কমেডি
ট্রাজেডি
সনেট

সিমবেলিন

সিমবেলিন

একবার ফিরে তোকানো যাক দু-হাজার বছর আগের দিকে। আজকের মতো সেদিনও ইংল্যান্ড বিভক্ত ছিল কতকগুলি ছোটো বড়ো রাজ্যে। ইংল্যান্ডের দক্ষিণাংশে সাগরতীরে যে বড়ো রাজ্যটি ছিল তার নাম ব্রিটেন। সে সময় ইউরোপের অধিকাংশ দেশই ছিল রোমান সাম্রাজ্যের অধীনে। রোমান বাহিনী এসে ঘাঁটি গেড়েছে ব্রিটেনের সীমাস্তে। তখনও রোমের সম্রাট হননি জুলিয়াস সিজার। রোমান সেনাবাহিনীর প্রধান সেনাপতি হিসেবে তিনি তখন দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। সারা দুনিয়া। ব্রিটেনের রাজা কেসিবেলান তার কাছে যুদ্ধে হেরে গিয়ে রোমের বশ্যতা স্বীকার করে নিয়েছেন। কিছুদিন বাদে দেশে ফিরে যান জুলিয়াস সিজার। পরবর্তীকালে তিনি নিহত হন। রোমান সেনেটের সদস্যদের হাতে। তার মৃত্যুর সাথে সাথেই ক্ষমতা দখলের লড়াই শুরু হয়ে যায় রোমান শাসকদের মাঝে। স্বভাবতই দুর্বল হয়ে পড়ে রোমান রাজশক্তি। ততদিনে মারা গেছেন ব্রিটেনের রাজা কেসিবেলান। তার ভাইপো সিমবেলিন বসেছেন সিংহাসনে। রোমান শক্তির দুর্বল অবস্থা দেখে তাদের রাজকর দেওয়া বন্ধ করলেন সিমবেলিন।

সিমবেলিনের সেনাপতি ছিলেন বেলারিয়াস। বহু যুদ্ধে পারদর্শিতা দেখিয়ে রাজার প্ৰিয়পাত্র হয়েছিলেন তিনি। ওদিকে রাজসভায় এমন অনেক অমাত্য ও সভাসদ ছিলেন যারা বেলারিয়াসকে একদম সহ্য করতে পারতেন না। তার সৌভাগ্য আর সমৃদ্ধি দেখে হিংসায় জুলে–পুড়ে মরতেন তাঁরা। বেলারিয়াসকে তার পদ থেকে সরিয়ে দেবার জন্য ওই সব অমাত্য ও সভাসদরা তার বিরুদ্ধে এক ষড়যন্ত্র করলেন। তাঁরা সবাই মিলে রাজার কাছে গিয়ে বেলারিয়াসের নামে মিথ্যে অভিযোগ জানিয়ে বললেন যে রাজাকে সরিয়ে দিয়ে সিংহাসনে বসার জন্য বেলারিয়াস গোপনে ষড়যন্ত্র করেছেন রোমানদের সাথে। তাদের অভিযোগ সত্য বলে প্রমাণ করতে তারা রাজার কাছে কিছু জাল প্ৰমাণপত্র পেশ করলেন। তাদের অভিযোগ সত্যি বলে মেনে নিলেন সিমবেলিন। তিনি বেলারিয়াসের সেনাপতির পদ, জমিদারি, বিষয় সম্পত্তি, টাকা-কড়ি সবকিছু কেড়ে নিয়ে দেশ থেকে তাড়িয়ে দিলেন তাকে। রাতারাতি সবকিছু খুইয়ে পথের ভিখারি হয়ে গেলেন নিরপরাধ বেলারিয়াস। দেশ ছেড়ে চলে যাবার আগে প্রতিজ্ঞা করে গেলেন সময়-সুযোগ এলে একদিন তিনি এই অন্যায়ের প্রতিশোধ নেবেন। সিমবেলিনের রাজত্বের সীমানা ছেড়ে ওয়েলসের জঙ্গলে গিয়ে নতুন নামে আস্তানা গাড়লেন তিনি।

রাজা সিমবেলিন ছিলেন দুই পুত্রের জনক–একটির নাম গিভেরিয়াস আর অন্যটির নাম আরভিরেগাস। বড়ো গিভেরিয়াসের বয়স তখন তিন আর ছোটো আরভিগেরাসের এক। তাদের উভয়ের দেখাশোনার ভার ছিল ইউরিদাইল নামে এক সুন্দরী যুবতির ওপর।

এদিকে কিন্তু নিশচুপ হয়ে বসে রইলেন না বেলারিয়াস। সবার অলক্ষে তিনি গোপনে দেখা করলেন ইউদাইলের সাথে–অনেক প্রলোভন দেখিয়ে হাত করলেন তাকে। বেলারিয়াসের নির্দেশে সিমবেলিনের ছেলে দুটিকে রাজপ্ৰসাদ থেকে চুরি করে ইউরিদাইল তাদের নিয়ে এলেন ওয়েলসের জঙ্গলে বেলারিয়াসের গোপন আস্তানায়। এরপর বেলারিয়াস বিয়ে করলেন রাজবাড়ির ধাই ইউরিদাইলকে। নিজের ছেলের মতো তারা মানুষ করতে লাগলেন রাজার ছেলে দুটিকে–সেই পাহাড়-ঘেরা ওয়েলসের জঙ্গলে। তারা ছেলেদুটির নতুন নাম দিলেন পলিডোর আর কডওয়াল।

হারানো ছেলে দুটির অনেক খোঁজ-খবর করলেন রাজা সিমবেলিন। কিন্তু কোথাও তাদের সন্ধান পেলেন না। কিছুদিন বাদে রানি এক কন্যা সন্তানের জননী হলেন। রাজা তার মেয়ের নাম রাখলেন আইমেজেন। সে জন্মাবার কিছুদিন বাদেই মারা গেলেন তার মা।

 

তারপর এক এক করে অনেক বছর কেটে গেছে। ওয়েলসের জঙ্গলে পালিত সেই দুই রাজপুত্র আজ পূর্ণ যুবক। যে ধাইমা ইউরিদাইল তাদের নিজের ছেলের মতো মানুষ করে গেছেন তিনি বহুদিন আগেই গত হয়েছেন। বেলারিয়াস কিন্তু এখনও বেঁচে আছেন। জঙ্গলে আস্তানা বাঁধার পর থেকেই তিনি নিজের নতুন নাম নিয়েছেন মর্গান। সেই নামেই তিনি পরিচিত তার পালিত পুত্রদের কাছে। বাবার মতোই তারা তাকে মানে, ভক্তি-শ্রদ্ধা করে। তিনিও তাদের নিজ সন্তানের মতোই ভালোবাসেন। তাদের আসল পরিচয় গোপন রেখে তিনি তাদের এমন শিক্ষা দিয়েছেন যাতে ভবিষ্যতে তারা আদর্শ রাজা হয়ে উঠতে পারে। এদিকে ততদিনে পূর্ণ যুবতি হয়ে উঠেছে রাজা সিমবেলিনের মেয়ে রাজকুমারী আইমেজেন। সে শুধু রূপসি আর গুণবতীই নয়, তার স্বভাবও খুব নম্র। তার আত্মমর্যাদাবোধ খুবই প্রবল। রাজার অবর্তমানে সেই যে সিংহাসনে বসবে তা জানে সবাই।

হঠাৎ এই বুড়ো বয়সে কী খেয়াল চাপল রাজা সিমবেলিনের মাথায়, তিনি বিয়ে করে বসলেন এক বিধবা মহিলাকে। সেই মহিলার আবার আগের পক্ষের এক ছেলে রয়েছে–নাম ক্লোটেন। বয়সে যুবক সেই ছেলে ক্লোটেন। শুধু বিবেকহীনই নয়, সে ভয়ংকর লোভী এবং চরিত্রহীন। হেন অপরাধ নেই। যা এই বয়সে সে করেনি। কোটেনের সাথে আইমোজেনের বিয়ে হলে ভবিষ্যতে সেই ব্রিটেনের সিংহাসনে বসবে, এই পরিকল্পনা মাথায় রেখেই সেই মহিলা রাজা সিমবেলিনের সাথে প্রেম-ভালোবাসার এমন অভিনয় করে যাতে তিনি বাধ্য হন মহিলাকে বিয়ে করতে।

বিয়ের পর নতুন রানি রাজপ্ৰসাদে এসে আইমোজেনকে নিজের বশে নিয়ে আসার জন্য মিষ্টি মধুর ব্যবহার করতে লাগলেন। অন্যদিকে আইমোজেনের নামে তিনি রাজার কাছে এমন সব মিথ্যে অভিযোগ জানাতে লাগলেন যাতে রাজা তার উপর চটে যান। আর সেই সাতে ভাবেন। যে তার মেয়েকে নতুন রানি নিজের মেয়ের মতোই স্নেহ করেন। রাজা যখন মেয়েকে বকা-ঝাকা করেন তখন রানি এমন মিষ্টি-মিষ্টি কথা বলে আইমোজেনকে সাস্তুনা দেন যাতে তার উপর আইমোজেনের ভক্তি-শ্রদ্ধা বেড়ে যায়।

কিন্তু এতসব করা সত্ত্বেও রানির পরিকল্পনা সফল হবার কোনও সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। ক্লোটেন যে কত বড়ো শয়তান তা বুঝতে বাকি নেই আইমোজেনের। তাই শুধু ক্লোটেন নয়, নতুন রানিকেও এতটুকু বিশ্বাস করেন না আইমেজেন। মা ও ছেলে উভয়েই তার ঘৃণার পাত্র। রাজাকে এমন বশে এনেছেন নতুন রানি যে এখন তিনি চাইছেন আইমোজেনের সাথে বিয়ে হোক ক্লোটেনের। কিন্তু আইমোজেন তারা বাবাকে সরাসরি বলে দিয়েছে সে বরং সারাজীবন কুমারী থাকবে, তবুও তারা হাল ছাড়েননি। তারা ক্লোটেনকে বলে দিয়েছেন সে যেন সবসময় চেষ্টা করে কী ভাবে আইমোজেনকে খুশি করা যায়, তার মন জয় করা যায়।

ওদিকে রাজা, রানি আর ক্লোটেন কেউ কিন্তু তখনও পর্যন্ত জানতে পারেননি যে তার মনের মতো প্রেমিককে খুঁজে পেয়েছে আইমোজেন। সে প্রেমিকের নাম পাসথুমাস। একসময় তার বাবা বীর লিওনেটাস ছিলেন রাজা সিমবেলিনের সেনাপতি। এক যুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে মারা যান লিওনেটাস। অনেক আগেই তার স্ত্রী একটি পুত্রসস্তানের জন্ম দিয়ে মারা যান। সেই অনাথ পুত্ৰ পসথুমাসকে লালন-পালনের জন্য নিজের কাছে নিয়ে আসেন রাজা সিমবেলিন, তার মেয়ে আইমোজেনের সাথে লেখা-পড়া শিখে সে বড়ো হয়ে উঠল। যৌবনে পা দিয়ে যুদ্ধবিদ্যাও শিখে নিল সে। ছোটোবেলা থেকেই তার ব্যক্তিত্ব, সততা, অধ্যবসায় দেখে তার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল আইমোজেন। যৌবনে পা দিয়ে তারা একে অপরকে ভালোবেসে ফেলল। তারপর সবার অগোচরে একদিন বিয়ে করে ফেলল। তারা। কিন্তু অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও আইমোজেনের বিয়ের খবরটা চাপা রইল না। রানির কাছে। সময়-সুযোগ বুঝে একদিন খবরটা রাজার কানে তুলে দিলেন তিনি।

আইমোজেন গোপনে পাসথুম্যাসকে বিয়ে করেছে শুনে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন রাজা সিমবেলিন। পাসথুম্যাসকে রাজসভায় ডেকে এনে নির্বাসন দণ্ড দিলেন। তাকে আদেশ দিলেন এই মুহূর্তে ব্রিটেন ছেড়ে চলে যেতে হবে এবং ভবিষ্যতে আর কখনও ফেরা চলবে না –তাহলে প্ৰাণদণ্ড হবে।

রাজার এই অমানবিক আচরণ বাধ্য হয়ে সহ্য করতে হল আইমোজেনকে, কারণ কোনও কিছু করার উপায় ছিল না তার। এই পরিবেশে ভালো মানুষ সাজতে চাইলেন রানি। আইমোজেনের জন্য যেন দুঃখে তার প্রাণ কেঁদে উঠছে এই ভাব দেখিয়ে তিনি আইমোজেনের সাথে পাসথুম্যাসের গোপনে দেখা করার ব্যবস্থা করলেন।

বিদায় দেবার সময় আইমোজেন তার হাতের আঙুল থেকে একটি আংটি খুলে নিয়ে পরিয়ে দিলেন পাসথুম্যাসের আঙুলে। এবার পসৰ্থমাস একজোড়া বালা তার স্ত্রীর হাতে পরিয়ে দিয়ে বললেন, পৃথিবীর যেখানেই থাকি না কেন, আমি কখনও ভুলতে পারব না তোমায়। এই বালা জোড়া আমার মায়ের স্মৃতি। একে সযত্নে রাখবে। এই বলে পাসথুমাস বিদায় নিলেন আইমোজেনের কাছ থেকে। নির্বাসন দণ্ড মাথায় নিয়ে রোমের পথে রওনা হলেন পাসথুম্যাস। আর বাবার প্রাসাদেই রয়ে গেল আহমোজেন।

ব্রিটেন ছেড়ে চলে গেল পাসথুমাস। সে চলে যাবার পর রাজা-রানি ক্লোটেনকে ডেকে বললেন সে যেন ধৈর্য ধরে আইমোজেনের সাথে মেলামেশা করে। তাকে আরও বোঝালেন এইভাবে মেলামেশা করলে তবেই সে আইমোজেনের মন জয় করতে পারবে কারণ পাসথুম্যাসের সাথে আর তার দেখা হবে না। তার অনুপস্থিতিতে ক্লোটেনকেই ভালোবাসতে শুরু করবে। আইমোজেন, আর একদিন তাকে বিয়ে করতেও রাজি হবে। এসব যুক্তি মনে ধরল ক্লোটেনের। সে এই আশায় ধৈর্য ধরে থাকতে রাজি হল যে শেষমেশ আইমোজেনের মতের পরিবর্তন হবে।

রোমে আসার পর পাসথুমাস আশ্রয় নিল তার বাবার এক পুরোনো বন্ধুর কাছে। তিনি তাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন রোমের অভিজাত আর সম্রােন্ত বংশীয় যুবকদের সাথে।

যা সচরাচর হয়ে থাকে সেই নিয়ম মেনেই তরুণ যুবকেরা প্রায়ই নিজেদের মধ্যে আলোচনা করত নারীর প্রেম-ভালোবাসা নিয়ে। একদিন আয়াকিমো নামে এক যুবক বলল পৃথিবীর যে কোনও মেয়ের সাথেই সে প্ৰেম-ভালোবাসা চালিয়ে যেতে পারে। সে কথা শুনে পাসথুমাস প্রতিবাদ করে বলল আহমোজেন এর ব্যতিক্রম। স্বামী ছাড়া আর কারও সাথেই প্রেম-ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে তুলবে না সে। সে কথা শুনে বাজি ধরে আয়াকিমো বলল সে ব্রিটেনে গিয়ে আইমোজেনের সাথে প্রেম-ভালোবাসা করবে। আর তার প্রমাণ এনে দেখাবেন পাসথুম্যাসকে। সে যদি প্রমাণ দেখাতে পারে তাহলেই বাজি জিতবে, নইলে নয়। আইমোজেনের উপর অগাধ বিশ্বাসের দরুন পাসথুমাস হেসেই উড়িয়ে দিল আয়াকিমোর কথা। সাথে সাথে সে রাজি হয়ে গেল বাজি ধরতে।

এর কিছুদিন বাদে সত্যি সত্যি আয়াকিমো এসে দেখা করল ব্রিটেনের রাজা সিমবেলিনের সাথে। যদিও অনেকদিন ধরে রোমকে রাজকর দেওয়া বন্ধ করেছেন সিমবেলিন, তবুও রোমের সম্মানের কথা মনে রেখে তিনি তাকে সাদরে গ্রহণ করলেন রাজসভায়। পাসথুম্যাসের স্ত্রী আইমোজেনের সাথে তার আলাপ-পরিচয় হল।

আয়াকিমো তার স্বামীর বন্ধু শুনে আইমোজেন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তার স্বামীর খোঁজ-খবর নিলেন।

সামান্য আলাপচারিতার পর আয়াকিমে বুঝতে পারলেন পুরুষের মিষ্টি কথায় ভুলে গিয়ে যে ধরনের মেয়েরা সহজেই পুরুষের প্রেমে পড়ে, মোটেও সে ধরনের মেয়ে নয়। আইমেজেন। কিন্তু সে যদি আইমোজেনের সাথে তার প্রেমের প্রমাণস্বরূপ কোনও কিছু না নিয়ে যায়, তাহলে বাজিতে সে তো প্রচুর টাকা হার বেই, সেই সাথে সবার উপহাসের পাত্র হবে। অনেক ভেবে-চিন্তে সে ঠিক করল আইমোজেনের বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে সে তাকে ঠকাবে। রোমে ফিরে যাবার আগের দিন আইমোজেনের সাথে দেখা করে আয়াকিমো বলল দেশে ফিরে গিয়ে সম্রাটকে উপহার দেবার জন্য সে কিছু দামি হিরে রত্ন কিনেছে, কিন্তু চুরি যাবার ভয়ে সেগুলি সরাইখানায় নিজের কাছে রাখতে সাহস পাচ্ছে না। অনুগ্রহ করে আইমোজেন যদি মণি-মুক্তো বোঝাই সেই বাক্সটা এবং রাতের জন্য তার কাছে রেখে দেয়, তাহলে খুবই ভালো হয়। পরদিন সকালে সে অবশ্যই বাক্সটা নিয়ে যাবে। স্বামীর বন্ধুর এই অনুরোধ অগ্রাহ্য করতে পারল না। সে রাজি হল এক রাতের জন্য বাক্সটা নিজের কাছে রাখতে। তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে খুশি মনে হাসতে হাসতে সরাইখানায় ফিরে গেল আয়াকিমো।

কিছুক্ষণ বাদে আইমোজেনের শোবার ঘরে একটা বড়োসড়ো বাক্স এনে হাজির করল সরাইখানার লোকেরা। তারা আইমোজেনের নির্দেশ অনুযায়ী বাক্সটা ঘরের এককোণে নামিয়ে রেখে তার কাছ থেকে বিকশিশ নিয়ে বিদায় নিল।

ধীরে ধীরে রাত গভীর হল। গাঢ় ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল আইমেজেন। ঠিক সে সময় বাক্সের ঢাকনা খুলে বাইরে বেরিয়ে এল আয়াকিমো। শোবার ঘরের চারপাশটা ভালো করে দেখে নিল সে। জানালার পর্দার রং, দেওয়ালের রং, ঘরে কী কী আসবাবপত্র রয়েছে, সে সব খুটিয়ে দেখে নিল আয়াকিমো। তারপর আস্তে আস্তে আইমোজেনের হাত থেকে খুলে নিল পাসথুম্যাসের দেওয়া বালা দুটো। তারপর বাক্সের ভিতর ঢুকে আয়াকিমো ভেতর থেকে বন্ধ করে দিল বাক্সের ঢাকনা।

আগে থেকেই প্রচুর বকশিশ দিয়ে সরাইখানার লোকদের ঠিক করে রেখেছিল আয়াকিমো! পরদিন সকালে তার নির্দেশমতো আবার এসে হাজির হল সরাইখানার লোকেরা। আইমোজেনোর শোবার ঘরে ঢুকে সেই বাক্সটা তারা কাধে তুলে নিয়ে চলে গেল সরাইখানায়। কিছুক্ষণ বাদে আইমোজেনের বাড়িতে এসে তাকে ধন্যবাদ জানাল আয়াকিমো।

যথাসময়ে রোমে পৌঁছে গেল আয়াকিমো! ঘুমন্ত আইমোজেনের হাত থেকে খুলে আনা বালা দুটো পসথুম্যাসকে দেখোল সে। মিথ্যে করে সে সবার সামনে বলল যে সে আইমোজেনের পাশে শুয়ে সারারাত কাটিয়েছে। পাসথুম্যাসের বিশ্বাস অর্জনের জন্য সে তাকে আইমোজেনের শোবার ঘরের খুঁটি-নাটি বর্ণনা দিল। তার কথা শুনে বিস্ময়ে অবাক হয়ে গেল পাসথুমাস, তার মাথায় (,, জি পড়ল। সে ভেবে পেল না। কী করে আইমোজেন তার মায়ের হাতের বালাজোড়া যা কিনা সে নিজে পরিয়ে দিয়েছিল তার হাতে, খুলে আয়াকিমোকে দিতে পারে! পাসথুম্যাসের মনে আর কোনও সন্দেহ রইল না যে তার স্ত্রী অসতী, কুলটা। সে ভাবতে লাগল। কী করে আইমোজেনকে উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া যায়।

 

জুলিয়াস সিজারের মৃত্যুর পর পরই প্রচণ্ড ক্ষমতার লড়াই শুরু হয়েছিল রোমের শাসকদের ভিতর। যথারীতি সে লড়াই একদিন মিটেও গেল। এবার রোমের সিংহাসনে বসলেন জুলিয়াস সিজারের ভাগ্নে অক্টেভিয়াস বা অগাস্টাস সিজার। সিংহাসনে বসেই অগাস্টাস চাইলেন সমস্ত দেশে পাকাপাকিভাবে রোমান শাসন প্রচলন করতে। সে সময়ে ফ্রান্সের নাম ছিল গল। তখন রোম সম্রাটের প্রতিনিধি হিসেবে সে দেশ শাসন করতেন রোমান সেনাপতি কেইয়াস লুসিয়াস। বহু বছর ধরে ব্রিটেন রাজকর না পাঠানোর জন্য সম্রাট অগাস্টাস তাঁর দূত হিসেবে ব্রিটেনে পাঠালেন কেইয়াস লুসিয়াসকে।

ব্রিটেনে এসে রাজা সিমবেলিনের সাথে দেখা করলেন সেনাপতি কেইয়াস লুসিয়াস। তিনি  রাজাকে বললেন যেসব রাজকর পাওনা আছে তা পুরোপুরি মিটিয়ে দিতে। কিন্তু রাজা সিমবেলিন পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন ফ্রান্সকে কোনও রাজকর দেবে না ব্রিটেন।

তাহলে রাজা সিমবেলিন, যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হন। আপনি–বলে গল-এ ফিরে গেলেন সেনাপতি কেইয়াস লুসিয়াস। কীভাবে ব্রিটেনকে আক্রমণ করা যায়। সে আয়োজনে ব্যস্ত রইলেন তিনি।

 

ব্রিটেনে পাসথুম্যাসের বাড়ি-ঘর বিষয়-সম্পত্তির দেখভাল করত তার বিশ্বস্ত ভৃত্য পিসানিও। একদিন প্রভুর কাছ থেকে মুখবন্ধ একটা খাম পেল সে। খাম খুলে দেখল তাতে দুটো চিঠি রয়েছে — একটি তার নামে আর অন্যটি আইমোজেনের নামে। নিজের নামে লেখা চিঠিটা পড়ল পিসানিও। তাতে লেখা আছে, আমার স্ত্রী যে অসতী ও কুলটা সে প্রমাণ আমি পেয়েছি পিসানিও। এই সাথে তার নামে একটা চিঠি দিলাম। তুমি সেটা অবশ্যই তাকে দিয়ে দেবে। ওই চিঠিতে লেখা আছে সে যেন গোপনে আমার সাথে দেখা করে ওয়েলসের জঙ্গলে।

এবার শোন কী করতে হবে তোমায়। তার নামে লেখা চিঠিটা আইমোজেনকে দিয়ে বলবে তার সাথে দেখা করার জন্য সবার অলক্ষে আমি লুকিয়ে রয়েছি ওয়েলসের জঙ্গলে। তবে আমি কিন্তু সত্যি সত্যি ওখানে যাব না। আমার সাথে দেখা করার অছিলায় তুমি আইমোজেনকে ওই জঙ্গলে নিয়ে গিয়ে হত্যা করবে। আরা তার রক্তমাখা জামা-কাপড় পাঠিয়ে দেবে আমার কাছে। আমার এ আদেশের যেন ব্যতিক্রম না হয়।

আইমোজেনকে লেখা যে ছোটো চিঠিটা খামের মধ্যে ছিল তা খুলে পিসানিও দেখল তাতে লেখা রয়েছে, তোমার আদর্শনে আমি যে কী ভীষণ অস্থির হয়ে উঠেছি, তা ভাষায় বৰ্ণনা করা সম্ভব নয় প্রিয়ে। শুধু তোমাকে দেখার আশায় নির্বাসন দণ্ড উপেক্ষা করেও আমি সবার অগোচরে রোম থেকে পালিয়ে এসে তোমার জন্য অপেক্ষা করছি মিলফোর্ডের কাছাকাছি ওয়েলসের জঙ্গলে। তুমি অবশ্যই পিসানিওকে সাথে নিয়ে আমার সাথে দেখা করবে।

চিঠি পড়ে তো বিস্ময়ে হতবাক পিসানিও। বলে কী? আইমোজেন অসতী, কুলটা? দিনরাত আইমোজেনের উপর নজর রাখছে পিসানিও। সে নিজের চোখেই দেখছে। যতই দিন যাচ্ছে পাসথুম্যাসের উপর আইমোজেনের ভালোবাসা ততই তীব্র হয়ে উঠেছে। তাহলে কীসের জন্য মনিব তার স্ত্রীকে অসতী, ব্যভিচারিণী বলে ভাবছেন! হয় মনিব তার স্ত্রীকে ভুল বুঝছেন, নতুবা কোনও ফেরোপবাজ লোক তাকে ভুল বুঝিয়েছে। — এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই পিসানিওর মনে।

মনিব যখন এমন একটা নিষ্ঠুর আদেশ দিয়েছেন তাকে, তখন আর চুপ করে বসে থাকলে চলবে না। ঠান্ডা মাথায় এমন একটা উপায় বের করতে হবে যাতে দুই কূল বজায় থাকে। — মনিবের আদেশও পালন করা হয়। আর সেই সাথে আইমোজেনের প্রাণ বাঁচে। আহমোজেনকে লেখা মনিবের চিঠিটা সে তার হাতে তুলে দিল।

চিঠিটা পড়ে আইমোজেনের মুখে হাসি ফুটে উঠল। তার মন-প্ৰাণ খুশিতে ভরে উঠল। যখন সে জানল শুধু তারই সাথে দেখা করার জন্য গোপনে রোম থেকে পালিয়ে এসে ওয়েলসের জঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছেন তার স্বামী। স্বামীর সাথে দেখা করার উদ্দেশ্যে সেদিন গভীর রাতে পিসানিওকে নিয়ে প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে ওয়েলসের জঙ্গল অভিমুখে রওনা হলেন আইমেজেন। অনেকক্ষণ ধরে হাঁটার পর তারা এসে পৌঁছালেন ওয়েলেসের জঙ্গলের সীমানায় মিলফোর্ডে। তখন আইমোজেন লক্ষ করে দেখলেন পিসানিওর হাবভাব যেন কেমন কেমন লাগছে। যে কোনও কারণেই হোক সে মাথা নিচু করে রয়েছে, কোনও কথা বলছে না। আইমোজেন এর কারণ জানতে চাইল পিসানিওর কাছে।

তখন পিসানিও তাকে পাসথুম্যাসের লেখা সেই চিঠিটা দেখাল যাতে তাকে হত্যা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। শুধু তাকে হত্যা করাই নয়, পাসথুমাস তাকে অসতী, কুলটা বলেছে। এ কথা জেনে থর থর করে কেঁপে উঠল আইমোজেনের সারা শরীর। সে অসতী, ব্যভিচারিণী? পিসানিওই তো দিনরাত দেখছে স্বামীর অবর্তমানে সে অন্য কোনও পুরুষের সাথে কথা বলেন না, নির্বাসিত স্বামীর কথা ভেবে সারারাত চোখের জল ফেলে, সেকিনা অসতী? আর সহ্য হল না আইমোজেনের। সে কাঁদতে কাঁদতে বলল, পসথুম্যাসের চোখে আমি যখন অসতী, ব্যভিচারিণী তখন আর বেঁচে থেকে লাভ কী? এর চেয়ে মরে যাওয়া ভালো; পিসানিও! তুমি আর দেরি না করে আমাকে হত্যা করে মনিবের আদেশ পালন কর।

পিসানিও বলল, মনিব বলেই যে আমি তার অন্যায় আদেশ মেনে নেব তা ভাববেন না আপনি। আমি নিঃসন্দেহ মনিব আপনাকে অন্যায় সন্দেহ করছেন। আমার মনে হচ্ছে কিছুদিন আগে আয়াকিমো নামে যে লোকটা এখানে ওর বন্ধু সেজে এসেছিল। সেই হয়তো রোমে ফিরে গিয়ে আপনার নামে আজে-বাজে কথা বলে মনিবের মন ভাঙিয়েছে। তাই হয়তো তিনি আপনার উপর মিথ্যে সন্দেহ করছেন। আপনি নিরাশ হবেন না। ঈশ্বরের উপর ভরসা রাখুন! যা প্রকৃত সত্য তা একদিন প্রকাশ পাবেই। ততদিন শাস্ত হয়ে অপেক্ষা করুন। আপনি। আমার মনে হয় আপনি পুরুষের ছদ্মবেশে রোমে যান, তাহলে স্বামীর অগোচরে ওর পাশে থেকে সবসময় ওর গতিবিধির উপর লক্ষ রাখতে পারবেন। তারপর সময় সুযোগ বুঝে ওর ভুল ধারণা ভেঙে দিয়ে পুনরায় তার সাথে মিলিত হতে পারবেন।

পিসানিওর পরামর্শ মনে ধরল আইমোজেনের। কিন্তু সাত তাড়াতাড়ি সে কোথায় পাবে। পুরুষের পোশাক? এ সমস্যা দেখা দেবে তা আগেই জানে পিসানিও। তাই আগে থেকেই একপ্রস্থ পুরুষের পোশাক জোগাড় করে এনেছে সে। জঙ্গলের ভেতর মশালের আলোয় সে পুরুষের বেশে সাজিয়ে দিল আইমোজেনকে। এবার সে বন্দরে গিয়ে জাহাজে চেপে পাড়ি দেবে রোমে। আর পিসানিও ফিরে যাবে তার প্রভুর প্রাসাদে।

পুরুষবেশী আইমোজেনের হাতে এবার একটা ওষুধের পুরিয়া তুলে দিল পিসানিও। ওই ওষুধটা রাজার প্রধান চিকিৎসক কর্নেলিয়াসের কাছ থেকে সংগ্রহ করে রানি সেটা পিসানিওকে দিয়ে বলেছিলেন, আই,মোজেনের কোনও অসুখ হলে এটা খাইয়ে দিও তাকে। নিমেষেই অসুখ সেরে যাবে।

পিসানিও অবশ্য রানির কথায় বিশ্বাস করে ওষুধটা নিয়েছিল, কিন্তু সেটা যে বিষ তা জানত না সে। রানির ধারণা ছিল আইমোজেনের কোনও অসুখ হলে ওই ওষুধের পুরিয়াটা তাকে খাইয়ে দেবে পিসানিও। তার ফলস্বরূপ আইমোজেন মারা যাবে আর তার ছেলে ক্লোটেনেরও সিংহাসনে বসার পথ নিষ্কণ্টক হবে। কিন্তু রানি জানতেন না। ওই পুরিয়ার ওষুধটা বিষ হলেও তা খুব কমজোরি। ওষুধটা রানিকে দেবার সময় চিকিৎসক কর্নেলিয়াস তাকে বলে দেননি যে ওই ওষুধ খেলে দেহে মৃত্যুর লক্ষণ দেখা দেবে, তবে কিছুক্ষণ বাদে ওই লক্ষণ মিলিয়ে গিয়ে রোগী পুনরায় সুস্থ হয়ে উঠবে। ইচ্ছে করেই ওষুধের এ গুণের ব্যাপারটা রানিকে বলেননি চিকিৎসক কর্নেলিয়াস।

বিদায় নিয়ে পিসানিও চলে গেলে বন্দরের দিকে রওনা দিল আইমোজেন। কিন্তু যেতে যেতে পথ হারিয়ে ফেলল সে। ঘুরতে ঘুরতে হাজির হল এক গভীর জঙ্গলে। প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে আসার সময় সে সামান্য খাবার সাথে নিয়ে এসেছিল, তা আগেই খাওয়া হয়ে গেছে। তারপর থেকে আর পেটে দানা-পানি পড়েনি। খাবার না পেলে এখন একপাও চলার সামর্থ্য নেই তার। এমন সময় তার চোেখ পড়ল পাহাড়ের গায়ে এক গুহার উপর। কৌতূহলের বশে এগিয়ে গেল সে। গুহার ভিতরে গিয়ে দেখল মানুষ থাকার চিহ্ন থাকলেও ভেতরে কেউ নেই। তবে সেখানে প্রচুর খাবার-দাবার মজুত রয়েছে। ক্ষুধায় এত কাতর হয়ে পড়েছিল আইমোজেন যে গুহার বাসিন্দারা ফিরে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করে থাকতে পারল না সে। হাতের কাছে যা পেল। তাই খেয়ে নিল। তার কিছুক্ষণ বাদেই ফিরে এল গুহার বাসিন্দারা — একজন বুড়ো মানুষ আর দুজন কমবয়সি যুবক। তাদের কাছে গিয়ে আইমোজেন নিজের নাম বলল ফাইডেল। বিনা অনুমতিতে তাদের খাবার খেয়ে নেবার জন্য মাফ চাইল আইমোজেন, মিটিয়ে দিতে চাইল খাবারের দাম। তার কথা শুনে অবাক হয়ে গেল বুড়ো আর সেই দুই যুবক। তারা জঙ্গলে গিয়ে ইচ্ছেমতো হরিণ আর অন্যান্য জানোয়ার শিকার করে আনে, দাম নিয়ে মাংস কেনার প্রয়োজন হয় না। ইচ্ছে করলে ফাইডেল আরও খাবার খেতে পারে, বরঞ্চ তাতে খুশিই হবে তারা। পুরুষের ছদ্মবেশী অল্পবয়স্ক আইমোজেনের কথা-বার্তা আর আচার-আচরণ তাদের ভালো লেগে গেল। তাদের মনে হল ও যেন খুবই মেহের পাত্র।

ওই দুই যুবক আসলে রাজা সিমবেলিনের দুই হারানো ছেলে গিভেরিয়াস আর আরভিরেগাস সম্পর্কে ওরা আইমোজেনের দুই সহোদর ভাই। আর বুড়ো মানুষটি হলেন রাজা সিমবেলিনের প্রাক্তন সেনাপতি বীর বেলারিয়াস। মগন নামে তিনি বহুদিন ধরে এই জঙ্গলের গুহায় বাস করছেন। বনের জন্তু-জানোয়ার শিকার করে তাদের মাংস আগুনে সেঁকে তিনি নিজে খান এবং ছেলে দুটিকে খাওয়ান।

এদিকে আইমোজেন অসুস্থ বোধ করছে শুনে তাকে বিশ্রাম করতে বলে শিকারে বেরিয়ে গেল। গুহাবাসীরা। সেসময় হঠাৎ মনে পড়ল তার কাছে তো ওষুধ রয়েছে। ওষুধটা দেবার সময় পিসানিও বলেছিল অসুস্থ বোধ করলে সে যেন ওষুধটা খেয়ে নেয়। তাহলে অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে সে ভালো হয়ে যাবে। সে কথা মনে পড়ায় সাত-পাঁচ না ভেবেই ওষুধটা মুখে পুরে দিল আইমেজেন। কিছুক্ষণ বাদেই মৃত্যুর লক্ষণ ফুটে উঠল তার দেহে। শিকার থেকে ফিরে এসে গিভেরিয়াস আর আরভিগেরাস দেখল প্ৰাণের চিহ্নমাত্র নেই ফাইডেল-বেশী আইমোজেনের দেহে। অতি প্রিয়জনের মৃত্যুতে মানুষ যেভাবে দুঃখ পায় সেভাবে কাঁদতে লাগল তারা।

 

এদিকে আইমোজেনের পালিয়ে যাবার খবর শুনে রেগে জ্বলে উঠল রানির প্রথম পক্ষের ছেলে ক্লোটেন। তাকে খুঁজতে খুঁজতে পাসথুম্যাসের প্রাসাদে এল সে। প্রাসাদে পিসানিও দেখেই সে বলল, কোথায় আইমোজেন?

পিসানিও ধরে নিল এতক্ষণে নিশ্চয়ই আইমোজেন জাহাজে পৌঁছেছে, তাই চিন্তা-ভাবনা না করেই সে বলে দিল, মিলফোর্ডের জঙ্গলে গেছেন। আইমেজেন।

ক্লোটেন জানতে চাইল, কেন? সেখানে কী আছে?

পিসানিও জবাব দিল, তিনি সেখানে স্বামীর সাথে দেখা করতে গেছেন।

ক্লোটেন বললেন, তুমি পাসথুম্যাসের একটা পোশাক আমায় এনে দাও। ওই পোশাক পরে আমি নিজে যাব মিলফোর্ডের বনে। দূর থেকে আমায় ওই পোশাকে দেখলে নিজে থেকেই হাজির হবে আইমোজেন।

কোনও প্রতিবাদ না করে পিসানিও তার মনিবের একটা পোশাক এনে দিল ক্লোটেনকে। সে তখনই ওই পোশাক গায়ে চাপিয়ে রওনা দিল মিলফোর্ডের জঙ্গলের দিকে। কিন্তু সেখানে পৌঁছে আইমোজেন আর পসৰ্থমাস–কাউকে দেখতে পেল না ক্লোটেন। এদিকে বেলরিয়াসের দুই পালিত পুত্র গিভেরিয়াস অরা আরভিরেগাস তখন বনে শিকার করতে বেরিয়েছে। এই নির্জন বনে একজন অচেনা মানুষকে দেখে কৌতূহলবশত এগিয়ে এল। তারা।

ক্লোটেন চিরকালই অভদ্র আর বদমেজাজি। তদুপরি রাজা-রানির ছেলে বলে সে কাউকে তোয়াক্কা করে না।

শিকারি দু-ভাইকে দেখে ধমকে উঠল ক্লেগটেন, অ্যাই, কে তোরা? তোদের নাম কী? বিনীতভাবে বলে উঠল গিভেরিয়াস, আমাদের নাম গিভেরিয়াস ও আরভিগোরাস। পুনরায় ধমকে উঠে ক্লেগটেন বলল, জনিস আমি রাজার ছেলে! তোদের এত সাহস মাথা হেঁট করে অভিবাদন না জানিয়ে তোরা আমার সাথে কথা বলছিস? তোরা তো দেখছি বেজায় অসভ্য আর জংলি।

ক্লোটেনের সাথে পালিত পুত্রদের কথা বলতে দেখে দূর থেকে কৌতূহলী হয়ে ছুটে এলেন বেলারিয়াস। আমি রাজার ছেলে কথাটা কানে যেতেই তিনি ধরে নিলেন তার এই বনে লুকিয়ে থাকার কথাটা জেনে গিয়েছিন রাজা সিমবেলিন। তাই তিনি সৈন্য-সামন্ত পাঠিয়েছেন তাকে ধরে নিয়ে যেতে। সশস্ত্ৰ বেলারিয়াস তরবারি হাতে ছুটে এলেন। সেখানে ক্লেগটেনের সাথে তার তুমুল লড়াই বেধে গেল। গিভেরিয়াস এবং আরভিরেগাসও এগিয়ে এলেন ক্লোটেনের সাথে লড়াই করতে। তাদের সম্মিলিত আক্রমণের সাথে এঁটে উঠতে না পেরে মারা গেল ক্লোটেন। তার মাথাটা কেটে নিয়ে গিভেরিয়াস ছুড়ে ফেলে দিল নিকটবতী এক নদীর জলে।

এদিকে রানির দেওয়া বিয্যের ক্ষমতা কিন্তু ততক্ষণে কেটে গেছে। জ্ঞান ফিরে এসেছে আইমোজেনের। জ্ঞান ফিরে পেতেই সে বেরিয়ে এল গুহার বাইরে। সে দেখল রক্তে ভেসে যাচ্ছে চারিদিক আর তার মাঝে পড়ে রয়েছে একটা মুণ্ডহীন দেহ — যার পরনে তার স্বামী পাসথুম্যাসের পোশাক। পোশাক দেখেই আইমোজেন নিশ্চিন্ত হল ওই মৃতদেহটি তার স্বামী পাসথুম্যাসের। সে ধরে নিল পাসথুমাস নিশ্চয়ই তার সাথে দেখা করতে এসেছিল এবং এখানে এসে কোনও গুপ্ত শত্রুর হাতে নিহত হয়েছে সে। সেই মুণ্ডহীন মৃতদেহের উপর আছড়ে পড়ে স্বামীর নাম ধরে ডুকরিয়ে কাঁদতে লাগল আইমেজেন।

সেসময় ওই বনপথ দিয়ে গল থেকে ব্রিটেন আক্রমণ করতে আসছিলেন রোমান সেনাপতি কেইয়াস লুসিয়াস। কান্নার আওয়াজ লক্ষ করে তিনি এসে দাঁড়ালেন আইমোজেনের সামনে। দূর থেকে এদিকে এত সৈন্য দেখে বেজায় ঘাবড়ে গেলে বেলারিয়াস ও তার দুই পুত্র –কাদের সৈন্য তা বুঝতে না পেরে লুকিয়ে পড়লেন তারা। কান্নার আওয়াজ লক্ষ্য করে সেনাপতি লুসিয়াস এসে দেখলেন একটি মুণ্ডহীন দেহকে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কান্না-কাটি করছে। একজন পুরুষ। তিনি পুরুষটির পরিচয় জানতে চাইলেন। সেই সাথে তিনি আরও জানতে চাইলেন ওই মৃতদেহটি কার। আর তাকে জড়িয়ে ধরে লোকটিই বা কাঁদছে কেন।

সেনাপতির প্রশ্নের জবাবে পুরুষবেশী আইমোজেন জানোল তার নাম ফাইডেল। মৃতদেহটি তার মনিবের। জঙ্গলের মাঝে একদল ডাকাত এসে হত্যা করেছে তাকে।

মৃত মনিবের শোকে ফাইডেলকে এভাবে কাঁদতে দেখে তার প্রতি মুগ্ধ হলেন সেনাপতি লুসিয়াস। নিজের চাকর হিসেবে তিনি তাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে চাইলেন। ফাইডেলের অনুরোধে ওই মৃতদেহটি জঙ্গলের মাঝে কবর দিল সেনাপতি লুসিয়াসের সৈন্যরা। সেনাপতির প্রস্তাবে রাজি হয়ে ফাইডেলবেশী আইমোজেনও গেল তার সাথে। আর না গিয়েই বা সে কী করবে একলা এই বনের ভিতর! স্বামীই যখন বেঁচে নেই তখন রোমে ফিরে গিয়ে লাভ কী!

এবার বীর্য-বিক্রমে রোমান বাহিনী ঝাপিয়ে পড়ল ব্রিটেনের উপর। তুমুল লড়াই বেধে গোল দু-দেশের মধ্যে। রাজা সিমবেলিন চুপচাপ বসে রইলেন না। যুদ্ধের জন্য নিজের সৈন্যদের সাজালেন তিনি। অসৎ চরিত্র আর শয়তান প্রকৃতির লোক হলেও যুদ্ধবিদ্যাটা কিন্তু ভালোভাবেই রপ্ত করেছিল রানির ছেলে ক্লোটেন। তার উপর যথেষ্ট ভরসা ছিল রাজা সিমবেলিনের। কিন্তু এই দুর্যোগের সময়ে সে যে কোথায় উধ, ও হয়ে গেল তা ভেবে পেলেন না তিনি।

এবার ক্লোটেনের অভাব পূরণ করতে এগিয়ে এল বেলারিয়াসের দুই পালিত পুত্র গিভেরিয়াস আর আরভিরেগাস। তারা যে রাজা সিমবেলিনের পুত্র এ কথা না জেনেও তারা সাধারণ সৈনিক হিসেবে যোগ দিয়েছিল রাজার সৈন্যদলোঁ — বোলারিয়াসের নির্দেশেই তারা সেটা করেছিল। বেলারিয়াস তাদের বুঝিয়েছিলেন শত্রু যখন দেশ আক্রমণ করেছে তখন সবার উচিত ব্যক্তিগত স্বার্থকে মনে ঠাই না দিয়ে দেশের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য যুদ্ধে যোগ দেওয়া।

ওদিকে কেউ জানে না ব্রিটেনের সাথে লড়াই করতে সেনাপতি লুসিয়াসের সৈন্যদলের সাথে এসেছে পাসথুমাস আর আয়াকিমো ইতিমধ্যে যথেষ্ট পরিবর্তন ঘটেছে পাসথুমাস মনে। পিসানিও যে তার নির্দেশে আইমোজেনকে হত্যা করেছে সে খবর পৌঁছেছে তার কানে। সেই থেকে প্ৰচণ্ড অনুতাপের জ্বালায় জুলছে সে। এ কাজ করে সে যে ঘোরতর অন্যায় করেছে তা এখন মৰ্মে মৰ্মে অনুভব করছে সে। সে সিদ্ধান্ত নিল ব্রিটেনের হয়ে রোমান সৈন্যদের সাথে লড়াই করে সে প্রাণ দেবে। তাই একদিন রাতে সবার অলক্ষ্যে গরিব চাষির সাজে ব্রিটিশ সৈন্যশিবিরে গিয়ে যোগ দিল সে।

দু-পক্ষে প্রচণ্ড লড়াই শুরু হল পরদিন সকালে। লড়াই শুরু হওয়ার খানিকক্ষণ বাদেই রাজা সিমবেলিন বন্দি হলেন রোমানদের হাতে। এর কিছুক্ষণ বাদেই গিভেরিয়াস, আরভিরেগাস এবং চাষিবেশী পাসথুমাস এবং বেলারিয়াস–এই চারজন প্রচণ্ড লড়াই করে শত্রুসৈন্যের হাত থেকে মুক্ত করলেন রাজাকে। শেষ পর্যন্ত এই চারজনের জন্যই যুদ্ধের চাকা ঘুরে গেল, হেরে গোল রোমান সৈন্যরা। বন্দি হল তাদের সেনাপতি কেইয়াস লুসিয়াস। সেই সাথে বন্দি হল তার চাকর ফাইডেল এবং আয়াকিমো।

বন্দি অবস্থায় রাজা সিমবেলিনের কাছে তার চাকর ফাইডেলের জন্য প্ৰাণভিক্ষা চাইলেন রোমান সেনাপতি কেইয়াস লুসিয়াস। সে সময় ফাইডেলের মুখের দিকে তাকিয়ে রাজার মনে হল তার মেয়ে আইমোজেনের মুখের সাথে এর মুখের যথেষ্ট মিল রয়েছে। তার উপর রাজার মায়া পড়ে গেল। তিনি ফাইডেলকে মুক্তি দিয়ে জানতে চাইলেন যদি তার কোনও প্রার্থনা থাকে, তাহলে তিনি যথাসাধ্য ভাবে সেটা পূরণ করার চেষ্টা করবেন।

তিনি ফাইডেলকে বললেন, তোমার কোনও প্রার্থনা থাকলে নিঃসঙ্কোচে বলতে পার আমাকে। বন্দি সৈন্যদের মধ্যে ছিল আয়াকিমে ইশারায় তাকে দেখিয়ে ফাইডেল বললেন, মহারাজ! ওই রোমান যুবকটিকে আমি কিছু প্রশ্ন করত চাই। অনুগ্রহ করে আপনি ওকে আদেশ দিন পাসথুম্যাস সম্পর্কে ও যা যা জানে তা যেন আমাকে খুলে বলে। ও যদি বলতে অস্বীকার করে, তাহলে ওকে বাধ্য করুন। সত্যি কথা বলতে।

এবার আয়াকিমোর দিকে তাকিয়ে রাজা সিমবেলিন বললেন, শুনলে তো এর কথা!। যদি নিজের ভালো চাও। তবে এর সব প্রশ্নের উত্তর দাও। নইলে তোমার উপর অত্যাচার করতে বাধ্য হবে আমার সৈন্যরা।

রাজার কথা শুনে ভয় পেয়ে গেল আয়াকিমো। সে তার অপরাধের কথা স্বীকার করে নিল। সে বলল কীভাবে আইমোজেনের বিশ্বাস অর্জন করে সে বাক্সের মধ্যে ঢুকে রাতের বেলা তার ঘরে গিয়ে হাত থেকে বালা জোড়া খুলে নিয়েছিল–সব স্বীকার করল সে।

চাষির ছদ্মবেশী পাসথুমাস সে সময় উপস্থিত ছিল সেখানে। আয়াকিমোর মুখে সব কথা শুনে সে দুঃখ আর বেদনায় এমনভাবে ভেঙে পড়ল যে নিজের পরিচয় আর গোপন রাখতে পারল না। স্ত্রী আইমোজেনের নাম ধরে সে হায় হায় করতে লাগল। সাথে সাথে নিজের ভাগ্যকে ধিক্কার দিতে লাগল সে। রাজা সিমবেলিন খুব খুশি হলেন যখন তিনি জানতে পারলেন চাষির ছদ্মবেশী এই বীর যোদ্ধাই পাসথুম্যাস। যুদ্ধে জয়লাভ করা আর নিজের মুক্তির জন্য এই যুবকের বীরত্বের কাছে তিনি ঋণী। একে পুরস্কৃত করতে হলে প্রয়োজন আইমোজেনকে এর হাতে তুলে দেওয়া! কিন্তু কোথায় তার মেয়ে আইমোজেন? ওদিকে চাষির ছদ্মবেশী এই বীর যুবকটিই যে তার স্বামী পাসথুমাস, সে কথা জেনে আনন্দে উৎফুল্প হয়ে উঠলেন আইমোজেন। সেইসাথে তার মনে পড়ল বনের মাঝে দেখা সেই মুণ্ডহীন মৃতদেহের কথা–যার পরনে ছিল স্বামী পাসথুম্যাসের পোশাক। সেসব কথা খুলে বলার পর আইমোজেন জানতে চাইল বনের ভিতর পাওয়া সেই মুণ্ডহীন দেহটি তবে কার?

এ কথার জবাব দিতে এগিয়ে এলাগিভেরিয়াস, বেলারিয়াসের পালিত পুত্র। সে বলল ক্লোটেন মারা যাবার পর সে তার মাথাটা কেটে নদীর জলে ফেলে দিয়েছে।

সে কথা শুনে রেগে গিয়ে সিমবেলিন জানতে চাইলেন রানির ছেলে ক্লোটেন! কে হত্যা করেছে তাকে?

বুক ফুলিয়ে গিভেরিয়াস উত্তর দিল, আমিই মেরেছি ক্লোটেনকে।

কী বললে! তুমি মেরেছি। ক্লোটেনকে? গিভেরিয়াসের কথা শুনে রেগে গিয়ে তার দিকে চোখ পাকিয়ে রাজা বললেন, এজন্য আমি তোমায় ক্ষমা করতে পারব না।

এবার এগিয়ে এসে বেলারিয়াস বললেন, কিন্তু মহারাজ যে আপনার সৎ ছেলেকে হত্যা করেছে সে যদি আপনার নিজের ছেলে হয় তাহলেও কি ক্ষমা করতে পারবেন না?

অবাক হয়ে রাজা বললেন, কী বলছেন আপনি? আমার নিজের ছেলে? এ কথার অর্থ কী? আর আপনিই বা কে?

যাওয়া দুই ছেলে গিভেরিয়াস অর আরভিরেগাস। এ সব কথা শুনে আনন্দে অধীর হয়ে গেলেন রাজা সিমবেলিন। তিনি বেলারিয়াসকে ক্ষমা করে দিয়ে তার বাজেয়াপ্ত করা সমস্ত সম্পত্তিফিরিয়ে দিলেন — আবার নতুন করে সেনাপতির পদে বহাল করলেন বেলারিয়াসকে। এবার পসথুম্যাসকে কাছে টেনে নিয়ে আইমোজেনের হাত তার হাতে দিয়ে বললেন, তিনি সানন্দে মেয়েকে তার হাতে তুলে দিচ্ছেন।

আইমোজেনের দিকে তাকিয়ে রাজা বললেন, ছোটোবেলায় হারিয়ে গিয়েছিল তোমার দুভাই। এতদিন বাদে ফিরে পেলাম তাদের। কাজেই তোমার আর রাজত্ব পাওয়া হল না।

হেসে আইমোজেন বলল, কােজ নেই আমার রাজত্ব পেয়ে। তার বদলে দু-ভাইয়ের যে স্নেহভালোবাসা পেয়েছি, সেটাই রাজত্ব পাওয়ার সমান। ফাইডেল সেজে যেদিন বনের গুহায় ওদের আশ্রয় পেয়েছিলাম, সেদিন থেকেই ওদের ভালোবাসা পেয়েছি।

সমস্ত আত্মীয়-পরিজনকে ফিরে পাবার আনন্দে রোমান বন্দিদের মুক্তি দিয়ে দিলেন রাজা সিমবেলিন; রোমান সেনাপতি কেইয়াস নিজে উদ্যোগী হয়ে রোম ও ব্রিটেনের মধ্যে সন্ধি স্থাপনের ব্যবস্থা করলেন। এ সময় রাজার কাছে খবর এল আকস্মিকভাবে মারা গেছেন রানি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *