স্পেনীয় রাজকুমারীর জন্মতিথি
The Birth day of the Infanta
রাজকুমারীর জন্মদিন। রাজকুমারীর বয়স মাত্র বারো। রাজপ্রাসাদের বাগানগুলিতে জোরাল সূর্যের আলো পড়েছে। সত্যিকারের রাজকুমারী এবং স্পেনের ইনফ্যানটা হওয়া সত্ত্বেও দরিদ্র ঘরের ছেলেমেয়েদের মতোই বছরে তারও কেবল একদিনই জন্মতিথি পালিত হত। যাতে এই দিনটি বেশ সুন্দর ভাবে উদযাপিত হয়, সেই জন্যেই সারা দেশই আনন্দে মুখর হয় উঠতো। আর দিনটি সত্যিই বড়ো সুন্দর হয়ে উঠেছিল। লম্বা লম্বা সুন্দর টিউলিপ ফুলগুলি ডাঁটা ওপরে মাথা উঁচু করে ঘাসের বনে ওপাশ থেকে গোলাপের দিকে তাকিয়ে বলল–আমরাই বা কমতি কিসের? বেগুনে রঙের প্রজাপতি পাখায় স্বর্ণরেণু মিশিয়ে এ-ফুল থেকে ও-ফুলের ওপরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। দেওয়ালের ফাটল থেকে টিকটিকিরা উঁকি দিয়ে রোদ পোহাচ্ছে। ডালিম ফলগুলি গরমে ফেটে পড়ায় তাদের রক্তাক্ত হৃদয়গুলি বাইরে বেরিয়ে পড়েছে। চারপাশে আনন্দ আর উত্তেজনার ঢল নেমেছে। বাতাস সুগন্ধের প্রাচুর্যে উঠেছে ভারী হয়ে।
সঙ্গীদের নিয়ে বাচ্চা রাজকুমারী অলিন্দের ওপরে লুকোচুরি খেলছে। সাধারণত নিজের পদমর্যাদার উপযুক্ত ছেলেমেয়েদের সঙ্গেই তাকে খেলা করতে দেওয়া হয়। ফলে তাকে একলাই খেলা করতে হয়। কিন্তু এই জন্মদিনটিই যা ব্যতিক্রম। রাজা নির্দেশ দিয়েছেন আজকের দিনে যার সঙ্গে খেলা করতে তার ভালো লাগে রাজাকুমারী তাকেই নিমন্ত্রণ করতে পারবে। স্পেনদেশীয় রোগাটে শিশুদের গতির মধ্যে বেশ একটা লাবণ্য রয়েছে। কিন্তু সবচেয়ে লাবণ্যময়ী হচ্ছে রাজকুমারী নিজে। একটু বোঝার মতো হলেও পোশাক-পরিচ্ছদ, সাজ-সজ্জা তার বেশ মনোমুগ্ধকরই ছিল। ধূসর বর্ণের সাটিনের পোশাক তার গায়ে: রুপো দিয়ে মোড়া বেশ শক্ত গোছের অন্তর্বাস সে পরেছে। সরু ফিতে দিয়ে তৈরি গোলাপ ফুলের নকশা কাটা ছোটো দুটি শ্লিপার তার পায়ে। হেঁটে বেড়ানোর সময় বাইরে থেকে সে দুটিকে বেশ ভালো করেই দেখা যাচ্ছে। তার বিবর্ণ মুখের ওপরে চুলের মধ্যে জ্যোতির্মণ্ডলের মতো সুন্দর সাদা গোলাপ শোভা পাচ্ছে।
রাজপ্রাসাদের একটি বাতায়ন কক্ষে বিষণ্ণ রাজা বসে রয়েছেন। এদের সবাইকে তিনি দেখছিলেন, তাঁর পেছনে দাঁড়িয়েছিলেন তাঁর ভাই অ্যারাগনের ডন পেড্রো; এই ভাইটিকে তিনি ঘৃণা করতেন। তাঁর কনফেশর গ্রানাদার গ্র্যান্ড ইনকুইজিটর বসেছিলেন তাঁর পাশে। অন্যান্য দিনের চেয়ে রাজা আজ বেশি বিষণ্ণ। তাঁর শিশু কন্যাটি তার শিশুসুলভ গাম্ভীর্যে সমবেত পারিষদবর্গকে মাথা নীচু করে অভিবাদন জানাচ্ছিল। সেই মেয়েকে দেখতে-দেখতে তিনি তখন তার মা যুবতী রানির কথা চিন্তা করছিলেন। তাঁর মনে হল মাত্র কিছুদিন হল ফ্রান্সের আনন্দোজ্জ্বল দেশ থেকে তিনি এখানকার রানি হয়ে এসেছিলেন। মেয়েটির জন্মের ছ’মাস পরেই তাঁর মৃত্যু হয়। এই রানিকে তিনি এতই ভালোবাসতেন যে মৃত্যুর পরে রাজা তাঁর মৃতদেহকে কবরস্থ করতে দেননি। একজন মুরদেশের চিকিৎসক তাঁর দেহটিকে ওষুধপত্র দিয়ে অবিকৃত অবস্থায় রেখে দিয়েছিল। যাদুবিদ্যার প্রয়োগের জন্যে তার প্রাণদণ্ড হয়েছিলা। কিন্তু এই কাজের জন্যে রাজা তার মৃত্যুদণ্ড মকুব করে দিয়েছিলেন। বারো বছর আগে একটি বাত্যামুখর মার্চ মাসে পাদরিরা তাঁর দেহটিকে নিয়ে প্রাসাদের একটি কালো মার্বেল গির্জায় স্থাপন করেছিলেন। কালো পোশাক পরে একটি লণ্ঠন হাতে নিয়ে রাজা প্রতি মাসে একবার করে সেখানে গিয়ে সেই দেহটির পাশে হাঁটু মুড়ে বসে আমার রানি, আমার রানি, বলে তাকে ডাকতেন। স্পেনে মানুষের প্রতিটি কাজ করার পেছনে একটা শালীন রীতি রয়েছে–এমন কি রাজার শোকেরও একটা সীমা সেখানে নির্ধারিত রয়েছে–সেই রীতি ভঙ্গ করে মৃতদেহের মণিমুক্তার গয়নাপরা বিবর্ণ হাতটা নিজের হাতে ধরে চিৎকার করে কাঁদতেন; ঠান্ডা রঙকরা গালে চুমু খেতেন উন্মাদের মতো।
মাত্র পনেরো বছর বয়সে ফঁতেনব্লু দুর্গে রানিকে তিনি প্রথম দেখেছিলেন। রানির বয়স তখন আরো কম। সেদিনকার রানির মূর্তিটি আবার তাঁর চোখের ওপরে ভেসে উঠল। সেইদিন ফরাসি সম্রাটের সামনে তাঁদের বিয়ের ব্যবস্থা পাকা হয়। ফিরে আসার সময় নিয়ে এসেছিলেন পীতবর্ণ চুলের ছোটো একটি আংটি, সেই সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন গাড়ি থেকে নামার পরে বালিকা বধূ তাঁর হাতে যে চুম্বন করেছিলেন সেই স্মৃতি দেশের সীমান্তবর্তী ছোটো একটি নগর বার্গোতে খুব তাড়াতাড়ি তাঁদের বিয়ে হয়েছিল; তারপরে বিরাট শোভাযাত্রা করে ফিরে এসেছিলেন মাদ্রিদে। লা অ্যাটোচা গির্জায় ধর্মীয় প্রার্থনা সভা বসেছিল; এবং তারপরেই প্রায় শ’তিনেক কাফেরকে, তাদের মধ্যে ইংরাজদের সংখ্যাও অনেক ছিল, সৈন্যবাহিনির হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল পুড়িয়ে মারার জন্যে।
সত্যি কথা বলতে কি রাজা তাঁকে উন্মাদের মতো ভালোবাসতেন। নতুন বিশ্বের ওপরে আধিপত্য বিস্তার করার উদ্দেশ্যে ইংলন্ডের সঙ্গে তখন তাঁর দেশের যুদ্ধ শুরু হয়েছিল। তাঁর সেই উন্মাদ প্রেমের জন্যে তাঁর দেশের সুষ্ঠু যুদ্ধ পরিচালনাও ব্যাহত হয়েছিল। এক মুহূর্তের জন্যেও তিনি তাঁকে চোখের আড়াল করতেন না। এরই ফলে অনেকের ধারণা জরুরি রাজকার্যেও তিনি অবহেলা করতেন। ভোগবাসনা মানুষকে যে ভয়ঙ্কর রকমের অন্ধ করে দেয় তারই জন্যে তিনি দেখতে পাননি যে রানিকে তুষ্ট করার জন্যে তিনি যে বিরাট আয়োজন করেছিলেন তারই ফলে রানি একটি অদ্ভুত অসুখের কবলস্থ হয়ে পড়েছিলেন। রানির মৃত্যুর পরে কিছুটা সময় তাঁর চিন্তাশক্তি লোপ পেয়েছিল। একবার মনে হয়েছিল সিংহাসন পরিত্যাগ করে তিনি গ্রানাদার গির্জায় গিয়ে বাকি জীবনটা পারলৌকিক চিন্তায় কাটিয়ে দেবেন; কিন্তু শিশু কন্যাটিকে তিনি তাঁর নির্দয় ভাই-এর হাতে রেখে যেতে ভয় পেলেন। কারণ, স্পেনে তাঁর ভাই-এর মতো নিষ্ঠুর আর কেউ ছিল না এবং অনেকের ধারণা রানি যখন তাঁর দুর্গ অ্যারাগনে গিয়েছিলেন তখন এই লোকটিই তাঁকে একজোড়া বিষাক্ত দস্তানা উপহার দিয়ে তাঁর মৃত্যু ঘটিয়েছিলেন। এর পরে রাজা রাজ্যের মধ্যে পরের তিনটি বছর শোক পালন করার নির্দেশনামা জারি করেছিলেন। তার পরেও আর একটি বিয়ে করার জন্যে কোনো মন্ত্রীই তাঁকে রাজি করাতে সক্ষম হননি। একবার সম্রাট তাঁর ভাইঝি বোহেমিয়ার সুন্দরী আর্ক ডাচেন্সের সঙ্গে তাঁর বিয়ের প্রস্তাব করেছিলেন, কিন্তু বোহেমিয়ার রাষ্ট্রদূতদের ডেকে তিনি বলে দিলেন–তোমাদের সম্রাটকে জানিয়ে দিয়ো যে স্পেনের রাজা দুঃখকেই তাঁর পত্নী হিসাবে বরণ করেছেন; এবং যদিও সৌন্দর্যের তুলনায় দুঃখ অনেক বেশি বন্ধ্যা রমণী তথাপি সৌন্দর্যের চেয়ে দুঃখকেই তিনি বেশি ভালোবাসেন। তাঁর এবম্বিধ উত্তরের জন্যে অচিরাৎ তাঁকে নেদারল্যান্ড-এর প্রদেশগুলি খেসারৎ দিতে হয়েছিল; বোহেমিয়ার সম্রাটের উসকানিতে রিফর্মড চার্চের কিছু গোঁড়া নেতা তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল। তাঁর ছোটো মেয়েটিকে প্রাসাদের অলিন্দে খেলা করতে দেখে আগুনে উচ্ছ্বাস ভরা আর রানির হঠাৎ মৃত্যুতে যে মহাশোকের তরঙ্গ তাঁকে বিপর্যস্ত করে তুলেছিল, বিবাহিত জীবনের সুখ-দুঃখ ভরা সেই মেয়েটির মধ্যে ফুটে বেরিয়েছে-সেই হাসি, হাসার সময় সেইভাবে ঠোঁট বাঁকানো, সেইভাবে ঘাড় নাড়ানো,–সব সব, কিন্তু শিশুদের চিৎকার তাঁর কান দুটো ব্যথিত করতে লাগল; মেঘমুক্ত নির্মল সূর্যের আলো তাঁর বেদনাকে ব্যঙ্গ করতে লাগল–এবং একটা অদ্ভুত বিশ্রী গন্ধ–শব সংরক্ষণ করার জন্যে চিকিৎসকেরা সাধারণত যে ধরনের গন্ধদ্রব্য ব্যবহার করে থাকে–সেই অস্বস্তিকর একটা গন্ধ-সত্যি? না, মতিভ্রম তাঁর?-পরিচ্ছন্ন প্রভাত-হাওয়াকে বিষাক্ত করে তুলল। হাত দুটোর মধ্যে মুখটাকে তিনি ঢেকে দিলেন। তারপরে রাজকুমারী আবার যখন মুখ তুলল তখন পর্দা পড়ে গিয়েছে–রাজা সেখান থেকে চলে গিয়েছেন।
রাজকুমারী একটু মনোক্ষুণ্ণ হল। বিরক্তিতে কাঁধটা কোঁচকাল! আজ তার জন্মদিন। এদিনটা তিনি এখানে থাকতে পারতেন। নিরর্থক সরকারি কাজগুলির দাম তাঁর কাছে এতই বেশি? অথবা যে অন্ধকারাচ্ছন্ন বিমর্ষ ঘরটিতে সব সময়েই বাতি জ্বলছে, আর যে ঘরে তাকে যেতে দেওয়া হয় না সেইখানেই তিনি গিয়েছেন। কী বোকা, কী বোকা! এই উজ্জ্বল আলো ছেড়ে, এই আনন্দ ছেড়ে কেউ আবার সেই অন্ধকার ঘরে যায়! তা ছাড়া শিঙা বাজছে। এখনই ষাঁড়ের লড়াই শুরু হবে। এদিক থেকে তার কাকা আর গ্র্যান্ড ইনকুইজিটর অনেক বেশি বিজ্ঞ। তাঁরা অলিন্দের ওপরে এসে তাকে উৎসাহিত করেছেন। সুতরাং সুন্দর মাথায় ঝাঁকানি দিতে দিতে ডন পেড্রোর হাত ধরে সে লম্বা তাঁবুর দিকে এগিয়ে যেতে লাগল। বাগানের শেষ প্রান্তে লাল সিল্ক দিয়ে তৈরি এই তাঁবু। ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েরাও তাদের পিছু পিছু এগিয়ে গেল। যার নাম সবচেয়ে লম্বা সেই চলল তাদের আগে। নামের দৈর্ঘ্যর মাপে নিজেদের শ্রেণিকে সাজিয়ে নিল তারা।
অভিজাত সম্প্রদায়ের একদল ছেলে তার সঙ্গে দেখা করল। তাদের ভেতরে ছিল তিয়েরা-নেভার যুবক কাউন্ট। বয়স তার চোদ্দর কাছাকাছি। অভিজাত সম্প্রদায়ের লাবণ্য আর পূর্ণ মর্যাদার সঙ্গে এগিয়ে এসে সে রাজকুমারীকে অভ্যর্থনা জানাল; তারপরে মাঠে যেখানে হাতির দাঁতের উঁচু চেয়ার বসানো রয়েছে সেইখানে তাকে নিয়ে গেল।
ষাঁড়ের লড়াই যা হল তা সত্যিই অপরূপ! রাজকুমারীর মনে হল পার্মার ডিউক তার বাবার সঙ্গে যখন দেখা করতে এসেছিলেন তখন যে সত্যিকার ষাঁড়ের লড়াই সে দেখেছিল এ লড়াই তার চেয়েও সুন্দর। কয়েকটি বালক বেশ ভালোভাবে সাজানো খেলার ঘোড়ার চারপাশে লম্বা বর্শা নিয়ে ঘোড়ার মতো পা তুলে-তুলে লাফাতে লাগল। আর কয়েকজন পায়ে হেঁটে তাদের লাল আলখাল্লা ষাঁড়ের সামনে দোলাতে শুরু করল। আর সেই ষাঁড় যখন তেড়ে এল তখন তারা বেড়ার এপাশে লাফিয়ে পালিয়ে এল। আর ষাঁড়টাকে দেখতে মনে হচ্ছিল যেন সত্যিকারের একটা ষাঁড়। আসলে সেটা কিন্তু চাঁচ, দরমা, আর কঞ্চি দিয়ে তৈরি ছিল; তার ওপরে চাপা দেওয়া ছিল লম্বা একটা চামড়া। মাঝে-মাঝে পেছনের পায়ে ভর দিয়ে সে যুদ্ধক্ষেত্রে ছুটে বেড়ানোর তাল কষছিল। এভাবে ছোটার কথা সত্যিকার কোনো জীবন্ত ষাঁড় স্বপ্নেও ভাবতে পারত না। আর যুদ্ধও সে কম করল না। ছেলেরা সব গাছের ডালে লাল শালু ওড়াতে-ওড়াতে ব্র্যাভো ব্র্যাভো বলে চেঁচাতে লাগল। মনে হল তারা যেন সত্যিকার বয়স্ক মানুষ। বহুক্ষণ ধরে যুদ্ধ চলল। এরই মধ্যে অনেকগুলি খেলার ঘোড়া শিংয়ের গুঁতো খেয়ে ধরাশায়ী হয়েছে। শেষকালে বিষম রণের পরে তিয়েরা-নেভার কাউন্ট সেই ষাঁড়টাকে হাঁটু মুড়ে বসাল, তারপরে রাজকুমারীর কাছ থেকে চরম আঘাত হানার নির্দেশ পেয়ে সে তার কাঠের তরোয়ালটা ষাঁড়ের ঘাড়ে এমন জোরে ঢুকিয়ে দিল যে ষাঁড়ের মাথাটা আলাদা হয়ে গেল; আর তার ভেতর থেকে হাসতে-হাসতে বেরিয়ে এল মাদ্রিদের ফরাসি রাষ্ট্রদূতের পুত্র মঁসিয়ে দ্য লোরেঁ।
যুদ্ধক্ষেত্র পরিস্কার করার পালা এবার। জমকালো হলদে আর কালো পোশাক পরা দুজন মুরদেশীয় চাকর সেই খেলার মৃত ঘোড়াগুলির দেহ বেশ গম্ভীরভাবে বয়ে নিয়ে গেল বাইরে। তারপরে একটু বিরতি। এরই মধ্যে ফরাসি যাদুকর দড়ির ওপরে হেঁটে বেড়ালো; ইতালির মুখোশ অভিনীত হল। তারা এত সুন্দর আর স্বাভাবিকভাবে অভিনয় করল যে, পালার শেষ রাজকুমারীর চোখ দুটো জলে ভর্তি হয়ে গেল। এমন কি কয়েকটা ছেলেও দুঃখে আর্তনাদ করে উঠলো; তাদের কান্না থামানোর জন্যে শেষ পর্যন্ত তাদের মেঠাই খেতে দিতে হল। আর গ্র্যান্ড ইনকুইডিটর-ও এত অভিভূত হয়ে পড়লেন যে শেষ পর্যন্ত ডন পেড্রোকে তিনি বলতে বাধ্য হলেন–এই সব অভিনেতারা যদিও কাঠ আর রঙিন মোম দিয়ে তৈরি হয়েছে, আর যন্ত্রের সাহায্যে এদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নড়াচড়া করছে তবু এরা যে এত স্বাভাবিকভাবে এদের সুখ-দুঃখ প্রকাশ করছে এ দেখে সত্যিই তিনি মর্মাহত হয়েছেন।
তারপর এল আফ্রিকান যাদুকর। সঙ্গে নিয়ে এল একটা চ্যাপ্টা ঝুড়ি। লাল কাপড় দিয়ে সেটা ঢাকা। বাক্সটাকে জমির মাঝখানে রেখে পাগড়ির ভেতর থেকে অদ্ভুত একটা শরের পাইপ বার করে বাজাতে শুরু করল। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই কাপড়টা সরতে শুরু করল, বাঁশির সুরটা জোরাল হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে দুটো সবুজ আর সোনালি রঙের সাপ তাদের গোঁজের মতো মাথাগুলি বার করে ধীরে ধীরে বেরিয়ে এল; তারপরে বাঁশির তালে-তালে জলের মধ্যে লতার মতো এদিকে-ওদিকে দুলতে লাগল। তাদের সেই চিত্রিত ফণা আর লকলকে জিব দেখে শিশুরা বেশ ভয় পেযে গেল। কিন্তু তারপরেই যাদুকর যখন বালির ভেতর থেকে ফুটফুটে একটা কমলালেবুর গাছ তৈরি করে তাতে ফুল ফোঁটাল আর ফল ধরাল তখন তারা বেশ খুশি হয়ে উঠল। তারপরে যাদুকর মার্কুই দ্য লা টোরে-র বাচ্চা মেয়ের পাখাটা নিয়ে তা থেকে একটা নীল পাখি তৈরি করে ফেলল। সেই পাখিটা তাঁবুর চারপাশে ঘুরে-ঘুরে গান গাইতে লাগল। তাই দেখে শিশুদের আনন্দ আর ধরে না। নুয়েস্ত্রা সেনোরা দল পিলারের গির্জা থেকে কতগুলি নাচিয়ে বালক এসেছিল। তাদের দ্বৈত নাচ বড়োই সুন্দর হয়েছিল। এই নাচ প্রতি বছর মে মাসে ভার্জিনের বেদীর কাছে দেখানো হয়, কিন্তু রাজকুমারী আগে কোনো দিনই সে-নাচ দেখেনি। একজন উন্মাদ পাদরি, অনেকের মতে ইংলন্ডের রানি এলিজাবেথের কাছ থেকে ঘুষ খেয়ে, একবার অ্যাসটুরিয়াস-এর যুবরাজকে খাম জোড়ার সঙ্গে বিষাক্ত গঁদ দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। সেই থেকে স্পেনের রাজবংশের কেউ স্যারাগোসার বিরাট গির্জায় ঢোকেনি। এই নাচের নাম ছিল ‘আওয়ার লেডিস ড্যান্স’। রাজকুমারী লোকমুখে ওই নামটাই কেবল শুনেছিল। এই নাচ সত্যিই বড়ো সুন্দর দেখতে। এই নাচ দেখে রাজকুমারী এতই মুগ্ধ হয়ে পড়েছিল যে প্রতিদানে আওয়ার লেডি অফ পিলারের কাছে বেশ বড়ো একটা মোমের বাতি পাঠাতে কৃতসংকল্প হয়েছিল।
এগিয়ে এল একদল সুন্দর চেহারার ইজিপশিয়ান–যাযাবরদের তখন সবাই ইজিপশিয়ান বলেই চিহ্নিত করত। গোল হয়ে পায়ের উপরে পা তুলে দিয়ে বসে তারা তাদের তারের যন্ত্র তুলে নিল। খাদের সুর উঠল; আর সেই সুরের তালে-তালে দেহগুলিও তাদের দুলতে লাগল। ডন পেড্রোকে দেখেই তারা ভেংচি কাটল; আবার কেউ কেউ ভীষণ ভয় পেয়ে গেল; কারণ কয়েকদিন আগেই এই পেড্রো ডাকিনীবিদ্যার অজুহাতে ওদের দুজনকে খোলা বাজারে ফাঁসি দিয়েছিল। কিন্তু ফুটফুটে রাজকুমারী তার পাখার ওপরে ঝুঁকে যখন তার নীল চোখ দুটি দিয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে রইল তখন তারা বেশ খুশিই হল; কারণ তারা বুঝেছিল নিষ্পাপ সুন্দর মুখ কারও ওপরে কোনোদিন নির্দয় হতে পারে না। তারপরেই হঠাৎ তারা এমনভাবে চিৎকার করে উঠল যে শিশুরা তো ঘাবড়ে গেল, এমনকি ডন পেড্রো পর্যন্ত চমকে উঠে তার কোমরের ছোরাটাকে শক্ত করে ধরলো। সেই গায়করা তখন উন্মত্তের মতো মাঠের মধ্যে নাচানাচি আর জোরাল সুরের তালে-তালে তাদের মাতৃভাষায় বিকৃত সুরে প্রেমের গান গাইতে লাগল। তারপরেই তারা সবাই মাটির ওপরে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল; মনে হল তারা সব মরে গিয়েছে। মৃদু বাজনার তালে-তালে তাদের দেহের মৃদু স্পন্দনগুলি কেবল দেখা গেল। তারপরে তারা সবাই দল বেঁধে বেরিয়ে গেল। কিছুক্ষণ পরেই কটা রঙের লোমশ একটা ভালুককে চেন দিয়ে বেঁধে তারা টানতে-টানতে নিয়ে এল। তার কাঁধের উপরে কয়েকটা ‘বারবারি’ বাঁদর, পরিপূর্ণ গাম্ভীর্যের সঙ্গে ভালুকটা মাথার ওপরে ভর দিয়ে দাঁড়াল; আর বাঁদরগুলি তাদের মনিব দুটি জিপসি ছেলের সঙ্গে নানারকম খেলা দেখাতে লাগল। ছোটো ছোটো তরোয়াল নিয়ে তারা খেলা করল, বন্দুক ছুঁড়ল, আর রাজার সত্যিকার সৈন্যবাহিনীর মতো রীতিমতো কুচকাওয়াজ করল। এক কথায় জিপসিদের খেলা সত্যই বড়ো মনোরম হয়েছিল।
কিন্তু প্রভাতকালীন সমস্ত খেলার মধ্যে বাচ্চা বামনের নাচটাই বোধ হয় সেরা হয়েছিল। বামনটা যখন তার বাঁকানো পা দুটোর ওপরে ভর দিয়ে আর তার বিরাট বিকৃত মাথাটাকে এপাশে-ওপাশে দোলাতে-দোলাতে খেলার মাঠে নামল তখন বাচ্চারা হেসে লুটোপুটি খেতে লাগল; আর খুদে রাজকুমারীও এত হাসতে শুরু করল যে শেষ পর্যন্ত ক্যামেরারাকে বলতে বাধ্য হতে হল যে সমগ্রোত্রীদের কাছে রাজকুমারীর কান্নার নজির স্পেনের ইতিহাসে থাকলেও, যারা নিচুস্তরের মানুষ তাদের কাছে সত্যিকার রাজকুমারীর হাসির নজির আজ পর্যন্ত নেই। কিন্তু বামনের খেলার সত্যিকার কোনো জবাব নেই। এমন কি যে সপ্যানিশ রাজদরবারে সব সময়েই পরিশীলিত বীভৎসতার জন্যে প্রসিদ্ধ ছিল সেখানেও এই জাতীয় অদ্ভুত খুদে দৈত্যকে আর কোনোদিন দেখা যায়নি। আর সবচেয়ে বড়ো কথা হচ্ছে এইটাই তার প্রথম খেলা। মাত্র একদিন আগে একে আবিষ্কার করা হয়েছিল। তখন সে বনের মধ্যে বিপুল বেগে ছুটে বেড়াচ্ছিল। স্পেনের দুজন নোবল শিকারের জমকালো পোশাক পরে সেই বনে গিয়েছিল শিকার করতে। রাজকুমারীকে অবাক করে দেওয়ার জন্যে তারাই তাকে ধরে এলেছিল। তার দরিদ্র বাবাও এইকম অপদার্থ কুৎসিত ছেলেকে বিদায় করে বেঁচেছিল। বোধহয় সবচেয়ে মজার কথা হচ্ছে তার এই অদ্ভুত বিকলাঙ্গের কথা সে নিজেও জানত না। সত্যি কথা বলতে কি এই খেলা দেখিয়ে সে নিজেও বেশ আনন্দ পেযেছিল। শিশুরা যখন হাসছিল, সেও তখন তাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আসছিল। প্রতিটি খেলার শেষে সে তাদের দিকে মাথা নুইয়ে অভিবাদন জানাচ্ছিল। মনে হয়েছিল সে যেন ওদেরই একজন; প্রকৃতি যে অপরকে হাসানোর জন্যে খামখেয়ালির বশে তাকে বিকৃতাঙ্গ করে সৃষ্টি করেছিল সেকথা সে ভাবতেও পারেনি। আর রাজকুমারী তো একেবারে মোহিত হয়ে গিয়েছিল। সেও রাজকুমারীর দিক থেকে তার চোখ দুটো সরাতে পারেনি। তার মনে হয়েছিল কেবল রাজকুমারীর জন্যেই সে নাচবে। রাজকুমারীও শেষকালে কিছুটা রসিকতা আর কিছুটা ক্যামেরারাকে বিরক্ত করার জন্যে তার চুল থেকে একটা গোলাপ খুলে মিষ্টি হেসে তার দিকে ছুঁড়ে দিল। বামনও সব জিনিসটা বেশ আনন্দের সঙ্গেই গ্রহণ করল। গোলাপ ফুলটাকে বিকৃত ঠোঁটের উপরে চেপে একটা হাত সে নিজের বুকের ওপরে রাখল। আনন্দে তার মুখের ওপরে বিকৃত হাসি ফুটে উঠল। চোখ দুটো চকচক করতে লাগল তার।
বামন খেলা শেষ করে ছুটে বেরিয়ে গেল মাঠ থেকে। রাজকুমারী মুষড়ে পড়ে তার কাকাকে বলল–এখনই আবার ওকে খেলা দেখাতে বলুন। কিন্তু ক্যামেরারা তাকে বুঝিয়ে বলল যে, অনেক বেলা হয়ে গিয়েছে। এখন রাজকুমারীর প্রাসাদে ফেরা উচিত। সেখানে তার জন্মদিন মহা সমারোহে উদযাপন করার জন্যে বিরাট ভোজের আয়োজন হয়েছে, তার নিজের হাতে সই করা সত্যিকার জন্মদিনের কেক তৈরি করা হয়েছে। এই সব শুনে রাজকুমারী পরিপূর্ণ মর্যাদার সঙ্গে উঠে প্রাসাদের দিকে এগিয়ে গেল; কিন্তু যাওয়ার আগে নির্দেশ দিয়ে গেল যে মধ্যাহ্ন ভোজনের বিরতির পরে আবার সেই বামনকে খেলা দেখাতে হবে। যাওয়ার আগে টিমেরা-নেভার কাউন্টকেও তার অপূর্ব অভ্যর্থনার জন্যে সে ধন্যবাদ জানাল। তার পিছুপিছু ছেলেমেয়েরাও ফিরে গেল–ঠিক যেভাবে তারা পরপর এসেছিল ঠিক সেইভাবেই ফিরল তারা।
খুদে বামন যখন শুনল রাজকুমারীর বিশেষ ইচ্ছাতেই আবার তাকে তার কাছে নাচতে হবে তখন সে আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠল। দৌড়ে বাগানের মধ্যে বেরিয়ে গেল সে। সেইখানে সেই সাদা গোলাপটা নিয়ে হাস্যকর একটা আনন্দে চুমু খেতে লাগল। তার আনন্দ বাইরে প্রকাশ করতে লাগল একটা বিকৃত অঙ্গভঙ্গির ভেতর দিয়ে।
দৈত্যের মতো তাকে বাগানে ঘুরে বেড়াতে দেখে ফুলেরা ভীষণ বিরক্ত হল।
টিউলিপ ফুলেরা বলল–লোকটা এতই কুৎসিত যে আমরা যেখানে থাকি সেখানে ওকে খেলা করতে দেওয়া উচিত নয়।
লাল টকটকে লিলিরা তো চটে লাল, তারা বেশ উষ্মার সঙ্গে বলল–আফিঙের জল খেয়ে লোকটার হাজার বছর ঘুমানো উচিত।
কান্নার সুরে ক্যাকটাস বলল–লোকটা একেবারে মূর্তিমান আতঙ্ক–যাকে বলে একেবারে অষ্টবক্র। আর ওর মাথাটা কী বিরাট দেখেছ? ও দে পায়ের ওপরে অত বড়ো মাথাট কী বেখাপ্পাই না দেখাচ্ছে! ওকে দেখেই আমার সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে। ও যদি আমার কাছে আসে তাহলে ও গায়ে আমার কাঁটা দিয়ে এমন ফুটিয়ে দেব না!
সাদা গোলাপ-গাছটা বলল–সত্যি বলতে কি ও আমার সেরা ফুলটা নিয়ে নিয়েছে। আজ সকালে রাজকুমারীকে আমি ওটা নিজেই দিয়েছিলাম তাঁর জন্মদিনের উপহার হিসাবে ও তাঁর কাছ থেকে ফুলটা চুরি করে নিয়েছে। এই বলেই সে চিৎকার করে উঠল–চোর!চোর!
চরিত্রের দিক থেকে লাল জিরেনিয়াম ফুলগুলি সাধারণত বেশ নম্র। ফুলের জগতে তার অনেক দরিদ্র আত্মীয়-স্বজন রয়েছে। তারাও তাকে দেখে বিরক্তিতে কেমন যেন কুঁকড়ে গেল। ভাযলেট চুলেরা বেশ নম্রভাবেই মন্তব্য করল: লোকটা খুবই সাদাসিধে মলে, সাদাসিধে না হয়ে ও পারে না। তবু তারা বেশ বিজ্ঞভাবেই বলল যে ওটাই ওর সত্যিকারের ত্রুটি; এবং রোগটাকে সারানো যায় না বলে মানুষকে প্রশংসা কেন করা হবে সে বিষয়ে তারা বেশ। যুৎসই একটা যুক্তি খুঁজে পেল না। এমন কি তারা একথা বলতেও দ্বিধা করল না যে ওই খুদে। বামনটা তার কুৎসিত রূপটাকে নিয়ে বড়ো বেশিই বাড়াবাড়ি করছে, তার উচিত ছিল কিছুটা দুঃখ করা; অন্তত কিছুটা বিষণ্ণ হওয়া। তা না করে হতভাগাটা বিপুল আনন্দে লাফালাফি দাপাদাপি করে বেড়াচ্ছে।
ওদের মধ্যে সূর্য-ঘড়িটাই বোধ হয় সবচেয়ে বিশিষ্ট বস্তু। সম্রাট পঞ্চম চার্লস-এর মতো মানুষকেও সে সময় বলে দিতে পেরেছিল। ওই খুদে বামনের চেহারা তাকেও কেমন যেন ঘাবড়ে দিয়েছিল। ফলে ছায়ার আঙুল দিয়ে পুরো দুটি মিনিট সময় নির্ধারণ করতে সে ভুলে গিয়েছিল। রেলিঙের ধারে দুধের মতো সাদা যে ময়ূরটা রোদ পোহাচ্ছিল তাকে লক্ষ করে। তাই সে না বলে পারল না–সবাই ডালে রাজার ছেলে রাজাই; আর কয়লা কুড়ানির ছেলে কয়লা কুড়ানিই। এর ব্যাতিক্রম কিছু রয়েছে এটা চিন্তা করাই হাস্যকর। এই মন্তব্যের সঙ্গে ময়ূরও একমত, তাই সে চিৎকার করে বলল–নিশ্চয়, নিশ্চয়। তার সেই কাংস ক্রেংকার ধ্বনি। শুনে ঠান্ডা ঝরনার জলে যে সমস্ত সোনালি মা-এর দল জলকেলি করছিল তারা হঠাৎ ভ্য পেয়ে চমকে উঠে জলের ওপরে মাথা তুলে বিরাট বিরাট পাথরের মূর্তিগুলিকে জিজ্ঞাসা করল–পৃথিবীকে কী ঘটছে বল তো? এত হইচই কেন?
যাই হোক, পাখিরা কিন্তু তাকে বেশ পছন্দ করত। বনের ঝরা পাতার পেছনে-পেছনে বনপরীরদের মতো ছুটতে তারা তাকে দেখেছে অথবা প্রাচীন ওক গাছের কোটরে যুঁড়ি দিয়ে শুয়ে কাঠবিড়ালির সঙ্গে ভাগ করে সে বাদাম খাচ্ছে এ-দৃশ্যও অনেকবার তাদের চোখে পড়েছে। ও যে একটু কুৎসিত তার জন্যে তাদের কোনো অভিযোগ নেই। এমন কি অমন যে নাইটিংগেল পাখি যার মিষ্টি গান শোনার জন্যে মাঝে-মাঝে কমলালেবুর ঝোপের মধ্যে চাঁদও ঝুঁকে পড়ে, সেই বা কী এমন আহামরি দেখতে! তা ছাড়া, মনটাও ওর বড়ো উদার। কড়া শীতের দিনগুলিতে যখন বনের মধ্যে বেরি ফল দুপ্রাপ্য হয়ে ওঠে, মাটি লোহার মতো শক্ত বরফে ভরে যায়, এমন কি খাবারের সন্ধানে বুলো ভালুকগুলো পর্যন্ত শহরের দরজায়। এসে উপস্থিত হয়–সেই সময়েও ও একবারও তাদের কথা ভোলেনি; নিজের সামান্য খাবার তাদের ভাগ করে দিয়েছে।
সেই জন্যে তারা তার চারপাশে ঘুরে-ঘুরে উড়তে লাগল; ওড়ার সময় তাদের পাখা দিয়ে তার গলাটা সপর্শ করে গেল। এই দেখে বামন খুব খুশি। সে তাদের সেই সাদা গোলাপটা দেখিয়ে বলতে লাগল–দেখ, দেখ। এটা আমাকে রাজকুমারী উপহার দিয়েছে। কারণ, রাজকুমারী তাকে ভালোবাসে।
তার কথার বিন্দুবিসর্গ তারা বুঝতে পারল না, কিন্তু তাতে কিছু আসে-যায় না। তারা ঘাড়গুলিকে একদিকে ঘুরিয়ে বিজ্ঞের মতো বসে রইল। কোনো কিছু বোঝার ওইটাই একমাত্র প্রশস্ততম আর সহজতম পথ
এমন কি টিকটিকিগুলিও তাকে বেশ পছন্দ করত। কারণ ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে সে যখন ঘাসের ওপরে গড়াগড়ি দিত তখন তারা তার গায়ের ওপরে লাফালাফি করত। তারা বলাবলি করত–অবশ্য টিকটিকির মতো সুন্দর প্রাণী সবাই হতে পারে না–সেকথা চিন্তা করাও বাতুলতা। আর যদিও বলতে বেশ অদ্ভুত-ই লাগছে তবু একথা সত্যি যে লোকে ওকে যতটা কুৎসিত মনে করে ও ততটা কুৎসিত নয়। শুধু চোখ দুটো তোমার বন্ধ করে রাখ ওর দিকে তাকিয়ো না। তাহলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। চরিত্রের দিক থেকে টিকটিকিরা। প্রথম শ্রেণির দার্শনিক। যখন করার কিছু না থাকে, অথবা বৃষ্টির দিনে যখন বাইরে বেরোনো। যায় না তখন তারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে চুপচাপ বসে থেকে চিন্তা করে যায়।
ওদের চালচলন আর ব্যবহারে ফুলেরা বড়োই বিষুব্ধ হয়ে উঠল। নিজেদের মধ্যে তারা বলাবলি করতে লাগল-রাতদিন এই রকম ফল-ফস করে, হইচই করে উড়ে বেড়ানোর ফলটা কী বিষময় দেখ। সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিরা আমাদের মতো চিরকাল একই জায়গায় বসে থাকে। লাফিয়ে লাফিয়ে চলতে অথবা ফড়িং-এর পেছনে ঘাসের ভেতর দিয়ে দৌড়ে বেড়াতে কেউ কি আমাদের কখনো দেখেছে? হাওয়া পরিবর্তনের প্রয়োডন বুঝলে আমরা বাগানের মালিকে সংবাদ পাঠাই। সে অন্য বিছানায় আমাদের বয়ে নিয়ে যায়। আমরা যে সম্ভ্রান্ত শ্রেণির এটা থেকেই তা প্রমাণিত হয় এবং তাই হওয়া উচিত। কিন্তু পাখপহষ্কী আর টিকটিকি-গিরগিটিদের বিশ্রাম করার যে প্রয়োজনীয়তা রয়েছে সে বিষয়ে কোন জ্ঞান নেই। আর সত্যি কথা বলতে কি পাখিদের স্থায়ী কোনো ঘরবাড়িও নেই। তারা জিপসিদের মতোই ভবঘুরে। তাদের ঠিক সেই ভাবেই দেখা উচিত।
এই বলেই উদ্ধত ভঙ্গিতে নাক উঁচিয়ে দিল তারা। কিছুক্ষণ পরে বামন যখন ঘাস থেকে উঠে প্রাসাদের অলিন্দের দিকে এগিয়ে গেল তখন তারা খুব খুশি হয়ে উঠল। তারা। বলল–যাবজ্জীবন ঘরের মধ্যে ওকে বন্দী করে রাখা উচিত। পিঠের ওপরে কুঁজ আর বাঁকা। পাগুলির দিকে ওর একবার তাকিয়ে দেখ-রামশ্চন্দ্র, রামশ্চন্ত্র।
কিন্তু বামনটি এত সব কথার কিছুই জানতে পারল না। পাখি আর টিকটিকিদের সে খুবই ভালোবাসত। তার কাছে ফুলগুলি ছিল বিশ্বের অপরূপ সুন্দর–অবশ্য এক রাজকুমারী ছাড়া। সে তাকে সেই সুন্দর লাল গোলাপটি দিয়েছে এবং সে তাকে ভালোবাসে। এটাই তো সবচেয়ে বড়ো কথা রাজকুমারীর কাছে ফিরে গেলে কতই না খুশি হত সে। ডান হাতের ওপরে তাকে বসিয়ে রাজকুমারী তার দিকে চেয়ে হাসত। সে তাহলে রাজকুমারীকে তার খেলার সঙ্গী করে নিতে পারত, অনেক অদ্ভুত অদ্ভুত খেলা শেখাতে পারত তাকে। কারণ এর
আগে যদিও সে কোনোদিন প্রাসাদে আসেলি তাহলেও সে অনেক বিস্ময়কর কাজ করতে জানে। ফড়িংরা যাতে গান করতে পারে সেই জন্যে শরগাছ দিয়ে সে বেশ ছোটো ছোটো খাঁচা তৈরি করতে পারে। তৈরি করতে পারে তললা বাঁশের বাঁশি। সে প্রতিটি পাখিরই ডাক জানে; আর নানা জায়গা থেকে নানা পাখির স্বর নকল করে তাদের ডাকতে পারে। ঋতুর পরিবর্তনে অরণ্যভূমিতে যে সব বিভিন্ন নাচ শুরু হয় তার সব কাটাই তার মুখস্থা বুনো পায়রা কোথায় বাসা বাঁধে তাও তার অজানা নয়। একবার একটা ব্যাধ দুটো পায়রাকে জাল পেতে ধরে নিয়ে গেল। তাদের বাচ্চাগুলোর কী দুর্দশা! সে তাদের নিয়ে এসে একটা বাসা তৈরি করে দিল। তারা বেশ পোষ মেনে গিয়েছিল। প্রতিদিন সকালে তারা তার হাত থেকে খাবার। খেয়ে যেত। রাজকুমারীরও ভালো লাগবে তাদের। ভালো লাগবে কাঁটার মতো লম্বা। ঠোঁটওয়ালা ডে পাখিদের, বন্য শুয়োর আর বিত্ত মন্থরগতি কচ্ছপদের যারা বনের মধ্যে ঘাড় দুলিযে-দুলিয়ে হাঁটে আর কচি-কচি পাতা ঠুকরে-ঠুকরে খায়। নিশ্চয়, বনের মধ্যে গিয়ে তার সঙ্গে খেলতে তাকে হবেই। সে তাকে তার ছোট্ট বিছানার একপাশে শুতে দেবে। যাতে কোনো বন্য ডানোয়ার তার বিছানার কাছে আসতে না পারে সেই জন্যে সারারাত জেগে সে পাহারা দেবে। সকাল হলে সে তাকে ভাগাবে; তারপর সারাদিন দুজনে তারা বনের মধ্যে নেচে নেচে বেড়াবে। মাঝে মাঝে সাদা খচ্চরের উপরে চড়ে পাদরি বই পড়তে পড়তে সেদিকে আসবে, আর আসবে জমকালো পোশাক পরা শিকারির দল। মদ তৈরি করার সময় আঙুর। ফলের ব্যবসাদাররা আসবে, হাত-পা তাদের লাল রঙে মাখা; কাঁধের ওপরে ভিস্তি, সেই ভিস্তি থেকে চুইযে গড়িয়ে পড়বে মদের ফোঁটা। বনবাসীরা বনের মধ্যে চারকোল পোড়াবে; ডাকাতরা গুহা থেকে বেরিয়ে তাদের অব লুটপাট করে নিয়ে যাবে। সত্যি সত্যিই বনের মধ্যে দেখার অনেক জিনিস রয়েছে। সেই সব দেখে যখন সে ক্লান্ত হয়ে পড়বে তখন সে তাকে ভলার ধারে নিয়ে যাবে। যদিও সে লম্বা নয় তবুও যে সে শক্তিমান একথা সে জানে। লাল বেরির হার গড়িয়ে দেবে সে। আজ রাজকুমারী তার পোশাকের ওপরে যে সাদা বেরির। হার পরেছিল তারই মতো সুন্দর দেখাবে লাল বেরি। সে সবও যখন রাজকুমারীর আর ভালো লাগবে না তখন সে তার জন্যে অন্য ব্যবস্থা করবে।
কিন্তু রাজকুমারী বর্তমানে কোথায়? সাদা গোলাপকে জিজ্ঞাসা করল। সে কিন্তু কোনো উত্তর পেল না। সারা প্রাসাদটাই যেন ঘুমোচ্ছে। এমন কি যে সব জানালা খোলা ছিল তাদের। ওপরেও ঝুলছিল বেশ মোটা পর্দা। ভেতরে ঢোকার একটা কিছু রাস্তা বার করার জন্যে সে প্রাসাদের চারপাশে ঘুরে বেড়াতে লাগল। অবশেষে সে দেখতে পাল ছোটো একটা খিড়কির দরজা খোলা রয়েছে। ঢুকতেই সে চমৎকার বেশ বড়ো একটা ঘরের ভেতরে হাজির হল। তার ভয় হল ঘরটা বনের চেয়েও অনেক বেশি সুন্দর। কারণ দেওয়ালে তার নকশা-কাটা; আর মেঝেটাও রঙিন পাথর দিয়ে মাডা একরকম ভ্যামিতিক পদ্ধতিতে সেগুলি গাঁথা। কিন্তু খুদে রাজকুমারী সেখানে নেই। রয়েছে কেবল উঁচু বেদীর ওপরে কয়েকটি মূর্তি বিষণ্ণ উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি দিয়ে আর অদ্ভুত রকমের হাসি হেসে তারা তার দিকে অবজ্ঞার দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে।
ওই ঘরেরই শেষ প্রান্তে আর একখানা ঘর নকশা করা কালো ভেলভেটের পর্দা ঝুলছে সেখানে। রাজকুমারী কি ওরই পেছনে লুকিয়ে রয়েছে? অন্তত চেষ্টা করে দেখতে দোষটা কী? এই বলে সে নিঃশব্দে এগিয়ে গেল। পর্দাটাকে টেনে সরিয়ে দিল একপাশে। না, ওখানে কেউ নেই। রয়েছে একখানা ঘর। সেটা আগের ঘরের চেয়েও সুন্দর। আগে এই ঘরটা ব্যবহার। করতেন জাঁলিফো। সবাই তাঁকে পাগলা রাজা বলে ডাকতা শিকার করতে তিনি এতই ভালোবাসতেন যে ঘুমোতে-ঘুমোতেও তিনি চিৎকার করে উঠতেন। এখন এটা মন্ত্রণাকক্ষ হিসাবে ব্যবহৃত হয়।
অবাক চোখে আমাদের খুদে বামনটি চারপাশে তাকাতে লাগল। আর এগোতে তার সাহস হল না। কিন্তু সেই সুন্দরী রাজকুমারীর কথা ভেবে তার বুকে বল এল। সে তো কেবল তাকেই চায়। সে যে তাকে কত ভালোবাসে সেই কথাটাই তো সে তাকে জানাতে চায়। সম্ভবত রাজকুমারী তার পাশের ঘরেই রয়েছে।
সেই নরম মোটা কার্পেট পেরিয়ে সে ছুটে গেল সামনে; দরজা খুলল, না! সেখানেও সে নেই। ঘর খালি। সেখানে রয়েছে কেবল একটা সিংহাসন। এখানে আগে রাজা বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের অভ্যর্থনা জানাতেন। এখন আর বেশি রাষ্ট্রদূত আসে না। তাই রাজা এখানে পরিচিতদের দর্শন দেন। ইংলন্ডের রানির সঙ্গে স্পেনের যুবরাজের বিয়ের সম্বন্ধ করতে এই ঘরেই অনেক বছর আগে একদন ইংলন্ড থেকে দূত এসেছিল। নানা ঐশ্বর্য আর রম্য স্মৃতির চিহ্ন দিয়ে এই ঘরটি সাজানো। কিন্তু খুদে বামনটির এসব দিকে বিশেষ লক্ষ বা আকর্ষণ ছিল না। সে চেয়েছিল তাঁবুতে রাজকুমারী যাওয়ার আগে তার সঙ্গে একবার দেখা করতে এবং নাচের। শেষে তার সঙ্গে বনে চলে যাওয়ার কথা বলতে। প্রাসাদে বাতাস বড়ো ভারী; কিন্তু অরণ্যে হওয়া মুক্তা প্রভাতের সোনালি রোদ সারা বনের ওপরে সোনার রঙে রাঙিয়ে দেয়। নিশ্চয়। তার সঙ্গে দেখা হলে সে তাকে নিয়ে যাবেই। এই ভেবেই তার মুখের ওপরে হাসি ফুটে উঠল। পরের ঘরে সে ঢুকে গেল।
এতক্ষণ যতগুলি ঘর সে দেখেছে তাদের মধ্যে এই ঘরটিই সবচেয়ে সুন্দর আর উজ্জ্বল। নানা বর্ণে চিত্রিত দেওয়াল আসবাবপত্রগুলি ভারী-ভারী রুপোর তৈরি। বিরাট-বিরাট দুটো চুল্লির মাঝখালে বিরাট পর্দা ঝুলছে। সেই পর্দার ওপরে টি আর ময়ূরের ছবি। মেঝেটা সমুদ্রের মতো সবুজ ওনিক্স পাথর দিয়ে মোড়া। সেই চকচকে মেঝেটা অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত। হঠাৎ সে লক্ষ করল ঘরে সে একা নেই। দরজার সামনে যে ছায়া পড়েছে তারই আড়ালে দাঁড়িয়ে বেঁটে চেহারার একটা লোক তাকে লক্ষ করছে। তার বুকটা দুরুদুরু করে কেঁপে উঠল; তার ঠোঁটের ভেতর থেকে আনন্দের ধ্বনি ফুটে বেরোল। সে রোদের মধ্যে এসে দাঁড়াল। সে বেরিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে স্পষ্ট লক্ষ করল সেই মূর্তিটাও বেরিয়ে এসেছে।
রাজকুমারী! না, না। এ একটা রাক্ষস। এরকম কিম্ভুতকিমাকার দৈত্য জীবনে সে আর কোনোদিন দেখেনি। অন্য সব মানুষের মতো তার দেহ পুষ্ট নয়; তার পিঠের ওপরে বিরাট একটা কুঁজ; তার পাগুলো বাঁকা; মাথার ওপরে বিরাট বিসদৃশ মাথা; আর টিকিতে একঝাঁক কালো চুল। তাই দেখে আমাদের বামনটি বিষ্ণায় তার ভুরু কোঁচকাল; দৈত্যটাও তার দিকে তাকিয়ে ভুরু কোঁচকাল তার। সে হাসল, তাই দেখে মূর্তিটা হাসল। সে দু’পাশে হাত দুটো ছড়িয়ে দিল। সেই দৈত্যটাও অনুকরণ করল তাকে। সে মুখ ভেঙল, দৈত্যটাও তাকে ঠিক একই ভাবে মুখ ভেঙাল। সে তার দিকে এগিয়ে গেল, দৈত্যটাও এগিয়ে এল তার দিকে।
বামনটি যে কটা পা এগোল, দৈত্যটাও গুণে-গুণে সেই কটা পাই এগোল। সে থামল, দৈত্যটাও থেমে গেল। আনন্দে চিৎকার করে দৌড়ে গিয়ে তাকে ধরার জন্যে সে হাত বাড়াল। দৈত্যটাও তার হাতটা ধরলা একেবারে ঠান্ডা কনকনে হাতা ভয় পেয়ে সে তার হাতটা সরিয়ে নিল, দৈত্যটাও সরিয়ে নিল তার হাত। সে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল, কিন্তু শক্ত আর মসৃণ একটা জিনিস তাকে বাধা দিল। দৈত্যের মুখটা একেবারে তার মুখের ওপরে এসে পড়েছে। ভয়ে সে। কাঁপতে লাগল। চোখের ওপর থেকে হাতে করে সে তার চুলগুলি সরিয়ে দিল। দৈত্যটাও তাকে অনুকরণ করল। সে দৈত্যটাকে থাপ্পড় মারল, দৈত্যটাও থাপ্পড় মারল তাকে। সে পিছু হটে এল-দৈত্যটাও পিছিয়ে গেল।
কী ওঠা? এক মুহূর্ত চিন্তা করে সে ঘরের চারপাশে তাকাল। কী অদ্ভুত ব্যাপার! সেই অদৃশ্য পরিচ্ছন্ন জলস্তম্ভের মধ্যে ঘরের প্রতিটি জিনিসই প্রতিবিম্বিত হয়েছে। হ্যাঁ, প্রতিটি জিনিসেরই প্রতিফলন পড়েছে–প্রতিটি জিনিসেরই।
এটা কী তাহলে প্রতিধ্বনি? একবার পাহাড়ি উপত্যকায় সে এই প্রতিধ্বনিকে ডেকেছিল–প্রতিধ্বনি তার প্রতিটি কথারই উত্তর দিয়েছিল। মানুষের স্বরের মতো তার দেহটাকেও কি সে ব্যঙ্গ করতে পারে? এটা কি তাহলে?
সে চমকে উঠল। বুকের ওপর থেকে শ্বেত গোলাপটা তুলে নিয়ে চম খেলা দৈত্যটারও লিডের একটা গোলাপ ছিল। পাপড়িতে-পাপড়িতে একেবারে একা সেও সেই রকম চুমু খেল, আর বীভৎস অঙ্গভঙ্গি সহকারে ফুলটাকে সে নিজের বুকের ওপরে চেপে ধরল।
সত্যটা বোঝার সঙ্গে সঙ্গে নৈরাশ্যের একটা বিরাট আর্তনাদ করে সে মাটির ওপরে লুটিয়ে পড়ে ফোঁপাতে লাগল। তাহলে সে নিজেই এই রকম বীভৎস আর বিকলাঙ্গ? তার পিঠের ওপরেই কুজ রয়েছে দেখতে সেই কিম্ভুতকিমাকার! সে নিজেই তাহলে দৈত্য; আর তবে দেখেই তাহলে ছেলেমেয়েরা ওইরকম হাসছিল। আর সেই রাজকুমারী! সে মনে করেছিল রাজকুমারী তাকে ভালোবাসে কিন্তু সে-ও তো তাহলে তাকে ব্যঙ্গ করেই হাসছিল। তার সেই বিকৃত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দেখে রসিকতা করছিল! তারা তাকে বলেই রেখে এল না কেন? বলে তো কোনো আয়না নেই। তার বাবা তাকে মেরে না ফেলে তাকে এইভাবে বিক্রি করে দিল। কেন? তার চোখ দুটো গরম জলে ভরে উঠল। শ্বেত গোলাপটিকে সে ছিঁড়ে ফেলল টুকরো টুকরো করে, দৈত্যটাও ঠিক সেই রকম পাপডিগুলো একটা একটা করে ছিঁড়ে মেঝের ওপরে ছড়িয়ে দিল। পাচ্ছে তার সঙ্গে আবার দেখা হয়ে যায় এই ভযে চোখে হাত চাপা দিয়ে আহত, পশুর মতো ছায়ার দিকে গুঁড়ি দিয়ে সে এগিয়ে গেল, তারপরে ফোঁপাতে লাগল।
ঠিক সেই মুহূর্তে মুক্ত গবাক্ষ দিয়ে দলবল নিয়ে রাজকুমারী সেইখানে এসে হাজির হল। তারা দেখল সেই কুৎসিত খুদে বামনটি মেঝেতে শুয়ে খুব জোরে জোরে আর বিস্ময়কর ভাবে মেঝের ওপর ক্রমাগত ঘুষি মেরে চলেছে। এই দেখে তারা সব আনন্দে হো-হো কর হেসে উঠল। তারপরে তার চারপাশে ঘিরে দাঁড়িয়ে তার খেলা দেখতে লাগল।
রাজকুমারী বলল–কী হাসির নাচ দেখ! কিন্তু ওর অভিনয় আরো হাসির। ওকে দেখলে ঠিক মনে হবে ও যেন একটা পাপেট; তবে ঠিক পাপেট-এর মতো স্বাভাবিক নয়।
এই বলে তার সেই পাখাটা হাওয়া খাওয়ার ভঙ্গিতে লাডিযে সে হাততালি দিল।
কিন্তু সেই খুদে বামনটি ওপরের দিকে তার মুখ আর তুলল না। তার ফোঁপানি ধীরে ধীরে মৃদু থেকে মৃদুতর হয়ে এল। তারপরে সে একটা অদ্ভুত রকম মূখব্যাদান করে নিজের দেহটাকে হাত দিয়ে জাপটে ধরল; আবার সে পড়ে গেল তারপরে সব চুপচাপা।
একটু থেমেই চিৎকার করে উঠল রাজকুমারী-বহুত আচ্ছা। কিন্তু এখন তো তোমাকে নাচতে হবে।
শিশুরা চিৎকার করে সমর্থন জানাল তাকে–হ্যাঁ, নিশ্চয়। ওঠ নাচবে চল। কারণ বারবারি বাঁদরের মতোই তুমি চতুর এবং বেশি হাস্যকর।
কিন্তু কোনো উত্তর এল না খুদে বামনটির কাছ থেকে।
রাগে গরগর করেত-করতে রাজকুমারী মাটিতে পা ঠকতে লাগল। এমন সময় চ্যামবারলেনের সঙ্গে মেকসিকো থেকে আসা নতুন সংবাদ পড়তে-পড়তে তার কাকা অলিন্দের উপর পায়চারি করছিল। সেইখানেই সেশনের ‘হোলি অফিস’ সম্প্রতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। রাজকুমারী তার কাকাকে ডেকে বলল–আমার এই আমুদে বামনটা রাগ করে ঘুমোচ্ছে। আপনি ওকে তুলে দিয়ে আমার জন্যে নাচতে বলুন।
তারা নিজেদের মধ্যে একটু হাসাহাসি করল। তারপরে ঝুঁকে পড়ে তাঁর কারুশিল্প খচিত দস্তানা দিয়ে ডন পেড্রো তার গালে বিরাট একটা চড় কষিয়ে দিলেন–ওঠ; বেটা ওঠ। স্পেনের আর ইনডিস-এর রাজকুমারী তোর নাচ দেখতে চান। তোকে নাচতে হবে, বীভৎস জানোয়ার।
কিন্তু খুদে বামনটির কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না।
ডন পেড্রো ক্লান্তভাবে বললেন–চাবুক মাস্টারকে সংবাদ দিতে হবে।’ এই বলে তিনি অলিন্দের দিকে বেরিয়ে গেলেন। কিন্তু চ্যামবারলেনকে বেশ গম্ভীর দেখা গেল। সে বামনটির পাশে হাঁটু মুড়ে বসল এবং তার বুকের উপরে হাতটা রাখল। কয়েক মুহূর্ত পরে কাঁধটা কুঁচকে সে দাঁড়িয়ে উঠে রাজকুমারীর সামনে মাথাটা একটু নুইয়ে বলল–আমার সুন্দরী রাজকুমারী, আপনার এই আমুদে বামনটি আর কোনোদিনই নাচবে না। রাজাকে হাসানোর মতো সে যে এতটা কুৎসিত হয়ে জন্মেছে এইটাই খুব দুঃখের কথা।
হাসতে-হাসতে রাজকুমারী জিজ্ঞাসা করল–কিন্তু ও আর নাচবে না কেন?
কারণ, তার হৃদয়টা ভেঙে গিয়েছে উত্তর দিল চ্যামবারলেন।
এই শুনে রাজকুমারী ভ্রূকুটি করল; তার সেই গোলাপের পাপড়ির মতো ওষ্ঠ-যুগল ঘৃণায় বিকৃত হয়ে উঠল। সে চিৎকার করে বলল–যার হৃদ্য আছে ভবিষ্যতে সে যেন আমার সঙ্গে খেলতে না আসে।
এই বলেই সে দৌড়ে বাগানের দিকে চলে গেল।