সুবৰ্ণ সমাধি – ৩০

তিরিশ

কাঁধে হাত পড়তে জেগে গেল এলেনা। বিড়ালের মত চোখ মেলে চাইল। ঠোঁট না নাড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কে?’

বলেই বুঝল, বেকুবের মত হয়ে গেছে প্রশ্নটা। তারা দু’জন ছাড়া তৃতীয় কোনও মানুষ তো এখানে থাকবার কথা নয়।

কতক্ষণ ঘুমিয়েছে?

অনেক রাত পর্যন্ত জেগে ছিল। সোনা পেলে কী করবে, এ নিয়ে অনেক জল্পনা-কল্পনা করেছে সেনিয়োর মিলফোর্ড।

থালার মত চাঁদ মাথার ওপরে। মাতাল জোছনা ধুয়ে দিচ্ছে পাহাড়ের ফসিল।

ক্যাম্পফায়ারের ছাইয়ের মধ্যে রক্তিম আভা ছড়াচ্ছে কয়লা।

‘ওরা চলে এসেছে!’ বলল জোহান ফিসফিস করে।

‘কে? সেনিয়োর আলভারো?’

‘না। ওরা।’

রাতজাগা একটা পেঁচা ডেকে উঠল।

ধড়মড় করে উঠে বসল এলেনা। পাগলাঘণ্টা বেজে উঠেছে তার অবচেতন মনে। দুরুদুরু অনুভূতি। ভয় পাচ্ছে। তারও বেশি উত্তেজিত।

‘লুকাতে হবে,’ চাপা গলায় বলল জোহান, ‘আমরা সবাই যে এখানে নেই, এটা ওদের বুঝতে দেয়া চলবে না। আমি চাই না, ওরা আমাদের কবজা করে ফেলুক।’

‘কতজন ওরা?’

‘পাঁচ-ছয়জন। বেশিও হতে পারে। অন্ধকারে বোঝা যায় না। একটা দুরবিন যদি থাকত—’

‘কদ্দূর?’ কথার মাঝখানে বাগড়া দিল এলেনা।

‘বেশি দূরে নয়। তাড়াতাড়ি করো!’

এলেনার হাত ধরে টেনে তুলে দাঁড় করাল জোহান। স্যাডল আর কম্বলটা তুলে নিল।

যতটা সম্ভব, শব্দ না করে ঘোড়ার কাছে পৌছে গেল ওরা। সোনালী অ্যাসপেন ঝোপের গোড়ায় বাঁধা রয়েছে ও-দুটো।

আলো থাকতে আশপাশটা ভাল করে দেখে নিয়েছে। হাইড- আউটের জন্যে পারফেক্ট জায়গা জঙ্গল। অন্ধকার সেখানে নিবিড়।

ঘোড়াসহ এলেনাকে লুকাতে সাহায্য করে ফিরে এল জোহান। পজিশন নেবার জন্যে যে জায়গাটা সে নির্বাচন করেছে, সেটাকেও খারাপ বলা যাবে না। বড়সড় এক গাছের গুঁড়ির পাশে বুক-সমান উঁচু একটা পাথর কাভার দিচ্ছে তাকে।

ওর বাম দিকে বিশ গজ দূরে রয়েছে এলেনা।

আশপাশে চল্লিশ গজের মধ্যে অনুসরণকারীদের জন্যে কোনও আড়াল নেই।

অপেক্ষা করবার চাইতে বোরিং আর কিছু হতে পারে না। তবে এই ব্যাপারটা অন্যরকম। শঙ্কা আর উত্তেজনায় ভরা।

উইনচেস্টারের লিভার টেনে আলগোছে ফেলে রেখেছে সে কোলের ওপরে। প্রয়োজনে বিনা নোটিশে ব্যবহার করতে পারবে। ডান বগলের খাঁজে রেখেছে আরেকটা রাইফেল।

এসে গেল ওরা।

ঘোড়াগুলোর পদশব্দ আর নিজের হৃৎস্পন্দন একই লয়ে হচ্ছে বলে মনে হলো জোহানের।

‘চিড়িয়া ভাগ গিয়া!’ বলল একজন।

‘ধুর!’ বিরক্তি উদগিরণ করল আরেকজনের স্বরযন্ত্র।

জোহান ভাবল, পিলে চমকে দেয়া যাক ওদের।

‘ভাই সব’ সম্বোধন দিয়ে শুরু করল সে। আমুদে গলায়।

অচেনা কণ্ঠের আওয়াজে চমকে গেল ঘোড়াগুলো। হেষাধ্বনিতে সেটা চাপা থাকল না। ইতস্তত পা ফেলতে লাগল। অস্বস্তি ভরে নাক ঝাড়ছে।

‘কে! কে কথা বলে!’ বক্তার গলায় নগ্ন ভয়। অচিন দেশ। তামসী রাত। সুনসান পার্বত্য এলাকা। অনেকক্ষণ থেকে মানসিক ভাবে কাবু হয়ে আছে আলবার্তো। এবারে সেটা প্রকাশ হয়ে পড়ল।

নিজের পরিচয় দেবার গরজ অনুভব করল না জোহান। আলাপের সুরে বলল, ‘তোমরা এখান থেকে কেটে পড়লে ভাল হয়।’

এই অর্বাচীনসুলভ কথার প্রতি-উত্তরে হা-হা হাসির শব্দ ভেসে এল। ‘কেটে পড়ব?’ তারও কণ্ঠে আমোদ।

‘আমার কথা শুনেছ তোমরা।’ হুমকি নয়। হালকা চালে বলল জোহান।

‘কয় কী ব্যাটা!’ তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গাত্মক কণ্ঠে বলে উঠল চিন মুয়েলার।

‘কথা বলে কে? মিলফোর্ড নাকি?’ প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল জিল ট্যাটাম।

‘ধরেছ ঠিকই।’

‘তো, মিলফোর্ড, আমরা তো যাবার জন্য আসিনি, ভাই!’ অমায়িক স্বরে বলল ট্যাটাম কথাটা। জোহানের গলা নকল করে। তবে তাতে প্রচ্ছন্ন বিদ্রূপ।

‘সেনিয়োরিটা মনটেরো কোথায়?’ মারিয়াচির গলাটা বেসুরো শোনাল।

‘নেই এখানে,’ মিথ্যে বলল জোহান। ‘তুমি নিশ্চয় মারিয়াচি? শোনো, বাড়ি, মিস মনটেরো তোমাকে বিয়ে করতে চায় না।’

অবহেলাসূচক হাসিতে নিজের মনোভাব বুঝিয়ে দিল স্প্যানিয়ার্ড। বিদ্বেষপূর্ণ স্বরে বলল, ‘তার চাওয়া-না-চাওয়ায় কিছু যায়-আসে না।’

থেমে গিয়েছিল, ঘোড়ার খুরের আওয়াজ উঠল আবার। ছড়িয়ে পড়বার ফন্দি করছে লোকগুলো।

ট্রিগার গার্ডের ওপরে আঙুল চেপে বসল জোহানের। দুই হাতে শক্ত করে ধরল রাইফেলটা। মুহূর্তের মধ্যে গুলি ছুঁড়বার জন্যে সম্পূর্ণ তৈরি।

‘খবরদার!’ সাবধানবাণী শোনাল জোহান। ‘তোমাদের প্রত্যেককে ফেলে দেয়া আমাদের জন্য নেহাত ওয়ান-টু-এর মামলা।’

‘ঘোঁত’ করে বিদঘুটে একটা আওয়াজ ছাড়ল আলবার্তো নাক দিয়ে। নিচু স্বরে গাল বকল।

চিন মুয়েলার ভড়কায়নি। বাজখাঁই গলায় বলল, ‘ব্লাফ দিচ্ছে শালা!’

‘দেখতে চাও?’ চ্যালেঞ্জ করল জোহান।

কোনও জবাব এল না কারও কাছ থেকে।

‘হ্যাঁ, মিস্টার মারিয়াচি… যা বলছিলাম… মেয়েদের ইচ্ছা- অনিচ্ছার দাম দিতে শেখো। এতে তোমার সম্মান বাড়বে বৈ কমবে না।’

স্প্যানিশ যুবক নিরুত্তর।

বোঝাবার সুরে বলল জোহান, ‘যে-মেয়ে তোমাকে পছন্দ করে না, কেন তার জন্য অযথা হয়রান হচ্ছ? মুফতে একটা সুপরামর্শ দিচ্ছি তোমাকে। বাড়ি ফিরে যাও। খুঁজলে এমন অনেক মেয়ে পাবে, যারা প্রকৃতই তোমাকে ভালবাসে।’

মন্তব্য নেই।

জোহান বলে যাচ্ছে, ‘আমাদের মধ্যে কোনও শত্রুতা নেই, মিস্টার মারিয়াচি। তোমার ব্যাপারটা আমি বুঝি। কিন্তু আমাকে তুমি এটা বোঝাও তো, তোমার সাথে মিস্টার জিল ট্যাটাম কেন?’

‘সে আমার বন্ধু,’ আগ বাড়িয়ে বলল ট্যাটাম।

‘সত্যি নাকি, মিস্টার মারিয়াচি?’

‘হ্যাঁ, সুহৃদ,’ একটু দোনোমনো করেই যেন জবাব দিল লাতিন তরুণ।

‘তা-ই মনে হয় তোমার?’ প্রশ্ন তুলল জোহান। ‘জেনে রাখো, মিস্টার মারিয়াচি, স্বার্থ ছাড়া এক পা-ও বাড়ায় না মিস্টার ট্যাটাম। জিজ্ঞেস করো তো, এখানে তার স্বার্থটা কোথায়!’

‘ছোকরা!’ ক্ষুব্ধ হলো ট্যাটাম। ‘তোমার আস্পর্ধা তো কম নয়! সবার সামনে আমাকে অপমান করছ! একটা বাটপারের কথায় আমাকে জবাবদিহি করতে হবে!’

‘বাটপার! কে বাটপার?’ সমান তেজে বলল জোহান।

‘সেনিয়োর ট্যাটামের টাকা ফেরত না দেবার মতলবে পালাচ্ছ না তোমরা?’ মারিয়াচি বোঝাল, জিল ট্যাটামের উদ্দেশ্য সম্পর্কে সে অবগত।

‘না, মিস্টার মারিয়াচি। কথাটা একদমই ঠিক নয়। পালাচ্ছি- ঠিক, তবে মিস্টার ট্যাটামের টাকা ফেরত দেবার জন্য।’

‘বুঝলাম না।’

‘তুমি তা হলে জানো না! আশ্চর্য কথা! মিস্টার ট্যাটামকে জিজ্ঞেস করো। সে জানে।’

‘ননসেন্স!’ উন্মত্ত ষাঁড়ের মত গোঁ-গোঁ করে উঠল ট্যাটাম। ‘কী জানি আমি! পাওনা টাকা আদায় করতে এসে ভ্যালা মুসিবতে পড়লাম তো! একটা তস্করের কাছে বড়-বড় বোলচাল শুনতে হচ্ছে!’

তাকে গ্রাহ্যই করল না জোহান। ওর বদ্ধমূল ধারণা, সোনাল গন্ধ শুঁকতে শুঁকতেই এখানে এসেছে জিল ট্যাটামের বদমাশ- বাহিনী।

‘মিলফোর্ড, শোনো,’ মারিয়াচির গলাটা দুর্বল শোনাল। ‘সেনিয়োর ট্যাটামের লাভ-লোকসান নিয়ে মাথাব্যথা নেই আমার। সেনিয়োরিটা মনটেরোর জন্য এদ্দূর এসেছি আমি। ওকে আমার হাতে তুলে দাও, নিয়ে চলে যাব।’

‘শালা বোধ হয় একা আছে!’ দীর্ঘ বাতচিতে যুগপৎ অধৈর্য ও বিরক্ত চিন মুয়েলার। মারিয়াচিকে উসকানি দিল, ‘ওকে ফেলে দিয়ে মেয়েটাকে নিয়ে গেলেই হয়!’

সঙ্গে সঙ্গে বোল্ট টানবার আওয়াজ এল জঙ্গলের ভেতর থেকে। আলভারোর ভয়ালদর্শন বাফেলো গান এখন এলেনার হাতে। রাতের নীরবতায় শব্দটা অত্যন্ত জোরাল শোনাল।

দ্বিধাজড়িত, অনিচ্ছুক ভঙ্গিতে আগুপিছু করল ঘোড়াগুলো।

‘এক মিনিট সময় দিলাম,’ আলটিমেটাম দিল জোহান। ‘ডিসিশন তোমাদের। মাশুলও দিতে হবে তোমাদের। তবে রক্তারক্তি এড়ানো গেলেই আমি খুশি হতাম।’

কারোরই পছন্দ হলো না এই শাসানি। খোলা জায়গায় রয়েছে। সহজ টার্গেট। কোনখান থেকে অতর্কিতে আক্রান্ত হবে, কে বলতে পারে!

রণে ভঙ্গ দিল জিল ট্যাটাম। চলে যাবার জন্যে স্পার দাবাল।

সবার আগে তাকে অনুগমন করল আলবার্তো।

‘মিলফোর্ড!’ নিষ্ফল আক্রোশে দাঁত কিড়মিড় করল মারিয়াচি। ‘এর জন্য দুর্ভোগ পোহাতে হবে তোমাকে।’

‘মোক্ষম সময়ে রাইফেল কক করেছ তুমি!’ জোহানের সপ্রশংস স্বীকৃতি, ‘পারফেক্ট টাইমিং!’

‘কিন্তু ওরা কোথায় গেল, সেনিয়োর!’ টেনশন কাটছে না এলেনার।

‘ত্রিসীমানায় নেই, ম্যা’ম।’

একটু যেন আশ্বস্ত হলো এলেনা। ‘এখন কী করব আমরা?’

‘তুমি ইচ্ছা করলে শুয়ে পড়তে পারো।’

‘আর তুমি?’

‘আজ রাতে আমার আর ঘুম হবে না, ম্যা’ম।’

‘সকাল হতে তো বোধ হয় বেশি বাকি নেই।’

‘না, নেই। …এই ঘণ্টা দুয়েক।’

‘আমারও ঘুম আসবে না, সেনিয়োর। গল্প করে কাটিয়ে দেয়া যায় না রাতটা?’

একত্রিশ

দিনের প্রথম আলো বসুধায় পৌছাবার আগেই ফিরে এল ওরা। আলভারোরা।

ঘুমিয়ে সময় নষ্ট করেনি রাতে। নাকে-মুখে কিছু গুঁজেই রওনা দিয়েছে।

খাঁড়ির কাছে এসে বেচায়েন হয়ে পড়ল মিসেস মিলফোর্ড। গেল কোথায় সব! তল্পিতল্পা গুটিয়ে বেমালুম গায়েব!

না চাইতে অলক্ষুণে চিন্তাটা এসে ঠাঁই গাড়ল কল্পনায়।

আলভারো বিচলিত হয়নি। দুই মিনিটেই খুঁজে বের করে ফেলল ওদের। সেই ছাউনিটার নীচে। ঈগল আঁকা পাথর রয়েছে যেখানটায়।

মারিয়াচিরা ফিরে আসতে পারে, এই আশঙ্কায় জায়গা বদল করেছে ওরা।

আলভারোদের দেখে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল জোহান।

খুশি উপচে পড়ছে মিসেস মিলফোর্ডের চোখ থেকে। কিছু জিজ্ঞেস না করেই প্রাপ্তিসংবাদ পেয়ে গেল জোহান।

কিন্তু রাতের ঘটনা শুনে রোজমেরির চেহারা থেকে বিচ্ছুরিত আনন্দের ছটা ম্লান হয়ে এল।

‘লেজ গুটিয়ে ভাগতে হবে,’ আলভারোর ত্বরিত ডিসিশন।

‘ওদের নাকের ডগা দিয়ে পালাব কী করে?’ জোহানের জিজ্ঞাসা।

‘ওইদিক দিয়ে যাব না। অন্য একটা রাস্তা চিনি।’

‘একটাই না রাস্তা!’ বিস্মিত হলো মিসেস মিলফোর্ড।

‘এটা ঘুরপথ। ঘুরে-ফিরে আমার কেবিনের পাশ দিয়েই যেতে হবে।’

.

মাথার ওপরে পাতার সামিয়ানা। আকাশছোঁয়া সাইপ্রেস গাছের মগডালে আলোর লুকোচুরি। বাতাসের বিলি কাটা।

চোরাপথ দিয়ে এসে তির্যক ভাবে মাটি স্পর্শ করেছে সকালের প্রথম সূর্যরশ্মি। ছায়ার শরীরে অবিরত ইকড়িমিকড়ি আল্পনা কাটছে রোদের ছুরি।

বাতাসে বার বার নুয়ে পড়ে অভিবাদন জানাচ্ছে যেন গাছগুলো। ছায়া-ছায়া আদর মাখিয়ে দিচ্ছে ওদের গায়ে।

দ্রুতও নয়, আস্তেও নয়- এমন একটা গতিতে এগিয়ে চলেছে অবলা প্রাণীগুলো। ব্যাপক পেরেশানি যাচ্ছে তাদের ওপর দিয়ে 1

ঝরাপাতার ভেতর দিয়ে সরসর করে চলে যাচ্ছে কী যেন। এ-গাছ থেকে ও-গাছের কাণ্ডে বিশাল-বিশাল জাল বুনে রেখেছে ঊর্ণনাভ। মাথায়, মুখে জড়িয়ে যাচ্ছে।

বনের ভেতর থেকে বেরিয়ে টিলা দিয়ে ঘের দেয়া একটা জায়গায় এসে পড়ল দলটা। কিছুদূর এঁকেবেঁকে চলবার পর চুলের কাঁটার মত মোচড় খেল পথ।

মোড়টা ঘুরে অবশ হয়ে গেল রোজমেরি মিলফোর্ডের দেহ। ভাল লাগবার অনুভূতি গোটা অস্তিত্বে। ‘জেস, তুই!’

বত্রিশ

ইতিউতি খোঁজাখুঁজি করে আবার এক জায়গায় জমায়েত হলো ঘোড়সওয়ারেরা।

‘পাখি উড়ে গেছে,’ নির্জীব স্বরে বলল টাকার।

‘গাধা কোথাকার!’ ঠিক বোঝা গেল না, কাকে গালি দিল জিল ট্যাটাম।

‘খুব ভাল হয়েছে!’ দেশলাইয়ের কাঠির মত জ্বলে উঠল রগচটা মুয়েলার। কাল রাত থেকেই মেজাজটা খিঁচড়ে রয়েছে তার। ‘তখনই বলেছিলাম, আবার ভুল করতে যাচ্ছি আমরা।’ শ্লেষ ঝাড়ল, ‘একটা ফোঁটা সাহস নেই কারও! এখন বসে বসে আঙুল চোষো!’

বন্দুকবাজের দিকে চেয়ে কাষ্ঠ হাসল ট্যাটাম। বিব্রতকর অবস্থা। রাতের বেলা চুপিসারে হামলা করবার প্রস্তাব তুললে সে- ই মুয়েলারকে বাতিল করে দিয়েছিল। অজুহাত হিসেবে বলেছে সবার নিরাপত্তার কথা। আসল কথা, নিজের নিরাপত্তা নিয়ে আশঙ্কিত ছিল সে।

‘মিস্টার আরবো থাকতে চিন্তা কী!’ সাফাই গাইবার সুরে বলল ট্যাটাম। ‘ঠিক পাকড়াও করে ফেলব ওদের। কী, মিস্টার আরবো?’

কিন্তু ম্যানুয়েল আরবোকে এখন আত্মবিশ্বাসী মনে হচ্ছে না। চিন্তান্বিত চোখে জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে আছে। কাঁধের কাপড়ে জুলফি আর কান ঘষে নিয়ে বলল, ‘কাজটা সহজ হবে না।’

‘ওদের ট্র্যাক বের করতে পারবে না তুমি?’ সোনা ফসকে যাবার চিন্তায় ককিয়ে উঠল ট্যাটাম।

টোকা দিয়ে নাকের চূড়া থেকে ছোট্ট একটা পোকা ফেলল ট্র্যাকার। ‘পারাটা অসম্ভব, তা বলছি না। কিন্তু… আসলে, বনে- বাদাড়ে কাজ করবার অভিজ্ঞতা নেই, ম্যান।’

‘জিল,’ ট্যাটামের দৃষ্টি আকর্ষণ করল চিন মুয়েলার। ‘আমার ধারণা, ও আর আমাদের সাহায্য করতে চায় না। কারণটা বলি? ও একটা ভীতুর ডিম,’ ম্যানুয়েল আরবোর প্রতি অনাস্থা পোষণ করল গানম্যান।

গায়ে পড়ে ঝগড়া বাধাবার তালে আছে লোকটা, বুঝতে পারছে আরবো। হিমশীতল চোখে মাপল সে বর্ণসঙ্করকে। অন্ধ রোষ মাথাচাড়া দিচ্ছে। সরীসৃপের মত ঠাণ্ডা রক্তের অধিকারী বলে জ্বলে উঠল না।

‘থামো!’ ধমকে উঠল ট্যাটাম। তারপর ম্যানুয়েলের দিকে ফিরে পাম দিল, ‘তোমার মতন ঝানু ট্র্যাকারই বলছে এ কথা!’

কড়ে আঙুল দিয়ে নাকের ডগা চুলকাল ম্যানুয়েল। চাটুকারিতাকে প্রশ্রয় দিল না। মারিয়াচির দিকে ফিরে বলল, ‘বন্ধু, আমি কিন্তু ফিরে যাবার কথা ভাবছি।’

দাড়িতে আলতো আঙুল বোলাচ্ছে মারিয়াচি। মন্তব্য করল না।

ম্যানুয়েলের কথা শেষ হয়নি। ‘লাভ কী বেহুদা ঘুরে? আজ হোক, কাল হোক, ওরা তো ফিরবেই একসময়, তা-ই না? রেঞ্জেই হোক না শো-ডাউনটা। তাড়াহুড়া কীসের?’

আলবার্তো মুখিয়ে ছিল। তৎক্ষণাৎ সায় দিল, ‘যথার্থ বলেছ!’ ভেজা মুখটা শার্টের আস্তিনে মুছে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল। ফিরবার ব্যাপারে সে তো এক পায়ে খাড়া। সারাক্ষণ তটস্থ হয়ে থাকতে ভাল্লাগছে না তার। এই অশান্তি থেকে পরিত্রাণ চায়।

‘তুমি তো বলবেই এ কথা!’ ফোড়ন কাটল মুয়েলার। প্যান্ট ভেজানো, না কী জানি বলল বিড়বিড়িয়ে।

শুনেও না শুনবার ভান করল ভীতু রাইডার। অন্যদিকে মুখ ফেরাল।

পিন ফোটানো বেলুনের মত চুপসে গেছে ট্যাটাম। এত কাঠখড় পোড়াবার পর ভরাডুবি হতে চললে কেমন লাগে!

হঠাৎ মনে হলো, এই অবস্থায় টাকার কি কোনও সাহায্য করতে পারবে?

কথাটা পাড়ল সে, ‘পার্টনার, তুমি তো স্মাগলিং করো। এই জায়গায় এসেছ আগে?’

বিদেশিদের সামনে জিল ট্যাটাম তার প্রেসটিজ পাংচার করে দেবে, এটা দুঃস্বপ্নেও ভাবেনি টাকার।

বিচিত্র দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে স্প্যানিশ লোকগুলো।

মনটা বিষিয়ে উঠল তার ট্যাটামের ওপরে। সরোষে জবাব দিল, ‘কস্মিনকালেও নয়!’

জিল ট্যাটাম বুঝল, সময় উপস্থিত। আর চেপে রাখলে আখেরে আমও যাবে, ছালাও যাবে। স্প্যানিয়ার্ডদের প্ররোচিত করবার চেষ্টায় বলল, ‘একটা কথা জানলে ফিরে যেতে চাইবে না কেউ!’

লাতিনদের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হলো সে কথাটা বলে।

হিস্পানিগুলোকে উৎসাহী করে তুলতে পেরেছে- নিজের সাফল্যে মনে মনে হাসল ট্যাটাম। ‘মিলফোর্ডরা আসলে স্বর্ণশিকারে বেরিয়েছে,’ কারণটা বলল।

‘ও,’ টেনে বলল মারিয়াচি। ‘তা হলে এটার প্রতিই ইঙ্গিত করেছিল মিলফোর্ড! এটাই লুকাচ্ছিলে তুমি…’

‘আমি চিন্তা করেছিলাম, সোনা পাইয়ে দিয়ে তোমাদের চমকে দেব,’ আত্মপক্ষ সমর্থন করল ট্যাটাম।

একটুও আকৃষ্ট হলো না হিস্পানিক যুবক। প্ররোচনায় ভুলল না।

‘তা হলে কী দাঁড়াল?’ জিল ট্যাটাম ধরে নিয়েছে, সবাই এখন ওর কথায় নাচবে। ‘ওই সোনা আমাদেরও দরকার। রাইট?’

‘রং,’ ট্যাটামের অনুকরণে বলল মারিয়াচি। ‘সোনার নিকুচি করি আমি।’ সোজাসাপ্টা জানিয়ে দিল, ‘আমি শুধু সেনিয়োরিটা মনটেরোকে চাই। সে আমার কাছে সোনার চেয়েও দামি।’

ফ্রস্টবাইটের মত আড়ষ্টতা অনুভব করল ট্যাটাম। দর্প চূর্ণ হয়ে গেছে তার। মারিয়াচিকে ধন্য করে দিচ্ছে, ধারণাটা ধূলিসাৎ হয়ে যেতে অপমানিত বোধ করল।

আর সইতে পারল না মুয়েলার। আজ পর্যন্ত তার প্রস্তাবনাকে বুড়ো আঙুল দেখাবার ধৃষ্টতা দেখায়নি কেউ। এই লোকগুলো না থাকলে জিল ট্যাটাম তার কথার বাইরে এক পা-ও নড়ত না। বিক্ষোভের তুবড়ি ছুটল তার গলা দিয়ে, ‘কিচ্ছু না, জিল! শুধু যদি আমার কথাটা শুনতে! বহুত তো বড়-বড় কথা বলেছিলে তখন! এখন কী করবে?’ প্রলাপ বকা আরম্ভ করেছে যেন। ‘তোমার বোকামির জন্য, জিল! শুধু তোমার গাধামি আর গোঁয়ার্তুমির জন্য…’

মুয়েলারের এই আস্ফালনে তড়পে উঠল আলবার্তো। ‘নিজেকে খুব চালাক ঠাউরেছ, না? খালি বাগাড়ম্বর! হিরো হবার আদিখ্যেতা! পাছায় একটা গুলি ঢুকলে ফরফর করা বেরিয়ে যেত!’

‘তুমি চুপ করো!’ খেঁকিয়ে উঠল মুয়েলার। মুঠি পাকিয়ে ফেলেছে। ‘ডরপোক কোন্খানের! মুরগির কলজে নিয়ে পয়দা হয়েছে, আবার গলাবাজি করতে আসে! শালা বেজন্মা!’

জন্মপরিচয় তুলে খিস্তি। কী জানি হয়ে গেল আলবার্তোর। যে কাজটা সে করল, সেটা তার মত লোকের পক্ষে অসম সাহস কিংবা ভীষণ নির্বুদ্ধিতার উদাহরণ বলা যায়। চাবুক খুলে নিল সে কাঁকাল থেকে। কবজির এক বিদ্যুৎ-ঝাঁকিতে গোল করে পেঁচিয়ে রাখা কশার প্রান্ত লম্বা হয়ে ছুটে গেল।

সপাং!

কশাঘাত খেয়ে রুদ্র হুঙ্কার ছাড়ল মুয়েলার। এরকম কিছু যে ঘটতে পারে, স্বপ্নেও চিন্তা করেনি সে। পড়েই যাচ্ছিল ব্যালান্স হারিয়ে, কোনও রকমে ঘোড়ার পিঠের ওপরে সিধে রাখল নিজেকে। ফোঁসফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলছে। চোখে জিঘাংসা। তার ইচ্ছেশক্তি থাকলে ভস্ম হয়ে যেত আলবার্তো।

মুয়েলার আশা করেছিল, জিল ট্যাটাম তার পক্ষ নিয়ে কিছু বলবে। একদল বিদেশির সামনে তাদেরই একজনের হাতে অপদস্থ হচ্ছে তার দোস্ত, এতে সে নির্বাক থাকতে পারে না। কিন্তু বিবমিষার সাথে লক্ষ করল, কোনও রকম রি-অ্যাকশনই দেখাল না ট্যাটাম। দেখতে পায়নি, এমন ভাব করে আরেক দিকে তাকিয়ে আছে।

রুষ্ট হলো মুয়েলার। সোনার লোভ তার এত বছরের চেনা মানুষটার আচরণ বদলে দিয়েছে।

মাজায় ঝোলানো পিস্তলের বাঁটে হাত দিল সে। গোক্ষুরের বিষ দুই চোখে। কাছাকাছি হয়ে এসেছে চোখের পাতা।

ও কী করতে যাচ্ছে, হৃদয়ঙ্গম করতে পেরে সতর্কবাণী উচ্চারণ করল ট্যাটাম, ‘বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু, পার্টনার! নিজেদের মধ্যে গোলমাল চাই না আমি।’

বহু কষ্টে বেসামাল মগজটাকে সামলাল মুয়েলার। আরেকটু হলেই বেচাল চালতে যাচ্ছিল সে। এ যাত্রা বেঁচে গেল মোটকুটা। কৃতজ্ঞ বোধ করা উচিত, কিন্তু কেন যেন মুয়েলারের সব অসন্তোষ গিয়ে পড়ল ট্যাটামের ওপরে।

সান্ত্বনাসূচক চুকচুক শব্দ বের হলো শর্টির মুখ দিয়ে। মুয়েলার চাইতে সহানুভূতির হাসি হাসল সে ঠোঁট টিপে।

মুয়েলার বুঝল উল্টো। ভাবল, তার কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিচ্ছে বাঁটুলটা।

ফের রক্ত উঠে গেল মাথায়। শর্টির বুকে তাগ করে ঘোড়া টিপে দিল রিভলভারের।

বুম!

হার্ট ছিদ্র করে ফেলল বুলেট।

অবাক বিস্ময়ে সহযাত্রীর দিকে তাকাল বেঁটে। তারপর তাকাল নিজের ফুটো হয়ে যাওয়া বুকের দিকে। টপটপ করে খুন ঝরছে ছেঁদা থেকে।

ব্যথায় কুঁচকে গিয়ে বীভৎস দেখাচ্ছে শর্টির মুখ। কিন্তু গলা দিয়ে আর্তচিৎকার বের হলো না তার। সামনের দিকে বাঁকা হয়ে গেল। তারপর ডেড শট খাওয়া ঘুঘুর মত ধড়াম করে মুখ থুবড়ে পড়ল মাটিতে। পটল তুলেছে।

আগ্নেয়াস্ত্রের শব্দটা মিলিয়ে যেতে স্তম্ভিত হয়ে পড়ল মুয়েলার। রাগের মাথায় দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ফেলেছে। এখন হায়-হায় করা ব্যতীত গত্যন্তর নেই। নিরপরাধ ভঙ্গিতে দুটো হাত মাথার ওপরে উঠে গেল তার।

হতবাক হয়ে লাশের দিকে তাকিয়ে আছে ট্যাটাম। ঠিক যেমন যক্ষ্মা রোগী তাকায় তার রক্তাক্ত তোয়ালের দিকে।

পতনের ধাক্কায় শূন্যে ওড়া ধুলো থিতিয়ে আসছে। হ্যাটটা খুলে এসেছিল, পড়েছে আবার শর্টির মুখের ওপরে; মুখের আধখানা ঢেকে দিয়েছে।

ওর সোরেলটা কয়েক গজ তফাতে দাঁড়িয়ে। প্রভুর বেহাল দশায় থ।

আলবার্তো আর ম্যানুয়েলও ঘটনার আকস্মিকতায় হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছে। ভীত চকিত দৃষ্টি।

হোলস্টারের কাছে হাত চলে যাচ্ছে ট্যাটামের। ওখানে বন্দি হয়ে আছে তার একান্ত প্রিয় পিস্তলটা।

মারিয়াচির কোনও ভাবান্তর নেই। সে শুধুই দর্শক। নিস্পৃহ দৃষ্টিতে দেখে যাচ্ছে বিয়োগান্তক নাটক।

তেত্রিশ

‘তোমরা যাবার ঘণ্টা খানিক পরে ইনডিয়ান টেরিটোরিতে চলে যাই আমি,’ বলে চলেছে জ্যাসন, ‘ওর সাথে দেখা করি।’

‘তারপর তোরা বেরিয়ে পড়লি?’

‘হ্যাঁ, দাদা।’

‘রানশ?’

‘রানশ নিয়ে চিন্তা কোরো না,’ দুরন্ত ঈগল আশ্বস্ত করল, ‘আমার লোকেরা রানশের দেখভাল করছে।’

‘ধন্যবাদ, ঈগল। তোমাদের মতন বন্ধু পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার।’

মাঝবয়সী ইনডিয়ান ও তার দুই সঙ্গী নড করল।। তিনজনেরই লম্বা চুল মেয়েদের মত একবেণি করা। প্রতিটা বুননের মাঝে পাখির পালক গোঁজা। গায়ে নেকড়ের ছাল। পিঠে তীর-ধনুক।

‘কিন্তু এই পথে কেন?’ আবার জিজ্ঞেস করে জোহান। জবাবটা শুনবার আগেই বুঝে গেল।

বুঝল মেরিও। ট্র্যাক ধরে আসোনি… এর একটাই মানে…’ মিসেস মিলফোর্ডের গলার স্বর পাল্টে গেল, ‘দুরন্ত, তুমি কিন্তু কখনও বলোনি, সোনার খোঁজ জানো তুমি!’

‘কিছু কথা গোপন রাখতে হয়, মা-জননী,’ অম্লান বদনে ঝেড়ে দিল দুরন্ত ঈগল।

বলে সারতে পারল না, ভোঁতা একটা আওয়াজ মনোযোগ কেড়ে নিল সবার।

শব্দটা বহুদূর থেকে এসেছে। বাতাস আর প্রতিধ্বনির ডানায় ভর করে।

কারও বুঝতে অসুবিধা হয়নি, আওয়াজটা কীসের।

কে গুলি করল?

কাকে?

হয়তো শিকার করছে কেউ।

নাকি ফাঁকা আওয়াজ?

মিস-ফায়ার নয়তো?

পলকে অনেক রকমের ভাবনা খেলে গেল প্রত্যেকের মগজে। কিন্তু কোনওটাতেই থিতু হলো না।

ওদেরকে আরও বিভ্রান্ত করে দিল আরও তিনটা গুলির শব্দ।

একে অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল সবাই।

দুরন্ত ঈগলের মাঝে প্রাণচাঞ্চল্য দেখা গেল। ‘তোমরা যাও। পরে আসছি আমরা।’

‘আমরা’ মানে, তিন ইনডিয়ান।

বাকিদের নিঃশব্দ সওয়াল: ‘কেন?’

‘ফলস ট্র্যাক তৈরি করব।’

বিষয়টা নিয়ে নাড়াচাড়া করল জোহান। তার মনঃপূত হলো আইডিয়াটা।

শশব্যস্ত হলো দুরন্ত ঈগলের দল। ভুয়া ট্র্যাক বানানো, ঘুরপথে আবার আসল রাস্তায় ফিরে আসা তো আছেই, আসবার সময় নিজেদের চিহ্নগুলো মুছে আসতে হবে।

সুগভীর নিষ্ঠার সাথে কাজ করে চলল ওরা। চোখে সঙ্কল্প। কিছু পাওনা বুঝিয়ে দেবার আছে ট্যাটাম ও তার চেলা- চামুণ্ডাদের।

অসংখ্য বার সে তার গরু-মহিষগুলোকে ঘাস খাওয়াবার জন্যে তাদের এলাকায় ঠেলে দিয়েছে। অন্যায় ভাবে চোরাকাঁটার বেড়া দিয়ে সীমানা বাড়িয়েছে রানশের। শান্তিপ্রিয়, নিরীহ মানুষদের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করে ক্লেইম করেছে সেই জমি। প্রতিবাদ করতে গেলে ভয়ভীতি তো দেখিয়েছেই, গুণ্ডাপাণ্ডা দিয়ে লাঞ্ছিতও করেছে। পাইকারি হারে কচুকাটা করার ভয় দেখিয়েছে। শ্বেতাঙ্গদের তৈরি করা আইন পাশে দাঁড়ায়নি তাদের। উল্টো সমঝোতা করে চলবার উপদেশ দিয়েছে।

আজকে মওকামত পেয়েছে। উড়ে এসে জুড়ে বসা পাজি সাদা মানুষদের হাড়ে হাড়ে টের পাইয়ে ছাড়বে, কাদের বাপদাদারা এখানে বাস করছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম।

.

ওদের জানবার কথা নয়, পরপারের ট্রেইল ধরেছে ট্যাটাম। সাথে করে নিয়ে গেছে চিন মুয়েলার নামে আরেক কুখ্যাত বন্ধুকে।

ট্যাটামের ডান ভুরুর নীচে গর্ত। ওখানে চোখ ছিল। এখন নেই। বাম চোখটা নিষ্পলক। বাদামি আইরিস বিস্ফারিত। হাঁ করা মুখের পাশ দিয়ে নেমেছে শোণিতধারা।

তার পিস্তলের উত্তপ্ত সিসে পাঁজরে নিতে চায়নি মুয়েলার। বুকের বাঁ দিকে হলকা অনুভব করামাত্রই বিদ্যুদ্বেগে পাল্টা গুলি পাঠিয়ে ভবলীলা সাঙ্গ করে দিয়েছে ট্যাটামের। মেয়ারের ওপর থেকে ছিটকে গেছে সে। রেকাবে আটকে গেছে পা। হাঁক ছেড়ে ছেঁচড়ে নিয়ে গেছে তাকে ঘোড়াটা।

ওদিকে টাকারের করা গুলিটা পিঠ পেতে নিতে হয়েছে মুয়েলারকে।

মাটিতে পড়ে ছটফট করল সে ডাঙায় তোলা মাছের মত। ধুলো খামচাল। সেই অবস্থাতেই প্রাণবায়ু বেরিয়ে গেল তার।

মারিয়াচিকে দেখাচ্ছে ক্লাসরুমের শেষ বেঞ্চে বসা বিষণ্ণ বালকের মত।

তিনটা মৃতদেহ। এই জীবন ছিল, এই নেই। আশা, ইচ্ছে, রঙিন স্বপ্ন… কিছুই পূরণ হলো না তাদের।

সোনা সম্পর্কে অনেক গুজব রয়েছে। অনেক উপাখ্যান। অনেকের ভাগ্যে নাকি সোনা সয় না। কারও জন্যে এটা অভিশাপ হয়ে আসে। গানপাউডারের উৎকট গন্ধে সেই আলামত।

‘আমি বাড়ি যাব,’ ঘোর লাগা গলায় বলে উঠল টাকার। ফিটফাট কাপড়ের নীচে ধসে গেছে যেন তার দেহটা।

‘ডেডবডিগুলো নিয়ে যাও,’ অনুরোধ করল মারিয়াচি। তার কথা টাকারের কানে গেছে বলে মনে হলো না। গোড়ালির গুঁতো দিল জেব্রা ডানের পেটে।

এক নজরে কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থাকল স্প্যানিয়ার্ড। তারপর কোমরের খাপ থেকে বের করে আনল তীক্ষ্ণধার ম্যাশেটি। কবর খুঁড়বে।

চৌত্রিশ

রোদের তাপ সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। ছায়ায় থম মেরে বসে দিবস নিরসনের অপেক্ষা করছে ক্যাঙ্গারু ইঁদুর। আঁধার নামলেই খাবার খুঁজতে বেরোবে।

প্রাচীন নগরের ধ্বংসাবশেষ কিংবা ভাস্কর্য প্রদর্শনী- কোনও উপমাই আজব এই অঞ্চলের দৃশ্য বয়ান করবার জন্যে পর্যাপ্ত নয়। অগণনীয় পাথরের থামের মাথায় চাকতির মত চ্যাপ্টা পাথর। সৃষ্টি হয়েছে বিশালাকৃতির ব্যাঙের ছাতার মত উদ্ভট সব স্ট্রাকচার। যেন পাথর পরেছে টুপি।

প্রমাণ ব্যালকনি, অবারিত গ্যালারি- সব কিছুই রয়েছে এখানে। মূলত ধূসর হলেও কোথাও-কোথাও কলামগুলো মেরুন, ম্যাজেন্টা, কমলা রঙের ডোরা কাটা দাগে সাজানো। কোথাও আবার ক্রিম বা সবজে-পীতাভ ছোপ

গোড়া ক্ষয়ে গেছে পিলারগুলোর। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়, ছোঁয়া লাগলেই হুড়মুড় করে ধসে পড়বে।

এখানে কোনও গাছপালা নেই। খাবার-পানিও অনুপস্থিত। শুধু পাথর আর সিমেন্টের মত শক্ত কাদা।

কোনও-কোনও জায়গায় রক্তাভ শিলাস্তর খণ্ডবিখণ্ড হয়ে নুড়ির আকার ধারণ করেছে। যেন হেলায়-ফেলায় পড়ে আছে অগণ্য রুবি।

এই গম্বুজগুলোর ভেতর দিয়ে একদা উদ্দাম জলপ্রবাহ বয়ে যেত। বর্ষা মৌসুমের অঝোর বৃষ্টিপাতের ফলে কর্দমাক্ত ও খরস্রোতা নদে পরিণত হত ব্যাডল্যাণ্ডস। আক্ষরিক অর্থেই অশুভ মৃত্যুফাঁদ।

‘ডিয়োস!’ ঈশ্বরের নাম জপল আলবার্তো। কাঁদো-কাঁদো চেহারা।

হাড়গোড় ছড়িয়ে রয়েছে এখানে-ওখানে। কবে এখানে মরতে এসেছে জানোয়ারগুলো, সেটা কারও পক্ষে বলা সম্ভব নয়।

অবনত মস্তকে দাঁড়িয়ে রয়েছে ম্যানুয়েল আরবো। হ্যাটটা ঘোরাচ্ছে দুই হাত দিয়ে। রোদ থেকে বাঁচাতে সরু করে রেখেছে চোখ।

মারিয়াচিকে অসুস্থ লাগছে দেখতে।

ওপরে খিলান আকৃতির আকাশ। ইস্পাত-নীল। দূরে, বহুদূরে খাঁজকাটা পাহাড়ের অস্পষ্ট অবয়ব। মধ্যেখানে তরঙ্গায়িত জমিনের পরতে পরতে লুকিয়ে থাকা অনিশ্চয়তার কারণে মনে হচ্ছে, পথটুকু অসীম এবং দুরতিক্রম্য।

দিনটা মনে হয় অভিশপ্ত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *