লর্ড আর্থার সেভাইল-এর অপরাধ

লর্ড আর্থার সেভাইল-এর অপরাধ
Lord Arthur Savile’s crime

০১.

ইস্টারের আগে লেডি উইনডারমিয়ারের এইটাই হচ্ছে শেষ ভোজের আয়োজন। বেনটি হাউস-এ এইসব আসরের সাধারণত যত অতিথি আসেন এবারে এসেছেন তার চেয়ে অনেক বেশি। সরকারি তকমা এঁটে আর জাঁকজমক পোশাক পরে এসেছেন ছ’জন কেবিনেট মন্ত্রী। সুব সুন্দরী মহিলাই তাঁদের সেরা পোশাক পরেছন। আর পিকচার গ্যালারির শেষ প্রান্তে প্রিনসেস সোফিযা দাঁড়িয়ে রয়েছেন। চার্লসরুহীর রাজকুমারী তিনি। দেখতে বেশ মোটা ভারী তাতার রমণীর মতো ছোটো ছোটো কালো চোখ; তিনি বেশ জোরে ডোরে বিকৃত উচ্চারণে ফরাসী ভাষায় কথা বলছিলেন। তাঁকে লক্ষ করে যাই বলা হোক না কেন তাই শুনে তিনি অশালীন ভাবে হাসছিলেন। কত বিভিন্ন প্রকৃতির মানুষেরই না সমাবেশ হয়েছিল এখানে। শৌখিন পোশাক পরে পিয়ারসরা অমায়িকভাবে উগ্রপন্থী ব্র্যাডিক্যালদের সঙ্গে গল্প। করছিলেন, জনপ্রিয় ধর্মপ্রচারকরা প্রথিতযশা নাস্তিকদের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী হয়ে বসেছিলেন, নিয়মনিষ্ঠ রুচিশীলা মহিলা পাদরির দল বেশ স্বাস্থ্যবতী নর্তকীদের সঙ্গে ঢলাঢলি করছিলেন। কলাবিদের বেশ ধরে কয়েকজন রয়্যাল অ্যাকাডেমিসিয়েনরা সিড়িঁর ওপরে দাঁড়িয়েছিলেন। শোনা যায় একসময় খাবার ঘর প্রথম শ্রেণির জিনিযাসে একেবারে গিজগিজ করত। সত্যি কথা বলতে লেড উইনডারমিয়ারের এটি হচ্ছে একটি উৎকৃষ্ট ভোজসভা। প্রিনসেস প্রায় রাত্রি সাড়ে এগারটা পর্যন্ত সেখানে ছিলেন।

তিনি প্রস্থান করার পরেই লেডি উইনডারমিয়ার পিকচার গ্যালারিতে ফিরে এলেন। সেইখানে একজন বিদগ্ধ রাজনৈতিক অর্থনীতিবিশারদ পণ্ডিত হাঙ্গেরি থেকে আগত সূক্ষ চারুকলার সমঝদারের কাছে সঙ্গীতের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা বেশ সমারোহের সঙ্গেই। করছিলেন। তাঁর সেই বিদগ্ধ আলোচনা শুনে চারুকলার সমঝদার বিষম বিতৃষ্ণায় তাঁর। নাসিকা আর ভুরুযুগল কুঞ্চিত করছিলেন। এই দেখে অর্থনীতিবিশারদ সেইসলের ডাচেসের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করলেন। ডাচেসের গলার রঙ হাতির দাঁতের মতো সাদা; আমাকে-ভুলোনা গোছের সুন্দর নীল চোখ, আর এক গোছা সোনালি কেশের স্তুবক। সব জড়িয়ে তাঁর দেহ-সৌষ্ঠভটি বড়োই মনোরম দেখাচ্ছিল। তাঁর মুখের ওপরে যুগপৎ একজন সাধুর শান্ত সমাহিত মুখভঙ্গিমার সঙ্গে পাপীর মুখের আকর্ষণ পরিস্ফুট হয়ে উঠেছিল। মনস্তাত্ত্বিক গবেষণার প্রশস্ত ক্ষেত্র বলে মনে হয়েছিল তাঁকে। প্রথম জীবনে একটি মূল্যবান সত্য তিনি আবিষ্কার করেছিলেন। সেটি হচ্ছে এই যে অস্থিরচিত্ততার মতো নিরপরাধ জিনিস আর কিউ নেই এবং অজস্র হঠকারী উচ্ছৃংখল আচরণের মাধ্যমে, যাদের অর্ধেকগুলিই নিরপরাধ বলে বিবেচিত হয়েছিল, ব্যক্তিত্ব অর্জনের সমস্ত সুযোগ তিনি পেয়েছিলেন। তিনি একবারের বেশি স্বামী পরিবর্তন করেছিলেন, সত্যি কথা বলতে কি দেব্রেত সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন তিনটি বিয়ের। কিন্তু প্রেমিককে তিনি কোনোদিনই বর্জন করেননি। ফলে, তাঁর কলঙ্কের কথা সমাজ আর এখন আলোচনা করে না। মাত্র চল্লিশ বছর তাঁর বয়স, কোনো সন্তান নেই তাঁর। রয়েছে কেবল আনন্দ করার অসম্ভব মাদকতা। যৌবনকে বজায় রাখার এইটিই হল প্রধান উপায়।

হঠাৎ তিনি ঘরের চারপাশে একবার তাকিয়ে নিলেন; তারপরে জিজ্ঞাসা করলেন–আমার ‘চিরোম্যানটিস্ট’ কোথায়?

হঠাৎ চমকে ডাচেস চিৎকার করে উঠলেন-তোমার কী, গ্ল্যাডিস?

 আমার ‘চিরম্যানটিস্ট’, ডাচেস। বর্তমানে ওঁকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারি নে।

ডাচেস বুঝতে পারলেন আসল শব্দটা হল ‘চিরোপোডিস্ট’ (যে চিকিৎসক পা, পায়ের নখ, কড়া ইত্যাদির চিকিৎসা করে); বুঝতে পেরেই বললেন–না গ্ল্যাডিস; তুমি একটি অদ্বিতীয়া।

লেডি উইনডারমিয়ার বললেন–প্রতিটি সপ্তাহে দু’বার করে নিয়মিত ভাবে তিনি আমার হাত দেখে যান, এবং তিনি নিজেই এবিষয়ে অত্যন্ত কৌতূহলী।

ডাচেস নিজের মনে-মনেই বললেন–হা ঈশ্বর! লোকটা চিরোপোডিস্ট ছাড়া আর কিছু নয়। কী ভয়ঙ্কর! আশা করি, লোকটি বিদেশি। তাহলে, ব্যাপারটা নিয়ে ভাবনার কিছু নেই।

আমি নিশ্চয় তোমার সঙ্গে তাঁর আলাপ করিয়ে দেব।

 ডাচেস প্রায় চিৎকার করে উঠলেন–আলাপ! তুমি নিশ্চয় বলতে চাও না যে তিনি এখানেই রয়েছেন।এই বলে তিনি কচ্ছপের খোলার ছোটো পাখা আর ‘লেস’ দেওয়া শালটা নেওয়ার জন্যে চারপাশে একবার তাকালেন। মনে হল, তিনি এখনই ওখান থেকে চলে যাবেন।

 নিশ্চয়। তিনি তো এখানেই রয়েছেন’–বললেন লেডিউইলডারমিযারা তাঁকে বাদ দিয়ে পার্টি দেওয়ার কথা আমি ভাবতেই পারিনি। তিনি বলেন আমার হাতটা নাকি একেবারে। আধ্যাত্মিক, আর আমার বুড়ো আঙুলটা যদি আর একটু ছোটো হত তাহলে আমি একবার পুরোপুরি নাস্তিক হয়ে সোজা মঠে চলে যেতাম।

বেশ কিছুটা আশ্বস্ত হয়ে ডাচেস বললেন–তাই বুঝি! মনে হচ্ছে তিনি ভাগ্য গণনা করেন তাই না?

লেডি উইনডারমিয়ার বললেন–এবং দুর্ভাগ্যও; অনেক অনেক দুর্ভাগ্য। ধরুন, দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, আগামী বছর জল আর স্থল দু’জায়গাতেই আমার বিপদ ঘটতে পারে। তাই আমি ঠিক করেছি ওই সময়টা আমি বেলুনে বাস করব; আর প্রতিদিন একটা বাক্স করে আমার ডিনার। নিয়ে যাব। এ-সব কথা আমার বুড়ো আঙুলে লেখা রয়েছে। হাতের চেটোতেও থাকতে পারে। ঠিক কোথায় লেখা রয়েছে তা আমার মনে নেই।

বল কী গ্ল্যাডিস? এতে ঈশ্বরও প্রলুব্ধ হবেন যে দেখছি।

প্রিয় ডাচেস, এর মধ্যে ঈশ্বর নিশ্চয় প্রলোভনকে এড়াতে পারবেন। আমার বিশ্বাস প্রত্যেকেরই মাসে অন্তত একবার করে হাত দেখানো উচিত। কী তার করা উচিত নয় সেটা তাহলে সে বুঝতে পারবে। তবে তা জেনেও মানুষ সব কাজই করে। কিন্তু আগে থাকতে বিপদের সঙ্কেত পাওয়াটা খুবই মনোরম। এখন কেউ যদি গিয়ে মিঃ পডগারসকে এক্ষুনি এখানে ডেকে না আনেন তাহলে আমাকেই যেতে হবে।

একটি দীর্ঘকায় সুন্দর যুবক এতক্ষণ দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে সব শুনছিলেন। শুনতে-শুনতে একটু হাসছিলেনও। তিনি বললেন–আমি যাচ্ছি, লেডি উইনডারমিয়ার।

ধন্যবাদ, লর্ড আর্থার। কিন্তু ভয় হচ্ছে আপনি হয়তো তাঁকে চিনতে পারবেন না।

 তিনি যদি আপনার মতোই অনবদ্য হন তাহলে চিনতে অবশ্য আমার ভুল হবে না। কেমন দেখতে বলুন তো। আমি এখন তাঁকে আপনার কাছে নিয়ে আসছি।

 মানে, চিরোম্যানটিস্টের মতো আদৌ তিনি দেখতে নন। অর্থাৎ, তিনি অদ্ভুত চেহারার মানুষ নন, অথবা, রোমান্টিকও মনে হবে না তাঁকে। বেশ শক্তসমর্থ চেহারা তাঁর, বেশ রসিক-মাথায় টাক চোখে সোনার পাতে মোড়া চশমা। অনেকটা গৃহচিকিৎসক আর গ্রামের উকিলের মাঝামাঝি চেহারা তাঁর। আমি সত্যিই খুব দুঃখিত; কিন্তু তার জন্যে আমি দায়ী নই, মানুষরা সত্যিকার বড়োই বিরক্তিকর। আবার যাঁরা পিয়ানো বাজান তাঁদের সকলের চেহারা কবিদের মতো। আর আমার পরিচিত সব কবিরাই পিয়ানো বাজিয়েদের মতো। দেখতে। আমার বেশ মনে রয়েছে গত বছর আমি একজন ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্রকারীকে ডিনারে নিমন্ত্রণ করেছিলাম। লোকটি সব সময় সাঁজোয়ার কোট পরত; তার শার্টের ভেতরে লুকানো থাকত একটা ছোরা। আপনি কি জানেন লোকটি যখন আসত তখন তাকে একটি চমৎকার বৃদ্ধ পাদরি বলে মনে হত; আর সারা সন্ধেটাই রসিকতা করে তিনি আসর জমিয়ে রাখতেন? কিন্তু তা সত্ত্বেও, আমি খু বই নিরাশ হয়েছিলাম। আমি যখন তাকে ও সাঁজোয়ার কোটের কথা জিজ্ঞাসা করলাম তখন তিনি কী বললেন জানেন? কেবল হেসে বললেন ইংলন্ডে ঠান্ডা এত বেশি যে ওই কোট এখানে পরা যায় না। আরে, ঐ তো মিঃ পডগারস, সেইসলের ডাচেসের হাতটা দেখতে আমি আপনাকে অনুরোধ করছি। ডাচেস, তোমার দস্তানাগুলো খুলে ফেলা না, না-বাঁ হাত নয়; না, না-বাঁ হাত নয়; ডান হাত।

ভিজে ‘কিড’ দস্তানা আস্তে-আস্তে খুলে ডাচেস বললেন–প্রিয় গ্ল্যাডিস, না না–ঠিক হচ্ছে না…

লেডি উইনডারমিয়ার বললেন–দুনিয়াটাই এমনি। এখানে কিছুই কৌতূহলোদ্দীপক নয়। কিন্তু তোমার সঙ্গে পরিচয় আমাকে করিয়ে দিতে হবে। ডাচেস, ইনি হচ্ছেন, আমার প্রিয় চিরোম্যাটিস্টি, মিঃ পডগারস; ইনি হচ্ছেন সেইসলের ডাচেস। আপনি যদি বলেন ওঁর হাতে যে চাঁদের পাহাড় রয়েছে সেটা আমর চেয়ে বড়ো তাহলে আর কোনোদিনই আমি আপনাকে বিশ্বাস করব না।

ডাচেস গম্ভীরভাবেই বললেন–আমার হাতে নিশ্চয় ওসব কোনো বস্তু নেই।

তাঁর ছোট চ্যাপ্টা চতুর্ভুজ আঙুলগুলি দিয়ে ডাচেসের মোটা ছোটো হাতের দিকে তাকিয়ে। মিঃ পডগারস বললেন–ডাচেস সত্যি কথাই বলেছেন। চাঁদের পাহাড় এখনও বেড়ে ওঠেনি; কিন্তু জীবনের রেখাঁটি সত্যিই বড়ো ভালো। দয়া করে কলিটা একটু বাঁকাল। ধন্যবাদ। তিনটি রেখা আপনার হাতে এডোএড়ি হয়ে রয়েছে। আপনি অনেক দিন বেশ সুখেই বাঁচবেন।

উচ্চাকাঙ্খা-মোটামুটি বুদ্ধির রেখাটা খুব একটা মারাত্মক রকমের নয়, হৃদয়রেখা–

লেডি উইনডারমিয়ার একটু চেঁচিয়েই বললেন–এবারে কিন্তু সাবধান।

 মিঃ পডগারস মাথাটা নুইয়ে বললেন–ডাচেস যদি বিচক্ষণ হতেন সেকথা বলতে আমি খুব খুশিই হতাম, কিন্তু একথা বলতে আমি খুবই দুঃখিত যে ওঁর হাতের ওপরে যেসব চিহ্ন দেখতে পাচ্ছি তা থেকে বোঝা যাচ্ছে উনি হৃদযবতী মহিলা; এবং ওঁর কর্তব্যজ্ঞান বড়ো টনটনে।

বেশ সন্তুষ্ট হয়ে ডাচেস বললেন–অনুগ্রহ করে বলে যান মিঃ পডগারস।

মিঃ পডগারস বললেন–ডাচেস, মিতব্যয়িতার কোনো লক্ষণ আপনার হাতে প্রতীয়মান হচ্ছে না।

এই কথা শুনে লেডি উইনডারমিয়ার হেসে কুটিকুটি হয়ে গেলেন।

ডাচেস সন্তুষ্ট হয়ে বললেন–মিতব্যয়িতা বড়ো ভালো জিনিস। আমি যখন পেইসলকে বিয়ে করেছিলাম তখন তার সাতটি দুর্গ ছিল; বাস করার মতো বাড়ি ছিল না একটাও।

লেডি উইনডারমিয়ার বললেন–এখন তাঁর বারোটা বাড়ি রয়েছে; একটাও দুর্গ নেই।

ডাচেস বললেন–আসল কথাটা কী ডান? আমি চাই

শেষ করলেন মিঃ পডগারস–সুখ, আর চান প্রতিটি ঘরে আধুনিক সাজসজ্জা এবং প্রতিটি যার ঘরে গরম জল। আপনি ঠিকই বলেছেন। সুখ আর স্বাচ্ছন্দ্যই একমাত্র জিনিস বর্তমান সভ্যতা আমাদের যা দিতে পারো।

ডাচেসের চরিত্রের সম্বন্ধে আপনি চমৎকার বলেছেন, মিঃ পডগারস। এবার আপনি লেড ফ্লোরার হাত দেখে বলুন।

 হাস্যমানা গৃহস্বামিনীর ইঙ্গিতে সোফা থেকে উঠে দাঁড়ালেন একটি দীর্ঘাঙ্গিনী বালিকা। তাঁর চুলগুলি স্কটল্যান্ডের বালির মতো কটা, চওড়া কাঁধ। জড-ভরতের মতো সামনের দিকে। এগিয়ে এসে তিনি তাঁর ছুঁচোল আঙুলগুলি বাড়িয়ে দিলেন।

 মিঃ পডগারস বললেন–আপনি তো দেখছি পিয়ানো বাজিয়ে, চমৎকার পিয়ানো বাজান আপনি। কিন্তু গায়িকা আপনি নন। খুব সংযত, অতিরিক্ত ন্যায়বাদিনী; আর জীবদের ওপরে আপনার স্নেহ অগাধা।

লেডি উইনডারমিয়ারের দিকে তাকিয়ে ডাচেস বললেন–খাঁটি কথা; একেবারে খাঁটি কথা! ম্যাক্রোসকিতে ফ্লোরার দু’ডজন নেড়ি কুত্তা রয়েছে; ওর বাবা রাজি হলেও ওদের বাড়িটাকে একটি পশ্বাগারে পরিণত করে ফেলতা।

লেডি উইনডারমিয়ার হেসে বললেন–প্রতি বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় আমার বাড়িটা যা হয়। তবে নেড়ি কুত্তার চেয়ে আমি বেশি পছন্দ করি সিংহকে।

খুব আড়ম্বরের সঙ্গে মিঃ পডগার মাথাটা নুইয়ে বললেন–লেডি উইনডারমিয়ার, আপনার একটি ভুল হচ্ছে

লেডি উইলডারমিযার বললেন–যদি কোনো মহিলা তার ভুলগুলিকে মনোরম করে তুলতে পারে তা হলে সে নিছক নারী ছাড়া আর কিছু নয়। আরও কয়েকজনের হাত আপনাকে আজ দেখতে হবে। স্যার টমাস, আপনি হাত দেখান।

সাদা ওয়েস্ট কোটপরা একটি শান্ত চেহারার বৃদ্ধ ভদ্রলোক এগিয়ে এস তাঁর পুরুষ্ট লম্বা তৃতীয় আঙুলটি বাড়িয়ে দিলেন।

আপনার চরিত্রটি দুঃসাহসিক। অতীত আপনি চারবার দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রা করেছেন। আর একবার করবেন। আপনার জাহাজ তিনবার দুর্ঘটনায় পড়েছিল। না, দু’বার। কিন্তু ভবিষ্যতে আর একবার দুর্ঘটনায় পড়ার সম্ভবনা রয়েছে। আপনি খুব শক্ত কারভেটিভ, সময়ের জ্ঞান আপনার টনটনে; আর অদ্ভুত-অদ্ভুত জিনিস সংগ্রহ করার দিকে ঝোঁক রয়েছে আপনার। ষোল থেকে আঠারো বছর বয়সের মধ্যে আপনার একবার কঠিন অসুখ করেছিল। তিরিশ বছর বয়সে আপনি অনেক সম্পত্তি পেয়েছিলেন। বিড়াল আর র‍্যাডিকেলদের ওপরে আপনার বিতৃষ্ণা অগাধা

স্যার টমাস বললেন–অদ্ভুত, অদ্ভুত! আপনি আমার স্ত্রীর হাতটাও দেখুন।

স্যার টমাসের হাতটা নিজের হাতের ওপরে রেখে তিনি বললেন–আপনার দ্বিতীয়া স্ত্রীর। খুশি হয়েই দেখব।

লেডি মার্ভেলের চেহারাটি বিষণ্ণ, কটা চুল, চোখ দুটো ভাবপ্রবণ। তাঁর অতীত আর ভবিষ্যৎ প্রকাশ হয়ে পড়ুক তা তিনি ঠিক চাচ্ছিলেন না। লেডি উইনডারমিয়ার যাই চান, রাশিয়ার রাষ্ট্রদূতও তাঁর দস্তানা খুলতে রাজি হলেন না। সত্যি কথা বলতে কি অনেকেই এই অদ্ভুত। হাসির খুদে লোকটির মুখোমুখি পড়তে রাজি হচ্ছিলেন না। তারপরে তিনি যখন লেডি ফারমারকে মুখের ওপরে বলে দিলেন যে সঙ্গীতের ওপর তাঁর বিন্দুমাত্র আকর্ষণ নেই তখনই সবাই বুঝতে পারলেন এক খোশ গল্প ছাড়া হাত দেখা ব্যাপারটাকে বেশি প্রশ্রয় দেওয়া উচিত নয়।

লেডি ফারমোরের দুর্ভাগ্যজনক কাহিনি লর্ড আর্থার সেভাইল জানতেন না। তিনি বিরাট একটি কৌতূহল নিয়ে মিঃ পডারস-এর দিক তাকিয়ে রইলেন। নিজের হাতটা দেখানোর। খুব ইচ্ছা হল তাঁর। কিন্তু হাত দেখাতে তাঁর বেশ লজ্জা হচ্ছিল। লেডি উইনডারমিয়ার যেখানে বসেছিলেন সেইখানে গিয়ে একটু মিষ্টি হেসে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন:হাত দেখালে কি মিঃ পডগারস কিছু মনে করবেন?

লেডি উইনডারমিয়ার বললেন–নিশ্চয় না। সেইজন্যেই তো তিনি এখানে এসেছেন। লর্ড আর্থার, আমার সমস্ত সিংহই সিংহের মত খেলা করেন; যখনই আমি বলব তখনই তাঁরা। সার্কাসের ঘেরাটোপের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়বেন। কিন্তু আপনাকে আমি প্রথমেই সাবধান করে দিচ্ছি যে সব কথা আমি সাইবিলকে বলে দেব। আগামী কাল সে আমার সঙ্গে লাঞ্চ খেতে আসবে, সেই সঙ্গে বোনেট’ (মহিলাদের মস্তকাবরণ) নিয়ে কিছউ আলোচনাও করবে আমার সঙ্গে। যদ মি: পডগারস আপনার সম্বন্ধে এমন কিছু কথা বলেন–এই ধরুন, আপনার হয়তো বাতের লক্ষণ রয়েছে, আপনার মেভাডটা বেশ রুক্ষ, অথবা, আপনার একটা স্ত্রী ‘বেযেসওয়াটারে’ থাকে তাহলে সেসব কথা নিশ্চয় আমি তাকে জানিয়ে দেব।

একটু হেসে লর্ড আর্থার মাথা নেড়ে বললেন–ওকে আমার ভয় নেই। দুজনেই আমরা দুজনকে ভালভাবে চিনি।

তাই বুঝি! একথা শুনে আমি কিঞ্চিৎ দুঃখিত হচ্ছি। কারণ, বিয়ের আসল কথাই হচ্ছে স্বামী আর স্ত্রীর মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস না, না, বিবাহের সতোকে আমি অবিশ্বাস করছি নে; ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকেই আমি এই কথা বললাম। দুটোর মধ্যে ফারাক অবশ্য বিশেষ কিছু একটা নেই। মিঃ পডগারস, লর্ড আর্থার সেভাইল তাঁর হাত দুটি দেখানোর জন্যে একেবারে উন্মাদ হয়ে উঠেছেন। লনডনের সবচেয়ে সুন্দরী একট যুবতীর সঙ্গে ওঁর যে বিয়ের ব্যবস্থা পাকা হয়ে গিয়েছে সেকথা আপনি যেন বলবেন না; কারণ মাসখানেক আগে ‘মর্নিং পোস্ট’ কাগজেই সে-সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে।

জেডবার্ডের মার্কুইস-পত্নী চিৎকার করে বললেন–প্রিয় লেডি উইনডারমিয়ার, মিঃ। পডগারসকে এখানে আর একটু থাকতে বলুন। তিনি এইমাত্র বললেন যে আমি একজন অভিনেত্রী হব, কথাটা শুনে আমার বড়ো কৌতূহল হয়েছে। লেড জেডবার্ড, মিঃ পডগারস যদি ওই কথা বলে থাকেন তাহলে তাঁকে আমি নিশ্চয় সরিয়ে নেব। মিঃ পডগারস, আপনি এখানে লর্ড আর্থারের হাতটা দেখুন তো? লেড জেডবার্ড একটু নড়ে-চড়ে বললেন–স্টেডে নামাটা যদি সম্ভব না হয় তাহলে অন্তত, দর্শকবৃন্দের একজন হতে পারি।

লেডি উইনডারমিয়ার বললেন–অবশ্যই আমরা সবাই দর্শকবৃন্দের অংশ হতে যাচ্ছি। এখন মিঃ পডগারস আমুল; এর সম্বন্ধে কিছু ভালো কথা বলুন; ইনি আমার বিশেষ অনুগৃহীত।

কিন্তু মিঃ পডগারস লর্ড আর্থারের হাত দেখেই কেমন যেন বিবর্ণ হয়ে গেলেন। মনে তিনি যেন শিউরে উঠলেন। তাঁর লোমশ ভ্রুযুগল কুঁচকে উঠল। কিছুটা বিভ্রান্ত মনে হল তাঁকে। তারপরে কয়েকটি মোটা মোটা ঘামের ফোঁটা জমে উঠল তাঁর কপালের উপরে।

লর্ড আর্থারও তাঁর এই পরিবর্তন লক্ত করলেন। জীবনে এই প্রথম বোধ হয় তিনি একটু ভয় পেলেন। একবার মনে হয়েছিল ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে যাবেন তিনি। কিন্তু তারপরেই তিনি নিজেকে সামলে নিলেন। তিনি ভাবলেন ভবিষ্যৎ যত ভয়ঙ্করই হোক অনিশ্চয়তার মধ্যে না থেকে বরং তা আগে থাকতে জানাই ভালো।

তিনি বললেন মিঃ পডগারস, আমি অপেক্ষা করছি

অস্থিরভাবে লেডি উইনডারমিয়ার-ও বললেন–আমরা সবাই অপেক্ষা করে রয়েছি।

কিন্তু তিনি কোনো উত্তর দিলেন না।

হঠাৎ তিনি আর্থারের ডান হাতটা ছেড়ে দিয়ে বাঁ হাতটা তুলে নিলেন। তারপরে সেই হাতটা চোখের একেবারে সামনে তুলে এনে গভীরভাব দেখতে লাগলেন। এক মুহূর্তের জন্যে তাঁর মুখটা কেমন যেন ফ্যাকাশে হয়ে গেল; কিন্তু তারপরে নিজেকে সামলে নিয়ে লেডি উইনডারমিয়ারের দিকে তাকিয়ে কষ্ট করে হেসে বললেন–হাত তো ভালোই অর্থাৎ মনোমুগ্ধকর যুবকের হাত যেমন হওয়া উচিত।

লেডি উইলডারমিযার বললেন–সে তো বটেই। সে তো বটেই। কিন্তু উনি কি মনোমুগ্ধকর স্বামী হতে পারবেন? সেইটাই আমি সেইটাই আমি জানতে চাই।

 লেড জেডবার্ড আস্তে-আস্তে বললেন–আমার মনে হয় না কোনো স্বামীরই বেশিমাত্রায় আকর্ষণী শক্তি থাকা উচিত। থাকলে, সেটা বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়াবে।

লেডি উইনডারমিয়ার বললেন–বৎসে, স্বামীদের কোনোদিনই স্ত্রীকে আকর্ষণ করার শক্তি থাকে না। কিন্তু আমি চাই খুঁটিনাটি বিষয়ে জানতে। মানুষের আগ্রহ-ই তো খুঁটিনাটি জানার। লর্ড আর্থারের ভবিষ্যৎটা কী রকম তাই বলুন।

কয়েক মাসের মধ্যেই লর্ড আর্থার সমুদ্রযাত্রা করবেন

নিশ্চয়। হনিমুনে যাবে বইকি।

এবং একটি আত্মীয়কে হারাবেন।

করুণ সুরে লেডি জেডবার্ড বললেন–আশা করি সেই আত্মীয়টি বোন নয়। একটি বিরক্তির ভঙ্গিতে মিঃ পডগারস বললেন–নিশ্চয় না। একটি দূর সম্পর্কের আত্মীয়।

লেডি উইনডারমিয়ার বললেন–কথাটা শুনে আমি বেশ হতাশ হলাম। আগামী কাল সাইবিলকে বলার মতো কিছুই রইল না আমার। আজকাল দূর সম্পর্কের আত্মীয়-স্বজনদের নিয়ে কেউ বিশেষ ব্যস্ত নয়। অনেকদিন আগেই ওটা চলনের বাইরে চলে গিয়েছে। যাই হোক, সাইবিলের সিল্কের কালো একটা ঘোমটা রাখা উচিত। এখন খেতে যাই চলুন। মনে হচ্ছে, ওরা সব খেয়ে শেষ করে ফেলেছে। কিছু গরম ‘সুপ’ ছাড়া আর কিছুই পড়ে নেই আমাদের জন্যে। একসময় ফ্র্যাঙ্কোয় বড়ো সুন্দর ‘সুপ’ তৈরি করতে পারত, কিন্তু অধুনা রাজনীতি নিয়ে সে এতই উত্তেজিত হয়ে থাকে যে ‘সুপের’ দিকে নজর রাখা তার পক্ষে কঠিন হয়ে পড়েছে। জেনারেল বোলাঙ্গার কথা বলাটা কমালেই আমি খুশি হতাম। ডাচেস, তুমি নিশ্চয় ক্লান্ত হয়ে পড়েছ?

দরজার দিকে এগিয়ে ডাচেস বললেন–না, না। খুবই ভালো লাগল। সবচেয়ে ভালো লাগল ‘চিরোপোডিস্ট’, অর্থাৎ, ‘চিরোম্যানিস্ট’কো ফ্লোরা, আমার কচ্ছপের খোলা দিয়ে তৈরি হাতপাখাটা কোথায় থাকতে পারে বল তো? ওঃ, ধন্যবাদ, স্যার টমাস। আমার লেস দেওয়া শালটা কোথায় ফ্লোরা? ওঃ, ধন্যবাদ স্যার টমাস।

এই বলে সেই সম্মানিতা প্রাণীটি কোনোরকমে শেষ পর্যন্ত নিচে নেমে এলেন। আসার পথে দু’বারের বেশি তিনি সেন্ট-এর শিশিটা হারাননি–এটাই সৌভাগ্যের বিষয় বলতে হবে।

সারা সময়টা লর্ড আর্থার আগুনে চুল্লির পাশে সমানে দাঁড়িয়ে ছিলেন। সারা সত্তার ওপরে তাঁর কেমন যেন একটা আতঙ্কের ছায়া পড়েছিল। কোন জাতীয় দুর্ভাগ্য তাঁর আসতে পারে। সেই কথাই ভাবছিলেন তিনি। তাঁর বোন লর্ড প্রিমডেলের হাত ধরে ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় বিমর্ষ দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে তিনি একটু হাসলেন। মুক্তা আর ব্রোকেড-এ তাঁকে বেশ সুন্দরী দেখাচ্ছিল। লেডি উইনডারমিয়ার যখন তাঁকে তাঁর পিছু পিছু আসার কথা বললেন তখন সেকথাও তাঁর কালে ঢুকল বলে মনে হল না। সাইবিল মার্টনের কথাই তিনি তখন ভাবছিলেন। তাঁদের মধ্যে কিছু ঘটতে পারে এই কথাই ভেবেই তিনি বেশ কষ্ট পাচ্ছিলেন। তাঁর চোখ দুটি জলে ভিজে আসছিল যেন। এতদিন পর্যন্ত একটানা সুখ আর প্রাচুর্যের মধ্যে তিনি জীবন কাটিয়ে এসেছেন। দুঃখের বিন্দুবিসর্গও তিনি জানতেন না। এই প্রথম তিনি রহস্যময় ভবিষ্যতের ভয়ে আঁৎকে উঠলেন। অনাগত দুর্ভাগ্যের একট ভয়ঙ্কর কালো ছায়া ধীরে ধীরে তাঁর রৌদ্রজ্জল যৌবনের সামনে এসে দাঁড়াল।

সমস্ত জিনিসটাই তাঁর কাছে কেমন যেন একটা অর্থহীন ভয়ঙ্কর বলে মনে হল। তাঁর হাতে এমন কী লেখা থাকতে পারে যা পড়ার ক্ষমতা তাঁর নিজের নেই, যা অন্য লোকে বুঝতে পারে–সেই ভয়ঙ্কর গোপন পাপ অথবা অপরাধের রক্তাক্ত অদৃশ্য চিহ্নটি কী? এ থেকে কি মুক্তি নেই মানুষের? সেই অদৃশ্য ক্ষমতা নিজের ইচ্ছেমতো আমাদের জন্যে যা সাডিযে রেখেছেন তাকে ওলোট-পালোট করার মতো বুদ্ধি আর শক্তি কি আমাদের নেই? সমস্ত ব্যাপারটার বিরুদ্ধেই তাঁর জ্ঞান আর বুদ্ধি বিদ্রোহ ঘোষণা করল। তবু তাঁর মনে হল অনাগত এটি দুর্ভাগ্য তাঁর সামনে ঝুলছে; আর সেই দুর্ভাগ্যেই তাঁর মনের ওপরে একটি নিদারুণ চাপ সৃষ্টি করেছে। সে-চাপটিকে তিনি সহ্য করতে পারছেন না। মঞ্চের অভিনেতাদের কপাল ভালো। তাঁর হাসুন আর কাঁদুন, দুঃখ করুন বা আনন্দই করুন-ট্র্যাজেডি অথবা কমেডি-কিসে অভিনয় করবেন সেটা তাঁরা নিজেরাই ঠিক করে নেন। কিন্তু বাস্তব জীবনে সমস্তটাই আলাদা। অধিকাংশ নর-নারীকেই এমন সব অভিনয় করতে হয় যা করার দক্ষতা। তাদের থাকে না। সমস্ত পৃথিবীটাই একটা রঙ্গমঞ্চ; কিন্তু অভিনয়ের পালা এখানে বড়ো বিসদৃশ।

হঠাৎ মিঃ পডগারস ঘরে ঢুকলেন। লর্ড আর্থারকে দেখেই একটু চমকে উঠলেন তিনি, তাঁর সেই স্থূল মুখের ওপরে একটা হলদে আভা নেমে এল। দুজনে চোখাচোখি হল। মুহূর্তের জন্যে কেউ কোনো কথা বললেন না।

শেষকালে মিঃ পডগারস বললেন–ডাচেস তাঁর একট দস্তানা এখানে ফেলে গিয়েছেন। সেইটা আমাকে তিনি নিয়ে যেতে বললেন। এইতো; সোফার ওপরে পড়ে রয়েছে। নমস্কার। মিঃ পডগারস, আমি আপনাকে একটি প্রশ্ন করছি। আমি চাই আপনি তার সোজা উত্তর দেবেন।

অন্য সময়, লর্ড আর্থার। ডাচেস বড়োই উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছেন। আমাকে এখনই যেতে হবে।

না। ডাচেসের কোনো তাড়া নেই।

একটু বিষণ্ণ হাসি হেসে মিঃ পডগারস বললেন–মহিলাদের বসিয়ে রাখা উচিত নয়। ওঁরা স্বভাবতই তাতে ধৈর্য হারিয়ে ফেলেন।

লর্ড আর্থারের সুন্দর ঠোঁট দুটি একটা অশিষ্ট ব্যঙ্গে কুঞ্চিত হয়ে উঠল। ঠিক সেই মুহূর্তে হতভাগিনী ডাচেসের দাম তাঁর কাছে সামান্য বলেই মনে হল। তিনি মিঃ পডগারস-এর কাছে এগিয়ে গিয়ে তাঁর হাত ধরলেন।

আমার হাতে কী দেখলেন সত্যি করে বলুন। আমার তা জানতেই হবে। আমি শিশু নই।

সোনার পাত দিয়ে চশমার পেছনে মিঃ পডগারস-এর চোখ দুটি মিটমিট করে উঠল। এক পা থেকে আর এক পায়ের ওপরে তিনি অস্থিরভাবে সরে দাঁড়ালেন।

আমি আপনাকে যা বলেছি তার চেয়ে যে আপনার হাতে আমি বেশ কিছু দেখেছি এইরকম

একটা ধারণা আপনার হল কেন, লর্ড আর্থার?

আমি তা জানি। আমি চাই সেই কথাটা আপনি আমাকে বলবেন। তার জন্যে আমি আপনাকে একশ পাউন্ড-এর একটা চেক দেব–আপনার পারিশ্রমিক হিসাবে।

সেই সবুজ চোখ দুটি একবার চকচক করেই আবার ঝিমিয়ে পড়ল। আস্তে করে তিনি শেষ পর্যন্ত জিজ্ঞাসা করলেন-গিনি?

নিশ্চয়। কালই আপনাকে একটা চেক পাঠিয়ে দেব। আপনার ক্লাবের নাম কী?

আমার কোনো ক্লাব নেই–অর্থাৎ বর্তনামে আমার ঠিকানা হচ্ছে, কিন্তু আমার একখানা কার্ড আপনাকে দিচ্ছি।

এই বলে পকেট থেকে একটা কার্ড বার করে ছোট্ট একটা অভিবাদন জানিয়ে তিনি সেটা লর্ড আর্থারের হাতে দিলেন। কার্ডের ওপরে লেখা ছিল-মিঃ সেপটিমাস আর পডগারস-হস্ত-পরীক্ষক–১০৩0 ওয়েস্ট মুন স্ট্রিট।

যান্ত্রিকভাবে ফিস ফিস করে বললেন–আমার সময় হচ্ছে দশটা থেকে চারটে। পরিবারের উল্যে ফিস আমার কিছু কম হয়।

বিবর্ণ মুখে নিজের হাতটাকে প্রসারিত করে লর্ড আর্থার বললেন–তাড়াতাড়ি করুন।

ভয়ে ভয়ে চারপাশে একবার তাকিয়ে মিঃ পডগারস ভারী পর্দাটাকে টেনে দিয়ে বললেন–একটু সময় লাগবে, লর্ড আর্থার। আপনি বরং বসুন।

সেই মসৃণ মেঝের ওপরে রেগে পা ঠুকে লর্ড আর্থার বললেন–তাড়াতাড়ি স্যার।

মিঃ পডগারস হাসলেন; তারপরে বুকপকেট থেকে ছোটো একটা ম্যাগনফাইং গ্লাস বার করে সেটাকে ভালো করে রুমাল দিয়ে মুছে তিনি বললেন–আমি প্রস্তুত।

.

০২.

মিনিট দশেক পরে বেনটিক হাউস থেকে হুড়মুড় করে বেরিয়ে গেলেন লর্ড আর্থার সেভাইল। প্রচণ্ড আতংকে তাঁর মুখ তখন থমথম করছে। দুঃখে বিভ্রান্ত হয়েছে তাঁর দুটি চোখ। দ্রুত বেরিয়ে যাওয়ার সময় কোনো কিছু দেখলেন না, কারও কথা শুনলেন না তিনি। ঠাণ্ডা কনকল। করছে রাত্রি, তীক্ষ্ণ বাতাসে পার্কের গ্যাসের আলোগুলি মিটমিটি করছে। কিন্তু তাঁর হাত দুটি মনে হচ্ছিল জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে, কপালটা পুড়ছে আগুনে। মাতালের মতো টলতে টলতে তিনি চলতে লাগলেন। একটি পুলিশম্যান তাঁর দিকে কৌতূহলী হয়ে তাকিয়ে রইল। খিলানের তলা থেকে একটি ভিক্ষুক ভিহে চাইবার চেষ্টা করে থেমে গেল। তার মনে হল, তার চেয়েও দুঃখী তিনি। একবার একটা বাতির সামনে দাঁড়িয়ে তিনি নিজের হাত দুটো দেখলেন। তাঁর। মনে হল তাঁর হাতে যে রক্তের দাগ লেগে রয়েছে তা তিনি দেখতে পাবেন। তাঁর কম্পমন ঠোঁট দুটি থেকে একটা অস্পষ্ট আর্তনাদ বেরিয়ে এল।

হত্যা! এই চিহ্নই গণৎকার তাঁর হাতের মধ্যে দেখেছেন। সেই হত্যার ধ্বনি আকাশে-বাতাসে পথে-প্রান্তরে সর্বত্র ধ্বনিত আর প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। অন্ধকারাচ্ছন্ন রাস্তাগুলি সেই শব্দ মুখরিত হয়ে উঠেছে। বাড়ির ছাদ থেকে তারা যেন তাঁকে ব্যঙ্গ করছে।

প্রথমে তিনি একটি পার্কে এলেন। এর শান্ত গম্ভীর পরিবেশ তাঁকে মুগ্ধ করত। ভিজে ধাতুর বেড়ার গায়ে হেলান দিয়ে নিজেকে তিনি ঠান্ডা করার চেষ্টা করলেন। বৃদের মুখর স্তব্ধতার দিকে রইলেন কান পেতো বার বার তিনি বিড় বিড় করে উচ্চারণ করতে লাগলেন-হত্যা, হত্যা! মনে হল ঐ শব্দটা বার বার উচ্চারণ করলেই হয়তো তাঁর তীব্রতা কমে যাবে। নিজের শব্দেই তিনি চমকে উঠতে লাগলেন। মনে হল নিঃসঙ্গ পথচারীদের থামিয়ে তাদের কাছে সব তিনি খুলে বলবেন।

অক্সফোর্ড স্ট্রিটে ছাড়িয়ে তিনি নোংরা গলির মধ্যে ঢুকলেন। রঙ করা মুখে দুটি মেয়ে দাঁড়িয়ে ছিল রাস্তায়। পাশ দিয়ে পেরিয়ে যেতে দেখে তারা তাঁকে বিদ্রূপ করতে লাগল। একটা অন্ধকার উঠোনের উপর থেকে মারামারি আর গালাগালির শব্দ ভেসে এল। সেই দুঃস্থ-দারিদ্র্য দেখে তাঁর মনে কপার সঞ্চার হল। এই যে পাপ আর দারিদ্র্যের সন্তান–এরাও কি সেই ভাগ্যের হাতে বাঁধা?

কিন্তু তবু রহস্য নয়; যা তাঁকে আঘাত করল সেটা হচ্ছে দুঃখের কমেডি-যার সত্যিই কোন প্রয়োজনীয়তা নেই–যার অর্থ বলতে কোনো কিছু নেই। সবটাই যেন অদ্ভুত, কিম্ভুতকিমাকার। সামঞ্জস্য বা সমতা বলতে কোথাও যেন কিছু নেই এর বাস্তব আর দিনের আলোতে আমরা যে ভুযো রঙিন আশার ছবি দেখি–এ দুযের মাঝখানে কোনো মিল তাঁর চোখে পড়ল না। তিনি এখনো যুবক।

এইভাবে হাঁটতে-হাঁটতে তিনি মেরিলিবোন চিগড়ার কাছে হাজির হলেন। সেই নির্জন পথটিকে দেখে তাঁর মনে হল পালিশকরা রুপোর সুতোর মতো; মাঝে-মাঝে ছায়ারা এসে কেবল তার ছলটিকে ব্যাহত করছে। অনেক দূরে গ্যাসের বাতিগুলি কেঁপে-কেঁপে উঠছে। বাইরে ছোটো একটি ঘরে একটা ঘোড়ার গাড়ি দাঁড়িয়েছিল। সহিস তার ভেতরে ঘুমোচ্ছে। এদিকে-ওদিকে তাকাতে তাকাতে–মন হচ্ছিল কেউ যেন তাঁর পিছু নিয়েছে–তাড়াতাড়ি তিনি পোর্টল্যান্ড প্লেসের দিকে এগোতে লাগলেন। রিচ স্ট্রিটের কোণে তিনি দেখলেন দুটি লোক দেওয়ালের ওপরে আটা একটা বিজ্ঞাপন পড়ছে। বিজ্ঞাপনে ছিল, যে লোক একটি হত্যাকারীর সন্ধান দিতে পারবে তাকে পুরস্কার দেওয়া হবে। লোকটির বয়স তিরিশ থেকে চল্লিশের মধ্যে তার মাথার ওপরে সুঁচলো একটা টুপি, পরনে চেকের ট্রাউডার, গায়ে কালো কোট, ডান গালে একটা দাগ। বিজ্ঞাপনটা বার বার পড়লেন তিনি। সেই হতভাগ্য লোকটি ধরা পড়বে কি না এবং সে যে কতটা সন্ত্রস্ত হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে এই কথা ভেবে তিনি অবাক হয়ে গেলেন। একদিন হয়তো লনডনের দেওয়ালে-দেওয়ালে তাঁর নামের এইরকম বিজ্ঞাপন বেরোবে। তাঁকে ধরে দেওয়ার জন্যেও পুরস্কার ঘোষিত হবে এইভাবে। এই ভেবে তিনি আরো ভয় পেয়ে অন্ধকারের মধ্যে নিজেকে মিশিয়ে দিলেন।

কোথায যে যাচ্ছেন সে বিষয়ে কোনো সপষ্ট ধারণা তার ছিল না। মনে হল অনেক পথে-বিপথে ঘুরছিলেন তিনি। শেষকালে ভোরের দিকে পিকাডেল সার্কাসে হাজির হলেন । তিনি। বাড়ির পথে যখন তিনি বেলগ্রেভ স্কোয়ারের দিকে এগোচ্ছিলেন এমন সময় দেখলেন কনভেন্ট গার্ডেন-এর দিকে সজির গাড়ি চলেছে সাদা পোশাক-পরা পসারীদের দল ঘোড়ার পিঠে চাবুক মারছে আর নিজেদের মধ্যে খুশমেজাজে গল্প করছো কী জানি কেন তিনি। অদ্ভুতভাবে শান্ত হয়ে গেলেন। ঊষার কোমল সৌন্দর্যের মধ্যে এমন একটা কারুণ্য রয়েছে যাকে বুদ্ধি দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। সেই সব দেহাত রুক্ষ বেপরোয় রহস্যপ্রিয় লোকগুলি নিয়ে কী অদ্ভুত লনডনকেই না তিনি দেখলেন। এই লনডন রাত্রির পাপ থেকে মুক্ত, দিনের ধোঁয়ায় কলঙ্কিত নয়। এ লনডন পরিত্যক্ত কবরখানার শহর নয়। এর চাকচিক্য আর লজ্জা, এর ভীষণ আনন্দের উচ্ছ্বাস আর ভয়ঙ্কর হস্কৃধার ব্যভিচার, সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত যারা। এখানে টগবগ করে ফুটছে তাদের সঙ্গে এদের যে কোনো সপষ্ট সম্বন্ধ রয়েছে সেকথা ভেবেই তিনি অবাক হয়ে গেলেন। সম্ভবত এটা তাদের কাছে ফল বিক্রি করার বাডার ছাড়া আর কিছু নয়। এখানে তারা আসে, বেচাকেনা করে। বিশ্রাম করে কিছুক্ষণ, তারপরে আবার যে যার জায়গায় ফিরে যায়। তাঁর মনে হল, তারা প্রকৃতির কোলেই বাস করে; আর প্রকৃতিই তাদের মনে শান্তির প্রলেপ বুলিয়ে দিয়েছে। তাদের দেখে তাঁর হিংসে হতে লাগল।

বেলগ্রেভ স্কোয়ারে যখন তিনি পৌঁছলেন তখন সকাল হয়েছে। একটা মৃদু রক্তাভা ছড়িয়ে পডেছে চারপাশে। বাগালে পাখিরা শুরু করেছে কিচমিচ করতে।

.

০৩.

লর্ড আর্থারের যখন ঘুম ভাঙল তখন বেলা বারোটা। দুপুরের রোদে ভরে উঠেছে চারপাশ। ঘুম থেকে উঠে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলেন তিনি। বাড়ির নীচে যে পার্কে সেখানে সাদা প্রজাপতির মতো কয়েকটি শিশু ছুটাছুটি করছে। ফুটপাথে অনেক লোক; তারা পার্কের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে সব। জীবন যে এত সুন্দর তা তিনি আগে জানতেন না। জীবনের সব কিছু অমঙ্গল তাঁর কাছ থেকে অনেক দূরে সরে গেল।

তাঁর চাকর এল একটা ট্রেতে করে এক কাপ চকোলেট নিয়ে সেটা পান করে তিনি স্নানের ঘরে ঢুকলেন। বেশ ভালো করে স্নান করলেন। মনে হল তাঁর সমস্ত লজ্জাকর স্মৃতি যেন ধুযে মুছে শেষ হয়ে গিয়েছে। স্নানের ঘর থেকে বেরিয়ে আসার পরে তাঁর মন শান্তিতে ভরে উঠল। ঠিক সেই মুহূর্তে তাঁর যে চমৎকার শারীরিক অবস্থা দাঁড়িয়েছিল তাতে তিনি খুশিই হয়েছিলেন। যাদের স্বভাব সূম ভাবানুভূতির ডাল দিয়ে তৈরি তাদের প্রায় এইরকমই হয়। প্রবৃত্তির উচ্ছ্বাস তাদের যেমন পবিত্র করে, তেমনি আবার কখনো-কখনো তাকে পুড়িয়েও মারে।

প্রাতঃরাশ শেষ করে তিনি একটি ডিভানের ওপরে গা এলিয়ে দিয়ে সিগারেট ধরালেন কুলুঙ্গির ওপরে সাইবিল মার্টনের বেশ বড়ো একটি ফটোগ্রাফ বসানো ছিল। লেডি নোযেন-এর নাচের আসরেই তাঁকে তিনি প্রথম দেখেছিলেন। ছোটো খুদে মাথাটি তাঁর একদিকে একটু হেলে পড়েছে, মনে হচ্ছে সেই শর গাছের মতো সরু গলাটি তাঁর মাথার। বোঝা যেন আর বইতে পারছে না। ঠোঁট দুটি সামান্য ফাঁক হয়ে রয়েছে।মনে হবে, এই দুটি ঠোঁট মিষ্টি গান গাইবার জন্যেই যেন বিধাতা পুরুষ সৃষ্টি করেছেন। তাঁর অনুঢ়া কৈশোরের সমস্ত পেলব শুচিতা তাঁর সেই স্বপ্নলু চোখ দুটির মধ্যে থেকে যেন অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রয়েছে।

সেই ছবিটির দিকে তাকিয়ে লর্ড আর্থারের মনটা করুণায় টনটন করে উঠল। এই করুণার উৎস হচ্ছে তাঁর ভালোবাসা। তাঁর মাথার ওপরে আসন্ন হত্যার অভিশাপ ঝুলছে। এ অবস্থা সাইবিলকে বিয়ে করার অর্থই হচ্ছে তাঁর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা। সেই বিশ্বাসঘাকতায় জুডাসের বিশ্বাসঘাতকতার চেয়েও জঘন্য। তাঁর হস্তলিপির সেই ভয়ঙ্কর ভবিষ্যৎবাণীকে সফল করার জন্যে যে-কোনো মুহূর্তে তাঁর তলব আসেত পারে। সেই কাজ যতক্ষণ না সম্পন্ন হচ্ছে ততক্ষণ তাঁদের জীবনে কী সুখ আসতে পারে? সুতরাং যেমন করেই হোক এ-বিয়ে বন্ধ করতেই হবে। সেদিক থেকে তাঁর মনে কোনো দ্বিধা নেই, যদিও মেয়েটিকে তিনি খুবই ভালোবাসতেন এবং মেয়েটির সামান্য সপর্শ তাঁর শরীরে আনন্দ আর উত্তেজনার ঢল বইয়ে দিত তবু তিনি নিশ্চিত ছিলেন যে আগে হত্যা না করে কিছুতেই তিনি তাঁকে বিয়ে করতে পারেন না। একবার সেই কাজটা সুসম্পন্ন হলেই তিনি গির্জায় গিয়ে সাইবিলকে বিয়ে করতে পারবেন। তখন আর তাঁকে কর্তব্যকর্ম শেষ না করার অপরাধে জর্জরিত হতে হবে না। একবার সেই কাজটা শেষ হলেই তিনি তাঁর প্রিয়তমাকে বুকের ওপরে জড়িয়ে ধরতে পারবেন। তার জন্যে সাইবিলকে কোনো দিন লজ্জায় মাথা নীচু করে হবে না। তাই হত্যাটাই তাঁকে তাড়াতাড়ি করতে হবে। যতটা তাড়াতাড করা যায় ততই তাঁর পক্ষে মঙ্গল।

তাঁর অবস্থায় অনেকেই কর্তব্যের খাড়াই পাহাড়ে ওঠার চেষ্টা না করে দ্বিধা বা অপেষ্কা করত। কিন্তু আর্থারের চরিত্র সে-ধাতুতে গড়া ছিল না। নীতিটা ছিল তাঁর সকলের ওপরে। বিশ্বের যা কিছু সৎ আর উন্নত সাইবিল তাঁর কাছে ছিলেন সেইরকম। যে কাজটা করার জন্যে ভাগ্য তাঁকে নিযুক্ত করেছিল সেই কাজটার কথা চিন্তা করতেই তাঁর মনট বিতৃষ্ণায় কেমন যেন সঙ্কুচিত হয়ে উঠল। কিন্তু সেটা হণিকের জন্যে তাঁর হৃদয় তাঁকে বলল–এটা কোনো অপরাধ নয়, আত্মদান। তাঁর মস্তিষ্ক তাঁকে স্মরণ করিয়ে দিল যে এ ছাড়া অন্য কোন পথ তাঁর কাছে খোলা নেই, তাঁর কাছে একট পথই খোলা ছিল–হয় তাঁকে নিজের জন্যে বাঁচতে হবে; আর না হয়, বাঁচতে হবে পরের জন্য। এবং যদিও কাজটি তাঁর কাছে নিঃসন্দেহে ভয়ঙ্কর তবু তিনি প্রেমের অসম্মান করে স্বার্থপরতাকে প্রশ্রয় দিলেন না। আজ হোক আর কাল হোক, এ-জাতীয় সমস্যায় আমাদের সবাইকে একদিন না একদিন পড়তে হয়; তবে আর্থারের। জীবনে সেই সমস্যাটা করার সময় পাযলি। সৌভাগ্যের বিষয় তিনি অলস স্বপ্ন ছিলেন না; থাকলে, হ্যামলেটের মতোই তিনি আরব্ধ কর্ম সম্পাদন করার জন্যে দ্বিধা বা সংশয় প্রকাশ করতেন। যা অনেকেরই থাকে না–তাঁর সেইটি ছিল। সেটি হচ্ছে ‘কমনসেনস’।

গত রাত্রিতে উন্মত্তের মতো ভ্রমণের কথা বিরক্তই হলেন। যে কাজ তাঁকে করতেই হবে তা। নিয়ে এতটা দুর্ভাবনার কারণ কী রয়েছে? কারণ, তিনি জানতেন হত্যার জন্যে চাই একটি মানুষ আর একজন পাদরি। কিন্তু জিনিস না হওয়ার ফলে তাঁর কোনো শত্রু ছিল না। তবু একটি দেবাদিষ্ট মহান কর্তব্য তাঁর সামনে থাকার পরে নিজেকে অজাশত্রু ভেবে তিনি কোনোরকম আত্মপ্রসাদ লাভ করলেন না। সেইজন্যে একটা কাগডের ওপরে বন্ধু আর। আত্মীয়-ভাবনা করে শেষ পর্যন্ত একটা নামই তিনি সাব্যস্ত করলেন। তাঁর নাম হচ্ছে লেডি ক্লিমেনটিনা বিক্যাম্প। বৃদ্ধাটিকে কার্ডল স্ট্রিটে। সম্বন্ধটা ছিল তাঁর মায়ের দিক থেকে সবাই তাঁকে লেডি ক্লেম বলে ডাকত। আর্থার নিজেও তাঁকে বেশ ভালোবাসতেন। তাছাড়া, লর্ড বাগরির সমস্ত সম্পত্তি পাওয়ার ফলে তাঁকে হত্যা করে আর্থারের যে কিছু আর্থিক সুবিধে হত তা নয়। সত্যি কথা বলতে কি বিষয়টা নিয়ে যতই ভাবতে লাগলেন ততই তাঁর মনে হল। হত্যা করার পষ্কে লেডি ক্লেমই একমাত্র মানুষ। দেরি করলে পাছে সাইবিলের ওপরে অবিচার করা হয় এই আশংকায় তিনি অনতিবিলম্বে সমস্ত পরিকল্পনা পাকা করে ফেললেন।

তার আগেও একটা কাজ ছিল তাঁর। সেটি হচ্ছে গণৎকারকে তাঁর কথামতো টাকা পাঠানো। মিঃ সেপটিমাস পডগারস-এর নামে ১০৫ পাউন্ডের একটা চেক লিখে সেটিকে তিনি একটা খামে মুড়লেন; তারপরে ওয়েস্ট মুন স্ট্রিটে চাকরের হাত দিয়ে সেটি পাঠিয়ে দিলেন। তারপরে গাড়ি ঠিক করার জন্যে আস্তাবলে টেলিফোন করে তিনি পোশাক পরার জন্যে উঠে গেলেন। যাওয়ার সময় সাইবিলের ফটোর দিকে তাকিয়ে শপথ নিলেন যে তাঁর কপালে যাই থাকুক তিনি যে তাঁর জন্যে কী করছেন সেকথা তাঁকে তিনি কোনোদিনই জানতে দেবেন না; সমস্ত জিনিসটাকেই আত্মদান হিসেবে তিনি নিজের হৃদয়ের মণিকোঠায় লুকিয়ে রাখবেন।

বাকিংহাম যাওয়ার পথে ফুলের দোকান থেকে এক ঝুড়িনারসিসি ফুল কিনে তিনি সাইবিলের কাছে পাঠি লন; তারপরে হাজির হয়ে লাইব্রেরিতে গিয়ে দাঁড়ালেন। চাকরকে বললেন বিষবিজ্ঞানের ওপরে একটা বই আনতে। তিনি স্থির করে ফেললেন এই কষ্টকর আর কঠিন কাজে বিষ প্রয়োগই প্রশস্ত উপায়। সুলপ্রয়োগে হত্যা করাটা তাঁর কাছে কেমন যেন ঘৃণ্য বলে মনে হল। তাছাড়া জনসাধারণ জানতে পারে এমনভাবে কোনো কাজই তিনি করতে রাজি হলেন না। হত্যাকারীদের নামের তালিকার পাশে নোংরা খবরের কাগড়ে তাঁর নামটাও ছাপা হবে এটা ভাবতেও তাঁর মনটা কেমন সঙ্কুচিত হয়ে উঠল। তাছাড়া, আইবিলের বাবা-মাও হচ্ছেন সেই পুরনো আমলের। তাঁর নামে যদি হত্যাকারীর কলঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে তাহলে হয়তো এই বিয়েতে তাঁরাও আপত্তি করে বসবেন। যদিও একথা সত্যি যে কেন তিনি এই হত্যা করেছেন তার ইতিহাস আনুপূর্বিক জানলে সবাই তাঁকে প্রশংসাই করবে। সব দিক ভেবে সেই জন্যে বিষকেই তিনি নির্বাচন করলেন। এইটাই সবচেয়ে নিরাপদ, শান্ত আর নিশ্চিত উপায। মরার সময় মানুষ যেরকম যন্ত্রণা আর বেদনাদায়ক ক্রিয়াকলাপ দেখায়, এই বিষক্রিয়ায় মরণোন্মুখ মানুষের দেহে সে রকম কোনো বিকার দেখা যায় না। অধিকাংশ ইংরেজদের মতো এই দৃশ্য দেখতে তিনিও চান না।

কিন্তু বিষবিজ্ঞান সম্বন্ধে তাঁর কোনো জ্ঞানই ছিল না। যে চাকরটিকে তিনি বিষের বই আনতে বলেছিলেন তার জ্ঞানও ছিল সেই রকমই অকিঞ্চিৎকর। সুতরাং তাঁকেই ঘুরে ঘুরে দেখতে হল। দু’চারটে বই-ও তিনি ওলটালেন কিন্তু সেগুলি এমন ভাবে আর ভাষায় লেখা যে তাদের কোনো অর্থই তিনি উদ্ধার করতে পারলেন না। তাঁর দুঃখ হল যে অক্সফোর্ডে পড়ার সময় ক্লাসিকগুলি তিনি মন দিয়ে পড়েননি। ঘাঁটতে-ঘাঁটতে হঠাৎ তিনি একটি বই পেযে গেলেন। বইটি আর্কক্সিন সাহেবের লেখা। পাতা ওলটাতে ওলটাতে তিনি হঠাৎ একটি ওষুধের নাম দেখতে পেলেন–ওষুধটির নাম হচ্ছে অ্যাকোনিটিন-তার গুণাবলী পরিষ্কার ঝরঝরে ইংরিজিতে লেখা পড়তে লাগলেন তিনি। এই বিষটির ক্রিয়া অত্যন্ত দ্রুত, বলা যায় একেবারে সঙ্গে সঙ্গে খাওয়ার অপেক্ষা মাত্ৰ। এই বিষে কোনো যন্ত্রণা নেই। ভিলেটিনের সঙ্গে খেলে স্যার ম্যাথুর মতে খুব একটা খারাপ নয়। ভামার হাতায নামটা আর কতটা পরিমাণ খেলে মানুষ মরতো পারে সেইটা লিখে নিয়ে তিনি ডেমস স্ট্রিটের দিকে এগিয়ে গেলেন। সেখানে বেশ একটা বড়ো ওষুধের দোকান ছিল। তার নাম হচ্ছে পেমল অ্যান্ড হামবী। ধনী অভিজাত খদ্দেরদের মিঃ পেসল নিজেই অভ্যর্থনা করতেন। লর্ড আর্থারের কথা শুনে তিনি অবাক হয়ে বললেন ওই ওষুধ তিনি কী জন্যে চাইছেন, আর তার জন্যে চাই ডাক্তারের সার্টিফিকেট। আর্থার বললেন তাঁর বিরাট সে তাঁর কোচোয়ানকে কামড়ে দিয়েছে। তাকে মারার জন্যেই তাঁর ওই বিষ দরকার। কথাটা শুনে ভদ্রলোক সন্তুষ্ট হয়ে তাঁর বিদ্যাবুদ্ধির তারিফ করে একটা প্রেসক্রিপশন লিখে ওষুধটা দিয়ে দিলেন।

লর্ড আর্থার ক্যাপসুলটিকে একটা ছোট্ট রুপোর কৌটোতে ঢুকিয়ে ‘পেসল আর হামবী’ কোম্পানির বিশ্রী কৌটোটাকে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন; তারপরে, লেডি ক্লেমেনটিনার বাড়ির দিকে গাড়ি চালিয়ে দিলেন।

 বৃদ্ধা মহিলাটির ঘরে ঢোকার সঙ্গে-সঙ্গে তিনি আনন্দের আতিশয্যে চিৎকার করে উঠলেন: দুষ্টু ছেলে কোথাকার! এতদিন আমাকে দেখতে আসনি কেন?

লর্ড আর্থার হেসে বললেন–প্ৰিয় লেডি ক্লেম; এতটুকু সময় পাইনি।

অর্থাৎ, সারা দিনই বুঝি তুমি সাইবিল মার্টনের সঙ্গে কেনাকাটা করার জন্যে দৌড়ে বেড়াচ্ছে আর রাতদিন আবোল-তাবোল বকছো? বিয়ে নিয়ে মানুষ এত হইচই করে কেন তা বাপু আমার মাথায় ঢোকে না। আমাদের দিনে প্রকাশ্যে বা ঘরের ভেতরে এই রকম প্রেমালাপ করার কথা আমরা স্বপ্নেও ভাবতে পারতাম না।

লেডি ক্লেম, আপনি নিশ্চিন্ত হল, গত চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে সাইবিলের সঙ্গে আমার দেখা হয়নি। আমার বিশ্বাস সে এখন দডিদের নিয়ে ব্যস্ত রয়েছে।

তাই বুঝি আমার মতো কুৎসিত বৃদ্ধা মহিলার সঙ্গে দেখা করবার সময় হল তোমার? পুরুষ মানুষেরা কেন যে সময় থেকে সাবধান হয় না তাই আমি অবাক হয়ে ভাবি। এই আমার কথাই ধর। আমার জন্যে পুরুষরা কত বোকামিই না করেছিল। কিন্তু আজ সেই আমি বেতো রোগীতে পরিণত হয়েছি, আমার দাঁত সব বাঁধানো; মেজাজটা তিরিক্তি; প্রিয় লেডি জ্যানসেন যদি আমার রদ্দি ফরাসি উপন্যাস না পাঠাতেন তাহলে আমার দিন যে কী করে কাটত তা এক ঈশ্বরই জানেন। এক ফি নেওয়া ছাড়া ডাক্তাররা কোনো কাজের নয়। আমার হৃদয়ের জ্বালাটাও তারা সারাতে পারে না।

লর্ড আর্থর বেশ গম্ভীর হয়ে বললেন–সেই অসুখ সারানোর জন্যে আমি একটা ওষুধ নিয়ে এসেছি। ওষুধটা খুব ভালো। অ্যামেরিকাতেই এটা বেরিয়েছে। অ্যা

মেরিকার ওষুধ ভালো নয় আর্থার। না, না-মোটেই ভালো নয়। সম্প্রতি আমি কয়েকটা অ্যামেরিকান নভেল পড়লাম–যাচ্ছেতাই, যাচ্ছেতাই।

কিন্তু এ ওষুধটা যাচ্ছেতাই নয়, লেডি ক্লেম–আমি আপনাকে নিশ্চয় করে বলছি এটা একেবারে ধন্বন্তরি। আপনাকে আজকেই পরীক্ষা করতে হবে-প্রতিজ্ঞা করুন।

এই বলে পকেট থেকে ছোটো বাক্সটা বার করে আর্থার তাঁর হাতে দিলেন।

বাঃ, বাক্সটি তো বড়ো চমৎকার, আর্থার! সত্যি কি এটা উপহার? বাঃবাঃ! এইটি বুঝি সেই অদ্ভুত ওষুধ? আরে, দেখতে যে চিনির মেঠাই-এর মতো! আমি এখনই খাব।

তাঁর হাতটা ধরে লর্ড আর্থার ঝাঁঝিয়ে উঠলেন প্রায়-হা ঈশ্বর! না-না; লেডি ক্লেম ও কাজটা মোটেই করবেন না। এটা হচ্ছে একটা হোমিওপ্যাথি ওষুধ। বুকে যন্ত্রণা শুরু না হলে এই ওষুধটা যদি খান তাহলে আপনার ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি বুকে যন্ত্রণা হলে তবেই এটা খাবেন। এর আশ্চর্য ফল দেখে আপনি অবাক হয়ে যাবেন।

সেই স্বচ্ছ ক্যাপসুলটি লেডি ক্লেম আলোর দিকে তুলে ধরে দেখলেন।

ক্যাপসুলের ভেতরে জলীয় অ্যাকোনিটিন টলটল করছিল। তাই দেখে তিনি। বললেন–এখনই আমার খেতে ইচ্ছে করছে। এটি যে সুস্বাদু সে দিক থেকে আমার কোলো। সন্দেহ নেই। আসল কথাটা কী জান? ডাক্তারদের আমি ঘৃণা করি, কিন্তু ওষুধ আমি বড়ো ভালোবাসি। যাই হোক, বুকে যন্ত্রণা না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করব।

লর্ড আর্থার আগ্রহভরেই জিজ্ঞাসা করলেন-কবে নাগাদ হতে পারে মনে হচ্ছে? তাড়াতাড়ি হওয়ার কোনো সম্ভাবনা রয়েছে?

আশা করি, এক সপ্তাহের আগে নয়। গতকাল সকালেই ওটাকে নিয়ে বেশ ঝঞ্ঝাটে পড়েছিলাম। কিন্তু কখন যে দেখা দেবে কেউ তা জানে না।

লেডি ক্লেম, তাহলে এ মাসের শেষ নাগাদ নিশ্চয় একবার আসবনা, কী বলেন?

আমারও সেইরকমই ভয় হচ্ছে যেন। সত্যিই আর্থার, আজ তোমাকে বড়ো সহানুভূতিশীল দেখাচ্ছে! সাইবিল সত্যিই তোমার বড়ো উপকার করেছে। এখন আমাকে উঠতে হচ্ছে বাপু। যাদের সঙ্গে আমার আজ ডিনার খাওয়ার কথা তারা বড়ো অরসিক। অপরের কলঙ্ক নিয়ে তারা আলোচনা করে না। আমি জানি এখন যদি একটু না ঘুমিয়ে নিই তাহলে ডিনারের সময় জেগে থাকা আমার পক্ষে কষ্টকর হবে। এখন এস আর্থার। সাইবিলকে আমার ভালোবাসা জানিযো। অ্যামেরিকান এই ওষুধটির জন্যে তোমাকে ধন্যবাদ।

চলে আসার জন্যে দাঁড়িয়ে লর্ড আর্থার বললেন–তাহলে এটা খেতে ভুলবেন না, কেমন?

না, না, নিশ্চয় না। আমার কথা যে তোমার মনে রয়েছে তাতে আমি খুব খুশি হয়েছি। এই

ওষুধ আরো দরকার হলে তোমাকে আমি লিখে জানাব।

খুব আশ্বস্ত হয়ে বেশ খুশ মেজাজে লর্ড আর্থার বেরিয়ে এলেন।

সেই রাত্রিতেই সাইবিলের সঙ্গে তাঁর দেখা হল। তিনি তাঁকে জানালেন এমন একটি ভয়ঙ্কর জটিলতার মধ্যে তিনি জড়িয়ে যা ছিঁড়ে বেরিয়ে আসাটা তাঁর যে কেবল সম্মানের দিক। থেকেই হানিকর হবে, তা-ই নয়, কর্তব্যের দিক থেকেও এটি রয়ে যাবে। সেই জন্যে যত দিন না এই সমস্যার একটা সমাধান তিনি করতে পারছেন ততদিন বিয়েটা তিনি পিছিয়ে দিচ্ছেন। এই বিয়ের ব্যাপারে সাইবিলের মনে যাতে কোনো সন্দেহ না উল্লায় সেই জন্যে। তিনি তাঁকে অনেক বোঝালেন। সবই ঠিক হয়ে যাবে, তবে দরকার একটু ধৈর্যের।

সাইবিলও খুব খুশি হল। একবার আর্থারের মনে হল কাপুরুষের মতো লেডি ক্লেমকে সেই ওষুধ খাওয়ার কথাটা আর একবার স্মরণ করিয়ে দিয়েই তিনি বিয়ের ব্যাপারে এগিয়ে যাবেন, একবার তিনি পডগারস-এর কথা মন থেকে মুছে ফেলতে চাইলেন; কিন্তু বিবেক আর কর্তব্য শীঘই তাঁর ফিরে এল এবং কাঁদতে-কাঁদতে সাইবিল তাঁর বুকের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়লেও, স্বীয়। প্রতিজ্ঞা থেকে বিচ্যুত হলেন না তিনি। কয়েকটি মাসের আনন্দের জন্যে অমন সুন্দর একটি জীবনকে ধ্বংস করাটা অন্যায় হবে বলেই মনে হল তাঁর।

তিনি অনেক সান্ত্বনা দিনেল সাইবিলকে। সাইবিল-ও তাঁকে কম সান্ত্বনা দিল না। এইভাবে মাঝরাতে পর্যন্ত কাটিয়ে ভোরের দিকে তিনি ভেনিস যাত্রা করলেন। বিয়েটা স্থগিত রাখা যে অবশ্য প্রযোজনীয় সে-সম্বন্ধে একটা পুরুষোজনিত চিঠি লিখে তিনি মিঃ মার্টনকে পাঠিয়ে দিলেন।

.

০৪.

তাঁর ভাই, লর্ড সার্বিটোন তাঁর ছোটো জাহাজে করে কর্ফু থেকে তখন ভেনিসে এসে। পৌচেছেন। সেইখানেই তিনি উঠলেন। দুটি যুবক দিন পনেরো সেখানে বেশ আনন্দের সঙ্গেই কাটালেন। তবু লর্ড আর্থার কেমন যেন আনন্দ পাচ্ছিলেন না। প্রতিদিনই টাইমস পত্রিকার শোকবার্তা জ্ঞাপক অংশটি তিনি পড়তে লাগলেন। প্রতিদিনই তিনি আশা করেছিলেন। ওইখানে লেডি ক্লেমেন্টিনার মৃত্যুর সংবাদ পাবেন। কিন্তু প্রতিদিনই হতাশ হচ্ছিলেন। তাঁর ভয় হল হয়তো তাঁর কোনো দুর্ঘটনা ঘটেছে। যখন তিনি সেই ওষুধটা পরীক্ষা করতে চেয়েছিলেন তখন যে তিনি তাঁকে বাধা দিয়েছিলেন একথা ভেবেই তাঁর বেশ অনুশোচনা হচ্ছিল।

দিন পনেরো কাটানোর পরেই লর্ড সার্বিটোনের ভেনিস আর ভালো লাগল না। তিনি ঠিক করলেন ব্র্যাভেলার উপকূল তিনি বন-মুরগি শিকার করে বেড়াবেন। লর্ড আর্থার প্রথমে তাঁর সঙ্গে যেতে রাজি হলেন। মাসের পনেরো তারিখে যাত্রা করলেন তাঁরা। কয়েক দিন বেশ। আনন্দেই কাটালেন কিন্তু হঠাৎ বাইশ তারিখে লেডি ক্লেমেন্টিনার কথা ভেবে তিনি অস্থির। হয়ে উঠলেন। ভাই-এর অনিচ্ছা সত্ত্বেও তিনি ভেনিসে ট্রেনে চেপে ফিরে এলেন।

হোটেলে ঢুকতেই হোটেলের মালিক একখানা টেলিগ্রাম নিয়ে এগিয়ে এল। লর্ড আর্থার টেলিগ্রামটি তার হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে দেখলেন তাঁর পরিকল্পনা সার্থক হয়েছে। সতেরোই রাত্রিতে লেডি ক্লেমেন্টিনা হঠাৎ মারা গিয়েছেন।

প্রথমেই যাঁর কথা তাঁর মনে হল তিনি হচ্ছেন সাইবিল। তিনি তাঁকে একটা টেলিগ্রাম করে দিলেন যে এখনই তিনি লন্ডনে ফিরে আসছেন। তাড়াতাড়ি জিনিসপত্র গোছানোর জন্যে নির্দেশ দিলেন চাকরকে। তারপরে হোটেলে ফিরে এসেই দেখলেন তিনটি চিঠি তাঁর জন্যে অপেক্ষা করছে একটি এসেছে সাইবিলের কাছ থেকে। চিঠিটিতে রয়েছে সহানুভূতি আর শোক প্রকাশ। দ্বিতীয়টি এসেছে মায়ের কাছ থেকে তৃতীয়টি এসেছে লেডি ক্লেমেন্টিনার সলিসিটরের কাছ থেকে চিঠিটি পড়ে বোঝা গেল ভদ্রমহিলা সেদিন ডাচেসের সঙ্গে ডিনার খেয়েছেন। তাঁকে সেদিন বেশ প্রফুল্লই দেখা যায়; কিন্তু বুকে ব্যথা লাগছে এই বলে একটু তাড়াতাড়িই তিনি বাড়ি ফিরে যান। পরের দিন সকালে বিছানার ওপরে মৃত অবস্থায় তাঁকে দেখা যায়। মনে হচ্ছে মৃত্যুর সময় কোনো যন্ত্রণাই তিনি ভোগ করেননি। স্যার ম্যাথু বিড়কে তখনই ডেকে পাঠানো হয়। তবে তখন আর করার কিছু ছিল না। বাইশ তারিখে বিক্যাম্প। ক্যালকোটিতে তাঁকে কবরস্থ করা হবে। মৃত্যুর কয়েকদিন আগে তিনি একটি উইল করেছেন। সেই উইলে তিনি আর্থারকে তাঁর কার্ডন স্ট্রিটের বাড়ি-আসবাবপত্র, ব্যক্তিগত জিনিসপত্র, ছবি-সবই দিয়ে গিয়েছেন। কেবল ছোটো ছোটো কতগুলি ছবি দিয়েছেন তাঁর বোনকে; আর পদ্মরাগমণির হারটা দিয়ে গিয়েছেন সাইবিলকে। সম্পত্তির মূল্য এমন কিছু বেশি ছিল না। তবে সম্ভব হলে লর্ড আর্থার যাতে অনতিবিলম্বে ফিরে আসেন সেই জন্যে সলিসিটর মিঃ স্যালফিলড বিশেষ উদ্বিগ্ন রয়েছেন। কারণ অনেকগুলি পাওনাদারদের টাকা মেটাতে হবে; আর লেডি ক্লেমেন্টিনা কোনোদিনই বিশেষ হিসাবপত্র রাখতেন না।

লেডি ক্লেমেন্টিনা যে তাঁকে মনে রেখেছেন এই কথা ভেবে তিনি বেশ অভিভূত হয়েই পড়লেন। তাঁর মনে হল এই মৃত্যুর জন্যে মিঃ পডগারসকে কৈফিয়ৎ দিতে হবে। কিন্তু সাইবিলের ওপরে ভালোবাসা তাঁর অন্য সব অনুভূতিগুলিকে ছাপিয়ে গেল এবং তিনি যে তাঁর কর্তব্য করেছেন এই ভেবে তিনি একটা শান্তি আর আত্মপ্রসাদত লাভ করলেন। তিনি যখন চারিংক্ৰশে হাজির হলেন তখন তাঁকে বেশ খুশি খুশি দেখা গেল।

মার্টনরা তাঁকে বেশ হৃদ্যতার সঙ্গেই অভ্যর্থনা জানালেন। সাইবিল তাঁকে প্রতিজ্ঞা করালেন যে তার কিছুই তাঁদের বিয়েতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারবে না। সাতই জুন বিয়ের দিন ঠিক হল। হঠাৎ তাঁর মনে হল জীবনটা বড়ো সুন্দর, বড়ো উজ্জ্বল। পুরনো আনন্দ আবার ফিরে এল তাঁর জীবনে।

এরই মধ্যে একদিন সলিসিটর আর সাইবিলকে সঙ্গে নিয়ে তিনি কার্ডন স্ট্রিটের বাড়িতে হাজির হলেন। তারপরে সেখানে কাগজপত্র ঘাঁটতে লাগলেন। ঠিক এমনি সময় সাইবিল আনন্দে চিৎকার করে উঠলেন।

মুখ তুলে হেসে লর্ড আর্থার জিজ্ঞাসা করলেন-ব্যাপার কী সাইবিল!

সাইবিল বলল–আর্থার, এই ছোটো চকোলেটের বাক্সটা কী সুন্দর দেখা এটা আমাকে দাও। আমি জানি আশি বছর বয়স হওয়ার আগে পদ্মরাগমণি আমাকে মানাবে না।

এটা সেই বাক্স যার ভেতরে অ্যাকোনিটিন ছিল।

চমকে উঠলেন লর্ড আর্থার। গালের ওপরে লজ্জার সামান্য একটা আভাও দেখা গেল। এসব কথা তিনি একেবারে ভুলেই গিয়েছিলেন, আর যার জন্যে তিনি সেই ভয়ঙ্কর অস্থিরতার মধ্যে দিয়ে দিন কাটিয়েছিলেন–এমনই ভাগ্যের পরিহাস যে–সেই সাইবিল-ই সেই কথাটা তাঁকে প্রথণ স্মরণ করিয়ে দিল।

বেশ তো, নাও না। লেডি ক্লেমকে আমিই এটা দিয়েছিলাম।

ধন্যবাদ আর্থার। চিনির মেঠাইটাও নিই? লেডি ক্লেম যে মিষ্টি এত ভালোবাসতেন তা আমি জানতাম না। আমার ধারণা ছিল তিনি একটু বেশি মাত্রায় বুদ্ধিজীবিনী ছিলেন।

 হঠাৎ কেমন ভয়ঙ্কর রকমের বিবর্ণ হয়ে গেলেন লর্ড আর্থার, কী বললে-চিনির মেঠাই?

হা এর ভেতরে একটা রয়েছে দেখছি। বেশ পরনো বলেই মনে হচ্ছে এটা খাবার এতটক ইচ্ছেও অবশ্য আমার নেই। তোমার কী হল, আর্থার? অত ফ্যাকাশে হয়ে গেলে কেন?

 দৌড়ে গিয়ে লর্ড আর্থার বাক্সটা তুলে নিলেন। তার ভেতরে বিষভরা সেই ক্যাপসুল। সেটাকে তিনি আগুনের মধ্যে ছুঁড়ে ফেলে হতাশভাবে চিৎকার করে সোফার ওপরে বসে পড়লেন।

.

০৫.

বিয়েটা দ্বিতীয়বার স্থগিত হওয়ার ফলে মিঃ মার্টন খুবই দুঃখিত হলেন। লেডি জুলিয়া মেয়ের বিয়েকে উপলক্ষ করে নিজের জন্যে পোশাক তৈরি করতে দিয়েছিলেন। বিয়েটা সাময়িকভাবে বন্ধ হল দেখে এ-বিয়ে ভেঙে দেওয়ার জন্যে মেয়েরে তিনি অনেক বোঝালেন। সাইবিল মাকে ভালোবাসতেন সত্যি কথা; কিন্তু আর্থারের কাছেই তিনি তাঁর জীবন-যৌবন সমর্পণ করেছিলেন। সুতরাং মায়ের প্রস্তাবে তিনি রাজি হলেন না। আর লর্ড আর্থার! দিল। কয়েক এই অভাবনীয় কাণ্ডে তাঁর স্নায়ুগুলি একেবারে বিকল হয়ে গেল। তারপরেই কিন্তু তাঁর অদ্ভুত কমনসেনস অথবা বাস্তব জ্ঞনটি ফিরে এল। এবং কী করতে হবে সেদিক থেকে কোনোরকম সন্দেহ রইল না তাঁল, বিষ ব্যর্থ হওয়ায় এখন তাঁকে ডিনামাইট অথবা অন্য কোনো বিস্ফোরক বস্তুর সাহায্য নিতে হবে।

 এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়ে তিনি আবার তাঁর বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন আর। পরিচিত-পরিচিতদের তালিকা নিয়ে বসলেন। অনেক চিন্তা-গবেষণার পরে ঠিক করলেন যে তাঁর কাকা চিচেস্টারের ডিনকেই তিনি উড়িয়ে দেবেন এই ডিনটি ছিলেন সত্যিকারের। পণ্ডিত আর সংস্কৃতিবান পুরুষ। ঘড়ি জিনিসটাকে বড়ো ভালোবাসতেন তিনি। ঘড়ি সংগ্রহ করার একটা শখ ছিল তাঁর। পঞ্চদশ শতাব্দী থেকে আধুনিক যুগ পর্যন্ত কত রকমেরই না টাইম-পিস তাঁর ছিল! আর্থার ভাবলেন ওই শখই বিস্ফোরক দ্রব্য ব্যবহার করার অভূতপূর্ব সুযোগ তাঁকে এনে দিয়েছে। কিন্তু বিপদ হল এই জাতীয় বিস্ফোরক কোথায় পাওয়া যায় তা তিনি জানেন না। একবার ভাবলেন স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। কিন্তু সে বাসনা তাঁকে পরিত্যাগ করতে হল; কারণ তিনি জানতেন যে বিস্ফোরণ ঘটার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত বিস্ফোরক দ্রব্যের গতিবিধি সম্বন্ধে তারা কিছুই জানতে পারে না; ঘটার পরেও যা ডলতে পারে তাও এমন কিছু নয়।

হঠাৎ বন্ধু রুবালোফের কথা তাঁর মনে পড়ে গেল। বিপ্লবী মনোভাবাপন্ন এই যবুকটির সঙ্গে লেডি উইনডারমিয়ারের বাড়িতে শীতকালে তাঁর আলাপ হয়েছিল। গুজব, কাউন্ট রুবালোফ সম্প্রতি তোর মিস্ত্রি হিসাবে বাস করছিলেন সেই সময়কার কাগজপত্র পরীক্ষা উল্যেই তিনি নাকি এখানে রয়েছেন, কিন্তু অনেকেরই বিশ্বাস রুবালোফ নিহিলিস্টদের একটি এডেন্ট। রাশিযার রাষ্ট্রদূতাবাস যে তাঁর লন্ডনে অবস্থিতিটাকে ভালো চোখে দেখবে না এবিষয়ে আর সন্দেহ কী! লর্ড আর্থার-এর মনে হল এবিষয়ে রবালো-ই তাঁকে সাহায্য করতে পারবেন; এই ভেবে তিনি একদিন সকালে তাঁর বাসা ব্লুমসবারিতে হাজির হলেন। তাঁর সঙ্গে পরামর্শ করতে।

লর্ড আর্থার তাঁর সেখানে যাওয়ার উদ্দেশ্যটা বিবৃত করলেন। তাই শুনে কাউন্ট রুবালোফ। বললেন–তাহলে আপনি রাজনীতিতেই নিজেকে ডুবিয়ে দিলেন? কিন্তু হাঁকডাক করে কোনো কিছু করার পক্ষপাতী। লর্ড আর্থার কোনোদিনই ছিলেন না। তিনি স্বীকার করতে বাধ্য হলেন যে সামাজিক কোনো প্রশ্ন নিয়ে সম্প্রতি তিনি বিব্রত নন। তিনি বিস্ফোরক দ্রব্য চান নিছক সাংসারিক একটি সমস্যার সমাধান করতে আর এই সমস্যা সমাধানে উপকার একমাত্র তার নিজেরই হবে, আর কারও ন্য।

কয়েকটি মুহূর্ত কাউন্ট রুবালোফ তাঁর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন; কিন্তু তাঁকে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ দেখে ছোটো একটা কাগভে ঠিকানা লিখে তলায় সই করলেন, তারপরে, টেবিলের এক পাশ থেকে সেটি তাঁর দিকে বাড়িয়ে দিলেন, বললেন প্রিয় বন্ধু, এই ঠিকানাটা জোগাড় করার জন্যে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড অনেক অর্থ খরচ করবে।

লর্ড আর্থার হেসে বললেন–এ-ঠিকানা কিছুতেই তারা পাবে না।

এই বলে পরম হৃদ্যতার সঙ্গে যুবক রাশিয়ানটির করমর্দন করে তিনি প্রায় দৌড়ে নীচে নেমে এলেন; তারপরে কাগজটি পরীা করে কোচোয়ানকে সোহো স্কোয়ারের দিকে গাড়ি চালাতে। বুললেন।

সোহো স্কোয়ারের এসে কোচোয়ানকে বিদায় দিয়ে গ্রীক স্ট্রিটের ওপর দিয়ে হাঁটতে-হাঁটতে তিনি একটি জায়গায় এসে হাজির হলেন। ডাযগাটির নাম বেইলির কোর্ট। এইখানে একটা খিলানের ভেতর দিয়ে যেখানে তিনি এসে পৌঁছলেন সেখানে একটা ফ্রেঞ্চ লনড্রি ছিল। এই লনড্রির পাশ ধরে ঘরের পর ঘরের উঠোনে অসংখ্য পোশাক তারের ওপরে ঝোলানো ছিল। দেখলেই মনে হবে ওটা একটা ধোপাদের পাড়া। তিনি সোজা হেঁটে গিয়ে ওই লাইনের। একেবারে শেষ প্রান্তে উপস্থিত হলেন; তারপরে ছোটো সবুজ রঙের একটা ঘরের দরজায়। টোকা দিলেন। টোকা দেওয়ার পরেই আশপাশের জানালা থেকে কৌতূহলী দৃষ্টি তাঁর দিকে তাকিয়ে রইল। তারও কিছুক্ষণ পরে দরজা খুলে গেল, একটি রুক্ষ চেহারার বিদেশি বিকৃত ইংরেজ ভাষায় তাঁকে জিজ্ঞাসা করল–কাকে চাই? লর্ড আর্থার কাউন্ট রুবালোফের চিরকুটটা তার হাতে দিলেন। চিরকুটটার ওপরে চোখ বুলিয়েই লোকটি তার মাথাটা নীচু করে তাঁকে ভেতরে ডেকে নিয়ে গেল। একতলার একটি বিশ্রী ঘরে আর্থার গিয়ে বসলেন। অনতিবিলম্বে হার উইনকেলকফ নামে, ওই নামে লন্ডনে তিনি পরিচিত, একটি লোক ঘরে এসে উপস্থিত হলেন। তাঁর ঘাড়টা মদে ভেজা একটা রুমাল দিয়ে জড়ানো; বাঁ হাতে একটা ফ্রক।

লর্ড আর্থার তাঁকে অভিবাদন জানিয়ে বললেন–কাউন্ট রুবালো আপনাকে দেওয়ার জন্যে আমাকে একটি পরিচয়পত্র দিয়েছেন। বিশেষ একটা ব্যাপারে আপনার সঙ্গে কিঞ্চিৎ আলোচনা করতে আমি এখানে এসেছি। আমার নাম স্মিথ-রবার্ট স্মিথ। একটা বিস্ফোরক ঘড়ির জন্যে আমি আপনার কাছে এসেছি।

সেই ভদ্রবেশী জার্মানটি হেসে বললেন–আপনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে আমি খুশি হয়েছি। অত ভয় পাবেন না। সকলের সঙ্গে পরিচিত হওয়াটাই আমার কর্তব্য। একদিন সন্ধ্যায় লেডি উইনডারমিয়ারের বাডিতে আপনাকে আমি দেখেছি। আশা করি হার লেডিশিপ বহাল তবিয়তেই রয়েছেন। আমার সঙ্গে একটু ব্রেকফাস্ট খাবেন কি? আমাদের খাবার বড়ো চমৎকার; আর আমার বন্ধুরা যা করে বলেন, আমার এখানে যে উৎকৃষ্ট ধরনের রাইন মদ পাওয়া যায় সেরকম বস্তু জার্মান এমব্যাসিতেও দুষ্প্রাপ্য।

ধরা পড়ে গিয়েছে বুঝতে পারার আগেই আর্থারকে নিয়ে তিনি পেছনের ঘরে বসালেন। তারপরেই উৎকৃষ্ট খাবার আর বন্ধুত্বপূর্ণ আলোচনাতে আর্থার জমে গেলেন।

হার উইনকেলকফ বললেন–আজকাল রপ্তানির দিক থেকে বিস্ফেরক ঘড়িগুলি বিশেষ কাজের নয়। কাস্টমস-এর হাত থেকে কোনোরকমে ছাড়ান যদি বা পেল তো পড়ল ট্রেনের। খপ্পরে। ট্রেন সারভিস আজকাল এমনি অখদ্যে হয়ে উঠেছে যে গন্তব্যস্থলে পৌঁছবার আগেই ওগুলি ফেটে যায়। যদি অবশ্য বাড়িতে ব্যবহার করার জন্যে ওরকম কোনো ঘড়ির দরকার। আপনার হয় তাহলে আপনাকে আমি একটা সুন্দর জিনিস দিতে পারি এবং আমি নিশ্চিত যে তার ফল সেযে আপনি সন্তুষ্ট হবেন। কার জন্যে এ-জিনিসটা আপনার দরকার তা কি আমি জানতে পারি? যদি পুলিশ অথবা স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের সঙ্গে যুক্ত কার-ও জন্যে দরকার হয় তাহলে আমি দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি যে এবিষয়ে আপনাকে আমি কোনোরকম সাহায্য করতে পারব না। ইংরাজ গোয়েন্দারাই আমাদের সত্যিকারের বড়ো বন্ধ। আমি সব সময়ে লক্ষ করেছি তাদের মূর্খতার ওপরে আস্থা রেখে আমরা যা ইচ্ছে তাই করতে পারি। তাদের বিনাশ করার জন্যে আপনাকে আমি কোনো সাহায্য করতে পারব না।

লর্ড আর্থার বললেন–আপনি নিশ্চিন্ত হোন-এর সঙ্গে পলিশের কোনো সম্পর্ক নেই। সত্যি। কথা বলতে কি চিচেস্টারের ডিন-এর জন্যেই ঘড়িটা আমার দরকার।

তাই বুঝি! ধর্মের প্রতি আপনার এত আনুগত্য রয়েছে তা তো আমি জানতাম না! আজকাল যুব সম্প্রদায়ের ভেতরে এ-জিনিসটা সাধারণত দেখা যায় না।

একটু লজ্জা পেয়ে লর্ড আর্থার বললেন–আপনি একটু বাড়িয়ে বলছেন, হার উইনকেলকফ। সত্যি কথা বলতে কি, ধর্ম সম্বন্ধে আমার জ্ঞান খুবই কম।

এটা তাহলে একেবারে ব্যক্তিগত ব্যাপার?

একেবারে।

হার উইনকেলকফ তাঁর কাঁধটিকে কুঁচকিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন; তারপরে ফিরে এলেন ছোটো পেনির মাপের একটা ডিনামাইট কেক আর সুন্দর একটা ফরাসি ঘড়ি নিয়ে।

বস্তু দুটি দেখেই লর্ড আর্থারের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তিনি বেশ আনন্দের সঙ্গেই বললেন–এই রকম একটা জিনিসই আমার চাই। এখন বলুন কেমন করে এটা ফাটবে।

নিজের আবিষ্কারের দিকে গর্বের সঙ্গে তাকিয়ে হারউইনকেলকফ বললেন–ওইখানেই আমার রহস্য। কখন আপনি বিস্ফোরণ ঘটাতে চান বলুন। আমি জিনিসটাকে একেবারে কাঁটায়-কাঁটায় ঠিক করে দেব।

ধরুন মঙ্গলবার, আজই যদি দিতে পারেন

অসম্ভব। মস্কোতে বন্ধুদের জন্যে আমার হাতে কিছু জরুরি কাজ রয়েছে। কাল পাঠাতে পারি।

 লর্ড আর্থার বিনীতভাবে বললেন–তাহলেই চলবে-কাল রাত্রি অথবা মঙ্গলবার সকালে পেলেও বিশেষ কোনো অসুবিধে হবে না। শুক্রবার দুপুরের দিকে এই বিস্ফোরণ ঘটানো চাই। ডিন শুক্রবার দুপুরে বাড়িতেই থাকেন।

শুক্রবার, দুপুর-হারউইনকেলকফ কাগজে সময়টা টুকে নিলেন।

 উঠে পড়ে আর্থার ডিজ্ঞাসা করলেন–কত দিতে হবে আমাকে?

লর্ড আর্থার, জিনিসটা এত সামান্য যে বেশি কিছু নিতে আমি চাই নো ডিনামাইটের দাম সাড়ে সাত শিলিং: ঘড়িটার দাম সাড়ে তিন পাউন্ড আর গাড়িভাড়া হচ্ছে পাঁচ শিলিং। কাউন্ট রুবালোফের কোনো বন্ধুর উপকার করতে পারলেই আমি কৃতার্থ।

আপনার পারিশ্রমিক?

 ও কিছু নয়, কিছুনয়। অর্থের জন্যে আমি কাজ করি নে; করি, দক্ষতার জন্যে।

দাম মিটিয়ে দিয়ে লর্ড আর্থার সেখান থেকে বেরিয়ে এলেন।

পরের দুটি দিন বিরাট একটা উত্তেজনার ভেতর দিয়ে কেটে গেল তাঁর। শুক্রবার বেলা বারোটার সময় সংবাদ আহরণ করার জন্যে তিনি বাকিংহামে হাজির হলেন। সারাটা বিকাল ভাবলেশহীন হল-পোর্টার’ সংবাদের পর সংবাদ ছড়িয়ে গেল। নানা অঞ্চলের ঘোড়-দৌড-এর খবর, বিবাহ-বিচ্ছেদের খবরল, আবহাওয়ার খবর, হাউস-অফ-কমনসে সারা রাত ধরে যে সব তর্ক-বিতর্ক হয়েছে, সেই সব বিরক্তিকর সংবাদ, ফাটকা বাজারে যে আতংকের সৃষ্টি হয়েছে সেই সব টুকরো টুকরো কাহিনি। চারটে সময় নানান কাগজের সান্ধ্য গুলি একটার পর একটা আসতে লাগল। পল মল’ এল, ‘সেন্ট জেমস’ এল, গ্লোব এল, এল ‘ইকো’। কোনো কাগজেই চিচেস্টারের কোনো সংবাদ নেই। লর্ড আর্থার ভাবলেন–প্রচেষ্টাটি নিশ্চয় তাঁর ব্যর্থ হয়েছে। এটা তাঁর কাছে বিরাট একটি আঘাত হয়ে দেখা দিল। বেশ ঘাবড়িয়ে গেলেন তিনি। পরের দিন তিনি হার উইনকেলকফের সঙ্গে দেখা। করলেন। বিস্ফোরণ ঘটেনি, সংবাদ পেয়ে তিনি বিস্তারিতভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করে বিনা মূল্যে তাঁকে আর একটা ওই জাতীয় ঘড়ি দিতে চাইলেন; অথবা, কেনা দামে চাইলেন কয়েকটি নাইট্রোগ্লিসিরিল বোমা বিক্রি করতে। কিন্তু বিস্ফোরক দ্রব্যের ওপরে আর তাঁর আস্থা নেই। হার উইকেল অবশ্য বললেন এই ভেজালের যুগে ডিনামাইটের বারুদেও ভেজাল ঢুকেছে। এদিক থেকে তিনি নিরুপায। জার্মান ভদ্রলোকটি অবশ্য মনে করেন যন্ত্রপাতি কিছুটা বিগডে গেলেও এক সময় না এক সময় ওটি ফাটবেই। এইরকম একটা আশা প্রকাশ করে তিনি একটি উদাহরণ দিলেন। একবার ওদেসার সামরিক গভর্নরের কাছে একটি ব্যারোমিটার পাঠানো হয়। কথা ছিল দশ দিনের মধ্যে সেটি ফাটবে। কিন্তু আগামী তিন মাসের মধ্যেও সেটি ফাটেনি। তারপরে যখন ফাটল তারই ছ’সপ্তাহ আগে গভর্নর শহরের বাইরে বেরিয়ে গিয়েছেন। সেই বিস্ফোরণ মারা গেল তাঁর একটি পরিচারিকা। বেচারার দেহটা একেবারে দলা পাকিয়ে গেল। এই থেকেই বোঝা যায় এই সব বিস্ফোরক দ্রব্যের সময়জ্ঞান না থাকলেও বড়োই শক্তিশালী। এই কাহিনি শুনে লর্ড আর্থার কিছুটা সান্ত্বনা যে পেলেন না তা নয়; কিন্তু দু’দিন পরে সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় ডাচেস যখন তাঁকে একখানি চিঠি দেখালেন তখনই তিনি একেবারে নিরাশ হয়ে গেলেন। চিঠিটা সেইমাত্র ডিনারি থেকে তিনি পেয়েছিলেন।

ডাচেস বললেন–ড্রেন বড়ো সুন্দর চিঠি লেখে। এটা তোমার শেষকালে পড়া উচিত। মুডি আমাকে যে সব উপন্যাস পাঠায় এটি তাদেরই মতো সুখপাঠ্য।

চিঠিটা মায়ের হাত থেকে নিয়ে লর্ড আর্থার পড়তে লাগলেন।

দি ডিনারি, চিচেস্টার,
২৭শে মে

প্রিয় কাকিমা,
ডোরকাস সোসাইটির জন্যে তুমি যে ফ্ল্যানেল পাঠিয়ে তার জন্যে ধন্যবাদ, আর সেই সঙ্গে ডোরাকাটা সুতোর কাপড়ের জন্যে আমি তোমার সঙ্গে একমত যে সুন্দর সুন্দর পোশাক। পরার ইচ্ছে হওয়াটা ওদের উচিত নয়। কিন্তু আজকাল সবাই এত রাডিকেল আর অধার্মিক হয়ে পড়েছে যে অভিজাত সম্প্রদায়ের মতো পোশাক-পরিচ্ছদ পরাটা যে তাদের পক্ষে উচিত নয় সেকথা তাদের কিছুতেই বোঝানো যাবে না। কী দুদিনই যে আসছে তা আমি বুঝতে পারাছি নো ধর্মসভায় বাবা বারবারই বলেছেন আমরা অবিশ্বাসের যুগে বাস করছি।

গত বৃহস্পতিবার বাবার কোনো একজন অজ্ঞাত গুণমুগ্ধ ব্যক্তি বাবাকে একটি ঘড়ি পাঠিয়েছেন। ঘড়িটা পেয়ে আমাদের যে কী আনন্দ হয়েছিল তোমাক কী বলব! একটা কাঠের বাক্সের ভেতরে প্যাক করা ছিল ঘড়িটা প্রেরক ঘড়িটা পাঠানোর খরচ নিজেই দিয়ে দিয়েছিলেন। যথেচ্ছাচারিতাই কি স্বাধীনতা’–এর ওপরে বাবা একটি ধর্মসভাযএকবার একটি মনোজ্ঞ ভাষণ দিয়েছিলেন। বাবার ধারণা ঘড়িপ্রেরকটি বাবার সেই বাণী শুলেছিলেন। ঘড়ির ওপরে ছিল একটি মহিলার প্রতিকৃতি। তার মাথায় ছিল একটা টুপি। বাবা বলেন ওটি হচ্ছে স্বাধীনতার প্রতীক। জিনিসটা দেখতে আমার কাছে বেশ ভালো লাগেনি, কিন্তু বাবা বলেন-ওটা হচ্ছে ঐতিহাসিক। বাবার কথায় আমারও তাই মনে হয়েছিল। পার্কার বাক্সটাকে খুললে বাবা লাইব্রেরির কুলুঙ্গিতে ঘড়িটা রেখে দিলেন। শুক্রবার দিন সকালে আমরা সবাই বসে রয়েছি। বারোটা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে একটা ফুসফুস শব্দ হল প্রতিমূর্তিটার পায়ের তলা থেকে কিছুটা ধোঁয়া বেরোল; আর স্বাধীনতার দেবী পড়ে গেল। নীচে পড়ে গিয়ে নাকটা ভাঙল তারা মারিয়া তো ভয়ে অস্থির কিন্তু ব্যাপার দেখে ভেমস আর আমি তো হেসে কুটিকুটি এমন কি বাবাও মুখ টিপে হেসে ফেললেন। পরীক্ষা করার। পরে আমরা বুঝতে পারলাম আসলে ওটা একটা অ্যালার্ম দেওয়া ঘড়ি। ও ভেতরে কিছু বারুদ আর ছোটো হাতুড়িটার নীচে একটা টুপি বসিযে যদি ঘড়ির কাঁটাটাকে ঠিক জায়গায় ঘুরিয়ে দাও তাহলে ঠিক সেই সময় সেটা ফেটে যাবে। ওই রকম শব্দ করে বলেই বাবা ওটাকে লাইব্রেরি ঘরে রাখতে চাইলেন না। তাই রেডি তাকে স্কুল ঘরে রেখে এল। সেখানেও কেবল ফুসফুস, ফরফর করে শব্দ করছে। তোমার কি মনে হয় বিয়ের উপহার হিসাবে ওই রকম একটা ঘড়ি দিলে আর্থার খুশি হবো লন্ডনে আজকাল এই সব জিনিসের চলনই বেশি! বাবা বলেনএরাই মানুষের মতল করবে। কারণ এ থেকেই বোঝা যায় যে স্বাধীনতার পরমায়ু বেশি দিনের নয় ও মরে যেতে বাধ্য। তা ছাড়া স্বাধীনতা শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে ফরাসি বিপ্লব থেকে। কী ভয়ঙ্কর
–জেন পারসি।

চিঠিটা পড়ে আর্থার এতই গম্ভীর আর ধূমথমে হয়ে গেলেন যে ডাচেস তো হেসেই খুন। প্রিয় আর্থার, আর কোনোদিনই কোনো যুবতীর চিঠি তোমাকে আমি পড়তে দেব না। কিন্তু ঘড়িটার সম্বন্ধে কী বলব বল তো? আমার নিজেরই ওইরকম একটা ঘড়ি পেতে ইচ্ছে করছে।

একটা বিষণ্ণ হাসি হেসে আর্থার বললেন–ওসব কিছু নয়। এই বলে মাকে চুমু খেয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন তিনি।

ওপরে উঠেই একটা সোফার ওফরে তিনি ঢলে পড়লেন। তাঁর চোখ দুটি জলে ভরে উঠল। এই হত্যা করার জন্যে যথাসাধ্য চেষ্টা তিনি করেছেন; কিন্তু দু-দুবারই তিনি ব্যর্থ হয়েছেন; আর সেই ব্যর্থতার জন্যে তিনি নিজে এতটুকু দায়ী নন। কর্তব্য করার চেষ্টা তিনি করেছেন, কিন্তু মনে হচ্ছে ভাগ্য তাঁর সঙ্গে বারবার প্রতারণা করেছে। কী করবেন তিনি? এই বিয়ে ভেঙে দেবেন? আইবিলের যে কষ্ট হবে সেটা ঠিক; কিন্তু তাতে তাঁর মতো উন্নত চরিত্রের অবনতি ঘটবে না এতটুকু। আর তাঁর কথা? তিনিও কষ্ট পাবেন সত্যি কথা। কিন্তু তাতে কী আসে যায়? সব সময়েই তো যুদ্ধ হচ্ছে। তাতে মানুষ মারা যেতে পারে। এমন কোনো কারণ ঘটতে পারে যার জন্যে মানুষকে জীবন দান করতে হয়। জীবনে তাঁর কোনো আনন্দ নেই বলেই মৃত্যুতেও তাঁর কোনো ভয় নেই। ভাগ্যই তাঁর ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করুক। তাকে সাহায্য করার জন্যে তিনি একটুও চেষ্টা করব না।

রাত্রি সাড়ে সাতটার সময় পোশাক পরে তিনি ক্লাবে গেলেন। একদল যুবকের সঙ্গে আর্বিটান সেখানে বসেছিলেন। তাঁদের সঙ্গেই তাঁর ডিনার খাওয়ার কথা ছিল। তাঁদের সেই হালকা। আলোচনা তাঁর ভালো লাগল না। কফি আসার সঙ্গে-সঙ্গে একটা জরুরি কাজের অছিলায় তিনি ক্লাব ছেড়ে বেরিয়ে এলেন। বেরিয়ে আসার সময় ক্লাবের বেয়ারা তাঁর হাতে একখানা চিঠি দিল। চিঠি এসেছিল হার উইনকেলকফের কাছ থেকে। তাঁর কাছে একটা বিস্ফোরক ছাতা রয়েছে। সেই ছাতা খেলার সঙ্গে-সঙ্গে বিস্ফোরণ ঘটে যাবে। এটাই হচ্ছে সর্বশেষ আবিষ্কার–সম্প্রতি জেনেভা থেকে আমদানি হয়েছে। সেই ছাতাটা দেখার জন্যে আর্থারকে তিনি পরের দিন সকালে তাঁর বাসায় আসতে অনুরোধ করেছিলেন। চিঠিটাকে তিনি টুকরো-টুকরো করে ছিঁড়ে ফেললেন। আর কোনো পরীক্ষা করবেন না বলে তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তারপরে টেমস নদীর বাঁধের ওপরে তিনি ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। ঘণ্টার পর ঘন্টা বসে রইলেন নদীর ধারে। ছোটো-ছোটো মেঘের ভেতর দিয়ে চাঁদ উঁকি দিতে লাগল; বড়ো বড়ো নৌকোগুলি নদীর তীব্র স্রোতের ওপরে পাক খেয়ে-খেয়ে ঘুরতে লাগল। পোলের ওপর দিয়ে চিৎকার করতে করতে ট্রেন চলার সময় রেলের সঙ্কেত সবুজ থেকে লাল হয়ে গেল। কিছুক্ষণ পরেই ওয়েস্টমিনিস্টারের দীর্ঘ গম্বুজ থেকে রাত বারোটার ঘণ্টা বাড়লো সেই উচ্চনিনাদী শব্দের তালে-তালে রাত্রিটা কাঁপতে লাগল যেন। তারপরে রেল স্টেশনের আলো গেল নিবে। জ্বালা রইল রুবির মতো একটি মাত্র আলো। শহর ধীরে ধীরে স্তব্ধ হয়ে আসতে লাগল।

রাত্রি প্রায় দুটোর সময় তিনি উঠলেন। হাঁটতে লাগলেন ব্ল্যাকফ্রায়ার্স এর দিকে। কত অপার্থিব, কত স্বপ্নমযই না সব দেখাচ্ছে মনে হচ্ছে নদীর উলটো দিকে বাডিগুলি সব অন্ধকার দিয়ে তৈরি হয়েছে। দেখলে মনে হবে রুপো আর ছায়া দিয়েই বিশ্বটা তৈরি হয়েছে। সেই কুয়াশাচ্ছন্ন বাতাসের মধ্যে সেন্ট পলের উঁচু গম্বুজটাকে একটা বুদবুদের মতো মনে হল।

ক্লিয়োপেট্রার নিডল-এ এসে পৌঁছতেই তিনি দেখতে পেলেন একটা লোক কার্নিশের ওপরে ঝুঁকে পড়ে কী যেন দেখছে। কাছাকাছি আসতেই লোকটি ওপর দিকে তাকাল। সেই সময় গ্যাসের আলোটা তার মুখের ওপরে গিয়ে পড়ল।

লোকটি আর কেউ নন, মিঃ পডগারস, সেই গণৎকার। সেই থ্যাবড়া, থলথলে মুখ, সোনা দিয়ে বাঁধালো চশমা, রুগ্ন হাসি, আর কামার্ত মুখের চেহারা দেখে অন্য লোক বলে ভুল হওয়ার উপায় নেই কারও।

লর্ড আর্থার দাঁড়িয়ে পড়লেন। মগড়ের মধ্যে একটা চমৎকার চিন্তা খেলে গেল তাঁরা নিঃশব্দে তিনি তাঁর পেছনে গিয়ে দাঁড়ালেন। তারপরে ঝটিতি তাঁর পা দুটো ধরে সোডা তিনি তাঁকে টেমস নদীর জলে ফেলে দিলেন। একটা গালাগালির শব্দ শোনা গেল; তারপরেই শোনা গেল ঝপাং করে একটা জিনিস জলে পড়ার শব্দ। তারপরেই সব চুপচাপ। অস্থিরচিত্তে লর্ড আর্থার সেই দিকে চেয়ে রইলেন। কিন্তু গণৎকারের আর কিছুই দেখা গেল না। শুধু তাঁর উঁচু টুপিটা চন্দরকরোজ্জ্বল নদীর জলে নাচতে লাগল। কিছুক্ষণ পরে তাও গেল তালিযে। মিঃ পডগারস-এর কোনো চিহ্ন আর দেখা গেল না। একবার মনে হল তাঁর বিকৃত দেহটা পোলের সিড়িঁটা আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করছে, কিন্তু তারপরেই মন হল ওটা ছায়া ছাড়া আর কিছু নয়। আকাশে চাঁদ দেখা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই ছায়াটাও মিলিয়ে গেল। ভাগ্যের বিধান কী ছিল এবার তিনি তা যেন বুঝত পারলেন। একটা বিরাট স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন তিনি। তারপরেই সাইবিলের নামটা তাঁর ঠোঁটের ডগায় এসে উপস্থিত হল।

পরের কটা দিন আশা আর ভয়ের আবর্তে তিনি পাক খেতে লাগলেন। মাঝে-মাঝে তাঁর মনে হত এই বুঝি মিঃ পডগারস তাঁর ঘরে এসে হাজির হন। কিন্তু অন্য সময় তাঁর মনে। হত-না; ভাগ্য কি তাঁর ওপরে এত নির্দয় হতে পারে? দু’দুবার তিনি গণৎকারের বাড়ির সামলে গেলেন; কিন্তু কিছুতেই বেল বাজাতে পারলেন না। তিনি নিশ্চিন্ত হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ভয়ে সেকথা কাউকে জিজ্ঞাসা করতে পারছিলেন না।

অবশেষে সংবাদ এল। চা খাওয়ার পর ক্লাবের ধুমপান করার ঘরে তিনি বলেছিলেন এমন সময় বেহারা কয়েকটি কাগজের সান্ধ্য সংস্করণ নিয়ে হাজির হল। সেন্ট জেমস কাগজটা। তুলে নিয়ে তিনি চোখ বুলিয়ে যাচ্ছিলেন এমন সময় একটা বেশ বড়ো অক্ষরে ছাপা বিশেষ একটি সংবাদ তাঁর চোখে পড়ল।

গণৎকারের আত্মহত্যা

উত্তেজনায় কেমন যেন বিবর্ণ হয়ে গেলেন তিনি। তাড়াতাড়ি পড়তে লাগলেন। সংবাদিট হচ্ছে —

গতকাল সকালে সাতটার সময় মিঃ সেপটিমাস আর, পডগারসবিখ্যাত হস্তপরীহক-এর। মৃতদেহ গ্রীনউইচ উপকূলে পাওয়া গিয়েছে, শ্যিপ হোটেলের ঠিক সামনেই হতভাগ্য ভদ্রলোককে কয়েকদিন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। গণৎকারদের সমাজে তাঁর জন্যে বেশ উদ্বেগ প্রকাশ করা হচ্ছিল। মনে হচ্ছে সামরিক মস্তিষ্ক বিকারের ঝোঁকে তিনি আত্মহত্যা করেছেন। হয়তো, অতিরিক্ত পরিশ্রমই এর জন্যে দায়ী। করোনাররাও এই মন্তব্য প্রকাশ করেছেন। মিঃ পডগারস সম্প্রতি ‘মানুষের হাত’–এই বিষয়ে একটি বিশদ পুস্তক রচনার কাজ শেষ করেছেন। সেটি শীঘ্রই প্রকাশিত হবে। হলে, একটা আলোড়নের সৃষ্টি হবে চারপাশে। মৃত ব্যক্তির বয়স ছিল পঘষট্টি বছর। তাঁর কোনো আত্মীয়-স্বজন নেই বলেই আমাদের মনে হয়।

কাগজটা হাতে নিয়ে লর্ড আর্থার ক্লাব থেকে ছুটে বেরিয়ে এলেন। তারপরেই সোডা পার্ক লেন। জানালা থেকে সাইবিল তাঁকে দেখলেন। দেখেই তাঁর মনে হল নিশ্চয় কোনো শুভ সংবাদ রয়েছে। তাড়াতাড়ি নেমে এলেন তিনি। আর্থারের সঙ্গে দেখা হতেই তিনি। বুঝলেন–হ্যাঁ, সংবাদটা শুভই।

লর্ড আর্থার বললেন–প্রিয় সাইবিল, কালকেই আমরা বিয়ে করব।

চোখের জলে হাসতে হাসতে সাইবিল বললেন–বোকা ছেলে! এখনো কেক তৈরি করার জন্যে বাঘনা দেওয়া হয়নি যে।

.

০৬.

তিন সপ্তাহ পরে বিয়ে হল তাঁদের। এই উপলক্ষে সেন্ট পিটার গির্জায় চটপটে আধুনিক যুবক-যুবতীর বেশ ভালোই সমাবেশ হয়েছিল। চিচেস্টারের ডিন গাম্ভীর্যপূর্ণ পরিবেশের মধ্যে ধর্মীয় অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করলেন। এরকম সুন্দর পাত্র-পাত্রী ও অঞ্চলে আর কখনো যে। দেখা যায়নি সে বিষয়ে সবাই একমত। সাইবিলের জন্যে লর্ড আর্থার যে কষ্ট করেছেন সেকথা একবারও তাঁর মনে হল না। আর নারী তার শ্রেষ্ঠ জিনিস পুরুষকে যা দিতে পারে-সেবা, যত্ন আর ভালোবাসা-সাইবিল যে-সবই আর্থারকে দিয়েছিলেন। তাঁদের ভীবনে বাস্তবের সংঘাতে রোমান্স চূর্ণ হয়নি। চিরকালই তাঁদের যৌবন অটুট ছিল।

কয়েক বছর পরের কথা। তখন তাঁদের সুন্দর দুটি সন্তান জন্মেছে। লেডি উইনডারমিয়ার একদিন তাঁদের সঙ্গে দেখা করতে এলেন অ্যালটন প্রযোরিতো জায়গাটা বড়ো সুন্দর। ডিউক যৌতুক হিসাবে এই জায়গাটা তাঁর পুত্রকে দান করেছিলেন। একদিন বিকালে বাগানের একটা লাইম গাছের তলায় লেডি উইনডারমিয়ার লেডি আর্থারের সঙ্গে বসে গল্প করছিলেন। ফুটফুটে বাচ্চা ছেলে-মেয়ে দুটি গোলাপ বাগানের ভেতরে খেলা করছিল। এমন সময় হঠাৎ সাইবিলের হাতটা ধরে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন-তুমি সুখী হচ্ছে, সাইবিল?

 নিশ্চয়, নিশ্চয়। আপনি সুখী হননি?

সুখী হওয়ার মতো আমার সময় নেই, সাইবিলা আমার সঙ্গে যে লোকটি সকলের শেষে পরিচিত হয় তাকেই আমার ভালো লাগে। কিন্তু ব্যাপারটা হচ্ছে মানুষের সঙ্গে ভালোভাবে পরিচিত হওয়ার পরেই আর তাকে আমার ভালো লাগে না।

সিংহেরা আর আপনাকে আনন্দ দেয় না?

উঁহু! সবাই ওই একটা ঋতুর খদ্দের। তাছাড়া, তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করলেই তারা সঙ্গে সঙ্গে খারাপ ব্যাবহার করতে শুরু করবে। সেই বিশ্রী পডারসকে মনে রয়েছে তোমার? একটা প্রতারক-ভয়ঙ্কর রকমের প্রতারক। অবশ্য তাও আমি কিছু মনে করিনি। অনেকবার তাকে আমি টাকা ধারও দিয়েছি; কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে আমার সঙ্গে প্রেম করতে শুরু করল। এইটাই অসহ্য। তারই জন্যে চিরোম্যানসি শাস্ত্রটাকে আমি ঘৃণা করি। এখন আমি। টেলিপ্যাথি পড়ছি। ওটা সুন্দর জিনিস।

লেডি উইনডারমিয়ার, চিরোম্যানসির বিরুদ্ধে আপনি কিছু বলবেন না। আর্থার ওর বিরুদ্ধে। কাউকে কিছু বলতে দেবে না। এক কথা ও বিষয়ে সে খুবই সিরিয়াস।

 সে যে এটা বিশ্বাস করে এটা নিশ্চয় তুমি আমাকে বলতে চাও না?

ওকেই জিজ্ঞাসা করুন। ওই তো এসে গিয়েছে।

একগোছা বোনে গোলাপ ফুল নিয়ে আর্থার দুটি নৃত্যরত শিশুদের সঙ্গে হাজির হলেন। লেডি উইনডারমিয়ার জিজ্ঞাসা করলেন-আর্থার, তুমি নিশ্চয় ‘চিরোম্যানসি’ বিশ্বাস করো না?

নিশ্চয় করি-হাসলেন আর্থার।

কেন কর?

কারণ, আমার আনন্দ ওরই ওপরে নির্ভর করে। ওরই জন্যে আমি সাইবিলকে পেয়েছি।

লেডি উইনডারমিয়ার বললেন–এরকম অর্থহীন কথা জীবনে আমি শুনিনি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *