সুখী রাজকুমার
The Happy Prince
শহরের মাথা ছাড়িয়ে উঁচু বেদীর ওপরে সুখী রাজকুমারের প্রতিমূর্তি দাঁড় করানো ছিল। মূর্তিটার সারা গায়ে পাতলা সোনার পাত দিয়ে মোড়া। তার চোখ দুটি ছিল নীলকান্ত মণিরা তার তরোয়ালের বাঁটের ওপরে জ্বলজ্বল করছিল একটা বেশ বুড়ো লাল রঙ-এর রুবি।
সবাই এই মূর্তিটি দেখে খুব প্রশংসা করত। চারুশিল্পের সমঝদার হিসাবে নাম কিনতে চাইতেন এমন একজন শহরের কাউনসিলার বললেন–মূর্তিটা ঠিক বায়ু-নিশানের মতোই সুন্দর। পাছে লোকে তাঁকে অবাস্তব বলে মনে করে, আর অবাস্তব প্রকৃতির নুষ তিনি। সত্যিই ছিলেন না, এই ভযে তিনি যোগ করলেন–তবে ততটা প্রযোজনীয় নয়।
একটা বাচ্চা ছেলে চাঁদ ধরার জন্যে কাঁদছিল। তাকে তার বিজ্ঞ মা বললেন–তুমি সুখী রাজকুমারের মতো হতে পার না কেন? কোনো কিছু পাওয়ার জন্যে কান্নাকাটি তিনি করতেন না।
জীবনে হতাশ হয়েছে এইরকম কোনো মানুষ এই অদুত সন্দর মর্তিটির দিকে তাকিয়ে বলত–জগতে যে একজন মানুষও সুখী হতে পেরেছে এটা জেনে আমি আনন্দিত।
চকচকে পরিষ্কার পোশাক পরে গির্জা থেকে বেরিয়ে এসে ছেলেরা বলত–দেখতে একেবারে দেবদূতের মতো।
অঙ্কের শিক্ষক জিজ্ঞাসা করতেন–তোমরা কী করে জানলে? দেবদূত তো তোমরা কোনোদিন দেখনি?
ছেলেরা বলত–স্বপ্নে দেখেছি–
এই কথা শুনে গম্ভীর হয়ে শিক্ষক মশাই ভ্রু কুঞ্চিত করতেন; কারণ, ছেলেদের স্বপ্ন দেখাটা তিনি বেশ পছন্দ করতেন না।
একদিন রাত্রিতে একটা ছোটো দোয়েল পাখি শহরের ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছিল। প্রায় ছ’সপ্তাহ আগে তার বন্ধুরা ইজিপ্টে উড়ে গিয়েছে। কিন্তু সে পেছনে পড়েছিল। তার কারণ, সে একটি সুন্দর শরগাছের সঙ্গে প্রেমে পড়েছিল। বেশ বড়ো একটা বেগনে প্রজাপতির পেছনে ধাওয়া করার উদ্দেশ্যে সে একদিন যখন নদীর জলের ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছিল এমন সময় একটি প্রথম বসন্তে তার সঙ্গে শরগাছটির দেখা হয়। শরগাছের সরু কোমর দেখে সে এতই মুগ্ধ হয়ে পড়েছিল যে তার সঙ্গে আলাপ করার জন্যে সে থেমে গেল।
দোয়েলটি সোজাসুজি কথা বলতে ভালোবাসত। তাই সে জিজ্ঞাসা করল–তোমাকে কি আমি ভালোবাসব? শরগাছটি মাথা নীচু করল তারা তখন সে নদীর ওপরে রূপালি ঢেউ তুলে তার চারপাশে ঘুরে ঘুরে উড়তে লাগল। এইভাবে সে তার ভালোবাসা জানাল; আর এটা চলল সারা গ্রীষ্মকাল ধরে।
অন্য সব দোয়েল পাখিরা ঠাট্টা করল তাকে–এই ভালোবাসা দেখে হাসি পাচ্ছে আমাদের। মেযেটার কোনো দাম নেই। আত্মীয়-স্বজনেও ওর অনেক। আর নদীটা যে শরগাছে বোঝাই ছিল সেকথা তো মিথ্যে ন্য। তারপরে, শরৎকাল আসার সঙ্গে সঙ্গে তারা সবাই উড়ে গেল।
বন্ধুরা সবাই চলে গেলে তার বডো একা-একা লাগল। তার প্রেমিকাকে তার আর যেন ভালো লাগল না। সে বললও কোনো কথা বলতে পারে না। তা ছাড়া ও বড়ো ঢঙি। বাতাস একবার বইতে শুরু করলেই ব্যস। ও তার সঙ্গে অমনি ঢঙ করতে শুরু করে দেবে। আর কথাটা সত্যিই। যখনই বাতাস বইত তখনই ও সুন্দর ভাবে কোমর দুলিয়ে তাকে অভিবাদন জানাত। সে বলে গেল–স্বীকার করছি ও ঘরোয়া। কিন্তু নানা দেশ বেড়িয়ে আমার ভালো লাগে; আর আমার স্ত্রীরও সেই রকম বেড়াতে ভালো লাগা উচিত।
সে একবার শেষবারের মতো জিজ্ঞাসা করলচতুমি কি আমার সঙ্গে আসবে? কিন্তু শরটি মাথা নেড়ে বলল–না। ঘরে থাকার মোহ তার এত বেশি।
সে কান্নার সুরে বলল–এতদিন তুমি আমার সঙ্গে ছলনা করেছ। আমি পিরামিডের দিকে উড়ে চললাম। বিদায়! এবং সে উড়ে গেল।
সারা দিন ধরেই সে উড়েছে। রাত্রিতে সে শহরে এসে হাজির হল। সে বলল–কোথায় আমি থাকব? আশা করি এই শহরে থাকার মতো জায়গা নিশ্চয় কোথাও রয়েছে।
তারপরেই লম্বা বেদীর ওপরে সে সেই মূর্তিটা দেখতে পেল। সে বলল–আমি এইখানেই থাকব। বেশ সুন্দর জায়গা পরিষ্কার বাতাসও রয়েছে প্রচুর। এই বলে সে সুখী রাজকুমারের দুটি পায়ের মাঝখানে এসে বসে পড়ল।
চারপাশে তাকিয়ে দেখেই সে বলল–আমার শোওয়ার ঘরটা তো দেখছি সোনার। এই বলেই সে ঘুমানোর ব্যবস্থা করল। কিন্তু সবেমাত্র সে পালকের ভেতরে মাথাটা তার ঢুকিয়ে দিয়েছে এমন সময় বড়ো এক ফোঁটা জল তার গায়ে এসে পড়ল। সে প্রায় চিৎকার করে উঠল–অবাক কাণ্ড! আকাশে এক ফোঁটা মেঘ নেই। নক্ষত্রগুলি বেশ পরিচ্ছন্ন আর উজ্জ্বল। তবু বৃষ্টি হচ্ছে? উত্তর ইউরোপের আবহাওঘাটা সত্যিই বড়ো ভয়ঙ্কর। শরগাছ বৃষ্টি বড়ো ভালোবাসত। সেটা। তার স্বার্থপরতা।
আর এক বিন্দু জল পড়ল।
সে বলল–বৃষ্টিই যদি ঠেকাতে না পারল তাহলে স্ট্যাচু থাকার দরকারটা কী? আমাকে একটা চিমনি খুঁজে বার করতে হবে। এই বলেই সে উড়ে যাওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু উড়ে যাওয়ার জন্যে পাখা দুটো মেলে ধরার আগে তৃতীয় বিন্দুটি পড়ল। সে ওপর দিকে
তাকাল–দেখল-হায়রে, কী দেখল সে?
দেখল, সুখী রাজপুত্রের চোখ দুটি জলে ভর্তি হয়ে গিয়েছে তার সোনালি গাল দুটি বেয়ে সেই জল গড়িয়ে পড়ছে। চাঁদের আলোতে তার মুখটা এতই সুন্দর দেখাচ্ছিল যে সেই ক্ষুদে দোয়েলটির মন করুণায় ভরে গেল। জিজ্ঞাসা করল–তুমি কে?
আমি হচ্ছি সুখী রাজকুমার।
তাহলে তুমি কাঁদছ কেন? এত কাঁদছ যে চোখের জলে আমাকে একেবারে ভিজিয়ে দিয়েছ।
সেই মূর্তিটি বলল–আমি যখন মানুষ ছিলাম, যখন আমার মানুষের হৃদয় ছিল তখন। চোখের জলে কাকে বলে তা আমি জানতাম না। কারণ আমি তখন স্যানসসোসির। রাজপ্রাসাদে বাস করতাম–কোনো দুঃখই সেখানে ঢুকতে পারত না। দিনের বেলায় সঙ্গিদের সঙ্গে আমি বাগানে খেলা করতাম-সন্ধেবেলায় ‘গ্রেট হল’-এ আমি নৃত্য পরিচালনা করতাম। বাগানের চারপাশে ছিল উঁচু পাঁচিল-কিন্তু তার ওপাশে কী রয়েছে তা কোনোদিনই আমি জানতে চাইতাম না। আমার চারপাশে এমন সুন্দর সুন্দর ডিনিস ছড়িয়ে থাকত যে সে সব কিছু জানার প্রয়োজনই আামার হত না। আমার সভাসদেরা আমাকে সুখী রাজকুমার বলে ডাকতেন আর আনন্দটা যদি সুখ হয় আমি তাহলে সত্যিই সুখী ছিলাম। এইভাবেই আমি বেঁচে ছিলাম, আর এইভাবেই আমি একদিন মারা গেলাম। আমি মারা যাওয়ার পরে তারা। আমাকে এত উঁচু বেদীর ওপরে বসাল যে আমার শহরের সমস্ত কদর্যতা আর দুঃখ আমি বেশ দেখতে পাচ্ছি। আর যদিও আমার হৃদযটা ওরা সীসে দিয়ে তৈরি করেছে তবু আমি না কেঁদে পারছি লে।
দোয়েল পাখি নিজের মনে-মলেই বলল–কী! ওর সমস্তটা কি সোনা নয়?
সে এতটা নম্র ছিল যে এই ব্যক্তিগত মন্তব্যটা সে চেঁচিয়ে বলতে পারল না।
আস্তে-আস্তে সুরেলা কণ্ঠে মূর্তিটি বলল–অনেক দূরে–অনেক দূরে রাস্তার ওপারে একটা কুঁড়ে রয়েছে। ওই ঘরের একটা জানালা খোলা। তারই ভেতর দিয়ে একটি মহিলাকে আমি। টেবিলের পাশে বসে থাকতে দেখছি। তার মুখটা রুগ্ন, ক্লিষ্ট। তার হাত দুটি লাল খসখসে, দুচে বেঁধা–কারণ মেয়েটি পেশায় দর্জিা রানির সব চেয়ে সুন্দরী একটি সহচরী পরবর্তী ‘কোর্ট বল’-এ নাচবে। তারই জন্যে সার্টিনের গাউনের ওপরে সে ‘প্যাশান ফ্লাওয়ার’ আঁকছে তার ঘরের এক কোণে তার শিশুটি অসুস্থ অবস্থায় শুয়ে রয়েছে। তার জ্বর হয়েছে। সে কমলালেবু খেতে চাইছে। নদীর ভাল ছাড়া তাকে আর কিছু খেতে দেওয়ার সামর্থ্য তার মাযের নেই। তাই সে কাঁদছে। দোয়েল দোয়েল, আমার ছোট্ট দোয়েল, আমার তরোয়ালের বাঁটের ওপরে যে রুবিটা রয়েছে সেটা কি তুমি তাকে একটু দিয়ে আসবে না? আমার পা দুটো এই মাঁচার সঙ্গে বাঁধা রয়েছে। আমি যে নড়াচড়া করতে পারি নে।
চ বলল–ইজিপ্টে বন্ধুরা আমার প্রতীক্ষা করছে। আমার বন্ধুরা নীল নদের ওপরে পাক খেযে-খেয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে। বড়ো বড়ো কুমুদ ফুলের সঙ্গে গল্প করছে তারা। শীঘ্রই তারা সম্রাটের কবখানার মধ্যে ঘুমোতে যাবে। চিত্ৰবিচিত্র কফিনে সম্রাটও সেইখানে ঘুমোচ্ছেন। নানারকম সুগন্ধী মশলা দিয়ে মাখা বেগনে কাপড়ে ঢাকা রয়েছে তাঁর দেহ। তাঁর গলায় রয়েছে বিবর্ণ জীর্ণ ঘোড়ার একটা শেকল। তাঁর হাত দুটি শুকিয়ে যাওয়া পাতার মতো। রাজপুত্র বলল–দোয়েল, দোয়েল, আমার ছোট্ট দোয়েল, তুমি কি একটা রাত্রি আমার কাছে থাকবে না–হবে না আমার দূত? বাচ্চাটার বড্ড তেষ্টা পেযেছে। বড্ড কষ্ট পাচ্ছে ওর মা।
দোয়েল বলল–ওই সব বাচ্চাদের আমার খুব একটা ভালো লাগে না। গত গ্রীষ্মে আমি যখন নদীতে বাস করছিলাম তখল কলওযালার দুটো বদমাইশ ছেলে সব সময় আমার দিকে ঢিল চুড়তো। সেই সব ঢিল আমার গায়ে অবশ্য লাগেনি। আমরা অনেক দূরে ঘুরে বেড়াই। তা ছাড়া, আমি যে বংশের পাখি তারা ডানার ডোরের জন্যে বিখ্যাত। কিন্তু তবু এটা একটা অসম্মান তো!
কিন্তু সুখী রাজকুমারকে এত বিষণ্ণ দেখাল যে খুদে দোযেলের কেমন কষ্ট হল। সে বলল–জায়গাটা বড়ো ঠান্ডা। তবু আজ রাত্রিতে আমি তোমার কাছে থাকব–কাজ করে দেব তোমার।
রাজকুমার বলল–ধন্যবাদ।
সুতরাং দোয়েল পাখিটি রাজকুমারের তরোয়ালের বাঁট থেকে সেই বড়ো রুবিটা খুলে নিয়ে ঠোঁটে করে অনেক বাড়ির ছাদের ওপর দিয়ে উড়ে গেল।
গির্জার উঁচু গম্বুজের পাশ দিয়ে সে উড়ে গেল। সেইখানে দেবদূতদের শ্বেত পাথরে আঁকা মূর্তিগুলি খোদাই করা রয়েছে। সে প্রাসাদের পাশ দিয়ে উড়ে গেল; শুনতে পেল নাচের শব্দ। একটি সুন্দরী মেযে তার প্রেমিকের সঙ্গে কথা বলতে বলতে বারান্দার ওপরে বেরিয়ে এল। প্রেমিকটি তার প্রেমিকাকে বলল–তারাগুলি কী অদ্ভুত সুন্দর! প্রেমের ক্ষমতা কী অদ্ভুত!
মেয়েটি বলল–আশা করি স্টেটবল-এর আমার নতুন পোশাকটা তৈরি হয়ে যাবে। আমি তার ওপরে প্যাশান ফ্লাওয়ার এঁকে দিতে বলেছি। কিন্তু মেয়ে-দর্জিগুলো বড়োই অলস।
সে নদীর ওপর দিয়ে উড়ে গেল; দেখল জাহাজের মাস্তুলের ওপরে লণ্ঠন ঝুলছে। উড়ে গেল। জু’দের বসতির ওপর দিযে; দেখল, তারা দরকষাকষি করে তামার দাঁড়িতে করে টাকা ওজন করছে। অবশেষে সে দরিদ্র কুটিরে হাজির হয়ে উঁকি দিয়ে দেখল। বাচ্চাটা জ্বরের ঘোরে বিছানার ওপরে গড়াচ্ছে। মা তার ঘুমিয়ে পড়েছে-বড়োই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল সে। লাফাতে লাফাতে ঘরের মধ্যে ঢুকে টেবিলের ওপরে যেখানে মেয়েটির সেলাই পড়েছিল তারই পাশে সেই বিরাট রুবিটি রেখে দিল। তারপরে সে ধীরে-ধীরে বিছানার চারপাশে উড়তে লাগল। ছেলেটির কপালে তার ডানা দিয়ে হাওয়া করল। ছেলেটি বলল–আামার গা-টা ঠান্ডা হয়ে গেল। আমার নিশ্চয় ভত্বর ছেড়ে গিয়েছে। এই বলে মিষ্টি ঘুমের আমেজে সে ঢলে পড়ল।
দোয়েলটি ফিরে এল নিজের জায়গায়, সে যা করেছে সে-সব কথা সুখী রাজকুমারকে বলল। তারপরে মন্তব্য করল–কী অদ্ভুত! যদিও এত ঠান্ডা, তবুও আমার বেশ গরম লাগছে।
রাজকুমার বলল–তার কারণ, তুমি একটা ভালো কাজ করেছ।
এবং সেই ছোট্ট দোয়েলটি চিন্তা করতে-করতে ঘুমিয়ে পড়ল। চিন্তা করতে-করতে সব সময়েই সে ঘুমিয়ে পড়ত।
সকাল হলে সে নদীতে গিয়ে স্নান করে এল। পক্ষীতত্ত্ববিশারদ একটি অধ্যাপক সেই সময় পুলের ওপর দিয়ে যাচ্ছিলেন। দোয়েলকে দেখে বিস্মিত হয়ে তিনি বললেন–কী অদ্ভুত ঘটনা! শীতকালে দোয়েল! স্থানীয় একটি সংবাদপত্রে এই নিয়ে তিনি দীর্ঘ একটি চিঠি লিখলেন। প্রত্যেকেই এটি পড়ল, আলোচনা করল; কিন্তু চিঠিতে এত শব্দ ছিল যে তারা তার। বিন্দুবিসর্গও হৃদয়ঙ্গম করতে পারল না।
দোয়েল বলল–আজ রাত্রিতে আমি ইজিপ্ট যাচ্ছি। এই যাওয়ার আনন্দে তাকে বেশ উত্তেজিত দেখা গেল। যত মঠ-মন্দির আর দেখার জায়গা ছিল সব সে দেখে বেড়াল। গির্জার চড়ার ওপরে অনেকক্ষণ ধরে সে বসে রইলা যেখানেই সে গেল সেখানেই চড়াই পাখিরা তাকে দেখে কিচিরমিচির করে নিজেদের ভেতরে বলাবলি করতে লাগল-কী সম্ভ্রান্ত এই বিদেশি পাখি! এইভাবে ঘুরে বেড়িযে সে যথেষ্ট আনন্দ পেলা।
আকাশে চাঁদ উঠলে সে সুখী রাজকুমারের কাছে উড়ে গিয়ে বলল–ইজিপ্টে কাউকে কিছু। বলার রয়েছে তোমার? আমি এবার যাচ্ছি।
রাজকুমার বলল–দোয়েল, দোয়েল, ছোট্ট দোয়েল–আর একটা রাত্রি কি তুমি আমার কাছে থাকবে না?
দোয়েল বলল–ইজিপ্টে বন্ধুরা আমার জন্যে অপেক্ষা করছে। আগামীকাল তারা দ্বিতীয় জলপ্রপাত দেখতে যাবে। সেখানে শরগাছের ঝোঁপের মধ্যে নদী-ঘোড়া লুকিয়ে থাকে; আর। গ্রানাইট পাথরের তৈরি বিরাট একটা ঘরের ওপরে মেমনন দেবতা বসে রয়েছেন। সারা রাত্রি ধরে তিনি তারামণ্ডলের দিকে তাকিয়ে থাকেন; ভোরের তারা চকচক করে ওঠার সঙ্গে-সঙ্গে তিনি আনন্দে একবার চিৎকার করেই শান্ত হয়ে যান। দুপুর বেলা পীতাভ সিংহেরা নদীর ধারে আসে জল খেতো তাদের চোখগুলি সবুজ পান্নার মতো চকচকে; তাদের গর্ডন। উঁচুলপ্রপাতের গর্জনের চেয়েও ডোরাল।
রাজকুমার বলল–দোয়েল, দোয়েল, ছোট্ট দোয়েল-শহর ছাড়িয়ে অনেক দূরে চিলেকোঠার মধ্যে আমি একটি যুবককে দেখতে পাচ্ছি। কাগজে বোঝাই টেবিলের ওপরে মাথাটি রেখে সে বসে রয়েছে। তার পাশে একটা গামলার ভেতরে রয়েছে কযেকটা শুকলো ভায়লেট ফুল। তার মাথার চুলগুলি কটা আর কোঁকড়ানো। তার ঠোঁট দুটো ডালিমের মতো লাল-বড়ো আর স্বপ্নপু চোখ। থিয়েটারের জন্যে সে একটা নাটক লিখছে; কিন্তু তার এত শীত করছে যে তার হাত সরছে না। তার কামরায় কোনো আগুন নেই। খিদেতে সে বড়ো কাতর হয়েছে।
দোয়েলের হৃদয়টা ছিল সত্যিই বড়ো কোমল। তাই সে বলল–বেশ। আর একটা রাত্রি আমি তোমার জন্যে থেকে যাব। তার কাছে কি আর একটা রুবি আমি পৌঁছে দেব?
রাজকুমার বলল–হায়রে, আমার তো আর কোনো রুবি নেই। আছে কেবল এই চোখ দুটি। এই চোখ দুটি আমার দুষ্প্রাপ্য নীলকান্ত মণির। এই মণি দুটি হাজার বছর আগে ভারতবর্ষ থেকে কিনে আনা হয়েছিল। তারই একটা মণি খুলে নিয়ে তাকে দিয়ে এস। সোনার দোকালে সে সেটা বিক্রি করে জ্বালানি কাঠ কিনবে-তারপরে নাটকটা শেষ করবে সে।
দোয়েল বলল–প্রিয় রাজকুমার, ও কাজ আমি করতে পারব না। এই বলে সে কাঁদতে লাগল।
রাজকুমার বলল–দোয়েল, ছোট্ট দোয়েল-আমার নির্দেশ তুমি পালন করা
সুতরাং দোয়েল রাজকুমারের চোখ থেকে একটা মণি খসিয়ে নিয়ে ছাত্রটির চিলেকোঠায় পৌঁছে দিয়ে এল। ছাদের মুখে একটা গত ছিল। তাই ঘরে ঢোকাটা খুব সহজ ছিল তার কাছে। সেই গর্তের ভেতর দিযে সে তীরবেগে ভেতরে ঢুকে গেল। যুবকটি তার দুটো হাতের মধ্যে মাথাটা চিপে বসেছিল। সেইজন্যে পাখির ডানার শব্দ তার কানে গেল না। মুখ তুলে সে দেখল শুকনো ভাবলেট ফুলের পাশে একটা সুন্দর নীলকান্ত মণি বসানো রয়েছে। নীলকান্ত মণি দেখে ছেলেটি চিৎকার করে উঠল-আমার গুণপনা মানুষ উপলব্ধি করতে শুরু করেছে। এটা নিশ্চয় আমার গুণমুগ্ধ কোনো ভক্ত পাঠিয়ে দিয়েছে। এখন আমার নাটকটি আমি শেষ করে ফেলি।
ছেলেটি বেশ খুশি হয়েছে বোঝা গেল। পরের দিন দোয়েলটি বন্দরের দিকে উড়ে গেল। একটা বিরাট জাহাজের মাস্তুলের মাথায়। গিয়ে বসল; দেখল, নাবিকরা সব চিৎকার করতে-করতে জাহাজের খোল থেকে দড়ি বেধে বড়ো-বড়ো পেটি নামাচ্ছে দোয়েল চিৎকার করে বলল–আমি ইডিচল্টে যাচ্ছি। কিন্তু তার কথায় কান দিল না কেউ। তারপরে আকাশে যখন চাঁদ উঠল সে আবার সুখী রাজকুমারের কাছে গিয়ে বলল–আমি তোমার কাছ থেকে বিদায় নিতে এসেছি।
রাজকুমার বলল–দোয়েল, দোয়েল, আমার ছোট্ট দোয়েল; তুমি কি আর একটা রাত আমার কাছে থাকবে না?
দোয়েল বলল–এখন শীতকাল; শীগগিরই ঠান্ডা কনকনে বরফ জমবে এখানে। ইজিপ্টে সবুজ পাম গাছের ওপরে সর্য গরম হয়ে উঠেছে। মাটির ওপরে কুমিররা সব শযে অলসভাবে তাকিয়ে রয়েছে পরসপরের দিকে। বলবেক-এর মন্দিরে আমার বন্ধুরা বাসা তৈরি করছে। সাদা আর গোলাপী ঘুঘু পাখিরা তাদের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে গুঞ্জন করছে। প্রিয় রাজকুমার, তোমাকে ছেড়ে আমাকে যেতেই হবে; কিন্তু আমি তোমাকে ভুলব না; এবং আগামী বসন্তে যে মণিটি তুমি বিলিয়ে দিয়েছ তার বদলে দুটি সুন্দর মণি তোমাকে এনে দেব। লাল গোলাপের চেয়েও সেই রুবিটা হবে লাল; আর নীলকান্ত মণিটি হবে বিরাট সমুদ্রের চেয়েও অনেক বেশি নীলা।
সুখী রাজকুমার বলল–নীচে ওই পার্কের মধ্যে একটি মেযে দাঁড়িয়ে আছে। বাড়িতে সে কিছু টাকা না নিয়ে গেলে তার বাবা তাকে মারবে। সেইজন্যেই সে কাঁদছে। তার জুতো বা মোজা লেই। তার মাথা খোলা। তুমি আমার আর একটা চোখ খুবলে মণিটা নিয়ে ওকে দিয়ে এস। তাহলে তার বাবা আর তাকে মারবে না।
দোয়েল বলল তোমার সঙ্গে আর এক রাত্রি থাকতে আমি রাজি হয়েছি কিন্তু তোমার চোখ খুবলোতে রাজি নই। তুমি তাহলে একেবারে অন্ধ হয়ে যাবে।
রাজকুমার বলল–দোয়েল, দোয়েল, ছোট্ট দোয়েল; আমি যা বলছি তা-ই তুমি কর।
সুতরাং রাজকুমারের আর একটা চোখ সে খুবলে নিল; তারপর সেই চোখটা নিযে সে। তীরবেগে বেরিয়ে গেল। মেয়েটির সামনে নীচু হয়ে তার হাতের চেটোয় ফেলে দিল সেটি।
কী সুন্দর গ্লাসের টুকরো!–সেই বাচ্চা মেযেটা আনন্দে চিৎকার করেই বাড়ির দিকে ছুটে গেল।
তারপর দোয়েল পাখিটা রাজকুমারের কাছে উড়ে এসে বলল–তুমি এখন অন্ধ হয়ে গিয়ে। সেই জন্যে আমি তোমার কাছে সব সময় থাকব।
হতভাগ্য রাজকুমার বলল–না, ছোট্ট দোয়েল; এবার তোমাকে ইজিপ্টে যেতে হবে।
দোয়েল বলল–আমি তোমার কাছে সব সময় থাকব। এই বলে সে রাজকুমারের পায়ের কাছে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।
পরের সারাটা দিনই সে রাজকুমারের পিঠের ওপর বসে রইল; বিদেশ-বিভুই-এ সে যা দেখেছে সেই সব গল্প তাকে বলল। সে তাকে লাল সারস পাখিদের কথা বলল–এই সব পাখিরা নীল নদের তীরে লম্বা লম্বা সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে আর গোল্ড ফিশ ধরে। শোনাল পৃথিবীর মতো পুরাতন ফিনিক্সের কাহিনি। হাতে রুদ্রাক্ষের মালা নিয়ে উটের পিছু পিছু হাঁটছে এমন সব বণিকদের কথা বলল, বলল আবলুস কাঠের মতো কালো কুচকুচে চন্দ্ৰপাহাড়ের রাজার কথা, পামগাছের কোটরে যে সব সাপেরা ঘুমোয় তাদের কথা–এই সাপেদের মধুমাখানো পিঠে দিয়ে কুডিটি পুরোহিত ভোজন করায। লম্বা-লম্বা পাতার ভেলায় চড়ে যে সব পিগমিরা বড়ো লেকটার ওপরে ঘুরে বেড়ায় আর সব সময় প্রজাপতিদের সঙ্গে যুদ্ধ করে, শোনাল তাদের কথা
রাজকুমার বলল–প্রিয় ছোট্ট দোয়েল, তুমি আমাকে অনেক অদ্ভুত কাহিনি শোনালে; কিন্তু সবচেয়ে অদ্ভুত ঘটনা হচ্ছে মানুষের দুঃখ দুঃখের মতো রহস্য আর কিছু নেই। আমার এই শহরের ওপর দিয়ে একবার উড়ে এসে আমাকে বল কী তুমি দেখলে।
সুতরাং উড়ে গেল দোয়েল সেই বিরাট শহরের ওপর দিযে; দেখল ধনীরা তাদের সুন্দর-সুন্দর বাড়িতে আনন্দ করছে; আর তাদেরই ফটকের ধারে বসে রয়েছে ভিক্ষুকরা। সে অন্ধকার গলির মধ্যে উড়ে গিয়ে দেখল ক্ষুধাতুর শিশুগুলি বিবর্ণ মুখে হতাশ চোখে কালো রাস্তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। পুলের নীচে নিজেদের গরম করার জন্যে দুটি ছেলে জড়াজড়ি করে শুয়ে রয়েছে। তারা বলল–বড় খিদে পেযেছে। পাহারাদাররা ধমক দিল–এখান থেকে ওঠ ওঠা বৃষ্টির ভেতরে বেরিয়ে পড়ল তারা।
তারপর সে ফিরে এসে যা দেখেছে সব রাজকুমারকে বলল।
রাজকুমার বলল–আমার সারা গায়ে সোনার চাদর মোডা। একটা একটা পাত খুলে নিয়ে তুমি আমার দরিদ্রদের বিলিয়ে দাও। জীবন্ত মানুষরা সব সময় মনে করে সোনার ঝালর গায়ে দিয়ে আমি খুব সুখী।
একটা একটা সোনার পাত খুলতে লাগল দোয়েল। বিশ্রী চেহারা হল রাজকুমারের। একটা একটা সোনার পাত সে দরিদ্রদের দিয়ে এল। সঙ্গে সঙ্গে তাদের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। রাস্তার ওপরে খেলতে শুরু করল তারা; আনন্দে চিৎকার করে বলল–আমাদের খাওয়ার সংস্থান রয়েছে।
তারপরে বরফ নামল, নামল ঘন কুয়াশা। মলে হল সব রাস্তাটাই রুপোর তাল হয়ে গিয়েছে। গলা বুপোর মতোই তারা চকচকে করে লাগল। সবাই ফারকোট গায়ে দিয়ে বেরোতে লাগল রাস্তাঘা।
বেচারা দোয়েলও দিন-দিন ঠান্ডায় কুঁকড়ে যেতে লাগল। কিন্তু রাজকুমারকে সে এতই ভালোবেসে ফেলেছিল যে কিছুতেই সে তাকে ছেড়ে যেতে পারল না। বুটিওয়ালার অসাক্ষাতে তার দরডা থেকে দু’এক টুকরো রুটি সে ঠোঁটে করে তুলে নিয়ে আসত; আর ডানা নেড়ে-নেডে গরম রাখার চেষ্টা করত নিডোকো।
কিন্তু শেষকালে সে বুঝতে পেরেছিল–তার মৃত্যুর দিন ঘনিয়ে আসছে। কোনরকমে আর একবার সে রাজকুমারের পিঠের ওপরে উঠে এল; বলল–প্রিয় রাজকুমার, বিদায়। তোমার হাতে একটু চুমু খেতে দেবে?
রাজকুমার বলল–আমার ছোট্ট দোয়েল তুমি যে শেষ পর্যন্ত ইভিংস্টের দিকে রওনা হতে পেরেছ তাতে আমি খুশি হয়েছি। অনেকটা বেশি সময় তোমাকে এখানে থাকতে হয়েছে।
তুমি আমার এই ঠোঁটে চুমু খাও–কারণ আমি তোমাকে ভালোবাসি। দোয়েল বলল–আমি ইজিপ্টে যাচ্ছি নেযাচ্ছি মরণের ঘরে। মৃত্যুই তো ঘুমের ভাই। তাই না?
এবং সুখী রাজকুমারের ঠোঁটে একটা চুমু খেয়ে সে মারা গেল, তারপর পড়ে গেল মূর্তিটির পায়ের কাছে।
ঠিক সেই মুহূর্তে মূর্তিটার ভেতরে একটা অদ্ভুত ভাঙনের শব্দ হল–মনে হল কিছু যেন একটা ভেঙেছে। আসল কথাটা হচ্ছে মূর্তির সীসের মাথাটা দুটো ভাগে ভাগ হয়ে গেল। কুয়াশাটা সত্যিই ভীষণ জমাট বেঁধে গিয়েছে।
পরের দিন প্রত্যুষে টাউন কাউন্সিলরদের নিয়ে মেয়র পার্কে বেড়াচ্ছিলেন। সেই উঁচু বেদীটার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তিনি একবার মূর্তিটার দিকে তাকিয়ে দেখলেন–হ্যায় কপাল! সুখী রাজকুমারের চেহারা এ কী হয়েছে!
কাউনসিলাররাও সব সময়েই মেয়রের সঙ্গে একমত। তারাও একবাক্যে চিৎকার করে উঠল-আরে, ছি-ছি!
মেয়র বললেন–তরোয়াল থেকে রুবিটা পড়ে গিয়েছে, চোখ দুটো নেই। সোনার পাতও দেখছি নে। মনে হচ্ছে রাজকুমার একেবারে ভিক্ষুক হয়ে গিয়েছেন।
হ্যাঁ, ঠিক একেবারে ভিক্ষুক-সায় দিল পারিষদবর্গ।
মেযর বলে গেলেন–আর এঁর পায়ের তলায় সত্যি সত্যিই একটা মরা পাখি। আমাদের এখনই একটা বিজ্ঞপ্তি প্রচার করা উচিত যে এখানে আর কোনো পাখিকেই মরতে দেওয়া হবে না।
কর্পোরেশনের কেরানি কথাগুলি টুকে নিল। তারপরে তারা মূর্তিটাকে ভেঙে ফেলল। বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্টের প্রফেসর বললেন–রাজকুমার তার মূল্য হারিয়েছে, কারণ তার আর কোনো সৌন্দর্য নেই।
তখন তারা তাকে আগুনে গলিয়ে ফেলল। ধাতুটাকে নিয়ে কী করা হবে সেই সিদ্ধান্তে উপনীত হওযার জন্যে মেযর একটা সভা ডাকলেন। তিনি বললেন–আমাকে অবশ্য আর একটা মূর্তি গড়তে হবে-আর সেটা হবে আমার।
সভাসদেরা বলল–আমার, আমার।
এই নিয়ে নিজেদের মধ্যে তারা ঝগড়া করতে শুরু করল। শেষ খবর আমি যতটুকু পেয়েছি তা থেকে জানা যায় তারা এখন-ও ওই নিযে ঝগড়া করছে।
ধাতু গলানোর কারখানায় একজন কারিগর বলল–কী আশ্চর্য! এই ভাঙা সীসের হৃদপিণ্ডটা কিছুতেই আগুনের চুল্লিতে গলছে না।
সেই জন্যে তারা সেটাকে একটা ম্যলা ফেলার জাযগায় ফেলে দিল। সেই মরা পাখিটার দেহও পড়েছিল সেইখানে।
ঈশ্বর তাঁর দেবদূতদের বললেন–শহরের সবচেয়ে দুটি মূল্যবান জিনিস আমাকে এনে দাও। তাঁর দেবদূতেরা তাঁকে এনে দিল সেই সীসের হৃৎপিণ্ড আর মরা পাখিটার দেহ।
ঈশ্বর বললেন–তোমরা ঠিক জিনিসই এনেছ; কারণ, আমার প্যারাজাইসের বাগানে এই ছোট্ট পাখিটা অনন্তকাল ধরে গান করবে; আর আমার সোনার শহরে এই সুখী রাজকুমার আমার বন্দনা গাইবে চিরদিন।