ইনফার্নো

ইনফার্নো

এক

নিতান্ত সাদাসিধে ধরনের মানুষ বিমল কর; সাত চড়েও রা করে না। জগৎ- সংসার সম্পর্কে এতটা নির্লিপ্ত মানুষ কদাচিৎই চোখে পড়ে।

ভিতরে অনুভূতি যেমনই হোক না কেন, বাইরে তার চেহারা সারাক্ষণই ভাবলেশহীন। জাগতিক কোন ব্যাপারে চোখে পড়ার মতন কোন প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে বিমল, এমনটা কেউ কখনও দাবি করতে পারবে না।

তীব্র আনন্দ কিংবা তীব্র বেদনায়, একই রকম নির্বিকার লোকটা। মানুষ হয়েও আদতে একটা রোবট-জীবন যাপন করে চলেছে সে।

সকালে ঘুম ভাঙার পর বাড়িতে কোন নাস্তা জোটে না বিমলের। স্ত্রী মালতি দু’চোখে দেখতে পারে না তাকে। সাতসকালে বিমলের জন্য নাস্তা বানানোর কথা কল্পনাও করতে পারে না মহিলা।

এর নেপথ্যের কারণ হিসেবে অবশ্য বছর কয়েক আগে ঘটে যাওয়া একটা দুর্ঘটনাকে দায়ী করে লোকে। তবে কেবল মালতিই জানে, এই সীমাহীন বিতৃষ্ণার পিছনে ওই ঘটনাটার চাইতেও বড় আরেকটা কারণ রয়েছে।

এক সকালে একমাত্র ছেলে অমলকে নিয়ে তড়িঘড়ি করে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিল বিমল। ছেলেকে স্কুলে পৌছে দিয়ে তবেই অফিসে যায় সে। মোটর সাইকেল থাকায়, পথের যানজট খুব একটা বড় বাধা ছিল না ওদের জন্য।

তবে আদতেই সেদিন বড্ড দেরি হয়ে গিয়েছিল, কেবল মিনিট পাঁচেকই বাকি ছিল অমলের অ্যাসেম্বলি শুরু হওয়ার। নিতান্ত বাধ্য হয়েই অন্যান্য দিনের তুলনায় খানিকটা জোরে বাইক ছুটিয়েছিল সেদিন বিমল। তবে তার জানা ছিল না, বিধাতা ঠিক কী লিখে রেখেছিল তার ভাগ্য লিপিতে!

বড় রাস্তার মোড়ে পৌছতেই সিগন্যাল ভাঙা একটা ট্রাক বেপরোয়া গতিতে ছুটে এল ওদের দিকে। চোখের পলকে ওটার তলায় চাপা পড়ে গেল ছোট্ট বাইকটা।

ট্রাকের দানবীয় চাকায় পিষে গেল অমলের ছোট্ট দেহটা, প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই মারা গেল সে।

তবে উপস্থিত সবার চক্ষু চড়কগাছ করে দিয়ে, প্রায় বহাল তবিয়তে ট্রাকের তলা থেকে বেরিয়ে এল বিমল! এখানে-ওখানে খানিকটা কেটে-ছড়ে গেছে বটে, তবে বলার মত বড় ধরনের কোন চোট পায়নি সে।

একমাত্র সন্তানের রক্তাক্ত মৃতদেহ সহ্য করার ক্ষমতা পৃথিবীর কোন মায়েরই নেই; মালতিও তার ব্যতিক্রম নয়। গগনবিদারী আর্তনাদ করে সেদিন ধুলোয় লুটিয়ে পড়েছিল সে।

তীব্র যাতনার মধ্যেও হতবাক হয়ে লক্ষ করেছিল, চোখে এক ফোঁটা জল নেই বিমলের; নিস্পৃহ চেহারা নিয়ে ঘরের এক কোনায় দাঁড়িয়ে আছে মানুষটা!

লোকটা কি সত্যিই মানুষ? নাকি আস্ত একটা পিশাচ?

সন্তান হারানোর ক্ষতে সময়ের প্রলেপ পড়ল ঠিকই, তবে সেদিনের সেই নির্লিপ্ততার জন্য বিমলকে কোনদিনও আর ক্ষমা করতে পারল না মালতি। তবে কেবল অমলের জন্যই এখনও লোকটার ঘর করছে সে। নাহয় বহু আগেই বিমলের কপালে লাথি মেরে যেদিকে দু’চোখ যায়, সেদিকে চলে যেত মালতি।

মহল্লার এক কোণে একটা কানাগলির মুখে আবুল মিয়ার চায়ের দোকান। চা-বিড়ির পাশাপাশি সেদ্ধ ডিম আর গুলগুলাও বিক্রি করে আবুল।

রোজ সকালে অফিস যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে ওই দোকানে গিয়ে হাজির হয় বিমল। দোকানের লাগোয়া একটা বাঁশের বেঞ্চিতে জুত করে বসে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে আবুলের দিকে।

তার দিকে এক পলকের জন্য তাকায় বটে আবুল, কিন্তু পরক্ষণেই আবার মুখ ফিরিয়ে নেয় সে। ব্যস্ত হয়ে পড়ে অন্যান্য খদ্দেরদের সঙ্গে বেচাকিনি নিয়ে। দোকান একেবারে খালি হওয়ার আগ পর্যন্ত আর একটিবারের জন্যও বিমলের দিকে দৃষ্টি ফেরায় না সে।

নিয়মিত কাস্টোমার হওয়া সত্ত্বেও বিমলকে ভীষণ অপছন্দ করে আবুল। সে চায় না যে লোকটা রোজ-রোজ তার দোকানে আসুক। একারণেই এতটা অবহেলা করে সে। চায়, লোকটা বিরক্ত হোক; মানে-মানে কেটে পড়ুক এখান থেকে।

অন্য কিছু নয়, মানুষটার মূক পশুর মত আচরণটাই অসহ্য লাগে আবুলের। সকাল-সকাল এমন একটা পাথুরে মুখ দেখতে কারই বা মন চায়?

কিন্তু কখনওই আবুলের এই মনোবাসনাটা পূরণ করেন না বিধাতা; শত লাঞ্ছনার পরও ঠিকই রোজ সকালে এসে উপস্থিত হয় বিমল!

বিরস বদনে তাকে দু’খানা টোস্ট বিস্কিট আর এক কাপ চা এগিয়ে দিতে হয় আবুলকে। ওই দিয়েই নাস্তা সারে বিমল। তারপর বিনাবাক্যব্যয়ে দাম মিটিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে যায় বড় রাস্তার উদ্দেশে; অফিসগামী বাস ধরার জন্য।

পিছন থেকে অস্ফুটে খিস্তি আওড়ায় আবুল। অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে বিমলের অপসৃয়মাণ অবয়বটার দিকে। কেবল দৃষ্টি দিয়ে কাউকে ভস্ম করে দেয়া সম্ভব হলে, অনেক আগেই অঙ্গার বনে যেত বিমল কর!

দুই

রোজ অফিসে ঢুকতেই নিজের টেবিলে রাখা বিশাল একখানা ফাইলের স্তূপের সাথে মোলাকাত হয় বিমলের। তার মাঝারি আকারের দেহটা রীতিমত হারিয়ে যায় ওগুলোর আড়ালে; চট করে বোঝা যায় না, আদৌ ওখানটায় কেউ আছে নাকি নেই!

দর্শনার্থীদেরকে কথা বলতে হয় জিরাফের মত গলা বাড়িয়ে, নইলে বিমলের চেহারা দেখার সৌভাগ্য হয় না ওদের।

এতখানি কাজ করার কথা নয় বিমলের; তবুও তাকে করতে হয়। বলা ভাল, নিতান্ত বাধ্য হয়েই করতে হয়। কখনওবা বসের নির্দেশ, কখনওবা সহকর্মীদের অনুরোধ!

‘আজকের মধ্যে ফাইলগুলো দেখে দিন, বিমল বাবু…’

‘আজ একটু দেরি করে বাসায় ফিরলে কোন সমস্যা হবে আপনার?’

‘অডিট আসছে। বাড়তি কাজ করতে হবে। উপায় নেই।’

‘দাদা, আজ আমার শালীর জন্মদিন। না গেলেই নয়। আমার কাজগুলো একটু করে দেবেন, প্লিজ?’

‘ছোট ছেলেটাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাব। চারটায় অ্যাপয়েন্টমেন্ট। আপনি যদি একটু সাহায্য করেন, তাহলে তিনটায় অফিস থেকে বেরিয়ে পড়তে পারি, দাদা। ভীষণ কষ্ট পাচ্ছে ছেলেটা।’

‘ভাইয়ের জন্য মেয়ে দেখতে যাব। আজ একটু জলদি ফিরতেই হবে, দাদা। আমার এই দুটো ফাইল কিন্তু আপনাকে দেখে দিতে হবে আজ। না বললে শুনব না কিন্তু, দাদা।’

‘আপনার ভাবীকে নিয়ে শপিঙে যেতে হবে। জানেনই তো, সংসারে কাদের রাজত্ব চলে। আজ একটু সাহায্য করতে হয় যে, দাদা। এই জীবন আর ভাল লাগে না একদম।’

‘রানু পিসিটা হঠাৎ করে মরে গেল! আপনি যদি একটু সাহায্য করেন আমাকে, মরামুখটা দেখার সৌভাগ্য হবে আমার।’

এভাবেই আসে একের পর এক আবদার, কাউকেই মানা করে না বিমল। নির্বিকার ভঙ্গিতে হাত বাড়িয়ে লোকের ফাইলগুলো নেয় সে, অনেক রাত অবধি বেগার খেটে কাজগুলো ঠিকঠাক করেও দেয়।

সবার জন্য এত করে, তবুও কারও প্রিয় মানুষের তালিকায় বিমলের নামটা খুঁজে পাওয়া যায় না! কেন যেন কেউই বিশেষ পছন্দ করে না তাকে।

প্রায়ই বিভিন্ন উপলক্ষে কারও না কারও বাড়িতে ছোটবড় পার্টি হয়। অফিসের প্রায় সবাই সেখানে নিমন্তন্ন পেলেও, বিমল কখনও পায় না!

যদিও এ নিয়ে কাউকে কখনও কিছু জিজ্ঞেস করেনি সে, তবুও মাঝেমধ্যে নিজ থেকেই তাকে কৈফিয়ত দেয় লোকজন। চক্ষুলজ্জা বলেও তো একটা ব্যাপার আছে, নাকি? সময়ে-অসময়ে প্রায় সবারই তো উপকারে আসে মানুষটা।

অবশ্য অজুহাতগুলোর সবই ভীষণ খেলো ধরনের; কোন বৈচিত্র্য নেই!

‘একেবারে তাড়াহুড়োর মধ্যে হয়েছে পুরো আয়োজনটা। হুলস্থুলের ভিতরে কী থেকে যে কী হয়ে গেল! আপনাকে বলা হয়নি! লজ্জায় একেবারে মরে যাচ্ছি, দাদা।’

‘ছোট আয়োজন। পরিবার আর খুব কাছের কিছু মানুষজন ছাড়া বলতে গেলে আর তেমন কেউই ছিল না।’

‘আপনাকে তো, দাদা, ফোনে পাওয়াই যায় না। কতবার বললাম, অপারেটর পাল্টান। আপনি তো কানেও তোলেন না আমাদের কথা!’

মুখে মৃদু হাসি নিয়ে সমানে দু’হাত চালাতে-চালাতে লোকজনের মিথ্যে অজুহাতগুলো শোনে বিমল, কখনও কোন প্রতিবাদ করে না। কী লাভ?

পাহাড় প্রমাণ কাজ করেও দিন শেষে তার প্রাপ্তির খাতাটা প্রায় শূন্যই বলা চলে। চার বছর হতে চলল, প্রমোশনের শিকেটা এখনও ছিঁড়ল না তার ভাগ্যে।

তার অনেক পরে জয়েন করা একেকজন ফাঁকিবাজ জুনিয়র, কেবল তেলবাজির জোরে পদোন্নতি পেয়ে-পেয়ে বড় অফিসার বনে গেল। কিন্তু এখনও ঠিক আগের চেয়ারেই বহাল রয়েছে বিমল।

ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা অবশ্য প্রতি সপ্তাহেই আশ্বাসের বাণী শোনায় তাকে; তার ধৈর্যের প্রশংসা করে।

‘হবে, হবে। এবারে আপনারটা হবেই হবে। মন্ত্রণালয় থেকে ফাইনাল কাগজটা এই এল বলে…’

দিন যায়, সপ্তাহ যায়, মাস পেরিয়ে নতুন বছর চলে আসে। রোজ শত-শত সরকারী আদেশ-নিষেধও আসে; বিমলের পদোন্নতির নির্দেশটাই কেবল আসে না!

বিমলের নিজের অবশ্য এ নিয়ে তেমন কোন মাথাব্যথা নেই। একমনে নিজের কাজ করতেই অভ্যস্ত সে। প্রমোশনের জন্য আজকাল যে আর কেবল কাজ করাই যথেষ্ট নয়; খানিকটা ছোটাছুটি, খানিকটা তেলবাজিও যে করতে হয়, এটা তাকে কে বোঝাবে!

অবশ্য একেবারেই যে এ নিয়ে কেউ কিছু বলেনি তাকে, ব্যাপারটা ঠিক তেমনও নয়। সহানুভূতিশীল হয়ে কেউ-কেউ আকারে-ইঙ্গিতে বিষয়টা খোলসা করেছে তাকে। কিন্তু তাতে কোন ফল হয়নি। এক বাক্যে জানিয়ে দিয়েছে বিমল, এসব কাজ সে কস্মিনকালেও করতে পারবে না; এগুলো তার ধাতেই নেই।

এরপর আর কী-ই বা বলার থাকে? হতাশ হয়েই হাল ছেড়ে দিয়েছে লোকে যার প্রয়োজন, তারই যদি গরজ না থাকে, অন্য কারও সেটা নিয়ে ভাববার কী এমন ঠেকা পড়েছে?

কেবল সহকর্মীরাই নয়, অফিসের পিয়ন রাঘবও ভীষণ বিরক্ত বিমলের ওপর। অন্য কেউ ডাকলে চিতার বেগে ছুটে যায় সে। অথচ বিমল ডাকলে শুনেও না শোনার ভান করে থাকে, জায়গা ছেড়ে এক চুলও নড়ে না।

অনেকক্ষণ হাঁকডাকের পর যা-ও বা যায়, অনাগ্রহের স্পষ্ট ছাপ থাকে তার চেহারায়। হয় উদাসীন হয়ে ছাতের দিকে তাকিয়ে থাকে সে, নয়তো গোমড়া মুখে নোংরা নখ দিয়ে ফাইলের কোনা ছেঁড়ায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে! বিমল কী বলে না বলে, সেদিকে কোন ভ্রূক্ষেপই থাকে না তার।

রাঘবের তখনকার হাবভাব দেখলে মনে হয়, বিমল কর সাধারণ একজন পিয়ন আর সে নিজেই বুঝি মস্ত কোন অফিসার!

প্রায়ই বড় স্যরের বিভিন্ন কাজের অজুহাত দেখিয়ে রিমলের দেয়া কাজ করতে অস্বীকৃতি জানায় সে। যদিও তখন তার হাতে কোন কাজই থাকে না!

বিষয়টা বিমলের নিজেরও জানা আছে, তবুও এটা নিয়ে কখনও কোন উচ্চবাচ্য করে না সে। রাঘবকে সবসময় নম্র স্বরেই অনুরোধ করতে অভ্যস্ত সে।

সুযোগটার পুরোপুরি সদ্ব্যবহার করে রাঘব; যতভাবে পারে হেনস্তা করে বিমলকে। সিঙ্গাড়া আনতে বললে আনে চমচম, জুস আনতে বললে আনে কোক! তবে তাতে বিশেষ কোন লাভ হয় না। নির্লিপ্তই থাকে বিমল, রাগে না।

সারাদিন সর্ব সাকল্যে একবেলা মালতির হাতের রান্না খাওয়ার সৌভাগ্য হয় বিমলের; রাতে। তবে খাবারটা তাকে একা-একাই খেতে হয়, মালতি কখনও তাকে সঙ্গ দেয় না। অমল মরার পর থেকেই এই ব্যবস্থা।

একই বাড়িতে একই ছাদের নীচে বসবাসরত এই দুটো প্রাণীর মধ্যে লোক দেখানো সামাজিক সম্পর্কটা ছাড়া, আদতে আর কোন সম্পর্কই নেই। না শারীরিক, না মানসিক।

ওই দুর্ঘটনাটার পর থেকে আজ অবধি মালতিকে কখনও ছুঁয়েও দেখেনি বিমল। মালতির মধ্যেও ঘনিষ্ঠ হওয়ার কোনরকম আগ্রহ প্রকাশ পায়নি।

লোকে ভাবে, ওদের বর্তমান সম্পর্কটা খানিকটা শীতল বটে, তবে অচিরেই এই অচল অবস্থা পাল্টে যাবে। সংসারে আবার ছেলেপুলে এলেই ঠিক হয়ে যাবে সবকিছু। আবারও সুখের সুবাসে ভরে উঠবে ঘর-বাড়ি।

তবে সন্তান জন্মদানের প্রাকৃতিক উপায়টা থেকে যে তারা দু’জন যোজন- যোজন দূরে সরে আছে, এটা কারও কল্পনাতেও নেই।

মাথাব্যথার ব্যারাম আছে মালতির। অতি অল্প শব্দেই চট করে মাথা ধরে যায় তার। টিভির দিকে বেশিক্ষণ তাকাতে পারে না; চোখ জ্বলে। তাই টিভি বলতে গেলে দেখেই না সে।

তবে রাতের আহার পর্ব সমাপ্ত হলে টিভিতে খানিকক্ষণ খবর দেখে বিমল সেটাও অবশ্য পুরোপুরি শব্দহীনভাবে, যেন মালতির কোন অসুবিধে না হয়।

এভাবে নিঃশব্দে টিভি দেখতে-দেখতে লিপ রিডিঙে অনেকখানি দক্ষ হয়ে উঠেছে বিমল। বহু দূর থেকেও কেবল ঠোঁট নাড়ানো দেখে মানুষজনের কথোপকথন বুঝতে পারে সে।

তার অফিসের কলিগদের কারও ধারণাও নেই যে, ওদের প্রত্যেকের কত- শত হাঁড়ির খবর জানা আছে বিমলের!

তিন

এক ছুটির দিনের সকালে বিমল করের নিস্তরঙ্গ জীবনটা হঠাৎ করেই আমূল বদলে গেল। ভোরবেলায় চোখ মেলা মাত্রই তার মনে হলো, এভাবে সবার অপছন্দের পাত্র হয়ে গোটা জীবনটা পার করে দেয়ার কোন মানেই হয় না!

সর্বজনবিদিত বাইরের মেকী খোলসটা ভাঙতে হবে তাকে; পুরোপুরি পাল্টে ফেলতে হবে নিজেকে। অন্য কারও জন্য নয়, কেবল নিজের জন্যই বাঁচতে হবে তাকে।

জীবন যদি রোমাঞ্চকরই না হয়, অহেতুক অক্সিজেনের অপচয় করে কী লাভ?

স্টোর রুমের আবর্জনার দঙ্গল ঘেঁটে মান্ধাতা আমলের একটা সিন্দুক বের করল বিমল। খুব একটা বড় নয় জিনিসটা; বহুদিন সেঁতসেঁতে জায়গায় পড়ে থাকার কারণে ডালার এখানে-ওখানে রঙ চটে গেছে।

সিন্দুকটা ওর দাদার সম্পত্তি, উত্তরাধিকার সূত্রে ওটার মালিক হয়েছে বিমল। দাদার নিজের হাতে লেখা একটা জরাজীর্ণ ডাইরি ছাড়া আর তেমন কিছুই নেই ওটার ভিতরে। বোতাম আকৃতির ছোট-ছোট কিছু পাথর অবশ্য আছে; তবে ওগুলো যে ঠিক কী কাজে লাগে, খোদা মালুম!

বিমলের দাদাকে লোকে পাগল বলত। ঘর-সংসার বাদ দিয়ে অদ্ভুতুড়ে সব কাজে মেতে থাকত লোকটা।

তন্ত্র-মন্ত্রর চর্চা করত; বেশ কয়েকবার বহুদিনের জন্য গায়েবও হয়ে গিয়েছিল সে। কোথায় যেত, কী করত, সেটা কখনও কাউকে খোলসা করেনি সে।

এমন মানুষের সঙ্গে জীবন কাটানো যায় না। তাই বাধ্য হয়েই তার দাদীকে আবারও বিয়ে দিয়েছিল তার ভাইয়েরা। ততদিনে অবশ্য বিমলের বাবা বেশ বড় হয়ে গিয়েছিল।

মায়ের নতুন সংসারে উপদ্রব হতে চায়নি বলে অর্ধ-উন্মাদ বাবার সঙ্গেই রয়ে গিয়েছিল সে। তবে বাবার কোন প্রভাব নিজের ওপর পড়তে দেয়নি লোকটা, অন্য দশজন সাধারণ মানুষের মতই ঘরকন্না সামলেছে সে।

স্বভাবতই বাবার সিন্দুক কিংবা ডাইরির প্রতি কোনরকম আগ্রহ ছিল না তার। কেবল পূর্বপুরুষদের আত্মাকে কষ্ট দিতে চায়নি বলেই সিন্দুকটাকে ঘরে রেখে দিয়েছিল সে, নাহয় বহু আগেই আঁস্তাকুড়ে ঠাঁই পেত ওটা।

ডাইরিটা বগলদাবা করে বৈঠকখানায় চলে এল বিমল। সোফায় আয়েশ করে বসে পড়তে শুরু করল।

(মূল ডাইরিটাতে সবকিছু সাধু ভাষায় থাকলেও, বোঝার সুবিধার্থে এখানে চলিত ভাষা ব্যবহার করা হলো।)

দাদার হাতের লেখা চমৎকার, একেবারে ঝকঝকে পরিষ্কার। পড়তে কোন অসুবিধাই হলো না বিমলের।

প্রথম পাতাতেই গোটা-গোটা অক্ষরে লেখা

‘হে, আমার প্রাণপ্রিয় বংশধর, তোমাকে আজ এক রহস্যময় পথের সন্ধান দিতে চলেছি আমি। তবে আগে বাড়ার পূর্বে তোমাকে সতর্ক করছি, কোনরকম পিছুটান থাকলে এখনই পঠনে ইস্তফা দাও; এই পথ তোমার জন্য নয়। ডাইরিটা রেখে দাও যথাস্থানে, সংসার বিবাগী অন্য কোন সাধকের জন্য; যে একদিন আমার এই সাধনার অংশ হবে।

‘একবার এই পথে পা বাড়ালে, পিছিয়ে আসার আর কোন পথ থাকবে না। এলে ভয়াবহ অভিশাপ নেমে আসবে তোমার ওপরে।

‘অতএব, ভেবেচিন্তে অগ্রসর হও। জাদুর নেশা, এ পৃথিবীর সবচাইতে বড় নেশা। একবার এই নেশায় মজলে, সাধারণ জীবন অর্থহীন মনে হবে।

‘সচেতন অনুসারীই কাম্য আমার, পথহারা পথিক নয়। তোমাকে শুভেচ্ছা।’ ডাইরিটা পাশে রেখে চোখ মুদে খানিকক্ষণ ভাবল বিমল। সত্যিই কি তার কোন পিছুটান আছে?

