পরমাশ্চর্য রকেট
The Remarkable Rocket
রাজপুত্রের বিয়ে হবে। চারপাশে আনন্দের বান ডেকেছে। রাজপুত্র তাঁর কনের জন্য সারাটা বছর অপেক্ষা করেছেন। অবশেষে রাজকন্যা উপস্থিত হয়েছেন। ইনি হচ্ছেন রাশিয়ান। রাজকন্যা। ছটি বল্লা-হরিণের টানা স্লেজ গাড়িতে চেপে ফিনল্যান্ড থেকে সারা পথটা তিনি এসেছেন। গাড়িটাকে বিরাট একটা সোনালি হাঁসের মতো করে সাজানো হয়েছিল; রাজকুমারী বসেছিলেন সেই হাঁসের দুটি ডানার মধ্যে। আরমিনের লোম দিয়ে তৈরি ঢিলে জামাটা তাঁর পা পর্যন্ত ছিল ঝোলানো। তাঁর মাথার উপরে ছিল রুপোর সুতো দিয়ে তৈরি করা ছোটো একটা টুপি বরফের প্রাসাদেই চিরকাল তিনি বাস করতেন বলেই রঙটাও তাঁর ওই বরফের মতোই যেতাভ হয়ে উঠেছিল। তাকে এতই বিবর্ণ দেখাচ্ছিল যে রাস্তা দিয়ে। আসার সময় মানুষরা সব অবাক হয়ে তাকিয়ে বলছিল-আরে, ইনি যে একটি শ্বেত গোলাপ দেখছি।’ এই বলে জানালা থেকে তাঁর ওপরে ফুল ছুঁড়ে দিয়েছিল।
দুর্গের প্রধান ফটকের কাছে তাঁকে স্বাগত জানানোর জন্য রাজকুমার অপেক্ষা করছিলেন। তিনি রাজকন্যার হাতে চুম্বন করে বললেন–তোমার ছবিটি বড়ো সুন্দর; কিন্তু তার চেয়েও সুন্দর তুমি।
একটি যুবক ভৃত্য তার প্রতিবেশীকে বলল–রাজকন্যা আগে শ্বেত গোলাপের মতো দেখতে ছিলেন; এখন তিনি দেখতে হয়েছেন রক্ত গোলাপের মতো। এই কথা শুনে উল্লসিত হয়ে উঠল সবাই।
পরের দিন লোকের মুখে কেবল ওই দুটি কথা–’শ্বেত গোলাপ, রক্ত গোলাপ, রক্ত গোলাপ, শ্বেত গোলাপ’ রাজা খুশি হয়ে ভৃত্যের মাইনে দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিলেন। ভৃত্যটি কোনো মাইনে পেত না বলেই এই বেতন-বুদ্ধিতে তার কোনো ক্ষতি-বৃদ্ধি হল না; কিন্তু সবাই এটাকে পরম সম্মানের বস্তু বলে মন করল; রাজপুরীর গেজেটেও সেই সংবাদ প্রকাশিত হল।
তিন দিন পরে বিবাহ অনুষ্ঠিত হল। এটা অদ্ভুত একটি আনন্দোৎসব। ছোটো ছোটো মুক্তা। দিয়ে খচিত বেগুনে রঙের ভেলভেটের চাঁদোয়ার নীচে দিয়ে সদ্য বিবাহিত দম্পতি পরস্পর হাত ধরাধরি করে বেড়ালেন। তারপরে পাঁচদিন ধরে চলল স্টেট ব্যাংকোযেটা রাজকুমার আর রাজকুমারী গ্রেট হল-এর শিখরে বসে স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ পেয়ালার একসঙ্গে মদ্যপান করলেন। কেবলমাত্র আসল প্রেমিক-প্রেমিকারাই এইরকমভাবে একই পাত্র থেকে মদ্য পান করার সৌভাগ্য রাখে। যারা তা নয় তাদের ঠোঁটের সপশে পাত্রটা বিবর্ণ হয়ে যায়।
সেই ছোট্ট চেহারার ভৃত্যটি বলল–এঁরা যে পরস্পরকে ভালোবাসেন সেই ভালোবাসা ওই স্ফটিকের মতোই স্বচ্ছ।
সেই শুনে মহারাজ আবার তার মাইনে দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিলেন।
সভাসদেরা আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল–কী সম্মান! কী সম্মান!
ব্যাংকোয়েটের পরে শুরু হল ‘বল। দম্পতিদের সেখানে গোলাপ নৃত্য দেখানোর কথা। মহারাজ কথা দিলেন সেই নাচে তিনি বাঁশি বাজাবেন। বাজালেন তিনি খুবই জঘন্য; কিন্তু তিনি রাজা। সেকথা তাঁর মুখের ওপরে কে বলবে! সবাই তাই চিৎকার করে বলল–আহা-হা! চমৎকার!
এই কর্মসূচীর সমাপ্তি হচ্ছে বাজি দিযে। বিরাট আয়োজন হয়েছে তার। কাঁটায় কাঁটায় রাত্রি বারোটার সময় শুরু হবে এই বাড়ি ছোঁড়া। রাজকুমারী কোনো দিন আতশবাজির খেলা দেখেননি। তাই মহারাজ হুকুম দিলেন বিয়ের দিন আতশবাজিকর সব সময় উপস্থিত থাকবে।
রাজকুমারকে জিজ্ঞাসা করলেন রাজকুমারী–আতশবাজি কী?
যাকেই প্রশ্ন করা হোক, মহারাজ তার উত্তর দেবেনই। তিনি বললেন–ঠিক সুমেরুজ্যোতির মতো। তবে এটা হল একটু বেশি স্বাভাবিক। নক্ষত্রগুলি যখন ফুটে ওঠে তখন তাদের তুমি। দেখেছ। ব্যক্তিগতভাবে এইসব নক্ষত্রদের চেয়ে আমি আতশবাজিদের বেশি পছন্দ করি; কারণ তা আমার বাঁশি বাড়ানোর মতোই মধুর, তুমি নিশ্চয়ই তা দেখতে পাবে।
এইজন্যে রাজার উদ্যানের শেষ প্রান্তে বেশ বড়ো একটা মাচা বাঁধা হল। আর রাজা। আতশবাজির সব আয়োজন প্রস্তুত করে ফেললেন। সেই সময় বাড়িরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা শুরু করল।
বাচ্চা পটকাটা বলল–এই পৃথিবীটা সত্যিই বড়ো সুন্দর। ওই হলদে টিউলিপ ফুলগুলিকে দেখা বাহ! ওরা যদি সত্যিকারের ক্র্যাকার হত তাহলে কখনই এত সুন্দর হতে পারত না। আমি যে অনেক জায়গা ঘুরে বেডিযোদু, সেজন্যে আমি খুশি। বিদেশ মণই মনকে অদ্ভুত ভাবে উন্নত করে, আর নষ্ট করে দেয় যাবতীয় কুসংস্কার।
বড়ো রোমান ক্যানডাল বলল–ওরে মূর্খ পটকা, রাজার বাগানটা বিশ্ব নয়। বিরাট বিশ্ব হচ্ছে–এটাকে ঘুরে-ঘুরে দেখতে তোমার তিন দিন লাগবে।
বিষণ্ণ ক্যাথারিন হুইল বলল–যে-কোনো জায়গাই তোমার কাছে বিশ্ব।
এই হুইল প্রথম জীবনে একটা বাক্সের সঙ্গে জড়িত ছিল এবং হৃদযটা তার ভেঙে যাওয়ার জন্যে সে বেশ গর্বিত। সে বলল–কিন্তু আজকাল প্রেম এমন একটা প্রচলিত রীতিসম্মত নয়। কবিরাই একে জবাই করে ফেলেছে। তারা এই প্রেম নিয়ে এত কথা লিখেছে যে কেউ আর তা বিশ্বাস করতে চায় না। এবং আমি তাতে আশ্চর্যও হই না। সত্যিকার প্রেম দুঃখ পায় সে। কোনো প্রতিবাদ করতে চায় না। আমার একবার বেশ মনে রয়েছে…কিন্তু যাকগে। রোমান্স এখন আমার কাছে অতীতের বস্তু।
রোমান ক্যানডাল বলল–মূর্খ কোথাকার! রোমান্স কোনো দিন মরে না। চাঁদের মতো; চিরকাল ও বেঁচে থাকে।
কিন্তু ক্যাথারিন হুইল লিভের মতে অটুট; সে মাথা নেড়ে বলল–রোমান্স মৃত, মৃত, মৃত
যারা জানে একটা কথা বারবার বললে তা শেষ পর্যন্ত সত্যি হয়ে দাঁড়ায় এ হচ্ছে সেই জাতীয় বস্তু।
হঠাৎ একটা শুকনো তীক্ষ্ণ কাশির আওয়াজ হতেই সবাই সেই দিকে ঘুরে দাঁড়াল। কাশিটা। আসছিল একটা লম্বা উদ্ধ৩ রকেটের কাছ থেকে। রকেটটা একটা লম্বা ছুড়ির শেষ কোণে বাঁধা ছিল। দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যে কোনো কিছু বলার আগে সব সময়েই সে কাশে।
সে বলল–আহেম, আহেম–শোন।
শোনার জন্যে সবাই তার দিকে ঘুরে তাকাল–একমাত্র হতভাগ্য ক্যাথারিন হুইল ছাড়া। সে বেচারা তখনো নিজের ঝোঁকে মাথা নেড়ে নেড়ে বলছে-রোমান্স মরে গিয়েচ্ছে, মরে গিয়েছে।
চেঁচিয় উঠল ক্র্যাকার—’অর্ডার! অর্ডার!’ তার মেজাজ অনেকটা রাজনীতিবিদদের মতো। স্থানীয় নির্বাচনে সে সব সময় বিশেষ অংশগ্রহণ করেছে। এই সব হেষ্কত্রে কি ধরনের পার্লামেন্টারি রীতি অনুসরণ করা যেতে পার তা সে জানে।
ক্যাথারিন হুইল ফিসফিস করে বলল—’মরে কাঠ হয়ে গিয়েছে।’ এই বলেই সে ঘুমানোর আয়োজন করল।
সবাই চুপচাপ হয়ে গেল। রকেট তৃতীয়বার কেশে শুরু করল তার বক্তৃতা। তার বক্তৃতা অন্যদের ওপরে কী রকম প্রভাব বিস্তার করছে তা জানার জন্যে কথার ফাঁকে ফাঁকে সে অন্য সকলের ঘাড়ের ওপর দিযে উচিযে দেখতে লাগল। আসল কথাটা হচ্ছে তার ধরনটি। সত্যিকারের অভিভাত।
আকাশে যেদিন আমাকে ছুঁড়ে দেওযা হবে ঠিক সেইদিন রাজকুমারের বিযে। কী ভাগ্যবান তিনি!…কিন্তু রাজকুমাররা চিরকালই সৌভাগ্যবান!
পুঁচকে পটকাটা বলল–যা বাব্বা! আমি ভেবেছিলাম ব্যাপারটা ঠিক উল্টো। রাজকুমারের সম্মানে আমাদেরই ফাটানো হচ্ছে–এই ছিল আমার ধারণা।
রকেট বলল–ওটা তোমার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে পারে। হতে পারে বলছি কেন, হয়েছে; কিন্তু আমার বিষয়টা স্বতন্ত্র। আমি একটি অত্যাশ্চর্য রকেট; আমার পূর্বপুরুষরাও সত্যিকারের। অভিজাত। আমার মা ছিলেন সে-যুগের সবচেয়ে বিখ্যাত ক্যাথারিন হুইলা সুষম নৃত্যের জন্যে তিনি প্রসিদ্ধ ছিলেন। যেদিন তিনি প্রকাশ্যে বিরাট নাচের আসরে নামলেন সেদিন তিনি আকাশযাত্রা করার আগে উনিশ বার ঘুরে ঘুরে নেচেছিলেন, তিনি প্রতিবার বাতাসে সাতটি পাটলবর্ণের নক্ষত্র ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর কটিদেশের পরিমাণ ছিল সাড়ে তিন ফিট, আর শরীরটা ছিল সেরা গান-পাউডারে তৈরি। আমার বাবাও আমারই মতো রকেট ছিলেন; কিন্তু তাঁর ধমনীতে ছিল ফরাসি রক্ত। তিনি এত উঁচুতে উঠে যেতেন যে লোকেদের
ভয় হত আর বুঝি তিনি নামবেন না। কিন্তু তিনি নামতেন; আর নামার সময় সোনালি রঙের বৃষ্টিতে ভরিয়ে দিতেন চারপাশ। খবরের কাগডোর সংবাদদাতারা তো মুহ্যমান হয়ে পড়তেন–তার সম্বন্ধে লম্বা লম্বা প্রশস্তি বার করতেন কাগডে। রাজার গেজেটেও বলা হত। পলিটেকনিক আর্টের বিজয় অভিযান ছিলেন তিনি।
বেঙ্গল লাইট বলল–কী বললে? ও; পাইরোটেকনিক বলছ বুঝি!
রকেট বেশ রুঢ় কণ্ঠে বলল–আমি বলেছি পলিটেকনিক।
এই শুনে বেঙ্গল লাইট এতই ঘাবড়ে গেল যে সে সঙ্গে সঙ্গে পুঁচকে পটকাটাতে দাঁত খিঁচোতে লাগল। নইলে, তার যে কিছু মূল্য রয়েছে তা বোঝানো যাবে কেমন করে?
রকেট শুরু করল–আমি বলছিলাম-কী বলছিলাম?
রোমান ক্যানডাল বলল–নিজের কথা বলছিলে।
নিশ্চয় নিশ্চয়। বেশ মনে পড়েছে আমি যখন একটি চিত্তাকর্ষক কাহিনি নিয়ে আলোচনা করছিলাম এমন সময় আমাকে অসভ্যের মত বাধা দেওয়া হয়েছিল। আমি এসব আদৌ পছন্দ করি নে; কারণ, বিশ্বের মধ্যে সপর্শকাতরতার দিক থেকে আমার জোড়া নেই।
রোমান ক্যানডালকে জিজ্ঞাসা করল ক্র্যাকার–স্পর্শকাতর কাকে বলে হে?
রোমান ক্যানডাল নীচু গলায় বলল–যে লোক নিজের পায়ে কড়া হয়েছে বলে ইচ্ছে করে অন্য লোকের পাযের কড়া মাড়িয়ে দেয়।
এই শুনে আর একটু হলে ক্র্যাকার হো-হো হেসে উঠত। খুব সামলে নিল সে।
রকেট জিজ্ঞাসা করল–তুমি হাসছ কেন? আমি তো হাসছি নে।
ক্র্যাকার বলল–আমি সুখী বলেই হাসছি।
বেশ রাগ করেই রকেট বলল–আচ্ছা স্বার্থপর তো। সুখী হওয়ার কী অধিকার তোমার রয়েছে শুনি? অপরের কথা তোমার চিন্তা করা উচিত, অর্থাৎ, আামার কথাই তোমার চিন্তা করা উচিত। আমি সব সময়েই আমার কথা ভাবি: আমি আশা করি সবাই সেই কাজই করবে। এটা বড়ো সুন্দর গুণ। আমার মধ্যে এই গুণ অনেক পরিমাণে রয়েছে। ধর, আজ রাত্রেই আমার যদি কিছু একটা হয়ে যায় তাহলে সেটাকে কি তোমরা নিজেদের দুর্ভাগ্য বলে মনে করবে না! রাজকুমার আর রাজকুমারী কেউ সুখী হবেন না। তাঁদের বিবাহিত জীবনটা নষ্ট হয়ে যাবে। মহারাডংও এই শোক ভুলতে পারবেন না। সত্যি কথা বলতে কি নিজের এই উঁচু মানের কথা আমি যখন ভাবি তখন আমারই চোখে জল আসে।
রোমান ক্যানডাল বলল–তুমি যদি অন্যদের আনন্দ দিতে চাও তাহলে নিজের পাউডার যাতে শুকনো থাকে সে বিষয়ে অবহিত হও।
এতক্ষণে বেঙ্গল লাইটের আগেকার অবস্থা ফিরে এসেছে। সে সমর্থনের স্বরে বলল–একশবার। এইটাই হচ্ছে কমনসেন।
ঘৃণার সঙ্গে রকেট বলল–তাই বটে! তুমি ভুলে যাচ্ছ যে আমি একডনি অসাধারণ আর অত্যাশ্চর্য প্রাণী। যার চিন্তা করার মতো ক্ষমতা নেই সে ছাড়া আর কারো কমনসেনস থাকবে কেন? কিন্তু আমার চিন্তা করার, কল্পনা করার শক্তি রয়েছেকারণ যা রয়েছে তার কথা আমি কোনোদিনই চিন্তা করি নো…আর শুকনো থাকার কথা যদি বল তাহলে একথা আমি বলতে পারি যে এখানে এমন কেউ নেই অনুভূতিপ্রবণতা কাকে বলে তা সে জানে। সৌভাগ্যবশত, আমি তা গ্ৰহ্য করি নে। আমাকে কেবল একটা জ্ঞানই সারা জীবন বাঁচিযে রেখেছে, সেটা হচ্ছে এই যে আমি ছাড়া অন্য সবাই যে নীচুস্তরের সেটা আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি তোমাদের কি হৃদয় বলে কোনো বস্তু রয়েছে! তোমরা সবাই হাসছ, আনন্দ করছ–যেন মনে হচ্ছে রাজকুমার আর রাজকুমারীর এই মাত্র বিয়ে হয়নি।
ছোটো একটা ফায়ার-বেলুন বলল–কেন নয়? আয়োজনটা তো আনন্দ করারই মতো। আমি যখন আকাশে উঠব তখন নক্ষত্রদেরও আমি এই আনন্দের কথাই তো বলব।
রকেট বলল–জীবনের সম্বন্ধে তোমার ধারণা কী তুচ্ছ! কিন্তু এছাড়া তোমার কাছে আর কীই বা আশা করব? তুমি শূন্যগর্ভ ভেতরে তোমার কিছু নেই। হয়তো একদিন রাজকুমার সস্ত্রীক কোনো গ্রামাঞ্চলে বেড়াতে যাবে। সেখানে হয়তো একটা নদী রয়েছে। নাম হয়তো তাদের একটি মাত্র পুত্রকে নিয়ে ঘুরতে বেরোবে; তারপর তাকে ছেড়ে দিয়ে গাছের তলায় ঘুমোবে; আর সেই সুযোগে ছেলেটা নদীতে ডুবে মারা যাবে! হতভাগ্যেরা তাদের একমাত্র সন্তানকে হারাবে। অহো! কী দুর্দৈব! কী ভয়ঙ্কর! আমি কোনো দিনই তা ভুলতে পারব না।
রোমন ক্যানডাল বলল–কিন্তু তারা তো তাদের কোনো সন্তানকে হারায়নি।
রকেট বলল–হারিয়েছে সেকথা বলছি নো বলছি, যদি হারায। হারালে, তার জন্যে দুঃখ করে লাভ নেই। যারা পড়ে যাওয়া দুধের জন্যে দুঃখ করে তাদের আমি ঘৃণা করি। কিন্তু তারা তাদের একমাত্র সন্তানকে হারাতে পারে এই ভেবে আমি দুঃখিত।
বেঙ্গল লাইট চিৎকার করে বলল–নিশ্চয়। আসল কথা হচ্ছে তোমার মতো চিরদুঃখী প্রাণী আমি আর কখনো দিখিনি।
রকেট বলল–তোমার মতো অভদ্র প্রাণীও আমি আর কখনো দেখিনি। আমার মধ্যে যে। বন্ধুত্বের আবেগ রয়েছে তা তুমি বুঝতে পারবে না।
রোমান ক্যানডাল দাঁত খিঁচিয়ে বলল–তুমি তো তাকে এখনো চেনই না হে।
রকেট বলল–চিনি যে সে কথা তো আমি বলিনি। চিনলে তো তার সঙ্গে আমার বন্ধুত্বই হত না। বন্ধুদের চেনা বড়ো বিপজ্জনক।
ফায়ার বেলুন বলল–তুমি বরং নিজেকে শুকনো রাখ হে। ওইটাই সবচেয়ে প্রয়োজনীয়।
রকেট বলল–ওটা নিঃসন্দেহে তোমার কাছে প্রয়োজনীয়। কিন্তু ইচ্ছে হলে আমি কাঁদব তো বটেই।
এই বলেই সে ভেউ-ভেউ করে কেঁদে ফেলল।
ক্যাথারিন হুইল বলল–লোকটা সত্যিকারের রোমান্টিক। যেখানে কাঁদার কিছু নেই সেখানেও কাঁদছে।
কিন্তু রোমান ক্যানডাল আর বেঙ্গল লাইট বিরক্তির সঙ্গে বেশ চেঁচিয়েই বলল–এ একটা হামবাগ!
এরা দুজনেই অত্যন্ত বাস্তবপন্থী। যা ওরা অপছন্দ করত তাকেই হামবাগ বলে চিহ্নিত করত।
ঠিক বারোটার সময় রাজা, রাজকুমার, রাজকুমারী, সভাসদবর্গ এবং অন্যান্য সবাই বেরিয়ে এলেন আতশবাজির খেলা দেখতে। রাজা বললেন–এবার শুরু করা
রাজার আতশবাজিকর মাথাটা নীচু করে অভিবাদন জানিয়ে বাগানের শেষ প্রান্তে চলে। গেল। তার সঙ্গে দু’জন সহকারী। তাদের প্রত্যেকেরই হাতে একটি করে জ্বলন্ত টর্চ লম্বা লাঠির ডগাঘ বাঁধা।
সত্যই বড়ো চমৎকার–বড়ো অদ্ভুত এইসব আতশবাজির খেলা।
হুইজ! উঠে গেল ক্যাথারিন হুইল। ওঠার সময় বন-বন করে ঘুরতে লাগল। বুম! বুম! করতে-করতে উড়ে গেল রোমান ক্যানডালা পুচকে পটকাটা চারপাশে ঘুরবার মতো নাচতে লাগল। বেঙ্গল লাইটগুলি চারপাশ লালচে করে দিল। ছোটো ছোটো নীল রং-এর আভা। ছড়িয়ে ফায়ার বেলুন আকাশে উড়ে যাওয়ার সময় বিদায় জানিয়ে গেল সবাইকে ব্যাও। ব্যাঙ! শব্দে ক্র্যাকাররা ফাটতে লাগল। মনে হল তাদের খুব মজা লাগছে। একমাত্র সেই অত্যাশ্চর্য রকেট ছাড়া আর সবাই বেশ সাফল্যের সঙ্গে সকলকে আনন্দ দিল। কেঁদে-কেঁদে রকেটটি এতই ভিড়ে গিয়েছিল যে তাকে কিছুতেই ওড়ানো গেল না। তার মধ্যে যেটা সবচেয়ে সেরা জিনিস ছিল সেটা হচ্ছে বারুদ। তার সব দরিদ্র বন্ধুবান্ধব যাদের সঙ্গে ঘৃণা ছাড়া আর কিছুর মাধ্যমেই সে কথা বলতে না তারা সবাই আকাশে সোনালি ফুলের রোশনাই জ্বেলে সুন্দর ভাবে সফল হল। সভাসদেরা ‘হুডা, হুজা’ বলে আনন্দে চিৎকার করে উঠল। খুদে রাজকুমারী আনন্দে হাসতে লাগলেন।
রকেট বলল–আমার ধারণা আরো কোনো জাঁকজমকপূর্ণ পরিবেশের জন্যে ওরা আমাকে মজুত রেখেছে। নিঃসন্দেহে এর কারণটা হল তাই। এই ভেবে আগের চেয়ে সে বেশি দম্ভ অনুভব করল।
পরের দিন ভাযগাটা পরিষ্কার করার জন্যে বাগানে মজুররা হাজির হল। রকেট মনে করল। এরাই হচ্ছে প্রতিনিধি দল। আমি এদের বেশ ভারিক্কি চালে অভ্যর্থনা জানাব। এই ভেবে সে বাতাসে নাকটা উঁচিয়ে দিল; তারপর কটমট করে তাকিয়ে রইল তাদের দিকে, মনে হল সে সিরিয়াস কিছু একটা ভাবছে। চলে যাওয়ার আগে পর্যন্ত তারা তার দিকে কোনো নজরই দিল না। তারপরে একজনের চোখ তার ওপরে পড়তেই সে বলে উঠল–এটা একেবারে বাজে। এই
বলে সেটা তুলে নিয়ে দেওয়াল টপকে পাশের খানায় ফেলে দিল সে।
বাতাসের মধ্যে দিযে ঘুরতে-ঘুরতে সে বলল–বাজে-রকেট বাজে-রকেট? অসম্ভব! লোকে আমাকে আশ্চর্য রকেট বলে সম্বোধন করেছে। ও দুটো শব্দের অর্থ প্রায় একই। এই বলে সে। কাদার মধ্যে পড়ে গেল।
কাদার মধ্যে পড়ে সে মন্তব্য করল–জায়গাটা বেশ ভালো লাগছে না তো। এটা বোধ হয় উচ্চ সমাজের ভলকেলি করার জাযগা। স্বাস্থ্য উদ্ধার করার জন্যে তারা হয়তো আমাকে এখানে পাঠিযেছে। আমার স্নায়ুগুলোও কেমন যেন দুর্বল হয়ে পড়েছে। আমারও বিশ্রামের দরকার।
তারপরে একটা বাচ্চা ব্যাঙ সাঁতরে উঠে এল। চকচক করছে তার চোখ দুটো।
ব্যাঙটা বলল–নতুন আমদানি বলে মনে হচ্ছে! যাই তোমরা বল, কাদার মতো জিনিস আর নেই। আমাকে বৃষ্টির জল আর খানা দাও। তাহলেই আমি খুশি।
রকেট বলল–’আহেম, আহেম’। তারপরেই সে কাশতে আরম্ভ করল।
চিৎকার করল ব্যাঙ-তোমার স্বরটা কী চমৎকার! ঠিক ব্যাঙের ডাকের মতো। সত্যি কথা বলতে কি ব্যাঙের ডাকের মতো মধুর সঙ্গীত পৃথিবীতে আর কিছু নেই। আমাদের ক্লাবে। আজ সন্ধেতে যে জলসা বসবে তা তুমি শুনতে পাবে। চাষীর বাড়ির পাশের যে পুরনো। ডাক-পুকুর রয়েছে সেখানে আমরা বসে থাকি আর চাঁদ ওঠার সঙ্গে সঙ্গে গা জুড়ে দিই। আমাদের গান এতই মধুর যে সবাই ডেগে-জেগে সেই গান শোনে। সত্যি কথা বলতে কি গতকালই আমার কানে গেল চাষীর মেযেটা বলছে আমাদের জন্যে রাত্রে তার এ হয়নি। এইভাবে জনপ্রিয় হওয়াটা সত্যিই বড় সন্তোষজনক।
রকেট রেগে বলল–আহেম! আহেম!
তার বিরক্তির কারণ হচ্ছে কথা বলার একটুও সুযোগ সে পাচ্ছে না।
ব্যাঙ বলেই চলল-বড়ো মিষ্টি স্বর তোমার। আশা করি একদিন তুমি ডাক পুকুরে আসবে। আমার ছটা সুন্দরী মেয়ে রয়েছে। তাদের খুঁজতে যাচ্ছি। মিষ্টিজলের মাছটাকেই বড়ো ভয় করে। এও একটা দৈত্য বিশেষ। তাদের ধরে ধরে ব্রেকফাস্ট করতে ওর এতটুকু দ্বিধা হয় না। আচ্ছা, চললাম। আমি তোমাকে নিশ্চিত করে বলতে পারি আমাদের আলোচনাটা বেশ ভালোই লাগল।
রকেট বলল–আলোচনাই বটে! সারাক্ষণ তো তুমিই কথা বলে গেলো একে কি কথাবার্তা বলে?
ব্যাঙ বলল–একজনকে তো শুনতেই হবে। আমি নিজেই নিজের কথা বলতে ভালোবাসি। এতে সময় বাঁচে-তর্কের কচকচানিও শুনতে হয় না।
রকেট বলল–কিন্তু তুমি তর্ক ভালোবাসি।
ব্যাঙ সন্তুষ্ট মনে বলল–তর্কাতর্কি জিনিসটাই হচ্ছে অশালীন। কারণ ভদ্র সমাজে সকলেরই মতামত একই ধরনের। আবার বলছি বিদায। দুরে মেযেদের দেখতে পাচ্ছি।
এই বলে ব্যাঙ সাঁতার দিয়ে চলে গেল।
রকেট নিজের ভাবেই মাতোয়ারা হয়ে বলতে লাগল–তুমি একটি বিরক্তিকর অসভ্য জীব। যারা তোমার মতো নিজের কথাই বলে যখন অপরে আমার মতো নিজের কথা বলতে চায় তাদের আমি ঘৃণা করি। এইটাকেই আমি স্বার্থপরতা বলি। এটা আমার মতো লোকের কাছে খুব ঘৃণ্য কারণ আমার মনটাই হচ্ছে সংবেদনশীল। আমার কাছ থেকেই তোমার। শিক্ষালাভ করা উচিত…অবশ্য এসবের তুমি কিছুই জান না, কারণ তুমি একটি গেঁয়ো ভূত।
তামাটে রঙের লম্বা ঘাসের ওপরে একটা ফডিং বসেছিল। সে বলল–তার সঙ্গে কথা বলে আর লাভ কী? সে তো চলে গিয়েছে।
রকেট বলল–তাতে ক্ষতি তারই হয়েছে। সে আমার কথা শুনল না বলেই আমি তার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করতে পারি নে। নিজের সঙ্গে কথা বলতে আমি সব সময়েই ভালোবাসি। মাঝে-মাঝে অনেকহণ ধরে নিজের সঙ্গেই আমি নিজে কথা বলি; আর আমি এতই বুদ্ধিমান যে মাঝে-মাঝে আমি নিজে যা বলি তার একটি বর্ণও বুঝতে পারি নে।
তাহলে নিশ্চয় তোমার দর্শনশাস্ত্রের ওপর বক্তৃতা দেওয়া উচিত–এই বলে দুটি ডানা মেলে ফড়িংটা উড়ে গেল।
রকেট বলল–কী বোকা! চলে গেল। আমি নিশ্চিত যে নিজেকে উন্নত করার এরকম সুযোগ সে খুব একটা বেশি পাবে না। মরুক গে; আমার প্রতিভা একদিন না একদিন স্বীকৃত হবেই।–এই বলে কাদার মধ্যে আর একটু ডুবে গেল সে।
অনেকক্ষণ পরে সাঁতরাতে-সাঁতরাতে একটা সাদা পাতিহাঁস সেখানে এসে হাজির হল। তার পা দুটি হলদে, তার চলার বা ভাসার গতিটা বড়োই সুন্দর।
কোয়াক, কোয়াক, কোয়াক! কী অদ্ভুত চেহারা গো তোমার? জন্ম থেকেই কি তোমার এইরকম চেহারা? না, কোনো দুর্ঘটনায় পড়ে এইরকম হয়েছে?
রকেট বলল–তোমার কথা শুনে বেশ বোঝা যাচ্ছে যে চিরকালই তুমি পাড়াগাঁয়ে বাস কর, তা না হলে, আমি কে তা তুমি বুঝতে পারতো যাই হোক, তোমার এই অজ্ঞতাকে আমি ক্ষমা করলাম। শুনলে তুমি খুশিই হবে যে আকাশে আমি উড়ে যেতে পারি; আর নেমে আসার সময় চারপাশে ছড়িয়ে দিই সোনালি বৃষ্টির ধারা।
পাতিহাঁস বলল–ওসব কথার খুব একটা দাম আমার কাছে নেই কারণ ওর কোনো প্রয়োজনীয়তা রয়েছে বলে আমি মনে করি লো তুমি যদি ষাঁড়ের মতো লাঙল চষতে পারতে, অথবা ঘোড়ার মতো গাড়ি টানতে পারতে, অথবা কুকুরের মতো ভেড়ার দল পাহারা দিতে পারতে–তাহলেও তবু একটা কথা ছিল।
বেশ রাগত কণ্ঠেই রকেট বলল–বৎস, দেখতে পাচ্ছি তুমি নীচ জাতীযা। আমার মতো প্রাণীর কতকগুলি উঁচু ধরনের গুণ রয়েছে। সেগুলিই যথেষ্ট। উৎপাদক ডাতীয় কোনো জিনিসের ওপর আমার কোনো সহানুভূতি নেই; বিশেষ করে যে সব জিনিসের কথা তুমি। এইমাত্র বললে। আমার ধারণা, কঠোর পরিশ্রমের আড়ালে তারাই আশ্রয় নেয় যাদের আর কিছু করার নেই।
পাতিহাঁসের কারও সঙ্গেই কোনো বিরোধ নেই। সে বড়ো শান্তিপ্রিয় জীব। সে বলল–ঠিক আছে, বিভিন্ন মানুষের রুচি বিভিন্ন। যাই হোক, আশা করি এখানেই তুমি থেকে যাচ্ছ?
রকেট বলল–না, না। আমি এখানে একটি সম্মানিত অতিথিমাত্রা সত্যি কথা বলতে কি জায়গাটা আমার মোটেই ভালো লাগছে না। এখানে সমাড বা নিউলতা কোনোটাই নেই। সম্ভবত আমি রাজসভাতেই ফিরে যাব। কারণ আমি জানি বিরাট একটা আলোড়ন সৃষ্টি করতেই আমার জন্ম হয়েছে
পাতিহাঁস বলল আমি নিজে একবার পাবলিক লাইফ-এ ঢোকার চেষ্টা করেছিলাম। দেখলাম সেখানে অনেক কিছু সংস্কার করার প্রযোজনীয়তা রয়েছে। একবার একটা সভায়। সভাপতি হয়েছিলাম। আমরা যা পছন্দ করিনে সে সব বিষয়কে নিন্দা করে সেখানে আমরা অনেকগুলি প্রস্তাব গ্রহণ করেছিলাম। তাতে কিছু লাভ হয়নি। এখন আমি গৃহকর্মে চললাম।
রকেট বলল–আমার জীবন কিন্তু জনসেবায় উৎসর্গীকৃত। আমার আত্মীয়-স্বজনরাও তাই–এমন কি তাদের মধ্যে সবচেয়ে যে দরিদ্র সে-ও। আমরা প্রকাশ্যে এসে দাঁড়ালেই সকলের দৃষ্টি আমাদের ওপরে গিয়ে পড়ে। আমি অবশ্য এখনো প্রকাশ্যে আবির্ভূত হয়নি। হলে একখানা দারুণ আলোড়ন পড়ে যাবো আর ঘর-সংসারের কাজ? ওর মধ্যে মাথা গলালেই বুড়িয়ে যায় মানুষ। উঁচু আদর্শ থেকে বিচ্যুত হতে হয়।
পাতিহাঁস বলল–উঁচ আদর্শই বটে। আর এই আদর্শের জন্য কত অনাহাবেই না থাকতে হয়েছে–এই বলে ‘কোযাক-কোয়াক’করে ডাকতে-ডাকতে সে মাঝ দরিযার দিকে সাঁতার কেটে বেরিয়ে গেল। রকেট প্রায় কেঁদে ফেলে আর কি। চেঁচাতে লাগল সে-ফিরে এস, ফিরে এস তোমাকে আজ একটা বড়ো আদর্শের কথা শোনাব।
আর বড়ো আদর্শ! সে তখন অনেক দূরে।
রকেট তখন নিজের মনে-মনেই বলল–যাকগে। ভালোই হয়েছে। ওর মনটা যে মধ্যবিত্ত সেদিক থেকে আমি নিশ্চিত।
এই বলে সে কাদার আর একটু নীচে ডুবে গোল; ভাবতে লাগল এ-দুনিয়ায় প্রতিভার নিঃসঙ্গতার কথা। ঠিক এমনি সময় কয়েকটা সাদা ঢিলে জামা পরে, একটা কেতলি আর কিছু জ্বালানি কাঠ নিযে কয়েকটা বাচ্চা ছেলে সেই দিকে ছুটে এল।
রকেট ভাবল-এরা বোধ হয় একদল প্রতিনিধি।
এই ভেবে নিজেকে সে সম্ভ্রান্ত করে তোলার চেষ্টা করল।
একটা ছেলে চিৎকার করে উঠল-দেখ, দেখ, এটা একটা ওলড়স্টিক। এ এখানে এল কি ক’রে বল তো?
এই বলে গর্তের ভেতর থেকে রকেটটাকে টেনে বার করল।
রকেট ভাবল—’ও-ল-ড’! অসম্ভব! ওরা নিশ্চয় বলেছে ‘গো-ল-ড স্টিক’। ‘গোলড’ শব্দটা বড়োই প্রশংসাসূচক!
আর একটা ছেলে বলল–ওটাকে পুড়িয়ে ফেলি আয়। কেতলিটা ফুটবে ভালো।
এই কথা বলে জ্বালানি কাঠগুলো একসঙ্গে ভড় করে রকেটটাকে তাদের ওপরে বসাল; তারপরে আগুন ধরিয়ে দিল।
রকেট বেশ উল্লসিত হয়ে বলল–চমৎকার, চমৎকার। যাতে সবাই আমাকে দেখতে পায় এই উন্যে এরা আমাকে দিনের বেলাতেই ফাটাচ্ছে।
ছেলেরা বলল–এখন ঘুমিয়ে পড়ি আয। ঘুম থেকে উঠে দেখবি ডল গরম হয়ে গিয়েছে।
এই বলে তারা সটান ঘাসের ওপরে শুয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল।
রকেটটা ভিজে থাকায় শুকনো হতে একটু সময় নিল। তারপরে পুড়তে শুরু করল।
সে চিৎকার করে বলল–এখন আমি উড়ছি। আমি জানি নক্ষত্র বা চাঁদের চেয়েও উঁচুতে উঠব আমি সত্যি কথা বলতে কি আমি এত উঁচুতে উঠব যে—
ফিড-ফিজ-ফিজ! তারপরেই সে আকাশে উড়ে গেল।
নিজের মনেই সে চিৎকার করে উঠল-সুন্দর, সুন্দর! চিরকাল আমি এইভাবে উড়ব।
কিন্তু কেউ তাকে দেখল না।
তারপরেই সে সারা শরীরে একটা তীব্র যন্ত্রণা অনুভব করল।
সে চিৎকার করে উঠল–এখন আমি ফেটে যাব। সমস্ত পৃথিবীর ওপরে আগুন জ্বালিয়ে দেব আমি। এমন সাড়া জাগাব যে একটা বছর মানুষ আর কোনো কথা নিয়ে আলোচনা করবে না। আর সত্যিই সে ফাটল। ব্যাঙ, ব্যাঙ, ব্যাঙ। বারুদ ফাটছে।
কিন্তু কেউ সেই শব্দ শুনতে পেল না। এমনকি সেই বাচ্চা ছেলেদেরও ঘুম ভাঙল না।
বাকি রইল কেবল একখানা ছড়ি। সেটা গিয়ে পড়ল একটা হাঁসের পিঠে হাঁসটা তখন খানার ধারে ধীরে ধীরে বেড়াচ্ছিল।
হাঁসটা চিৎকার করে উঠল-হা ঈশ্বর! আজ কি ছড়ি বৃষ্টি হবে?
এই বলে সে দৌড়ে জলের ওপরে নেমে গেল।
রকেটটা হাঁপাতে হাঁপাতে বলল–’আমি জানতাম, আমি একটা বিরাট আলোড়নের সৃষ্টি করব।’
এই কথা বলেই সে শেষবারের মতো নিবে গেল।