দেবকুমার
The Star-Child
একদিন দুজন দরিদ্র কাঠুরিয়া বিরাট একটা পাইন বনের ভিতর দিয়ে হাঁটছিল। শীতকাল। ঠান্ডা কনকনে রাত। মাটির ওপরে গাছের পাতায় বেশ পুরু পুরু বরফ জমেছে। তাদের পথের দু’পাশে ঘন বরফের চাঁই মটমট করে পল্লবগুলিকে ভেঙে দিচ্ছে। হাঁটতে-হাঁটতে যখন তারা পাহাড়ি ঝর্নার কাছে এল তখন ঝর্নাটা নির্জীব হয়ে বাতাসে ঝুলছে; কারণ, বরফ-রাজ তাকে চুমু খেয়েছে। এত ঠান্ডা যে কী করবে তা তারা ভেবে পেল না।
দুটো পায়ের ভেতরে ন্যাজটা ঢুকিয়ে দিয়ে বনের মধ্যে খোঁড়াতে-খোঁড়াতে নেকড়ে বাঘ ঘোঁৎ-ঘোঁৎ করে বলল–উঃ! আবহাওয়া বটে একখানা! সরকার এ-সম্বন্ধে কোনো ব্যবস্থা করে না কেন?
সবুজ রঙের লিনেট পাখিরা গানের সুরে বলে-হুইট! হুইট! হুইট! পুরনো পৃথিবীটা মরে গিয়েছে। সাদা চাদরে তার মৃতদেহটাকে ওরা দিয়েছে ঢেকে।
টার্টল ডাভেরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতে লাগল–পৃথিবীর আজ বিয়ে হবে; তাই সে সাদা পোশাক পরেছে। তাদের লাল টুকটুকে পাগুলি তুষারে ক্ষতবিক্ষত হয়ে উঠেছিল। কিন্তু তারা মনে করেছিল এই অবস্থায় তাদের কিছু রোমান্টিক হওয়া উচিত।
দাঁত খিচোল নেকড়ে বাঘ–মূর্খ কোথাকার! আমি বলছি এই উৎপাতের জন্যে আমাদের সরকারই দায়ী। আমার কথা যদি তোরা বিশ্বাস না করিস তাহলে আমি তোদের খেয়ে ফেলব। নেকড়ের বাস্তব বুদ্ধিটা অত্যন্ত প্রখর ছিল; কোনো একটা যুৎসই যুক্তি খাড়া করতে সে পিছপা হত না।
কাঠঠোকরা পাখি দার্শনিক হয়েই জন্মেছে। সে বলল আমার কথা যদি ধর তাহলে আমি ওসব অ্যাটমিক থিয়োরিতে বিশ্বাসী নই। আসল কথাটা হল কোনো জিনিস যদি কোনো একরকম হয় তাহলে সেটা সেই রকমই হবে এবং বর্তমানে সত্যিই বড়ো ঠান্ডা পড়েছে।
সত্যিই প্রচণ্ড ঠান্ডা। লম্বা ফার গাছের কোটরে বসে বাচ্চা কাঠবিড়ালিরা নিজেদের গরম রাখার জন্যে পরস্পরের নাক ঘষে দিচ্ছিল। খরগোসেরা নিজেদের গর্তের মধ্যে গুঁড়ি দিয়ে শুয়ে রইল; বাইরে তাকাতে ভরসা পেল না। সেই শীতের রাত্রিতে একমাত্র যাদের বেশ আনন্দ হল তারা হচ্ছে শিংওয়ালা ওই পেঁচারা। তারা তাদের বড়ো-বড়ো হলদে চোখ পাকাতে-পাকাতে বনের একপ্রান্ত থেকে আর এক প্রান্ত পর্যন্ত আনন্দে ডাকাডাকি শুরু করল–টুইট! টু-টুইট! কী চমৎকার আবহাওয়া!
আমাদের সেই দুটি কাঠুরে চলছে তো চলছেই। মাঝে মাঝে আঙুল ঝেড়ে তারা বরফ সরাচ্ছে, আর বিরাটাকার লোহার জুতো ঠুকে বরফের চাঁই ভাঙছে। একবার তারা বরফের খাদে পড়ে গেল; যখন ওপরে উঠল তখন তারা একেবারে সাদা হয়ে গিয়েছে একবার তারা জমাট-বাঁধা জলায় পড়ে গেল। জ্বালানি কাঠগুলি ছিটকে পড়ল তাদের কাঁধ থেকে। আবার সেগুলি কুড়িয়ে বেশ ভালো করে কাঁধে বাঁধতে হল তাদের। একবার তারা পথ হারিয়ে ভীষণ ভয় পেয়ে গেল; কারণ তারা জানত বরফের মধ্যে যারা ঘুমিয়ে পড়ে তাদের ওপরে বরফ বড়ো নির্দয় ব্যবহার করে। কিন্তু পথিকদের দেবতা সেন্ট মার্টিনের ওপরে বিশ্বাস রেখে ঠিক রাস্তায় ফিরে এল তারা। অবশেষে তারা বনের সীমান্তে এসে হাজির হল। দূরে দেখতে পেল তাদের গ্রামে বাতি জ্বলছে। অরণ্যের বিভীষিকা থেকে মুক্তি পেয়ে তারা এতই খুশি হয়ে উঠল যে তারা জোরে-জোরে হাসতে লাগল। তাদের কাছে মনে হলে পৃথিবীটা রূপালি ফুলের মতো; আর চাঁদটি হচ্ছে যেন সোনাল ফুল।
কিন্তু হাসি বন্ধ হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে নিজেদের দারিদ্র্যের কথা স্মরণ করে তারা বেশ মুষড়ে পড়ল। একজন বলল–আমরা আনন্দ করলাম কেন? জীবনটা তো হচ্ছে ধনীদের জন্যে, আমাদের মতো গরিবদের জন্যে নয়। এর চেয়ে বরং ওই বনের মধ্যে ঠান্ডায় মরে যাওয়াই আমাদের পক্ষে ভালো ছিল অথবা কোনো বন্য জন্তু যদি আমাদের খেয়ে ফেলত তাহলেও আমরা কোনো দুঃখ করতাম না।
তার সঙ্গীটি বলল–ঠিকই বলেছ। কাউকে-কাউকে অনেক জিনিস ঈশ্বর দেন; আবার কাউকে কাউকে ঈশ্বর কিছুই দেন না। অন্যায়টাই পৃথিবীতে রমরমিয়ে বেড়াচ্ছে। দুঃখ ছাড়া সমান ভাগে ভাগ করে নেওয়ার-ও কিছু নেই এ জগতে।
তারা দুজনেই যখন এইভাবে বিলাপ করছিল ঠিক সেই সময় ব্যাপারটা ঘটল। আকাশ থেকে একটা উজ্জ্বল আর সুন্দর নক্ষত্র পৃথিবীর বুকে নেমে এল। তারা অবাক হয়ে দেখল তাদের কাছ থেকে অনতিদূরে একঝাঁক উইলো গাছের পেছলে সেই দ্যুতিময় নক্ষত্রটা পড়ে গেল।
তারা চিৎকার করে উঠল–ওখানে একটা সোনার তাল পড়েছে। আমাদের মধ্যে যে দেখতে পাবে ওটা হবে তারই।
এই বলেই তারা ছুটতে শুরু করল। সোনার লোভ তাদের এত!
তাদের মধ্যে একজন দৌড়ে তার সঙ্গীকে টপকে উইলো গাছগুলির ওপাশে হাজির হল; সত্যিই তো সাদা বরফের ওপরে একটা সোনার জিনিস পড়ে রয়েছে। এই দেখেই সে জিনিসটার দিকে দৌড়ে গিয়ে তার ওপরে হাত রাখল। সেটা সোনালি আলখাল্লায় মোড়া; সেই আলখাল্লার ওপরে তারকা চিহ্ন রয়েছে অনেগুলি। জিনিসটা সেই আলখাল্লা দিয়ে বেশ ভালো করে জড়ানো এই দেখেই সে তার সঙ্গীকে চিৎকার করে ডাকল। সঙ্গীটি এলে তারা দুজনে পাটের পর পাট খুলতে লাগল। তারা ঠিক করেছিল ভেতরে যদি কিছু সোনা-দানা থাকে তাই তারা ভাগ করে নেবে। কিন্তু হায়রে কপাল! সেই ভাঁজ খুলে তারা না পেল কোনো সোনা, না পেল কোনো রুপো; এমন কি মূল্যবান কোলো ধাতুও দেখতে পেল না তারা। যা দেখল তা হছে একটা ছোট্ট শিশু। শিশুটা ঘুমোচ্ছে।
এই দেখে একজন আর একজনকে বলল–কী তিক্তভাবেই না আমাদের আশার পরিসমাপ্তি হল! কিছুই লাভ হল না আমাদের। কারণ, মানুষের কাছে শিশুর দাম কী? একে এখানেই ফেলে রেখে যাই চল। আমরা গরিব লোক। আমাদের ছেলেও কম নেই, তাদের খাবার থেকে কিছুটা কেটে একে খাওয়াতে আমরা পারব না।
কিন্তু তার সঙ্গীটি বলল–উহু। শিশুটিকে এইভাবে মৃত্যুর মুখে ফেলে যাওয়াটা খারাপ হবে। যদিও তোমার মতোই আমিও গরিব, ছেলেমেয়েদের খাইয়ে যদিও আমার কিছুই আর অবশিষ্ট থাকে না, তবুও একে আমি বাড়িতে নিয়ে যাই। আমার স্ত্রী একে দেখবে।
এই বলে পরম যত্নে শিশুটি সে কোলে তুলে নিল, ঠান্ডার হাত থেকে তার নরম দেহটাকে বাঁচানোর জন্যে সেই আলখাল্লাটা দিয়ে বেশ ভালো করে তাকে জড়াল, তারপরে তার বাড়ির দিকে এগিয়ে গেল। তার এই মূর্খতা আর নরম হৃদয় দেখে তার সঙ্গীটি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল তার দিকে।
তার স্ত্রী দরজা খুলে দিল। স্বামী নিরাপদে ফিরে এসেছে দেখে দু’হাতে তার গলা জড়িয়ে ধরে সে চুমু খেল, তার কাঁধ থেকে খুলে নিল জ্বালানি কাঠ, জুতো থেকে সরিয়ে দিল বরফের কুচি, তারপরে ভেতরে আসতে বলল তাকে।
কিন্তু সে তার স্ত্রীকে বলল–বন থেকে আমি একটা জিনিস কুড়িয়ে এনেছি। আমার ইচ্ছে তুমি এর যত্ন নেবে।
তার স্ত্রী আনন্দে বলে উঠল-কী এনেছ–দেখি, দেখি! ঘরে আমাদের অনেক কিছু জিনিসের অভাব রয়েছে।
এই কথা শুনে সে আলখাল্লাটা সরিয়ে ঘুমন্ত শিশুটিকে দেখাল।
স্ত্রী তো রেগে গরগর করে উঠল-এ কী করেছ তুমি! শিশু! আমাদের নিজেদের ছেলেমেয়েই কি কম যে আর একজনকে তাদের খাবারের ভাগ দিতে হবে! তাছাড়া, কে জানে ও আমাদের দুর্ভাগ্য ডেকে আনবে কি না। আর ওকে মানুষই বা আমরা করব কী করে?
সে বলল–কোনো দুর্ভাগ্য আনবে না; কারণ ও একটি দেবকুমার।
এই বলে সে সেই অদ্ভুত কাহিনিটি তার কাছে বর্ণনা করল।
কিন্তু স্ত্রীকে খুশি করা গেল না। সে ব্যঙ্গ করে বলতে লাগল আমাদের ছেলেমেয়েদেরই খাবার নেই, আবার পরের ছেলে এনেছে! এ-বিশ্বে আমাদের জন্যে ভাবনা করে কে? কে আমাদের খাবার দেয়?
সে বলল–চড়াই পাখিদের কথাও ঈশ্বর ভাবেন, তাদেরও খেতে দেন তিনি।
কিন্তু শীতকালে খেতে না পেয়ে সেই চড়াইরাও কি মারা যায় না? আর এখন কি সেই শীতকাল নয়?
লোকটি কোনো উত্তর দিল না; চৌকাঠ থেকে ভেতরেও ঢুকল না। বাইরে থেকে ঠান্ডা কনকনে বাতাস এসে তার স্ত্রীকে কাঁপিয়ে দিতে লাগল। কাঁপতে কাঁপতে তার স্ত্রী বলল–তুমি কি দরজাটা বন্ধ করবে না? বাইরে থেকে ঠান্ডা হাওয়া আসছে। আমি জমে গেলাম যে।
সে জিজ্ঞাসা করল–যে বাড়িতে কঠিনহৃদয় মানুষ বাস করে সেখানে সব সময় কি ঠান্ডা কনকনে বাতাসে বয় না?
কোনো উত্তর না দিয়ে তার স্ত্রী আগুনের ধারে এগিয়ে গেল। কিছুক্ষণ পরে সে ঘুরে দাঁড়িয়ে তার দিকে চাইল। তার চোখ দুটি তখন জলে ভরে উঠেছে। এই দেখে সে চট করে ভেতরে ঢুকে এসে শিশুটিকে তার কোলে দিয়ে দিল। সে শিশুটিকে চুমু খেয়ে তার সবচেয়ে বাচ্চা ছেলেটির পাশে শুইয়ে দিল। পরের দিন সকালে কাঠুরে সোনার তৈরি সেই অদ্ভুত পোশাকটিকে তাদের বড়ো সিন্দুকটার ভেতরে রেখে দিল। শিশুটির গলায় হলদে রঙের যে হারটা ছিল তার স্ত্রী সেটাও খুলে নিয়ে সেই সিন্দুকটার মধ্যে ঢুকিয়ে রাখল।
এইভাবে কাঠুরের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে সেই দেবকুমারটি বাড়তে লাগল, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার সৌন্দর্যও বাড়তে লাগল। গাঁয়ের সবাই তার সেই সুন্দর চেহারার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকত। কিন্তু সেই সৌন্দর্যই তার কাল হল। কারণ সে খুব গর্বিত, নিষ্ঠুর আর সেই সঙ্গে স্বার্থপর হয়ে উঠল। কাঠুরের আর অন্যান্যদের ছেলেমেয়েদের সে ঘৃণা করতে লাগল। তার নিজের জন্ম হয়েছে নক্ষত্রলোক থেকে আর তারা সবাই অশিক্ষিত বংশের এই কথা বলে তাদের ওপর সে প্রভুত্ব বিস্তার করল–তাদের দেখতে লাগল চাকর-বাকরের মতো। যারা দরিদ্র, অন্ধ অথবা বিকলাঙ্গ তাদের ওপরে তার কোনো মমতা ছিল না। তাদের দেখলেই সে ঢিল মেরে গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দিত। ফলে, এক ডাকাত ছাড়া আর কেউ তাদের গ্রামে আসতে সাহস করত না। নিজের সৌন্দর্যে সে এতই মুগ্ধ হয়ে পড়েছিল যে পাদরির পাতকুয়ার ধারে গিয়ে জলের ভেতরে সারাদিনই প্রায় সে নিজের মুখ দেখত, আর তারিফ করত নিজের সুন্দর মুখমণ্ডলকে।
কাঠুরে আর তার স্ত্রী এই জন্যে তাকে প্রায়ই তিরস্কার করে বলত–দুঃস্থদের সঙ্গে তুমি যেরকম ব্যবহার কর, আমরা তো তোমার সঙ্গে সেরকম ব্যবহার করি নে। যারা করুণার পাত্র তাদের সঙ্গে তুমি অমন নিষ্ঠুর ব্যবহার কর কেন?
পাদরি তাকে প্রায়ই ডেকে এনে বলতেল-মাছিও তোমার ভাই, তাদের তুমি কোনো ক্ষতি করো না। বনের পাখিদেরও স্বাধীনতা রয়েছে। স্ফূর্তির জন্যে তুমি তাদের জাল পেতে ধরো না। কানা, খোঁড়া, ছুঁচো–সবাইকেই ঈশ্বর সৃষ্টি করেছেন। এই বিশ্বে তাদেরও একটা জায়গা রয়েছে। ঈশ্বরের পৃথিবীতে এই অনাচার করার তোমার অধিকার কী রয়েছে? এমন কি মাঠের গবাদি পশুরাও ঈশ্বরের মহিমা কীর্তন করে।
কিন্তু কোনো উপদেশই তার কানে ঢুকল না। নিজেকে সে এতটুকুও শোধরাল না। সে আগের মতোই সকলের ওপরে প্রভুত্ব করতে লাগল। সে যখন ছুঁচোর চোখে কাঠি ঢুকিয়ে দিত, অথবা কুষ্ঠরোগীকে ঢিল ছুঁড়ে মারত, তখন তারাও হাসত। এইভাবে গ্রামের ছেলেরাও তার মতো নির্দয় হয়ে উঠল।
একদিন গ্রামের পথ দিয়ে একটি ভিক্ষুক-রমণী যাচ্ছিল। তার পোশাক ছিঁড়ে গিয়েছিল, রাস্তা দিয়ে হাঁটার ফলে পা দিয়ে তার রক্ত পড়ছিল। তার অবস্থাটা সত্যিই বড়ো খারাপ দেখাচ্ছিল। ক্লান্ত হয়ে একটি বাদাম গাছের তলায় বসে সে বিশ্রাম করছিল।
তাকে দেখে সেই দেবকুমার তার সঙ্গীদের বলল–ওই সুন্দর গাছের তলায় একটা নোংরা কদর্য চেহারার ভিখিরি বসে রয়েছে দেখ। এস, ওকে আমরা তাড়িয়ে দিই।
এই বলে দলবল নিয়ে সে সেই মেয়েটির দিকে পাথর ছুঁড়তে শুরু করল; বিদ্রূপ করতে লাগল তাকে। মেয়েটি সরে গেল না; একটা ভয়ার্ত বিমূঢ় দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইল। কাঠুরে পাশেই কাঠ চিরছিল। এই দেখে সে দৌড়ে এসে তাকে বকতে লাগল-কী নিষ্ঠুর তুমি? দয়ামায়ার বাষ্পও তোমার মধ্যে নেই। এই মেয়েটি তো তোমার কোনো ক্ষতি করেনি।
এই শুনে দেবকুমার রেগে মাটিতে পা ঠুকে বলল–আমার কাজের কৈফিয়ৎ চাওযার কী অধিকার তোমার রয়েছে শুনি? আমি তোমার ছেলে নই যে তোমার হুকুম মানব।
কাঠুরে বলল–সেকথা সত্যি। কিন্তু তোমাকে যখন বনের মধ্যে পড়ে থাকতে দেখেছিলাম তখন তোমাকে আমিই দয়া করেছিলাম।
সেই মেয়েটি এই কথা শুনেই চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে মূর্ছিত হয়ে পড়ল। কাঠুরে তাকে নিজের ঘরে বয়ে নিয়ে গিয়ে সেবাযত্ন করল। মূৰ্ছা ভাঙার পরে সে উঠে বসল; তখন মাংস, দুধ আর খাবার দিয়ে কাঠুরে আর তার স্ত্রী তার সেবা-যত্ন করল।
কিন্তু সে কিছুই খেল না; কাঠুরেকে জিজ্ঞাসা করল–তুমি বলছিলে না যে শিশুটিকে তুমি বনের মধ্যে কুড়িয়ে পেয়েছ? আর সেটা কি আজ থেকে বছর দশেক আগে নয়?
কাঠুরেটি উত্তর দিল-হ্যাঁ। বনের মধ্যেই ওকে আমি কুড়িয়ে পেরেছিলাম। আর সেও প্রায় দশ বছর আগেই।
মেয়েটি কাঁদতে কাঁদতে বলল–ওর দেহে কী কী চিহ্ন ছিল? ওর গলায় কি হলদে রঙের একটা হার ছিল না? ওর গায়ে কি সোনা দিয়ে মোড়া আর তারকা চিহ্ন দিয়ে খচিত একটা আলখাল্লা ছিল না?
হ্যাঁ, হ্যাঁ। ঠিক-ঠিক। যা বললে ঠিক তাই।
এই বলে সে সিন্দুক থেকে বার করে এনে সেগুলি তাকে দেখাল।
সেইগুলি দেখে মেয়েটি আনন্দে কাঁদতে লাগল। বলল, ওই আমার সেই শিশু। ওকেই আমি বনের মধ্যে হারিয়ে ফেলেছিলাম। তোমাকে অনুরোধ করছি ওকে এখনই ডেকে পাঠাও। ওরই জন্যে আজ আমি সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়াচ্ছি।
সুতরাং কাঠুরে আর তার স্ত্রী সেই দেবকুমারকে ডেকে নিয়ে এসে বলল–ঘরে যাও। সেখানে তোমার মা বসে রয়েছেন দেখতে পাবে।
এই কথা শুনে আনন্দে নাচতে-নাচতে দেবকুমার ঘরে দৌড়ে এসে তাকে দেখল; তারপরে ঘৃণার সঙ্গে হাসতে-হাসতে বলল–কই, কোথায় আমার মা? কারণ, এখানে তো সেই নোংরা ভিখিরি মেয়েটা ছাড়া আর কাউকে দেখতে পাচ্ছি না।
ভিখিরি মেয়েটি বলল–আমিই তোমার মা।
দেবকুমার রেগে চিৎকার করে উঠল-তুমি উন্মাদ। তাই একথা বলছ। তোমার মতো নোংরা ভিখিরির ছেলে আমি নই। বেরিয়ে যাও। তোমার মুখ আমি দেখতে চাই নে।
না-না। তুমি আমার ছেলে। তোমাকে নিয়ে আমি বনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলাম। ডাকাতরা তোমাকে আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে ওইখানে ফেলে রেখে গিয়েছিল। কিন্তু তোমাকে দেখেই আমি চিনতে পেরেছি। তোমার গায়ে যে সব চিহ্ন ছিল সেগুলিও আমি চিনেছি। অনুরোধ করছি, তুমি আমার সঙ্গে এস। চল পুত্র; তোমার স্নেহের ভিখারি আমি।
কিন্তু দেবকুমারকে নড়ানো গেল না। তার মায়ের কান্নাও তার মনে কোনো করুণার উদ্রেক করতে পারল না। ভিখারিণী যন্ত্রণায় কেবল কাঁদতে লাগল।
শেষকালে সে কথা বলল; বেশ রুক্ষ আর তিক্ত তার স্বর–যদি সত্যিই তুমি আমার মা হও তাহলে তোমার উচিত ছিল আমার কাছ থেকে দূরে সরে থাকা। এভাবে আমার জীবনে কলঙ্কের ছাপ দিতে আসা উচিত ছিল না তোমার। ভেবেছিলাম আমি কোনো দেবদূত–তোমার কাছে এখন যা শুনছি–কোনো ভিখারিণীর ছেলে আমি। সুতরাং তুমি এখান থেকে দূর হয়ে যাও। তোমার মুখ আমি দেখতে চাই নে।
ভিখারিণী কেঁদে বলল–হায় পুত্র, চলে যাওয়ার আগে তুমি কি আমাকে একটা চুমুও খাবে না?
সে বলল–না, তুমি দেখতে বড়ো কুচ্ছিত। তোমাকে চুমু খাওয়ার চেয়ে আমি বরং সাপকে চুমু খাব, চুমু খাব পথের ধুলোকে।
সুতরাং ভিখারীণী কাঁদতে কাঁদতে বনের দিকে চলে গেল। সে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে দেখে দেবকুমার খুব খুশি হয়ে তার সঙ্গীদের কাছে খেলতে ছুটে গেল।
কিন্তু তারা তাকে বিদ্রূপ করে বলল–তুমি কটকটে ব্যাঙের মতো বিশ্রী দেখতে; সাপের মতো ঘৃণ্য। এখানে থেকে দূর হয়ে যাও। আমরা তোমার সঙ্গে খেলব না।
এই কথা শুনে দেবকুমার ভ্রু কুঁচকে নিজের মনে বলল–এরা বলে কী? আমি পাতকূয়ার কাছে গিয়ে জলের দিকে তাকাব; পাতকূয়ার জলই বলে দেবে আমি কত সুন্দর।
এই পাতকুয়ার কাছে গিয়ে সে জলের দিকে তাকাল। হায়, হায়! তার মুখ হয়েছে কটকটে ব্যাঙের মুখের মতো; তার গায়ে গড়িয়েছে সাপের গায়ের মতো আঁশ। এই দেখেই ঘাসের ওপরে লম্বা হয়ে শুয়ে কাঁদতে-কাঁদতে সে বলল–নিশ্চয়ই এটা আমার পাপের ফল। অস্বীকার করে আমি আমার মাকে তাড়িয়ে দিয়েছি! আমি দাম্ভিত; মায়ের ওপরে আমি নিষ্ঠুর ব্যবহার করেছি। যতদিন না আমি মাকে খুঁজে পাই ততদিন সারা বিশ্ব আমি ঘুরে বেড়াব, বিশ্রাম নেব না এতটুকু।
কাঠুরের বাচ্চা মেয়েটি তার কাছে এসে কাঁধে হাত দিয়ে বলল–তুমি কেঁদ না, আমাদের কাছে তুমি থাক; আমি তোমাকে ঠাট্টা করব না।
ছেলেটি ঘাড় নেড়ে বলল–না। মায়ের ওপরে আমি দুর্ব্যবহার করেছি। তাই তাঁকে খোঁজার জন্যে আমি সারা বিশ্ব ঘুরে বেড়াব। কোথাও থামব না।
এই কথা বলেই তার মাকে ডাকতে ডাকতে সে বনের দিকে দৌড়ে গেল। কিন্তু কেউ তার ডাকে সাড়া দিল না। সারা দিন ধরেই সে চেঁচাতে লাগল। তারপরে রাত্রি নেমে এলে সে শুকনো পাতা বিছিয়ে শুয়ে পড়ল। কিন্তু পশু-পাখিরাও তার কাছ থেকে পালিয়ে গেল। কারণ তার নিষ্ঠুরতার কথা তারাও জানত। তার সঙ্গী হয়ে রইল কেবল কটকটে ব্যাঙ আর সাপের দল।
সকাল হল। গাছ থেকে কিছু তেতো ফল তুলে সে চিবোল তারপরে ভীষণ কাঁদতে কাঁদতে সে আবার বিরাট বনের ভেতর দিয়ে ছুটতে শুরু করল।
একটা ছুঁচোকে সে জিজ্ঞাসা করল–তুমি তো মাটির নীচে যেতে পার। আমার মা সেখানে আছে কি না বলতে পার?
ছুঁচো বলল–তুমি আমার চোখ দুটোকে অন্ধ করে দিয়েছ। আমি জানব কেমন করে?
লিনেট পাখিকে সে জিজ্ঞাসা করল–তুমি লম্বা গাছের ওপর দিয়ে উড়ে গোটা পৃথিবীকে দেখতে পাও। আমার মাকে তুমি দেখেছ?
লিনেট বলল–আমার ডানা দুটো কেটে তুমি আনন্দ করেছ। আমি উড়বো কেমন করে?
ফার গাছের কোটরে নিঃসঙ্গভাবে যে বাচ্চা কাঠবিড়ালি থাকত তাকে সে জিজ্ঞাসা করল–আমার মা কোথায়?
কাঠবিড়ালি উত্তর দিল-আমার মাকে তুমি মেরে ফেলেছ। তোমার মাকেও কি মারতে চাও?
এই কথা শুনে লজ্জায় মাথা নীচু করে দেবকুমার কাঁদতে লাগল; ঈশ্বরের সৃষ্ট প্রাণীদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করল; তারপরে সেই ভিখারিণীকে খুঁজে বার করার জন্যে বনের মধ্যে দিয়ে চলতে লাগল। তৃতীয় দিনের বনের শেষ প্রান্তে সে এসে পৌঁছল; তারপরে নেমে গেল সমতলভূমিতে। গাঁয়ের ভেতর দিয়ে চলার সময় ছেলেমেয়েরা তাকে বিদ্রূপ করতে লাগল–তার দিকে ঢিল ছুঁড়তে লাগল। কেউ তাকে মাঠে-ঘাটে রাত্রে শুতে দিল না। এমন কুৎসিত তার চেহারা হয়েছিল যে কেউ তার ওপরে একটু করুণাও দেখাল না। তিনটি বছর এইভাবে সে তার ভিখারিণী মায়ের সন্ধানে ঘুরে বেড়াল। কোথাও তাকে খুঁজে পেল না। মাঝে-মাঝে তার মনে হত তার মা সামনে এগিয়ে চলেছে। এই দেখে সে তার পিছু পিছু দৌড়ে যেত; কিন্তু পথের ওপরে শক্ত পাথর লেগে তার পা যেত ছিড়ে। কিন্তু সে তাকে ধরতে পারত না। পাশাপাশি যারা থাকত তারা অবশ্য স্বীকার করত যে ওই রকম একটি ভিখারিণীকে তারা দেখেছে কিন্তু কোথায় সেই ভিখারিণী? দুঃখে ভেঙে পড়ত সে।
একদিন একটি নদীর ধারে এক শহরের ফটকের কাছে এসে সে দাঁড়াল। শহরের চারপাশটা শক্ত দেওয়াল দিয়ে ঘেরা। ক্লান্ত আর পায়ে ঘা হওয়া সত্ত্বেও সে শহরের ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করল। কিন্তু পাহারাদার সৈন্যরা তাদের তরোয়াল উঁচিয়ে রুক্ষ স্বরে জিজ্ঞাসা করল–শহরে তোমার কী দরকার?
সে বলল–আমার মাকে খুঁজছি। সে সম্ভবত এইখানে আছে। দয়া করে আমাকে ঢুকতে দিন।
কিন্তু তারা তাকে বিদ্রূপ করল। একজন তার কালো দাড়ি নেড়ে বলল–সত্যি কথা বলতে কি যা তোমার চেহারা না–কটকটে ব্যাঙ আর সাপও তোমাকে দেখে ভিরমি যাবে। ভাগো-ভাগো। তোমার মা এখানে নেই।
আর একজন জিজ্ঞাসা করল–তোমার মা কে?
সে বলল–আমারই মতো একজন ভিক্ষুক। আমি তার সঙ্গে বড়োই দুর্ব্যবহার করেছি। দয়া করে আমাকে ভেতরে যেতে দাও। তার কাছ থেকে ক্ষমা চাইতে হবে আমাকে।
তারা তো তাকে যেতে দিলই না, অধিকন্তু তাদের বর্শা দিয়ে তাকে খোঁচা দিল।
সে কাঁদতে কাঁদতে চলে যাচ্ছিল এমন সময় বর্ম-পরা একটি বীরপুরুষ তাদের সামনে এসে হাজির হল। তার বর্মের ওপরে সোনার ফুল বসানো, আর শিরস্ত্রাণের ওপরে আঁকা শায়িত সিংহের একটি ছবি। সে এসে তাদের জিজ্ঞাসা করল–কে ভেতরে যেতে চাইছিল?
তারা বলল–ও একটা ভিখিরি। ওকে আমরা তাড়িয়ে দিয়েছি।
সে হেসে বলল–উহু। ওকে আমরা এক ভাঁড় মিষ্টি মদের দামে ক্রীতদাস হিসেবে বেচে দেব।
একটা কুৎসিত বীভৎস চেহারার লোক সেই সময় ওই পথ দিয়ে যাচ্ছিল। এই কথা শুনে ঘুরে দাঁড়িয়ে সে বলল–ওই দামে আমি ছেলেটাকে কিনব। এই বলে মদের দাম দিয়ে তাকে সে কিনে হাত ধরে শহরের ভেতরে ঢুকে গেল। শহরের অনেক রাস্তা পেরিয়ে তারা একটা ছোটো দরজার কাছে এসে থামল। একটা দেওয়ালের গায়ে দরজাটা বসানো ছিল। দেওয়ালটাকে ঢাকা দিয়ে রেখেছিল একটা ডালিম গাছ। বুড়ো লোকটা দরজা খুলল। তারপরে দুজনে ব্রাশের তৈরি পাঁচটা সিড়িঁ পেরিয়ে একটা বাগানে এসে হাজির হল। আফিং গাছে আর পোড়া মাটির সবুজ জার-এ বোঝাই ছিল বাগানটা। সেই বুড়োটা তার পাগড়ির ভেতর থেকে একটা সিল্কের রুমাল বার করে তার চোখ দুটো বেঁধে দিল; তারপরে, তার চোখ দুটো বেঁধে তাকে সামনে এগিয়ে নিয়ে চলল। রুমালটা সরিয়ে নেওয়ার পরে সে দেখল একটা গুহার মতো ভাযায় সে এসে পড়েছে। সেখানে শিঙের একটা লন্ঠন জ্বলছে।
তখন বুড়ো লোকটা একটি পাত্রে ছাতাপড়া একটুকরো রুটি তার সামনে ধরে বলল–খাও; আর একটা কাপে কালো একটু জল দিয়ে বলল–পান কর। খাওয়া শেষ হওয়ার পরে বুড়ো লোকটা তাকে লোহার চেন দিয়ে বাঁধল; তারপরে দরজায় তালা দিয়ে বেরিয়ে গেল।
ওই বুড়োটা ছিল লিবিয়ার একটু চতুরতম যাদুকর। যার কাছ থেকে সে যাদুবিদ্যা শিখেছিল সেই লোকটা থাকত নীল নদের ধারে একটা কবরখানার ভেতরে। পরের দিন সকালে সেই যাদুকর এল, মুখ বাঁকিয়ে বলল–এই শহরের ফটকের কাছাকাছি একটা বন রয়েছে সেই বনে তিল তাল সোনা রয়েছে। একটা সাদা, একটা হলদে, আর একটা লাল। আজ তুমি সেই সাদা সোনার তালটা নিয়ে আসবে। আনতে না পারলে, তোমাকে একশোবার চাবুক মারা হবে। তাড়াতাড়ি যাও। সন্ধের সময় এইখানে তোমার জন্যে আমি অপেক্ষা করব।
এই বলে তার চোখে সেই সিল্কের রুমালটা বেঁধে ঘর পেরিয়ে বাগানের ভেতর দিয়ে দরজার বাইরে নিয়ে এসে চোখ খুলে দিয়ে বলল–যাও।
সেই দেবকুমার শহরের ফটকের কাছে এল, তারপরে যাদুকর যে-বনটার কথা তাকে বলেছিল সেই বনের মধ্যে গিয়ে ঢুকল।
বাইরে থেকে দেখতে বনটি বড়ো সুন্দর ছিল। কত পাখি গান করছিল সেখালে, কত সুগন্ধী ফুলের সমারোহ জেগেছিল চারপাশে। কিন্তু এত সৌন্দর্যও কোনো কাজে এল না তার। কারণ যে-পথ দিয়েই সে হাঁটতে লাগল সেই পথেই রাশি রাশি কাঁটা গাছ তাকে ক্ষতবিক্ষত করতে লাগল। তাছাড়া সেই সোনার তালটারও কোনো হদিস পেল না সে। সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত ঘুরে-ঘুরে ক্লান্ত হয়ে পড়ল। সন্ধেবেলা ভীষণ কাঁদতে কাঁদতে সে বাড়ির দিকে ফিরল। সেদিন তার কপালে কী আছে তা সে জানত।
যখন সে বনের ধারে এসে পৌঁছেছে এমন সময় পেছনে ঝোপের ভেতর থেকে কে যেন যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠল। নিজের দুঃখ ভুলে গিয়ে সে দৌড়ে গেল সেইদিকে, দেখল একটা খরগোস ব্যাধের জালে আটকা পড়ে চিৎকার করছে।
তার দয়া হল খরগোসটার উপরে। সে তাকে জাল থেকে মুক্ত করে বলল–আমি একজন ক্রীতদাস ছাড়া আর কিছু নই। তবু তোমাকে আমি মুক্ত করে দিলাম।
তখন খরগোস বলল–সেকথা নিশ্চয় সত্যি। প্রতিদানে তোমাকে আমি কী দেব?
দেবকুমার বলল–আমি একটা সাদা সোনার তাল খুঁজছি। কিন্তু কোথাও পাচ্ছি নে। ওটা নিয়ে না গেলে আমার মনিব আমাকে খুব মারবে।
খরগোস বলল–আমার সঙ্গে এস। আমি তোমাকে সেখানে নিয়ে যাচ্ছি। সেটা কোথায় আর কী উদ্দেশ্যে রয়েছে তা আমি জানি।
সুতরাং দেবকুমার খরগোসের সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে গেল। সত্যিই তো! বিরাট একটা ওক গাছের কোটরে সাদা সোনার একটা ছোটো তাল রয়েছে। সেইটাকে সে খুঁজতে এসেছিল। আনন্দে আত্মহারা সেই সোনার তালটাকে নিয়ে সে খরগোশকে বলল–তোমার যে উপকার আমি করেছি তার অনেক অনেক বেশি উপকার তুমি আমার করলে। যে দয়া তোমাকে আমি দেখিয়েছি, তুমি তার শতগুণ বেশি দয়া আমাকে দেখালে।
খরগোস বলল–উঁহু! তুমি আমার সঙ্গে যে রকম ব্যবহার করেছ আমিও তোমার সঙ্গে ঠিক সেই রকম ব্যবহার করেছি।–এই বলে সে দৌড়ে পালিয়ে গেল। দেবকুমারও এগিয়ে গেল শহরের দিকে।
শহরের ফটকের কাছে একটা কুষ্ঠরোগী বসেছিল। ধূসর রঙের একটুকরো কাপড়ের ফালি দিয়ে তার মাথাটা ঢাকা ছিল। সেই কাপড়ের ফুটো দিয়ে তার চোখ দুটো জ্বলছিল জ্বলন্ত অঙ্গারের মতো। তাকে আসতে দেখে সেই লোকটা কাঠের পাত্রের ওপরে শব্দ করে বলল–আমাকে কিছু অর্থ দাও। না খেয়ে আমি মারা যাচ্ছি। ওরা আমাকে শহরের বাইরে বার করে দিয়েছে। এমন কেউ নেই যে আমাকে একটু দয়া করে।
দেবকুমার বলল–হায়, হায়! আমার কাছে একটুকরো সোনা রয়েছে বটে, কিন্তু সেটা যদি আমার মনিবের কাছে নিয়ে না যাই তাহলে সে আমাকে খুব মারবে; কারণ, আমি তার ক্রীতদাস।
কিন্তু কুষ্ঠরোগীরটা তাকে সেটা দেওয়ার জন্যে বড়োই অনুরোধ করতে লাগল। শেষকালে সে তার সেই সোনার টুকরোটা না দিয়ে পারল না।
যাদুকর তাকে দেখে জিজ্ঞাসা করল–তুমি সেই সাদা সোনার তালটা নিয়ে এসেছ?
দেবকুমার বলল–না।
এই শুনে ঘাদুকর তাকে বেদম প্রহার করতে লাগল। তারপরে একটা শূন্য খাবার থালা আর শূন্য কাপ তার সামনে রেখে বলল–খাও।
পরের দিন সকালে সেই যাদুকর এসে বলল–আজ যদি তুমি সেই হলদে সোনার টুকরোটা না আনতে পার তাহলে তোমাকে আমি চিরকাল আমার চাকর করে রাখব; আর চাবুক খাবে তিনশটি।
দেবকুমার আবার সেই বনে ফিরে গেল; সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত হলদে সোনার খোঁজে বৃথাই সে খুঁজে বেড়াল। সূর্যাস্তের সময় একটা পাথরের ওপরে বসে সে যখন কাঁদছে এমন সময় সেই বাচ্চা খরগোসটা তার কাছে এসে জিজ্ঞাসা করল–কাঁদছ কেন? কী হয়েছে তোমার?
সে বলল–আমি খুঁজছি হলদে সোলার তাল। এইখানেই কোথাও সেটা লুকালো রয়েছে। সেটা নিয়ে না গেলে আমার মনিব আমাকে খুব মারবে। আমি তার কেনা চাকর কি না।
খরগোস বলল–আমার সঙ্গে এস। এই বলে দৌড়তে-দৌড়তে সে একটা জলাশয়ের ধারে এসে পৌঁছল। সেই জলাশয়ের তলায় হলদে সোনার তালটা ছিল।
দেবকুমার বলল–তোমাকে আমি কী বলে ধন্যবাদ দেব বুঝতে পারছি নে। এই দ্বিতীয়বার তুমি আমাকে বাঁচালে।
খরগোস বলল–ও কথা বলো না। তুমিই তো আমাকে প্রথম দয়া করেছিলো-এই বলে সে ছুটে পালিয়ে গেল।
ফটকের কাছে আবার সেই কুষ্ঠরোগীটার সঙ্গে দেখা। তাকে দেখেই সে দৌড়ে তার কাছে এগিয়ে এসে কাতর স্বরে ভিক্ষে চাইল। তার অনুরোধ এড়াতে না পেরে দেবকুমার তাকে সেই হলদে সোনার টুকরোটা দিয়ে শূন্য হাতে বাড়ি ফিরে এল।
শূন্য হাতে ফিরে এসেছে দেখে যাদুকর তাকে বিষম প্রহার করল, তারপরে শেকল দিয়ে তাকে বেশ ভালো করে বেঁধে সেই গর্তের মধ্যে ফেলে রেখে চলে গেল।
পরের দিন যাদুকর আবার এল; বলল–আজ যদি তুমি সেই লাল সোনার তালটা নিয়ে আস তাহলে তোমাকে আমি মুক্তি দেব; যদি না আন, তাহলে তোমাকে নির্ঘাৎ খুন করে ফেলব।
আবার সে সেই বনের মধ্যে গেল। আবার সারাদিন বনের মধ্যে ঘুরে বেড়াল। আবার সন্ধের সময় একটা পাথরের ওপরে বসে কাঁদতে লাগল। তারপরে এল সেই বাচ্চা খরগোস। সব শুনে সে বলল–তোমার পেছনে যে গুহা রয়েছে তারই মধ্যে তো সেটা রয়েছে।
লাল সোনার তালটা নিয়ে সে বলল–বারবার তিনবার আমাকে তুমি বাঁচালে।
খরগোস বলল–উহু! তুমি আমাকে প্রথমে বাঁচিয়েছিলে যে!–এই বলেই সে ছুটে পালিয়ে গেল।
আবার সেই কুষ্ঠরোগী তার রাস্তার ওপরে গিয়ে দাঁড়াল, বলল–আমাকে ওটা দাও না হলে আমি খিদেয় মারা যাব।
দেবকুমার বলল–তোমার প্রয়োজন আমার চেয়ে বেশি। সুতরাং তুমিই এটা নাও।
সোনাটুকু সে দিয়ে দিল বটে, কিন্তু তার মনটা বড়ো খারাপ হয়ে গেল। তার কপালে যে কী রয়েছে তা সে জানত।
কিন্তু কী আশ্চর্য! শহরের ফটকের পাশ দিয়ে সে যখন এগিয়ে যেতে লাগল তখন সেপাই-সান্ত্রীর দল মাথা নীচু করে তাকে সম্মান জানাল, চেঁচিয়ে বলল–আমাদের প্রভু কী সুন্দর দেখতে! শহরবাসীরা তার পিছু-পিছু হাঁটতে-হাঁটতে বলতে লাগল–সত্যিই এত সুন্দর মানুষ পৃথিবীতে আর নেই।
দেবকুমার কাঁদতে কাঁদতে ভাবল-নিশ্চয় ওরা আমার ঠাট্টা করছে। তাকে দেখার জন্যে এত লোকের ভিড় হল যে সে পথ হারিয়ে রাজপ্রাসাদের সামনে এসে হাজির হল। রাজপ্রাসাদের রক্ষীরা দরজা খুলে দিল। পুরোহিত আর উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারীরা দৌড়ে এলেন তার দেখা করার জন্যে, বললেন–আপনিই আমাদের প্রভু। আপনার জন্যেই আমরা অপেক্ষা করে রয়েছি। আপনিই আমাদের রাজার কুমার।
দেবকুমার বলল–আমি কোনো রাজার কুমার নই। আমি হচ্ছি ভিখারিণীর ছেলে। আমি দেখতে কুৎসিত। আপনারা আমাকে সুন্দর বলছেন কেন?
এই শুনে সেই লোকটা যার বর্মের ওপরে সোনার ফুল আঁকা ছিল, আর শিরস্ত্রাণের উপরে ছিল শায়িত সিংহের ছবি–-তার ঢালটাকে দেবকুমারের মুখের সামনে তুলে ধরে বলল–প্রভু যে সুন্দর নন সেকথা কেমন করে তিনি বললেন?
দেবকুমার সেই ঢালের মধ্যে নিজের প্রতিচ্ছবি দেখে অবাক হয়ে গেল; সত্যিই তো! তার সৌন্দর্য ফিরে এসেছে, ফিরে এসেছে তার লাবণ্য আর সুষমা।
রাজপুরুষেরা বলল–পুরাকালের ভবিষ্যৎবাণী হচ্ছে আজকের দিনে আমাদের রাজা ফিরে আসবেন। তিনিই আমাদের দেশ শাসন করবেন। অতএব আপনি এই রাজদণ্ড আর মুকুট গ্রহণ করুন। ন্যায়পরায়ণতার সঙ্গে শাসন করুন আমাদের দেশ।
কিন্তু সে তাদের বলল–না, না। আমি এসবের যোগ্য নই। যে মা আমাকে গর্ভে ধারণ করেছেন আমি তাঁকে অস্বীকার করেছি। যতদিন না তাঁকে আমি খুঁজে পাচ্ছি, যতদিন না তিনি আমাকে ক্ষমা করছেন ততদিন পর্যন্ত আমার বিশ্রাম নেই। সুতরাং আমাকে যেতে দিন। ওই রাজদণ্ড আর মুকুট দিলেও আমি এখানে থাকতে পারব না।
এই কথা বলে সে রাস্তার দিকে ঘুরে দাঁড়াল। এই রাস্তাটাই সোজা শহর-ফটকের দিকে এগিয়ে গিয়েছে। কিন্তু কী আশ্চর্য! সেই রাস্তা দিয়ে সেই ভিখারিণীটি তার দিকে এগিয়ে এলেন; আর তাঁরই পাশে সেই কুষ্ঠরোগী।
আনন্দে আত্মহারা হয়ে চিৎকার করতে-করতে সে দৌড়ে গেল তাঁর কাছে; মায়ের ক্ষতকে চুম্বন করে চোখের জলে ভিজিয়ে দিল তাঁর পা দুটি। ধুলোর মধ্যে মাথাটা রেখে বলল–মা, দম্ভে একদিন তোমাকে আমি অগ্রাহ্য করেছিলাম। সে-দম্ভ আজ আমার নেই। এখন আমাকে তুমি ক্ষমা কর।
সেই ভিখারিণী কোনো উত্তর দিল না।
সে তখন সেই কুষ্ঠরোগীর সাদা পা দুটো দু’ হাতে জড়িয়ে ধরে বলল–তিনবার তোমাকে আমি দয়া করেছি। আমার সঙ্গে কথা বলতে তুমি নির্দেশ দাও মাকে।
কিন্তু কুষ্ঠরোগীটি একটিও কথাও বলল না।
আবার সে কাঁদতে লাগল–মা, এ দুঃখ আমি আর সহ্য করতে পারছি না। আমাকে ক্ষমা কর। আবার আমি বনে ফিরে যাই।
এবার সেই ভিখারিণীটি তার মাথার ওপর হাত রেখে বললেন—ওঠ।
সেই কুষ্ঠরোগীটিও তার মাথার ওপরে হাত রেখে বললেন—ওঠ।
সে উঠল। কিন্তু কী আশ্চর্য! তাঁরাই হচ্ছেন রাজা এবং রানি। রানি বললেন–ইনিই তোমার পিতা। এঁকেই তুমি সাহায্য করেছিলে।
রাজা বললেন–ইনিই তোমার মা। এঁরই পা দুটি তুমি চোখের জলে ভিজিয়ে দিয়েছিলে।
তাঁরা তাকে কাছে টেনে নিয়ে চুমু খেলেন। রাজপ্রাসাদের ভেতরে নিয়ে গিয়ে রাজপোশাক পরালেন। হাতে দিলেন রাজদণ্ড; মাথায় দিলেন রাজমুকুট। ন্যায়পরায়ণতা আর সততার সঙ্গে রাজত্ব করতে লাগল সে। সেই দুষ্ট যাদুকরকে নির্বাসিত করল। সেই কাঠুরে, তার স্ত্রী আর তাদের ছেলেমেয়েদের উপঢৌকন পাঠাল প্রচুর। পশু-পাখি-মানুষ কারও ওপরে যাতে কেউ নির্দয ব্যবহার করতে না পারে সেদিকে সজাগ রইল। দেশের মধ্যে সুখ-শান্তি আর ঐশ্বর্য উথলে পড়ল।
কিন্তু জীবনে সে এত কষ্ট পেয়েছিল যে বেশি দিন সে বাঁচল না। তিন বছর পরেই সে মারা গেল। তারপর যে রাজা হল সে বেশ নির্দয়ভাবেই রাজ্য শাসন করতে লাগল।