না। নেই।

দিন কয়েকের জন্য সে বেমালুম গায়েব হয়ে গেলে কিছুই যাবে-আসবে না মালতির। এমনকী চিরকালের জন্যও যদি গুম হয়ে যায় বিমল, একরত্তি দুঃখও পাবে না সে; উল্টো মুক্তি দেয়ার জন্য দিনরাত মনে-মনে তাকে ধন্যবাদ দেবে!

আচ্ছা, তার বাবা কি দাদার লেখা এই ডাইরিটা পড়েছিল? মনে হয়, পড়েনি। যদিও বা কখনও হাতে নিয়ে থাকে, নিশ্চয়ই এই প্রথম পাতাটা পড়েই ক্ষান্ত দিয়েছিল সে।

সংসারী মানুষ ছিল বাবা, বৈরাগী হওয়ার কোন খায়েশ ছিল না তার। চারিত্রিক নির্লিপ্ততার অনেকখানি বাবার কাছ থেকেই পেয়েছে বিমল।

সাতপাঁচ ভেবে আবার ডাইরিটা হাতে তুলে নিল বিমল। মনোযোগ দিয়ে পড়তে শুরু করল।

‘হে, শিষ্য, তোমাকে অভিনন্দন। আজ থেকে সজ্ঞানে রোমাঞ্চকর এক নয়া জীবন বেছে নিয়েছ তুমি। এই সাধক জীবন বড় বিচিত্র, বড্ড আনন্দময়। তোমাকে আশীর্বাদ করছি, নিশ্চয়ই তুমি সফলকাম হবে।

‘শুধু একটা বিষয় মাথায় রাখবে, তোমাকে ধারাবাহিকভাবে পড়তে হবে এই পুস্তক। ভুলেও কখনও এক পৃষ্ঠার কাজ সমাপ্ত না করে অন্য পৃষ্ঠায় যাওয়া চলবে না। তাহলে সমস্ত সাধনাই বৃথা যাবে।

‘দেবতারা আকাশে থাকেন, দানবেরা পাতালে। আর আমরা মানুষ জাতি, এই দুয়ের মধ্যখানে অসহায়ের মত আটকে আছি।

‘লক্ষ-কোটি বছর আগে দেবতাদের সঙ্গে দানবেরা এক মরণপণ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল। তার পরপরই নিজেদের সুবিধামত এলাকা ভাগাভাগি করে নিয়েছিল ওরা। স্বর্গ স্থাপন করা হয় অন্তরীক্ষে আর নরকের ঠাঁই হয় পাতালে।

‘নভোমণ্ডলের পরিধি অসীম, তবে পাতালের ব্যাপ্তি অসীম নয়। তাই স্বৰ্গ দর্শন মানুষের জন্য প্রায় অসম্ভব হলেও, নরকের খোঁজ পাওয়া ততটা কঠিন নয়।

‘মানুষের খুব কাছাকাছি বসবাস করে, আবার পাতালের সঙ্গেও নিবিড় যোগাযোগ আছে, এমন কোন প্রাণীর কথা কি মনে পড়ে তোমার? পড়ছে না?

‘আমিই বলে দিচ্ছি তাহলে; মূষিক। যাকে আমরা সচরাচর ইঁদুর বলে ডাকি। মাটির ওপরে ওদের নিত্য আনাগোনা, তবে মাটির নীচেই ওদের স্থায়ী বসবাস।

‘আমাদের চোখের আড়ালে সুরঙ্গ খুঁড়ে বিশ্বের এই প্রান্ত থেকে ওই প্রান্তে চলে যেতে পারে ওরা। বিনা বাধায় চষে বেড়াতে পারে গোটা পৃথিবী।

‘পাতালপুরী সম্পর্কে ওদের চেয়ে বেশি জ্ঞান আর কারোরই নেই। এই জ্ঞান ওরা পেয়েছে বংশানুক্রমে; সেই সৃষ্টির আদিকাল থেকে। একজোড়া ইঁদুরকে ঠিকঠাক বংশ বিস্তার করতে দিলে বছর শেষে সংখ্যাটা সর্ব সাকল্যে প্রায় হাজারে গিয়ে ঠেকবে। বুঝতে পারছ, আমাদের অগোচরে কত লক্ষ-কোটি ইঁদুর ছড়িয়ে আছে এই বিশ্বজগতে?

‘হাজার-হাজার বছর ধরে পাতালপুরী সম্পর্কিত জ্ঞান আহরণ করেছে ইঁদুরেরা, লুকিয়ে রেখেছে নিজেদের ভিতরে। অন্য কোন প্রাণীর সঙ্গে ভাগাভাগি করেনি, মানুষের সাথে তো নয়ই।

‘তবুও বুদ্ধিমান মানুষ ঠিকই জেনেছে ওদের বিভিন্ন ক্ষমতার কথা। যুগে- যুগে এর উপযুক্ত সম্মান দিতেও কখনও কার্পণ্য করেনি। তবে আজও তাদের সবচেয়ে বড় ক্ষমতাটার কথা গোপন রয়ে গেছে সিংহভাগ মানুষের কাছে।

‘মানুষ জানে না, নিয়মিতই নরকে আসা-যাওয়া করে ইঁদুরেরা; ওরাই নরকের আসল পাহারাদার!

‘আজ আমরা যাকে আগ্নেয়গিরি বলি, সেগুলো আর কিছুই নয়, নরকের একেকটা খোলা মুখ। মানুষকে শায়েস্তা করার জন্যই ইঁদুরেরা কালে-কালে খুলে দিয়েছে ওগুলো। লাভার উদ্গিরণ শেষে এমনভাবে বন্ধ হয়ে যায় পথগুলো যে, ওপথে আর নরকের হদিস মেলে না। কিংবা হয়তো গোটা নরকটাকেই সরিয়ে ফেলা হয় ওখান থেকে। কেবলমাত্র ইঁদুরেরাই জানে নরকের সঠিক অবস্থান এবং ঠিক কীভাবে ওখানে যেতে হয়।

‘ইঁদুরেরা ক্ষমতাবান, ভীষণ ক্ষমতাবান। যুগে-যুগে পৃথিবীর নানা প্রান্তের নানা লোকগাথায় ওদের সামর্থ্যের বয়ান আমরা পেয়েছি।

‘ক্ষমতা এবং উন্নয়নের দেবতা গণেশ। লোকে বিদ্যার দেবী সরস্বতী কিংবা সম্পদের দেবী লক্ষ্মীর চেয়ে তাঁর পুজো কোন অংশে কম করে না। তিনি যে একটা ইঁদুরের পিঠে চড়ে বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডে ঘুরে বেড়াতেন, সেটা নিশ্চয়ই তোমার অজানা নয়। কিন্তু এটা কি জানো, ওই বাহন ইঁদুরটা আদতে কী ছিল?

‘গণেশ পুরাণের মতে, দেবতা ইন্দ্রের দরবারে একজন সঙ্গীতজ্ঞের নাম ছিল, ক্রাঞ্চা। একদিন ভুলক্রমে মুনি ভামাদেভাকে অপমান করে ফেলেন তিনি। অভিশাপ দেয়া হয় তাঁকে; শেষটায় একটা ইঁদুরে পরিণত হন তিনি।

‘কিন্তু তাঁর ছিল প্রচণ্ড রাগ আর সেই সঙ্গে দানবীয় শারীরিক কাঠামো। ক্রোধান্বিত হয়ে ঋষি পরোশারার আশ্রমে হামলা চালান তিনি, তছনছ করে দেন গোটা আশ্রম। নিরুপায় ঋষি গণেশের দরবারে আর্জি জানান; তাঁর ডাকে সাড়া দেন গণেশ। বিশাল শুঁড় দিয়ে তিনি চেপে ধরেন ক্রাঞ্চার গলা; সিদ্ধান্ত নেন, এখন থেকে ওই ইঁদুরের পিঠেই সওয়ার হবেন।

‘কিন্তু গণেশের বিশালকায় দেহের ভার বহন করার সামর্থ্য ছিল না ওই ইঁদুরটার। তাই গণেশ পিঠে চড়া মাত্রই ব্যথায় ককিয়ে ওঠে ওটা। এতে গণেশের মনে দয়ার উদ্রেক হয়, তাই নিজেকে অনেকটা হালকা করে নেন তিনি। এরপর থেকে আর তাঁকে বইতে কোনরকম সমস্যা হয়নি বাহক ইঁদুরটার।

‘একজন মহা পরাক্রমশালী দেবতা হয়েও সামান্য একটা ইঁদুরের পিঠে সওয়ার হতে কুণ্ঠাবোধ করেননি গণেশ; উল্টো ইঁদুরটাকে প্রাপ্য সম্মান দিয়েছিলেন তিনি। নিজের ভাগের লাড্ডু খেতে দিতেন ওটাকে, ওটার এঁটো করা খাবারও খেয়ে নিতেন নির্দ্বিধায়। সর্বদাই একান্ত একজন বন্ধুর মতন আচরণ করতেন প্রাণীটার সঙ্গে।

‘গণেশের শরীর ছিল প্রকাণ্ড, মাথা ছিল হাতির। যতই তিনি নিজেকে হালকা করুন না কেন, অতবড় একখানা পাহাড়সম দেহ বইতে পারাটা, ইঁদুরটার শারীরিক সামর্থ্যেরই প্রমাণ। পরবর্তীতে গণেশের ধ্বংসাত্মক ক্ষমতারই প্রতীক হয়ে উঠেছিল ইঁদুরটা। আপাতদৃষ্টিতে সামান্য একটা ইঁদুর আদতে কতখানি গুরুত্ব বহন করে, সবাইকে সেটাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিলেন গণেশ। অবশ্য হিন্দুদের কেউ-কেউ ইঁদুরকে অপদেবতা কিংবা শয়তানের প্রতিমূর্তি হিসেবেও বিবেচনা করে থাকে।

‘চীনদেশে লোকে শূ নামে ডাকত ইঁদুরকে। ওরা বিশ্বাস করত, যে কয়টি প্রাণী সূর্য থেকে আলো বহন করে নিয়ে আসে মর্ত্যে, ইঁদুর তার মধ্যে অন্যতম। ইঁদুরকে পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধের রক্ষাকর্তাও ভাবত ওদের কেউ-কেউ।

‘মিসরে ওদেরকে ভাবা হত ধ্বংসের দেবতা। মিসরীয়রা বিশ্বাস করত, ইঁদুরদের অবাধে ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর সর্বময় ক্ষমতা দিয়েছেন ঈশ্বর।

‘আইরিশরা মনে করত, শিল্প-সাহিত্য সম্বন্ধে বেশ ভাল ধারণা রাখে ইঁদুরেরা। কোন চমৎকার কবিতা কিংবা সুরেলা গানের প্রতি সহজেই ওরা আকৃষ্ট হয়! তখন সম্মোহিত করে ওদের দিয়ে যে কোন কাজ করিয়ে নেয়া যায়। সম্ভবত এই বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করেই এককালে হ্যামিলিনের বাঁশিওয়ালার মত গল্পগুলো রচিত হয়েছিল।

‘রোমানদের বিশ্বাস ছিল, ইঁদুরেরা সৌভাগ্য বয়ে আনে। তবে খ্রীষ্টানদের কেউ-কেউ আজও শয়তানের প্রতীক হিসেবেই দেখে ইঁদুরকে।

‘জাপানে ওদেরকে বলা হত, নাজুমি। ভাবা হত, দেবতা দাইককুর বার্তাবাহক এই ইঁদুরেরা। জাপানীদের বিশ্বাস ছিল, নতুন বছরের কেক যদি ইঁদুরেরা স্বেচ্ছায় খেয়ে যায়, তাহলে সে বছর বেশ ভাল ফলন হবে।

‘কিছু-কিছু আফ্রিকান উপজাতি এখনও যুদ্ধের ময়দানে ইঁদুরের লোমের মুকুট পরে। তারা বিশ্বাস করে, এই মুকুট ওদেরকে সকল প্রকারের অনিষ্ট থেকে রক্ষা করবে। এমনকী শত্রুর ছোঁড়া তীর-বল্লমও ওদের গায়ে না লেগে পিছলে যাবে!

‘ইঁদুরদের নিয়ে আগ্রহের কমতি ছিল না মায়ানদের। ইঁদুরের গতিবিধির ওপর তীক্ষ্ণ নজর রাখত ওরা। শত্রুর হাত থেকে বাঁচার পরিখা, মাটির নীচে সুরঙ্গ খোঁড়া, এসবকিছু সম্ভবত ইঁদুরদের কাছ থেকেই শিখেছিল মায়ানরা। এমনকী প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত থেকে রক্ষা পেতে ইঁদুরদের দেখাদেখি মাটির নীচে সম্পূর্ণ শহরও গড়ে তুলেছিল ওরা। শহরগুলোয় ঢোকার মুখে যে ধাতুর তোরণ থাকত, প্রায়শই সেটায় আঁকা থাকত বিশাল কোন ইঁদুরের ছবি। কৃতজ্ঞতা স্বরূপ প্রায়ই ইঁদুরদের জন্য ভোজসভার আয়োজন করত মায়ানরা!

‘ইঁদুর আকৃতির বিশাল-বিশাল সব মূর্তি শহরে স্থাপন করেছিল অ্যাজটেকরা। আপাতদৃষ্টিতে নিরেট মনে হলেও, এর বেশিরভাগই ছিল পুরোপুরি ফাঁপা। নগর রক্ষকের দল অনায়াসে ওগুলোর ভিতরে লুকিয়ে থাকতে পারত। শত্রুকে বিভ্রান্ত করতে যুদ্ধের ময়দানেও ব্যবহার করা হত এসব ইঁদুরের মূর্তি।

‘সুমেরীয়দের বিশ্বাস ছিল, ইঁদুরেরা মূলত চাঁদে বসবাস করে। আর চাঁদের গায়ের কৃষ্ণ গহ্বরগুলো আসলে ওদেরই সৃষ্টি!

‘আপাতত আর এসব নিয়ে কিছু বলতে চাচ্ছি না, নয়তো এগুলো বলতে বলতেই এই পুস্তকের সবক’টি পাতা ফুরিয়ে যাবে। তুমি নিজেই বরঞ্চ ইঁদুরদের সম্পর্কে খানিকটা পড়াশুনা করে নাও। তারপরও যদি এই ব্যাপারে তোমার আগ্রহ অব্যাহত থাকে, তবেই কেবল পরবর্তী অধ্যায়ের দিকে অগ্রসর হবে। সেখানে আমি তোমাকে মূষিক-সাধনা সম্পর্কে বিস্তারিত জানাব। তোমাকে শেখাব, কী করে এই মহা ধুরন্ধর প্রাণীকুলের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে হয়। কীভাবে ওদেরকে তোমার আজ্ঞাবহ করতে হয় এবং কেমন করে ওদের সাহায্যে খুঁজে পেতে হয় নরকের দরজা! আপাতত, বিদায়!’

চার

অসুস্থতার দোহাই দিয়ে অফিস থেকে দিন কয়েকের ছুটি নিল বিমল। আবেদন করা মাত্রই ছুটি মঞ্জুর হয়েছে তার, কোনরকম ঝক্কি পোহাতে হয়নি। দীর্ঘকালের চাকরি জীবনে ইতিপূর্বে একদিনের জন্যও অফিস কামাই দেয়নি সে!

ইঁদুর বিষয়ক কিতাবের খোঁজে পুরো শহর চষে বেড়াল বিমল। সদ্য প্রকাশিত ঝকঝকে বই থেকে শুরু করে প্রাচীন আমলের রদ্দিমাল, যেখানে যা পেল, খুঁজে-খুঁজে জড় করল। তারপর নাওয়া-খাওয়া শিকেয় তুলে একনাগাড়ে পড়তে শুরু করল।

মালতি বুঝল, কোথাও কোন একটা গণ্ডগোল হয়েছে; কিন্তু পরোয়া করল না সে। উচ্ছন্নে যাক ব্যাটা, কী আসে যায়?

তবে আগের তুলনায় কাজের পরিমাণ খানিকটা বেড়েছে তার, এক বেলার পরিবর্তে এখন দু’বেলার খাবার রাঁধতে হয় তাকে। তবে বেশিরভাগ সময় দিনে একবারই কেবল খাবার খায় বিমল, সেটাও একেবারে ভর সন্ধ্যায়। বাকিটা সময় মুখ গুঁজে থাকে বইয়ের পাতায়।

মালতিকে দেখেও যেন দেখে না সে; সবসময় চোখে-মুখে কীসের যেন একটা ঘোরলাগা দৃষ্টি তার! বিমলের চোখের দিকে চোখ পড়লে খানিকটা অস্বস্তিতে ভোগে মালতি; পাগল হয়ে যাচ্ছে না তো লোকটা?

অবশেষে সপ্তাহ খানেক বাদে মূষিক সম্বন্ধীয় জ্ঞান আহরণ শেষ হলো বিমলের। অনেকটা সময় নিয়ে স্নান সারল সে, তারপর ভরপেট ভাত খেল। মালতির দিকে তাকিয়ে মুচকি একটা হাসিও দিল; গত কয়েক বছরে যে কাজটা একবারও করেনি সে!

নিজেকে ভীষণ হালকা লাগছে তার; শেষতক খুঁজে পেয়েছে নিজের জীবনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য। দাদার মত মূষিক সাধক হবে সে, জানবে অন্ধকার জগতের নানা খুঁটিনাটি। সাধারণ একঘেয়ে জীবনের প্রতি ঘেন্না ধরে গেছে তার। কী লাভ এভাবে অহেতুক দিনের পর দিন শ্বাস নিয়ে?

যতদিন বাঁচবে, জীবনটাকে পুরোদমে উপভোগ করবে সে। জীবিত মানুষ হিসেবে নরক পরিদর্শনের সুবর্ণ সুযোগটা হেলায় হারানোর কোন ইচ্ছেই নেই তার। বিফল হলেও ক্ষতি নেই তেমন; মাঝখানের উত্তেজনাটাই বা কম কীসে?

সেই সন্ধ্যায় আবারও দাদার ডাইরিটা পড়তে শুরু করল বিমল। একে-একে জানতে লাগল মূষিক-সাধনার যাবতীয় নিয়ম কানুন। কিছু-কিছু বিবরণ এতটাই বীভৎস যে, পড়তে গিয়েই শরীরের সবক’টা লোম দাঁড়িয়ে গেল তার; চোখ-মুখ কুঁচকে গেল।

তবুও হাল ছাড়ল না বিমল, লেগে রইল। মনে-মনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করল, যেভাবেই হোক, এর শেষ দেখে ছাড়বে সে। মাঝামাঝি গিয়ে সটকে পড়ার লোক নয় সে মোটেও; অন্য দশজন মানুষের চেয়ে তার ধৈর্যের পরিমাণ বেশি বৈ কম নয়। আপাতদৃষ্টিতে অসম্ভব মনে হলেও যজ্ঞগুলো করতে পিছপা হবে না সে।

এক রাতে কৌতূহলবশত বিমলের ঘরে উঁকি দিল মালতি। দরজাটা ভেজানো, লক করেনি বিমল। ঘরের সবক’টা বাতি নেভানো; তবে জানালা- দরজার ফাঁকফোকর দিয়ে বাইরের খানিকটা আলো ঠিকই ঢুকে পড়ছে ঘরে। তাতে অবশ্য ভিতরের গুমট অন্ধকার পুরোপুরি কাটেনি, তবে চেনা ঘরে অতটুকু আলোই যথেষ্ট মালতির জন্য।

অন্দরের দৃশ্যটায় চোখ পড়তেই ভীষণ চমকে উঠল মালতি। অকারণেই ধক্ করে উঠল বুকের ভিতরটা। যা দেখছে, ঠিক দেখছে তো?

ঘরের মধ্যখানটায় চোখ মুদে পদ্মাসনে বসে আছে বিমল। পুরোপুরি দিগম্বর, একরত্তি সুতোও নেই তার পরনে। গায়ে কী যেন একটা মেখেছে সে। আবছা আলো-আঁধারিতেই রীতিমত চকচক করছে তার শ্যামবরণ দেহটা।

ঘরের বাতাস ভারী হয়ে আছে অচেনা একটা গন্ধে। গন্ধটা ভীষণ বিশ্ৰী, চট করে নাকে লাগে। বিমলের শরীরে মাখা, তেলটা থেকেই এই বিচ্ছিরি গন্ধের উৎপত্তি কিনা, খোদা মালুম!

চোখজোড়া বন্ধ থাকলেও ঠোঁটদুটো অনর্গল নড়ছে তার। নিচু স্বরে কী যেন জপে চলেছে সে। শ্বাসের সঙ্গে বুকের ওঠানামার গতিটা এতটাই ক্ষীণ যে, ভালমত না তাকালে প্রায় নজরেই পড়ে না। কেবল ওই ঠোঁটজোড়া অনড় থাকলে, অবলীলায় একখানা পাথুরে মূর্তি বলে চালিয়ে দেয়া যেত তাকে।

চটজলদি ওখান থেকে সরে এল মালতি; সারা শরীর ঘামছে তার। নাড়ির গতি বেড়ে গেছে অনেকখানি; হাঁটু দুটোতেও ঠিক জোর পাচ্ছে না সে। দ্রুত শ্বাস নিচ্ছে, চোখের তারায় স্পষ্ট আতঙ্কের ছাপ। কোনমতে হাঁচড়ে-পাঁচড়ে নিজের ঘরে ফিরে বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দিল সে।

কী হয়েছে লোকটার? মাথা-টাথা খারাপ হয়ে যায়নি তো? পাগল তো সে আগেই ছিল, এখন কি তাহলে বদ্ধ উন্মাদ বনে গেছে? কী করা উচিত এখন মালতির? ভাইদেরকে সবকিছু খুলে বলবে?

বহুদিন ধরেই বিমলকে ডিভোর্স দেয়ার জন্য চাপ দিয়ে আসছে মালতির আত্মীয়-স্বজনেরা, কিন্তু মালতি কখনও রাজি হয়নি। লোকটাকে পছন্দ না করলেও, কেমন যেন একটা মায়া পড়ে গেছে। অতীতে একে অপরকে ভালবাসত ওরা, সুখের একটা সংসার ছিল। চাইলেই সেসব দিনের অজস্র টুকরো-টুকরো সুখের স্মৃতিগুলো মন থেকে তাড়ানো যায় না।

ভালবাসা নেই; কিন্তু বিমলকে ছেড়ে অন্য কোন পুরুষের সঙ্গে নতুন করে ঘর বাঁধার কথা কল্পনাও করতে পারে না মালতি। স্বামীকে ছাড়া যায় ঠিকই, কিন্তু নিজের সন্তানের পিতাকে কি অস্বীকার করা যায় কখনও?

এতদিন ঘরে সুখ ছিল না সত্যি, তবে জীবন ঠিকই চলছিল তার নিজস্ব গতিতে। কিন্তু এখন? একজন উন্মাদের সঙ্গে সংসার করাটা কতটা নিরাপদ?

আজ অবধি মালতির শীতল আচরণের জন্য কখনও কৈফিয়ত চায়নি বিমল, নীরবেই সহ্য করে গেছে সমস্ত অবহেলা। এজন্যই হয়তো তাকে ছেড়ে যেতে মন সায় দেয়নি মালতির। তার অবচেতন মন হয়তো দেখতে চেয়েছে, তাকে ঠিক কতটা ভালবাসে বিমল!

পরের সন্ধ্যায় বিমল খেতে বসলে, নিজের অজান্তেই টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল মালতি। নিজ হাতে খাবার তুলে দিল বিমলের টিনের থালায়।

ব্যাপারটা বহু বছর পর ঘটলেও, খুব স্বাভাবিকভাবেই নিল বিমল। এমন ভাব করল, যেন রোজই তাকে খাবার বেড়ে দেয় মালতি!

হালকা গলায় বলল, ‘তুমি খাবে না?’

মুখ তুলে তার দিকে তাকাল মালতি। জবাব দেবে কিনা, সেটাই বোধহয় ভাবল খানিকক্ষণ। তারপর বলল, ‘পরে খাব। তুমি খাও।’

আলতো করে মাথা নাড়ল বিমল, মুখে কিছু বলল না। প্লেটের খাবারের দিকে মনোযোগ দিল সে। হাত বাড়িয়ে খানিকটা নুন তুলে নিয়ে, ভাত মাখিয়ে,

খেতে শুরু করল।

হতবাক মালতি, কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল বিমলের নিরাসক্ত চেহারার দিকে। তারপর হতাশ গলায় বলল, ‘তোমার সমস্যাটা কী?’

খাওয়া অব্যাহত রাখল বিমল। ‘কই! কোন সমস্যা নেই তো!’

‘সমস্যা না থাকলে অফিসে যাচ্ছ না কেন? চাকরি চলে গেছে?’

‘চাকরি চলে যাবে কেন! কয়েক দিনের ছুটি নিয়েছি।

‘কেন? কী করো তুমি সারাদিন ঘরে বসে?’ সতর্ক গলায় জিজ্ঞেস করল মালতি।

এতক্ষণে মুখ তুলে তাকাল বিমল; আগ্রহ ফুটে উঠেছে দু’চোখে। ‘জীবনটা পাল্টাতে চাইছি, বুঝলে…ভীষণ একঘেয়ে হয়ে পড়েছিল সবকিছু।’

‘ও আচ্ছা। ভাল,’ নিরুত্তাপ গলায় বলল মালতি। ‘তা কীভাবে করতে চাচ্ছ কাজটা, শুনি?’

চওড়া হাসি ফুটল বিমলের চেহারায়। ‘দাদার লেখা একটা ডাইরি খুঁজে পেয়েছি। ওতেই বিশদভাবে লেখা আছে সমস্ত নিয়মকানুন। ‘

‘দাদা! তোমার দাদা?’ দ্রুত বলে উঠল মালতি। ‘আমি তো জানতাম, পাগল ছিলেন উনি।

নিমেষেই হাসি মুছে গেল বিমলের মুখ থেকে, চোখ-মুখ কঠিন হয়ে গেল। ‘ভুল জানতে। মোটেও পাগল ছিলেন না তিনি। লোকে খামোকাই তাঁর নামে ভুলভাল বলত। সত্যি বলতে, অনেক বড় একজন মূষিক-সাধক ছিলেন তিনি।’

‘কী ছিলেন?’ অবাক হয়ে জানতে চাইল মালতি।

‘মূষিক…ইঁদুর, ইঁদুর। ইঁদুরের সাধনা করতেন তিনি।’

‘ইঁদুরের সাধনা!’ আপনমনে বিড়-বিড় করল মালতি। ‘তাহলে তো ঠিকই বলত লোকে! সত্যিই দেখছি বদ্ধ উন্মাদ ছিল লোকটা!’

‘মোটেও না, মালতি। একেবারেই সুস্থ একজন মানুষ ছিলেন তিনি। আমাদের যে কারও চেয়ে বেশি বুদ্ধি রাখতেন মাথায়,’ চটজলদি বলে উঠল বিমল। ‘ইঁদুরদের ক্ষমতা সম্পর্কে তেমন কোন ধারণাই নেই মানুষের। একারণেই হয়তো সবার কাছে এতটা অস্বাভাবিক লাগে ব্যাপারটা।’

‘তাই বুঝি?’ ব্যঙ্গ ঝরে পড়ল মালতির কণ্ঠে। ‘তা কী-কী ক্ষমতা আছে মহা পরাক্রমশালী ইঁদুরদের?’

তার গলার উপহাসের সুরটা সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করল বিমল। ‘অনেক ক্ষমতা, অনেক। সারা রাত বর্ণনা করেও শেষ করা যাবে না সেসব। তবে তুমি জানতে চাইলে, ওদের একটা বিশেষ ক্ষমতার কথা বলতে পারি তোমাকে।’

‘বলো তাহলে। শুনে ধন্য হই।’

কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইল বিমল; পুরো বিষয়টায় খানিকটা বাড়তি গুরুত্ব আরোপের প্রয়াস পাচ্ছে। ‘নরকের সন্ধান জানে ইঁদুরেরা। এই সাধনায় সফল হলে, জীবিত মানুষ হয়েও নরক দর্শন করতে পারব আমি।

‘অন্যদেরকে নরক দেখানোর ক্ষমতা তো তোমার এখনই আছে,’ চিবিয়ে- চিবিয়ে বলল মালতি। ‘আমার জীবনটা কোন দোজখের চাইতে কম কীসে?’

চমকে উঠল বিমল। কথাটার মর্মার্থ অনুধাবন করতে, বেশ খানিকটা সময় লাগল তার। পরক্ষণেই চেহারাটা রক্তবর্ণ ধারণ করল, ভীষণ রেগে গেছে।

তবে সেদিকে কোন ভ্রূক্ষেপও করল না মালতি; অনল বর্ষণ অব্যাহত রাখল। ‘এক সপ্তাহ সময় দিলাম তোমাকে। ভাল চাইলে এসব পাগলামি ছেড়ে ছুড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফেরত এসো। নইলে ভয়াবহ পরিণতি অপেক্ষা করছে তোমার জন্য, এই আমি বলে দিলাম।’

এক মুহূর্তের বিরতি নিয়ে আবারও মুখ খুলল সে, ‘যদি ভেবে থাকো, বাপের বাড়িতে চলে যাব আমি; তাহলে ভুল ভাবছ। যেতে চাইলে অনেক আগেই যেতে পারতাম, এতদিন অপেক্ষা করতাম না। আমি নই, তোমাকেই বরঞ্চ জায়গামত পাঠানোর ব্যবস্থা করা হবে। সেটা কোথায়, বুঝতে পারছ তো? পাগলা গারদে। আমার মনে হয়, দিনে-দিনে মানব সমাজে বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ছ তুমি!’

সশব্দে চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়াল মালতি, হন হন করে হেঁটে চলে গেল তার শোবার ঘরের উদ্দেশে।

.

আরও বহুক্ষণ সেখানেই ঠায় বসে রইল বিমল, উথলে ওঠা ক্রোধটাকে দমন করতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে তাকে।

মধ্যযুগে বন্দিদের ওপর ইঁদুরদের দিয়ে অত্যাচার চালাত সম্রাটরা। একটা ইঁদুরকে কয়েকদিন ধরে অভুক্ত রাখা হত, এতে করে ভীষণ ক্ষুধার্ত আর হিংস্র হয়ে উঠত জানোয়ারটা।

নির্দিষ্ট দিনে একজন বন্দিকে নগ্ন করে হাত-পা বেঁধে ফেলা হত। তারপর একটা খাঁচা সমেত ইঁদুরটাকে এনে রাখা হত লোকটার পেটের ওপর!

লোহার তৈরি খাঁচাটার অন্য সবদিক বন্ধ থাকলেও, কেবল নীচের দিকটা খুলে দেয়া হত। অনেকটা বাধ্য হয়েই বন্দির পেটের নরম চামড়া খুঁড়তে শুরু করত ইঁদুরটা, ধীরে-ধীরে সেঁধিয়ে যেত উদরের গভীরে! বাঁচার পথ এবং খাবার, দুটোই চাই তার।

পুরোটা সময় সজ্ঞানে ওই ভয়াবহ যন্ত্রণাটা অনুভব করত হতভাগা মানুষটা। তারপর একসময় তীব্র বেদনা অথবা অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মারা যেত। কিংবা বলা ভাল, মুক্তি পেত।

মালতিকে এখনই ওই ধরনের কোন শাস্তি দিতে ইচ্ছে করছে বিমলের!

রোমান সম্রাটদের মত ক্ষুধার্ত ইঁদুর ভর্তি একটা গোপন কুঠুরি যদি তার থাকত, নির্ঘাত এখন মালতিকে ওটাতে ঠেলে ফেলে দিত সে।

শত-সহস্র ইঁদুর একযোগে ঝাঁপিয়ে পড়ছে মালতির নধর দেহটার ওপর; দৃশ্যটা মানসপটে কল্পনা করতেই ভীষণ পুলক অনুভব করল বিমল!

পাঁচ

প্রয়াত মূষিক-সাধকের ডাইরির ভাষ্য অনুযায়ী, সাধনার পরবর্তী ধাপের জন্য বেশ কিছু জিনিসপত্র জোগাড় করল বিমল।

একেকটা উপকরণ খুঁজে বের করতে রীতিমত গলদঘর্ম হতে হলো বেচারাকে। সাধনার জন্য যে এসব জিনিসেরও প্রয়োজন পড়তে পারে কখনও, এটা সে কস্মিনকালেও কল্পনা করেনি।

মিয়ানো মুড়ি

খানিকটা ঝোলা গুড়

গোটা দুয়েক পচা ডিম

মাকড়সার ঝুল

দুটো নোনতা বিস্কিট

চালের রুটি

ডুবো তেলে ভাজা সিঙ্গাড়া

গোটা চারেক বাতাসা

একটা মরা টিকটিকি

বাসি পাউরুটি

খানিকটা মাখন

কয়েক বছরের পুরনো গম

আধ কাপ মোরগের রক্ত

কয়েক ছটাক আমন ধানের চিটা

এক মুঠো শুকনো দূর্বাঘাস

কয়েক গাছি বিড়ালের লোম

খানিকটা লাল মাটি

আরও কত কী…!

এসব জোগাড়যন্ত্র করা কি চাট্টিখানি কথা?

তবুও শেষতক ঠিকই সবকিছু এক জায়গায় জড় করল বিমল। একখানা বড় পোড়ামাটির পাত্র খুঁজে নিয়ে, তাতে আধ লিটার পানি ভরে নিল। তারপর সবগুলো উপকরণ ভালমত মিশিয়ে এক ধরনের শরবত মতন তৈরি করল।

জিনিসটা দেখতে অবিকল থকথকে কাদার মত। আর গন্ধটা এমন যে, মরণাপন্ন কোন মানুষের নাকের সামনে ধরলেও লাফিয়ে উঠে পালিয়ে যেতে দিশা পাবে না বেচারা!

একটা বড় মগে তরলটা ছেঁকে নিল বিমল, তারপর কিচেনের মিটসেফে তুলে রাখল সকালে ব্যবহার করার জন্য। ওটাকে পুরো রাত নিজের কাছে রাখার কোন উপায় নেই; রসুইঘরের আলমারিতে লুকিয়ে রাখাটাই নিয়ম। সারা রাতের পর ভোরের একেবারে শুরুর দিকে একদমে পান করতে হবে তাকে জিনিসটা, এর কোন অন্যথা করা যাবে না।

যদিও ওটা গেলার কথা কল্পনা করামাত্রই ভিতর থেকে সমস্তকিছু বেরিয়ে আসার উপক্রম হচ্ছে বিমলের। কিন্তু করার কিছুই নেই তার; হাত-পা বাঁধা। সাধনার উপরিস্তরে উন্নীত হওয়ার জন্য অদ্ভুত এই শরবতটা গলাধঃকরণের কোন বিকল্পই নেই।

প্রত্যূষে পা টিপে-টিপে রান্নাঘরে গিয়ে মগটা বের করে আনল বিমল। বাইরে তখনও পুরোপুরি আলো ফোটেনি; নিজের ঘরে বেঘোরে ঘুমুচ্ছে মালতি।

খানিকক্ষণ ইতস্তত করে ঠিকই শেষটায় নিজের গলায় ঢেলে দিল বিমল নাড়িভুঁড়ি উল্টে আসতে চাইল তার, শ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলো; তবুও হাল ছাড়ল না সে। নিজের ওপর জোর খাটিয়ে গিলে নিল সবটুকু শরবত, খালি করে ফেলল মগটা। তারপর চোখ বুজে বসে রইল নিজের জায়গায়; শরীরটা কেমন- কেমন যেন করছে তার।

এহেন অখাদ্য একটা জিনিস পেটে চালান করার পর প্রচণ্ড অস্বস্তি লাগার কথা, পেট নেমে যাওয়ার কথা। উল্টো নিজের ভিতরে রাজ্যের ক্ষুধা অনুভব করল বিমল! এই মুহূর্তে প্রাগৈতিহাসিক ম্যামথ সামনে পেলেও যেন কাঁচা চিবিয়ে সাবাড় করে ফেলতে পারবে সে!

ঠিক এমনটাই অবশ্য লেখা ছিল ডাইরিটায়!

অপরিমেয় ক্ষুধা একটা প্রাণীকে ঠিক কতটা বিচলিত করে তুলতে পারে, সেটাই এখন অনুভব করবে বিমল। কোন সাধারণ খাবারেই এই বিশেষ ক্ষুৎপিপাসা মিটবার নয়। গোটা একটা দিন দুর্যোগটা কাটানোর পর, রাতে খুলতে হবে ডাইরির পরবর্তী পাতাটা; ওতেই মিলবে সমাধান।

বহুদিন পর আবারও সেদিন অফিসের উদ্দেশে তৈরি হলো বিমল। যাত্রাপথে আবুল মিয়ার টঙ দোকানে রোজকার এক কাপ চা আর দুটো টোস্ট বিস্কিটের বদলে, ভরপেট খাবার খেল সে।

চার প্যাকেট মিষ্টি বিস্কিট, দুটো বড় পাউরুটি, দশ কাপ চা আর গোটা পনেরো সেদ্ধ ডিম খেয়ে, আবুল মিয়ার ছানাবড়া চোখজোড়াকে পেছনে রেখে অফিসের উদ্দেশে পা বাড়াল বিমল। তখনও তার পেটের আগুন একরত্তিও নেভেনি!

কিন্তু আবুলের দোকানে এর বেশি আর খাওয়ার উপায় ছিল না। কারণ কেবল দোকানীই নয়, অন্য সব খদ্দেররাও বিস্ফারিত নয়নে তাকিয়ে ছিল তার দিকে! এতগুলো মানুষ অপলক তাকিয়ে থাকলে, কারই বা আর খেতে ইচ্ছে করে!

অফিসে ঢুকেই রাঘবকে উচ্চস্বরে বার কয়েক ডাকল বিমল। কান দিল না রাঘব; বিমলকে পাত্তা না দিয়েই অভ্যস্ত সে। গড়িমসি করে অনেকটা সময় কাটিয়ে, তবেই বিমলের টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়াল সে।

মুখ বাঁকিয়ে বলল, ‘কী কাম?’

‘কিছু খাবার এনে দাও। জলদি।’

‘অহন পারুম না। অন্য কাম আছে। বড় সাব যে কোন সময় ডাকবার পারে।’

নিজের ভাগ্যের লিখন সম্পর্কে যদি বিন্দুমাত্রও ধারণা থাকত রাঘবের, ভুলেও, আজ বিমলের সঙ্গে বেয়াদবি করত না সে!

বিদ্যুৎ গতিতে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল বিমল, সজোরে চেপে ধরল রাঘবের ইউনিফর্মের কলার। তারপর দেহের সর্বশক্তি দিয়ে একখানা রামচড় বসিয়ে দিল তার ডান গালে। ছিটকে দু’হাত দূরে গিয়ে পড়ল রাঘব, মাথাটা বোঁ-বোঁ করে ঘুরছে তার। বিমলের হাতটা তার গাল ছোঁয়ার আগ পর্যন্ত ঘটনার কিছুই আঁচ করতে পারেনি সে।

কোনমতে হাঁচড়ে-পাঁচড়ে উঠে দাঁড়াল সে, চেয়ারের হাতল খামচে ধরে নিজেকে ফের পতনের হাত থেকে রক্ষা করল। তারপর হতভম্ব দৃষ্টিতে তাকাল বিমলের অগ্নিশর্মা চেহারাটার দিকে।

চার চোখের মিলন হতেই আতঙ্কে রীতিমত কুঁকড়ে গেল রাঘব। চোখ তো নয়, যেন এক জোড়া অঙ্গার!

কী হয়েছে লোকটার? রাতারাতি এভাবে বদলে গেল কেমন করে? আজ কেবল ভগবানই পারেন এই দানবের হাত থেকে তাকে রক্ষা করতে।

‘ছোটলোকের বাচ্চা,’ হিসহিসিয়ে বলল বিমল। ‘আর কখনও যদি আমার মুখে-মুখে কথা বলিস, জুতোর তলা দিয়ে তোর ঠোঁট দুটো একদম থেঁতলে দেব আমি।’

তীব্র আতঙ্কে কাঁপতে-কাঁপতে বিমলের কথাগুলো শুনল রাঘব; নড়াচড়া করার সাহসটুকুও যেন হারিয়ে ফেলেছে সে। অবশ্য ভয় কেবল সে-ই নয়, অফিসের বাদবাকি সবাই-ই পেয়েছে। উপস্থিত সবক’টা চোখ কোটর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ার চেষ্টায় মত্ত; পলক পড়ছে না কারও চোখে! নিজের ওপর বিশ্বাস হারিয়েছে সব ক’জন মানুষ, সত্যিই কি খানিকক্ষণ আগে কিছু ঘটেছিল এখানে? নাকি সবটাই ভ্ৰম?

সেদিন অন্তত দশ বার বিমলের জন্য খাবার আনতে বাইরে গেল রাঘব, ভুলেও একটা সেকেণ্ড বাড়তি সময় নষ্ট করেনি সে। অন্য কেউও রাঘবকে সেদিন কোন কাজের ফরমায়েশ দিল না; পাছে ওকে না পেয়ে রেগে যায় বিমল!

মিনিট পাঁচেকের জন্য বিমল একবার টয়লেটে যেতেই জাদুমন্ত্রের মত উধাও হয়ে গেল তার টেবিলের বেশিরভাগ ফাইল! সবাই আজ নিজেদের কাজ নিজেরাই করবে; জলদি বাড়ি ফেরার তাড়া নেই আজ কারও!

সন্ধ্যায় ঘরে ফেরার আগে অন্তত পাঁচটা রেস্টুরেন্টে ঢু মারল বিমল। প্রতিটাতেই অন্তত দশ জন পূর্ণবয়স্ক মানুষের খাবার পেটে চালান করল সে।

বিরিয়ানি, সাদা ভাত, মোরগ-পোলাও, মণ্ডা-মিঠাই, কিছুতেই কিছু হলো না; উদরের এক কোনাও ভরল না তার। পিপাসায় বুকের ছাতি ফেটে যাওয়ার উপক্রম হলো; প্রশান্ত মহাসাগরের সমস্ত জল গিললেও যেন সেই রাক্ষুসে পিপাসা মিটবার নয়!

বিফল মনোরথে ঘরে ফিরে আবারও দাদার ডাইরিটা হাতে তুলে নিল বিমল, তড়িঘড়ি করে খুলল সমাধান লেখা সেই বিশেষ পাতাটা।

পুরো পৃষ্ঠা জুড়ে কেবল একটামাত্র শব্দই লেখা ছিল, তাতে, ‘মানুষের মাংস!’

ছয়

গভীর রাতে নিজের জন্য রাঁধতে বসল বিমল। পুরো মহল্লা ততক্ষণে ঘুমিয়ে কাদা, সুনসান নীরবতা বিরাজ করছে চরাচরে।

অন্যান্য দিন রাত-বিরেতে চৌকিদারের হাঁকডাক শোনা যায় বটে, তবে আজ সেটাও অনুপস্থিত। নেড়ি কুকুরের দল কোথায় কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে, কে জানে! ওদেরও কোন সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না।

আপনমনে খানিকক্ষণ হাসল বিমল। বহুদিন পর আজ উনুনে হাঁড়ি চড়িয়েছে সে; অথচ একটা সময় রোজই তাকে কিছু না কিছু রাঁধতে হত। রান্নার হাত বরাবরই ভাল ছিল তার। যে-ই খেয়েছে, উচ্ছ্বসিত প্রশংসা না করে পারেনি।

তবে বিয়ের পর আর খুব একটা বাবুর্চিগিরি করার মওকা পায়নি সে। পুরুষ মানুষ রসুই ঘরের হাঁড়ি-পাতিলের চারপাশে ঘুর-ঘুর করবে, ব্যাপারটা ভীষণ অপছন্দ ছিল মালতির।

সে রাতে তৃপ্তি সহকারে উদরপূর্তি করে আহার করল বিমল। মূষিক-সাধকের নিদান অনুযায়ী, তার পেটের রাক্ষুসে খিদেটাও মিটে গেল পুরোপুরি!

মাংসের সালনটা অবশ্য বেশ ঝাল হয়েছিল, তবে তাতে খুব একটা সমস্যা হয়নি বিমলের।

বেঁচে থাকতে যে পরিমাণ ঝাঁঝ ছিল মালতির, খানিকটা বাড়তি ঝাল না দিলে তার মাংস মুখে রুচত কিনা কে জানে!

সাত

এক বিকেলে বাক্স-পেটরা নিয়ে নিজের গ্রাম, বিজয়পুরে গিয়ে হাজির হলো বিমল। সীমান্তের কাছাকাছি টিলাটক্কর আর খানাখন্দে ভরা একটা পাহাড়ি গ্রাম, বিজয়পুর। বিমলের পৈতৃক ভিটাটা এখনও রয়ে গেছে, বিক্রি করেনি সে।

তার বেশ কিছু চাষবাসের জমিও আছে ওখানে, তবে ওগুলোর খোঁজ খুব একটা রাখে না সে। দূরসম্পর্কের চাচা-জ্যাঠারাই আজতক ভোগদখল করে আসছে জমিনগুলো।

বাড়িটাও এতদিনে জবরদখল হয়ে যেত নির্ঘাত; তবে একটা পুরানো কুসংস্কারই রক্ষা করে চলেছে ওটাকে।

আড়ালে আবডালে পাগল বললেও, বিমলের দাদাকে ঠিকই ভয় পেত লোকে। সেই ভয়টা এখন অবধি কাটেনি। তার যে বিশেষ কিছু ক্ষমতা ছিল, এ নিয়ে দ্বিমত নেই কারও। এমন একজন কামেল তান্ত্রিকের বসতভিটা দখলের কথা কল্পনাও করতে পারে না ওরা। জরাজীর্ণ একটা ইমারতের লোভে নিজেকে নির্বংশ করার কোন মানে হয় না।

আদতেই বেহাল দশা বাড়িটার। কী করে যে এখনও নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে আছে সেটাই বিস্ময়কর! সীমানা প্রাচীর বহু আগেই মাটির সঙ্গে মিশে গেছে, ফটকের কোন বালাই নেই। পুরো বাড়ি জুড়ে ঝোপঝাড় আর আগাছার দঙ্গল, পায়ে হাঁটার পথটুকুও নেই।

দালানটার মুমূর্ষু দশা, রীতিমত ধুঁকছে। বাতাসের একটা জোরদার ধাক্কায়, হুড়মুড় করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ার সম্ভাবনা প্রবল। রঙের কোন বালাই নেই, পলস্তারা খসে দেয়ালের হাড় বেরিয়ে পড়েছে বেশিরভাগ জায়গায়।

এক সময় যেখানে দরজা-জানালা নামের বস্তুগুলো ছিল, এখন সেখানে শুধুই শূন্যতা; কালো ফোকর। খানিকটা ডান দিকে হেলে আছে রুগ্ন ছাত; জমিনের আহ্বানে সাড়া দিতে পুরোপুরি প্রস্তুত!

হাজার টাকা সাধলেও কোন সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ এ বাড়িতে জীবন যাপন করতে রাজি হবে বলে মনে হয় না।

তবে আজ রাতটা বিমলকে এখানেই কাটাতে হবে! কারণ ডাইরির বয়ান মোতাবেক, সাধনার শেষ লগ্নে এ বাড়িরই কোথাও উন্মুক্ত হবে নরকের পথটা!

বিমলের এই আকস্মিক আগমনে তার আত্মীয়স্বজনদের কেউই ঠিক খুশি হতে পারল না। তারা বিমলের সঙ্গে দেখা করতে এল মুখ ভার করে। সবার বদ্ধমূল ধারণা, বিমল এবারে নির্ঘাত সমস্ত জমিজমা বিক্রি করতে এসেছে! হয়তো কোন কারণে টাকাপয়সার টানাটানি চলছে তার, তাই দেখতে এসেছে এখানকার সহায়সম্পত্তি বিক্রিবাট্টা করে কিছু পাওয়া যায় কিনা।

এতদিন ভোগদখল করতে-করতে জমিগুলো নিজেদেরই ভাবতে শুরু করেছিল ওরা। ভাবতেও পারেনি, ন্যায্য দাবি নিয়ে কোন একদিন আচমকা এসে হাজির হবে ওগুলোর প্রকৃত মালিক!

শঙ্কর জ্যাঠার মুখটাই বেজার বেশি; বিমলের সিংহভাগ জমি তার দখলেই আছে কিনা!

শুকনো স্বরে বিমলকে জিজ্ঞেস করল সে, ‘তা হঠাৎ কী মনে কইরা গেরামে আইলা, ভাতিজা?’

হাসল বিমল। ওদের মনে কী চলছে, আন্দাজ করতে কষ্ট হচ্ছে না তার। ‘এমনিতেই এলাম। বিশেষ কোন কারণ নেই। অনেকদিন আসার সুযোগ হয়নি। তাই ভাবলাম, একবার এসে ঘুরে যাই। আপনাদের সবার সঙ্গে একবার দেখা করে যাই। আপনারা ছাড়া আপন বলতে আর কে-ই বা আছে আমার।’

ঠোঁটে হাসি ফোটানোর বৃথা চেষ্টা করল শঙ্কর। ‘ভালাই করসো, ভাতিজা। সেই যে শহরে চইলা গেলা, আর তো গেরামে পা-ও ফেললা না।’

সেজন্যই এলাম এবার। দিন দুয়েক থাকব, তারপর আবার ফিরে যাব শহরে।’

‘জমি-জিরাতের কোন কারবার আছেনি, ভাতিজা?’ খুব সাবধানে প্রশ্নটা করল শঙ্কর।

‘আরেহ, না, না,’ তাকে আশ্বস্ত করল বিমল। ‘আমি কেবল দাদার ভিটায় দুটো দিন থাকতে এসেছি। অন্য কোন উদ্দেশ্য নেই।’

এবারে দাঁত কেলানো হাসি ফুটল শঙ্করের মুখে; অন্যদেরও যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল। আচমকা বিমলকে সমাদর করতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ল সবাই।

‘এই বাড়িতে তো আর রাইতে থাহনের উপায় নাই। তুমি আমাগো বাড়িতে চলো। সকালে নাহয় সবকিছু ঘুইরা দেইখো,’ বলে উঠল বিমলের চাচা, আদিত্য।

মাথা নাড়ল বিমল। ‘না, খুড়ো মশাই। আমাকে রাতে এই বাড়িতেই থাকতে হবে। যদি একটা ঘর খানিকটা পরিষ্কার করে দেন, আর রাতে জ্বালানোর মত একটা লণ্ঠন পাওয়া যায়; তাহলেই চলবে।’

‘কও কী তুমি! এইহানে ক্যামনে থাকবা রাইতে! ভূত-প্রেতের কথা নাহয় বাদই দিলাম, সাপ-খোপেরও তো অভাব নাই পুরা বাড়িতে।’

কাঁধ ঝাঁকাল বিমল; হাসছে। ‘সমস্যা হবে না, খুড়ো মশাই। সঙ্গে করে কার্বলিক এসিড নিয়ে এসেছি আমি।’

একে অন্যের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল সমবেত জনতা, ঠোঁটে কোন রা নেই কারও। কেন এই পোড়ো বাড়িতে রাত কাটাতে গোঁ ধরেছে বিমল, এটা কারোরই মাথায় আসছে না!

বয়স্ক একজন মানুষকে তো আর জোরও করা যায় না তেমন। কী বলবে, কিছুই মাথায় আসছে না ওদের।

অবশেষে অনেকক্ষণ পর নীরবতা ভাঙল শঙ্কর। হতাশ গলায় বলল, ‘খাওন? রাইতের খাওড়া তো অন্তত আমাগো লগে খাইবা, নাকি?’

‘তা খাওয়া যায়। এতে কোন আপত্তি নেই আমার,’ হাসিমুখে জবাব দিল বিমল।

হাঁফ ছাড়ল সবাই। সদলবলে বিমলকে এগিয়ে নিয়ে গেল শঙ্করের বাড়ির উদ্দেশে।

অল্প সময়ে বেশ জমকালো আয়োজনই করা হলো বিমলের জন্য। জানা- অজানা অজস্র পদে বোঝাই হয়ে গেল খাবার টেবিল।

আরও বহুবছর ফসলের খেতগুলো ভোগদখল করতে পারবে, এই নিশ্চয়তা পেয়ে হাত খুলে খরচ করেছে শঙ্কর; কোন কার্পণ্য করেনি

দ্বিগুণ মাইনেতে ঠিক করা দু’জন দিনমজুর গিয়ে বাড়িটার সবচেয়ে বড় ঘরটা যথাসম্ভব সাফসুতরো করে দিল; ওটাতেই রাত কাটাবে বিমল। একটার বদলে দুটো লণ্ঠনের ব্যবস্থা করা হলো, সারা রাত ধরে আলো দেবে ওগুলো। চারপাশে আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে দেয়া হলো কার্বলিক এসিড; সাপের দল এই জিনিসটা একেবারেই সহ্য করতে পারে না।

অবশেষে ভূরিভোজের পর গ্রামের মান্যগণ্য মানুষজনের সঙ্গে ভাব বিনিময় শেষে, নিজের বাড়ির উদ্দেশে পা বাড়াল বিমল। দু’জন জোয়ানমর্দ লোক তাকে বাড়িটার সীমানা অবধি এগিয়ে দিয়ে গেল। ঘড়ির কাঁটায় সময় রাত এগারোটা বেজে ত্রিশ মিনিট।

.

নিশুতি রাতে আগের চেয়েও অনেক বেশি ভুতুড়ে দেখাচ্ছে বাড়ির কাঠামোটাকে কোণের ঝাঁকড়া নিম গাছটার ডালগুলো এমনভাবে দুলছে, যেন প্রচণ্ড আমোদে মাথা ঝাঁকাচ্ছে কোন দুষ্ট প্ৰেত!

আকাশে চাঁদ আছে, তবে জোছনাটা কেমন যেন ঘোলাটে। পাতলা মেঘের সার্বক্ষণিক আনাগোনা স্বচ্ছন্দে আলো বিলাতে বাধা দিচ্ছে ওটাকে।

দ্রুত কাপড়-চোপড় ছেড়ে সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে গেল বিমল। হাত বাড়িয়ে কমিয়ে দিল লণ্ঠনগুলোর আঁচ। এখন আর কেউ আচমকা ঘরে ঢুকলে আবছা আলো- আঁধারিতে চট করে দেখতে পাবে না তাকে।

অবশ্য কুসংস্কারাচ্ছন্ন গ্রামবাসীদের কেউই যে মাঝরাতে এ বাড়িমুখো হবে না, এই ব্যাপারে শতভাগ নিশ্চিত বিমল। তবুও সতর্ক থাকা ভাল। গাঁয়ে একটা সম্মান আছে তার, অযথা সেটা খোয়ানোর ঝুঁকি নেয়ার কোন মানেই হয় না।

পুঁটলির ভিতর থেকে দুর্গন্ধময় একটা তেলের শিশি বের করল বিমল; আচ্ছামতন মেখে নিল সারা শরীরে। সিন্দুকে পাওয়া বোতাম আকৃতির পাথরগুলো বের করে বড় একটা বর্গ তৈরি করল মেঝেতে। তারপর ওর ভিতর গিয়ে চিত হয়ে শুয়ে পড়ল, এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ছাতের একটা ফাটলের দিকে; মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করছে।

তারপর ধীরে-ধীরে চোখ মুদল সে; মূষিক-সাধনার মন্ত্র জপতে শুরু করল। পুরো দেহটা মূর্তির মত অনড় তার, শুধু ঠোঁটদুটো ক্রমাগত ওঠানামা করছে।

দেখতে-দেখতে পেরিয়ে গেল অনেকটা সময়, কিন্তু তেমন কিছুই ঘটল না। শুধু ঘেমে-নেয়ে একাকার হয়ে গেল বিমলের বিবস্ত্র শরীরটা।

এক মুহূর্তের জন্যও মন্ত্র জপা থামাল না সে, ঠোঁটজোড়া নড়ে চলল অনর্গল। বাইরে ততক্ষণে একাকী চাঁদকে ঘিরে ধরেছে দস্যু মেঘেরা।

অনেক-অনেকক্ষণ পর মাটির গভীরে মৃদু একটা কম্পন অনুভব করল বিমল; সেই সঙ্গে দূরাগত মেঘের গর্জনের মতন ভোঁতা একটা আওয়াজ। যেন বহুদূর থেকে ধেয়ে আসছে বিশাল একটা অশ্বারোহীর দল!

পলকের জন্য এক চিলতে হাসি ফুটল বিমলের ঠোঁটের কোনায়, মন্ত্র জপার গতি আরও বাড়িয়ে দিল সে। অন্ধকার জগতের সমস্ত মূষিক অপশক্তিকে আহ্বান করছে সে। আগের মতই বুজে রেখেছে চোখ দুটো; খোলার সময় হয়নি এখনও।

ধীরে-ধীরে বাড়তে লাগল কম্পনটা, মেঘের গর্জনটাও যেন অনেকখানি কাছিয়ে এল। মন্ত্র জপা চালিয়ে গেল বিমল।

অবশেষে একটা বোটকা গন্ধ ভক্ করে এসে ধাক্কা দিল তার নাকে। গন্ধটা তার অতি চেনা, ইঁদুরের গন্ধ!

নিজের ওপর অসংখ্য চোখের দৃষ্টি অনুভব করল বিমল, একেকটা সুচের মতই যেন ছুটে এসে শরীরে বিঁধছে ওগুলো!

বার কয়েক কেঁপে উঠল বিমলের নেত্র-পল্লব; ধীরে-সুস্থে চোখ মেলল সে। জানে, কী দেখতে পাবে; তবুও এপাশ-ওপাশ মাথা ঘুরাল ও।

লক্ষ-কোটি ইঁদুর সারিবদ্ধভাবে ঘিরে রেখেছে বর্গটাকে। কুঁতকুঁতে চোখে তার দিকেই অপলক তাকিয়ে আছে নরকের বাসিন্দাগুলো!

ওকে চোখ মেলতে দেখেই নড়ে উঠল ইঁদুরের দল; সার বেঁধে এগিয়ে গেল বাইরের দিকে।

দ্রুত উঠে দাঁড়াল বিমল। ইঁদুরের দলের পিছু নিয়ে সম্মোহিতের মত বেরিয়ে এল খোলা বারান্দায়।

আকাশের চাঁদ ততক্ষণে হার মেনে নিয়েছে কালো মেঘের কাছে, তবে সামনের দৃশ্যটা ঠিকই পরিষ্কার দেখতে পেল বিমল।

আগাছার দঙ্গলের মধ্যখান দিয়ে প্রশস্ত একখানা রাস্তা তৈরি হয়েছে, এই পথেই ঘর অবধি এগিয়ে এসেছে অগণিত ইঁদুর।

পথটা গিয়ে শেষ হয়েছে আঙিনার একেবারে শেষ প্রান্তে, একটা কুয়োর মুখে। আজ বিকেলেও কুয়ার চাড়িটা আবর্জনা আর জংলায় ঢাকা ছিল। আগে থেকে জানা না থাকলে, কেউ ভাবতেও পারবে না, ওখানে একটা মান্ধাতা আমলের কুয়োমুখ লুকিয়ে আছে!

কিন্তু এই মুহূর্তে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে ওটাকে। কোন সন্দেহ নেই, ওই কুয়োর ভিতর দিয়েই পাতাল ফুঁড়ে বেরিয়ে এসেছে ইঁদুরের দল; ওটাই নরকে যাওয়ার পথ!

মন্ত্রমুগ্ধের মত এগিয়ে গিয়ে কুয়োটার ভিতরে উঁকি দিল বিমল, তাকে সঙ্গ দিল সুশৃঙ্খল মূষিকের পাল।

কুয়োর ভিতরের দেয়ালটা আগে একেবারে মসৃণ ছিল। এখন সেখানে খানিক বাদে-বাদে খোঁড়ল তৈরি করে একটা মইমতন বানানো হয়েছে। নিঃসন্দেহে এটা ইঁদুরদেরই কাজ।

এক মুহূর্তের জন্যও ইতস্তত করল না বিমল, ধাপগুলো বেয়ে নীচে নামতে শুরু করল। দ্রুত হাত-পা চালাচ্ছে সে; যত জলদি সম্ভব কুয়োর তলায় পৌঁছতে চায়।

ছায়ার মত তার সঙ্গে সেঁটে রইল মূষিকের পাল, জলস্রোতের মত কুয়োর দেয়াল বেয়ে নামতে শুরু করেছে ওরা।

বিমল নামছে তো নামছেই; এই অবরোহণের যেন কোন সমাপ্তি নেই! তার হাত-পায়ের পেশিগুলোঁ প্রচণ্ড ব্যথা করছে, মস্তিষ্কের আদেশ আর শুনতে চাইছে না।

মাথার ওপরের কুয়োমুখটা ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হতে-হতে একসময় একটা বিন্দুর আকার ধারণ করল, তবুও শেষ হলো না উলম্ব পথটা। অবশেষে যে-ই না হাল ছেড়ে দিয়ে নীচের অন্ধকারে নিজেকে সঁপে দিতে যাবে বিমল, ঠিক তখনই কুয়োর তলায় পৌঁছে গেল সে!

মেঝেতে শরীর এলিয়ে খানিকক্ষণ বিশ্রাম নিল বিমল। শ্বাসের তালে-তালে হাপরের মতন ওঠানামা করছে তার পাঁজরের হাড়। টনটন করছে গোটা দেহের সবক’টা মাংসপেশি।

আচমকা একটা গুঞ্জন কানে এল তার। গুঙিয়ে উঠেছে ইঁদুরের দল, যেন তাড়া দিচ্ছে তাকে!

ব্যস্তসমস্ত হয়ে উঠে দাঁড়াল বিমল। কুয়োর বাম পাশে একটা সুরঙ্গমুখ দেখতে পেয়ে হাঁটা শুরু করল ওটা ধরে। পথটা নতুন, সদ্যই খোঁড়া হয়েছে। ভিতরটা ঘুটঘুটে অন্ধকার, খুব একটা প্রশস্তও নয়। খুব সাবধানে পা ফেলতে হচ্ছে বিমলকে।

চোখে তেমন কিছু দেখতে না পেলেও আশপাশে ইঁদুরদের উপস্থিতি স্পষ্ট টের পাচ্ছে সে। এখনও তার চলনদারের ভূমিকা পালন করে চলেছে ওরা।

সুরঙ্গ পথে মাটির তলা দিয়ে ক্রমাগত দক্ষিণে এগিয়ে চলেছে বিমল। গাঁয়ের সবচেয়ে বড় পাহাড়টা ওদিকেই। ওখানকার মাটিতে কী যেন একটা সমস্যা আছে; কখনওই ওখানে ফসল ফলানো যায় না! এমনকী জুম চাষের চেষ্টাও বিফল হয়েছে প্রতিবার।

বিমলের মনে হচ্ছে, অনন্তকাল ধরে বুঝি পথ চলছে সে। তেপান্তরের মাঠ পেরোতেও তো এর চেয়ে কম সময় লাগার কথা!

আচমকা দৃষ্টিসীমার শেষপ্রান্তে খানিকটা আলোর আভা দেখতে পেল বিমল, সেই সঙ্গে অনুভব করল অদ্ভুত এক ধরনের খরতাপ!

যতই সে সামনে এগুতে থাকল, ততই বাড়তে লাগল ব্যাপারটার তীব্রতা। তাহলে কি সত্যিই অবশেষে নরকের দেখা পেতে চলেছে সে? নাকি আদতে কোন সুপ্ত আগ্নেয়গিরি ওটা?

এদিকে তার মাথার ওপর আমূল বদলে গেছে প্রকৃতি! বিনা নোটিশে ভয়াবহ এক ঝড় আঘাত হেনেছে বিজয়পুর গ্রামে। গাঁয়ের ছেলে-বুড়ো কেউই নিজেদের জীবদ্দশায় এতখানি তীব্র ঝড় ইতিপূর্বে কখনও চাক্ষুষ করেনি।

দমকা হাওয়ার প্রথম ঝাপটাতেই বিমলের পৈতৃক বসতবাড়িটা হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল। শতবর্ষী গাছগুলো হেলে পড়ে একেবারে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে ফেলল রুগ্‌ণ দালানটাকে।

বানের জল তীব্র বেগে ছুটে গেল কুয়োটার দিকে। প্রচণ্ড আক্রোশে ভেঙে খান-খান করে ফেলল ফুট চারেক উঁচু চাড়িটা, তারপর ভয়ানক তর্জন-গর্জন করতে-করতে রওয়ানা হলো পাতাল অভিমুখে!

ধেয়ে আসা জলের গর্জনটা যতক্ষণে শুনতে পেল বিমল, কিছুই আর তখন করার নেই তার।

আচমকা সুনসান পাতালপুরীতে নিজেকে ভীষণ একা লাগল তার। মূষিকের পাল কোন্ ফাঁকে বেমালুম গায়েব হয়ে গেছে, সেটা সে টেরও পায়নি। পরক্ষণে মালতির মায়াকাড়া মুখ আর অমলের নিষ্পাপ চাহনি ভেসে উঠল তার মনের পর্দায়। পাষাণ মাটির বুকে গড়িয়ে পড়ল দু’ফোঁটা অশ্রুজল।

ঘোরলাগা দৃষ্টিতে খানিকক্ষণ পিছনের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে রইল বিমল। মাথার ওপরের চেনা পৃথিবীটাতে আর কখনও ফেরা হবে না তার; ভাবনাটা ভীষণ কষ্ট দিচ্ছে তাকে।

আচমকা প্রাণপণে সামনের দিকে ছুটতে শুরু করল সে; জীবিত অবস্থায় একটিবারের জন্য হলেও নরক দেখতে চায়!

জলের স্তম্ভটা তাকে ছুঁয়ে ফেলার আগ পর্যন্ত এক মুহূর্তের জন্যও হাল ছাড়েনি বিমল কর!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *