দ্য কমেডি অব এররস
বহুকাল ধরেই ঝগড়া-ঝাটি লেগে আছে দুটি পাশাপাশি রাজ্য সিরাকিউজ আর এফিসাসের মধ্যে। তদুপরি তাদের মনোমালিন্য আরও চরমে পৌঁছেছে সাম্প্রতিক চালু করা একটা আইন নিয়ে। একটা নতুন আইন চালু করেছেন এফিসাসের ডিউক, যা হল সিরাকিউজের কোনও নাগরিক এফিসাসে ঢুকে পড়লে তার সব টাকা-কড়ি কেড়ে নিয়ে প্রাণদণ্ড দেওয়া হবে তাকে। তবে সেই প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত ব্যক্তির পক্ষে এফিসাসের কোনও নাগরিক যদি এক হাজার মার্ক জরিমানা দেয়, তাহলে মকুব করে দেওয়া হবে সেই ব্যক্তির প্রাণদণ্ড।
ঘটনাচক্রে সিরাকিউজের এক বৃদ্ধ সওদাগর, ইজিয়ান এসে পৌঁছালেন এফিসাসে। নতুন আইন সম্পর্কে জানা ছিল না তার। স্বাভাবিকভাবেই নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে তিনি নিজেকে সিরাকিউজের অধিবাসী বলে উল্লেখ করলেন। সাথে সাথেই প্রহরীরা তার টাকা-কড়ি ও অন্যান্য জিনিস-পত্ৰ কেড়ে নিয়ে গ্রেফতার করল তাকে। তার হাত-পা বেঁধে প্রহরীরা তাকে হাজির করল এফিসাসের ডিউক সোলিনাসের সামনে। প্রহরীদের কাছে সব কথা শুনে ইজিয়নকে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করলেন ডিউক। তিনি আরও বললেন সূর্যাস্তের আগে যদি কোনও নাগরিকতার জরিমানা স্বরূপ এক হাজার মার্ক মিটিয়ে দেয়, তবেই মকুব হবে ইজিয়নের প্রাণদণ্ড। বৃদ্ধ ইজিয়ন ভেবে পেলেন না। এমন কোনো সহৃদয় নাগরিক আছে যে তার জরিমানার টাকা মিটিয়ে দেবে। এবার ডিউক জানতে চাইলেন কেন এফিসাসে এসেছে ইজিয়ন। ডিউকের প্রশ্নের জবাবেইজিয়ন, তার জীবনের করুণ কাহিনি শোনাতে লাগলেন ডিউককে।
ইজিয়ান বলতে লাগলেন, আমি সিরাকিউজে জন্মেছি। বড়ো হয়ে আমার পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছি ব্যবসা-বাণিজ্যকে। বিবাহিত জীবন সুখেই কেটেছে। এপিড্যামনামে আমার ব্যবসার দেখ-ভাল করত এক বিশ্বস্ত কর্মচারী। সে মারা যাবার পর অন্য কাউকে দায়িত্ব না দিয়ে আমি নিজেই চলে এলাম এপিডামনামে। সেখানে এসে ব্যবসার নানা কাজে জড়িয়ে পড়লাম। আমি। সে সব কাজ মিটিয়ে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরা গেল না –। এমনকি ছমাসেও শেষ হল না সে সব কাজকর্ম। আমি বাড়ি না ফেরায় স্বভাবতই অস্থির হয়ে উঠল। স্ত্রী এমিলিয়া। আমি চলে যাবার সময় স্ত্রী এমিলিয়া ছিল গর্ভবতী-আমার জন্য সে ব্যাকুল হয়ে উঠল। শেষে থাকতে না পেরে অন্য এক জাহাজে চেপে হাজির হল আমার কাছে এপিড্যামনামে। সেখানে আসার অল্পদিন বাদেই আমার স্ত্রী যমজ ছেলের জন্ম দিলেন। ছেলে দুটি দেখতে হুবহু এক রকম। — কোনও তফাত নেই তাদের। আমরা উভয়ের নামকরণ করলাম অ্যান্টিফোলাস — একজন বড়ো অ্যান্টিফোলাস আর অন্যজন ছোটো অ্যান্টিফোলাস। এক এক সময় আমরাই বুঝে উঠতে পারতাম না ওদের মধ্যে কে বড়ো, কে ছোটো।
আমার প্রতিবেশিনী ছিলেন এক দরিদ্র মহিলা। তিনি ও আমার স্ত্রী, উভয়ে একই দিনে সন্তান প্রসব করেন। আশ্চর্যের কথা, ওই মহিলাও আমার স্ত্রীর মতো যমজ সন্তানের জন্ম দেন। দুৰ্ভাগ্যবশত যমজ সন্তান প্রসব করেই ওই মহিলা মারা যান। ওই বাপ-মা হারা ছেলে দুটিকে আমি তখন নিজ বাড়িতে নিয়ে আসি। ভেবেছিলাম বড়ো হয়ে ওই শিশু দুটি আমার দুই ছেলের চাকরের কাজ করবে। মহামান্য ডিউক! আপনি বিশ্বাস করবেন। কিনা জানি না, আমার যমজ ছেলেদুটির মতো ওই শিশু দুটিও ছিল হুবহু একই রকম। আমি তাদের নাম দিলাম বড়ো ড্রোমিও আর ছোটো ড্রোমিও।
এপিড্যামনামে কয়েক বছর বাস করার পর আমার স্ত্রী তাগাদ দিতে লাগলেন দেশে ফেরার জন্য। রোজ রোজ তাগাদা শুনে আমিও সিদ্ধান্ত নিলাম দেশে ফেরার। একদিন স্ত্রী এমিলিয়া, বড়ো অ্যান্টিফোলাস, ছোটো অ্যান্টিফোলাস, বড়ো ড্রোমিও আর ছোটো ড্রোমিওকে নিয়ে জাহাজে চেপে রওনা দিলাম দেশের উদ্দেশে। দুদিন দু রাত নির্বিয়ে কেটে গেল জাহাজে। তৃতীয় দিন দুপুর থেকেই জটিল হতে লাগল পরিস্থিতি। একফালি ঘন কালো মেঘ দেখা দিল আকাশের এক কোণে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই একটুকরো মেঘ ছেয়ে ফেলল। সারা আকাশকে, সাথে সাথে শুরু হল ঝড়-বৃষ্টির দাপট। প্রতিমুহূর্তেই আমাদের মনে হচ্ছিল জাহাজটা যেন ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। প্রকৃতির তাণ্ডবের হাত থেকে রক্ষা পেতে জাহাজের ক্যাপ্টেন আর মাঝি-মাল্লারা ছোটো ছোটো, নৌক জলে নামিয়ে যে যেদিকে পারে পালিয়ে গেল। এক মুহুর্তের জন্যও কেউ ভাবল না। আমাদের কথা। কী করব ভেবে পাচ্ছিলাম না, এমন সময় চোখে পড়ল পাটাতনের এক কোণে রাখা জাহাজের একটি বাড়তি মাস্তুলের উপর। আমনি মাথায় এক বুদ্ধি এসে গেল। ওই মাস্তুলের একদিকে শক্ত করে বাঁধলাম স্ত্রী এমিলিয়া, ছোটো অ্যান্টিফোলাস আর ছোটো ড্রোমিওকে, আর অন্যদিকে বাঁধলাম বড়ো অ্যান্টিফোলাস, বড়ো ড্রোমিও আর নিজেকে। এরপর যা হয় হোক ভেবে নিয়ে বাঁপিয়ে পড়লাম সমুদ্রের জলে। জলে ভেসে থাকতে কোনও অসুবিধা হল না। উদ্দেশ্যহীনভাবে আমরা ভেসে চললাম। উত্তাল সমুদ্রের বুকে। ঝড়টা যখন সবে স্তিমিত হয়ে আসছে, সে সময় ঘটে গেল এক অদ্ভূত ঘটনা। ডুবোপাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে মাস্তুলটা ভেঙে দু-টুকরো হয়ে গেল। মুহুর্তের মধ্যে আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম স্ত্রী এমিলিয়া, ছোটো অ্যান্টিফোলাস ও ছোটো ড্রোমিওর কাছ থেকে। অসহায়ভাবে চেয়ে দেখলাম ভাঙা মাস্তুলটা তাদের নিয়ে চলেছে। আমাদের উল্টোদিকে। কিছুক্ষণ বাদে দূর থেকে দেখলাম একটা ছোটো নৌকা এসে তাদের তুলে নিল সেই জাহাজে। কিছুটা আশ্বস্ত হলাম। এই দেখে যে তারা জাহাজে আশ্রয় পেয়েছে। দূর থেকে দেখে মনে হল সেটা করিস্থেরই কোনও জাহাজ। এরপর পাল তুলে যাত্রা করল সেই জাহাজটি, ধীরে ধীরে তা মিলিয়ে গেল দিগন্তের ওপারে।
পরম করুণাময় ঈশ্বরের অসীম কৃপায় আমাদেরও আর বেশিক্ষণ জলে ভেসে থাকতে হল না। ভাসতে ভাসতে কিছুক্ষণ পর আমরা এক জাহাজের সামনে এসে পৌঁছালাম। আমাদের দেখতে পেয়ে জাহাজের মাঝি-মাল্লারা নৌকা নামিয়ে আমাদের তুলে নিল। ঝড়-বৃষ্টি থেমে যাবার পর তারা আমাদের পৌঁছে দিল সিরাকিউজ বন্দরে। হে মহামান্য ডিউক! সেই থেকে আমি খুঁজে বেড়াচ্ছি স্ত্রী এমিলিয়া ও সেই শিশু দুটিকে। কিন্তু আজ পর্যন্ত তাদের দেখা পাইনি। এভাবে দিন কেটে যেতে লাগল। আজ বড়ো অ্যান্টিফোলাস আর বড়ো ড্রোমিও- উভয়েই পা দিয়েছে আঠারোয়। এখন তারা বলছে যে তারা বড়ো হয়েছে, এবার খুঁজতে বেরুবে মা-ভাইদের 1 তারা যেখানেই থাক না কেন, আমার বিশ্বাস এমিলিয়া, ছোটো অ্যান্টিফোলাস আর ছোটো ড্রোমিও সবাই জীবিত আছে। বয়সের ভারে আমার দেহ-মন খুবই ক্লান্ত, তাই ইচ্ছে সত্ত্বেও তাদের সঙ্গী হতে পারছি না। আমি। এমনিতেই প্ৰিয়জনদের হারিয়ে আমার মন ভেঙে গেছে। তার উপর যে দুজন আছে, তারাও যদি হারিয়ে যায় সেই ভয়ে আমি শুরুতে রাজি ছিলাম না তাদের প্রস্তাবে। কিন্তু অভিযানের নেশায় তাদের রক্ত গরম, তাই আমরা বারণ সত্ত্বেও পেছু হঠল না তারা। শেষমেশ অনেক বুঝিয়ে তারা আমাকে রাজি করাল। এক শুভদিনে বেরিয়ে পড়ল তারা।
ওরা চলে যাবার পর প্রিয়জনকে ফিরে পাবার আশায় দিন কাটতে লাগল আমার। দেখতে দেখতে পুরো এক বছর কেটে গেল তবুও ওরা ফিরে এল না। এভাবে একবছর কেটে যাওয়ার পর আমার আর ধৈর্যােসইল না। মনে হল, ওদের অনুমতি দিয়ে ঠিক কাজ করিনি। আমি। বেপরোয়া হয়ে আমি তাদের খুঁজতে বেরলাম জাহাজে চেপে। পাগলের মতো আমি ওদের খুঁজে বেড়ালাম এশিয়া-ইউরোপের দেশে-দেশে, বন্দরে-বন্দরে, কিন্তু কোথাও তাদের হদিস পেলাম না। হতাশ হয়ে একসময় দেশে ফেরার জন্য চেপে বসলাম জাহাজে। মাঝপথে কেন যে হঠাৎ এফিসাস বন্দরে নেমেছি তা আমি ভেবে উঠতে পারছি না। এদেশে যে এমন অদ্ভূত আইন চালু হয়েছে তা আমার জানা ছিল না। শহরে ঢুকতেই রক্ষীদের চোখে পড়ে গেলাম আমি। তারা আমায় বন্দি করে হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে এল আপনার দরবারে। তারপর যা ঘটেছে তা তো অজানা নেই আপনার, মহামান্য ডিউক।
ইজিয়নের বেদনাভরা জীবন-কাহিনি শুনে খুবই ব্যথা পেলেন ডিউক। তিনি বললেন, দেখ, সওদাগর ইজিয়ন! তোমার জন্য আমি সত্যিই খুব দুঃখিত। কিন্তু দেশের প্রচলিত আইন ভেঙে তোমাকে মুক্তি দেওয়া আমার ক্ষমতার বাইরে। তবে তোমার মানসিক অবস্থা বিবেচনা করে পুরো একদিন সময় দিলাম। হয়তো এই এফিসাস নগরে তোমার এমন কোনও আত্মীয়-বন্ধু আছে যে জরিমানার টাকা জমা দিয়ে তোমায় খালাস করে দিতে পারে–এই বলে কারাধ্যক্ষকে ডেকে ডিউক আদেশ দিলেন, একে কারাগারে নিয়ে যাও আর শহরের নাগরিকদের জানিয়ে দাও এর প্রাণদণ্ডের কথা। যদি কোনও সহৃদয় নাগরিক এর জরিমানার টাকা দিতে রাজি হয়, তাহলে একে ছেড়ে দিতে আমার কোনও আপত্তি নেই। ডিউককে অভিবাদন জানিয়ে কারাধ্যক্ষ ইজিয়নকে নিয়ে গেলেন। কারাগারে।
আসুন! এবার আমরা ফিরে তোকই অতীতের দিকে। আঠারো বছর আগে ঝড়-বৃষ্টির সময় যে মাঝি-মাল্লারা এমিলিয়া, ছোটো অ্যান্টিফোলাস আর ছোটো ড্রোমিওকে জাহাজে তুলে নিয়েছিল তারা সবাইছিল আদতে জলদসু্য। জাহাজ এফিসাস বন্দরে ভিড়তেই তারা তাড়িয়ে দিল এমিলিয়াকে। তারপর তারা ছোটো অ্যান্টিফোলাস আর ছোটো ড্রোমিওকে চড়া দামে বিক্রি করে দিলে এক ধনী যোদ্ধার কাছে। সেই যোদ্ধা ছিলেন। এফিসাসের ডিউকের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। একদিন আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে এসে ডিউকের নজর পড়ল সেই শিশু দুটির দিকে। প্রথম দেখাতেই তার মায়া জন্মে গেল শিশু দুটির উপর। আত্মীয়টি যে দামে শিশু দুটিকে কিনেছিলেন, তার চেয়ে অনেক দাম দিয়ে তিনি তাদের নিয়ে এলেন রাজপ্রাসাদো-সেখানেই তারা মানুষ হতে লাগল। লেখাপড়ার সাথে সাথে তারা মল্লবিদ্যাও শিখতে লাগল। ওরা একটু বড়ো হবার পর ডিউক তাদের যুদ্ধবিদ্যাও শেখালেন। অল্পদিনের মধ্যেই যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শিতা দেখালেন ছোটো অ্যান্টিফোলাস। তখন ডিউক তার সেনাবাহিনীতে সৈনিকের পদে নিয়োগ করলেন তাকে। অল্পদিনের মধ্যেই ছোটো অ্যান্টিফোলাস তার অসাধারণ দক্ষতা দেখিয়ে ডিউকের রাজসভায় স্থায়ী আসন অর্জন করল। ক্রমে ক্ৰমে সে ডিউকের প্রিয়পাত্র হয়ে উঠল। এরপর ডিউক ছোটো অ্যান্টিফোলাসের বিয়ে দিলেন শহরের সম্রােন্ত ধনীর মেয়ে আড্রিয়ানার সাথে। আড্রিয়ানা যেমন সুন্দর দেখতে তেমনি গুণবতী। বিয়ের সময় তার শ্বশুর ছোটো অ্যান্টিফোলাসকে একটি সুন্দর বাড়িও যৌতুক হিসেবে দিলেন। আড্রিয়ানা তার নিজের অবিবাহিতা ছোটো বোন লুসিয়াকে এনে রাখল নিজের কাছে। কাজের দরুন ছোটো অ্যান্টিফোলাস যখন বাইরে থাকে, সে সময়টা বড়ো বোন আড্রিয়ানাকে সঙ্গ দেয় লুসিয়া না সাহায্য করে ঘর-দের গোছাতে। বড়ো বোন আড্রিয়ানার মতো লুসিয়াও অসাধারণ রূপসি।
রূপবতী স্ত্রী আর শ্যালিকাকে নিয়ে সুখে-স্বচ্ছন্দে দিন কটালেও মনে শান্তি নেই ছোটো অ্যান্টিফোলাসের। মার কথা মনে পড়লেই সে যেন কেমন আনমনা হয়ে যায়, সব সময় কেঁদে ওঠে তার মন। কী অদ্ভুত এই নিয়তির খেলা! মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত বন্দি ইজিয়ান জানেন না যে তার ছেলে ছোটো অ্যান্টিফোলাস আর পালিত পুত্র ছোটো ড্রোমিও রাজার হালে দিন কাটাচ্ছে এই শহরে বসে।
কী বিচিত্র এই নিয়তির লীলাখেলা। বৃদ্ধ সওদাগরাইজিয়নকে কারাগারে নিয়ে যাবার কিছুক্ষণ বাদে একটি জাহাজ এসে ভিড়ল এফিসাস বন্দরে। সেই জাহাজে ছিল ইজিয়নের ছেলে বড়ো অ্যান্টিফোলাস আর বড়ো ড্রোমিও। জাহাজ থেকে নামার আগে এক সহৃদয় ব্যক্তি বড়ো অ্যান্টিফোলাসকে জানাল এফিসাসের নতুন আইনের কথা এবং সে এও বলল রক্ষীদের প্রশ্নের জবাবে বড়ো অ্যান্টিফোলাস যেন না বলে যে সে সিরাকিউজ থেকে এসেছে। এফিসাসের নতুন আইন অনুযায়ী কোনও সিরাকিউজবাসী সেখানে এলেই তার প্রাণদণ্ড হবে – এ কথা সে প্রথম জানতে পারল সেই যাত্রীর কাছে থেকে। এবার মাল-পত্ৰ নিয়ে তারা নেমে পড়ল ডাঙায়। রক্ষীদের প্রশ্নের জবাবে উভয়ে জানাল যে এপিড্যামনাম থেকে আসছে তারা। বন্দর থেকে বেরিয়ে এসে তারা শুনতে পেল সেইদিনই শুধু সিরাকিউজের অধিবাসী এই অপরাধে একজন বৃদ্ধ সওদাগরকে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছে। কিন্তু তারা কেউই জানতে পারল না যে সেই বৃদ্ধ সওদাগরই ইজিয়ন।
সম্পর্কে মনিব আর চাকর হলেও মাঝে মাঝে সমবয়স্ক বন্ধুর মতো একে অপরের সাথে কথা-বার্তা বলে। কখনও মানিবের মন খারাপ হলে বড়ো ড্রোমিও চেষ্টা করে হাসি-ঠাট্টার মাধ্যমে তাকে চাঙ্গা করে তুলতে।
কদিন এ শহরে থাকতে হবে তার ঠিক নেই। কাজেই থাকা— খাওয়ার একটা নিশ্চিন্ত ব্যবস্থা করতে ব্যাকুল হয়ে উঠল বড়ো অ্যান্টিফোলাস। জাহাজে থাকাকালীন এক যাত্রীর মুখে সে শুনেছিল এই শহরের সবচেয়ে ভালো হোটেলের নাম সেন্টার হোটেল। সেই হোটেলে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করার জন্য সে বড়ো ড্রোমিওকে ডেকে পাঠিয়ে তার হাতে প্রয়োজনীয় টাকা-কড়ি দিয়ে দিল। হোটেলে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করার জন্য বড়ো ড্রোমিও বেরিয়ে যেতেই মা-ভাইয়ের খোঁজে আশপাশের কয়েকটা রাস্তায় ঘুরে বেড়াল বড়ো অ্যান্টিফোলাস। কিন্তু তাদের কোনো হদিস না। পেয়ে মন খারাপ হয়ে গেল তার। সে ভাবতে লাগিল দেশে ফিরে গিয়ে বাবাকে কী জবাব দেবে। ঠিক সে সময় সে দেখতে পেল ড্রোমিওকে। অবাক হয়ে বড়ো অ্যান্টিফোলাস বলল, কীরে! এত তাড়াতাড়ি ফিরে এলি? হোটেলের খাতায় আমাদের নাম-ধাম লিখিয়ে টাকা-পয়সা জমা দিয়েছিস তো? আমরা যে এপিডামনাম থেকে এসেছি সে কথা বলেছিস তো?
ড্রোমিও জবাব দিল, এ সব আপনি কী বলছেন? আপনার আসতে দেরি দেখেই তো গিন্নিমা আপনার খোঁজে আমায় পাঠালেন। তাড়াতাড়ি চলুন, নয়তো খাবার-দাবার জুড়িয়ে জল হয়ে যাবে।
ধমকে উঠে বলল বড়ো অ্যান্টিফোলাস, পাগলের মতো কি যা-তা বকছিস? গিঘিমা! সে আবার কে! এই কি তোর ঠাট্টা করার সময়?
বাঃ! বেশ বলেছেন তো! বলল ড্রোমিও, আমাদের গিন্নিমা মানে আপনার স্ত্রী আর সুন্দরী শ্যালিকা আপনার সাথে খাবে বলে সেই কখন থেকে অপেক্ষা করে বসে আছে। তাদেরও তো ক্ষুধা-তৃষ্ণা আছে সে কথা কেন ভুলে যাচ্ছেন?
ধমকে উঠে বলল বড়ো অ্যান্টিফোলাস, এখানে এসে তোর খুব বাড় বেড়েছে, তাই না? আরে আমি বিয়ে করলাম কবে যে আমার বউ আর শ্যালিকা অপেক্ষা করে বসে থাকবে? আর দ্যাখ! দুপুর হতে চলল, এখন এসব রসিকতা আর ভালো লাগছে না। এখন বল, হোটেলে ঘর ভাড়া নিয়েছিস তো? ঘরে আলো-হাওয়া ঢোকে তো? টাকা-পয়সা জমা দিয়েছিস?
উভয়ের চড়া গলার কথা-বার্তা শুনে কিছু কৌতূহলী মানুষের ভিড় জমে উঠল তাদের চারপাশে। তাদের দিকে এক পলক তাকিয়ে আপন মনে বলে উঠল। ড্রোমিও, এ আবার কী ফ্যাসাদে পড়া গেল! মনিবের কি মাথা খারাপ হয়ে গেল? সে মনিবের দু-হাত ধরে বলল, বিশ্বাস করুন, আমি আপনার সাথে ঠাট্টা-তামাশা করছি না। মনে হচ্ছে আপনিই বরং আমার সাথে ঠাট্টা-তামাশা করছেন। সে যাই হোক, আপনি খাওয়া-দাওয়ার পাটটা আগে মিটিয়ে ফেলুন, নইলে বাড়ির কারও খাওয়া হবে না। এ কথাটা কেন আপনি বুঝতে পারছেন না? দোহাই আপনার! এবার বাড়ি চলুন। গিন্নিমা আপনার জন্য….।
আবার বলছিস গিন্নিমা! হতভাগা, আমার সাথেইয়ার্কি হচ্ছে? বলেই সবার সামনে ড্রোমিওকে বেশ কয়েক ঘা লাগিয়ে দিল বড়ো অ্যান্টিফোলাস। মার খেয়ে একটি কথাও না বলে চোেখ মুছতে মুছতে ড্রোমিও ফিরে গেল গিন্নিমার কাছে।
কেঁদে কেঁদে গিন্নিমাকে শোনাল ড্রোমিও কীভাবে সবার সামনে রাস্তার মাঝে সে মার খেয়েছে মনিবের হাতে। সব শুনে বেজায় রেগে গেল আড্রিয়ানা। সে ধরে নিল তার স্বামী অন্য কোনও মেয়ের প্রেমে পড়েছে।
চাকরকে সাস্তুনা দিয়ে বলল, আড্রিয়ানা, মিনিবের হাতে মার খাবার জন্য তুই দুঃখ করিস না ড্রোমিও। আমি কথা দিচ্ছি। উনি ফিরে এলেই এর একটা হেস্তনেস্ত করে তবে ছাড়ব।
পাশ থেকে আড্রিয়ানার ছোটো বোন লুসিয়ানা বলে উঠল, দেখতে পাচ্ছি শুধু তোর বর নয়, তোরও মাথা খারাপ হয়েছে। আচ্ছা, তোর বর যদি সত্যিই অন্য কারও প্রেমে পড়ে থাকেন, তাহলে কি তিনি সে কথা স্বীকার করবেন? দ্যাখ, ওভাবে কাজ হবে না। এবার আমি যা বলি তা মন দিয়ে শোন। চল, ওদের হাতে-নাতে ধরতে আমরা এখনই বেরিয়ে পড়ি — ঘাড় ধরে নিয়ে আসি তোর বরকে। যদি দেখি সে কোনও সর্বনাশীর সাথে ফষ্টি-নষ্টি করছে, তাহলে সবার সামনে তার চুলের মুঠি ধরে বেশ কয়েক ঘা লাগিয়ে দিবি যাতে অন্যের সাথে প্রেম করার শখ চিরদিনের মতো মিটে যায়।
আড্রিয়ানার মনে ধরল। ছোটো বোনের কথা। সে তখনই তার সাথে বেরিয়ে গেল স্বামীর খোঁজে।
সবার সামনে ড্রোমিওকে মার-ধর করার জন্য মনটা বেশ খারাপ লাগছে অ্যান্টিফোলাসের। সে সোজা চলে এল সেন্টর হোটেলে। দেখল তার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে ড্রোমিও। সে বলল মনিবের কথামতো ঘর ভাড়ার টাকা সে আগাম জমা দিয়েছে।
এই তো আমার কথা মতো কাজ করেছিস, বলল অ্যান্টিফোলাস, তাহলে কিছুক্ষণ আগে কেন বলছিলি। গিন্নিমা অপেক্ষা করছে, তাড়াতাড়ি বাড়ি না গেলে খাবার ঠান্ড হয়ে যাবে। — এইসব আজে-বাজে কথা? ড্রোমিও আশ্চর্য হয়ে গেল এসব কথা শুনে। এ ধরনের আজে-বাজে কথা সে মোটেও বলেনি। টাকা জমা দেবার পর হোটেল থেকে সে একদম বাইরে বের হয়নি। ঠিক সে সময় লুসিয়ানাকে সাথে নিয়ে আড্রিয়ানাও এসে হাজির সেখানে। রাস্তার লোকজনকে জিজ্ঞেস করে সে জেনেছে চাকরকে মারধর করার খানিক বাদেই তার স্বামী সোজা এই হোটেলে এসে ঢুকেছে।
সবাইকে শুনিয়ে আড্রিয়ানা জোর গলায় বলল তার স্বামীকে, কী করেছ তুমি? কেন রাস্তার মাঝে সবার সামনে ড্রোমিওকে মারধর করেছ? তাকে নাকি বলেছ তোমার বিয়েই হয়নি। আর হোটেলে থাকবে বলে টাকা জমা দিয়েছ? আমায় ছুয়ে বল তো এসব সত্যি কিনা! আমি এমন কী দোষ করেছি। যার জন্য তুমি আমায় ত্যাগ করে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে চাইছ? বলতে বলতে আড্রিয়ানার দু-চোখ জলে ভরে ওঠে।
আড্রিয়ানার অভিযোগ শুনে বেশ ঘাবড়ে গেল অ্যান্টিফোলাস। সে ভেবে পেল না। কীভাবে এই অস্বস্তিকর পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পাবে। সে ঠান্ডা মাথায় আড্রিয়ানাকে বোঝাতে চাইল যে সে তার স্বামী নয়, একজন পর্যটক মাত্র। একটা বিশেষ প্রয়োজনে সে এসেছে এফিসাসে। তার এখনও বিয়েই হয়নি।
নিজের কপাল চাপড়ে আক্ষেপের সুরে বলল আড্রিয়ানা, এই সেদিনও বিয়ের পর তুমি আমায় কত ভালোবাসতে, আদর-সোহাগ করতে – এগুলো তো সামান্য কদিন আগের ঘটনা। আর এখন তুমি বলছি কিনা তোমার বিয়েই হয়নি! নিশ্চয়ই কোনও মেয়েছেলের নজর পড়েছে তোমার উপর, তাই আজি না চেনার ভান করছি। পুরুষগুলোর স্বভাবই এমন, কখন কাকে মনে ধরে তার ঠিক নেই। এরপর ছোটো বোনের দিকে তাকিয়ে আড্রিয়ানা বলল, আমার অবস্থাটা একবার ভেবে দ্যাখ লুসি, যে মেয়েমানুষ স্বামীর ভালোবাসা পায় না, তার মতো অভাগী আর কেউ নেই–বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়ল আড্রিয়ানা। এবার সত্যিই মুশকিলে পড়ে গেল অ্যান্টিফোলাস। সে আড্রিয়ানাকে যতই বলে যে সে ভুল করেছে, ততই কান্না বেড়ে যায় আড্রিয়ানার।
এবার চাপা স্বরে অ্যান্টিফোলাসকে ধমকে বলে উঠল লুসিয়ানা, আচ্ছা! আপনি কী ধরনের লোক বলুন তো! সেই তখন থেকে কীসব ছেলেমানুযি শুরু করেছেন? না হয় মানছি আপনার বিয়ে হয়নি, আর বিয়েও আপনাকে করতে হবে না। দয়া করে এবার বাড়ি চলুন। সেই কখন থেকে আপনার খাবার সাজিয়ে বসে আছে দিদি। আমাদেরও তো ক্ষুধা-তৃষ্ণা পায় না কি, আমরা রক্ত-মাংসের মানুষ নই?
লুসিয়ানার দিকে তাকিয়ে অ্যান্টিফোলাস বলল, তোমার দিদি? তাহলে তুমি কে?
ভগ্নিপতির কথায় এই প্রথম ধাক্কা খেল। লুসিয়ানা। সে অবাক হয়ে বলল, কী বলছেন আপনি? তার মনে প্রশ্ন জাগল, সত্যিই কি আড্রিয়ানার মতো তাকেও চিনতে পারেননি। অ্যান্টিফোলাস?
সে হেসে জবাব দিল, আমি আপনার আদরের শ্যালিকা লুসিয়ানা।
আমার শ্যালিকা? বললেই হল আর কী? লুসিয়ানার দিকে তাকিয়ে গলা চড়িয়ে বলল অ্যান্টিফোলাস, আরো আমার বলে এখনও পর্যন্ত বিয়েই হয়নি!
ঠান্ডা মাথায় তাকে বোঝাতে লাগল। লুসিয়ানা, বেশ, মেনে নিলাম আপনার বিয়ে হয়নি। কিন্তু তার আগে দয়া করে একবার বাড়ি চলুন। এত বেলা পর্যন্ত সবাই না খেয়ে আপনার জন্য অপেক্ষা করে আছে। রান্না খাবার-দাবারও পচে নষ্ট হবার জোগাড়। আপনিই বলুন না কেন এসব কি ঠিক হচ্ছে?
লুসিয়ানার প্রস্তাবে সায় দিয়ে বলল ড্রোমিও, কর্তা, তাই চলুন। ওরা যখন এত করে বলছেন তখন ওদের বাড়ি গিয়ে রান্না করা খাবারগুলো খেয়ে নেওয়া যাক।
রেগে গিয়ে ড্রোমিওর দিকে তাকিয়ে অ্যাস্টিফোলাস বলল, ও! তুইও ওদের দলে ভিড়েছিস!
মতো এমন একটা আকর্ষণ ছিল যা শুরুতেই আকৃষ্ট করেছে তাকে। অনেক চেষ্টা করেও সেই চুম্বকের আকর্ষণ থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারছে না অ্যান্টিফোলাস।
বেশ! তবে চলো—বলে উঠে দাঁড়াল অ্যান্টিফোলাস। পরীক্ষণেই কী মনে করে আড্রিয়ানার
একটা শর্ত আছে। বাড়ি গিয়ে তুমি মুখ ফুটে কাউকে বলবে না যে আমি তোমার স্বামী। ও সব আদেখলাপনা আমার মোটেই পছন্দ নয় তা কিন্তু আগেই বলে দিচ্ছি।।
তাহলে কী করতে হবে? জানতে চাইল লুসিয়ানা।
তুমি চুপ কর। তোমার সাথে কথা বলছি না বলে এক ধমকে তাকে থামিয়ে দিল অ্যান্টিফোলাস! তারপর আড্রিয়ানার দিকে ফিরে বলল, সবার সামনে তুমি এমন ভাব দেখাবে যেন আমি তোমার কেউ নই। — কোনও সম্পর্ক নেই তোমার সাথে।
কানে কানে লুসিয়ানাকে বলল আড্রিয়ানা, বুঝলি, এই ভয়টাই আমি করেছিলাম। এ নিশ্চয়ই সেই সর্বনাশীর কাজ। ও চাইছে আমার কাছ থেকে স্বামীকে ছিনিয়ে নিতে।
আঃ দিদি! এখন মাথা গরম করিস না— বলে অ্যান্টিফোলাসের দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, শুধু এইটুকুই আপনার শর্ত? ঠিক আছে, আমরা মেনে নিলাম আপনার শর্ত। এবার দয়া করে আমাদের সাথে বাড়ি চলুন।
যতটুকু রাগ তার মাথায় জন্মেছিল, বড়ো বা সিরাকিউজের অ্যান্টিফোলাস দেখল কখন তা যেন আপনা থেকেই উধাও হয়ে গেছে, তার পরিবর্তে স্বপ্নের একটা ঘোর তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। কিন্তু সে সব ভাবার সময় এখন নেই। বাধ্য হয়ে সে ড্রোমিওকে সাথে নিয়ে এগিয়ে চলল আড্রিয়ানা ও লুসিয়ানার পেছু পেছু। এই ড্রোমিও অবশ্য তারই মতো বড়ো বা সিরাকিউজের ড্রোমিও।
বাড়িতে এসে পাহারা দেবার দায়িত্ব দিয়ে বড়ো ড্রোমিওকে একতলার সদর দরজার সামনে দাঁড় করিয়ে, দিল আড্রিয়ানা। তাকে নির্দেশ দিল সে যেন কাউকে ভেতরে ঢুকতে না দেয়। আর কেউ অ্যান্টিফোলাসের সাথে দেখা করতে চাইলে যেন বলে, উনি এখন খাচ্ছেন, তাই তার সাথে দেখা হবে না। এরপর অ্যান্টিফোলাস আর লুসিয়ানাকে নিয়ে খাওয়া-দাওয়া সারতে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠল আড্রিয়ানা। সবার আগে ড্রোমিওকে ডেকে আড্রিয়ানা বলল, দ্যাখ। ড্রোমিও! আমরা এখন খেতে যাচ্ছি। দেখবি বাইরের লোক যেন ঘরে না ঢোকে। তাহলে কিন্তু তোর মাথা ফাটিয়ে দেব — এ কথা যেন মনে থাকে।
খেতে বসে ইচ্ছে করেই অ্যান্টিফোলাসের শর্ত ভাঙল আড্রিয়ানা। সবার সামনে বারবার স্বামী বলে ডেকে সে তাকে অস্থির করে তুলল। ওদিকে তার মতো একই ভুল করে বসল। আড্রিয়ানার পরিচারিকা নেল। কাজের মাঝে সময় পেলে এতদিন সে ছোটো ড্রোমিওর সাথে ফষ্টি-নষ্টি করত। তাকে বিয়ে করে ঘর-সংসার বাঁধিবে বলে কথাও দিয়েছিল সে। অ্যান্টিফোলাসের সাথে বড়ো ড্রোমিওকে দেখে সে ধরে নিল। এই তার পুরনো প্রেমিক। সে যেচে গিয়ে তাকে প্ৰেম-ভালোবাসার কথা শোনাতে লাগল। নেলের ভাব-সাব দেখে তার মনিবের মতো ড্রোমিও বেশ ঘাবড়ে গেল। বড়ো ড্রোমিও ধরে নিল মনিবের মতো সেও এক স্বপ্নের ঘোরের মাঝে রয়েছে। ততক্ষণে খাওয়া শেষ হয়েছে আড্রিয়ানা আর অ্যান্টিফোলাসের। খাবার ফাকে লুসিয়ানার সাথে বেশ জমিয়ে গল্প করেছে অ্যান্টিফোলাস। লুসিয়ানাকে তার খুব পছন্দ হয়েছে – তাকে নিয়ে রঙিন স্বপ্নের জাল বুনতে শুরু করেছে। কিন্তু লুসিয়ানার সাথে এই মেলামেশা মোটেও পছন্দ নয়। আড্রিয়ানার। লুসিয়ানা যে আদতে এফিসাসবাসী তার ছোটো ভাই ছোটো অ্যান্টিফোলাসের শ্যালিকা, সে কথা কিন্তু জানে না। অ্যান্টিফোলাস বা আড্রিয়ানা।
কিছুক্ষণ বাদে ছোটো ড্রোমিওকে সাথে নিয়ে বাড়ি ফিরে এল ছোটো অ্যান্টিফোলাস। তার ভীষণ অবাক লাগছে ছোটো ড্রোমিওর কথা শুনে। ছোটো ড্রোমিওর মূল বক্তব্য হল কিছুক্ষণ আগে সে তাকে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে আসার কথা বলেছে। সাথে এও বলেছে যে তার স্ত্রী ও শ্যালিকা খাবার নিয়ে তার জন্য অপেক্ষা করে আছে। সে কথা শুনে অ্যান্টিফোলাস নাকি তাকে রাস্তার মাঝে বেধড়ক মারতে শুরু করে দেয়। আর মারতে মারতে আমি তো বিয়েই করিনি, বউ আর শ্যালিকা আবার কোথা থেকে এল এ জাতীয় কথাও বলেছে তাকে।
ড্রোমিওর মুখে এসব অভিযোগ শুনে রেগে উঠে বলেছিল ছোটো অ্যান্টিফোলাস, এই হতভাগা! আমি তোকে এসব কথা বলেছি? তুই আরও বলেছিস আমি তোকে মেরেছি, বলেছি আমার স্ত্রী নেই, আমি হোটেলে থাকব, খাব? আমি আবারও বলছি। এতসব কথা তোকে বলিনি আর মারধরও করিনি। তারপরেও যদি বলিস। আমি এসব করেছি, তাহলে বলব বেশ করেছি। তোর মতো বদমাশকে মেরে ফেলাই উচিত।
ছোটো ড্রোমিওকে বেশ করে ধমকিয়ে বাড়ি ফিরে গেল ছোটো অ্যান্টিফোলাস। গিয়ে দেখল ভেতর থেকে বন্ধ রয়েছে বাড়ির সদর দরজা। সে বারবার দরজায় ধাক্কা দিল, চেঁচিয়ে ডাকতে লাগল স্ত্রী আর শ্যালিকাকে, এরপর জোরে কড়া নাড়ল। কিন্তু ভেতর থেকে কেউ দরজা খুলে দিল না। শেষমেশ ছোটো ড্রোমিও তার প্রেমিক, আড্রিয়ানার সহচরী নেল-এর নাম ধরে ডাকাডাকি করল। কিন্তু তাতেও কেউ দরজা খুলে দিল না।
এসব কাণ্ড-কারখানা দেখে বড়ো অ্যান্টিফোলাস আর বড়ো ড্রোমিওর মনে এতুটুকুও সন্দেহ রইল না যে তার এক আজব দেশে এসে পৌঁছেছে। তারা উভয়েই হাঁফিয়ে উঠেছে। এ বাড়ির পরিবেশ ও তার অধিবাসীদের হাব-ভাব দেখে। সুযোগ পেতেই তারা আড্রিয়ানা আর লুসিয়ানার চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়ে গেল বাড়ি থেকে। ওদিকে আবার চেচামেচি করেও বাড়ির দরজা খোলাতে না পেরে রেগে বোম হয়ে আছে ছোটো অ্যান্টিফোলাস। খাওয়া-দাওয়া সারাতে সে তখনই চলে গেল তার এক বন্ধুর বাড়িতে। পথে তার সাথে দেখা হল স্যাকরান অ্যাঞ্জেলোর সাথে। এর আগে আড্রিয়ানার জন্য বহু গয়না তৈরি করেছে অ্যাঞ্জেলো। এই কদিন আগেও আড্রিয়ানার জন্য হিরে-জহরত বসানো একটা সোনার তৈরির গয়না দিয়েছে অ্যান্টিফোলাস। দেখা হতেই অ্যাঞ্জেলো জানাল যে হারখানা তৈরি হয়ে গেছে। এমনিতেই আড্রিয়ানার উপর বেজায় রেগে ছিলেন অ্যান্টিফোলাস। তিনি স্থির করলেন হারখানা আড্রিয়ানাকে না দিয়ে বরং তার বন্ধুকে উপহার দেবেন। তিনি স্যাকরাকে বললেন সে যেন হারখানা বন্ধুর বাড়িতে দিয়ে আসে। তার কথা শুনে স্যাকরা তখনই ছুটিল নিজের বাড়ির দিকে।
বাড়ি থেকে হার নিয়ে এসে কিছুদূর যাবার পর অ্যাঞ্জেলোর সাথে দেখা হয়ে গেল বড়ো অ্যান্টিফোলাসের। সে একরকম জোর করেই হারটা বড়ো অ্যান্টিফোলাসের হাতে গুজে দিয়ে বলল, এই রইল আপনার হার। আপনি যেমন বলেছেন তেমনিই করেছি। আশা করি এটা আপনার পছন্দ হবে।
অ্যাঞ্জেলোর দিকে তাকিয়ে বললেন বড়ো অ্যান্টিফোলাস, এ কি, হারটা আমায় দিচ্ছেন কেন? মনে হয় আপনি ভুল করছেন। আমি তো আপনাকে চিনিই না।
এ সব কী বলছেন আপনি, বলল অ্যাঞ্জেলো, আরে মশায়! আপনার সাথে কি আজকের সম্পর্ক নাকি আপনি ভাবছেন দামের কথা। সে আপনি পরে দিয়ে দেবেন- আমি আপনার বাড়ি গিয়ে নিয়ে আসবা–বলে অন্যদিকে চলে গেল অ্যাঞ্জেলো। এত তাড়াতাড়ি ঘটনোটা ঘটে গেল যে অ্যাঞ্জেলোকে কিছু বলা বা বাধা দেবার সময় পেলেন না বড়ো অ্যান্টিফোলাস। হারটা হাতের মুঠোয় নিয়ে সে মনে মনে বলল, এ যে সত্যিই একটা আজব দেশ তাতে কোনও সন্দেহ নেই। এখানকার বড়ো ঘরের বউ-ঝিরা অচেনা পুরুষকে বাড়ি নিয়ে গিয়ে পাশে বসিয়ে খাওয়ায়, স্বামী স্বামী বলে আদর-সোহাগ করে। আর এখানকার স্বর্ণকাররাও তেমনি! অচেনা বিদেশির হাতে দামি জড়োয়ার হার গুজে দিয়ে দাম না নিয়ে চলে যায়। আজব দেশের সব আজব ঘটনা।
বড়ো ড্রোমিও নিজেও ভাবছিল সেই একই কথা। কিছুক্ষণ আগে যে বাড়ির বউ তার মনিবকে খাওয়াতে নিয়ে গেল, সে বাড়ির কাজের মেয়ে নেল। তার সাথে এমন ব্যবহার করল যে মনে হল পরস্পর পরস্পরকে কত ভালোবাসে। সে নিজ মুখেই ড্রোমিওকে বলল যে সে তাকে বিয়ে করতে রাজি আছে।
বড়ো অ্যান্টিফোলাস বলল, আর নয় ড্রোমিও, ঢ়ের হয়েছে। নতুন কিছু ঘটার আগেই চল এখান থেকে পালিয়ে যাই। তুই এখনই জাহাজঘাটায় চলে যা। সবচেয়ে আগে যে জাহাজটা ছাড়বে, তা যে দিকেই যাক না কেন, সেটাতে আমাদের যাবার ব্যবস্থা করে আয়। তুই ফিরে এলে হোটেল থেকে আমাদের মাল-পত্ৰ, টাকা-কড়ি সব তুলে নিয়ে জাহাজে চাপতে হবে। বেশিদিন এদেশে থাকলে হয়তো আমাদের জেলেই যেতে হবে। তার চেয়ে চল, প্ৰাণ নিয়ে পালাই।
বাড়ি ফিরে অ্যাঞ্জেলো দেখল তার কাছ থেকে পাওনা টাকা আদায়ের আশায় অপেক্ষা করে আছে এক পাওনাদার। কিছুক্ষণ আগে অ্যান্টিফোলাসকে যে হারখানা সে দিয়েছে তার দাম নেওয়া হয়নি। সে স্থির করল ওই টাকাটা আদায় করে পাওনা মিটিয়ে দেবে। পাওনাদারকে অপেক্ষা করতে বলে সে চলে গেল অ্যান্টিফোলাসের বাড়ির দিকে।
বাড়ি থেকে বেরিয়ে কিছুদূর যাবার পর রাস্তাতেই অ্যাঞ্জেলোর সাথে দেখা হয়ে গেল ছোটো অ্যান্টিফোলাসের। সে তখন বন্ধুর বাড়ি থেকে খাওয়া-দাওয়া করে ফিরছিল। ছোটো অ্যান্টিফোলাসকে দেখেই অ্যাঞ্জেলো বলল, এই যে মশাই! আপনার কাছে যাচ্ছিলাম।
আমার কাছে? কেন? ব্যাপারটা আঁচ করতে না পেরে বলল অ্যান্টিফোলাস।
অ্যাঞ্জেলো বলল, বাড়ি ফিরে দেখি এক পাওনাদার বসে আছে। সে আবার পাওনা টাকা না নিয়ে এক পাও নড়বে না। বলছি কী, যে হারটা আপনি আমায় বানাতে দিয়েছিলেন, অনুগ্রহ করে যদি তার দামটা দিয়ে দেন তাহলে পাওনাটা মিটিয়ে দিতে পারি।
নিশ্চয়ই পাবে, বলল অ্যান্টিফোলাস, আগে তো হারটা আমায় দেবে। তবে তো দাম দেব। জিনিসটা না দিয়েই তুমি তার দাম চাইছ? কী করে ভাবলে জিনিসটা না পেয়ে আমি তার দাম দেব?
সে কী কথা! অবাক হয়ে দু-চোখ কপালে তুলে বলল অ্যাঞ্জেলো, এই তো কিছুক্ষণ আগে রাস্তার মাঝে হারটা তুলে দিলাম। আপনার হাতে।
রেগে গিয়ে দু-চোখ কপালে তুলে বলল ছোটো অ্যান্টিফোলাস, কী বললে, হারটা আমার হাতে দিয়েছ আর তাও আবার রাস্তার মাঝখানে! আমি তোমায় বলেছি হারটা নিয়ে বন্ধুর বাড়িতে যেতে। কিন্তু তুমি সেখানে যাওনি। তারপর তোমার সাথে এই দেখা। তুমি মিথ্যে কথা বলছি অ্যাঞ্জেলো। হারটা তুমি মোটেও দাওনি–না দিয়েই দাম চাইছ।
এবার রেগে গেল অ্যাঞ্জেলো। ছোটো অ্যান্টিফোলাসকে ধমকে উঠে বলল, কী বললেন, আমি মিছে কথা বলছি? আপনার মতো একজন ধনী লোক যে মিছে কথা বলে এভাবে গয়নাটা হাতিয়ে নেবেন তা আমার জানা ছিল না। জানলে কাজের আগেই পুরো দামটা আগাম নিয়ে নিতাম।
ধমকে উঠে বলল ছোটো অ্যান্টিফোলাস, মুখ সামলে কথা বলবে অ্যাঞ্জেলো। রাস্তার মাঝে যা-তা বলে অপমান করার ফল কিন্তু হাড়ে হাড়ে টের পাবে।
আপনি থামুন মশাই, পালটা ধমক দিল অ্যাঞ্জেলো, আপনার মতো চোর-জোচ্চোরকে আমি থোড়াই কেয়ার করি। এখনও বলছি হারের দামটা মিটিয়ে দিন, নইলে ঘোল খাইয়ে ছাড়ব আপনাকে।
এদের ঝগড়া-ঝাঁটির মাঝেই এসে পড়ল আদালতের পেয়াদা। তাকে দেখেই ছোটো অ্যান্টিফেলাসকে ইশারায় দেখিয়ে অ্যাঞ্জেলো বলল, এর ফরমায়েস মতো আমি একটা হার তৈরি করে কিছুক্ষণ আগেই এর হাতে দিয়েছি। কিন্তু ও তার দাম দিতে চাইছে না। তুমি ওকে গ্রেপ্তার করে ডিউকের আদালতে নিয়ে যাও। খানিক বাদে আমিও যাচ্ছি। সেখানে।
সে সময় অভিযোগকারীর কাছ থেকে নির্দিষ্ট সরকারি দক্ষিণা নিয়ে যে কোনও লোককে গ্রেপ্তার করতে পারত আদালতের পেয়াদা। অ্যাঞ্জেলোর কাছ থেকে যথােচিত দক্ষিণা নিয়ে সে সাথে সাথে গ্রেপ্তার করল ছোটো অ্যান্টিফোলাসকে, ছোটো অ্যান্টিফোলাস দেখল পরিস্থিতি মোটেও তার অনুকূল নয়–কাজের মানুষ হিসেবে যদিও সে ডিউকের কাছের লোক, কিন্তু আসামী হিসেবে আদালতে হাজির হলে ডিউকের সাথে তার সে সম্পর্ক থাকবে না। তাছাড়া অ্যাঞ্জেলোর অভিযোগ প্রমাণিত হলে তার মান-সম্মান- প্রতিপত্তি এমনকি পদস্থ সেনানির চাকরিটাও হয়তো তাকে খোয়াতে হবে। এতক্ষণ ধরে অবাক হয়ে তার মনিবের সাথে অ্যাঞ্জেলোর কথা কাটাকাটি শুনছিল ছোটো ড্রোমিও। এবার অ্যান্টিফোলাস তাকে বলল সে যেন আড্রিয়ানার কাছ থেকে স্বর্ণকার অ্যাঞ্জেলোর পাওনা টাকাটা নিয়ে আসে। সাথে সাথেই মনিবের বাড়িতে ছুটে গেল ছোটো ড্রোমিও। গিন্নিমা আড্রিয়ানাকে সব কথা বলতেই সে তাড়াতাড়ি সিন্দুক খুলে টাকাটা বের করে দিয়ে দিল ছোটো ড্রোমিওর হাতে। টাকাটা নিয়ে বেরিয়ে গেল ছোটো ড্রোমিও। কিছুদূর যেতেই তার সাথে দেখা হল বড়ো অ্যান্টিফোলাসের। ছোটো ড্রোমিও কিছুতেই বুঝতে পারল না। টাকা ছাড়া কীভাবে তার মনিব খালাস পেলেন। ভবিষ্যতে কাজে লাগতে পারে এই ভেবে সে পুরো টাকাটাই মনিবের হাতে তুলে দিয়ে বলল, এ টাকা গিন্নিমা পাঠিয়ে দিয়েছেন। বড়ো অ্যান্টিফোলাসের বুঝতে বাকি রইল না যে অচেনা মহিলা তাকে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে পাশে বসিয়ে খাইয়েছেন, স্বামী বলে আদর-সোহাগ করেছেন- তিনিই পাঠিয়েছেন এ টাকাটা। সে একবার ভাবল টাকাটা মহিলাকে ফিরিয়ে দেবে, কিন্তু পরীক্ষণেই মনে হল টাকাটা ফেরত দিতে গিয়ে যদি আবার কোনও ঝামেলা বেধে যায় — এই ভেবে টাকার থলিটা সে পকেটে পুরে নিল। এরপর ছোটো ড্রোমিওকে বলল, দ্যাখ! হাতে আর বেশি সময় নেই। এই বেলা সেন্টার হোটেলে চলে যা। সেখানে থাকা-খাওয়ার জন্য যে টাকাটা জমা দিয়েছিস তা তুলে নিয়ে আয়। আর মাল-পত্র যা রয়েছে তা নিয়ে জাহাজঘাটায় চলে যাবি। একটু বাদেই জাহাজ ছাড়বে।
আবার সেই হোটেল! সেখান থেকে মালপত্র নিয়ে জাহাজে যেতে হবে? –মনিবের কথাগুলো শুনে ছোটো ড্রোমিওর বুঝতে বাকি রইলনা সত্যিই তার মনিবের মাথা খারাপ হয়ে গেছে। হোটেলে যাবার নামে সে তখনি ছুটে গেল মনিবগিন্নি আড্রিয়ানার কাছে। সব কথা খুলে বলল তাকে। তার স্বামীর যে সত্যিই মাথা খারাপ হয়েছে, সে কথা ছোটো ড্রোমিওর মতো আড্রিয়ানা ও লুসিয়ানার বুঝতে বাকি রইল না। লুসিয়ানাকে সাথে নিয়ে আড্রিয়ানা তখনই বেরিয়ে পড়লেন স্বামীর খোঁজে।
কিছুদূর যাবার পর আড্রিয়ানার চোখে পড়ল আদালতের পেয়াদা বেঁধে নিয়ে যাচ্ছে তার স্বামীকে। স্বামীর ওই অবস্থা দেখে চোখে জল এসে গেল। আড্রিয়ানার। সে তখনই ছুটে গোল স্বামীর কাছে। তাকে দেখেই তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠল। ছোটো অ্যান্টিফোলাস। যা মুখে আসে তাই বলে গালাগাল দিয়ে বলল, ক্ষুধার জুলায় যখন আমার পেট জ্বলে যাচ্ছিল, সে সময় বারবার ডাকাডাকি করা সত্ত্বেও তুমি বাড়িতে ঢুকতে দাওনি আমায়। এমন কি গ্রেপ্তারের খবর পেয়েও তুমি আমায় ছাড়াতে টাকা পাঠাওনি। এসবের পরেও তুমি কি করে আমার স্ত্রী বলে নিজেকে দাবি করো? মরলেও নরকে ঠাই হবে না তোমার। ডিউককে বলে এবার তোমার শাস্তির ব্যবস্থা করছি।
আড্রিয়ানা বুঝে উঠতে পারল না নিজের পাশে বসিয়ে খাওয়াবার পরও কেন তার স্বামী এই অভিযোগ করছেন। আর জরিমানার টাকা! সে তো নিজেই কিছুক্ষণ আগে আলমারি খুলে বের করে দিয়েছে ছোটো ড্রোমিওর হাতে তাহলে তিনি কি করে এসব কথা বলছেন? স্বামীর মাথা যে ঠিক নেই সে ব্যাপারে কোনও সন্দেহ রইল না আড্রিয়ানা আর লুসিয়ানার মনে।
এবার পেয়াদার হাত থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে স্বামীকে বাড়ি নিয়ে যাওয়া দরকার। আড্রিয়ানা পেয়াদাকে কথা দিল স্বামীকে বাড়ি পৌঁছে দিলেই সে তার জরিমানার টাকা দিয়ে দেবে। পেয়াদার কাছে সে এও শুনল কিছুক্ষণ আগে স্বর্ণকার অ্যাঞ্জেলো তার স্বামীকে একখানা হার দিয়েছে। কিন্তু তার স্বামী সে হারের দাম দিতে চাইছেন না, বলছেন স্বর্ণকার আদীে তাকে কোনও হার দেয়নি।। তারপর তারা উভয়ে একে অন্যকে গালাগাল দিতে শুরু করে। সে সময় সরকারি পেয়াদা সেখান দিয়ে যাচ্ছিল। অ্যাঞ্জেলো তাকে ডেকে সবকিছু জানিয়ে বলে যে সে যেন তার কাছ থেকে সরকারি দক্ষিণা নিয়ে ছোটো অ্যান্টিফোলাসকে গ্রেপ্তার করে। সেইমতো অ্যাঞ্জেলোর কাছ থেকে যথাযথ দক্ষিণা নিয়ে সে গ্রেপ্তার করে ছোটো অ্যান্টিফোলাসকে। ছোটো অ্যান্টিফোলাসকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আড্রিয়ানার কাছে থেকে টাকা নিয়ে চলে গেল পেয়াদা। এবার চেঁচিয়ে রাস্তা থেকে লোকজন ডেকে আনল আড্রিয়ানা। তার কথামতো লোকজন দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখল ছোটো অ্যান্টিফোলাসকে। তারপর পাগলামির চিকিৎসার জন্য ডেকে নিয়ে এল এক গ্রাম্য ওঝাকে। সে সময় পাগলামির চিকিৎসার জন্য লোকেরা ওঝারই শরণাপন্ন হত।। ওঝার হাতে স্বামীকে ছেড়ে দিয়ে, বাড়ির দরজা ভালোভাবে বন্ধ করে দিয়ে এবার আড্রিয়ানা রওনা দিল অ্যাঞ্জেলোর বাড়িতে গিয়ে হারের দাম পরিশোধ করতে। কিছুদূর যাবার পর তার সাথে দেখা হয়ে গেল বড়ো অ্যান্টিফোলাসের। তাকে দেখেই আড্রিয়ানা ধরে নিল ওঝার হাত ছাড়িয়ে পালিয়ে এসেছে তার স্বামী।
সত্যি সত্যিই বড়ো অ্যান্টিফোলাসকে তখন দেখে মনে হচ্ছিল সে পাগল হয়ে গেছে। তার মাথার চুল উশকোখুশকো, হাতে খোলা তলোয়ার আর দু-চোখে পাগলের মতো হিংস্ৰ চাহনি আর তাকে তাড়া করে চলেছে শত শত লোক। আসলে তখন চারদিকে খবর ছড়িয়ে পড়েছে যে অ্যান্টিফোলাস পাগল হয়ে গেছে। তাই তাকে ধরার জন্য পেছনে লোক ছুটেছে। আড্রিয়ানা দেখতে পেল। বড়ো ড্রোমিওর হাতেও তলোয়ার-তলোয়ার উচিয়ে সে তার মনিবকে পাহারা দিয়ে যাচ্ছে যাতে কেউ তার মনিবের কাছে ভিড়তে না পারে। এ দৃশ্য দেখে আড্রিয়ানা জনতার কাছে করুণ মিনতি জানাতে লাগল তারা যেন তার স্বামীকে বেঁধে ফেলে। এদিকে অ্যান্টিফোলাসও বেশ বুঝতে পারল এভাবে তলোয়ারের ভয় দেখিয়ে বেশিক্ষণ আটকে রাখা যাবে না জনতাকে। কিছুক্ষণ বাদেই লোকেরা তার চারপাশ ঘিরে ধরে আড্রিয়ানার কথামতো দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলবে তাকে। এমন সময় সামনে একটা বাড়ি দেখতে পেল অ্যান্টিফোলাস। কোনও উপায় দেখতে না পেয়ে সে আর বড়ো ড্রোমিও দ্রুত সেই বাড়িতে ঢুকে পড়ল আশ্রয়ের আশায়।
সে বাড়িটা আসলে একটা মঠ, এক বৃদ্ধ সন্ন্যাসিনী সেই মঠের কর্ত্রী। লোকজনের চিৎকারচেচামেচি শুনে তিনি বাইরে বেরিয়ে এলেন। সব শোনার পর তিনি আড্রিয়ানাকে বললেন, দ্যাখ, এই মঠে কেউ আশ্রয় নিলে তাকে জোর করে ধরে নিয়ে যাবার অধিকার কারও নেই। এই মুহূর্তে তোমরা চলে যাও এখান থেকে।
সন্ন্যাসিনীর কথা শুনে আড্রিয়ানা রেগেমেগে বলল, কিন্তু যাদের মাথা খারাপ হয়েছে তাদের বেলা এ নিয়ম খাটে না। আমার স্বামীর মাথা খারাপ হয়েছে। বাড়িতে নিয়ে গিয়ে আমি তার চিকিৎসা করবে। সেখানে ওঝা অপেক্ষা করে আছে।
মঠের কর্ত্রী কিন্তু মানতে চাইলেন না আড্রিয়ানার কথা। তার স্থির বিশ্বাস, আশ্রয়ের জন্য যারা মাঠে ঢুকেছে। তাদের কেউ পাগল নয়। মেয়েটি বলছে বটে তার স্বামীর মাথা খারাপ হয়ে গেছে, কিন্তু কোথায় যেন একটা ভুল হচ্ছে বলে মনে করছেন সন্ন্যাসিনী। তাই তিনি কিছুতেই রাজি হলেন না। আড্রিয়ানার হাতে বড়ো অ্যান্টিফোলাসকে তুলে দিতে।
এদিকে সন্ধে হয়ে আসছে। বৃদ্ধ সওদাগরাইজিয়নকে তার জরিমানার টাকা জমা দেওয়ার যে সময় দিয়েছিলেন ডিউক, তার মেয়াদও ফুরিয়ে আসছে। সূর্য ডোবার আগে টাকা দিতে না পারলে প্ৰাণদণ্ড হবে ইজিয়নের। প্ৰাণদণ্ড দেবার জন্য রক্ষীরা ইজিয়নকে কারাগার থেকে বের করে। মঠের দিকে নিয়ে আসছে। যে জায়গাটায় তার প্রাণদণ্ড হবে তা মঠের ঠিক পাশেই।
প্ৰাণদণ্ড দেবার জন্য ইজিয়নকে নিয়ে চলেছে জল্লাদ। আর তার পেছনে পেছনে ডিউক চলেছেন একদল প্রহরী আর কর্মচারী নিয়ে। সে সময় মঠ থেকে বেরিয়ে এল আড্রিয়ানা। মঠের কািন্ত্ৰী তার পাগল স্বামীকে আটকে রেখেছেন বলে সে অভিযোগ জানাল ডিউকের কাছে।
ডিউক খুব দুঃখ পেলেন আড্রিয়ানার কথা শুনে। কারণ তার স্বামী অ্যান্টিফোলাস সেনাদলের এক পদস্থ সেনানি, রাজসভার নিয়মিত সভাসদ। একদিন তিনি নিজেই অ্যান্টিফোলাসের সাথে আড্রিয়ানার বিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি মঠের কর্ত্রীকে ডেকে বললেন, অ্যান্টিফোলাস নামে যে ব্যক্তিটি আপনার মঠে আশ্রয় নিয়েছে তাকে ডেকে আনুন। ডিউকের হুকুম শুনে মঠের কর্ত্রী ভেতরে গেলেন তার আশ্রিতদের আনতে। ঠিক সে সময় ছোটো ড্রোমিওকে সাথে নিয়ে ছোটো অ্যান্টিফোলাসও হাজির হলেন সেখানে। ওঝার হাত থেকে কোনও মতে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আড্রিয়ানার সাথে একটা ফয়সালা করতে এসেছেন তিনি। তারা আসার সাথে সাথেই বড়ো অ্যান্টিফোলাস আর বড়ো ড্রোমিওকে নিয়ে বাইরে এলেন মঠের কর্ত্রী।
এবার সবাই নিশাচুপ। অবাক হয়ে আড্রিয়ানা দেখল তার সামনে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে দুজন স্বামী। বড়ো ও ছোটো ড্রোমিও আশ্চর্য হয়ে দেখল তাদের দুজন মনিবই হুবহু একরকম দেখতে। বড়ো ও ছোটো অ্যান্টিফোলাসও দেখলেন তাদের দুজন চাকরের মাঝে এক আশ্চর্য মিল। আর ইজিয়ান যেন নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারল না যে সত্যিই তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে দুই হারানো ছেলে আর দুই পালিত পুত্র। সে ডেকে উঠল তার দুই ছেলেকে। ডাক শুনে ঘাড় ঘোরালো বড়ো ও ছোটো অ্যান্টিফোলাস। বন্দি অবস্থায় বাবাকে দেখে অবাক হয়ে গেল তারা। ছোটো অ্যান্টিফোলাসকে ডেকে নিজের পরিচয় দিলাইজিয়ান। এতদিন পর হারানো বাবাকে পেয়ে বেজায় খুশি হল ছোটো অ্যান্টিফোলাস। এবার চমকে উঠলেন। মঠের কর্ত্রী — তিনি স্বপ্নেও ভাবেননি এতদিন বাদে আবার ফিরে পাবেন স্বামী ইজিয়নকে। আর শুধু স্বামী নয়, দুই হারানো ছেলে আর দুই পালিত পুত্রকেও ফিরে পেলেন ইজিয়নের স্ত্রী এমিলিয়া।
এমন আনন্দের দিনে ডিউক খুশি হয়ে প্রাণদণ্ড মকুব করে মুক্তি দিলেন ইজিয়নকে। স্বামীর সাথে ভুল বোঝাবুঝি মিটে গেল আড্রিয়ানার। ডিউকের সামনে আড্রিয়ানা প্রতিশ্রুতি দিলেন তিনি তার বোন লুসিয়ানার বিয়ে দেবেন ভাসুর বড়ো অ্যান্টিফোলাসের সাথে।
পড়লাম