প্ৰণয়

প্ৰণয়

একগাদা তেল চিটচিটে কাঁথার দঙ্গলে মুখ গুঁজে রেখেছে মানিক। শ্যামলা মুখখানা লালচে হয়ে গেছে তার। সেই সন্ধ্যা থেকেই একনাগাড়ে কেঁদে চলেছে সে। ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে, শিশুদের মত। সত্যিকারের পুরুষ মানুষরা কাঁদতে শেখেনি, চায়ের দোকানে বসে হাজারবার শোনা বেঁটে মাস্টারের অমোঘ বাণীটাও আজ তার কান্না রুখতে পারেনি।

বেঁটে মাস্টারকে এখন হাতের কাছে পেলে, চাবকে নির্ঘাত তার পিঠের ছাল- চামড়া তুলে নিত মানিক। তাতে যদি লোকটার নাম বেঁটে মাস্টার থেকে ছালছাড়া মাস্টারও হয়ে যেত, তাতেও কোন পরোয়া করত না সে।

সত্যিকারের পুরুষ মানুষেরা তাদের স্ত্রীকে ভালবাসে। আর সেই ভালবাসার মানুষের মৃত্যুতে গলা ফাটিয়ে কাঁদতেও পারে তারা!

মরিয়ম, মানিকের বউ, মাটির উপর বসবাস করা তার সর্বশেষ আপনজন, তিনদিনের জ্বরে ভুগে আজ দুপুরবেলা মারা গেছে। আজকাল জ্বরজারিতে কেউ মরে? সদরে গিয়ে ডাক্তার দেখানোর সুযোগটাও স্বামীকে দেয়নি সে। চার বছর আগে অগ্রহায়ণের এক বিকেলে, জনা পঞ্চাশেক লোককে সাক্ষী রেখে মরিয়মকে ঘরে তুলেছিল মানিক। লাল শাড়ি ছিল তার পরনে, গলায় ইমিটেশনের ভারী গয়না। পুরোদস্তুর নববধূর সাজে কী সুন্দরই না লাগছিল তাকে সেদিন।

আর আজ কি না গুটিকয়েক লোক মিলে তাকে পুঁতে দিয়ে এল কবরস্থানে! পরনে সাদা কাফন, শুধুই আবরণ, আভরণের বালাই নেই। মরিয়মের এহেন রূপ, কেমন করে সহ্য করবে মানিক? কেমন করে ঠেকাবে দু’চোখের বাঁধভাঙা বানের জল?

তাই তো সমবেদনা জানাতে আসা শেষ মানুষটিও যখন বাড়ির সীমানা ছাড়িয়ে দূরে চলে গেল, নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারাল মানিক। মরিয়মের শূন্য বিছানায় ঝাঁপিয়ে পড়ে চিৎকার করে কাঁদতে লাগল সে।

ঘড়িতে ঘণ্টা কয়েক পেরিয়ে যাবার পর দেহের শক্তিতে ভাটা পড়ল সত্যি, তবে দুঃখের ভাণ্ডার তখনও কানায় কানায় ঠিকই পূর্ণ। তাই গর্জন কমে এলেও বর্ষণ কমল না এতটুকুও। ঘড়ির কাঁটা যখন বারোটা ছুঁই-ছুঁই, তখনই কেবল সে রাতে প্রথমবারের মত মাথা তুলল মানিক।

বাইরে তখন ঝিঁঝি পোকারা ডেকে চলেছে অনর্গল। অন্যান্য দিন যে শব্দটায় সে ভীষণরকম বিরক্ত হত, আজ সেই একই শব্দ তার কানে মধু বর্ষণ করল। কারণ ঝিঁঝি পোকার এই ডাকটা খুব পছন্দ করত মরিয়ম।

কতদিন যে ঘরে ফিরে মরিয়মকে জানালার পাশে চুপটি করে বসে থাকতে দেখেছে মানিক, তার কোন ইয়ত্তা নেই। পরে জেনেছে, ঝিঁঝি পোকাদের এই সম্মিলিত নিনাদ মরিয়মকে নেশাতুর করে তুলত। অনেকটা নিশিতে পাওয়া মানুষদের মত। কাজকর্ম সব শিকেয় তুলে রেখে নিজের অজান্তেই নাকি জানালার পাশে বসে পড়ত সে! কতটা সময় কেটে যাচ্ছে, সেটা নাকি টেরও পেত না।

আর নেশা ছাড়াতে চুলের মুঠি খামচে ধরার চেয়ে ভাল কোন পদ্ধতি জানা ছিল না মানিকের! কারণে-অকারণে মরিয়মকে পেটাত সে। সপ্তাহে অন্তত দু’বার। এক সাধুর আখড়ায় শুনেছিল, নিয়মিত না পেটালে স্ত্রীরা কখনও স্বামীর বশে থাকে না। কথাটা মানিকের অবচেতন মনে বেশ ভালভাবেই গেঁথে গিয়েছিল।

ঘরে ফিরে মরিয়মের সঙ্গে নরম করে দুটো ভালবাসার কথা বলেছে মানিক, এমনটা কেউ কখনও দেখেনি। ঠোঁট ফাঁক করে মরিয়মের উদ্দেশে একটা জিনিসই কেবল ওগরাত সে-খিস্তি! অশ্রাব্য সব খিস্তি করতে গোটা তল্লাটে তার জুড়ি মেলা ভার।

স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার চিরন্তন দৈহিক ব্যাপারটাও অবধারিতভাবে নির্ভর করত মানিকের মর্জির উপর। মরিয়মের ইচ্ছা-অনিচ্ছার থোড়াই কেয়ার করত সে।

সেই মরিয়ম কী কৌশলে, কেমন করে মানিকের পাষাণ হৃদয় দখল করে নিয়েছিল, সেটা মানিকের নিজেরও জানা নেই। আজ বুকের মধ্যখানে আচমকা তৈরি হওয়া শূন্যতাটুকু রীতিমত অসহ্য ঠেকছে তার কাছে।

সহসাই আবিষ্কার করেছে মানিক, স্ত্রীকে যারপরনাই ভালবাসত সে! যদিও আচার-আচরণে এর উল্টোটাই সে প্রকাশ করেছে সবসময়, তবুও ওটা ভালবাসাই। অন্য দশজনের চেয়ে আলাদা, অনেকখানি অন্যরকম, তবে পুরোপুরি নিখাদ।

রোজ সন্ধ্যায় ঘরে ফেরার সময় হাত দুটো কখনও খালি থাকত না তার। আলতা, চুড়ি, নাকফুল কিংবা বিলেতি সাবান, কিছু না কিছু সে নিয়ে আসতই মরিয়মের জন্য। যদিও কখনও নিজহাতে ওগুলো বউকে দেয়নি সে! চৌকাঠ পেরিয়েই সজোরে খাটের উপর ছুঁড়ে ফেলত সে হাতের সদাই। তারপর লাল গামছাটা কাঁধে ফেলে বেরিয়ে যেত পুকুর ঘাটের উদ্দেশে। এটাই ছিল তার রোজকার রুটিন।

গোসল শেষে ফিরে এসে খাটের উপর গরম খাবার সাজানো পেত সে। কারণ মরিয়মের জানা ছিল, ক্ষুধার্ত মানিকের হাতের চড় গালে পাঁচ আঙুলের ছাপ ফেলে দেয়!

গঞ্জের বাজারে ছোট একখানা মুদি দোকান চালায় মানিক। আর বাজার মাত্রই নানা কিসিমের লোকজনের আনাগোনা, সেই সঙ্গে হরেক রকম কানকথার উড়োউড়ি। মরিয়মকে নিয়েও অমন উড়ো খবর বেশ কয়েকবারই কানে এসেছে তার! শুনেও না শোনার ভান করেছে মানিক। পুরোপুরি নির্লিপ্ত থেকেছে, কোনরকম উচ্চবাচ্য করেনি।

এমনকী মরিয়মকে এসব নিয়ে একটি প্রশ্নও কখন করেনি সে। তার ভয় হত, যদি দুম করে স্বীকার করে বসে মরিয়ম! যদি বলে দেয়, সব সত্যি! তাহলে কেমন করে বেঁচে থাকবে মানিক? কাকে নিয়ে বেঁচে থাকবে?

যদি সত্যিই রতন চোরার সঙ্গে মরিয়মের কোন সম্পর্ক থেকে থাকে, তাতে বাগড়া দিতে চায়নি মানিক! প্রতিটি মানুষেরই সুখী হবার অধিকার আছে, তাই না? বিধাতা কার সুখ কোথায় লিখে রেখেছেন, কে বলতে পারে!

তাই দুপুরের পর বাজার ক্রেতাশূন্য হয়ে গেলেও কখনও সন্ধ্যার আগে বাড়ি ফিরত না মানিক। সবসময় একই রুটিন মেনে চলত, কখনও এর ব্যতিক্রম করেনি সে। সদা সতর্ক থাকত, উল্টোপাল্টা কোন কিছু যেন তার নজরে না আসে। তার চোখের আড়ালে যা খুশি হোক, কী করার আছে তার?

তবে গেল সপ্তাহে যখন সর্দার বাড়িতে চুরি করতে গিয়ে গণধোলাই খেয়ে পটল তুলল রতন চোরা, স্বস্তির নিঃশ্বাসটা ঠিকই ফেলেছিল মানিক। যাক, বাবা, এবার বুঝি সমস্ত নষ্ট কথার ইতি ঘটল। দিন কয়েক পর মরিয়মও যে তাকে ফাঁকি দিয়ে ওপারে পাড়ি জমাবে, এটা তো আর তার জানা ছিল না।

কাছেপিঠে কোথাও একটা শিয়াল ডেকে উঠল। রাতের নিস্তব্ধতাকে যেন চিরে দিল ডাকটা। ঝিঁঝি পোকার দলের সঙ্গে চমকে উঠল মানিকও।

ডাকটা কবরস্থানের ওদিক থেকেই এসেছে। আর সেখানেই শুয়ে আছে মরিয়ম, একা। যে কি না বেঁচে থাকতে শিয়ালকে প্রচণ্ড ভয় পেত। দূরে কোথাও শিয়াল ডাকলেও ভয়ে রীতিমত কুঁকড়ে যেত মেয়েটা।

খুব ছোটবেলায় ভর সন্ধ্যায় একবার শিয়ালের তাড়া খেয়েছিল মরিয়ম। ছুটে ‘পালাতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে গর্তমতন একটা জায়গায় পড়ে গিয়েছিল সে। শিয়ালটা গর্তের মুখে দাঁড়িয়ে স্থির দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে, জ্ঞান হারাবার আগে এটাই ছিল তার সর্বশেষ স্মৃতি। স্বভাবতই মনের গভীরে শিয়ালের ভয়টা ঢুকে গিয়েছিল তার। বড় হবার পরও ভয়টা আর কোনদিনও কাটেনি।

আর এখন এই মধ্যরাতে, এসব ভাবনাই রীতিমত অস্থির করে তুলল মানিককে। শিয়ালটাকে দেখতে পেয়ে খুব কি ভয় পাচ্ছে মরিয়ম? আতঙ্কে কবরের এক কোনায় জড়সড় হয়ে নেই তো মেয়েটা? কাঁপছে থর-থর করে? নাকি নিঃশব্দে কাঁদছে? কার বুকে মুখ লুকাবে সে এখন? হাত বাড়িয়ে মানিককে না পেলে কী করবে পাগলি মেয়েটা?

আচ্ছা, শিয়ালটা মরিয়মকে খেতে আসেনি তো? সে জানে, শিয়ালের দল কবর খুঁড়ে লাশ বের করে খেয়ে ফেলে। তাহলে কি সেটাই হতে চলেছে এখন? নতুন কবরের খবর পেয়ে খাবারের সন্ধানে হাজির হয়ে গেছে শিয়ালের পাল?

আর ভাবতে পারল না মানিক। নিজের অজান্তেই সটান উঠে দাঁড়াল। পড়িমরি ছুটল দরজার দিকে। অসাবধানতায় দরজার চৌকাঠে হোঁচট খেয়ে হাত- পা ছড়িয়ে মাটিতে পড়ল সে। প্রথমটায় ব্যথার চোটে ককিয়ে উঠলেও, তড়িঘড়ি আবার উঠে দাঁড়াল সে। সারা শরীর ধুলোয় মাখামাখি, সেদিকে তার বিন্দুমাত্র ভ্রূক্ষেপও নেই। তার সমস্ত চিত্ত জুড়ে রয়েছে মরিয়ম, যত দ্রুত সম্ভব তার কাছে পৌছতে চায় সে।

আকাশে ভাঙা থালার মত আধখানা চাঁদ উঠেছে। তার ঘোলাটে আলোয় কেটে গেছে জমাট অন্ধকার। শীত এখনও পুরোপুরি আসেনি। তবে তার আগমনী বার্তা নিয়ে হাজির হয়ে গেছে মিহি কুয়াশা। আর সেই শিশিরের আলতো স্পর্শে ভিজে আছে খেতের আইলের ঘাস।

তাই চেনা পথে ডাকহরকরাদের মত গতি তুলে ছুটতে গিয়ে বার কয়েক হোঁচট খেল মানিক। তবে তাতে তার চলার গতি এতটুকুও মন্থর হলো না। মিনিট পাঁচেকের মাথায়ই সে পৌছে গেল গোরস্তানের প্রবেশদ্বারে।

আজ বিকেলেই মরিয়মকে দাফন করতে গাঁয়ের লোকের সঙ্গে এখানে এসেছিল মানিক। কিন্তু এখন এই মধ্যরাতে, কুয়াশাভেজা চাঁদের আলোয়, চারপাশটা কেমন যেন অচেনা ঠেকছে তার কাছে! তবে মরিয়মের কবরটা সে চেনে ঠিকই। সোজাসুজি কিছুদূর গিয়ে হাতের ডানদিকে ঝাঁকড়া একখানা জারুল গাছ। সেটা পেরিয়ে দ্বিতীয় সারির প্রথম কবরটাই মরিয়মের।

রতন চোরাকে বাদ দিলে গত ক’দিনে নতুন কবর বলতে গেলে ওই একটাই। যে কারোরই চিনতে পারার কথা। দু’সারি কবরের মধ্যখান দিয়ে হাঁটতে শুরু করল মানিক। এগুলো সব গ্রামের সম্ভ্রান্ত মানুষজনের কবর। বেঁচে থাকতে সামাজিক মর্যাদার মাপকাঠিতে যারা পিছিয়ে ছিল, মরে গিয়েও তারা সে ব্যবধান ঘুচাতে পারেনি! তাই তাদের কবরগুলো ঠাঁই পেয়েছে গোরস্তানের অপেক্ষাকৃত পিছনের অংশে।

বড়-বড় গাছের ডালপালার আড়ালে চাঁদের আলোর অনেকটাই ঢাকা পড়ে গেছে ওখানে। তবে আলোর বার্তাবাহক হয়ে আছে অগণিত জোনাকির দল। এখানে-ওখানে, ঝোপ-জংলায়, মনের সুখে দল বেঁধে ঘুরে বেড়াচ্ছে ওরা।

জারুল গাছের নীচে, তেমন একটা জোনাকিছাওয়া ঝোপ পেরোতেই মরিয়মের কবরটা নজরে এল মানিকের। পরক্ষণেই আচমকা থমকে দাঁড়াতে বাধ্য হলো সে।

মরিয়মকে কবরের ভিতরে আশা করেছিল সে, বাইরে নয়!

ধবধবে সফেদ কাফনে জড়ানো মরিয়মের লাশটা এই আবছা আঁধারেও বেশ স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছে মানিক। সদ্য খোঁড়া কবরটার পাশেই পড়ে আছে লাশটা। আর যা কিছুই কবরটা খুবলে খুঁড়ে থাকুক না কেন, ওটা এখনও এখানেই আছে! ঝুঁকে আছে শ্বেতবসনা মরিয়মের উপর!

ওটা কি শিয়াল? নিজেকেই প্রশ্ন করল মানিক।

উঁহুঁ। গঠনে মেলে না।

ছায়ামতন কিম্ভূতকিমাকার একখানা অবয়ব, চেনাজানা কোন কিছুর সঙ্গে তুলনা করা যাচ্ছে না ওটাকে। তবে আর যা-ই হোক না কেন, শিয়াল যে নয়, একথা ঈশ্বরের দিব্যি করে বলতে পারে মানিক। তাহলে কী ওটা? নিজের অজান্তেই অস্ফুট শব্দ করে উঠল মানিক। আর ঠিক তখনই নড়ে উঠল ওটা!

আঁতকে উঠে চোখজোড়া বন্ধ করতে বাধ্য হলো মানিক। কয়েক মুহূর্ত পর আবার যখন খুলল, ওটাকে আর ওখানে দেখতে পেল না সে। শুধু মরিয়মের লাশটাই দৃশ্যপটে পড়ে আছে প্রকট হয়ে। এখানে-ওখানে আগের মতই দাবড়ে বেড়াচ্ছে জোনাকির দল।

সত্যিই কি কিছু ছিল ওখানটায়? নাকি সবই চোখের ভুল?

নিশুতি রাতে একা-একা গাঁয়ের শেষ মাথার গোরস্তানে আসাটা সহজ কাজ নয়। নির্ঘাত মনের উপর ভীষণ চাপ পড়েছে তার। আর তাতেই হয়তো ভুলভাল দেখতে শুরু করেছে সে। তাই না? নিজেকে প্রবোধ দেয়ার প্রয়াস পেল মানিক।

চকিতে কঠিন একখানা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল সে। মরিয়মকে কিছুতেই এখানে একাকী ফেলে রাখা যাবে না। তাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাবে সে। ঘরের উঠনে কবর দেবে। যেন দিবানিশি নিজেই পাহারা দিতে পারে।

তার ভালবাসার ধনকে শিয়ালে খাবে আর সে কি না আরামসে পৃথিবীর মজা লুটবে? কক্ষনো না।

কোন সন্দেহ নেই, লোভী শিয়ালগুলোই মরিয়মকে কবর থেকে বের করে এনেছে। নইলে এই মাঝরাতে আর কে-ই বা কবরের মাটি খুবলাতে যাবে?

নিশিতে পাওয়া মানুষের মত এলোমেলো পায়ে লাশটার দিকে এগিয়ে গেল মানিক। মরিয়মের শরীর থেকে এখনও আতর লোবানের গন্ধ বেরোচ্ছে। কাছাকাছি যেতেই সেই গন্ধের তীব্র একটা ঝাপটা এসে লাগল মানিকের নাকে। কেমন যেন অস্বস্তি লাগতে শুরু করল তার।

পরোয়া করল না সে। দেহের সর্বশক্তি দিয়ে আঁকড়ে ধরল লাশটা। তারপর সেটা ডান কাঁধে ফেলে উঠে দাঁড়াল। অনেকটা ঘোরের মধ্যেই ফিরতি পথ ধরল সে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ঘরে ফিরতে চায়।

যদিও পুরো গ্রাম এখন ঘুমিয়ে কাদা, ভোর হতে এখনও ঢের দেরি। তবুও কারোর চোখে পড়ার ঝুঁকিটা নিতে চায় না সে। প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে যে কেউ জেগে উঠতে পারে যখন-তখন। যদি তাদের কারও চোখে পড়ে যায় ঘটনাটা?

কিছুদূর এগোতেই পিছনে একটা আওয়াজ শুনতে পেয়ে সচকিত হয়ে উঠল মানিক। খুব ক্ষীণ একটা শব্দ, যেন আলতো পায়ে কেউ তার পিছন-পিছন আসছে!

কে?

চেনাজানা কেউ? নাকি ভিনগাঁয়ের কেউ?

ভয়ে-ভয়ে ঘাড়ের উপর দিয়ে ফিরে তাকাল মানিক। জানা নেই, ঠিক কাকে দেখতে পাবে। যে-ই হোক, কপালে দুঃখ আছে মানিকের।

মাঝরাতে বউয়ের লাশ কাঁধে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে এক লোক, গ্রামের মানুষের জন্য এরচেয়ে বেশি মুখরোচক গল্প আর কী হতে পারে?

মানিক অবাক হয়ে আবিষ্কার করল, তার পিছনটা পুরোপুরি ফাঁকা! যতদূর চোখ যায়, কোন জনমানব দূরে থাক, একটা ঘেয়ো কুকুর পর্যন্ত নেই। এখানে- ওখানে, দূরে-দূরে কিছু মিটমিটে আলো জ্বলছে। গ্রামের অবস্থাসম্পন্ন মানুষজনের কাছারি ঘরের বাইরে ঝোলানো বাতি ওগুলো। সারা রাত ধরে জ্বলে, ফজরের আজানের পরই কেবল নেভানো হয়।

আবারও হাঁটতে শুরু করল মানিক। ডান কাঁধটা প্রায় অবশ হয়ে এসেছিল তার। তাই ভার বদলে মরিয়মকে বাম কাঁধে চালান করে দিয়েছে সে।

আর খানিকটা পথ পেরোলেই নিজের বাড়ির আঙিনায় পৌঁছে যাবে, তাই দ্রুত পা চালাল মানিক।

কিন্তু কিছুদূর যেতেই আবারও থামতে হলো তাকে। এবার কেবল পদশব্দ নয়, ভারী নিঃশ্বাসের শব্দও শুনতে পাচ্ছে সে পিছনে! যেন তার দ্রুতগতির চলনের সঙ্গে তাল মিলাতে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠেছে অনুসরণকারী! আর সেজন্যই লম্বা দম নিতে বাধ্য হচ্ছে সে!

সীমাহীন আতঙ্কে জমে বরফ হয়ে গেল মানিক। স্পষ্ট বুঝতে পারছে, গোরস্তানের সেই ভয়ানক অবয়বটাই পিছু নিয়েছে তার! এহেন ভয়ঙ্কর নিঃশ্বাসের শব্দ কিছুতেই কোন মানুষের হতে পারে না।

কী এটা? মড়াখেকো পিশাচ?

ছোটবেলা থেকে শুনে আসা কবরস্তানের পিশাচদের লোমহর্ষক সব গল্পগুলো একের পর এক মনে আসতে লাগল তার। সদ্য গোর দেয়া লাশের প্রতি একটা আলাদা আকর্ষণ থাকে ওদের। কে কার আগে চেটেপুটে খাবে, তারই প্রতিযোগিতায় মাতে পিশাচের দল। তারই একটা হয়তো এখন খেতে এসেছে মরিয়মের লাশ।

ভাবনাটা অনেকটা শক্তি জোগাল মানিককে। প্রাণ থাকতে মরিয়মকে কোন পিশাচের খোরাক হতে দেবে না সে। কোনমতেই না।

পিছন ফিরে তাকানো থেকে অনেক কষ্টে নিজেকে নিবৃত্ত করল সে। ভয়ঙ্কর কোন চেহারার মুখোমুখি হয়ে সাহস হারানোর ঝুঁকিটা নিতে চায় না ও। তাহলে মরিয়মকে রক্ষা করা সম্ভব হবে না তার পক্ষে।

মরিয়মকে দু’হাতে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরল মানিক। তারপর আল্লাহর নাম নিয়ে আচমকা সজোরে দৌড়তে শুরু করল! ভেজা ঘাসে বারকয়েক পিছলে পড়তে-পড়তেও কোনমতে বেঁচে গেল সে। যতটা সম্ভব দ্রুত ছুটছে, দম ফুরাবার আগে আমার ইচ্ছে নেই তার।

ছুটতে-ছুটতেই অনুধাবন করল, মড়াখেকোটা ঠিকই এখনও ছায়ার মত পিছনে লেগে আছে! ওটার ছুটে আসার শব্দটাও খুব একটা পিছিয়ে নেই।

কীভাবে নিজের বাড়ি পৌঁছেছে, সেটা মানিক নিজেও জানে না। সে শুধু জানে, প্রাণ বাজি রেখে জীবনের সবচেয়ে দ্রুতগতির দৌড়টা আজ দৌড়েছে।

ঘরে ঢুকে মরিয়মকে আলগোছে খাটের উপর নামিয়ে রাখল সে। চেনা খাট, চেনা শরীর, শুধু অমূল্য প্রাণটাই অনুপস্থিত।

দ্রুত হাতে ঘরের দরজাটা বন্ধ করে দিল মানিক। পরিশ্রমে ঘেমে-নেয়ে একাকার হয়ে গেছে সে। বুকটা হাপরের মত ওঠানামা করছে ক্রমাগত।

ভয়টা এখনও কাটেনি ওর। জানে, তার পিছু-পিছু এখান পর্যন্ত ঠিকই পৌঁছে গেছে পিশাচটা। ঘরে ঢোকার ঠিক আগমুহূর্তেও পিছনে ওটার তেড়ে আসার শব্দ শুনতে পেয়েছে সে। উঠনের কোন ঝোপেই হয়তো ঘাপটি মেরে বসে আছে এখন।

অনিশ্চয়তার সময়টা খুব একটা দীর্ঘ হলো না। কেননা কিছুক্ষণের মধ্যেই ওটা তার উপস্থিতি জানান দিল! দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ, সেই সঙ্গে আলতো থাবার আঘাত। মানিকের দেহে কাঁপুনি তুলতে এর বেশি কী লাগে আর?

কাঁপতে-কাঁপতেই দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়াল সে। কাঠের এই পাটাতন কতক্ষণ বাইরের রাক্ষসটাকে ঠেকিয়ে রাখতে পারবে, কে জানে!

কেবল মরিয়মের কথা ভেবেই এখনও চিৎকার করা থেকে নিজেকে বিরত রেখেছে মানিক। প্রকাণ্ড একখানা আর্তচিৎকার গলার কাছটায় এসে দানা বেঁধে আছে অনেক আগে থেকেই।

থেমে গেল দরজায় করাঘাতের আওয়াজ। ওটা সরে গেছে ওখান থেকে, ঘুরে বেড়াচ্ছে এখন ঘরের চারধারে।

বেড়ার দেয়ালের এখানে-ওখানে ওটার আঁচড়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে। যেন নখ দিয়ে আঁচড়ে-আঁচড়ে দেয়ালের দুর্বল জায়গা খুঁজে বেড়াচ্ছে ওটা।

শব্দটাকে ভিতর থেকে অনুসরণ করে চলল মানিক। হাতে তুলে নিয়েছে ভয়ালদর্শন একখানা রাম-দা। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে সে, মরতে যদি হয়, লড়াই করেই মরবে।

আচমকা ঘরের ছাদটা মচমচ করে উঠল! কিছু একটা আছে ওখানে!

পিশাচটা কি ওখানে উঠে গেছে? কীভাবে উঠল?

যেভাবেই হোক, উঠেছে ওটা। আর এখন হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে রান্নাঘরের দিকে।

বিদ্যুচ্চমকের মত কথাটা মনে পড়ে গেল মানিকের। রান্নাঘরের ছাদে একটা ফোকর আছে!

অপেক্ষাকৃত কম প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র উপরে তুলে রাখার জন্যই করা হয়েছিল ফোকরটা। চাইলেই ওই পথে নেমে আসতে পারবে পিশাচটা। সম্ভবত এটাই করতে চলেছে ওটা এখন।

পড়িমরি রান্নাঘরে ছুটে গেল মানিক। রাম-দাটাকে সজোরে আঁকড়ে ধরে তাকিয়ে রইল কালো ফোকরটার দিকে। থর-থর কাঁপছে তার গোটা শরীর।

মিঁয়াও।

তাকে হতভম্ব করে দিয়ে সিলিং থেকে নেমে এল একটা হোঁতকা মোটা হুলো বিড়াল! অচেনা নয়, অনেকবারই ওটাকে দেখেছে মানিক। তাই আটকে রাখা নিঃশ্বাসটা সশব্দেই ছাড়ল সে।

আর ঠিক তখনই শুনতে পেল সদর দরজা খোলার শব্দটা! কেউ একজন দরজাটা খুলে ফেলছে। কে?

ফিরে এসে দরজার কবাটগুলো পুরোপুরি খোলাই দেখতে পেল সে। খোলা দরজা দিয়ে বাইরের চাঁদের আলো অবাধে ঢুকে পড়ছে ঘরে।

সেই সঙ্গে ঢুকে পড়েছে লম্বামতন একখানা ছায়া!

ছায়াটা রতন চোরার, দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে এক পলকে তাকিয়ে আছে সে মানিকের হতবাক চেহারার দিকে! সারা দেহে এখানে-ওখানে মাটি লেগে আছে রতনের। চোখদুটো আধবোজা। মুখে ঝুলে আছে ভয়ানক অশুভ একচিলতে হাসি।

মানিকের বেহাল দশা দেখে বেশ আমোদ পাচ্ছে সে।

সপ্তাহখানেক আগে কবর দেয়া একজন মানুষকে চোখের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে পুরোপুরি নির্বাক হয়ে গেল মানিক। তাছাড়া কিছুতেই তার মাথায় আসছে না, বাইরে থেকে রতন দরজাটা খুলল কীভাবে। দরজার হুড়কোগুলো সব ভিতরের দিকে, বাইরে থেকে খোলার কোন উপায়ই নেই।

জবাবটা খুব তাড়াতাড়িই পেয়ে গেল মানিক।

তার পিছন থেকে ভেসে এল হালকা হাসির শব্দ!

খাটের উপর বসে আছে মরিয়ম!

সফেদ কাফনের পরিবর্তে তার দেহে জড়িয়ে আছে টুকটুকে লাল একখানা বেনারসি শাড়ি। গা-ভর্তি সোনার গয়না।

ঘোমটা সরিয়ে মানিকের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসল মরিয়ম।

কিন্তু যখন মুখ খুলল, বোঝা গেল হাসিটা মানিকের জন্য নয়, ছিল তার পিছনে দাঁড়ানো রতনের জন্য!

‘কেমুন আছেন, রতন বাই?’

এরপর আর কিছু মনে নেই মানিকের!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *