কিং লিয়ার
দেশ শাসনের দায়ভার থেকে মুক্তি পাবার জন্য ইংলন্ডের বৃদ্ধ রাজা লিয়ার যখন তার তিন মেয়ে, দুই জামাই ও অমাতাদের সাথে নিয়ে রাজসভায় প্রবেশ করলেন, তখন সেখানে বসে নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করছিলেন লর্ড অব কেন্ট এবং লর্ড অব গ্লস্টার। কথার ফাঁকে একসময় গ্লস্টারকে জিজ্ঞেস করলেন, কেন্ট, আচ্ছা মাননীয় গ্লস্টার, আলবেনিয়ার ডিউক আর কর্নওয়ালের ডিউক, এই দুই জামাইয়ের মধ্যে রাজার কাছে কে সবচেয়ে প্রিয় তা কি আপনি আন্দাজ করতে পারেন?
না, প্রিয় বন্ধু মাথা নেড়ে বললেন গ্লস্টার, এ ব্যাপারে সঠিক অনুমান করা কঠিন, কারণ দুজনেই সমান গুণী, কেউ কারও চেয়ে কম বা বেশি নন।
সে সময় গ্লস্টারের পাশে বসে থাকা এক তরুণকে দেখে বললেন কেন্ট, ওই যুবকটি কি আপনার পুত্ৰ?
গ্লস্টার বললেন, হ্যা। তবে ওকে ছেলে বলে মেনে নিতে আমার লজ্জা হয়। তারপর একটু দোনোমোনোভাবে বললেন, ওর আচার-আচরণ খুবই খারাপ। তবে ওর বড়ো ভাই আমার প্রিয়পাত্র। এবার ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন, শোন এডমন্ড, ইনি হচ্ছেন আমার প্রিয় বন্ধু, কেন্টের লর্ড!
আপনি যখন বাবার বন্ধু, তখন আমারও পূজনীয়, বললেন এডমন্ড।
কেন্ট বললেন, আশা করি ভবিষ্যতে তোমার উপর আমার স্নেহ আরও বেড়ে যাবে।
বিশিষ্ট অতিথিদের অভ্যর্থনার উদ্দেশ্যে রাজা ঘরে ঢুকেই চলে যেতে বললেন গ্লস্টার ও এডমন্ডকে। তারা চলে যাবার পর রাজা কিছুক্ষণ চোখ বুলোলেন সাথে নিয়ে আসা সীমানাসহ অঙ্কিত রাজ্যের মানচিত্রের উপর। তারপর উপস্থিত সবার সামনে তিন মেয়ে ও দুই জামাইকে লক্ষ্য করে বললেন, হে আমার মেয়ে জামাইরা! আমি স্থির করেছি। রাজার দায়িত্ব-কর্তব্য থেকে মুক্ত হয়ে আমার বুড়ো বয়স অর্থাৎ শেষ জীবনটা আনন্দে কাটাব। সে জন্য আমি সমান তিন ভাগে ভাগ করেছি আমার সাম্রাজ্যকে। এ নিয়ে ভবিষ্যতে যাতে তোমাদের মধ্যে বিবাদ না হয় তাই এই তিন ভাগ আমি দান করে দিতে চাই আমার তিন কন্যাকে। সেই সাথে কর্ডেলিয়ার পাণিপ্রার্থী ফ্রান্স ও বাগন্ডির রাজকুমারের প্রতীক্ষার অবসানও করতে চাই আমি। কিন্তু তার আগে বল, তোমরা আমায় কে কতটুকু ভালোবাস?
রাজার বড়ো মেয়ে গনেরিল বলল সবার আগে, মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড়ো অভিশাপ হল অন্ধত্ব, বন্দিদশা এবং মৃত্যু। এ জীবনে যদি আপনার স্নেহ না পাই, তাহলে স্নেহহীন সে জীবন আমার কাছে ভীষণ কষ্টকর বলে মনে হবে। সস্তানের প্রতি আমার স্নেহ-ভালোবাসা যে কোনও সন্তানই কামনা করে।
এ কথা শুনে খুব খুশি হলেন রাজা। আনন্দের চোখে তিনি মেয়েকে দান করে বসলেন। শস্যশ্যামলা এক বিশাল রাজ্য। তারপর মেজ মেয়ে রিগানকে বললেন, এবার বল, তুমি আমায় কতটুকু ভালোবাস?
রিগান উত্তর দিলে, বাবা, আমার প্রতি আপনার যে ভালোবাসা তার পরিমাপ করার সাধ্য আমার নেই, আর আমি সে চেষ্টাও করব না। তবে জেনে রাখুন, মানুষের জীবনে যত কিছু আনন্দ আছে, সে সবই আমার কাছে বিষের মতোই মনে হবে, যদি আমি বঞ্চিত হই। আপনার স্নেহ থেকে।
স্নেহ-দুর্বল বাবা খুব খুশি হলেন মেয়ের কথা শুনে। তিনি রিগানকেও দান করলেন সাম্রাজ্যের এক সমৃদ্ধিশালী অংশ। সবশেষে তিনি উৎসাহ আর আনন্দের সাথে আদরের ছোটো মেয়েকে বললেন সে যেন জানায় বাবাকে সে কতটুকু ভালোবাসে।
কর্ডেলিয়া বলল, মেয়ে হিসেবে বাবাকে যতটুকু ভালোবাসা দরকার, আমি ততটাই ভালোবাসি আপনাকে।
আদুরে ছোটো মেয়ের মুখে শোনা কথা কেন জানি অবিশ্বাস্য মনে হতে লাগল রাজা লিয়ারের। তার মনে হল এক ঝটিকায় তিনি যেন স্বপ্ন থেকে ছিটকে পড়েছেন শক্ত মাটিতে। তিনি ছোটো মেয়েকে বললেন, আরও একবার ভেবে বল কর্ডেলিয়া, তুমি কি এর চেয়ে বেশি ভালোবাস না আমায়?
দৃঢ় কণ্ঠে উত্তর দিল কর্ডেলিয়া, আমার যা বলার ছিল তা আমি ভেবে-চিন্তেই বলেছি। যদি আপনাকেই মন-প্ৰাণ দিয়ে ভালোবাসতে হয়, তাহলে স্বামী ও অন্যান্যদের প্রতি আমার ভালোবাসাকর্তব্য বলে কিছুই থাকে না। আর সেটা হবে খুব অন্যায় কাজ। তাই আমি পারি না সমস্ত মন-প্ৰাণ দিয়ে আপনাকে ভালোবাসতে।
কর্ডেলিয়ার কথা বোধগম্য না হওয়ায় রাজা রেগে গিয়ে বললেন তাকে, তোমার মনের কথা যদি এই হয়, তাহলে ঈশ্বরের দোহাই, আজ থেকে তোমার-আমার সম্পর্ক শেষ। তোমার সাথে আমার আচরণও সেরূপ নির্মম হোক, যে আচরণ অসভ্য স্কাইলিয়া করেছিল রানির সাথে। তুমি এই মুহূর্তে দূর হয়ে যাও আমার চোখের সামনে থেকে।
এর মধ্যে প্ৰভুভক্ত কেন্ট কিছু বলতে যেতেই চিৎকার করে তাকে থামিয়ে দিলেন রাজা লিয়ার। তারপর বললেন জামাইদের, প্রিয় ছেলেরা, এবার শেষ তৃতীয় ভাগটা নিজেদের মধ্যে সমান ভাগে ভাগ করে নাও তোমরা। আমি পালা করে তোমাদের দুজনের সাথে থাকব একশো অনুচর নিয়ে। আমার মাথায় মুকুটটাকে দু-ভাগ করে সমস্ত সম্পদ ও ক্ষমতা তোমাদের দান করলাম। আমার জন্য রইল। শুধু রাজা উপাধিটা। তারপর সভাসদদের দিকে ফিরে বললেন, তোমরা যে কেউ একজন গিয়ে ডেকে আন ফ্রান্স ও বাৰ্গান্ডির দুই যুবরাজকে।
কেন্ট বললেন, এরূপ অবিবেচকের মতো কােজ আপনি করবেন না প্ৰভু! একটু ভেবে দেখুন, তাহলে বুঝতে পারবেন। আপনার প্রিয় ছোটো মেয়ে আপনাকে সত্যিই ভালোবাসে।
কর্ডেলিয়া সম্পর্কে এ কথা বলতেই রাজা তলোয়ার দিয়ে মেরে ফেলতে চাইলেন কেন্টকে। কেন্ট বললেন, প্রাণের ভয়ে আমি কিছুতেই মিথ্যে, কথা বলতে পারব না প্ৰভু! আপনি যে ভুল করছেন সে কথা যতক্ষণ পর্যন্ত আমার দেহে প্ৰাণ আছে আমি বলে যাব।
এত রেগে গেছেন রাজা লিয়ার যে স্বাভাবিক জ্ঞানটুকুও হারিয়ে ফেলেছেন তিনি। তাই তিনি তার পরম বন্ধু কেন্টকে বলতে পারলেন, তুমি একটা রাজদ্রোহী দুৰ্বত্ত ছাড়া আর কিছু নও। দেশ থেকে আমি তোমাকে নির্বাসিত করলাম তোমার উদ্ধত আচরণের জন্য। আগামী পাঁচ দিনের মধ্যে তোমায় এই দেশ ছেড়ে চলে যেতে হবে, অন্যথায় মৃত্যু হবে তোমার।
কন্যাসম কর্ডেলিয়াকে আশীর্বাদ করে চোখের জল মুছতে মুছতে রাজসভা থেকে বিদায় নিলেন কেন্ট।
এ সময় শোনা গেল নেপথ্যে কথাবাতাঁর আওয়াজ। দুই যুবরাজ আর তাদের অনুচরদের নিয়ে প্রবেশ করলেন গ্লস্টার।
রাজালিয়ার তাদের দেখে বললেন, হে বাগন্ডির যুবরাজ! আমার ছোটো মেয়ের পাণিপ্রার্থীদের মধ্যে তুমি অন্যতম। তুমি নিশ্চয়ই শুনেছ। আমার ছোটো মেয়েকে সাম্রাজ্যের এক-তৃতীয়াংশ যৌতুক হিসাবে দেব বলে আমি পূর্বে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম। কিন্তু এখন সে প্রতিশ্রুতি অর্থহীন। এখন সে পিতার মেহবঞ্চিত ঘৃণ্য এক তুচ্ছ নারী। এবার তুমি বল, এই বঞ্চিত, নিঃস্ব অভিশপ্ত মেয়েকে তুমি কি আগের মতোই বিয়ে করতে আগ্রহী?
সব শোনার পর বাৰ্গান্ডির যুবরাজ অস্বীকার করলেন কর্ডেলিয়াকে বিয়ে করতে। এবার ফ্রান্সের যুবরাজকে উদ্দেশ করে বললেন রাজা, প্রিয় যুবরাজ, এবার বল কর্ডেলিয়া সম্পর্কে তোমার অভিমত কী?
ফ্রান্সের যুবরাজ বললেন, আমি আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছি এই ভেবে কিছুক্ষণ আগে যে ছিল পিতার প্ৰাণস্বরূপ, এমন কী কারণ ঘটল যে এই অল্প সময়ের মধ্যে সে বঞ্চিত হল পিতার স্নেহ থেকে।
সে যাই হোক, প্রকৃত ভালোবাসা স্বর্থহীন। কর্ডেলিয়ার প্রতি আমার প্রেম যে কত নিবিড় তা প্রমাণ করার জন্য কর্ডেলিয়ার মতো প্ৰেম-ধন্যা, সততার পূজারি, সবার অবজ্ঞার পাত্ৰ, নিঃস্ব অথচ সুন্দরী মেয়েকে আমি ফ্রান্সের রানি এবং চিরসঙ্গিনী হিসাবে আনন্দের সাথে গ্ৰহণ করছি— বললেন ফ্রান্সের যুবরাজ।
রাজা বললেন, বেশ, তাই হোক। তারপর কর্ডেলিয়াকে আশীর্বাদ না করেই তিনি চলে গেলেন রাজসভা ছেড়ে। আর তার সাথে সাথে বেড়িয়ে গেল বাগন্ডি, কর্নওয়াল, আলবেনি, গ্লস্টার ও তার অনুচরেরা।
প্রাসাদ ছেড়ে চলে যেতে যেতে কাঁদতে কাঁদতে বললেন কর্ডেলিয়া, আমার দুর্ভাগ্য এই যে বাবা ভুল বুঝলেন আমায়। হে আমার বড়ো বোনেরা! তোমাদের প্রতিশ্রুতির উপরই নির্ভর করছে বাবার ভবিষ্যৎ জীবন। আশা করি কর্তব্য পালনে তোমাদের কোনও ত্রুটি হবে না।
একথা বলেই তিনি চলে গেলেন ফ্রান্সের যুবরাজের সাথে। তারা চলে যাবার পর গনেরিল চুপি চুপি বলল তার বোন রিগানকে, দাখ, বুড়ো হয়ে আমাদের পিতা মানসিক দিক দিয়ে খুবই দুর্বল আর অপ্রকৃতিস্থ হয়ে পড়েছেন। তাই তার পক্ষে সম্ভব হল প্রিয় কন্যার সাথে এরকম ব্যবহার করার। এটা সত্যিই তার অবিবেচক মনের পরিচায়ক।
রিগান বলল, আর বলিস না! এটাই ওর চিরকেলে স্বভাব।
রিগানের কথা শুনে গনেরিল বলল, সেটা তো তাহলে আরও ভয়ের ব্যাপার। বয়স বেড়ে যাবার সাথে সাথে তার এই অভ্যোসটা বেড়ে যাবে আর সেটা সহ্য করতে হবে আমাদের। আয়, আমরা দুজনে পরামর্শ করি ভবিষ্যতে কী ভাবে এর হাত থেকে রক্ষণ পাওয়া যায়।
রিগান বলল, কথাটা তুমি ঠিকই বলেছ। খুব তাড়াতাড়িই পরামর্শটা করতে হবে আমাদের।
অন্যদিকে গ্লস্টারের প্রাসাদে সে সময় দুভাইয়ের মধ্যে লড়াই চলছিল সম্পত্তি নিয়ে। হে ঈশ্বর! সমাজে এমন নিয়ম কেন তুমি করেছ যে বংশের বড়ো ছেলেই সব কিছুরই মালিক হবে? অথচ দেখ, এই বড়ো ভাইয়ের চেয়ে বয়সে আমি হয়তো এক বছর কিংবা তার চেয়ে কম ছোটো, কিন্তু গুণে আর শক্তিতে কম নই। তাহলে আমি কেন বঞ্চিত হব সম্পত্তি থেকে। যদি তোমার এই নিয়ম হয়, তাহলে জেনে রেখ… বলেই চুপ করে যায় এডমন্ড। এরপর বড়োভাইয়ের উদ্দেশে বলল সে, বুদ্ধির জোরে আমিও অধিকার করব তোমার সম্পত্তি। চিঠির মাধ্যমে কৌশলে পিতার মেহ থেকে দূরে সরিয়ে দেব তোমাকে–এই আমার প্রতিজ্ঞা।
মনে মনে এডমন্ড যখন এরূপ মতলব আটিছিল সে সময় প্রবেশ করলেন তার বাবা গ্লস্টার।
ঘরে ঢুকেই এডমন্ডকে বললেন গ্লস্টার, শুনতে পেলাম রাজা নাকি নির্বাসন দণ্ড দিয়েছেন কেন্টকে? তিনি নাকি সমস্ত সম্পত্তি এবং রাজক্ষমতা দু জামাইয়ের মধ্যে সমান ভাগে ভাগ করে দিয়ে নিজের জন্য নির্দিষ্ট করেছেন সামান্য একটা বৃত্তি? ব্যাপার কী এডমন্ড? এত মনোযোগ দিয়ে কী পড়ছ তুমি?
এডমন্ড বললেন, ও কিছু নয় বাবা, ভাই এডগারের পাঠানো চিঠিটা পড়ছি।
নিশ্চয়ই ওটা বিশেষ গোপনীয়, বললেন গ্লস্টার, তা না হলে তুমি আমার কাছ থেকে ওটা লুকোতে না। দেখি চিঠিটা?
এডমন্ডের হাত থেকে সেই জাল চিঠিটা নিয়ে পড়তে শুরু করলেন গ্লস্টার। পড়তে পড়তে এক সময় রাগে। লাল হয়ে উঠল গ্লস্টারের মুখ। চিঠিটাতে লেখা ছিল, ভাই এডমন্ড, তাদের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধার সুযোগ নিয়ে বৃদ্ধরা আমাদের বঞ্চিত করে ধন-সম্পত্তি থেকে, ব্যর্থ করে দেয় আমাদের জীবন-যৌবন। তাই এস আমরা দুজন বুড়ো বাবাকে মেরে ফেলে তার সমস্ত সম্পত্তি সমান দু-ভাগে ভাগ করি আর সেই সাথে সার্থক করে তুলি আমাদের জীবন-ইতি এডগার।
বাবার প্রশ্নের উত্তরে ইনিয়ে বিনিয়ে বলল এডমন্ড, আগে আমাদের আলাপ-আলোচনার মাঝে এডগার এরূপ একটা ইঙ্গিত দিত বটে, তবে মনে হচ্ছে। এ চিঠিটা তার লেখা নয়। কেননা জানিলা গলিয়ে এ চিঠিটা কে যেন ভেতরে ফেলে গেছে।
গ্লস্টার বললেন, আমি বলছি চিঠিটা ওরই লেখা। এই এডগারকেই আমি সবচেয়ে বেশি। ভালোবাসতাম। আমি স্বপ্নেও ভাবিনি ও যে এত বড়ো শয়তান। যাও, ধরে নিয়ে এস সেই বর্বরটাকে।
এডমন্ড বলল, আপনি অত উত্তেজিত হবেন না বাবা। আগে আড়াল থেকে আপনি নিজে সব কথা শুনুন, তারপর না হয় তাকে শাস্তি দেবেন। নইলে তার প্রতি ঘোরতর অন্যায় করা হবে বাবা।
ঠিক আছে, সেই ব্যবস্থাই কর, বললেন গ্লস্টার, ওর আসল ইচ্ছেটা জানার পর তুমি স্বর্গমর্ত-পাতাল-যেখান থেকেই হোক সেই শয়তানটাকে খুঁজে বের করে আন। পৃথিবীটা বডড পাপে ভরে গেছে। মেহের মধুর সম্পর্কগুলি একে একে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। প্রেম, প্রীতি, শ্রদ্ধা–সব ক্ষেত্রেই আজ এত চক্রান্ত, শঠতা আর প্রতারণা। বাবার বিরুদ্ধে ছেলে, ছেলের বিরুদ্ধে বাবার বিদ্রোহ, চক্রান্ত আজ ঘোরতর অবস্থার মধ্যে দাঁড়িয়েছে। পূর্বে করা ভবিষ্যৎবাণী অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেছে আজ। কোনও দাম নেই সততার। আমি বলছি এডমন্ড, নিৰ্ভয়ে এগিয়ে যাও তুমি। যেভাবেই হোক, সেই শয়তানটাকে খুঁজে বের কর তুমি। কঠিন শাস্তি দেব আমি তাকে। দায়িত্ব এড়াবার জন্য অধিকাংশ মানুষ দোষারোপ করে তাদের ভাগ্যকে। কিন্তু চোর, জোচোর, মাতাল, বদমাশ হবার পেছনে মানুষ নিজেই দায়ী।
বলেই গ্লস্টার চলে গেলেন সেখান থেকে। ঠিক তখনই এডমন্ড দেখতে পেল এডগার এদিকেই আসছে। ভীষণ অবাক হয়ে গেল সে।
এডগার বলল ছোটোভাইকে, কী হল এডমন্ড, তুমি এত গম্ভীর কেন?
নিরীহ মুখে বলল এডমন্ড, সে সব ভবিষ্যৎবাণীর কথাই আমি ভাবছি। যাতে লেখা আছে পিতা-পুত্রের সম্পর্কছেদ, মৃত্যু। এছাড়াও আরও কত কথা। যাক, সে সব কথা ছেড়ে দাও। বলতো বাবার সাথে শেষ দেখা তোমার কবে হয়েছে? তার সাথে তোমার আচরণে কি কোনও অসন্তোষের ভাব প্রকাশ পেয়েছিল? এসব আমি জানতে চাইছি কারণ বাবা তোমার উপর খুবই রেগে আছেন। এর কারণ কী হতে পারে?
এডগার খুবই অবাক হল এডমন্ডের মুখে এ কথা শুনে। তারপর বলল, আমার এমন ক্ষতি কে করল? গতকাল রাতেই তো আমি দু-ঘণ্টা ধরে তার সাথে কথা বলেছি। কই, তখন তো তার মুখে কোনও রাগের চিহ্ন দেখিনি!
এডমন্ড বললেন, এতে তুমি ভয় পেও না। বাবা যতক্ষণ পর্যন্ত শাস্ত না হন, তুমি আমার ঘরে এসে বিশ্রাম করবে। তারপর তোমাকে আমি নিয়ে যাব তার কাছে। আমি ফিরে আসার পূর্বে যদি তোমার বাইরে যাবার দরকার হয় তাহলে অস্ত্র নিয়ে যেও সাথে। তোমার ভালোর জন্যই বলছি এ কথা। নাও, আর দেরি করো না। আমার ঘরের চাবিটা নাও আর এ জায়গা ছেড়ে শীঘ্ৰ পালাও।
এডগার আটকে পড়ল মায়াজালে। সে চলে যাবার পর মনে মনে খুব খুশি হয়ে বলতে লাগল এডমন্ড, আমার বুদ্ধির জোর বেশি আর তোমার আছে শুধু বোকা সততা। সেই সততার সুযোগ নিয়েই আমায় হস্তগত করতে হচ্ছে তোমার সম্পত্তি। তুমি একটা বোকা, নির্বোধ আর তাই ঈশ্বরের কাছে তুমি করুণার পাত্র ছাড়া আর কিছু নও।
রাজার বড়ো মেয়ে তার প্রাসাদে সে সময় ব্যস্ত ছিলেন প্রধান অনুচরদের সাথে আলোচনায়। দুঃখের সাথে বললেন গনেরিল, অসওয়াল্ড! একথা কি সত্য যে তার বিদূষককে অপমান করার জন্য বাবা মেরেছেন আমার অনুচরকে? ঘাড় নেড়ে সায় দিলেন অসওয়ান্ড। তখন গনেরিল বলল, সত্যিই অসহ্য হয়ে উঠছে বাবার এই নিত্যনতুন অত্যাচার। আর তার নাইটরাও ৪ হয়েছে তেমনি অসভ্য, বর্বর। বুঝলে অসওয়াল্ড, এবার থেকে তুমি আর অন্য চরেরা সবসময় তার সাথে এমন ভাব-ভঙ্গি করবে যাতে তিনি রেগে গিয়ে বোনের বাড়ি চলে যান। আর আমিও নিষ্কৃতি পাব তাতে। অসুস্থতার ভান করে আমিও কথা বলব না তার সাথে। বোনকে চিঠি দিয়ে জানিয়ে দেব সে যেন বাবার সাথে আমার মতোই ব্যবহার করে। আর সহ্য হচ্ছে; না। সব বিষয়ে তার অকারণ তিরস্কার। যে করেই হোক বন্ধ করতে হবে বাচ্চাদের মতো বুড়ে। বাবার এরূপ আচরণ। ঐ শোন, দূর থেকে আওয়াজ আসছে তার আগমনের বাদ্যধ্বনির। এবার তোমরা যাও, আমার আদেশ অনুযায়ী তার সাথে ভালো বা খারাপ ব্যবহার করবে।
তুমি কে? কী তোমার পেশা? সামনে দাঁড়ান ছদ্মবেশী ডিউক অব কেন্টকে প্রশ্ন করলেন। রাজা লিয়ার স্বয়ং।
কেন্ট বললেন, মহারাজ, আমার পোশাকই বহন করছে আমার কর্মদক্ষতার পরিচয়। আমি খুব দরিদ্র তবে কখনও বিশ্বাসের অমর্যাদা করি না। আমি সৎ আর জ্ঞানী লোকদের পছন্দ করি। সামান্য কারণে যুদ্ধ করি না। আর মদও খাই না।
কেন্টের কথা শুনে করুণায় ভরে গেল রাজার মন। কেন্টকে তিনি বললেন, তুমি সত্যিই গরিব। কী চাও তুমি আমার কাছে?
আমি অনুপ্রাণিত হয়েছি আপনার মুখে প্ৰভুত্বের দীপ্তি দেখে, বললেন কেন্ট, আমি চাই আপনার অধীনে কাজ করতে।
রাজা জানতে চাইলেন, কি কাজ করতে পারবে তুমি?
কেন্ট উত্তর দিলেন, আমি জানি দরকারি কথার গোপনীয়তা রক্ষা করতে, দ্রুত ঘোড়ায় চড়তে। এছাড়া সাধারণ মানুষের অন্যান্য গুণেরও অধিকারী আমি। আমি কঠোর পরিশ্রম করতে পেছপা নাই, বয়সও সহজে কাবু করতে পারে না আমায়।
কেন্টের কথা শুনে রাজা বললেন, আমার ভূত্য হিসেবে আমি তোমায় মনোনীত করলাম। এরপর তিনি অসওয়াল্ডকে বললেন গনেরিলকে ডেকে আনতে। এমন সময় জনৈক নাইট এসে জানাল যে রাজার মেয়ে অসুস্থ। লিয়ার জানতে চাইলেন, গনেরিলকি আসবে না! নাইট বলল, আমার অপরাধ নেবেন না প্ৰভু! আমার মনে হয় আপনার মেয়ে-জামাই আর তাদের লোকেরা আগের মতো শ্রদ্ধা করে না। আপনাকে। আপনি এখন তাদের কাছে বোঝা ছাড়া আর কিছু নন।
ঠিকই বলেছ তুমি বললেন লিয়ার, আমিও লক্ষ করেছি যে ওরা কর্তব্যে অবহেলা করছে। তবে মনে করেছিলাম যে ওটা আমার মনের ভুল, ভবিষ্যতে এবিষয়ে তীক্ষ দৃষ্টি রাখব। যাই হোক, আমার বিদূষক কোথায়?
নাইট বললেন, কৰ্ডেলিয়ার দুঃখে তিনি খুবই দুঃখিত মহারাজ। এ দুদিন তাই তিনি আসেননি।
তাকে নিরস্ত করে লিয়ার বললেন, থাক থাক আর বলতে হবে না। আমি স্থির করেছি মেয়ের সাথে কথা বলব। যাও, তাকে ডেকে আন তুমি।
এসময় ঢুকে পড়ল। অসওয়ান্ড। তাকে দেখে লিয়ার বললেন, তুমি জান আমি কে?
অসওয়াল্ড উত্তর দিলেন, জানি। আপনি আমার প্রভুপত্নীর পিতা।
রেগে বললেন লিয়ার, কী বললে? এছাড়া আমার আলাদা কোনও পরিচয় নেই? তোমার এত দুঃসাহস আমার মুখের উপর কথা বলছ? এজন্য আমি তোমায় শাস্তি দেব। বলেই রাজা
শুরু করলেন তাকে মারতে।
তখন কেন্ট বললেন অসওয়াল্ডকে, এই মুহূর্তে এখান থেকে দূর হয়ে যাও নির্বোধি। তোমার কি কাণ্ড-জ্ঞান লোপ পেয়েছে? কার সাথে কীরূপ ব্যবহার করতে হয় তা কি তুমি জান না? বলেই কেন্ট গলাধাক্কা দিয়ে বের করে দিল অসওয়াল্ডকে। কেন্টের এই আচরণে রাজা খুব খুশি হয়ে উপহার দিলেন তাকে।
এমন সময় বিদূষক এসে প্রবেশ করল। তাকে দেখে রাজা ব্যগ্র হয়ে বললেন, তুমি কেমন আছে বিদূষক?
কেন্টের দিকে তাকিয়ে বলল বিদূষক, স্যার, আমার টুপিটা আপনি নিন। কারণ যার অধীনে আপনি কাজ করেন। তিনি স্বয়ং তার দুই মেয়েকে নির্বাসন দিয়েছেন আর অনিচ্ছাসত্ত্বেও তৃতীয় মেয়েটিকে আশীৰ্বাদ করেছেন। ভগবান যদি আমায় দুটো মেয়ে আর দুটো টুপি দেন—
তার কথা শেষ না হতেই রাজা জানতে চাইলেন, তাহলে?
তাহলে বিষয়-সম্পত্তি তাদের দিয়ে দেবার পর অন্তত একটা টুপি আমার জন্য রেখে দিতাম–বলল বিদূষক, আপনাকে এখন অন্য মেয়ের উপর নির্ভর করতে হচ্ছে।
রেগে গিয়ে লিয়ার বললেন তাকে, এর জন্য কিন্তু তোমায় শাস্তি পেতে হবে।
বিদূষক বললেন, মহারাজ, ভয় পেয়ে যে নির্বোধ সত্যকে এড়িয়ে যায়, সে শুধু মিথ্যাকেই আরও বেশি প্রশ্রয় দেয়। এবার আপনি শুনুন, বুদ্ধিমান ব্যক্তি তার সঞ্চায়ের পরিমাণ বাইরের কাউকে জানায় না। সে কম কথা বলে, ব্যয়ের চেয়ে তার আয় বেশি। হাঁটাপথে না গিয়ে সে ঘোড়ায় চড়ে, কোনও কিছুতেই সে দমে না। আর বাজি রাখে বিশেষ বিবেচনার সাথে।
রাজা বললেন, এখানে এ সব কথার কোনও মানে হয় না, খুবই শক্ত তোমার কথাগুলি।
এবার বিদূষক বলল, যে লোকটি আপনাকে বিষয়-সম্পত্তি দান করার পরামর্শ দিয়েছিল তাকে আপনি ডাকুন নয়তো নিজে দাঁড়ান। তার জায়গায়, তাহলেই আপনি বুঝতে পারবেন তেতো ভাঁড় আর মিষ্টি ভাঁড়ের পার্থক্য।
ভাঁড়ের কথা শুনে বললেন কেন্ট, তুমি মোটেও বোকা নও।
ভাঁড় বলল, মোটেও নই, কারণ বোকা হলে চলবে না আমার। এই পৃথিবীর কেউ পুরোপুরি বোকা নয়, রাজার উদ্দেশে বলেই চললেন বিদূষক, আপনি কিন্তু বোকামি করে আপনার সম্পদ ও ক্ষমতা দুভাগে ভাগ করে দিয়েছেন। এরপর বিদূষক তার কথার সারমর্ম বোঝাতে লাগল একটি গান গেয়ে।
লিয়ার বললেন, কবে থেকে তুমি গান গাইছ?
ভাঁড় বলল, যবে থেকে সবকিছু কন্যাদের দান করে নিঃস্ব হয়েছেন আপনি।
রেগে গিয়ে বললেন লিয়ার, তুমি একটা মিথ্যেবাদী। আমি চাবুক মারব তোমাকে।
ভাঁড় বলল, সত্যি কথা বলার জন্য চাবুক মারে আপনার মেয়েরা। আপনি মারেন মিথ্যে কথা বলার জন্য। কী আশ্চর্য মিল আপনাদের মধ্যে। ওই যে আসছে আপনার বুদ্ধির দুর্ভাগ্যের একজন।
গনেরিলকে আসতে দেখে উৎকণ্ঠিত হয়ে বললেন রাজা, কী ব্যাপার গনেরিল! আজিকাল প্রায়ই দেখতে পাচ্ছি। তোমার গম্ভীর মুখ। এর কারণটা বলবে কি?
বিদূষক বলল রাজাকে, মহারাজ, উনি হলেন মটরডালের ভূসি। কিছুই আর অবশিষ্ট নেই ওর মধ্যে।
রেগে গিয়ে বলল গনেরিল, শুধুমাত্র ও নয়, আপনার প্রশ্ৰয় পেয়ে আপনার অনুচরেরা পর্যন্ত আমার সাথে ঝগড়া করার সাহস পায়, অভদ্র হয়ে ওঠে তাদের আচরণ। একটু আগে আপনি যে ব্যবহার আমার সাথে করলেন, আমি ভয় পাচ্ছি। এই ভেবে যে আপনার সমর্থনেই ওরা এতটা বেড়ে ওঠার সাহস পেয়েছে। যদিও একথা বলতে আমার লজ্জা হচ্ছে, তবুও অন্যায়ের হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য বাধ্য হয়েই বলছি। এর জন্য আপনার শাস্তি পাওয়া উচিত। তাতে হয়তো অন্যায়ের হাত থেকে রক্ষণ পাওয়া যাবে।
বিদূষক বলল, কোকিল। যেমন তার পালক পিতা কাককে মেরে ফেলে, ঠিক সেইরকম।
গনেরিলের কথা শুনে রাজা খুব দুঃখ পেলেন মনে। তিনি বললেন, আমি কে তা কি তুমি ভুলে গেছ?
উদ্ধত স্বরে জবাব দিল গনেরিল, বাবা, আপনার জ্ঞান-বুদ্ধি সব লোপ পেয়েছে।
লিয়ার বললেন, তাহলে কি পাগল হয়ে গেছি আমি? আমি কি আর সেই পূর্বের রাজা লিয়ার নই? কেন এমন পালটে গেছে আমার হাঁটার ধরন? কোথায় আমার সেই দৃষ্টিশক্তি? হায়! আমার বিচার শক্তিও আজ স্নেহবশত দুর্বল হয়ে গেছে? আমি তাহলে কে?
বিদূষক উত্তর দিল, আপনি লিয়ারের ছায়া।
রাজা বললেন, তবে যে লোকে বলছে আমি সেই তিন মেয়ের বাবা রাজা লিয়ার আর তুমি গনেরিল?
গনেরিল বলল, বয়সের কারণেই আপনার এই ভ্ৰাস্তিজনিত মানসিক দুর্বলতা। আপনি বৃদ্ধ ও সম্মানিত। সে কারণে আপনার বোঝা উচিত যে আপনার অনুগত একশো নাইটের আচরণ খুবই অশোভন। সব সময় তারা মদ খেয়ে বাজে কাজে লিপ্ত থাকে। গোটা রাজসভাটা এজন্য পরিণত হয়েছে এক বিলাস কেন্দ্রে। সে কারণে এখনই আমাদের উচিত ওই বিশৃঙ্খলাকারীদের অপমান করা। আমার কথা শুনুন বাবা। বয়স অনুযায়ী আপনার উপযুক্ত সঙ্গী আর অনুচরদের রেখে তাড়িয়ে দিন বাকিদের। আপনি না করলে বাধ্য হয়েই এ কাজ করতে হবে আমায়।
খুবই অপমানিত বোধ করলেন রাজা লিয়ার। তিনি বেজায় রেগে গেলেন এত বড়ো একটা অপমানের আঘাতে। চিৎকার করে তিনি বললেন, অকৃতজ্ঞ মেয়ে, আমি এ প্রাসাদ ছেড়ে চলে যাচ্ছি। ভুলে যেও না, আমার আরও সস্তান আছে।
গনেরিল, আমার লোকজনের উপর নিন্দনীয় আচরণ করছে আপনার অনুচরেরা।
এমন সময় প্রবেশ করল আলবেনি। কিন্তু তাকে দেখেও থামলেন না। রাজা। সজোরে প্রতিবাদ করে তিনি বললেন, গনেরিল, তুমি শুধু লোভী নও, মিথ্যেবাদীও বটে আমার অনুচরেরা সবাই জ্ঞানী ও গুণী। কোনওরূপ অশোভনীয় আচরণ করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। এরপর অনুতপ্ত রাজা নিজের মাথায় হাত চাপড়িয়ে বলতে লাগলেন, হায়! হায় কর্ডেলিয়ার চরিত্রের যে সমস্ত দোষ আমার চেতনাকে নষ্ট করে দেয়, তার প্রতি ঘৃণা আর তিরস্কারের মধ্য দিয়ে মুখামি প্রবেশ করে বিষাক্ত করে তোলে আমায়, সেই বোধকে আজ ধিক্কার জানাচ্ছে রাজা লিয়ার।
আলবেনি বলল, আপনি অযথা উত্তেজিত হবেন না মহারাজ। অনুগ্রহ করে শাস্ত হোন। আমি এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ নির্দোষ।
লিয়ার বললেন, হয়তো তাই। তবুও তোমায় অভিশাপ দিচ্ছি গনেরিল তোমার এই কদৰ্য নোংরা দেহ বঞ্চিত হবে সন্তান ধারণের গৌরব আর আনন্দ থেকে। আর সন্তান জন্মালেও তা হবে অদ্ভুত ধরনের। তার জন্য দুশ্চিন্তায় বিশ্ৰী হয়ে যাবে তোমার এই সুন্দর মুখ, শুকোবে না। চোখের জলও। তোমার পক্ষে তীক্ষ্ণ আর যন্ত্রণাদায়ক হয়ে উঠবে বিষাক্ত সাপের দাঁতের মতো সেই সন্তান। আমি চলে যাচ্ছি। কারণ আমায় যেতেই হবে।
রাজা লিয়ার চলে যাবার পর আলবেনি বলল, এর অর্থ কী গনেরিল? গনেরিল বলল, জেনে রেখ, এটা ওর বুড়ো বয়সের হঠকারিত।
লিয়ার আবার ফিরে এসে গনেরিলের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বললেন, তোমার এত দুঃসাহস যে আমার অনুমতি ছাড়াই পঞ্চাশ জন অনুচরকে এক সপ্তাহের মধ্যে প্রাসাদ ছেড়ে যাবার আদেশ দিয়েছ তুমি? ছিঃ গনেরিল, বৃদ্ধ বাবাকে অপমান করে তার চোখ থেকে অশ্রু ঝরানোর প্রবৃত্তি দেখে আমি যত না কষ্ট পেয়েছি, তার চেয়ে বেশি পেয়েছি লজ্জা। মনে রেখ, দয়া-মমতাময়ী আমার আর এক কন্যা আছে! এর শাস্তি সে তোমাকে দেবে! আমি অভিশাপ দিচ্ছি, অনুশোচনায় দগ্ধ হবে তোমার সমস্ত মন।
রাজা লিয়ারের পেছু পেছু চলে গেল কেন্ট ও অন্যান্য অনুচরেরা।
গনেরিল বলল তার স্বামীকে, দেখলে ওর ব্যবহারটা?
আলবেনি বলল, তোমার প্রতি আমার আকৃত্রিম ভালোবাসাই আমায় বলতে বাধ্য করছে যে কাজটা তুমি ঠিক করনি।
তুমি চুপ কর— বলে স্বামীকে থামিয়ে দিলেন গনেরিল। তারপর বিদূষককে বললেন, শয়তান, মুখ! তুমিও দূর হয়ে যাও বাবার সাথে। ওর বার্ধক্যজনিত এই ত্রুটিপূর্ণ ব্যবহার আরও বেশি প্রশ্রয় পেয়েছে অস্ত্ৰ-শস্ত্ৰ সুসজ্জিত একশো নাইটের শক্তিবলে, আর দীর্ঘদিন ধরে এ ধরনের অত্যাচার সহ্য করা নিশ্চয়ই আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
তোমার ভয় নিতান্তই অমূলক–বলল আলবেনি।
তা হয় হোক, বলল গনেরিল, আসলে ভয় থেকে মুক্ত হতে গেলে আগে থেকেই জীবন সম্পর্কে সচেতন হওয়া প্রয়োজন, নইলে ভবিষ্যতে সেখান থেকেই বীর বংশের বীজ উৎপন্ন হবার সম্ভাবনা থেকে যায়। যদি আমার বোন একশো নাইট সহ বাবাকে আশ্রয় দেয়, তাহলে— এই যে অসওয়াল্ড, লিখেছ সেই চিঠি? জানতে চাইল গনেরিল।
অসওয়াল্ড উত্তর দিল, হ্যাঁ, লিখেছি।
গনেরিল নির্দেশ দিল অসওয়াল্ডকে, তাহলে ঘোড়ায় চেপে এখনই এই চিঠি নিয়ে চলে যাও বোনের কাছে। আরও কিছু কারণ দেখিয়ে জোরদার করে তোেল আমার যুক্তিগুলিকে-যাতে সেও ভয় পায়! যাও, এবার চলে যাও। অসওয়াল্ড চলে যাবার পর আলবেনিকে উদ্দেশ করে। বলল গনেরিল, তুমি যত না দুর্বল তার চেয়ে বেশি বোকা।
স্ত্রীর মুখে একথা শুনে আলবেনি বলল, তুমি জান তো অনেক সময় অধিক লোকের দ্বারা ঠকে গিয়ে মানুষ বঞ্চিত হয় তার প্রাপ্যবস্তু থেকে।
তাহলে কী বলতে চাও তুমি? জানতে চাইলে গনেরিল।
আলবেনি তার উত্তরে বলল, কিছুই বলতে চাই না আমি। ভবিষ্যৎই প্রমাণ করবে সব কিছু।
কেন্টের হাতে একটা চিঠি দিয়ে লিয়ার বললেন তাকে, এই চিঠিটা তাড়াতাড়ি পৌঁছে দাও গ্লস্টারের হাতে। চিঠিতে যা লেখা আছে আর আমার মেয়ে যা জানতে চায়, ঠিক সেটুকুরই উত্তর দেবে, বেশি কিছু মোটেও বলবে না। এটা নিয়ে তাড়াতাড়ি চলে যাও। নইলে তার আগেই আমি গিয়ে পৌঁছাব সেখানে।
তাই হবে প্রভু বলল কেন্ট, আপনার আদেশ পালনের আগে আমি অন্য কিছুতে মন দেব না।
এবার বিদূষক বলল, সত্যি কথা বলার জন্য আমায় ক্ষমা করবেন মহারাজ। আপনার কন্যার আচরণ কী হবে সে তো আপনি ভালেই জানেন।
অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে লিয়ার বললেন, বলতো, কী হবে?
বিদূষক উত্তর দিল, দিদির মতোই উপযুক্ত হবে তার আচরণ। সোজাপথে না গিয়ে মানুষ যেমন ঘুরপথে গোপনীয় খবর সংগ্রহ করে, তেমনি মানুষের এক চোখ যাতে অন্য চোখকে দেখতে না পায় সেজন্যই ঈশ্বর ব্যবধান তৈরি করেছেন নাসিকা সৃষ্টির মাধ্যমে।
কর্ডেলিয়ার প্রতি আমার আচরণ ঠিক নয় তা আমি জানি, বললেন লিয়ার।
বিদূষক বলল, যাতে শামুকরা আশ্রয়হীন না হয় তাই একটি খোলা তৈরি আছে তাদের মাথা গোঁজার জন্য।
লিয়ার বললেন, ও কথা আর আমাকে মনে করিয়ে দিও না। জোর করে আমি কেড়ে নেব সব।
বিদূষক বলল, মহারাজ, বয়স বাড়ার আগেই আপনার এ বুদ্ধি হওয়া উচিত ছিল।
লিয়ার বললেন, দোহাই তোমাদের, আমাকে তোমরা পাগল করে দিওনা। হে ঈশ্বর! আমার বিবেক-বুদ্ধিকে চঞ্চল করে তুলোনা তুমি। আমি পাগল হতে চাইনা! না, কখনই না।
০২.
সুপ্ৰভাত কিউরান, বলল এডমন্ড।
প্রতি উত্তরে বলল কিউরান, সুপ্ৰভাত এডমন্ড। আমি এইমাত্রই এলাম। আপনার বাবার কাছ থেকে। আমি আগে থেকেই তাকে সতর্ক করে দিয়েছি ডিউক অফ কর্নওয়াল ও রিগানের আসার ব্যাপারে। ভালো কথা, আপনি কি শুনেছেন একটা খবর?
কী খবর কিউরান? জানতে চাইল এডমন্ড।
কিউরান বলল, আলবেনি আর কর্নওয়ালের মধ্যে বিবাদের সৃষ্টি হয়েছে। উভয়েই গোপনে যুদ্ধের আয়োজন করছেন।
না, সে কথা শুনিনি তো, বলল এডমন্ড।
কিউরান বলল, এবার তাহলে আমি চলি স্যার।
ঠিক আছে, তুমি এস, এডমন্ড বলল।
কিউরান চলে যাবার পর মনে মনে চিস্তা করতে লাগল এডমন্ড, ডিউক আসছেন, সে তো খুব ভালো কথা। ভাগ্যের উপর নির্ভর এবার আমার পরিকল্পনামাফিক কাজটা তাড়াতাড়ি শেষ করে ফেলি। গলাটা একটু উঁচু করে ভাইকে বললেন তিনি, নেমে এস, একটা কথা আছে তোমার সাথে। এই অন্ধকারের মাঝে তাড়াতাড়ি পালিয়ে যাও তুমি। বাবা জানতে পেরেছেন তুমি কোথায় লুকিয়ে আছি। ঐ বাবার পায়ের শব্দ শুনতে পাচ্ছি আমি। তলোয়ার বের করে আত্মহত্যার ভান করি। ও রে কে আছিস; আলো আন। যাও, শীঘ্ৰ পালিয়ে যাও।
এডমন্ড চলে যাবার পর নিজের চক্রান্তকে আরও যুক্তিপূৰ্ণ করে তুলতে নিজেই আঘাত করল নিজেকে। তারপর সেই রক্তাক্ত হাত নিয়ে চিৎকার করে বলে উঠল, কে আছ, বাঁচাও আমাকে। বাবা, কোথায় তুমি?
ব্যগ্ৰকণ্ঠে বলে উঠলেন গ্লস্টার, কী হয়েছে, এডমন্ড? এত রক্ত কেন তোমার হাতে?
এডমন্ড বলল, এই অন্ধকারের মাঝে দাঁড়িয়ে আপনমনে কী সব যেন বলছিল এডগার। আপনার শব্দ শুনেই সে পালিয়ে গেল এই রাস্তা দিয়ে।
কোথায় পালাবে সে শয়তানটা! ভাবেই হোক তা থেকে খুঁজে বের কর তোমরা — বলে অনুচরদের নির্দেশ দিলেন গ্লস্টার। তারপর জানতে চাইলেন এডমন্ডের কাছে, তোমার কাছে কেন সে এসেছিল?
এডমন্ড উত্তর দিলে, সে আমার কাছে এসেছিল। আপনাকে হত্যা করার উপদেশ দিতে। কিন্তু আমি মন থেকে কিছুতেই সায় দিইনি। পিতৃহত্যার মতো জঘন্য কাজে। তাই সে তলোয়ার দিয়ে আঘাত করে আমায়। যখন আমি তার অসৎ উদ্দেশ্যের জোর প্রতিবাদ করছি আর প্রতি আক্রমণে উদ্যত হয়ে সাহায্যের জন্য চিৎকার করছি, ঠিক তখনই সে পালিয়ে গেল ভয় পেয়ে।
স্নেহশীল পিতা কিন্তু বুঝতে পারল না এডমন্ডের চালাকি, উপরন্তু তার প্রতি করুণায় বিগলিত হয়ে তিনি বললেন, রাজার আদেশ নিয়ে আমি সারা রাজ্যে ঘোষণা করে দেব যে তাকে ধরে আনতে পারবে, তাকে প্রচুর পুরস্কার দেওয়া হবে। আর তার আশ্রয়কারীকে দেওয়া হবে প্ৰাণদণ্ড।
এডগারের প্রতি পিতার অবিশ্বাসকে আরও জোরদার করার জন্য বলল এডমন্ড, বাবা, সে আমায় ভয় দেখিয়ে গেছে। যদি আমি এই ষড়যন্ত্রের কথা প্ৰকাশ করি, তাহলে সে বলবে। আমিই নাকি সেই ষড়যন্ত্রের কারণ। সে নাকি আমার প্ররোচনাতেই পিতৃসম্পত্তি গ্ৰাস করার ষড়যন্ত্র করেছে। তার মৃত্যুতে আমার পক্ষে সম্পত্তি লাভ সহজ হবে জেনেই আমি নাকি মৃত্যুমুখে ঠেলে দিয়েছি।
গ্লস্টার বললেন, কোনও ভয় নেই তোমার। ওর হাতের লেখাই প্রমাণ করবে ওর ষড়যন্ত্রের কথা। ঐ শোন মহামান্য ডিউকের আগমনের বাদ্যধ্বনি। শয়তানটা যাতে আমার রাজ্য ছেড়ে পালিয়ে যেতে না পারে। সেজন্য সমস্ত শহর ও বন্দরের পথ বন্ধ করে দেব আমি। রাজ্যের সর্বত্র পথে-ঘাটে ওরা ছবি ছাপিয়ে দেব আমি। সন্তানের উপযুক্ত কাজই করেছ তুমি। ওকে আর আমি সস্তান বলে স্বীকার করব না। আমার একমাত্র সন্তান তুমিই আর সমস্ত সম্পত্তি আমি তোমাকেই দিয়ে যাব।
এ সময় কর্নওয়াল প্রবেশ করে বললেন গ্লস্টারকে, কেমন আছ বন্ধু? ভারি একটা আশ্চর্য খবর শুনলাম। এখানে এসে।
এ কথা সত্যি হলে অপরাধীকে শাস্তি দেওয়া কঠিন হবে–বলল রিগান, আচ্ছা, বাবার ইচ্ছা অনুযায়ী কি ওর নাম রাখা হয়েছিল?
সে কথা বলতে আমার বুক দুঃখে বিদীর্ণ হয়ে যাচ্ছে ম্যাডাম–বলল গ্লস্টার।
রিগান বলল, আচ্ছা, ওকি আমার বাবার উচ্ছঙ্খল নাইটদের মধ্যে একজন?
এডমন্ড জানাল, হ্যাঁ ম্যাডাম, ও ছিল তাদেরই একজন।
একথা শুনে রিগান বলল, এবার বেশ বুঝতে পারছি আমি। বৃদ্ধ পিতাকে হত্যা করতে ঐ শয়তান নাইটরাই প্ররোচিত করেছে তাকে। এডগারের সাথে সাথে তাহলে তারাও ভোগ করতে পারবে সম্পত্তি। আজ সন্ধ্যায় আমি দিদির পাঠানো একটা চিঠি পেয়েছি। যাতে এদের সম্পর্কে আমায় সাবধান করে দেওয়া হয়েছে। সে চিঠিতে দিদি লিখেছে ওরা আসার আগেই আমি যেন বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাই।
কর্নওয়াল বলল, তুমি ঠিক কথাই বলেছ প্রিয়তম। আর এডমন্ড, যথার্থ পুত্রের মতোই আন্তরিক তোমার কর্তব্যবোধ।
আনন্দে গদগদ স্বরে উত্তর দিল গ্লস্টার, ঠিক সে কারণে সে আহত হওয়া সত্ত্বেও সমঝোতা করেনি। অন্যায়ের সাথে।
কর্নওয়াল বলল, ওর খোঁজে আপনি চর পাঠান চারিদিকে। এ ব্যাপারে সবরকম সাহায্য আপনি পাবেন আমার কাছ থেকে। আর এডমন্ড, আমাদের এখন প্রয়োজন তোমার মতো সৎ, কর্তব্যপরায়ণ, বিশ্বাসী, বীর যুবকের। আমাদের আন্তরিক ইচ্ছা তুমি সহচর রূপে আমাদের কাছাকাছি থাকো।
এই যদি আপনাদের ইচ্ছা হয়, তাহলে সততা আর বিশ্বাসযোগ্যতার গুণে আপনাদের স্নেহভাজন হতে পেরে আমি ধন্য মনে করছি নিজেকে, বলল এডমন্ড।
আনন্দের সাথে গ্লস্টারও সায় দিলেন তার কথায়।
রিগান বলল, হে মাননীয় আর্ল অফ গ্লস্টার। আপনি আমাদের পুরনো বন্ধু। এই অন্ধকার রাতে আমরা এখানে এসেছি একটা গুরুতর বিষয়ে আপনার পরামর্শ নিতে। আমাদের পিতাকন্যার বিরোধের ব্যাপারে কোনটি গ্রহণযোগ্য সে ব্যাপারে আপনার সিদ্ধান্ত জানালে বাধিত হব।
আগে আমার বাড়িতে চলুন। তারপর সবাই মিলে না হয় পরামর্শ করা যাবে–বলল গ্লস্টার।
রিগান বলল, বেশ, তাই চলুন।
অসওয়ান্ড বলল, নমস্কার বন্ধু। আমার প্রতি যদি তোমার বিন্দুমাত্ৰও ভালোবাসা থাকে, তবে সে ভালোবাসার দোহাই, দয়া করে আস্তাবলটা দেখিয়ে দাও আমাকে।
কেন্ট বলল, তোমার প্রতি আমার বিন্দুমাত্রও ভালোবাসা নেই।
তাতে আমার কিছু এসে যায় না, উত্তর দিল অসওয়ান্ড।
লিপসবেরি পাউন্ডে গেলে কিন্তু গ্রাহ্য করাটা প্রয়োজন হবে, বলল কেন্ট।
অসওয়াল্ড বলল, আমার সাথে এভাবে ঝগড়া করছি কেন? আমি মোটেও চিনি না তোমাকে।
তবে আমরা কিন্তু দুজনে দুজনকে চিনি। তুমি হচ্ছ.পরান্নে পালিত একটা নিঃস্ব, দুৰ্বত্ত, কাপুরুষ ক্রীতদাস। মনে নেই কদিন আগে আমারই আঘাতে রাজার সামনে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছিলে তুমি। এবার অস্ত্র ধর শয়তান— চিৎকার করে বলে উঠল কেন্ট।
অসওয়াল্ড বলল, চলে যাও তুমি। আমার কোনও শত্রুতা নেই তোমার সাথে।
রাগের সাথে কেন্ট বলতে লাগল, তোমার একমাত্র দোষ এই যে তুমি রাজার বিরুদ্ধে উদ্ধত, ঘৃণিত গনেরিলের লেখা চিঠি বয়ে নিয়ে এসেছী। পাঁজি শয়তান, তলোয়ার না বের করলে তোমার পা দুটোই কেটে নেব আমি।
ভয় পেয়ে অসওয়াল্ড যতই সাহায্যের জন্য চিৎকার করতে লাগল, ছদ্মবেশী কেন্ট ততই আঘাত করতে লাগল তাকে।
খোলা তলোয়ার হাতে ঘরে ঢুকে এডমন্ড ছাড়িয়ে দিল তাদের দুজনকে। ত্রুদ্ধ কেন্ট বলতে লাগল, লড়াই করতে ভয় পোচ্ছ কেন হে ছোকরা!
অসওয়াল্ড বলল, যদি প্ৰাণের মায়া না থাকে। তবে ভয় পাচ্ছিস কেন? আমাদের উভয়ের মধ্যে লড়াইয়ের কারণটাই বা কী?
রিগান বলল, এদের চিনতে পেরেছি আমি। এরা আমার বোন ও বাবার দূত।
তাহলে তোমাদের মধ্যে ঝগড়া বাঁধিল কেন? আশ্চর্য হয়ে জানতে চাইল কর্নওয়াল।
অসওয়াল্ড বলল, এই বুড়োটা বেজায় পাজি। শুধু ওর সাদা দাড়ির খাতিরে আমি ছেড়ে দিয়েছি। ওকে।
ফের মিথ্যে কথা, গজে উঠে বলল কেন্ট।
চুপ কর, তুমি কি ভদ্রতাবোধও ভুলে গেছ? বলল অসওয়ান্ড।
কর্নওয়ালকে উদ্দেশ করে কেন্ট বলল, স্যার, এ ধরনের লোকেরা মানুষের ভেতরের কোমল ও পবিত্র সম্বন্ধের অবসান ঘটায়। ভূতের মতো এরা প্রভুকে নির্মল তোষামোদ করে তাকে আরও ভয়ংকর করে তোলে। আবার হাসছিস; মৃগী রোগীর মতো তোর ওই বিবৰ্ণ মুখটায় নেমে আসুক অভিশাপ। এর মতো বদমাশ লোক আমি কখনও দেখিনি।
ও বদমাস কীসে হল? জানতে চাইল কর্নওয়াল।
ওর মুখই তার প্রমাণ, উত্তর দিল কেন্ট।
অসওয়াল্ড বলল, স্পষ্টবাদী হবার দরুন। এ জাতীয় লোকেরা সরল হলেও খুব ভয়ানক বা ধূর্ত হয়, সে কথা আমি জানি।
আমার কিন্তু আপনার প্রতি সেরূপ কোনও বদমতলব নেই, বলল কেন্ট, আমি সরল তবে প্ৰতারক নই। আমার মতো সাধারণ শ্রেণির সরল ও সৎ লোক কখনও পর হয় না।
অসওয়ান্ড বলল, ওর বিরুদ্ধে আমার কোনও ব্যক্তিগত অভিযোগ নেই প্ৰভু। তবে কিছুদিন আগে ভুল বুঝে রাজা লিয়ার আমায় আঘাত করলে এই লোকটাও আমাকে আঘাত করে পেছন দিক থেকে। রাজার প্রশংসা কুড়েবার জন্য এই হীন জঘন্য লোকটা আমায় যাচ্ছেতাই গালাগাল আর অপমান করে।
রেগে গিয়ে অসওয়াল্ড আদেশ দিলেন তার অনুচরদের, বদমাশ মিথ্যেবাদী শয়তান এই বুড়োটার দুপায়ে কাঠের খুটো পরিয়ে দাও। ওকে আমি এমন শাস্তি দেব যে-
স্যার, আমি কিন্তু রাজার দূত। রাজদূতের পায়ে খুঁটো পরালে পরোক্ষভাবে রাজারই অপমান হবে, বলল কেন্ট।
রিগান বলল, ও সব কিছু শুনতে চাই না আমি। পায়ে খুঁটো বেঁধে ও দুপুর পর্যন্ত, না রাত পর্যন্ত থাকবে।
তাহলে এই সেই অন্যতম বদমাশ, যার কথা বলেছিল। গনেরিল, বলল কর্নওয়াল।
গ্লাস্টর বলল, মাননীয় ডিউক, চোরের মতো কঠিন শাস্তি আপনি ওকে দেবেন না। ওর প্রভুর উপরেই আপনি ছেড়ে দিন ওর শাস্তির ভার। রাজদূতকে এভাবে অপমান করলে রাজা রুষ্ট হবেন আপনার উপর।
রিগান বলল, কিন্তু মাননীয় গ্লস্টার, ওকে শাস্তি না দিলে যে আমার অনুচরদের প্রতি অন্যায় করা হবে। তাই আপনার অনুরোধ রক্ষা করা আমার পক্ষে সম্ভবপর নয়। এবার কর্নওয়ালের দিকে ফিরে সে বলল, চলুন, আমরা সবাই এখান থেকে চলে যাই।
সবাই চলে যাবার পর গ্লস্টার বলল কেন্টকে, আমি অবশ্য ডিউককে অনুরোধ করব তার এই অন্যায় খেয়ালের পরিবর্তনের জন্য।
না স্যার, আপনি করবেন না, বলল কেন্ট, এই সুযোগে আমি কাটিয়ে দেব পথের ক্লান্তি।
গ্লস্টার চলে যাবার পর আপন মনে বলতে লাগল কেন্ট, হে মুখ, আমার এ চিঠি পাঠ করতে সাহায্য করুক তোমার প্রখর কিরণ রাশি। আমি কর্ডেলিয়াকে বিশদভাবে জানিয়েছি আমার সমস্ত কার্যকলাপ। আশা করছি যে কোনও মুহূর্তে তিনি এসে উদ্ধার করবেন আমাদের মহান রাজাকে। হে আমার দুনিয়ন, দীর্ঘদিনের পথশ্রমে তোমরা যে ধ্বস্ত ও ক্লাস্ত তা আমি জানি। এবার সময় এসেছে তোমাদের ভালোমতন বিশ্রাম নেবার। হে সৌভাগ্যের দেবী, তুমি আমাদের উপর বুলিয়ে দাও তোমার প্রসন্ন দৃষ্টি।
ঘরে ঢুকে পাগলের মতো বিড়বিড় করে বলতে লাগল এডগার, ভাইকে বিশ্বাস করে আজ আমার এই অবস্থা। পলাতক আসামীর মতো ঘৃণ্য পোশাকে,গরিবের মতো নগ্নপদে, রুক্ষ, অবিন্যস্ত চুল নিয়ে, গাছের কোটরে দিন যাপন করে, ছদ্মবেশে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে আমাকে। আমার অবস্থােটা সেই গরিবভিখারি টম টার্লিগদের মতো, যারা নিরাশ্রয়–পরের উপর নির্ভরশীল। তাদেরও কিছু মূল্য আছে, কিন্তু আমার তাও নেই।
আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলেন রাজা লিয়ার, এতক্ষণে তো আমার অনুচরদের এখানে এসে যাবার কথা, অথচ তুমি বলছি কাল রাতেই হঠাৎ এ বাড়ি ছেড়ে কোথায় যেন চলে গেছে আমার মেয়ে-জামাই। হঠাৎ তার চোখে পড়ল বন্দি অবস্থায় সামনে দাঁড়ান কেন্টকে। বিস্মিত হয়ে তিনি বললেন, এরূপ নির্মমভাবে কে তোমায় বন্দি করেছে?
বিদূষক বলল, এ ধরনের যন্ত্রণাদায়ক কাঠের লাগাম কেবল পরানো হয় ঘোড়ার মাথায় কুকুর, ভালুকের গলা নতুবা রাজদ্রোহীর পায়ে।
লিয়ার জানতে চাইলেন, বল, কে তোমায় আটকে রেখেছে। এ অবস্থায়?
কেন্ট উত্তর দিলে, প্ৰভু, সে অপরাধী আপনার মেয়ে-জামাই।
লিয়ার বললেন, না, না, এ কখনই হতে পারে না। ঈশ্বরের নামে শপথ নিয়ে বলছি, এরূপ ভয়ংকর কাজ করার সাহস তাদের কখনই হবে না।
কেন্ট বলল, হে প্ৰভু, আপনার প্রতি শ্ৰদ্ধা নিয়েই বলছি, তারাই করেছে এ কাজ।
লিয়ার বললেন, হায় ভগবান! এত মানুষ খুন করার চেয়েও জঘন্য কাজ। আমি তো তোমায় পাঠিয়েছিলাম। শুধু একটা চিঠি পৌঁছে দিতে। কিন্তু তুমি এমন কী করেছ যার জন্য তারা এই কঠিন
কেন্ট বলল, আমার চিঠি পাবার পর পরই গনেরিলের পক্ষ থেকে একজন দূত এসে তাকে চিঠি দিল একটা। দ্বিতীয় চিঠিটা পড়ার পরই আমার প্রতি চরম অবজ্ঞা দেখিয়ে তিনি চলে গেলেন ঘোড়ায় চড়ে। ওরা চলে যাবার পর আমি লোকটাকে চিনতে পেরে রাগের মাথায় তলোয়ার বের করে হত্যা করতে যাই ওকে। ওর চিৎকার শুনে আপনার মেয়ে-জামাই ফিরে এসে এই কঠিন শাস্তি দিয়েছেন আমায়।
বাবার টাকা-পয়সা কমে যাবার সাথে সাথে সস্তানের ভালোবাসাও ওঠা-নমা করে–বলল বিদূষক।
গভীর দুঃখে ভেঙে পড়ল রাজার লিয়ারের মন। দুঃখের সাথে তিনি বললেন, তোমরা দুজনে শান্ত হও। এভাবে অস্থির করে তুলোনা আমায়! আমি মিনতি করছি, তোমরা দুজনে শান্ত হও। কিন্তু আমার মেয়ে কোথায় গেল কেন্ট? বলে ফিরে গেলেন তিনি। তিনি ফিরে যাবার পর কেন্ট উৎসুক হয়ে বলল বিদূষককে, আচ্ছা, রাজার অন্যান্য অনুচরেরা কোথায় গেল?
বিদূষক হেঁয়ালি করে বলল, একটা পিঁপড়েও শীতকালে কাজ করে না। যার চোখ আছে রাস্তায় সে কখনও সোজাসুজি হাঁটে না। আর যে বুদ্ধিমান, সে কখনও পাহাড়ের ঢালু পথ বেয়ে নেমে আসা চাকার গতি রোধ করে সহজে বিপদে পড়তে চায় না। আর লোভী ও স্বার্থপর লোকেরা বিপদের গন্ধ পেলেই বন্ধুকে ত্যাগ করতে দ্বিধা করে না। কিন্তু আমি তো সামান্য একজন বিদূষক মাত্র। কাজেই সে পথ যারা অনুসরণ করেছে তারা আমার পক্ষে উপযুক্ত নন।
এ কথা শুনে চমৎকৃত হয়ে বললেন কেন্ট, ভারি সুন্দর তোমার উপমাগুলি।
গ্লস্টারের সাথে একত্র ঢুকে আপন মনে বলতে লাগলেন লিয়ার, মিথ্যে কথা, অসুস্থতার ভান করে তারা বিদ্রোহ করেছে আমার বিরুদ্ধে। এবার বলে দাও আমি কী করব?
উঃ এত বড়ো অকৃতজ্ঞ ওরা! বলে দাও গ্লস্টার, রিগান আর কর্নওয়ালকে— আমার হুকুম, তারা যেখানেই থাকি যেন এখানে চলে আসে। আর সেই রাগী ডিউককেও বলে দিও, সে যেন এই রাগী বৃদ্ধ স্নেহময় সম্রাটের আদেশ অবিলম্বে পালন করে, নইলে.। তারপর যে কী ভেবে তিনি বললেন, না, না, আমি একী বলছি! হয়তো সে সত্যিই অসুস্থ। আর এত সবাই জানে যে মানুষ অসুস্থ হলে তার পূর্বের স্বভাবের কিছু পরিবর্তন হয়। কাজেই আমার মেজাজকে সংবরণ করে আমি অপেক্ষা করব তাদের সুস্থতার জন্য।
এরপর হঠাৎ কেন্টের দিকে তাকিয়ে পালটে গেল। লিয়ারের মনোভাব–হায় কী নির্বোধি আমি।আমার এই বৃদ্ধ ভূত্যের অবস্থা দেখেই বুঝতে পারছি,ইচ্ছাকৃত ভাবে চলে গেছে তারা। পূর্ব পরিকল্পনা মাফিক এটা তাদের একটা চাল। কে আছ, ডিউক ও তার স্ত্রীকে শীঘ্ৰ ডেকে নিয়ে এস এখানে। তারা স্বইচ্ছায় না এলে, আমি নিজে গিয়ে তাদের টেনে আনিব এখানে।
আপনি এত উত্তেজিত হবেন না প্ৰভু। আমি যাচ্ছি—বলে চলে গেলেন গ্লস্টার।
লিয়ার বলতে লাগলেন, হে আমার মন! এত সহজেই তুমি ধৈর্যহারা হয়ে চঞ্চল করে তুলো না। আমাকে। রাজা লিয়ার করুণ মিনতি জানাচ্ছে তোমার কাছে, তুমি শান্ত হও, থামো।
বিদূষক বলল রাজাকে, গরম কড়াইতে গোটা মাছ ছেড়ে দিয়ে মেয়েরা যেমন তার মৃত্যু কামনা করে, ঘোড়া তৈলাক্ত জিনিস খায় না জেনেও যে নির্বোধি তার বিচালিতে তেল মেশায়, তেমনি আপনিও নির্বোধের মতো বৃথা চেষ্টা করছেন আপনার ক্রোধকে প্রমাণ করতে।
রিগান বলল, বাবা আপনি আমার শ্রদ্ধা নেবেন।
পূর্বের সবকিছু ভুলে গিয়ে লিয়ার বললেন, আমি জানি তোমরা উভয়েই খুশি হয়েছ আমি আসায়।
রিগান বলল, প্রিয় বাবা, আমার বিবেচনায় সে যদি আপনার উদ্ধত উচ্ছঙ্খল নাইটদের আচরণের প্রতিবাদ করে থাকে, তাহলে সে ঠিকই করেছে। আপনার এই মানসিক অসুস্থত। আর দোষহীন দুর্বলতা, যা বার্ধক্যের কারণে হয়েছে বলে আপনি মনে করেন, তার একমাত্র প্রতিকার কারও কাছে অনুগত হয়ে থাকা। তাই বলছি আপনি অন্যায় স্বীকার করে ফিরে যান তার কাছে।
অবাক হয়ে বললেন লিয়ার, কী বলছি, আমি ক্ষমা চাইব? তুমি কি আমায় দীন-হীন ভিখারির বেশে দেখতে চাও? এই বলে নতজানু হয়ে রাজা বললেন, আমি করজোড়ে তোমার কাছে পোশাক, খাদ্য এবং আশ্রয় ভিক্ষা চাইছি! ভেঙে পড়লেন রাজা লিয়ার।
রিগান বলল, না সেটা সম্ভব নয়।
লিয়ার বললেন, আমার অনুচরের সংখ্যা কমিয়ে দেবার কথা বলে গনেরিল অপমান করেছে আমায়। রূপ আর শক্তির গর্বেই সে সাহস পেয়েছে। এরূপ কাজ করার। সে ধ্বংস হয়ে যাবে ভগবানের অভিশাপে।
কিন্তু তুমি এক মধুর স্বভাবের মেয়ে। আমার শাখ-আহ্রদ বন্ধ করে দিয়ে আমায় অপমান করতে তুমি সাহসী হবে না। আর সে ইচ্ছাও তোমার নেই, তা আমি জানি। আমি তোমার বাবা আর তুমি আমার অর্ধেক সম্পত্তির উত্তরাধিকারিণী— সেকথা তুমি নিশ্চয়ই ভুলে যাবে না। এই কথা বলে থেমে গেলেন রাজা।
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর কেন্টের কথা মনে পড়ল রাজা লিয়ারের। তিনি বললেন, আমি জানতে চাই কার এত দুঃসাহস যে আমার দূতের পায়ে এই যন্ত্রণাদায়ক কাঠের খুঁটোটা পরিয়েছে?
এমন সময় দূর থেকে জোরদার গলার আওয়াজ শুনতে পেয়ে কর্নওয়াল জিজ্ঞেস করল রিগানকে, কে এল?
বোধ হয় আমার দিদি। তারই আসার কথা ছিল, বলল রিগান। তারপর অসওয়াল্ডকে আসতে দেখে জিজ্ঞেস করল, দিদি কি আসছেন?
অসওয়াল্ডকে দেখেই চিৎকার করে উঠলেন রাজা লিয়ার, আমার সামনে থেকে তুই দূর হয়ে যা ঘৃণ্য গনেরিলের প্রশ্রয় পাওয়া পাজি শয়তান চাকর কোথাকার! তারপর রিগানকে বললেন, আমার দূতের পায়ে কে খুঁটা পরিয়েছে। আশা করি তুমি তা জান না। হে ঈশ্বর, মানুষের প্রতি তোমার মমতা সাহায্য করুক আমায়। হায় রিগান, এই ঘৃণ্য নারী গনেরিল তোমার এত প্রিয়, যে তুমি ওর হাত ধরেছ।
উদ্ধতভাবে উত্তর দিল গনেরিল, অবুঝের মতো তোমার কাজ-কৰ্মই বিচারের শেষ কথা।।।
লিয়ার বললেন, আমি নিজেই আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছি। আমার সহ্যশক্তির সীমা দেখে। বল, কে আমার দূতের এ অবস্থা করেছে?
আমি করেছি, বলল কর্নওয়াল, কিন্তু তাতেও ওর উপযুক্ত শাস্তি হয়নি।
অবাক হয়ে বললেন লিয়ার, তুমি, তুমি করেছ এ কাজ?
রিগান বলল, বাবা, আপনি বৃদ্ধ হয়েছেন, আগের মতো আর সবল নন। এখন আপনার উচিত ভাগাভাগি করে একবার আমার কাছে অন্যবার দিদির কাছে গিয়ে থাকা। বর্তমান অবস্থায় আমাদের পক্ষে সম্ভব নয় আপনাকে আশ্রয় দেওয়া।
লিয়ার বললেন, তার চেয়ে আমি বন্য জন্তুর সাথে বাস করব, সহ্য করব দারিদ্র্যের চরম কশাঘাত, প্রয়োজনে আশ্রয় ভিক্ষা চাইব ফ্রান্সের রাজার কাছে–তবুও আমি সেখানে যাব না অনুচরদের ছেড়ে। সেরূপ পরিস্থিতি হলে আমি বরং ক্রীতদাসটার অবশ্য হয়ে থাকব, তবুও সেখানে যাব না। আশা করি তুমি আমায় সেরূপ দুর্ভাগ্যের মুখে ঠেলে দেবে না। রিগান। আমার দেহের দুষ্ট ক্ষত হলেও আমি তো জানি তুমি আমারই মেয়ে। আমি তোমায় অভিশাপ দেব না। নিজের ভুল একদিন তুমি নিজেই বুঝতে পারবে।
আমি বরঞ্চ আমার অন্য মেয়ে রিগানের কাছেই থাকব। আর সাথে রইবে একশোজন নাইট।
রিগান বলল, আমার কিন্তু ইচ্ছে নয় বাবা যে আপনি আমার কাছে থাকেন। বুড়ো হয়ে আপনার জ্ঞান-গাম্যি সব লোপ পেয়েছে। একমাত্র আমার দিদিই সঠিক জানে সে কী করেছে।
লিয়ার বললেন, তোমার কি মনে হয় তুমি যা বলছি তা সত্য?
রিগান বলল, হ্যাঁ, আমি সত্যি কথাই বলছি। খুব বিপদের দিনেও পাঁচিশজন লোক রাখার কোনও অর্থ হয় না। আর মালিকানা যেখানে ভাগ হয়ে গেছে, সেখানে এত লোকের মাঝে বিশৃঙ্খলা দেখা দেওয়াটাই তো স্বাভাবিক।
এবার গনেরিল আর রিগান দুজনেই একসাথে বলল, বাবা, আমাদের সাথে না থাকার কোনও যুক্তিসঙ্গত কারণই আমরা খুঁজে পাচ্ছি না। আমরা তীক্ষ নজর রাখব যাতে আপনার প্রতি কোনও অন্যায় না হয়।
রিগান বলল, পাচিশ জনের বেশি নাইট কিন্তু আপনি সাথে রাখতে পারবেন না।
লিয়ার বললেন, ওরে অকৃতজ্ঞ মেয়েরা, তোরা কি ভুলে গেছিস যে সব সম্পত্তি আমারই?
আপনার যথাসর্বস্ব। আপনি দান করেছেন আমাদের, উত্তর দিল রিগান।
লিয়ার বললেন, আমি চাই না সে সব সম্পত্তি ফেরত নিতে। কিন্তু কোন সাহসে তোরা বলছিস আমার অনুচরের সংখ্যা কমাতে?
উদ্ধতভাবে আবারও তার মতামত ব্যক্ত করল রিগান।
ভেতরে ভেতরে রেগে গেলেও অসহায়ভাবে বললেন রাজা, উপরে ভালোমানুষির নিচে তোর এই নীচ মনের কথা আগে জানা ছিল না। গনেরিল, একশোর অর্ধেক পঞ্চাশ হলেও তা কিন্তু পাঁচিশের দ্বিগুণ। আজ থেকে তোর প্রতি আমার ভালোবাসাও দ্বিগুণ হল, আমি তোর কাছেই থাকব।
গনেরিল বলল, এখানে যা লোক আছে তার ডবল লোক সেখানে সেবা করবে আপনার। কিন্তু আপনার অনুচরদের সেখানে নিয়ে যাবার কোনও দরকার নেই।
লিয়ার বললেন, কেউ জানে না, প্রয়োজনের সীমা কোথায়। শীতনিবারণের জন্য প্রয়োজনীয় পোশাক থাকা সত্ত্বেও যেমন তুমি অতিরিক্ত কিছু পরেছ, তেমনি মনে রেখ প্রয়োজনের অতিরিক্ত যা কিছু মানুষকে পশুদের চেয়ে আলাদা করে তা হল সহনশীলতা। এই সহনশীলতাই এখন আমার দরকার। হে ঈশ্বর, তুমি করুণা করে এই বুড়ো লোকটির সহ্যের সীমা বাড়িয়ে দাও। তোমার চক্রান্তেই যদি আমার মেয়েদের মন বিষিয়ে ওঠে তাহলে তোমার কাছে আমার মিনতি, চোখের জলে আমায় নাভিজিয়ে সাহায্য কর আমার রাজ্যকে জ্বলে উঠতে। তাই কাঁদব না। আমি, ফেলব না চোখের জল। এই ঝড়জলের মাঝে যদিও আমায় আশ্রয়হীন হয়ে বাইরে বেরিয়ে যেতে হবে, তবুও কেঁদে কেঁদে আমি ভারাক্রাস্ত হতে দেব না। আমার মনকে। সব কষ্ট সহ্য করব আমি। কী বোকা আমি। এই অসহ্য যাতনা পাগল করে তুলেছে আমায়–বলেই ছুটে বেরিয়ে গেলেন রাজা। সেই সাথে গ্লস্টার ও বিদূষকও চলে গেলেন সে স্থান ছেড়ে।
রিগান বলল, এই ছোটো বাড়িটাতে একসাথে থাকার জায়গা হত না বুড়ো আর তার অনুচরদের।
সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের আশা জলাঞ্জলি দিয়ে এই ঝড়ের রাতে দুর্ভোগ পোহাবার জন্য দায়ী তার নিজের বোকামি, বলল গনেরিল।
রিগান বলল, লোকজন ছাড়া তার নিজের ঢোকার ব্যাপারে তো কোনও বাধা ছিল না।
নিশ্চয়, বলল গনেরিল; কিন্তু গ্লস্টারকে দেখছি না কেন?
কর্নওয়ালের ডিউক বলল, তিনি গেছেন রাজার সাথে। আবার ফিরে আসবেন।
এ সময় গ্লস্টার ফিরে এসে বলল, রাগে পাগল হয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে চলে যেতে চান রাজা।
কোথায়? জানতে চাইল রিগান।
গ্লস্টার উত্তর দিলে, জানি না।
তার চলে যাওয়াই উচিত, বলল অসওয়াল্ড।
সায় দিয়ে বলল গনেরিল, তাকে ফিরে আসার জন্য অনুরোধ করা আমাদের উচিত নয়।
কিন্তু বিষণ্ণতার ছায়া পড়ল গ্লস্টারের মুখে। তিনি বললেন, একেই এই ঝড়-জলের রাত, তায় ঘন অন্ধকার। এর মধ্যে কী করে বাইরে যাবেন তিনি?
অমনি তাড়াতাড়ি বলল রিগান, একগুয়ে লোকদের স্বভাবই এই। আর গুণের দিক দিয়ে ওর সঙ্গী-সাথীরা আরও এককাঠি উপরে। যাইহোক, দরজাটা দিয়ে দাও যাতে তারা কেউ ঢুকতে না। পারে।
চিৎকার করে জানতে চাইল কেন্ট, এই দুর্যোগপূর্ণ রাতে কে ওখানে?
উত্তর এল, আমি ওই লোক যার কাছে প্ৰচণ্ড ঝড় কোনও নতুন কথা নয়।
কেন্ট বলল, গলা শুনে আমি তোমায় চিনতে পারছি না। তুমি তো রাজার অনুচর। তাহলে বল রাজা কোথায়?
রাজানুচর বলল, পাগল হয়ে তিনি আজ ছুটে বেড়াচ্ছেন গুহায় গুহায়। এই পৃথিবীটাকে ধ্বংস করে ফেলার জন্য তিনি ব্যথিত হৃদয়ে অনুরোধ করছেন সমুদ্রের জলরাশিকে। প্রবল ঝড়বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে দুহাতে মাথার চুল উপরে তুলে বিপদের বাতাবরণকে উড়িয়ে দিয়ে তিনি মেতে উঠেছেন এক বিকৃত বীভৎস খেলায়। শুধুমাত্র বিদূষককে সাথে নিয়ে অনবরত চিৎকার করে চলেছেন তিনি।
বিদূষক ছাড়া আর কি কেউ তার সাথে নেই? জানতে চাইল কেন্ট।
না, আর কেউ নেই। শুধু সেই চেষ্টা করছে হালকা হাসির মধ্যে দিয়ে রাজার শোক কমিয়ে দেবার, উত্তর দিল অনুচর।
কেন্ট বলল, শোন, তুমি আমার বিশেষ পরিচয়। তোমাকে একটা গোপন কথা বলতে চাই আমি। কথাটা বাইরে প্রকাশ না পেলেও জেনে রেখা একটা ঠান্ডা লড়াই চলছে আলবেনি আর কর্নওয়ালের মাঝে। তারা একে অপরকে ঠকিয়ে রাজ্যের উন্নতি করতে চাইলেও তাদের ভূত্য ও অনুচরেরা রাজার উপর আরোপিত ষড়যন্ত্র, তার প্রতি অন্যায়-অত্যাচারের যে খবর শুনছে। দেখছে–তা সবই গোপনে পাঠিয়ে দিচ্ছে ফ্রান্সে। একদল ফরাসি সৈন্যও গোপনে রয়েছে বন্দরে। আমার নির্দেশ অনুযায়ী তুমি তাড়াতাড়ি সেখানে গিয়ে রাজার দুরবস্থার কথা। একজন লোককে জানাবে। পারিশ্রমিক হিসেবে এই থলিটা আমি তোমায় দিচ্ছি। আর ফ্রান্সের রানি কার্ডলিয়ার সাথে দেখা করে এই আংটিটা তাকে দিলেই তিনি তোমায়ে জানিয়ে দেবেন। আমার পরিচয়। এবার তুমি যাও।
অনুচরটি কিছুদূর যাবার পর ফের তাকে ডাকলেন কেন্ট, বললেন, ওহে শোন, আগের চেয়েও একটা বেশি গোপনীয় কথা আছে তোমার সাথে। কথাটা হল, যত শীঘ্র সম্ভব আমাদের রাজাকে খুঁজে বের করতে হবে। আমাদের উভয়ের মধ্যে যেই আগে খবরটা পাক, সে তা জানিয়ে দেবে অন্যদের। খুব সাবধান, এ কথা যেন কেউ জানতে না পারে।
আপনার আদেশ যথারীতি পালিত হবে— বলে অনুচর বিদায় নিল।
লিয়ার বললেন, হে বাতাস, তুমি সমস্ত শক্তি দিয়ে চূর্ণ করে দাও এ পৃথিবীটাকে। আমার রাজ্যের আগুনকে বাড়িয়ে দিয়ে তুমি তৈরি কর দাবানল। হে মেঘ, অঝোর ধারায় বর্ষিত হয়ে তুমি নেমে এস পৃথিবীতে, ধুয়ে মুছে শেষ করে দাও সবকিছু। অবিশ্রান্ত আঘাত হানো গির্জাগুলির চুড়ার উপর। হে আগুন, দ্রুতগতিতে নেমে এসে তুমি জ্বালিয়ে দাও আমার সাদা দাড়ির গোছগুলি আর তোমার প্রভু কঠিন বজকে বলো যেন তার আমোঘ শক্তিতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে এই পৃথিবীটা আর সে যেন ধ্বংস করে দেয় অকৃতজ্ঞ মানুষের বাসস্থান-মোয়াজলে ঘেরা এই বিশ্বকে।
বিদূষক বলল, আপনি বরং ঘরে এসে ওদের তোষামোদ করুন। আজকের রাতটা বড়োই দুৰ্যোগপূর্ণ।
আপন মনে বললেন লিয়ার, হে প্রাকৃতিক বস্তুসমূহ! তোমরা নিশ্চয়ই আমার মেয়ের মতো অকৃতজ্ঞ নও কিংবা আমার অধীনও নও। এক অসহায় দুর্বল বৃদ্ধ করজোড়ে মিনতি জানাচ্ছে তোমাদের কাছে–আরও প্রবল এবং প্রচণ্ড হয়ে ওঠ তোমরা। হে বিদ্যুৎ, আগুন, বাতাস, তোমরা সবাই নেমে এস আমার মাথার উপর। তোমরা আর দেরি করো না। এই দেখ, এক ক্রীতদাসের মতো আমি তোমাদের করুণাপ্রার্থী। আমায় দয়া করে তোমরা।
একটু থেকে কান পেতে বজের গর্জন ও আওয়াজ শুনে বললেন লিয়ার, ঐ দূর আকাশের বজ, বিদ্যুৎ, বৃষ্টি — ওদের সাথে আমার রক্তের সম্পর্ক না থাকা সত্ত্বেও আমার মতো বুড়োর প্রতি অন্যায়-অত্যাচারের প্রতিবাদে তারা সবলে রুখে দাঁড়িয়েছে আমার দু-মেয়ের বিরুদ্ধে, সত্যিই এ খুব আশ্চর্যের ব্যাপার।
বিদূষক বলল, মহাশয়, একটা প্রচলিত প্ৰবাদ আছে যে শিরস্ত্ৰণ তারই সাজে যার মাথার উপর আছে একটা বাড়ি—যে লোক পায়ের বুড়ো আঙুলের সাহায্যে মনের কাজ করে, কাঁটা তার পায়ে না। ফুটে অন্তরে বেঁধে আর দুঃস্বপ্নে ভরিয়ে তোলে তার সারা রাত। আর যে প্রকৃতই সুন্দরী, আয়না কখনও বিকৃত করে দেখায় না। তার সারা মুখ।
এ সময় দূর থেকে একজন জিজ্ঞেস করল, কে ওখানে? সাড়া দাও! তারপর কাছে এসে চিনতে পেরে বলল, হায় ভগবান, এই দুর্যোগপূর্ণ রাতে নিশাচর প্রাণীরাও আশ্রয় নিয়েছে তাদের বাসস্থানে, আর রাজা লিয়ার, এই দুর্যোগের রাতে আপনি রয়েছেন বাইরে?
লিয়ার বললেন, গোপনে গোপনে নানা পাপ কাজের দ্বারা যে সমস্ত হতভাগা তাদের হাতকে কলঙ্কিত করে মানুষের রক্তে, মিথ্যা শপথ নিয়ে বাইরে যারা সৎ ও ধাৰ্মিকের ভান করে, বন্ধুত্বের ভান করে। কিন্তু লিপ্ত হয় নানা ষড়যন্ত্ৰে— অথচ শাস্তি পায়নি তারা এসব জঘন্য কাজের জন্য। আজ সময় এসেছে তাদের নিজেকে ঈশ্বরের কাঠগড়ায় সঁপে দেবার। আমিও সেইসব হতভাগাদের একজন যার শাস্তির পরিমাণ ছাপিয়ে গেছে পাপের পরিমাণকেও।
লোকটি বলল, মহারাজ, আমার বিনীত অনুরোধ বিশ্বস্ত কয়েকজনকে নিয়ে আপনি ঢুকে পড়ুন ওই কুটিরে। আর আমি যাচ্ছি কিছুক্ষণ আগে প্রত্যাখ্যাত পরিশ্রান্ত ঐ নিষ্ঠুর মানুষগুলির প্রাসাদে।
লিয়ার বললেন, তই চল ছোকরা। ঠান্ডায় কাহিল হয়ে পড়ছে আমার শরীর, লোপ পাচ্ছে আমার বুদ্ধি। আমার শোবার ঘরটা কোথায়? বিদূষক, তুমি শুয়ে পড়া ঐ বাক্সটায়। ঈশ্বরের কী আশ্চর্য করুণা! এখনও পর্যন্ত ও আমায় ছেড়ে যাননি।
তবে যাবার আগে একটা ভবিষ্যদ্বাণী করে যাই– বামন এবং পূজারিরা যখন বেশি কথা বলবে, বেশি জল মেশানো হবে মদে, যখন সামন্তরা করবে দর্জির কাজ, নাস্তিকদের শাস্তি ভোগ করবে শ্রমিকেরা, ধনীরা ভুলে যাবে ধার করতে, দুর্লভ হবে গরিব নাইটের সংখ্যা, মানুষ ভুলে যাবে মিথ্যা কথা বলা আর চোর ও মানুষের মাঝে থাকবে না কোনও পার্থক্য–ঠিক তখনই ঘটবে মানুষের আত্মসাক্ষাৎ। তবে ব্রিটেন। কিন্তু বিপর্যস্ত হবে দারুণ বিশৃঙ্খলায়।
হতাশায় ভেঙে পড়ে গ্লস্টার বলল, শোন এডমন্ড, আমার প্রভু ও প্রভুপত্নী এমনই নির্দয় যে তারা আমার সব ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছে যাতে আমি বৃদ্ধ রাজাকে আশ্রয় দিতে না পারি। আর তারা কড়াভাবে আমায় শাসিয়ে গেছে এসব সত্ত্বেও আমি যদি রাজার সাথে যোগাযোগ করি, তাহলে চিরকালের মতো এ পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হবে আমায়।
নিরীহের ভান করে এডমন্ড বলল, সত্যিই বাবা, এ কাজটা ওদের পক্ষে খুবই দোষণীয়। * গ্লস্টার বলল, চুপ এডমন্ড, কেউ শুনতে পাবে। কারও চোখে যাতে না পড়ে সেজন্য আমি বিশ্বাস করে তার ছেলেকে রেখেছি। আর শোন, রাজার প্রতি অপমানের প্রতিশোধ নেবার জন্য সেনাবাহিনীর একটা অংশ বাইরে থেকে এখানে গোপনে আশ্রয় নিয়েছে। আমার সম্পর্কে ওরা কিছু জানতে চাইলে তুমি বলবে যে আমি অসুস্থ। তবে জেনে রেখ, ওদের নিষেধ সত্ত্বেও আমার প্রাক্তন মনিবকে খুঁজে বের করে তাকে যথাসাধ্য সাহায্য করব আমি। এডমন্ড, তুমি সাবধানে থেক?
গ্লস্টার চলে যাবার পর এডমন্ড ছুরি শানাতে বসল। তার উদ্দেশে। মনে মনে সে ঠিক করল বাবার পরিকল্পনার সব কথা ডিউককে জানিয়ে দিয়ে সে হাত করবে। বাবার সম্পত্তি। কারণ যুবকদের উন্নতির জন্য প্রয়োজন বৃদ্ধদের হটানো।
বিনীতভাবে রাজাকে অনুরোধ করল কেন্ট, প্ৰভু, দয়া করে আপনি এ কুটিরে প্রবেশ করুন।
আমায় একটু একা থাকতে দাও কেন্ট, বললেন লিয়ার, আমার হৃদয়টা ভেঙে যাক তাই কি তুমি চাও? তুমি ভাবছ। এই প্রচণ্ড ঝড়ের কষ্ট আমার কাছে দুঃসহ বলে মনে হচ্ছে? না, এর চেয়ে অনেক বেশি কষ্ট আমি সয়েছি। এই দেহে। আমার মনের এই কষ্ট, সমুদ্র ঝড়ের আঘাতে সম্পূর্ণভাবে অসাড় করে দিয়েছে আমার অনুভূতিগুলিকে। আমি আর চোখের জল ফেলব না, প্রতিশোধ নেব। আমার সন্তানদের অকৃতজ্ঞতার। মেয়েদের সব কিছু দান করে নিঃস্ব-রিক্ত হয়ে গেল বাবা, আর তাকেই কিনা নিরাশ্রয় করে তাড়িয়ে দিল মেয়েরা? যাকগে, আমি ভুলে যাব সে কথা! তুমি চলে যাও কেন্ট। এর চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতির হাত থেকে আমায় রক্ষা করবে। এ ঝড়; তুমিও ঘরে চলে যাও বিদূষক। হে ভগবান, তুমি পরম দয়াবান! কোনও দিন সে কথা ভাবিনি। আজ তুমি আমায় ভাববার সুযোগ দিয়েছ। কী করে দরিদ্র নিরাশ্রয় মানুষগুলি প্রচণ্ড ঝড়-বৃষ্টির আঘাত সহ্য করে। হে ধনী লোকেরা, ঈশ্বরের কৃপালাভের জন্য তোমাদের উচিত প্রয়োজনের অতিরিক্ত টাকা-পয়সা গরিব জনসাধারণের জন্য দান করা।
হঠাৎ একটা অদ্ভুত শব্দ শুনে গুহার ভেতর থেকে বেরিয়ে এল বিদূষক, বলল, টম নামে একটা ভূত আছে গুহায়। ওগো, কে কোথায় আছ আমায় বাঁচাও।
কেন্ট এগিয়ে এসে বললেন, কে আছ, বেরিয়ে এস গুহার ভেতর থেকে।
পাগলের মতো গুহার ভেতর থেকে বেরিয়ে এল এডগার, বলল, পালিয়ে যাও তোমরা। একটা শয়তান সবসময় আমার পেছু তাড়া করছে।
রাজা লিয়ার জানতে চাইলেন, আচ্ছা, তুমি কি নিঃস্ব হয়ে পড়েছ সবকিছু মেয়েদের দান করে?
আমার কী আছে? বলল। টম, জলে-স্থলে, স্বপনে-জাগরণে, সবসময় একটা শয়তান আমায় তাড়া করে ফিরছে। যার পথ নির্দিষ্ট করা আছে বিপদের মধ্য দিয়ে, তার কীই বা থাকতে পারে? ঈশ্বরের দোহাই, ক্ষুধার্ত টমকে কিছু খেতে দাও। শয়তান অবিরাম জ্বালাতন করছে তাকে। হয়তো সেই শয়তানটা এখানেই থাকে।
লিয়ার বললেন, আচ্ছ টম, তোমার এ অবস্থা কে করেছে? তোমার মেয়েরা কি সবকিছু কেড়ে নিয়েছে?
না মহারাজ, এর মধ্যে আমি একটা কলঙ্কের ব্যাপার দেখছি, বলল বিদূষক।
লিয়ার বললেন, তাহলে আমি অভিশাপ দিচ্ছি, যথাসময়ে পতন হবে ওর মেয়েদের।
ছদ্মবেশী কেন্ট বলল, মহারাজ ওর কোনও মেয়ে নেই।। তুমি একটা মিথ্যেবাদী, চিৎকার করে বললেন লিয়ার, মেয়ে না থাকলে কখনো ওর এই অবস্থা হত? দেখছি না, আমার মেয়েরাও তো এভাবেই আমার রক্ত শোষণ করেছে।
বিদূষক বলল, এ অসহ্য পরিবেশকে মেনে নেওয়া আমার মতো নির্বোধের পক্ষে সম্ভব নয়।
ব্যগ্র কণ্ঠে রাজা জিজ্ঞেস করলেন টমকে, আগে কী করতে তুমি?
টম উত্তর দিল, আগে আমি খুব অহংকারী ছিলাম। কথায় কথায় মিথ্যে শপথ নিতাম। যৌবনের নানা খেলায় ব্যস্ত রাখতাম নিজেকে। নিজ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য হীন কাজ করতেও পেছ-পা হতাম না। মদ খেতাম, জুয়ো খেলতাম প্রেম নিয়ে। অলসতা, লুব্ধতা, ধূর্তমি আর নানারূপ পাপ কাজে সিদ্ধহস্ত ছিলাম আমি। এসব কাজে আমি ছিলাম পশুরও উপরে। কিন্তু সাবধান, হৰ্মন বনের বাতাসের রূপ ধরে আসছে। ঐ শয়তান।
হে ভগবান, মানুষের কি কোনও দাম নেই? বললেন লিয়ার, এই গুহায় বাস করছি আমরা তিনটি দু-পেয়ে প্রাণী, অথচ কেউই স্বাভাবিক নই। তারপর হঠাৎ তিনি দু-হাতে নিজের জামাকাপড় ছিড়ে ফেলে অনাবৃত করতে লাগলেন দেহকে।
বিদূষক বলল, মহাশয়, এই শীতের রাতে গায়ের পোশাক খুলবেন না। ঐদিকে দেখুন, কে যেন মশাল হাতে এগিয়ে আসছে।
এডগার বলল, ও হচ্ছে শয়তান কিবাগিগিবেট। সন্ধ্যার পর মানুষের দুরবস্থার নকল করে সে নানাভাবে বিভ্রান্ত করে তাদের।
নেপথ্যে পায়ের আওয়াজ শুনে রাজা বললেন, কে ওখানে? কার গলা শোনা গেল পেছনে? কে তুমি? আগে তোমার নাম বল।
আমি সেই হতভাগ্য টম যার খাদ্য হল কোলাব্যাং, বিষাক্ত সাপ, টিকটিকি আর মরা কুকুর। আমার পানীয় হল শ্যাওলা পচা জল, সম্বল জামা-কাপড়, একটা ঘোড়া আর তলোয়ার। আমি সেই শয়তান যাকে অহরহ তাড়া করছে আর একটা শয়তান। নরক আর অন্ধকারের রাজাই আমার একমাত্র বন্ধু।
গ্লস্টার বলল, জানো, আমার ছেলেদের কাছে আজ। আমি একটা ঘৃণিত জীব মাত্র।
রাজা লিয়ার বললেন, আপনার কন্যাদের বারণ সত্ত্বেও আমি এসেছি আপনাকে নিয়ে যাব বলে। এর পরপরই তিনি বললেন, বজের উদ্দেশ্য কী? আচ্ছা!টম, তোমারই বা জ্ঞানের উদ্দেশ্য কি?
রাজার এরূপ অবস্থা দেখে দুঃখের সাথে কেন্ট বললেন, গ্লস্টারকে, স্যার, ওর মাথা পুরোপুরি খারাপ হয়ে গেছে।
গ্লস্টার বললেন, সেজন্য দায়ী ওর মেয়েরাই! জানো বন্ধু, এই কিছুদিন আগে আমার প্রিয় পুত্ৰও হত্যা করতে চেয়েছিল আমাকে। আমিও রাজার মতোই এক হতভাগ্য। তারপর লিয়ারকে উদ্দেশ করে বললেন, আজকের রাতটা খুবই দুর্যোগের। আমার কথাটা শুনুন মহারাজ।
লিয়ার বললেন, আমি ক্ষমা চাইছি তোমাদের কাছে। এস, সবাই ভেতরে যাই। ওহে যুবক, এস, বিশ্রাম করবে। আমাকেও তোমার সঙ্গী করে নাও।
গ্লস্টার বলল, চুপ, ধীরে ধীরে। তারপর ছদ্মবেশী কেন্টকে উদ্দেশ করে তিনি বললেন সে যেন সবাইকে ভেতরে নিয়ে যায়। সবাই যখন বাড়ির ভেতরে ঢুকছে, তখন টমর্যাপী ছদ্মবেশী এডগার বলে উঠল, ধিক ধিক, আমি টের পাচ্ছি এক ব্রিটিশ বীরের উপস্থিতি।
কর্নওয়াল বলল, তাহলে তো গ্লস্টারকে হত্যা করার চেষ্টা করে ঠিকই করেছে তোমার ভাই। এ বাড়ি ছেড়ে যাবার পূর্বে আমিও প্রতিশোধ নেব তার উপর।
এডমন্ড ছিল খুব চতুর। সে বলল, না। হুজুর, তা করবেন না। তাহলে সবাই আমায় অপবাদ দেবে পিতৃহত্যার। আমার ভাগটো সত্যিই খুব খারাপ। কারণ আমার বাবা চেষ্টা করছেন ফরাসিদের অনুকূল সুযোগ দেবার। আর এ চিঠিটাই তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি, বাবা যেন এ কাজ থেকে বিরত হন। কিন্তু এ চিঠিটা যদি সত্যি হয় তাহলে….।
কর্নওয়াল বলল, সত্যি মিথ্যে যাই হোক না কেন, তোমার বাবাকে খুঁজে বের করে গ্রেপ্তার করতে পারলে তুমিই হবে আর্ল অফ গ্লস্টার।
কথাটা শুনে মনে মনে ভাবতে লাগল এডমন্ড, যদি সত্যিই এরকম হয়, তাহলে তো রাজার প্রতি–বাবার সাস্তুনা বাণীই দূর করে দেবে ডিউকের সন্দেহ আর সেই সাথে সফল হবে। আমার উদ্দেশ্য! হে ঈশ্বর, আমার উদেশ্য যেন সফল হয়।
গ্লস্টার কেন্টকে বলল, আপনি এখানে একটু অপেক্ষা করুন। আমি দেখছি অন্য আর কিছু করা যায় কিনা। গ্লস্টারের মহানুভবতায় মুগ্ধ হয়ে গেলেন কেন্ট। রাজার প্রতি তার এই মমতাময় আচরণের জন্য তিনি গ্লস্টারের মঙ্গল কামনার প্রার্থনা করলেন ঈশ্বরের কাছে।
এডগারকে দেখিয়ে বিদূষক প্রশ্ন করলেন লিয়ারকে, মহারাজ, এই লোকটি কে?
লিয়ার বললেন, উনি এক রাজা।
বিদূষক বলল, উহুঁ, ছেলেকে ভদ্র হতে দেখলে নিচু শ্রেণির মানুষও পাগল হয়ে যায়। উনি সত্যিই পাগল হয়ে গেছেন। যে কোনও ঠুনকে জিনিস এখন সহজেই ওর বিশ্বাস ভেঙে দিতে পারে।
লিয়ার বললেন, আমি সামনাসামনি বিচার করব তাদের। ওহে যুবক আর বিদূষক, তোমরা দুজনেই বস এক জায়গায়, আর অকৃতজ্ঞের দল, আমি বিচার করব তোমাদের।
এডগার বলল, আবার নাইটিংগেলের পাখির সুরে গান গাইছে জঘন্য শয়তানটা। ওহে শয়তান, তুমি চুপ কর। এখন আমার কাছে কোনও খাবার নেই।
ওহে যুবক, তুমি আর তোমার সঙ্গী এই বেঞ্চের উপর বাস বিচারক হিসাবে— তারপর কেন্টের দিকে তাকিয়ে বললেন লিয়ার, আচ্ছা, তুমিও বস এদের সাথে। আমি দেখব বিচার করে। আগে গনেরিলের বিচার হবে। সে তার বৃদ্ধ পিতাকে লাথি মেরে তাড়িয়ে দিয়েছে বাড়ি থেকে।
অদৃশ্য মহিলার উদ্দেশে বলল বিদূষক, তুমিই গনেরিল? আমি ভেবেছিলাম তুমি এক নোংরা। আবর্জনা। চিৎকার করে বলে উঠলেন। লিয়ার, এই নারীর মন যে কত ক্রুর তা ওর চোখ দেখলেই বোঝা যায়। তোমরা তাড়াতাড়ি অস্ত্ৰ নিয়ে এস। তোমরা এরূপ অবিশ্বস্ত যে তাকে পালিয়ে যেতে দিলে?
রাজা আজ ধৈর্য হারিয়ে ফেলেছেন, বাধা মানছে না কেন্টের চোখের জলও।
আচ্ছা, ট্রে, সুইটহার্ট আর ব্রাট, এই তিনটে কুকুরকি আমার দিকে তাকিয়ে ঘেউঘেউ করছে? জানতে চাইলেন। লিয়ার।
টম বলল, ভাববেন না, তাড়া করলেই তারা পালিয়ে যাবে।
আবার বললেন লিয়ার, তোমরা রিগানকে কেটে দেখ কী দিয়ে তার হৃদয়টা সৃষ্টি করেছেন প্রকৃতি। যাও, তোমরা আর চিৎকার করো না, আমি এবার বিশ্রাম নেব।
গ্লস্টার তাড়াতাড়ি এসে পৌছল। সেখানে। সে কেন্টকে বলল, বন্ধু, বাইরে যে ঘোড়ার গাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে, তাতে মহারাজকে চাপিয়ে যত শীঘ্র সম্ভব তোমরা তাকে নিয়ে যাও ডোভারে আমার নিরাপদ আশ্রয়ে! আর আধঘণ্টা দেরি হলেই বিপন্ন হবে তার জীবন! আমাকে অনুসরণ করে তোমরা তাড়াতাড়ি পালিয়ে যাও নিরাপদ স্থানে।
হয়তো ওর আত্মা এই ঘুমের মাঝে বিশ্রাম পাচ্ছে, বলল কেন্ট; যাই হোক, তুমি এস বিদূষক। আমরা সাহায্য করব রাজাকে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যেতে।
সবাই চলে যাবার পর কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল এডগার। মনে মনে সে ভাবল, হয়তো পৃথিবীর নিয়মই এই। মহান ব্যক্তির দুঃখ ভুলিয়ে দেয় তুচ্ছ ব্যক্তিগত দুঃখকে। দীর্ঘদিন সুখে থাকার পর হঠাৎ দুঃখ পেলে তা সহন করা কঠিন হয়ে পড়ে। আর দুঃখী লোকের পক্ষে দীর্ঘদিন দুঃখভরা জীবন কাটানোর কষ্টও প্রচুর। আমি আর আমাদের মহান রাজা, উভয়েই কষ্ট পাচ্ছি পিতা আর সস্তানের মাঝে ভুল বোঝাবুঝির দরুন না। টম, এসব নিয়ে তোমার আর ভাবার দরকার নেই। যখন দেখবে সবকিছু বাধা দূর হয়ে বাপ-ছেলের মিলন ঘটবে, ঠিক তখনই সবার সামনে আত্মপ্রকাশ করবে তুমি। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি, মহারাজ যেন নিরাপদে ডোভারে যেতে পারেন।
ফ্রান্সের সৈন্যরা যে এসে পড়েছে সে খবর দিদি তাড়াতাড়ি পাঠিয়েছিলেন আলবেনির কাছে। চাকরেরা চলে যাবার পর কর্নওয়াল বলল এডমন্ডকে, সেই বিশ্বাসঘাতক গ্লস্টারকে খুঁজে বের করে তার উপর প্রচণ্ড প্রতিশোধ নেব আমি। তার আগে এডমন্ড, তুমি গনেরিলের কাছে গিয়ে দ্রুত সব ব্যবস্থা কর।
এ সময় ছুটতে ছুটতে এসে বলল অসওয়াল্ড, প্ৰভু, আগে থেকেই ষড়যন্ত্র করে রাজা ও তার সামন্ত এবং অনুচরবর্গকে ডোভারে পাঠিয়ে দিয়েছেন লর্ড গ্লস্টার।
একথা শুনে তৎপর হয়ে উঠল কর্নওয়াল। সে বলল, আপনি তাড়াতাড়ি ঘোড়ায় চেপে চলে যান। আর আমার অনুচরবর্গ, তোমরা সবাই খুঁজে বের তাকে। কে? কে দাঁড়িয়ে ওখানে?
অনুচরসহ গ্লস্টারকে বন্দি অবস্থায় দেখে বেজায় খুশি হলেন কর্নওয়াল আর রিগান। এরপর সবাই পৈশাচিক আনন্দে চিৎকার করে বলে উঠল, অকৃতজ্ঞ শয়তান, তোরা বেঁধে ফেল ওর হাত দুটো।
তাদের আচরণে অবাক হয়ে বললেন গ্লস্টার, সে কি? আমিই আপনাদের আশ্রয় দিয়েছি আর আশ্রয়দাতাকে আপনারা এভাবে অপমান করছেন? মনে রাখবেন, আমি বিশ্বাসঘাতক নই। রিগান, তুমি এরূপ অন্যায়ভাবে আমার দাড়ি ছিড়ে না।
বুড়ো শয়তান, তুমি একটা পাজি বদমাশ বলল রিগান।
গ্লস্টার জ্বলে উঠল এ কথা শুনে। সে বলল, নিষ্ঠুর নারী, আমি তোমায় অভিশাপ দিচ্ছি অতিথির প্রতি এরূপ অন্যায় আচরণের জন্য। ভবিষ্যতে আমার এ দাড়ির প্রতিটি লোম চরম শাস্তি দেবে তোমায়। বল, কেন তোমরা এরূপভাবে অপমান করছ তোমাদের আশ্রয়দাতাকে?
কর্নওয়াল বলল, আমিও সে কথা বলতে চাই তোমায়। বল, কোথায় রেখেছি ফ্রান্সের রাজার চিঠিটা? কী ধরনের ষড়যন্ত্ৰ তুমি করেছ বিদেশিদের সাথে?
রিগান বলল, আর তাও বল এইসাথে যে উন্মাদ রাজা এখন কোথায়?
গ্লস্টার বলল, আমার কাছে যে চিঠিটা আছে তা বিরোধী পক্ষের নয়, ওটা এসেছে। একজন নিরপেক্ষ লোকের কাছ থেকে। আমি শুধু রাজাকে সাহায্য করেছি। ডোভারে পালিয়ে যেতে।
কর্নওয়াল বলল, কোন তুমি এ কাজ করেছ? আমরা যে তোমায় বারণ করেছিলাম। সে কথা কি তুমি ভুলে গেছ?
গ্লস্টার উত্তর দিল, না, ভুলিনি। তবে আজ আমি মরতে বসেছি। তাই কোনো ভয়ই আমায় বাধ্য করতে পারবে না। অন্যায় কাজ করতে।
রিগান জানতে চাইল, কেন তুমি রাজাকে ডোভারে পাঠিয়েছে?
গ্লস্টার বলল, তোমাদের হিংস্ৰ নখ আর দাঁতের আক্রমণ থেকে রক্ষা করতেই আমি পাঠিয়ে দিয়েছি তাকে। যে দুৰ্য্যোগপূর্ণ রাতে তোমরা তাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়েছ, সে রাতে তোমাদের ধ্বংস করার জন্য দেবতাদের কাছে প্রার্থনা করেছিলেন তিনি। অথচ তার স্নেহময় অন্তর কামনা করছিল বৃষ্টিপাতের। আমি চাই যত শীঘ্ৰ হোক ঈশ্বরের অভিশাপ নেমে আসুক তোমাদের উপর, ধবংস হয়ে যাও তোমরা?
রিগান বলল কর্নওয়ালকে, নষ্ট করে দাও ওর চোখ দুটো।
গ্লস্টার বলে উঠল, কী নিষ্ঠুর তোমরা! অন্তত মানবিকতার খাতিরে এই বুড়োটাকে তোমরা রক্ষা কর।
গ্লস্টারের এই কাতর আবেদনে স্থির থাকতে না পেরে একজন ভৃত্য এসে বাধা দিল কর্নওয়ালকে। ভূত্যের এই দুঃসাহস দেখে রিগান তাকে মেরে ফেলল তলোয়ার দিয়ে। মৃত্যুর আগে সে ভৃত্য বলে গেল, হে আমার প্রভু, আমি মারা গেলাম। আপনি দেখবেন ঘৃণিত এই নারীর জীবনের পরিণাম।।
যাতে আর তা দেখতে না হয়, সে ব্যবস্থাই আমি করছি, বলেই তলোয়ার দিয়ে গ্লস্টারের দুচোখ অন্ধ করে দিল কর্নওয়াল। তারপর দূর করে তাড়িয়ে দিল তাকে।
চোখের যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠল গ্লস্টার, বলল, পুত্ৰ এডমন্ড, অন্যায়কারীদের তুমি উপযুক্ত শাস্তি দিও যখন তুমি শুনবে তোমার বাবার উপর এরূপ অত্যাচার হয়েছে।
গ্লস্টারের কথা শুনে হা হা করে হেসে উঠল দুজনে। তারপর ব্যঙ্গের সুরে বলল রিগান, তোমার বিশ্বাসঘাতকতার কথা এডমন্ড ফাস করে দিয়েছে আমাদের কাছে। তোমার মত অবিবেচক বিশ্বাসঘাতক সে নয় যে তোমায় দয়া করবে।
ও কি নির্বোধি আমি, বলল গ্লস্টার, এডমন্ডের কথায় বিশ্বাস করে আমি চরম অন্যায় করেছি এডগারের প্রতি। ঈশ্বর, তারা যেন মঙ্গল হয়।
চাকরকে ডেকে রিগান বলল, বের করে দাও এ লোকটাকে। তারপর বলল কর্নওয়ালকে, আঘাতটায় কি খুব যন্ত্রণা হচ্ছে?
হাঁ প্রিয়তমা, বলুল কর্নওয়াল, অসতর্কমুহূর্তে আমায় আঘাত করেছে তৃত্যটা। চল, ভেতরে যাই।
ওরা চলে যাবার পর দ্বিতীয় এবং তৃতীয় ভৃত্য স্থির করল তারা রাজার কাছে এখানেই থেকে যাবে। তাদের মধ্যে একজন চলে গেল গ্লস্টারের আহত চোখে লাগাবার জন্য প্রলেপের খোঁজে। অন্যজন বলল, চল, বুড়ো আর্লকে অনুসরণ করে আমরাও যাই এডগারের খোঁজে। ঈশ্বর যেন তাকে ভালো রাখেন।
কোনও কাজে ব্যর্থ হলেও মানুষ সর্বদা একটা-না-একটা আশার দ্বারা পরিচালিত হয়। কিন্তু সবচেয়ে শোচনীয় ব্যাপার সৌভাগ্য থেকে দূর্ভাগ্যের কবলে পড়াটা। এখন যিনি দুর্ভাগ্যের কবলে পড়েছেন। অথচ ভবিষ্যৎ সুখের আশায় সে দুঃখকে অম্লান বদনে মেনে নিয়েছেন, সেরূপ লোকদের মধ্যে আমিও একজন-– মনে মনে নিজেকে এরূপ ভেবে নিল এডগার। একজন বুড়ো লোকের সাহায্যে বাবাকে আসতে দেখে এডগার বলল, কী আশ্চর্য! আমার বাবা আসছেন এক বুড়ো লোককে অবলম্বন করে!
বুড়ো লোকটি গ্লস্টারকে উদ্দেশ করে বলল, হুজুর, আশি বছর ধরে আমি আপনার অধীনস্থ একজন প্ৰজা!
গ্লস্টার বলল, ঈশ্বর তোমার কল্যাণ করুন। তুমি চলে যাও, নইলে বিপদ হতে পারে তোমার। আমার সামনে এখন শুধুই অন্ধকার। পথ চলার জন্য কোনও সাখীর প্রয়োজন নেই আমার। হে প্রিয় এডগার, ভুলবশত যে অন্যায় আমি তোমার উপর করেছি, তার জন্য আজ ক্ষত-বিক্ষত আমার হৃদয়। এই অন্ধত্ব দশা থেকে আমার মুক্তি হবে। যদি কখনও তোমার স্পর্শ পাই।
পিতার এই শোচনীয় অবস্থা থেকে এডগার মনে মনে ভাবতে লাগল এর চেয়ে খারাপ আর কিছুই হতে পারে না।
এডগারকে দেখে বৃদ্ধ বলল, ওহে যুবক, কোথায় যাচ্ছ তুমি?
গ্লস্টার বলল, কে উনি? উনি কি একজন ভিক্ষুক? মনে হয় না ও পুরোপুরি পাগল। গত রাতে ঝড়ে বিপর্যস্ত একটা লোককে দেখে আমার মনে পড়ে গিয়েছিল ছেলের কথা। কিন্তু সে সময় নিবুদ্ধিতাবশত আমায় আচ্ছন্ন করে রেখেছিল বিজাতীয় ক্ৰোধ। তাই মনে হয়েছিল মানুষ সামান্য কীটমাত্র। আজ বেশ বুঝতে পারছি মানুষ কত অসহায়— ঈশ্বরের হাতে ক্রীড়ানক মাত্র। আমায় বল, লোকটির কি নগ্নদেহ?
হ্যাঁ প্রভু, বলল বৃদ্ধ।
গ্লস্টার বলল, তাহলে এখনি গিয়ে তার জন্য কিছু পোশাক নিয়ে এস। এখন সেই হবে। অন্ধের যষ্টি স্বরূপ।
কিন্তু প্ৰভু, উনি তো সম্পূর্ণ পাগল, বলল বৃদ্ধ।
তা হোক বলল গ্রেস্টার, আমি যা বললাম। তাই করো। শীঘ্ৰ চলে যাও। বৃদ্ধ লোকটি চলে গেল। বাবার দুঃখে এডগার এত কাতর হয়ে পড়েছে যে তার কথা বলার শক্তি নেই। কিন্তু অন্ধ গ্লস্টার চিনতে পারেনি তাকে। তিনি বললেন, যুবক, তুমি বলতে পারডোভারের পথ কোন দিকে?
ওদিকে হতভাগ্যটমের বুকে তখন অনবরত নাচছে পাঁচ শয়তানী— ওবিডিকাঠ, হবিডিডাম্প, মৃদু, মোদো আর বিকারটি গিরোট। সুতরাং অর্থহীন তার কথা। তবুও সে বলল, ঈশ্বর আপনাদের মঙ্গল করুন। আমি জানি ডোভারের পথ।
উৎসুক হয়ে তাকিয়ে গ্লস্টার বলল, হে প্রিয় বন্ধু, এই নাও টাকা। দুঃখময় জীবনে অন্তত কিছুটা শান্তি ভোগ কর। জীবনে যাদের কাছে সুখটাই বড়ো, তোমার দুঃখ তাদের কাছে সৃষ্টি করবে। ঘৃণা। তুমি সুস্থ হও।
আলবেনিকে জিজ্ঞেস করলেন গনেরিল, তোমার প্রভু কোথায়?
উত্তর দিল আলবেনি, তিনি খুবই পালটে গেছেন ম্যাডাম। তিনি বিশ্বাসই করলেন না ফরাসি সৈন্যের আগমন-বার্তা আর গ্লস্টারের বিশ্বাসঘাতকতার কথা। উল্টে ভাবলেন যে আমিই মিথ্যেবাদী।
এ কথা শুনে গর্জে উঠে গনেরিল বলল, একমাত্র তোমার মতো নির্বোধ, দুর্বল, কাপুরুষরাই পারে দেশদ্রোহিতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ না করে থাকতে।
আলবেনি বলল, তুমি এক অকৃতজ্ঞ দুনীতিপরায়ণ নারী। এখনও সময় আছে পাপবোধ সম্পর্কে তোমার সচেতন হবার। এখনও বলছি আমি, নিজেকে ধ্বংস করার আগে তাকে ধ্বংস কর, নইলে অচিরেই শেষ হয়ে যাবে তুমি।
এমন সময় একজন দূত এসে প্রবেশ করল। আলবেনি জিজ্ঞেস করলেন, কী খবর দূত?
দূত বলল, হুজুর গ্লস্টারের চোখ তুলে নেবার সময় সে যে আঘাত পায় তাতেই তার মৃত্যু হয়েছে। এক ভূত্য সে সময় তাকে বাধা দিলে তিনি রেগে গিয়ে তাকে হত্যা করেন। কিন্তু মৃত্যুর আগে ওই ভূত্যের তলোয়ারের আঘাতে তার বুকে ওই ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে।
গনেরিল বলল, পাপের পরিণতি হয় তার শাস্তিতে। আচ্ছা, গ্লস্টারের কি দু-চোখই নষ্ট হয়ে গেছে?
হ্যাঁ, উত্তর দিল দূত, আপনার বোনের একটা চিঠি আছে। তাড়াতাড়ি তার উত্তর দিতে হবে।
চিঠিটা নিয়ে মনে মনে ভাবল গনেরিল, এর উত্তর তো তৈরিই আছে। ঠিক আছে, এর উত্তর দিচ্ছি। আমি—বলে চলে গেল। গনেরিল।
গনেরিল চলে যাবার পর আলবেনি জিজ্ঞেস করল দূতকে, বলতে পোর, যখন গ্লস্টারের চোখ তোলা হচ্ছিল, তখন কোথায় ছিল এডমন্ড?
দূত বলল, ইচ্ছে করেই তিনি সে সময় বাড়ি ছিলেন না। বাবার পরিকল্পনার কথা তিনিই তো ফাস করে দিয়েছেন। ডিউককে।
আলবেনি বলল, তুমি ধন্য গ্লস্টার। তোমার প্রভুভক্তি সত্যিই দেখার মতো। আমি প্রতিজ্ঞা করছি তোমার উপর নিষ্ঠুর অত্যাচারের প্রতিশোধ আমি নেব্বই। এস বন্ধু, যা জানি আমায় নিৰ্ভয়ে বল। চলো, ভেতরে চল।
কেন্ট জিজ্ঞেস করল, বলতে পার কাউকে সেনাপতির পদ না দিয়েই কেন চলে গেলেন ফ্রান্সের রাজা?
বোধহয় বিশেষ প্রয়োজনেই তাকে চলে যেতে হয়েছে–বলল দূত।
কেন্ট জানতে চাইল, চিঠিটা পেয়ে রাজা কী করলেন?
বারবার তার চোখ জলে ভরে উঠছিল চিঠিটা পড়তে পড়তে। একটা বদ্ধ আবেগ যেন মোহিত করেছিল তার মনকে, বলল দূত।
কেন্ট বলল, উনি কি কিছু জিজ্ঞেস করেছিলেন তোমায়?
অন্তর মন্থন করে অতিকষ্টে তার মুখ থেকে বেরিয়ে আসছিল পিতা শব্দটি। একবার তিনি চিৎকার করে বলেছিলেন তোমরা মেয়ে জাতির কলঙ্ক — হায় সেই ঝড়ের রাতে–তারপরই হঠাৎ চুপ করে গেলেন তিনি–বলল দূত।
আমি আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছি। এই ভেবে যে একই পিতার ঔরসে কীভাবে পরস্পরবিরোধী সস্তানের জন্ম হয়, বলল কেন্ট।
এ সময় একজন দূত এসে বলল যে ব্রিটিশ সেনাদল এদিকেই এগিয়ে আসছে।
আচ্ছা অসওয়াল্ড, আমার ভগ্নীপতির কি স্বয়ং যুদ্ধক্ষেত্রে সৈন্য পরিচালনা করবেন? জানতে চাইল রিগান।
হ্যাঁ, বলল অসওয়াল্ড, তবে সৈনিক হিসাবে আপনার বোন তার চেয়েও দক্ষ।
রিগান বলল, আচ্ছা অসওয়াল্ড, দিদির চিঠিতে কী লেখা ছিল? নিশ্চয়ই কোনও প্রয়োজনীয় কাজের জন্য তাকে ডাকা হয়েছে। তুমি এখানেই থাকবে। আগামীকাল থেকে শুরু হবে আমাদের অভিযান।
আমার পক্ষে তা সম্ভবপর নয়, উত্তর দিল অসওয়াল্ড।
কেন? কী এমন কথা আছে যা মুখে না বলে চিঠিতে লিখলেন দিদি? জানতে চাইল রিগান।
এডগার বলল, মহাশয়, আপনার নির্দেশমতোই আমরা হাঁটতে শুরু করেছি। খাড়া পাহাড়টার উপর দিয়ে।
কিন্তু আমার তো মনে হচ্ছে বনের উপর দিয়ে হাঁটছি। কোনও শব্দ শুনতে পাচ্ছি না।। তোমার গলার আওয়াজটা যেন আগের চেয়ে ভিন্ন মনে হচ্ছে, বলল গ্লস্টার।
এডগার বলল, চোখের দারুণ যন্ত্রণাই দুর্বল করে দিয়েছে আপনার ইন্দ্ৰিয়গুলিকে। আমার যা পরিবর্তন হয়েছে তা একমাত্র পোশাকে। পাহাড়ের খুব বিপদজনক জায়গায় এখন এসে পৌঁছেছি আমরা। ভাসমান জাহাজগুলিকে খুবই ছোটো দেখাচ্ছে এখান থেকে। মাথা ঘুরে যাবে নিচের দিকে তাকালে। এখান থেকে মাত্র একফুট দূরে শেষে কিনারা।
ঠিক আছে বন্ধু–বলল গ্লস্টার, এবার আমায় ছেড়ে দিয়ে এই মূল্যবান রত্নটাকে তুমি নাও। হে ঈশ্বর, তিলতিল করে ক্ষয়ে যাওয়া দুঃখের বোঝা কমানোর জন্য আমি স্বেচ্ছায় মৃত্যুবরণ করব। বিদায় এডগার! ভগবান তোমার মঙ্গল করুন। বলেই শূন্যে লাফিয়ে উঠলেন গ্লস্টার। তাই দেখে ভাবল এডগার, মানুষ কি এভাবেই নিজেকে শেষ করে। তারপর মিনিট খানেকের মধ্যেই তার কাছে গিয়ে বলল, ও মশাই! আপনি কি জীবিত না মৃত?
মরতে দাও আমাকে, চিৎকার করে বলল গ্লস্টার।
এডগার বলল, এত উঁচু থেকে পড়ে গিয়েও আপনি যখন অক্ষত রয়েছেন, তখনই বোঝা যায় আপনার শরীরটা শক্ত ধাতু দিয়ে গড়া।
ক্ষুন্ন মনে জানতে চাইল গ্লস্টার, সত্যি করে বল তো আমি কি সত্যিই পাহাড় থেকে নিচে লাফিয়ে পড়েছি? তারপর করুণায় ভেঙে পড়ে সে বলল, আমার আর মর্যা হল না। মৃত্যুও এখন ব্যঙ্গ করছে আমায় নিয়ে।
এডগার বলল, কী আশ্চর্যের ব্যাপার! কোনও ব্যথাই অনুভব করছেন না আপনি। বলুন তো, এই পাহাড়ের মাথায় কে নিয়ে এসেছে আপনাকে?
একটা ভিখারি। আমায় নিয়ে এসেছে। এখানে। কিন্তু কেন জানতে চাইছ তার কথা? বলল গ্লসটার।
এডগার উত্তর দিল, নিচে থেকে তাকে দেখে আমার মনে হল তার মুখে হাজারটা নাক আর অসংখ্য শিং। তার গায়ে সমুদ্র তরঙ্গের মতো অসংখ্য পাহাড়। আর মুখের মধ্যে বড়ো বড়ো দুটো চোখ। নিশ্চয়ই সে কোনও শয়তান?
হ্যাঁ, সে বারবার বলছিল বটে শয়তান। তবে আমি ভেবেছিলাম সে মানুষ। ওই আমায়। সে জায়গায় নিয়ে গিয়েছিল। এবার আমার সব কথা মনে পড়ছে। আনন্দের সাথে বলে ওঠে। গ্লস্টার।
এডগার বলল, হ্যাঁ, ভালো করে ভাবুন আপনি। এদিক পানে কে যেন আসছে? নিশ্চয়ই লোকটি অসুস্থ।
কেউ আর এখন টাকার লোভে বন্দি করতে আসবে না আমায়। কারণ এখন আমিই যে রাজা –মনে মনে ভাবতে লাগলেন রাজা লিয়ার।
উঃ কী ভয়ংকর দৃশ্য! দেখে মনে হচ্ছে উনিই রাজা লিয়ার, যন্ত্রণায় কেঁপে উঠে বলল এডগার।
লিয়ার বলতে লাগলেন, চেয়ে দেখা ওই লোকটার দিকে। মনে হচ্ছে ও যেন মাঠে কাক তাড়াচ্ছে। দেখ দেখা ঐ একটা ইদুর। আমি দৈত্যের উপর পরীক্ষা করব। এই সেকা রুটিটা দিয়ে। বাদামি রং-এর টাঙ্গি আর বর্শাটা নিয়ে এস, তিরটা অব্যর্থভাবে লেগেছে ওর বুকে।
এর গলার আওয়াজ শুনে তো রাজা বলেই মনে হচ্ছে–বলল গ্লস্টার।
ঠিকই বলেছেন, আমিই রাজা। ঐ তুষারের মত সাদা মেয়েটাকে দেখুন। ওর নারীত্বের আবরণে ঢাকা রয়েছে নরকের ঘন অন্ধকার, সৰ্ব্বনাশী আগুনের জুলন্ত শিখা সবকিছুকে পুড়িয়ে দিয়ে ছাই করে দেয়। শতাধিক সে মেয়েকে। হে রাজবৈদ্য, আমার দূষিত কল্পনাকে হঠিয়ে দিতে একফোঁটা সুগন্ধী দাও আমাকে, বললেন লিয়ার।
গ্লস্টার বলল, সত্যিই আশ্চর্য, নিয়তির হাতে নিগৃহীত আপনার মতো একজন মহান ব্যক্তি আমাকে চেনেন।
তোমার চোখের ওই চাউনিকে আমি ভালো করেই চিনি, বললেন। লিয়ার, কিন্তু আমি কিছুতেই ভালোবাসব না তোমায়। উঃ তুমিও কি নিঃস্ব ও দৃষ্টিহীন আমারই মতো। তাহলে কীভাবে তুমি বুঝতে পারছি পৃথিবীর গতি কোন দিকে।
মনে মনে বলল। এডগার, স্বচক্ষে না দেখলে মর্মান্তিক অবিশ্বাস্য বলে মনে হত এ দৃশ্যকে।
লিয়ার বললেন, তুমিই বল কে পাগল আর কে চোর। আমি তোমায় বলছি বন্ধু, জমকালো পোশাকের আড়ালে যে পাপ সহজেই লুকিয়ে আছে,মিথ্যেবাদী রাজনীতিকের নকল চোখে তাকাবার ভান করলে তা সব কিছুই দেখতে পাবে তুমি। এবার সুতো খুলে দাও, বডড লাগছে পায়ে।
রাজার কথা শুনে অবাক হয়ে মনে মনে ভাবল এডগার, আশ্চর্য, রাজার কথার এই আঘাতউন্মত্ততার মাঝেও রয়েছে একটা খুশির ভাব।
লিয়ার বললেন, গ্লস্টার, তুমি যদি সমবেদনা দেখাতে চাও, তাহলে চোখটাকে ধার করতে হবে তোমায়। আমি তোমায় চিনি, অধৈর্য হয়ে না তুমি, কারণ চোখের জল ফেলাটা আমাদের উভয়ের জীবনের নিয়তি। পরে আমি তোমায় সব বুঝিয়ে বলব।
উঃ মানুষের কী ভয়ংকর পরিণতি, বলল গ্লস্টার।
লিয়ার বলতে লাগলেন, আমরা বোকার মতে কাঁদি যখন এ পৃথিবীতে প্রথম আসি। মাথার টুপি অশ্বারোহী সৈনিকের ঘোড়ার পায়ের নিচে পড়িয়ে পরীক্ষা করব আমি। চুপি চুপি একবার জামাইয়ের কাছে পৌছতে পারলেই একবারে মেরে ফেলবে তাকে।
আমি এখন অসহায়। যাবে আমৃত্যুর সাথে? একজন ডাক্তারকে দিয়ে মাথার চিকিৎসা করব। সেখানে তোমরা কেউ যাবে না, শুধু আমি একা থাকব। কিন্তু না, শোন তোমরা, রাজার মতো বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করব আমি। এত সহজ নয়। আমাকে ধরা, আমি ছুটব— বলেই ছুটতে শুরু করলেন রাজা লিয়ার। রাজাকে ধরার জন্য তার অনুচররাও পেছু পেছু ছুটতে লাগল।
একজন অনুচর বলল, রাজার এ অবস্থা আর চোখে দেখা যায় না।
কেন্ট বললেন তাকে, ওহে, আসন্ন যুদ্ধের কোনও খবর রাখা তুমি? কতদূর এগিয়ে এসেছে শক্ৰ সৈন্যেরা?
অনুচর উত্তর দিলে, খুব দ্রুত এগিয়ে আসছে তারা। আর আধঘণ্টার মধ্যেই এখানে এসে পড়বে প্রধান সৈন্যদল। রানি বিশেষ কারণে রয়ে গেছেন। কিন্তু সৈন্যরা চলে গেছে।
গ্লস্টার বলল, আমার আর বাঁচতে ইচ্ছে করে না। বল যুবক, কে তুমি?
জীবনের ঘাত-প্রতিঘাতে বিপর্যস্ত এক যুবক আমি, যে ভালোবাসি মানুষকে সহানুভূতি দেখাতে–বলল। এডগার। তারপর যত্নের সাথে গ্লস্টারের শীর্ণ হাত ধরে সে বেরিয়ে গেল নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে।
দূর থেকে গ্লস্টারকে আসতে দেখে মনে মনে খুব খুশি হল অসওয়াল্ড। সে গ্লস্টারকে বলল, ওঃ কী ভাগ্যবান আমি। ওহে বুড়ো, এবার এই তলোয়ারের আঘাতেই মারা যাবে তুমি, বলেই তলোয়ার বের করল সে।
অসওয়াল্ডকে বাধা দিয়ে বলল, খবরদার বলছি, এই হতভাগ্য বুড়োটার কাছে এস না। তোমরা সরে যাও, যেতে দাও একে। নইলে তোমার জীবন বিপন্ন হবে এই লাঠির ঘায়ে।
দূর হয়ে যা ঘৃণ্য চাষি, বলল অসওয়ান্ড।
তবে রে হতচ্ছাড়া পাজি! দেখাচ্ছি। তোকে মজা, বলেই লাঠি তুলল এডগার।
এরপর শুরু হয়ে গেল দু-জনের লড়াই। কিছুক্ষণ বাদেই এডগারের লাঠির আঘাতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল আসওয়ান্ড। তার পকেট হাতড়িয়ে পাওয়া গেল একটা চিঠি, যাতে লেখা আছে—
আমাদের একে অন্যকে দেওয়া প্রতিশ্রুতির কথা মনে রেখে যত শীঘ্র সম্ভব মেরে ফেল তাকে। আর আমাকে অন্যের শয্যাসঙ্গিনী না করে দয়া করে যত তাড়াতাড়ি পার তোমার শয্যাসঙ্গিনী করে নাও।
ইতি–তোমার প্ৰিয়তমা স্ত্রী গনেরিল।
গ্লস্টার বলল, হে ঈশ্বর, এই দুঃখ-কষ্ট থেকে আমাকে বাঁচাবার জন্য পৃথিবীটাকে অসংলগ্ন করে পাগল করে দাও আমায়।
দূর থেকে রণদামামার আওয়াজ কানে আসতেই চঞ্চল হয়ে উঠল এডগার, আপনি তাড়াতাড়ি হাত ধরুন আমার। আমি আপনাকে নিয়ে যাব আমার বন্ধুর নিরাপদ আশ্রয়ে।
হে মহানুভব কেন্ট! আপনার ঋণ আমি জীবনেও শোধ করতে পারব না, বিনয়ের সাথে বলল কর্ডেলিয়া, আপনার ওই ছেড়া পোশাক ফেলে দিয়ে নূতন পোশাক পরুন।
কেন্ট বলল, আপনি আমায় ক্ষমা করবেন। ম্যাডাম। আমার উদ্দেশ্য সাধনের জন্য প্রয়োজন আছে। এ ছদ্মবেশের। অনুগ্রহ করে আমার পরিচয় প্রকাশ করবেন না।
বেশ, করব না, বলে ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করলেন কর্ডেলিয়া, এখন কেমন আছেন রাজা?
ডাক্তার বললেন, তিনি ঘুমোচ্ছেন।
হে ঈশ্বর, সস্তানের দ্বারা প্ৰপীড়িত ওর আত্মাকে শান্তি দাও। আচ্ছা, ওকে কি নতুন পোশাক পরানো হয়েছে? জানতে চাইলেন কর্ডেলিয়া।
হ্যাঁ ম্যাডাম, উত্তর দিলেন ডাক্তার। উনি এখনও অসুস্থ। আপনি থাকুন ওর কাছে।
কর্ডেলিয়া মনে মনে বলতে লাগল, হে আমার প্রিয় পিতা, আমার এই চুম্বন যেন সারিয়ে তোলে আপনার দুরারোগ্য ব্যাধিকে। তারপর রাজাকে দেখেই বলে উঠল, হায় পিতা, রাজা হয়েও আপনি কীভাবে এই বাজে লোকদের সাথে শুয়োরের খোয়াড়ে শুয়ে আছেন? এইতো, জেগে উঠেছেন উনি।
ডাক্তার বললেন, আপনি তাড়াতাড়ি কথা বলুন।
ব্যগ্র কণ্ঠে বলল কর্ডেলিয়া, আপনি কেমন আছেন মহারাজ?
তুমি এক স্বর্গীয় আত্মা, কিন্তু আমি কাঁদছি, পুড়ে যাচ্ছি নরকের আগুনে–চিৎকার করে বলে উঠলেন। লিয়ার।
কর্ডেলিয়া বলল, আপনি আমায় চিনতে পারছেন না বাবা? ডাক্তার! উনি যে এখনও উন্মাদ।
চিৎকার করে বলতে লাগলেন লিয়ার, এখন আমি কোথায়? সবাই ঠকিয়েছে আমায়, জানি না। আমি কী বলব। এ হাত তো আমার নয়! না, না, এই তো আঘাতের বেদনা অনুভব করছি হাতে। আমার মতো এরূপ অবস্থায় কেউ যেন না পড়ে।
করুণ স্বরে বলল কর্ডেলিয়া, বাবা, আমার দিকে চেয়ে আশীৰ্বাদ করুন আমায়।
লিয়ার বললেন, তুমি কি আমার সাথে পরিহাস করছ? আমি এক নির্বোধ মেহদুর্বল আশি বছরের বুড়ো। কিন্তু তোমায় যেন কোথাও দেখেছি বলে মনে হচ্ছে। গতরাতে আমি কোথায় ছিলাম আর আজই বা কোথায়। বুদ্ধি-সুদ্ধি বলে কিছু নেই আমার। দয়া করি আমায়, পরিহাস করে আমার অস্তরে ব্যথা দিও না। তুমি কি আমার মেয়ে কর্ডেলিয়া? তুমি আর কেঁদো না মা। বিনাদোষে তোমার বোন আমার উপর অন্যায়-অত্যাচার করেছে। বিষ খেয়ে মরব আমি। আচ্ছা! মা, আমি কি ফ্রান্সে রয়েছি?
বাবাকে সাস্তুনা দিয়ে বলল কর্ডেলিয়া, না বাবা, এ আপনারই রাজ্য।
ডাক্তার বলল, পাগলামির জন্য পূর্বের কোনও কথা ওর মনে নেই। আপনি একটু ধৈর্য ধরুন भJivठभ। w
কর্ডেলিয়ার দু-হাত ধরে বললেন লিয়ার, কর্ডেলিয়া, মা আমার, এই বুড়ো বাবার সব দোষ ভুলে গিয়ে ক্ষমা কর তাকে।
বাবা ও ডাক্তারকে নিয়ে কর্ডেলিয়া অন্য জায়গায় চলে যাবার পর কেন্ট বলল তার চাকরকে, তাহলে কর্নওয়ালের রাজ্য চালাচ্ছে প্রস্টারের ছেলে এডমন্ড, ডিউকের সম্বন্ধে যা গুজব রটেছে তা সত্যি। কিন্তু গ্লস্টারের নির্বাসিত ছেলে কি জার্মানিতে রয়েছে?
আগে থাকতেই কিছু বলা যাচ্ছে না, সৈনাদল দ্রুত এগিয়ে আসছে। আজকের যুদ্ধে জয়পরাজয়ের উপরই নির্ভর করছে আমাদের পরিকল্পনার সফলতা, বলল এডমন্ড।তারপর একজন অফিসারকে ডেকে সে বলল, যাও, তুমি গিয়ে জেনে এস অস্থিরচিত্ত ডিউকের শেষ সিদ্ধান্তটা।
অফিসার চলে যাবার পর রিগান বলল, ওগো আমার প্রিয় এডমন্ড! তুমি সত্যি করে বলতো আমার বোনকে ভালোবাস কিনা?
চালাক এডমন্ড সাথে সাথেই বলে উঠল, না ম্যাডাম, কথাটা মোটেও সত্যি নয়।
তার সাথে তোমার ঘনিষ্ঠ হওয়াটা আমি কিছুতেই সহ্য করব না, বলল রিগান।
মনে মনে মতলব ভাজতে লাগল। গনেরিল, বোনের সাথে এডমন্ডের বিয়ে হলে আমার পক্ষে তা হবে যুদ্ধে পরাজয়ের সামিল।
এ সময় ঘরে ঢুকে বলল আলবেনি, সুপ্ৰভাত। আমাদের দ্বারা বিতাড়িত হয়ে রাজা এখন তৃতীয় মেয়ের আশ্রয়ে। সততার অভাবেই আমরা ভালোভাবে যুদ্ধ করতে পারছি না। ফ্রান্সের বিরুদ্ধে।
ব্যঙ্গ করে বলল রিগান, এটা কি কোনও যুক্তির কথা?
এডমন্ড বলল, আসুন মহামান্য আলবেনি, তাবুতে গিয়ে আমরা এ বিষয়ে আলোচনা করি।
কেন? জানতে চাইলেন আলবেনি।
বিশেষ প্রয়োজন আছে। চল আমাদের সাথে, বলল রিগান।
কিছুক্ষণ ভেবে বলল আলবেনি, বেশ, চল।
ছদ্মবেশী এডগার ঘরে ঢুকে বলল আলবেনিকে, আমার মত গরিবের কথা শোনার ইচ্ছে কি আপনার আছে?
আলবেনি আর এডগারকে রেখে দিয়ে চলে গেল ওরা সবাই। তখন এডগার বলল, যুদ্ধে নামার আগে আপনি পড়ে দেখুন। এ চিঠিটা। বাইরের এই নোংরা পোশাক সত্ত্বেও আমি জানি কীভাবে সম্মান রক্ষা করতে হয়। আমি বলছি আপনাকে, এক গভীর ষড়যন্ত্র চলছে আপনার বিরুদ্ধে। এখন আমি বিদায় নিচ্ছি। সময় হলে আবার আসব আমি।
এডগার চলে যেতেই আবার এল এডমন্ড, সে ডিউককে বলল, আমাদের শত্রু সৈন্যরা এখনও দুর্বল। তাড়াতাড়ি চলুন যাতে সৈন্যদের একজোট করতে পারি–বলেই তাড়া দিতে লাগল। ডিউককে। আলবেনি চলে যাবার পর মনে মনে একবার তার প্ল্যানটাকে ঝালিয়ে নিল এডমন্ড। ওদের দু-বোনের সাথেই আমি ভালোবাসার অভিনয় করব কিন্তু বিয়ে কাউকে করব না। ওদের আর আমার বাবার সমস্ত সম্পত্তি দখল করতে হলে আমার প্রয়োজন ওদের সমর্থন আর সহযোগিতা। আমি ছেড়ে দেব না লিয়ার আর কর্ডেলিয়ার সাহায্যকারী আলবেনিকে। আর ওরা দু-বোন নিজেদের মধ্যে হিংসার ফলেই মারা যাবে। চালাকি করে এখন থেকে আমি ঝগড়া এড়িয়ে চলব।
বাবা, এই গাছের তলায় বসে আপনি কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিন, বলেই চলে গেল এডগার। আবার কিছুক্ষণ বাদেই ফিরে এল সে। ኦ
আমার হাত ধরে তাড়াতাড়ি আসুন, আমার সাথে; পরাজিত হয়ে রাজা লিয়ার বন্দি হয়েছেন তার মেয়ের সাথে, বলল। এডগার।
কান্নায় ভেঙে পড়ে গ্লস্টার বলল, না, আমি আর বঁচিতে চাই না। কিন্তু মৃত্যু তো মানুষের ইচ্ছাধীন নয়।
চিৎকার করে এডমন্ড তাঁর ভৃত্যদের হুকুম দিল বিচার না হওয়া পর্যন্ত তারা যেন লিয়ার আর কর্ডেলিয়াকে রেখে দেয়।
না কর্ডেলিয়া, ওদের ডেক না, বললেন লিয়ার, তার চেয়ে আমরা বরং কারাগারে গিয়ে সেই সব রাজাদের সমব্যাখী হই যারা ষড়যন্ত্রের শিকার। আমার চোখের জলে অচিরেই ধ্বংস হয়ে যাবে ওদের সাম্রাজ্য আর গর্ব। চল, আমরা কারাগারে যাই।
রক্ষীসহ লিয়ার আর কর্ডেলিয়া চলে যাবার পর একটা কাগজ ক্যাপ্টেনের হাতে দিয়ে তাকে নির্দেশ দিল এডমন্ড, মনে রেখ, এই চিঠির নির্দেশ অনুযায়ী যে গুরুত্বপূর্ণ কাজ তোমায় দেওয়া হয়েছে, তা পালন করতে পারলে পদোন্নতি হবে তোমার। যাও, কাজটা তাড়াতাড়ি করে এস।
এ সময় নেপথ্যে বাদ্যধ্বনি শোনা গেল। তারই সাথে প্রবেশ করল আলবেনি, গনেরিল, রিগান আর সৈন্যেরা। আলবেনি বলল, সাবাস এডমন্ড! আজকের যুদ্ধে তুমিই জয়ী হয়েছ। এবার আমি আমার ইচ্ছেমত বন্দিদের শাস্তি দেব।
আলবেনির কথা শুনে এডমন্ড খুশি হল। সে বলল, রাজা এবং কর্ডেলিয়ার এই অবস্থা দেখে দেশের মানুষ যাতে বিদ্রোহ করতে না পারে, সে জন্যই কঠোর পাহারায় রেখেছি তাঁদের। এরপর ঠান্ডা মাথায় একদিন তাদের বিচার করা যাবে।
আলবেনি বল, তুমি বোধহয় তোমার পদমর্যাদার কথা ভুলে গেছ এডমন্ড। মনে রেখা তুমি রাজার আত্মীয় নও, একজন প্ৰজা মাত্র।
রিগান বলল আলবেনিকে, মহাশয়, দয়া করে ভুলে যাবেন না যে আমার সাথে ঘনিষ্ঠতার জন্যই আজ উনি আপনাদের সমপর্যায়ভুক্ত এক সহকর্মী।
তোমার শক্তি, একথা বোলোনা বোন, উনি নিজ বলেই বলীয়ান, বলল গনেরিল।
রিগান বলল, নিজের মতোই আজ আমি ওনাকে সমস্ত সম্মান সম্রাম দান করলাম। হে আ-র প্রিয় সেনানায়ক, সবার সামনে আমি ঘোষণা করছি যে আজ থেকে তুমিই আমার স্বামী এবং প্রভু। আমার সমস্ত জীবন সমর্পণ করলাম তোমার হাতে।
ছিঃ ছিঃ রিগান, ধিক্কার দিয়ে বলে উঠল গনেরিল।
আলবেনি চিৎকার করে বলে উঠল, এডমন্ড, রাজদ্রোহিতার অপরাধে আমি বন্দি করলাম তোমায়— সেই সাথে তোমার প্রতি অনুরক্ত আমার ভণ্ড কুটিল স্ত্রীকে গ্রেফতার করলাম। আর এডমন্ড, তুমিও তো সশস্ত্র। আমি তিনবার ঢাক বাজাবার সাথে সাথে একজন লোক এসে তোমার এই রাজদ্রোহিতা আর বিশ্বাসঘাতকতার প্রমাণ দেবে।
খাপ থেকে তলোয়ার বের করে বলল এডমন্ড, সেই অভিযোগকারী লোকটি একটি শয়তান। সাহসের সাথে আমিও দ্বন্দ্ব যুদ্ধে আহ্বান জানাচ্ছি তাকে।
আলবেনি বলল, কিন্তু এডমন্ড, তোমার নিজস্ব সৈন্যেরা আমার অনুগত। কাজেই এখন থেকে নিজস্ব শক্তিই তোমার একমাত্র ভরসা।
এ সময় রিগান হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ল। আলবেনি ভৃত্যদের আদেশ দিল ওরা যেন তাকে তার তাঁবুতে নিয়ে যান।
এদিকে আলবেনির আনা অভিযোগ প্রমাণ করতে নেপথ্যে ঢাক বাজাতে লাগল। ভূত্যেরা। তৃতীয় বার ঢাক বাজার সাথে সাথে সশস্ত্র অবস্থায় প্রবেশ করল এডগার।
রক্ষী, এর আগমনের উদ্দেশ্য কী? জানতে চাইল আলবেনি।
শয়তানের ষড়যন্ত্র যদিও আমার নির্দিষ্ট পরিচয় নষ্ট হয়ে গেছে, তবুও জেনে রাখুন, আমিও উঁচুবংশের লোক, বলল ছদ্মবেশী এডগার।
ছদ্মবেশী এডগারকে প্রশ্ন করল আলবেনি, আপনার প্রতিপক্ষ কে?
আর্ল অফ গ্লস্টার এডমন্ডের প্রতিনিধি কে? জানতে চাইল ছদ্মবেশী এডগার।
আমিই স্বয়ং এডমন্ড, আর্ল অফ গ্লস্টার। বল, কী জানতে চাও তুমি? এডগারের সামনে এগিয়ে এল এডমন্ড।
তাহলে যুবক, তলোয়ার নিয়ে আত্মরক্ষার জন্য প্রস্তুত হও। আপনার অনেক গুণ থাকা সত্ত্বেও আমি জোর গলায় বলছি আপনি বিশ্বাসঘাতক। আপনি একথা অস্বীকার করলে আমার হাতের তলোয়ারই তার যোগ্য জবাব দেবে, বলল, এডগার।
ছদ্মবেশী এডগারকে বলল এডমন্ড, তোমার চেহারা আর কথাবার্তায় ভদ্রবংশের বলে মনে হলেও তোমার ঘৃণ্য ভাষণের জন্য আমার ইচ্ছে করছে এই মুহূর্তে তলোয়ার দিয়ে তোমায় হত্যা করতে।
তলোয়ার নিয়ে দু-জনের মাঝে লড়াই শুরু হবার কিছুক্ষণ বাদেই প্রচণ্ড আহত হয়ে মাটিতে পড়ে গেল এডমন্ড। তা দেখে গনেরিল চিৎকার করে বলে উঠল, ওরে কে আছিস, বাঁচা ওকে।
গনেরিলকে জোর ধমক দিয়ে বলল আলবেনি, চুপ কর কুটিল নারী। তুমি আর এডমন্ড, উভয়েই শোন তোমাদের পাপের কথা। আর এডমন্ড, এই চিঠিটাই সাক্ষ্য দিচ্ছে তোমার ঘৃণ্য কাজের।
বেশ করেছি। ওটা আমার চিঠি। আমি যা খুশি তাই করতে পারি, বলল গনেরিল।
আলবেনি ভৃত্যদের ডেকে বললেন, তোমরা ওকে দেখো।
মুমূর্ষু এডমন্ড বলতে লাগল, স্বীকার করছি অনেক পাপ করেছি।আমি। ওহে যুবক, যদি তুমি উচ্চবংশীয় হওতাহলে আমাকে হত্যা করার পাপ থেকে আমি ক্ষমা করে দেব তোমায়।
তার প্রতিদানে আমি তোমায় ক্ষমা করব এডমন্ড। আমি তোমার বড়ো ভাই এডগার। ভগবানের কাছে মানুষকে তার পাপের শাস্তি এ জন্মেই পেতে হয়। হয়তো আমার বাবার সেরূপ কোনও কাজের জন্য নিজের চোখ হারিয়েছেন।
আলবেনি বলল, হে উচ্চবংশের সস্তান, তোমাকে আলিঙ্গন করা থেকে তুমি আমাকে বঞ্চিত কর না। তোমার বাবা এবং তুমি, উভয়েই আমার প্রিয়। এতদিন কোথায় ছিলে তুমি? তোমার বাবার এরূপ অবস্থার কথা কে জানোল তোমায়? উত্তরের আশায় আলবেনি উৎসুক ভাবে চেয়ে রইলেন এডগারের দিকে।
এডগার বলল, দিনের পর দিন আমি যখন মৃত্যুভয়ে মৃত্যুর চেয়ে বেশি যন্ত্রণা ভোগ করছি, ঠিক সে সময় আমার দেখা হল বাবার সাথে। তখন দেখলাম তার দু-চোখ রক্তে ভেসে যাচ্ছে। পাগলের ভান করে আমি তাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চললাম। পরে আমার পরিচয়ও তাকে দিলাম। কিন্তু এত দুঃখ-কষ্ট-বেদনার ভার সইতে না পেরে তিনি মারা গেলেন।
আলবেনি বলল, আপনার এই দুঃখ আমায়ও বিচলিত করেছে।
এডগার বলল, এত অল্পেই আপনি বিচলিত হবেন না মহামান্য ডিউক। যারা নির্বোধি তারাই শুধু অল্পে কাতর হয়। আমি যখন পলাতক আসামীর মতো পালিয়ে বেড়াচ্ছিলাম, তখন একজন লোক সহানুভূতির সাথে আমার সব কথা শুনে জড়িয়ে ধরেন আমার বাবাকে। তিনিই আমায় আশা জুগিয়েছেন। এরপর এক এক করে রাজা লিয়ার আর তার দুঃখের কাহিনি বলে যেতে লাগল এডগার।
উৎসুক হয়ে আলবেনি বললেন, কে তিনি?
উনি হলেন নির্বাসিত কেন্ট, যিনি আজও ছদ্মবেশে রয়েছেন, উত্তর দিল এডগার।
এ সময় হাতে একটা রক্তাক্ত ছুরি নিয়ে ঘরে প্রবেশ করল একজন ভৃত্য। সে চেঁচিয়ে বলল, কে কোথায় আছ, বাঁচাও আমাকে।
আলবেনি বলল, কী হয়েছে?
ছুরিতে ওই যে রক্ত দেখছেন, তা আপনার স্ত্রীর। ওটা দিয়েই আত্মহত্যা করেছেন তিনি। আর মরার আগে বোনকেও তিনি বিষ খাইয়ে মেরেছেন, বলল সেই ভৃত্য।
এডমন্ড বলল, বাঃ বেশ ভালেই হয়েছে। এবার নিশ্চিন্তে বিয়ে করতে পারব আমরা।
এডগার বললেন আলবেনিকে, মহাশয়, ওই দেখুন, এদিকেই আসছেন কেন্ট।
দূর থেকে কেন্টকে আসতে দেখে শ্ৰদ্ধাভরে বলল আলবেনি, ভেবে পাচ্ছি না। কী দিয়ে আপনার মতো মাননীয় ব্যক্তিকে সম্মান জানাব।
কেন্ট বলল, রাজা কোথায়? আমি এসেছি তার কাছ থেকে বিদায় নিতে।
চমকে উঠলেন আলবেনি, তিনি বললেন, সত্যিই তো রাজালিয়ার আর তার মেয়ে কর্ডেলিয়া কোথায়?
কেন্ট বলল, যদিও আর বেশিক্ষণ বঁচিব না, তবুও তার আগে একটা কাজ করে যেতে চাই আমি। তাড়াতাড়ি একটা লোককে প্রাসাদ দুর্গে পাঠাতে হবে এই পরিচয় চিহ্ন আর তলোয়ারটা দিয়ে। অনেক আগেই ওদের মেরে ফেলার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
আলবেনি বলল, যাও, শীঘ্ৰ যাও।
তলোয়ারটা হাতে নিয়ে যত দ্রুত সম্ভব দুর্গের দিকে ছুটে গেল এডওয়ার্ড। তার যাবার দিকে তাকিয়ে বলল এডমন্ড, আমার আর গনেরিলের আদেশ অনুযায়ী ওরা তো কর্ডেলিয়াকে মেরে ফেলবে, কিন্তু বাইরে আমরা রটিয়ে দেব দুঃখে আর হতাশায় আত্মহত্যা করেছে কর্ডেলিয়া।
কর্ডেলিয়ার মৃতদেহ কোলে নিয়ে পাগলের বেশে ঘরে এসে ঢুকলেন রাজা লিয়ার। ক্যাপ্টেন, এডগার আর অন্য সবাই ঢুকাল তার পিছু পিছু।
ওগো, তোমরাকি সবাই পাথর হয়ে গেলে? প্ৰাণপণে প্ৰতিবাদ কর তোমরা। সে যে চিরকালের মতো ছেড়ে গেছে আমায়। একটা আয়না দেও আমায়। আমি দেখব ওর মাঝে এখনও প্ৰাণ আছে কিনা— পাগলের মতো বলতে লাগলেন রাজা লিয়ার।
এডগার ও কেন্ট বলল, সত্যিই কী ভয়াবহ পরিণতি রাজা লিয়ারের।
ওগো, তোমরা দেখ ওর আঁচলটা নড়ছে, ও এখনও বেঁচে আছে। কে তুমি, চলে যাও বলছি, বললেন লিয়ার।
মহারাজ, ইনি আপনার বন্ধু কেন্ট, বলল এডগার।
লিয়ার বলল, তোমরা মিথ্যেবাদী। মানুষ খুনের দায়ে অভিযুক্ত তোমরা। হয়তো বাঁচাতে পারতাম তাকে। কিন্তু … কর্ডেলিয়া, তুমি যেও না, দাঁড়াও, তাকিয়ে দেখ তোমার হত্যাকারীকে ফাসি দিয়েছি আমি।
কে তোমরা? ভালো করে দেখতে পাচ্ছি না আমি। তুমিই কি কেন্ট?
হ্যাঁ প্ৰভু, আমিই কেন্ট, যে আপনার দুঃখে আন্তরিকভাবে দুঃখিত।
রাজা লিয়ার স্বাগত জানাচ্ছে তোমায়।
কেন্ট বলল, আপনার দুই মেয়ে আজ মৃত। শ্মশানে পরিণত হয়েছে তাদের রাজ্য।
আমারও মনে হয় তাই, বললেন লিয়ার।
আলবেনি বলল, মাননীয় কেন্ট, মেয়ের শোকে উনি পুরোপুরি উন্মাদ। এসব কথা আজ ওর কাছে অর্থহীন।
কেন্ট বলল আলবেনিকে, মহাশয়, এডমন্ডের মৃত্যু হয়েছে।
সে কথায় কান না দিয়ে আলবেনি বলল, মাননীয় লর্ড এবং আমার বন্ধুরা, এবার আপনারা আমার মনোগত অভিপ্রায় শুনুন। বৃদ্ধ রাজাকে আমি আমার সমস্ত সম্পত্তি দিয়ে দিলাম। আজ থেকে ওর সেবায় নিয়োজিত রাখব নিজেকে। প্রিয় এডগার ও কেন্ট, পূর্বের মতো নিজেদের সাম্রাজ্য নিজের হাতে নিয়ে বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হন। আপনারা।
সবাই তাকিয়ে রইল রাজার দিকে। লিয়ার বলতে লাগলেন, হায় হতভাগী কর্ডেলিয়া! তুমি কি কিছু বলতে চাইছ? চিৎকার করে বললেন তিনি, কিছু বল আমায়। আমি তোমার বৃদ্ধ পিতা হতভাগ্য রাজা লিয়ার। আমার মেয়ে কি আজও বেঁচে আছে? ওর ঠোঁট যেন নড়ছে। এডগার, তুমি দেখতো একবার। ওঃ ভগবান! বলেই অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে গিয়ে সাথে সাথেই মারা গেলেন তিনি। কাতর স্বরে বলল প্ৰভুভক্ত কেন্ট, প্রচণ্ড দুঃখ-শোকেই মৃত্যু হল রাজার।
প্ৰভু, একবার চোখ মেলে তাকান, বলল এডগার।
ওর জীবনকে দীর্ঘায়িত করে আর তাকে কষ্ট দিও না তুমি, বলল কেন্ট, জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা এসে গিয়েছিল রাজার। এই প্রচণ্ড কষ্ট এতদিন ধরে তিনি কীভাবে সহ্য করেছেন তা ভেবে আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি।
আলবেনি বলল, এবার আপনারা রাজ্যের শাসনভার গ্রহণ করুন।
কেন্ট বলল, আমার পক্ষে তা সম্ভব নয়। প্রভুর সঙ্গ ছাড়া আমার জীবন অর্থহীন। তিনি ডাকছেন আমায়, আমি চললাম তার কাছে।
শেষে বলল এডগার, বয়স বাড়ার সাথে সাথে নানা বাধা-বিয়ের মধ্য দিয়ে মানুষ দুঃখের স্বাদ যেমন পায়, তেমনি অর্জন করে নানারূপ অভিজ্ঞতা। অল্প বয়সিরা এসব জানে না। তাই আমাদের উচিত সর্বদা সত্যের পথ অনুসরণ করা— আর সেই সাথে বর্তমান সময়ের ভার বহন করা।