ওরাকল

ওরাকল

এক

দিগন্ত বিস্তৃত বনভূমি, মাঝে এক চিলতে খোলা জায়গা। বাওয়াদের সবচেয়ে বড় গ্রামটা এখানেই। গায়ে গা ঠেকিয়ে দাঁড়ানো কয়েক সারি কুঁড়েঘর। বাঁশের বেড়ার দেয়াল, মাথার উপর মাকানো পাতার ছাউনি। সবক’টা দেখতে অবিকল একই রকম।

প্রথম দর্শনে নিতান্ত নড়বড়ে মনে হলেও, ঘরগুলো আদতে বেশ পোক্ত। পাকা বাঁশের কঞ্চির ফাঁকে-ফাঁকে বেতের ডাল গুঁজে মজবুত করা হয়েছে দেয়াল।

আর রোদ-বৃষ্টি ঠেকাতে মাকানো পাতার ছাদের কোন জুড়ি যে নেই, সে তো সবারই জানা। একেকটা পাতা প্রায় এক মানুষ সমান লম্বা, প্রস্থেও নেহায়েত কম নয়। পরিণত পাতার প্রান্তের দিকে এক ধরনের আঠা তৈরি হয়। তাই সহজেই একটার সঙ্গে আরেকটা জোড়া লাগিয়ে আকার বাড়ানো যায়। আঠার কারণেই কি না কে জানে, পাতাগুলো বেশ পিচ্ছিল হয়। বৃষ্টির জল সহজেই গা বেয়ে গড়িয়ে পড়ে, লেগে থাকে না।

দার্শনিক অংরা, মাকানো পাতাকে বেশ পছন্দ করতেন। তাঁর ধারণা ছিল, মানব সভ্যতার বিকাশে এর বেশ বড় রকমের অবদান রয়েছে। দীর্ঘস্থায়ী, তাই মাকানো পাতাতেই আদিম মানুষ প্রথম চিত্র আঁকতে শুরু করে বলে মত প্রকাশ করে গেছেন তিনি।

বাওয়াদের ধারণাও নেই, এই বনের বাইরেও একটা জগৎ আছে, সেখানেও বাস করে মানুষ। দৃষ্টিসীমার ভিতরের পর্বত, নদী, অরণ্য, এসব নিয়েই বাওয়াদের পৃথিবী।

গ্রামটার নাম, সাসাকো। বাওয়া ভাষায় যার অর্থ দাঁড়ায়, নদীর কন্যা। গাঁয়ের পাশ দিয়ে বয়ে চলা লানু নদীর কারণেই এহেন নামকরণ। তবে কন্যার প্রতি মাঝে-মাঝেই বিমাতাসুলভ আচরণ করতে দেখা যায় লানুকে। ভরা বর্ষায় যখন দু’কূল ছাপিয়ে প্লাবিত হয় লানু, তখন সাসাকোকেও সে বিন্দুমাত্র ছাড় দেয় না। গোটা গ্রাম বন্যার পানিতে তলিয়ে যায় তখন।

তবে লানুর মেজাজ-মর্জির খবর বাওয়ারা আগে থেকেই টের পেয়ে যায়। তাই তল্পিতল্পা গুটিয়ে অদূরের পাহাড়ে গিয়ে আশ্রয় নিতে পারে। খুব একটা ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা থাকে না কখনওই।

বাওয়াদের জীবনযাত্রা খুব সহজ। দক্ষতার নিরিখে শ্রমবিভাগ গড়ে উঠেছে বাওয়া সমাজে। সবচেয়ে শক্তিশালী গড়নের পুরুষেরা যোদ্ধা হয়। গাঁয়ের সবার নিরাপত্তার ভার ওদের উপর। শিকারের মাধ্যমে সবক’টা মুখে আহার জোগানোর কাজটাও ওরাই করে।

অপেক্ষাকৃত দুর্বল পুরুষেরা সাধারণত শ্রমিক হয়। ঘরবাড়ি, অস্ত্রশস্ত্রসহ নিত্য প্রয়োজনীয় যাবতীয় জিনিসপত্র নির্মাণ এবং রক্ষণাবেক্ষণের দায়ভার তাদের।

মহিলারা মূলত ঘরের কাজেই ব্যস্ত থাকে। রন্ধনশৈলীর প্রদর্শন ছাড়া, সন্তান উৎপাদন এবং প্রতিপালনকেই তাদের প্রধান কাজ বলে গণ্য করা হয়। তবে যৎসামান্য কৃষিকাজের যে প্রচলন বাওয়া সমাজে আছে, সেটা মহিলারাই নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। কৃষিকে চিরকাল অসম্মানের চোখেই দেখতে অভ্যস্ত বাওয়ারা।

গোটা সাসাকো জুড়েই আজ উৎসবের আমেজ। বাওয়াদের সবার মধ্যেই অন্যান্যদিনের তুলনায় খানিকটা বাড়তি কর্মচাঞ্চল্য লক্ষ করা যাচ্ছে আজ। কালো-কালো মুখগুলো নিষ্পাপ হাসিতে উদ্ভাসিত, ভিতরের খুশি গোপন করার কোন চেষ্টাই করছে না সহজ-সরল মানুষগুলো। উৎসবের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত সবাই, সূর্য ডুবলেই শুরু হবে মূল অনুষ্ঠান। আজ সন্ধ্যারাতেই সিংহাসনে আরোহণ করতে চলেছে সাসাকোর নতুন সর্দার। পূর্ববর্তী সর্দার শাংকুর ছেলে, কিকা। বাওয়ারা সবাই তাকে পছন্দ করে, এজন্য তাদের খুশিটাও পুরোপুরি নিখাদ প্রয়াত সর্দার শাংকুকেও ভালবাসত বাওয়ারা। নিজের মৃত্যুশয্যায় অধীনস্তদের চোখে শতভাগ অকৃত্রিম বিষাদ দেখতে পাওয়ার সৌভাগ্য সব শাসকের কপালে জোটে না। একশো সতেরো বছর বয়সে থুথুড়ে বুড়ো হয়ে মরার আগে সর্দার শাংকু সেটাই দেখে যেতে পেরেছে। দিন সাতেক আগে, ভর সন্ধ্যাবেলায় গোটা সাসাকোবাসীকে কাঁদিয়ে পরলোকগমন করেছে সে।

সেদিন থেকে গতকাল রাত অবধি তার জন্য শোক পালন করেছে বাওয়ারা। ভাগাড়ে থাকা পুরানো শুকনো খাবার খেয়ে থেকেছে, শিকারে যায়নি কেউই। মদ গেলেনি, সঙ্গম করেনি। নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া অহেতুক ঢাকও বাজায়নি I কবরের নিস্তব্ধতা নেমে এসেছিল গোটা সাসাকো জুড়ে। শিশুরাও বুঝতে পেরেছিল, অবস্থা বিশেষ সুবিধের নয়। তাই তারাও সারাক্ষণ বড়দের মত মুখ ভার করে রেখেছিল। যেন সব ক’জন সুবোধ বালক-বালিকা, চেঁচামেচি কাকে বলে জানেই না কেউ!

তবে আজ সকালে উৎসবের সপ্তাহ শুরু হওয়া মাত্রই ওরা চোখের পলকে আমূল বদলে গেছে, ফিরে গেছে ওদের চিরচেনা রূপে। এতদিন গোলমাল না করার শোধটা তুলে নিচ্ছে কড়ায়-গণ্ডায়। তাদের সম্মিলিত রণনিনাদের তোড়ে বড়দের কানের পর্দা ফাটার উপক্রম হলেও, আজ তাদের শাসন করতে এগিয়ে যাচ্ছে না কেউ। বরঞ্চ হাসিমুখে সহ্য করছে সমস্ত অত্যাচার। আজ উৎসবের দিন, আজ আনন্দের দিন। শাসন-বারণের নিয়মগুলো আজকের জন্য মুলতবী রাখা হয়েছে।

লানু নদীর কোল ঘেঁষে ছোট একখানা মঞ্চ বানানো হয়েছে। মাঝখানে সর্দারের বসার জন্য তাকিয়ামতন একখানা আসন।

মঞ্চের সামনের দিকটায় ভাকরা গাছের ডাল দিয়ে ঘিরে তৈরি করা হয়েছে বিশাল চত্বর। বাওয়ারা সবাই এখানেই বসবে, যাবতীয় অনুষ্ঠান এবং সামাজিক প্রথাগুলো এখানেই পালন করা হবে।

মঞ্চের পিছনেই বাওয়াদের ঘাট। তাতে হরেক রকমের সারি-সারি নৌকা বাঁধা। গত এক সপ্তাহ ধরে ওগুলো ওখানেই ঠায় পড়ে আছে, ব্যবহার করেনি কেউ। তবে বাওয়াদের জানা নেই, শীঘ্রিই ওগুলো ব্যবহারের দরকার পড়বে ওদের!

দুই

সাঁঝ ঘনাতেই ঢাক বেজে উঠল। বাওয়া যুবকেরা প্রায় সবাই একখানা করে ভাগে পেয়েছে আজ। প্রত্যেকেই চেষ্টা করছে, অন্যদের চেয়ে জোরে বাজাতে। কেউ কারও চেয়ে পিছিয়ে থাকতে রাজি নয়। মশালের আলোয় ঘর্মাক্ত রঙচঙে মুখগুলো রীতিমত ভয়ঙ্কর লাগছে। যদিও মানুষ হিসেবে বাওয়ারা মোটেও হিংস্র নয়।

চত্বরের একপাশে চলছে ভূরিভোজের আয়োজন। আগুনের উপর ঝুলছে আস্ত এক দাঁতাল শুয়োর। ছোট বাচ্চাদের বেশ ভিড় ওখানটায়। বাদুড় আর চামচিকা দিয়ে তৈরি হরেক রকম পদ শোভা পাচ্ছে তার পাশেই। বেশ কয়েকটা ছোট বানরকে কাঠিতে পুড়িয়ে মচমচে করা হয়েছে। মূল খাবারের পর বাওয়াদের হাতে-হাতে ঘুরবে ওগুলো। যার-যার পছন্দমত অংশ ভেঙে ভেঙে খাবে। এতে একে অপরের সঙ্গে সম্প্রীতি বৃদ্ধি পায় বলেই বাওয়াদের বিশ্বাস। প্রিয় মানুষকে আস্ত বানরপোড়া উপহার দেয়ার রীতিও প্রচলিত আছে বাওয়া সমাজে। ফালি- ফালি করে কাটা হয়েছে হরিণের মাংস। বাহারি মশলায় মাখানো টুকরোগুলো দেখতে যেমন আকর্ষণীয়, খেতেও তেমনি চমৎকার।

সাপ, ব্যাঙ, গিরগিটি, গুইসাপ থেকে শুরু করে অজগর অবধি সবই আছে। কিছুই বাদ পড়েনি ভোজের তালিকা থেকে।

সর্দারের জন্য বিশেষ খাবার হিসেবে তৈরি করা হয়েছে পুপার রোস্ট। পুপা একজাতের ছোট হরিণ, খুবই বিরল। আকারে বিড়ালের চেয়ে সামান্য বড়, তবে গতিতে চিতাকেও হার মানাতে পারে এরা। গভীর বনে লুকিয়ে থাকে, ক্ষণে-ক্ষণে চামড়ার রঙ বদলায়। তাই ওদের দেখতে পাওয়া যতটা কঠিন, ধরা তার চেয়েও দুষ্কর।

তবে সর্দারের জন্য মূল্যবান উপহার না আনলে চলবে কেন? তাই নিজেদের তাগিদেই কষ্টসাধ্য কাজটা করেছে বাওয়ারা। জোগাড় করেছে একজোড়া মধ্যবয়স্ক পুপা।

ভাবি সর্দার কিকা দাঁড়িয়ে আছে ওঝার পাশে। পুরোদস্তুর নগ্ন হয়ে। গায়ে বিচিত্র রঙের আঁকিবুকি। মুখেও আঁকা হয়েছে বাহারী নকশা। এই নকশার মাধ্যমেই সমগ্র বাওয়া ইতিহাস শরীরে ধারণ করেছে সে। ওঝার সাজপোশাকও কম বিচিত্র নয়। ঊর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃত হলেও, কোমরে একখানা নেকড়ের ছাল জড়িয়েছে সে। গলায় হাড়ের মালা, লকেট হিসেবে শোভা পাচ্ছে ছোট একখানা খুলি। মানুষের নয়, হনুমানের। মাথায় কাঁটার মুকুট। কপালের এখান-ওখান থেকে হালকা রক্ত ঝরছে তার। তবে চেহারায় যন্ত্রণার কোন ছাপ নেই। বাওয়ারা ভাবে, চাইলেই ব্যথা বেদনার ঊর্ধ্বে চলে যেতে পারে ওঝারা! তা নইলে আর তারা ওঝা কেন? কালবিলম্ব না করে অনুষ্ঠান শুরু করল ওঝা। প্রথমেই করা হবে পূর্বপুরুষদের আরাধনা। তাঁদের আত্মারা অসীম শক্তির উৎস। বংশের সাফল্য- ব্যর্থতা মূলত ওঁরাই নিয়ন্ত্রণ করেন। তাঁরাই তৈরি করেন বীর যোদ্ধা, আবার যোদ্ধাদের মরণও ডেকে আনেন তাঁরাই! তাই এসব কায়াহীনদের সন্তুষ্ট রাখাটা বাওয়াদের জন্য অবশ্য কর্তব্য। বাওয়ারা চিরকাল সেটাই করে এসেছে।

টামবারানের সামনে বিশাল একখানা অগ্নিকুণ্ড তৈরি করা হয়েছে। জ্বালানী হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে পালান কাঠের লাকড়ি। এই বিশেষ কাঠ পোড়ার সময় তীব্র সুগন্ধ উৎপন্ন করে। পূর্বপুরুষ-পূজার এটাও একটা বিশেষ অনুষঙ্গ।

ওরা দু’জন আগুনের পাশে গিয়ে দাঁড়ানো মাত্রই থেমে গেল সবক’টা ঢাকের আওয়াজ। বাওয়ারা সবাই যে যার জায়গায় অনড় দাঁড়িয়ে পড়ল। নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করেও কথা বলছে না কেউ। বাচ্চারাও কুলুপ এঁটে দিয়েছে নিজেদের মুখে।

মাথা ঘুরিয়ে চারপাশটা একবার দেখে নিয়ে সন্তুষ্ট হলো ওঝা। পরক্ষণেই বিড়বিড় করে মন্ত্র জপতে শুরু করল সে। প্রথমটায় নিচু স্বরে শুরু করলেও, ধীরে-ধীরে স্বরটা উঁচু হতে থাকল তার। একেবারে শেষ মাথায় দাঁড়ানো বাওয়া মানুষটাও এখন স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে তার কথা।

একরত্তি অর্থ বুঝতে না পারলেও, ওঝার কণ্ঠের আকুতি অনুধাবন করতে কষ্ট হচ্ছে না কারও। জানে, পূর্বপুরুষদের আত্মাকে ডাকছে ওঝা। অতীতেও এহেন দৃশ্য চাক্ষুষ করেছে বাওয়ারা।

ধীরে-ধীরে পরিবেশ ভারী হয়ে উঠল। সবাই স্পষ্ট বুঝতে পারল, এসে গেছে অতিথিরা। চোখে যদিও কোন কিছুই দেখতে পেল না কেউ।

কণ্ঠের সবটুকু জোর কাজে লাগিয়ে তারস্বরে চেঁচাচ্ছে ওঝা। একটু পর-পরই হাতের মুঠো থেকে আগুনে বালি ছিটিয়ে চলেছে সে। সাধারণ কোন বালি নয়, পবিত্র গুহার বালি। বহু বছর আগে এক বাওয়া সর্দার এনেছিল ওগুলো।

আচমকাই টামবারানের ভিতর থেকে ভেসে এল খুলিতে-খুলিতে ঠোকাঠুকির শব্দ! সেই সঙ্গে পিলে চমকানো সম্মিলিত হাসি। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে জমানো বীর পুরুষদের খুলিতে আবারও ফিরে এসেছে প্রেতাত্মারা। বংশধরদের ডাকে সাড়া না দিয়ে পারেনি।

মন্ত্র জপা বন্ধ করল ওঝা। আপাতত তার কাজ শেষ। ঘেমে নেয়ে একাকার তার গোটা শরীর, যেন সদ্যই লানু নদীতে ডুব দিয়ে এসেছে সে।

ধীর পায়ে টামবারানের বন্ধ দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল কিকা। মাথা নিচু করে রেখেছে। ভয়ে রীতিমত কাঁপছে তার গোটা শরীর। তার মনে হচ্ছে, যে কোন মুহূর্তে হুড়মুড় করে মাটিতে লুটিয়ে পড়বে সে। পাজোড়া দেহের ভার বইতে অক্ষমতা জানাচ্ছে বারংবার।

শ্বাসরুদ্ধকর উত্তেজনা নিয়ে কিকার দিকে তাকিয়ে আছে বাওয়ারা। জানে, কিকার ভাগ্য এখন একটা সুতোর উপর ঝুলছে। যে কোন মুহূর্তে সে তার প্রাণ পর্যন্ত হারাতে পারে। সর্দারকে প্রেতাত্মাদের পছন্দ হলে, খুশি মনে বিদায় নেবে ওরা। কিন্তু পছন্দ না হলে, কী করে বসবে তার কোন্ ঠিক-ঠিকানা নেই। সবই নির্ভর করছে অশরীরীদের মেজাজ-মর্জির উপর।

ঠিক তখনই প্রচণ্ড শব্দে খুলে গেল টামবারানের দরজাটা। একঝলক দমকা হাওয়া বেরিয়ে এল ভিতর থেকে। শোঁ-শোঁ শব্দে বাতাসটা গিয়ে হামলে পড়ল আরাধনার অগ্নিকুণ্ডটার উপর। মুহূর্তেই নরক গুলজার হয়ে উঠল জায়গাটায়। আগুন-বাতাস, দুই চিরশত্রুর লড়াই বেধে গেল নিমেষেই, কে জিতবে বলা মুশকিল।

নিজের অজান্তেই যার-যার জায়গা ছেড়ে এক কদম পিছিয়ে গেল বাওয়ারা। বিস্ফারিত নেত্রে দুই দানবের লড়াই দেখছে সবাই। এহেন অভূতপূর্ব ঘটনা এর আগে কেউই দেখেনি ওরা, শোনেওনি।

যেমনভাবে শুরু হয়েছিল, চোখের পলকে ঠিক তেমনিভাবে শেষ হয়ে গেল ব্যাপারটা। রসগোল্লার মত বড়-বড় চোখ নিয়ে সাসাকোবাসী আবিষ্কার করল, আগুনটা নিভে গেছে! পবন দানবও উধাও হয়ে গেছে; তার টিকিটাও দেখা যাচ্ছে না কোথাও।

সুনসান নীরবতা বিরাজ করছে চারদিকে, খানিক আগে যেন কিছুই ঘটেনি এখানে!

পরক্ষণেই একযোগে হুল্লোড় করে উঠল সমবেত জনতা। সন্তুষ্ট চিত্তে প্রস্থান করেছে প্রেতাত্মারা, নতুন সর্দারকে পছন্দ হয়েছে ওদের।

উৎসাহের আতিশয্যে কেউ-কেউ দৌড়ে গেল কিকার দিকে। উত্তেজনার রেশ কাটতেই ভীষণ দুর্বল হয়ে মাটির উপর বসে পড়েছে নতুন সর্দার।

নিজেকে ফিরে পেতে খুব একটা সময় লাগল না কিকার। উঠে দাঁড়িয়ে দ্রুত একখানা হরিণের ছাল কোমরে জড়িয়ে নিল সে। প্রেতাত্মাদের সামনে দিগম্বর হয়ে দাঁড়ানোর রেওয়াজটা পালন করেছে সে। তাই বলে সবার সামনে নগ্ন হয়ে ঘুরে বেড়ানোর কোন মানে হয় না।

কিকাকে মঞ্চের দিকে এগিয়ে নিয়ে গেল ওঝা। আর মাত্র একটা কাজই বাকি এখন। কুফলু পাখির পালকে তৈরি মুকুটটা মাথায় পরা। তাহলেই আনুষ্ঠানিকভাবে সাসাকোর সর্দার হয়ে যাবে কিকা।

কুফলু পাখিরা কেবল আভিজাত্যের নয়, ভয়ঙ্কর ক্ষমতারও প্রতীক। তাই কুফলুর পালকে তৈরি মুকুট কেবল সর্দারই পরতে পারে, অন্য কেউ নয়।

কুফলুরা মাংসাশী, থাকে পর্বতের চূড়ায়। আকারে বিশাল, ডানা ছড়ালে সূর্যকেও ঢেকে দিতে পারে অনায়াসে। যে কোন বড় জানোয়ারই খায় ওরা, খুব একটা বাছ-বিচার করে না। তবে মানুষকে বাগে পেলে অন্য খাবারে আগ্রহ হারায়

একা কেউ কুফলুদের কবলে পড়লে, বেঁচে ফিরে আসতে পারে না কখনওই। ফি-বছর অন্তত জনা দশেক বাওয়া প্রাণ হারায় ওদের হাতে। বাওয়া শিশুদের প্রথম যে ভয়ের সবকটা দেয়া হয়, তার নাম-কুফলু। তবে স্বভাবে ওরা যতই হিংস্র হোক না কেন, দেখতে ভারি সুন্দর। পালকে সাদার উপর গোলাপি রঙের প্রলেপ দেয়া, এখানে-ওখানে ছোপ-ছোপ নীল রঙ।

বাওয়ারা বিশ্বাস করে, ঘরে কুফলুর পালক রাখলে, দৈবশক্তির অনিষ্ট থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। তাই সর্দারের মুকুট তৈরির জন্য কুফলুর পালককেই সবচেয়ে উপযুক্ত মনে করে ওরা।

তিন

কম্পনটা শুরু হলো খুব মৃদুভাবে। যেন অদূরের পাহাড়শ্রেণীর কোথাও বড় কোন পাথরের স্থানচ্যুতি ঘটেছে। আর তাতেই কেঁপে উঠছে পায়ের তলার জমিন আর সেই সঙ্গে ভেসে আসছে দূরাগত মেঘের আবছা গর্জন। প্রথমটায় বাওয়াদের কেউই আসল ঘটনা আঁচ করতে পারল না। সবাই কেমন যেন হকচকিয়ে গেল। কম্পনের প্রকোপ বৃদ্ধির সঙ্গে-সঙ্গে তাদের বিহ্বলতার পরিমাণ বাড়ল বৈ কমল না। ভূমিকম্পে অভ্যস্ত নয় বাওয়ারা। আচমকা লানু নদীর মধ্যখানটায় প্রচণ্ড রকমের আলোড়ন উঠল। টনকে টন জল ফোয়ারার মত দিগ্বিদিক্ ছড়িয়ে পড়তে লাগল। যেন প্রকাণ্ড কোন দানব সীমাহীন আক্রোশে ঝাঁপিয়ে পড়েছে নদীর জলের উপর। বহুদিনের পুষে রাখা ক্ষোভ, আজ সুদে-আসলে উসুল করা চাই তার।

তবে অল্পক্ষণ পরে জল ফুঁড়ে যে আকৃতিটা বেরিয়ে এল, সেটা মানুষেরই, কোন দানবের নয়। যদিও সাধারণ মানুষের গড়নের চেয়ে দৈর্ঘ্য-প্রস্থ দুটোই ঢের বেশি তার। গায়ের রঙ বাওয়াদের মত ঘোর কৃষ্ণবর্ণের নয়, অনেকটাই ফর্সা। আর সেই ত্বকের নীচে কিলবিল করতে থাকা মাংসপেশীগুলো যে অমিত শক্তির আধার, এটা বুঝতে দিব্যদৃষ্টির প্রয়োজন পড়ে না।

কোমরে একখানা কালো জাগুয়ারের চামড়া জড়ানো, দু’পায়ে দু’খানা সোনার বেড়ি। কালের আবর্তে উজ্জ্বল সোনালি রঙ বিলুপ্ত হয়ে খানিকটা কালচে হয়ে গেছে।

মাথাভর্তি ধূসর চুল, প্রায় নিতম্ব ছুঁই-ছুঁই করছে। দু’কাঁধে দুটো কুফলু পাখি বসে আছে, বাচ্চা, পূর্ণবয়স্ক হতে এখনও ঢের দেরি। তবে কুফলুদের স্বভাবসুলভ চপলতা অনুপস্থিত ওদের মধ্যে।

বাওয়ারা কিছুতেই ভেবে পেল না, কেমন করে কুফলুদের পোষ মানাল লোকটা! পানির তলাতেই বা ছিল কেমন করে? শ্বাস আটকে আসেনি?

জলের উপর দিয়ে অবলীলায় তাকে হেঁটে আসতে দেখে সভয়ে কয়েক কদম পিছিয়ে গেল বাওয়ারা। আঁতকে উঠে অস্পষ্ট অস্ফুট শব্দ করে উঠল কেউ-কেউ। শুধু ভাবি সর্দার কিকা আর ওঝা নিজেদের জায়গায় ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। দু’জনেই তাকিয়ে আছে আগন্তুকের আগমনী পথের দিকে। মনে একই প্রশ্ন খেলা করছে, কে এই অদ্ভুত লোকটা?

কাছে এসে ওদের মুখোমুখি দাঁড়াল অদ্ভুতদর্শন আগন্তুক। দু’চোখ ভয়ানক রাগে জ্বলজ্বল করছে তার। যেন চোখের আগুনে ভস্ম করে দেবে সামনে দাঁড়ানো সবক’টা মানুষকে! ভিতরকার দুর্বিনীত ক্ষোভ চাপা দেয়ার কোন চেষ্টাই নেই লোকটার। তার ভীতিকর চাহনির সামনে একেবারে কুঁকড়ে গেল ওঝা ও কিকা।

আচমকা লোকটা যখন মুখ খুলল, চারপাশটা রীতিমত গম-গম করে উঠল। যেন একসঙ্গে বেজে উঠেছে গোটা দশেক ঢাক! ‘দেবরাজ জারাল পাঠিয়েছেন আমাকে, যাঁর আদেশ তোমরা অমান্য করে চলেছ প্রতিনিয়ত। তোমাদের জন্য বয়ে এনেছি দুঃসংবাদ, শাস্তি, যা কৃতকর্মের ফলস্বরূপ তোমরা নিজেরাই অর্জন করে নিয়েছ। বয়ে এনেছি সুসংবাদ, এই প্রায়শ্চিত্তের পর তোমরা প্রত্যেকেই হবে একেকজন নবজাতকের মত পাপ-পঙ্কিলতামুক্ত। দেবরাজ জারাল ক্ষমা করে দেবেন সবাইকে।’

বাওয়ারা প্রত্যেকেই যে যার জায়গায় হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। অতিথিকে সম্মান জানানোর বহু প্রাচীন রীতি এটা। দেবদূতকে সম্মান জানানো মানেই পরোক্ষভাবে দেবতাকে সম্মান জানানো। জ্ঞাতসারে ছোট দেবতাদেরও যথাযথ সম্মান প্রদর্শনে কার্পণ্য করে না বাওয়ারা। সেখানে দেবতাদের রাজা, দেবরাজ জারালকে অসম্মান করার তো প্রশ্নই আসে না।

তবে যে কারণেই হোক, তাদের উপর ঠিকই অসন্তুষ্ট হয়েছেন দেবরাজ। অন্যথায় কখনওই তিনি দেবদূত পাঠাতেন না মর্ত্যে। কী শাস্তি ভোগ করতে হবে, কে জানে! আতঙ্কে রীতিমত কাঁপতে শুরু করল বাওয়ারা। মাথা নিচু করে থাকা ভয়ার্ত মুখগুলোর দিকে কিছুক্ষণ পূর্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন দেবদূত। তারপর ফিরলেন ওঝা এবং কিকার দিকে। অন্যদের মত ওরাও মাথা ঝুঁকিয়ে রেখেছে দেবদূতের সামনে, নড়ছে না একচুলও।

‘দেবরাজের পূজার জন্য কৃষ্ণপাথরের কোন বেদী নেই তোমাদের গ্রামে নেই দেবরাজের মন্দির। নেই মন্দিরের দোরগোড়ায় পঞ্চতোরণের প্রবেশপথ প্রতি পূর্ণিমার রাতে গাঁয়ের সবচেয়ে শক্তিশালী মোষটাকে বলি দেয়ার কথা ছিল তোমাদের। মোষের উষ্ণ রক্তের ঢল, পূর্ববর্তী ত্রিশদিনের পাপগুলোকে ধুয়ে-মুছে সাফ করে দেয়।

‘কথা ছিল প্রতি ছয় চাঁদ পর-পর কুমারী কন্যার রক্তে ভেজানো হবে দেবরাজের বেদী। আর তাতেই সন্তুষ্ট হয়ে পরবর্তী ছয় চাঁদের জন্য খাবারের বরাদ্দ দেন দেবরাজ জারাল।

‘কিন্তু তোমরা এর কিছুই করনি। দেবরাজকে ভুলে গিয়ে অন্য দেবতাদের তুষ্টিতে নিজেদেরকে নিয়োজিত রেখেছ সবসময়। কী কারণে এত বড় স্পর্ধা দেখালে তোমরা? জবাব দাও,’ একদমে কথাগুলো বলে থামলেন দেবদূত। ক্রুদ্ধ সাপের মতই ফোঁসফোঁস করে শ্বাস নিচ্ছেন তিনি, দৃষ্টিতে এখনও আগুন ঝরছে। ভীষণ ঘাবড়ে গেল কিকা। দেবরাজের আরাধনার ব্যাপারে যা-যা বললেন দেবদূত, এর কিছুই তার জানা ছিল না। অতীতের কোন ওঝা দূরে থাক, তার বাবা সর্দার শাংকুও এ ব্যাপারে কখনওই কিছু বলেনি। অথচ দেবতাদের ব্যাপারে সমস্ত রকম বিদ্যাশিক্ষা শৈশবেই দেয়া হয়েছে তাকে, সর্দার নিজেই দিয়েছে।

এতবড় বিষয়টা কী করে ভুলে গিয়েছিল বাবা? কিছুতেই ভেবে পেল না কিকা।

সে চিরকাল জেনে এসেছে, মর্ত্যের মানুষের আরাধনার প্রয়োজন নেই দেবরাজ জারালের। কারণ অন্য দেবতারাই দিনরাত তাঁর প্রার্থনায় মত্ত থাকেন। তাঁদের স্তুতিবাক্যেই সর্বদা বিগলিত থাকেন দেবরাজ। খুশি হয়ে যাঁর-যাঁর যোগ্যতা অনুযায়ী ক্ষমতা বণ্টন করে দেন। যেন পৃথিবীর মানুষজনের দেখভাল করতে পারেন দেবতারা। তাহলে হঠাৎ কেন মানুষের পুজো পেতে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন দেবরাজ? নাকি বরাবর ভুল জেনে এসেছে বাওয়ারা? হাজার বছরের পাপের প্রায়শ্চিত্ত কতটা কঠিন হবে?

ভয়ে-ভয়ে মুখ তুলে দেবদূতের দিকে তাকাল কিকা। দেবদূতের সঙ্গে চোখাচোখি হতেই অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল তার। স্পষ্ট বুঝতে পারছে, জবাবটা সবার হয়ে তাকেই দিতে হবে। এটাই আশা করছেন দেবদূত, এটাই নিয়ম। কথা বলতে গিয়ে আবিষ্কার করল, গলা দিয়ে স্বর বেরোতে চাচ্ছে না, নিজের উপর রীতিমত জোর খাটাতে হচ্ছে তাকে।

‘দেবরাজের পায়ে মাথা ঠেকাতে আমাদের কোন আপত্তি নেই, হুজুর। কিন্তু এ ব্যাপারে কিছুই আমাদের জানা ছিল না। কীভাবে দেবরাজ জারালের উপাসনা করতে হয়, কখন করতে হয়, এর সবটুকুই আমাদের অজানা। আমরা অথর্ব, অধম। আমাদের ক্ষমা করুন, হুজুর।’

গর্জে উঠলেন দেবদূত, ‘ক্ষমা? কখনওই না। শাস্তি তোমাদের পেতেই হবে।. এটাই দেবরাজের ইচ্ছা।’

জ্বলন্ত দৃষ্টিতে ওঝার দিকে তাকালেন দেবদূত। ‘ওদেরকে জানানোর দায়িত্বটা তোমারই ছিল। তাই না? কীসের ওঝা তুমি?’

লজ্জায়, ভয়ে একেবারে মাটির সঙ্গে মিশে যেতে ইচ্ছে হলো ওঝার। মৃদুস্বরে বলল, ‘আমার নিজেরও এ ব্যাপারে কিছু জানা ছিল না, হুজুর।

ভীষণ অবাক হলেন দেবদূত। একজন ওঝা কেমন করে দেবরাজের আরাধনার নিয়ম না জানতে পারে? এসব নিয়েই তো ওঝাদের কারবার। ‘তোমার আগে সাসাকোর ওঝা কে ছিল?’

‘আমার বাবা, হুজুর।’

‘তার আগে?’

‘আমার দাদা।’’

‘তারও আগে?’

‘আমার পরদাদা, হুজুর।’

‘এরা কেউই তোমাদের দেবরাজের উপাসনার ব্যাপারে কিছু বলেনি?’

‘জী না, হুজুর।’

‘কলিকাল, ঘোর কলিকাল,’ গর্জাতে-গর্জাতে বললেন দেবদূত। ছোট পরিসরে পায়চারি করছেন তিনি। কিছু একটা নিয়ে গভীরভাবে ভাবছেন। আচমকা থমকে দাঁড়িয়ে ওঝার দিকে তাকালেন দেবদূত। চোখ-মুখ উজ্জ্বল, যেন কঠিন কোন সমস্যার সমাধান পেয়ে গেছেন।

‘পুরো ব্যাপারটাতে তোমার বংশের দোষই সবচেয়ে বেশি দেখতে পাচ্ছি আমি। দেবরাজের কথা সবাইকে জানানোর দায়িত্বটা তোমাদেরই ছিল। তোমরা অপরাধী, ভয়াবহ অপরাধ করেছ। স্বীকার করো এটা?’

‘স্বীকার করি, হুজুর। আমরা অপরাধী।’

‘অপরাধের শাস্তি পেতে হবে তোমাকে। তোমার নিজের অপরাধের জন্য তো বটেই, পূর্বসুরিদের কৃতকর্মের শাস্তিও তোমাকেই ভোগ করতে হবে।’

‘আমি প্রস্তুত, হুজুর। যে কোন শাস্তি মাথা পেতে নেব। আমায় সাজা দিন।’

‘উঠে দাঁড়াও,’ ওঝার দিকে তাকিয়ে বললেন দেবদূত। তারপর ফিরলেন কিকার দিকে। ‘তুমিও।

চট করে উঠে দাঁড়াল দু’জনেই। এখনও অধোবদন হয়ে আছে। নীরব, চিন্তিত। নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে সন্দিহান। জানা নেই, কতটা ভয়াবহ শাস্তির সম্মুখীন হতে চলেছে।

নিজের পিছন দিকটায় হাত বাড়িয়ে, ছোট একটা মাটির পাত্র আর একখানা রঙচঙে খুলি বের করে আনলেন দেবদূত। তাঁর পিঠের ঝোলাটা দীঘল চুলের আড়ালে ঢাকা পড়ে আছে, ইতিপূর্বে কেউই সেটা লক্ষ করেনি। দেবদূতের নির্দেশে লানু নদী থেকে পাত্রটায় পানি ভরে নিয়ে এল ওঝা। রঙিন খুলিটা রাখা হয়েছে মঞ্চের তাকিয়ার উপর। বড্ড জীবন্ত মনে হচ্ছে ওটাকে। একনজরে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না, গায়ে কাঁটা দেয়। মাটির পাত্রটা ওটার পাশে রাখলেন দেবদূত। তারপর এক কদম পিছনে সরে এলেন। তাঁর দেখাদেখি ওঝা এবং কিকাও খানিকটা পিছিয়ে গেল। বাওয়ারা যে যার জায়গায় ঠায় বসে আছে এখনও, একচুলও নড়েনি কেউ। যতদূর সম্ভব দু’হাত প্রসারিত করে আকাশের দিকে মুখ তুলে দাঁড়ালেন দেবদূত। তারপর নিচু গলায় প্রার্থনা শুরু করলেন। দেবরাজ জারালকে ডাকছেন তিনি।

ধীরে-ধীরে মৃদু ধোঁয়া উঠতে শুরু করল পাত্রের পানি থেকে! যেন অদৃশ্য কোন আগুন জ্বলছে ওটার নীচে, আর তাতেই উত্তাপ পাচ্ছে পাত্রের তরল।

দেবদূত মোটেও গলা চড়ালেন না। কিন্তু ধোঁয়ার পরিমাণ ক্রমেই বাড়তে লাগল। একসময় রীতিমত ফুটতে শুরু করল পাত্রের জল। ছলকে পড়তে লাগল পাশে রাখা খুলিটার উপর।

প্রার্থনায় ক্ষান্ত দিলেন দেবদূত। ওঝা এবং কিকাকে ইশারা করে এগিয়ে গেলেন পাত্রটার দিকে। দু’হাত নাড়িয়ে সরিয়ে দিলেন উপরে জমে থাকা ধোঁয়ার ভারী আস্তরণ।

ভিতরে তাকিয়ে অস্ফুট শব্দ করে উঠল ওঝা এবং কিকা। ভীষণ চমকে গেছে দু’জনেই।

পাত্রের পানির উপর অস্পষ্ট কিছু খণ্ডচিত্র দেখতে পাচ্ছে ওরা। প্রাচীন কিছু বাওয়া মানুষের ছবি, যারা বহুকাল আগে এই সাসাকোতেই বসবাস করত। অন্তরের অন্তস্তল থেকে উপলব্ধি করল ওরা, মানুষগুলো অপরিচিত নয়, তাদেরই পূর্বপুরুষ।

প্রত্যেককেই দেখা গেল বিচিত্র ধরনের আরাধনায় মগ্ন। দেবদূত যেমনটা বলেছিলেন, অনেকটা সেরকমই তাঁদের কার্যকলাপ। মনে হচ্ছে, দেবরাজ জারালের পূজা অর্চনাতেই ব্যস্ত সবাই। একসময় সত্যিই তাহলে দেবরাজের উপাসনা হত সাসাকোয়! কালের আবর্তে বাওয়ারা সেটা ভুলে গেছে। অকারণে রাগেননি দেবরাজ জারাল। আচমকা আবারও ফুটতে শুরু করল পাত্রের পানি, নিমিষেই মিলিয়ে গেল ছবিগুলো। সে জায়গা আবারও দখল করে নিল সফেদ ধোঁয়ার দঙ্গল।

সবাইকে চমকে দিয়ে নড়ে উঠল খুলিটা। তারপর সবার চোখের সামনেই শূন্যে ভাসতে শুরু করল! ফুটখানেক উপরে উঠে থামল ওটা, স্থির হয়ে রইল ওখানেই।

প্রার্থনার ভঙ্গিতে হাতজোড় করলেন দেবদূত, চোখ মুদলেন। ‘ওঝার শাস্তি কী হবে, প্রভু?’

বহুক্ষণ ধরে প্রশ্নের জবাব দিল না কেউ। একমাত্র দেবদূতই চোখ বন্ধ করে আছেন, বাকি সবাই ছানাবড়া চোখ নিয়ে নির্নিমেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শূন্যে ভাসমান খুলিটার দিকে।

তাদের ধৈর্যের বাঁধ ভাঙার ঠিক আগমুহূর্তে শীতল একটা কণ্ঠ ভেসে এল খুলিটার ভিতর থেকে। ‘মৃত্যুদণ্ড।’

চার

ওঝার মৃত্যুদণ্ড রদ করার সর্বাত্মক চেষ্টা করল কিকা। কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না। তার সমস্ত কাকুতি-মিনতি বৃথা গেল, খুলির মুখ দিয়ে আর একটা শব্দও উচ্চারণ করলেন না দেবরাজ জারাল। রায় ঘোষণার পর-পরই আগের অবস্থানে নেমে এসেছে ওটা। অনড় পড়ে রয়েছে মাটির পাত্রটার পাশে।

প্রচণ্ড এক ধমকে কিকাকে নিবৃত্ত করলেন দেবদূত। না হয় সারা রাতই দেবরাজের কাছে ওঝার প্রাণভিক্ষা চাইত সে। তাতে হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি, বিরক্ত হতে পারেন দেবরাজ। এটাই বাওয়াদেরকে বুঝিয়ে বললেন দেবদূত।

দেবরাজের সামনে অন্য দেবতারাই যেখানে কথা বলার সাহস পায় না, সেখানে তুচ্ছ এক বাওয়া সর্দারের বাড়াবাড়ি না করাটাই মঙ্গলজনক।

বুঝল কিকা। অদৃষ্টের লিখন, না যায় খণ্ডন।

ওঝার মৃত্যুদণ্ড কীভাবে কার্যকর করা হবে সে সিদ্ধান্তের ভার বাওয়াদের উপরই ছেড়ে দিলেন দেবদূত। নিজ থেকে কোন উপায় বাতলে দেয়া থেকে বিরত থাকলেন। এতেই বাওয়ারা তাঁর প্রতি ভীষণ কৃতজ্ঞ হয়ে পড়ল। তারা জানে, চাইলেই নৃশংস কোন পন্থায় ওঝার প্রাণদণ্ড কার্যকর করতে পারতেন দেবদূত, সে ক্ষমতা তাঁর আছে।

প্রবীণ বাওয়ারা একত্রিত হয়ে আলোচনায় বসল। বয়স নিতান্ত কম হলেও ভাবি সর্দার হিসেবে, কিকাও যোগ দিল তাতে। দীর্ঘক্ষণ আলাপচারিতা শেষে সিদ্ধান্ত হলো, পরদিন ভোরবেলায় কার্যকর করা হবে ওঝার দণ্ড। রাতে কাজটা করা যাবে না কিছুতেই। রাতের বেলা প্রাণী হত্যা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ সাসাকোয়, যুগ- যুগ ধরে এই নিয়মই চলে আসছে এখানে।

বাওয়াদের সিদ্ধান্তে হস্তক্ষেপ করলেন না দেবদূত। শাশ্বতকালের নিয়ম ভাঙার কোন প্রয়োজন নেই। একটা রাতের আয়ু না হয় বেশিই পেল ওঝা, কী আসে-যায় তাতে?

সবাই জানে, পালাবে না ওঝা, তবুও কড়া পাহারায় রাখা হলো তাকে। চারজন যোদ্ধার সশস্ত্র প্রহরায় বেঁধে রাখা হলো টামবারানের সামনে। এই টামবারানের ভিতরেই দেবদূতের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে, তিনি নিজেই বেছে নিয়েছেন জায়গাটা। সাধারণ মানুষের পক্ষে কিছুতেই টামবারানের ভিতরে রাত কাটানো সম্ভব নয়, কিন্তু দেবরাজ জারালের দূতের তো আর প্রেতাত্মাদের ভয় নেই। বরঞ্চ প্রেতাত্মারাই আজ কেউ টামবারানের ছায়া মাড়ানোর সাহস করবে বলে মনে হয় না।

ভোরেই জেগে উঠল গোটা সাসাকো। আজ তাদের জন্য একটা বিশেষ দিন। কারণ আজ থেকেই শুরু হতে চলেছে শুদ্ধি অভিযান, অতীতের পাপকর্মের কালিমা মোচনের পালা। ওঝার মৃত্যুদণ্ডের মধ্য দিয়ে সূচনা হতে চলেছে সে প্রক্রিয়ার।

প্রথমটায় ঠিক হলো, লানু নদীতে ডুবিয়ে মারা হবে ওঝাকে। দু’জন শক্তিশালী বাওয়া যোদ্ধা সজোরে পানির তলায় চেপে ধরে রাখবে তাকে। ধরাধাম ত্যাগ করতে খুব একটা সময় লাগবে না ওঝার। পুরো ঘটনা ঘটবে জলের তলায়, তাই ওঝার মৃত্যুযন্ত্রণাও কারও চোখে পড়বে না।

প্রস্তাবটা প্রায় সবারই পছন্দ হলো। যন্ত্রণাক্লিষ্ট একটা মুখ, কারই বা দেখতে ইচ্ছে হয়?

ওঝা নিজেই গিয়ে নদীর জলে নামল। বুক পানিতে নেমে স্থির হয়ে দাঁড়াল। নিয়তি মেনে নিয়েছে সে, কোনরকম অস্থিরতা নেই তার মধ্যে। শান্ত, সৌম্য, মৃত্যুকে বরণ করে নেয়ার জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত। কিন্তু বিপত্তি বাধল অন্যখানে। কোন যোদ্ধাই এগিয়ে গেল না ওঝাকে চেপে ধরার জন্য!

একে-একে শক্তিশালী যোদ্ধাদের প্রায় সবাইকেই ডাকল ওঝা, কিন্তু কেউই তার ডাকে সাড়া দিল না। কিকাও কাউকে আদেশ দিতে পারল না, কারণ আইনত এখনও সর্দার হয়নি সে। তাকে কুফলু পাখির পালকে গড়া মুকুটটা পরানোর সুযোগ পায়নি ওঝা। আর সর্দার ছাড়া অন্য কারও আদেশই মানতে বাধ্য নয় বাওয়ারা! নিজেকে নিজে ডুবিয়ে মারা যায় না। তাই খানিকক্ষণ বৃথা চেষ্টা করে গোমড়া মুখে নদী থেকে উঠে এল ওঝা। এবার নিজেই একটা প্রস্তাব রাখল সে। কোমর সমান গর্ত খুঁড়ে, মাটি চাপা দেয়া হোক তাকে। তারপর সবাই একযোগে পাথর ছুঁড়ে মারুক তার দিকে। এতে করে বিশেষ কেউ আর অপরাধবোধে ভুগবে না। কারণ সবারই সমান অংশগ্রহণ থাকবে পুরো প্রক্রিয়ায়।

যৌক্তিক প্রস্তাব, তাই ব্যাপারটা অনুমোদন করলেন দেবদূত। গর্ত খুঁড়তে সময় লাগল না, নিমিষেই কাজটা করে ফেলল শ্রমিক বাওয়ারা। ওঝা গিয়ে ওখানটায় দাঁড়ালে, কোমর পর্যন্ত মাটি চাপা দেয়া হলো তাকে। সবাই মাঝারি আকারের পাথর তুলে নিল হাতে, তারপর গিয়ে গোল হয়ে দাঁড়াল ওঝার চারদিকে। দেবদূতের সংকেত পেলেই একযোগে পাথর ছুঁড়বে সবাই। এহেন প্রস্তরবৃষ্টি থেকে প্রাণে বেঁচে যাওয়ার কোন সম্ভাবনাই নেই ওঝার। যথাসময়ে সংকেত দিলেন দেবদূত।

একবার নয়, পরপর তিনবার!

কিন্তু দেখা গেল, একজন বাওয়াও পাথর ছোঁড়েনি! প্রত্যেকেই নিজ-নিজ জায়গায় অনড় দাঁড়িয়ে আছে। কারও-কারও চোখে টলমল করছে অশ্রুজল।

বলা বাহুল্য, এ পদ্ধতিতেও হত্যা করা সম্ভব হলো না ওঝাকে।

.

ভীষণ রেগে গেলেও খুব একটা চোটপাট করলেন না দেবদূত। বাওয়াদের আবেগের ব্যাপারটা বুঝতে মোটেও কষ্ট হচ্ছে না তাঁর। শেষটায় নিজেই একটা উপায় বাতলে দিলেন।

বাওয়ারা প্রত্যেকেই মনে-মনে স্বীকার করতে বাধ্য হলো, এবার আর কিছুতেই প্রাণদণ্ড ঠেকানো যাবে না ওঝার। তবে এ পদ্ধতিতেই সম্ভবত তার মরণযন্ত্রণা সবচেয়ে কম হবে।

ঠিক হলো, বিষপ্রয়োগে মারা হবে ওঝাকে। তিতাম গাছের রস দিয়ে বানানো বিষ।

বাওয়ারা বড় কোন জানোয়ার শিকারে গেলে, এ বিষ সঙ্গে করে নিয়ে যায়। কোনমতে শিকারকে কোণঠাসা করা সম্ভব না হলে, এই বিষ প্রয়োগ করা হয়। মোষ, গণ্ডার থেকে শুরু করে বিশালাকার ভ্যারল পর্যন্ত সহজেই কাবু হয়ে যায় তিতামের বিষে।

তিতাম গাছের তলায় প্রায়শই মৌমাছি, পোকামাকড় আর ছোট পাখি মরে পড়ে থাকতে দেখা যায়। তিতামের বর্ণিল ফুল থেকে মধু খেতে আসাটাই কাল হয় ওদের জন্য। মধুর সঙ্গে-সঙ্গে খানিকটা বিষও ওদেরকে উপহার দেয় তিতাম আর প্রাণ কেড়ে নিতে কেবলমাত্র একফোঁটা তিতামের বিষই যথেষ্ট।

অস্ত্রাগার থেকে আনা হলো তিতামের রস। পাকা বাঁশের মোটা নলের ভিতর রাখা হয় এই বিষ। সংগ্রহের পরপরই মুখে ছিপি এঁটে দেয়া হয়। রাখা হয় সাধারণের নাগালের বাইরে, অস্ত্রাগারের গোপন কুঠুরিতে। যেখানে কেবল যোদ্ধাদেরই প্রবেশাধিকার আছে।

ওঝাকে একটা লম্বা পাটাতনে শোয়ানো হলো। পাতা দিয়ে ঢেকে দেয়া হলো দু’চোখ।

বিষের পাত্র আর একখানা ধারাল ছুরি নিয়ে তার দিকে এগিয়ে গেল কিকা হাঁটু গেড়ে বসল তার পাশে। তারপর ওঝার হাতটা নিজের হাতে তুলে নিয়ে আলতো করে ছুরি ছোঁয়াল তাতে।

ধারাল ফলার স্পর্শ পেতেই দ্বিখণ্ডিত হলো ত্বক, বেরিয়ে এল রক্তের ক্ষীণ ধারা। খুব সাবধানে তাতে ফোঁটায় ফোঁটায় বিষ ঢালল কিকা। তারপর হাতটা খানিকক্ষণ উপরেই ধরে রাখল, যেন রক্তের ফোঁটা মাটিতে না পড়ে। নিমিষেই শিরাপথে ওঝার দেহের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়ল গরলের দল। আর ধরে রাখার প্রয়োজন নেই বুঝতে পেরে হাতটা ছেড়ে দিয়ে পিছিয়ে এল কিকা। বুকের ভিতরটা ভেঙেচুরে তছনছ হয়ে যাচ্ছে তার। জানে, আর বেশিক্ষণ বাঁচবে না ওঝা। তিতামের বিষ ঠেকানোর সাধ্য নেই কোন মানুষের।

এই মানুষটাই তাকে শৈশবে হাত ধরে-ধরে শিখিয়েছে অনেক কিছু। সর্দারের ছেলের শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে ওঝা, এটাই বাওয়া সমাজের প্ৰথা। –

মুখ দিয়ে কোন আর্তনাদ বেরোল না ওঝার। শুধু বারকয়েক খিঁচুনি উঠল গোটা শরীরে। হাতদুটো মুষ্টিবদ্ধ হয়ে গেল তার, কুঁচকে গেল মুখের চামড়া। তারপর আচমকা পুরোপুরি নিথর হয়ে গেল তার দেহ, সব শেষ। কান্নায় ভেঙে পড়ল কিকা। তবে তাকে সান্ত্বনা দিতে এগিয়ে গেল, না কেউ, যে যার জায়গায় ঠায় দাঁড়িয়ে রইল সবাই। নিজের দুঃখ নিজেকেই বহন করতে হয় বাওয়াদের।

পাঁচ

শোকের প্রকোপটা খানিকটা লাঘব হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন দেবদূত। তারপর মঞ্চে উঠে সবার দিকে তাকালেন তিনি। আবারও দৃঢ়চেতা ভাবভঙ্গি ফিরে এসেছে তাঁর, খানিক আগের সহনশীলতার লেশমাত্রও নেই এখন চেহারায়।

‘এবার তোমার পালা, কিকা। তুমি প্রস্তুত?’

‘আমি প্রস্তুত, হুজুর। বলুন কী শাস্তি অপেক্ষা করছে আমার জন্য,’ শান্তস্বরে . বলল কিকা।

‘শাস্তি নয়, প্রায়শ্চিত্ত। সর্দার হিসেবে অনেক ভুলই শোধরাতে হবে, যার জন্য চড়া মূল্যও দিতে হতে পারে তোমাকে। কাজগুলো তুমি নিজেও করতে পারো, চাইলে অন্য কাউকে প্রতিনিধি হিসেবেও পাঠাতে পারো। সর্দার হিসেবে এই অধিকার তোমার আছে।’

‘আমি নিজেই কাজগুলো করতে চাই, হুজুর। সাসাকোর মানুষের জন্য প্রাণ বিলিয়ে দিতেও কখনও দ্বিধা করব না আমি। যদিও এখনও সর্দার হইনি আমি, তবুও সর্দার হিসেবে আমার জীবন সবার মঙ্গলের জন্যই উৎসর্গ করা।’

সময়টা অন্যরকম হলে, সমগ্র সাসাকোবাসী চিৎকার করে তাদের সর্দারের প্রতি আনুগত্য জানাত। এটাও জানাত যে, আইনত সর্দার না হলেও, কিকাকে ওরা অনেক আগেই সর্দার হিসেবে নিজেদের অন্তরে স্থান দিয়েছে। তাই তার আদেশে যে কোন কাজই করতে প্রস্তুত ওরা।

কিন্তু এখন এই দুর্যোগঘন সময়ে, দেবদূতের সামনে, চিৎকার করার সাহস নেই কারও। তাই নীরবে মাথা দুলিয়েই কিকার প্রতি শ্রদ্ধা জানাল বাওয়ারা।

সবই দেখলেন দেবদূত। কিছুই নজর এড়াল না তাঁর।

‘একজন যোগ্য সর্দারের মতই কথা বললে তুমি, কিকা। তবে তোমাকে কাজের মাধ্যমেই নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে হবে। সবাইকে দেখাতে হবে, জিভের মতই তোমার মাথা এবং পেশীগুলোও দ্রুত চলে।’

‘প্রাণ থাকতে আমি কোন কাজে পিছপা হব না, হুজুর।’

‘বেশ। আমিও সেটাই চাই। এখন সবাই এসো আমার সাথে।’

নদীর ঘাটের দিকে হাঁটতে শুরু করলেন দেবদূত। পিছন পিছন চলল বাওয়ারা। প্রত্যেকেই খেয়াল রাখছে, তাদের পদশব্দ যেন বিরক্ত না করে দেবদূতকে। তাই এত বড় দলটা বলতে গেলে প্রায় নিঃশব্দেই নদীর ঘাটে পৌছে গেল।

পানির কিনারায় পৌছে থমকে দাঁড়ালেন দেবদূত। ঘুরে সমবেত জনতার মুখোমুখি হলেন। ‘তোমাদের কারও জানা আছে, লানু নদীর নীচ দিয়ে বয়ে চলা পাতাল নদীটার কথা?’

অস্ফুট শব্দ করে উঠল বাওয়ারা। চোখ বড়-বড় হয়ে গেছে সবার। মাটির তলায় আবার কেমন করে নদী থাকে? হাসলেন দেবদূত। তাঁর ঠিকই জানা ছিল, পাতাল নদী সম্পর্কে কোন ধারণাই নেই বাওয়াদের। ‘চলো, তোমাদেরকে এমন কিছু দেখিয়ে আনি, যা এর আগে কখনও দেখনি তোমরা। আবার কখনও দেখতে পাবে, সে সম্ভাবনাও নেই।’

কথা শেষ করেই নদীর দিকে পা বাড়ালেন দেবদূত। হাঁটতে শুরু করলেন পানির উপর দিয়ে! আগের রাতেও তাঁকে ঠিক এভাবেই পানির উপর দিয়ে হাঁটতে দেখেছিল সবাই।

তবে অল্পক্ষণের মধ্যেই বাওয়ারা যা আবিষ্কার করল, তাতে তাদের বিস্ময় বাড়ল বৈ কমল না! দেবদূত পানির উপর দিয়ে হাঁটছেন না, তিনি হাঁটছেন এক দঙ্গল কুমিরের পিঠের উপর দিয়ে! শত-শত কুমির গায়ে গা ঠেকিয়ে আড়াআড়িভাবে নদী পারাপারের একটা অস্থায়ী সাঁকো তৈরি করেছে তাঁর জন্য! কুমিরগুলোর দেহের প্রায় সবটুকুই জলের আড়ালে থাকায়, চট করে চোখে পড়ে না। দিনের আলোতেই ঠাহর করতে কষ্ট হয়, রাতের আঁধারে ওদেরকে দেখতে পাওয়া রীতিমত অসম্ভব।

শ্রদ্ধায়, ভয়ে মাথা নত হয়ে এল বাওয়াদের। কেমন করে কুমিরদের বশ করলেন দেবদূত? তাঁর ক্ষমতার পরিসীমা আঁচ করতে পেরে নিজের অজান্তেই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল সবার।

বিস্ময়ের ঘোর কাটতেই হুড়োহুড়ি করে যে যার নৌকায় চড়ে বসল বাওয়ারা। দেবদূত ততক্ষণে পৌঁছে গেছেন নদীর ওপারে। নিশ্চয়ই তিনি বাওয়াদের জন্য অপেক্ষা করে থাকাটা উপভোগ করবেন না।

সমস্ত বাওয়া ওপারে পৌঁছনোর পর তাদেরকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়াতে নির্দেশ দিলেন দেবদূত। তারপর ভীষণ মোটা একখানা গাছের গুঁড়িতে আলতো করে হাত রাখলেন। দেখতে-দেখতে একপাশে হেলে পড়ল অতবড় গাছটা, তবে পুরোপুরি লুটিয়ে পড়ল না মাটিতে। গাছটার গোড়ার দিককার শিকড়বাকড়গুলো উঠে এসেছে জমিনের উপরে। আর সেখানেই একটা ফোকরমতন তৈরি হয়েছে।

ইশারায় সবাইকে পিছু নিতে বলে সেই ফোকরটার মধ্যে গিয়ে ঢুকলেন দেবদূত। তাঁর ঠিক পিছনেই আঠার মত সেঁটে রয়েছে কিকা। অন্যরাও একে- একে তাদের সর্দারকে অনুসরণ করল।

পাতালে নামতেই বাওয়াদের চোখগুলো বিস্ময়ে পুরোপুরি ছানাবড়া হয়ে গেল। এ কোথায় এসেছে ওরা? পৃথিবীতে এমন জায়গাও বুঝি থাকতে পারে!

তাদের চোখের সামনেই বিশাল একখানা পাথুরে দেয়াল। তবে পাথরের গড়নটা অদ্ভুত, স্বচ্ছ। কাচের মতই দেয়ালের ওপাশটা স্পষ্ট চোখে পড়ছে সবার। সেখানে নীরবে বয়ে চলেছে একটা শান্ত নদী!

মাথার বেশ খানিকটা উপরে মাটির ছাদ। সেখান থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় জল চুইয়ে পড়ছে। অস্পষ্ট হলেও, লানু নদীর বয়ে চলার শব্দটা ঠিকই কানে আসছে। নদীটার ঠিক নীচেই এখন আছে সবাই।

গমগমে গলায় কথা বলে উঠলেন দেবদূত। ‘নদী দেখাতে তোমাদেরকে এখানে আনিনি আমি। এনেছি বিশেষ একটা জিনিস দেখাতে। সবাই নদীটার তলার দিকে ভাল করে তাকাও।’

তাঁর আদেশ অক্ষরে-অক্ষরে পালন করল বাওয়ারা। পাথুরে দেয়ালটার কাছাকাছি গিয়ে ভাল করে লক্ষ করল পাতাল নদীর তলদেশের দিকে। পরক্ষণেই ভীষণ চমকে উঠল।

শত-শত মানব কঙ্কালে বোঝাই হয়ে আছে জায়গাটা। রীতিমত হাড়ের স্তূপ। যতজন মানুষের হাড়গোড় পড়ে আছে এখানে, এর বিশ ভাগের একভাগ মানুষও এখন সাসাকোয় নেই।

সবার আঁতকে ওঠাটা আয়েশ করে উপভোগ করলেন দেবদূত। তাদের চোখের তারায় ফুটে ওঠা প্রশ্নবোধক চিহ্নটাও নজর এড়াল না তাঁর।

‘এরা তোমাদেরই পূর্বপুরুষ। বহুকাল আগে এরাই দাপিয়ে বেড়াত গোটা অঞ্চল, ঠিক তোমাদেরই মত। যতদিন না মালানিরা এদিকটায় সরে আসতে শুরু করে। যুগের পর যুগ মালানিদের সাথে লড়াইয়ের ফলাফল দেখতে পাচ্ছ তোমরা চোখের সামনে। এরা সবাই প্রাণ দিয়েছে সেই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে, যেন তাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নিরাপদে বসবাস করতে পারে। যেন মালানিদের হাত থেকে নিস্তার পায়।’

মালানিদের সঙ্গে দুই শতাব্দী ধরে চলা ভয়ঙ্কর যুদ্ধের কথা জানা আছে বাওয়াদের। এই যুদ্ধ নিয়ে প্রচুর কাহিনি শুনেছে ওরা বয়স্কদের মুখে।

মালানি, একরকমের বনমানুষ। বহুকাল আগে ওরা পৃথিবীর অন্য কোন কোণে বসবাস করত। সম্ভবত সপ্ত পাহাড়ের অন্য পাশে। কিন্তু খাবারে টান পড়ায় ধীরে-ধীরে ওরা সরে আসতে শুরু করল বাওয়া এলাকায়। স্বভাবতই শিকার নিয়ে ওদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে বাওয়ারা। মালানিরাও ছেড়ে কথা বলার পাত্র ছিল না। তাই খণ্ড-খণ্ড সংঘর্ষ ধারাবাহিক যুদ্ধে রূপ নেয়। দেখতে-দেখতে জাতশত্রুতে পরিণত হয় বাওয়া এবং মালানিরা। সুযোগ পেলেই একে অন্যের কলোনিতে আক্রমণ করত। দু’শো বছর ধরে একনাগাড়ে চলে এই রক্তক্ষয়ী লড়াই। কখনও অবিরাম, কখনও বা সাময়িক বিরতি দিয়ে।

অবশেষে মালানিদের কোন এক আচরণে প্রচণ্ড বিরক্ত হন আলোর দেবতা অলুরাং। মালানিদের ক্ষমতা কমিয়ে দেন তিনি, ভাগ করে দেন বিভিন্ন উপদলে। সেই উপদলগুলোই পরবর্তীতে বানর, হনুমান, শিম্পাঞ্জি, গরিলা এবং বেবুনে পরিণত হয়।

বাওয়ারা জানত, সেই যুদ্ধে প্রচুর বীর যোদ্ধা প্রাণ দিয়েছিল। কিন্তু তাদের কঙ্কাল এভাবে কোথাও একত্রে জমা করা আছে, এটা তারা কখনও কল্পনাও করেনি। আজ চোখের সামনে ওগুলোকে দেখতে পেয়ে, যুগপৎ শ্রদ্ধায় এবং বিস্ময়ে পুরোপুরি নির্বাক হয়ে গেল ওরা।

‘এখানে তোমাদের পূর্বপুরুষদের প্রায় সবাই-ই আছে। শুধু একজন ছাড়া,’ বলে উঠলেন দেবদূত।

‘কে, হুজুর?’ মৃদুস্বরে জানতে চাইল কিকা

‘বীর যোদ্ধা, লাক্রা। তার কঙ্কালই তোমাকে এখানে ফিরিয়ে আনতে হবে, কিকা। এটাই তোমার প্রথম কর্তব্য।’

‘আমি অবশ্যই ফিরিয়ে আনব, হুজুর। কোথায় আছে সেটা?’

‘পবিত্র গুহায়।’

ছয়

সপ্ত পাহাড়ে দুটো কিম্ভূতকিমাকার শৈলশিরার ঠিক মাঝখানটায় পবিত্র গুহার অবস্থান। বন্ধুর পথ, ভয়ানক বিপদসংকুল। আদিমকাল থেকেই পবিত্র গুহা জয় করাটাকে বাওয়ারা বিশেষ সম্মানের চোখে দেখে আসছে। তাই এযাবৎকালে ওপথে যাত্রা করা বাওয়া যোদ্ধাদের সংখ্যাটা নেহায়েত কম নয়। তবে তাদের বেশিরভাগই আর কখনও ফেরত আসেনি লোকালয়ে।

শুধু কয়েক যুগ আগে একজন শক্তিশালী বাওয়া সর্দার ফিরে আসতে পেরেছিল পবিত্র গুহা জয় করে। প্রয়াত সর্দার শাংকুর দাদা, কিকা তারই বংশধর। তার আনা পবিত্র গুহার বালি এখনও দেবতাদের পূজা-অর্চনায় ব্যবহার করা হয়। অজ্ঞাত কারণে এই বিশেষ বালি দেবতারা খুবই পছন্দ করেন।

শাংকুর দাদার কাছ থেকেই পবিত্র গুহার গমন পথের বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতার কথা জানতে পেরেছিল বাওয়ারা। তারপর থেকে কেউ আর পবিত্র গুহায় যাওয়ার ব্যাপারে আগ্রহ দেখায়নি। খানিকটা বাড়তি সম্মান অর্জনের জন্য পৈত্রিক প্রাণটা খোয়াতে রাজি নয় কেউ।

কিন্তু কিকার এখন ওসব ভাবার সুযোগ নেই, তাকে যেতেই হবে। অন্য কোন পথ খোলা নেই তার সামনে। দেবতাদের নাম নিয়ে সপ্ত পাহাড়ের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করল সে। দিনের আলো থাকতে-থাকতেই পৌঁছে যেতে চায় গন্তব্যে।

চেনা নদীপথ, ঘন জঙ্গল, বেশ সহজেই পেরিয়ে গেল সে। তেমন কোন বিপদ-আপদের সম্মুখীন হতে হলো না তাকে।

একটা দাঁতাল মাদী শুয়োর অবশ্য অনেকদূর পর্যন্ত তাড়া করেছিল তাকে। তবে চিতার গতিতে ছুটতে পারা কিকার টিকিটা ছোঁয়ারও সাধ্য হয়নি ওটার। চাইলেই ওটাকে মেরে ফেলতে পারত কিকা। তাতে অহেতুক দৌড়নোর ঝক্কিটা এড়ানো যেত। কিন্তু শুয়োরটার ছোট দুটো বাচ্চা দেখেছে সে। বাচ্চাদের নিরাপত্তার জন্যই প্রাণ বাজি রেখে কিকাকে তাড়া করেছিল ওটা। একটা স্নেহবৎসল মাকে মারতে মন সায় দেয়নি তার। ওটাকে মারলে, কয়েকদিনের মধ্যে বাচ্চাগুলোও মরে যেত নির্ঘাত।

সপ্ত পাহাড়ের গোড়ায় পৌঁছে প্রথম বিপদটার মুখোমুখি হলো কিকা। খুব সরু একটা পিচ্ছিল গিরিপথ পাড়ি দিতে হবে তাকে, যার দু’পাশেই গভীর খাদ। একবার পা ফসকালেই আর দেখতে হবে না, এক লহমায় কম্ম কাবার। পথটা এতটাই সরু যে, পাশাপাশি দুটো পা রেখেও দাঁড়ানো যায় না, আগুপিছু করে এগোতে হয়। সেই পথও আবার নিরবচ্ছিন্ন নয়, এখানে-ওখানে মস্ত ফাটল। ওগুলোতে পা পড়লেও খেল খতম, টুক করে হারিয়ে যেতে হবে মাটির গভীরে।

কিছুদূর চলার পরই হাড়ে হাড়ে টের পেল কিকা, এভাবে এগোলে পুরো পথ পাড়ি দেয়া কিছুতেই সম্ভব হবে না তার পক্ষে। ধীরে চললে শরীর বেশি হেলে পড়ে, নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারানোর সম্ভাবনা থাকে। তাই দ্রুতলয়ে ছুটতে শুরু করল সে। তীক্ষ্ণ নজর রাখল, ঠিক কোথায় পা ফেলছে। কদম ছোট-বড় করে আলগা নুড়ি এবং ফাটলগুলো এড়িয়ে চলার যথাসাধ্য চেষ্টা করছে সে। তবুও বেশ কয়েকবারই পা হড়কাল তার। কোনমতে পড়তে-পড়তে বাঁচল। তবে শেষ অবধি পথটা পেরোতে পারল সে, মোটামুটি অক্ষত অবস্থায়ই। পরের বিপদটা এল অতর্কিতে, কোনরকম সতর্ক বার্তা ছাড়া। একটা তীক্ষ্ণ বাঁক ঘুরতেই একপাল বানরের মুখোমুখি হতে হলো তাকে। এখানে-ওখানে, গাছের ডালে, পাথরে, শত- শত বানর। এক নজরেই বুঝতে পারল কিকা, এটাই ওদের আবাসস্থল। ওদের বাড়ির উঠন চিরেই এগিয়ে গেছে পথটা।

কিকাকে দেখামাত্রই ক্রুদ্ধ হয়ে উঠল বানরের দল। নিজের বাসায় অনাহূত অতিথির অনুপ্রবেশ, কে-ই বা পছন্দ করে?

নেতৃস্থানীয় গোটা কয়েক বানর এগিয়ে এল কিকার দিকে। দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে বিকট ভেংচি কাটছে ওগুলো। বাকিরাও নিশ্চুপ নেই, যে যার জায়গায় বসে থেকেই ভয়ানক চেঁচামেচি জুড়ে দিয়েছে সবক’টা মিলে। ওদের সম্মিলিত চিৎকারে কানের পর্দা ফাটার জোগাড় হলো কিকার। প্রচণ্ড ভয় পেলেও মাথা ঠাণ্ডা রাখল সে। জানে, একটামাত্র ভুল পদক্ষেপই মুহূর্তের ব্যবধানে লাশে পরিণত করবে তাকে। একপাল ক্রুদ্ধ বানর একযোগে ঝাঁপিয়ে পড়লে, মাংসের দলায় পরিণত হতে খুব একটা সময় লাগবে না।

আগুয়ান বানরগুলোর চোখে-চোখে তাকাল কিকা। সে ভয় পেয়েছে, এটা যেন ওরা কিছুতেই বুঝতে না পারে, সেদিকে খেয়াল রাখল। শিকার ভয় পেয়েছে · বুঝতে পারলে, অতি উৎসাহী হয়ে সময়ের আগেই আক্রমণ করে বসতে পারে দলের কোন অনভিজ্ঞ তরুণ। আর একবার ব্যাপারটা শুরু হয়ে গেলে বাকিরাও হাত গুটিয়ে বসে থাকবে না।

খুব ধীরে-ধীরে চার হাতপায়ে হামাগুড়ি দিয়ে বসল কিকা। বারদুয়েক চোখ বুজে দেবতাদের স্মরণ করতেও ভুলল না। মুখ খুলে লম্বা দম নিতে শুরু করল সে, যতটা সম্ভব বাতাস ভরে নিতে চায় ফুসফুসে। যে একমাত্র অস্ত্রটা প্রয়োগ করতে চলেছে সে, তাতে দেবতাদের অনুগ্রহের পাশাপাশি বুক ভরা বাতাসও তার খুবই দরকার। আচমকা গলা ফাটিয়ে ভয়ঙ্কর গর্জন করে উঠল কিকা! চিতাবাঘের ডাক নকল করছে সে। অনেক পশুপাখির ডাকই অনুকরণ করতে পারে বাওয়ারা, শিকারের সময় কাজে লাগে। আজ নিজে শিকার হওয়ার হাত থেকে বাঁচতেও হয়তো কাজে লাগতে পারে বিদ্যাটা।

চিতাবাঘকে যমের মত ভয় পায় বানরেরা। কারণ তাদের মত গাছে চড়ার বিদ্যাটা চিতাবাঘেরও জানা আছে। চট করে গাছের মগডালে চড়ে অন্য শিকারি প্রাণীর হাত থেকে বাঁচা সম্ভব হলেও, চিতাবাঘের হাত থেকে নিস্তার পায় না ওরা। এহেন শত্রুকে ভয় না পেয়ে উপায় কী?

এক লহমায় থেমে গেল বানরের দলের চেঁচামেচি। অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওরা কিকার দিকে। অন্তরের অন্তস্তল থেকে অনুভব করছে, ভয় পাওয়া উচিত। কিন্তু সামনে দাঁড়ানো প্রাণীটাকে ঠিক চিতাবাঘের মত লাগছে না ওদের কাছে, তাই সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে।

সুযোগটা কাজে লাগল কিকা। গর্জন করতে-করতে এক কদম সামনে বাড়ল। সেই সঙ্গে ডানহাতের থাবাটা সজোরে নামিয়ে আনল মাটির উপর। যেন ভয়ানক রেগে গেছে সে!

আর কোন দ্বিধা রইল না বানরদের। পড়িমরি করে ছুট লাগল। চোখের নিমিষে লুকিয়ে পড়ল ঘন পাতার আড়ালে, সন্দেহের বশবর্তী হয়ে প্রাণ খোয়াতে রাজি নয় কেউ।

চটজলদি জায়গাটা পেরিয়ে গেল কিকা। জানা আছে, যে কোন মুহূর্তে সাহস সঞ্চয় করে ফিরে আসতে পারে বানরের দল। দ্বিতীয়বার একই কৌশল খাটবে না ওদের উপর।

কিছুদূর এগোনোর পর দস্তুরমতন ঘামতে শুরু করল কিকা। প্রথমটায় ভাবল, খানিকক্ষণ আগের উত্তেজনার কারণেই এমনটা হচ্ছে। মনের উপর দিয়ে ধকলটা তো আর কম যায়নি! তবে অল্পক্ষণের মধ্যেই ভুলটা ভাঙল তার।

একটা মাঝারি আকারের প্রান্তরের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে সে, যার পুরোটাই ঢেকে আছে গনগনে লাভায়! ফুটন্ত পানির মতই টগবগ করে ফুটছে ওগুলো, কালচে ধোঁয়ারও কোন কমতি নেই। সেই সঙ্গে গোটা জায়গাটা ঘিরে আছে তীব্র ঝাঁঝাল এক বিচ্ছিরি গন্ধ। শ্বাস টানতেও বেশ কষ্ট হচ্ছে।

প্রচণ্ড উত্তাপে পাগল হওয়ার জোগাড় হলো কিকার। ভেবেই পেল না, কী করে পার হবে জায়গাটা। উদ্ভ্রান্তের মত এদিক-ওদিক তাকাল সে। কিন্তু বিকল্প কোন পথই তার নজরে পড়ল না। এতদূর এসে খালি হাতে ফিরতে হবে, এটা ভাবতেই বুকটা হু-হু করে উঠল তার। সেখানেই বসে পড়ে ডুকরে কেঁদে উঠল সে। বারকয়েক চিৎকার করে দেবতাদের ডাকল সে, পাহাড়ে পাহাড়ে প্রতিধ্বনি তুলল তার আহাজারি। কিন্তু কোন জবাব মিলল না।

তবে শেষমেশ দেবতারা বোধকরি তার ডাক ঠিকই শুনলেন। আচমকা একঝলক ঠাণ্ডা বাতাস এসে হাজির হলো ওখানটায়। উত্তাপ কমে গেল অনেকখানি, শ্বাস নেয়ার কষ্টটাও আর রইল না। সেই সঙ্গে দূর হলো বাষ্পের ভারী পর্দা। আর তাতেই প্রান্তরটা পেরোবার একটা উপায় খুঁজে পেল কিকা!

তরল লাভার এখানে-ওখানে বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মত মাথা তুলে আছে কিছু পাথরের চাঁই। চেষ্টা করলে হয়তো ওগুলোর উপর দিয়ে লাফিয়ে-লাফিয়ে প্রান্তরটা পেরোনো যাবে।

চট করে উঠে পড়ল কিকা। সময় নষ্ট করার সুযোগ নেই, যে কোন মুহূর্তে ভারী বাষ্প আর কালচে ধোঁয়ায় আবারও ঢেকে যেতে পারে পাথরগুলো। ঠাণ্ডা বাতাস খুব বেশি সময় ধরে লড়াই চালিয়ে যেতে পারবে না। গাছের ছাল-বাকল দিয়ে মোজামতন তৈরি করে পায়ে জড়িয়ে নিল কিকা। কোন সন্দেহ নেই, ভয়ানক গরম হয়ে আছে সবক’টা পাথর। খালি পায়ে দাঁড়ানো মাত্রই পুড়ে ছাই হয়ে যাবে পায়ের পাতা। বাধ্য হয়েই তখন উত্তপ্ত লাভায় আত্মাহুতি দিতে হবে।

একপলক পাথরগুলোর দিকে তাকিয়ে একটা সরলরৈখিক পথ ঠিক করে নিল সে। তারপর ছুটতে শুরু করল। লাফিয়ে-লাফিয়ে এগোচ্ছে, কোন পাথরেই দাঁড়াচ্ছে না। একবার ক্ষণিকের জন্য পিছলে গেল পা, ধপাস করে আছড়ে পড়ল সে পাথরের উপর। পরক্ষণেই হাঁচড়েপাঁচড়ে উঠে দাঁড়াল সে। ততক্ষণে তার শরীরের এখানে-ওখানে ফোসকা পড়ে গেছে। গরম পাথরের ছোঁয়া লেগেছে জায়গাগুলোয়।

পাথরটা আকারে বিশাল ছিল বলেই এযাত্রা প্রাণে বেঁচে গেল সে। অন্যথায় লাভা সরোবরেই অক্কা পেতে হত তাকে।

অবশেষে গুহামুখে যখন পৌঁছল ও, সূর্য ততক্ষণে বিদায় নেবার তোড়জোড় করছে। পাহাড়ের উপরে বলে এখনও খানিকটা আলো পাওয়া যাচ্ছে, নীচের দিকে ইতোমধ্যেই সাঁঝ ঘনিয়ে গেছে। গুহামুখের আশপাশে প্রচুর কুফলু পাখির পালক পড়ে থাকতে দেখল কিকা। কিন্তু একটা পাখিকেও দেখা গেল না কোথাও।

প্রায়ই কি পবিত্র গুহায় আসে কুফলুরা? কেন আসে?

গাছের মোটা একটা ডাল দিয়ে, চটজলদি ছোট একটা মশাল বানিয়ে নিল কিকা। আলো ছাড়া পবিত্র গুহায় ঢোকার কোন মানে হয় না। ততক্ষণে পুরোপুরি নেমে এসেছে আঁধারের চাদর, কয়েক হাত দূরের জিনিস ঠাহর করাও কষ্টকর এখন।

দুরু-দুরু বুকে পবিত্র গুহার দিকে পা বাড়াল কিকা। উত্তেজনায় কাঁপছে তার গোটা শরীর। অবশেষে পৌঁছতে পেরেছে সে পবিত্র গুহায়, বাওয়াদের সবচেয়ে আরাধ্য জায়গায়। কত বীর যোদ্ধা এখানে আসতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছে, তার খবর কে বলতে পারে!

মশালের আলোয় গুহার ভিতরকার জমাট আঁধার দূর হতেই তীব্র আতঙ্কে পুরোপুরি জমে গেল কিকা! শীতল শিহরণ বয়ে গেল তার শিরদাঁড়া বেয়ে। নিজের চোখজোড়াকেও অবিশ্বাস করতে ইচ্ছে হচ্ছে তার। পবিত্র গুহার দেয়ালে- দেয়ালে অসংখ্য আঙটা গাঁথা। তার একটাও খালি নেই, প্রত্যেকটাতেই ঝুলছে কোন না কোন নরকঙ্কাল! সবক’টা বহুদিনের পুরানো, ক্ষয়া।

দেয়ালগুলোয় কালচে রঙের কালিতে বিজাতীয় ভাষায় কিছু লেখা রয়েছে। অক্ষরজ্ঞান নেই কিকার, তাই লিপিগুলোর মর্ম উদ্ধার করা সম্ভব হলো না তার পক্ষে। তবে এটুকু ঠিকই বুঝতে পারল, তাজা রক্ত দিয়ে লেখা হয়েছিল কথাগুলো। কালের আবর্তে এখন কালচে হয়ে গেছে রঙ।

ঝকঝকে-তকতকে গুহার প্রতিটি দেয়াল, যেন নিয়মিত ঝাঁট দেয় কেউ! কোথাও একরত্তি মাকড়সার ঝুলও নেই। বদ্ধ গুমট বাতাস এতটাই ভারী, যেন হাতের মুঠোয় ধরা যাবে ওগুলোকে!

পুরো ব্যাপারটাই ভয়ানক অশুভ। প্রচণ্ড ভয় পাচ্ছে কিকা। ষষ্ঠ ইন্দ্ৰিয় জানান দিচ্ছে তাকে, পালিয়ে যাও এখান থেকে, জলদি পালাও।

কিকা ভেবেছিল রাতটা এখানেই কাটিয়ে দিয়ে সাতসকালে ফিরতি পথ ধরবে। কিন্তু সিদ্ধান্ত বদলাতে বাধ্য হলো সে। যত দ্রুত এখান থেকে পালানো যায়, ততই মঙ্গল।

পবিত্র গুহার বালির আলাদা কদর আছে, তাই দ্রুতহাতে কিছু বালি থলেতে পুরে কোমরে বেঁধে নিল সে। দেবতাদের উপাসনায় কাজে দেবে।

পরক্ষণেই একটা সমস্যা প্রকট হয়ে ধরা পড়ল তার মাথায়।

কোটা বীর যোদ্ধা লাক্রার কঙ্কাল? এতগুলো কঙ্কালের ভিতর থেকে কেমন করে খুঁজে বের করবে সে ওটাকে? অনেক ভেবেচিন্তে গুহামুখের সবচেয়ে কাছের কঙ্কালটাকে তুলে নিল সে। মন বলছে, এটাই হবে। যদি না হয়, আর কী-ই বা করার আছে তার?

কঙ্কালটাকে কষে নিজের পিঠের সঙ্গে বেঁধে নিল কিকা। অনেক জায়গাতেই ছুটতে হবে তাকে, হাতে বহন করা সম্ভব নয় ওটাকে।

কাজ শেষে জ্বলন্ত মশাল হাতে বাইরে বেরিয়ে এল কিকা। ফিরতি পথে রওনা দেয়ার জন্য মানসিকভাবে তৈরি।

তবে বাইরের পরিস্থিতি ততক্ষণে আমূল বদলে গেছে। কিকাকে অভ্যর্থনা জানাতে অপেক্ষা করছে একদল শিকারি!

ওদের উপর চোখ পড়তেই পিলে চমকে উঠল কিকার! বাঁচার আশা পুরোপুরি ছেড়ে দিল সে। অসংখ্য কুফলু পাখি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে আছে চারপাশে। গুহার ভিতরে থাকায়, তাদের আগমনের ব্যাপারটা এতটুকুও টের পায়নি কিকা।

কুফলুরা এমনিতেই নিঃশব্দে চলাচল করে। তার উপর নিজের ভাবনা-চিন্তায় এতটাই মজে ছিল কিকা, বাইরের মৃদু শব্দগুলো সহজেই তার কান এড়িয়ে গেছে।

ওকে দেখতে পেয়ে কুফলুদের প্রায় সবার চোখেই তীব্র আগ্রহ দেখা দিল। যদিও ভরপেট খাবার খেয়েই ঘরে ফিরেছে সবাই, তবে বাড়তি ডেজার্ট হিসেবে কিকাকে খেতে মোটেও আপত্তি নেই ওদের। মানুষ কি আর রোজ-রোজ মেলে?

বিড়ালের মত মৃদু গর-গর শব্দ বেরিয়ে আসছে কুফলুদের গলার গভীর থেকে। ধীরে-ধীরে কিকার দিকে এগিয়ে আসতে শুরু করল ওরা।

পিছিয়ে যেতে চাইল কিকা, আপাতত গুহাতেই আবার ফিরে যাওয়ার ইচ্ছে তার।

কিন্তু বিধি বাম। হঠাৎই খেয়াল করল, পিছন দিক থেকেও এগিয়ে আসছে কুফলুরা, গুহায় ফিরে যাওয়ার কোন উপায়ই নেই তার।

আদতে বিশাল একখানা বৃত্তের মতই তাকে ঘিরে ফেলেছে কুফলুরা। এখন আস্তে-ধীরে বৃত্তের পরিধিটা গুটিয়ে আনছে।

প্রাণভয়ে এদিক-ওদিক বারকয়েক তাকাল কিকা, যদি মুক্তির কোন উপায় মেলে। ঠিক তখনই বৃত্তের ছোট একটা ফাঁক আবিষ্কার করতে পারল তার অনুসন্ধানী চোখ। ওদিকটায় নিচু পাথরের দেয়াল, তার ওপাশে বিশাল খাদ। উপর থেকে তাকালে তল পর্যন্ত দৃষ্টি পৌঁছয় না, এতটাই গভীর।

কিন্তু আচমকা ওদিকেই দৌড়তে শুরু করল কিকা, প্রবল বেগে ছুটে গেল নিচু দেয়ালটার দিকে। প্রয়োজনে পাথরে থেঁতলে মরবে, তবুও কুফলুদের খাবার হতে রাজি নয় সে।

শিকারিরা সতর্ক হওয়ার আগেই ফাঁকটা পেরিয়ে গেল কিকা। দেয়ালটা টপকে অন্ধের মত ঝাঁপিয়ে পড়ল উল্টোপাশে।

অনন্তকাল শূন্যে ভাসার পর গাছের ডালের উপর পতনের তীব্র যন্ত্রণাটা ঠিকই অনুভব করল সে, তারপর আর কিছু মনে নেই তার।

সাত

জ্ঞান ফেরার পর নিজেকে একটা খাঁড়ির বালিয়াড়িতে আবিষ্কার করল কিকা। ততক্ষণে বিশ্রাম শেষে ঊর্ধ্বগগনে ফিরে এসেছে ভোরের সূর্য, আলো বিলাতে শুরু করেছে। বুকে-পিঠে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করছে কিকা, হাড় ভেঙেছে কি না কে জানে!

গোটা শরীরের এমন কোন জায়গা নেই, যেখানটায় কাঁটা-ঝোপের আঁচড় লাগেনি। পাহাড়ের উপর থেকে গড়িয়ে পড়ার সময় জঙ্গলের কাছ থেকে ওগুলো উপহার পেয়েছে সে।

কেমন করে লানু নদীতে ভাসতে ভাসতে এই খাঁড়িতে এসে পৌঁছেছে, এ ব্যাপারে বিন্দুমাত্র ধারণাও নেই তার। প্রাণে বেঁচে গেছে, এতেই খুশি সে। সে-ই সম্ভবত প্রথম বাওয়া মানুষ, একদল কুফলুর সামনে পড়েও যে বেঁচে ফিরে এসেছে!

তার খুশির সীমাটা মাত্রা ছাড়াল, যখন সে আবিষ্কার করল, পিঠে বাঁধা কঙ্কালটা এখনও যথাস্থানেই আছে! এত ঝক্কির পরও স্থানচ্যুত হয়নি ওটা! কয়েকটা হাড় অবশ্য ভেঙে গেছে, তবে বেশিরভাগটাই এখনও অক্ষত। খাঁড়িটা কিকার চেনা। এখান থেকে সাসাকো ঘণ্টা দুয়েকের পথ। তবে জঙ্গলের মধ্য দিয়ে হাঁটাপথ পরিহার করে, নদীপথেই গাঁয়ে ফিরবে বলে ঠিক করল সে। এতে সময় খানিকটা বেশি লাগবে, তবে শরীরের উপর দিয়ে ধকলটা অনেকখানি কমে যাবে। সারা দেহে প্রচণ্ড ব্যথা নিয়ে, বুনো পথে হাঁটার ইচ্ছে মোটেও নেই তার। পাকা বাঁশ দিয়ে কোনমতে চলনসই একটা ভেলা বানাল কিকা। পেটের খিদে মেটাল বুনো জাম দিয়ে। তারপর আয়েশ করে নদীর জলে ভেলা ভাসাল। ভাটির পথ, পরিশ্রম বলতে গেলে নেই-ই। হালটা কেবল ধরে রাখতে হবে তাকে।

সাসাকোয় ফিরে বাওয়াদের উষ্ণ অভ্যর্থনায় সিক্ত হলো কিকা। দেবদূত নিজেও তাকে অভিনন্দন জানাতে এগিয়ে এলেন। তাঁকে দেখে মনে হলো, ভীষণ অবাক হয়েছেন। সত্যি-সত্যিই পবিত্র গুহা থেকে কঙ্কালটা উদ্ধার করতে পারবে কিকা, এতটা বোধকরি কখনওই আশা করেননি তিনি। পথের বিপদগুলো সম্পর্কে অন্য যে কারও চেয়ে তাঁর জ্ঞান বেশি বৈ কম নয়।

দেবদূতের নির্দেশে মাটির উপর উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল সাসাকোর সব মহিলা ও শিশুরা। গায়ে গা ঠেকিয়ে পাশাপাশি শুয়েছে সবাই, তৈরি করেছে একধরনের মানব গালিচা। এর উপর দিয়েই টামবারানের দরজা পর্যন্ত হেঁটে যেতে হবে কিকাকে, সমর্পণ করতে হবে বয়ে আনা পূর্বপুরুষের দেহপিঞ্জর। এটা বিশেষ একধরনের সম্মান। মৃতের জন্য এবং কিকার নিজের জন্য। ·

মন সায় না দিলেও প্রথাটা পালন করতে হবে তাকে, প্রত্যাখ্যানের কোন সুযোগ নেই।

যথাসম্ভব দ্রুত গালিচাটা অতিক্রম করল কিকা। শিশুদের শরীর এড়িয়ে গেছে সে, কেবল মহিলাদের দেহেই পা রেখেছে। এখনও পূর্ণবয়স্ক পুরুষ হয়ে ওঠেনি সে, ওজনও খুব একটা বেশি নয়। তাই মহিলাদের খুব বেশি কষ্ট হয়েছে, এমনটা বলা যাবে না।

আট

সেদিন বিকেলে পরবর্তী কাজ বুঝিয়ে দেয়ার জন্য কিকাকে কাছে ডাকলেন দেবদূত। শান্তস্বরে জানালেন, কী করতে হবে তাকে।

শুনতে-শুনতে ভীষণ উত্তেজিত হয়ে পড়ল কিকা। কোন ফল পাবে না জেনেও, অনেক কাকুতি-মিনতি করল দেবদূতের কাছে। সমস্তটাই শেষমেশ অরণ্যে রোদন হলো, সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করলেন না দেবদূত।

ভগ্নপ্রায় হৃদয় নিয়েই পাশের গ্রাম মারাকোর উদ্দেশে যাত্রা করল কিকা।

তাকে এবার মারাকোর সর্দার ভীমনাকে খুন করতে হবে!

নয়

মারাকোয় পৌঁছে ভীমনার কুঁড়েতে গেল না কিকা, গেল জুরু বুড়োর ডেরায়।

আশপাশের সমস্ত গাঁয়ের বাওয়ারা জুরুকে একনামে চেনে। সবার চোখে পরম সম্মানিত একজন মানুষ সে। জীবিত বাওয়াদের মধ্যে সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ, সবচেয়ে জ্ঞানী। যে কোন মুশকিল কেবল জুরুই আসান করতে পারে, বাওয়া সমাজে খুবই প্রচলিত একটা কথা এটা।

জুরুর সামনে গিয়ে জড়সড় হয়ে বসল কিকা, হাত রাখল বুড়োর পায়ের কনিষ্ঠ আঙুলে। বাওয়া সমাজে জ্ঞানীদেরকে এভাবেই সম্মান জানানো হয়।

‘কী হে, সর্দার? তোমার মাথার মুকুট কোথায়? সর্দারকে কি তার মুকুট ছাড়া মানায়?’

‘আমি এখনও সর্দার হইনি, জুরু। ভীষণ বিপদে পড়ে তোমার সাহায্য চাইতে এসেছি।’

‘অন্য কেউ সর্দার হতে চাইছে? কে সে? তোমাদের ওঝা কী বলে এই ব্যাপারে?’

‘ওসব কিছু নয়, অন্য ব্যাপার। আশা করি, তোমার কাছ থেকে সঠিক পরামর্শই পাব।’

‘তোমার সমস্যাটা আগে শুনতে তো দাও।’

কিছুক্ষণ চুপ করে রইল কিকা। বুঝতে পারছে না ঠিক কীভাবে শুরু করবে। তারপর দ্বিধা কাটিয়ে উঠে বলতে শুরু করল।

‘মনে করো, পূর্বপুরুষদের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করার একটা সুযোগ এসেছে আমার সামনে। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে নিজের জাতভাই কাউকে হত্যা করতে হবে আমার। এখন আমি যদি কাজটা না করে পালিয়ে যাই, পূর্বসুরিরা খুব কি অসন্তুষ্ট হবে আমার উপর? তাদের অভিশাপে আমাকে কি অনন্তকাল নরকের আগুনে জ্বলতে হবে?’

নড়েচড়ে বসল জুরু। তার চোখের তারায় স্পষ্ট আগ্রহ ফুটে আছে।

‘পুরো ঘটনাটা খুলে বলো, খোকা। কেন যেন মনে হচ্ছে, ভয়ানক কোন জালে জড়িয়ে পড়েছ তুমি।’

জুরুকে সবকথা বলতে কোন আপত্তি নেই কিকার। জানে, শতভাগ বিশ্বস্ত সামনের মানুষটা। সারাজীবন কারও বিশ্বাসের অমর্যাদা সে করেনি, কখনও করবেও না। কেবল নিজের চারিত্রিক গুণেই সমস্ত বাওয়াদের প্রিয় পাত্রে পরিণত হতে পেরেছে সে।

একে-একে তাকে সমস্ত বৃত্তান্ত বর্ণনা করতে লাগল কিকা। দেবদূত আসার পর থেকে এ পর্যন্ত যা-যা হয়েছে, তার কোন কিছুই বাদ দিল না সে। শেষটায় যোগ করল মারাকোর সর্দার ভীমনাকে হত্যা করার আদেশের কথা।

বাওয়াদের ভবিষ্যৎ শান্তি-সমৃদ্ধির জন্য ভীমনাকে প্রধান অন্তরায় হিসেবে দেখছেন দেবরাজ জারাল। দেবরাজের আরাধনা থেকে বাওয়াদের দূরে সরাতে ভীমনার পূর্বপুরুষরাই মূলত দায়ী, এটাও তাকে জানিয়েছেন দেবদূত। তাই দেবলোক থেকেই ঘোষণা করা হয়েছে ভীমনার মৃত্যুদণ্ড।

পুরোটা শুনতে-শুনতে চোয়াল শক্ত হয়ে গেল জুরুর। বেশ কিছুক্ষণ চোখ মুদে রইল সে। ঘন-ঘন শ্বাস নিচ্ছে। প্রচণ্ড উত্তেজিত হয়ে পড়েছে বুড়ো, বাইরেও সেটা চাপা থাকছে না।

‘দেবদূতের কাঁধে দুটো কুফলু পাখির বাচ্চা আছে নাকি? দেখেছ কখনও?’ আচমকা জানতে চাইল জুরু।

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, আছে তো। কিন্তু তুমি জানলে কেমন করে?’

বেশ অবাক হলো কিকা। দেবদূতের কোন বর্ণনা সে দেয়নি জুরুকে, ঘটনাগুলোই কেবল সবিস্তারে বলেছে এতক্ষণ।

‘চুল ধূসর? অনেক লম্বা?’

‘হ্যাঁ।’

‘দু’পায়ে সোনার বেড়ি পরা?’

‘হ্যাঁ।’

‘তার কাছে রঙিন একটা খুলি আছে?’

‘আছে। কিন্তু তুমি এতসব কীভাবে বলতে পারছ? সাসাকো থেকে আমার আগে কেউ কি এসেছিল এখানে?’

আবারও চোখ বন্ধ করল জুরু। ‘কেউ আসেনি, কিকা। অনেক আগে থেকেই একে চিনি আমি। তবে চর্মচক্ষু দিয়ে দেখিনি কখনও, কেবল তার গল্প শুনেছি।’

‘এই তাহলে ব্যাপার! দেবদূত সম্পর্কেও জ্ঞান রাখো তুমি! সত্যিই তুমি জ্ঞানের ভাণ্ডার, জুরু। এখন আমাকে বলে দাও, কী করা উচিত আমার। ভীমনাকে খুন করব? নাকি পালিয়ে যাব দূরে কোথাও?’

‘লোকটা কোন দেবদূত নয়, কিকা। ভয়ঙ্কর শক্তিশালী এক জাদুকর, একটা রাক্ষস!’

পুরোপুরি হতভম্ব হয়ে গেল কিকা। এ কী বলছে জুরু? নাকি শুনতে ভুল হলো তার?

আবারও মুখ খুলল জুরু, ‘কয়েকশো বছর পর-পর সে আসে বাওয়া অঞ্চলে। কেউ জানে না তার সত্যিকারের বয়স কত। হাজার হতে পারে, তারচেয়ে বেশিও হতে পারে। তার জাদুর ক্ষমতা অসীম। জাদুবলেই নিজেকে বছরের পর বছর বাঁচিয়ে রাখার শক্তি পেয়েছে সে।

‘সে একটা রাক্ষস, কারণ কেবল মানুষকেই খাবার হিসেবে গণ্য করে সে, অন্য কিছু মুখে রোচে না তার। পাতাল নদীতে কিংবা পবিত্র গুহায়, যত নরকঙ্কাল তুমি দেখেছ, তার বেশিরভাগই সম্ভবত ওই পিশাচের হাতেই মারা পড়েছে।

‘কুফলুরা তার পোষা। কারণ ওদেরকে খাবারের জোগান দেয় সে-মানুষ! কুমিররাও একই কারণে তার আজ্ঞাবহ। আমাদের ধারণার চাইতেও অনেক- অনেক বেশি তার ক্ষমতার পরিধি।’

শূন্য দৃষ্টিতে জুরুর দিকে তাকিয়ে রইল কিকা। পুরোপুরি নির্বাক।

আবারও বলতে শুরু করল জুরু, ‘সাসাকোয় পা দিয়েই সে কৌশলে তোমাদের ওঝাকে দৃশ্যপট থেকে সরিয়ে দিয়েছে। সরিয়ে দিতে চেয়েছিল তোমাকেও, পবিত্র গুহার বিপদসংকুল পথে একাকী পাঠিয়ে। কিন্তু দেবতাদের আশীর্বাদে বহাল তবিয়তে ফিরে এলে তুমি। বিফলে গেল তার পরিকল্পনা।

‘কিন্তু নতুন ছকে জাল ফেলল রাক্ষসটা। তোমাকে দিয়েই ভীমনাকে মারার পরিকল্পনা করল সে। অনেকটা কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার মত। সুবিধামত সময়ে তোমাকেও কোন এক ছুতোয় মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করত সে। তারপর অভিভাবকহীন দুটো গাঁয়ে নির্বিবাদে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করত। সবক’টা মানুষ খাওয়ার আগ পর্যন্ত নড়ার নামও মুখে আনত না।’

বজ্রাহতের মতই ঠায় বসে রইল কিকা। এরচেয়ে বেশি বিস্ময়কর কিছু এ জীবনে শোনেনি সে। কোনমতে বলল, ‘কিন্তু সাসাকোয় আসার পর আজ অবধি একজন মানুষও খায়নি সে। ক’দিন খাবার ছাড়া কাটাতে পারে সে?’

‘কে বলেছে খায়নি? তোমাদের ওঝার লাশটা কোথায়?’

চট করে মনে পড়ল কিকার। ওঝার লাশটা নিজেই টামবারানের ভিতরে নিয়ে গিয়েছিল জাদুকর। আর রাতে টামবারানের ভিতরেই থাকে সে, একা।

ওঝার জন্য বুকের ভিতরটা মুচড়ে উঠল কিকার। কী নিদারুণ কৌশলে তাকে খুন করিয়েছে রাক্ষসটা!

চট করে উঠে দাঁড়াল কিকা। রাগে বিষধর সাপের মতই ফুঁসছে সে।

‘নিজ হাতে শয়তানটাকে হত্যা করব আমি, জুরু। যদি ব্যর্থ হই, সবার সামনে তার মুখোশ উন্মোচন করার জন্য তুমি তো রইলে।’

ঘর থেকে বেরোতে উদ্যত হলো কিকা।

‘তাকে কিন্তু স্বাভাবিক নিয়মে মারতে পারবে না, কিকা,’ পিছন থেকে বলে উঠল বুড়ো।

কাঁধের উপর দিয়ে ফিরে তাকাল কিকা। ‘কেন?’

‘কারণ তার প্রাণ নিজের দেহপিঞ্জরে রাখে না রাক্ষসটা, ওটা বন্দি থাকে সাথের রঙিন খুলিটার ভিতর। ওটাই তার সমস্ত শক্তির আধার। তাকে মারতে হলে, ওটাকে নষ্ট করতে হবে তোমার।’

মুখে হাসি ফুটল কিকার। ‘অনেক ধন্যবাদ, জ্ঞানী বুড়ো। যে কোন মুশকিল কেবল জুরুই আসান করতে পারে।’

ও বেরিয়ে যাবার পর তার সুরক্ষার জন্য প্রার্থনায় বসল জুরু। ভাবছে, বাবার মতই সাহসী হয়েছে ছেলেটা।

দশ

টামবারানের দরজায় কোন হুড়কো থাকে না, তাই ঢুকতে কোন বেগ পেতে হলো না কিকার। নিশুতি রাত, পুরো সাসাকো গভীর ঘুমে অচেতন। অন্য সবার মত জাদুকরও বেঘোরে ঘুমোচ্ছে একটা পাটাতনে শুয়ে। টামবারানের এক কোণে একটা মশাল জ্বলছে। সেই আলোয় ঘরের বেশিরভাগটাই আলোকিত হয়ে আছে। একপাশে থরে-থরে সাজানো খুলিগুলোর দিকে একপলক তাকাল কিকা পরক্ষণেই তাকাল ওঝার আধখাওয়া লাশটার দিকে। ইতোমধ্যেই অনেকখানি সাবাড় করে ফেলেছে রাক্ষসটা।

অবদমিত ক্রোধে শরীরটা বারকয়েক কেঁপে উঠল কিকার। চারপাশে তাকিয়ে রঙচঙে খুলিটা খুঁজতে শুরু করল সে।

সহজেই পাওয়া গেল ওটাকে, জাদুকরের মাথার কাছে একটা তাকিয়ার উপর বসে আছে। অশুভ একটা অবয়ব। দেখেই রাগে ব্রহ্মতালু জ্বলে উঠল কিকার।

দ্রুতপায়ে ওটার দিকে এগিয়ে গেল সে। হাতে ধরে রেখেছে মস্ত একখানা পাথর। শেষবারের মত জাদুকরের মুখের দিকে একবার তাকাল কিকা। তারপর দেহের সর্বশক্তি দিয়ে পাথরটা নামিয়ে আনল খুলিটার উপর।

অনুভব করল, হাতের তলায় পুরোপুরি গুঁড়িয়ে গেছে ওটা। পাটাতনে শুয়ে থাকা জাদুকরের মাথাটাকেও একই সঙ্গে চূর্ণবিচূর্ণ হতে দেখে মনে অদ্ভুত এক শান্তি পেল কিকা।

শেষ অবধি রাক্ষসটাকে শাস্তি দিতে পেরেছে সে। অবসান হয়েছে হাজার বছর ধরে চলতে থাকা মানুষ শিকারের খেলা।

ভোরের আগেই একখানা নৌকায় চেপে সাসাকো ছাড়ল কিকা! গাঁয়ের সীমানা পেরোবার সময় হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল সে। বার-বার ফিরে-ফিরে তাকাল ঝাপসা চোখে।

প্রাণ বাঁচানোর তাগিদেই সাসাকো ছেড়ে পালাতে হচ্ছে তাকে। হাতেনাতে ধরতে পারলে নির্ঘাত তাকে প্রাণদণ্ড দেবে বাওয়ারা।

কারণ শাশ্বতকালের নিয়ম ভেঙেছে সে, রাতের বেলায় প্রাণী হত্যা করেছে সাসাকোর সীমানায়! এক্ষেত্রে শত্রু-মিত্র ভেদাভেদ করে না বাওয়ারা। পরম শত্রুকে হত্যা করলেও বাঁচার কোন উপায় নেই। প্রাণের বিনিময়ে প্রাণ, সবার ক্ষেত্রে একই নিয়ম।

যা গাঁয়ের সর্দারের ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য।

এটাই আইন।

এটাই রীতি।

.

হয়তো কোন এক সময় এই রীতিতে পরিবর্তন আসবে। বাস্তবতা বুঝতে শিখবে বাওয়ারা, শত্রু-মিত্র চিনতে শিখবে।

তবে ততদিনে অনেক দেরি হয়ে যাবে।

সিংহ হৃদয়ের অধিকারী, অকুতোভয় কিকাকে ফেরারী হয়েই বাকি জীবনটা পার করতে হবে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *