পেরিক্লিস, দ্য প্ৰিন্স অব টায়ার
চারদিক দিয়ে সারি সারি পাহাড়ে ঘেরা ছোট্ট একটি রাজ্য–নাম অ্যান্টিওক। সে দেশের রাজার নাম অ্যান্টিওকাস। রাজা ঠিক করেছেন তার রূপসি মেয়ের বিয়ে দেবেন। সেই অপরাপা সুন্দরী মেয়েকে বিয়ে করার উদ্দেশ্যে দেশ-দেশান্তর থেকে রাজা আর রাজপুত্ররা এসে সমবেত হয়েছেন অ্যান্টিওকে। এখানে এসেই তারা শুনলেন বিয়ের এক অদ্ভূত শর্তের কথা। শর্তটা এই — যে রাজকন্যার ধাঁধার সঠিক জবাব দিতে পারবে, রাজকন্যা তাকেই বিয়ে করবেন। আর ধাঁধার সঠিক জবাব দিতে না পারলে মৃত্যুদণ্ড হবে। রাজকন্যাকে বিয়ে করতে এ যাবত কত না রাজা ও রাজপুত্র এসেছে তার ঠিক নেই। তবে ধাঁধার সঠিক জবাব দিতে না পেরে তারা কেউ আর প্রাণে বাঁচেনি।
এবার টায়ারের রাজা পেরিক্লিস এলেন রাজা অ্যান্টিওকের সেই অসামান্যা সুন্দরী মেয়েকে বিয়ে করতে। রাজকুমারীর ধাঁধার সঠিক জবাব দিতে না পারলে তার প্রাণদণ্ড হবে – সে কথা নিজমুখে তাকে বলে দিলেন রাজা অ্যান্টিওক্যাস। মৃত্যুতে ভয় নেই পেরিক্রিসের। তাই এই ভয়ানক শর্তের কথা শুনেও তিনি রাজি হলেন সরাসরি রাজকন্যার সাথে দেখা করতে। এরপর অ্যান্টিওক্যাসের আর বলার কিছুই রইল না। তাঁর আদেশে অন্দরমহলের প্রহরীরা রাজকুমারীকে নিয়ে এসে হাজির করল পেরিক্রিসের সামনে। রাজকন্যার এই অপরূপ সৌন্দর্য দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলেন তিনি। রক্ত-মাংসে গড়া কোনও মেয়ে যে এত সুন্দরী হতে পারে তা জানতেন না তিনি। জীবনে এরূপ সৌন্দর্যবতী যুবতির মুখোমুখি হননি তিনি।
রাজকুমারীর একজন সহচরী বললেন, মহারাজ! এবার আমাদের রাজকুমারী আপনাকে একটি ধাঁধা বলবেন তার সঠিক জবাব দিতে হবে আপনাকে। জবাব সঠিক না হলে তার পরিণতি অবশ্যই আপনারা জানা আছে। প্রহরীরা আপনাকে বধ্যভূমিতে নিয়ে যাবে আর জল্লাদ এককোপে আপনার মুণ্ডুটা কেটে ফেলবে। এবার বলুন আপনি কি ধাঁধা শুনতে রাজি আছেন?
পেরিক্লিস বললেন, আমি বুঝতে পারছি না বারবার একই শর্তের কথা বলে লাভ কি। তোমাদের রাজকুমারীকে বল ধাঁধাটা শুনিয়ে দিতে।
রাজকুমারী ধাঁধাটি শুনিয়ে দিলেন। মাথা খাটিয়ে বুদ্ধিমান পেরিক্লিস তার অর্থ ঠিকই বের করলেন তবে তা এতই নোংরা যে কথায় তা প্রকাশ করা যায় না। ধাঁধার সঠিক অর্থ হল অ্যান্টিওক্যাস তার সুন্দরী মেয়ের সাথে অবৈধ সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন। পেরিক্রিসের বুঝতে বাকি রইল না। এই রূপসী রাজকন্যা আসলে এক ব্যভিচারিণী নারী।
ধাঁধার সঠিক জবাব পেরিক্লিস বুঝতে পেরেছেন জেনে রাজা অ্যান্টিওকাস ভয় পেয়ে গেলেন। বাবা-মেয়ের কুকর্মের কথা জেনে পেরিক্লিস তার মেয়েকে বিয়ে করা তো দূরের কথা, উলটে সবাইকে জানিয়ে দেবেন তার চরিত্রহীনতার কথা। এ ব্যাপারে নিঃসন্দেহ অ্যান্টিওক্যাস। ধাধার সঠিক অর্থ খুজে বের করার পর তার বেঁচে থাকাটা যে রাজার কাছে বিপজ্জনক, সেটা স্পষ্ট বুঝতে পেরেছেন পেরিক্লিস। তাই রাজা কিছু টের পাবার আগেই তিনি অ্যাস্টিওক ছেড়ে পালিয়ে এলেন নিজ রাজ্য টায়ারে। পেরিক্রিসের পালিয়ে যাবার খবর শুনে রেগে আগুন হয়ে উঠলেন অ্যান্টিওক্যাস। তিনি স্থির করলেন পেরিক্লিস কোনও কিছু রটিয়ে দেবার আগেই তিনি তাকে হত্যা করবেন। অ্যান্টিওকাস তার সভাসদ থেলিয়ার্ডকে ডেকে বললেন, যত তাড়াতাড়ি পারেন। আপনি টায়ারে চলে যান। সেখানে গিয়ে সবার অগোচরে বিষপ্রয়োগে হত্যার ব্যবস্থা করুন পেরিকিসকে। সঠিক ভাবে কাজটা না করতে পারলে আপনিও বাঁচবেন না। দেশে ফিরে এলেই আপনার শিরশ্ছেদ করা হবে।
প্ৰাণ নিয়ে অ্যান্টিওক্যাসের রাজ্য থেকে ফিরে এলেও শান্তি নেই পেরিক্রিসের মনে। কারণ অ্যান্টিওক থেকে টায়ার অনেক ছোটো রাজ্য। ইচ্ছে করলেই সেখানকার রাজা যে কোনও সময় তার বিশাল বাহিনী নিয়ে টায়ার আক্রমণ করতে পারেন। পেরিক্লিস জানেন সেরূপ কিছু ঘটলে তিনি তার দেশ ও প্রজাদের রক্ষা করতে পারবেন না। — কারণ তার এমন সৈন্যবাহিনী নেই যা অ্যান্টিওক্যাসের আক্রমণ ঠেকাতে পারে। পেরিক্লিস তার প্রধান অমাত্য হেলিকেন্যাসকে আদেশ দিলেন, আপনি এখনই বন্দরে গিয়ে সেখানে সেনাবাহিনী নিয়োগ করুন। দূর থেকে কোনও যুদ্ধজাহাজের মাস্তুল দেখা গেলেই আমায় সংবাদ দেবেন। যাবার আগে সেনাপতিকে এখনই আমার কাছে পাঠিয়ে দিন। রাজার নির্দেশ শুনে চমকে উঠলেন হেলিকেন্যাস। তিনি বুঝতে পারলেন কোনও কারণে যুদ্ধের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে রাজার মনে। আসল ব্যাপারটা কী তা জানার জন্য তিনি একদৃষ্টি তাকিয়ে রইলেন রাজার মুখের দিকে।
তা দেখে উত্তেজিত হয়ে পেরিক্লিস বললেন, কী ব্যাপার! আমার কথা শুনতে পাননি। আপনি? বললাম সেনাপতিকে ডেকে আনুন। তা না করে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আপনি কি দেখছেন?
হেলিকেন্যাস উত্তর দিলেন, মহারাজ! আমি আপনার একজন অনুগত অমাত্য। আমার কাজ রাজ্য পরিচালনার ব্যাপারে আপনাকে যথাসাধ্য সাহায্য করা। আমি লক্ষ করছি অ্যান্টিওক থেকে ফিরে আসার পর থেকে আপনি ভীষণ মানসিক অশাস্তির মাঝে দিন কাটাচ্ছেন। মনে হচ্ছে কোনও কারণে আপনি ভয় পেয়েছেন —সর্বদাই একটা আতঙ্কের মাঝে সন্ত্রস্ত হয়ে আছেন। মহারাজ! আপনি যদি বিশ্বাস করে আমায় সব কথা খুলে বলেন, তাহলে আমি আপ্রাণ চেষ্টা করে দেখব কীভাবে আপনাকে এই সংকট থেকে মুক্ত করা যায়।
হেলিকেনাসের কথায় ভরসা পেয়ে অ্যান্টিওকে যে সব ঘটনা ঘটেছে তা তাকে খুলে বললেন রাজা। তিনি বললেন, অ্যান্টিওক্যাসের মধ্যে এমন একটা ধারণা জন্মেছে যে নিজের মেয়ের সাথে তার ব্যভিচারের কথাটা আমি চারদিকে রটিয়ে দেব। আমি জানি চুপচাপ বসে থাকার লোক নন। উনি। যে কোনওভাবেই হোক টায়ারে উনি আঘাত হানবেনই। বুঝলেন হেলিকেন্যাস, সে সব কথা ভেবেই ভয় পাচ্ছি। আমি। এখন আপনিই বলুন আমি কি করব।
আপনি যা ভাবছেন তা মোটেই অযৌক্তিক নয় মহারাজী, বললেন হেলিকেন্যাস, টায়ার যদি উনি আক্রমণ নাও করেন তাহলেও তিনি একবার না একবার আপনার প্রাণনাশের চেষ্টা করবেন। আমার পরামর্শ যদি চান তাহলে বলি কি আপনি কিছুদিনের জন্য এ রাজ্য ছেড়ে অন্য কোথাও আশ্রয় নিন। আপনি এখানে নেই জানলে আপনার উপর অ্যান্টিওক্যাসের যে রাগ জমে আছে তা স্বাভাবিকভাবেই উবে যাবে। এমনও হতে পারে আপনার অনুপস্থিতিতে তার মতো অহংকারী রাজা মারা গেলেন। যাইহোক, আপনি যোগ্য লোকের হাতে রাজ্য পরিচালনার ভার দিয়ে নিশ্চিন্তে কিছুদিনের জন্য বাইরে চলে যান। আমি কথা দিচ্ছি। দেহের শেষ রক্তবিন্দু থাকা পর্যন্ত দেশের স্বাধীনতা রক্ষা করে যাব।
পেরিক্লিস বললেন, ঠিক আছে, আপনার পরামর্শও আমি কিছুদিনের জন্য টায়ার ছেড়ে যাচ্ছি। আমার অনুপস্থিতিতে এ রাজ্য আপনিই পরিচালনা করবেন। আমি যেখানেই থাকি না। কেন, চিঠিপত্রের মাধ্যমে আপনার সাথে যোগাযোগ রাখব।
এবার হেলিকেন্যাসকে টায়ারের শাসক পদে নিযুক্ত করে রাজা পেরিক্লিস তার কয়েকজন বিশ্বস্ত অনুচর, প্রচুর খাবার-দাবার এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে জাহাজে চেপে পাড়ি দিলেন অজানার পথে। পরদিন নতুন দায়িত্ব নিয়ে রাজসভায় এলেন হেলিকেন্যাস। সমবেত অমাত্য এবং সভাসদদের উদ্দেশ করে তিনি বললেন, কোনও বিশেষ কারণে নিজের অজান্তে আমাদের রাজা পেরিক্লিাস অন্যায় আচরণ করে ফেলেছেন অ্যান্টিওকের রাজা অ্যান্টিওক্যাসের প্রতি। সে আচরণের জন্য রাজা নিজে খুব অনুতপ্ত। অন্যায়ের শাস্তি স্বরূপ তিনি খালাসির বেশে সমুদ্রপথে কোনও এক অজ্ঞাত স্থানে যাত্ৰা করেছেন। বন্ধুগণ! আপনারা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন এ অবস্থায় রাজার জীবনের কোনও নিরাপত্তা নেই। অনুগ্রহ করে আপনারা তার অন্যায় আচরণ বা তার অনুতাপের বিষয়ে আমায় কোনও প্রশ্ন করবেন না। যাবার সময়ে তিনি তার অনুপস্থিতিতে রাজ্য শাসনের দায়িত্বভার আমার ওপর দিয়ে গেছেন। সময় অভাবে তিনি আপনাদের সবাইকে আলাদা করে এ ব্যাপারে কিছু বলে যেতে পারেননি।
এসব কথা হেলিকেন্যাস যখন তার সতীর্থ অমাত্য আর সভাসদদের বলছিলেন, সে সময় সেখানে এসে হাজির হলেন অ্যান্টিওক্যাসের প্রধানমন্ত্রী থেলিয়ার্ড—উদ্দেশ্য বিষপ্রয়োগে রাজা পেরিক্লিসকে হত্যা করা। পেরিক্রিসের চলে যাবার কথা শুনে হাফ ছেড়ে বঁচিলেন তিনি। অ্যান্টিওকে ফিরে গিয়ে রাজাকে এ কথা জানালে নিশ্চয়ই তিনি তার প্রাণ নেবেন না – ভেবে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন তিনি।
সভাসদদের অভিবাদন জানিয়ে থেলিয়ার্ড বললেন, রাজা অ্যান্টিওক্যাসের দূত হিসেবে আমি এক জরুরি বার্তা বয়ে নিয়ে এসেছি। রাজা পেরিক্রিসের জন্য। এসে শুনি তিনি নিরুদেশ যাত্রা করেছেন। দেশে ফিরে গিয়ে আমি রাজাকে সে কথাই বলব।
হেলিকেন্যাস বললেন, রাজার জন্য যে বিশেষ বার্তা আপনি বয়ে নিয়ে এসেছেন তা জানতে আমরা আগ্রহী নই। তবে আপনি আমাদের সম্মানীয় অতিথি। অনুগ্রহ করে আজকের দিনটা থেকে গেলে আমরা খুব খুশি হব।
তাদের কথা রাখতে শুধু সেদিনের রাতটুকুটায়ারের প্রাসাদে অতিথি হয়ে কটালেন থেলিয়ার্ড। পরদিন সকালে অ্যান্টিওকে চলে গেলেন তিনি।
একসময় টায়ারের অন্তর্ভুক্ত থার্সাস নগরী এতই সমৃদ্ধিশালী ছিল যে সেখানে কখনও খাদ্যাভাব হয়নি। দুঃখ যে কী তা সেখানকার লোকেরা কখনও অনুভব করেনি। নাগরিকদের প্রয়োজন মেটার পর থাসাঁসের উৎপাদিত ফসল পাঠিয়ে দেওয়া হত আশে-পাশের শহরে। কিন্তু সেই থার্সাসেই একদিন দেখা দিল অনাবৃষ্টি। বৃষ্টি না হওয়ায় ফসল ফলাল না খেতে, ফলে চরম খাদ্যাভাব দেখা দিল সেখানে। খাদ্য জোগাড় করতে সেখানকার লোকেরা ঘর-বাড়ি, গোরু-ঘোড়া সব কিছু বিক্রি আরম্ভ করল। কিন্তু এভাবে আর কতদিন চলে! শেষমেশ এমন অবস্থা দাঁড়াল থার্সাসে, যে ভিক্ষা দেবার লোকও রইল না। সেখানে। ক্ষুধার জ্বালায় অখাদ্য কৃখাদ্য খেতে শুরু করল সেখানকার লোকেরা! ফলস্বরূপ দেখা দিল মহামারী। কুকুর-বেড়ালের মতো বিনি চিকিৎসায় মরতে লাগল থাসাসের লোকেরা।
থার্সাসের মানুষদের এই চরম দুঃখ-দুৰ্দশা দেখে হতাশ হয়ে পড়লেন সেখানকার শাসনকর্তা ক্লিওন। অনেক ভেবেচিন্তেও তিনি হদিস পেলেন না। কীভাবে প্রজাদের দুর্দশা দূর করা যায়।
থার্সাসের লোকদের যখন এই অবস্থা, সে সময় কয়েকজন অনুচরসহ জাহাজে চেপে সেখানে এস হাজির হলেন রাজা পেরিক্লিস। তিনি রাজাকে অভিবাদন করে বললেন, থার্সাসে যে দুৰ্ভিক্ষ চলছে সে খবর আমি আগেই পেয়েছি। তাই আমি জাহাজে করে তাদের জন্য প্রচুর খাদ্য-শস্য নিয়ে এসেছি। এতে অন্তত কিছুদিনের জন্য তাদের খাদ্যাভাব মিটবে। তবে এর বিনিময়ে আমার কিছু চাইবার আছে মহারাজ।
রাজা ক্লিওন বললেন, যখন খাদ্যাভাবে আমার লোকেরা শেয়াল-কুকুরের মতো মরছে, সে সময় আপনি তাদের জন্য জাহাজভর্তি খাবার নিয়ে এসেছেন। এর বিনিময়ে আমার যদি কিছু করার থাকে তা আমি আশুই করব। আপনি নিঃসঙ্কোচে বলুন কী চাই আপনার।
বিশেষ কিছু নয় মহারাজ, বললেন রাজা পেরিক্লিস, ‘এই কয়েকজন অনুচরসহ আমি কিছুদিন আপনার রাজ্যে থাকতে চাই।
এ আর এমন কী! আপনার যতদিন ইচ্ছে থাকুন। এখানে, আমি বরঞ্চ খুশিই হব তাতে, বললেন রাজা ক্লিওন, আমি আপনাকে যে কোনও রকম সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি।
পেরিক্লিস কিছুদিন কটালেন। থার্সারের রাজা ক্লেওনের রাজপ্রাসাদে। এর মাঝে তিনি চিঠিপত্রের মাধ্যমে নিয়মিত যোগাযোগ বজায় রেখে চলেছিলেন অমাত্য হেলিকেনাসের সাথে। তার একটা চিঠিতেই পেরিক্লিস জানতে পারলেন কিছুদিন আগে তাকে হত্যা করার জন্য রাজা অ্যান্টিওকাস তার মন্ত্রী থেলিয়ার্ডকে টায়ারে পাঠিয়েছিলেন। তার নিরুদ্দেশ যাত্রার খবর শুনে অ্যান্টিওকে ফিরে গেছেন থেলিয়ার্ড। খবরটা শুনে চিন্তায় পড়ে গেলেন পেরিক্লিস। কারণ তিনি এখানে আছেন জানতে পারলে অ্যান্টিওকাস আবার লোক পাঠাবেন তাকে হত্যা করতে। তাই রাজা ক্লিওনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে জাহাজে চেপে পুনরায় যাত্রা করলেন অজানার উদ্দেশে।
থার্সাস ছেড়ে যাবার পর দুটো দিন ভালোভাবেই কাটল। কিন্তু তৃতীয় তিন সকালে ঘন মেঘে। ছেয়ে গেল সারা আকাশ। কিছুক্ষণ বাদেই শুরু হল তুমুল ঝড়-বৃষ্টি। সমুদ্র উত্তাল হয়ে উঠল। হাওয়ার দাপটে। ঝড়ের তাণ্ডবে ভেঙে পড়ল জাহাজের মাস্তুল। পাহাড়ের মতো উচু উচু ঢেউগুলো জাহাজটাকে নিয়ে যেন ছেলেখেলা করতে লাগল। অশান্ত সমুদ্রের সাথে পাল্লা দিতে দিতে এক সময় জাহাজটা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল। রাজা পেরিক্লিস ভাঙা জাহাজের একটা বড়ো টুকরো আঁকড়ে ধরে অসহায়ভাবে ভাসতে লাগলেন সমুদ্রে। বহুক্ষণ এভাবে কাটাবার পর সমুদ্রের অশান্ত ঢেউ তাকে এনে ফেলল কুলে। একটানা অশাস্ত সমূদ্রের সাথে লড়াই করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন পেরিক্লিস। কুলে আছড়ে পড়ার সাথে সাথেই জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন তিনি। জ্ঞান এলে তিনি দেখলেন ঝড়-বৃষ্টি থেমে গেছে। রাতের অন্ধকার দূর হয়ে ভোরের আলো ফুটে উঠেছে। ঝড়ের তাণ্ডবে ভাঙা জাহাজের সাথে সাথে তার অনুচররাও যে কে কোথায় চলে গেছে তা কেউ জানে না। কিন্তু এভাবে জলের ধারে হাত-পা ছড়িয়ে কতক্ষণ আর বসে থাকা যায়! তাছাড়া ক্ষুধা-তৃষ্ণায় তার গলা শুকিয়ে এসেছে।
যে করেই হোক তাকে বাঁচতে হবে এই আশা নিয়ে সব ক্লাস্তি ঝেড়ে ফেলে উঠে দাঁড়ালেন। পেরিক্লিস। একপাশে পাহাড় আর অন্যপাশে সমুদ্রকে রেখে দৃঢ়তার সাথে এগিয়ে চললেন তিনি। বেলা বাড়ার সাথে সাথে সূর্যের তেজ বাড়তে লাগল। বহুদূর হাঁটার পরও কোনও লোকালয়ের দেখা মিলল না। সূর্য যখন ঠিক মাথার উপর উঠে বসেছে, সে সময় দেখা মিলল একদল জেলের। ঝড়-বৃষ্টির পর তারা সমুদ্রে মাছ ধরতে গিয়েছিল। এখন তারা ঘরে ফিরছে বড়ো বড়ো জাল আর মাছ নিয়ে। জলে ভেজা কাপড়-চোপড় পরা পেরিক্লিসকে দেখে তারা থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল— জানতে চাইল তার পরিচয়। পেরিক্লিস তার আসল পরিচয় ইচ্ছে করেই গোপন করলেন তাদের কাছে। তিনি তাদের বললেন যে তিনি একজন বণিক। ঝড়ের তাণ্ডবে জাহাজ ডুবির ফলে সর্বস্ব হারিয়ে তিনি এসে পড়েছেন এই অজানা দ্বীপে। তার দুঃখের কথা শুনে সমবেদনা জানাল জেলেরা। তারা তাকে সাথে নিয়ে চলল নিজেদের বাড়িতে আশ্রয় দেবার জন্য। যেতে যেতেই পেরিক্লিস তাদের কাছে শুনতে পেলেন এই শহরের নাম পেন্টাপােলিস — এটি গ্রিসের অন্তর্গত। এর রাজার নাম সাইমোনাইডিস। সুশাসন আর বিচক্ষণতার জন্য প্রজারা তাকে আদর করে বলে মহান সাইমোনাইডিস। তার এক মেয়ে আছে— নাম থাইসা। সে যেমন রূপসি তেমনি গুণবতী।
জেলেদের কথা-বার্তায় সূত্র থেকেই পেরিক্লিস জানতে পারলেন আগামীকাল মেয়ে থাইসার জন্মদিন উপলক্ষে বিরাট এক উৎসবের আয়োজন করেছেন রাজা সাইমোনাইডিস। দূর দূর দেশ থেকে রাজা, রাজপুত্র আর নাইটরা এসে হাজির হবেন সেই উৎসবে। তাদের মধ্যে যিনি অস্ত্রবিদ্যায় পারদর্শিতা দেখাতে পারবেন, রাজকন্যা নিজে পুরস্কৃত করবেন তাকে। এ কথা শুনে খুবই দুঃখ পেলেন তিনি। ভাগ্য বিপর্যয় না হলে হয়তো এ উৎসবে তিনি আমন্ত্রিত হতেন।
কিছুক্ষণ বাদে জেলেদের মধ্যে একজন তার জালের মধ্য থেকে একটা জং-ধরা লোহার বর্ম বের করে সবাইকে দেখিয়ে বলল, সমুদ্রে মাছ ধরতে গিয়ে সে সেটা পেয়েছে। বর্মটার দিকে নজর পড়তেই চমকে উঠলেন পেরিক্লিস। ভালো করে সেটা নেড়ে-চেড়ে দেখে মনে মনে বললেন, আরে! এটাই তো আমার বাবার দেওয়া সেই বর্ম। বর্মটা দেবার সময় তিনি আমাকে বলেছিলেন, এই বর্মটা আমি তোকে দিয়ে গেলাম! বৰ্মটা যখন তুমি পরবে তখন এও আমার মতো তোমার প্রাণ বাচাবে। বাবার অন্তিম ইচ্ছানুযায়ী সব সময় এই বর্মটা পারতাম। ঝড়ের সময় এটা আমার কাছ থেকে হারিয়ে গেছে। দেখছি সমুদ্র এটা আমায় ফিরিয়ে দিয়েছে। যার জালে বর্মটা উঠেছে, পেরিক্লিস তার কাছে সেটা ভিক্ষে চাইলেন। তিনি জেলেকে বললেন, ভাই বর্মটা তুমি আমায় ভিক্ষে দাও। ওটা একসময় এক রাজার ছিল। ওটা পড়লে আমায় বড়ো লোকের মতো দেখাবে। তুমি আমায় রাজপ্ৰসাদের পথটা দয়া করে দেখিয়ে দাও। আমি কথা দিচ্ছি সময় সুযোগ এলে আমি অবশ্যই এর যোগ্য প্রতিদান দেব।
সেই জেলে বলল, তাহলে তুমি ঠিক করেছ রাজপ্রসাদে যে অস্ত্র প্রতিযোগিতা হবে তাতে তুমি যোগ দেবে?
তুমি ঠিকই ধরেছি! ওখানে অস্ত্ৰ প্ৰতিযোগিতায় আমি আমার পারদর্শিতা দেখাব, সায় দিয়ে পেরিক্লিস বললেন।
জেলে বলল, বেশ! সমুদ্রের অতল থেকে তুলে আনা এই বর্ম পরে যদি তোমার ভাগ্য ফেরে, তাহলে আমাদের কথা কিন্তু ভুলে যে ও না।
পেরিক্লিস বললেন, আমি কথা দিচ্ছি। তেমন সুদিন এলে আমি অবশ্যই তোমাদের কথা মনে রাখব। তবে শুধু বর্ম হলে তো হবে না, প্রতিযোগিতায় যোগ দিতে হলে একটা ঘোড়াও দরকার আমার।
পোশাক আর ঘোড়ার ব্যবস্থা আমরা করে দিচ্ছি। তুমি এবার তৈরি হও।
তোমরা যে আমার কী উপকার করলে তা আমি ভাষায় বোঝাতে পারব না, বললেন পেরিক্লিস, ঈশ্বর তোমাদের ভালো করুন।
এবার তার বাবার দেওয়া জং-ধরা লোহার বর্ম পরিধান করে জেলেদের জোগাড় করা তেজী ঘোড়ায় চেপে যথাসময়ে প্রতিযোগিতা ক্ষেত্রে উপস্থিত হলেন পেরিক্লিস। রাজার মেয়ে থাইসার জন্মদিন উপলক্ষে খুব সুন্দর করে সাজানো হয়েছে রাজপ্রাসাদের চারদিকটা। এ উপলক্ষে যে অস্ত্ৰ প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছে তাতে যোগ দেবার জন্য দূর-দূরান্ত থেকে এসেছেন, রাজা, রাজপুত্র আর নাইটরা। প্রাসাদ প্রাঙ্গণের একদিকে বসেছেন তারা। বাইরে দাঁড়িয়ে তাদের ঘোড়াগুলির দেখভাল করছেন সহিসেরা। এতসব আয়োজন দেখে বল-ভরসা পেলেন পেরিক্লিস। প্রাসাদের বাইরে একটা খুঁটিতে ঘোড়াটাকে বেঁধে রেখে অভ্যাগতদের পাশে গিয়ে বসলেন তিনি। কিছুক্ষণ বাদে চড়া সুরে বেজে উঠল বাজনা। ধীর পায়ে কন্যা থাইসার হাত ধরে প্রাসাদ প্রাঙ্গণে এলেন রাজা সাইমোনাইডিস। তাদের অভ্যর্থনা জানাতে সমবেত অতিথিরা আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। প্রাসাদের একপাশে তৈরি হয়েছে একটা সুসজ্জিত মঞ্চ। সেখানে দুটি আসনে পাশাপাশি বসলেন তারা। সুন্দরী থাইসার পরনে ঢিলেঢালা রেশমের পোশাক, কানে-গলায় হাতে দুর্লভ হিরে মণিমুক্তাখচিত অলংকার। রাজা তার নিজ আসনে বসে সৌজন্য সহকারে হাত নাড়ার পর সবাই তার নিজ নিজ আসনে বসে পড়লেন।
এবার রাজার নির্দেশে শুরু হল ক্রীড়া প্রতিযোগিতা। স্পার্ট থেকে এসেছেন একজন নাইট যার ঢালের গায়ে আঁকা রয়েছে একটা ছবি আর উদ্ধৃতি। রাজা নিজে সেটা পড়ে শোনালেন মেয়েকে, তাতে লেখা — সেই তোমাকে প্রকৃত ভালোবাসে যে তোমারা জন্য প্ৰাণ দিতে পারে। এরপর এলেন। দ্বিতীয় নাইট যিনি আদতে ম্যাসিডনের রাজপুত্র। তিনি দেখালেন কীভাবে নারীর কাছে হেরে গেলেন একজন নাইট।
এরপর কয়েকজন নাইট একে একে মঞ্চে উঠে তাদের খেলা দেখালেন। সব শেষে এলেন পেরিক্লিস — তিনি হলেন ক্রীড়া প্রতিযোগিতার ষষ্ঠ নাইট। তাকে চিনতে না পারলেও তার আচার-আচরণ তার গভীর ব্যক্তিত্বের প্রভাবে তার প্রতি আকৃষ্ট হলেন রাজা সাইমোনাইডিস।
পেরিক্লিসকে দেখে মন্তব্য করলেন রাজকুমারী থাইস – এ নাইটকে দেখে মনে হচ্ছে ইনি যেন একটা শুকিয়ে যাওয়া গাছ, যার মাথায় কোনওমতে টিকে আছে কয়েকটা সবুজ পাতা।
মেয়ের কথা কানে যেতেই বলে উঠলেন রাজা, একে দেখেই বুঝতে পারছি চরম দুৰ্দশার মাঝেও কঠোর সংগ্রাম করে বেঁচে আছেন ইনি। তোমার সাহায্যে তার দুর্ভাগ্যকে জয় করার আশা নিয়েই এ প্রতিযোগিতায় যোগ দিতে এসেছেন ইনি।
একজন সভাসদ আবার আড়াচোখে পেরিক্রিসের দিকে তাকিয়ে ব্যঙ্গের সাথে মন্তব্য করলেন, দেখে তো মনে হয় না। কখনও যুদ্ধে গেছেন। লোকটা একেবারে কাণ্ডজ্ঞানহীন।
সভাসদদের কথা শুনে রাজা সাইমোনাইডিস বলে উঠলেন, বাইরের চেহারা দেখে কাউকে। বিচার করার অর্থ নিছক বোকামি ছাড়া আর কিছু নয়। যাই হোক, সবাই এসে গেছেন, আশা করি আপনারা এবার সংযত হবেন। চলুন, গ্যালারিতে যাই আমরা।
নিজের নির্দিষ্ট আসনে গিয়ে বসলেন রাজা সাইমোনাইডিস। তার পাশের আসনে বসলেন। রাজকুমারী থাইসা। অভাগত সবাই যে যার আসনে গিয়ে বসলেন। এবার অভ্যাগতদের খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করলেন রাজা। খানিকবাদে তার নজর পড়ল পেরিক্লিসের উপর। দুঃখ-দুৰ্দশার চাপে তাকে ক্লান্ত দেখালেও বীরের মতো ব্যক্তিত্ব আর রাজার মতো সুন্দর মুখশ্ৰী ভীষণভাবে আকৃষ্ট করল রাজাকে।
দূর থেকেইশারায় পেরিক্লিসকে দেখিয়ে রাজা চাপা স্বরে তীর মেয়েকে বললেন, ওই যুবকও যে আজকের অস্ত্ৰ প্ৰতিযোগিতায় যোগ দিয়েছিল সে কথা বেশ মনে আছে আমার। আমি বুঝতে পারছি না। এত আনন্দের মাঝেও কেন ওকে এত বিযগ্ন দেখাচ্ছে! মনে হয় আমাদের কোনও আচরণে হয়তো উনি দুঃখ পেয়েছেন। যাই হোক, তুমি এক কাজ কর। তুমি নিজে একপাত্র সুস্বাদু সুরা নিয়ে গিয়ে ওকে পরিবেশন কর। সেই সাথে ওর নাম, পরিচয় সবকিছু জেনে নিও।
রাজার নির্দেশে একপােত্র সুস্বাদু সুরা নিয়ে গিয়ে নিজ হাতে তা পেরিক্লিসকে পরিবেশন করলেন থাইসা-সেই সাথে জানাতে চাইলেন তার নাম-ধাম ও পরিচয়! হাসিমুখে থাইসার দেওয়া সুরা হাতে নিয়ে পেরিক্লিস বললেন, আমার নাম পেরিক্লিস। আমি টায়ার রাজ্যের এক সন্ত্রান্ত বংশের সন্তান। সবরকম কলা এবং যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী আমি। একদল যাত্রীর সাথে সমুদ্রপথে এক দুঃসাহসিক অভিযানে পাড়ি দিয়েছিলাম আমি। প্রচণ্ড ঝড়ের তাণ্ডবে জাহাজ ডুবি হয়ে সমুদ্রের অতলে তলিয়ে গেছে সবাই। করুণাময় ঈশ্বরের কৃপায় একমাত্র আমিই ভাসতে ভাসতে এ দেশের উপকূলে এসে পড়েছি।
রাজকুমারী থাইসা খুবই দুঃখ পেলেন পেরিক্লিসের ভাগ্য-বিড়ম্বনার কথা শুনে। ফিরে এসে বাবাকে বললেন, বাবা! উনি টায়ার রাজ্যের এক সম্রাস্ত বংশের সন্তান— নাম পেরিক্লিস। সব রকম কলা এবং যুদ্ধবিদ্যায় পারদশী উনি। ঝড়ের দাপটে জাহাজ ডুবি হয়ে সবাই সমুদ্রের অতলে। ডুবে গেছে। একমাত্র উনিই ভাসতে ভাসতে আমাদের দেশের উপকূলে এসে পৌঁছেছেন। মেয়ের মুখে সবকিছু শুনে রাজাও খুব দুঃখ পেলেন। তিনি মেয়েকে কথা দিলেন যে ভাবেই হোক পেরিক্রিসের দুঃখ-দুৰ্দশা মোচন করবেন। এবার অতিথিদের মনোরঞ্জনের জন্য রাজার অনুরোধে সবাই মহিলাদের সাথে নিয়ে শুরু করলেন সৈনিক নৃত্য। রাজা নিজেও যোগ দিলেন নাচের আসরে। কিছুক্ষণ বাদে পেরিক্লিসের সামনে রাজা বললেন, আমি তো শুনেছি টায়ারের লোকেরা মেয়েদের সাথে ভালো নাচতে পারে। খুব খুশি হব। আপনি যদি আমাদের সাথে নাচে যোগ দেন। রাজার অনুরোধ এড়াতে না পেরে পেরিক্লিসও মহিলাদের সাথে নাচতে শুরু করলেন। অনুষ্ঠান শেষে পেরিক্লিসের নাচের ভূয়সী প্রশংসা করে সবাইকে সেদিনের মতো বিশ্রাম নিতে বলে চলে গেলেন রাজা।
এবারে নজর ফেরানো যাক পেরিক্রিসের নিজ রাজ্য টায়ারের ঘটনাবলির দিকে। আগেই বলা হয়েছে নিজ রাজ্য ছেড়ে অজানার পথে পাড়ি দেবার আগে তিনি শাসনভার সাপে দিয়ে এসেছিলেন তাঁর মন্ত্রী হেলিকেনাসের উপর। হেলিকেন্যাস তার দায়িত্ব নিখুঁতভাবে পালন করলেও রাজা কোথায় আছেন, কবে ফিরবেন—এজাতীয় প্রশ্নের মুখোমুখি প্রায়ই হতে হয় তাকে! একদিন প্রাসাদের সভাকক্ষে এসকেন নামক জনৈক সভাসদ ওই জাতীয় প্রশ্ন করলেন তাকে; কথায় কথায় সেদিন নানা প্রসঙ্গ উঠল। হেলিকেন্যাস সভাসদদের জানালেন যে অ্যান্টিওকের ব্যভিচারী রাজা ও তার মেয়ে উভয়েই বাজ পড়ে মারা গেছে। কিছুদিন আগে অ্যান্টিওকাস নাকি তার মেয়েকে নিয়ে রথে চেপে কোথাও যাচ্ছিলেন। সে সময় তাদের উপর বাজ পড়ে — ছিড়ে টুকরো টুকরো হয় তাদের দেহ। এভাবেই নিজেদের পাপের সাজা পেলেন তারা। হয়তো ঈশ্বর এ ভাবেই পাপীকে শাস্তি দেন। হেলিকেনাসের কথা শুনে আশ্চর্য হয়ে গেলেন এসকেন। তিনি স্বপ্নেও ভাবেননি এভাবে পাপিষ্ঠ রাজাকে শাস্তি দেবেন। ঈশ্বর। এর পরই অন্যান্য সভাসদর রাজা পেরিক্লিস কোথায় আছেন? তিনি ফিরে আসবেন কিনা?-এ জাতীয় প্রশ্ন করে বিব্রত করে তুলতে লাগলেন হেলিকেন্যাসকে। অনেকে আবার এও বললেন রাজা পেরিক্লিস আর বেঁচে নেই এবং সে কথা ইচ্ছে করেই তাদের জানাননি হেরিকেনাস। তাদের বক্তব্য, এই যদি প্রকৃত পরিস্থিতি হয় তাহলে হেলিকেন্যাস যেন টায়ারের সিংহাসনে বসে রাজ্যশাসনের ভার নিজ হাতে তুলে নেন। তারা হেলিকেন্যাসকে আশ্বাস দিলেন যে তিনি সিংহাসনে বসলে সবাই তার আনুগত্য স্বীকার করে সৰ্ব্বতোভাবে সাহায্য করবেন তাঁকে।
কিন্তু সিংহাসনে বসতে মোটেই আগ্রহী নন হেলিকেন্যাস। তিনি সবিনয়ে সভাসদদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বললেন যারা রাজা পেরিরিকসকে সত্যিই ভালোবাসেন, তারা যেন দেশ এবং রাজার স্বার্থ রক্ষার জন্য অন্তত এক বছর ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করেন। যদি এই সময়ের মধ্যে রাজা পেরিক্লিস ফিরে না আসেন, তাহলে নিজের অনিচ্ছাসত্ত্বেও এই বয়সে রাজ্য শাসনের ভার নিজের হাতে তুলে নেবেন তিনি। সভাসদদের এটা পছন্দ না হলে তারা নিজেদের ইচ্ছেমতো একজনকে বেছে নিয়ে তার হাতে টায়ারের শাসনভার তুলে দিতে পারেন। তিনি তাদের এও বললেন তাদের প্রিয় রাজা পেরিক্লিস মারা গেছেন বলে যারা ধারণা করছেন, তেমন কোনও দুর্ঘটনার কথা জানা নেই তার।
হেলিকেনাসের কথা শেষ হতেই সভাসদরা একবাক্যে জানালেন তারা তার মত অনুযায়ী চলতে ইচ্ছক, তারাও তার মতো ভালোবাসেন রাজাকে। একথা জেনে হেলিকেন্যাস আশ্বস্ত হলেন যে তার উপর সভাসদদের আস্থা আগের মতেই অটুট আছে।
রাজা সাইমোনাইডিস বসে রয়েছেন তাঁর পেন্টাপলিসের রাজপ্ৰসাদে। তাঁর আমন্ত্রণে দেশ বিদেশ থেকে যে সব রাজা, রাজপুত্র আর নাইটরা এসেছেন, তারা সবাই জানেন তাদেরই একজনের সাথে রাজকুমারীর বিয়ে দেবেন। রাজা। হঠাৎ সে সময় রাজকুমারী থাইস। তাঁর বাবাকে চিঠি লিখে জানালেন যে বাবার পছন্দমতো কাউকে বিয়ে করা এ মুহূর্তে তাঁর পক্ষে সম্ভবপর নয়। এর পাশাপাশি থেইসা কাকে বিয়ে করতে চান সে কথাও জানিয়েছেন বাবাকে। মেয়ের লেখা চিঠিটা পেয়ে খুবই চিন্তিত হয়ে পড়েছেন রাজা।
সকালবেলা প্রাসাদে বসে মেয়ের লেখা চিঠিটা মন দিয়ে পড়ছিলেন রাজা, সেই সময় থেইসাকে বিয়ে করতে ইচ্ছক নাইটেরা এলেন রাজার কাছে তাদের দেখে চিঠি থেকে মুখ তুলে রাজা বললেন, মাননীয় নাইটগণ! আমি খুব দুঃখিত যে আমার মেয়ে থাইসা বিয়ের ব্যাপারে তার মত পালটিয়েছে। সে বলেছে আগামী এক বছরের মধ্যে সে কাউকে বিয়ে করতে পারবে না। আমি অনেক চেষ্টা করেও তার এই আকস্মিক পরিবর্তনের কারণ জানতে পারিনি?
নাইটদের মধ্যে একজন বললেন, আমরা কি একবার রাজকুমারীর সাথে দেখা করতে পারি?
গম্ভীর স্বরে রাজা সাইমোনাইডিস বললেন, আমি দুঃখিত মাননীয় নাইট, থেইসা তার নিজের মহলে নিজেকে এমন ভাবে আটকে রেখেছে যে কারও পক্ষে তার সাথে দেখা করা সম্ভব নয়। দেবী সিনথিয়ার নামে সে শপথ নিয়েছে ডায়নার মতো আগামী এক বছর কুমারী জীবন কাটাবে সে। দেহ মনের সমস্ত শক্তি দিয়ে এই শপথ পালন করবে সে।
রাজার কথা শুনে বিষন্ন মনে যে যার দেশে চলে গেলেন নাইটেরা। তারা সবাই চলে যাবার পর রাজা পুনরায় খুঁটিয়ে পড়তে লাগলেন মেয়ের চিঠিটা। চিঠির শেষে মেয়ে লিখেছে বিয়ে যদি করতেই হয় তাহলে টায়ার থেকে পেরিক্লিস নামে যে নাইট এসেছেন তাকেই বিয়ে করবেন তিনি। নইলে বাকি জীবন চোখে কালো কাপড় বেঁধে কাটাবেন যাতে সূর্যের আলো বা পর পুরুষের মুখ দেখতে না হয়।
তার পছন্দের মানুষটিকেই মেয়ে বিয়ে করতে চায় জেনে খুশি হলেন রাজা সাইমোনাইডিস। সত্যি কথা বলতে কী, গতরাতে তার নাচ-গান শুনে তিনি নিজেই পেরিক্লিসকে তার জামাতার আসনে বসিয়েছেন। থাইসা আর পেরিক্লিস যে একে অপরকে ভালোবাসে তা বুঝতে বাকি রইল না রাজার। তবুও তাদের ভালোবাসা যে কতটা খাঁটি তা যাচাই করে নিতে চাইলেন তিনি। এর ঠিক কিছুক্ষণ বাদেই সেখানে এসে হাজির হলেন পেরিক্লিস। রাজা প্রথমে তার নাচ-গানের প্রশংসা করে থাইসা সম্পর্কে তার অভিমত জানতে চাইলেন। থাইসার রূপ গুণ, দুয়েরই প্রশংসা করলেন পেরিক্লিস। তখন রাজা তাকে দেখালেন। থাইসার লেখা চিঠিটা।
চিঠিটা পড়ে খুবই আশ্চর্য হয়ে গেলেন পেরিক্লিস। এত সব নাইটদের ছেড়ে থাইসা যে কেন তাকে বিয়ে করতে পাগল হয়ে উঠেছে তা কিছুতেই বুঝতে পারলেন না তিনি। সেই সাথে তার মনে হল নিশ্চয়ই সাইমোনাইডিসের কুনজর পড়েছে তার উপর। তবুও চুপচাপ না থেকে তিনি খোলাখুলিভাবে রাজাকে জানালেন যে তিনি অন্তর থেকে শ্রদ্ধা করেন তার মেয়েকে। তাকে ভালোবাসার মতো দুঃসাহস তার নেই। রাজা বুঝতে পারলেন। থাইসার চিঠি পড়ে খুবই ঘাবড়ে গেছেন পেরিক্লিাস। তাকে আরও একটু যাচাই করে নেবার জন্য তিনি পেরিক্লিসকে শয়তান বলে অভিহিত করলেন। তিনি আরও বললেন ডাইনি বিদ্যার সাহায্যে সে তার মেয়েকে বশ করেছে। এর জবাবে ঈশ্বরের নামে শপথ নিয়ে পেরিক্লিস বললেন যে রাজার অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যে। এমন কোনও কাজ করেননি তিনি।
পেরিক্লিসের প্রতিবাদ সত্ত্বেও রাজা তাকে বিশ্বাসঘাতক বললেন। তিনি আরও বললেন নিজের সম্পর্কে যে যা কিছু বলেছে তা সর্বৈব মিথ্যে। রাজা তাকে বিশ্বাসঘাতক, মিথ্যেবাদী বলায় রাগে জুলে উঠলেন পেরিকিস। তিনি আরও বললেন সাইমোনাইডিস রাজা না হলে তিনি তাকে বাধ্য করতেন। ওইসব গালি-গালাজ ফিরিয়ে নিতে।
তাঁর উদ্দেশ্য সফল হয়েছে দেখে খুশি হলেন রাজা সাইমোনাইডিস। পেরিক্লিস যে সৎসাহসী তাতে কোনও সন্দেহ নেই তার। কিন্তু নিজের মনোভাব বাইরে প্রকাশ করলেন না তিনি। অনুচর পাঠিয়ে তিনি ডেকে আনলেন। থাইসাকে। মেয়ে সামনে এসে দাঁড়াতে তিনি তার মনোভাবও যাচাই করতে চাইলেন। তিনি মেয়েকে বললেন তার অমতে পেরিক্রিসের মতো একজন অচেনা অজানা বিদেশি যুবককে ভালোবেসে খুব অন্যায় করেছে সে। এজন্য তার প্রতি তিনি অসন্তুষ্ট হয়েছেন।
এভাবে পেরিক্লিসের সামনে বাবার বকুনি খেয়ে খুবই লজ্জা পেলেন থাইসা। তিনি চুপচাপ মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলেন। থাইস। থাইসার অবস্থা দেখে আর চুপ করে থাকতে পারলেন না পেরিক্লিস। তিনি থাইসাকে বললেন, তুমি একজন সুন্দরী গুণবতী নারী। কিন্তু তা সত্ত্বেও অমি তোমায় প্রকাশ্যে প্রেম নিবেদন করিনি। কেন তুমি এ কথাটা বাবাকে বুঝিয়ে বলতে পারছি না?
তার কথার জবাবে থাইস বললে, আপনি যদি আমাকে প্ৰেম নিবেদন করেও থাকেন এবং তার ফলে আমি যদি আনন্দ পেয়ে থাকি, তাতে অন্যায় বা দোষণীয় কী আছে?
থাইসার জবাব শুনে চমকে উঠলেন পেরিক্লিস। রাজা বুঝতে পারলেন তাঁর মেয়ে সত্যিই ভালোবাসে পেরিক্লিসকে। এ অবস্থায় তাদের বাধা দেওয়া বৃথা। ভেতরে ভেতরে খুব খুশি হলেও বাইরে রাগ দেখিয়ে বললেন রাজা, এবার বিয়ে দিয়ে তোমাদের মনের আশা পূর্ণ করব। বিয়েতে তোমরা রাজি আছ তো?
তাঁরা দুজনে একসাথে বললেন, আমরা রাজি আছি। এবার আপনি খুশি হলেই সব দিক পূর্ণ হয়।
রাজা সাইমোনাইডিস বললেন, আমি সত্যিই খুশি হয়েছি। এবার তাড়াতাড়ি তোমাদের বিয়েটা দিয়ে দিই। তোমরা সুখে-স্বচ্ছন্দে এ প্রাসাদে বাস কর।
রাজার উদ্যোগে অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই বিয়ে হল থাইসা আর পেরিক্লিসের। রাজার ইচ্ছায় তাঁরা প্রাসাদেই দাম্পত্য জীবন কাটাতে লাগলেন। পুরো একবছর না যেতেই গর্ভবতী হলেন থাইস।
পেরিক্রিসের নিজ রাজ্য টায়ারের অবস্থা কিন্তু ওদিকে ঘোরালো। এক ধরনের ক্ষোভ আর হতাশা জমাট বেঁধে উঠেছে রাজ্যের মন্ত্রী, সভাসদ আর অমাত্যদের মনে। রাজার দীর্ঘ অনুপস্থিতি আর তার কারণ জানতে চাইলে মন্ত্রী হেলিকেনাসের সদুত্তরের বদলে কেমন একটা গা-ছাড়া ভাব- এসব দেখে দেখে ক্ৰমেই তাদের সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। নানা রকম সন্দেহ জাগছে তাদের মনে। এভাবে কিছুদিন কাটাবার পর একদিন তাঁরা সবাই এসে হাজির হলেন হেলিকেনাসের কাছে। রাজা পেরিক্রিসের ব্যাপারে নানারূপ প্রশ্নে ব্যতিব্যস্ত করে তুললেন তাকে। তাদের সবারই এক কথা-রাজা পেরিক্রিসের খোজ না পাওয়া পর্যন্ত শাস্ত হবেন না তারা। তারা এও বললেন এভাবে রাজসিংহাসন শূন্য রেখে রাজ্যশাসন করাটা তাঁরা মেনে নিতে পারছেন না।
সভাসদদের মনোভাব বুঝতে পেরে হেলিকেন্যাস বললেন, আমি জানি আপনাদের ক্ষোভের সঙ্গত কারণ আছে! আপনারা জেনে রাখুন এবারে সময় হয়েছে তাকে ফিরিয়ে আনার। পৃথিবীর যে প্রান্তেই তিনি থাকুন না কেন, তাকে ফিরিয়ে এনে টায়ারের শূন্য সিংহাসনে বসানোই আমাদের প্ৰতিজ্ঞা। আপনারা এও জেনে রাখুন। যদি তাকে খুঁজে না পাওয়া যায়, তাহলে আপনারা নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করে যে কোনও সভাসদকে রাজসিংহাসনে বসাতে পারেন। হেলিকেনাসের আশ্বাস, পেয়ে তখনকার মতো চলে গেলেন মন্ত্রী ও সভাসদরা। তিনি বুঝতে পারলেন এবার আর অপেক্ষা করার সময় নেই। যে করেই হোক ফিরিয়ে আনতে হবে রাজা পেরিক্লিসকে। তিনি সবকিছু জানিয়ে একটা চিঠি লিখে দূত মারফত পেন্টাপোলিসে পাঠিয়ে দিলেন।
চিঠি নিয়ে টায়ারের দূত এসে উপস্থিত হলেন পেন্টাপোলিসের রাজপ্রাসাদে। রাজা সাইমোনাইডিসের সাথে দেখা করে তিনি তাকে বললেন যে তাদের প্রিয় রাজা পেরিক্লিসের জন্য তিনি কিছু বার্তা নিয়ে এসেছেন। সসম্মানে দূতকে বসতে বলে তিনি পেরিক্লিসকে খবর পাঠালেন রাজসভায় আসার জন্য। সে সময় পেরিক্লিস তখন অস্তঃপুরে তার স্ত্রী থাইসার সাথে কথা বলে সময় কাঁটাচ্ছিলেন। হেলিকেনাসের দূত এসেছেন শুনে তিনি চলে এলেন রাজসভায়। তাঁকে আসতে দেখে টায়ারের দূত তার নিজের আসন ছেড়ে উঠে তাকে যথারীতি অভিবাদন জানিয়ে
হেলিকেনাসের চিঠি পড়ে তিনি জানতে পারলেন রথের উপর বাজ পড়ে মারা গেছেন পাপিষ্ঠ রাজা অ্যান্টিওকাস আর তার মেয়ে। তিনি এও জানতে পারলেন তার দীর্ঘ অনুপস্থিতির দরুন হেলিকেনাসের শাসন আর মানতে চাইছে না। টায়ারের মন্ত্রী আর সভাসদরা এবং তার খোজ না পেলে হেলিকেন্যাস বাধ্য হবেন সভাসদদের কাউকে সিংহাসনে বসাতে। হেলিকে নাসের কথার উত্তরে পেরিক্লিাস তাকে জানিয়ে দিলেন শীঘ্রই তিনি টায়ারে ফিরে যাবেন। রাজা সাইমোনাইডিসকে অভিবাদন জানিয়ে পেরিক্লিসের চিঠি নিয়ে টায়ারের দূত ফিরে গেল তার নিজ রাজ্যে।
দূত চলে যাবার পর রাজা সাইমোনাইডিসকে সবকিছু জানিয়ে পেরিক্লিস বললেন রাজসিংহাসন এবং দেশের স্বার্থরক্ষার জন্য তার অবিলম্বে টায়ারে ফিরে যাওয়া প্রয়োজন। পেরিক্রিসের দুঃসময়ের অবসান হয়েছে জেনে সাইমোনাইডিস আর আপত্তি করলেন না। এমনকি থাইসা গর্ভবতী জেনেও তিনি তাকে যাবার অনুমতি দিলেন। পরদিন এক শুভ সময়ে পেরিক্রিসের সাথে জাহাজে চেপে টায়ার অভিমুখে রওনা হলেন থাইসা। রাজা সাইমোনাইডিসের নির্দেশে গর্ভবতী থাইসার দেখাশোনার জন্য তার সঙ্গী হল ধাত্রী লাইকোরিডা।
পেন্টাপোলিস বন্দর ছেড়ে সমুদ্রপথে যাত্রা করে একসময় পেরিক্লিসের জাহাজ এসে পৌছােল মাঝসমুদ্রে। খানিক বাদে ঈশান কোণে দেখা দিল একটুকরো ঘন কালো মেঘ। দেখেই গভীর হয়ে গেল মাঝিমাল্লাদের মুখ। দেখতে দেখতে সেই একটুকরো কালো মেঘ ছেয়ে ফেলল। সারা আকাশ। মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়ে গেল উজ্জ্বল সূর্য। শুরু হয়ে গেল প্রচণ্ড ঝড়-বৃষ্টি। এই প্রাকৃতিক গোলযোগের মধ্যেই জাহাজের কেবিনে থাইসা জন্ম দিলেন এক কন্যা-সন্তানের। মেয়েকে দেখাবার জন্য তাকে পেরিক্রিসের কাছে নিয়ে এলেন ধাত্রী লাইকোরিডা। আর তার কাছেই শুনলেন পেরিক্লিসএর কন্যার জন্ম দিতে গিয়ে মারা গেছেন, থাইসা। ধাত্রী জানালেন গর্ভবতী হবার পরই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন থাইসা। ঝড়ের দাপট আর জাহাজের বাকুনি সহ্য করতে পারেননি তিনি।
থাইসার মৃত্যু-সংবাদ শুনে কান্নায় ভেঙে পড়লেন পেরিক্লিস। তিনি মনে মনে ভাবলেন কেন যে ঈশ্বর তাকে থাইসার মতো একজন সুন্দরা গুণবতী স্ত্র দিয়ে আবার তাকে ফিরিয়ে নিলেন। — এ প্রশ্ন নিজেকে করলেন তিনি। এখন কেইবা স্তন্যপান করিয়ে এই ফুলের মতো শিশুটিকে বড়ো করে তুলবে? সমুদ্রে জন্মেছে বলে পেরিক্লিস মেয়ের নাম রাখলেন মেরিনা।
ওদিকে ঝড়ের দাপট কিন্তু তখনও সমানে চলছে। সে সময় দু-জন নাবিক এসে বলল জাহাজে মৃতদেহ থাকার দরুন প্রকৃতির আক্রোশ কমছে না। মৃতদেহ সমুদ্রে ফেলে দিলেই সমূদ্র আবার শান্ত হয়ে উঠবে। পেরিক্লিস তাদের বোঝাতে চাইলেন এ নিছক কুসংস্কার। জাহাজ ডাঙায় ভিড়লেই তিনি মৃতদেহ সমাধিস্থ করবেন। তিনি বললেন নাবিকেরা যেন ততক্ষণ পর্যন্ত ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করেন। কিন্তু তার অনুরোধে কোনও কাজ হল না।
দল বেঁধে নাবিকেরা বারবার এসে বলতে লাগল। মাঝসমুদ্রে ঝড় ওঠার পর যদি কোনও নাবিক বা যাত্রী মারা যায়, তাহলে তাকে সমূদ্রে ফেলে দেওয়াই প্রচলিত রীতি। তাদের বিশ্বাস রানির মৃতদেহ সমুদ্রে ফেলে দিলেই ঝড় থেমে যাবে।
পেরিক্লিস বুঝতে পারলেন হাজার চেষ্টা করেও তিনি এদের বোঝাতে পারবেন না। তার চোখের সামনেই প্রিয়তমা স্ত্রীর মৃতদেহ এরা সমুদ্রে ফেলে দেবে আর হিংস্র হাঙ্গর এসে তাটুকরো টুকরো করে তাকে খাবে। তিনি আক্ষেপ করে বলতে লাগলেন, হায় ঈশ্বর! স্ত্রীর মৃতদেহ সমাধিস্থ করার মতো জায়গািটুকুও তুমি আমায় দিলে না? শেষমেশ অনেক কষ্টে নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে স্ত্রীর মৃতদেহসমুদ্রে ফেলে দেবার আদেশ দিলেন নাবিকদের। তারা একটা বড়ো বাক্স নিয়ে এসে তার ভেতর সুন্দর করে বিছানা পেড়ে গুইয়ে দিল থাইসার মৃতদেহ। ধাত্রী লাইকোরিডা সুগন্ধী ছিটিয়ে দিল বাক্সর ভেতর। এরপর পুরু কৰ্ক দিয়ে বাক্সের মুখটা এটে নাবিকেরা সেটা ফেলে দিল উত্তাল সমুদ্রের জলে। তা দেখে কান্নায় ভেঙে পড়লেন পেরিক্লিস। এ দৃশ্য সইতে না পেরে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন তিনি।
সত্যি সত্যিই মৃতদেহ জলে ফেলে দেবার পর শান্ত হয়ে গেল সমুদ্র। নাবিকদের কাছে তিনি জানতে পারলেন জাহাজ এসে পৌঁছেছে। থার্সাসের উপকূলে। থার্সাসের নাম শুনে উৎসাহিত হয় উঠলেন পেরিক্লিস। তিনি স্থির করলেন। থার্সাসের শাসক ক্লিওনের উপর তিনি মেয়ে মেরিনার লালন-পালনের ভার দিয়ে যাবেন। এতদিন বাদে উপকারী বন্ধুকে দেখে খুব খুশি হলেন ক্লিওন আর তার স্ত্রী ডাইওনিজা। সেই সাথে তারা চরম দুঃখ পেলেন যখন পেরিক্লিসের কাছে শুনলেন তার স্ত্রী থাইসা মারা গেছেন। জন্ম-মৃত্যু সবই বিধির বিধান। কারও হাত নেই তাতে। তারা পেরিক্লিসকে বোঝালেন যা ঘটেছে তা মেনে নিতে। তখন একমাত্র কাজ শিশুকন্যা মেরিনাকে বড়ো করে তোলা। তখন পেরিক্লিস বললেন বহুদিন বাদে দেশে ফিরে যাচ্ছেন তিনি। রাজ্য পরিচালনার পাশাপাশি মেয়ের প্রতি নজর রাখা তীর পক্ষে সম্ভব হবে না। তিনি মেয়েকে বড়ো করার ভার দিতে চান ক্লিওন আর তার স্ত্রী ডাইওনিজার হাতে।
এ কথা শুনে পেরিক্লিসকে আশ্বাস দিয়ে ক্লিওন বলে উঠলেন, এতো খুব আনন্দের কথা। অল্প কিছুদিন আগে আমার স্ত্রী ডাইওনিজও একটি কন্যাসন্তানের জন্ম দিয়েছে। আমরা তার নাম রেখেছি ফিলোটিনা। আপনার মেয়ের সমবয়সি। আমাদের কাছে মেরিনা থাকলে যেমন মাতৃস্নেহ পাবে তেমনি পাবে বোনের স্নেহ-ভালোবাসা। নিজের মেয়ের মতো একই রকম শিক্ষা দিয়ে আমরা তাকে বড়ো করে তুলব। এখন মেরিনা আমাদের কাছেই থাকি; একটু বড়ো হলে না হয়। আপনি ওকে নিয়ে যাবেন। আশা করি ততদিনে ওর লেখা-পড়া, নাচ-গান, কলাবিদ্যা শেখা অনেকটাই এগিয়ে থাকবে। আমার স্ত্রী কাছে থাকলে মাতৃহারা মেরিনা তার মায়ের অভাবও বোধ করবে না। মেয়েকে আমাদের হাতে সঁপে দিয়ে আপনি নিশ্চিন্ত মনে টায়ারে ফিরে যান পেরিক্লিাস। সেখানে আপনার অপেক্ষায় রয়েছে সবাই।
ক্লিওনের কথা শুনে আশ্বস্ত হলেন পেরিক্লিস। তিনি মেরিনাকে ক্লিওন এবং তার স্ত্রীর হাতে সঁপে দিয়ে নিশ্চিন্ত মনে টায়ারে ফিরে গেলেন। ধাত্রী লাইকোরিডা কোনওমতেই রাজি হল না। মেরিনাকে ছেড়ে থাকতে। সেও রয়ে গেল থার্সাসে।
ওদিকে সত্যি সত্যি থাইসা কিন্তু মারা ধাননি। আসলে প্রসবের পর তিনি দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন। তার উপর প্রচণ্ড ঝড়ের তাণ্ডব তার ঘন ঘন বাজ পড়ার আওয়াজ শুনে তিনি মানসিক স্থিতি হারিয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়েন। অনেকক্ষণ ধরে অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকার দরুন মাঝি-মাল্লারা ধরে নিয়েছিল তিনি মারা গেছেন। তাই সমুদ্রের রীতি অনুযায়ী তারা তাকে বাক্সে পুরে সমুদ্রের জলে ফেলে দেয়। অনেকক্ষণ ধরে জলের মধ্যে থাকার পর শেষ রাতের দিকে তার অচেতন অবস্থা কেটে যায়, স্বাভাবিক মানুষের মতোই ঘুমোতে থাকেন তিনি। ঘুমন্ত থাইসাকে নিয়ে ভাসতে ভাসতে সেই কাঠের বাক্সটি এসে ঠেকল এফিসাসের উপকূলে। শেষ রাতে স্থানীয় কিছু জেলে মাছ ধরতে গিয়েছিল সমুদ্রে। বাক্সটিকে জলে ভাসতে দেখে তারা সেটিকে তুলে নেয় নৌকায়। কৌতূহলের বশে বাক্সের ঢাকনা খুলে দেখতে পায় থাইসাকে। তার নাকের কাছে হাত নিয়ে দেখে স্বাভাবিক শ্বাস বইছে। উপকূলের খুবু কাছে থাকেন সেরিমন নামে রাজসভার এক জ্ঞানী সভাসদ। তিনি খুবই পরোপকারী। কারও অসুখ-বিসুখ হলে লোক-জন তার কাছেই ছুটে আসে। তিনিও সাধ্যমতো চিকিৎসা করে তাদের সুস্থ করে তোলেন। জেলেরা কাঠের বাক্সটি নিয়ে এল। তার কাছে। সেরিমন বাক্সের ঢাকনাটি খুলে থাইসকে বের করে বিছানার উপর শুইয়ে দিলেন। থাইসার পরনে মৃতদেহ সমাধিস্থ হবার পোশাক আর বাক্সের ভেতর নানারূপ সুগন্ধী শেকড়-বাকড় দেখে সেরিমন অনুমান করলেন যুবতিটি নিশ্চয়ই জাহাজে চেপে কোথাও যাচ্ছিলেন। কোনও কারণে সে পথিমধ্যে অসুস্থ হয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। বহুক্ষণ জ্ঞান ফিরে না। আশায় সমুদ্রের রীতি অনুযায়ী মাঝি-মাল্লারা তার দেহে সমাধি দেবার পোশাক পরিয়ে বাক্সে পুরে জলে ফেলে দেয়। বাক্সের ভিতর একটি কৌটো দেখে কৌতূহলী হয়ে সেরিমন সেটা খুলে দেখলেন তাতে রয়েছে একটা গোটানো কাগজ আর হিরের আংটি। কাগজটা খুলে দেখলেন তাতে গোটা গোটা অক্ষরে চিঠির মতো কী যেন একটা লেখা রয়েছে। কাগজটা চোখের সামনে নিয়ে সেরিমন সেটা পড়তে লাগলেন। তাতে লেখা রয়েছে —এই মৃতদেহটি যার চোখে পড়বে সেই ব্যক্তির উদ্দেশে আমিটায়ারের রাজা পেরিক্লিস জানাচ্ছি যে মৃতদেহটি আমার স্ত্রী রানি থাইসার। সমুদ্রযাত্রার সময় প্রচণ্ড ঝড়-বৃষ্টির দরুন তার মৃত্যু হয়েছে। সমুদ্রের রীতি অনুযায়ী মাঝি-মাল্লারা তার দেহ বাক্সে পুরে জলে ফেলে দেয়। কৌটোর ভিতর একটি হিরের আংটি রয়েছে। যিনি এই মৃতদেহটি পাবেন তাঁর কাছে অনুরোধ তিনি যেন আংটিটি বেচে সেই অর্থ দিয়ে রানিকে সমাধিস্থ করার ব্যবস্থা করেন…।
চিকিৎসাশাস্ত্র নিয়ে চর্চা করার দরুন দ্রব্যগুণ সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান আছে সেরিমনের। তার সেবা-যত্নে একসময় সুস্থ বোধ করে চোখ মেলে তাকালেন থাইসা। সেরিমনের দেওয়া ওষুধ খেয়ে অল্প সময়ের মধ্যেই সুস্থ হয়ে উঠলেন। থাইস। পেরিক্লিসের লেখা চিঠি এবং হিরের আংটিটা থাইসাকে দেখিয়ে সেরিমন বললেন, এই চিঠিটা পড়ে আপনার পরিচয় জেনেছি। আমি। পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠতে হলে আরও কিছুদিন আমার এখানে থেকে আপনাকে বিশ্রাম নিতে হবে। কাজেই আপনি ভাবনা-চিন্তা সব ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্তে বিশ্রাম নিন। আপনি এখন এফিসাসে রয়েছেন। আমার নাম সেরিমন। আমি এখানকার রাজার একজন সভাসদ। চিকিৎসাশাস্ত্রে আমার যা সামান্য জ্ঞান আছে, আশা করি তা দিয়ে আপনাকে সুস্থ করে তুলতে পারব। আমার অনুরোধ, পুরোপুরি সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত আপনি আমার এখানেই থাকুন।
হিরের আংটিটি সেরিমনকে দেখিয়ে থাইসা বললেন, আপনারা মতো মহৎ ব্যক্তির মুখেই এ কথা শোভা পায়। বিয়ের কিছুদিন বাদে আমি স্বামীর সাথে জাহাজে চেপে তাঁর রাজ্যে যাচ্ছিলাম। মাঝপথে প্রচণ্ড ঝড়-বৃষ্টি শুরু হয়। সেই ঝড়ের মাঝেই আমার কন্যাসন্তান জন্ম নেয়। তারপরআমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। আমার শুধু এটুকুই মনে আছে। জ্ঞান ফিরে আসতেই দেখি আমি আপনার বাড়িতে শুয়ে আছি। জামা-কাপড় সব জলে ভেজা। এখন স্বামীর চিঠি পড়ে বুঝতে পারছি আমাকে মৃত ভেবে মাঝি-মাল্লারা আমার দেহটি বাক্সে পুরে সমুদ্রের জলে ফেলে দেয়। ঈশ্বরের দয়ায় প্ৰাণে বেঁচে আমি আপনার আশ্ৰয় পেয়েছি। আমি জানি না। স্বামী-কন্যার কী দশা হয়েছে। ঝড়-জলের হাত থেকে আমার স্বামী ও সদ্যোজাত কন্যাটি রক্ষা পেয়েছে কিনা জানি না। এখন আপনিই বলুন মহাত্মা সেরিমন, এভাবে বেঁচে থেকে কী লাভ? কীভাবে দিন কটাব আমি? বেশ বুঝতে পারছি চোখের জল আর দীর্ঘশ্বাসই এখন আমার একমাত্র সম্বল।
তাকে সাস্তুনা দিয়ে সেরিমন বললেন, আপনার মানসিক অবস্থা আমি বেশ বুঝতে পারছি রানি থাইসা। কিন্তু ঈশ্বরের উপর তো কারও হাত নেই। কাছেই ডায়ানা দেবীর মন্দির রয়েছে। আপনার মন চাইলে আপনি দেবীর আরাধনা করে দিন কাটিয়ে দিতে পারেন। দিন-রাত সাধনভজনে মেতে থাকলে আপনার মন শান্ত হবে। সেখানে আমার ভাইঝি। আপনার দেখাশোনা করবে।
থেরিসা বললেন, সেরিমন! আস্তরিক ধন্যবাদ ছাড়া আপনাকে আর কিছু দেবার নেই আমার। আপনার প্রতি আমার যে শুভেচ্ছা রইল তা এই সামান্য প্রতিদানের চেয়ে অনেক বড়ো। আমি দেবী ডায়ানার মন্দিরে গিয়ে বাকি জীবনটা তার আরাধনা করেই কাটিয়ে দেব।
সেরিমনের অনুরোধে কিছুদিন তার বাড়িতে থেকে ওষুধ-পত্র খেয়ে পূর্ণ বিশ্রাম নিলেন রানি থাইসা। তারপর একদিন পুরোপুরি সুস্থ হয়ে সেরিমনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে দেবী ডায়ানার মন্দিরের উদ্দেশে রওনা দিলেন রানি। তাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল সেরিমনের ভাইঝি।
টায়ার বন্দরে এসে নোঙ্গর করল পেরিক্রিসের জাহাজ। সংবাদ পেয়ে অমাত্য আর সভাসদদের নিয়ে জাহাজ ঘাটে এলেন হেলিকেন্যাস। রাজকীয় সংবর্ধনা জানিয়ে তাঁরা রাজপ্রাসাদে নিয়ে এলেন পেরিক্লিসকে। এতদিন বাদে রাজাকে ফিরে পেয়ে আনন্দে মেতে উঠল প্ৰজারা। তারা এই জেনে নিশ্চিন্ত হল যে, সিংহাসন আর খালি থাকবে না। সবার মাঝে ফিরে আসতে পেরে পেরিক্লিসও খুশি হলেন। সিংহাসনে বসে তিনি আগের মতোই মনোযোগ দিয়ে রাজকাৰ্য পরিচালনায় মগ্ন হলেন। কিন্তু এরই মাঝে যখন স্ত্রী-কন্যার মুখ মনে পড়ে, তখন আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারেন না পেরিক্লিস। কাজ-কর্ম সব ছেড়ে চোখের জল সামলে নিয়ে চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন তিনি। পেরিক্লিস তখনও জানে না যে তার স্ত্রী থাইসা এখনও বেঁচে আছেন-দেবী ডায়ানার আরাধনা করে তিনি তার মন্দিরে দিন কাটান। ওদিকে থার্সাসের শাসক ক্লিওনের মেয়ে ফিলোটিনার সাথে একই ভাবে বড়ো হচ্ছে পেরিক্রিসের মেয়ে মেরিনা। দিনে দিনে শুক্লপক্ষের চাদের মতো বেড়ে উঠতে লাগল মেরিনা। যদিও ফিলোটিনা আর মেরিনা একই বয়সি, কিন্তু রূপ-গুণ কোনও দিক থেকেই মেরিনার পাশে দাঁড়াবার যোগ্য নয় ফিলোটিনা। একই সাথে নাচ-গান, শিল্প-কলা শেখে দুজনে, তবুও মেধার জোরে সবকিছুতেই ফিলোটিনাকে ছাপিয়ে যায় মেরিনা।
তাদের দু-জনের স্বভাবও আলাদা। থার্সাসের শাসকের তত্ত্বাবধানে বড়ো হলেও মেরিনার মনে কোনও অহংকার নেই। ছোটো-বড়ো, উচু-নিচু সবাই তার চোখে সমান। সে সহজভাবে তাদের সাথে মেলামেশা করে, চেষ্টা করে সবার মন জয় করার। সে খুবই বিনম্র। এর ফলে দেশের মানুষ ফিলোটিনার চেয়ে মেরিনার প্রশংসাই বেশি করে করতে লাগল। ফিলোটিনাকে হারিয়ে দিচ্ছে — ব্যাপারটা ক্লিওনের নজরে না এলেও তার স্ত্রী ডায়োনিজা কিন্তু সহজে ব্যাপারটা মেনে নিতে পারলেন না।
রূপ-গুণ, স্বভাব-চরিত্র সব দিক দিয়েই ফিলোটিনার চেয়ে অনেক উন্নত মেরিনা। তাই যতদিন সে তাদের আশ্রয়ে থাকবে, ততদিন ফিলোটিন আর দাঁড়াতে পারবে না মেরিনার পাশে। এ কথাটা বুঝতে পেরে হিংসায় জুলে উঠলেন ডায়োনিজা। শেষে পথের কঁটা দূর করতে এক গুপ্তঘাতককে দিয়ে মেরিনাকে হত্যার ব্যবস্থা করলেন ডায়োনিজা। অনেক টাকার বিনিময়ে লিওনাইন নামে এক গুপ্ত ঘাতক রাজি হল মেরিনাকে হত্যা করতে। ডায়োনিজা তাকে নির্দেশ দিলেন যে যেন সবার অলক্ষ্যে মেরিনাকে সাগরতীরে নিয়ে গিয়ে তাকে খুন করে মৃতদেহের গলায় পাথর বেঁধে যেন তাকে সমুদ্রে ফেলে দেয়। মেরিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে সবার অলক্ষে তাকে সমুদ্রতীরে নিয়ে এল লিওনাইন। খুন করার আগে সে মেরিনাকে বলল শেষবারের মতো প্রার্থনা করতে। তার কথা শুনে মেরিনা বুঝতে পারল তাকে হত্যা করার জন্যই লোকটিকে নিয়োগ করা হয়েছে। মেরিনার প্রশ্নের জবাবে সে কথা স্বীকার করল লিওনাইন। মেরিনা শুনে অবাক হয়ে গেল। যখন সে জানল যে ডায়োনিজা ছােটোবেলা থেকে মাতৃস্নেহে তাকে মানুষ করেছেন তাকে, তিনিই আবার লিওনাইনকে নিয়োগ করেছেন তাকে হত্যা করতে। লিওনাইনের কাছে প্ৰাণভিক্ষা চাইল মেরিনা। ঠিক সে সময় একদল জলদসু্য এসে হাজির সেখানে। লিওনাইন যখন মেরিনাকে হত্যা করার জন্য তৈরি হচ্ছে, সে সময় তারা জোর করে মেরিনাকে তাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে চেপে বসল জাহাজে। জাহাজে ওঠার সাথে সাথে পাল তুলে ছেড়ে দিল জাহাজ। জলদসু্যরা কিন্তু মেরিনাকে বাঁচাবার উদ্দেশ্যে আসেনি। তাদের কয়েকজন যখন ডাঙায় ঘুরে বেড়াচ্ছিল, সে সময় তাদের চোখে পড়ে মেরিনাকে। তখনই তারা সিদ্ধান্ত নেয় ক্ৰীতদাসী হিসেবে একে বেচিতে পারলে বাজারে চড়া দাম মিলবে।
জলদস্যুদের সর্দার কিন্তু দাসবাজারের বদলে চড়া দামে মেরিনাকে বেচে দিল মিটিলেনের এক পতিতালয়ে। ও সবজায়গায় যে সব নতুন মেয়ে আসে, খন্দেরের মনোরঞ্জনের জন্য সেখানকার যে বয়স্ক পতিতা তাদের ছলা-কলা আর আদব-কায়দা শেখায়, সবাই তাকে মাসি বলেই ডাকে। সেরূপ এক মাসিও রয়েছে মিটিলেনের পতিতালয়ে। মেরিনাকে খদ্দেরের মনোরঞ্জন করার কায়দা-কানুন শেখাতে তার পিছনে উঠে-পড়ে লাগল সেই মাসি। ততদিনে মেরিনা বুঝতে পেরেছে সে এক নরক থেকে অন্য এক নরকে এসে পড়েছে। সুন্দর, সুখী জীবনের লোভ দেখানো সত্বেও সে কিছুতেই রাজি হয়না পতিতাবৃত্তি গ্রহণ করতে। এমন কি চাবুক মারার ভয় দেখিয়েও বাধ্য করা যায় না। তাকে। মেয়েটি যে এমন অবাধ্য হবে তা স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি পতিতালয়ের মালিক এবং মাসি। তারা ভাবতে লাগলেন। কীভাবে মেয়েটিকে সর্বতোভাবে পতিতা করে গড়ে তোলা যায়। ওদিকে দালালদের মারফত মেরিনার রূপের কথা অনেক খন্দেরের কানেই পৌঁছেছে। তার দেহের স্বাদ পেতে অনেকেই পাগল হয়ে উঠেছে। ইচ্ছে করেই মেরিনাকে শুনিয়ে শুনিয়ে এ কথা বলাবলি করল মাসি আর দালাল। দালাল এও বলল রাতের বেলায় কোনও না কোনও খদের আনবে মেরিনার কাছে। তবুও মেরিনা তার সিদ্ধান্তে অটল – জুলন্ত আগুন, উদ্যত ছুরি কিংবা সমুদ্রের জল, এরা যদি একসাথে মিলেমিশে আমায় মেরে ফেলার ভয় দেখায় — তাতেও ভয় না পেয়ে আমি নিজের সতীত্ব রক্ষা করে যাব। এ কাজে দেবী ডায়ানা আমার সহায় হবেন।
ওদিকে মেরিনা অকস্মাৎ নিখোঁজ হয়ে যাওয়ায় মহা ফাপরে পড়েছেন থার্সাসের শাসক ক্লিওন। অনেক খোঁজাখুঁজি সত্ত্বেও মেরিনার হদিশ পায়নি তার লোকেরা। এ অবস্থায় কী যে করবেন তা ভেবে পাচ্ছেন না ক্লিওন। এমন সময় একজন অনুচর মারফত জানতে পারলেন কিছুদিন ধরেই ডায়োনিজা নাকি গুপ্তঘাতকের সাহায্যে মেরিনাকে হত্যা করার চক্রান্ত করেছেন। পেশাদার গুপ্তঘাতক লিওনাইনের সাথে তাকে বহুবার প্রাসাদের বাইরে কথা বলতে দেখা গেছে।
এ কথা শুনে আক্ষেপ করে বললেন ক্লিওন, এ তুমি কী করলে ডায়োনিজা! এখন আমি কোথায় খুঁজে পাব মেরিনাকে?
ক্লিওনের বিশ্বস্ত চর যে তার সাথে কথা বলছে তা দেখতে পেয়েছেন ডায়োনিজা! ক্লিওনের আক্ষেপ শুনে তিনি দ্রুত সেখানে এসে বললেন, কী সব যা তা বলছ! যা গেছে তা কি আর ফিরে আসে? জেনে রােখ, মেরিনার রূপের দৌলতে কেউ মুখ ফিরে তাকাত না আমাদের মেয়ের দিকে। সবাই শুধু মেরিনার রূপ-গুণের প্রশংসা করত। মেয়ের স্বার্থেই আমি এ কাজ করেছি।
অসহায়ভাবে ক্লিওন বললেন, কিন্তু এর পরিণাম কী হতে পারে তা কখনও ভেবেছ? পেরিক্লিস তার মেয়েকে দেখতে চাইলে কী বলবে তাকে?
বলব, রোগে ভুগে কদিন আগে মারা গেছে মেরিনা, জবাব দিলেন ডায়োনিজ, আগে ভাগেই মেরিনার নামে একটা স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করে রাখবে। পেরিক্লিস মেয়েকে দেখতে এলে তুমি কাঁদতে কাঁদিতে তারই সামনে স্মৃতিস্তম্ভে ফুল দেবে। অবশ্য তার আগে মেরিনার গুণের প্রশংসা খোদাই করিয়ে রাখবে ওই স্তম্ভের গায়ে।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে ক্লিওন বললেন, সুন্দর হয়েও তুমি যে এত ফেরেববাজ, স্বার্থপর আর নিষ্ঠুর হতে পার তা আগে জানা ছিল না। আমার।
মুখে স্ত্রীকে গালাগালি দিলেও শেষপর্যন্ত কিন্তু স্ত্রীর প্রস্তাবকেই মেনে নিতে হল ক্লিওনকে। সমুদ্রের ধারে মেরিনার সমাধি গড়ে তাতে একটা সুন্দর স্তম্ভ গড়ালেন তিনি। শিল্পীদের দিয়ে মেরিনার প্রশংসাসূচক অনেক সুন্দর সুন্দর কথা খোদাই করালেন সেই স্তম্ভের গায়ে।
এদিকে বহুদিন মেয়ের খোঁজ-খবর না পেয়ে খুবই চঞ্চল হয়ে উঠেছেন রাজা পেরিক্লিস। ক্লিওনকে অনেক চিঠি দিয়েও কোনওটির উত্তর পেলেন না। শেষমেশ স্থির করলেন তিনি নিজেই মেয়েকে দেখে আসবেন।
একদিন মন্ত্রী হেলিকেন্যাসকে সাথে নিয়ে তিনি এসে হাজির হলেন থার্সাসে। সে খবর পেয়ে স্ত্রী ডায়োনিজকে সাথে নিয়ে ক্লিওন এলেন জাহাজঘাটে। জাহাজ থেকে পেরিক্লিস নেমে আসতেই স্ত্রীর শেখানো মতো ক্লিওন কাঁদিতে কাঁদিতে পেরিক্লিসকে জানালেন তার মেয়ে মেরিনার মৃত্যুর কথা। মেরিনা। আর বেঁচে নেই জেনে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন পেরিক্লিস। মৃত স্ত্রী থাইসার একমাত্র সন্তানকে বুকে ধরে তিনি স্ত্রী-শোক ভুলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু নিষ্ঠুর বিধাতার তা সহ্য হল না। তিনি তাকেও অকালে কেড়ে নিলেন। শোকে যেন পাথর হয়ে গেলেন পেরিক্লিস। বলার মতো কোনও কিছু খুঁজে পেলেন না তিনি।
ঠিক এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন ডায়োনিজা। মেয়ের শোকে পেরিক্লিসকে বিতুল অবস্থায় দেখে এখন কী করতে হবে সে ব্যাপারে চাপা গলায় প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিলেন স্বামীকে। ক্লিওন তাকে নিয়ে গেলেন সমুদ্রতীরে নির্মিত মেরিনার সমাধিস্থানে — সেখানে তার ভূয়সী প্রশংসা করলেন। আগে থেকেই সাথে করে কিছু সাদা ফুল নিয়ে এসেছিলেন ডায়োনিজা। সেই ফুল স্ত্রীর হাত থেকে স্মৃতিস্তম্ভের গোড়ায় ছড়িয়ে দিলেন ক্লিওন। তা দেখে পেরিক্লিসও সেখানে কিছু ফুল ছিটিয়ে দিলেন। তারপর কাঁদতে কাঁদিতে ক্লিওনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে মন্ত্রী হেলিকেন্যাসকে সাথে নিয়ে জাহাজে চেপেটায়ারে ফিরে গেলেন পেরিকিস।
ওদিকে মোটা টাকা দিয়ে মেরিনাকে কিনে নেবার পর থেকেই বেজায় মুশকিলে পড়ে গেছেন পতিতালয়ের মালিক। দালালদের মুখ থেকে মেরিনার রূপ-যৌবনের নানা কথা শুনে সেখানকার খরিদাররা রোজই আসছে তার সাথে রাত কাটাতে। কিন্তু মেরিনা তার সংকল্পে অটল। রাত কাটানো তো দূরে থাক, সে কাউকে তার দেহও ছুতে দিতে রাজি নয়। যে খদের আসে মেরিনা তাকেই ধর্মোপদেশ দেয়, চরিত্র সংশোধন করতে বলে। ফলস্বরূপ খদোররা এসেও মুখ কালো করে বাড়ি ফিরে যায়। কিছুতেই মেরিনাকে বাগ মানাতে না পেরে অনেক খদের পতিতালয়ে আসই ছেড়ে দিল। এসব দেখে-শুনে মেরিনার উপর বেজায় রেগে গেল পতিতালয়ের মালিক। সে নিজে ছিল যৌনরোগে আক্রান্ত। সে মতলব করল জোর করে মেরিনার সতীত্ব নষ্ট করে ওই কুৎসিত রোগের বীজ সে তার দেহে ঢুকিয়ে দেবে।
একদিন নতুন নারীর খোজে। সেই পতিতালয়ে এলেন মিটিলেনের শাসক লাইসিমেকাস। তাকে দেখে ব্যস্ত হয়ে উঠল। পতিতালয়ের সবাই। দালাল মেরিনাকে নিয়ে এল। তার ঘরে। তাদের সাথে মাসিও এল; ইশারায় লাইসিমেকাসকে দেখিয়ে মাসি মেরিনাকে বলল, ইনি হলেন এই রাজ্যের শাসক। অসীম ক্ষমতা ওর। ইচ্ছে করলেই উনি যা খুশি তাই করতে পারেন। তুমি যদি ওকে খুশি করতে পার তাহলে আর ভাবতে হবে না তোমায়, সোনা-রূপা, হিরে-জহরত দিয়ে উনি তোমার সারা গা মুড়িয়ে দেবেন।
মাসির কথার অর্থ বুঝতে পারল মেরিনা। তবুও সে নিজের জেদ বজায় রেখে বলল, উনি ভালোবেসে আমায় কিছু দিতে চাইলে আমি তা শ্রদ্ধার সাথে নিতে রাজি আছি।
ও দিকে লাইসিমেকাস অধৈৰ্য হয়ে মেরিনার উদ্দেশে গলা চড়িয়ে বললেন, কী গো মেয়ে! তোমাদের কথা-বার্তা শেষ হল! আমি আর কতক্ষণ এখানে একা একা বসে থাকব?
তার কথা শুনে মাসি ছুটে এসে লাইসিমেকাসকে সেলাম জানিয়ে বলল, হুজুর! কিছু মনে করবেন না। আপনি। এই মেয়েটা এখনও আনকোরাই রয়ে গেছে। অনেক চেষ্টা করেও আমরা ওকে বাগ মানাতে পারিনি। তবে হুজুর যখন এসে গেছেন তখন আর চিন্তা নেই, আপনি ঠিক ওকে পােষ মানাতে পারবেন? — বলে মেরিনার হাত ধরে টানতে টানতে তাকে ঢুকিয়ে দিল লাইসিমেকাসের ঘরে। তারপর দালালকে সাথে নিয়ে অন্যদিকে চলে গেল মাসি। জীবনে বহু মেয়ে ঘেটেছেন লাইসিমেকাস। তিনি দেখেছেন তার ক্ষমতার পরিচয় পাবার পর সব মেয়েরই চোেখ-মুখের ভাবভঙ্গি পালটে যায়। তারা সবাই আপ্ৰাণ চেষ্টা করে তাকে খুশি করতে। কিন্তু এ মেয়েটা তাদের মতো নয় — এ সম্পূর্ণ বিপরীত। শিরদাঁড়া সোজা করে এমনভাবে সে তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে যে দেখে মনে হচ্ছে তাকে খুশি করার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই এর। সেই সাথে ওর চোখের চাউনি কেমন নম্র আর বিনত, ঔদ্ধত্যের বিন্দুমাত্র চিহ্ন নেই তাতে। মেয়েটিকে খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে কৌতূহল বেড়ে গেল। লাইসিমেকাসের। এক সময় তিনি মুখ ফুটে বলেই ফেললেন, কী নাম তোমার?
আমার নাম মেরিনা বলল সে।
মেরিনা! বেশ ভালো নাম, বললে লাইসিমেকাস, এখন বল -তে কতদিন ধরে তুমি এ ব্যবসায় রয়েছ?
ব্যবসা? কীসের ব্যবসার কথা বলছেন। আপনি? থতমত খেয়ে বলল মেরিনা।
তুমিই বল! সে কথা কি আমি নিজের মুখে বলতে পারি! বললেন লাইসিমেকাস।
মিনতি জানিয়ে মেরিনা বলল, দোহাই আপনার! দয়া করে বলুন কোন ব্যবসার কথা বলছেন আপনি?
লাইসিমেকাস জানতে চাইলেন, কিতদিন হল এ ব্যবসায় এসেছ তুমি?
মেরিনা জবাব দিলে, যতদিনের কথা আমার মনে আছে ততদিন এসেছি এ ব্যবসায়।
তার দিকে তাকিয়ে লাইসিমেকাস বললেন, তাহলে আমায় ধরে নিতে হবে খুব অল্পবয়সেই এ ব্যবসায় এসেছ তুমি। ধর তোমার বয়স তখন পাঁচ-সাত।
যদি সত্যি সত্যিই আমি এ ব্যবসায় এসে থাকি তাহলে আমার বয়স তখন আরও কম, জবাব দিল মেরিনা।
তখন লাইসিমেকাস বললেন, তুমি জান এ বাড়ির সবাই তোমাকে বিক্রির মাল বলে ভাবে?
লাইসিমেকাসের দিকে তাকিয়ে মেরিনা বলল, জায়গাটা যদি ততই খারাপ তাহলে কেন এখানে আসেন। আপনি? আপনি তো এখানকার শাসক, মান্যগণ্য লোক। অসীম ক্ষমতা আপনার হাতে।
আমার কথা কে বলল তোমায়? নিশ্চয়ই তোমার গুরুঠাকুরানি, জানতে চাইলেন। লাইসিমেকাস।
অবাক হয়ে মেরিনা বলল, গুরুঠাকুরানি! সে আবার কে?
লাইসিমেকাস বললেন, আরে ওই মেয়েটা যে তোমায় ছলা-কলা কায়দা-কানুন শেখায়, সে তোমায় খানিক আগে এখানে পৌঁছে দিয়ে গেল। বেশ বুঝতে পারছি আমার পরিচয় আর ক্ষমতার কথা শুনে তুমি আমার মুখ থেকে আরও বেশি করে প্ৰেম-পিরিাতের কথা শুনতে চাইছ। নাও, এবার আমায় নিরিবিলি জায়গায় নিয়ে চল।
গম্ভীর স্বরে মেরিনা বলল, আপনি যদি সত্যিই সদ্বংশের সন্তান হয়ে থাকেন তবে তার প্রমাণ দিন। আপনি এখানকার শাসক। আপনার কাছে আমি বিচারপ্রার্থী। আশা করি আপনার বংশ আর পদমর্যাদার উপযুক্ত বিচার করবেন। আপনি ৷
মেরিনার কথা শুনে বেজায় অস্বস্তির মধ্যে পড়ে গেলেন লাইসিমেকাস। তিনি বললেন, এ সব কী বলছি তুমি? এক রাতের স্ফুর্তি লুটতে এসে এ তো ভালো বিড়ম্বনায় পড়া গেল দেখছি! যাই হোক, তুমি শাস্ত হও মেরিনা। তুমি অন্য কিছু চাও।
মেরিনা বলল, তাহলে জেনে রাখুন। আপনি, আমি এক কুমারী মেয়ে যে ভাগ্যের কোপে পড়ে বাধ্য হয়েছে এখানে আসতে। এই বাড়িটার কথাই কিছুক্ষণ আগে আপনি বলছিলেন না? এ এমন একটা জঘন্য নরক যার প্রতিটি অধিবাসীই কৃৎসিত রোগে আক্রান্ত। একমাত্র ঈশ্বর ছাড়া আর কেউ আমাকে এই নরক থেকে উদ্ধার ক্রুতে পারবে না। এখন আমার অবস্থা এক ডানাভাঙা পাখির মতে- যার ক্ষমতা নেই ডানা মেলে উড়ে যাবার।
তুমি বেশ সন্দর কথা বলতে পার মেরিনা, বলে উঠলেন লাইসিমেকাস, তোমার কথা শুনলে যে কোন ও পতিতার মনেও ভালো হবার আকাঙ্ক্ষা জেগে উঠবে। — আমার কোনও সন্দেহ নেই সে বিষয়ে। যাই হোক, এই টাকাগুলো তুমি রেখে দাও, চেষ্টা করবে। এর সাহায্যে পালিয়ে যাবার।
ঈশ্বর আপনার ভালো করবেন, বলে। লাইসিমেকাসের দেওয়া টাকাগুলি রেখে দিল মেরিনা। দরজার দিকে যেতে যেতে লাইসিমেকাস বললেন, আমি চললুম। যদি কখনও তোমায় খবর পাঠাই তাহলে জানবে সেটা ভালো খবর। এই নাও, আরও কিছুটাকা রইল। এগুলো তুলে রােখ। দরকার মতো কাজে লাগিও — বলে আরও কিছু টাকা মেরিনার হাতে দিয়ে চলে গেলেন। লাইসিমেকাস।
সত্যিই মেরিনার কাজে লেগে গেল। লাইসিমেকসের দেওয়া টাকাগুলো। সে টাকা দিয়ে বিশ করল পতিতালয়ের মালিকের চাকর বোল্টকে। একদিন তারই সাহায্যে পতিতালয় থেকে পালিয়ে গিয়ে একজন সচ্চরিত্র লোকের আশ্রয় পেল মেরিনা। সেই ভদ্রলোক নিজের মেয়ের মতো ভালোবাসেন মেরিনাকে। কিন্তু তার আশ্রয়ে থেকেও বসে বসে সময় কাটে না মেরিনার। থার্সাসে থাকাকালীন সে নাচ-গান, শিল্প-কলা সবই আয়ত্ত করেছিল। এখন ছোটো ছোটো ছেলে-মেয়েদের সে সব বিদ্যে শিখিয়ে পয়সা উপার্জন করতে লাগল। বোল্টের সাহায্যে সে উপার্জিত টাকা পতিতালয়ের মাসিকে সাহায্য হিসেবে পাঠাতে লাগল।
নিজের মেয়ের সমাধিতে ফুল দিয়ে বিষণ্ণ মনে টায়ারে ফিরে আসছিলেন পেরিক্লিস। মাঝপথে তার জাহাজ এসে দাঁড়াল মিটিলেন বন্দরে। দূর থেকে পেরিক্রিসের জাহাজটিকে দেখে কৌতূহলী হয়ে উঠলেন মিটিলেনের শাসক লাইসিমেকাস। কোন দেশের জাহাজ, কে রয়েছেন জাহাজে এসব জানতে দু-জন সভাসদকে নিয়ে বড়ো নৌকায় চেপেটায়ারের জাহাজের কাছে এলেন তারা তখন জাহাজের ডেকে চেয়ারে বসে আরাম করছিলেন ক্লান্ত রাজা পেরিক্লিস মিটিলেনের একজন সভাসদ জনৈক নাবিককে সাথে নিয়ে উঠে এলেন জাহাজের ডেকে। এদের দেখতে পেয়ে এগিয়ে এলেন অমাত্য হেলিকেন্যাস। হেলিকেন্যাসকে উদ্দেশ্য করে সেই নাবিক বলল, প্ৰভু হেলিকে নাস! নৌকায় অপেক্ষা করছেন মিটিলেনের শাসক লাইসিমেকাস। তিনি আসতে চান আমাদের জাহাজে।
দুজন সভাসদকে ডেকে নিয়ে হেলিকেন্যাস বললেন, যান, আপনারা গিয়ে মিটিলেনের শাসক লাইসিমেকাসকে অভ্যর্থনা জানিয়ে ওপরে নিয়ে আসুন।
নিয়ে তারা উঠে এল জাহাজের ওপরে। সেখানে তাকে অভিবাদন জানালেন মন্ত্রী হেলিকেন্যাস। ইশারায় পেরিক্লিসকে দেখিয়ে তিনি বললেন, ইনিই আমাদের প্রভু টায়ারের রাজা পেরিক্লিস। শোকে তিনি এত কাতর। যে প্রায় তিনমাস ধরে খাওয়া-দাওয়া একরকম বন্ধই করে দিয়েছেন। কারও সাথেই কথা বলেন না তিনি।
লাইসিমেকাস বললেন, আমি কি একবার ওর সাথে দেখা করতে পারি?
নিশ্চয়ই পারেন, বললেন হেলিকেন্যাস, তবে ওর সাথে দেখা করে কোন ও ফল হবে না। কারণ আপনার সাথে উনি একটা কথাও বলবেন না। স্ত্রী ও একমাত্ৰ কন্যার বিয়োগে উনি খুবই কাতর হয়ে পড়েছেন।
লাইসিমেকাস এগিয়ে এসে অভিবাদন জানালেন পেরিক্লিসকে। জবাবে কিছু না বলে বিষণ্ণ মুখে বসে রইলেন পেরিক্লিস।
হেলিকেন্যাসকে ডেকে একপাশে সরিয়ে এনে লাইসিমেকাস বললেন, আমি একটা কথা
বলতে চাই আপনাকে। আমাদের মিটিলেনে একটি কুমারী মেয়ে আছে! রূপে-গুণে সে অতুলনীয় আর চমৎকার তার গানের গলা। আমার বিশ্বাস তার গান শুনলে রাজা পেরিক্লিস আবার তার কথা বলার ক্ষমতা ফিরে পাবেন। আপনার অনুমতি হলে ওই মেয়েটিকে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করতে পারি। আমি।
কাজ হবে বলে মনে হয় না। যাই হোক আপনি যখন বলছেন তখন একবার চেষ্টা করে দেখতে পারেন।
হেলিকেনাসের নির্দেশে একজন সভাসদ বড়ো নৌকায় চেপে রওনা হলেন। কিছুক্ষণ বাদে তিনি ফিরে এলেন মেরিনাকে সাথে করে। তার আগেই ডেক ছেড়ে নিজের কামরায় চলে গেছেন রাজা পেরিক্লিস। হেলিকেন্যাস সেখানে পৌঁছে দিলেন মেরিনাকে।
পেরিক্লিসকে অভিবাদন জানিয়ে মেরিনা বললেন, মহারাজ! আপনার মতো আমিও বুকের মাঝে অসহ্য যন্ত্রণা আর দুঃখ বহন করে চলেছি। শুনেছি। আমার বাবাও নাকি রাজা ছিলেন। সমুদ্র ঝড়ে জাহাজ ডুবি হয়ে আমি বাবা-মার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি।
আপন মনে পেরিক্লিস বললেন, এই মেয়েটিও দেখতে ঠিক আমার স্ত্রী আর মেয়ের মতে, কথাগুলি অনুচ্চ স্বরে বললেও তা ঠিকই পৌঁছেছে মেরিনার কানে।
মেরিনার দিকে তাকিয়ে পেরিক্লিস বললেন, কী নাম তোমার?
আমার নাম মেরিনা, জবাব দিল সে।
মেরিনা নামটা শুনে কেমন যেন চমকে উঠলেন পেরিক্লিস। তিনি বললেন, তোমার নাম শুনে আমি যে কতটা চমকে গেছি তা তোমায় বোঝাতে পারব না। কে তোমার এই নাম দিয়েছিল?
মেরিনা জবাব দিল, মৃত্যুর আগে আমার ধাত্রী লাইকোরিডা নিজ মুখে বলে গেছে যে আমরা বাবা একজন নামি রাজা ছিলেন। আমার মাও নাকি ছিলেন রাজবংশীয়। সমুদ্রবক্ষে জন্মেছিলাম বলে জাহাজের মধ্যেই বাবা আমার নাম রেখেছিলেন মেরিনা। আমি এও শুনেছিলাম ঝড়-জলের তাণ্ডব সহ্য করতে না পেরে আমায় জন্ম দিয়েই মা মারা যান। মেরিনার কথা শুনে উত্তেজনায় থারথার করে কেঁপে উঠল পেরিক্রিসের ঠোট। তিনি চাপা স্বরে আপন মনে বলতে লাগলেন, মেয়েটি বলছে। ওর বাবা রাজা ছিলেন আর মাও নাকি রাজবংশীয়; সমুদ্রে জন্মেছিল বলে ওর বাবা নাম রেখেছিল মেরিনা। এ সব কি আমি স্বপ্ন দেখছি। এই তো কদিন আগে মারা গেছে সে। আমি নিজে তার সমাধিতে ফুল ছিটিয়ে এসেছি। তবু ওকে একবার বাজিয়ে নেওয়া যাক। মেরিনার দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, তোমার পুরো জীবনকাহিনি শুনতে চাই আমি! জন্মের পর তোমার কী হল, কী করে তুমি এখানে এলে — সব খুলে বল আমায়।
মেরিনা বলতে লাগল, আমাকে জন্ম দিয়েই মা মারা যান। শুনেছি তার মৃতদেহ নাকি সমুদ্রের জলে ফেলে দেওয়া হয়। তারপর আমার পিতা থাসাসের শাসকের কাছে রেখে দেন। আমাকে! আমাকে খাইয়ে-দাইয়ে বড় করে তোলেন ক্লিওন আর তার স্ত্রী। তারপর কেন জানি না আমাকে গোপনে হত্যা করার জন্য একজন গুপ্তঘাতককে নিয়োগ করেন ক্লিওনের স্ত্রী। আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে ছিলাম ধাত্রী লাইকোডিয়ার সমাধিতে ফুল দেব বলে। মাঝপথে ঘাতক আমায় ভুলিয়েভালিয়ে নিয়ে গেছিল।সমূদ্রতীরে। আমি কাতর স্বরে প্রাণভিক্ষা চাইলাম সে ঘাতকের কাছে। সে সময় একদল জলদসু্য এসে আমাকে ছিনিয়ে নিয়ে গিয়ে জাহাজে তোলে, তারপর এক সময় এসে পৌঁছলাম এই মিটিলেনে।
এটুকু বলার পর মেরিনার নজরে এল শিশুর মতো কাঁদছেন তার শ্রোতা।
মেরিনা বলল, আমার জীবনকাহিনি শুনে আপনি কাঁদছেন! বিশ্বাস করুন রাজা পেরিক্লিসের মেয়ে আমি। জানি না। আমার বাবা এখনও বেঁচে আছেন। কিনা।
রাজা পেরিক্লিস গলা চড়িয়ে হেলিকেন্যাসকে ডেকে বললেন, প্রিয় হেলিকেন্যাস! একবার এস এ ঘরে?
রাজার ডাক শুনে হেলিকেন্যাস ঘরের ভিতর গিয়ে দেখলেন এতদিন বাদে রাজার মুখে হাসি ফুটেছে। তা দেখে খুশি হলেন তিনি।
পেরিক্লিস বললেন, শোন হেলিকেন্যাস, ও বলছে ওর নাম মেরিনা। সমুদ্রে জন্মাবার দরুন ওর বাবা নাকি এই নাম রেখেছিলেন। দেখা মা! ঈশ্বরের লীলা বোঝা ভার। একদিন সমুদ্রে জন্মেছিল বলে এতদিন বাদে সমুদ্ৰই তোমায় আজ ফিরিয়ে দিয়েছে আমার কাছে। দেখা মা! এতক্ষণ পর্যন্ত তুমি যা বলেছ তা সবই সত্যি। তবুও সংশয় রয়ে গেছে আমার মনে। তুমি যদি সত্যিই পেরিক্লিসের মেয়ে হও, তাহলে বলতো তোমার মা’র নাম কী?
নিশ্চয়ই বলব, তবে তার আগে বলুন আপনি কে? জানতে চাইল মেরিনা।
আমি টায়ারের রাজা পেরিক্লিাস, জবাব দিলেন তিনি।
উত্তেজনা চেপে রেখে মেরিনা বলল, আমার মার নাম থাইসা।
কী বললে, তুমি থাইসার মেয়ে? এগিয়ে এসে মেরিনাকে বুকে জড়িয়ে ধরে রাজা পেরিক্লিস বললেন, তুমি যে সত্যিই আমার মেয়ে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। বুঝলে হেলিকেন্যাস, জীবনে শুধু দুঃখই নেই, আনন্দও আছে। আজ কত বছর বাদে ফিরে পেলাম নিজের মেয়েকে। যাও! মেয়ের জন্য নতুন পোশাক নিয়ে এস, বলে ঘরের বাইরে এসে দাঁড়ালেন পেরিক্লিস। সামনে লাইসিমেকাসকে দেখে বললেন, হেলিকেন্যাস! ইনি কে? এঁকে তো চিনতে পারছি না।
আজ্ঞে! ইনি হলেন মিটিলেনের শাসক লাইসিমেকাস। একমাত্র এরই জন্য এতদিন বাদে আপনি ফিরে পেয়েছেন মেয়েকে
তইতো আপনাকে দেখে পরমাত্মীয় বলে মনে হয়েছিল, বলেই আনন্দের সাথে লাইসিমেকাসকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন পেরিক্লিস। ঈশ্বর আমাদের উভয়ের মঙ্গল করুন বলে কঠিন দৃষ্টিতে হেলিকানাসের দিকে তাকিয়ে বললেন পেরিক্লিস, বুঝতে পারছি মেরিনা যে সত্যিইআমার মেয়ে এ বিষয়ে তোমার সন্দেহ এখনও ঘোচেনি। রাজার কথার কোনও জবাব দিলেন না হেলিকেন্যাস।
বহুক্ষণ ধরে পেরিক্লিসের মনে একটা সূক্ষ্ম অনুভূতির বোধ হচ্ছে। কোথা থেকে মিষ্টি সুরের একটা গান ভেসে আসছে তার কানে। অথচ কেউ তা শুনতে পাচ্ছে না। সেই সূরা শুনতে শুনতে একসময় ঘূমিয়ে পড়লেন পেরিক্লিাস। ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখলেন দেবী ডায়ানা যেন তাকে বলছেন, এফিসাসে চলে যাও তুমি! দেখবে সেখানে তোমার স্ত্রী আমার আরাধনা করছে। ধাও! সেখানে গিয়ে তাকে গ্রহণ কর।
ঘুম ভাঙার পর জাহাজে চেপে পেরিক্লিস রওনা হলেন এফিসাসের পথে। একসময় জাহাজ এসে থামল সেখানে। মেরিনা, হেলিকেন্যাস আর কয়েকজন সভাসদকে সাথে নিয়ে দেবী ডায়ানার মন্দিরে গেলেন পেরিক্লিস। ঘটনাচক্রে সে সময় উপস্থিত ছিলেন। এফিসাসের সভাসদ সেরিমন— যার পরামর্শে একদিন বাকি জীবন কাটাতে থাইসা এসেছিলেন এই মন্দিরে। দেবী ডায়ানার বেদির সামনে দাঁড়িয়ে উপস্থিত সবাইকে জোর গলায় নিজের জীবনের ইতিহাস শোনালেন পেরিক্লিস। থাইসাও তখন সেখানে ছিলেন। এতদিন বাদে স্বামীর গলা শুনে আর তাকে সামনে দেখে আনন্দে আত্মহারা হয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন। থাইসা! সেরিমনের পরিচর্যায় কিছুক্ষণের মধ্যেই জ্ঞান ফিরে পেলেন তিনি। তখন থাইসকে দেখিয়ে পেরিক্লিসকে বললেন সেরিমন, যার খোজে আপনি এতদূর এসেছেন, এই থাইসাই আপনার সেই হারিয়ে যাওয়া স্ত্রী।
বহুদিন বাদে স্বামী-কন্যাকে এক সাথে ফিরে পেয়ে আনন্দের চোটে কী যে করবেন। থাইসা, তা ভেবে পাচ্ছেন না তিনি। এবার তাদের সবাইকে নিজের বাড়িতে নিয়ে এলেন সেরিমন। যে বাক্সতে পুরে থাইসাকে সমুদ্রে ফেলে দেওয়া হয়েছিল -সেই বাক্সটা আর তার ভেতরের সব জিনিস সযত্নে রেখে দিয়েছিলেন সেরিমন। তিনি সেগুলি দেখালেন পেরিক্লিসকে। বিয়ের রাতে স্বামীর কাছ থেকে যে হিরের আংটিটিা উপহার হিসেবে পেয়েছিলেন। থাইসা, এতদিন বাদে তিনি সেটা দেখালেন পেরিরিকসকে। আংটিটা একেবার দেখেই চিনতে পারলেন পেরিক্লিস। জন্ম দেবার পর থেকে যে মেয়েকে তিনি দেখেননি, সেই মেয়ে আজ এত বড়ো হয়েছে দেখে খুশি হলেন থাইসা। মাকে পেয়ে তার সামনে হাঁটু গেড়ে সশ্রদ্ধ ভঙ্গিতে বসেছিল মেরিনা, তাকে দু-হাতে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে শিশুর মতো কাঁদিতে লাগলেন থাইসা।
এবার সেরিমনকে দেখিয়ে তিনি পেরিক্লিসকে বললেন, এনার দেখানো পথ অনুসরণ করে আমি এতদিন দেবী ডায়ানার আরাধনা করে এসেছি, আজ এতবছর পরে দেবী ডায়ানার কৃপাতেই তোমাদের ফিরে পেলাম আমি।
ইশারায় লাইসিমেকাসকে দেখিয়ে পেরিক্লিস বললেন, একবার এর দিকে চেয়ে দেখা থাইসা। ইনি হলেন মিটিলেনের শাসক লাইসিমেকাস। আমি স্থির করেছি। এর হাতেই সঁপে দেব মেরিনাকে ৷ এবার মেরিনার হাত লাইসিমেকাসের হাতে তুলে দিয়ে বললেন। থাইসা, তোমাদের দাম্পত্য জীবন সুখের হোক।
এর পরও কিছু অবশিষ্ট আছে। এ কাহিনির ক্লিওন আর তার স্ত্রী যে মেরিনাকে হত্যা করার চক্রান্ত করেছিলেন সে কথা জানতে পেরে তাদের উপর ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন। থার্সাসের প্রজারা। এ অন্যায়ের প্রতিশোধ নিতে প্রজারা একদিন আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিল তাদের প্রাসাদ। প্রাসাদ পুড়ে ছাই হয়ে গেলেও, ক্লিওন আর তার স্ত্রী কিন্তু প্ৰাণে বেঁচে গেলেন। সম্ভবত আরও বড়ো শাস্তি তাঁদের পাওনা ছিল বলেই বেঁচে গেলেন তারা।