সুবৰ্ণ সমাধি – ২০

বিশ

দিনের প্রথম ভাগে বের হয়েছে বলে খাতির করেনি ওদের সূর্য। রোদ যথেষ্ট চড়া।

সামান্য রদবদল হয়েছে প্ল্যানে। রোজমেরি ও এলেনা জোহানদের সঙ্গ নিয়েছে। মারিয়াচি তো রয়েছেই, শিরঃপীড়ার আরেকটা কারণ চিন মুয়েলার। হাফ-ব্রিড এই লোকটা গানফাইটার হিসেবে যতটা না পরিচিতি পেয়েছে, তার চেয়ে বেশি কুখ্যাতি পেয়েছে নীচ, খুনে স্বভাবের জন্যে। পেছন থেকে খুন করতেও আপত্তি নেই লোকটার।

মানুষ হত্যার পেশাদার কারিগরের সাথে দোস্তি পাতিয়েছে ট্যাটাম— এটা জানবার পর মহিলাদের কী করে ছোট ভাইয়ের জিম্মায় রেখে যায় জোহান? শক্ত-সমর্থ পুরুষ হলে একটা কথা ছিল।

আপাতত বাড়িতেই রয়ে গেছে জ্যাসন। অবস্থা বেগতিক বুঝলে সটকে পড়বে।

ছোট্ট দলটার নেতৃত্ব দিচ্ছে স্যাম ফুলার। আগে-আগে চলেছে সে।

রোজমেরির কালো গেলডিং প্রৌঢ় স্যামের খয়েরি মাসট্যাংটার গায়ে গায়ে এগিয়ে চলেছে। পেছন পেছন তাকে অনুসরণ করছে এলেনা।

সবার ওপরে নজর রাখতে সুবিধা হবে বলে শেষে রয়েছে জোহান। এক হাতে সে ঘোড়ার রাশ ধরে আছে। আরেক হাতে এক জোড়া খচ্চরের দড়ি। পিছু পিছু আসছে মালবাহী জীব দুটো। একটার পিঠে কাপড়চোপড়ের পুঁটলি, বেডরোল ইত্যাদি। অন্যটাতে চাপানো হয়েছে খাবারের ক্যান, বেলচা, গাঁইতি আর খনি খুঁড়বার অন্যান্য সরঞ্জাম।

পাল্টাবার মত কোনও ঘোড়া নেই তাদের সাথে।

দুর্গম ট্রেইল। এবড়োখেবড়ো পাহাড়ি রাস্তা ওপরে উঠে গেছে চড়াই বেয়ে। আবার উপত্যকার দিকে নেমে চলে গেছে উতরাই। কোথাও-কোথাও পথ খুবই সঙ্কীর্ণ। রোদ-বৃষ্টি-বাতাসে আলগা হয়ে গেছে মাটি, পাথর। সেসব জায়গায় পা হড়কে যাচ্ছে জন্তুগুলোর। খুরের আঘাতে কিনারা পেরিয়ে পাশের খাদের মধ্যে পড়ছে পাথর।

অনেকদিন ব্যবহার হয় না এই পথ। রোদে পোড়া ঘাস আর গ্রিজউডের ভেতর দিয়ে চলতে হচ্ছে প্রাণীগুলোকে। গতি শ্লথ।

বাতাস নেই এক বিন্দু। পরিবেশটা ভাপসা। গা আঠা আঠা হয়ে গেছে সবার। ঘামের সাথে আটকে যাচ্ছে ধুলো।

কারও মুখে কথা নেই।

জানোয়ারের পা ঠুকবার আওয়াজ আর এক-আধটা মৌমাছির গুঞ্জন ছাড়া কোনও শব্দ নেই।

এখনও পর্যন্ত কোনও বিপদ বা ঝামেলার সম্মুখীন হয়নি তারা। তবে একবার…

বহুদিন আগে দলছুট গবাদি পশুর একটা ঝাঁক পেরোচ্ছিল ওরা। ঈষৎ ভয় নিয়ে। ছন্নছাড়া গরু-মোষের দল কখনও-কখনও জংলি জানোয়ারের চাইতেও বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। নিচু জমিতে বিচরণ করে সারাদিন। আয়েশ করে ঘাস খায়। তেমন একটা পাত্তা দেয় না কাউকে।

কোনও-কোনওটার প্রায় গা ঘেঁষে যাচ্ছিল ওরা। ওদেরকে নিয়ে আলাদা ভাবে মনোযোগী হবার মত উৎসাহ দেখা যায়নি

চারপেয়েগুলোর মধ্যে। বড় জোর মাথা তুলে এক নজর দেখেছে। জোহানরা থামেনি, এটা একটা কারণ হতে পারে। চলে যাচ্ছে বলে উপদ্রব মনে করেনি হয়তো।

শুধু দানবাকৃতির একটা লাল ষাঁড় চোখ টেরে তাকাচ্ছিল মানুষ ও তাদের বাহনের দিকে। নাকের পাটা ফুলে-ফুলে উঠছিল পশুটার। হয়তো আক্রমণের পাঁয়তারা কষছিল।

পালটা যখন পেরিয়ে এসেছে ওরা, ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল লাল দানব। পা দিয়ে মাটি আঁচড়াল। দৌড়ানি দেবার ভঙ্গিতে শিং বাগিয়ে ছুটে গেল দলটার দিকে। কী মনে করে জানি থেমে গেল মাঝপথে। গরগর করল। একবার আছড়াল লেজটা। তারপর বিপরীত দিকে ঘুরে চলে গেল ধুলো উড়িয়ে। ভাবভঙ্গিতে বুঝিয়ে দিল যেন: ‘যাহ! এবারের মতন মাফ করে দিলাম। আর কখনও এলে…’

একটা শৈলশিরার ওপরে এসে দাঁড়িয়ে গেল স্যাম ফুলার। বাকিরাও। দুই দণ্ড জিরিয়ে নেবার অবসর পেল ভারবাহী জানোয়ারগুলো।

সূর্য এখন মধ্যগগনে।

অনেক উঁচুতে একটা শিকারি বাজ শাঁখ মাজা ডানা মেলে অপরাজিতা-নীল আকাশের তল্লাশ নিচ্ছে।

পেছন ফিরে চাইল একবার ফুলার।

দশ মাইলের বেশি পথ অতিক্রান্ত হয়েছে ইতিমধ্যে। সকলেই শ্রান্ত। হাতে হাতে ঘুরছে ক্যানটিন।

নিজের স্টিল-ডাস্ট স্ট্যালিয়নটাকে স্যাম ফুলারের ঘোড়ার পাশে হাঁটিয়ে আনল জোহান। ‘আর কতদূর?

‘সুরুজ ডুববার আগে নয়।’

বাম হাতটা ভুরুর ওপরে নিয়ে এল জোহান। ছায়া দিল চোখ দুটোকে। আরেক হাতের আঙুল দিয়ে ডান দিকের আবছা পাহাড়প্রাচীরের দিকে নির্দেশ করল। ‘ওটা স্যাডল রকের চূড়া না?’

কমপক্ষে বারো মাইল দূরে ওই পাহাড়শ্রেণী। গ্র্যানিটের নাঙ্গা শিখর রোদে পুড়ে বাদামি হয়ে উঠেছে। মাঝে একটা বাদে দুই পাশের চূড়াগুলো সমান প্রায়, বেশ উঁচু। স্যাডল রক হচ্ছে মাঝখানের নিচু পাহাড়টার নাম।

‘ইয়াহ।’ গলায় পেঁচানো ব্যাণ্ডানা দিয়ে ঘর্মাক্ত মুখ মুছল ফুলার।

ঘুমন্ত স্মৃতি জেগে উঠল জোহানের মনে। সেই কিশোর বয়স! প্রথম শিকার করবার আনন্দ।

অ্যান্টিলোপ মেরেছিল সে ওখানটায়। বাবা ছিল সাথে। কতই বা বয়স হবে তখন! বারো কি তেরো। পৃথিবীটা কত ছোট তখন তার কাছে! মনটা কচি পাতার মত।

স্মৃতিময় হয়ে উঠল জোহানের চোখ দুটো। অদ্ভুত একটা দীপ্তি খেলতে লাগল চোখে। বড় ভাল লাগে তার। সাথে সাথে কষ্টও হয়। আহা, পুরানো সেই দিন! ছোটবেলার জোহানটাকে আদর করে দিতে ইচ্ছে করে তার।

স্যাম ফুলার ঘোড়া থেকে নামল। এখানেই ওরা দুপুরের খাওয়া সারবে।

ছায়াময় একটা স্থানে জানোয়ারগুলোকে একত্র করা হলো। ওরাও বসল গিয়ে পাথরের চাঁইয়ের ছায়ায়।

বিশ্রাম। খাওয়া। বিশ্রাম। তারপর আবার একটানা এগিয়ে চলা। কখনও টিলার কাঁধ বেয়ে। কখনও ঢেউ খেলানো পাথুরে সমতল দিয়ে। মাঝে জানোয়ারগুলোকে অবসর দিতে খানিকটা সময়ের বিরাম। নিজেরাও হাত-পাগুলো খেলিয়ে নিল।

অনেকক্ষণ চলবার পরে ট্রেইলে জুতোর ছাপ দেখতে পেল ওরা। উদ্দীপনার সঞ্চার ঘটল প্রত্যেকের মধ্যে। কারণ, এ যাবত একটাও লোকবসতি চোখে পড়েনি তাদের। আশপাশে নিশ্চয় রয়েছে।

জোহান ও স্যাম ফুলার ঘোড়া থেকে নেমে পড়ল। ছাপগুলো পরীক্ষা করবে। করল।

অনেক ছাপ। তবে জুতো এক জোড়াই। মোকাসিন নয়। স্যাণ্ডেল।

পায়ের ছাপগুলো নতুন নয়। আবার বেশি পুরানোও নয়। আধ খাপচা হয়ে সরে গেছে ধুলো।

ওরা যেদিকে যাচ্ছিল, সেদিকেই গেছে ছাপ। এর মানে, এই পথে আনাগোনা রয়েছে কারও।

প্রশ্ন হচ্ছে, কার?

আলভারোর?

দু’জনে আবার ঘোড়ায় উঠল। চলা শুরু করল দলটা।

বেলেপাথরের সাম্রাজ্য সর্বত্র। স্বাভাবিক ভাবেই হারিয়ে যাচ্ছে ছাপ। আবার ফিরেও আসছে।

একেকজনের মগজে একেক প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে।

লোকটা এখানে বেঁচে আছে কীভাবে? কী খেয়ে?

পানি পায় কোথায়?

সমভূমি ছেড়ে এখানে বাস করে কেন?

শেষ বিকেলে হিমেল বাতাসের সাথী হয়ে ওরা একটা প্ল্যাটফর্মের মত জায়গায় এসে পৌছাল। সাথে সাথে অন্তরাল থেকে ঝুপ করে বেরিয়ে এল দৃশ্যটা।

তুলনামূলক ভাবে গাছের ঘনত্ব এখানে বেশি। ঘন সবুজ। লাগানো হয়েছে, বোঝা যায়। চতুর্দিকের মরুময় বিস্তারের মাঝে কেমন বেমানান। কিন্তু আশীর্বাদের মত।

অর্ধচন্দ্রাকারে দাঁড়িয়ে রয়েছে গাছগুলো। সবই অল্ডার। বৃত্তের ব্যাস তৈরি করেছে বেলেপাথরের দেয়াল। একটা কাঠের কেবিন দেয়ালের গায়ে ঠেকা দিয়ে বানানো। তেমন মজবুত নয়।

কেবিনটার দিকে অগ্রসর হলো ওরা।

লগ-হাউসের চালা ধরে রেখেছে যেসব খাম্বা, সেগুলোর মধ্যে একটা দাওয়ার ক্যানোপি ফুঁড়ে বেরিয়ে গেছে। ওই খুঁটির আগায় গরুর খুলি বসিয়ে রাখা হয়েছে। তার নীচে একটা দড়ির মালা ঝোলানো। লাল, নীল, সাদা, কালো, হলুদ, সবুজ, কমলা, বেগুনি— একেক রঙের কাপড়ের টুকরো দড়ির একটু পরে-পরে গিঁট দিয়ে বাঁধা। কাপড়ের পুতুলের মাথা বানাবার সময় কাপড়ের মাঝখানটাতে তুলো রেখে যেমন গিঁট মেরে দেয়া হয়, এই গিঁটগুলোও সেরকম। পার্থক্য শুধু, এখানে তুলোর পরিবর্তে পোৱা হয়েছে তামাক।

এভাবে কাপড় লাগানোকে ল্যাকোটা ইনডিয়ান রীতিতে ‘প্রেয়ার টাইজ’ বলা হয়, জোহান জানে। এটা তাদের আধ্যাত্মিক সিম্বল। প্রতিটা রঙের বিভিন্ন অর্থ রয়েছে। হলুদ হলো পূর্ব দিক। কালো পশ্চিম। উত্তর হচ্ছে লাল। সাদা বোধ হয় দক্ষিণ। নীল মানে আকাশ। মাটি বোঝাবার জন্যে সবুজ। আরগুলো কীসের প্রতীক, মনে পড়ছে না।

একবার এক একসোরসিস্টকে ভূতের আছর হওয়া বাড়িতে প্রার্থনাগ্রন্থি বাঁধতে দেখেছে সে। একটা করে কাপড় বাঁধছিল ওঝা, আর একবার করে মন্ত্র পড়ছিল মেঘের ওপারে বসবাসকারী মহান আত্মা ওয়াকান তানকার উদ্দেশে।

কেবিনের একধারে এক আঁটি লাকড়ি বেঁধে ফেলে রাখা হয়েছে। আরেক ধারে ছায়ায় পাতা বেঞ্চি। ছায়ায় বলেই বেঞ্চে বসা লোকটাকে নজরে পড়েনি কারও।

এবারে সে উঠে দাঁড়াল।

চোখ পিটপিট করল জোহান।

ধূসর চুলঅলা বুড়োর চেহারাই বলে দিচ্ছে, সে ইনডিয়ান নয়। মেকসিকান। চওড়া কাঁধ। চওড়া চোয়ালের হাড় আর তামাটে চামড়া। নারকেলের ছোবড়ার মত। অজস্র বলিরেখা। ভোগবিলাস ত্যাগ করা সন্তের মত প্রাজ্ঞ চোখে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে।

একুশ

খড়ের তৈরি হ্যাট তার মাথায়। গায়ে বহুবর্ণ সেরাপি। বহু ব্যবহারে জীর্ণ। ওয়ামপাম গুটির মালা গলায়। হাতে বোনা চপ্পল পরেছে পায়ে।

এতটুকু অবাক হয়নি সে আগন্তুকদের দেখে। মুখ দেখে মনে হচ্ছে, ওদের প্রতীক্ষাতেই বসে ছিল লোকটা। যেন জানত, ওরা আসবে।

‘হাউডি, বন্ধুগণ!’ অভ্যর্থনার হাসি উপহার দিল সে। তার গলার স্বর নিচু, কিন্তু কম্পিত। অনেক গভীর থেকে উঠে আসে যেন কথা। মঞ্চে দাঁড়িয়ে যাজক যেমন করে শ্লোক পড়ে, বলবার ভঙ্গি অনেকটা সেরকম।

এ ধরনের মানুষকে চেনে জোহান। চেহারা দেখলে সমীহ জাগে মনে। বুড়ো মানুষটার সমগ্র অস্তিত্ব যেন বনস্পতির ছায়া।

ঘোড়া থেকে নামল সবাই।

‘কী খবর, স্যাম?’ দুই হাত দুই পাশে ছড়িয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করল বুড়ো।

দুই পুরানো আমলের মানুষ কোলাকুলি করল।

‘এতদিন পরে মনে পড়ল এই বুড়োকে!’

‘মনে তো সব সময় পড়ে। কিন্তু যে জায়গায় থাকো…’

বিমল হাসি দিয়ে মেনে নিল মেকসিকান কথাটা।

জোহান এগিয়ে গেল।

বুড়ো মেকসিকান তার দিকে তাকাল। তাকিয়েই বদলে গেল তার চাউনি। জোহানের মুখে কী জানি অন্বেষণ করছে বয়সী চোখ জোড়া।

‘তুমি আলভারো, সেনিয়োর?’ সম্ভ্রমের সাথে জিজ্ঞেস করল জোহান।

‘নিশ্চয়ই।’ দরাজ হাসি হাসল মেকসিকান বুড়ো। ‘গত আটষট্টি বছর ধরেই আলভারো গনজালেস হয়ে বেঁচে আছি আমি। এর জন্য দুঃখ নেই। তরুণ বয়সে অবশ্য অন্য কিছু হতে ইচ্ছা করত… বিখ্যাত কোনও চরিত্র…’ খানিকটা স্তিমিত হলো তার হাসি। ‘কিন্তু… তোমাকে এর আগে কোথায় দেখেছি, বলো তো!’

‘ওর বাপকে দেখেছ।’ আলভারোর খুঁতখুঁতানি দূর করে দিল স্যাম ফুলার।

দপ করে জ্বলে উঠল বুড়োর চোখ জোড়া। ‘আরি, তা-ই তো!’ মিলটা ধরতে পেরে যার-পর-নাই উৎফুল্ল হয়ে উঠেছে। ‘এক্কেবারে সেই আদল!’ ওদেরকে ছাড়িয়ে চলে গেল তার দৃষ্টি। ‘জেরি এল না?’

জোহানের দিকে তাকাল স্যাম ফুলার। জোহান তাকাল তার দিকে।

বোঝা যাচ্ছে, বন্ধুর মৃত্যুসংবাদ জানে না আলভারো।

হাত নেড়ে মানা করে দিল ফুলার। সে বলতে পারবে না।

জবাব দেবার আগে একটা মুহূর্ত খতিয়ে দেখল জোহান। সত্যি কথাটা সহজ ভাবে জানিয়ে দেয়াই ভাল, যত মর্মান্তিক ই হোক। যতটা নরম করে বলা সম্ভব, বলল, ‘বাবা মারা গেছে।’

চমকাল না আলভারো। মুখের প্রফুল্ল হাসিটা নিভে গেছে। জোহানের দিকে তাকিয়ে রইল অদ্ভুত দৃষ্টিতে। সেখানে দুঃখের বদলে অবিশ্বাস। জেরার্ড মিলফোর্ড আর সবার মত মরণশীল মানুষ, তা যেন এই প্রথম জানল সে।

আলভারোর জন্যে মায়া হলো স্যাম ফুলারের। মেকসিকানের চোখে পানি নেই। কিন্তু বুকের মধ্যে যে ছিঁড়ে যাচ্ছে, দাঁড়াবার ভঙ্গি দেখেই বোঝা যায়।

‘স্বাভাবিক মৃত্যু?’ ধরা গলায় জিজ্ঞেস করল আলভারো।

‘না, সেনিয়োর।’ আস্তে করে মাথা নাড়ল জোহান। ‘ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে গিয়েছিল। মেরুদণ্ড ভেঙে…’

আলভারোর কালো চোখে বিষাদ ঘনাল। চোখ বুজল সে। স্ট্র হ্যাটটা খুলে ফেলল মাথা থেকে। আকাশের দিকে গর্দান তুলে চাইল। বিড়বিড় করছে। প্রার্থনা করছে প্রিয় বন্ধুর বিদেহী আত্মার জন্যে।

একটা দীর্ঘশ্বাস উড়িয়ে দিল সে শেষ বেলার বাতাসে। মুখ নামিয়ে চাইল মিসেস মিলফোর্ডের দিকে।

‘আমার মা,’ পরিচয় দিল জোহান।

রোজমেরির চোখের কোণে পানি টলমল করছে। বিষাদময় হাসি হাসল। স্বামী মারা গেছে, এটা সে ভাবতে চায় না। বরঞ্চ ভাবতে পছন্দ করে, দূরে কোথাও গেছে মানুষটা। অনেক দূরে। হয়তো একদিন ফিরে আসবে। যদ্দিন না আসছে, অপেক্ষায় থাকবে সে। আমৃত্যু।

মিসেস মিলফোর্ডের দিকে এগোল আলভারো। কাছে এসে মহিলার ডান হাতটা নিজ হাতে তুলে নিল। চুম্বন করল হাতের পিঠে। সাথে সাথে ছেড়ে দিল না। অন্য হাতটা রাখল হাতের ওপরে। নীরবে সান্ত্বনা দিল।

‘বড় বিপদে আছি আমরা,’ সাহায্য প্রার্থনার সুরে বলল স্যাম ফুলার।

‘শুনব সব।’ বন্ধুপত্নীর দিকে তাকাল আলভারো। ‘আমার গরিবখানায় স্বাগতম।’

একটা চাঁদোয়ার তলায় বাঁধা হলো ঘোড়া আর খচ্চরগুলো। আলভারোর পেছন পেছন কেবিনে ঢুকল ওরা।

অতি সাধারণ ঘর। কোনও আসবাব নেই। দেয়াল ঘেঁষে

ফেলা হয়েছে তোশক। ঘুমাবার ব্যবস্থা। ঘরের এক অংশে পার্টিশন দিয়ে রান্নাঘর বানানো হয়েছে।

রংচটা একটা কম্বল বের করে মেঝেতে পাতল আলভারো। হাতের ইশারায় বসতে বলল।

কম্বলের ওপরে বসল ওরা।

কম্বলটার এক জায়গায় ছিঁড়ে গেছে। রিপু করা হয়েছিল। সেলাই খুলে এসেছে। তলার কাঠ উঁকি মারছে জোড়ার ফাঁক দিয়ে।

লাউয়ের খোলে তৈরি একটা জগ নিয়ে এল আলভারো হেঁসেল থেকে। ছোট-ছোট ক্লে-কাপে পানীয় ঢেলে দিল সবাইকে জগ থেকে। নিজেও নিল। মধু মেশানো ইতালিয়ান মদ। জিনিসটা পুরানো। শরীর চাঙ্গা রাখে।

সেরাপির ঝুলে ঠোঁট মুছল সে পান শেষ করে। চিকন একটা কালো চুরুট বের করে স্যাম ফুলারের দিকে বাড়িয়ে দিল। ফুলার সেটা নেয়ার পর নিজে আরেকটা গুঁজল ঠোঁটের ফাঁকে। প্রথমে নিজেরটাতে ম্যাচের কাঠি জ্বেলে অগ্নিসংযোগ করল। তারপর সিগারটা বাড়িয়ে ধরল অতিথির দিকে।

সেটা দিয়ে নিজেরটা ধরিয়ে নিয়ে ফিরিয়ে দিল আবার স্যাম ফুলার। রয়েসয়ে টানতে লাগল।

জোহানকে সিগার অফার করেনি ওল্ডটাইমার। ওর মায়ের সামনে সেটা করা শোভন হত না। মেকসিকানের জানা নেই, রোজমেরি মিলফোর্ডের কোনও ছেলেই ধূমপান করে না।

বিস্তারিত শুনল আলভারো। কিছুটা রোজমেরির মুখ থেকে। কিছুটা জোহানের মুখ থেকে।

‘সেনিয়োর, এখন তুমিই পারো আমাদের সাহায্য করতে,’ বলে উপসংহার টানল জোহান।

‘হুম।’ গম্ভীর ভাবে মাথা নাড়ল আলভারো।

নির্নিমেষ চোখে তার দিকে চেয়ে রয়েছে জোহান। দৃষ্টিতে আশাবাদ।

‘স্বর্ণ?’ ভূমিকা না করে আসল কথায় চলে এল মেকসিকান।

‘আছে কি?’

‘তা আছে।’

আলোর ঝিলিক দেখা গেল জোহানের চোখে। যাক, ভাল খবর। প্রাথমিক সংশয় কাটল।

টাকরায় শব্দ তুলে জিজ্ঞেস করল সে, ‘ওখানে আমাদের নিয়ে যাবে তুমি?’

‘যাব।’

তমসাচ্ছন্ন হয়ে এসেছে কেবিনের ভেতরটা। সন্ধ্যাবাতি জ্বালাবার জন্যে উঠে গেল আলভারো।

খোলা দরজা দিয়ে বাইরে চাইল জোহান।

সূর্যাস্তের কোমল আলো প্রায় বিলীন। বেগুনি মেশানো সিঁদুররঙা গোধূলি নেমে এসেছে দিগন্তের কিনারায়। কেমন অপার্থিব রং। গাঢ় হচ্ছে ক্রমশ। পাহাড়ে পাহাড়ে ছড়িয়ে পড়েছে যেন সেই রঙের নেশা। জ্বলজ্বল করছে গিরিশৃঙ্গ।

প্রলম্বিত একটা চিৎকার আসন্ন সাঁঝের শীতল স্তব্ধতা চিরে দিল।

‘কী ওটা?’ আঁতকে উঠে বলল এলেনা।

অনুরণন তুলে ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল চিৎকারটা।

‘কয়োটি,’ দরজা থেকে চোখ না সরিয়ে বলল জোহান।

কয়োটি না, হাতি! মনে তো হলো, মরণের ওপার থেকে এসেছে ওই ডাক। যেন আচানক ঘুম ভেঙে উঠে বসে করুণ সুরে বিলাপ করে উঠেছে কোনও প্রেত। ফিরে আসতে চায় তার হারিয়ে যাওয়া জীবনে। বছরের পর বছর যেখানে সুখে-দুঃখে কালাতিপাত করে গেছে।

বুকে থুতু দিল এলেনা। বাপ রে! এমন লাফ দিয়েছিল হৃৎপিণ্ডটা! এখনও ধড়াস ধড়াস করছে।

আবার সেই জান্তব গোঙানি ঢেউ তুলল পাহাড়ের শান্ত নীরবতায়।

বাইশ

কোনওমতে কেটে গেল রাতটা।

ভোরের উন্মেষের ঘণ্টা খানেক আগে ঘুম ভাঙল জোহানের। একে একে জাগল সবাই। প্রাতঃকৃত্য সারল। সমাধা হলো ব্রেকফাস্টের পালাও।

দিক্‌চক্রবালে ততক্ষণে ঊষার লালাভ আলোর রেখা দেখা দিয়েছে।

কেবিন ত্যাগ করল ওরা।

বাঁধন খুলে শেড থেকে বের করা হলো জানোয়ারগুলোকে। স্যাডল আর লাগাম পরানো হলো ঘোড়ায়।

পমেলে হাত রেখে এক ঝটকায় ওর বাকস্কিন ঘোড়াটাতে চড়ে বসল আলভারো। ঢিলেঢালা একটা পনচো গায়ে দিয়েছে সে। পরেছে মোটা সুতায় তৈরি কালো কাপড়ের ঢোলা প্যান্ট।

বাকিরা ঘোড়ায় চাপবার পর হেলেদুলে চলতে আরম্ভ করল বৃদ্ধ মেকসিকান।

জোহান পিছু ধরল তার। এরপর মেয়েরা। তাদের পেছনে কয়েক হাত ব্যবধানে স্যাম ফুলার। তার হাতে এবার খচ্চরের ভার।

বিবর্ণ থেকে একটু-একটু করে চারপাশটা রংদার হচ্ছে। ফুরফুরে বাতাসের কারণে রোদের মেজাজ ভাল। তেতে উঠবার অনেক বাকি। তবে প্রয়োজনীয় ওম ঠিকই বিলাচ্ছে।

তারপরও পারতপক্ষে রোদ মাখছে না কেউ গায়ে। স্যাণ্ডস্টোন ক্লিফ বা গাছের ছায়ায় ছায়ায় চলেছে।

দুইবার গ্রিজলি ভালুকের ট্র্যাক চোখে পড়ল ওদের। একবার সিংহের। পাহাড়ি ছাগলের চিহ্ন তো হরহামেশাই দেখা যাচ্ছে।

রাইফেল হাতে ঘোড়া সামলাচ্ছে জোহান। বিপদের ভয় সে করছে না। কিন্তু সতর্কতায় ঢিল দেবার ইচ্ছে নেই বিন্দুমাত্র। স্যাডলে বসা অবস্থাতেই কিছুক্ষণ পর-পর পেছনে তাকাচ্ছে ঘাড় ফিরিয়ে।

নীচে নামছে ওরা।

অপ্রশস্ত জায়গাগুলো পার হবার সময় ভীত হয়ে পড়ছে জানোয়ারগুলো। পাশেই মরণফাঁদ। অষ্টপ্রহর হাঁ করে রয়েছে খাদ।

সাবধানের মার নেই। ওরকম ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায় ঘোড়া থেকে নেমে পড়ছে ওরা।

তারপরেও চলতে চায় না ঘোড়া বা খচ্চরগুলো। তখন কয়েকটা মিনিট তাদের পেছনে খরচ করতে হচ্ছে। নাকে-মুখে হাত বুলিয়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছে লাগাম ধরে।

এভাবে চলতে চলতে গিরিতলে এসে পৌছাল অভিযাত্রীরা।

বিশাল সব বোল্ডার চারপাশে। তার মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলল দলটা।

সোজা পথটা কিছুদূর এগিয়ে বাঁক নিল। ওপাশে বেরোতেই জোহানদের চোখে পড়ল একটা ওঅটর-হোল।

বোঝা গেল, কোত্থেকে পানি আনে মেকসিকান। বহুদূরের পথ অতিক্রমণ করতে হয় তাকে এই জন্যে।

প্রচুর পাখি। কিচিরমিচিরে ভরে আছে জায়গাটা।

সূর্যের আলো সোজাসুজি যাতায়াত করতে পারছে না এখানে। নানা অলিগলি বেয়ে চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে। কেমন নীলাভ করে দিয়েছে ভেতরের সব কিছু। তবে দেখা যায় পরিষ্কার।

পানির গন্ধ পেয়ে জানোয়ারগুলো নিজেরাই স্বতঃস্ফূর্ত পদক্ষেপে এগিয়ে গেল জলাধারটার দিকে।

শুধু ওদের নয়, সবারই কমবেশি তেষ্টা পেয়েছে।

টলটলে পরিষ্কার পানি। আঁজলা ভরে পান করল ওরা। ভেতরটা জুড়িয়ে গেল খেয়ে। খুব মিষ্টি আর শীতল। একেবারে বরফের মত।

এই গরমেও এত ঠাণ্ডা থাকে কী করে, ভেবে অবাক হলো জোহান। পাহাড়ের অন্তস্তল থেকে উঠে আসছে নিশ্চয়।

ইচ্ছেমত পানি খাবার সুযোগ দেয়া হলো চারপেয়েগুলোকে। দুই পক্ষই রিল্যাক্স করবার অবকাশ পেল এই সময়টুকুতে। ক্যানটিনগুলো ভরে নিয়ে রওনা করল ওরা আবার।

দেখতে দেখতে মাথার ওপরে উঠে এল সূর্য। মেঘহীন সুনীল আকাশে একচ্ছত্র অধিপতির মত রাজত্ব করতে লাগল। পুরো পৃথিবীটাকেই সেদ্ধ করে ফেলবার পণ করেছে যেন আগুনের গোলকটা।

পাহাড়ের ঢালে পড়ে ঠিকরে যাচ্ছে রোদ। চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে।

তপ্ত বাতাসের ঝিলিমিলি নাচ দেখতে দেখতে চোখ ব্যথা হয়ে গেছে জোহানের। নোনা ঘাম লেগে জ্বলছে। জুলফির ভেতর দিয়ে গড়িয়ে নীচে নামছে ঘাম। গাল-গলা বেয়ে শার্টের ভেতরে ঢুকে সুড়সুড়ি দিচ্ছে।

আরও একবার পেছনে তাকাল সে। হাতের চেটো দিয়ে ললাটের ঘাম মুছল।

পাশাপাশি রাইড করছে ওর মা আর এলেনা। বরাবর তা-ই হয়েছে। শুধু ট্রেইল যেখানটায় অপেক্ষাকৃত অপরিসর, সেখানে পিছিয়ে পড়েছে এলেনার পনি।

একটা প্রায়ান্ধকার গিরিপথে ঢুকে পড়ল ওরা বিকেল নাগাদ।

দুই ধারে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে আছে ন্যাড়া পাহাড়। মাঝখানে ফাঁক খুব সামান্য। দুই দিকের দেয়ালই স্পর্শ করা যায়।

নিরেট গাম্ভীর্যের সঙ্গে ওদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করতে লাগল দানবীয় পাহাড়গুলো। বহুদিন এই তল্লাটে মানুষ দেখেনি তারা।

পানির আরেকটা উৎসের কাছে ফের থামল মেকসিকান।

পাহাড়ের ভেতরে লুকানো একটা ঝরনা। আলভারো বলল- ‘সোনালী ঝরনা’। এখানেই ক্যাম্প করবে, বলল। এখনকার মত। আঁধার নামবে একটু পরেই। এর থেকে নাকি ভাল জায়গা নেই সামনে।

ঝরনাটা খুব সুন্দর। দশ-বারো ফুট চওড়া। পাহাড়ের একটা ফাটল থেকে বেরোচ্ছে চঞ্চল পানি। নামবার সময় ঠেলে বের হয়ে আসা অংশগুলোতে বাড়ি খেয়ে যাচ্ছে স্রোত। কুলকুল শব্দে বয়ে যাচ্ছে।

ঝরনার ধারেই ক্যাম্প করল ওরা।

মিহি বালি আর নুড়িপাথর ছড়িয়ে রয়েছে সর্বত্র। তার ওপরে বেডরোল পাতা হলো। বালিশের কাজ করবে যার-যার স্যাডল। রাতে ঠাণ্ডা লাগতে পারে। অসুবিধা নেই। কম্বল আছে। গায়ে দেয়া যাবে।

লাকড়ির জন্যে বেশিদূর যেতে হলো না। কাছেপিঠে মেসকিট গাছ রয়েছে।

মিউলের পিঠে বোঝাই ব্যাগ থেকে বেকনের একটা চাকা বের করল জোহান। মিসেস মিলফোর্ডের হাতে ধরিয়ে দিল। রান্নার তৈজসপত্র নামাতে হাত লাগাল এলেনা।

অস্তাচলে ঢলে পড়েছে সূর্য। ঘন ছায়া নামছে ভ্যালিতে। গুড়ি মেরে এগিয়ে আসছে যেন অন্ধকারের দানব।

তেইশ

সন্ধের পরে চুকিয়ে ফেলা হলো সাপারের পাট। তেমন কিছু নয়। বেকনের সাথে সামান্য বিন আর ভুট্টার রুটি। শেষে কফি।

জায়গায় জায়গায় ঘাসের চাপড়া। ধূলিময় মাটিতে টিকে আছে কোনও মতে। ঘেসো জায়গায় খুঁটি পুঁতে বাঁধা হয়েছে জানোয়ারগুলোকে। ঘোড়ার জিন খুলে আচ্ছামত দলাইমলাই করেছে তিন পুরুষ। খচ্চরগুলোও বাদ যায়নি। ম্যাসাজ করবার পর যব দেয়া হয়েছে গামলায়। সাথে সাথে ওতে মুখ ডুবিয়ে দিয়েছে জন্তুগুলো।

বিছানায় মাথা ছোঁয়ানোমাত্র ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে গেল দুই নারী।

ম্যাণ্ডোলিনে টুং-টাং সুর তুলল স্যাম ফুলার। গুনগুন করে গাইল:

‘ফাঁকি দিয়ে প্রাণের পাখি উড়ে গেল
আর তো এল না।’

ঘুমে ঢুলুঢুলু চোখ বুজে এল তার একটা সময়। নাক ডাকবার আওয়াজ শোনা গেল।

কেন জানি ঘুম নেই জোহানের চোখে। শুয়ে শুয়ে আকাশ দেখছে। নির্মেঘ আকাশে একটা তারা ফুটল। তারপর আরেকটা। দেখতে দেখতে ছয়-সাতটা গুনে ফেলল। তারপর খইয়ের মত এত দ্রুত ফুটতে শুরু করল যে, খেই হারিয়ে ফেলল।

শত-সহস্র তারায় ভরে গেল আকাশ। দেখা দিল ছায়াপথ।

অনেক বড় দেখাচ্ছে তারাগুলোকে। অনেক উজ্জ্বল। মনে হচ্ছে, হাত বাড়ালে ধরা যাবে। কালো আকাশের ব্যাকগ্রাউণ্ডে হীরের টুকরোর মত জ্বলছে।

বিশ্বজগতের বিশালত্বের তুলনায় সে যে কত তুচ্ছ, বিমর্ষ চিত্তে উপলব্ধি করল জোহান। কী বিশাল মহাকাশ! কত কোটি- কোটি মাইল দূরে!

জোহানের পাশে শুয়ে কাত হলো আলভারো। ‘ফেউ লেগেছে আমাদের পিছে।’

‘কী করে বুঝলে, সেনিয়োর?’ ভাব-টার মুছে গিয়ে মুহূর্তে সজাগ জোহান। ‘আমি তো কিছু টের পাইনি!

‘আমি পেয়েছি। ওরা নিজেদের লুকাতে পারেনি।’

‘একাধিক লোক?

‘সি।’

‘কতদূরে?’

‘বেশ দূরে। তবে লেগে আছে।’

কনুইয়ে ভর দিয়ে আধশোয়া হলো জোহান। ‘সেনিয়োর, এখানকার ইনডিয়ানদের স্বভাব-চরিত্র আমি জানি। তারা আমাদের পিছু নেবে… ব্যাপারটা ঠিক মেলানো যাচ্ছে না!’

‘ইনডিয়ান না, মাই বয়।’ জোহানের ভাবনার বহর দেখে যেন ভ্রূকুটি করল মেকসিকান। ‘আমি থাকতে কোনও ইনডিয়ানের বাপেরও সাহস নেই, আমাদের ব্যাপারে নাক গলায়।’

‘ইনডিয়ান নয়… তা হলে?’

‘মনে হয়, তোমরাই ওদের ডেকে এনেছ।’

‘সেটা কী করে সম্ভব! আমরা এসেছি, কেউ তো জানে না!’

‘হয়তো আরও আগে থেকে নজর রাখা হচ্ছিল তোমাদের উপরে। হয়তো… আচ্ছা, মেয়েটা কে?’ হঠাৎ জিজ্ঞেস করল আলভারো।

বলল জোহান। আদ্যোপান্ত। বলতে বলতেই আঁচ করে ফেলল, মেকসিকানের চিন্তা কোন্ খাতে প্রবাহিত হচ্ছে। ‘আমি যা ভাবছি, তুমিও বোধ হয় তা-ই ভাবছ, সেনিয়োর। মিস মনটেরো…’

‘সেই সম্ভাবনাই বেশি।’

সে ক্ষেত্রে ড্র অনিবার্য। মারিয়াচিকে আণ্ডার-এস্টিমেট করবার কোনও সুযোগ নেই। জোহান ভাল করেই জানে, এল মারিয়াচির মত লোকেরা সহজে ক্ষান্ত দেয় না। সম্মুখযুদ্ধ হবেই। ওকে খুন করবার ওপরে লোকটার মানসম্মান নির্ভর করছে।

একটু শঙ্কিত বোধ করল জোহান। বন্দুকে তার হাত মন্দ নয়। কিন্তু একজন চালু পিস্তলবাজের সাথে ডুয়েল লড়বার জন্যে এই যোগ্যতা যথেষ্ট নয়।

তার থেকেও বড় কথা হলো, গানফাইটে নামবার কোনও ইচ্ছেই তার নেই। নিতান্ত বাধ্য না হলে পিস্তলে হাত দিতে চায় না সে।

জোহান মিলফোর্ড গোলাগুলি ভয় পায়, এমন কথা কেউ বলবে না। কিন্তু সে রক্তপাত এড়িয়ে চলতেই অভ্যস্ত। এর কারণ ওর বাবার দেয়া শিক্ষা। সংঘাত-সংঘর্ষ কোনও ভাল ফল বয়ে আনে না। শান্তিপূর্ণ ভাবে মীমাংসাই সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা।

জোহান পুরো অবস্থাটা আগাগোড়া তলিয়ে দেখল।

হয় সে থাকবে। নয়তো মারিয়াচি। অথবা দুইজনই মারা যাবে। মাঝামাঝি কিছু নেই।

দরকার পড়লে বন্দুকের সামনে দাঁড়াবে বৈকি ও। একজন ভদ্রমহিলার সম্মান রক্ষার্থে জীবন দেবে।

কিন্তু তারপর?

‘মেয়েদেরকে এর মধ্যে আনা ঠিক হয়নি, উৎকণ্ঠিত আলভারো বলল।

সেটা জোহানও বুঝতে পারছে।

কেন এনেছে, সে বিষয়ে তার মুখ থেকে মোটামুটি গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা শুনবার পরেও তুষ্ট হলো না মেকসিকান। অন্তর্ভেদী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

‘প্রেমে পড়েছ তুমি, সান,’ যেন ষোলো আনা নিশ্চিত, এই ভাবে কথাটা বলল আলভারো।

‘না-না, সেনিয়োর। তা নয়,’ লাজুক ভাব ফুটে উঠল জোহানের কণ্ঠে। ‘মিস মনটেরো চমৎকার মেয়ে। তবে আমাদের মধ্যে এরকম কিছু ঘটেনি।’ হেসে ফেলে সে। ‘প্রেম-ভালবাসার জন্য সময়টা বোধ হয় উপযুক্ত নয়।’

‘আমি কিন্তু ‘তোমাদের’ কথা বলছি না। ‘তোমার’ কথা বলছি।’

জবাব দিতে কয়েক মুহূর্ত দেরি করল জোহান। ‘চমৎকার মেয়ে মিস মনটেরো। কিন্তু…’ কথা হারিয়ে গেল। ‘আমি আসলে ব্যাপারটা নিয়ে সেভাবে ভাবিনি…’

‘ওকে, সান।’ মৃদু হেসে রেহাই দিল ওকে আলভারো। একটুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর উদাসী স্বরে বলল, ‘যুবক বয়সে আমিও একজনকে ভালবেসেছিলাম… এক ইনডিয়ান মেয়ে…

এই জন্যেই কি ইনডিয়ান সংস্কৃতির প্রতি মেকসিকান এত অনুরক্ত? শুধাল জোহান, ‘আর মেয়েটা?’

‘সে-ও বাসত।’

‘আচ্ছা, সেনিয়োর, তুমি লোকালয়ে থাকো না কেন?’ কথার মোড় ঘোরাল জোহান।

‘ভাল লাগে না আমার।’

‘কিন্তু এই যে সব কিছু ছেড়ে-ছুঁড়ে নির্জনে বাস করছ… একা-একা লাগে না?’

‘প্রকৃতির কোলে এসে কখনও একা হবে না তুমি,’ আলভারো বলল, ‘তাজা বাতাস… গাছগাছালি… বুনো জীবজন্তু… সব সময় ঘিরে থাকবে তোমাকে।’

এই জীবনদর্শন শুনবার পর আর কী বলবার থাকতে পারে? জোহান আগের কথার সূত্র ধরে, ‘মেয়েটার কথা বলছিলে, সেনিয়োর…’

আবছা অন্ধকারে তার মুখের দিকে তাকাল আলভারো। ‘হ্যাঁ।’ ম্লান একটু হাসল। ‘খুব ভাল ছিল মেয়েটা। আমার খাবার রান্না করে দিত…’

‘বিয়ে করেছ তাকে?’

‘না। পারলাম আর কই?’

‘প্রেম নিবেদন করেছিলে?’

‘পারিনি। তার আগেই…’ চুপ হয়ে গেল মেকসিকান।

‘বিয়ে হয়ে গেল?’

‘মরে গেল।’

আহাজারি করে উঠল জোহানের অন্তরাত্মা। বিষাদের ছায়া ঘনাল চোখে। অস্ফুটে উচ্চারণ করল, ‘আমি… আমি দুঃখিত, সেনিয়োর।’

নিজের ইচ্ছায় মরেনি ও…’ জোহানের কথাটা যেন শুনতেই পায়নি আলভারো।

বুঝল জোহান। ‘এই একটা জায়গায় আমরা সবাই-ই তো ঈশ্বরের দাস… তাঁর ইচ্ছায় দুনিয়াতে আসি, আবার তাঁর ইচ্ছাতেই চলে যেতে হয়। জন্ম-মৃত্যুর ব্যাপারটা তো মানুষের হাতে নেই, সেনিয়োর।

‘আমি বিশ্বাস করি না ঈশ্বর ওর মৃত্যু চেয়েছিল…’ আলভারোর গলা ভারী হয়ে উঠল।

‘তুমি বললে…’

‘মেরে ফেলা হয়েছে ওকে।’

একটা বাদুড় উড়ে গেল ডানায় ঝটপট শব্দ তুলে।

পেটের ভেতরে শূন্যতা অনুভব করল জোহান। এই বৃদ্ধের জীবনের এক দুর্বিষহ সত্যের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে সে ঘটনাচক্রে। হৃদয়ের মস্ত একটা ক্ষত উন্মোচন করে দেখাচ্ছে তাকে মেকসিকান।

কোমল গলায় জিজ্ঞেস করল জোহান, ‘কী হয়েছিল,সেনিয়োর?’

তারাজ্বলা আকাশের দিকে চেয়ে আছে আলভারো। যেন চোখের সামনে ফুটে উঠেছে তার অতীত। সুদীর্ঘ একটা মুহূর্ত চুপ করে রইল। তারপর বলল, ‘শয়তানের নজর পড়েছিল মেয়েটার উপরে। রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে গেল ওকে পাঁচ গুণ্ডা। কুত্তার বাচ্চারা ওকে… ওকে…’ চোখ বন্ধ করে ফেলল বুড়ো। যা ঘটেছিল, সহ্য করতে পারছে না যেন।

আলভারোর গায়ে সান্ত্বনার হাত রাখল জোহান।

ধাতস্থ হতে সময় নিল না মেকসিকান। দৃষ্টি যখন মেলল, অশ্রু চিকচিক করছে তখন চোখের কোণে। জোহানের দিকে তাকিয়ে নালিশের সুরে বলল, ‘ধর্ষণ করে মেরে ফেলেছে ওকে হারামজাদারা!’

ডান হাতটা মুষ্ঠিবদ্ধ হয়ে গেছে আপনা-আপনি। কঠোরতার ছাপ জোহানের চোয়ালে। জোরে জোরে কয়েকবার শ্বাস ফেলল। ক্রোধ সামলাবার চেষ্টা করছে। ‘তুমি ওদের ছেড়ে দাওনি, সেনিয়োর। দিয়েছ?’

‘না। দিইনি,’ বিকারহীন চেহারায় বলল আলভারো, ‘ধরে ধরে জবাই করেছি সব ক’টাকে।

‘হ্যাঁ, এটাই ঠিক, সেনিয়োর,’ অনুমোদন দিল জোহান। ‘তার আত্মা নিশ্চয় শান্তি পেয়েছে।

নীরবতা পালন করল ওরা। দীর্ঘ নীরবতা।

অনেকক্ষণ পরে জিজ্ঞেস করল জোহান, ‘কী নাম ছিল তার?’

‘“দীঘল সবুজ ঘাস”,’ বলতে বলতে ভালবাসার ছায়া পড়ল আলভারোর চেহারাতে। ‘নামটা সুন্দর না?’

‘দারুণ, সেনিয়োর।’

‘এত ভাল একটা মেয়ে ছিল ও… ওই নরকের কীটগুলোকে যদি শাস্তি দিতে না পারতাম, তা হলে নিজেকেই নিকেশ করে দিতাম আমি। আমার প্রেতাত্মা ছিঁড়ে-খুঁড়ে দিয়ে আসত কুকুরগুলোর শিরা-উপশিরা!’

‘পালালে তারপর?’ আন্দাজে ঢিল মারে জোহান।

‘হ্যাঁ। সভ্যতা আমাকে তাড়া করছিল। কারও সান্নিধ্য ভাল লাগত না। জনারণ্যেও একা বোধ হত নিজেকে। একদিন তাই কাউকে কিছু না বলে হারিয়ে গেলাম।’

জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেলল আলভারো। জোর করে হেসে ঝেঁটিয়ে দিল যেন বিধুর স্মৃতিকণা। ‘রাত জাগতে হবে। প্রথম পালায় কে পাহারা দেবে- তুমি, না আমি?’

‘আমিই জাগছি। তুমি ঘুমাও, সেনিয়োর।’

‘তথাস্তু, অ্যামিগো।’ খোদ সম্রাটের মত বলল আলভারো। ‘শুভরাত্রি।’

‘বুয়েনোস নচেস।’

নিদ্রাদেবীর কোলে নিজেকে সঁপে দিল মেকসিকান।

এক ঘণ্টা গেল। দুই ঘণ্টা। আকাশের অবসন্ন চাঁদটা একপাশে সরে গিয়ে ঝিমাতে লাগল।

নিজের জিনের গায়ে হেলান দিয়ে সময় অতিবাহিত করছে জোহান। নির্দিষ্ট বিরতিতে উঠে আশপাশে টহল দিচ্ছে।

ঝিঁঝির কোরাস ভরে রেখেছে রাত। কানে তালা লেগে যাবার অবস্থা রীতিমত। ডাকতে ডাকতে হঠাৎ থেমে যাচ্ছে পোকাগুলো একসাথে। আশ্চর্য একটা নৈঃশব্দ বিরাজ করছে তখন কয়েক সেকেণ্ড। তারপর আবার তান ধরছে সবাই মিলে।

নরম দীর্ঘশ্বাস ছাড়ছে ঘোড়াগুলো। খচ্চর দুটো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘুমাচ্ছে। রাতচরা পাখির হঠাৎ চিৎকারে খানখান হয়ে ভেঙে পড়ছে রাত্রির অদৃশ্য প্রাচীর।

রোমকূপে শিরশিরানি তুলে বয়ে যাচ্ছে যাযাবর বাতাস। যেখানেই বাধা পাচ্ছে, বিচিত্র শব্দ করছে। কখনও বা থেমে যাচ্ছে হঠাৎ করেই।

মাঝে মধ্যে ইঁদুর বা খরগোশের পায়ের ঠেলায় পাহাড়ের পাথুরে গা বেয়ে গড়িয়ে নামছে ছোট পাথর। চাপা টুকুর-টাকুর শব্দ তুলছে। আর অবিরাম জল-কোলাহল তো রয়েছেই। শ

আনমনে মাথা দোলায় জোহান। শান্ত, সুন্দর একটা রাত। ঠিক যেমনটা হওয়া বাঞ্ছনীয়।

কিন্তু এই শান্তির বিপরীতে কয়েকটি প্রাণীর হৃদয়ে কী অশান্ত ঝড় বইছে, কেউ কি কল্পনা করতে পারবে?

চব্বিশ

পায়ে গলাবার আগে বুটের গোড়ালির দিকটা সাবধানে মাটিতে ঠুকল জোহান। কাঁকড়াবিছা বা ট্যারানটুলা মাকড়সার কামড় খাবার শখ নেই তার। এই বদখত চেহারার বিষাক্ত প্রাণী দুটো প্রায়শই জুতোর ভেতরে ঘাপটি মেরে থাকে। নিকৃষ্ট শ্রেণীর জীব। বুটজুতোর অন্ধকারকে মনে করে নিরাপদ আবাস। এতে করে যে জুতোর মালিকের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে, সেটা বুঝবার মত ঘিলু নেই ঘটে।

শেষ রাত।

উজ্জ্বলতা কমে গেছে নক্ষত্রগুলোর। দূরবর্তী হারবার-লাইটের মত ঘোলা দেখাচ্ছে তাদের আলো।

ভোরের বার্তা নিয়ে বইছে ঝিরঝিরে বাতাস। ফারের বন ছুঁয়ে আসছে। তাজা করে দিচ্ছে শরীর-মন।

সবাই উঠে পড়েছে। ঝেড়েঝুড়ে বিছানা গোটানো শেষ।

কফির পানি চড়ানো হয়েছে কেটলিতে। বগবগ শব্দ করে ফুটছে।

খাবার পরে আর একটা মিনিটও দেরি করতে চাইল না আলভারো।

এবারে সে যে পথটা বেছে নিয়েছে, সেটা একটা অব্যবহৃত ট্রেইল। না আছে ওয়্যাগনের চাকার দাগ, না দেবে যাওয়া ক্ষতবিক্ষত মাটি। দুই পাশ থেকে চেপে এসেছে কনিফারের

ঝোপ। প্রায় জঙ্গল হয়ে রয়েছে। পাতার ঘষা লাগছে পায়ে, স্টিরাপে। দুয়েকটা বেয়াড়া ডাল কাঁধে বাড়ি মারছে।

বিতিকিচ্ছি অবস্থা।

বিরক্তিকর।

আঁকাবাঁকা, তমসাবৃত প্যাসেজে বেশিদূর দৃষ্টি এগোয় না। ঘোড়ার কানের ওপরে নির্ভর করতে হচ্ছে তাদের। সতর্ক থাকতে হচ্ছে পুরো মাত্রায়। আবছা আঁধারে দৃষ্টিহীনের মত এগিয়ে চলা আর অশ্বখুরের ঠক-ঠক আওয়াজ- সবটা মিলে যেন অভিনব এক মানসিক পীড়ন। ভোররাতের নিষ্পাপ বাতাসটা উপশমের কাজ করছে বলে রক্ষা। তা না হলে ওরা বোধ হয় সত্যি-সত্যি পাগল হয়ে যেত।

জানোয়ারগুলোও উষ্মা প্রকাশ করছে।

তবে একটা সময় দৃশ্যপট বদলে গেল।

একটা বাড়ি। কাদামাটি দিয়ে গড়া। পাণ্ডববর্জিত একটা জায়গার জন্যে বেখাপ্পা নিদর্শনই বলতে হবে।

নিচু ছাতঅলা বাড়িটা ধসে আছে। গোটাটাই।

একটা পোল-করাল। জীবনের চিহ্ন নেই। না, ভুল হলো। পোকামাকড়ের ঘরবসতি।

ছানার পানির মত আলো ছড়িয়ে পড়ছে চারধারে।

বিস্তীর্ণ জনশূন্য প্রান্তর পড়ে রয়েছে ওদের সামনে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *