এসকর্ট

এসকর্ট

এক

আপনি যদি জেফ কার্টারকে তার পেশা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন, জবাব পাবেন, ছোটখাট একটা ব্যবসা করি। কিংবা সে বলবে, আমি একজন আইটি ইনচার্জ। অথবা বলবে, বীমার দালাল।

মোদ্দাকথা, সত্যি কথাটা কিছুতেই আপনি তার মুখ দিয়ে বের করতে পারবেন না।

এমন নয় যে তার পেশা নিয়ে লজ্জিত সে, নিজেকে নিয়ে রীতিমত গর্ববোধ করে জেফ। তবুও সবার কাছে নিজের কাজের ক্ষেত্রটা গোপন রাখতেই পছন্দ করে সে। তার মতে, এই পেশায় গোপনীয়তার বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটা ভূমিকা রয়েছে এবং কখনও-কখনও এটাই সাফল্যের চাবিকাঠি।

আদতে জেফ কার্টার একজন মেল এসকর্ট। নারীরা অর্থের বিনিময়ে তার সঙ্গ কেনে। এই পেশায় সে একজন সুপারস্টার, আর তাই তার সঙ্গ পেতে চাইলে বেশ চড়া মূল্যই গুণতে হয় আগ্রহীদের।

নারীসঙ্গ কেনাবেচা, সম্ভবত পৃথিবীর আদিমতম ব্যবসা। তবে এই একবিংশ শতাব্দীতে এসে, যখন নারীরা প্রায় সব ব্যাপারেই পুরুষদের সমকক্ষ হতে চাইছে, তখন আর ব্যবসাটা একমুখী নেই। অর্থের বিনিময়ে পুরুষদের উপর আধিপত্য করার সুযোগটা বিত্তবান নারীরা বেশ উপভোগ করে বলেই মনে হয়।

তাই নিতান্ত পরীক্ষামূলকভাবে শুরু হওয়া এই মেল এসকর্টের ব্যবসাটা খুব তাড়াতাড়িই নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে গেছে। এখানে-ওখানে গড়ে উঠেছে বহু এসকর্ট এজেন্সি।

যদিও লেনদেনের বেশিরভাগ অংশ এখনও গোপনেই সারা হয়, তবুও এর বিস্তৃতি যে কোন অসচেতন মানুষের পিলে চমকে দেবার জন্য যথেষ্ট

শহরের অভিজাত এলাকার প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত জেফের অ্যাপার্টমেন্টটা বেশ বিলাসবহুল। এই মুহূর্তে নিজের ফ্ল্যাটের নরম গদিমোড়া কাউচে আধশোয়া হয়ে আছে সে। হাতে শোভা পাচ্ছে বিয়ারের বোতল। আধঘণ্টা ধরে একটা বিশেষ ফোনের অপেক্ষায় আছে সে।

ফোনটা করবেন তার বস, রবার্ট জনসন। সাধারণত সন্ধ্যা ছ’টা থেকে সাতটার মধ্যেই ফোন করেন তিনি। সাতটার পরও তাঁর ফোন না এলে, ধরে নিতে হবে আজ রাতে জেফকে দেয়ার মত কোন কাজ নেই তাঁর হাতে। তবে এমন ঘটনা গত দু’মাসে মাত্র একবারই ঘটেছে।

বিয়ারের তৃতীয় বোতলটা শেষ হবার আগেই ফোনটা বেজে উঠল।

‘হ্যালো, জেফ। ঠিকানা লিখে নাও।’

কাগজ-কলম নিয়ে তৈরিই ছিল জেফ। ঠিকানাটা টুকে নিতে সময় লাগল না।

‘আজকের ক্লায়েন্ট একজন কুমারী। ফর্মে অন্তত তিনি সেটাই লিখেছেন। তাঁর বিয়ে হবার কথা সামনের সপ্তাহে। তাই সিঙ্গেল লাইফটাকে শেষবারের মত উপভোগ করতে চান। তোমার বায়োডাটা দেখেই পছন্দ হয়ে গেছে তাঁর। পিক টাইম-ইলেভেন পিএম। বুকিং-ফুল নাইট। জব-এনিথিং। ক্লিয়ার?’

‘ইয়েস, স্যর।’

‘গুড। এবার শপথ বাক্যটা বলে ফেলো জলদি।’

‘এজেন্সির সুনাম অক্ষুণ্ণ রাখা এবং ক্লায়েন্টের সন্তুষ্টি অর্জনই আমার প্রধান কর্তব্য, নিজে উপভোগের সুযোগ পাওয়াটা বাড়তি পাওনা। আমি সদা সতর্ক থাকব, যেন আমার কোন আচরণের জন্য পুরো এজেন্সির অস্তিত্ব হুমকির মুখে না পড়ে। এর কোন ব্যত্যয় ঘটলে, এজেন্সি কর্তৃক প্রদত্ত যে কোন শাস্তি মাথা পেতে নিতে বাধ্য থাকব।’

যন্ত্রের মত গড়গড় করে বলে গেল জেফ। প্রতিটা কাজ বুঝে নেয়ার সময়ই এটা বলতে হয় তাকে। রুটিন ওয়ার্ক।

‘বেস্ট অভ লাক, জেফ।’

ফোন কেটে দিলেন রবার্ট জনসন।

মনে-মনে খুশি হয়ে উঠল জেফ। সে খেয়াল করেছে, এ পর্যন্ত যতবার বিদায় নেয়ার সময় ‘বেস্ট অভ লাক’ বলেছেন বস, ততবারই নিজের কাজটা উপভোগ করেছে সে। তাহলে আজকের রাতটাও কি তেমনই একটি স্মরণীয় রাত হতে যাচ্ছে?

তৈরি হতে চলল জেফ। ক্লায়েন্টদের কাছে সবসময় নিজেকে পরম কাঙ্ক্ষিত একজন সঙ্গী হিসেবেই উপস্থাপন করতে চায় সে। আর এজন্য সময়সাপেক্ষ একটি প্রস্তুতিপর্বের কোন বিকল্প নেই।

দুই

জেফের আজকের ক্লায়েন্টের নাম, মিরাণ্ডা। রওনা হবার আগে ঠিকানা লেখা কাগজটায় আরেকবার চোখ বুলিয়ে নিল জেফ। ১৩/৪ মিডল জোন।

ভ্রূজোড়া খানিকটা কুঁচকে গেল তার। এর আগে ব্যাপারটা খেয়াল করেনি ও। এই প্রথম মিডল জোনের কোন ক্লায়েন্টকে সঙ্গ দিতে যাচ্ছে সে।

ওখানে সাধারণত নিম্নবিত্ত শ্রেণীর মানুষেরা বসবাস করে। তাদের কাছে এসকর্ট সার্ভিসের চার্জটা গগনচুম্বী লাগার কথা। নুন আনতে যাদের পান্তা ফুরায়, তাদের এহেন বিলাসিতার সুযোগ কোথায়?

তাহলে মিরাণ্ডা অতগুলো টাকা পেল কোথায়? লটারি জিতেছে?

তবে ব্যাপারটা নিয়ে খুব বেশি মাথা ঘামানোর প্রয়োজন নেই জেফের। তার ক্লায়েন্ট ধনী নাকি দরিদ্র, তাতে তার কী আসে-যায়? তাকে কাজের জন্য পেমেণ্ট করে এজেন্সি, সরাসরি ক্লায়েন্ট নয়।

তাছাড়া ব্যাপারটা হয়তো ততটা গোলমেলেও নয়। কারণ অনেকেই ভুল ঠিকানা ব্যবহার করে এ ধরনের গোপনীয় কাজে। যদিও তার এজেন্সি শতভাগ বিশ্বস্ততার সঙ্গেই এযাবৎকাল কাজ করে এসেছে, তারপরও সঠিক পরিচয় প্রকাশের ক্ষেত্রে অনেক ক্লায়েন্টেরই আপত্তি থাকে। এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। আবার এমনও হতে পারে, এই বিশেষ রাতের জন্যই সারাজীবন ধরে অর্থ সঞ্চয় করেছে মেয়েটা!

নির্দিষ্ট ঠিকানায় পৌছে মিরাণ্ডার নাম্বারে ফোন করল জেফ। তার গাড়ির রঙ এবং পার্কিং লটের ঠিক কোথায় সেটা অবস্থান করছে, সে বিষয়ে বিস্তারিত জানাল মেয়েটাকে। তারপর দীর্ঘ প্রতীক্ষার প্রস্তুতি নিয়ে হাত-পা ছড়িয়ে যতটা সম্ভব আরাম করে বসল। অভিজ্ঞতা থেকে জানে, মেয়েদের সাজগোজের শেষ পর্বটাই সাধারণত সবচেয়ে লম্বা হয়। এক ক্লায়েন্টের জন্য ঝাড়া তিনঘণ্টা অপেক্ষা করার রেকর্ডও আছে তার!

তবে মিরাণ্ডা খুব একটা অপেক্ষা করাল না তাকে। মিনিট দশেকের মধ্যেই নীচে নেমে এল। জেফের জন্য তৈরি হয়েই অপেক্ষা করছিল মেয়েটা। বিশেষ রাতের একটা মুহূর্তও অপচয় করার ইচ্ছে নেই তার।

তাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানাল জেফ। তার ডান হাতটা মুঠোয় নিয়ে, হাতের উল্টোপিঠে আলতো করে চুমু খেল।

‘নিঃসন্দেহে আমার দেখা সেরা সুন্দরীদের একজন আপনি, মিস মিরাণ্ডা।’

হাসল মেয়েটা। ‘আপনিও কম হ্যাণ্ডসাম নন, মিস্টার জেফ কার্টার।’

‘শুধু জেফ,’ বলতে-বলতে প্যাসেঞ্জার সিটের দরজাটা মিরাণ্ডার জন্য খুলে দিল জেফ। মেয়েটা উঠে বসার পর ড্রাইভিং সিটে এসে বসল সে।

মনে-মনে হাসছে ও। ক্লায়েন্টদের খুশি করার জন্য কত কিছুই না বলতে হয়! এমন ভাব করতে হয়, যেন পৃথিবীর সবচেয়ে আরাধ্য মেয়েটিকে সঙ্গী হিসেবে পেয়েছে সে। অন্য কারও সঙ্গেই যার তুলনা চলে না। এমন কিছু করা যায় না, যাতে মেয়েটি নিজেকে ছোট ভাবে।

অথচ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বলা কথাগুলো হয় নির্জলা মিথ্যা! যার জ্বলন্ত উদাহরণ, কিছুক্ষণ আগে মিরাণ্ডাকে বলা তার স্তুতিবাক্যটা। শতভাগ মিথ্যা, সত্যের লেশমাত্রও নেই ওতে।

মেয়েটা দেখতে বিশ্রী। মুখের গড়ন দেখলে মনে হয়, কেউ রাগের মাথায় হাতুড়ি দিয়ে আচ্ছামত পিটিয়েছে তাকে! তাতেই ওটা অমন এবড়ো-খেবড়ো হয়ে গেছে!

গায়ের রঙ ফ্যাকাসে। যেন বহুদিন একনাগাড়ে কয়লা খনিতে কাজ করতে বাধ্য হয়েছে সে, সূর্যের দেখা পাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি!

শরীরটা স্থূলকায়। দূর থেকে দেখলে হাতির বাচ্চা বলে ভুল করবে যে কেউ। শরীরের মতই ইয়া মোটা একজোড়া ঠোঁট, মুখের অনেকটা জায়গা দখল করে রেখেছে। আর তাতে মাখানো টুকটুকে লাল রঙের লিপস্টিক আরও বেশি করে চোখে লাগছে। হাতের লম্বা নখেও একই রঙের নেলপলিশের প্রলেপ। কোন সন্দেহ নেই, এটা মিরাণ্ডার পছন্দের রঙ।

দুই কানে আরব্য রজনীর দানবদের পরার উপযোগী একজোড়া রিং ঝুলিয়েছে সে। ওগুলোর ভারে কখন যে কানদুটো ছিঁড়ে পড়বে, কে জানে!

অত্যন্ত নিম্নমানের রুচি মেয়েটার। তবুও আজ রাতটা এর সঙ্গেই কাটাতে হবে জেফকে।

মিরাণ্ডাকে মিষ্টি একটা হাসি উপহার দিল সে। ‘বলুন, কোথায় যাব এখন? কোন হোটেলে যেতে চান? আপনি চাইলে ডিসকাউন্টের ব্যাপারে আমি সাহায্য করতে পারি।’

রহস্যময় ভঙ্গিতে হাসল মিরাণ্ডা। ‘ক’দিন পরেই আমার বিয়ে হতে যাচ্ছে। এই অবস্থায় হোটেলে রাত কাটানো কি ঠিক হবে? যদি কারও চোখে পড়ে যাই! কোন বিশ্বস্ত বন্ধুর বাসায় গেলে কেমন হয়?’

‘আপনার যেমন ইচ্ছে, মিস।’

‘ঠিক আছে। তাহলে প্রথমে নর্থ হাইওয়েতে চলুন। ওখান থেকেই আমার বান্ধবীকে তুলে নেব।’

নর্থ হাইওয়ে! চমকে উঠল জেফ। ওখানে কেন?

গত কয়েকমাসে ওই রাস্তায় বেশ কিছু রহস্যময় খুনের ঘটনা ঘটেছে ভিকটিমদের লাশগুলো কেবল পাওয়া গেছে, খুনি এখনও ধরা পড়েনি। লাশ বলতে অবশ্য শুধুই কঙ্কাল, গায়ে একরত্তি মাংসও ছিল না কারও! তাই চেনার জো নেই, কাদের লাশ ওগুলো। তবে শেষ অবধি ডিএনএ টেস্ট করে বেশ কিছু ভিকটিমের পরিচয় বের করতে পেরেছে পুলিশ।

সব ক’জনই সাধারণ মানুষ, কারোরই অতীতে কোন ক্রিমিনাল রেকর্ড নেই। প্রাণে মেরে ফেলতে পারে, এমন বড় কোন শত্রুও খুঁজে পাওয়া যায়নি কারও।

তাই পুলিশের ধারণা, বিকৃত মস্তিষ্কের কোন সিরিয়াল কিলারের আবির্ভাব ঘটেছে ওই এলাকায়। তবে গোয়েন্দা বিভাগের মতে, খুনি একজন নয়, একাধিক। তাই ওই এলাকায় চলাচলের ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে জনসাধারণকে। বাড়ানো হয়েছে পুলিশি নজরদারি।

কোন নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়নি, তবুও সন্ধ্যার পর পারতপক্ষে ওই রাস্তাটা এড়িয়ে চলে এখন লোকজন। আর রাত দশটার পর তো রীতিমত খাঁ-খাঁ করে পুরো তল্লাট।

এই রাতদুপুরে অপরিচিত দুটো মেয়েসহ যদি পুলিশের কোন টহল দলের সামনে পড়তে হয়, কী জবাব দেবে জেফ?

ওদেরকে আলাদা করে মাত্র মিনিট দুই জেরা করলেই প্রকৃত সত্যটা বের করে ফেলতে পারবে পুলিশ। আর তাতে করে এজেন্সির অস্তিত্ব ফাঁস হয়ে যাওয়ার একটা আশঙ্কা তৈরি হবে।

‘অন্য কোথাও থেকে আপনার বান্ধবীকে পিক করা যায় না? জানেনই তো, আজকাল নর্থ হাইওয়েতে পুলিশের বড্ড কড়াকড়ি চলছে।’

‘লারা ওখানেই একটা বারে কাজ করে। রাত বারোটায় তার শিফট শেষ হয়। আমি ওকে কথা দিয়েছি, যাবার সময় তুলে নেব। অপেক্ষায় থাকবে ও। তাছাড়া ওর বাসাতেই যাচ্ছি আমরা, জায়গাটা নর্থ হাইওয়ের একেবারে শেষ মাথায়।’

জোর করে মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলল জেফ। সে মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছে, এটা ক্লায়েন্টকে বুঝতে দিতে চায় না। ‘চলুন তাহলে। কী আর করা। প্রার্থনা করুন, কোন পেট্রোল কারের সামনে যেন পড়তে না হয়।’

‘কিংবা সেই সাইকো খুনিটার সামনে,’ যোগ করল মিরাণ্ডা।

হাসল জেফ। সাইকোকে নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না সে, তার যত ভয় পুলিশকেই। একবার হাতেনাতে ধরতে পারলে, ঠিকই কেঁচো খুঁড়তে সাপ বের করে আনবে হতচ্ছাড়ার দল।

কিন্তু জেফের জানা নেই, টহল দেবার মত একজন পুলিশও আজ নেই নর্থ হাইওয়েতে! পুলিশ কমিশনারের ছেলের বিয়ে, ওখানেই ফুর্তি করছে বেশিরভাগ অফিসার। আর যাদেরকে দুঃখজনকভাবে আজকের এই বিশেষ রাতে বাধ্যতামূলক ডিউটি দেয়া হয়েছে, তারাও টহল চৌকিতে বসে তাস পেটাচ্ছে। অন্যরা মৌজ করবে, আর তারা বুঝি রাস্তায় ঘুরে মরবে? উঁহু, সেটি হচ্ছে না। কোথাও কিছু ঘটলে, দেখা যাবে ‘খন। অন্তত আজকের রাতে অহেতুক পণ্ডশ্রম করতে রাজি নয় কেউ।

তিন

লারা যেখানে কাজ করে, সে বারটাকে দেখে অবাক না হয়ে পারল না জেফ। গ্র্যাণ্ড স্ট্রীটের বারগুলোর সঙ্গে এটার আকাশ-পাতাল ফারাক। ওগুলোর ঝকমকে সাইনবোর্ডের বদলে এখানে ঝুলছে রঙজ্বলা একখানা নেমপ্লেট। আলোক স্বল্পতার কারণে সেটিও ভাল করে পড়ার উপায় নেই।

গ্র্যাণ্ড স্ট্রীটের বর্ণিল আলোর জৌলুশের বিপরীতে এখানে ঝুলছে কম পাওয়ারের একখানা হলদে বাতি। ভিতর থেকে ভেসে আসছে না কোন কোলাহল, বাজছে না কোন মিউজিক!

একজন খদ্দেরও বোধহয় নেই ভিতরে, কর্মচারীরাই হয়তো বসে মাছি মারছে। অথচ গ্র্যাণ্ড স্ট্রীটে রাত বারোটা মানে কেবলই সন্ধ্যারাত। প্রতিটা বারে লোকজন রীতিমত গিজগিজ করে।

লারার জন্য মায়াই লাগল জেফের। মেয়েটা ঠিকমত বেতন পায় কি না কে জানে।

বারের মত লারা নিজেও অবশ্য জেফকে কম অবাক করেনি! মিরাণ্ডার সঙ্গে মেয়েটার একরত্তি মিলও নেই। ছিপছিপে দেহের গড়ন, যেন হাড়ের উপর সরাসরি চামড়ার প্রলেপ দেয়া, মাংসপেশীর কোন বালাই নেই। এতটা শুকনো একজন মানুষ হয় কী করে?

গায়ের রঙ দুধে আলতা মেশানো, প্রচণ্ড সুন্দরী। একবার তাকালে চোখ ফেরাতে ইচ্ছে করে না।

মুক্তোর মত ধবধবে সাদা দু’সারি দাঁত, মুখ খুললেই ঝিলিক দিয়ে ওঠে তবে উপরের পাটির ক্যানাইন দুটো খানিকটা বেশি লম্বা মেয়েটার। তাই হাসার সময় খুব সাবধানে হাসে সে, যেন চট করে ব্যাপারটা কারও চোখে না পড়ে। মাপা হাসিতে আরও বেশি সুন্দর লাগে তাকে।

জেফ নিজেকে মনে করিয়ে দিল, তার ক্লায়েন্ট মিরাণ্ডা, লারা নয়। তাই মিরাণ্ডাই তার পূর্ণ মনোযোগের একমাত্র দাবিদার। যদিও এর উল্টোটা হলেই বেশি খুশি হত সে।

‘এবার কোথায় যাব, মিস?’ মিরাণ্ডাকে জিজ্ঞেস করল জেফ।

‘চলুন, পথ দেখাচ্ছি।’

গাড়ি ছেড়ে দিল জেফ। লারা পিছনের সিটে বসলেও, মিরাণ্ডা এখনও সামনের সিটে তার পাশেই বসে আছে। বান্ধবীকে সঙ্গ দিতে পিছনে গিয়ে ওঠেনি।

তবে একটা ব্যাপার ঠিকই খেয়াল করল জেফ। লারা আসার পর থেকে মিরাণ্ডার হাবভাবই পাল্টে গেছে।

দু’জনের মুখেই সার্বক্ষণিক চাপা হাসি লেগে আছে, দু’জনেই প্রচণ্ড উত্তেজিত। একটু পর-পরই চোখে-চোখে কথা হচ্ছে ওদের। যদিও আলাপের বিষয়বস্তু ঠিক পরিষ্কার না জেফের কাছে।

এতটা উত্তেজিত কেন ওরা? অনাগত রাতের অ্যাডভেঞ্চারের কথা ভেবে? এটাই হবে। দু’জনের জন্যই যে ব্যাপারটা নতুন, এতে কোন সন্দেহ নেই।

রিয়ারভিউ মিররের দিকে তাকাতেই লারার সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গেল জেফের। তার মুখের দিকেই এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মেয়েটা। তার চোখে যুগপৎ লালসা আর ঈর্ষা দেখতে পেল জেফ।

লালসা কার প্রতি, সেটা বুঝতে মোটেও কষ্ট হচ্ছে না। কিন্তু ঈর্ষা? বান্ধবীর ভাগ্যের প্রতি?

তার চোখে চোখ রেখেই নিজের শুকনো ঠোঁটে জিভ বুলাল লারা।

মনে-মনে হাসল জেফ। মেয়েটা নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না কোনমতেই। কতদিন পুরুষবিবর্জিত জীবন কাটাচ্ছে কে জানে!

নিজের উপর জোর খাটিয়ে রিয়ারভিউ মিরর থেকে চোখ সরাল জেফ। উপলব্ধি করছে, মিরাণ্ডাও তার মুখের দিকেই তাকিয়ে আছে এখন। মিরাণ্ডার চোখেও চকচক করছে লোভ!

ওদের উত্তেজনার মূল কারণটা কিছুটা হলেও এখন আঁচ করতে পারছে জেফ। সম্ভবত ওদের সম্মিলিত কোন ফ্যান্টাসি আছে, যা ওকে দিয়ে আজ পূরণ করাতে চলেছে ওরা। নিষিদ্ধ আনন্দ আহরণের সম্ভাবনা চিরকালই উত্তেজনাকর। ওদের আর দোষ কী?

আচমকা ঘাড়ের কাছে উষ্ণ একটা স্পর্শে চমকে উঠল জেফ। পরক্ষণেই বুঝতে পারল, লারা হাত বুলাচ্ছে ওখানে! ঝট করে ঘাড়টা সরিয়ে নিল জেফ। শিরদাঁড়া সোজা করে বসল সিটের উপর।

পিছন থেকে অস্ফুট শব্দ করে উঠল লারা। স্পষ্ট বোঝা গেল, ব্যাপারটায় অসন্তুষ্ট হয়েছে সে। তবে পরোয়া করল না জেফ। তার ক্লায়েন্ট মিরাণ্ডাকে পুরোপুরি সন্তুষ্ট করতে বাধ্য সে, লারাকে নয়।

গোটা ব্যাপারটা খুব ভালভাবে লক্ষ্য করলেও, মুখে কিছু বলল না মিরাণ্ডা শুধু লারার দিকে তাকিয়ে চোখ মটকাল একবার। ভাবখানা এমন, তর সইছে না, না?

চার

লারার অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিংটার পুরোপুরি বেহাল দশা। অনেক পুরানো একটা দালান, দেয়ালের জায়গায় জায়গায় ছাল-চামড়া উঠে গেছে। পলেস্তারা খসে গিয়ে ভিতরের লোহার কঙ্কাল বেরিয়ে পড়েছে। যে কোন সময় ভেঙে পড়ার শঙ্কা নিয়েই নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে আছে ওটা।

নিরাপত্তার কোন বালাই নেই। সিকিউরিটি ক্যামেরা দূরে থাক, একজন দারোয়ান পর্যন্ত নেই!

সিঁড়ি বেয়ে ওঠার সময় জেফ ভাবল, মিরাণ্ডার ভার সইবে তো জরাজীর্ণ সিঁড়িগুলো?,

তবে কোনরকম বিপত্তি ছাড়াই পাঁচতলায় লারার ফ্ল্যাটে উঠে এল ওরা।

ফ্ল্যাটটা ছোট, তবে বেশ পরিপাটি করে সাজানো। বাইরে থেকে কল্পনাও করতে পারবে না কেউ, ভিতরটা এতটা সুন্দর। মনে-মনে লারার রুচির প্রশংসা না করে পারল না জেফ।

ঘরে ঢোকার পর আর একটা সেকেণ্ডও নষ্ট করতে চাইল না মিরাণ্ডা। উত্তেজনায় রীতিমত কাঁপছে সে।

‘তুমি ভাল করেই জানো, আমি কেন তোমাকে এখানে এনেছি। তাই না, জেফ?’

মাথা নেড়ে সায় জানাল জেফ। জানে সে, বেশিরভাগ ক্লায়েন্ট তার কাছে এটাই চায়।

‘আমরা দু’জন একসাথে থাকলে তোমার কোন আপত্তি নেই তো?’ বলে উঠল লারা।

‘মিস মিরাণ্ডা রাজি থাকলে, আমার কোন অসুবিধে নেই,’ শান্ত স্বরে জবাব দিল জেফ।

জবাব দিতে একটুও সময় নিল না মিরাণ্ডা। ‘আমি রাজি। আসলে, আইডিয়াটা আমারই।’

শ্রাগ করল জেফ। ক্লায়েন্ট যা বলবে, তা-ই করতে বাধ্য সে।

তার চোখের সামনেই চটজলদি কাপড় ছাড়তে শুরু করল মেয়ে দুটো। পূর্ণ দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকিয়ে রইল জেফ।

নিজের ভিতরকার ক্রমবর্ধমান উত্তেজনাটা তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছে সে। কত সহজেই না শিকার মিলছে আজকাল! কেবল ঝোপ বুঝে কোপ মারতে পারলেই কেল্লা ফতে।

স্বীকার করতেই হয়, বস রবার্ট জনসনের এই এসকর্ট এজেন্সি খোলার আইডিয়াটা দুর্দান্ত ছিল। কেননা বেশিরভাগ মানুষই এসকর্ট এজেন্সির সার্ভিস নেয়ার ব্যাপারটাকে নিজেদের স্বার্থেই গোপন রাখে। তাই পুলিশের পক্ষে কখনওই ব্যাক-ট্র্যাক করে এজেন্সি পর্যন্ত পৌঁছনো সম্ভব হয় না।

গাড়িতে বসেই কথার ছলে জেনে নিয়েছে জেফ, মিরাণ্ডা আর লারাও আজকের ব্যাপারটাকে নিজেদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখেছে, আর কাউকে জানায়নি।

একজন মেল এসকর্টের সঙ্গে রাত কাটাতে যাচ্ছে, এটা কি আর জনে-জনে বলে বেড়ানোর বিষয়?

লম্বা দম নিল জেফ। অনুভব করছে, দেহের প্রতিটি কোষ থেকে দানবীয় শক্তি বিচ্ছুরিত হচ্ছে। পরিবর্তনের জন্য সম্পূর্ণ তৈরি সে!

আঁধারের দেবতাকে ধন্যবাদ জানাতে ভুলল না জেফ। বহুদিন বাদে তার ভাগ্যে জোড়া শিকার মিলেছে।

বিবস্ত্র মিরাণ্ডার চর্বিসর্বস্ব শরীরের দিকে তাকিয়ে চোখ জুড়িয়ে গেল তার। থলথলে মাংসপিণ্ডগুলো তার অনেকদিনের খিদে মেটানোর জন্য যথেষ্ট!

লারার ফর্সা ত্বকের নীচে বয়ে চলা উষ্ণ রক্তের শিরাগুলোও স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে সে এখন। আর তাতেই তার পিপাসা বেড়ে গেল বহুগুণে! তৃষ্ণায় বুকের ছাতি ফেটে যাওয়ার উপক্রম হলো।

আর সময় নষ্ট করতে ইচ্ছুক নয় জেফ। ধীরপায়ে এগিয়ে গেল সে পুরোদস্তুর নগ্ন মেয়ে দুটোর দিকে।

একধরনের ঘোরের মধ্যে থাকায়, জেফের দানবে রূপান্তরিত হওয়াটা দু’জনের কেউই লক্ষ করেনি। যতক্ষণে ওদের টনক নড়ল, ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে।

পরদিন নর্থ হাইওয়েতে পাওয়া লাশের তালিকায় যুক্ত হলো আরও দুটো নতুন নাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *