড়াইয়া ঘাডে আইয়া পড়সে,’ দাঁত কেলিয়ে হাসতে-হাসতে কৃতকর্মের বর্ণনা দিল ছেলেটা।

নিজের বীরত্বে ভীষণ গর্বিত সে। হাড় জিরজিরে বুকের ছাতি আদতেই এখন আধ-ইঞ্চি ফুলে আছে তার।

বহুকষ্টে নিজের ক্রোধ দমন করল মতি। তার ইচ্ছে করছে, ছুটে গিয়ে ছেলেটার পাছায় কষে একখানা লাথি দিতে। এই হারামিটাই যত নষ্টের গোড়া। এক লাথিতে হারামজাদার হাগা-মুতা চিরকালের জন্য বন্ধ করে দিতে পারলে খানিকটা শান্তি পাওয়া যেত।

‘বুঝলাম,’ অবদমিত ক্রোধটাকে চট করে গিলে নিল চেয়ারম্যান। ‘অহন কী করবার চান আফনেরা?

‘আমরা আর কী কমু, চেরম্যান সাব। আফনে যা ভালা মনে করেন, হেইডাই করেন। আফনের উফরে কি আর কুনু কতা আছেনি? আফনেই তো গেরামের মা- বাপ,’ জটলার একপাশ থেকে বলে উঠল মজু বেপারী। চেয়ারম্যানের খয়ের খাঁ হিসেবে এলাকায় বেশ কুখ্যাতি আছে তার। নিন্দুকেরা বলে, চেয়ারম্যানের পৃষ্ঠপোষকতায় নানা রকম অবৈধ মালের ব্যবসা করে মজু বেপারী। একারণেই রাতারাতি আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে গেছে তার।

এক দশক আগেও অন্যের বাড়িতে কামলা খাটত মজুর বাবা, সপরিবারে বসবাস করত গ্রামের সবচেয়ে জীর্ণ বাড়িটায়।

আজ সেখানে টিনের ঘর উঠেছে, বারান্দায় বসে সকাল-সন্ধ্যা নিয়ম করে হুক্কা টানে মজুর বাবা।

‘হুম,’ শিরদাঁড়া সোজা করে বসল চেয়ারম্যান। ‘মাখইন্যা যেহেতু গেরামে নাই, আমাগোরেই বিষয়ডার একটা বিহিত করন লাগব। আমরাই তো হেতের গার্জিয়ান। আমরা ছাড়া তিনকুলে আর কেডা আছে হেতের? আমাগোর উফরে হেতের একটা দাবিও তো আছে। কি কন?’

‘হ, হ। ঠিক, ঠিক,’ অনেকেই সায় জানাল চেয়ারম্যানের কথায়।

‘হিন্দু মাইয়া। দাফন তো আর করন যাইত না। পোড়াইতে হইব। তাইলে ‘হেইডাই করি। একটা পুরুত ডাইকা সবকিছুর আয়োজন করি। টেকাটুকা যা লাগে, আমিই দিমু। হেইডা লইয়া আফনেরা মাথা ঘামাইয়েন না।’

মৃদু গুঞ্জন করে উঠল জনতা, স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল কেউ-কেউ। চাঁদা দিতে হচ্ছে না, এতেই খুশি সবাই। তাছাড়া ঝামেলাটাও জলদি মিটানো দরকার, ঝুলিয়ে রাখার সুযোগ নেই। এখানে উপস্থিত প্রায় সবাইকেই দিন-রাত মাথার ঘাম পায়ে ফেলে পরিবারের অন্ন-বস্ত্রের জোগান দিতে হয়। সারাদিন এখানে বসে থাকলে, দিনশেষে অভুক্ত থাকতে হবে ওদের।

‘মাইয়াডা মরল ক্যামনে, হেইডা সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত লাশ পোড়ানডা ঠিক হইব না, চেয়ারম্যান সাব,’ আচমকা জমায়েতের পিছন থেকে বলে উঠল করিম মাস্টার।

ইউনিয়নের একমাত্র প্রাইমারী স্কুলটা খালিশপুরে, ওখানেই ক্লাস ফাইভে বাংলা পড়ায় সে। বয়সে তরুণ; কথাবার্তা-চালচলনে যৌবনের তেজ ঠিকরে পড়ে।

করিম মাস্টারকে দু’চোখে দেখতে পারে না মতি। তার কাছে করিম মাস্টার মূর্তিমান উপদ্রব ছাড়া আর কিছু নয়। ব্যাটা অহেতুক সব জায়গায় বাগড়া দেয়; এটাই হারামিটার স্বভাব।

কিছুদিন আগে গ্রামে একটা হাইস্কুল খোলার জন্য জনমত তৈরির চেষ্টা করেছিল করিম। বাড়ি-বাড়ি গিয়ে জনে-জনে বুঝাচ্ছিল হাই স্কুলের উপকারিতা। শেষতক অবশ্য তার সমস্ত পরিশ্রমই জলে গেছে, ভেস্তে গেছে পুরো পরিকল্পনা। নেপথ্যে থেকে কলকাঠি নেড়ে সবকিছু বানচাল করে দিয়েছে মতি চেয়ারম্যান।

তবে মাস্টারকে একটা উচিত শিক্ষা দেয়ার সিদ্ধান্তটা থেকে নিজেকে সরিয়ে আনতে অনেক বেশি বেগ পেতে হয়েছে মতিকে। নিজেকে বুঝিয়েছে, মাথা গরম না করে উপযুক্ত সময়ের প্রতীক্ষায় থাকাই শ্রেয়। ঝোপ বুঝে কোপ মারলেই চলবে; মাস্টারকে সরিয়ে ফেলা তেমন কোন কঠিন কাজ না তার জন্য।

চোখ সরু করে করিমের দিকে খানিকক্ষণ অপলক তাকিয়ে রইল মতি। ‘ক্যামনে সুরাহা হইব? কেউ তো ঘটনা ঘটতে দেহে নাই, মাস্টর।’

‘পুলিসে জানান লাগব। হেরাই তদন্ত কইরা বাইর করব সব,’ দৃঢ় গলায় জবাব দিল করিম।

‘পুলিস! এর মইধ্যে আবার থানা-পুলিস করনের কাম কী? বেহুদা গেরামে পুলিস আইলে, গেরামের ইজ্জত থাহেনি, মিয়া?’ বিরক্ত কণ্ঠে বলল মতি। মনে- মনে আফসোস করছে, সময় থাকতে হারামজাদার কল্লা ফালাই দেওনের কাম আছিল। বেশি বাড় বাড়ছে খানকির পোলার।

‘বেহুদা ক্যামনে হয়, চেয়ারম্যান সাব? একটা মাইয়ারে জানে মাইরা ফালাইসে। ধর্ষণের ঘটনা ঘটে নাই, হেইডাই বা কই ক্যামনে! এর একটা ফয়সালা না কইরা লাশটা পোড়াইয়া ফালাইবেন?’

‘ধর্ষণ! খুন! এইগুলান কী কও তুমি! হেতি তো আত্মহত্যাও করবার পারে, নাকি?’

‘আত্মহত্যা করব কিল্লাই? আমরা তো জানি হেতি মাখইন্যার লগে সুখেই আছিল।’

‘তুমি হেইডা ক্যামনে কও, মাস্টর! বাইরে থাইকা দেইখা কি মাইনষের সংসারের ভিতরের খবর কওয়া যায়? সবাই তো কইবা আমার সংসারে সুখের শেষ নাই, সুখ বাইয়া-বাইয়া পড়তাসে ঘরের বেড়ার ফুটা দিয়া। আমি নিজেই না কেবল কইতে পারি কোন্ আগুনে পুড়তাসি।

‘মাখইন্যা সারা বছর থাহে বাইরে-বাইরে। কোন্হানে কুন আকাম-কুকাম কইরা বেড়ায়, কেডা হের খবর রাহে! এইগুলান লইয়াও তো হেতাগো মইধ্যে ঝামিলা হইবার পারে, নাকি?’

‘পারে। হেইডা বাইর করন পুলিসের কাম, আমাগো না।’

‘আফনে এত ফুলিস-ফুলিস করতাসেন ক্যান, মাস্টার সাব? হগলে মিল্যা তো একটা ফয়সালা কইরা ফালাইসে। অহন বেহুদা এইডা লইয়া গ্যাঞ্জামের কাম কী?’ চেঁচিয়ে বলে উঠল মবিন; ওরফে মবু চোরা।

আশপাশের সমস্ত গ্রামে সিঁধেল চোর হিসেবে বিশেষ খ্যাতি আছে তার। ছোটখাট চুরির দায়ে বেশ কয়েকবার জেলও খেটেছে। হাজতে ছিঁচকে চোরদের কী পরিমাণ দুরমুশ করা হয়, সে সম্পর্কে সম্যক ধারণা আছে তার।

স্বভাবতই পুলিসের উপর বছরের তিনশো পঁয়ষট্টি দিনই মহাখাপ্পা হয়ে থাকে সে। সবসময় ওদের কাছ থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকতে চায়। গ্রামে পুলিসের আগমন ওর জন্য সত্যিই সুখকর কিছু নয়।

‘তুই চুপ থাক, মবু,’ খেঁকিয়ে উঠল করিম মাস্টার। ‘চোরের মন পুলিস- পুলিস। তোরে তো আর ধরতে আইতাসে না অহন, তোর এত ডর কীয়ের? যার ডরানোর হেতেই ডরাইব, তুই জুত কইরা বইয়া থাক।’

জনতার সম্মিলিত দৃষ্টি নিজের উপর অনুধাবন করে আচমকা ভীষণ লজ্জা পেল মবু। আড়াল পাওয়ার আশায় জটলার ভিতর আরও খানিকটা সেঁধিয়ে গেল সে। মনে-মনে প্রতিজ্ঞা করল, সব ধরনের সালিশে এখন থেকে নিজের মুখটা বন্ধ করে রাখবে, একটা শব্দও উচ্চারণ করবে না। চোর হলেও তার তো একটা ইজ্জত আছে, নাকি?

‘তাইলে পুলিস না আনলে আর চলতাসে না। তাই না, মাস্টর?’ হালকা গলায় জিজ্ঞেস করল মতি চেয়ারম্যান। কেউ জানে না কী খেলা চলছে ধূর্ত লোকটার মাথায়।

‘হ, পুলিস আনতেই হইব,’ জবাব দিতে এক মুহূর্তও দেরি করল না করিম মাস্টার।

‘আইচ্ছা। তুমি যহন এমনে জিদ করতাস, আনুম পুলিস। কোন সমস্যা নাই,’ হাসিমুখে বলল মতি। ‘তোমরা তো হগলেই জান, থানার দারোগা সাবের লগে আমার কীরাম দহরম-মহরম। আমি দাওয়াত দিলে হেয় কোনদিন মানা করত না। অন্য সব কামকাজ ফালাই থুইয়া এক দৌড়ে এইহানে আইয়া পড়ব। তারে আনাডা কোন ব্যাফার না। আমার খালি একটাই চিন্তা, তুমি না আবার মামলাডায় ফাইস্যা যাও, মাস্টর!’

নিজের অজান্তে পায়ের ভার বদল করে দাঁড়াল করিম। অনিশ্চিত কণ্ঠে বলল, ‘আমি ফাঁসমু ক্যান! কী কন এগুলা, চেয়ারম্যান সাব?’

‘মানে, লাশটা কিন্তুক পাওয়া গেসে মীর্জা বাড়ির ঘাড়ে। আর মীর্জা বাড়িত তো অহন তুমি একলাই থাহ। নাকি মিছা কইলাম?

‘তুমি জোয়ান-মর্দ পোলা, কিন্তু অহনতরি বিয়া-শাদী কর নাই। এইদিকে আবার মাখইন্যার বউ মাসের বেশিরভাগ সময় হেতির জামাইরে কাছে পায় না। তোমাগো মইধ্যে একটু ইটিশ-পিটিশ তো হইতেই পারে, হাছা না?

‘ধইরা নিলাম এইগুলান কিছুই হয় নাই, হেরপরেও কিন্তুক কথা থাইক্যা যায়। ধর্ষণ-খুন, এইসব কথা যেহেতু তোমার মাথায় আইয়া পড়সে, দারোগা সাবের মাথাতেও নিচ্চই আইবে। উনি যদি ভাইবা নেন যে, মাইয়াডা রাইতের বেলা খাওয়ার পানি আনতে মীর্জা বাড়ির চাপকলে গেসিল, আর কায়দামত পাইয়া তুমি হেতির উফরে ঝাঁপাইয়া পইড়া…’ ইচ্ছে করেই কথাটা অসমাপ্ত রাখল ধুরন্ধর চেয়ারম্যান। চেহারা পুরোপুরি নির্লিপ্ত তার।

এদিকে পাণ্ডুবর্ণ হয়ে গেছে করিম মাস্টারের মুখ, একেবারে চুপসে গেছে সে। ঘটনার মোড় এভাবে ঘুরে যাবে, এটা সে কস্মিনকালেও কল্পনা করেনি।

মীর্জারা শহরে চলে গেছে অনেক দিন আগে; বলতে গেলে মীর্জা বাড়ি সারা বছর খালিই পড়ে থাকে। তাই ছোট মীর্জার কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে ঘাটের পাশের অতিথিশালায় বাচ্চাদের জন্য একটা অবৈতনিক স্কুল খুলেছে করিম মাস্টার। পড়ানোর সুবিধার্থে নিজের বাড়িতে না থেকে বেশিরভাগ সময় ওখানেই থাকে সে।

কোন সন্দেহ নেই, গ্রামের অন্তত অর্ধেক মানুষ ইতোমধ্যেই মতি চেয়ারম্যানের কথা বিশ্বাস করে বসে আছে। বাকি অর্ধেকও দ্বিতীয়বার নেড়েচেড়ে দেখছে যুক্তিগুলো। শতভাগ নিশ্চয়তা দিয়ে বলা যায়, এই মুহূর্তে জনমত পুরোপুরি করিম মাস্টারের বিপক্ষে

তাছাড়া থানার দারোগার সঙ্গে চেয়ারম্যানের সখ্যের কথা সর্বজনবিদিত। সত্যিই দারোগাকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা রাখে লোকটা। একবার যদি অপকৌশলে দারোগার মনে সন্দেহের বীজটা বপন করে দিতে পারে সে, তাহলেই কম্ম কাবার। আর কিছু করতে হবে না খচ্চর চেয়ারম্যানকে, বাকিটা দারোগা সাহেব নিজেই করবেন। আর ভাবতে চাইল না করিম মাস্টার, দু’চোখে সর্ষেফুল দেখছে সে।

বহুবছর ধরে তাকে ফাঁসানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে মতি, এবার বুঝি সুযোগটা পেয়েই গেল হারামিটা। অনেক ভেবেও ফাঁদটা থেকে মুক্তি পাওয়ার কোন পথ খুঁজে পেল না করিম। হাল ছেড়ে দিয়ে নিজের জায়গায় অনড় দাঁড়িয়ে রইল সে।

‘তাইলে কী কও, মাস্টর? ডাকমু পুলিস?’ ভ্রূ নাচিয়ে জিজ্ঞেস করল চেয়ারম্যান। পুরো ব্যাপারটায় ভীষণ আমোদ পাচ্ছে সে। করিমের নাজেহাল অবস্থাটা তারিয়ে-তারিয়ে উপভোগ করছে। দেখা যাক, বড়শিতে গাঁথা মাছটা আর কতটুকু আনন্দের জোগান দিতে পারে!

তবে জবাবটা মাস্টারের কাছ থেকে নয়, এল তার বাবা, রহিম হাজীর কাছ থেকে। পরিস্থিতি বুঝে নিতে বিন্দুমাত্র সময় লাগেনি ঘাগু বুড়োর। একজন ইউপি মেম্বার হিসেবে বহুবছর ধরে মতির সঙ্গে ওঠাবসা রহিম হাজীর। বদের হাড্ডি মতি কী-কী করতে পারে, এ ব্যাপারে অনেকের চেয়ে স্পষ্ট ধারণা আছে তার। তাই আচমকা পাথরের মূর্তি বনে যাওয়া ঘাড়তেড়া ছেলেকে বিপদ থেকে উদ্ধার করতে, তাকেই শেষতক মাঠে নামতে হলো।

‘কী যে কন, চেয়ারম্যান সাব! পুলিস ডাকনের দরকার কী! আফনে যা কইসেন, হেইডাই হইব। পুলাপান কত কথাই কইব, হেগো লগে তাল মিলাইয়া নাচলে চলব নাকি আমাগো? কী কও, মিয়ারা?

‘হ, হ। ঠিক, ঠিক। বেহুদা ঝামেলা বাড়ানের কাম নাই। আজাইরা জিনিস লইয়া পইড়া থাকলে পেট চলত না। হগলেরই কাজ-কর্ম করন লাগে,’ সমর্থন জোগাল সামনের সারিতে উপবিষ্ট একজন বয়স্ক মানুষ। অন্যরাও মাথা নেড়ে সায় জানাল।

‘তাইলে হেই কথাই রইল। লাশটা সৎকারের ব্যবস্থা নিতাসি আমি। আফনেরা যে যার কামে যান, এইডা লইয়া আর চিন্তার কিছু নাই।’

উঠে দাঁড়াল মতি। পা বাড়াল ভিতর-বাড়ির দিকে। মুখে ফুটে উঠেছে কুটিল হাসি। ঝামেলাটা এত সহজে মিটে যাবে, ভাবেনি সে। উপরি পাওনা হিসেবে পাকনা মাস্টারকেও কিছুটা শায়েস্তা করা গেছে। আশা করা যায়, কিছুদিন অন্তত চুপচাপ থাকবে হারামজাদা।

.

ভিড় কমতে-কমতে একসময় পুরোপুরি খালি হয়ে গেল জামতলাটা। তবে একজন বয়স্কমতন অচেনা মানুষ আরও বহুক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে রইল ওখানটায়।

লোকটার পরনে সফেদ আলখাল্লা, কাঁধ থেকে ঝুলছে একখানা বাহারী রঙের ঝোলা। ক্ষণে-ক্ষণেই খিক্-খিক্ করে হাসছে সে, এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে চেয়ারম্যান বাড়ির দিকে। মুখের হাসি তার চোখ দুটোকে ছুঁতে ব্যর্থ হয়েছে, ছাইচাপা আগুনের মতই ধিকিধিকি জ্বলছে ওগুলো!

চার

একখানা লণ্ঠন মৃদু আলো বিলাচ্ছে চেয়ারম্যান বাড়ির কাছারি ঘরে। দরজাটা খোলা থাকায় সে আলোর কিয়দংশ চৌকাঠ ডিঙিয়ে অবলীলায় চলে আসছে লাগোয়া বারান্দায়।

আলোর সীমারেখার খানিকটা বাইরে কাঠের একটা নড়বড়ে বেঞ্চিতে বসে আছে লতিফ মিয়া। দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে ঝিম মেরে বসে আছে সে, গায়ে একখানা পাতলা চাদর জড়ানো; ক্লান্ত। আজ সারাদিন ব্যাপক দৌড়ঝাঁপ করতে হয়েছে তাকে, দম ফেলারও ফুরসত মেলেনি। তাই এই ভর সন্ধ্যায়, সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়া আরামদায়ক আলস্যটুকু চুটিয়ে উপভোগ করছে সে। সকালটা কেটে গেছে মাখনলালের স্ত্রীর সৎকারে। পুরোহিত ডাকা, শ্মশানঘাট পরিষ্কার করা, আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র জোগাড়যন্ত্র করা; ঝক্কি তো নেহায়েত কম নয়। তাছাড়া উপরি হিসেবে অতি উৎসাহী জনতার ভিড় সামলানোর ধকলটা তো আছেই।

কাজটা শেষ করেই ছুটতে হয়েছে বাবুর্চি খুঁজতে, তারপর তাকে সঙ্গে নিয়ে মাড়াতে হয়েছে হাটের পথ; শিরনি রাঁধার প্রয়োজনীয় উপকরণ কেনার জন্য।

আচমকা মতি চেয়ারম্যানের মনে হয়েছে, বিশাল একখানা ফাঁড়া কেটেছে আজ। শোকরানা স্বরূপ পীরের দরগায় এক হাঁড়ি শিরনি না পাঠালেই নয়।

নীলগঞ্জের বড়পীরের মস্ত বড় ভক্ত সে, মুরিদ। যে কোন বিপদ-আপদে পীরের দরগায় ছুটে যায়, গুরুর আশীর্বাদ নিয়ে আসে। লোকজন যদিও আড়ালে- আবডালে মানুষটাকে ভণ্ড বলে, তবে মতির কাছে সে-ই এ জগতের সবচেয়ে কামেল পীর।

আগামী নির্বাচনের পর হুজুরের দরগায় গোটা তিনেক ষাঁড় দেয়ার কথা মানত করে রেখেছে সে মনে-মনে। বিষয়টা অবশ্য পুরোপুরি নিজের ভিতরেই গোপন রেখেছে, কাউকে বলেনি; এমনকী ছায়াসঙ্গী লতিফ মিয়াকেও না। প্রকাশ হয়ে গেলে সেই মানতের আর জোর থাকে না, আশৈশব এটাই শুনে এসেছে সে।

নীলগঞ্জ থেকে ফিরতে-ফিরতে বিকেল গড়িয়ে গেছে। অবেলায় গোসল করে কোনরকমে মুখে ক’টা ভাত গুঁজে, বারান্দায় এসে বসেছে লতিফ মিয়া। জ্বলন্ত বিড়ি হাতে চকের দিকে তাকিয়ে অলস সময় পার করতে ভীষণ আমোদ পায় সে। অধিক পরিশ্রমের কারণেই কি না কে জানে, বসে থাকতে-থাকতে খানিকটা ঝিমুনি এসে গেল তার। নিজের ছন্নছাড়া জীবনের কথা ভাবছে, আদৌ কি ভবিষ্যৎ বলে কিছু আছে?

বয়স চল্লিশের কোঠায়, কিন্তু এখনও বিয়ে-শাদী করা হয়নি। অন্তরে সংসার পাতার একটা গভীর টান অনুভব করে সে, কিন্তু মুখ ফুটে চেয়ারম্যান সাহেবকে কিছু বলার সাহস হয় না। তার জানা নেই, রাহেলা ইতোমধ্যেই বেশ কয়েকবার মতির কানে তার বিয়ের কথাটা তুলেছে। শুনেও কোন রা করেনি মতি।

বিয়ে করালে এখনকার মত সকাল-সন্ধ্যা খাটতে পারবে না লতিফ মিয়া, এটা তার ভালই জানা আছে। এমন আরেকজন যোগ্য লোক না পাওয়া পর্যন্ত লতিফ মিয়াকে বিয়ে করানো কি ঠিক হবে?

অদ্ভুত একটা বোটকা গন্ধে তন্দ্রা টুটে গেল লতিফ মিয়ার। চোখ খুলেই ভয়ানক চমকে উঠল সে।

বুড়োমতন একজন লোক একেবারে তার মুখের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। দাঁত কেলিয়ে হাসছে, মুখের কশ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে পানের পিক। লালচে দাঁতগুলো ভীষণ এলোমেলো, ফাঁক দিয়ে ভিতরের কালো গহ্বর নজরে আসে; রীতিমত গা গুলিয়ে ওঠে।

‘কেডা? কেডা আফনে?’ নিজের অজান্তেই গলার স্বর খানিকটা চড়ে গেল লতিফ মিয়ার। জবাব না দিয়ে, স্বাভাবিক ভঙ্গিমায় এগিয়ে এসে তার পাশে বেঞ্চিতে বসে পড়ল লোকটা। মুখে এখনও বিশ্রী হাসিটা ধরে রেখেছে।

বাধ্য হয়েই খানিকটা সরে বসল লতিফ মিয়া। ভয়ানক দুর্গন্ধে দম আটকে আসার জোগাড় হলো তার।

গন্ধটা আসছে কোত্থেকে! লোকটার গা থেকে? নাকি সঙ্গের ঝোলাটা থেকে? কয়দিন ধরে গোসল করে না, খোদা মালুম! পরনের আলখাল্লাটা কয়দিন ধরে গায়ে আছে তা-ই বা কে জানে!

‘কেমুন আছ, লতিপ মিয়া?’ মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করল লোকটা।

‘ভালাই। কিন্তু আফনে কেডা? চিনলাম না তো।’ হড়বড়িয়ে বলল লতিফ মিয়া। এখনও ধাতস্থ হতে পারেনি সে।

‘আমি কেডা, হেইডা গুরুত্বপুন্ন না। আমি কিতা কইতে আইসি হেইডা গুরুত্বপুন্ন।’

‘কী কইতে আইসেন? চেরম্যান সাবরে ডাকুম?’

‘নাহ, হেরে ডাইক্কা কাম নাই। বজ্জাতটারে দেখলেই শ‍ইলডা জ্বলে। ‘মুখ সামলাইয়া কথা কন, মুরুব্বী।’

‘ক্যান? হেয় কি ভালা মানুষ নাকি, লতিপ?’

চুপ করে রইল লতিফ মিয়া, জবাব দিল না প্রশ্নটার। মতি চেয়ারম্যান কেমন মানুষ, এটা তার চেয়ে ভাল আর কে-ই বা জানে?

‘কামডা ক্যান করলা, লতিপ?’ ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল লোকটা।

‘কোন্ কাম?’

‘মাইয়াডারে মারলা ক্যান?’

উত্তেজনার বশে এক লাফে উঠে দাঁড়াল লতিফ মিয়া। ‘কোন্ মাইয়া? আমি মারুম ক্যান! এইগুলান আফনে কী কইতাসেন! কেডা আফনে? কেডা?’

‘শান্ত হইয়া বও, লতিপ। এমনে চিল্লাইলে তো মাইনষে হোন্ব। বিপদ তো আরও বাইড়া যাইব তাইলে।’

চট করে বসে পড়ল লতিফ মিয়া। ঘন-ঘন শ্বাস নিচ্ছে সে, বুক ধড়ফড় করছে। কে এই লোক? কতটুকু জানে সে?

‘কার কথা কইতাসি, হেইডা তুমি ভালই জান, লতিপ। সাধু সাইজ্জা ফয়দা কী? মাখনলালের বউডারে মারলা ক্যান?’

‘আমি মারুম ক্যান? আমি কাউরে মারি নাই।’

‘মারসো, লতিপ, মারসো। তুমি আর মইত্যা হারামজাদা মিল্লা মারসো। মাইয়াডা বহুত ভালা আছিল, লতিপ।’

‘মিছা কথা। আমি মারি নাই। কেউ দেহে নাই কেডা মারসে হেতিরে। কোন সাক্ষী নাই।’

‘সাক্ষী আছে, লতিপ মিয়া, সাক্ষী ঠিকই আছে। তোমরা দেহ নাই, কিন্তুক তোমাগোরে হেতারা ঠিকই দেখসে।’

‘কোন্ বেডারা দেখসে? কেডা? নাম কিতা হেতারার?’

এখনও এক নাগাড়ে হাসছে লোকটা। হাসিটা এখন আগের চেয়েও বেশি বিরক্তিকর লাগছে লতিফ মিয়ার কাছে।

‘বেডা দেখসে, কহন কইলাম? সাক্ষীরা কেউ মানুষ না, লতিপ।’

আরও ঘাবড়ে গেল লতিফ মিয়া। কী বলছে এসব লোকটা! কোত্থেকে এসেছে এই পাগলা? কোন্ গ্রামের লোক?

‘মাইয়াডা হাছাই খুব লক্ষ্মী আছিল, লতিপ,’ আবারও বলল লোকটা। ‘টানাটানির সংসার, নিজেরই ভাত জোটে না দুই বেলা। হের মইধ্যেই আমারে একবেলা ভাত খাওয়াইসিল। নিজের ভাগেরটাই দিয়া দিসিল মনে হয়। ওই অল্প একটু খানাতেই আমাগো সবার পেট ভইরা গেসিল, লতিপ। সবই খোদার ইচ্ছা।’

‘সবাই কেডা? আর কেডা-কেডা আছিল আফনের লগে?’

‘তাগো লগে খুব জলদিই তোমাগো মোলাকাত হইব, মিয়া। চিন্তা লইয়ো না।’ খিক্-খিক্ করে হেসে উঠল লোকটা।

কী বলবে ভেবে না পেয়ে চুপ করে রইল লতিফ মিয়া। লোকটার কাছ থেকে আরও খানিকটা সরে বসল সে। ইতোমধ্যেই লোকটা তাকে আতঙ্কিত করে তুলেছে।

‘মানুষ বেঈমান হয়, নিমকহারাম হয়, কিন্তুক অন্য জন্তু-জানোয়ার কুনু সময় বেঈমানী করে না, লতিপ,’ কথা চালিয়ে গেল লোকটা। ‘মাইয়াডা জিন্দা থাকতেও বহুত জানোয়ারের খিদা মিটাইসে, মইরা লাশ হইয়াও কিছু জানোয়ারের খাওনের জোগান দিসে। অরা কিন্তুক ঠিকই হের প্রতিদান দিব, লতিপ। শোধ কইরা দিব বেবাক দেনা-ফাওনা।’

বলতে-বলতে নিজের ঝোলায় হাত বুলাল লোকটা, দৃষ্টিতে স্নেহ ঝরে পড়ছে। এই প্রথম লতিফ মিয়া খেয়াল করল, লোকটার ঝোলায় যা-ই থাকুক না কেন, ওগুলো জীবন্ত! তার চোখের সামনেই বার কয়েক নড়ে উঠল ঝোলাটা!

কী আছে ব্যাগটার ভিতরে? বিড়াল? কুকুর? নাকি মানুষের বাচ্চা?

তড়িৎ বেগে লাফিয়ে উঠল লতিফ মিয়া। ভীষণ ভয় পেয়েছে সে। কোথায় যেন শুনেছিল, প্রেত-সাধকেরা সাধনার জন্য মানুষের বাচ্চা বলি দেয়। সিদ্ধি লাভের জন্য কাজটা করতে হয় ওদের। এই লোকটা নিশ্চয়ই তাদেরই একজন, বাচ্চাটাকে বলি দিতে চলেছে শয়তানের উদ্দেশে। তবে লোকটার যে কিছুটা হলেও আধ্যাত্মিক ক্ষমতা আছে, এটা নিশ্চিত। না হয় মাখনলালের বউয়ের কথাটা জানতে পারত না সে।

তাই অযথা লোকটাকে ঘাঁটানোর ঝুঁকি নিতে চাইল না লতিফ মিয়া। কোনমতে বলল, ‘শিগির বিদায় হন এহান থাইকা। আফনে পোলাচুর। বেশি ঝামেলা করলে চেরম্যান সাবরে ডাইকা আইনা থানায় চালান কইরা দেমু কইলাম।’

তাকে অবাক করে দিয়ে সঙ্গে-সঙ্গে উঠে দাঁড়াল লোকটা। ঝোলাটা কাঁধে ঝুলিয়ে নেমে পড়ল বারান্দা ছেড়ে। এতটা সহজে এহেন উটকো ঝামেলা থেকে রেহাই পাবে, কল্পনাও করেনি লতিফ মিয়া। হতভম্ব হয়ে লোকটার গমন পথের দিকে তাকিয়ে রইল সে।

বিড়বিড় করতে-করতে কয়েক কদম এগিয়ে গেল লোকটা, তারপর ঘাড়ের উপর দিয়ে ফিরে তাকাল। হাসি মুছে গেছে তার, দু’চোখ থেকে ছিটকে পড়ছে ক্রোধ।

‘সাবধানে থাইকো, লতিপ মিয়া। আজকের রাইতটা তেমন সুবিধার ঠেকতাসে না।’

পাঁচ

অন্যান্যদিনের তুলনায় সে রাতে খানিকটা আগেভাগেই শুয়ে পড়ল লতিফ মিয়া বুকটা ভারী হয়ে আছে তার, কিছুতেই অদ্ভুত লোকটাকে মাথা থেকে তাড়ানো যাচ্ছে না। লোকটার মধ্যে অশুভ কী যেন একটা আছে, মনের উপর চাপ ফেলে।

জীবনে এই প্রথম সত্যিকারের আতঙ্ক কাকে বলে টের পাচ্ছে লতিফ মিয়া। এতটাই ভয় পেয়েছে যে, নিজের ঘুপচি ঘরে শোয়ার সাহসটুকুও আজ হয়নি তার, বিছানা পেতেছে কাছারি ঘরে।

আগুন কেন জ্বেলে রেখেছে, নিভানোর সাহস নেই। তবে ভয়টা যে ঠিক কীসের, এটা কিছুতেই ভেবে পাচ্ছে না সে। একারণে শঙ্কাটা আরও বেশি জাঁকিয়ে বসেছে তার মনে। কাছারি ঘরের বিছানায় জাজিম নেই, কাঠের পাটাতনের উপর পাতলা চাদর পাতা। বালিশটাও ইটের মত শক্ত, ঘাড়ের কাছটায় ব্যথা লাগে।

তাতেই কোনরকমে পিঠ ঠেকিয়ে চোখ মুদল লতিফ মিয়া। ভারী কাঁথা টেনে দিয়েছে গলা পর্যন্ত। পরিশ্রান্ত মানুষ, গতরাতেও ঘুমোতে পারেনি; অচিরেই চোখের পাতা ভারী হয়ে এল তার।

খানিকক্ষণের মধ্যেই রীতিমত নাক ডাকতে শুরু করল সে। শীতের নিস্তব্ধ রাতে সে শব্দ ছড়িয়ে পড়ল অনেক দূর অবধি।

আচমকা চোখ খুলে ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসল লতিফ মিয়া। ঠিক কী কারণে কাঁচা ঘুমটা এভাবে চট করে ভেঙে গেল, প্রথমটায় কিছুতেই ঠাহর করতে পারল না সে। পরক্ষণেই দেখতে পেল, ভারী কাঁথাটা এখন আর গায়ে নেই তার, মেঝের ওপর পড়ে আছে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে! চোখ কচলে ওটার দিকে ভাল করে তাকাতেই, দেহের সমস্ত রক্ত জমে বরফ হওয়ার জোগাড় হলো তার। কাঁথাটা আর আস্ত নেই মোটেও; চিরে ফালাফালা করে ফেলা হয়েছে! যেন প্রচণ্ড আক্রোশে ওটার উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল কোন বিশালদেহী দানব!

কীসে এমন হাল করেছে ওটার? বন্ধ দরজা ডিঙিয়ে ঘরেই বা ঢুকল কেমন করে?

ঠিক তখনই ঘরের কোনায় হুটোপুটির আওয়াজ শুনতে পেল লতিফ মিয়া। নিমিষেই শরীরের সবক’টা লোম দাঁড়িয়ে গেল তার।

বিস্ফারিত নেত্রে কোণের জমাটবাঁধা অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে রইল সে। আর অপেক্ষায় রইল ভয়ানক কোন দানবকে চাক্ষুষ করার।

পরমুহূর্তেই তাকে বিস্ময়ে হতবাক করে দিয়ে মাঝারী আকারের একটা ধেড়ে ইঁদুর বেরিয়ে এল ওখান থেকে! কয়েক কদম এগিয়ে মেঝের আলোকিত অংশে এসে থমকে দাঁড়াল ওটা।

চেপে রাখা নিঃশ্বাসটা সশব্দে ছাড়ার অবকাশ পেল লতিফ মিয়া। সামান্য একটা ইঁদুরের কারণেই কি না আত্মারাম খাঁচাছাড়া হওয়ার উপক্রম হয়েছিল তার! এতটা ভীতুও বুঝি হয় কেউ?

তবে পরের দৃশ্যটা চোখে পড়া মাত্রই আবারও দম আটকে এল তার!

প্রথম ইঁদুরটার পিছু নিয়ে একে-একে অন্ধকার ছেড়ে বেরিয়ে আসতে শুরু করল ইঁদুরের পাল! সবক’টা বিশালাকার, দেখতে অবিকল একই রকম। শত- শত, হাজার-হাজার ইঁদুর! দেখতে-দেখতে পুরো মেঝেটাই ঢেকে গেল ইঁদুরের পালে!

বিদ্যুৎ চমকের মত সবকিছু পরিষ্কার হয়ে গেল লতিফ মিয়ার কাছে। বুঝে গেল, কাঁথাটার এমন হাল কারা করেছে। সন্ধ্যায় কাদের কথা বলেছিল রহস্যময় লোকটা; কারা ছিল গতরাতের হত্যাকাণ্ডের সাক্ষী!

পিছাতে-পিছাতে দেয়ালঘেঁষা খাটের একেবারে শেষ কোনায় চলে গেল লতিফ মিয়া। নিদারুণ আতঙ্কে সমস্ত অন্তরাত্মা কাঁপছে তার; নির্নিমেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ঘরভর্তি অগুনতি ইঁদুরের দিকে।

মেঝেতে এখন সমুদ্রের ঢেউয়ের মত ঢেউ উঠছে, একে অন্যের শরীরে ভর দিয়ে ধীরে-ধীরে উঁচু হচ্ছে খুনে ইঁদুরের দল। খাটের পায়া বেয়ে উঠতে শুরু করেছে বাকিরা, লতিফ মিয়ার নাগাল পেতে খুব বেশি বাকি নেই আর।

ঘোরলাগা চোখে পুরোটা সময় ওদের দিকে তাকিয়ে থাকলেও, তার মন পড়ে আছে অতীতে। দৈববলে শৈশবের সবকিছু মনে পড়ে গেছে তার! মা-বাবা, ভাই-বোনদের সঙ্গে কাটানো সুখের খণ্ডচিত্রগুলো একে-একে ভাসছে তার চোখের সামনে। নিয়তির নিষ্ঠুর ছোবলে, চোখের পলকে বদলে গেল সবকিছু!

প্রথম ইঁদুরটা শরীরে কামড় বসাতেই ঘোর কেটে গেল লতিফ মিয়ার। সাহায্যের আশায় গলা ফাটিয়ে চেঁচানোর জন্য মুখ খুলল সে।

তবে চিৎকারটা আর কখনওই ওর গলা ছেড়ে বেরোনোর সুযোগ পায়নি। মুখ খোলা মাত্রই অন্তত গোটা পাঁচেক ইঁদুর একযোগে ঢুকে পড়ল তার মুখগহ্বরে!

লতিফ মিয়ার আলজিভের দখল পেতে একে অন্যের সঙ্গে লড়াই শুরু করল ওরা!

ছয়

মতি চেয়ারম্যানের সাকল্যে তিনজন বউ। তবে বেশিরভাগ সময় রাতটা সে ছোট বউ ময়নার ঘরেই কাটায়।

বাচ্চা-কাচ্চা জন্ম দিয়ে বড় দু’জনের দেহের বাঁধন ঢিলে হয়ে গেছে; ওতে আর আজকাল মন ভরে না মতির।

ময়নার বয়স সবে উনিশ, আগুনরঙা রূপ। পা থেকে মাথা পর্যন্ত উপচে পড়া যৌবন, এক দফায় খাঁই মেটানো কঠিন। অমন বউ ছেড়ে কী কারণে অন্য বউদের ঘরে রাত কাটাতে যাবে মতি? চেয়ারম্যানকে ঢুকতে দেখেই লণ্ঠনের আঁচটা খানিকটা কমিয়ে দিল ময়না। অর্ধেক সেলাই করা নকশী কাঁথাটা তুলে রাখল পাশের টেবিলে। ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠল সলজ্জ হাসি।

ঘরে ঢুকেই চটজলদি দরজাটা বন্ধ করে দিল মতি। পরনের পাঞ্জাবীটা আলনায় তুলে রেখে, ভুঁড়িতে হাত বুলাতে-বুলাতে বিছানায় এসে বসল। খুশিতে সবক’টা দাঁত বেরিয়ে পড়েছে তার, কিছুতেই ওদেরকে ঠোঁটের আড়ালে লুকোতে পারছে না সে।

ময়নার কাছে এলেই কী যেন হয় তার! নিজেকে বাচ্চা-বাচ্চা মনে হয়, আহ্লাদ করতে ইচ্ছে করে, ন্যাকামো করতে মন চায়।

‘কাইল রাইতে কই আছিলেন? বড় বুবুর ঘরে?’ অভিমানী গলায় জিজ্ঞেস করল ময়না। আপাতদৃষ্টিতে নির্দোষ এই প্রশ্নটাতেই ভয়ানক চমকে উঠল মতি। এক নিমিষে মুছে গেল মুখের দ্যুতি।

‘হ,’ কোনমতে বলল সে। তার জানা আছে, রাতে থাকা নিয়ে সতীনেরা নিজেদের মধ্যে আলাপ করে না কখনওই। তাই ধরা পড়ার আশঙ্কা এক্ষেত্রে নেই বললেই চলে।

‘আইজও থাকতেন। আইলেন ক্যান?’ কণ্ঠে আরও খানিকটা আহ্লাদ ঢেলে বলল ময়না। নীচের দিকে মুখ নামিয়ে রেখেছে বলে আধো অন্ধকারে তার মুখের ভাব স্পষ্ট ঠাহর করতে পারল না মতি।

‘আমার ময়না পাখিডারে দেখতে মন চাইল। তাই চইলা আইলাম,’ যথাসম্ভব নরম গলায় বলল সে। তারপর এগিয়ে গেল ময়নার দিকে।

দ্রুত কাজে নেমে পড়ল চেয়ারম্যান। হাত বাড়িয়ে লণ্ঠনের আঁচটা আরও খানিকটা কমিয়ে দিল; তারপর অভ্যস্ত হাতে খুলতে শুরু করল ময়নার বসন।

‘ও, মা গো,’ আচমকা চেঁচিয়ে উঠল ময়না। ঝটকা মেরে মতিকে নিজের গায়ের উপর থেকে সরিয়ে দিল সে। উঠে বসে নিজের পায়ে হাত বুলাতে লাগল।

‘কী হইল আবার! চিল্লান দিলা ক্যান? অহনও তো শুরুই করি নাই কিছু, অবাক কণ্ঠে জানতে চাইল মতি।

‘কীয়ে জানি কামুড় দিল পায়ে…’

‘কও কী!’ লণ্ঠনটা, ময়নার পায়ের কাছে নিয়ে এল মতি। ‘দাঁতের দাগ দেহি। রক্তও তো বাইর হইতাসে!’

‘সাপে কামুড় দিলনি কোন? আমার অহন কী হইব? ও, আল্লা গো…’ আবারও চিৎকার শুরু করল ময়না।

তবে চেয়ারম্যানের কড়া ধমক খেয়ে আপাতত ক্ষান্ত দিল কাজটায়। ‘খাড়াও। বেহুদা চিল্লাইও না। দেইখা লই আগে।’

খাটের তলাটা ভাল করে দেখার জন্য আলোটা বাড়িয়ে দিল মতি। দামী লণ্ঠন, নিমিষেই দিনের আলোর মত ফকফকা হয়ে গেল জায়গাটা।

‘খাইসে! কত্ত বড় ইন্দুর! সাপখোপ না গো, ইন্দুরে কামড়াইসে তোমারে।’ ভুঁড়ি দুলিয়ে হাসতে শুরু করল মতি।

একটা বাঁশের কঞ্চি দিয়ে ইঁদুরটাকে তাড়িয়ে দিল সে। ঘরের পিছন দিকটায় বড়-বড় কয়েকটা গোলায় আতপ চাল রাখা আছে, ওখানেই গিয়ে লুকিয়ে পড়ল ওটা।

ইঁদুরটার চোদ্দগোষ্ঠীর উদ্দেশে খানিকক্ষণ খিস্তি করে উঠে দাঁড়াল মতি, দরজা খুলতে শুরু করল।

‘অহন আবার কনে যাইতাসেন?’

‘খাড়াও। আইতাসি। লতিপ্পারে ইঁদুরের ওষুধের কথা কইয়া আই। পরে ভুইল্যা যামু। ওষুধ না দিলে হারামিগুলান আমার গোলা সাফ কইরা ফালাইব।’

‘তাড়াতাড়ি আইয়েন কিন্তুক। আমার ডর করে।’

‘ডর কীয়ের আবার! আমি এই গেলাম আর আইলাম।’

দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে উঠনে পা রাখল মতি। জোর কদমে হাঁটতে শুরু করল কাছারি ঘরের দিকে।

বিশালকায় উঠনের একেবারে শেষ মাথায় কাছারি ঘর, তার পাশেই একটা ছোট্ট ঘরে রাত কাটায় লতিফ মিয়া।

অবচেতন মনে মাখনলালের বউটার কথা ভাবতে শুরু করল মতি চেয়ারম্যান। মেয়েটাকে প্রাণে মারার কোন ইচ্ছেই ছিল না তার। কী থেকে যে কী হয়ে গেল, খোদা মালুম!

বেঁচে থাকলে আরও অন্তত বার কয়েক মেয়েটাকে ভোগ করা যেত। বহুবছর পর ভীষণ রকম তৃপ্তি দিয়েছিল তাকে মেয়েটা।

আচমকা পিছনে অস্পষ্ট একটা শব্দ শুনতে পেয়ে ফিরে তাকাল মতি। শিশিরমাখা চাঁদের আলোয় যে দৃশ্যটা দেখতে পেল সে, কিছুতেই সেটা বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হলো না তার। সত্যিই কি এটা বাস্তব? নাকি নিদারুণ কোন ভ্রম?

জগতের সমস্ত ইঁদুর এসে জড় হয়েছে উঠনে! দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে এখন ওরই দিকে তেড়ে আসছে ওগুলো। কে কার আগে ওকে ধরতে পারবে, এই নিয়েই যেন প্রতিযোগিতায় মত্ত ওরা! নাগাল পেলে নিজের পরিণতি কী হবে, এটা না বোঝার মত বোকা নয় মতি। জীবন বাঁচাতে প্রাণপণে দৌড়তে শুরু করল সে।

ঘোলাটে জোছনায় কুয়াশা ভেজা খেতের আইলের উপর দিয়ে পালাচ্ছে মতি চেয়ারম্যান, তাকে তাড়া করে ছুটে চলেছে অপার্থিব ইঁদুরের পাল!

এসব থেকে অনেক দূরে এক ছোট্ট নৌকায় ঘুমিয়ে আছে পরিশ্রান্ত মাখনলাল। তার মাথার কাছে গামছায় জড়ানো কয়েক গাছি কাচের চুড়ি। বউয়ের জন্য হাট থেকে আজ বিকেলেই ওগুলো কিনেছে বেচারা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *