সুবৰ্ণ সমাধি – ১৫

পনেরো

সন্ত্রস্ত একটা গলা। ভরাট

লাফ দেয়া হলো না।

আপাতত।

রেলিং-এর সাথে সেঁটে গেল রোজ। মাথা ঘুরিয়ে লোকটাকে দেখবার চেষ্টা করল। ঠিক পেছনে দাঁড়ানো বলে মুখ দেখতে পেল না। চোখের কোনা দিয়ে শরীরের একাংশ নজরে আসছে।

ওর দৃষ্টিসীমানায় আসবার জন্যে খানিকটা পাশে সরে এল স্ট্রেঞ্জার। পায়ে সমস্যা আছে লোকটার। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটে।

এবারে রোজ স্পষ্ট দেখতে পেল তাকে।

এক যুবক। লম্বা। সুদর্শন। গায়ে জ্যাকেট।

পা টেনে টেনে এগিয়ে আসছে লোকটা।

শান দেয়া ছুরির মত বাতাস কাটল রোজের গলা। ‘খবরদার, কাছে আসবে না!’

থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল যুবক। সারেণ্ডারের ভঙ্গিতে দুই হাত তুলল মাথার ওপরে। যেন তার দিকে অস্ত্র ধরেছে কেউ।

একটা সিগারেট ধরা লোকটার দুই আঙুলের ফাঁকে। প্রায় শেষ হয়ে এসেছে সেটা। বাতাসের তাড়া খাওয়ায় দৃশ্যমান হচ্ছে না ধোঁয়া। কমলা এক ফালি আগুন দেখা যাচ্ছে শুধু।

‘হ্যাঁ,’ সন্তুষ্ট হলো রোজ। ‘ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকো।’

‘বিশ্বাস করো, ম্যা’ম, আমার কোনও বদ মতলব নেই, ‘ নিজের অবস্থান পরিষ্কার করতে চাইল যুবক। ‘আমি তোমাকে সাহায্য করতে চাইছি।’

রাগে গা জ্বলে গেল রোজের। পুরুষদের এই গায়ে পড়া স্বভাবটা অসহ্য!

ঝাঁজিয়ে উঠল সে, ‘কে বলল, তোমার সাহায্য লাগবে আমার?’

‘লাগবে না?’ অবাক মনে হলো যুবককে। ‘নিজে নিজে উঠতে পারবে তুমি?’

‘কেন উঠব?’

‘এটা আবার কেমন ধারা প্রশ্ন! সারারাত এভাবে নাকি থাকবে তুমি?’

‘প্রশ্নই ওঠে না!’

‘তা হলে উঠে এসো দয়া করে! এভাবে বেশিক্ষণ থাকতে পারবে না, ম্যা’ম। যে কোনও মুহূর্তে অ্যাকসিডেন্ট ঘটে যেতে পারে।’

‘যাক!’ গোঁয়ারের মত বলল রোজ। সামনে প্রসারিত করল দৃষ্টি।

তার ‘ড্যাম কেয়ার’ ভাব দেখে কিংকর্তব্য বোধ করল যুবক। তারপরও চেষ্টা করল সে আবার, ‘আমার কথা শোনো, ম্যা’ম। বিপদে পড়বে তুমি! মিস-অ্যাডভেঞ্চারের পরিণতি কিন্তু ভাল হয় না!’

মিস-অ্যাডভেঞ্চার!

তাচ্ছিল্যের হাসিতে বেঁকে গেল রোজের ঠোঁটের কোণ। লোকটা কি ভেবেছে, সে এখানে হাওয়া খেতে নেমেছে? বলদ!

‘নিজের চরকায় তেল দাও, মিস্টার!’ ঠাণ্ডা স্বরে বলল সে। ঘাড় ঘুরিয়ে যুবককে ফের এগিয়ে আসতে দেখল। মুহূর্তে উত্তাপ ছড়াল রোজের কণ্ঠ, ‘নড়বে না একদম!’

আবার ফ্রিজ হয়ে গেল যুবক।

রোজ একটু নরম হলো, ‘সাহায্য করতে চাইছ, সেজন্য ধন্যবাদ। তোমার সাহায্যের প্রয়োজন নেই আমার। আমি লাফ দেব!’

আকাশ থেকে পড়ল যুবক, ‘লাফ দেবে! কেন?’

‘আমার ইচ্ছা।’

বিহ্বল দেখাল যুবককে। ‘তারপর উঠবে কী করে?’

আজব চিজ!–ভাবল রোজ। লোকটা কি আসলেই কিছু বুঝতে পারছে না? নাকি ন্যাকা সাজছে? …নাহ, এই হতচ্ছাড়াকে আর সময় দেয়া যাবে না!

আবার সামনে তাকাল সে।

‘ও কী, ম্যা’ম!’ ভয় পাওয়া গলায় বলে উঠল যুবক, ‘সত্যি- সত্যিই লাফ দিচ্ছ নাকি?’

জবাব দেবার প্রয়োজন মনে করল না রোজ।

‘দাঁড়াও!’ কর্তৃত্বের ছাপ ফুটল যুবকের স্বরে, ‘লাফ দেবে না

তুমি!’

‘দাঁড়াব মানে?’ রোজ খেপে উঠল। ‘এই মিস্টার, কোটা করব, কোন্‌টা করব না, সেটা তুমি বলবার কে? আমার উপরে মাতব্বরি ফলাচ্ছ কী মনে করে?’

‘করতে চাইনি, ম্যা’ম। কিন্তু তুমি আমাকে বাধ্য করছ!’

‘তোমার কথা শুনতে বাধ্য নই আমি, মিস্টার!’

‘সেই স্বাধীনতা তোমার আছে, ম্যা’ম।’ অনিচ্ছা সত্ত্বেও মাথা ঝাঁকাল যুবক। ‘তোমার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করবার মানুষ আমি নই। কিন্তু চোখের সামনে একজন ভদ্রমহিলা সাগরে ঝাঁপ দেবে, আর আমি চেয়ে চেয়ে দেখব, সেরকম মানুষ মনে কোরো না আমাকে।’

কোনও মেয়েকে প্রভাবিত করবার জন্যে এই কথাগুলোই যথেষ্ট। কিন্তু রোজের তিক্ত অভিজ্ঞতা তাকে গলতে দিল না। কথায় পটু, সুন্দর, সুবেশী বদমাশ সে কম দেখেনি। এই জাহাজেই ডজন খানেক মধুলোভী ভ্রমর ছোঁকছোঁক করেছে তার আশপাশে।

সে বলল, ‘এটা তোমার অনধিকার চর্চা, মিস্টার। তুমি আমাকে চেনো না।’

‘না চিনলাম,’ হারতে চাইল না যুবক। ‘একজন অপরিচিত মানুষের উপরে আরেকজনের যতটুকু অধিকার থাকে, সেই অধিকার থেকে বলছি।’

‘দোহাই তোমার, চলে যাও!’ রোজের কণ্ঠে কাতর অনুনয়। ‘মনোযোগ নষ্ট করে দিচ্ছ তুমি আমার!’

যুবক নাছোড়বান্দা। ‘ম্যা’ম, তোমার বরং উঠে আসবার দিকে মনোনিবেশ করা দরকার।’

‘তার মানে, যাবে না তুমি?’

‘উঁহুঁ। ফেঁসে গেছি আমি, ম্যা’ম। তুমি যদি লাফ দাও, তা হলে আমিও লাফ দেব।’

‘আহাম্মকের মতন কথা বোলো না! তুমি লাফ দেবে কেন?’

‘তুমিই বা লাফ দেবে কেন, ম্যা’ম?’

‘আমি বাঁচতে চাই না!’

‘কেন চাও না, জানতে পারি?’

‘সেটা আমার নিজস্ব ব্যাপার। তোমার না জানলেও চলবে। শুধু এটুকু শুনে রাখো, বাঁচতে না চাওয়ার সঙ্গত কারণ আছে আমার।’

‘মরবার জন্য যখন লাফ দিচ্ছ, তখন কারণটা কিছুতেই যুক্তিসঙ্গত হতে পারে না।’

‘কে বলে?’ বক্রোক্তি করল রোজ।

‘আমি বলছি, ম্যা’ম।’

‘বাহ!’ রোজের গলার স্বরে ব্যঙ্গ। ‘নিজে এ কথা বলছ, আবার নিজেই চাইছ লাফ দিতে। খুব সুন্দর যুক্তি, মিস্টার! তোমার লাফ দেবার কারণটা কি সঙ্গত?’

‘আলবত, ম্যা’ম!’ বলল যুবক, ‘তোমাকে মরতে দিতে পারি না আমি। ‘শিভালরি’ বলে একটা কথা আছে না!’

‘আমাকে বাঁচাবার জন্য প্রাণ দেবে তুমি!’

‘কী আর করা, ম্যা’ম!’ বিরস মুখে বলল যুবক। ‘তবু সান্ত্বনা থাকবে, সাধ্যমতন চেষ্টা করেছি আমি তোমাকে বাঁচাতে।’

রোজ দ্বিধান্বিত।

সিগারেটটা ঠোঁটের কোনায় আটকে নিল যুবক। জ্যাকেট খুলে ডেকের ওপরে ফেলল। ডান হাঁটুর ওপরে বাম পা তুলে টান নিল বুটের ফিতেয়। খুলে গেল নট। ঠক করে মেঝেতে পড়ল জুতো।

‘লাফ দিলেই যদি তোমার কাজ হাসিল হয়ে যেত, তা হলে একটা কথা ছিল,’ বলে চলল সে, ‘কিন্তু সেটা তো হবে না, ম্যা’ম।’

‘হবে না কেন?’

অন্য জুতোটাও খুলে ফেলল যুবক। ‘মরবার সময় প্রচণ্ড যন্ত্রণা পাবে।’

‘বুঝেছি।’ মাথা নাড়ল রোজ। ‘দম আটকে মরবার কষ্টের কথা বলছ তো!’ সখেদে যোগ করল, ‘কিন্তু এখানেই নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে আমার…’

‘তুমি কি মনে করো, দম বন্ধ হয়ে যাওয়াটাই সব?’

‘কী বলতে চাও, পরিষ্কার করে বলো তো!’ অধৈর্য ভঙ্গিতে বলল রোজ। বিরক্ত। ‘এক লাইন, এক লাইন করে বলে নাটক করছ কেন?’

‘বলছি, ম্যা’ম।’ এক পা আগে বাড়ল যুবক। ‘পানিতে লাফ দিলে ব্যথা পাবে তুমি।’

‘মাথামোটা!’ রোজ মনে মনে বলল, ‘চেহারা সুন্দর হলে হবে কী, পাঁঠার বুদ্ধি মাথায়।’ মুখে বলল, ‘কী বলছ আগডুম-বাগডুম! পানিতে পড়লে কেউ ব্যথা পায় নাকি? কোত্থেকে এসেছ?’

‘মাদ্রিদ থেকে, ম্যা’ম,’ সরল মুখ করে বলল যুবক।

এই স্থূল রসিকতায় সহজ হলো না রোজ। হাসা তো দূরের কথা। চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, ‘আমাকে ব্যাখ্যা করো, মিস্টার, পানিতে লাফ দিলে কীভাবে ব্যথা পায় মানুষ!’

‘পায়। যদি বেকায়দা ভাবে পড়ে। পানিতে লাফ দেবার কিছু নিয়ম আছে, ম্যা’ম। উল্টাপাল্টা হলে বিপদ।’

‘যেমন?’ মনে মনে ভাবছে রোজ, ‘ওরে, আমার সবজান্তা রে! আমি মরছি নিজের জ্বালায়, আর উনি এসেছেন নিয়মকানুন শেখাতে।’

‘ধরো, এত উপর থেকে যদি মাটিতে লাফ দিতে তুমি, তা হলে কী হত? তরমুজের মতন ফেটে যেত মাথাটা। তা-ই না? পানিতে পড়লেও একই ব্যাপার,’ কোনও স্কুল-শিক্ষক তার ছাত্রীকে সবক দিচ্ছে যেন, ‘মাথা ফাটবে না। কিন্তু ব্যথা একটুও কম লাগবে না, বিশ্বাস করো! আর যদি বুক আগে পড়ে, তা হলে লাংসে প্রচণ্ড চাপ লাগবে। এত চাপ সইতে পারবে না লাংস। বেলুনের মতন ফেটে যাবে। মানেটা বুঝতে পারছ তো? প্রতিটা নিঃশ্বাসের সাথে রক্ত বের হয়ে আসবে তোমার নাক-মুখ দিয়ে কী ভয়ানক, চিন্তা করো, ম্যা’ম!’

‘এসব কে বলেছে তোমাকে?’

‘আমি জানি।’

‘পণ্ডিত লোক, মনে হচ্ছে!’ বাঁকা সুরে বলল রোজ। ‘সেই তখন থেকে উচিত-অনুচিত কপচাচ্ছ! বিস্তর বই পড়েছ, তা-ই না?’

‘তা পড়েছি,’ সহজ গলায় বলল যুবক। ‘তবে পণ্ডিত-টণ্ডিত কিছু নই, ম্যা’ম। আমি নেভিতে ছিলাম।’

ইশ, কী লজ্জা! কান ঝাঁ-ঝাঁ করে উঠল রোজের। না জেনে লোকটার সম্বন্ধে কত কী ভেবেছে! শত হোক, সেনা অফিসারের মেয়ে সে। শৈশব থেকে কড়া এটিকেটের মাঝ দিয়ে বড় হয়েছে। অথচ শুরু থেকেই দুর্ব্যবহার করে এসেছে সে দেশের জন্যে কাজ করা এই সাবেক ন্যাভাল পারসনের সাথে। কটু কথা শুনিয়েছে। যদিও লোকটা ওর ভাল চাইছে।

অস্বস্তিকর একটা মুহূর্ত।

রোজ নীরব হয়ে গেল। ভাবছে, ‘না জানি কী মনে করছে লোকটা আমাকে!

যুবক অবশ্য মনে করা-করির মধ্যে নেই।

‘তা ছাড়া পানি কী রকম ঠাণ্ডা, জানো, ম্যা’ম?’ বলল সে। রোজ নীচে তাকাল।

ক্ষুধার্ত সমুদ্র অপেক্ষা করে আছে।

‘কী রকম?’ মেয়েটার গলা থেকে উবে গেছে সব ঝাঁজ। বদলে ফুটে উঠল কৌতূহলী শিশুর সারল্য।

‘বরফের মতন, ম্যাম। আমার তো ধারণা, ঠাণ্ডাতেই মরে যাবে তুমি।’

‘ভয় দেখাচ্ছ কেন?’

‘ভয় পাবার কারণ আছে বলেই দেখাচ্ছি।’

‘যে মরতে চাইছে, তার কি এসবে ভয় পাওয়া উচিত?’

‘তুমি মোটেই মরছ না, ম্যা’ম।’

এর পরে কী বলা উচিত, বুঝে পেল না রোজ। ভেতরটা হাতড়ে খুঁজে পেল না বলবার মত কোনও শব্দ বা বাক্য।

এক পা, এক পা করে রেলিং-এর কাছে চলে এল যুবক। হাত দূরত্বে দাঁড়াল রোজের কাছ থেকে। ভয় পাচ্ছিল, প্রতিক্রিয়া দেখাবে মেয়েটা। চটজলদি বলল, ‘ভয় পেয়ো না, ম্যা’ম। আমি তোমাকে ছোঁব না। বিড়িটা ফেলবার জন্য এসেছি।’ ধূম্রশলাকার গোড়া চেপে ধরে আখেরি টান দিল যুবক। আঙুলের এক বিশেষ টোকায় ছুঁড়ে মারল সেটা। ধনুকের মত কোণ সৃষ্টি করে উড়ে গেল সিগারেটের অবশিষ্টাংশ

রোজের দৃষ্টি সেটাকে অনুসরণ করল।

নীচে পড়বার আগেই ঝোড়ো বাতাসের টানে হারিয়ে গেল সিগারেট।

কয়েকটা মুহূর্ত বিনা বাক্য ব্যয়ে পার হলো।

অপ্রাসঙ্গিক ভাবে জিজ্ঞেস করল যুবক, ‘ম্যা’ম, আলটা ক্যালিফোরনিয়াতে গেছ কখনও?’

রোজ মাথা নাড়ল। না। হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন, ভাবছে। জায়গাটা কোথায়, সে ব্যাপারে তার ধারণা নেই কোনও।

‘আমার পছন্দের একটা জায়গা। ওখানে একটা বাড়ি করে বাস করবার স্বপ্ন আমার অনেকদিনের।’

‘সুন্দর জায়গা?’

‘তোমার কেমন লাগবে, জানি না। শীত পড়তে শুরু করেছে এখন ওখানে। তুষার জমছে। এলাকাটা এমনিতে রুক্ষ। তবে এই রুক্ষতারও কিন্তু একটা সৌন্দর্য আছে। ভালই লাগে আমার।’

‘এতই যখন ভাল লাগে, তা হলে চলে গেলে কেন?’

‘ঘুরতে বেরিয়েছিলাম। রুচি পরিবর্তন বলতে পারো।’

‘আমাকে এসব বলছ কেন?’

সত্যি কথাটাই স্বীকার গেল যুবক, ‘ইচ্ছা করল, তাই।’ হাসল। ‘যাক গে, ম্যা’ম। এখন চলে এসো তো, প্লিজ!’

রোজ এখনও দ্বিধাগ্রস্ত।

‘কাম অন, ম্যা’ম। আমি জানি, তুমি লাফ দিতে চাও না। ইচ্ছার বিরুদ্ধে গেছ। আমি হান্ড্রেড পারসেন্ট নিশ্চিত এই ব্যাপারে।’

‘কী করে নিশ্চিত হলে?’

‘দিলে অনেক আগেই লাফ দিতে, ম্যা’ম। আমার বকবকানি শুনবার জন্য এতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে না।’

আসলেই কি তা-ই? নিজেকে জিজ্ঞেস করল রোজ। জবাব পেল না।

রেলিং ধরে রাখতে রাখতে ব্যথা হয়ে গেছে হাত। খসে যাবে যে কোনও মুহূর্তে। কবজি, কনুইয়ের ভাঁজ আর কাঁধের জয়েণ্টে টনটন করছে। মাংসপেশিতে খিঁচ ধরে যাবার অবস্থা। অনেকক্ষণ এক ভাবে দাঁড়িয়ে থাকবার ফলে খিল ধরে গেছে পায়ে।

রেলিং ছেড়ে দিলেই হয়! কিন্তু দোটানায় বেঁধে ফেলেছে ওকে পিছুটান।

যুবক কী বুঝল, কে জানে। একটা হাত বাড়িয়ে দিল। ‘আমার হাতটা ধরো, ম্যা’ম। তোমাকে টেনে তুলব আমি।’

দীর্ঘ একটা মুহূর্ত লোকটার চোখের দিকে তাকিয়ে রইল রোজ।

বাড়ানো হাতটা ঝাঁকাল যুবক। ‘কই, ধরো!’

‘অলরাইট!’ কেঁপে গেল রোজের গলা।

রেলিং খামচে ধরা একটা হাত মুক্ত করল সে। হাতটা লম্বা করে দিল। যুবকের হাত ধরবার জন্যে। অথবা লোকটা যেন তার হাত ধরতে পারে, সেই জন্যে।

ভীত পাখির ছানার মত থরথর করে কাঁপছে রোজের হাত। অল্পের জন্যে যুবকের হাতের নাগাল পেল না।

এক পা এগোল যুবক পাশে।

আঙুলে ছোঁয়াছুঁয়ি হলো ওদের।

আরেকটু এগিয়ে রোজের হাত ধরে ফেলল যুবক।

ঘুরতে আরম্ভ করল রোজ। তাকাবে না… তাকাবে না করেও নীচের দিকে না চেয়ে পারল না।

কত ওপরে রয়েছে সে!

কত নীচে পানি!

ব্যাপারটা চিন্তা করে ঘুরে উঠতে চাইল মাথা। ব্যস্তসমস্ত হয়ে রেলিং ধরে সামাল দিল নিজেকে।

রোজের মুখ এখন জাহাজের দিকে।

ওকে সুস্থির করে তুলতে অন্য প্রসঙ্গে চলে গেল যুবক, ‘কী নাম তোমার, ম্যা’ম?’

‘রোজ… রোজমেরি বেডফোর্ড।’

‘আরেহ! আমার নামের সাথে মিল! আমার নাম মিলফোর্ড, জেরার্ড মিলফোর্ড।’

‘আইরিশ তুমি?’

‘ইয়েস, ম্যা’ম।’

‘প্লিজড টু মিট ইউ, মিস্টার মিলফোর্ড।’

‘প্লিজড টু মিট ইউ, ম্যা’ম।’

ওপরের ধাপে পা দিল রোজ। শরীরের ভর চাপাতেই পিছলে গেল পা।

ষোলো

নিজের ওপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারাল রোজ। ফাঁকা হয়ে গেল মাথার ভেতরটা। পেটের ভেতরে নাগরদোলায় চড়বার অনুভূতি। বরফশীতল একটা হাত খামচি মেরে ধরল যেন তার হৃৎপিণ্ড।

মেয়েটা পড়ে যাচ্ছে, বুঝতে পেরে আতঙ্কিত হয়ে পড়ল জেরার্ড। অজান্তেই শক্ত হয়ে উঠল তার হাতের পেশি।

কিন্তু রোজের পতনোন্মুখ শরীরের ওজন যুবকের শক্তির চাইতে বেশি।

হেঁচকা টানে রেলিং-এর সাথে সেঁটে গেল জেরার্ড। রডের ফাঁক গলে বেরিয়ে গেল তার হাত। রোজের একটা হাত ছুটে গেল।

টানটা এত জোরে লেগেছে যে, ফুসফুসের সব বাতাস বের হয়ে গেছে। বাতাস ঢোকাতে গিয়ে দেখল, অন্য হাতও পিছলে সরে যাচ্ছে মেয়েটার।

সংবিৎ হারাল না জেরার্ড। আরও জোরে আঁকড়ে ধরতে চাইল রোজের হাত। চাপ বাড়াল। কিন্তু ঘামে ভেজা মুঠো নেমকহারামি করছে তার সাথে।

বাতাস।

বাতাস।

বাতাস।

ঠাণ্ডা বাতাস সংবিৎ ফিরিয়ে আনল রোজের। সচল হলো মগজ। সে-ও দেখল, পিছলে যাচ্ছে তার হাত।

অসহায় লাগল নিজেকে। বেদিশা হয়ে গেল। চোখে ভীত, বুনো দৃষ্টি। বাঁচবার তাগিদে খোলা হাতটা ধরে ফেলল ডেকের কিনার। চিৎকার বেরিয়ে এল গলা চিরে।

উড়নচণ্ডী বাতাস উড়িয়ে নিয়ে গেল সেই চিৎকার।

রোজ ডেক ধরে ফেলায় জেরার্ডের হাতের ওপর থেকে ভার কমে গেল অনেকখানি। শীগগির আরেক হাত দিয়ে ধরে ফেলল সে মেয়েটার কবজি।

‘নোড়ো না!’ বলল সে দাঁতে দাঁত চেপে, ‘একদম নড়াচড়া করবে না!’

খুব সাবধানে, ইঞ্চি-ইঞ্চি করে রোজকে তুলে আনতে শুরু করল জেরার্ড। চোয়াল শক্ত। মুখের পেশিতে কাঠিন্য। চাপতে চাপতে ব্যথা হয়ে গেছে দাঁত।

সাংঘাতিক দুরূহ আর যন্ত্রণাদায়ক কাজ। পঙ্গু পায়ে দেহের ভর চাপাতে পারছে না বলে খবর হয়ে যাচ্ছে জেরার্ডের। বাহুর মাংসে খিঁচুনি উঠে গেছে। ফুসফুস দুটো যেন ফেটে যাবে।

রোজের মনে হচ্ছে, ওর কবজিটা বুঝি গুঁড়ো হয়ে যাবে! এত জোরে চেপে ধরেছে যুবক! কিন্তু একচুল ঢিলে করবার উপায় নেই। ব্যথা সহ্য করছে সে ঠোঁট কামড়ে।

রেলিং-এর প্রথম ধাপটা নাগালে আসতেই ধরে ফেলল সেটা রোজ।

ঘন ঘন দম নিচ্ছে জেরার্ড। হাপরের মত ওঠানামা করছে বুক। প্রচণ্ড পরিশ্রমে কাহিল। হৃৎপিণ্ডটা বের হয়ে আসতে চাইছে যেন বুকের ভেতর থেকে।

তবে থামলে চলবে না!

আবার শুরু হলো কষ্টকর প্রচেষ্টা।

কিন্তু যার শুরু আছে, তার শেষও আছে। অবশেষে ডেকের প্রান্তে পা রাখতে সক্ষম হলো রোজ।

জেরার্ডও ফুরসত পেল। রোজের কটি জড়িয়ে ধরে আছে সে রেলিং-এর ফাঁক দিয়ে।

প্রচণ্ড উত্তেজনার পরে হাঁ করে বাতাস গিলছে দু’জনে।

পারল তা হলে!

স্বাভাবিক হতে কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিল ওরা।

ক্রুদ্ধ গর্জন করছে সাগর। মুখের গ্রাস হাতছাড়া হয়ে যাওয়ায় ফুঁসছে যেন।

নিজের চেষ্টাতেই এবার বাকিটা উঠতে পারল রোজ। থেমে থেমে উঠল। রেলিং টপকাল।

পুরোটা সময় সতর্ক রইল জেরার্ড। ধরে থাকল রোজকে। ঠিক জায়গাতে পা পড়ছে কি না, খেয়াল রাখল। পাছে আবার কোন্ অঘটন ঘটে।

শেষ ধাপে নামবার আগেই ফের পা হড়কাল রোজ।

এবার আর সামলাতে পারল না জেরার্ড। চেষ্টাও করল না। তার হাত-পায়ের পেশিগুলো ক্লান্তির চরমে পৌছে গেছে।

হুমড়ি খেয়ে চিতপাত হলো সে ডেকে।

জেরার্ডের গায়ের ওপরে পিঠ দিয়ে পড়ল রোজ। আরেকটা চিৎকার বের হয়ে এল তার মুখ দিয়ে।

ওভাবেই একটা মিনিট পড়ে রইল দু’জনে। হাঁপাতে লাগল। তারপর গড়িয়ে সরে এল রোজ জেরার্ডের ওপর থেকে। উপুড়

শুয়ে রইল পাশে।

বেশি ওপর থেকে পড়েনি। তাই ব্যথা বিশেষ পায়নি দু’জনের কেউ। তাকিয়ে রয়েছে পরস্পরের দিকে।

একান-ওকান হাসল জেরার্ড। ‘ভালই সার্কাস দেখালাম আমরা, কী বলো!’

সতেরো

ঘুমের মধ্যেই শব্দ করে হেসে ফেলল রোজমেরি। টুটে গেল তার ঘুমটা।

চোখ মেলতে দৃষ্টি পড়ল গিয়ে ছাতের কড়িবরগাতে। সেখান থেকে জানালায়।

মৃদু-মন্দ বাতাসে কাঁপতে থাকা পপলার গাছের পাতায় সূর্যের নরম আলো দোল খাচ্ছে। জাফরি কাটা নকশা খেলছে বেডকাভারের ওপরে।

এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিল রোজমেরি। ঘুমের মধ্যে স্মৃতিচারণ করেছে তার সক্রিয় মগজটা। ফিরিয়ে এনেছে হারানো অতীত। ফিরিয়ে এনেছে জেরিকে। তাদের প্রথম দেখা হবার দিনটাকে।

কত আগের ঘটনা! অথচ এখনও কী জীবন্ত! হীরের মত ঝকঝক করছে।

স্বপ্নের রেশ রয়ে গেছে চোখে। জীবনের পুরানো অধ্যায়ের পৃষ্ঠাগুলো উল্টে চলল রোজমেরি। ঠোঁটে মুচকি হাসি। কিন্তু অন্তরটা তার গভীর বিষাদে ছাওয়া। বুকের একেবারে তলদেশ থেকে উঠে এল একটা দীর্ঘশ্বাস।

জেরির জন্যে?

না, কেবল জেরির জন্যে নয়। সব কিছুর জন্যে। যা সে হারিয়ে এসেছে পেছনে।

বাবার জন্যে।

পুরানো রোজের জন্যে।

পুড়ে যাওয়া শস্যের জন্যে।

আগুন লাগাটা এই অঞ্চলে নৈমিত্তিক ঘটনা। কখন কার নসিব পুড়বে, কেউ বলতে পারে না। কিছু করবারও নেই।

ঝোপ-জাতীয় এক ধরনের গাছ জন্মায় পাহাড়ে। চ্যাপারাল। তিন থেকে বারো ফুট লম্বা হয়। পাহাড়ের আগামাথা ছেয়ে ফেলে এই চির-সবুজ উদ্ভিদ। খুদে খুদে শক্ত পাতা আর আঁকাবাঁকা ডালপালা পরস্পরের গায়ে লেগে তৈরি হয় অপ্রতিরোধ্য বুনোট।

দাবানল ছড়াবার ওস্তাদ এই গাছ। আগুনে কাঠ যোগ করে ছোট ধরনের এক জাতের ওক আর মেহগনি। ফলটা হয় ভয়ঙ্কর।

গ্রীষ্মের কুকুর পাগল করা তাপমাত্রাই প্রধানত আগুনের দোসর। কালেভদ্রে শরৎ-হেমন্তে। একবার লাগল, তো লাগল! তা-থই তা-থই উদ্বাহু নৃত্য করতে থাকে। আর বাতাস পেলে তো কথাই নেই! পানির সাধ্য নেই, তাকে থামায়।

গায়ের ওপর থেকে ব্ল্যাঙ্কেট সরাল রোজমেরি। বিছানা ছাড়ল। স্লিপার পায়ে গলিয়ে জানালার সামনে এসে দাঁড়াল।

দিগন্তপ্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে পর্বতশ্রেণী।

অগণন গিরিখাতের দেখা মিলবে ওখানে। স্রোতস্বিনী বয়ে চলেছে কোনওটার ভেতর দিয়ে। এই সব পাহাড়ি নদীর পাড়ে জন্মায় ম্যানজানিটা, ইউক্যালিপটাস, উইলো।

সমতলে বিছিয়ে রয়েছে অন্তহীন তৃণভূমি। হাজার হাজার একর জুড়ে কোমর-সমান উঁচু প্রেয়ারি গ্রাস। তাকালেই মনে হবে, সবুজ ভেলভেটের তৈরি একটা কার্পেট কলকল করে ভাসছে। যেদিকে তাকানো যায়, যতদূর তাকানো যায়, কেবল সবুজ আর সবুজ। ছবির মত সুন্দর। স্বর্গতুল্য। তরতাজা একটা সুরভি যেন সব সময় মিশে আছে বাতাসে।

কোথাও ঘন হয়ে জন্মায় বাফেলো ঘাস। গরু-বাছুরের উত্তম খাবার। ভীষণ শক্ত এই ঘাস মাটির অনেক গভীরে শেকড় গেড়ে বসে। বাথানের সতেজ ঘাস খেয়ে দিন দিন নধর হয়ে ওঠে প্রাণীগুলো। হাড্ডিসার শরীর ক’দিনেই তেলতেলে হয়ে যায়।

দেদারসে ইয়েলো পাইনও জন্মায় ওই চারণভূমিতে। বিশাল এক-একটা বৃক্ষ।

আর আছে শস্যখেত।

হরেক মৌসুমী ফসল ফলায় চাষিরা। গম। যব। ভুট্টা। জই। গাজর। বিট। টমেটো। শিম। শালগম। মুলো। সারা বছরের জন্যে আলু, পেঁয়াজ, লেটুস, কুমড়ো, মরিচ— এসব। যারা একটু উচ্চাকাঙ্ক্ষী, তারা লাগায় স্ট্রবেরি কিংবা পিচ ফল।

এক কথায়— অফুরান সম্ভাবনার সৌরভ এখানকার বাতাসে।

কিন্তু আগুন যখন লাগে, তখন এই বেহেশতই পরিণত হয় দোজখে।

সূচনা পাহাড় থেকে। গাছ থেকে গাছ হয়ে সাজানো-গোছানো সমতল ভূমিতে নেমে আসে। চোখের পলকে ছড়িয়ে যায় সবখানে। শুকনো বাতাসে স্ফুলিঙ্গ উড়তে থাকে। অগ্নিদানবের লকলকে জিহ্বা গ্রাস করে নেয় কারও-না-কারও ভবিষ্যৎ।

মড়ার ওপরে খাঁড়ার ঘার মত একের পর এক গড়িয়ে আসে টাম্বলউইড। লতার তৈরি এই বল এমনিতে খুব সাধারণ। বাতাসের ঠেলায় এদিক-সেদিক গড়িয়ে যায়। দাবাগ্নির সময় সেটাই হয়ে ওঠে জ্বলন্ত বিভীষিকা। হুঁশিয়ার না থাকলে বাড়িঘর কিংবা খড়ের গাদা জ্বালিয়ে দিতে পারে এই আগুনের গোলা।

জই বপন করেছিল সে। স্বপ্নের বুনিয়াদ। তরতর করে বেড়ে উঠছিল চারাগুলো উর্বর ভূমিতে।

কপালে সইল না।

পাহাড়ের ধারে হঠাৎ ডুবে যাওয়া সূর্যের মত আগামীর সুখসূর্যও অস্তমিত হয়ে গেল।

দীর্ঘশ্বাস।

বুকের ভেতরে এক গভীর শূন্যতা।

গভীর হাহাকার।

কেন এমন হয়?

কেন জীবন পূর্ণতার এত কাছাকাছি এসে ফের শূন্য হয়ে যায়?

বড় ছেলেটাও কাছে নেই।

বড্ড চিন্তা হয় ওর জন্যে। কোথায় আছে, কেমন আছে, কে জানে! কী খাচ্ছে, না খাচ্ছে! পরিবারের সুখের জন্যে ঘর ছেড়েছে, এটা চিন্তা করলেই চিনচিন করে ওঠে বুকের মাঝখানে। বিদেশ-বিভুঁইয়ে না জানি কত কষ্ট হচ্ছে তার!

সে ফিরে এলে কি দুঃসময় কাটিয়ে উঠতে পারবে তারা?

নিশ্চয়ই পারবে! ছেলে নিশ্চয় খালি হাতে ফিরবে না!

তবে ছেলের এখানে থাকাটা তার কাছে টাকাকড়ির চাইতেও বড়। জো পাশে থাকলে কোনও কিছুকেই সে ভয় করে না। যেমন করত না জেরি থাকতে।

কবে আসবে জো?

স্লিপিং গাউন পাল্টে পোর্চে এল রোজমেরি। ধীর পায়ে বারান্দার এধার-ওধার পায়চারি করতে লাগল।

সকালবেলার মিষ্টি রোদ তেরছা ভাবে সম্মুখের খোলা বিস্তৃতির ওপরে পড়েছে। রাতের হিম কেবলই রূপ নিয়েছে মোলায়েম উষ্ণতায়।

সকালের পরিচিত শব্দগুলো শুনতে লাগল মেরি কান পেতে।

ঝিরঝির করে বাতাস বইছে।

লার্ক পাখি মনের আনন্দে গাইছে তার নিরবচ্ছিন্ন গান।

গুরুগম্ভীর স্বরে ব্যাং ডাকছে।

কোথাও কোনও কাঠঠোকরা গাছের গায়ে কোটর খুঁড়ছে টকটক করে।

একটা গরু হাম্বা করে উঠল।

আস্তাবলে হালকা ডাক ছাড়ছে ঘোড়া।

ঘাস-বিচালির সোঁদা গন্ধটা বুক ভরে টেনে নিল মেরি। আবেশে চোখ বুজে এল তার।

চোখ খুলতেই দুই চাকার ঘোড়ার গাড়িটা দেখতে পেল সে। দিগন্তের ওপার থেকে উদয় হয়েছে।

এদিকেই আসছে ঘোড়াটা। দুলকি চালে। অনেকটা দূরে রয়েছে এখনও। চেহারা-সুরত বোঝা যাচ্ছে না সওয়ারিদের। শুধু বুঝতে পারছে, তিনজন মানুষ বসে আছে গাড়িতে।

কারা?

এত সকালে কী?

উৎকণ্ঠার সাথে প্রতীক্ষা করতে লাগল রোজমেরি।

এক্কা গাড়িটা একটু কাছে আসতে চালকের আসনে বসা স্যাম ফুলারকে চিনতে পারল সে।

চেহারা নয়, বিশালাকার সমব্রেরো হ্যাটটাই তার পরিচয়। এলাকায় ফুলারই একমাত্র ব্যক্তি, যে মেকসিকান না হয়েও মেকসিকান টুপি মাথায় দেয়। ওল্ডটাইমারের যুক্তি: প্রয়োজনেই পরে সে এটা, ছায়া বেশি পায় বলে। বয়স হয়েছে তো, শরীরটা আরাম চায়।

গাড়িটা তার।

আরোহী দু’জন-

জেসাস!

নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে ভরসা হচ্ছে না রোজমেরির।

জো! জো ফিরে এসেছে!

সাথের মেয়েটা কে?

আঠারো

ছেলে বিয়ে করেছে। সুন্দরী বউ নিয়ে এসেছে দূরদেশ থেকে। – এটাই প্রথম মাথায় এল রোজমেরির।

কোর্টইয়ার্ডে এসে থামল স্যাম ফুলারের কার্ট।

সাত-সকালে কাউকে দেখবে বলে আশা করেনি জোহান। মায়ের চোখে চোখ পড়তে হাসল।

রোজমেরি মিলফোর্ডের অভিব্যক্তিতে হর্ষ ও বিহ্বলতার সহাবস্থান।

জোহান গাড়ি থেকে নামল। এলেনাকে নামতে সাহায্য করল।

দু’জনে পা বাড়াল রানশহাউসের দিকে।

আঙিনায় নামল রোজমেরিও। এগিয়ে গেল কয়েক কদম।

কাছাকাছি হতে জড়িয়ে ধরল তাকে জোহান। ধরে রাখল কিছুক্ষণ। কোনও কথা বলল না। মাকে সে যে কতখানি মিস করেছে, বোঝাতে চাইল যেন নীরবে।

খুশির চোটে এক ফোঁটা জল বেরিয়ে গেল রোজমেরি মিলফোর্ডের চোখ থেকে।

সঙ্কোচের সাথে নিরীক্ষণ করছে তাকে এলেনা। মহিলা অপরূপ সুন্দরী। ওজনদার ব্যক্তিত্বের একটা ফ্রেম দিয়ে বাঁধানো চেহারাটা। অজানা ব্যথা লুকিয়ে আছে যেন নীল চোখের গভীরে।

জোহান বা রোজমেরি নয়, সে-ই প্রথম কথা বলে উঠল। ‘আমায় মাপ করুন, সেনিয়োরা!’ ভীরুতা প্রকাশিত হলো তার বলায়। ‘আমি বোধ হয় আপনাদের ঝঞ্ঝাটে ফেলে দিলাম!’

পূর্ণ দৃষ্টিতে মেয়েটিকে দেখল রোজমেরি। সূর্যের কিরণ তার ফরসা মুখটার ওপরে পড়ে এক ধরনের স্বর্ণালী প্রভা সৃষ্টি করেছে। কালো চুল ঠিক যেন কালো নয়, জলপাইয়ের মত সবজেটে দ্যুতি ছড়াচ্ছে।

‘নাম কী তোমার, মেয়ে?’ জিজ্ঞেস করল প্রৌঢ়া।

‘এলেনা মনটেরো,’ কুণ্ঠিত স্বরে জবাব দিল এলেনা।

চোখের ইশারায় ছেলেকে দেখাল মহিলা। ‘ও কি তোমাকে বলেছে, তুমি কিছু ভুল করেছ?’

এলেনা জোহানের দিকে তাকাল। ‘না, সেনিয়োরা।’

‘ব্যস, হয়ে গেল,’ নরম স্বরে ওকে আশ্বস্ত করল রোজমেরি। ‘এরপরে নিজেকে তোমার অবাঞ্ছিত মনে করবার কোনও কারণ দেখছি না, বাছা।’

জোহান ও এলেনা ফের নজর বিনিময় করল। জোহানের চোখের ভাষা ‘কী, বলেছিলাম না?’ গোছের।

চালকের দিকে দৃষ্টি দিল রোজমেরি। ‘হোয়াট’স আপ, স্যাম?’

প্রত্যুত্তরে বাউ করল কোচোয়ান। মুখভর্তি ধবল দাড়ি নিয়ে একগাল হাসল।

‘কফি চলবে তো?’

বাঁ হাতের তালুতে ঘুষি মারল বুড়ো। ‘দৌড়াবে, ম্যা’ম।’

.

হোম, সুইট হোম।

পারলারে চোখ বোলাচ্ছে জোহান।

আগুন জ্বলছে ফায়ারপ্লেসে। ম্যানটেলপিসে রাখা একটা স্কেচ। পাশে ছুটন্ত ঘোড়ার প্রতিকৃতি। চীনা মাটির তৈরি।

জানালার নীচে বুককেস। তাতে কিছু বই।

দেয়ালে ঝোলানো এলক হরিণের মাথা। সুদৃশ্য নেভাজো ইনডিয়ান গালিচায় ঢাকা মেঝে। –সব কিছুতে চেনা, ঘরোয়া আমেজ।

নিজের বাড়িতে ফিরবার মধ্যে শান্তি আছে। আছে স্বস্তি। যদিও এখন উপভোগের সময় নয়। তারপরও…

এলেনার ওপরে চোখ পড়তে দেখল, সে-ও তাকিয়ে দেখছে চতুর্পাশে।

রোজমেরি মিলফোর্ডের সুস্বাদু পাই-এর সদ্ব্যবহার সম্পন্ন হবার আগে দরকারি কোনও কথা হলো না।

কফির ফাঁকে জিজ্ঞেস করল জোহান, ‘জেসকে দেখছি না।’

‘আছে। ঘুমাচ্ছে।’

পরিস্থিতি সম্পর্কে ছেলেকে অবহিত করল রোজমেরি।

চুপচাপ শুনল জোহান।

ব্যাকুল নয়নে তার দিকে চেয়ে আছে মিসেস মিলফোর্ড। আশা, ছেলে তার এই ক্রাইসিস থেকে উত্তরণের পথ বের করে ফেলবেই। জোহানের ওপরে তার অগাধ বিশ্বাস। নানা দেশ ঘুরেছে সে। নানান দিক দেখেছে জীবনের। আয়ত্ত করেছে সহিষ্ণুতা আর দৃঢ় মনোবল। সহজে নিরুদ্যম বা অবসাদগ্রস্ত হয় * না সে। তার মতামতের দাম আছে। অনেক ভাবনা-চিন্তা করে কথা বলে ছেলেটা। ওর বাবার মত। যুক্তি দিয়ে। আগাপাছতলা বিচার করে।

ভাবনার ঝড় চলছে জোহানের মগজে। আড়াই হাজার ডলার! কম নয়। চকিতে নিজের পকেটের হালত পর্যালোচনা করল। কুড়িয়ে-বাড়িয়ে শ’ তিনেক হবে। এই টাকায় কী এমন উনিশ- বিশ ঘটবে অবস্থার?

খুব বেশি বন্ধুবান্ধব নেই তাদের। আত্মীয় স্বজন তো নেই- ই। যারা আছে, তাদের কেউই সচ্ছল নয়। আয় খুব কম। সঞ্চয় নেই, বলতে গেলে। ধার পাবার রাস্তা বন্ধ।

একটা কাজ অবশ্য করা যায়। জলমানবীকে বিক্রি করে দিলে-

কথাটা মনে আসতেই জোহানের বুক খাঁ-খাঁ করে ওঠে। ওরকম একটা জলযানের মালিকানা জোটে কয়জনের বরাতে? এই রানশ যেমন, তেমনি স্কুনারটাও তার কাছে বিরাট ব্যাপার। বাবার স্মৃতি জড়িয়ে আছে এর সাথে। মরে গেলেও ওটা সে বিক্রি করতে পারবে না।

কীসে দেনা শোধ করবে তা হলে?

ভেবে কূল-কিনারা পাচ্ছে না জোহান।

‘কয়দিন গা ঢাকা দিলে কেমন হয়?’ বলল সে প্রস্তাব রাখবার সুরে।

মিসেস মিলফোর্ডের প্রশ্ন, ‘তাতে কি কোনও লাভ হবে?’

‘একেবারেই যে হবে না, তা নয়। এই রানশ তোমার সম্পত্তি। যতক্ষণ না জিল ট্যাটামকে লিখেপড়ে দিচ্ছ, ততক্ষণ এটা তোমারই থাকবে। আইনত। মুখে যতই হম্বিতম্বি করুক, আইনের কাছে তার হাত-পা বাঁধা। আমরা যদি আত্মগোপন করি, তা হলে কাগজে সই করাবার জন্য পাচ্ছে কোথায় সে তোমাকে? অবশ্য এটা মন্দের ভাল,’ স্বীকার করল জোহান। ‘তার পরেও…’ ক’দিনের না কামানো দাড়ি চুলকাল সে চিন্তাক্লিষ্ট মুখে। ‘জিল ট্যাটামকে যদি কয়েকটা দিন দেরি করিয়ে দেয়া যায়, কিছু একটা ব্যবস্থা করে ফেলব এই ফাঁকে।’

এই জন্যেই জো হচ্ছে জো! প্রশস্তিসূচক সূক্ষ্ম হাসির আভাস প্রতীয়মান হলো রোজমেরি মিলফোর্ডের মুখমণ্ডলে। গতকাল পর্যন্ত মনে হচ্ছিল, নৈরাশ্য ছাড়া কিছু নেই তার সামনে। অথচ এসেই একটা রাস্তা বাতলে দিল ছেলেটা।

জ্যাসন মিলফোর্ডের, ঋজু শরীরটা দেখা গেল বৈঠকখানার দরজায়। ভেতরে এল সে।

দুই ভাইয়ের শারীরিক গঠন প্রায় একই রকম। একই সমান লম্বা। তফাত বলতে, গায়েগতরে কিছুটা ভারী বড় ভাই।

‘গলার আওয়াজ শুনলাম।’ ফোলা চোখের কারণে পর্যুদস্ত দেখাচ্ছে জ্যাসনকে। সহাস্যে বলল, ‘কল্পনাই করিনি, তোমাকে দেখব।’

চেয়ার ছেড়ে উঠল জোহান। ছোট ভাইকে বুকে জড়িয়ে ধরল।

ভাইয়ের কাঁধের ওপর দিয়ে অপরিচিত একটা মেয়েকে দেখে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল জ্যাসন।

পিঠে হালকা চাপড় দিয়ে তাকে ছেড়ে দিল জোহান। কুশল জিজ্ঞাসা করল, ‘কেমন আছিস?’

‘ভাল। তুমি?’

‘এই তো।’

‘আর তোমার ব্যবসা-বাণিজ্য?’

‘ভাল না,’ মলিন মুখে বলল জোহান। ‘কপাল খারাপ, বুঝলি? ফারের দর পড়ে গেছে।’ ঠোঁট উল্টে মাথা নাড়ল। ‘কিছুতেই সুবিধা করতে পারলাম না।’

‘মন খারাপ কোরো না, দাদা,’ সান্ত্বনা দিল জ্যাসন, ‘এমনটা হতেই পারে।’

ভাইয়ের নজর সরে যেতে জোহান বলল, ‘ও হচ্ছে এলেনা। কিছুদিন আমাদের সাথে থাকবে।’

মনে ফেনিয়ে ওঠা কৌতূহলের ঢেউ চোখের দৃষ্টিতে ফুটতে দিল না জ্যাসন। পরেও জানা যাবে। মাথা ঝোঁকাল সে মেয়েটার উদ্দেশে। ‘গ্ল্যাড টু মিট ইউ, ম্যা’ম।’

‘গ্ল্যাড টু মিট ইউ, সেনিয়োর!’ সসম্ভ্রমে বলল এলেনা।

টেবিলে যোগ দিল জ্যাসন।

ওর জন্যে পট থেকে কফি ঢালল রোজমেরি। মগ এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘জেস, জো একটা বুদ্ধি দিয়েছে।’

‘তা-ই নাকি!’ ঔজ্জ্বল্য খেলল জ্যাসনের চেহারাতে। ‘বলেছিলাম না, মা, পারলে দাদাই পারবে!’

কিন্তু শুনবার পর ততটা খুশি হতে পারল না সে। আত্মগোপন করবার কথা ভাবতেই আত্মসম্মানে লাগছে তার।

‘তাই বলে পালাব?’ মনের ভাব প্রকাশ করাটাই সমীচীন মনে করল জ্যাসন।

চেয়ারে হেলান দিল জোহান। ‘ওভাবে দেখছিস কেন ব্যাপারটা? অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখাটাই এখন আসল।

ডান হাতের তর্জনি আর বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে শুভ্র গোঁফের প্রান্ত মোচড়াচ্ছে স্যাম ফুলার। ‘সোনার কথা বলছ না কেন তোমরা?’

‘সোনা?’ প্রতিধ্বনি তুলল জোহান। ‘কীসের সোনা?’

কথাটা ধরল জ্যাসন। ‘দাদাহ!’ প্রায় চেঁচিয়ে উঠল। ‘ক্যালিফোরনিয়াতে সোনা পেয়েছে কেউ, এ কথা বিশ্বাস করো?’

‘এক ভ্যাকুয়েরো নাকি পেয়েছিল।’

‘কার কাছে শুনলে?’

‘বইয়ে পড়েছি।’

একদিকের নাক টানল জ্যাসন। ‘কোথায়- মানে, ঠিক কোন্ জায়গায় পেয়েছে, সেটা লেখা ছিল?’

‘না। গল্পটা এরকম: বিশাল এক অ্যালকেলাই বেসিনে সে পথ হারায়। ক্ষুৎপিপাসায় রুগ্ন হয়ে পড়ে। কাঁটাঝোপ ছাড়া সেখানে আর কোনও গাছ জন্মায় না। লোকটা ভাবল, গাছের শিকড় নিশ্চয় খাওয়া যাবে। একটা ঝোপ উপড়ে ফেলল সে। দেখে, শিকড়ে আটকে আছে সোনার পিণ্ড।’

‘ইনটারেস্টিং তো!’

‘হ্যাঁ। সত্য-মিথ্যা জানি না।’

‘বাবা পেয়েছে সোনা!’ বোম ফাটাল জ্যাসন।

মুখের ভাব বদলে গেল জোহানের। ‘কী!’

‘মা, বলো না!’

বলবার জন্যেই অপেক্ষা করছিল রোজমেরি।

শুনতে শুনতে বিস্ময়ের ছাপ পড়ল জোহানের চেহারাতে। দুয়েকটা প্রশ্ন করল। মায়ের কথা শেষ হলে বলল, ‘আশ্চর্য! এদ্দিন জানলাম না কেন?’

‘অবাক আমিও হয়েছি,’ ভাইয়ের সুরে সুর মেলাল জ্যাসন। ‘গল্প তো শুনেছি কতই। বিশ্বাস করিনি কোনও দিন। কালকে মাকে বলছিলাম, সোনা পেলে রানশটা বাঁচানো যেত। স্রেফ কথার কথা ছিল সেটা। তারপরে শুনি এই ঘটনা।’

নীচের ঠোঁটে চিমটি কাটছে জোহান। জ্যাসনের কথায় অন্যমনস্ক ভাবে মাথা নাড়ল।

হেসে বলল জ্যাসন, ‘তুমি কী ভাবছ, আমি জানি। সোনার সন্ধানে বেরোতে চাও তো?’

‘কেন নয়?’

বুড়ো স্যাম বলে উঠল, ‘আমিও এই কথাটাই বলতে চাইছিলাম।’

‘বাবা যে সোনা পেয়েছিল, তুমি জানতে?’ বুড়োকে জিজ্ঞেস করল জোহান।

‘হুম, জানতাম।’

‘কোথায় পেয়েছে, সেটা জানো?’

‘সঠিক জায়গাটা বলতে পারব না,’ নিরাশ করল ফুলার। ‘তোমার মা যা বলল, আমিও তা-ই জানি। উত্তরের পাহাড়ে।’

একবার মায়ের দিকে, একবার স্যাম ফুলারের দিকে তাকাল জোহান।

‘ব্যাপারটা এত সহজ নয়,’ বলতে বলতে মাথা নাড়ে জ্যাসন। ‘পাহাড় তো আর একটা নয়। তার উপরে আছে অগণিত গলি-ঘুপচি। সারা জীবন ধরে সুঁই-খোঁজা খুঁজলেও দেখে শেষ করতে পারব না। শেষটায় পথ হারিয়ে মরব।’

‘তারপরও আমি একবার চেষ্টা করে দেখতে চাই,’ এখনই

হাল ছাড়তে নারাজ জোহান।

‘কী করবে? পাহাড় চষে বেড়াবে?’

‘সেটা তো সম্ভবই নয়।’

‘আদৌ কিছু আছে কি না এখন সেখানে, তারই বা নিশ্চয়তা কোথায়?’ সংশয়ভরা কণ্ঠে বলল জ্যাসন। ‘বাবা তো গিয়েছিল অনেক বছর আগে। এরপরে কি সেখানে আর কেউ যায়নি? আমার তো মনে হয়, গেছে। নিশ্চয় সাফ করে ফেলেছে সব সোনা।’

ভাবছে জোহান। অমূলক না-ও হতে পারে আশঙ্কাটা।

‘আরেকটা কথা ভাবো, দাদা,’ শেষ হয়নি জ্যাসনের বক্তৃতা। ‘বাবা কেন আর সেখানে গেল না! সোনা থাকলে যেত নিশ্চয়। সোনার নেশা তো শুনেছি সাংঘাতিক হয়। গোল্ড ফিভার, না কী জানি বলে!’

‘তোর বাপ লোভী ছিল না, জেস!’ ভর্ৎসনার সুরে বলল রোজমেরি।

‘জানি, মা।’ শেষ চুমুক দিয়ে মগ নামিয়ে রাখল জ্যাসন। ‘আমরা সবাই জানি, কেমন মানুষ ছিল বাবা। আমি ওই লোভের কথা বলিনি। বলেছি অ্যাডভেঞ্চারের কথা। বাবার একটা অভিযানপ্রিয় মন ছিল। রোমাঞ্চের লোভেই সেখানে যেত বাবা।’ সমর্থন পাবার আশায় ভাইয়ের দিকে তাকাল সে। ‘যদি সোনা থাকত।’

‘এই আলভারো লোকটাকে খুঁজে পেলে হত,’ জোহান বলল।

‘হোপলেস ব্যাপার!’ জ্যাসনের স্বর নিরাশায় তেতো। ‘কোনও সূত্রই নেই!’

স্যাম ফুলার মুখ খুলল আবার, ‘আলভারোর ব্যাপারে আমি বোধ হয় সাহায্য করতে পারব।’

জ্যাসনের বুকের রক্ত ছলকে উঠল।

উনিশ

‘স্যাম, তুমি চেনো তাকে?’ ব্যগ্র ভাবে জিজ্ঞেস করল রোজমেরি।

‘বাহ, চিনব না! আমার গাড়িতে চড়েছে না সে!’

‘এতক্ষণে বলছ এ কথা!’ দেঁতো হাসি হাসছে জ্যাসন।

‘ওই পাহাড়ে যাবার সময়ও কি তোমার গাড়িতে উঠেছিল?’ প্রথমেই কাজের কথা জিজ্ঞেস করল জোহান।

‘ইয়েপ।’

‘বাবা আর আলভারো?’

‘হুম।’

‘পাহাড়ের গোড়ায় নেমে গেছে, ঠিক?’

‘একদম ঠিক।’

‘আলভারো কোথায় থাকে, জানো?

‘জানি। মানে, জানতাম। বহু বছর লোকটার কোনও খবর পাইনি আমি। এখনও সে ওখানে আছে কি না, বলতে পারব না।’

‘মরে-টরে যায়নি তো আবার!’ বলে উঠল জ্যাসন।

‘অসম্ভব নয়, বলল বুড়ো।

কত বয়স হতে পারে লোকটার?’

‘ম্‌ম্‌… শেষ যখন তাকে দেখি, তখন তার বয়স ছিল আমার এখনকার বয়সের সমান।’

‘সেটা কবে?’

‘তোমাদের বাপ যে বছর সোনা পেল, তার পরের বছর।’

‘সেরেছে! তা হলে এতদিনে বোধ হয় লোকটার বয়স হবে এক শ’র কাছাকাছি।’

‘আরে, না… অত নয়!’

‘কত তা হলে? ষাট? সত্তুর?’

‘ওই রকমই।’

‘ফেঁসে না গেলেই হয় এখন।’

আশঙ্কাটাকে আমল দিতে চাইল না জোহান। ফের জিজ্ঞেস করল, ‘কোথায় থাকে সে?’

তার দিকে তাকাল ফুলার। ‘একসময় সে নীচেই থাকত। এখন উপরে থাকে।’

‘উপরে মানে? পাহাড়ে?’

‘হ্যাঁ। ওই দিকেই। উত্তরে।’

‘চেনো তুমি?’

‘একবার গিয়েছিলাম। বোধ হয় চিনতে পারব।’

‘আমাকে নিয়ে যেতে পারবে তার কাছে?’

নিজের হাঁটুতে চাপড় মারল স্যাম। ‘এ আর এমন কী! কবে যেতে চাও?’

‘কাল। যদি কোনও অসুবিধা না থাকে তোমার।’

‘অসুবিধা নেই। কিন্তু মাত্র এলে। আবার কালই বেরিয়ে পড়তে চাও?’

‘নো ওয়ে, স্যাম। নষ্ট করবার মতন সময় নেই হাতে।’

‘তা-ও বটে।’

‘তা হলে ওই কথাই রইল। কাল সকাল সকাল বের হব আমরা।’

‘জিল ট্যাটাম কিন্তু বলে গেছে, কাল আসবে,’ স্মরণ করিয়ে দিল জ্যাসন। ‘ওদিকটা কীভাবে সামলাবে?

‘তার বোধ হয় দরকার পড়বে না। সে আসতে আসতে আমরা এখান থেকে চলে যাব। আমি আর স্যাম যাব উত্তরে। আর তুই মা আর মিস মনটেরোকে নিয়ে লুকিয়ে পড়বি।’

‘কোথায় লুকাব?’

‘সেই ভার তোর উপরে থাকল।’

‘ঘরদোর?’

‘তালা মেরে যাব।’ স্বস্তির একটা শ্বাস ফেলল জোহান। ‘কপাল ভাল যে, জিল ট্যাটামের সাথে লিখিত চুক্তি হয়নি। সাক্ষী নেই কোনও। জবরদখল সে করতে পারবে না রানশ। করলে সেটা হবে বেআইনী। পিস্তলের আইন খাটবে না এখানে।

রোজমেরি অনুচ্চ স্বরে বলল, ‘আমি তোর সাথে থাকতে জো। আমরা সবাই একসাথে থাকব।’

‘না,’ প্রস্তাবটা নাকচ করে দিল জোহান। ‘যে কাজে যাচ্ছি… জানি না, তাতে সফল হব কি না। কতদূর যেতে হবে, তা-ও জানি না…

‘অনেক দূর,’ কথার জোগান দিল স্যাম ফুলার।

‘রাস্তাঘাটে কত রকম বিপদ হতে পারে। আমি তো কোনও রিস্ক নিতে পারি না। না, মা, তুমি আমাদের সাথে যাচ্ছ না। তার চাইতে, জেস,’ অনুজের দিকে ফিরল জোহান। ‘দুরন্ত ঈগলের সাথে কথা বল। ও তোদের লুকাবার ব্যবস্থা করে দেবে।’

‘সেনিয়োর মিলফোর্ড, আমি তোমার সাথে যাব,’ জোহানদের পারিবারিক আলোচনার মাঝে এই প্রথম নিজে থেকে কথা বলল এলেনা। রোজমেরি মিলফোর্ড তাকে স্বাগত জানালেও মন থেকে অনাহূত ভাবটা যাচ্ছে না তার। বারংবার মনে হচ্ছে, এদের মাঝে অনধিকার প্রবেশ করেছে সে। তাই সবাই যখন কথা বলছিল, নিশ্চুপ ছিল এলেনা। মিলফোর্ডদের সমস্যার কথা শুনতে শুনতে ভেতরে ভেতরে সঙ্কুচিত হয়ে যাচ্ছিল। সৌজন্যবশত না বললেও ওরা তাকে গলগ্রহ ভাবছে- অস্বস্তির এই কাঁটাটা খচখচ করছিল তার মনের মধ্যে।

‘না, ম্যা’ম,’ ধৈর্য হারাবার পূর্বাভাস পাওয়া গেল জোহানের কণ্ঠে। ‘তুমিও মার সাথে যাবে। এতদূর জার্নি করে এসে আবার…। ঘোড়ায় চড়বার অভ্যাস আছে?’

প্রশ্নটা এড়িয়ে গেল এলেনা। ‘সেনিয়োর, তুমি মনে হয় ভুলে গেছ, আমি একটা বিপদ ডেকে আনছি। মারিয়াচি আসছে। আমি এই এলাকায় থাকলে খুঁজে বার করে ফেলবে সে। জোর- জবরদস্তি করে নিয়ে যেতে চাইবে আমাকে। বাধা পেলে…’ শেষ করল না সে বাক্যটা। ‘কোনও কিছুই অসম্ভব নয় তার পক্ষে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *