মাচ অ্যাডু অ্যাবাউট নাথিং
মূল রচনা: উইলিয়াম শেকসপিয়র
পুনর্কথন: মেরি ল্যাম্ব
অনুবাদ: অর্ণব দত্ত
মেসিনার রাজপ্রাসাদে বাস করত দুই মেয়ে – মেসিনার গভর্নর লিওনেটোর কন্যা হিরো ও ভাইঝি বিয়াত্রিস।
বিয়াত্রিস ছিল মিশুকে স্বভাবের। কিন্তু তার বোন হিরো ছিল গম্ভীর প্রকৃতির মেয়ে। বিয়াত্রিস সবসময় তার বুদ্ধিদীপ্ত কথাবার্তার মাধ্যমে মাতিয়ে রাখত বোনকে। যা কিছু ঘটত, অবধারিতভাবে তাকে হাসির খোরাক করে তুলত বিয়াত্রিস।
সেবার এক যুদ্ধের শেষে ঘরে ফেরার পথে সেনাবাহিনীর একদল উচ্চপদস্থ তরুণ যোদ্ধা মেসিনায় লিওনেটোর সঙ্গে দেখা করতে এলেন। এঁদের মধ্যে ছিলেন অ্যারাগনের রাজকুমার ডন পেড্রো, তাঁর বন্ধু ফ্লোরেন্সের লর্ড ক্লডিও এবং পাদুয়ার লর্ড বেনেডিক। এই শেষোক্ত ব্যক্তিটি ছিলেন যেমন বুদ্ধিমান, তেমনই উচ্ছৃঙ্খল।
এঁরা সবাই আগেও মেসিনায় এসেছিলেন। অতিথিবৎসল গভর্নর তাঁর মেয়ে ও ভাইঝির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন তাঁর এই পুরনো বন্ধুদের।
প্রাসাদে পৌঁছেই বেনেডিক লিওনেটো ও রাজকুমারের সঙ্গে মশকরা জুড়ে দিলেন। লোকের কথার মধ্যে নাক না গলিয়ে থাকতে পারত না বিয়াত্রিস। সে বেনেডিকের কথার মাঝখানে বলে বসল, “এ কী সিনিওর বেনেডিক, আপনি তো বকেই চলেছেন! দেখুন, কেউই আপনার কথা শুনছেন না!” বিয়াত্রিসের মতোই প্রত্যুৎপন্নমতি বেনেডিক। কিন্তু এহেন অভিনব অভিবাদন তাঁর ভাল লাগল না। তাঁর ধারণা ছিল, এমন বাচালতা ভদ্রনারীর পক্ষে শোভনীয় নয়। তাঁর মনে পড়ে গেল, আগের বার যখন তিনি মেসিনায় এসেছিলেন, তখন এই বিয়াত্রিস বেছে বেছে তাঁরই পিছনে লেগেছিল। বেনেডিক ও বিয়াত্রিস যে পরিমাণ স্বাধীনতা নিয়ে রঙ্গতামাশা করতেন, ঠিক ততটা আর কেউই করতে পারতেন না। তাই এই দুই তীক্ষ্মবুদ্ধিধর বাগযোদ্ধার মধ্যে প্রায়ই ঝগড়া লেগে থাকত, যার অবশ্যম্ভাবী ফল হত পরস্পরের সাময়িক মনোমালিন্য ও বিচ্ছেদ। বিয়াত্রিসের উপস্থিতি তিনি এতক্ষণ খেয়াল করেননি। কিন্তু যে মুহুর্তে বিয়াত্রিস তাঁকে কথার মাঝপথে থামিয়ে কেউ তাঁর কথা শুনছেন না বলে খোঁটা দিল, অমনি তার উপস্থিতি হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করলেন বেনেডিক। তিনিও পালটা জবাব দিলেন, “এই যে শ্রীমতী অবজ্ঞা দেবী, আপনি এখনো বেঁচে আছেন?” ব্যস! পুরনো যুদ্ধ নতুন করে বেধে গেল। লম্বা লম্বা সব যুক্তির ঝনঝনা শোনা গেল। সাম্প্রতিক যুদ্ধে নিজের কৃতিত্ব সম্পর্কে বড়াই করতেন বেনেডিক। বিয়াত্রিস সেই কথা জানত। সে বলল, যুদ্ধে যতজনকে বেনেডিক মেরেছেন, সবাইকে সে একাই খেয়ে ফেলতে পারে। রাজকুমার বেনেডিকের কথায় মজা পাচ্ছেন দেখে সে বেনেডিককে বলে বসল ‘রাজকুমারের ভাঁড়’। বিয়াত্রিসের অন্য কথাগুলির চেয়ে এই কথাটিই সবচেয়ে বেশি বিঁধল বেনেডিকের। তিনি ভাবলেন, তাঁর হাতে নিহতদের খেয়ে ফেলার কথা বলে বিয়াত্রিস আসলে তাঁকে কাপুরুষ বলে ইঙ্গিত করল। তিনি ভুলেই গেলেন যে, আদতে তিনি একজন বড়ো মাপের যোদ্ধা। আসলে, ভাঁড়ামির অপমানে যে দারুণ বুদ্ধিমত্তা লুকিয়ে থাকে তার থেকে মারাত্মক আর কিছুই হয় না। কারণ, এই সব ক্ষেত্রে আনীত অভিযোগগুলির মধ্যে সত্যতা বিশেষ থাকে না। এই জন্যই বিয়াত্রিস তাঁকে ‘রাজকুমারের ভাঁড়’ বলায় তার উপর হাড়ে চটলেন বেনেডিক।
মৃদুস্বভাবা হিরো অবশ্য বিশিষ্ট অতিথিদের সামনে চুপ করেই রইল। সে তখন সুন্দরী যুবতী। তার রূপলাবণ্যে মোহিত হয়ে গেলেন ক্লডিও। অবশ্য রাজকুমার তখন বেনেডিক ও বিয়াত্রিসের মজার বাকযুদ্ধ শুনতে ব্যস্ত। লিওনেটোর কানের কাছে ফিসফিস করে বললেন, “এই সদারঙ্গময়ী তরুণীটি কিন্তু বেনেডিকের উপযুক্ত স্ত্রী হবে।” লিওনেটো উত্তরে বললেন, “বলেন কী! এরা তো বিয়ের হপ্তা না কাটতেই উন্মাদ হয়ে যাবে।” লিওনেটো উভয়ের ঝগড়াটে স্বভাবের দিকে ইঙ্গিত করলেন বটে, কিন্তু রাজকুমার এই দুই মহাবুদ্ধিধরকে পরিণয়সূত্রে বাঁধার কথা ভুলতে পারলেন না।
ক্লডিওকে নিয়ে প্রাসাদে ফেরার সময় রাজকুমার বুঝলেন এই বেলা শুধু বেনেডিক ও বিয়াত্রিসের বিয়ে দিলেই চলবে না। ক্লডিও যখন হিরোর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা শুরু করলেন, তখন তার অর্থ বুঝতে বাকি রইল না রাজকুমারের। ক্লডিওকে জিজ্ঞাসা করলেন, “হিরোকে তোমার মনে ধরে?” ক্লডিও উত্তরে বললেন, “প্রভু, শেষবার যখন মেসিনায় এসেছিলুম, তখন ওকে দেখি সৈনিকের দৃষ্টিতে। তখন ভালবাসার কথা ভাববার সময় ছিল না। কিন্তু এখন চারিদিকে শুধুই শান্তি আর আনন্দ। যুদ্ধের চিন্তা যখন আর নেই, তখন সেই শূন্যস্থান অধিকার করছে নানা মধুর ভাবনা। এখন দেখছি হিরোর রূপ। এখন মনে হচ্ছে, যুদ্ধে যাওয়ার আগেই ওর প্রেমে পড়েছিলুম আমি।” নিজমুখে এভাবে ক্লডিও হিরোর প্রতি নিজের ভালবাসার কথা স্বীকার করলে ভারি সন্তুষ্ট হলেন রাজকুমার। তক্ষুনি লিওনেটোর কাছে গিয়ে ক্লডিওকে জামাই হিসেবে গ্রহণ করার আর্জি জানালেন তিনি। লিওনেটোও রাজি হয়ে গেলেন। ক্লডিও ছিলেন দুর্লভ পদমর্যাদার লর্ড তথা রাজকুমারের অন্যতম প্রধান মিত্র। কোমল স্বভাবের মেয়ে হিরোকে ক্লডিওর প্রতি অনুরক্তা করে তুলতে বেশি সময় লাগল না রাজকুমারের। এরপর রাজকুমার ও ক্লডিও লিওনেটোর সঙ্গে কথা বলে শীঘ্র বিবাহের জন্য একটি তারিখ স্থির করে ফেললেন।
তখনও বিয়ের কয়েকটি দিন দেরি। এই ক’টা দিন ক্লডিওর কাছে অতীব দীর্ঘতর মনে হতে লাগল। সাধারণত, এমন মধুর অনুষ্ঠানের জন্য অপেক্ষা করতে করতে যুবকেরা অধৈর্য হয়ে ওঠে। রাজকুমার তাই ক্লডিওর বিরহযন্ত্রণা কমানোর চেষ্টা করলেন। এবং এই সুযোগে কীভাবে বেনেডিক ও বিয়াত্রিসকে প্রেমপাশে বদ্ধ করা যায়, তার ছক কষতে শুরু করলেন। রাজকুমারের এই খেলায় ভারি মজা পেলেন ক্লডিও। লিওনেটোও তাঁদের সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দিলেন। এমনকি হিরোও জানালো যে, খুড়তুতো বোনটিকে উপযুক্ত স্বামী খুঁজে দিতে সে সর্বতোভাবে সাহায্য করবে।
রাজকুমারের পরিকল্পনা ছিল এই রকম: তাঁরা রাজপুরুষেরা মিলে বেনেডিকের মাথায় ঢুকিয়ে দেবেন যে, বিয়াত্রিস তাঁর প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। আর হিরো বিয়াত্রিসকে বুঝিয়ে দেবে যে, বেনেডিক তার প্রেমে পড়েছে।
রাজকুমার, লিওনেটো ও ক্লডিও আগে নামলেন মাঠে। একদিন কুঞ্জবিতানে বই পড়ছিলেন বেনেডিক। রাজকুমার তাঁর সহকারীদের নিয়ে কুঞ্জবিতানের পিছনে এসে এমন জায়গায় বসলেন যাতে তাঁদের কথা স্পষ্ট বেনেডিকের কানে যায়। খানিক বিশ্রম্ভালাপের পর রাজকুমার বললেন, “এদিকে এসো, লিওনেটো। তখন কী বলছিলে? তোমার ভাইঝি বিয়াত্রিস নাকি সিনিওর বেনেডিকের প্রেমে পড়েছে? ও মেয়ে আবার কারোর প্রেমে পড়তে পারে নাকি? আশ্চর্য হলাম!” “আমিও ভাবতে পারিনি, প্রভু,” লিওনেটো উত্তর দিলেন। “ওর আচরণ দেখে তো মনে হত, বেনেডিককে ও আদৌ পছন্দ করে না। অথচ সেই বেনেডিককেই তার পছন্দ। এ তো দারুণ ব্যাপার,” বললে ক্লডিও। সে আরও জানালো, হিরোও তাকে একই কথা বলেছে। বিয়াত্রিসের বেনেডিককে এত পছন্দ যে, বেনেডিক তাকে গ্রহণ না করলে সে দুঃখে মরেই যাবে। কিন্তু লিওনেটো ও ক্লডিও দু’জনেই বলল, বিয়াত্রিসকে ভালবাসা বেনেডিকের পক্ষে অসম্ভব। কারণ, তিনি সমস্ত সুন্দরী মেয়েকেই পরিহাস করেন। বিশেষত, এই মেয়েটিকে তিনি বিশেষ অপছন্দ করেন।
রাজকুমার বিয়াত্রিসের প্রতি সহানুভূতি দেখাচ্ছিলেন। তিনি সব শুনলেন। বললেন, “বেনেডিককে একথা বললেই ভাল হয়।” ক্লডিও বলল, “কী লাভ? সে এটা নিয়ে মজা করবে, বেচারি মেয়েটা আরও কষ্ট পাবে।” রাজপুত্র বললেন, “অমন করলে ওকে ফাঁসি দেওয়া হবে! বিয়াত্রিস ভারি ভাল মেয়ে। অসাধারণ বুদ্ধিমতী মেয়ে। শুধু একটাই বোকামি সে করেছে বেনেডিককে ভালবেসে।” এই বলে রাজকুমার তাঁর সহকারীদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে সেখান থেকে চলে গেলেন। সব শুনেটুনে বেনেডিক বসলেন ভাবতে।
বেনেডিক কান খাড়া করে এই কথোপকথন শুনছিলেন। বিয়াত্রিস তাঁকে ভালবাসে শুনে তিনি মনে মনে ভাবলেন, “এও সম্ভব নাকি?” তারপর ভাবলেন, “না, হয়েও পারে। সবাই কেমন গম্ভীর হয়ে বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করছিল। ওরা আবার হিরোর থেকে ব্যাপারটা জেনেছে। বিয়াত্রিসের উপরে ওদের ভারী দরদ দেখছি! আমাকে ভালবাসে! কেন? নিশ্চয় প্রতিশোধ নিচ্ছে। আমি তো কোনোদিন বিয়ের কথা ভাবিইনি। বলেছিলাম, আমি আইবড়ো অবস্থাতেই মরব। তার মানে নিশ্চয়ই এই নয় যে আমাকে বিয়ে করে বাঁচতে হবে। ওরা বলছিল, মেয়েটা সুন্দরী ও গুণবতী। কথাটা ঠিকই। কিন্তু অমন বুদ্ধিমতী মেয়েকে শুধুমাত্র আমাকে ভালবাসার জন্য বোকা বলার কী আছে? এই যে বিয়াত্রিস এদিকেই আসছে। আজ তো ওকে ভারী সুন্দর লাগছে! দেখি চুপিচুপি, ওর মধ্যে ভালবাসার কোনো চিহ্ন দেখতে পাই কিনা।” বিয়াত্রিস বেনেডিকের দিকে এগিয়ে এল এবং স্বভাবসিদ্ধ খোঁচা দিয়ে বলল, “আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে আমাকে পাঠানো হয়েছে, আপনাকে নৈশভোজে আমন্ত্রণ জানানো জন্য।” বেনেডিক কোনোদিন বিয়াত্রিসের সামনে নরম কথা বলেননি। কিন্তু সেই মুহুর্তে তিনি বলে ফেললেন, “সুন্দরী বিয়াত্রিস, এতটা কষ্ট করার জন্য তোমাকে ধন্যবাদ জানাই।” তারপর বিয়াত্রিস তাঁকে আর দু-তিনটে কড়া কথা শুনিয়ে সেখান থেকে চলে গেল। বেনেডিক ভাবলেন, এই অশোভন কথাগুলির মধ্যে অন্য কোনো গোপন অর্থ নিহিত রয়েছে। তিনি উচ্চকণ্ঠে বলে উঠলেন, “আমি যদি ওকে দয়া না করি, তাহলে আমি দুষ্ট। আমি যদি ওকে ভাল না বাসি, তাহলে আমি একটা ইহুদি। যাই, ওর একটা ছবি জোগাড় করি।”
বেনেডিক পাতা ফাঁদে পা দিলেন। এবার বিয়াত্রিসকে ফাঁদে ফেলার পালা হিরোর। সে তার দুই সহচরী আরসুলা আর মার্গারেটকে ডেকে পাঠাল। মার্গারেটকে বলল, “ভাই মার্গারেট, বৈঠকখানায় যাও। সেখানে বিয়াত্রিস রাজপুত্র ও ক্লডিওর সঙ্গে কথা বলছে। বিয়াত্রিসের কানে তুলে দাও, আমি আর আরসুলা বাগানে ওর সম্পর্কে কী যেন বলাবলি করছি। সেই যেখানে হানিসাকল লতা সূর্যালোকের দ্বারা পুষ্ট হয়ে সূর্যের আলোকেই অকৃতজ্ঞ গোলামের মতো ঢুকতে বাধা দেয়, সেই কুঞ্জবিতানে আমরা রয়েছি। ওকে আমাদের কথায় আড়ি পাততে উসকানি দিও কিন্তু।” এই সুস্নিগ্ধ কুঞ্জবিতানেই খানিকক্ষণ আগে বেনেডিককে ফাঁদে ফেলা হয়েছিল। হিরো এখানেই বিয়াত্রিসকে পাঠানোর কথা বলল মার্গারেটকে।
মার্গারেট বলল, “আমি ওকে আনছি ওখানে। এখুনি যাচ্ছি।”
আরসুলাকে পুষ্পবিতানে নিয়ে গিয়ে হিরো বলল, “উরসুলা, বিয়াত্রিস এলেই আমরা এই পথে এদিক-ওদিক হাঁটতে থাকব। তখন শুধু কথা হবে বেনেডিককে নিয়ে। আমি ওঁর নাম করলেই, তুমি ওঁকে সেরা পুরুষমানুষ বলে ওঁর গুণগান শুরু করে দেবে। আমি তোমাকে বলব, বেনেডিক কীভাবে বিয়াত্রিসকে ভালবাসেন, সেই কথা। নাও, শুরু করো। ওই দ্যাখো, বিয়াত্রিস কেমন ল্যাপউইং পাখির মতো চুপিচুপি আসছে আমাদের কথা শুনতে।” তারা কথা শুরু করল। হিরো কোনো কথার উত্তর দেওয়ার ভঙ্গিতে উরসুলাকে বলল, “না, সত্যি বলছি, আরসুলা, ওর স্বভাব খুব খারাপ। পাহাড়ি বুনো পাখির মতো উচ্ছৃঙ্খল।” আরসুলা বলল, “কিন্তু তুমি ঠিক জানো যে, বেনেডিক বিয়াত্রিসকে ভালবাসে?” হিরো বলল, “রাজপুত্র ও আমার ভাবী-স্বামী ক্লডিও তাই বলছিলেন। তাঁরা আমাকে ওকে সবকিছু খুলে বলতে বলেছিলেন। আমি রাজি হইনি। বেনেডিক যে বিয়াত্রিসকে ভালবাসেন, সে কথাটা ওকে না জানানোই ভাল।” আরসুলা বলল, “ঠিক বলেছ, ভালবাসার কথা ও কী বুঝবে। শুধু বিষয়টা নিয়ে তামাশা করবে।” হিরো বলল, “সত্যি বলতে কী, এত বুদ্ধিমান, এত মহৎ, তরুণ এবং দুর্লভ গুণের অধিকারী মানুষ আমি আর দেখিনি। আর ও কিনা তাকে অশ্রদ্ধা করে।” আরসুলা বলল, “ঠিক বলেছ, এমন দুর্ব্যবহার সহ্য করা যায় না।” হিরো বলল, “যায় তো না-ই। কিন্তু ওকে বোঝাবে কে? আমি বললে, আমার কথা তো তামাশা করে উড়িয়ে দেবে।” আরসুলা বলল, “না না, তুমি তোমার খুড়তুতো বোনকে ভুল বুঝছ। সত্যিকারের বিচার না করে সে সিনিওর বেনেডিকের মতো এক দুর্লভ ভদ্রলোককে প্রত্যাখ্যান করবে না।” হিরো বলল, “কেমন নামজাদা মানুষ বলো। আমার প্রিয়তম ক্লডিওকে বাদ দিলে সারা ইতালি খুঁজেও অমন মানুষ মিলবে না।” এইভাবে হিরো তাঁর সঙ্গিনীকে বিষয় পরিবর্তনের ইঙ্গিত করলেন। আরসুলা বলল, “তোমার বিয়ে কবে, দিদিমণি?” হিরো তাকে বলল, পরের দিনই ক্লডিওর সঙ্গে তার বিয়ে। সেজন্য সঙ্গিনীকে সে তার নতুন পোষাকগুলি দেখিয়ে পরের দিন কী পরবে তা নিয়ে আলোচনা করতে চাইল। বিয়াত্রিস রুদ্ধশ্বাসে তাদের কথা শুনছিল। ওরা চলে যেতেই বলে উঠল, “আমার কানে এ কী আগুন ঢেলে দিয়ে গেল? এ কী সত্য? বিদায়, অশ্রদ্ধা ও অবজ্ঞা! বিদায়, কুমারীর গৌরব! বেনেডিক, ভালবাসো! তোমাকে আমার মূল্য চোকানোর সময় এসেছে। আমার বুনো হৃদয় তোমার প্রেমহস্তে বেঁধে দেবো আমি।”
দুই কট্টর দুষমন পরিণত হল প্রাণের বঁধুয়ায়। রাজকুমারের মজাদার কূটবুদ্ধির শিকার হয়ে তাঁরা একে অপরের প্রেমে পড়ে গেলেন। কিন্তু সবটা ভাল হল না। এরপর থেকে হিরোর দুর্ভাগ্যের সূচনা হল। পরদিন, অর্থাৎ তার বিয়ের দিনই হিরো ও তার বাবা লিওনেটোর জীবনে ঘনিয়ে এল এক মহাদুঃখ।
ডন জন নামে রাজকুমারের এক সৎ ভাই ছিল। চাপা স্বভাবের খিটখিটে লোক ছিল সে। সবসময় মাথায় খেলাত দুষ্টুবুদ্ধি। ভাই রাজকুমারকে সে ঘৃণা করত। আর রাজকুমারের বন্ধু বলে ক্লডিওকেও বিশেষ অপছন্দ করত। ক্লডিও আর রাজকুমারের মনে দুঃখ দেওয়ার জন্য সে ক্লডিও ও হেরোর বিয়ে ভেস্তে দেওয়ার পরিকল্পনা করল। কারণ সে জানত, রাজকুমারের বড়ো সাধ এই বিয়েটা হোক। সেই সঙ্গে ক্লডিওরও মনের একান্ত বাসনা এই পরিণয়। বদমায়েশি করার জন্য ডন জন পাঠাল বোকাশিও নামে একটা লোককে। বোকাশিও তারই মতো শয়তান। ডন জন আবার তাকে ভাল ইনামের লোভ দেখিয়ে উসকাল। বোকাশিও হেরোর সহচরী মার্গারেটকে প্রেম নিবেদন করেছিল। ডন জন সেটা জানত। কী করতে হবে তা বোরাশিওকে শিখিয়ে দিল সে। মার্গারেটকে বলতে বলল, রাতে হিরো যখন ঘুমাবে, তখন হিরোর পোষাক পরে মার্গারেট যেন হিরোর শয়নকক্ষের জানলায় এসে দাঁড়ায়। তাহলেই ক্লডিও বিশ্বাস করবে, ও-ই হল হিরো। আর তাহলেই ডন জনের উদ্দেশ্য হবে সিদ্ধ।
এরপর ডন জন গেল রাজপুত্র ও ক্লডিওর কাছে। গিয়ে বলল, হিরো নষ্ট মেয়ে। মধ্যরাতে সে ঘরের জানলায় দাঁড়িয়ে অন্য এক পুরুষের সঙ্গে কথা বলে। সেদিন বিবাহের পূর্বসন্ধ্যা। ডন জন তাদের সেই রাতেই হাতে নাতে প্রমাণ করে দিতে চাইল তার কথা। তাঁরা রাজি হয়ে গেলেন। ক্লডিও বললেন, “আজ রাতে যদি কিছু দেখতে পাই, তাহলে আমি তাকে বিবাহ করব না। কাল আমাদের বিবাহের দিন। কালই ওর চরিত্র উদ্ঘাটন করব।” রাজপুত্র বললেন, “যেহেতু ওকে লাভ করার জন্য আমি তোমাকে সাহায্য করেছিলাম। তাই ওকে অপমান করার প্রয়োজন হলে, সেই কাজে আমিই তোমাকে সাহায্য করব।”
সেদিন রাতে ডন জন তাঁদের হিরোর শয়নকক্ষের কাছে নিয়ে গেলেন। তাঁরা দেখলেন, বোরাশিও জানলার নিচে আর মার্গারেট হিরোর জানলায় দাঁড়িয়ে। মার্গারেট কথা বলছে বোরাশিওর সঙ্গে। ক্লডিও ও রাজপুত্র হিরোকে যে পোষাকে দেখেছেন, মার্গারেটকেও সেই পোষাক পরতে দেখে তাকেই হিরো মনে করলেন।
ক্লডিও সব দেখে শুনে (অর্থাৎ, যা তিনি দেখছেন বলে ভেবেছিলেন) তো রেগে অস্থির। নিষ্পাপ হেরোর প্রতি তাঁর ভালবাসা এক মুহুর্তে ঘৃণায় পরিণত হল। ঠিক করলেন, গির্জায় সকলের সামনে হাঁড়ি ভাঙবেন তিনি। রাজপুত্রও রাজি হলেন। ভাবলেন, রাত পোহালে যার সঙ্গে ক্লডিওর মতো এক মহান পুরুষের বিয়ে, সে যখন দুষ্টা স্ত্রীলোকের মতো রাতের অন্ধকারে অন্য পুরুষের সঙ্গে কথা বলে তখন তার এই রকম শাস্তি হওয়াই উচিত।
পরদিন সবাই এল বিয়ের উৎসবে। ক্লডিও ও হিরো দাঁড়ালেন পাদ্রির সামনে। পাদ্রি অনুষ্ঠান শুরু করতেই ক্লডিও মধুরভাষ্যে নির্দোষ হিরোর দোষকীর্তন শুরু করলেন। হিরো তো থ। সে বিনয়ের সঙ্গে বলল, “স্বামী, আপনি ঠিক আছেন তো? এমন কথা কেন বলছেন?”
লিওনেটো খুব ভয় পেলেন, তিনি রাজপুত্রকে বললেন, “প্রভু, আপনি কিছু বলছেন না কেন?” রাজপুত্র বললেন, “আমি কী বলব? আমি অত্যন্ত অসম্মানিত হয়েছি। আমার প্রিয় বন্ধুর সঙ্গে আমি এক অযোগ্যা স্ত্রীলোকের বিবাহ দিতে যাচ্ছিলাম। লিওনেটো, আমার সম্মানের নামে শপথ করে বলতে পারি, আমি, আমার ভাই ও ক্লডিও, কাল মধ্যরাতে ওর ঘরের জানলার নিচে দাঁড়িয়ে থাকা একটি পুরুষের সঙ্গে ওর কথোপকথন শুনেছি।”
সব শুনে তো বেনেডিকও হতবাক। তিনি বলে উঠলেন, “এ তো বিবাহসভা মনে হচ্ছে না।”
“হা ভগবান!” ভগ্নহৃদয় হিরো এই কথা বলেই অজ্ঞান হয়ে গেলেন। মৃতবৎ পড়ে রইলেন তিনি। রাজপুত্র ও ক্লডিও গির্জা ছেড়ে চলে এলেন। তাঁদের এতটাই ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন যে, হিরো সুস্থ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষাও করলেন না। ভ্রুক্ষেপও করলেন না যে কী মনোবেদনায় লিওনেটোকে তাঁরা ফেলে যাচ্ছেন।
বেনেডিক কিন্তু রয়ে গেলেন। বিয়াত্রিস বোনের শুশ্রুষা করছিল। তাকে সাহায্য করলেন বেনেডিক। বললেন, “কেমন আছে ও?” বিয়াত্রিস বলল, “মনে হচ্ছে যেন মরে গেছে।” বিয়াত্রিস তার বোনকে খুব ভালবাসত। তাই খুব দুঃখ পেয়েছিল সে। সে তার বোনের স্বভাবচরিত্র জানত। তাই তার বিরুদ্ধে আনা কোনো অভিযোগই সে বিশ্বাস করেনি। তবে হতভাগ্য বাবার অবস্থা তা ছিল না। তিনি তাঁর মেয়ের এই লজ্জাজনক অপরাধের কথা বিশ্বাস করে ফেলেছিলেন। তাই মেয়েকে মৃত মনে করে তিনি বিলাপ করতে করতে বললেন, মেয়ে যেন তাঁর আর চোখ না খোলে।
কিন্তু বৃদ্ধ পাদ্রি ছিলেন বিচক্ষণ মানুষ। তিনি মানবচরিত্র গভীরভাবে নিরীক্ষণ করেছিলেন। যখন হিরোকে দোষারোপ করা হচ্ছিল, তখন তিনি তার মুখের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছিলেন। তিনি তাকে লজ্জায় রাঙা হতে দেখেছিলেন। দেখেছিলেন, দেবসুলভ এক পাণ্ডুরতা। সেই সঙ্গে তার চোখে দেখেছিলেন এক আগুন, যে আগুনই বলে দিচ্ছিল রাজপুত্রের আনা অভিযোগগুলি ভুল। তিনি বেদনার্ত বাবাকে বললেন, “আমার বিদ্যাভ্যাস, আমার পর্যবেক্ষণ শক্তি, আমার বয়স, আমার শ্রদ্ধাবোধ, আমার বৃত্তি সব কিছুই ভুল প্রমাণিত হবে যদি এই মিষ্টি মেয়েটি দোষী প্রমাণিত হয়। ও নির্ঘাত কোনো বিশ্রী ভুলের শিকার হয়েছে।”
জ্ঞান ফিরলে তিনি হিরোকে জিজ্ঞাসা করলেন, “বাছা, যে লোকটির সঙ্গে কথা বলার জন্য তোমার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হল, সে কে?” হিরো বলল, “ওঁরাই জানেন! আমি তো অমন কাউকে চিনি না।” তারপর লিওনেটোর দিকে তাকিয়ে বলল, “বাবা, যদি প্রমাণ করতে পারো, কোনো লোক রাতের অন্ধকারে আমার সঙ্গে কথা বলে, অথবা গতকাল রাতে আমি কোনো প্রাণীর সঙ্গে বাক্যালাপ করেছি, তাহলে যা ইচ্ছে কোরো, আমাকে ত্যাগ করো, ঘৃণা কোরো, যন্ত্রণা দিয়ে হত্যা কোরো, যা ইচ্ছে কোরো!”
পাদ্রি বললেন, “নিশ্চয় কোনো অত্যাশ্চর্য ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। রাজপুত্র ও ক্লডিও ভুল বুঝেছেন।” লিওনেটোকে তিনি উপদেশ দিলেন যে, হিরোকে মৃত ঘোষণা করতে। তাঁরা হিরোর মৃতপ্রায় অবস্থা দেখেই গিয়েছিলেন। সুতরাং হিরোকে মৃত প্রমাণ করতে বেগ পেতে হবে না। সেই সঙ্গে তিনি তাঁকে উপদেশ দিলেন শোকপালন করতে, একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করতে, এবং কবর দেওয়ার সব আচার-অনুষ্ঠান পালন করতে। লিওনেটো জিজ্ঞাসা করলেন, “এসব করে কী হবে?” পাদ্রি বললেন, “এসব করে কী হবে? তাঁর মৃত্যুসংবাদ নিন্দাকে করুণায় পরিণত করবে। এটাই ভাল হবে। তবে আমি শুধু এটুকু ভালই আশা করছি না। ক্লডিও যখন শুনবেন যে তাঁর কথা শুনে হিরো মারা গিয়েছে, তাঁর চরিত্র সম্পর্কে একটি কল্পনা তাঁর মনে প্রবেশ করবে। তিনিও শোকাচ্ছন্ন হবেন। তিনি মনে করেন তাঁর আনা অভিযোগগুলি সঠিক। কিন্তু ভালবাসা কখনও তাঁর মনে আশ্রয় নিয়ে থাকলে, তিনি ভাববেন তিনি অভিযোগগুলি না তুললেই ভাল করতেন।”
বেনেডিক তখন বললেন, “লিওনেটো, পাদ্রির উপদেশ গ্রহণ করুন। আমি রাজপুত্র ও ক্লডিওকে ভালবাসি। কিন্তু এই গোপন কথাটা আমি তাদের কাছে প্রকাশ করব না।”
তাঁরা সবাই লিওনেটোকে বোঝালেন। লিওনেটো পরম দুঃখে বললেন, “আমার মন এত ভেঙে পড়ছে যে, সামান্য সুতোয় বেঁধেও আমাকে চালনা করা যাবে।” দয়ালু পাদ্রি লিওনেটো ও হিরোকে সান্ত্বনা দিতে দিতে সেখান থেকে নিয়ে চলে গেলেন। বিয়াত্রিস ও বেনেডিক রইলেন। তাঁদের বন্ধুরা তাঁদের প্রেমের ফাঁদে ফেলার পর এই ছিল তাঁদের প্রথম সাক্ষাৎ। সেই বন্ধুদের মন তখন অন্যদিকে। কেউ যে আনন্দকে নির্বাসিত করেছিল সেখান থেকে।
কথা শুরু করলেন বেনেডিক। বললেন, “লেডি বিয়াত্রিস, তুমি কী কাঁদছ?” বিয়াত্রিস বলল, “হ্যাঁ, আরও কিছুক্ষণ কাঁদব।” বেনেডিক বললেন, “আমি নিশ্চিত যে তোমার বোনকে ভুল বোঝা হচ্ছে।” বিয়াত্রিস বলল, “ওকে যে নির্দোষ মনে করে, সেই তো আমার যোগ্য সঙ্গী।” বেনেডিক তখন বললেন, “বন্ধুত্ব প্রদর্শনের কী এমন কোনো উপায় রয়েছে? আমি তোমার চেয়ে ভাল আর কাউকেই বাসি না। এ কী অদ্ভুত ব্যাপার নয়?” বিয়াত্রিস বলল, “আমি যদি বলি, আমি তোমায় ছাড়া আর কিছুই ভালবাসি না, তাহলে হয়ত বিশ্বাস করবে না। কিন্তু আমি মিথ্যে বলছি না। আমি কোনো স্বীকারোক্তি দিচ্ছি না, আবার কিছু অস্বীকারও করছি না। আমার বোনের জন্য আমার ভীষণ দুঃখ হচ্ছে।” বেনেডিক বললেন, “আমার তরবারির শপথ, তুমি আমাকে ভালবাসো, আর আমি শপথ করে বলছি, আমিও তোমাকে ভালবাসি। বলো, কী করতে হবে। আমি তাই করব।” বিয়াত্রিস বলল, “ক্লডিওকে হত্যা করো।” বেনেডিক বললেন, “না, এই জগতের বিনিময়েও নয়।” বেনেডিক তাঁর বন্ধু ক্লডিওকে ভালবাসতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, ক্লডিওকে ভুল বোঝানো হয়েছে। বিয়াত্রিস বলল, “ক্লডিও কী শয়তান নয়? সে আমার বোনকে বদনাম দিয়েছে, কটুকথা বলেছে, অপমান করেছে। আহা! আমি যদি পুরুষ হতাম!” বেনেডিক বললেন, “শোনো বিয়াত্রিস।” কিন্তু বিয়াত্রিস ক্লডিওর হয়ে কোনো কথাই শুনতে রাজি হল না। সে বেনেডিকের উপর তার বোনের অপমানের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য চাপ দিতে লাগল। বলল, “জানলায় দাঁড়িয়ে অন্য পুরুষমানুষের সঙ্গে কথা বলেছে! হা ভগবান! আমার মিষ্টি হিরো! এ কী অন্যায় তার প্রতি! কী অপমান! কী অমর্যাদা! আহা! আমি যদি পুরুষ হতাম, বা আমার যদি কোনো পুরুষ বন্ধু থাকত! সৌজন্য আর মঙ্গলকামনার মধ্যে দিয়েই বীর্য নিঃশেষিত হয়ে যায়! আমি একজন সদিচ্ছাবান পুরুষ হতে পারি না, তাই আমি শোকার্তা নারী হয়েই মরতে চাই!” বেনেডিক বললেন, “দাঁড়াও বিয়াত্রিস, আমার এই হাতের দিব্যি আমি তোমাকে ভালবাসি।” বিয়াত্রিস বলল, “আমাকে ভালবাসলে ওই হাতটা দিব্যি কাটার বদলে অন্য কাজে লাগান।” বেনেডিক বললেন, “নিজের আত্মাকে প্রশ্ন করো বিয়াত্রিস, ক্লডিও কী হিরোকে ভুল বোঝেনি?” বিয়াত্রিস বলল, “হ্যাঁ, আমার চিন্তা আছে, আত্মাও আছে।” বেনেডিক বললেন, “যথেষ্ট হয়েছে। আমি ওকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান করব। তোমার হাত চুম্বন করে বিদায় নেবো। এই হাতেই ক্লডিও আমাকে এক প্রিয় বস্তু দেবে! আমার কথা শুনলে, যাও। তোমার বোনের শুশ্রুষা করো।”
বিয়াত্রিসের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান বেনেডিকের পক্ষে সম্ভব ছিল না। বিয়াত্রিস তার বাকচাতুর্যের মাধ্যমে বেনেডিকের ক্রোধ জাগিয়ে তুলল। বেনেডিক বন্ধু ক্লডিওর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে রাজি হলেন। এদিকে লিওনেটো তাঁর কন্যার মৃত্যুসংবাদ রটিয়ে দিলেন। মেয়ের প্রতি কৃত দুর্ব্যবহারের জন্য তিনি রাজপুত্র ও ক্লডিওকে অসিযুদ্ধে আহ্বান জানালেন। তাঁরা লিওনেটোর বয়সকে সম্মান করতেন। তাঁরা বললেন, “আমাদের সঙ্গে বিবাদ করবেন না। আপনি বয়স্ক মানুষ।” তখন এলেন বেনেডিক। তিনিও হিরোকে অপমান করার জন্য ক্লডিওকে অসিযুদ্ধে আহ্বান করলেন। ক্লডিও ও রাজপুত্র পরস্পরকে বললেন, “বিয়াত্রিস নিশ্চয়ই একে আমাদের পিছনে লাগিয়েছে।” ক্লডিওকে বেনেডিকের আহ্বান গ্রহণ করতেই হত। কারণ, সেই মুহুর্তে হিরোকে নির্দোষ প্রমাণ করার জন্য কোনো স্বর্গীয় ন্যায়ের অবতারণা সম্ভব ছিল না। দ্বন্দ্বযুদ্ধের অনিশ্চিত ফলই ছিল একমাত্র ভরসা।
বেনেডিকের আহ্বান সম্পর্কে রাজপুত্র ও ক্লডিও কথা বলছেন, এমন সময় এক ম্যাজিস্ট্রেট বোরাশিওকে বন্দী করে ধরে আনলেন রাজপুত্রের সামনে। ডন জনের বদমায়েশি নিয়ে আরেকজনের কাছে বড়াই করতে গিয়ে ধরা পড়েছিল সে।
ক্লডিওর সামনে বোরাশিও সব স্বীকার করল। জানাল, মার্গারেটকে সে-ই হিরোর পোষাক পরে জানলায় দাঁড়াতে বলেছিল, যাতে সবাই তাকে হিরো মনে করে। ক্লডিও ও রাজকুমার তাই-ই ভেবেছিলেন। যেটুকু সন্দেহ রয়ে গিয়েছিল, সেটুকুও কেটে গেল ডন জনের পলায়নের সংবাদে। বদমায়েশি ধরা পড়ে যাওয়ায় ভাইয়ের রাগের হাত থেকে বাঁচতে সে মেসিনা ছেড়ে পালিয়ে যায়।
ক্লডিও বুঝলেন যে, হিরোর বিরুদ্ধে আনা তাঁর অভিযোগগুলি ভিত্তিহীন ছিল। আর এই কড়া কথাগুলিই হিরোর মৃত্যুর কারণ হয়েছে ভেবে কিন্তু দুঃখে কাতর হয়ে গেলেন। তাঁর মনে পড়ল হিরোর ছবি। মনে পড়ল, তাকে প্রথম ভালবাসার কথা। রাজকুমার জিজ্ঞাসা যখন করলেন, কথাগুলি তাঁর মনে ইস্পাতের ফলার মতো বিঁধেছে কিনা, ক্লডিও উত্তরে বললেন, বোরাশিও কথা শুনে তাঁর মনে হচ্ছিল, তিনি যেন নিজের গলায় বিষ ঢালছেন।
অনুতপ্ত ক্লডিও বৃদ্ধ লিওনেটোর কাছে তাঁর সন্তানকে অপমান করার জন্য ক্ষমা চাইলেন। বললেন, লিওনেটো যা শাস্তি দেবেন, তাই তিনি মেনে নেবেন। তিনি নিজের বাগদত্তার প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ করেছেন, তার জন্যই তাঁকে শাস্তি সহ্য করতে হবে।
লিওনেটো তাঁকে শাস্তি দিলেন। শাস্তি হল, পরদিন ক্লডিওকে হিরোর খুড়তুতো বোনকে বিয়ে করতে হবে। কারণ সে-ই এখন লিওনেটের উত্তরাধিকারিণী এবং সে-ও অনেকটা হিরোরই মতো। ক্লডিও লিওনেটোর কাছে শপথ করে বলল, এই অপরিচিতা যদি ইথিওপও হন, তাহলেও তিনি তাঁকে বিবাহ করবেন। তাঁর হৃদয় বিদীর্ণ হয়ে গেল। সারা রাত তিনি কাঁদলেন। লিওনেটো হিরোর জন্য যে সমাধিসৌধটি বানিয়েছিলেন, সেখানে বসে বিলাপ করতে লাগলেন।
সকালবেলা রাজকুমার ক্লডিওকে নিয়ে গেলেন গির্জায়। সেখানে সেই পাদ্রি, লিওনেটো ও তাঁর ভাইঝি আগেই উপস্থিত হয়েছিলেন দ্বিতীয় বিবাহোৎসবে। লিওনেটো ক্লডিওর হাতে সমর্পণ করলেন প্রতিশ্রুত বধূকে। বধূর মুখে ছিল একটি মুখোশ, যাতে ক্লডিও মুখটি চিনতে না পারেন। ক্লডিও মুখোশ-পরিহিতা মেয়েটিকে বললেন, “এই পবিত্র পাদ্রির সামনে তোমার হাতটা আমায় দাও। আমি তোমার স্বামী হব, যদি আমাকে বিবাহ কর।” অপরিচিতা বলল, “যতদিন বাঁচি, তোমার স্ত্রী হয়েই যেন বাঁচি।” এই বলে সে মুখোশটি খুলল। সে প্রমাণ করল যে, সে লিওনেটোর ভাইঝি নয়, স্বয়ং তাঁর কন্যা লেডি হিরো। আমরা নিশ্চিত যে, তাকে দেখে ক্লডিও খুব অবাক হয়েছিলেন। তিনি হিরোকে মৃত মনে করেছিলেন। তাই আনন্দে নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। রাজপুত্রও সমান আশ্চর্য হয়েছিলেন। তিনি বলে উঠলেন, “এই কী সেই হিরো নয়, যে হিরো মারা গিয়েছিল?” লিওনেটো বললেন, “প্রভু, সে তো মারা গিয়েছিল, কিন্তু তার বদনামটা বেঁচে ছিল।” পাদ্রি বললেন, অনুষ্ঠানের শেষে তিনি এই আপাত কেরামতের ব্যাখ্যা দেবেন। তিনি বিবাহের অনুষ্ঠান চালিয়ে গেলেন। মাঝখান থেকে উদয় হলেন বেনেডিক। তিনি একই সময় বিয়াত্রিসকে বিয়ে করতে চাইলেন। বিয়াত্রিস তখন আপত্তি জানাল। বেনেডিক বললেন, হিরোর কাছ থেকে তিনি জেনেছিলেন যে বিয়াত্রিস তাঁকে ভালবাসে। একটা মজাদার ব্যাখ্যা দেওয়া হল। দেখা গেল দু’জনকেই কৌশলে প্রেমের ফাঁদে ফেলা হয়েছিল। তাঁরা কেউ কাউকে ভালবাসতেন না। কিন্তু মিথ্যা এক ঠাট্টার বশে তাঁরা একে অপরের প্রেমের পাশে বাঁধা পড়েছিলেন। কিন্তু এই প্রেম যতই ঠাট্টার ফসল হোক না কেন, এতটাই শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল যে কোনো গম্ভীর ব্যাখ্যাও তাকে টলাতে পারল না। বেনেডিক যেহেতু বিবাহের প্রস্তাব দিয়েছিলেন, কোনো কিছুই তাঁকে বিবাহের সিদ্ধান্ত থেকে টলাতে পারল না। তিনি ঠাট্টাটা বজায় রাখলেন। বললেন, দয়া করেই বিয়াত্রিসকে বিয়ে করছেন তিনি। কারণ তিনি শুনেছিলেন, তিনি বিয়াত্রিসকে বিয়ে না করলে, সে দুঃখেই মরে যাবে। বিয়াত্রিস বলল, সে বেনেডিকের প্রাণ বাঁচাতে তাঁকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছিল কারণ সে শুনেছিল, তার জন্য নাকি বেনেডিক খাওয়াদাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন। এইভাবে দুই পাগলের চার হাত এক হল ক্লডিও ও হিরোর বিবাহের পর। বৃত্ত সম্পূর্ণ করার জন্য, সব বদমায়েশির মাথা ডন জনকে মেসিনায় আবার ধরে আনা হল। ওই খিটখিটে লোকটাকে শাস্তি দেওয়ার জন্য মেসিনায় তার ব্যর্থ ষড়যন্ত্র এবং সেখানকার আনন্দময় ভোজসভার সাক্ষী করে রাখা হল তাকে।
[কৃতজ্ঞতা: অর্ণব দত্ত, http://bangabharati.wordpress.com]