সুবৰ্ণ সমাধি – ৩৫

পঁয়ত্রিশ

একটা ব্রেসলেট। কেউ আর পরতে পারবে না ওটা। দুমড়ে, বেঁকে গেছে।

এখানে-সেখানে ট্যাপ খাওয়া বস্তুটা কোনও কালে সম্ভবত বাটি হিসেবে ব্যবহার হত। নচেৎ পানপাত্ৰ।

চামড়ার বটুয়া থেকে মিসেস মিলফোর্ড যখন জিনিস দুটো বের করল, দুই সহোদরের মত এলেনার চোখও হয়ে উঠেছিল উদ্ভাসিত।

আরও আছে। একটা জার।

আকার-আকৃতি যেমনই হোক না কেন, সোনা সোনাই। ফালতু জিনিস নয়।

স্বপ্ন দেখবার রসদ রয়েছে। সুতরাং, নতুন আঙ্গিকে শুরু করতে বাধা নেই।

চাষাবাদে ফিরে যাবার ইচ্ছে মিসেস মিলফোর্ডের।

রোজগারের বিকল্প উপায় বাতলেছে জ্যাসন- ক্যানিয়নে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা গরুগুলো রাউণ্ড আপ করলে কেমন হয়? ভাল পয়সা আসবে মাংস আর চামড়া থেকে। মোম উৎপাদনের জন্যে চর্বির চাহিদাও বেশ।

…বুনো ঘোড়াও জড় করা যেতে পারে।

পাশাপাশি মুরগি পালা যায় না? এলেনার প্রস্তাব।

জোহানের ভবিষ্যৎ-পরিকল্পনা সুদূরপ্রসারী। হিসেবি। সে চায় চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত।

এক মরমনের সাথে জানা-শোনা রয়েছে তার। জোহানের দেখা সেরা কিছু ষাঁড়ের মালিক লোকটা।

গায়েগতরে তাগড়াই ষাঁড়গুলো। চকচকে, যেন মাছি বসলে পিছলে যাবে।

একটা ষাঁড় কিনবে সে। দামে যদি বনে, তা হলে দুটো। সমৃদ্ধ ফার্মহাউসের স্বপ্ন দেখছে জোহান।

একটা-দুটো ষাঁড় দিয়ে কি খামার হয়?

ও-ই দিয়েই শুরু করবে সে। তাদের গরুর সাথে ষাঁড়ের প্রজনন ঘটিয়ে বড় করবে ফার্ম। উন্নতি হবেই।

জোহানের আত্মবিশ্বাসের তারিফ করেছে সবাই।

আজ পঞ্চম দিন চলছে ওদের রানশে ফিরবার, ট্যাটাম বা মারিয়াচি— কারও পাত্তা নেই।

রোদ-ঝলমলে দিন। ঢিমে তালে এগিয়ে যাচ্ছে দুপুরের দিকে।

টাউনে গেছে জোহান। দামি জিনিসগুলো ব্যাঙ্কে গচ্ছিত রাখতে।

জ্যাসন স্কুলে।

বাড়িতে কেবল এলেনা আর মিসেস মিলফোর্ড।

বসে বসে খাওয়া যায় না। চক্ষুলজ্জা বলে একটা ব্যাপার আছে। তাই ঘরের কাজে রোজমেরিকে যথাসম্ভব সাহায্য করে মেয়েটা। নিজে করতে চায় কোনও-কোনও কাজ। অন্তত চেষ্টা করে।

এটা ঠিক, পশ্চিমের জীবনযাত্রা বা চালচলনে অভ্যস্ত নয় সে। হাড়ভাঙা খাটুনিতেও অনভ্যস্ত। তবে সব কিছুই শিখে নেবে ও।

সব কিছু।

চুলায় চড়ানো মটরশুঁটি সেদ্ধ হচ্ছে।

স্টোভে কফি তৈরি করল এলেনা। নিজে এক মগ নিয়ে একটা মগ মিসেস মিলফোর্ডকে দিয়ে এল। মহিলা নিজের ঘরে সূচিকর্মে মগ্ন।

লাঞ্চের আয়োজন নিয়ে ভাবছে এলেনা। রান্নাবান্নার কাজটা আজকাল তার ওপরে ছেড়ে দিয়েছে রোজমেরি। স্পেনীয় রসনার ভক্ত হয়ে উঠেছে মিলফোর্ড পরিবারের সবাই।

খানিকটা উন্মনা হলো সে।

শুঁটির মন মাতানো সৌরভে ভুরভুর করছে সারা বাড়ি।

বাইরে, পোর্চের বোর্ডওঅকে জুতোর আওয়াজ উঠল।

উৎকর্ণ হয়ে শুনল এলেনা। সেনিয়োর মিলফোর্ড বোধ হয় ফিরেছে।

সিরামিকের মগ হাতে কিচেন থেকে বেরিয়ে এল সে। সদর দুয়ার দিয়ে চাইতেই ভূত দেখবার মত চমকে উঠল। সমস্ত রক্ত সরে গেল মুখ থেকে।

দোরগোড়ায় যে দাঁড়িয়ে আছে, সে কি মানুষ, নাকি অশরীরী প্রেতাত্মা?

মেঝেয় পড়ে এক শ’ টুকরো হলো মগটা।

পায়ের নীচ থেকে মাটি সরে গেলে কেমন লাগে, বুঝতে পারল এলেনা। কাঁপতে কাঁপতে বসে পড়ল সে। হাঁটুতে জোর নেই।

ময়লা জ্যাকেটটা শতচ্ছিন্ন। ত্যানার মত ঝুলছে গা থেকে। জুতো জোড়া পাথরে কেটে ফালা-ফালা। সামনের ছেঁড়া অংশ দিয়ে বেরিয়ে পড়া আঙুল থেকে রক্ত ঝরছে।

চিবুকের হাড় ঠেলে বেরিয়ে এসেছে মারিয়াচির। উদ্যত হাতে ম্যাশেটি। রুধিররাঙা মুখে নীরবে হাসল ভয়ঙ্কর হাসি।

পরিত্রাহি চিৎকার দিল এলেনা।

কিছু ভাঙবার শব্দ শুনে ঝট করে মুখ তুলেছিল রোজমেরি। চিৎকারটা আত্মারাম কাঁপিয়ে দিল তার। নিডল ফেলে পড়িমরি করে দৌড়ে গেল বাইরের ঘরের দিকে।

চৌকাঠে দাঁড়ানো আগন্তুক তার দিকে তাকাল। তারপর পড়ে গেল হাঁটু ভেঙে। মাথার পাশটা তার আছড়ে পড়ল সিডার কাঠের মেঝেতে।

ছত্রিশ

সাত ঘণ্টা লাগল মারিয়াচির জ্ঞান ফিরতে।

চোখ খুলে প্রতিদ্বন্দ্বীকে দেখতে পেল সে। ‘ঘুম তা হলে ভাঙল!’ সরস কণ্ঠ জোহানের।

ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল মারিয়াচি।

‘আমি খুশি যে, তুমি বেঁচে আছ,’ অন্তর থেকে বলল জোহান।

কী বলবে, ভেবে পেল না মারিয়াচি। চোখ মুদল। না, অচেতন হয়ে যায়নি আবার। দীর্ঘ নিদ্রার শ্রান্তিতে।

.

আট দিনের আগে বিছানা ছেড়ে উঠতে পারল না সে।

এলেনা রাতদিন অক্লান্ত সেবাযত্ন করল তার। আন্তরিকতায় খাদ রাখল না।

মুমূর্ষু একটা লোককে মেরামত করা চাট্টিখানি কথা নয়। মারিয়াচি ভাবল, সার্থক হলো তার জীবন।

ওকে সুস্থ করে তুলতে দুরন্ত ঈগলের কবিরাজির অবদানও কম নয়।

যেচেই সব বলল স্প্যানিয়ার্ড। হতভাগা শর্টির কথা। ট্যাটাম আর মুয়েলার কীভাবে খুনোখুনি করে মরল। আলাদা হয়ে গেল টাকার…

সে কি ফিরেছে? জিজ্ঞাস্য মারিয়াচির।

ব্যাঙ্কের কাজ সেরে খোঁজখবর নিয়েছে জোহান। উত্তরটা হচ্ছে- না।

মারিয়াচি জানায়, দুই-দু’বার পথ হারিয়েছে তারা। চরকির মত ঘুয়েছে। একটা পর্যায়ে বদ্ধ উন্মাদ হয়ে যায় আলবার্তো। নিজের মাথায় গুলি করে বসে…

এক সকালে ঘুম ভেঙে দেখল, মরে পড়ে আছে ম্যানুয়েল। ক্ষুধা আর ডিহাইড্রেশনে মৃত্যু হয়েছে তার।

‘আমার জেদ, আক্ষেপ করে বলল সে। অনুশোচনায় দগ্ধ হচ্ছে। ‘আমার অবুঝ জেদই এজন্য দায়ী। এখানে আসবার ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করেছিল ওরা আমাকে। আমি কানে তুলিনি।’

সাঁইতিরিশ

প্রবল আলস্য ভরে পুবাকাশের বিছানায় গড়াগড়ি দিয়ে আড়ে ভাঙল দিনমণি।

রোববার।

সকালটা প্রাণবন্ত।

আকাশে ভবঘুরে মেঘ। বাতাস বইছে মন্দ-মধুর।

দুই হপ্তার ওপরে এদের সাহচর্যে কাটিয়েছে মারিয়াচি। দেশের জন্যে মন টানছে এবার। গতকাল সন্ধ্যায় ক্ষমা চেয়ে নিয়েছে সে এই পরিবারের সবার কাছে, আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছে।

‘আমি ভেবেছিলাম, গায়ের জোরে বুঝি মানুষের ভালবাসা আদায় করা যায়। ভেবেছিলাম, আমার শত্রুতা-মূলক আচরণের জবাবে তোমাদের শত্রুতাই আমার প্রাপ্য। অথচ পেলাম অকৃত্রিম আদর-যত্ন-সেবা। আমি চির কৃতজ্ঞ হয়ে রইলাম তোমাদের সবার কাছে।’ ফিরল মনটেরোর দিকে, ‘তোমার ওপর থেকে আমার সব দাবি আমি তুলে নিলাম। আজ থেকে তুমি আমার ছোট বোন। ওই লোকটা,’ জোহানের দিকে চোখের ইশারা করল, ‘কখনও যদি তোমাকে অবহেলা করে বা দুঃখ দেয়; এই বড় ভাইটাকে শুধু একটা খবর দিয়ো।’

প্রাতরাশের পর বেরিয়ে পড়ল হিস্পানিক তরুণ।

মেয়েদের হাতে চুমু খেল। দুই ভাইয়ের হাত ধরে মৃদু ঝাঁকুনি দিল।

‘অ্যাডিয়োস।’

বিদায়-সম্ভাষণ জানাল চারজনে।

একবারও পেছনে তাকাল না মারিয়াচি। ঘোড়া ছোটাতে ছোটাতে ডান হাত তুলল। কল্পিত রংধনু আঁকল বাতাসে।

জ্যাসন আর মিসেস মিলফোর্ড বাড়ির ভেতরে চলে যাবার পরেও প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে থাকল ওরা—জোহান আর এলেনা।

আড়চোখে মেয়েটাকে দেখছে জোহান। বলি-বলি করেও অ্যাদ্দিন কথাটা বলতে পারেনি। মারিয়াচির ঝামেলা নেই এখন। কাজেই, এলেনা মুক্ত বিহঙ্গ। আর কি বিলম্ব করা ঠিক হবে? নিদেনপক্ষে নিজের হৃদয়টা তো অর্পণ করা যায়।

গলা খাঁকারি দিল সে। ‘মিস মনটেরো…’

ওকে কথা শেষ করতে দিল না মেয়েটা। লাজশরমের মাথা খেয়ে বলল, ‘আমি কিন্তু আর বেশি দিন মিস মনটেরো থাকছি না!’

সরাসরি না বললেও অনায়াসে বুঝল জোহান। উত্তাল ঢেউ জাগল বুকে। পরোক্ষ ভাবে সে-ও বলল, ‘হাউ অ্যাবাউট মিসেস মিলফোর্ড, জুনিয়র?’

স্প্যানিশ গোলাপের চোখে জাদু। মুখে হাসি। মোহনীয় ভঙ্গিমায় হাত চালিয়ে চোখের ওপরে এসে পড়া অবাধ্য চুলগুলো সরিয়ে দিল।

***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *