ট্যাবু

ট্যাবু

রিজের ওপর এক চিলতে খোলা জায়গাকে ঘিরে রেখেছে একসারি কটনউড গাছ। এখানে-ওখানে ছড়িয়ে আছে ঘন মেসকিটের ঝোপ।

পরিশ্রান্ত সূর্যটা পশ্চিমের পর্বতমালার আড়ালে ডুব মেরেছে প্রায় ঘণ্টা দুয়েক আগে। তবে ফ্যাকাসে আলো পাতলা একখানা চাদরের মত ঠিকই এখনও ঝুলে আছে খোলা প্রেইরিতে।

ফাঁকা জায়গাটার একেবারে মধ্যখানে ছোট মতন একটা ক্যাম্পফায়ার জ্বলছে। তাতে রান্না চড়িয়েছে কম বয়সী এক কাউবয়। সবেমাত্র তার ঠোঁটের ওপর পাতলা গোঁফের রেখার আবির্ভাব ঘটেছে; তবে ছেলেটার শীতল চোখজোড়া জানান দেয়, পৃথিবীর কদর্যের অনেকখানি দেখা হয়ে গেছে তার।

রান্নার আয়োজন আহামরি কিছু নয়। গরুর শুকনো জার্কি আর সদ্য শিকার করা একটা সেজ মুরগির মাংস মিশিয়ে, থকথকে কাদার মত অর্ধতরল একধরনের খাবার তৈরি করা হচ্ছে।

জিনিসটা দেখতে যেমন বিদঘুটে, খেতেও তেমনই বিচ্ছিরি। রাঁধুনি নিজে অবশ্য এটাকে স্টু বলেই দাবি করে এসেছে এযাবৎকাল। তবে আজ অবধি, তাকে সমর্থন দেয়া দ্বিতীয় কারও সার্টিফিকেট জোগাড় করতে পারেনি সে।

আগুনের আঁচ থেকে খানিকটা দূরে, নিজের বেডরোলে শুয়ে কাতরাচ্ছে একজন মুমূর্ষু মানুষ। লোকটার বয়স ষাটের কোঠায়; তবে পেটা শরীরে ভাঙন ধরেনি এখনও। অন্তত গোটা চারেক তীর ঢুকেছিল তার দেহে; প্রচুর রক্ত হারিয়েছে। এখনও সে বেঁচে আছে কী করে, সেটাই বিস্ময়কর!

ইণ্ডিয়ান টেরিটরির ভিতর দিয়ে পথ চলার সময় আচমকা একটা কোমাঞ্চি ওয়ার পার্টির সামনে পড়ে যায় সে। কাল বিলম্ব না করে ওকে ধাওয়া করে ইণ্ডিয়ানরা। ক্ষত-বিক্ষত শরীর নিয়ে এই মেসার ওপরে পালিয়ে আসার আগ পর্যন্ত অন্তত দশ জন ইণ্ডিয়ান প্রাণ হারিয়েছে তার রাইফেলের গুলিতে।

শেষ বিকেলে একটা রক্তমাখা ট্র্যাক দেখতে পেয়ে, এই টিলার ওপর তাকে আবিষ্কার করে তরুণ কাউবয়। লোকটা তখন অচেতন অবস্থায় ঝুলছিল নিজের স্যাডল থেকে।

মালিকের কাছ থেকে বহুক্ষণ কোন দিক নির্দেশনা না পেয়েই হয়তো দাঁড়িয়ে পড়েছিল তার ঘোড়াটা। তবে ঘন হয়ে জন্মানো ওখানকার কচি ঘাসগুলোও যে তাকে সিদ্ধান্তটা নিতে প্রলুব্ধ করেছিল, তাতে কোন সন্দেহ নেই।

প্রৌঢ়ের নাম হিউগো; আর তরুণ কাউবয়কে লোকে মিচেল বলেই চেনে। ঘণ্টাখানেক সেবা-শুশ্রূষার পরই কেবল হিউগোর চেতনা ফেরাতে সক্ষম হয়েছিল বেচারা।

তীরগুলো খুলে নিয়ে, ক্ষতস্থানে পট্টি বেঁধে দেয়া হয়েছে। রক্তপাত আপাতত বন্ধ হয়েছে বটে; তবে ইতোমধ্যেই ক্ষতি যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। হিউগো এবারের ধকলটা ঠিকঠাক সামলে নেবে; এহেন বাজি ধরার লোক এই মুহূর্তে গোটা পশ্চিমে একজনও খুঁজে পাওয়া যাবে না।

স্যাডল ব্যাগ হাতড়ে একটা পুরনো বাটি বের করল মিচেল। মগভর্তি তেতো কফি আর বাটিভরা স্টু নিয়ে এগিয়ে গেল হিউগোর বেডরোলের দিকে

বহু কসরত করে তাকে আধশোয়া করল মিচেল; তারপর মুখে তুলে খাইয়ে দিতে লাগল। খানিকক্ষণ নীরবেই বিনা প্রতিবাদে খাবারটা গলাধঃকরণ করল হিউগো, তারপর হাত তুলে বাধা দিল। ইশারায় কফি দিতে বলে হেলান দিল পিছনে রাখা স্যাডলে; ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।

‘ঈশ্বর আমার ওপর এতটা নাখোশ হয়ে আছেন, সেটা আজকের আগে কখনও বুঝতেই পারিনি! বলতে বাধ্য হচ্ছি, এতটা জঘন্য খাবার এই জনমে আর খাইনি আমি। সত্যিই এটাকে মানুষের খাবার বলো তুমি?’

দাঁত কেলিয়ে হাসল মিচেল। কফি মগটা ধরিয়ে দিল হিউগোর হাতে।

‘যদি নরকে যাও, ওখানকার খাবার কেমন হতে পারে, সে সম্পর্কে একটা ধারণা হয়ে গেল তোমার,’ হাসিমুখে বলল সে। ‘জন্মের পর-পরই অনাথ হয়েছি; বলতে গেলে পথে পথেই মানুষ হয়েছি আমি। একটি দিনের জন্যও কোন সভ্য পরিবারের সঙ্গে বসবাস করার সুযোগ পাইনি। কে আর আমাকে রাঁধতে শেখাবে, বলো? পেটের তাগিদে কোনরকমে স্রেফ সেদ্ধ করাটা শিখে নিয়েছি। ওতেই দিব্যি চলে যায় আমার। যতদিন বেঁচে আছ, তোমাকেও ওই খেয়েই থাকতে হবে।’

হাসার চেষ্টা করল হিউগো, কিন্তু যন্ত্রণাক্লিষ্ট মুখে হাসিটা ঠিকঠাক ফুটল না। ‘অতটা অভাগাও বোধহয় নই আমি। সকাল অবধি টিকব বলে মনে হয় না। তোমার হাতের রান্না, তুমিই খাও, বাপু!’

চুপ করে রইল মিচেল, কোন প্রতিবাদ করল না। তার নিজেরও ধারণা, রাত ফুরাবার আগেই মারা যাবে হিউগো। কাশির সঙ্গে এখনও সমানে রক্ত আসছে লোকটার; নিশ্চয়ই ভিতরে কোথাও মস্ত ক্ষত হয়ে গেছে।

প্রসঙ্গ পাল্টানোর প্রয়াস পেল সে। ‘এই বুড়ো বয়সে ভীমরতি ধরেছিল নাকি? কী মনে করে ওই ইণ্ডিয়ান টেরিটরিতে ঢুকতে গেলে? এই উপত্যকায় আসার বিকল্প পথ যেহেতু রয়েছে; প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে ইণ্ডিয়ানদের মুখে হামলে পড়ার কোন মানে হয়?’

‘বিকল্প পথ ধরলে অনেকটা ঘুরপথে এখানে আসতে হত আমাকে। নিতান্ত বাধ্য হয়েই শর্টকাট ধরেছিলাম, সময় ছিল না হাতে,’ শান্ত গলায় জবাব দিল হিউগো। ‘অনেক দূর থেকে আসছি আমি, অহেতুক বাড়তি পথ পাড়ি দিতে মন সায় দিচ্ছিল না। ইণ্ডিয়ানদের কাছ থেকে লুকিয়ে থাকার কৌশল জানতাম। নিরাপদে টেরিটরি পার হতে পারব, সেই বিশ্বাসটাও ছিল। কিন্তু কপাল মন্দ; ওয়ার পার্টির সামনে পড়ে গেলাম। নাহয় ঠিকই অক্ষত দেহে পাড়ি দিতে পারতাম ট্রেইলটা।’

‘হুম। বুঝলাম,’ সমঝদারের ভঙ্গিতে মাথা দোলাল মিচেল। ‘তা এত হন্তদন্ত হয়ে যাচ্ছিলে কোথায়?’

‘এদিকেই আসছিলাম। ওক কাউন্টি থেকে রওনা দেয়ার পর আর একদিনের বেশি বিশ্রাম নিইনি কোথাও।’

‘এদিকে?! কিন্তু কেন? দলে দলে লোকে যখন আরও পশ্চিমে পাড়ি জমাচ্ছে, তুমি কেন উল্টোদিকে ফিরে এলে?’

‘ভাগ্য ফেরাতে, বাছা। ভাগ্য ফেরাতে,’ হতাশ গলায় বলল হিউগো। বার কয়েক খুক-খুক করে কাশল; কাশির দমকে আবারও ছলকে বেরিয়ে এল খানিকটা তাজা রক্ত। নিজের ব্যাণ্ডানা দিয়ে পরম যত্নে সেগুলো মুছে দিল মিচেল। বুড়োর জন্য অন্তরের অন্তস্তল থেকে মমতা অনুভব করছে সে।

নিচু স্বরে বলল, ‘ভাগ্য ফেরানোর মত কী-ই বা আছে এদিকে? মাইলের পর মাইল বিরান প্রান্তর ছাড়া আর তো কিছু চোখে পড়েনি আমার।’

নড়েচড়ে খানিকটা সোজা হয়ে বসার প্রয়াস পেল হিউগো। তারপর বলল, ‘সারাটা জীবনই প্রচণ্ড দরিদ্রতার ভিতর দিয়ে কাটালাম, বাছা। তারুণ্যে স্বপ্ন ছিল একখানা র‍্যাঞ্চ গড়ব; বিয়ে করব, সংসার পাতব। পাহাড়ের গহীনে পছন্দসই একটা জায়গাও ঠিক করে রেখেছিলাম বসতি গড়ার জন্য।

‘কিন্তু কী থেকে যে কী হয়ে গেল, টেরই পেলাম না! বিনা দোষেই ফেঁসে গেলাম একটা ওয়াগন ট্রেন লুটের কেসে। সবার চোখে আউট’ল বনে গেলাম।

‘তারপর থেকে শুধু ছুটে চলা আর নিজেকে লোকচক্ষুর অন্তরালে লুকিয়ে রাখা। এভাবেই কেটে গেল অনেকটা সময়। বেঁচে রইলাম ঠিকই, কিন্তু জীবনটাকে আর উপভোগ করা হলো না কখনও।

‘আদতে আউট’ল ছিলাম না বলে অর্থনৈতিকভাবে চরম অসচ্ছল ছিলাম। কোন শহরেই বেশিদিন থাকতাম না, পাছে আমার আউটল পরিচয় লোকের কাছে ফাঁস হয়ে যায়! তাই স্থায়ী কোন কাজও জোটেনি কপালে।

‘এই ছন্নছাড়া জীবনের সঙ্গে কাউকে জড়াতে চাইনি বলে, বিয়ে থা করা হয়নি। র‍্যাঞ্চ গড়ার স্বপ্নটাও চিরকাল স্বপ্নই রয়ে গেল। ..

‘অবশেষে এই বুড়ো বয়সে এসে গভর্নরের ক্ষমা পেলাম; আউট’ল তালিকা থেকে নাম কাটা গেল আমার। ভাবলাম, শেষ একটা চেষ্টা করে দেখি, ভাগ্যটা ফেরানো যায় কিনা। যদি আচমকা কিছু পয়সাকড়ি পেয়ে যাই, বাথান গড়ার ইচ্ছেটা হয়তো আর অপূর্ণ থাকবে না! সেজন্যই একটানা মরুভূমি পাড়ি দিয়ে এখানটায় ছুটে এসেছি আমি।’

হতভম্ব দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাল মিচেল। এই বিজন প্রান্তরে একজন মানুষের ভাগ্য ফেরানোর মতন কী আছে! ‘কীসের খোঁজে? স্বর্ণখনি?’

দ্রুত মাথা নাড়ল হিউগো। ‘খনিতে সোনা যা ছিল, সেসব বহু আগেই মাইনাররা চেটেপুটে সাফসুতরো করে ফেলেছে। তোমার-আমার জন্য সামান্য একটা শিরাও আর অবশিষ্ট নেই কোথাও।’

‘তাহলে?’

কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইল হিউগো। তারপর বলল, ‘গোল্ড ক্রীকের নাম শুনেছ কখনও?’

এপাশ-ওপাশ মাথা নাড়ল মিচেল; শোনেনি। ‘কী আছে ওই ক্রীকে? সোনা?’ মৃদু হাসল ধূর্ত বুড়ো। ‘অনেকটা ওরকমই। তবে ঠিক সোনা নয়, সোনা বানানোর পরশপাথর।’

‘মানে?’

ওই ক্রীকের জলের তলায় এমন একটা জিনিস আছে, যার স্পর্শে যে কোন কিছু খাঁটি সোনায় পরিণত হয়।’

‘গাঁজাখুরি গল্প বলার আর জায়গা পেলে না তুমি? এখন বুঝি রসিকতা করার সময়?’ প্রচণ্ড বিরক্তি ঝরে পড়ল মিচেলের কণ্ঠে 1

নিমেষেই গম্ভীর হয়ে গেল হিউগো; চেহারায় ভর করল বিষাদের কালো ছায়া। ভারী গলায় বলল, ‘একজন মৃত্যুপথযাত্রী মানুষ তোমার সঙ্গে মজা করবে না, বাছা। রসিকতা করার মত মানসিক অবস্থা থাকে না তার।’

লজ্জা পেল মিচেল; বুড়ো ঠিকই বলেছে। মৃদু গলায় বলল, ‘ক্রীকটা কোথায়?’

হাত তুলে পিছনের একটা মাঝারি উচ্চতার পাহাড় দেখাল হিউগো। ‘ওই টিলার ওপাশে একটা ক্যানিয়ন পাবে। ওটা ধরে সোজা উত্তরে গেলে সামনে পড়বে একটা শুষ্ক উপত্যকা। জায়গাটা পার হয়ে মাইল দশেক সামনে এগুলেই পেয়ে যাবে গোল্ড ক্রীক।’

আঁতকে উঠল যুবক। ‘ওটা তো রীতিমত ভুতুড়ে এলাকা। ইণ্ডিয়ানদের পুরনো গোরস্থানটা ওদিকেই না?

‘হ্যাঁ। তবে শুধু গোরস্থানই নয়, ইণ্ডিয়ান উপকথা অনুসারে, আস্ত দুটো গ্রামই সুদূর অতীতে বিলীন হয়ে গেছে গোল্ড লেকের অতলে।’

‘গোল্ড লেক! ওদিকটায় কোন হ্রদ আছে বলে তো শুনিনি কখনও!’

‘একসময় ছিল, এখন নেই। অতীতের গোল্ড লেকই পরিণত হয়েছে আজকের গোল্ড ক্রীকে।’

‘আর ওই ক্রীকের জলেই বুঝি লুকানো আছে সোনা বানানোর পরশপাথর?’ হালকা গলায় জানতে চাইল মিচেল।

—হুম। ঠিক তাই,’ শান্ত কণ্ঠে জবাব দিল হিউগো। দম নেয়ার জন্য কয়েক মুহূর্ত বিরতি নিল সে; কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে। ‘তবে ওটা কিন্তু কোন জড় বস্তু নয়; মস্ত দেহের বিশাল একটা প্রাগৈতিহাসিক প্রাণী!’

‘হায়, ঈশ্বর! বলছ কী এসব!’ রীতিমত চেঁচিয়ে উঠল মিচেল।

খানিকক্ষণ সরু চোখে তাকে নিরীখ করল হিউগো। তার চোখের তারায় নিখাদ বিস্ময় ব্যতীত উপহাসের ছায়াও খুঁজে পেল না কট্টর বুড়ো। তাই সন্তুষ্টচিত্তে বলতে শুরু করল, ‘চিপেওয়া উপকথায় পাওয়া যায়, গোল্ড লেকের একেবারে মধ্যখানটায় প্রাচীন কালে মাঝারি আকারের একটা দ্বীপ ছিল। ওতে বসবাস করত বিশালকায় এক জলজ চিতাবাঘ! অন্যান্য সাধারণ চিতার সঙ্গে মস্ত তফাৎ ছিল তার; জলে-ডাঙায় সমান স্বচ্ছন্দ ছিল প্রাণীটা!

‘ইণ্ডিয়ানদের জলদেবতা ছিল ওই অদ্ভুতুড়ে চিতাবাঘ। ওরা ওটাকে ডাকত মিশিবিঝিউ বলে।

‘ওদের বিশ্বাস ছিল, নদী-হ্রদ-ক্রীক এমন সমস্ত প্রাকৃতিক জলাধারে একটা করে মিশিবিঝিউ বসবাস করে! তবে গোল্ড লেকের মিশিবিঝিউই কেবল লোকচক্ষুর সামনে আসে। প্রয়োজনে শত-শত বছর ধরে না খেয়ে থাকতে পারে মিশিবিঝিউ; কারণ খাদ্য হিসেবে ডুবন্ত মানুষ ছাড়া আর কিছুই গ্রহণ করে না ওরা!

‘ওদের পুরো দেহ লাল-লাল লোমে ঢাকা; আকারে একটা পূর্ণবয়স্ক মোষের মতই প্রকাণ্ড। একেবারে কপালের মধ্যখানে একটা লোমে ঢাকা পেল্লায় শিঙ থাকে ওদের; তার ঠিক নীচেই থাকে রক্তবর্ণের মস্ত একখানা কুঁতকুঁতে চোখ। ‘কুমিরের মত লম্বা একটা লেজ আর হাঙরের মত ত্রিকোণ একটা পাখনা আছে ওদের পিঠে। একারণেই জলের তলায় ইচ্ছেমতন সাঁতরাতে পারে ওরা। মেরুদণ্ড বরাবর করাতের মত ধারাল একসারি দাঁত বসানো, যেগুলো ছড়িয়ে আছে একেবারে লেজের ডগা পর্যন্ত। সম্ভবত নিজের আত্মরক্ষার্থেই ওগুলো ব্যবহার করে মিশিবিঝিউ।

‘গোল্ড ক্রীকের দুই তীরে বসতি গেড়েছিল দুই দল সিয়ক্স ইণ্ডিয়ান। বংশানুক্রমে একে অপরের জাত শত্রু ছিল ওরা। প্রতিপক্ষের প্রতি ঘৃণা কিংবা মিশিবিঝিউ-এর প্রতি ভয়, যে কারণেই হোক, দুই গ্রামের কেউই কখনও হ্রদের জলে নামত না।

‘লোকে বলে, প্রায়ই তখন দেখা দিত মিশিবিঝিউ; আর তার ক্ষুধার্ত চেহারা যে কারও পিলে চমকে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। তাই ইণ্ডিয়ান যোদ্ধারা দিন-রাত পালা করে পাহারা দিত হ্রদের ধারে; যেন কম বয়সী কেউ ভুল করেও জলে নেমে পড়তে না পারে।

‘তবে এক উৎসবের রাতে সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেল। ভরপেট ঘরে বানানো মদ গিলে বেহেড মাতাল হয়ে পড়ল দুই গাঁয়ের সব ক’জন পুরুষ মানুষ; প্রহরার কথা আর মনে রইল না কারও!

‘সুযোগটা পুরোপুরি কাজে লাগাল ভিন গাঁয়ের দুই দস্যি মেয়ে। সবার সামনে শত্রুতার অভিনয় করলেও, একে-অন্যের প্রাণের সখী ওরা। দেখা করার এহেন সুবর্ণ সুযোগ কী করে হাতছাড়া করে ওরা?

‘দুটো ক্যানু নৌকা নিয়ে যে-ই না ওরা হ্রদের মধ্যখানটায় একত্রিত হয়েছে, ঠিক তখনই জল ফুঁড়ে বেরিয়ে এল মিশিবিঝিউ! তার পাহাড় প্রমাণ দেহটা ধীরে- ধীরে জেগে উঠল পানির ওপরে; অতিকায় ছায়ার আড়ালে প্রায় ঢাকা পড়ে গেল ছোট্ট নৌকো দুটো। উৎসবের ঢাকের বিকট আওয়াজে চাপা পড়ে গেল মেয়ে দুটির আর্তচিৎকার; দুই গ্রামের কারও কানেই পৌছল না, তাদের গলার স্বর!

‘মরিয়া হয়ে হাতের বৈঠা দিয়ে মিশিবিঝিউকে আঘাত করে বসল একটা মেয়ে; ভয় দেখিয়ে তাড়াতে চায় আজব জন্তুটাকে! কিন্তু তার ছানাবড়া চোখের সামনেই এক পলকে কেটে দু’টুকরো হয়ে গেল বৈঠাটা। সম্ভবত ওই প্রথম কোন মানুষ স্বচক্ষে মিশিবিঝিউ-এর পিঠের ধারাল দাঁতের কামাল দেখল!

‘ভয়ানক রেগে গেল চিতাটা, প্রচণ্ড আলোড়ন তুলে ডুব দিল পানিতে। খানিকক্ষণ নিথর হয়ে রইল চরাচর, সময়ও যেন থমকে গিয়েছিল তখন। পরক্ষণেই ফুঁসে উঠল গোটা হ্রদ; ধীরে-ধীরে বাড়তে লাগল জলের উচ্চতা।

এক লহমায় বিক্ষুব্ধ একটা সমুদ্রে পরিণত হলো গোল্ড লেক। নিমিষেই জলের অতলে হারিয়ে গেল আস্ত দুটো ইণ্ডিয়ান গ্রাম! তবে আশ্চর্যের বিষয়, নৌকায় থাকা মেয়ে দুটোর একটুও ক্ষতি করেনি মিশিবিঝিউ! প্রাণে বেঁচে যাওয়া ওই মেয়েগুলোর কাছেই পরবর্তীতে ঘটনাটার আদ্যোপান্ত শুনতে পায় লোকে।’

‘হায়, ঈশ্বর! হায়, ঈশ্বর!’ বার কয়েক নিচুস্বরে বিড়-বিড় করল মিচেল। ‘এত ভয়ঙ্কর একটা প্রাণীকে সোনা বানানোর পরশপাথর বলার কারণ কী? ওটা কি সোনার ডিম দেয়?’

মৃদু হাসল হিউগো। ‘না, সোনার ডিম দেয় না। তবে ওটার স্পর্শে সবকিছু সোনা হয়ে যায়। সেদিন ওই মেয়েটার হাতে থাকা বৈঠাটার বাকি অংশ নিখাদ সোনায় পরিণত হয়েছিল! ওটা বিক্রি করে বাকি জীবনটা বেশ সুখেই কাটিয়েছিল ওরা।

‘এর পরেও বেশ কয়েক জন মানুষ গোল্ড ক্রীকে গিয়ে বিভিন্ন জিনিস সোনায় পরিণত করেছে; অন্তত আমার কাছে এমনটাই দাবি করেছে এক সিয়ক্স চিফ। একবার একটা সিংহের কবল থেকে লোকটাকে বাঁচিয়েছিলাম আমি। প্রাণ বাঁচানোর প্রতিদান স্বরূপ আমাকে এই গোপন তথ্যগুলো উপহার দিয়েছে সে। কীভাবে কী করতে হবে, সবকিছু পই পই করে বলে দিয়েছে।’

‘আর তুমি সেগুলো বিশ্বাসও করেছ?’ সতর্ক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল মিচেল।

‘করেছি,’ চটজলদি জবাব দিল হিউগো। ‘জগতে কত অদ্ভুত কিছুই তো ঘটে, তাই না? তাছাড়া হারানোর কী-ই বা ছিল আমার? এমনিতেই এক পা কবরে দেয়া ছিল, ক’বছরই বা বাঁচতাম আর! শেষকালে একবার ভিন্ন পথে ভাগ্য ফেরানোর চেষ্টা করতে দোষ কী?’

জবাব দিল না মিচেল। কী বলবে?

স্থবিরতা নেমে এল আলাপনে; হঠাৎই যেন সব কথা ফুরিয়ে গেছে ওদের!

আচমকা বলে উঠল মিচেল, ‘কী কী করতে হবে গোল্ড ক্রীক থেকে সোনা পেতে হলে?’

খানিকক্ষণ ওর দিকে অপলক তাকিয়ে রইল পোড় খাওয়া বুড়ো; আপনমনে কী যেন ভাবছে। তারপর ধীর গলায় বলল, ‘তোমার ওখানে যাওয়া ঠিক হবে না, বাছা। সারা জীবন পড়ে রয়েছে তোমার সামনে, এখনই শর্টকাট খোঁজার কী দরকার! একটু ভুলভাল হলেই আর রক্ষা নেই, প্রাণ খোয়াতে হবে মিশিবিঝিউ- এর হাতে। অযথা ঝুঁকি নেয়ার কোন মানে হয় না।’

হাসল মিচেল। ‘আপাতত ওই পথ মাড়ানোর কোন ইচ্ছে নেই আমার। তবে পদ্ধতিটা জেনে রাখতে চাই। যদি বুড়ো বয়সে এসে তোমার মত জীবন নিয়ে কোন আক্ষেপ থাকে, তখন নাহয় একবার ঘুরে আসব গোল্ড ক্রীক থেকে। ঠিক আছে?’

‘ঠিক আছে। তবে আমাকে কথা দাও, বাছা; নিতান্ত ঠেকায় না পড়লে তুমি কখনও গোল্ড ক্রীকের ট্রেইল ধরবে না।’

‘কথা দিলাম,’ হাসিমুখে বলল মিচেল।

স্বস্তির একটা নিঃশ্বাস ফেলল হিউগো। তার জন্য এই ছেলেটা অযথা প্রাণ হারালে, নিজেকে কখনও ক্ষমা করতে পারত না সে। ‘পদ্ধতিটা খুব জটিল নয়। পূর্ণিমার রাতে ক্রীকে নেমে কোমর পানিতে গিয়ে দাঁড়াতে হবে। তারপর চোখ বন্ধ করে পর-পর তিনবার চিৎকার করে বলতে হবে, ‘মিশিবিঝিউ, আমি হাজির হয়েছি। আমার উপহার গ্রহণ করুন।’ তারপর যে জিনিস তুমি সোনা বানাতে চাও, সেটা বাড়িয়ে ধরতে হবে সামনের দিকে

‘এরপর চারপাশে যত অদ্ভুত শব্দই শুনতে পাও না কেন, ভুলেও চোখ খোলা চলবে না। সবকিছু মিটে গেলে পরিবেশ যখন শান্ত হয়ে যাবে, চোখ বন্ধ রেখেই ধীরে-ধীরে পিছিয়ে আসতে হবে। হাঁটু পানিতে পৌছনোর পর চোখ খোলা যাবে।

‘তারপর তীরে উঠে যত জলদি সম্ভব ওখান থেকে চলে আসতে হবে। সোনা- যেটুকু পাবে, তা দিয়ে তুমি রাতারাতি মস্ত ধনী হতে পারবে না; তবে বাকি জীবনটা বেশ সচ্ছলভাবেই কাটাতে পারবে। এক জীবনে দ্বিতীয়বার আর কখনও গোল্ড ক্রীকের পাড়ে যাওয়া যাবে না। রক্তের সম্পর্ক আছে, এমন কোন স্বজনকেও পাঠানো চলবে না।’

‘পাঠাব না,’ হেসে তাকে আশ্বস্ত করল মিচেল। ‘তা সোনা বানানোর জন্য কী নিয়ে যাচ্ছিলে তুমি গোল্ড ক্রীকে?’

‘চারটে রূপার স্পার; স্যাডল ব্যাগে আছে। তোমাকে জিনিসগুলো উপহার দিলাম, বাছা। রোডিওতে ওগুলো পুরস্কার হিসেবে পেয়েছিলাম আমি। আর কখনও ওগুলো ব্যবহারের সুযোগ হবে না আমার।’

থমকে গেল মিচেল। আরও খানিকটা এগিয়ে এসে নিজের মুঠোয় তুলে নিল হিউগোর হাত দুটো। ‘ভবিষ্যতের কথা কে-ই বা বলতে পারে, হিউগো! হয়তো আবারও সুস্থ হয়ে উঠবে তুমি; ঘোড়া দাবড়ে বেড়াবে। তখন নাহয় স্পারগুলো ফিরিয়ে দেব তোমাকে।’

মাথা দোলাল বুড়ো; আধশোয়া থেকে পুরোপুরি চিত হয়ে শুয়ে পড়ল বেডরোলে। প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছে তার, ক্ষতগুলো ভীষণ জ্বালা করছে। মৃদুস্বরে বলল, ‘এখন গিয়ে শুয়ে পড়ো। আমাকে খানিকটা একা থাকতে দাও। ঈশ্বরকে বলার মত এখনও অনেক কথা বাকি রয়ে গেছে আমার।’

ঘাড় কাত করে সায় জানাল যুবক। নিজের বাড়তি কম্বলটা এনে চাপিয়ে দিল হিউগোর আহত শরীরে। অসুস্থ মানুষ; খানিকটা বাড়তি উষ্ণতায় আরাম পাবে।

ক্যাম্পফায়ারে আরও খানিকটা লাকড়ি চড়িয়ে দিয়ে নিজের বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল মিচেল। আজ সারাদিনই রাইড করেছে সে। গলা ফাটিয়ে ক্লান্তির ঘোষণা দিচ্ছে পরিশ্রান্ত দেহের সবক’টা পেশি।

মস্ত থালার মত চাঁদ উঠেছে আকাশে; আর একদিন বাদেই পূর্ণিমা। চন্দ্ৰদেবীকে সঙ্গ দেয়া তারাগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখের পাতা ভারী হয়ে এল তার; কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ল সে।

.

শেষরাতের দিকে মারা গেল হিউগো; ভোরে ঘুম থেকে জেগে তাকে মৃত অবস্থাতেই পেল মিচেল। লাশটাকে জড়িয়ে ধরে অনেকটা সময় অঝোরে কাঁদল ছেলেটা।

অল্প সময়ের মধ্যেই বুড়োকে ভীষণ ভালবেসে ফেলেছিল সে। এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে যাদের আপন বলতে কেউ থাকে না, তারা একে অন্যকে খুব সহজেই আপন করে নিতে পারে।

মেসার গোড়ায় একটা অগভীর অ্যারোইয়োতে হিউগোকে কবর দিল মিচেল। ফিউনেরালের আচার অনুষ্ঠান কীভাবে সম্পন্ন করতে হয়, এ ব্যাপারে বিশদ জানা নেই তার। তবে হৃদয়ের সবটুকু ভালবাসা সমর্পণ করতে কার্পণ্য করল না সে।

ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই জিনিসপত্র গোছগাছ করে রওনা হওয়ার জন্য তৈরি হয়ে গেল মিচেল। কাছের শহর সিটাডলে যাবে। নতুন কিছু বাথান গড়ে উঠেছে ওখানে, কাজ পেতে সমস্যা হবে না।

যাত্রা শুরুর ঠিক আগ মুহূর্তেই আচমকা থমকে দাঁড়াল সে। বিদ্যুৎ চমকের মত একটা সম্ভাবনা মাথায় এসেছে তার। এই এলাকা পরিত্যাগ করার আগে, একবার স্বচক্ষে গোল্ড ক্রীকটা দেখে গেলে কেমন হয়? আর কখনও এ তল্লাটে আসার সুযোগ হবে কিনা, কে জানে!

তাছাড়া আজ রাতেই পূর্ণিমা! কীসের মোহে জীবন উৎসর্গ করল বুড়ো মানুষটা, একবার যাচাই করে দেখলে মন্দ হয় না।

হিউগোকে দেয়া প্রতিশ্রুতির কথা বেমালুম ভুলে গেল মিচেল। রোমাঞ্চকর এক অভিযানের নেশা তখন পুরোদমে চেপে বসেছে তার মাথায়। দুটো ঘোড়া নিয়ে নিষিদ্ধ এলাকার দিকে যাত্রা শুরু করল তরুণ কাউবয়।

আবছা একটা ট্রেইল ধরে অনুচ্চ পাহাড় সারিটা পার হলো মিচেল। বহুকাল অব্যবহৃত থাকায়, প্রায় বুজে এসেছে ট্রেইলটা। ধুঁকতে-ধুঁকতে সামনে এগিয়ে পাহাড়ের শেষপ্রান্তে গিয়ে অক্কা পেয়েছে ওটা।

তবে এ নিয়ে কোন ঝক্কি পোহাতে হলো না মিচেলকে। কারণ ইতোমধ্যেই হিউগোর নির্দেশনা অনুসারে ক্যানিয়নটার দেখা পেয়ে গেছে সে।

ক্যানিয়নটা বেশ সরু। দু’পাশের টিলাগুলো প্রায় গায়ে গা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পাশাপাশি দু’জনের বেশি পথ চলা যাবে না এখানে। জায়গায় জায়গায় বেশ অন্ধকার; মেঝে ভীষণ সেঁতসেঁতে। টিলার বাঁকা চূড়ার কারণে সূর্যের আলো ঠিকমত পৌঁছয় না ওসব জায়গায়।

একনাগাড়ে এগিয়ে গেল মিচেল, এক মুহূর্তের জন্যও বিশ্রাম নিল না কোথাও। অবশেষে দুপুর নাগাদ ক্যানিয়নটা অতিক্রম করতে পারল সে।

সামনের ধু-ধু প্রান্তরটার দিকে তাকিয়ে খানিকটা ভড়কে গেল মিচেল আদতেই ভীষণ রুক্ষ ময়দানটা। এখানে-ওখানে ছড়িয়ে আছে দানবীয় সব পাথুরে বোল্ডার আর পুরো এলাকা ছেয়ে আছে বিষাক্ত চয়ায়। এই চয়ার কাঁটা শরীরে বিধলে ভীষণ ব্যথা হয়; ঘোড়াকেও অবলীলায় খোঁড়া করে ফেলতে পারে চয়া।

একটা পাথুরে চাতালের ছায়ায় যাত্রাবিরতি টানল মিচেল। ক্যান্টিন বের করে পানি খেল, হ্যাটে ঢেলে ঘোড়া দুটোকেও খাওয়াল। কেবল সে নিজে নয়, অবলা জানোয়ার দুটোও বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। খানিকক্ষণ বিশ্রাম না নিলে, সামনে পথ চলা দায় হয়ে পড়বে ওদের জন্য।

গোল্ড ক্রীকের পাড়ে পৌঁছতে পৌঁছতে প্রায় সন্ধ্যা ঘনিয়ে গেল। ক্রীকের ধারে একটা পাইনের জটলায় ক্যাম্প করল মিচেল।

ক্রীকটা বিশাল, অনেকখানি প্রশস্ত। এতটা বিস্তৃত ক্রীক এর আগে কখনও দেখেনি সে। দু’পাশে অনেকদূর পর্যন্ত কোন গাছগাছালি নেই; ডানা ছড়ানো একটা বাদুড়ের আকৃতি পেয়েছে এলাকাটা।

সাপারের পর খানিকক্ষণ ইতিউতি খুঁজল মিচেল, কিন্তু মিশিবিঝিউ-এর টিকিটিরও সন্ধান মিলল না। দানবীয় কোন প্রাণী বসবাস করে এখানে, তেমন কোন আলামতও চোখে পড়ল না কোথাও।

হতাশ ভঙ্গিতে মাথা দোলাল মিচেল। আপনমনে বিড়-বিড় করল, ‘অযথাই একটা ভ্রান্তির পিছনে ছুটেছে বুড়ো হিউগো। নিছকই রূপকথা এসব; বাস্তবে ওই জলার চিতাবাঘের কোন অস্তিত্বই নেই।’

.

রুপোর থালার মত চাঁদ উঠেছে আকাশে, চরাচরে ছড়িয়ে দিচ্ছে বিষাদমাখা জোছনা। আচমকা হিউগোকে দেয়া আশ্বাসের কথা মাথায় আসাতে, মনটা ভীষণ ভার হয়ে গেল মিচেলের।

একবার ভাবল, ফিরে গেলে কেমন হয়? কিন্তু মনের ভিতর থেকে সায় মিলল না। এতখানি এসে ফিরে যাওয়ার কোন মানে হয়? কে জানে, নিজের অসমাপ্ত কাজটা অন্য কেউ করে দিলে হয়তো খুশিই হবে হিউগোর আত্মা! অন্যলোকে বসে এই মুহূর্তে কি তার দিকেই অপলক তাকিয়ে আছে অদম্য বুড়ো?

হিউগোর উপহার দেয়া স্পারগুলো হাতে নিয়ে ধীর কদমে পানিতে নামল মিচেল। ক্রীকের জল বেজায় ঠাণ্ডা; রীতিমত কেঁপে উঠল তার সমস্ত শরীর।

শৈত্যের শিহরণ উপেক্ষা করে দ্রুত কোমর পানি অবধি পৌছে গেল তরুণ কাউবয়। যা করার তাড়াতাড়ি করতে চায়; সারা রাত এই বরফ শীতল জলে দাঁড়িয়ে থাকার প্রশ্নই আসে না।

আলতো করে চোখ মুদল সে; হাত দুটো বাড়িয়ে ধরল সামনের দিকে। তারপর চিৎকার করে বলল, ‘আমি হাজির হয়েছি, মিশিবিঝিউ! আমার উপহার গ্রহণ করুন।’ পর-পর তিনবার কথাটা বলে, চুপ মেরে গেল সে। প্রতীক্ষায় রইল; যদি কিছু ঘটে!

প্রথম কয়েক মুহূর্ত কিছুই ঘটল না। তবে গুমট হয়ে গেছে পরিবেশ; ঝিঁঝি পোকারাও থামিয়ে দিয়েছে তাদের একঘেয়ে ডাক!

পরক্ষণেই আলোড়িত হতে শুরু করল ক্রীকের জল। প্রথমটায় খুব ধীরে- ধীরে, পরবর্তীতে তীব্র বেগে। যেন অতল থেকে মাথাচাড়া দিচ্ছে অতিকায় কোন জলদানব!

আতঙ্কে জায়গায় জমে বরফ হয়ে গেল মিচেল। বুকের গভীর থেকে উঠে আসা চিৎকারটা গলার কাছটায় এসে থমকে গেল। সামনে বাড়িয়ে রাখা হাত দুটো অনবরত কাঁপছে তার।

চোখ বন্ধ থাকা সত্ত্বেও সমগ্র চেতনায় মিশিবিঝিউকে অনুভব করল মিচেল। প্রাণীটার ক্ষমতার বিস্তৃতি আঁচ করতে পেরে অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল তার। এমনকী অল্প সময়ের জন্য ওটার মোলায়েম গর্জনও শুনতে পেল সে!

ধীরে-ধীরে মিচেলের সামনে এসে দাঁড়াল মিশিবিঝিউ; অনেকটা সময় নিয়ে নিরীখ করল তাকে। তারপর আলগোছে লেজটা বাড়িয়ে দিল মিচেলের হাতে ধরা স্পারগুলোর দিকে; ছুঁয়ে দিয়ে সোনায় পরিণত করবে জিনিসগুলোকে।

ঠিক তখনই মারাত্মক একটা ভুল করে বসল মিচেল! দানবটাকে দেখার তীব্র ইচ্ছাটাকে দমন করতে ব্যর্থ হলো সে। চোখ মেলে সরাসরি তাকাল প্রাগৈতিহাসিক চিতাটার একমাত্র অক্ষিগোলকের দিকে!

সঙ্গে সঙ্গে জ্বলে উঠল মিশিবিঝিউ-এর রক্তবর্ণ চোখ; ঝলসে উঠল পিঠের সবক’টা কাঁটা। ভয়ানক রেগে গেছে সিয়াদের জলদেবতা!

তড়িৎ গতিতে প্রকাণ্ড লেজটাকে নিজের দিকে ধেয়ে আসতে দেখল মিচেল; পরক্ষণেই পা থেকে মাথা পর্যন্ত মসৃণভাবে দু’টুকরো হয়ে গেল তার গোটা দেহটা! যেন একখণ্ড নরম মাখনে ছুরি চালিয়েছে মিশিবিঝিউ!

চট করে জলের তলায় ডুবে গেল টুকরো দুটো। কারণ ততক্ষণে নিজেই নিখাদ সোনায় পরিণত হয়েছে মিচেল!

অগণিত দ্বিখণ্ডিত মানুষের সঙ্গে মিচেলও চিরকালের জন্য ঠাঁই পেল গোল্ড ক্রীকের তলায়। বুড়ো হিউগোর নির্দেশ অমান্য করে এই নিষিদ্ধ এলাকায় এসে মোটেও ঠিক করেনি সে।

আচমকা তীরে দাঁড়ানো একটা অবয়বের দিকে তাকিয়ে বিকট একটা হাঁক ছাড়ল মিশিবিঝিউ; রাগ নেই তাতে, আছে কৃতজ্ঞতা।

হাত নেড়ে প্রাণীটাকে আশ্বস্ত করল বুড়ো হিউগো; তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে হাঁটতে শুরু করল! মিশিবিঝিউ-এর জন্য নতুন শিকার খুঁজতে যাচ্ছে!

আরও অনেকক্ষণ পর আবারও ডাকতে শুরু করল ঝিঁঝি পোকার দল। একমাত্র ওরাই জানে, খানিকক্ষণ আগে ঠিক কী ঘটেছিল এই গোল্ড ক্রীকে!

***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *