ধীবর আর তার আত্মা

ধীবর আর তার আত্মা
The Fisherman and his soul

প্রতিদিন সন্ধ্যায় যুবক ধীবরটি সমুদ্রে বেরিয়ে গিয়ে ভাল, ফেলত। উপকূলভাগ থেকে বাতাস বইলে তার জালে কোনো মাছই পড়ত না পড়লেও, তা সামান্য। কারণ সে-বাতাস ঠাণ্ডা, ঝড়ো। ঢেউগুলো ফুলে ফেঁপে সেই বাতাসের সঙ্গে মল্লযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ত। কিন্তু সমুদ্র থেকে উপকূলের দিকে যখন বাতাস বইত তখনই মাছের দল ঝাঁক বেঁধে দূর-দূরান্ত থেকে এসে তার ভালের মধ্যে ঢুকত। সেই সব মাছ বাজারে নিয়ে গিয়ে সে বিক্রি করত।

প্রতিদিন সন্ধ্যার সময়েই একভাবে সে সমুদ্রে ভাসত; একদিন জালটা এত ভারী হয়ে উঠল যে সে কিছুতেই সেটাকে টেনে নৌকোর ওপরে তুলতে পারল না। নিজের মনে হেসে সে বলল–নিশ্চয় ডালে অনেক মাছ পড়েছে। অথবা, কোনো সামুদ্রিক দৈত্য ধরা পড়েছে যাকে দেখে মানুষ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকবে, বা, এমন কোনো বীভৎস ভয়ঙ্কর প্রাণী ধরা পড়েছে যাকে আমাদের মহিমমযী মহারানি পেলে খুশি হবেন। এই বলে সে প্রাণপণ শক্তিতে জালে টান দিলা ধীরে ধীরে জলের ফতনাগুলে ভেসে উঠল; তারও বেশ কিছু পরে ভালটা নৌকোর ধারে উঠে এল।

কিন্তু জালে না রয়েছে মাছ, আর না রয়েছে কোনো সামুদ্রিক দৈত্য। রয়েছে ঘুমন্ত খুদে একটি জল-অপ্সরী। তার চুলগুলি ভেডয় সোনার পশমের মতো–এক একটি চুল যেন কাঁচের গ্লাসে রাখা সোনার সুতো। তার দেহটা হাতির দাঁতের মতো সাদা; তার ন্যাজটা রুপো আর মুক্তো। দিয়ে তৈরি। সমুদ্রের সবুজ আগাছাগুলি তার দেহটিকে বেষ্টন করে রয়েছে। তার কান দুটি সামুদ্রিক ঝিনুকের মতো; প্রবালের মতো রাঙা তার দুটি ঠোঁটা শীতল ঢেউগুলি তার নিরুত্তাপ কুচযুগলের ওপরে গড়িয়ে পড়ছে, তার চোখের পাতায় নুন পড়ে চিকচিক করছে। অপ্সরীটি এত সুন্দরী যে যুবক জেলেটি তার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। হাত দুটো বাড়িয়ে ভালটাকে সে তার কাছে টেলে নিল; তারপরে ঝুঁকে পড়ে দু’হাতে জাপটে ধরল। তাকে। তাকে সপর্শ করতেই সি-গালের মতো সে চমকে উঠে চিৎকার করে জেগে উঠল। তারপরে ফিকে লাল পদ্মরাগ মণির মতো চোখ দিয়ে ভ্যার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল তার। দিকে। পালিয়ে যাওয়ার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা করল সে; কিন্তু ছেলেটি কিছুতেই তাকে ছেড়ে দিল না। জোর করে জাপটে ধরে রাখল।

ছেলেটির আলিঙ্গণ থেকে মুক্তি পাওয়ার কোনো আশা নেই বুঝতে পেরে অপ্তরীটি কাঁদতে কাঁদতে বলল–দোহাই তোমার আমাকে ছেড়ে দাও; কারণ নিঃসঙ্গ বৃদ্ধ রাজার আমিই একমাত্র সন্তান।

কিন্তু ছেলেটি বলল–একটিমাত্র শর্তে তোমাকে আমি ছেড়ে দিতে পারি। সেটি হচ্ছে এই যে

যখনই আমি তোমাকে ডাকব তখনই তোমাকে আমার কাছে এসে গান গাইতে হবে। সেই গান শুনে ঝাঁকে ঝাঁকে মাছ এসে হাজির হবে। তাহলেই আমার ডাল মাছে বোঝাই হয়ে। যাবে।

অপ্সরীটি কাঁদতে কাঁদতে বলল–আমি যদি তোমার কথামতো কাজ করব বলে প্রতিজ্ঞা করি তাহলেই কি তুমি আমাকে ছেড়ে দেবে?

নিশ্চয় ছেড়ে দেব।

জল-অপ্সরীটি প্রতিজ্ঞা করতেই সে তার বাহুবন্ধন শিথিল করল। একটা অদ্ভুত ভয়ে কাঁপতে। কাঁপতে অঙ্গরীটি জলের মধ্যে ডুবে গেল।

প্রতিদিন সন্ধ্যায় যুবকটি সমুদ্রের বুকে গিয়ে অপ্সরীকে ডাকত, আর অগ্ধরীটি ভাল থেকে উঠে এসে তাকে গান শোনাত। সেই গান শুনে শুশুকের দল তার চারপাশে ভেসে বেড়াত। আর বন্য সি-গালের দল তার মাথার ওপরে চক্রাকারে বেড়াত উড়ে। কারণ তার গানগুলি বড়ো সুন্দর। এক গুহা থেকে আর এক গুহায় যারা মেষ চরিয়ে বেড়ায় সেই সব উপকুলবর্তী যাযাবরদের গান সে গাইত; লম্বা সবুজ দাড়িওয়ালা লোমশব ট্রিটনদের গান সে গাইত, সবুজ পাথর দিয়ে তৈরি রাজপ্রাসাদ, যার ছাদ হচ্ছে লাল পাথরের-তার গান সে গাইত। সে গান গাইত সমুদ্রের বাগানের–যেখানে সারাদিন প্রবালের ঢেউ খেলা করে, রুপালি পাখির মতো মাছেরা দৌড়ে বেড়ায় এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত–যার পাহাড়ের গায়ে এক ধরনের। সাদা ফুল ফুটে থাকে-হলদে বালির আলে যেখানে ফুটে থাকে পিঙ্ক ফুল। যে সব তিমিরা উওর সমুদ্র থেকে ভেসে আসে তাদের গান গাইত–যাদের গান না শোনার জন্যে নাবিকরা নিজেদের কানের বিবর মোম দিয়ে বন্ধ করে রাখত–কারণ তাদের গান একবার কালে ঢুকলেই সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের প্রাণ বিসর্জন দিতে হত–সেই সব সাইরেনদের গান সে গাইত। তাছাড়া গাইত বিরাট বিরাট জাহাজের গাল, মারম্যানদের গান, যারা সাদা ফেলার বিছানায় শুয়ে থাকে আর নাবিকদের অভ্যর্থনা করার জন্যে নিজেদের হাত বাড়িয়ে দেয়-সেই সব জল-অপ্সরীদের গান সে গাইতা এই গান শুনে মাছের ঝাঁক দৌড়ে আসত সেইখানে। আর জেলের ছেলেটি জাল বোঝাই করে মাছ ধরত। মাছ ধরা শেষ হলে অপ্সরী আবার সমুদ্রে ডুবে যেত।

কিন্তু তবু যুবকটি তার দেহ সস্পর্শ করতে পারে এতটা কাছে কোনোদিনই সে আসত না। যুবকটি অনুনয়-বিনয় করলেও না। ধরার চেষ্টা করলেই সীল মাছের মতো সে জলের তলায় ডুবে যেত, আর সেদিন উঠত না। কিন্তু সে তাকে নিত্য গান শোনাত। সে-গানে যুবকটি মুগ্ধ হয়ে যেত। অনেকদিন মাছ ধরতেও সে ভুলে যেত।

একদিন সন্ধ্যার সময় যুবকটি তাকে বলল–অপ্সরী, জল-অপ্সরী; তোমাকে আমি ভালোবাসি আমাকে বিয়ে কর তুমি।

কিন্তু জল-অপ্সরী মাথা নেড়ে বলল–তা হয় না। তোমার আত্মা হচ্ছে মানুষের। যদি তুমি তোমার ওই আত্মাটিকে সরিয়ে দিতে পার তাহলেই আমি তোমাকে ভালোবাসতে পারি।

এই শুনে যুবকটি নিজের মনে-মনেই বলল–আত্মাটা আমার কী কাজে লাগছে! আমি ওকে দেখতেও পাই নে, ছুতেও পারি নে। সুতরাং আমি ওকে পরিত্যাগ করব। তাহলেই আমার জীবন আনন্দে ভরে উঠবে।

এই রকম চিন্তা করার সঙ্গে-সঙ্গে আনন্দে তার বুকটা ভরে উঠল; সে হাতটা বাড়িয়ে। বলল–আত্মাকে আমি পরিত্যাগ করব। তুমি হবে আমার বৌ, আমি তোমার বর। তারপরে সমুদ্রের অতলে আমরা দুজনে বাসা বাঁধবো। তুমি যা বলবে তাই আমি করব তাহলে আর আমাদের ছাড়াছাড়ি হবে না।

খুশি হয়ে জল-অপ্সরী নিজের হাতের মধ্যে মুখটা ঢেকে ফেলল।

যুবকটি চিৎকার করে জিজ্ঞাসা করল–কিন্তু আত্মাটাকে আমি বিদায় দেব কেমন করে? বলে দাও–আমি তাই করব।

অপ্সরীটি বলল–তা আমি জানি নে। সমুদ্রে যারা বাস করে তাদের কোনো আত্মা নেই।

এই বলে তার দিকে একবার সতৃষ্ণ নয়নে তাকিয়ে সে জলের মধ্যে ডুবে গেল।

পরের দিন খুব সকালে–সূর্য তখনো পাহাড় উঁচিয়ে খুব বেশিদূর একটা ওঠেনি, ধীবর যুবকটি পাদরির বাড়িতে হাভির হয়ে দরজায় ধাক্কা দিল।

গির্জার নতুন কর্মচারীটি বেড়ার ফাঁক থেকে তাকিয়ে দেখল, তারপরে নিশ্চিন্ত হয়ে সে দরজা খুলে দিয়ে বলল—এস। যুবক ধীবরটি ভেতরে ঢুকে গেল; সুগন্ধ নলখাগড়া পাতা ছিল। মেঝেতে। পাদরি তখন প্রভুর গ্রন্থ পাঠ করছিলেন। সেইখানে হাঁটু মুড়ে বসে পাদরিকে। সম্বোধন করে ধীবরটি বলল–পিতা, আমি একটি জলচর প্রাণীর সঙ্গে প্রেমে পড়েছি। কিন্তু তার সঙ্গে মিলনের পথে বাধা সৃষ্টি করছে আমার এই আত্মা। বলুন দেখি, কেমন করে আমি আমার এই আত্মাটাকে বিদায় করে দিতে পারি। কারণ, সত্যি কথা বলতে কি একে আমার প্রয়োজনটাই বা কী? এর দামই বা আমার কাছে কতটুকু? আমি একে দেখতেও পাই নে, একে স্পর্শও করতে পারি নে। আমি একে চিনিও না।

এই কথা শুনে পাদরিটি বুক চাপড়িয়ে বললেন–হায়, হায়! তুমি কি উন্মাদ হয়েছ, না, কোলো। বিষাক্ত ওষুধ খেয়েছ? আত্মাই হচ্ছে মানুষের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। যাতে আমরা খুব ভালো আর। সভাবে ব্যবহার করতে পারি সেই উদ্দেশ্যেই ঈশ্বর এটি আমাদের দিয়েছেন। বিশ্বের সমস্ত সোনা-দানা একসঙ্গে জড়ো করলেও এর সমমূল্যের হয় না। সেই জন্যে বলছি, ওকথা তুমি আর মনেও স্থান দিয়ো না। একথা ভাবাও পাপ; সে-পাপের কোনো ক্ষমা নেই। আর জলচর প্রাণীদের কথা যদি বল তাহলে বলতে হয় তারা সবাই নষ্ট হয়ে গিয়েছে। যারা তাদের সঙ্গে মেলামেশা করে তারাও অধঃপাতে গিয়েছে। তারা হচ্ছে মাটির পশু; ন্যায়-অন্যায়ের জ্ঞান তাদের নেই। ঈশ্বর তাদের জন্যে মৃত্যু বরণ করেননি।

পাদরির এবম্বিধ বাক্য শুনে যুবক ধীবরটির চোখ দুটি জলে ভরে উঠল; তারপরে সে দাঁড়িয়ে উঠে বলল–পিতা, বনদেবতারা খুশি মনে বনে বাস করে; গন্ধর্বরা সোনার বীণা নিয়ে পাথরের ওপরে বাসে থাকে। তাদের দিনগুলি ফুলের মতো মিষ্টি। তোমাকে অনুরোধ করছি আমাকে তুমি তাদের মতো করে দাও। যে আত্মা আমার ভালোবাসার পথে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে তাকে পুষে রেখে আমার লাভ কী?

ভুরু দুটো কুঁচকে পাদরি চিৎকার করে বললেন–দেহজ ভালোবাসা নোংরা আর ঈশ্বর যে সব পেগান দেবতাদের তাঁর বিশ্বে ঘুরে বেড়াত দেন তারাও কদর্য। অরণ্যবাসী গন্ধর্বরা নিপাত যাক; নিপাত যাক জল-অপ্সরীর দল। রাত্রিতে আমি তাদের গান শুনেছি। তারা আমাকে ভুলিয়ে ঘরের বাইরে টেনে নিয়ে যেতে চায়। আমার জানালায় ঠকঠক করে শব্দ করে তারা হাসে। তাদের সেই বিপজ্জনক আনন্দের কাহিনি তারা আমার কানে কানে বলে যায়। তারা আমাকে প্রলুব্ধ করে। আমি যখন প্রার্থনা করি তখন তারা আমাকে ভেংচি কাটে। আমি তোমাকে বলছি স্বর্গ না নরক-কোথাও তাদের কোনো স্থান হবে না; কোথাও তারা ঈশ্বরের স্তব করবে না।

যুবক ধীরের কেঁদে বলল–পিতা, তুমি কী বলছ তা তুমি জান না। আমার জালে এবার আমি একটি রাজকন্যাকে বন্দী করেছি। সকাল বেলার নক্ষত্রের চেয়েও সে সুন্দরী, চাঁদের চেয়েও সাদা তার দেহের রঙ। তারই জন্যে আত্মাকে আমি বিসর্জন দেব; তারই জন্যে স্বর্গকে আমি পরিত্যাগ করব। সুতরাং আমি যা চাচ্ছি তাই আমাকে দাও; আমি শান্তিতে ফিরে যাই।

পাদরি চিৎকার করে বললেন–দূর হও, দূর হও। তোমার প্রণয়িণীকে ঈশ্বর পরিত্যাগ করেছেন। তোমাকেও ঈশ্বর পরিত্যাগ করবেন।

গভীর দুঃখে মাথাটি নিচু করে যুবকটি বাজারের দিকে এগিয়ে গেল।

ব্যবসাদারেরা তাকে আসতে দেখে নিজেদের মধ্যে কী সব আলোচনা করল; তারপরে তার নাম ধরে ডেকে জিজ্ঞাসা করলকী বিক্রি করবে হে?

সে বলল বিক্রি করব আমার আত্মা। এটাকে নিয়ে আমি বড়ো ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। তোমরা। এটা আমার কাছ থেকে কেড়ে নাও। কারণ, আমি একে দেখতেও পাই নে, সপর্শও করতে পারি লে; এটা কী তাও আমি জানি নে। এটা আমার কোন কাজে লাগবে?

ব্যবসাদারেরা তাকে ব্যঙ্গ করে বলল–তোমার আত্মা মানুষের কোন কম্নে লাগবে? এক টুকরো রুপোর দামও ওর নেই। তোমার দেহটাকে বিক্রি করে দাও। আমরা তোমাকে ক্রীতদাস করব। কিন্তু আর কথাটি বলো না। ওর কোনো দাম নেই আমাদের কাছে।

যুবক মনে-মনে বলল–কী অদ্ভুত জিনিস! পাদরি বললেন আত্মার দাম বিশ্বের সমস্ত সোনা একসঙ্গে করলে যা হয় তাই। ব্যবসাদাররা বলছে ওর দান কানাকড়িও নয়।

এই বলে সে বাজার ছাড়িয়ে সমুদ্রতীরে গিয়ে দাঁড়াল; তারপরে কী করবে ভাবতে লাগল।

ভাবতে ভাবতে হঠাৎ তার একটি বন্ধুর কথা মনে পড়ে গেল। বন্ধুটি তাকে এক-ডাইনির কথা বলেছিল। উপকূলের ওপরে একটা গুহায় সে বাস করত। আত্মাকে বিসর্জন দেওয়ার জন্যে সে এতই অস্থির হয়ে উঠেছিল যে সেই কথাটা মনে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সে সেইদিকে ছুটল। তার পেছনে-পেছনে ধুলোর ঝড় বইতে লাগল। হাত কুটকুটানি থেকে যুবতী ডাইনিটি বুঝতে পারল সে আসছে। বুঝে, সে একটু হেসে তার লাল চুলগুলিকে এলিয়ে দিলা এইভাবে এলো চুলে সে তার গুহার মুখে এসে দাঁড়ালা তার হাতে ছিল একগোছা ফুটন্ত হেমলক।

 ধীবর যুবকটি যখন হাঁপাতে হাঁপাতে খাড়াই সিঁড়ি বেযে তার সামনে এসে নতজানু হয়ে বসল তখন ডাইনিটি চিৎকার করে জিজ্ঞাসা করল–কী চাও তুমি-কী চাও? ঝড়ের সময়ে। ডালে মাছ ধরতে চাও? আমার শরের ছোটো একটা বাঁশি রয়েছে। সেটা বাড়ালেই মুলেটরা ভাসতে-ভাসতে সব উপকুলের ধারে এসে হাজির হয়। কিন্তু তার জন্যে হে সুন্দর যুবক, তোমাকে কিছু দিতে হবে। তোমার কী চাই–তোমার কী চাই? প্রচণ্ড বাত্যায় জাহাজকে ভেঙে চুরমার করে দিতে চাও যাতে সমস্ত মণিমুক্তা উপকূলে ভেসে আসবে? তাও তুমি পাবে। কিন্তু তার জন্যে কিছু দিতে হবে তোমাকে। আমার কাছে একটা ফুল রয়েছে সেটা এই উপত্যকারই এমন একটা অংশে জন্মায় যেটা আমি ছাড়া আর কেউ জানে না। তার বুকে একটা তারার চিহ্ন রয়েছে। এর রস হচ্ছে দুধের মতো সাদা। তারই একটা ফোঁটা যদি তুমি রানির দাম্ভিক ঠোঁটের ওপরে একবার বুলিযে দিতে পার তাহলে সে তোমার পিছু পিছু সারা বিশ্ব ঘুরে বেড়াবে। কিন্তু তার জন্যে কিছু দিতে হবে তোমাকে। কিছু দিতে হবে। একটা। ব্যাঙকে পিষে আমি কাদা করে দিতে পারি। সেইটাকে গোলাতে পারি একটা মরা লোকের হাত দিয়ে। ঘুমন্ত শত্রুর ওপরে সেটা যদি ছিটিয়ে দাও তাহলে সঙ্গে সঙ্গে সাপ হয়ে যাবে। তার মা-ই তখন তাকে মেরে ফেলবে। একটা চাকা দিয়ে চাঁদকে আমি স্বর্গ থেকে টেনে আনতে পারি। একটা স্ফটিক পাত্রের মধ্যে দেখাতে পারি মৃত্যুকে। কী চাও বল। তোমাকে আমি তাই দেব। কিন্তু প্রতিদানে কিছু দিতে হবে তোমাকে।

যুবক ধীবর বলল–আমি চাই সামান্য; কিন্তু পাদরি রেগে আমাকে তাড়িয়ে দিয়েছেন, আমাকে বিদ্রূপ করেছে ব্যবসাদাররা। যদিও মানুষে তোমাকে ডাইনি বলে, তবু সেই জন্যেই আমি তোমার কাছে এসোচ্ছিা তুমি প্রতিদানে যা চাও তাই আমি দেব।

তার সামনে এগিয়ে এসে ডাইনিটি জিজ্ঞাসা করল–কী চাও বলা

আত্মাটিকে আমি বিদায় দিতে চাই।

ডাইনির মুখটা বিবর্ণ হয়ে গেল। কেঁপে উঠল তার শরীর। নীল চাদরে সে তার মুখটা ঢেকে ফেলল। তারপরে বিড়বিড় করে বলল–সুন্দর যুবক, ওটা বড়ো ভয়ানক জিনিস।

যুবকটি তার তামাটে চুলগুলিকে ঝাঁকুনি দিয়ে হেসে বলল–আয়াটা আমার কাছে কিছু নয়। আমি তাকে দেখতেও পাইনে, সপর্শও করতে পারি নে। আমি তাকে চিনিও না।

সুন্দর চোখ দুটি দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে ডাইনি বলল–যদি তোমাকে আমি বলে দিই তাহলে আমাকে তুমি কী দেবে?

সে বলল–পাঁচটা সোনার মোহর। সেই সঙ্গে দেব ডাল, আমার বাড়ি, আর যে নৌকো ভাসিয়ে আমি মাছ ধরতে যাই সেই লৌকো। শুধু পথটা আমাকে দেখিয়ে দাও; আমার যা কিছু রয়েছে সব তোমাকে দিয়ে দেব।

বিদ্রূপ করে হেসে ডাইনিটি বলল–শরৎকালের পাতাকে আমি সোনায় পরিণত করতে পারি। ইচ্ছে হলে, বিবর্ণ চাঁদের আলোকে আমি রুপোর স্রোতে পরিণত করতে পারি। আমার মনিব বিশ্বের সমস্ত রাজাদের চেয়ে ধনী।

তাহলে, কী চাই তোমার?

আমার সঙ্গে নাচতে হবে।

মাত্র এই? অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে উঠল যুবকটি।

ও ছাড়া আর কিছু নয়-এই বলে ডাইনিটি মিষ্টি করে হাসল।

 যুবকটি বলল–তাহলে সূর্যাস্তের পরে কোনো গোপন জায়গায় আমরা দুজনে নাচব। নাচের শেষে আমি যা জানতে চাই তুমি আমাকে তাই বলে দেবে।

ডাইনিটি ঘাড় নেড়ে বলল–পূর্ণিমার রাতে, পূর্ণিমার রাতে।

 এই কথা বলে চারপাশে একবার উঁকি দিয়ে কান পেতে কী যেন শুনতে লাগল সে। একটা নীল পাখি চিৎকার করতে-করতে তার বাসা থেকে বেরিয়ে উড়ে গেল। মোটা ঘাসের বনে তিনটে। ডোরাকাটা পাখি খস খস করতে করতে শিস দিয়ে পরস্পরকে ডাকতে লাগল। আর শোনা গেল উপলখণ্ডের ওপরে ঢেউ-এর গড়িয়ে পরার শব্দ। এগুলি ছাড়া আর কোনো শব্দ ছিল না। কোথাও।

ডাইনিটি ফিসফিস করে বলল–আজ রাত্রিতে পাহাড়ের ওপরে নিশ্চয় তুমি আসবে। আজ হচ্ছে স্যাবাথা। তিনি সেখানে উপস্থিত থাকবেন।

একটু চমকে উঠে সে জিজ্ঞাসা করল–কার কথা বলছ?

ডাইনিটি বলল— শুনে লাভ নেই তোমার, আজ রাত্রিতে যথাস্থলে উপস্থিত হয়ে হর্নবিম গাছের ডালের নীচে আমার জন্যে অপেক্ষা করবে তুমি যদি কোনো কালো কুকুর তোমার দিকে দৌড়ে আসে তাহলে উইলো গাছের একটা লাঠি দিয়ে তাকে আঘাত করো। তাহলেই সে পালিয়ে যাবে। যদি কোনো পেঁচা তোমার সঙ্গে কথা বলতে চায়–তার কথার কোনো উত্তর দিয়ো না। আকাশে পূর্ণ চাঁদ উঠলেই আমি তোমার কাছে আসব। তারপরে আমরা দুজনে ঘাসের ওপরে নাচব।

সে জিজ্ঞাসা করল–কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তর দেবে তো?

 ছাগলের খুরে দিব্যি দিয়ে বলছি, দেব।

যুবকটিই তার মাথা থেকে টুপিটা একটু তুলল; তারপরে মাথাটা একটু নুইয়ে খুশি মনে ফিরে গেল।

যতদূর দেখা যায় ডাইনিটি তাকে দেখল; তারপরে গুহার ভিতরে গিয়ে আয়নায় নিজের মুখ দেখল; চারকোল পুড়িয়ে ধোঁয়ার ভেতর দিয়ে কী যেন দেখল; তারপরে মুষ্টিবদ্ধ করে বলল–জল-অপ্সরীর মতোই আমি সুন্দরী। ও আমারই হওয়া উচিত ছিল।

এবং সেদিন সন্ধ্যায় চাঁদ ওঠার সঙ্গে-সঙ্গে সে পাহাড়ের ওপরে উঠে হর্নবিম গাছের নীচে অপেক্ষা করতে লাগল। মধ্য রাত্রিতে ডাইনিরা বাদুড়ের মতো উড়তে উড়তে সেখানে হাজির হল। ঘাসের ওপরে নেমে তারা বলাবলি করতে লাগল–এ যে নতুন লোক দেখছি! শেষকালে বাতাসে লাল চুল উডিযে এল সেই যুবতী ডাইনি। তাকে দেখেই অন্য ডাইনিরা চিৎকার করে জিজ্ঞাসা করল–তিনি কোথায়-তিনি?

ডাইনিটি একটু হেসে হর্নবিম গাছের তলায় দৌড়ে গিয়ে ধীবরটির হাতে ধরে ঘাসের ওপরে টেনে নিয়ে এল। তারপরে তারা নাচতে শুরু করল। দুজনে তারা ঘুরে ঘুরে নাচতে লাগল। ঠিক এমন সময় মনে হল কে যেন ঘোড়ায় চেপে দ্রুতবেগে তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। কিন্তু কোনো ঘোড়াই তার চোখে পড়ল না। কেমন যেন ভয় পেয়ে গেল সে।

ডাইনি বলল–জোরে, জোরে; আরো জোরে। এই বলে ধীবরটির গলাটা সে দু’হাতে জড়িয়ে ধরল। তার তপ্তশ্বাস যুবকটির গালের ওপরে এসে পড়ল। আরও জোরে, আরও ডোরে’–চিৎকার করে উঠল ডাইনি। মনে হল, পৃথিবীটা তাদের তলায় বনবন করে ঘুরছে।

যুবকটির কেমন যেন ভয় লাগল। তার মনে হল কোনো অমঙ্গল যেন তাকে লক্ষ করছে। তারপরে তার মনে হল পাথরের ছায়ার নীচে একটা লোক বসে রয়েছে। এর আগে তাকে সে। দেখেনি। লোকটার গায়ে কালো ভেলভেটের পোশাক। তার মুখটা অদ্ভুত রকমের বিবর্ণ কিন্তু তার ঠোঁট দুটি লাল ফুলের মতো গর্বিত। তাকে বেশ ক্লান্ত মনে হল; মনে হল যেন। অন্যমনস্কভাবে একটা ছোরার বাঁট নিয়ে সে খেলা করছে।

মন্ত্রমুগ্ধের মতো যুবক ধীবরটি তাকে লক্ষ করল। তারপরে চারটি চোখের মিলন হল। ডাইনিটির হাসির শব্দ সে শুনতে পেল। সে তার কোমর জড়িয়ে ধরে বনবন করে ঘুরোতে লাগল। বনের ভেতরে হঠাৎ একটা কুকুর ডেকে উঠল। নাচিঘেরা সব থেমে গেল। তারপরে জোড়া-জোড়া তারা সেই লোকটার দিকে এগিয়ে দিয়ে তার হাতে চুমু খেল। কিন্তু লোকটির ঠোঁট দুটো ব্যঙ্গের হাসিতে বেঁকে গেল। সে কেবল যুবক ধীবরটির দিকে তাকিয়ে রইল।

ডাইনিটি তাকে ফিসফিস করে বলল–এস আমরা ওঁকে পুজো করি।

হাত ধরে তাকে সে এই লোকটির কাছে নিয়ে গেল; কিন্তু কাছাকাছি আসতেই কী জানি কেন ধীবরটি ক্রুশের ভঙ্গিতে তার বুকের ওপরে হাত দুটো রাখল; আর ঈশ্বরের নাম করল।

যুবকটির এরকম ব্যবহার দেখেই ডাইনিরা বাজপাখির মতো চিৎকার করতে করতে উড়ে পালাল; যে বিবর্ণ মুখটা এতক্ষণ ধরে তাকে লক্ষ করছিল সেটা যন্ত্রণায় কুঁকড়ে কুঁকড়ে উঠতে লাগল, তারপরে সে বনের মধ্যে দৌড়ে গিয়ে ঘোড়ায় চেপে তার দিকে বিষণ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।

লাল চুল-ওয়ালী সেই ডাইনিটিও পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল; কিন্তু ধীবরটি শক্ত করে তার কব্জিটা ধরে রইলা সে চিৎকার করে বলল–আমাকে ছেড়ে দাও, ছেড়ে দাও; কারণ, তুমি এমন একটি শব্দ উচ্চারণ করে যা তোমার উচ্চারণ করা উচিত হয়নি; এমন একটি চিহ্ন দেখিযে যার দিকে তাকানো উচিত নয় আমাদের।

ধীবরটি বলল–ওসব ছাড়া সেই গোপন কথাটা না বলা পর্যন্ত আমি তোমাকে ছেড়ে দেব না।

ডাইনির ঘেসো-সবুজ রঙের চোখ দুটো জলে করুণ হয়ে উঠল; বলল–ওটা বাদ দিয়ে তোমার যা ইচ্ছা তাই চাও।

ধীবরটি হেসে তার মুঠো আরও শক্ত করে ধরে রইল।

তার হাতে থেকে নিস্তার নেই বুঝতে পেরে ডাইনি অনুনয় করে বলল–সমুদ্রের মেয়ের মতোই নিশ্চয় আমি সুন্দরী, আর তারই মতো শান্ত।

কিন্তু ধীবরটি তাকে একটা ঝাঁকনি দিয়ে বলল–হয় বল; না হয়তো তোমাকে আমি খুন করে ফেলুব]

এই কথা শুনে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে ডাইনি বলল–তবে তাই হোক। তোমার আত্মা তোমার নিজস্ব। আমার নয়। ওকে নিয়ে যা ইচ্ছা তাই তুমি করতে পার।

এই বলে কোমরবন্ধনী থেকে ছোটো একটা ছুরি বার করে সে যুবকটির হাতে দিল।

অবাক হয়ে যুবকটি জিজ্ঞাসা করল–এ দিয়ে আমি কী করব?

 একটু চুপ করে রইল ডাইনি; ভয়ার্ত হয়ে উঠল তার দৃষ্টি। তারপরে কপালের উপর থকে। চুলগুলি সরিয়ে দিয়ে অদ্ভুতভাবে হেসে বলল–মানুষ যেটাকে দেহের ছায়া বলে মনে করে। সেটা দেহের ছায়া নয–সেটা হল আত্মার ছায়া। চাঁদের দিকে পেছন করে সমুদ্রের উপকূলে। দাঁড়াও। পায়ের চারপাশে তোমার যে ছায়াটাকে দেখতে পাবে সেটা কেটে ফেলবে। তারপরে তোমার আত্মাকে নির্দেশ দেবে তোমাকে ছেড়ে যেতো তখনই তোমার আত্মা তোমাকে ছেডে চলে যাবে।

সত্যি?

সত্যি তোমাকে এটা হয়তো আমার বলা উচিত হয়নি।

এই বলে কাঁদতে কাঁদতে সে তার হাঁটু দুটো জড়িয়ে ধরল।

ধীবরটি তাকে ঘাসের ওপরে ফেলে রেখে ছুরিটা তার কোমরে বেঁধে পাহাড় থেকে নেমে এল।

এবং তার ভেতরে যে আত্মাটা ছিল সে তাকে ডেকে বলল–শোন। আমি এতদিন তোমার সঙ্গে বাস করেছি–দাসত্ব করেছি তোমার। এখন আমাকে তুমি বিসর্জন দিয়ো না। আমি তো কোনো অন্যায় করিনি।

যুবকটি হেসে বলল–তা তুমি করনি। কিন্তু তোমাকে আমার আর প্রয়োজন নেই। বিরাট বিশ্ব–এখানে স্বর্গ আর নরক দুই-ই রয়েছে। যেখানে ইচ্ছে তুমি চলে যাও। আর আমাকে বিরক্ত করো না। কারণ, আমার প্রেয়সী আমাকে ডাকছে।

আত্মা বলল–যদি একান্তই আমাকে বিদায় দাও তাহলে অন্তত হৃদয়টাকেও দাও। এই পৃথিবী বড়োই নিষ্ঠুর। সুতরাং হৃদযটাকেও নিয়ে যেতে দাও আমাকে।

 যুবকটি হেসে মাথা নেড়ে বলল–হৃদয়টাই যদি তোমাকে দিলাম তাহলে প্রেয়সীকে আমি কী দেব? ওটা আমার প্রেমিকার। অতএব চলে যাও। আর দেরি করো না।

প্রেমে কি আমারও প্রয়োজন নেই?

চলে যাও, চলে যাও। তোমাকে আমার আর প্রয়োজন নেই।

এই বলে ছুরিটা নিয়ে সে পায়ের ছায়াটা কেটে ফেলে ছুরিটা আবার কোমরে গুঁজে রাখল। চলে যাও, চলে যাও। তোমাকে আর আমার প্রয়োজন নেই।

আটি বলল–না, আবার আমাদের দেখা হবে।

যুবকটি জিজ্ঞাসা করল–কী করে? তুমি নিশ্চয় সমুদ্রের তলায় আমার সঙ্গে যাবে না?

বছরে একবার এইখানে এসে আমি তোমাকে ডাকব। হয়তো, আমাকে তোমার প্রয়োজন হতে পারে।

যুবকটি বলল–তোমাকে আমার আবার কী প্রয়োজন হবে বুঝতে পারছি নে, তবে তুমি যখন আসতে চাইছ তখন এস।

এই বলে সে সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়ল। ট্রিটনরা তাদের শিঙে ফুকল। সেই খুদে ভলঅস্পরীটি সমুদ্রের জলে ভেসে তাকে অভ্যর্থনা জানাল; তার দুটি হাতে যুবকের গলাটা জড়িয়ে ধরে। তার মুখে চুমু খেল।

আর সেই নির্জন সমুদ্রতীরে আত্মাটি নিঃসঙ্গভাবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব দেখল। যখন তারা জলের তলায় ডুবে গেল তখনই সে কাঁদতে-কাঁদতে জলাভূমির ওপর দিয়ে চলতে লাগল।

এক বছর পরে সেইখানে ফিরে এসে আত্মাটি তাকে ডাকল। সমুদ্র থেকে উঠে যুবকটি জিজ্ঞাসা করল–ডাকছ কেন?

আমার কাছে এস। আমি কী অদ্ভুত জিনিস দেখেছি সেই সব কথাই তোমাকে বলব।

কাছে এস অগভীর জলে হেলান দিয়ে বসে ধীবরটি তার কথা শুনতে লাগল।

আত্মাটি বলল– তোমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে উত্তর দিকে মুখ করে আমি হাঁটতে লাগলাম। বিশ্বের যা কিছু বিজ্ঞতা সবই এই পূর্বদিক থেকে এসেছে। ছ’দিন হাঁটার পরে সপ্তম দিন সকালে আমি একটা পাহাড়ের কাছে এসে হাজির হলাম। এই দেশটা হচ্ছে তাতারদের। রোদের ঝাঁঝ এড়ানোর জন্যে আমি একটা গাছের ছায়ায় বসলাম। শুকনো মাটি, একেবারে রোদে পুড়ে গিয়েছে। মাছির মতো গুঁড়ি দিয়ে মানুষরা সব ঘুরে বেড়াচ্ছে সেখানে।

দুপুরের সময় দেখলাম সমতলভূমি থেকে লাল ধুলো উঠে আকাশ ছেয়ে দিয়েছে। এই দেখেই তাতাররা তাদের চিত্রিত ধনুক নিয়ে ঘোড়ার পিঠে লাফিয়ে সেইদিকে এগিয়ে গেল। মেয়েরা চিঞ্জার করতে করতে গাড়ির পেছনে নিজেদের লুকিয়ে ফেলল।

সন্ধ্যার দিকে তাতাররা ফিরে এল; কিন্তু তাদের মধ্যে পাঁচজনকে দেখা গেল না। যারা ফিরে। এল তাদের মধ্যেও কম লোক আহত হয়নি। তারা সেই গাড়িগুলোকে ঘোড়ার সঙ্গে জুড়ে দিয়ে তাড়াতাড়ি পালিয়ে গেল। তিনটে শেয়াল গর্ত থেকে বেরিয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে একবার দেখেই উলটো দিকে চলে গেল।

চাঁদ উঠলে দেখলাম সমতলভূমির ওপরে তাঁবুর কাছে আলো জ্বলছে। এই দেখে আমি সেই দিকে এগিয়ে গেলাম। দেখলাম কার্পেটের ওপরে একদল বণিক বসে রয়েছে। পেছনে বাঁধা। রয়েছে উটের দল; আর তাদের নিগ্রো চাকররা তাদের জন্যে তাঁবু খাঁচাচ্ছে। তাদের কাছে হাজির হতে বণিকদের নেতা তরোযাল খুলে জিজ্ঞাসা করল–কী চাই?

বললাম আমি আমার দেশের একজন রাজপুত্র। তাতাররা আমাকে ধরে এনে ক্রীতদাস করে রাখবে ভেবেছিল, আমি তাদের কাছ থেকে পালিয়ে এসেছি।

আমার কথা শুনে লোকটা হেসে আমাকে পাঁচটা কাটা মুণ্ডু দেখাল। মুণ্ডুগুলো পাঁচটা লম্বা। বাঁশের মাথার ওপরে গাঁথা ছিল। লোকটা আমাকে জিজ্ঞাসা করল–ঈশ্বরের অবতার কে? আমি বললাম-মহম্মদ।

এই কথা শুনে মাথাটা নুইয়ে সে হাত ধরে আমাকে তার পাশে বসাল। কাঠের পাত্রে একটা নিগ্রো ক্রীতদাস আমার জন্যে ঘোড়ার দুধ এনে দিল; আর এনে দিল সেদ্ধকরা একটুকরো মেড়ার মাংস।

সকাল হতে আমাদের যাত্রা শুরু হল। দলপতির পাশে-পাশে লাল-চুলো একটা উটের পিঠে চড়ে আমি চলতে লাগলাম। আমাদের সামনে বর্শা নিয়ে ছুটতে লাগল একটা লোক। আমাদের দু’পাশে চলল সৈন্য। পেছনে চলল খচ্চরের দল পণ্য নিয়ে।

তাতারদের দেশ ছেড়ে আমরা আর একটা দেশে হাজির হলাম। সেখানকার লোকেরা চন্দ্রকে অভিসম্পাত দেয়। আমরা গ্রাইফোনসদের দেখলাম। সাদা পাহাড়ের ওপরে বসে তারা। তাদের ধনরত্ন পাহারা দিচ্ছিল। পাচ্ছে নিঃশ্বাসের হাওযার বরফ ঝরে পড়ে এই ভযে পাহাড়ের ওপর দিয়ে আমরা নিঃশ্বাস বন্ধ করে হাঁটছিলাম। উপত্যকা দিয়ে যাওয়ার সময় গাছের কোটর থেকে পিগমিরা আমাদের দিকে তীর ছুঁড়ল রাত্রিতে বন্য মানুষেরা ভট্রাক পিটতে লাগল। বাঁদরদের টাওয়ারে এসে আমরা তাদের ফল খেতে দিলাম। ফলে, তারা আমাদের কোনো অনিষ্ট করল না। সাপেদের টাওয়ারে এসে তামার পাত্রে তাদের দুধ খেতে দিলাম। তারা আমাদের পথ ছেড়ে দিল।

প্রতিটি শহরের রাজা আমাদের ওপরে কর বসাল; কিন্তু আমাদের ভেতরে ঢুকতে দিল না। দেওয়ালের ওপাশ থেকে কিছু বুটি আর অন্যান্য খাবার ছুঁড়ে দিল। গ্রামবাসীরা আমাদের আসতে দেখে পাতকুযযার ডলে বিষ মিশিয়ে দিয়ে সব পাহাড়ের ওপরে পালিয়ে গেল। আমরা ম্যাগভি-দের সঙ্গে লড়াই করলাম। এরা বুড়ো হয়ে জন্মায়। তারপর ছোটো হয়ে ক্রমশ বাড়তে থাকে। শেষকালে মারা যাওয়ার সময় শিশু হয়ে যায়। লড়াই করলাম ল্যাকট্রইদের সঙ্গে। বাঘেদের সন্তান বলে নিজেদের জাহির করে তারা। আমাদের লড়াই করতে হল অরেনটিসদের সঙ্গে। মৃতদেহকে এরা গাছের ওপরে কবর দেয়, নিজেরা থাকে গুহার অন্ধকারে। এই সব লড়াই-এ আমাদের দলের এক তৃতীয়াংশ মারা গেল; আর এক তৃতীয়াংশ মারা গেল অভাবে বাকি যারা রইল তারা আমার বিরুদ্ধে এই বলে অভিযোগ করত লাগল যে তাদের এই সব দুর্ভাগ্যের জন্যে আমিই দায়ী। পাথরের নীচে থেকে শিং-ওয়ালা একাট বিষাক্ত সাপ বার করে ছোবল খেলাম তার। তারা যখন দেখল সাপের ছোবল খেয়েও আমাদের কিছু হল না তখন তারা ভয় পেয়ে গেল।

চতুর্থ মাসে আমরা হাজির হলাম ইলেল শহরে। তখন রাত্রি, আকাশে ফিকে চাঁদ দেখা যাচ্ছে। গাছ থেকে ডালিম পেড়ে তারই রস খেলাম আমরা। তারপরে আমাদেরই কার্পেট বিছিয়ে সকালের জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলাম। সকাল হলে শহরের ফটকে ধাক্কা দিলাম আমরা, ফটকের দরজা ছিল লাল ব্রোঞ্জ-এর; তার গায়ে আঁক ছিল সামুদ্রিক আর পাখা-ওয়ালা ড্রাগনদের ছবি। প্রাচীরের ওপর থেকে সশস্ত্র প্রহরীরা জিজ্ঞাসা করল–কী চাই তোমাদের? আমাদের মধ্যে যে দোভাষী ছিল সে বলল–সিরিয়া থেকে আমরা অনেক। পণ্যদ্রব্য নিয়ে এসেছি। আমাদের মধ্যে কয়েকজনকে তারা জামিন রেখে বলল–দুপুরের দিকে দরজা খোলা হবে। তোমরা ওখানে অপেহষ্কা কর।

দুপুরের দিকে দরজা খোলা হল। শহরের ভেতরে আমরা ঢুকে গেলাম। চারপাশ থেকে লোক এসে আমাদের দেখতে লাগল। একজন ঘোষক আমাদের আগমনবার্তা জানিয়ে জানিয়ে এগিয়ে গেল আমরা বাজারে এসে দাঁড়ালাম, আর নিগ্রোরা বাক্সপ্যাটরা খুলে জিনিসপত্র সব দেখাতে লাগল।

প্রথম দিন পাদরি এসে আমাদের সঙ্গে দরকষাকষি করল। দ্বিতীয় দিন এলো অভিজাত

সম্প্রদায়ের লোকেরা তৃতীয় দিনে হাজির হল মিস্ত্রি আর ক্রীতদাসের দল। বিদেশ থেকে বণিকরা এলে এই রীতিতেই ওখানকার মানুষেরা তাদের সঙ্গে সওদা করত।

প্রায় পনেরোটি দিন এইভাবে আমাদের কেটে গেল। তারপরে শুক্লপক্ক শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্লান্ত হয় আমি শহরের রাস্তায় বেরিয়ে পড়লাম। ঘুরতে ঘুরতে আমি একটা বাগানে এসে হাজির হলাম। সেখানে ওদের দেবতা বাস করেন। বেগুনে পোশাক পরে পাদরীরা সবুজ গাছের মধ্যে দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। কালো মার্বেল পাথরের একটি জায়গার ওপরে একটা। গোলাপের মতো লাল বাড়ি। সেখানেই দেবতারা থাকে। মণি-মুক্তা দিয়ে খচিত তার দরজা নানা চিত্রে শোভিত তার দেওয়াল। মন্দিরের সামনে পরিষ্কার ঝকঝকে একটি জলাশয়। তার পাশে আমি শুয়ে রইলাম। আমার বিবর্ণ আঙুলগুলি দিয়ে চওড়া-চওড়া পাতাগুলিকে ধরলাম। একটি পাদরি আমার দিকে এগিয়ে এসে পেছনে দাঁড়ালেন। তাঁর পায়ে চটি-জুতো। একটা পাটি জুতো সাপের নরম চামড়া দিয়ে তৈরি, আর এক পাটি জুতো তৈরি পাখির পালক দিয়ে।

একটু পরে আমাকে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন-কী চাই তোমার?

আমি বললাম–দেবতাকে দেখতে চাই।

তাঁর সেই তেবচা ছোটো চোখে আমার দিকে অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে তিনি বললেন–দেবতা শিকার করছেন।

বললাম-কোন বনে শিকার করছেন বলুন; আমি তাঁর সঙ্গে ঘোড়ায় চড়ে শিকার করব।

লম্বা নখ দিয়ে তাঁর ঢিলে পোশাকটা চেঁছে তিনি বললেন–দেবতা ঘুমোচ্ছেন।

জিজ্ঞাসা করলাম–কোন সোফায় ঘুমোচ্ছেন বলুন। আমি তাকে ঘুমোতে দেখব।

তিনি চেঁচিয়ে বললেন–দেবতা এখন ভোজনাগারে খাচ্ছেন।

 বললাম-মদ যদি মিষ্টি হয় তাহলে তাঁর সঙ্গে আমি মদ খাব। তেতো হলেও পিছিয়ে আসব না।

বিস্ময়ে তিনি মাথাটা নীচু করে আমাকে হাত ধরে তুললেন; তারপরে মন্দিরে নিয়ে গেলেন আমাকে।

প্রথম ঘরে দেখলাম একটা সিংহাসনের ওপরে একটি মূর্তি বসানো রয়েছে। সিংহাসনটি মূল্যবান ধাতুতে তৈরি। তার চারপাশটা প্রাচ্যদেশীয় মুক্তা দিয়ে খচিত। মূর্তিটার চেহারা একটা মানুষের মতো। তার কপালে একটা রুবি বসানো; তার চুল থেকে দাবনা পর্যন্ত তেলে ড্যাব ড্যাব করছে। নতুন জবাই করা একটা ছাগল শিশুর রক্ত তার পায়ে।

পাদরিকে আমি জিজ্ঞাসা করলাম–এই কি দেবতা?

পাদরি বললেন–এই দেবতা।

আমি চিৎকার করে বললাম-আমাকে দেবতা দেখাও। তা না হলে আমি তোমাকে খুন করব। এই বলে আমি তাঁর হাত ধরলাম। সঙ্গে-সঙ্গে তার হাতটা শুকিয়ে গেল।

পাদরি অনুনয় করে বলল–ঈশ্বর তাঁর সেবককে নিযোগ করুন এবং আমি তাকে ঈশ্বর দেখাব।

এই শুনে আমি তাঁর হাতের ওপরে নিঃশ্বাস ফেললাম। তাঁর হাতটা সঙ্গে-সঙ্গে সেরে উঠল। কাঁপতে কাঁপতে তিনি আমাকে দ্বিতীয় কক্ষে নিয়ে গেলেন। সেখানে আমি আর একটি মূর্তি দেখলাম। সেই মূর্তিটিও বহুমূল্য অলঙ্কারে সুসজ্জিত।

দেবতা কোথায়?–জিজ্ঞাসা করলাম আমি।

ইনিই দেবতা।

সত্যিকার দেবতা আমাকে দেখাও; না হলে, আমি তোমাকে হত্যা করব। এই বলে আমি তাঁর। চোখ দুটি সপর্শ করলাম। সঙ্গে সঙ্গে তিনি অন্ধ হয়ে গেলেন।

পাদরি আমাকে অনুনয় করে বললেন–ঈশ্বর তাঁর সেবককে নিরোগ করুন, তাহলেই আমি তোমাকে ঈশ্বর দেখাব।

তাঁর চোখের ওপরে নিঃশ্বাস ফেলতেই তিনি আবার তাঁর দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেলেন।

তিনি আমাকে তৃতীয় প্রকোষ্ঠে নিয়ে গেলেন। কিন্তু সেখানে কোনো মূর্তি নেই রয়েছে পাথরের বেদীর ওপরে একটা আয়নামাত্রা

দেবতা কোথায়?–জিজ্ঞাসা করলাম আমি।

তিনি বললেন–দেবতা বলে কিছু নেই। রয়েছে মাত্র এই আয়না; এটাকে বলা হয় বিজ্ঞতার আয়না। এর মধ্যে থেকে স্বর্গ আর মর্তের প্রতিটি জিনিস প্রতিফলিত হয়। অনেক আয়নাই এখানে রয়েছে; কিন্তু সেগুলি সবই ওই বিভিন্ন মতবাদের আয়না। যাদের এই আয়নাটি রয়েছে তারা সব কিছুই জানতে পারে। সেই জন্যে এটি আমাদের ঈশ্বর। আমরা সবাই একে পুজো করি।

আয়নার দিকে তাকিয়েই বুঝলাম পাদবিটি সত্যি কথাই বলেন। তারপরে আমি একটা অদ্ভুত কাজ করলাম; কিন্তু সে কথা থাক। এখান থেকে একদিনের দূরত্ব একটি জায়গায় আমি সেটিকে লুকিয়ে রেখে এসেছি। আমাকে যদি তোমার ভেতরে ঢুকতে দিয়ে তোমাকে সেবা। করার সুযোগ দাও তাহলে বিশ্বের সমস্ত জ্ঞানী মানুষদের চেয়েও তুমি বেশি বিজ্ঞ হতে পারবো সেই আয়নাটি হবে তোমার সম্পত্তি। সুতরাং তোমার ভেতরে আমাকে প্রবেশ করতে দাও।

কিন্তু যুবক ধীবরটি হেসে বলল–জ্ঞানের চেয়ে প্রেম মহত্তর এবং খুদে জল-অপ্সরী আমাকে ভালোবাসে।

আত্মাটি বলল–না, না-ওকথা বলো না। জ্ঞানের চেয়ে ভালো জিনিস আর কিছু নেই।

ধীবরটি বলল–প্রেম মহত্তর। এই বলে সে ডলে ডুবে গেল। কাঁদতে কাঁদতে ফিরে গেল আত্মা। দ্বিতীয় বছরের শেষে আত্মাটি আবার সেইখানে ফিরে এসে তাকে ডাকল। সমুদ্রের তলা থেকে মুখ তুলে ধীবরটি জিজ্ঞাসা করল–আমাকে ডাকছ কেন?

আত্মাটি বলল–আমার কাছে এস। আমি যে সব অদ্ভুত জিনিস দেখেছি সেসব কাহিনি তোমাকে আমি বলব।

সুতরাং সে অগভীর জলে উঠে এসে কাহিনি শোনার জন্যে হাতের ওপরে মাথাটা হেলিয়ে দিয়ে বসল।

আত্মাটি বলে গেল–তোমার কাছ থেকে ফিরে গিয়ে আমি দক্ষিণ দিকে এগিয়ে গেলাম। ওই দক্ষিণ দেশ থেকে সমস্ত কিছু মূল্যবান জিনিস দেশ-বিদেশে যায়। যে রাস্তাটা আশতার শহরে দিকে এগিয়ে গিয়েছে আর যার ওপর দিয়ে নানান তীর্থযাত্রী আসা-যাওয়া করে সেই রাস্তা ধরে ছ’দিন আমি হাঁটলাম। সাত দিনের দিন চোখ তুলে দেখলাম উপত্যকার ওপরে একটা শহরের কাছে এসে পৌঁছেছি।

সেই শহরের দরজা নটা। প্রতিটি দরজার সামনে একটা ব্রোঞ্জ-এর ঘোড়া দাঁড়িয়ে। পাহাড়ের ওপর থেকে বেদুইনের দল শহরের দিকে এগিয়ে এলেই তারা চিৎকার করে ওঠে। তামা দিয়ে দেওয়ালগুলি মোড়া; ছাদের ওপরে দস্তা ঢালা। প্রত্যেক গম্বুজের ওপরে একজন করে তীরন্দাজ ধনুক হাতে নিয়ে পাহারা দিচ্ছে।

আমি ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করতেই প্রহরীরা আমাকে বাধা দিল। আমি কে জিজ্ঞাসা করতে আমি বললাম আমি একজন দরবেশ। আমি মক্কায় যাচ্ছি। সেখানে সবুজ কাপড়ে মোড়া কোরান রয়েছে। দেবদূতেরা রুপোর অক্ষরে তার ওপরে নক্সা এঁকেছে। এই শুনে অবাক হয়ে তারা আমাকে ভেতরে প্রবেশ করার অনুমতি দিল।

শহরের ভেতরে বাজার। তোমার আমার সঙ্গে থাকা উচিত ছিল। সর সর রাস্তার ওপরে সেখানে প্রডাপতির মতো খুদে-খুদে কাগজের লণ্ঠন জ্বলছে। দোকানের সামনে সিল্কের কার্পেটের ওপরে বণিকরা বসে রয়েছে। তাদের দডিগুলো কালো সূচলো। তাদের মধ্যে কেউ কেউ ভারত মহাসাগর থেকে আমদানি করা সুগন্ধী আতর বিক্রি করে। কেউ তাদের সঙ্গে কথা বলার জন্যে দাঁড়ালে তারা জ্বলন্ত ধুলোচুরের ওপরে কিছু সুগন্ধ মশলা ঢেলে দিয়ে বাতাসটাকে মাতোয়ারা করে তোলে। বাজারে নানান লোক নানান জিনিস বিক্রি করছে। কেউ বিক্রি করছে রুপোর ব্রেসলেট, কেউ বিক্রি করছে মুক্তাখচিত দস্তার অ্যালকলেট, কেউ বা আবার বিক্রি করছে সোনার পাতের মধ্যে আকা বাঘের থাবা, কেউ চিতাবাঘের থাবা। চাযের দোকানের ভেতর থেকে গিটার বাজানোর শব্দ আসছে; আর আফিওখোরেরা তাদের সাদা। সাদা হাস মুখ নিয়ে পথচারীদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে।

সত্যি কথা বলতে কি আমার সঙ্গে তোমার থাকা উচিত ছিল। কাঁধের ওপরে চামড়ার কালো ভিস্তি নিয়ে কেউ মদ বিক্রি করার জন্যে ভিড় ঠেলে ঠেলে হেঁটে বেড়াচ্ছিল। অধিকাংশ মদের ব্যবসাদাররাই বিক্রি করছিল মধুর মতো মিষ্টি স্কিরাজ-এর মদ। বাজারে ফলওয়ালারা কত। রকমের ফলই না নিয়ে বসেছিল বিক্রি করার জন্যে! একবার একটা হাতি আমার চোখে পড়ল। তার শুডটা সিঁদুর আর হলুদে চিত্রিত। কানের ওপরে লাল সিল্কের দডি জড়ানো। হাতিটা একটা দোকানের উলটো দিকে দাঁড়িয়ে কমলালেবু খেতে লাগল। তাই দেখে হাসতে লাগল দোকানদার। তারা যে কী অদ্ভুত ধরনের মানুষ সেকথা তুমি কল্পনাও করতে পারবে না। আনন্দ হলে তারা কোনো পাখি-বিক্রির দোকানে গিয়ে খাঁচাসুদ্ধ পাখি কিনে আনে; তারপরে তাকে খাঁচা খুলে আকাশে উড়িয়ে দেয়। এতে তাদের আনন্দ আরো বেশি হয়। দুঃখ হলে যাতে, তাদের দুঃখ না কমে সেই জন্যে নিজেদের তারা কাঁটাগাছের চাবুক মারে।

একদিন সন্ধেবেলা দেখলাম কয়েকজন নিগ্রো একটা ভারী পালকি বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। রঙ করা। বাঁশ দিয়ে সেটা তৈরি; এর ডাণ্ডাগুলির মাথায় সীসের মযুর বসানো। জানালার ওপরে টাঙানো সূক্ষম মসলিনের পর্দা। আমার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় একটি সিরকাসিযেন মহিলা বিবর্ণমুখে আমার দিকে তাকিয়ে হাসল। আমি তাকে অনুসরণ করলাম। আমাকে দেখে নিগ্রোরা দাঁত খিচোল। কিন্তু আমার এতই কৌতূহল হয়েছিল যে আমি তাদের দাঁত খিচোনিকে গ্রাহ্য করলাম না।

তারপরে তারা একটা সাদা চৌকো ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালা এ ঘরে কোনো জানালা ছিল না; ছিল কবরের ভেতরে ঢোকার মতো একটা ফুটো। সেইখানে পালকিটা নামিয়ে একটা তামার হাতুড়ি দিয়ে বার-তিনেক তারা মাটি ঠুকল। একজন আর্মেনিয়ান তাদের দেখে দরজা খুলে একটা কার্পেট বিছিযে দিল। মহিলাটি বাইরে বেরিয়ে এল। ভেতরে ঢোকার সময় আমার দিকে তাকিয়ে সে আবার একটু হাসল। এত বিবর্ণ মুখ জীবনে আর কখনো আমি দেখিনি।

চাঁদ উঠলে আমি আবার সেখানে গেলাম; সেই বাড়িটা খুঁজলাম; কিন্তু কোনো বাডি চোখে পড়ল না। তখনই আমি বুঝতে পারলাম মেয়েটি কে, আর কেনই বা সে আমাকে দেখে হেসেছিল।

সত্যিই বলছি আমার সঙ্গে তোমার থাকা উচিত ছিল। অমাবস্যার দিন ওখানে যে ভোজের উৎসবর হয় সেইদিন প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে যুবক রাজকুমার প্রার্থনা করার জন্যে মসজিদে। ঢুকলেন। সূর্যোদয়ের সময় রুপোর পোশাক পরে তিনি প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে এলেন; সন্ধের সময় সোনার পোশাক পরে আবার তিনি ফিরে এলেন। জনতা তাঁর সামনে লম্বা হয়ে মাটিতে শুয়ে পড়ে নিজেদের মুখ ঢাকল, আমি কিন্তু তা করলাম না। একটা খেজুরের দোকানের পাশে দাঁড়িয়ে আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম। আমাকে দেখে সম্রাট তাঁর চিত্রিত ভুরু দুটি তুলে থেমে গেলেন। আমি তবু দাঁড়িয়ে রইলাম। তাঁকে সেলাম জানালাম না। আমার এই দুঃসাহসে সবাই অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল; আমাকে পালিয়ে যাওয়ার উপদেশ দিল। তাদের দিকে গ্রাহ্য না করে আমি কতগুলি ঘৃণ্য দেবতার স্টলে গিয়ে বিক্রেতাদের সঙ্গে বসে রইলাম। আমি কী করছই তা শুনে তাদের প্রত্যেকেই একটা দেবমূর্তি আমার হাতে দিয়ে তাদের কাছ থেকে সরে যেতে তারা আমাকে অনুরোধ জানাল।

সেইদিন রাত্রিতে ডালিম গাছে ভরা একটি রাস্তার ওপরে চা-এর দোকানে জাজিমের ওপরে আমি শুয়েছিলাম। এমন সময়ে সম্রাটের রন্ধীরা ঘরে ঢুকে আমাকে প্রাসাদে নিয়ে গেল। ভেতরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিটি ঘরের দরজা তারা বন্ধ করে শেকল এঁটে দিল। ভেতরে বিরাট একটা দরবার। তার চারপাশে বিরাট-বিরাট থামের ওপরে খিলান বসানো। দেওয়ালগুলি স্ফটিক পাথর দিয়ে তৈরি–মাঝে মাঝে নীল আর সবুজ টালি বসানো। এ রকম জায়গা এর আগে আমি কোনোদিন দেখিনি। দরবার দিয়ে যাওয়ার সময় ঘোমটায় ঢাকা দুটি মহিলা আমার দিকে তাকিয়ে আমাকে অভিসম্পাত দিল। প্রহরীরা দ্রুত হাঁটতে লাগল। তাদের বর্শার বাঁটগুলো মসৃণ মেঝের ওপরে লেগে শব্দ করতে লাগলা হাতির দাঁতের একটা দরজা খুলে তারা ভেতরে এল। দেখলাম আমি একটি জলসিক্ত বাগানের মধ্যে দাঁড়িয়ে। রয়েছি। এর ছাদ হচ্ছে সাতটা। একটা বাগান থেকে নাইটিংগেল পাখির গান শোনা যাচ্ছিল।

কিছুক্ষণ পরে প্রহরীদের দলপতি সবাইকে সরিয়ে দিতেই তারা সব প্রাসাদের দিকে ফিরে গেল। বাগানের শেষে একটা তাঁবু ছিল। তাদের বিদায় করে দলপতি আমাকে সেই তাঁবুর দিকে যাওয়ার জন্যে ইশারা করল। নির্ভয়ে এগিয়ে গেলাম আমি। তারপরে ভারী পর্দা সরিয়ে

ভেতরে ঢুকে গেলাম। যুবক সম্রাট রঙ করা সিংহের চামড়ায় ঢাকা একটা সোফার ওপরে। শুয়েছিলেন। তাঁর পেছনে সীসের পাগড়ি চাপিয়ে একজন নুবিযার ক্রীতদাস দাঁড়িয়েছিল। তার দু-ফাঁককরা কালের ওপরে দুটো বেশ ভারী মাকড়ি ঝুলছিল। সোফার পাশে ছিল একটা টেবিল। সেই টেবিলের ওপরে ছিল ইস্পাতের তৈরি বিরাট একখানা তরোযাল।

আমাকে দেখে সম্রাট ভ্রূকুটি করে ডিজ্ঞাসা করলেন–তোমার নাম কী? তুমি কি জান না আমি এখানকার সম্রাট? কিন্তু আমি কোনো উত্তর দিলাম না।

তিনি তখন সেই তরোয়ালটার দিকে আঙুল বাড়ালেন। এই দেখ সেই ক্রীতদাসটি সেটাকে তুলে নিয়ে ভীষণ জোরে আমাকে আঘাত করল। হুইস-হুঁইস শব্দে তরোয়ালের মুখটা। আমার ভেতর দিয়ে এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে গেল। কিন্তু আমার কোনো ক্ষতি করল না। এই দেখে লোকটা মেঝের ওপরে ডিগবাজি খেয়ে পড়ে গেল। যখন সে উঠল তখন তার দাঁতে দাঁত বসে গিয়েছে; সোফার পেছনে ভযে সে লুকিয়ে পড়ল। এই দেখে দাঁড়িয়ে উঠলনে সম্রাট ঘরের একপাশে কয়েকটা অস্ত্র দাঁড় করানো ছিল। সেখান থেকে একটা বর্শা তুলে নিয়ে। আমার দিকে ছুঁড়ে দিলেন। সেটা আমি ধরে ফেলে দু-আধখানা করে ফেললাম। তিনি একটা তীর ছুঁড়লেন; কিন্তু আমি হাত দুটো আকাশে তোলার সঙ্গে সঙ্গে তীরটাও মাঝখানে থেমে গেল। তখন তিনি কোমরবন্ধনী থেকে একটা ছোরা বার করে সেই ক্রীতদাসটির গলায় নলি কেটে দিলেন। তাঁর ভয় হচ্ছিল তাঁর অপমানের কথা যদি সে বাইরে প্রকাশ করে দেয়। লোকটা কাটা সাপের মতো মেঝের ওপর ন্যাকপ্যাক করতে লাগল; মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল। সাদা গ্যাঁজলা।

সে মারা যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সম্রাট আমার দিকে ঘুরে তাকালেন; তাঁর কপালের ওপরে তখন বড়ো বড়ো ফোঁটার ঘাম জমে উঠেছিল। ছোটো একটা রুমাল দিয়ে সেই ঘাম মুছে তিনি। আমাকে বললেন–আপনি কি নবী, না, ঈশ্বরের পুত্র যে আপনাকে আমি আঘাত করতে পারলাম না? আপনাকে অনুরোধ করছি আজ রাত্রিতেই আমার শহর ছেড়ে আপনি চলে যান। কারণ, যতক্ষণ আপনি এখানে থাকবেন ততক্ষণ আমি আর এখানে রাজত্ব করতে পারব না।

এই কথা শুনে আমি বললাম-তোমার ধনরত্নের অর্ধেক পেলে আমি চলে যেতে রাজি আছি।

সম্রাট আমার হাত ধরে বাগানে নিয়ে গেলেন। সেখানে একটা ঘর রয়েছে। সেই ঘরে শক্ত লাল পাথরের আটটা দেওয়াল। সম্রাট একটা দেওয়ালের গায়ে হাত দিতেই সেটো সরে গেল। আমরা সিড়ি দিয়ে নীচে নেমে গেলাম। সিড়িঁর তখন অনেকগুলো টর্চ একসঙ্গে জ্বলছিল। তুমি বললে বিশ্বাস করবে না কী অদ্ভুত সেই জায়গাটা! হীরে, মুক্তো, মণি, ডহরৎ, পান্না, চুনি, দামি-দামি পাথরে একেবারে বোঝাই।

সম্রাট বললেন–এই আমার ধনরত্ন। এর অর্ধেক আপনার। আমি প্রতিজ্ঞা করছি। আমি আপনাকে উট দেব, উট চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার লোক দেব। আপনি আপনার অর্ধেক সম্পত্তি নিয়ে আজ রাত্রেই এই শহর ছেড়ে চলে যান। পৃথিবীর যেখানেই যান না কেন আমার। লোকজন আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসবে। কিন্তু আভ রাত্রিতেই আপনাকে এখান থেকে চলে যেতে হবে। আমার শহরে এমন একডনি রয়েছেন যাঁকে আমি হত্যা করতে পারি নে এই কথাটা আমার পিতা সূর্যদেব জানতে পারুন তা আমি চাই নে।

বললাম-সোনা, রুপো, মূল্যবান সমস্ত পাথর যা এখানে রয়েছে তা সব তোমার। কিছুই আমার চাই নে। শুধু ওই ছোটো আংটিটা আমাকে দাও, ওই যেটো তুমি পরে আছ। তাহলেই। আমি চলে যাব।

সম্রাট ভ্রূকুটি করে বললেন–এটা তো সীসের আংটি। এর কোনো দাম নেই। তার চেয়ে আপনি বরং আমার অর্ধেক ধনরত্ন নিয়ে যান।

উহু! ওটা ছাড়া আর কিছুই আমি লেবু না। ওতে কী লেখা রয়েছে আর কী জন্যে লেখা রয়েছে তা আমি জানি।

সম্রাট কাঁপতে কাঁপতে বললেন–আমার অর্ধেক ধনরত্ন নিয়ে যান।

সেই শুনে আমি একটা অদ্ভুত কাজ করলাম। কিন্তু সেকথা থাকা আমি একটা গুহায় সেটা। লুকিয়ে রেখে এসেছি। ওটা হচ্ছে অর্থের আংটি। জায়গাটা এখান থেকে একদিনের যাত্রাপথ। এই আংটি যার হাতে থাকবে বিশ্বের সমস্ত ধন হবে তার। তুমি আমার সঙ্গে এসে সেটি গ্রহণ কর। বিশ্বের সম্পদ তোমার কারও হবে।

কিন্তু যুবক ধীরবটি হেসে বলল–অর্থের চেয়ে প্রেম অনেক বড়ো; এবং খুদে জল-অপ্সরীটি আমাকে ভালোবাসে। এই বলে সে সমুদ্রে ডুবে গেল। কাঁদতে-কাঁদতে ফিরে গেল আত্মা।

তৃতীয় বছরে শেষ হওয়ার পরে আত্মাটি আবার সমুদ্রোপকূলে ফিরে এসে ধীবরকে ডাকাল। ধীবর উঠে এসে ডিাসা করল–আমাকে ডাকছ কেন?

আত্মাটি বলল–আমার কাছে এস। আমি কত অদ্ভুত জিনিস দেখেছি। সে সব কথা তোমাকে আমি বলব। ধীবরটি অগভীর জলে এসে তার কাহিনি শোনার জন্যে হাতের ওপরে মাথাটা রেখে হেলান দিয়ে বসল।

আত্মাটি বলে গেল–আমি একটি শহরের কথা জানি, সেখানে নদীর ধারে একটা সরাইখানা রয়েছে। নাবিকরা সেখানে বসে দুটি বিপরীত-রঙা মদ্য পান করছিল, খাচ্ছিল বার্লির। রুটি–আর ভিনিগার মেশানো ছোটো ছোটো লোনা মাছ। তাদের পাশেই আমি বসেছিলাম। আমরা বসে-বসে ফুর্তি করছি এমন সময় একটি বৃদ্ধ এসে হাজির হল। তার হাতে একটি চামড়ার কার্পেট, আর দুটো অম্বরের শিং-ওয়ালা একটা বাঁশি। কাছে এসে সে কার্পেটটি বিছিয়ে সেই বাঁশির তারে পাখির একটা পালক দিয়ে আঘাত করল। সেই শব্দ শুনে ঘোমটায়। মুখ ঢেকে একটি বালিকা দৌড়ে এসে আমাদের সামনে নাচতে শুরু করল। তার পা দুটি ছিল অনাবৃত। ছোটো-ছোটো সাদা পায়রার মতো সে দুটি ঘুরতে লাগল। এমন অপরূপ নাচ ডীবনে আর কোনো দিনই আমি দেখিনি। যে শহরে মেয়েটি নাচে সেটি এখান থেকে একদিনের হাঁটাপথ মাত্র।

তার আত্মার কথা শুনে ধীবরের মনে হল তার প্রেমিকা অপ্সরীটির পা নেই। সে নাচতে পারে না। তাই হঠাৎ সেই নাচ দেখার প্রবল একটা ইচ্ছে হল তার সে নিজের মনে মনে। বলল–মাত্র একদিনের পথ। আমি আবার আমার প্রেমিকার কাছে ফিরে আসতে পারব। এই ভেবে একুট হেসে সে উপকূলের দিকে জল কেটে-কেটে এগিয়ে আসতে লাগল। শুকনো জায়গায় এসে একটু হেসে সে আত্মার দিকে হাতটা বাড়িয়ে দিল। আনন্দে চিৎকার করে তাকে সম্পূর্ণ করার জন্যে তার দিকে দৌড়ে গেল আত্মা; তারপরে তার ভেতরে ঢুকে গেল। যুবক ধীবরটি দেখতে পেল বালির ওপরে তার দেহের ছায়াটি লম্বা হয়ে পড়ে রয়েছে; আর। সেইটিই হচ্ছে তার আত্মার দেহ।

আত্মাটি বলল–আর অপেক্ষা করে লাভ কি? চল, আমরা তাড়াতাড়ি পালিযে যাই। কারণ সমুদ্রের দেবতারা বড়োই হিংসুটে, তাদের আজ্ঞা পালন করার জন্য দৈত্যেরা দৌড়ে আসে।

সুতরাং তারা তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এল, চাঁদের আলোতে তারা সারারাত হাঁটল; সূর্যের আলোতে হাঁটল সারাটা দিন; তারপর সন্ধের সময় তারা সেই শহরে এসে হাজির হল।

যুবক ধীবরটি জিজ্ঞাসা করল–এই শহরেই কি সেই মেয়েটি নাচে?

তার আত্মাটি বলল–এটা নয়! আর একটা। যাই হোক, চল, ভেতরে যাই।

সুতরাং তারা ভেতরে ঢুকল। রাস্তার দু’পাশে ভতুরিদের দোকান। তারা দেখল দোকানের। ওপরে একটা সুন্দর রুপোর কাপ বসানো রয়েছে। তার আত্মা বলল–ওই কাপটা নিয়ে লুকিয়ে ফেল।

সে কাপটা নিয়ে পোশাকের মধ্যে লুকিয়ে ফেলল।

শহর থেকে এক লিগের মতো দূরে গিয়ে ভ্রূকুটি করে কাপটা দূরে ছুঁড়ে দিল; তারপরে আত্মাকে বলল তুমি আমাকে কাপটা নিয়ে লুকিয়ে ফেলতে বললে কেন? কারণ, একাজ করা অন্যায়-তাই না?

আত্মা বলল–শান্ত হও, শান্ত হও।

দ্বিতীয় দিন সন্ধ্যায় তারা আর একটি শহরে এসে পৌঁছল। সে জিজ্ঞাসা করল–এই শহরেই কি সেই মেয়েটি নাচে?

তার আত্মা বলল–এই শহরে নয়। অন্য শহরে। তা হোক, চল, ভেতরে যাই।

সুতরাং তারা শহরে ঢুকলা চপ্পলের দোকানের পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে তারা দেখল এক কলসি জলের পাশে একটা ছেলে দাঁড়িয়ে রয়েছে। আত্মা তাকে বলল–এই ছেলেটাকে মার।

সে ছেলেটিকে এমন মার মারল যে ছেলেটি কাঁদতে লাগল। ছেলেটিকে মেরেই তারা তাড়াতাড়ি শহর ছেড়ে বেরিয়ে গেল।

শহর থেকে এক লিগের মতো পথ গিয়ে যুবক ধীবরটি চটে গিয়ে বলল–তুমি আমাকে। ছেলেটিকে মারতে বললে কেন? এটা অন্যায় কাজ তা তুমি ভাল না?

কিন্তু আত্মাটি বলল–শান্ত হও, শান্ত হও।

তৃতীয় দিনের সন্ধ্যাকালে তারা একটি শহরে এসে উপস্থিত হল। যুবকটি ডিজ্ঞাসা। করল–এটা কি সেই শহর?

আত্মা বলল–মনে হচ্ছে যেন। চল, ভেতরে যাই।

সুতরাং তারা ভেতরে ঢুকে হাঁটতে শুরু করল। কিন্তু কোথাও সে কোনো নদী বা নদীর ধারে কোনো সরাইখানা দেখতে পেল না। শহরের লোকেরা তার দিকে কৌতূহলের দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে রইল। ভয় পেয়ে সে আত্মাকে বলল–চল, আমরা এখান থেকে চলে যাই; কারণ সাদা

পা যার সে-মেয়েটি এখানে নাচে না।

কিন্তু আত্মা বলল–না, আমরা এখানে অপেক্ষা করি এস। কারণ রাত অন্ধকার। রাস্তার ওপরে ডাকাতরা সব ঘুরে বেড়াচ্ছে।

সুতরাং বাজারে সে বিশ্রাম নেওয়ার জন্যে বসে পড়ল। কিছুক্ষণ পরে, মাথার ওপরে উঁচুটুপি চাপিযে একজন বণিক সেইদিকে এল। তাতারী পোশাক তার গায়ে। বণিক তাকে বলল তুমি এই বাজারে বসে রয়েছে কেন? দোকান বন্ধ রয়েছে না?

যুবক ধীবর বলল–এই শহরে কোনো সরাইখানা দেখছি নে; অথবা, এমন কোনো আত্নীয়-স্বজন এখানে নেই যার বাড়িতে আমরা আশ্রয় পেতে পারি।

বণিকটি বলল–আমরা সবাই সকলের আত্মীয় বই কী? ঈশ্বরই কি আমাদের সবাইকে সৃষ্টি করেননি? সুতরাং আমার সঙ্গে এস; কারণ, আমার একটি অতিথি নিবাস রয়েছে। ধীবর উঠে দাঁড়াল; বণিকের পিছুপিছু তার বাড়িতে এসে হাজির হল। ঘরে ঢোকার পরে বণিক তাকে পাদ্য-অর্ঘ্য দিয়ে অভ্যর্থনা করল, তৃষ্ণা মেটানোর জন্য এনে দিল পাকা তরমুভ। খেতে দিল একথালা ভাত আর একতাল সেদ্ধ মাংস।

খাওয়া-দাওয়ার পরে বণিকটি তাকে অতিথি-নিবাসে নিয়ে গেল, তারপরে তাদের ঘুমিয়ে পড়তে বলল। ধীবরটি তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে পাঁঠার লোমের কার্পেটে শুয়ে পড়ল। তারপরে সে ঘুমিয়ে পড়ল।

 সকাল হতে তখন ঘণ্টা তিনেক বাকি, বলতে গেলে তখনো রাত্রি রয়েছে। আত্মা তাকে জাগিয়ে দিয়ে বলল–ওঠ; বণিক যে ঘরে শুয়ে রয়েছে সেই ঘরে গিয়ে তাকে হত্যা করা তারপরে তার ধনরত্ন নিয়ে নাও। কারণ, ওটার প্রয়োজন রয়েছে আমাদের।

 যুবক ধীরবটি উঠে গুঁড়ি দিয়ে বণিকের ঘরে হাজির হল। বণিকের পায়ের দিকে একটা বাঁকানো তরোয়আল পড়ে ছিল। হাত বাড়িয়ে সে তরোয়ালটা তুলে নিল। কিন্তু সেই মুহূর্তে বণিকটি জেগে উঠে বলল–উপকারের প্রতিদানে তুমি আমার এই অপকার করছ? তোমাকে যে দয়া আমি দেখিয়েছি তার পুরস্কার হিসাবে তুমি আমার রক্তপাত করছ?

আত্মা তাকে বলল তুমি ওকে আঘাত কর।

যুবক ধীবর বণিককে আঘাত করতেই সে অজ্ঞান হয়ে পড়ল। তারপরে ধীবরটি তার নটা সোনার থলি নিয়ে চটপট বেরিয়ে এল তার বাড়ি থেকে। তখন সকাল হয়েছে।

শহর থেকে তারা এক লিগের মতো দূরে গিয়েছে এমন সময় যুবক ধীবরটি নিজের বুক চাপড়ে বলল–বণিককে আঘাত করে তার সোনা নিতে তুমি আমাকে বললেন কেন? নিশ্চয় তুমি আমার দুর্গ্রহ।

কিন্তু আত্মা বলল–শান্ত হও, শান্ত হও।

যুবক ধীবর চিৎকার করে বলল–না, আমি শান্ত হব না। তুমি আমাকে দিয়ে যা করালে সেসব কাজ করে নিজের ওপরে আমার ঘৃণা হচ্ছে তোমাকেও আমি ঘৃণা করি। তুমি আমাকে এই সব কাজ করাতে বাধ্য করলে কেন তা বলতে আমি তোমাকে নির্দেশ দিচ্ছি।

 তার উত্তরে আত্মা বলল–যখন তুমি আমাকে বিদায় দিলে তখন হৃদয়টা আমাকে তুমি দাওনি। সেই জন্যেই এই সব কাজ করতে আমার ভালো লাগছে।

যুবক ধীবর গজগজ করল–কী বলছ তুমি?

আত্মা উত্তর দিল-তুমিই তা ভালো জান। তুমি যে আমাকে হৃদয় দাওনি সেকথা কি তুমি ভুলে গিয়েছ? সুতরাং আমার কথা ভেবে তুমি অশান্তি ভোগ করো না। শান্ত হও। কারণ এমন কোনো যন্ত্রণা নেই যা তুমি বিসর্জন দিতে পার না, এমন কোনো আনন্দ নেই যা তুমি পাবে না।

এই সব কথা শুনে কাঁপতে-কাঁপতে সে আত্মাকে বলল–উঁহু। তুমি দুর্গ্রহ। তুমি আমাকে। আমার ভালোবাসাকে ভুলতে বাধ্য করে। আমাকে প্রলুব্ধ করে। পাপের পথে পা দিতে আমাকে প্ররোচিত করেছ।

আত্মা বলল–আমাকে যখন তুমি পৃথিবীর বুকে ছেড়ে দিয়েছিলেন তখন যে তুমি আমাকে হৃদ্য দাওনি সেকথা তোমার ভুলে যাওয়া উচিত নয়। এস, অন্য এক শহরে আমরা যাই–সেখানে গিয়ে আনন্দ করি। আমাদের হাতে এখন ন‘থলে সোনা রয়েছে।

কিন্তু যুবক ধীবর সেই ন‘থলে সোনা নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে পা দিয়ে মাড়িয়ে দিল। তারপরে চিৎকার করে বলল–না, তোমাকে আমার আর প্রয়োজন নেই। তোমার সঙ্গে আর আমি কোথও যাব না। তোমাকে আগে একবার আমি যেমন বিতাড়িত করেছিলাম এখনো সেইরকম তাড়িয়ে দিচ্ছি। কারণ তুমি আমার কোনো দল করনি।

তবু আত্মা তার কাছ থেকে সরে গেল না বা তার কথায় কান দিল না, তাকে বলল–ডাইনি। তোমার ওপরে যে মোহ বিস্তার করেছিল তার মূল্য এখন আর কিছু নেই। কারণ, আমাকে তুমি পরিত্যাগও করতে পারবে না। তোমাকেও আমি ছেড়ে যাব না। মানুষ জীবনে একবার। মাত্র তার আত্মাকে বিসর্জন দিতে পারে; কিন্তু সেই আত্মাকে যখন সে ফিরে পায় তখন সারা। জীবনই তাকে তার ধরে রাখতে হয়। শান্তি বা পুরস্কার যাই বল এইটিই তার প্রাপ্য।

যুবক ধীবরটি এই কথা শুনে বিবর্ণ হয়ে গেল, সে হাত দুটো মুঠো করে চেঁচিয়ে বলল–ডাইনি ঝুটা। সে আমাকে একথা বলেনি কেন?

আত্মা বলল–না, ডাইনি তার দেবতাকে পূজা করে। তাঁর প্রতি সে অবিশ্বাসিনী নয়, তাঁকেই সে চিরকাল সেবা করবে।

যুব ধীবরটি যখন বুঝতে পারল যে আত্মাকে আর সে বর্জন করতে পারবে না, আর সেই আত্মা তার মঙ্গলের প্রতীক নয়, এবং সে তার সঙ্গে চিরকাল থাকবে তখন সে মাটির ওপর লুটিয়ে পড়ে ভীষণভাবে কাঁদতে লাগল।

সকাল হলে যুবক ধীবর উঠে তার আত্মাকে বলল–যাতে তোমার নির্দেশ পালন করতে না হয় সেই জন্যে আমার হাত দুটো বেঁধে ফেলব; যাতে তোমার কথা মুখে উচ্চারণ করতে না হয় সেইজন্যে ঠোঁট দুটো আমি বন্ধ করে রাখব। যেখানে অল্মরী থাকে, যে আমাকে ভালোবাসে, আমি সেইখানেই ফিরে যাব। আমি কী অন্যায় করেছি, আর তুমি আমার কী ক্ষতি করেছ সে-সব কথা তাকে আমি বলব।

আত্মা তাকে প্রলুব্ধ করে বলল–তোমার প্রেয়সী কে যে তুমি তার কাছে ফিরে যাবে? তার চেয়ে অনেক বেশি সুন্দর হচ্ছে এই পৃথিবী। এখানে স্যামারিস নর্তকীরা রয়েছে, তারা পাখি আর পশুদের মতো নাচতে পারে। তাদের পালি রঙ দিয়ে চিত্রিত; হাতে তাদের ছোটো-ছোটো তামার ঘন্টা। নাচতে-নাচতে তারা হাসে, তাদের হাসি জলের হাসির মতো। পরিচ্ছন্ন। আমার সঙ্গে এস; আমি তাদের দেখাব। যেটা পান করতে ভালো লাগে তার মধ্যে কি বিষ মেশানো থাকে? পাপ করে বলে চেঁচাচ্ছো কেন? বাজে চিন্তায় কষ্ট না পেয়ে আমার সঙ্গে আর একটি শহরে চল। কাছেই একটা ছোট্ট শহর রয়েছে। সেখানে টিউলিপ গাছের বাগান রয়েছ। এখানে অনেক মযুর রয়েছে। তাদের বুকগুলি সব নীল, সেখানে যে মেয়েটি তাদের খাওয়ায় সে মাঝে-মাঝে হাতের ওপরে নাচে, কখনো বা পায়ের ওপরে। তার নাকটি চড়াই পাখির ডানার মতো। নাচতে নাচতে সে হাসে; নাচার সময় তার নুপুরগুলি রুপোর ঘণ্টার মতো শব্দ করে। সুতরাং বাজে চিন্তা করে নিজেকে কষ্ট না দিয়ে আমার সঙ্গে সেই শহরে চল।

কিন্তু যুবকটি তার আত্মাকে কিছু না বলে ঠোঁট দুটি বন্ধ করে চোখ বুজে রইলা একটা শক্ত দড়ি দিয়ে বাঁধল তার দুটো হাত, যেখান থেকে এসেছিল সেইদিকে ফিরে গেল। তার আত্মা তাকে যতোই প্রলুব্ধ করার চেষ্টা করুক না কেন সে কোনো উত্তর দিল না। সে তাকে দিয়ে যত অন্যায় কাজ করানোর চেষ্টাই করুক না কেন সেদিকে সে কোনো ভ্রূক্ষেপই করল না। এমনি তার প্রেম।

সমুদ্রের তীরে গিয়ে সে হাতের দড়ি খুলে দিল, ঠোঁট দুটো খুলল; তারপরে জল-অপ্সরীকে ডাকল। সারাদিন ধরেই তাক ডাকল সে; কিন্তু জল-অপ্সরী তার ডাকে সাড়া দিল না।

তখন আত্মা তাকে বিদ্রূপ করে বলল–এখন বুঝতে পারছ প্রেয়সীর কাছ থেকে কোনো আনন্দ পাওয়ারই সম্ভাবনা তোমার নেই। মৃত্যুর সময় ভাঙা কলসির ভেতরে যে মানুষ জল ঢালে তোমার অবস্থা সেই রকমই তোমার যা রয়েছে তাই তুমি বিলিয়ে দিচ্ছ প্রতিদানে কিছুই পাচ্ছ না তুমি আনন্দের উপত্যকা কোথায় রয়েছে তা আমি জানি, সেখানে কী রয়েছে তাও আমার অজানা নয। তাই আমার সঙ্গে আসাই তোমার ভালো।

কিন্তু যুবকটি কোনো উত্তর দিল না; পাহাড়ের ওপরে কঞ্চির একটা ঘর তৈরি করে সেখানে সে। বছর খানেক বাস করল। প্রতিটি দিন সকাল, দুপুর আর রাত্রি চব্বিশ ঘন্টাই সে জল-অপ্সরীকে ডাকত তবু সাগর থেকে উঠে কোনোদিনই সে তাকে দেখা দিল না। তার আত্মা প্রতিদিনই খারাপ কাজ করার জন্যে তাকে প্রলুব্ধ করতে লাগল, কিন্তু তাকে প্রলুব্ধ। করতে পারল না।

বছর খানেক পরে আত্মা ভাবল আমাকে প্রভুকে খারাপ কাজ করার জন্যে আমি প্রলুব্ধ করেছি; কিন্তু আমার চেয়ে তার প্রেমের শক্তি বেশি। আমি এখন তাকে ভালো কাজ করার জন্যে প্রলুব্ধ করব। তাহলে হয়তো সে আমার সঙ্গে আসে পারে।

এই ভেবে সে যুবক ধীবরকে বলল–বিশ্বে যত আনন্দ রয়েছে সে সব কথা আমি তোমাকে বলেছি। তুমি সেসব কথায় কান দাওনি। এখল জগতের দুঃখের কথা আমাকে বলতে দাও। তাহলে হয়তো তুমি তা শুনবে। কারণ সত্যি কথা বলতে কি যন্ত্রণাই হচ্ছে বিশ্বের সম্রাট। এমন কেউ নেই যে সে হাত থেকে বাঁচতে পারে। কারও কারও পরার পোশাক নেই, কারও নেই খাবার। এমন অনেক বিধবা রয়েছে যারা রক্তাক্ত হৃদয়ে বেঁচে রয়েছে এমন অনেক পতিহীনা রয়েছে যারা ছিন্ন পোশাকে বসে থাকে; রাজপথের ওপর দিয়ে ভিক্ষুকরা ঘুরে বেড়ায়; তাদের টাকার থলি শূন্য। শহরের পথে-পথে দুর্ভিক্ষ ঘুর বেড়ায; প্লেগ বসে রয়েছে তাদের ঘরের দরজায। এস, এদের দুঃখ আমর দূর করি। এখানে প্রেমিকাকে ডেকে ডেকে তুমি বৃথা সময়। নষ্ট করছ কেন? দেখতেই পাচ্ছ তোমার ডাকে সাড়া দিচ্ছে না অপ্সরী। তাছাড়া, প্রেমের দামই বা কী?

কিন্তু যুবক ধীবর কোনো উত্তর দিল না। তার প্রেমের শক্তি এতই বেশি চব্বিশ ঘন্টাই সে তার প্রেয়সীকে ডাকতে লাগল-সকাল, দুপুর, সন্ধ্যা। কিছু অপ্সরীর দেখা সে পেল না। কোথাও সে তাকে দেখতে পেল না।

দ্বিতীয় বছর এইভাবে শেষ হওয়ার পরে একদিন রাত্রিতে নির্জনে আত্মা তাকে বলল–শোন; তোমাকে আমি অন্যায় কাজ করার জন্যে প্রলুব্ধ করেছি, প্রলুব্ধ করেছি ভালো কাজ করার। জন্যে। কিন্তু দেখছি, আমার চেয়ে প্রেমর শক্তিই তোমার কাছে অনেক বেশি। তাই তোমাকে আর আমি প্রলুব্ধ করব না। অনুরোধ করছি, আমাকে তোমার হৃদয়ে প্রবেশ করতে দাও। আগের মতোই তোমার সঙ্গে মিলে মিশে একাকার হয়ে যাই।

যুবক ধীবর বলল–নিশ্চয়, নিশ্চয়। কারণ হৃদয়হীন হয়ে তুমি যখন বিশ্বে ঘুরে বেড়িয়েছিলে তখন নিশ্চয়ই খুব দুঃখ পেযেছিলে।

আত্মা চিৎকার করে বলল–হায়, হায়! তোমার হৃদয় প্রেমে এমনই ভরাট হয়ে রয়েছে যে ঢোকার কোনো পথই যে আমি পাচ্ছি নে।

সে এই কথা বলার সঙ্গে-সঙ্গে সমুদ্র থেকে বিরাট একটা আর্তনাদ উঠল। সমুদ্রের কোনো অধিবাসী মারা গেলে মানুষ এইরকম আর্তনাদ শুনতে পায়। এই শুনে যুবক ধীবর লাফিয়ে উঠল; তার কঞ্চির ঘর ছেড়ে দৌড়ে নেমে এল নীচে। কালোকালো ঢেউগুলি ঝাঁপিয়ে পড়ল। তীরের ওপরে। সঙ্গে নিয়ে এল বরফের চেয়ে সাদা একটি বস্তু। দেখে মনে হবে, তীরের ওপরে আছড়ে-পড়া সমুদ্র তরঙ্গ। তরঙ্গের ওপরে ফুলের মতো সেটা যেন আছাড় খেয়ে পড়ল। তাকে তরঙ্গ-শিশুরা তুলে নিল সমুদ্রের কাছ থেকে তাদের কাছ থেকে তাকে তুলে নিল ফেলারা। শেষ পর্যন্ত তাকে তুলে নিল উপকূলে তারপরে দেখা গেল ধীবরের পায়ের কাছে পড়ে রয়েছে জল-অপ্সরীর দেহটি-জল-অপ্সরীর মৃতদেহ।

যন্ত্রণায় পাগল হয়ে সে তার পাশে ঝাঁপিয়ে পড়ে তার রক্তাক্ত ঠান্ডা ঠোঁটের ওপরে চুমু খেতে লাগল, তার সেই ভিজে সোনালি চুলগুলির ভেতরে আঙুল বোলাতে লাগল, বালির ওপরে লুটিয়ে পড়ে আনন্দ উত্তেজনায় কাঁপতে কাঁপতে সে কাঁদতে লাগল, দু’হাতে বুকের ওপর জড়িয়ে ধরল তাকে। তার ঠোঁট দুটি ঠান্ডা; তবুও সে তাকে চুম্বন করতে লাগল। তার চুলের স্বাদ নোনা। তবু একটা তিক্ত আনন্দে সে তাকে চুম্বন করল।

সেই মৃতদেহের কাছে সে তার পাপের স্বীকারক্তি করল। তিক্ত, তিক্ত তার আনন্দ; তার যন্ত্রণা একটি অদ্ভুত মাদকতায় উঠল ভরে।

কালো সাগর ক্রমশ তার কাছে এগিয়ে। কুষ্ঠরোগীর মতো সাদা ফেনা করতে লাগল বিলাপ ফেলার সাদা নখ দিয়ে সমুদ্র আঁচড়ে ধরল উপকূলকে। সমুদ্র সম্রাটের প্রাসাদ থেকে আবার বিলাপ ধ্বনি উঠল।

আত্মা বলল–পালাও, পালাও, সমুদ্র এগিয়ে আসছে। আর দেরি করলে ও তোমাকে হত্যা করে ফেলবে। পালাও, পালাও। তোমার মহৎ প্রেমের জন্যে, ভয় হচ্ছে, আমার প্রবেশের পথ হৃদয় তোমার রুদ্ধ করে দিয়েছে। নিরাপদ জায়গায় পালিয়ে যাও। নতুন জগতে নিশ্চয় তুমি আমাকে হৃদয়হীন অবস্থায় তাড়িয়ে দিতে চাও না।

কিন্তু যুবক ধীবর তার আত্মার আবেদনে সাড়া দিল না, সে অপ্সরীকে সম্বোধন করে বুলল–জ্ঞানের চেয়ে প্রেম মহর, সম্পদের চেয়ে অনেক বেশি মূল্যবান, নর্তকীর পায়ের চেয়ে। অনেক বেশি সুন্দর। আগুনে তাকে ধ্বংস করতে পারে না, জল পারে না তাকে নিঃশেষে পাল করতে। প্রভাতে তোমাকে আমি ডেকেছিলাম। সেই ডাক শুনে তুমি এসেছিলো চাঁদ তোমার নাম ডাকতে শুনেছিল; কিন্তু সে-ডাকে তুমি সাড়া দাওনি। কারণ অন্যায় কাজ করার জন্যে আমি তোমাকে ছেড়ে এসেছিলাম। এবং নিজের ক্ষতি করে আমি বিশ্বময় ঘুরে বেড়িয়েছি। তবু তোমার প্রেম আমার হৃদয়ে ভাস্বর হয়ে ছিল। যদিও আমি ভালো আর মন্দ দুই-ই দেখেছি, তবু কেউ তোমার প্রেম থেকে আমাকে বিচ্যুত করতে পারেনি। এখন তুমি মারা গিয়েছ। আমিও নিশ্চয় তোমার সঙ্গেই মারা যাব।

আত্মা তাকে নিরাপদে সরে যেতে অনুরোধ করলেও সে তার কথায় কর্ণপাত করল না। তার ভালোবাসা এতই বিরাট ছিল। সমুদ্র ধীরে-ধীরে কাছে আসতে লাগল তার ঢেউ দিয়ে তাকে গ্রাম করতে চাইল। যখন সে বুঝতে পারল তার সময় শেষ হয়ে আসছে তখন সে উন্মাদের মতো অপ্সরীকে চুমি খেতে লাগল; সেই দুঃখে ভেঙে যেতে লাগল তার হৃদযটা। প্রেমের প্রাচুর্যে তার হৃদযটা ভেঙে যাওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে ভেতরে ঢোকার সুযোগ পেল আত্মা-ভেতরে ঢুকে আগের মতোই ধীবরের সঙ্গে আবার এক হয়ে গেল। সমুদ্র এসে তার তরঙ্গ দিয়ে ঢেকে দিল তাকে।

প্রভাতে সমদ্রকে আশীর্বাদ করার জন্যে পাদরি এসে হাজির হলেন, কারণ, সমদ্র বেশ অস্থির হয়ে উঠেছিল। তাঁর সঙ্গে এলেন সন্ন্যাসী আর গাযকরা; আর এলো বাতিধারী কয়েকজন–আর এলো বিরাট একট দল। সমুদ্রের তীরে এসে দেখলেন যুবক ধীবরটি সমুদ্রের জলে ডুবে মরে রয়েছে; তাঁর হাত দুটি জড়িয়ে রয়েছে মৃত জল-অপ্সরীর দেহটিকে। কুটি করে তিনি ঘুরে দাঁড়ালেন, তারপরে বললেন–এই সমুদ্র বা এই সমুদ্রের কোনো কিছুকেই আমি আশীর্বাদ করব না। সমুদ্রের বাসিন্দারা সব অভিশপ্ত, আর অভিশপ্ত তারা যারা এদের। সঙ্গে মেলামেশা করে আর সেই লোকটি যে তার ভালোবাসার জন্যে ঈশ্বরকে ভুলে। গিয়েছিল, এবং সেই ঈশ্বরের বিচারেই যে তার প্রণঘিনীর পাশে নিহত অবস্থায় পড়ে রয়ছে। তার দেহ আর তার প্রণয়িনীর দেহ এখান থেকে তুলে নিয়ে ফুলারাস-এর মাঠের এক কোণে কবর দাও। তাদের ওপরে কোনো চিহ্ন বা স্মৃতিস্তম্ভ থাকবে না। ওখানে কাদের কবর দেওয়া হয়েছে সেকথা কেউ যেন জানতে না পারে। কারণ বেঁচে থাকতেও তারা অভিশপ্ত ছিল, মৃত্যুতেও তারা তাই।

তিনি যা বললেন লোকেরা তাই করল। ফুলারাস-এর মাঠের এক কোণে যেখানে কোন শাকসজি জন্মাতো না, তারা গভীর গর্ত খুঁড়ে সেই মৃতদেহ দুটিকে শুইয়ে দিল।

তৃতীয় বছর শেষ হলে ধর্মীয় অনুষ্ঠানের দিনে পাদরি গির্জায় গেলেন। ঈশ্বরের ক্ষত দেখানোর জন্যে সেখানে তিনি উপস্থিত হলেন। অনেক লোকও জমায়েত হয়েছিল সেখানে। ঈশ্বরের ক্রোধের সম্বন্ধে তাদের তিনি কিছু বলতে চেয়েছিলেন।

ধর্মীয় অনুষ্ঠানের পোশাক পরে, তিনি গির্জায় ঢুকেলেন, বেদীর সামনে নোয়ালেন তাঁর মাথা। এমন সময় তাঁর চোখে পড়ল বেদীর ওপরে অদ্ভুত কতগুলি ফুল ছড়ানো রয়েছে। দেখতে সেগুলি কেবল অদ্ভুত-ই নয়-সৌন্দর্যও তাদের বড়ো অদ্ভুত। সেই সৌন্দর্য তাঁকে অস্থির করে তুলল। তাদের গন্ধ তাঁর নাকে ঢুকল। কারণটা বুঝতে পারলেন না বটে, কিন্তু তাঁর বেশ ভালো লাগল। গির্জার দরজা খুলে রঙিন চিঠির কাগজটা বার করলেন। তারপরে কাপড়ের মধ্যে সেটিকে জড়িয়ে ঈশ্বরের ক্রোধের কথা সমবেত জনতাকে বোঝাতে চাইলেন। কিন্তু সাদা ফুলগুলির সৌন্দর্য তাঁকে অস্থির করে তুলল। কিন্তু সে সব কথা তাঁর মুখ দিয়ে বেরোল না; যা বেরোল তা হচ্ছে প্রেমময় ঈশ্বরের কথা।

সেই কথা শোনার পরে সবাই অশ্রু বিসর্জন করল। গির্জার যে সব কর্মচারী কবর খোঁড়ার কাজ করে তাদের কাছে তিনি গেলেন। চোক দুটোতে তখন তাঁর জল ছাপিয়ে উঠেছে। নিম্নপদস্থ কর্মচারীরা এসে তাঁর ধর্মীয় পোশাকগুলি খুলে দিল। তিনি স্বপ্নাচ্ছন্ন হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন।

পোশাক খোলার পর্ব শেষ হলে তিনি তাদের দিকে চেয়ে জিজ্ঞাসা করলেন–দেবীর ওপরে যে ফুলগুলি ছড়ানো রয়েছে ওগুলি কী ফুল? কোথা থেকেই বা ওগুলি তোমরা সংগ্রহ করেছ?

তারা বলল–ফুলগুলি কী তা আমরা জানি নে, কিন্তু ওগুলি এসেছে ফুলারাস-এর মাঠ থেকো।

 এই কথা শুনে পাদরি কেঁপে উঠলেন নিজের ঘরে গিয়ে প্রার্থনায় বসলেন।

পরের দিন প্রত্যুষে, সঙ্গীদের নিয়ে তিনি সমুদ্রের তীরে এসে হাজির হলেন; সমুদ্রকে আশীর্বাদ করলেন; সেই সঙ্গে আশীর্বাদ করলেন সমুদ্রে যারা বাস করে তাদেরও রোমক বনদেবতা, বনের মধ্যে যে সব ছোটো ছোটো প্রাণি নেচে-নেচে বেড়ায তাদের আশীর্বাদ। করলেন–ঈশ্বরের সমস্ত সৃষ্ট প্রাণীদের মঙ্গলের জন্যে প্রার্থনা করলেন তিনি। জনতার মন আনন্দে ভরে উঠল। তারপর থেকে ফুলারাস-এর মাঠে আর কোনোদিন কোনো ফুল ফোটেনি; আগের মতোই জায়গাটা অনুর্বর রয়ে গেল। সামুদ্রিক প্রাণীরা আগের মতো সেই উপকূলে আর এল না–তারা অন্য উপকুলে চলে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *