সুবৰ্ণ সমাধি – ১০

দশ

আগস্ট, ১৭৯৮।

বেতের চেয়ারে বসে আছে ক্যাপ্টেন জেরার্ড মিলফোর্ড। ঘরের বাইরে চোখ।

দিগন্তসীমানায় হেলে পড়েছে সূর্য। মরে গেছে রোদ।

একটু আগেও আকাশের রং ছিল ঘন নীল। এখন ফ্যাকাসে। পশ্চিম দিকটা ঘুঁটে দেয়া ডিমের কুসুমের মত কমলা-হলুদে মেশানো।

চোখ বুজলে রণাঙ্গণের টুকরো-টুকরো দৃশ্য বায়োস্কোপের মত মনের পর্দায় আসে আর যায়। যন্ত্রণাকাতর আহত যোদ্ধার আর্তনাদ কানে এসে লাগে। গুলিগালাচের সাথে পাল্লা দিয়ে ঢাক বাজায় হৃৎপিণ্ড। বড় করে শ্বাস টানলে বারুদের তীব্র ঘ্রাণ জ্বলুনি ধরায় যেন নাসারন্ধ্রে। রক্ত আর মৃত্যুর অলীক গন্ধটা পীড়া দেয়।

শুয়ে-বসে কাটছে দিন আর রাতের বেশির ভাগ সময়। শুশ্রূষার অত্যাচারে জীবন অতিষ্ঠ! আজকে ব্যাণ্ডেজ খুলে দেয়া হয়েছে। তবে এখনই ছুটি মিলছে না এখান থেকে। আরও কিছুদিন গৃহবন্দি হয়ে থাকতে হবে।

তর সয় না!

অস্থির লাগে। সহযোদ্ধারা জীবন বাজি রেখে লড়ছে, আর সে কি না আরাম করছে নার্সিং হোমের নিরাপদ বলয়ের মধ্যে!

পদমর্যাদার কারণে কেবিন পেয়েছে। চায়নি। বরঞ্চ আপত্তি করেছে। দেশের এই অবস্থায় বাড়তি সুবিধা নেবার সে ঘোর বিরোধী। কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাতে কান দেয়নি।

চেয়ারের হাতলে এক হাতের ভর রেখে উঠে দাঁড়াল ক্যাপ্টেন। খোঁড়াতে খোঁড়াতে জানালার কাছে গেল। ডান পা-টা ঠিকমত ফেলতে পারে না এখনও। টান লাগে।

সামনে ছড়িয়ে রয়েছে বেলাভূমি। তার ওপারে পারাবার। ভাটায় টান পড়েছে। লক্ষ্মী ছেলের মত শান্ত হয়ে আছে অকূল পাথার। ঢেউয়ের গায়ে ময়ূরপাখা-রঙের খেলা।

দূরে একটা নোঙর ফেলা জাহাজ।

থিরথির করে কাঁপছে নারকেল গাছের ডগা।

বড় অদ্ভুত এই সময়টা! মন কেমন করে দেয়া বাতাস। সাথে আশ্চর্য এক নীরবতা।

নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে ঢেউ গুনতে লাগল ক্যাপ্টেন মিলফোর্ড।

অনেক কথা ভাবছে সে। অনেক পুরানো কথা। মারাত্মক একাকী লাগছে তার নিজেকে। শূন্য, ফাঁকা লাগছে সব কিছু। একসময় সে থাকবে না পৃথিবীতে। কিন্তু বাড়িটা থাকবে। এই ঘরে বসে অন্য কেউ অনুভব করবে অপরাহ্ণের অলৌকিক নিস্তব্ধতা।

পায়ের শব্দ পেয়ে ঘাড় ঘোরাল ক্যাপ্টেন।

সিস্টার মারিয়া। হাতে একগাছা হলুদ টিউলিপ। চোখাচোখি হতে হাসল।

অল্পবয়সী একটা মেয়ে। গায়ের রং কালো। মুখে বসন্তের দাগ। তার পরেও চেহারার কোথায় যেন এক ধরনের স্নিগ্ধতা লুকিয়ে আছে।

ফুলগুলো ফ্লাওয়ারভাসে গুছিয়ে রেখে বলল, ‘স্যর, একজন অফিসার আপনার সাথে দেখা করতে চায়।’

‘নাম বলেছে?’

‘না, স্যর।’

নিয়ে একটু অবাক হলো ক্যাপ্টেন জেরার্ড। হাসপাতালে ভর্তি হবার

পর থেকে নানান ধরনের লোকজন আসছে তার সাথে সাক্ষাৎ করবার জন্যে। অনুমতি দিচ্ছে না ডাক্তাররা। আজকে নিশ্চয় জরুরি কিছু!

‘ঠিক আছে, আসতে বলো।’ ভেতরে ভেতরে উদ্‌গ্রীব হয়ে উঠলেও বাইরে তা প্রকাশ করল না ক্যাপ্টেন।

ফিরে গেল নার্স।

যুদ্ধাহত সৈনিক দরজার দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল।

… বুটজুতোর শব্দ উঠল কাঠের মেঝেতে।

দূরাগত পদধ্বনি ক্রমে জোরাল হলো। আইরিশ নৌবাহিনীর কমাণ্ডার রবিন কালাহান দেখা দিল দরজায়।

দীর্ঘদেহী। পেশিবহুল। পরনে ইউনিফর্ম। তাতে লাগানো ইনসিগনিয়া তার র‍্যাঙ্ক নির্দেশ করছে।

ভেতরে ঢুকল। সামরিক কায়দায় স্যালুট করল ঊর্ধ্বতন অফিসারকে।

স্যালুটের জবাব দিল ক্যাপ্টেন মিলফোর্ড। ঝকমক করছে তার চেহারা। সহকর্মীকে দেখে আনন্দিত।

কমাণ্ডার কালাহানের হাতে বড় একটা বাদামি এনভেলাপ। চোখ দুটো নিষ্প্রভ। চেহারাটা ম্রিয়মাণ।

যুদ্ধের ক্লান্তি, ভাবল ক্যাপ্টেন। নিজেকে অপরাধী মনে হলো তার!

ফর্মালিটির ধার দিয়ে গেল না জেরার্ড। আন্তরিক স্বরে জিজ্ঞেস করল, ‘কেমন আছ, কমাণ্ডার?’

‘ভাল, স্যর।’ ম্লান হাসল কালাহান। ‘আপনি কেমন আছেন, স্যর?’

‘দিব্যি হেঁটে বেড়াচ্ছি!’ দাঁত বেরিয়ে পড়ল ক্যাপ্টেনের। ‘চাইলে এখনই রিলিজ করে দিতে পারে। কিন্তু এরা তা করবে না!’ মৃদু অনুযোগ ফুটল তার গলায়।

‘স্যর, সার্ভিসের সবাই আপনার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। আপনার তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত আর সাহসিকতার কারণে সেদিন অতগুলো প্রাণ রক্ষা পেয়েছে।’

‘রাখো তো, কমাণ্ডার!’ অধস্তন অফিসারকে ধমক লাগাল ক্যাপ্টেন। কিন্তু চেহারাতে খেলা করছে আত্মতৃপ্তি। ‘আমার কর্তব্য আমি করেছি। আমার জায়গায় তুমি হলেও তা-ই করতে। করতে না?’

‘লজ্জা দিচ্ছেন, স্যর।’ বিনয়ের অবতার সাজল কমাণ্ডার। ‘আপনার মতন যদি হতে পারতাম….

‘দোহাই, কমাণ্ডার!’ নির্ভেজাল মিনতি ঝরল ক্যাপ্টেনের কণ্ঠ থেকে। ‘আর ফুলিয়ো না। খাওয়া আর ঘুমের উপরে থাকতে থাকতে এমনিতেই ফুলে যাচ্ছি!’

নীরব হাসি হাসল কালাহান। পলকের জন্যে সজীব হয়ে উঠল মুখটা।

‘আসল কথা বলো, কমাণ্ডার,’ ক্যাপ্টেন বলল। ‘এতদূর থেকে নিশ্চয় আমার গুণকীর্তন করতে আসোনি!’

‘ক্যাপ্টেন, স্যর, আপনাকে সবাই শুভেচ্ছা জানিয়েছে।’

‘আমারও শুভেচ্ছা রইল, কমাণ্ডার।’

প্যান্টের পকেটে হাত ঢোকাল কালাহান। লাল রিবনে মোড়া ছোট্ট একটা বাক্স বের করল। অফিসারের হাতে তুলে দিল সেটা।

‘কী এটা?’ বিস্মিত চেহারায় জানতে চাইল ক্যাপ্টেন।

‘খুলুন, স্যর।’ রহস্য করল কমাণ্ডার রবিন। ‘খুলে দেখুন, ভিতরে কী আছে।’

ফিতের প্রান্ত ধরে টান দিল ক্যাপ্টেন মোহাবিষ্টের মত। খুলে এল গেরো।

বাক্সের মধ্যে, নীল মখমলের ওপরে শুয়ে আছে একটা রূপালী ব্যাজ।

ধাতুর তৈরি চাপরাশের শরীর কুঁদে একটা শব্দ লেখা। ভ্যালর।

ছোট একটা কার্ডও রয়েছে ব্যাজের সাথে।

কার্ডটা তুলে চোখের কাছে আনল ক্যাপ্টেন। ওতে লেখা:

যুদ্ধক্ষেত্রে অসামান্য বীরত্ব প্রদর্শনের জন্যে ক্যাপ্টেন জেরার্ড মিলফোর্ডকে প্রেসিডেন্টের তরফ থেকে।

চোখ মিটমিট করে কমাণ্ডারের দিকে তাকাল ক্যাপ্টেন মিলফোর্ড। ঠোঁটে সন্তুষ্টির হাসি। দায়িত্ব বেড়ে গেল এখন থেকে।

‘আর এটা, স্যর।’ হাতের খামটা বাড়িয়ে ধরল কালাহান।

নিতে নিতে জিজ্ঞেস করল ক্যাপ্টেন, ‘এটা আবার কী? প্রমোশন লেটার?’

জবাব দিতে পারল না কমাণ্ডার।

এনভেলাপটা উল্টেপাল্টে দেখল জেরার্ড। গলিত মোম ফেলে বন্ধ করা হয়েছে মুখ। শুকিয়ে যাওয়া লাল মোমের ওপরে ফুটে রয়েছে সরকারি সীলমোহর। প্রাপকের জায়গায় তার নাম লেখা।

চিকচিক করছে কালাহানের চোখ। একটু ইতস্তত করে বলল, ‘হিজ একসেলেন্সি নিজে আপনার পুরো মেডিকেল রিপোর্ট পড়ে দেখেছেন।’

কথাটার মর্মার্থ অনুধাবন করবার চেষ্টা করছে মিলফোর্ড।

‘ওখানে লেখা আছে, স্যর!’ কমাণ্ডারের গলাটা কেঁপে গেল। ঠিকা খামটা খুলল ক্যাপ্টেন। ভেতরের কাগজটা বের করে চোখের সামনে মেলে ধরল।

ছোট্ট একটা চিঠি।

ডিয়ার ক্যাপ্টেন জেরার্ড মিলফোর্ড,

আপনার শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হলো। দেশ আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ।

নীচে রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষর।

বোবা দৃষ্টিতে অধস্তনের দিকে তাকাল ক্যাপ্টেন। স্পষ্ট হস্তাক্ষরে লেখা কথাগুলোর অর্থ খুঁজে বের করতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে মস্তিষ্ক।

চোখে চোখ রাখবার সাহস পেল না কালাহান। পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে তার। মেঝের দিকে তাকিয়ে বলল কোনওমতে, ‘আ-আমি দুঃখিত, স্যর। চিকিৎসকরা জানিয়েছে, আপনি আর কোনও দিন স্বাভাবিক ভাবে হাঁটতে পারবেন না।’

যেন ঘুম থেকে জেগে উঠল ‘ক্যাপ্টেন মিলফোর্ড। তা হলে এই তার অর্জন? প্রয়োজন ফুরাতেই ছুঁড়ে ফেলা হলো তাকে পরিত্যক্ত কাপড়ের মত!

কমাণ্ডার রবিন কালাহান এই মুহূর্তে দুনিয়ার সবচেয়ে অসহায় মানুষ। ওপরের আদেশ। তার কিছু করবার নেই। তার বদলে আর কেউ যদি এই পরোয়ানা বহন করত, তা হলে খুশি হত কমাণ্ডার। কিন্তু এখানেও সে নিরুপায়। এটাও অথরিটির হুকুম। ‘না’ করবার ক্ষমতা নেই তার। মন না চাইলেও তাই অপ্রিয় কাজটা করতে হলো।

সান্ত্বনা-সমবেদনা এখন অর্থহীন। কিছুই স্পর্শ করবে না ক্যাপ্টেনকে। চলে যাওয়াই ভাল।

শেষবারের মত প্রাক্তন বসকে অভিবাদন জানাল কমাণ্ডার। চলে যাবার জন্যে ঘুরল। দরজার কাছে পৌঁছে গেছে, থেমে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল। ‘উই উইল মিস ইউ, স্যর!’

কিছুই কানে ঢুকল না ক্যাপ্টেনের। কিছুই দেখল না। অনড় দাঁড়িয়ে রইল। অনেক স্মৃতির ঝড়ে মেঘ জমল মনে। ঝাপসা হলো দৃষ্টি।

অনেকক্ষণ পরে নিজের মাঝে ফিরে এল সে। বাক্স খুলে নির্বিকার চেহারায় ব্যাজটা দেখল এক পলক। তুলে নিল মুঠোয়। সমস্ত রাগ, ক্ষোভ, হতাশা দিয়ে চেপে ধরল। আহত সিংহের চাপা গোঙানি বেরিয়ে এল বুক চিরে।

সমস্ত শক্তি দিয়ে ব্যাজটা জানালার ওপারের অন্ধকারে নিক্ষেপ করল ক্যাপ্টেন জেরার্ড মিলফোর্ড।

*

হিজ হাইনেস নিষ্ঠুর নন। ক্যাপ্টেন জেরার্ড মিলফোর্ডের সততা, কর্তব্যপরায়ণতা আর দুঃসাহসিকতার প্রতিদান তিনি দিয়েছিলেন। তাঁর বদৌলতেই উত্তরাধিকার সূত্রে জলমানবীর স্বত্ব পেয়েছে জোহান মিলফোর্ড।

চল্লিশ ফুটী যানটা জোহানের বাবাকে দেয়া প্রেসিডেন্টের পুরস্কার। খুশি হয়েই গ্রহণ করেছিল ক্যাপ্টেন মিলফোর্ড। বাস্তবতার কাছে হার মেনেছে ইমোশন।

জোহানের বয়স যখন ষোলো, সেই সময় প্রথম সাগরে বেরোয় সে বাবার সাথে। তারপর অনেকবার। কখনও বাপ-বেটা মিলে, কখনও একাই। সেসব গন্তব্য ছিল কাছেপিঠেই। এই প্রথম সে এতদূরে সফর করেছে।

‘তোমার মায়ের কথা বলো, সেনিয়োর,’ এলেনা বলল। ‘কেমন মানুষ সে?’

‘কেমন? উম…’ কী বলা যায়, ভাবছে জোহান। কম কথায় কীভাবে বিশ্লেষণ করা যায়। ‘কোমলে-কঠোরে মেশানো।

‘আমাকে বোধ হয় পছন্দ করবে না!’ সসঙ্কোচে বলল মেয়েটা।

‘এরকম মনে হচ্ছে কেন?’

‘ঝামেলায় ফেললাম যে তোমাকে!’

‘আমার তা মনে হয় না, ম্যা’ম।’ একটু গম্ভীর হলো জোহান। ‘মাকে আমি চিনি। তা ছাড়া… তোমার মতন বয়সে মাকেও প্রতিকূল অবস্থার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে।’

‘কী রকম?’ এলেনার চোখে আগ্রহের ছায়া দেখা গেল। মেকসিকান চাদরের তলে শরীরটা জুত করে নিল।

শুরু হলো গল্প।

এগারো

প্যাট্রিক বেডফোর্ড। পদবি কর্নেল। আইরিশ এই সেনা কর্মকর্তা অত্যন্ত গর্হিত কাজ করেছিল অভ্যুত্থানের সময়। দেশদ্রোহিতা। মোটা টাকার বিনিময়ে রাষ্ট্রের গোপন তথ্য পাচার করছিল ব্রিটিশ সরকারের কাছে।

একটা সময় সিক্সথ সেন্স তাকে সাবধান করে দিল। প্যাট্রিক বেডফোর্ড টের পেল, ধরা পড়তে যাচ্ছে সে। সরকারি গোয়েন্দারা জেনে গেছে তার বেইমানির কথা। হাতেনাতে ধরবার জন্যে খেলাচ্ছে ওরা তাকে।

ধরা পড়লে কী ঘটবে, সেই বিষয়ে পূর্ণ ওয়াকেফহাল ছিল কর্নেল। শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে কোর্ট-মার্শাল তো হবেই, বিচারে এমনকী মৃত্যুদণ্ডও দিয়ে দিতে পারে ওপরঅলারা। ফায়ারিং স্কোয়াডে পাঠাতে পারে।

কালবিলম্ব করল না কর্নেল। ছদ্মবেশ নিয়ে দেশ ছেড়ে পালাল। পাড়ি জমাল স্পেন অভিমুখে। হিতাকাঙ্ক্ষী এক লোক সাহায্য করল তাকে এই ব্যাপারে। সে-ও প্যাট্রিকের সাথ ধরল।

ভিনদেশে গিয়ে অসুখে পড়ল কর্নেল বেডফোর্ড। টিবি। কাশির দমকে রক্ত বেরোতে লাগল নাক-মুখ দিয়ে। মাত্রাতিরিক্ত মদ্যপান করত আগে থেকেই, আত্মপীড়ন করতে আরও বাড়িয়ে দিল পেগের পরিমাণ। ফলাফল: চরম বিদ্রোহ করে বসল শরীর।

এমন একগুঁয়ে মানুষ প্যাট্রিক, ডাক্তারও দেখাবে না! আর দেখালেই বা কী! যক্ষ্মা হলে রক্ষা আছে?

বাঁচবে না, বুঝতে পেরে অনুতপ্ত হলো কর্নেল। যুক্তিবাদী লোকটার ওপরে জীবনের শেষ বেলায় জেঁকে বসল কুসংস্কার। মাতৃভূমির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবার সাজা হিসেবে প্রাণদণ্ড দিয়েছে তাকে ঈশ্বর, এরকম একটা ধারণা জন্মাল মনে। আয়ারল্যাণ্ডে ফেলে আসা মা-হারা একমাত্র মেয়েটার প্রতি বড় বেশি অবিচার করা হয়েছে, চিন্তা করে মুষড়ে পড়ল আরও।

বিছানা নিল। পাগলামির লক্ষণ দেখা দিল আচরণে। ওই অবস্থাতেই চিঠি লিখল সে মেয়েকে।

দীর্ঘ সেই চিঠিতে পিতা হিসেবে নিজের ব্যর্থতা আর অযোগ্যতার কথা স্বীকার করল কর্নেল অকপটে। ক্ষমা চাইল মেয়ের কাছে। রাষ্ট্রদ্রোহিতার কথাও লুকাল না।

শুভাকাঙ্ক্ষী লোকটার হাতে দিয়ে পাঠানো হলো চিঠি।

কাটাকাটি আর অজস্র বানানভুলে ভরা সেই চিঠি পড়ে কেঁদে আকুল হলো রোজমেরি বেডফোর্ড। মৃত্যুপথযাত্রী বাপকে দেখতে স্পেন রওনা হলো সে।

পৃথিবীটা এক বিশ্রী জায়গা। কেবলই আশাভঙ্গ হয় এখানে। যখনই কারও মন আশায় উদ্বেল হয়ে ওঠে, তখনই নেমে আসে হতাশা।

রোজমেরি যেদিন স্পেনে পৌঁছাল, তার আগের দিনই ইহধাম ত্যাগ করল প্যাট্রিক বেডফোর্ড।

এমনই দুর্ভাগ্য মেয়ের, মৃত বাপের মুখটা পর্যন্ত দেখবার সুযোগ হলো না তার। কারও আসবার কথা ছিল না; অতএব, প্রতিবেশীরা চাঁদা তুলে কবর দিয়ে দিয়েছে বুড়োকে।

একদম একা হয়ে পড়ল মেরি। তিনকূলে আর কেউ রইল না তার।

দেশে আর ফিরল না সে। তার বাপ সেখানে খলনায়ক। নিজেকে ভাসিয়ে দিল মেরি অজানার স্রোতে। এ-ঘাট থেকে সে-ঘাটে কাটতে লাগল তার শেওলা-জীবন। করডোভা, প্যারিস, মারসাই হয়ে ভেসে চলল সে মেকসিকোর দিকে।

বারো

‘মেকসিকো যাবার পথে বাবার সাথে মায়ের পরিচয় হয়।’ জোহান থামল।

তার চোখে-মুখে তৃপ্তির চিহ্ন। শ্রোতা হিসেবে এলেনা মনটেরো প্রথম শ্রেণীর। দশে দশ পাবার যোগ্য। কথা বলে আরাম আছে।

‘একদম গল্পের মতন,’ মন্তব্যের ঢঙে বলল এলেনা, তবে গল্পের চাইতেও নাটকীয়।’

জোহান ভাবছে, এলেনার সাথে ওর যেভাবে পরিচয় হলো, সেটা কি কম নাটকীয়?

‘মায়ের মুখে শুনেছি এসব কথা,’ বলল সে।

এলেনা ভাবছে, সেনিয়োর মিলফোর্ড দেখি পুরুষ সম্পর্কে আমার সমস্ত ধারণাই পাল্টে দেবে!

এক ধরনের ধ্যানমগ্ন ভাব রয়েছে লোকটার চেহারাতে। কথা বলবার সময় অলস একটা শান্ত ভঙ্গিতে বলে। শুনবার সময় মনে হয়, উচ্চারিত প্রতিটা বাক্যের অন্তর্নিহিত অর্থ আত্মস্থ করবার চেষ্টা করছে।

চিন্তা-ভাবনার নিজস্ব একটা ধরন রয়েছে তার। সম্ভবত জগৎ সম্পর্কে আলাদা দৃষ্টিভঙ্গিও।

এক সপ্তা হলো, এই জাহাজে রয়েছে ও। লোকটা একবারও বুঝতে দেয়নি, সে তার আশ্রিতা। অন্য দু’জনও নয়। ওর অসহায়ত্বের সুযোগ নিতে পারে, এরকম আশঙ্কা ছিল মনে। কিন্তু গায়ে হাত দেয়া দূরে থাক, একটি বারও কেউ বাজে দৃষ্টিতে তাকায়নি ওর দিকে। অশোভন উক্তি কিংবা অশ্লীল ইঙ্গিত করেনি।

ঘুমাবার সময় ছাড়া চারজনে একসাথেই থাকছে। একসাথে খাচ্ছে খাবার সময়। যেন ওরা অভিন্ন পরিবারের সদস্য।

সেনিয়োর মিলফোর্ড মাঝে মাঝে হুইল ধরতে দেয়। হার্ডি বা হিপো অবশ্য দেয় না। প্রায় সব ব্যাপারে দু’জনের মতপার্থক্য থাকলেও একটা বিষয়ে তারা ঐকমত্য প্রকাশ করেছে- ব্যাটাছেলেদের কাজ ওর লাবণ্য নষ্ট করে দেবে। তবে সাগর সম্পর্কে জ্ঞান দিতে কারও কোনও কার্পণ্য নেই। পানিতে রঙের হেরফের দেখে বাতাস আর স্রোতের মতিগতি কী করে বুঝে নিতে হয়, উদার শিক্ষকের মত শিখিয়েছে ওরা তাকে।

আশ্চর্য সরল এই মানুষ দু’জন! ভাল না বেসে পারা যায় না।

সেনিয়োর মিলফোর্ডের প্রতি ভাল লাগাটাও কি প্রগাঢ় হচ্ছে না?

এটা কি প্রেমে পড়বার লক্ষণ?

তেরো

দ্বিতীয় সপ্তাহ।

নিস্তরঙ্গ সাগরে সাঁতরে চলেছে জলমানবী। নির্ভাবনায়। তবে বোটের যাত্রীরা ভাবনাহীন নয়। বরং দুর্ভাবনায় রয়েছে। কার

এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে একটু আগে। তার ফলে বিকেল যেন নবজীবন পেয়েছে। কিছুতেই ফুরাতে চাইছে না। হলুদাভ রোদে ঝিলমিল করছে সাগর। অন্যদিন হলে সাঁঝের আঁধার ঘনাত এতক্ষণে।

প্রশান্ত বাতাসের আদর উপভোগ করছে জোহান। বিমনা। সাগরের কুলুকুলু শুনতে শুনতে দুয়েকটা ঢিল ছুঁড়ছে স্মৃতির পুকুরে। আলোড়ন উঠছে পানিতে। ঢেউয়ের বড় হতে হতে মিলিয়ে যাওয়া দেখতে দেখতে অজান্তে বেরিয়ে আসছে দীর্ঘশ্বাস।

শীতকালে যখন লেকের পানি জমে বরফ হয়ে যেত, ওদের দুই ভাইকে নিয়ে মাছ ধরতে বের হত বাবা। জমাট বাঁধা লেকের ওপর দিয়ে হেঁটে জুতসই জায়গা খুঁজে বেড়াত ছিপ ফেলবার জন্যে। সব জায়গায় সমান পুরু হত না বরফ। সেজন্যে কোথাও সাদা, কোথাও ঘোলাটে কাচের মত ধারণ করত রং। সাদা অংশগুলো পাথরের মত শক্ত। আর সাদার মাঝে মাঝে যেখানে কালচে হয়ে আছে, সেখানকার বরফ পাতলা। ওপরে কয়েক ইঞ্চি জমেছে কেবল। তলার পানি পানিই রয়ে গেছে।

এরকম কোনও পাতলা স্তরের মাঝে গর্ত খুঁড়ে বড়শি ফেলা হত। খুবই হুঁশিয়ার থাকতে হত। একটু এদিক-ওদিক হলেই বরফের জমিন ফেটে যাবে চড়চড় করে। হিমঠাণ্ডা পানিতে পড়লে আর দেখতে হবে না! সাধ মিটে যাবে মাছ ধরবার। শরীরের ভারে যাতে ভেঙে না যায়, সেদিকেও সতর্ক থাকতে হত।

একবার তো সত্যিই বিপদ হয়েছিল…

একটা দ্বীপ অতিক্রম করল জলমানবী।

দ্বীপটার কী নাম, জোহানের জানা নেই। নটিকাল চার্টে থাকবার কথা। জাহাজ চলাচলের পথে যেহেতু পড়ে। ওর মত দুই পয়সার নাবিক ওসব মানচিত্র কোথায় পাবে?

নাম না জানা এরকম হাজারও আইল্যাণ্ড তারা পার হয়ে এসেছে।

সাগরের তলা থেকে যেন অকস্মাৎ বুদ্বুদের মত ভেসে ওঠে ডাঙা। আয়তন বেশি নয়।

রসদ জোগাড়ের জন্যে নামতে হয়েছে কোথাও।

নারকেল, কলা আর ব্রেডফ্রুটের ভাণ্ডার দ্বীপগুলো। খাঁড়ির পানিতে রয়েছে দেদার মাছ, গলদা চিংড়ি, কাঁকড়া, কচ্ছপ।

জঙ্গলে শুয়োর।

বেশির ভাগ দ্বীপেই জনমনিষ্যি নেই। যেগুলোতে আছে, তারাও সংখ্যায় বেশি নয়।

যেমন এটা।

সাগরবেলায় দাঁড়িয়ে আছে কয়েকটা কালো মূর্তি। দৃষ্টি অপসৃয়মান বোটটার দিকে।

মেইনল্যাণ্ড থেকে এতদূরে কীভাবে এল মানুষগুলো, সেটা একটা রহস্য। এই রহস্যের চাবি ইতিহাসের কাছে।

সভ্যতা থেকে দূরে থাকবার ঝোঁক আছে এই মানুষগুলোর মধ্যে। উৎপাত অপছন্দ করে। এক অর্থে তাই বিপজ্জনক এসব লোক।’ সেজন্যে যখনই কোথাও থেমেছে, খুব সতর্ক ছিল জোহানরা।

চকের দাগের মত তটরেখা যতক্ষণ দৃষ্টিগোচর হলো, চেয়ে রইল জোহান।

কেমন যেন নিঝঝুম হয়ে আছে ধরিত্রী।

পাখিরা চলে গেছে তাদের আস্তানায়। কালো হয়ে এসেছে বিকেলের প্রসন্ন মুখ। এদিক-ওদিক চাইতে চাইতে মন্থর পায়ে এগিয়ে আসছে তমস।

হিপো এসে দাঁড়াল জোহানের পাশে।

অস্থির প্রকৃতির এই যুবক এসেই উসখুস শুরু করল। নার্ভাস ভঙ্গিতে হাত কচলাচ্ছে। কিছু বলতে চায়। দ্বিধাদ্বন্দ্ব ঝেড়ে ফেলে শেষমেশ বলেই ফেলল, ‘তোমাকে একটা কথা বলতাম, বস! যদি কিছু মনে না করো…’

কোনও অপরাধ করে ফেলেছে?

‘বলো, কী বলবে।’

জোহানের কথায় লাই পেল হিপো। নাক চুলকাল। ‘আঁ… ইয়ে মানে… বলতে চাইছিলাম কি, বস… আমরা…’

ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করছে জোহান।

কী হতে পারে কথাটা?

ওকে না জানিয়ে কোনও কাজ করেছে?

নাকি কোনও কিছুর জন্যে পারমিশন চায়?

কানের আগা চুলকাল হিপো। খুঁত-খুঁত করে গলা পরিষ্কার করল। ‘কয়টা টাকা আলাদা করে রেখেছি তোমার জন্য। … আঁ… তোমার লাগবে, বস! ‘

চট করে আরেক দিকে মুখ ঘোরাল জোহান। চোখে পানি এসে গেছে। আবেগে রুদ্ধ হয়ে আসতে চাইছে গলা।

ওর আর্থিক অবস্থা হার্ডি আর হিপোর অজানা নেই। তার ওপর মায়ের চিঠিতে আরেক দুঃসংবাদ।

এথেন্স পোর্টের ঠিকানা দিয়ে এসেছিল সে বাড়িতে। সেই ঠিকানাতে গেছে পত্র। গ্রিস ছাড়িয়ে আরও অনেক দূর ভ্রমণ করেছে জলমানবী। ফিরতি পথে বন্দরের পোস্ট অফিসে খোঁজ নিয়েছে জোহান। চিঠি পেয়েছে।

বসের খেত আগুন লেগে ছারখার হয়ে গেছে শুনে খুবই দুঃখ পেয়েছে দুই মাল্লা। গোপনে শলা-পরামর্শ করেছে, কী করে ক্যাপ্টেনকে সাহায্য করা যায়।

নিজেকে সামলে নিয়ে হিপোর দিকে ফিরল জোহান। তবে চোখ জোড়া সিক্তই রইল তার।

সন্ধ্যার আবছায়াতে জোহানের ভেজা চোখ দেখতে পেল না পলিনেশিয়ান।

‘না, হিপো।’ কর্মীদের উপার্জনে হাত দিতে চায় না জোহান। ‘লাগবে না। আমি একটা কিছু ব্যবস্থা করে নেব।’

জোরে জোরে মাথা দোলাল হিপো ডাইনে-বাঁয়ে। ‘তোমাকে তো চিনি, বস।’ জড়তা উধাও তার গলা থেকে। ‘জানি, ঠিক- ঠিক সামলে নেবে। তার পরেও টাকাগুলো থাকল। দরকার পড়লে নিয়ো।’

যেন মহামান্য আদালত রায় জানিয়েছে। এরপরে আর কোনও কথা থাকতে পারে না।

উষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল দু’জনে পরস্পরের দিকে।

শ্রেণিবৈষম্য কখনওই প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়নি ওদের অটুট বন্ধুত্বে। বরঞ্চ একজনের জন্যে আরেকজন নির্দ্বিধায় জীবন দিয়ে দিতে প্রস্তুত।

কথা বলল না জোহান। বন্ধুর আশ্বাস অনুভব করল হৃদয় দিয়ে।

হার্ডি এসে দাঁড়াল তার আরেক পাশে। ‘মারিয়াচির ব্যাপারে কিছু ভাবলে?’

‘কী ভাবব?’

ঘসঘস করে গিজগিজে দাড়ি চুলকাল হার্ডি। ‘সেটাও অবশ্য কথা!’

ভেতরে ভেতরে যথেষ্ট উদ্বিগ্ন জোহান। কিন্তু কী করবে সে? মারিয়াচির মোকাবেলা করবে? কোন্ অধিকারে? মানবতার খাতিরে? হালে তেমন পানি পায় না এই যুক্তি। যথার্থ দাবি রয়েছে মারিয়াচির মিস মনটেরোর ওপরে। আংটি-বদল যেহেতু হয়ে গেছে।

লোকটা পিছু নিয়েছে, নিশ্চিত। কার বোট, সেটাও নিশ্চয় তার অজানা নয়। হারবারে খোঁজখবর করলেই জানা যায়। ‘নিখোঁজ’ জলমানবী সম্পর্কে যা-যা জানে- সব উগরে দিয়েছে নিশ্চয় মাঝিমাল্লার দল।

মারিয়াচি কি রানশ পর্যন্ত ধাওয়া করবে?

কে সারা সারা- যা হবার, তা হবে। আগে থেকে ভয় পেয়ে লাভ কী?

‘তবে যা-ই করো, বস, মারিয়াচিকে হালকা ভাবে নিয়ো না।’ আদরের ভঙ্গিতে চিবুকে আঙুল ঘষছে হার্ডি। ‘লোকটার সম্বন্ধে যা শুনেছি!’ শঙ্কা প্রকাশিত হলো তার গলায়।

‘কী করতে বলো আমাকে?’

শক্ত প্রশ্ন। জবাব দিতে গিয়ে থমকে গেল হার্ডি।

উত্তরের আশায় কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করল সে। জবাব খুঁজে না পেয়ে সস্তা টোব্যাকো বের করল পকেট থেকে। বিশাল এক চাকা তামাক মুখে পুরল। হার্ডি খেয়াল করেছে, এই জিনিস চাবালে বুদ্ধি খেলে।

গালের একটা পাশ ফুলে ঢোল হয়ে গেছে হার্ডির। তামাকের চাপে ফেটে যাবে বলে মনে হচ্ছে। কয়েক চিবুনি দিয়ে অন্য গালে চালান করে দিল সে তামাকের ঢেলা। কিন্তু ‘আউম-আউম’ করাই সার হলো, বুদ্ধি আর বেরোল না।

থোক করে এক দলা খয়েরি থুতু সাগরে ফেলল হার্ডি। নিজের ওপরে বিরক্ত। প্রায় বিশ্বাস করে ফেলেছে, গতরখানা তার ভীমদর্শন হলে কী হবে; হিপো যে খেপায়: ওর বুদ্ধি আসলে হাঁটুতে- কথাটা ভুল বলে না।

‘হিপো!’ বরাবরের মত হাওয়াইয়ান মেটের সরু বুদ্ধির শরণাপন্ন হলো হার্ডি।

কিন্তু হিপোর অবস্থাও তথৈবচ।

‘কঠিন সমস্যা!’ বলে মাথা চুলকাল সে। সমাধান না পেয়ে শেষে ‘দূর, ছাই!’ বলে হাল ছেড়ে দিল।

বুদ্ধির কমতি থাকতে পারে, কিন্তু সাহসের কোনও অভাব নেই দু’জনের কারও। তারই প্রতিফলন ঘটল হার্ডির কথায়। ‘যা- ই হোক, ভয় নেই তোমার। আমরা আছি।’

হিপো আর হার্ডির মত দুটো স্বর্ণহৃদয় বন্ধু পেয়েছে বলে ভাগ্যকে ধন্যবাদ দিল জোহান। ওদেরকে দিল না। বন্ধুর কাছ থেকে ‘থ্যাঙ্কস’ নেয়াটা তারা ব্যক্তিগত অপমান হিসেবে দেখে।

‘বস, মিস মনটেরোর কাছে যাও,’ হার্ডি বলল, ‘ওর জ্বর এসেছে।

চোদ্দ

মেয়েটার নাম রোজ। একুশ বছরের তরুণী। জাহাজের ফোরডেকে দাঁড়িয়ে। রেলিং-এ পিঠ দিয়ে।

বিধ্বস্ত সে। বিপর্যস্ত। জীবনের ওপরে বীতশ্রদ্ধ।

কিছুক্ষণ আগে পোর্ট ছেড়েছে জাহাজ। চলেছে আরেক গন্তব্যে। জানে না সে, কোথায়। কাউকে জিজ্ঞেস করেনি। ইচ্ছে করছে না জানতে। ইদানীং সব কিছুতে বিতৃষ্ণা এসে গেছে তার।

ঝরঝর করে কাঁদছে রোজ। বুকের মধ্যেখানে তুমুল ঝড়।

বাবা নেই। কেউ নেই। থাকলেও কে তার খবর রাখে!

কার কাছে যাবে সে? এই বিশাল পৃথিবীতে কে আছে তার?

কোথায় মিলবে একটুকু মমতার আশ্রয়? বুকে তুলে নেবে কেউ?

আজ এখানে, কাল ওখানে- এভাবে আর কয়দিন?

এত মানুষ এই জাহাজে, অথচ কেউ তার আপন নয়!

কী ভয়ঙ্কর নিঃসঙ্গ জীবন!

কী তীব্র এই একাকিত্ব!

টাকা ফুরিয়ে এসেছে। ধেড়ে ইঁদুর আর আরশোলার মত ক্লেদাক্ত দিনগুলোও ফুরাল বলে। এরপরে হয়তো সবচেয়ে সহজ পথটাই বেছে নিতে হবে বেঁচে থাকবার জন্যে। দুর্ভাগা মেয়েদের শেষ ঠিকানা হয় যেখানে।

কিন্তু এর চাইতেও সহজ রাস্তা রয়েছে মুক্তির।

এক সেকেণ্ডে মনস্থির করে ফেলল সে।

আর না!

ঢের হয়েছে এই দুঃসহ জীবনের ভার টানা। আর পারছে না! আজকেই চুকিয়ে ফেলবে সব হিসেব।

সিদ্ধান্তটা নেয়া হয়ে যেতে অবর্ণনীয় একটা প্রশান্তি অনুভব করল রোজ। জীবনের ওপরে প্রতিশোধ নিতে পারবার আনন্দে বিচিত্র হাসি খেলে গেল তার ঠোঁটে।

বড় করে দম টানল সে। পা রাখল রেলিং-এর নীচের ধাপে। এক হাতে ধরল ওপরের একটা রড। নিজেকে টেনে তুলে অন্য হাতেও ধরল সেটা। রোজের দুই পা-ই এখন প্রথম ধাপে।

সাদা রং করা রেলিং-এ মোট পাঁচটা ধাপ। তিন নম্বর ধাপ পর্যন্ত উঠে এল সে। তারপর বাম পা-টা তুলে দিল শেষ ধাপের ওপর দিয়ে। দুই হাতে আঁকড়ে ধরে আছে রডটা। নাগালের মধ্যে অবলম্বন খুঁজে নিল পা। একই ধাপে ডান পা নামিয়ে এনে জোরে শ্বাস নিল রোজ।

এবার সে নামতে আরম্ভ করল। অতি সাবধানে নেমে এল প্রথম ধাপে। ফের কিছুক্ষণ দম নিয়ে ঘুরতে শুরু করল।

হাত কাঁপছে। রক্ত সরে গিয়ে সাদা দেখাচ্ছে আঙুল আর নখগুলো। হাঁটু দুটোয়- মনে হচ্ছে, কোনও জোর নেই। গতি আর মাধ্যাকর্ষণ শক্তি ফেলে দেবার চেষ্টা করছে ষাট ফুট নীচের কালো জলে। হৃৎপিণ্ডটা এত জোরে ধুকপুক করছে, নিজের কানেই পৌছে যাচ্ছে যেন সেই শব্দ।

নীচে তাকাল রোজ।

বহু নীচে শোনা যাচ্ছে সমুদ্রের জলকল্লোল। ছলাত-ছলাত। হিস্‌স্-হিস্‌স্। পানির বুক চিরে বেরিয়ে আসা ফেনা চোখে ধরা পড়ল কি পড়ল না।

উন্মুখ হয়ে চাইল সে অনন্ত আঁধারের দিকে।

উথাল-পাথাল সমীরণে চুল উড়ছে তার। কাঁধখোলা পাতলা কাপড়ের জামায় শীত মানছে না। শিরশির করছে গালে আর গলার কাছে, যেখানে শুকিয়ে এসেছে অশ্রুর দাগ।

আর মাত্র কয়েকটা মুহূর্ত! তার পরেই সমস্ত জ্বালা আর যাতনার অবসান ঘটবে।

ডেকে কেউ নেই। সূর্যাস্ত দেখা যাত্রীর দল অনেক আগেই যার-যার কামরায় চলে গেছে। সাঁঝবাতি জ্বলে উঠবার পরেও যারা ডেক ছেড়ে নড়তে চায় না, তারাও নেই আজকে। জাহাজের স্টাফদেরকেও ধারে-কাছে চোখে পড়েনি। ঠাণ্ডাটা আজকে একটু বেশিই পড়েছে।

ভালই হলো। কেউ দেখবে না। কেউ জানবে না।

সাঁতার জানে না সে। টুপ করে গিলে নেবে তাকে পানি।

মুক্তি!

ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গেছে তার। দুনিয়ার কেউ তাকে ফেরাতে পারবে না।

রোজ ফুঁপিয়ে উঠল।

এমন তো কথা ছিল না! সে তো বাঁচতে চেয়েছিল। কত স্বপ্ন বুনেছিল জ্ঞান হবার পর থেকে! কত পরিকল্পনা ছিল জীবন নিয়ে! সব ছেড়ে অকালে চলে যেতে হচ্ছে কেন তাকে? কেন ভাগ্যদেবী সদয় হলো না তার প্রতি?

অদম্য অভিমানে রোজের গলাটা বুজে এল।

সামনের দিকে ঝুঁকে এল সে। টানটান হয়ে গেল রেলিং ধরা হাত দুটো।

জলের খলখল হাসি। বাতাসের বিলাপ। আঁধারের করাল রূপ। সবটা মিলিয়ে ওর মনে হলো, সম্মোহিত হয়ে পড়েছে। চলন্ত ট্রেন থেকে প্যাসেঞ্জাররা যেমন শুকনো পাতা উড়ে যেতে দেখে তুষারঝড়ে, এক ধরনের আচ্ছন্নতায় বুঁদ হয়ে সে-ও তেমনি দেখতে পাচ্ছে তার অতীত। হারানো দিনগুলো চোখে ধুলো দিয়ে উড়ে পালাচ্ছে যেন।

আলগা করে দিতে যাচ্ছিল হাত, এমন সময়—

‘কী করছ তুমি?’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *