কমেডি
ট্রাজেডি
সনেট

রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট – ০৫ (শেষ)

এই তো সবে বিয়ে হয়েছে রোমিও-জুলিয়েটের। এরই মধ্যে রোমিওর হাতে টিবল্টের মৃত্যু ও তার পরিণতিতে রোমিওর নির্বাসন দণ্ডের খবর শুনে যার-পর-নাই ভেঙে পড়ল জুলিয়েট। নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে দিয়ে সর্বদাই সে কাঁদতে লাগল। বাবা, মা, বাড়ির সবাই নানাভাবে বোঝালেন তাকে—তা সত্ত্বেও জুলিয়েটের চোখের জল বাঁধা মানল না।

একমাত্র মেয়ের এরূপ অবস্থা দেখে বুড়ো ক্যাপুলেট বড়োই উদ্বিঘ্ন হয়ে উঠলেন। তার মনের শান্তি নষ্ট হয়ে গেল, রাতের ঘুম যে কোথায় পালিয়ে গেল তা কে জানে। শেষ অনেক ভেবেচিন্তে স্ত্রীর সাথে আলোচনা করে একটা উপায় খুঁজে পেলেন তিনি। তিনি তো কাউন্ট প্যারিসকে আগেই কথা দিয়েছেন যে জুলিয়েটের বিয়ে দেবেন। তিনি স্থির করলেন অযথা কাল-বিলম্ব না করে কাউন্টের সাথে জুলিয়েটের বিয়েটা চুকিয়ে দেবেন। স্বামী-স্ত্রী ধরে নিলেন বিয়ের আনন্দে টিবল্টের কথা ভুলে যাবে জুলিয়েট।

এবার জুলিয়েটের বিয়ের জোরদার আয়োজন শুরু হল। পরিবারের সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ঘর-দোর সাজানো, রাতারাতি জুলিয়েটের জন্য গহনা গড়ানো, এ সবই হয়ে গেল। ব্যাপার-স্যাপার দেখে খুবই চিন্তিত হয়ে পড়ল জুলিয়েট। এর তো সবে মাত্র বিয়ে হয়েছে তার, আর তাও কিনা চিরশত্রু মন্টেগু পরিবারের রোমিওর সাথে—মরে গেলেও এ খবর তিনি জানাতে পারবেন না কাউকে। সে মিনতি জানিয়ে বাবা-মাকে বলল তার মনটা বড়োই চঞ্চল হয়ে আছে। এসময় তার বিয়ে দিলে বিয়ের কোনও আনন্দই উপভোগ করতে পারবে না সে।

কিন্তু জুলিয়েটের কাতর মিনতি ও চোখের জল সত্ত্বেও তার বাবার মন গলল না। তার অনুরোধের কোনও মূল্য দিলেন না তার বাবা। তিনি জুলিয়েটকে ডেকে স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিলেন যে কাউন্ট প্যারিসের সাথেই তার বিয়ে হবে। এতে জুলিয়েট রাজি না হলে একবস্ত্রে তাকে বের করে দেবেন বাড়ি থেকে। আর যতদিন বেঁচে থাকবেন তার মুখদর্শন করবেন না।

একগুঁয়ে বাপের সিদ্ধান্ত শুনে খুবই মুশকিলে পড়ে গেল জুলিয়েট। সে ভেবে পেল না কীভাবে এই বিপদ থেকে মুক্তি পাবে। শেষমেশ তার মনে পড়ল সন্ন্যাসী লরেন্সের কথা—যিনি তাদের বিয়ে দিয়েছিলেন। একদিন সবার অলক্ষ্যে বাড়ি থেকে বেরিয়ে সে চলে গেল সন্ন্যাসীর আস্তানায়। সন্ন্যাসীকে সব কথা বলে তার পরামর্শ চাউল সে।

সবকথা শোনার পর সন্ন্যাসী তাকে বললেন, ‘দেখ, বাবার অবাধ্য হয়ো না। কাউন্ট প্যারিসকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে যাও তুমি। ও নিয়ে কান্না-কাটি করোনা। ফুলের তৈরি একটা ওষুধ আমি তোমায় দিচ্ছি। তুমি সেটা সাবধানে রেখে দিও। এটা যেন অন্য কারও হাতে না পড়ে। যে দিন তোমার বিয়ে হবে, তার আগের দিন রাতে এই ওষুধটা খেয়ে তুমি শুয়ো। এই ওষুধের প্রভাবে খুব শীঘ্র ঘুমিয়ে পড়বে তুমি—তখন মৃতের সমস্ত লক্ষণ দেখা দেবে তোমার দেহে। পরদিন সকালে তোমাকে দেখে সবাই ধরে নেবে তুমি মারা গেছ। তখন বাধ্য হয়ে তোমার বাবা বিয়ে বন্ধ করে তোমার মৃতদেহ গির্জায় পাঠিয়ে দেবেন কবর দেয়ার জন্য। গির্জার ভেতর ক্যাপুলেটদের একটা নিজস্ব ঘর আছে। পারিবারিক নিয়ম অনুযায়ী তোমার মৃতদেহ কমপক্ষে একদিন রাখা হবে সেখানে। আমি যে ওষুধটা তোমায় দিচ্ছি তার মেয়াদ চব্বিশ ঘণ্টা। এর অর্থ রাত ফুরোবার আগেই ক্যাপুলেটদের সেই কক্ষে ঘুম ভেঙে যাবে তোমার। ঘুম ভেঙে গেলেই দেখবে তোমার কাশে বসে আছে রোমিও। তোমার জ্ঞান ফিরে এলেই রাতারাতি তোমায় মান্টুয়ায় নিয়ে যাবে রোমিও। নিশ্চিন্তে সেখানে ঘর বাঁধতে পারবে তোমরা। আমি এখনই একজন বিশ্বস্ত লোককে মন্টুয়ায় রোমিওর কাছে পাঠিয়ে দিচ্ছি। রোমিওর যা যা করণীয় তাকে আগে থেকেই বলে আসবে সে। আশা করি এবার তুমি নিশ্চিন্ত হয়ে বাড়ি ফিরে যেতে পারবে।’

সন্ন্যাসীর কথায় আশ্বস্ত হয়ে বাড়ি ফিরে এল জুলিয়েট। বাবাকে ডেকে সে বলল, ‘বাবা! কাউন্টকে বিয়ে করতে রাজি আমি। তুমি যেদিন বলবে সে দিনই বিয়ে হবে।’

বাবা ভাবলেন সম্ভবত বাড়ি ছাড়ার ভয়েই জুলিয়েট রাজি হয়েছে কাউন্ট প্যারিসকে বিয়ে করতে। যাই হোক, এবার তিনি নিশ্চিন্ত হয়ে মেয়ের বিয়ের দিন-ক্ষণ স্থির করলেন।

সে দিন তার বিয়ে হবে তার আগের রাতে খাওয়া-দাওয়া সেরে তার ঘরের জানালার কাছে এসে দাঁড়াল জুলিয়েট। রোমিওর সাথে প্রথম পরিচয়ের রাতে যে গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে রোমিও সারারাত তার সাথে কথা বলেছিল, সে দিকে তাকিয়ে বহুক্ষণ দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। তারপর ধারেকাছে কাউকে দেখতে না পেয়ে সন্ন্যাসী প্রদত্ত ওষুধটা খেয়ে ফেলল সে। একটু বাদেই বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ বাদেই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল সে।

পরদিন সকালে জুলিয়েটকে ডাকতে এসে ধাই দেখতে পেল মড়ার মতো নিশ্চুপ হয়ে শুয়ে পড়ে আছে জুলিয়েট। কাছে গিয়ে সে দেখল তা নিশ্বাস-প্রশ্বাস বইছে না, বুকের ধুকপুকুনি নেই, চোখের মণি ওপরে উঠে গেছে। ভয় পেয়ে তৎক্ষণাৎ খবর দিল জুলিয়েটের বাবা-মাকে। তারা এসে মেয়ের অবস্থা দেখে বেজায় ঘাবড়ে গেলেন। সাথে সাথেই জুলিয়েটের বাবা চাকরকে পাঠিয়ে ডাক্তারকে ডেকে আনলেন। জুলিয়েটকে ভালোভাবে পরীক্ষা করে ডাক্তার জানালেন বহু আগেই মৃত্যু হয়েছে। ডাক্তারের কথা শুনে বাড়িময় কান্নার রোল উঠল। বাড়ির সবাই বুক চাপড়ে কাঁদতে লাগল। তারা স্বপ্নেও ভাবেনি এমন সর্বনাশ ঘটে যেতে পারে।

মেয়ের দুঃখে কাঁদতে কাঁদতে তার মৃতদেহটিক ফুলে সাজিয়ে কবর দেবার জন্য গির্জায় পাঠিয়ে দিলেন জুলিয়েটের বাবা-মা। পারিবারিক প্রথা অনুযায়ী জুলিয়েটের মৃতদেহটি একদিন সমাধি ক্ষেত্রে রাখার ব্যবস্থা করা হল।

সন্ন্যাসী লরেন্সও চুপচাপ বসে ছিলেন না। একজন বিশ্বস্ত লোককে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে তাকে পাঠিয়েছিলেন মান্টুয়ায় রোমিওর কাছে। কথা ছিল সেই লোক রোমিওকে সব কিছু খুলে বলবে এবং জুলিয়েটের মৃতদেহ সমাধিকক্ষে রাখা হলে সে রোমিওকে সেখানে নিয়ে আসবে। সন্ন্যাসী লরেন্স জানতেন জুলিয়েট যে ওষুধ খেয়েছে তার মেয়াদ কখন শেষ হবে। তিনিও রাতের বেলা সেখানে চলে আসবে যাতে ঘুম ভেঙে জুলিয়েট দেখে তাকে আর রোমিওকে। এরপর জুলিয়েটকে ভেরোনার সীমান্ত পার করিয়ে মান্টুয়ায় পৌঁছে দেবার দায়িত্ব তারই।

অথচ রোমিওর দুর্ভাগ্য এমনই যে সন্নাসীর লোক পৌঁছাবার আগেই ভেরোনা ফেরত অন্য এক লোকের মুখে জানতে পারল জুলিয়েট মারা গেছে। জুলিয়েটের বাবা-মা তার বিয়ে ঠিক করেছিল কাউন্ট প্যারিসের সাথে। কিন্তু বিয়র নির্দিষ্ট দিনে ভোরের আলো দেখার সুযোগ হয়ে ওঠেনি জুলিয়েটের। আগের রাতেই মারা গেছে সে। জুলিয়েটের মৃত্যুর কথা শুনে মন ভেঙে গেল তার। সে স্থির করল আত্মহত্যা করবে। এক ওঝার কাছ থেকে মারাত্মক বিষ সংগ্রহ করে ভেরোনায় এসে পৌঁছাল সে। অনেক খোঁজ করেও সন্ন্যাসী লরেন্সের লোক খোঁজ পেন না রোমিওর।

আবার রোমিওর মত ঠিক একই অবস্থা হয়েছে কাউন্ট প্যারিসের। জুলিয়েটের অপরূপ সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে তাকে বিয়ে করার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছিল প্যারিস। এবার জুলিয়েটের মৃত্যু-সংবাদ শুনে সে যেন সত্যিই পাগল হয়ে গেল। পরদিন সকালেই জুলিয়েটকে সমাধি দেওয়া হবে শুনে তাকে এক ঝলক দেখার জন্য সে রাতেই কাউন্ট এসে হাজির সেই সমাধিক্ষেত্রে। কিন্তু নিয়তি কী নিষ্ঠুর! তিনি আসার কিছু আগেই রোমিও এসেছে সেখানে। সমাধিক্ষেত্রে ঢোকার আগে সে চারপাশে খুঁজে দেখছিল সেখানে কেউ পাহারা দিচ্ছে কিনা।

কাউন্ট প্যারিস সমাধিকক্ষে ঢোকার সময় রোমিওকে হঠাৎ সেখানে দেখে বেজায় চমকে উঠলেন। তিনি জানেন তোমিও ক্যাপুলেটদের চিরশত্রু। কিছুদিন আগে ক্যাপুলেট বংশের টিবল্টকে হত্যার দরুন ভেরোনার রাজার যে রোমিওকে মান্টুয়ায় নির্বাসনে পাঠিয়েছেন সে কথাও অজানা নেই তার। স্বভাবতই কাউন্টের মনে হল সীমান্ত পেরিয়ে এত রাতে এখানে কেন এসেছে রোমিও? নিশ্চয়ই তার কোনও অসৎ উদ্দেশ্য আছে নইলে সে এখানে ঘোরাঘুরি করছে কেন। জুলিয়েটকে বিয়ে করতে না পারলেও কাউন্ট নিজেকে ক্যাপুলেটদের আত্মীয় বলেই মনে করেন। সে কথা মনে রেখে কাউন্ট তখনই তলোয়ার বের করে ঝাঁপিয়ে পড়লেন রোমিওর উপর। সাথে সাথে রোমিও পালটা আক্রমণ করল কাউন্টকে। এ ধরনের চোরা-গোপ্তা আক্রমণের জন্য আগে থেকেই প্রস্তুত হয়ে এসেছিল রোমিও। কিন্তু তলোয়ারবাজিতে তার সাথে মোটেই পাল্লা দিতে পারলেন না কাউন্ট প্যারিস। কিছুক্ষণ বাদেই তিনি রক্তাক্ত দেহে লুটিয়ে পড়লেন সমাধিকক্ষের দোরগোড়ায়। জুলিয়েটের নামটা কোনওমতে আউড়ে চিরকালের মতো নীরব হয়ে গেলেন তিনি।

শত্রু নিধনের পর রোমিও প্রবেশ করলেন জুলিয়েটের সমাধিকক্ষে। সেখানে ঢুকে মোমবাতির মৃদু আলোয় দেখতে পেলেন সামনেই একটা কফিনে শুয়ে আছে জুলিয়েট—প্রাণের স্পন্দন নেই শরীরে। সন্ন্যাসীর দেওয়া ওষুধের প্রভাব তখনও কাটেনি। জ্ঞান ফিরে আসতে দেরি আছে। কিন্তু রোমিও তো জানে না সন্ন্যাসীর দেওয়া ওষুধের কথা। তাই সে ধরে নিল জুলিয়েটের মৃত্যু হয়েছে। ওঝার দেওয়া বিষের শিশিটা বের করে শেষবারের মতো জুলিয়েটের ঠোঁটে চুমু খেল রোমিও। তারপর শিশির পুরো বিষটা ঢেলে দিল নিজের গলায়। বিষের জ্বালায় জ্বলতে জ্বলতে কিছুক্ষণ বাদেই জুলিয়েটের কফিনের পাশে শেষ নিশ্বাস ফেলল রোমিও।

ওষুধের প্রভাব কেটে যাবার পরই চোখ মেলে তাকাল জুলিয়েট। কফিনের বাইরে বেরিয়ে সে দেখল বরফ-ঠাণ্ডা মেঝের উপর শুয়ে আছে রোমিও। বহুবার ডেকেও তার কোনও সারা পেলনা জুলিয়েট। সন্দেহ হতে রোমিওর নাকের সামনে হাত নিয়ে দেখলে নিশ্বাস-প্রশ্বাস বইছে না। ঠিক সে সময় তার নজরে এলো মেঝের উপরে পড়ে রয়েছে একটা শিশি। শিশিটা কুড়িয়ে নিয়ে শুঁকতেই তীব্র গন্ধে তার নাক জ্বলে যেতে লাগল। শিশিতে যে তীব্র বিষ ছিল এ ব্যাপারে নিঃসন্দেহ হল জুলিয়েট। রোমিওর কোমরের খাপ থেকে ছোরাটা বের করে সজোরে নিজের বুকে বসিয়ে দিল জুলিয়েট। দু-একবার ছটফট করে চিরকালের মতো নিশ্চল হয়ে গেল তার দেহ।

সঠিক সময়ে সন্ন্যাসী লরেন্স এলেন সেখানে। রোমিও-জুলিয়েটের মৃতদেহ দেখে আর্তনাদ করে উঠলেন তিনি।

খবর পেয়ে ক্যাপুলেট আর মন্টেগু—উভয় পরিবারের লোকেরা সেখানে ছুটে এল তাদের আত্মীয়-স্বজনদের নিয়ে। ভেরোনার রাজাও খবর পেয়ে ছুটে গেলেন সেখানে। সন্ন্যাসী লরেন্স সবাইকে বলতে লাগলেন কীভাবে রোমিও-জুলিয়েট ঘর বাঁধার পরিকল্পনা করেছিল আর নিষ্ঠুর নিয়তির প্রভাবে কীভাবে তা ধ্বংস হয়ে গেল। কীভাবে অতীতের সামান্য শত্রুতার জেরে তাদের উভয় পরিবারের জীবনে এমন সর্বনাশ নেমে এল সে কথা উপলব্দি করে সবার সামনে কেঁদে ফেললেন রোমিও ও জুলিয়েটের বাবা। হাতে হাত মিলিয়ে তারা ঘোষণা করলেন আজ থেকে সমস্ত বৈরিতার অবসান হল—সেই সাথে শপথ নিলেন ভেরোনা শহরের মাঝখানে তাঁরা রোমিও-জুলিয়েটের মর্মর মূর্তি স্থাপন করবেন।

(সমাপ্ত)

3 Comments
Collapse Comments

অসাধারণ উপস্থাপন!

খুব ভালো লাগলো ।

বহুদিন থেকে সখ ছিল শেক্সপিয়ারের “রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট” পড়ার, উক্ত সাধ মেটানোর জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *