সাহিত্যিকের বউ

সাহিত্যিকের বউ 

সাহিত্যিক? শেষ পর্যন্ত একজন দেশপ্রসিদ্ধ সাহিত্যিকের সঙ্গেই তার বিবাহ হইবে নাকি?—এই বিস্ময় বিবাহের আগে কতদিন অমলাকে অভিভূত করিয়া রাখিয়াছিল ঠিক করিয়া বলা সহজ নহে; মোটামুটি তিন মাস। কারণ, স্বনামধন্য সাহিত্যিক সূর্যকান্তের সঙ্গে সম্বন্ধ স্থির হওয়ার মাস তিনেক পরেই শুভবিবাহটি সম্পন্ন হইয়াছিল। 

ফোর্থ ক্লাস পর্যন্ত স্কুলে পড়িয়া তারপর বাড়িতে লেখাপড়া, গানবাজনা, সেলাই-ফোঁড়াই, সংসারের কাজকর্ম, ঝগড়াঝাঁটির কৌশল ইত্যাদি শিখিতে শিখিতে যেসব মেয়ে আত্মীয়স্বজনের সতর্ক পাহারা ও অসতর্ক রক্ষণাবেক্ষণে বড় হয়, অমলা তাদের একজন। অতএব বলাই বাহুল্য যে লাইব্রেরি মারফত বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে অমলার ভালোরকম পরিচয়ই ছিল। প্ৰথমে লুকাইয়া আরম্ভ করিয়া তারপর ঘরের কোণ আশ্রয় করার মতো বয়স হওয়ার পর হইতে প্রকাশ্যভাবেই সে সপ্তাহে চার-পাঁচখানা গল্প-উপন্যাসের বই ও মাসে তিন- চারখানা মাসিকপত্র নিয়মিতভাবে পড়িয়া আসিতেছে। প্রকৃতপক্ষে, স্কুল ছাড়িবার পর বাড়িতে তার পড়াটা দাড়াইয়াছে এই এবং লেখাটা দাঁড়াইয়াছে চিঠি লেখা। সূর্যকান্তের লেখা পাঁচখানা উপন্যাস, তিনখানা গল্প সঞ্চয়ন ও একখানা নাটক সে তার সঙ্গে ভদ্রলোকের বিবাহের প্রস্তাব হওয়ার অনেক আগেই পড়িয়া ফেলিয়াছিল। তখন কী সে জানিত হৃদয়ের ভাবপ্রবণতাগুলিকে পরম উপভোগ্যভাবে উদবেলিত করিয়া রাখা, কখনো কাঁদানো কখনো- হাসানো এই কাহিনীগুলির জন্মদাতা একদিন স্বয়ং তিনটি বন্ধুর সঙ্গে তাকে দেখিতে আসিবে এবং দেখিয়া পছন্দ করিয়া যাইবে! 

বড় খাপছাড়া মনে হইয়াছিল ব্যাপারটা অমলার। সাহিত্যিকরা, বিশেষত সূর্যকান্তের মতো সাহিত্যিকরা, কী রকম রামশ্যামের মতো জীবনসঙ্গিনী খুঁজিয়া নেয়? তার মতো পর্দানশিন সাধারণ মেয়েকে (সাধারণ মেয়ে অবশ্য সে নয় কিন্তু একদিন খানিকক্ষণ শুধু চোখে দেখিয়া, কয়েকটা প্রশ্ন করিয়া, সেলাইয়ের কাজের একটু নমুনা দেখিয়া, আর একখানা গানের সিকি অংশ শুনিয়া তার কী পরিচয় ওরা পাইয়াছিল শুনি?) পছন্দ করে? এ জগতে পুরুষ ও নারীর প্রেম তো একরকম ওরাই ঘটায় এবং শেষ পর্যন্ত মিলন হোক আর বিচ্ছেদ হোক—ওদের ঘটানো প্রেমের অগ্রগতির কাহিনী পড়িতে পড়িতেই তো যতটুকু মন কেমন করা সম্ভব ততটুকু মন কেমন করে মানুষের? কয়েকটি ছোটগল্প ছাড়া সূর্যকান্তের কোন লেখাটি সে পড়িতে পারিয়াছিল যার মধ্যে দু-এক জোড়া নরনারীর জটিল সম্পর্ক তাকে দুশ্চিন্তা, আবেগ ও সহানুভূতিতে পরবর্তী বইখানা পড়িতে আরম্ভ করা পর্যন্ত অন্যমনা ও চঞ্চলা করিয়া রাখে নাই? সেই সূর্যকান্ত এ কী করিতে চলিয়াছে? একটা শ্বাসরোধী অসাধারণ ঘটনার ভিতর দিয়া প্রথম পরিচয় এবং কতগুলি জটিল ও বিস্ময়কর অবস্থার মধ্যস্থতায় প্রেমের জন্ম হইয়া না হোক অন্ততপক্ষে জানাশোনা মেয়েদের মধ্যে একজনকে খুব সাধারণভাবেই একটু ভালবাসিয়া তারপর তাকে বিবাহ করা তো উচিত ছিল সূর্যকান্তের? তার বদলে একটা অজানা-অচেনা মেয়েকে সে গ্রহণ করিতেছে কোন যুক্তিতে? জীবনে এ অসামঞ্জস্য সে বরদাস্ত করিবে কী করিয়া। ওর বইগুলিতে কত স্বামী-স্ত্রী পরস্পরকে ভালবাসিতে পারে নাই, জীবনটা তাদের ব্যর্থ হইয়া গিয়াছে। নিজের বেলাও সেরকম কিছু ঘটিতে পারে—এ ভয় সূর্যকান্তের নাই? 

এসব গভীর সমস্যার কথা ভাবিবার সময় অমলা পাইয়াছিল তিন মাস। তিন মাসে উনিশ বছরের একটি মেয়ে যে কত চিন্তা আর কল্পনায় মনটা ঠাসিয়া ফেলিতে পারে, কত রোমাঞ্চকর রোমান্স অনুভব করিতে পারে, উনিশ বছরের মেয়েরাই তা জানে। একটা কথা অমলা বেশি করিয়া ভাবিত : প্রেম-সংক্রান্ত বিরাট ব্যাপার কিছু একটা যদি সূর্যকান্তের জীবনে নাই ঘটিয়া থাকে— সব বিষয়ে এমন গভীর ও নিখুঁত জ্ঞান সে পাইল কোথায়, আর ওরকম কিছু ঘটিয়া থাকিলে বিবাহে তার রুচি আসিল কোথা হইতে? কোনো সময় অমলার মনে হইত নিজের বুক ভাঙিবার রোমাঞ্চকর অপূর্ব ইতিহাস যদি সূর্যকান্ত ভুলিয়া গিয়া থাকে, এত দুর্বল যদি তার হৃদয়ের একনিষ্ঠতা হয় যে ইতোমধ্যে ভাঙা বুকটা আবার লাগিয়া গিয়া থাকে জোড়া, মানুষ হিসাবে লোকটা তবে কী অশ্রদ্ধেয়! ছি ছি, শেষ পর্যন্ত এমন একটা স্বামী তার অদৃষ্টে ছিল যে ভালবাসে, কিন্তু ভুলিয়া যায়? আবার অন্য সময় অমলার মনে হইত, সূর্যকান্তের হৃদয়ে হয়তো কখনো ভালবাসার ছাপ পড়ে নাই, আসলে লোকটা খুব জ্ঞানী আর অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন বলিয়া অন্য লোকের জীবনের ঘটনা ও মানসিক বিপর্যয় দেখিয়া শুনিয়া অনুমান ও কল্পনা করিয়া নরনারীর হৃদয়-সংক্রান্ত অভিজ্ঞতাগুলি সে আহরণ করিয়াছে। ভালবাসিলে দুঃখ পাওয়ার সম্ভাবনাটাই বেশি অনিবার্য, এ কথা জানে বলিয়াই বোধ হয় ভালো না বাসিয়া বিবাহ করাটা সে মনে করিয়াছে ভালো? তা যদি হয়, অমলা ভাবিত, তাতেও ওকে শ্রদ্ধা সে করিতে পারিবে না। দুঃখ পাইবে বলিয়া যে ভালবাসে না, সে আবার মানুষ না কি! একেবারে অপদার্থ জীব! আবার সময় সময় অমলার মনে হইত, নিজের ভালবাসার নির্মম পরিণতির স্মৃতি ভুলিতে পারিতেছে না বলিয়া অসহ্য মনোবেদনার তাড়নাতেই সূর্যকান্ত এই খাপছাড়া কাণ্ডটা করিতেছে! অমলা কি জানে না ও রকম অবস্থায় কত লোকে কত কী অদ্ভুত কাণ্ড করে? কেউ মদ খাইয়া গোল্লায় যায় (সূর্যকান্তের ‘দিবাস্বপ্ন’, ‘ঘরের বাহিরে পথ’ প্রভৃতি গ্রন্থ দ্রষ্টব্য), কেউ সন্ন্যাসী হয়, কেউ হাজার হাজার লোকের সর্বনাশ করিয়া যশ ও টাকা করে (নাম মনে নাই), কেউ আত্মহত্যা করে (মাগো!)। সূর্যকান্ত একটা বিবাহ করিবে তা আর বেশি কী? এই কথাগুলি ভাবিবার সময় ভাবী স্বামীর জন্য বড় মমতা হইত অমলার। নিশ্বাস ফেলিয়া মনে মনে সে বলিত, আহা, আমি কি ওকে এতটুকু শান্তি দিতে পারব? 

যত পরিবর্তনশীল এলোমেলো কল্পনাই মনে আসুক এ কথা কিন্তু অমলা কখনো ভুলিত না যে সাধারণ উকিল, মোক্তার, ডাক্তার, চাকরে, ব্যবসাদার বা ওই ধরনের কারো সঙ্গে তার বিবাহ হইবে না, স্বামী সে পাইবে অসামান্য; দেশসুদ্ধ লোক যার নাম জানে, দেশসুদ্ধ লোক যার লেখা পড়িয়া হাসে কাঁদে। 

প্রায় ত্রিশ বছর বয়স সূর্যকান্তের। ঠিক সুপুরুষ তাকে বলা যায় না, তবে চেহারায় একটা দুর্বোধ্য ব্যক্তিত্বের ছাপ আছে, একটা আশ্চর্য আকর্ষণ আছে। কথাবার্তা-চলাফেরায় সে খুব ধীর ও শান্ত—অনেকটা বৃহৎ সংসারের আকণ্ঠ- সংসারী বড়কর্তাদের মতো। কারো সঙ্গে কথা বলিবার সময় সে এমনভাবে নিরপেক্ষ নিরুত্তেজ হাসি হাসে যে মনে হয় আলাপি লোকটির মতো অসংখ্য লোকের সঙ্গে ইতোপূর্বেই তার ঘনিষ্ঠ পরিচয় হইয়াছে এবং যে কথাগুলি লোকটি বলিতেছে কতবার যে এসব কথা সে শুনিয়াছে তার সংখ্যা হয় না। কেবল মানুষ নয়, জগতে কিছুই যেন সূর্যকান্তের কাছে মৌলিক নয়, কিছুই তাকে আশ্চর্য করিতে পারে না, পুরোনো জুতার মতো হইয়া গিয়াছে— মানুষ, ঘটনা, বস্তু, বাস্তবতা, কল্পনা ও জীবনের খুঁটিনাটি; তার অভিজ্ঞতায় এমন বেমালুম খাপ খায় যে ফোসকা পড়া দূরে থাক অস্পষ্ট একটু মচমচ শব্দ পর্যন্ত যেন করে না। যা কিছু আছে জীবনে সমস্তের সমালোচনা করিয়া দাম কষা হইয়া গিয়েছে—আশা-আকাঙ্ক্ষা ব্যথা-বেদনা আনন্দ-উচ্ছ্বাস আবেগ-কল্পনা সমস্ত হইয়া আসিয়াছে নিয়ন্ত্রিত : নালিশও নাই, কৃতজ্ঞতাও নাই। বাহুল্যবর্জিত একটা আরাম বোধ করা ছাড়া বাঁচিয়া থাকার আর কোনো অর্থ সে যেন খুঁজিয়া পায় না। পাকা সাঁতারুর মতো সহজ ও স্বাভাবিকভাবে সে সাঁতার কাটে জীবনসমুদ্রে, প্রাণপণে হাত-পা ছুঁড়িয়া ফেনিল আবর্ত সৃষ্টি করে না। 

জীবনসমুদ্র? অমলা তো একেবারে থতোমতো খাইয়া গেল। এ যে গুমোটের দিঘি! এ কী শান্ত, ঠাণ্ডা মানুষ! ভাব কই, তীব্রতা কই, উচ্ছ্বাস কই? অন্যমনস্কতা, ছেলেমানুষি, খাপছাড়া চালচলন, রহস্যময় প্রকৃতির ছোটবড় অভিব্যক্তি—এসব কোথায় গেল? মানুষের মধ্যে সে যে একজন অত্যাশ্চর্য মানুষ—দিনে-রাত্রে কখনো একটিবারও এ পরিচয় সে দেয় না। সাধারণত মানুষের মধ্যেও বরং যতটুকু প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য, চরিত্রগত মৌলিকতা থাকে, তাও যেন তার নাই। তার অসাধারণত্ব যেন এই যে সাধারণ মানুষের চেয়েও সে সাধারণ। গম্ভীর নয়, বেশি কথাও বলে না। বেশভূষার দিকে বাড়াবাড়ি নজর নাই, অবহেলাও করে না। সুখসুবিধা যতখানি পাওয়ার কথা না পাইলে কারণ জানিতে চায়, বেশি পাইলে খুশি হয়, অতিরিক্ত উদারতাও দেখায় না, স্বার্থপরের মতো ব্যবহারও করে না। ক্ষুধা পাইলে খায়, ঘুম পাইলে ঘুমায়, রাগ হইলে রাগে, হাসি পাইলে হাসে, ব্যথা পাইলে ব্যথিত হয়, এই কী অমলার কল্পনার সেই আত্মভোলা রহস্যময় মানুষ? এসব সাধারণ ব্যাপারে শুধু নয়, বউয়ের সঙ্গে পর্যন্ত সে হাসে, গল্প করে, বউকে রাগাইয়া মজা দেখে, বউকে আদর করে, স্নেহ জানায়—একেবারে সহজ স্বাভাবিকভাবে, আর দশজন বাজে লোকের মতো, একটা অপূর্ব ও অসাধারণ সম্পর্ক তাদের মধ্যে যেন সৃষ্টি করিয়া লইতে হইবে না : আঙুলে আঙুলে ঠেকিলে দুজনের যাতে রোমাঞ্চ হয়, চোখে চোখে চাহিয়া মুহূর্তে তারা যাতে আবিষ্কার করিতে পারে পরস্পরের নব নব পরিচয়, যাতে শুধু অফুরন্ত শিহরন। 

গোড়ার একদিনের কথা— যখন পর্যন্ত স্বামীর প্রকৃতির এরকম স্পষ্ট পরিচয় অমলা পায় নাই—অমলার মনে গাঁথা হইয়া আছে। বিকালে কোনো কাগজের বিপন্ন সম্পাদক জরুরি তাগিদ দিয়া গিয়াছিল, সন্ধ্যার পর শোবার ঘরে সূর্যকান্ত লিখিতে বসিয়াছিল গল্প। বাড়িতে অনেক লোক : বিবাহ উপলক্ষে আসিয়া অনেক আত্মীয়স্বজন তখনো ফিরিয়া যায় নাই! কত যে বাধা পড়িতে লাগিল লেখায় বলা যায় না। এ অকারণে ডাকে, সে কী দরকারি কথা জিজ্ঞাসা করে, ছেলেরা হট্টগোল করে ঘরের সামনে বারান্দায়, রান্নাঘরে ডাল সম্ভার দিবার সময় হাঁচিতে হাঁচিতে বেদম হইয়া আসে সূর্যকান্ত। ঘরে আসিয়া দেখিয়া যাইতে না পারিলেও অমলা টের পাইয়াছিল স্বামী তার লিখিতে বসিয়াছে। ঘরে গিয়া স্বনামধন্য লেখক সূর্যকান্তকে প্রথমবার লিখনরত অবস্থায় দেখিবার জন্য মনটা ছটফট করিতেছিল অমলার এবং এ কথা ভাবিয়া মনটা তার ক্ষোভে ভরিয়া গিয়াছিল যে এই হাঁকাহাঁকি গণ্ডগোলের মধ্যে এক লাইনও সে কি লিখিতে পারিতেছে? বাড়ির লোকের কি এটুকু কাণ্ডজ্ঞান নাই? তার যদি অধিকার থাকিত, সকলকে ধমকাইয়া সে আর কিছু রাখিত না। সূর্যকান্ত লিখিতে বসিলে সমস্ত বাড়িটা তো হইয়া যাইবে স্তব্ধ—পা টিপিয়া হাঁটিবে সকলে, কথা বলিবে ফিসফিস করিয়া, ডালে সম্ভার পর্যন্ত দেওয়া হইবে না। তা নয়, আজই যেন গোলমাল বাড়িয়া গিয়াছে বাড়িতে-এ কী অবিবেচনা সকলের, ছি! 

রাত সাড়ে দশটার সময় সে যখন ঘরে গেল, সূর্যকান্ত তখনো লিখিতেছে। টেবিলে সাত-আটখানা লেখা কাগজ দেখিয়া অমলা অবাক হইয়া গিয়াছিল। অত বাধা ও গোলমালের মধ্যেও সূর্যকান্ত তবে লিখিতে পারে? তা ছাড়া, কত সন্তর্পণে পা টিপিয়া টিপিয়া সে ঘরে আসিয়াছে, লিখিতে লিখিতে তবু তো সে টের পাইল! এবার সূর্যকান্তের বিরুদ্ধেই অমলার মনটা ক্ষুব্ধ হইয়া উঠিয়াছিল। 

বাস্, আজ এই পর্যন্ত, বলিয়া কলম রাখিয়া দু হাত উঁচু করিয়া বিশ্রী ভঙ্গিতে তুলিয়াছিল হাই। তারপর হাসিমুখে কাছে ডাকিয়াছিল অমলাকে। বিষণ্নমুখে অমলা গিয়া টেবিল ঘেঁষিয়া দাঁড়াইয়াছিল। বলিয়াছিল, আচ্ছা আপনি কী করে লেখেন? 

গলার আওয়াজে তার কৌতূহল ছিল এত কম, আর বলার ভঙ্গিতে ছিল এত বেশি অবহেলা—যে মনে হইয়াছিল সে বুঝি জিজ্ঞাসা করিতেছে সূর্যকান্তের মতো লোক যে লিখিতে পারে এটা সম্ভব হইল কী করিয়া? সূর্যকান্ত বুঝিতে পারিয়াছিল কিনা বলা যায় না, চেয়ার ঘুরাইয়া বসিয়া সে ধরিয়াছিল অমলার একখানা হাত, তারপর তাকেও বসাইয়াছিল নিজের চেয়ারে। সাহিত্যিক বলিয়া অবশ্য নয়, নতুন বউ টেবিল ঘেঁষিয়া দাঁড়াইয়া ওরকম একটা প্রশ্ন করিলে প্রথম নিঃশব্দ জবাবটা এভাবে না দিয়া কোনো স্বামী পারে? তারপর একটু হাসিয়াছিল সূর্যকান্ত, বলিয়াছিল, তুমি যেমন করে লেখ ঠিক তেমনি করে, কাগজের ওপর কলম দিয়ে। কিন্তু অমলারানী, আর কতদিন আমায় আপনি বলবে? 

অমলা অস্ফুটস্বরে বলিয়াছিল, বারণ তো করো নি আগে। 

কেন করি নি জান? তুমি নিজে থেকে বল কিনা দেখছিলাম। কেন বল নি বল তো? 

লজ্জা করে না বুঝি? অভিমান হয় না বুঝি? 

যে অধিকার হইতে স্বামী তাকে এক সপ্তাহ বঞ্চিত করিয়া রাখিয়াছিল, অধিকার পাওয়ামাত্র লজ্জাও থাকে নাই অমলার, অভিমানও থাকে নাই। সে ভাবিতেছিল, ঠিক দিয়েছি তো জবাবটা? এমন অবস্থায় এরকম জবাব তো দিতে হয়? না, আর কিছু বললে ভালো হত? আচ্ছা, এ কথা বলব, তুমি কী বুঝবে তোমাকে তুমি বলতে বল নি বলে কী গভীর ব্যথা লেগেছিল আমার মনে? মুখের দিকে তাকিয়ে আছে একদৃষ্টে! আর কিছু না বলে মুখ নিচু করাই বোধ হয় ভালো এবার। 

সূর্যকান্ত সত্যসত্যই কয়েক মুহূর্ত তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে অমলার মুখের দিকে চাহিয়াছিল, মুখের মৃদু লালিমার মধ্যে সে যেন পরিমাণ করিতে চাহিয়াছিল তার লজ্জা ও অভিমানের। বই লিখিবার সময় যত বড় মনস্তত্ত্ববিদ হোক সূর্যকান্ত, অমলাকে সে ঠিক বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছিল না। স্বামীর সঙ্গে তাড়াতাড়ি ভাব জমানোর জন্য অমলার ঔৎসুক্য তার কাছে অল্পে অল্পে ধরা পড়িতেছিল বটে, কিন্তু ভাব জমানোটাই যে তার অধীরতার কারণ, লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য নয়—তাও বেশ বোঝা যাইতেছিল। ঠিক ভাবপ্রবণতা যেন নয়, কী যেন অমলা জানিতে ও বুঝিতে চায় তার সম্বন্ধে, সব সময়ে কী যেন একটা বিস্ময়কর কিছু সে প্রত্যাশা করে তার কাছে। এমন নাটকীয় ধরনে কথা বলে অমলা! কথার পিছনে প্রকৃত নাটত থাকে না অথচ একেবারেই। হৃদয়াবেগ ও মস্তিষ্ক মিশিয়া যেন তৈরি হয় তার ব্যবহার ও মুখের শব্দগুলি। কাঁচাপাকা আমের মতো নতুন বউকে সূর্যকান্তের লাগিতেছে মিষ্টি আর টক। তার দোষ ছিল না, ওইরকম ব্যবহারই করিতেছিল অমলা! তিন মাস ধরিয়া তপস্যার মতো সে যে ভাবিয়াছে কী, কী কারণে সূর্যকান্তের মতো লোক তার মতো মেয়েকে এমন সাধারণভাবে বিবাহ করে, এখন বিবাহের পর সে জানিবার চেষ্টা করিবে না সেই কারণগুলির মধ্যে কোনটা তার স্বামীর বেলা প্রযোজ্য? তিন মাসের গভীর গবেষণা তার বিফলে যাইবে? 

তবে ও বিষয়ে জ্ঞান সঞ্চয়ের ইচ্ছাটা তার ক্রমেই শিথিল হইয়া আসিতেছিল। তার মনে হইতেছিল, অতীত জীবনে যত বিপর্যয় সূর্যকান্তের হৃদয়ে ঘটিয়া থাক, সে কথা আজ না ভাবাই ভালো। তাকে লইয়া একটা নতুন অধ্যায় আরম্ভ হোক সূর্যকান্তের জীবনে। আপনা হইতে সে তুমি বলিতে আরম্ভ করে কিনা দেখিবার জন্য অপেক্ষা করিতেছিল সূর্যকান্ত! হয়তো আপনা হইতে সে তাকে ভালবাসিতে আরম্ভ করে কিনা দেখিবার জন্যও সে অপেক্ষা করিয়া আছে? হায় অমলার অবোধ স্বামী! এত বড় সাহিত্যিক তুমি, তোমাকে ভালো না বাসিয়া কি অমলা পারে? এইসব ভাবিয়া ক্রমে ক্রমে অমলা নিজেকে ও স্বামীকে মনে করিতে আরম্ভ করিয়াছিল সূর্যকান্তেরই একখানা বইয়ের এক জোড়া নবদম্পতির মতো। যদিও বইয়ের ওরা দুজনে, শঙ্কর ও সরযূ, প্রায় তিন বছর ধরিয়া অনেক ভুল-বোঝা, কলহ-বিবাদ ও বাধা-বিপত্তির পর একেবারে শেষ পরিচ্ছেদে নবদম্পতি হইয়াছিল, কিন্তু তাতে কী আসিয়া যায়? তেমন বৈচিত্র্যময় তিনটা বছর কাটাইবার পর তাদেরও মিলন হইয়াছে এটা কল্পনা করা এমন কী কঠিন? অন্তত সূর্যকান্তের পক্ষে একটুও কঠিন নয়—সেই তো লিখিয়াছে বইটা। 

অমলা (এখন সরযূ) তাই ধীরে ধীরে গলা জড়াইয়া ধরিয়াছিল সূর্যকান্তের (এখন শঙ্কর), ‘স্মৃতির কাতরতা মেশানো অবর্ণনীয় পুলকের স্বপ্ন’ ঘনাইয়া আসিয়াছিল তার দুটি অর্ধনিমীলিত চোখে, ‘তিন বছর যে কণ্ঠস্বরে লুকানো ছিল গোপন অশ্রুর সজল সুর তাতে প্রথম মোহকরী আনন্দের আভাস মিশিলে যেমন শোনায়’ তেমনই কণ্ঠস্বরে সে বলিয়াছিল – হ্যাঁ গো, তুমি কি কখনো ভাবতে পেরেছিলে তুমি আর আমি কোনোদিন এত কাছাকাছি আসতে পারব? 

যেসব গহনা দাবি করা হইয়াছিল বিবাহের সময়, আজ অমলার হাতে তার অতিরিক্ত একজোড়া ব্রেসলেট ছিল। সূর্যকান্ত জিজ্ঞাসা করিতে যাইতেছিল ও গহনাটি কে দিয়েছে। অবাক হইয়া সে বলিয়াছিল, তার মানে? 

অমলা বলিয়াছিল, আমার মনে হচ্ছে কতকাল যেন ভাগ্য আমাদের জোর করে তফাত করে রেখেছিল। আরো দু-এক বছর দেরি করে যদি আমাদের বিয়ে হত, তা হলে হয়তো আমি— 

সূর্যকান্তের মুখ দেখিয়া অমলা থামিয়া গিয়াছিল। এ তো অভিমান নয়, সত্যই বুকের মধ্যে টিপটিপ করিতেছিল তার, আবেগে সে নিশ্বাস ফেলিতেছিল ছোট ছোট। মধ্যবিত্ত সংসারের অনভিজ্ঞ, কোমলমনা, ছেলেমানুষ মেয়ে, জীবনে প্রথমবার একজনের সঙ্গে পাকা প্রেমিকের মতো ব্যবহার করিতে গেলে বইপড়া বিদ্যায় কুলাইবে কেন! আবেগ, উত্তেজনা, উচ্ছ্বাস ও হঠাৎ একেবারে জন্মের মতো কথা বন্ধ করিয়া সূর্যকান্তের বুকে মুখ লুকাইয়া ফেলিতে যাওয়ার মতো যে গভীর লজ্জা এখন অমলার আসিয়াছিল, তার কোনোটাই বানানো নয়। 

সূর্যকান্ত ভ্রু-কঞ্চিত করিয়া বলিয়াছিল, তোমার বয়স কত বল তো? 

উনিশ বছর। 

বিয়ের আগে শুনেছিলাম ষোল চলছে। তোমার নাকি বাড়ন্ত গড়ন। 

এ কী অচিন্তিত আঘাত! আশ্বিনের রাত্রি, আকাশে হয়তো জ্যোৎস্নার ছড়াছড়ি—পরশু সন্ধ্যায় সূর্যকান্তের এক বন্ধুর বউ যে একরাশি ফুল দিয়াছিল, ঘর ভরিয়া সেই বাসিফুলের গন্ধ। শুধু তাই নয়। প্যাডে সূর্যকান্তের অসমাপ্ত গল্পটির শেষ কয়েকটা লাইন অমলা আড়চোখে পড়িয়া ফেলিয়াছিল, অবনী নামে কে যেন অনুপমা নামে কার ছদ্মবেশ-পরানো গোপন ভালবাসা জানিতে পারিয়া স্তম্ভিত হইয়া গিয়াছে, বিবর্ণ পাংশু হইয়া আসিয়াছে তার মুখ, আর অনুপমার অনুপম চোখ দুটিতে দীপশিখার মতো দেদীপ্যমান হইয়া উঠিয়াছে বিদ্রোহ—প্রথার বিরুদ্ধে, দুর্বলতার বিরুদ্ধে, কে জানে আরো কীসের বিরুদ্ধে! এমন সময়, অবনী ও অনুপমার ওরকম উত্তেজনাময় মুহূর্তগুলোর কথা লিখিতে লিখিতে, বউকে বুকে লইয়া এ কী রূঢ় বাস্তব মন্তব্য সূর্যকান্তের! সম্বন্ধ করার সময় দু বছর কী আড়াই বছর বয়স ভাঁড়াইয়াছিল তার বাপ-মা, এই কি সে কথা তুলিবার সময়? 

অবনী ও অনুপমার গল্পটা পরে অমলা অনেকবার পড়িয়াছে। সেদিন যেখানে সূর্যকান্ত লেখা বন্ধ করিয়াছিল, প্রথম হইতে শেষ পর্যন্ত পড়িয়া প্রত্যেকবার অমলার রক্ত চঞ্চল হইয়া উঠিয়াছে। আর ও পর্যন্ত লিখিয়া সেদিন রাত্রে সূর্যকান্ত অমন নিরুত্তেজ আবেগহীন অবস্থায় কী করিয়াছিল? কী প্রবঞ্চক সূর্যকান্ত!

.

আজকাল স্বামীর প্রবঞ্চনাকে অমলা মাঝে মাঝে আত্মসংযম বলিয়া চিনিতে শিখিয়াছে। এটাও সে জানিয়াছে যে সূর্যকান্ত সবদিক দিয়া যতই সাধারণ হোক— বাস্তব জীবনে, কী যেন আছে লোকটার মধ্যে, অপূর্ব ও অদ্ভুত, যার অস্তিত্ব আবিষ্কার করা যায় না, প্রমাণ করা যায় না, গ্রহণও করা যায় না। সাফল্যলাভ করিবার আগে প্রতিভাবানের প্রতিভা যেমন থাকিয়াও থাকে না, সেই রকম একটা অস্তিত্বহীন বিপুল ব্যক্তিত্ব যেন সূর্যকান্তের থাকিয়াও নাই—অন্তত অমলার কাছে। তাই, মাঝে মাঝে বিনয়ে তার হৃদয়টা কেন এতখানি ভরিয়া আসে যে সূর্যকান্তের কাছে মাথা নত করিয়া থাকিতে ইচ্ছা হয়, সে ভালো বুঝিতে পারে না। বশ মানিতে সাধ হয় অমলার। স্বামী তার স্বপ্ন ভাঙিয়া দেয়, কল্পনাস্রোত রুদ্ধ করে, আশা অপূর্ণ রাখে, নিজেও যথোচিতভাবে ভালবাসে না, তাকেও বাসিতে দেয় না—তবু! 

আজকাল মানে বিবাহের মাস আষ্টেক পরে-বসন্তের শেষে যখন গ্রীষ্ম শুরু হইয়াছে—গরমে অমলার ঘনঘন পিপাসা পায়—সেটা স্বাভাবিক। কিন্তু সূর্যকান্তের অবাস্তব কবিত্বময় ভালবাসার জন্য তার যে পিপাসা সব সময় জাগিয়া থাকে, গ্রীষ্ম তার কারণ নয়, সেটা স্বাভাবিকও নয়। একদিন, একটা দিনের জন্যও সূর্যকান্ত যদি উচ্ছৃঙ্খল হইয়া উঠিত! যদি আবোলতাবোল কথা বলিত অমলাকে, আবেগে অদ্ভুত ব্যবহার করিত, পাগলের মতো, মাতালের মতো এমন ভালবাসিত তাকে—যে বাস্তব জগৎটা আড়াল হইয়া যাইত প্রেমের রঙিন পর্দায়! কিন্তু সূর্যকান্ত এক মিনিটের জন্যও আত্মবিস্মৃত হইতে জানে না। এমনকি অমলা নিজেই যদি একটু বাড়াবাড়ি উচ্ছ্বাস আরম্ভ করিয়া দেয়, সৃষ্টি করিয়া লইতে চায় একটি মোহকরী কাব্যময় পরিবেষ্টনী, সূর্যকান্ত অসন্তুষ্ট হইয়া বলে, এসব ছ্যাবলামি শিখলে কোথায়? 

রাগের মাথায় অমলা বলে, তোমার কাছ থেকে শিখেছি, তোমার বই থাকে। 

সূর্যকান্ত বলে, তোমাকে যখন দেখতে গিয়েছিলাম, বিয়ের আগে, মনে হয়েছিল তুমি বুঝি খুব সাদাসিধে সরল—এসব পাকামি জান না। তুমি যা শিখেছ অমল, আমার কোনো বইয়ে তা নেই। যদি কখনো লিখে থাকি, ঠাট্টা করে খোঁচা দিয়ে লিখেছি; এরকম কবিত্ব যারা করে তাদের যে মাথার ব্যারাম থাকে তাই দেখাবার জন্য। 

সূর্যকান্তের লেখার সমালোচকরা এ কথা শুনিলে তাকে মিথ্যাবাদী বলিত, অমলা রুদ্ধশ্বাসে শুধু বলে, ভালবাসা বুঝি মাথার ব্যারাম? 

ভালবাসার তুমি কী বোঝ শুনি? 

অমলা স্তব্ধ হইয়া যায়। রাগে অভিমানে প্রথমে তার মনে হয় এর চেয়ে মরিয়া যাওয়াও ভালো। ভালবাসার কিছু বোঝে না সে? বেশ, চুলোয় যাক ভালবাসা! সে বুঝিতে চায় না। সে কী চায় তা তো সূর্যকান্ত বোঝে? হোক এসব তার ছ্যাবলামি, কী দোষ আছে এতে, কী ক্ষতি আছে? তার সঙ্গে এই ছ্যাবলামিতে সূর্যকান্ত একটু যোগ দিলে কি বাড়ির ছাদটা ধসিয়া পড়িবে, না পুলিশে ধরিয়া তাদের জেলে পুরিবে? ক্ষতি তো কিছু নাইই, বরং লাভ আছে অনেকে—এইসব মনান্তর ও মনঃকষ্টগুল ঘটিবে না। অকারণে কেন এরকম করে সূর্যকান্ত তার সঙ্গে? কী সুখটা তার হয়, বউকে এত কষ্ট দিয়া? অমলার কান্না আসে। কুঁজোটা হাতখানেক সরাইয়া রাখা, টেবিল গুছানো, বই ও কাগজপত্রগুলো একটু ভিন্নভাবে সাজানো, এই ধরনের খুঁটিনাটি কাজ করিতে করিতে সে চোখের জল ফেলিতে থাকে। সূর্যকান্ত যে দেখিতে পাইতেছে যে সে কাঁদিতেছে, তাতে অমলার সন্দেহ থাকে না। 

সূর্যকান্ত বলে, এক গ্লাস জল দাও তো। 

অমলা কাচের গ্লাসে জল দিলে এক চুমুক পান করিয়া হাসিয়া বলে, তুমি জল দিলে আমার মনে হওয়া উচিত—জল খাচ্ছি না, সুধা পান করছি, না অমলা?

ঠাট্টা! সে কাঁদিতেছে দেখিয়াও এমন রূঢ় পরিহাস! বিছানায় আছড়াইয়া পড়িয়া এবার অমলা ফুঁপাইয়া ফুঁপাইয়া কাঁদিতে থাকে। আছড়াইয়া পড়ার ধাক্কায় সূর্যকান্তের হাত হইতে গ্লাসটা পড়িয়া গিয়া বিছানা ভাসিয়া যায়। গ্লাসটা তুলিয়া সরাইয়া রাখিবার পর মনে হয় অমলার চোখের জলেই বিছানাটা এমনভাবে ভিজিয়াছে। 

সূর্যকান্ত বিব্রত হইয়া বলে, তোমার সঙ্গে পেরে উঠলাম না অমল, সোজা সহজ জীবনে তুমি খালি বিকার টেনে আনছ। এই বয়সে এরকম হল কেন তোমার? অনর্থক দুঃখ তৈরি কর কেন? কী হয়েছে তোমার, ছেলে মরেছে, না স্বামী তোমায় ত্যাগ করেছে? খেতে পরতে পাচ্ছ না তুমি? সংসারের জ্বালা যন্ত্রণা সইছে না তোমার? দিব্যি হেসে খেলে মনের আনন্দে দিন কাটাবে তুমি, তা নয়, সব সময় একটা কৃত্রিম ব্যথায় ব্যথিত হয়ে আছ। বিয়ের আগে আর কারো সঙ্গে তোমার ভাব হয়ে থাকলেও বরং ব্যাপারটা বুঝতে পারতাম। তাও তো নয়। তোমার যত ব্যথা বেদনা সব আমাকে নিয়েই। কেন বল তো? তোমাকে আমি অবহেলা করি, আদর-যত্ন করি না? আজ তোমাকে হাসাবার কত চেষ্টা করলাম তুমি হাসলে না, রাগাবার চেষ্টা করলাম রাগলে না, বললাম এস দুজনে একটু ব্যাগাটেলি খেলি, তার বদলে তুমি- 

উত্তেজনায় কাঁপিতে কাঁপিতে অমলা উঠিয়া বসে, অশ্রুপ্লাবিত মুখখানা গুঁজিয়া দেয় স্বামীর পায়ের মধ্যে, বলে, আমায় মাপ কর, মাপ কর। আমি তোমার উপযুক্ত নই। 

সূর্যকান্ত বলে, এই তো! এই দ্যাখো আবার কী আরম্ভ করলে! 

.

এই ধরনের দাম্পত্যালাপের যখন ইতি হয় এবং উত্তেজনা কিছু জুড়াইয়া আসে, অমলার মনের মধ্যে তখন যে সমস্ত মানসিক প্রক্রিয়া গজরায় ও গুমরায় তার মধ্যে প্রধান হইয়া থাকে অভিমান। দুরন্ত অভিমানকে জয় করিয়া তাকে ঘুম পাড়াইতে একেবারে হয়রান হইয়া যায় ঘুমের পরীরা। সকালে থাকে বিষাদ। সংসারের কাজ করিতে করিতে সে অন্যমনা হইয়া যায়। বড় জা, বিধবা ননদ, দুটি দেবর এবং আরো যারা বাড়িতে থাকে পরীক্ষকের দৃষ্টিতে সকলে মুখের দিকে তাকায় অমলার, মেয়েরা ফিসফিস করিয়া নিজেদের মধ্যে তার কথা আলোচনা করে। তারপর সূর্যকান্ত আপিসে চলিয়া গেলে নিজের অজ্ঞাতেই এমন ব্যবহার করে অমলা, বাড়িতে যেন আর মানুষ নাই, বাড়ি খালি হইয়া গিয়াছে। 

দেবর চন্দ্রকান্ত বলে, মাথা ধরেছে মেজোবউদি? 

কই না। 

তবে দয়া করে শুয়ে না থেকে একবার শুনে এস দিকি দিদি ডাকছে কেন? এমন সময় মানুষ শোয়! 

তখন অমলার মনে পড়ে আজ তার রান্নার পালা ছিল, কিন্তু রান্না সে করে নাই। তার জন্য হয়তো হেঁসেল আগলাইয়া একজন বসিয়া আছে। হায়, যে স্বামী পদে পদে অপমান করে, আপিস যাওয়ার সময় যার জামার বোতাম লাগাইতে কাঁপা গলায় ‘কী করে সারা দুপুর কাটাব?’ বলার জন্য যার পরিহাসের আঘাতে আজই তাকে বিছানা আশ্রয় করিতে হইয়াছে, দশটা হইতে বেলা একটা পর্যন্ত সেই স্বামীর কথাই ভাবিয়াছে বিছানায় চোখ বুজিয়া শুইয়া। —কী করা যায় এখন? সকলের কাছে কী কৈফিয়ত দেওয়া যায় শুইয়া থাকার? 

অমলা হঠাৎ কাতরকণ্ঠে বলে, শরীরটা বড় খারাপ লাগছে, আমি আজ খাব না। 

উপবাসী হৃদয়ের কাণ্ডকারখানায় দিনটা অমলার উপবাসে কাটে। বিকালের দিকে ক্রমবর্ধনশীল উত্তেজনায় সে হইয়া থাকে বোমার মতো উচ্ছ্বাসের বিস্ফোরক। সূর্যকান্ত বাড়ি আসিলেই বলে, শোন, ওগো শোন, কাছে এস না? এইখানে এসে শোন! এক মাসের ছুটি নেবে? কোথাও নিয়ে যাবে আমাকে? যেখানে হোক, যেদিকে দু চোখ যায় চল আমরা বেরিয়ে পড়ি। শুধু তুমি আর আমি, আর কেউ নয়। যাবে? বল না, যাবে? তাজমহলের সামনে দাঁড়িয়ে অপর্ণার মতো আমি তোমাকে শেষবার জিজ্ঞেস করব—

আপিস ফেরত ঘর্মাক্ত সূর্যকান্ত গলা হইতে অমলার হাতের বাঁধন ধীরে ধীরে খুলিয়া দেয়। তারপর খোলে জামা। 

জিজ্ঞাসা করে, অপর্ণা কে? 

ওমা, ভুলে গেছ? তোমার অপর্ণা গো!

আমার অপর্ণা? 

তোমার রামধনু বইয়ের। যে বলেছে, মেয়েদের জীবনের একমাত্র ব্রত হওয়া উচিত একজনকে ভালবাসা, সে রাজা হোক, পথের ভিখারি হোক— 

ও, সেই অপর্ণা? জুতা জামা খুলিয়া সূর্যকান্ত তফাতে চেয়ারে বসে। গম্ভীর চিন্তিত মুখে অমলার মুখের ভাব দেখিতে দেখিতে বলে, সামনের শনিবার ছুটি নিয়ে তোমাকে বাপের বাড়ি রেখে আসব কিছুদিনের জন্য। 

স্তম্ভিত অমলা বলে, কেন? 

এখানে থাকলে তুমি খেপে যাবে। 

এ আঘাতে অমলার উচ্ছ্বাসের বোমা ফাটিয়া যায়, কান্নার বিস্ফোরণে। সূর্যকান্ত নিষ্ঠুর নয়, মিনিটখানেকের মধ্যে তার ঘামে ভেজা বুকখানা অমলার চোখের জল আরো ভিজাইয়া দিতে থাকে। বড় ম্লান দেখায় সূর্যকান্তের মুখখানা। 

.

স্ত্রীকে নার্ভ টনিক খাওয়ানোর বদলে কিছু দিনের জন্য বাপের বাড়ি পাঠানোই সূর্যকান্ত ভালো মনে করিল। এখানে থাকিয়াই সে নার্ভ টনিক খাইতে পারিবে শুধু এই ভয়ে নয়। অমলা অনেক দিন বাপ মাকে দেখে নাই। কুমারী জীবনের আবহাওয়ায় কিছু দিন বাস করিয়া আসিলে হয়তো বিবাহিত জীবন যাপনের কৌশলগুলো সে কিছু কিছু আয়ত্ত করিতে পারিবে। উনিশটা বছর অমলা সেখানে ছিল, সবগুলো বছর বোধ হয় সঙ্গে আনিতে পারে নাই, তাই এরকম ছেলেমানুষি করে। তা ছাড়া একটু বিচ্ছেদ ভালো। বিরহের তাপে ওর প্রেমের অস্বাভাবিকতার বীজাণুগুলো একটু নিস্তেজ হইতেও পারে। 

যাইতে রাজি হইল বটে অমলা, সে জন্য কাণ্ড করিল কম নয়। রাজি হওয়ার রাত্রে অনেকক্ষণ গুম খাইয়া থাকিয়া বলিল, আমাকে সইতে পারছ না বলে পাঠিয়ে দিচ্ছ না তো? 

না গো, না। 

আমার জন্য তোমার মন কেমন করবে? 

করবে না? তুমি বুঝি ভাব তোমাকে আমি ভালবাসি না? একা একা বিশ্রী লাগবে অমল। 

শুধু বিশ্রী লাগিবে! অমলা জোর দিয়া বলিল, একা একা আমি মরে যাব। এক মাস বাপের বাড়িতে থাকিয়া অমলা ফিরিয়া আসিল। মরিয়া যাইতে অবশ্য সে পারিত, কারণ সেখানে দিন সাতেক সে খুব জ্বরে ভুগিয়াছিল। আশ্চর্য জ্বর। এক শ এক ডিগ্রিতে পৌঁছিলেই অমলা বিড়বিড় করিয়া প্রলাপ বকিতে শুরু করিত (সজ্ঞানে) এবং তার চারটি বউদির মধ্যে ছোটজনকে চুপিচুপি জানাইয়া দিত যে জীবনটা তার ব্যর্থ হইয়া গিয়াছে। ছোটবউদি বলিত ছোটদাদাকে এবং দুই ননদকে। জ্বরের সাত দিনে বাড়ির বিশেষ আদরের ছোট মেয়েটির জীবনের ব্যর্থতার সাত রকম দুর্বোধ্য কাহিনী শুনিয়া বাড়ি সুদ্ধ লোক এমন দুশ্চিন্তায় পড়িয়াছিল বলিবার নয়। জ্বর সারিবার পর সকলের প্রতিনিধি হিসেবে বাড়ির বড়বউ কতকগুলো কথা জিজ্ঞাসা করিয়াছিল অমলাকে। লোক ভালো নয় অমলার শ্বশুরবাড়ির সকলে? কী করে অমলাকে তারা? বকে? গঞ্জনা দেয়? খাইতে দেয় না? খাটাইয়া মারে? এমনি মারে? তা যদি না হয় তবে সূর্যকান্ত বুঝি— 

প্রশ্নগুলোর জবাব শুনিয়া বাড়িসুদ্ধ লোকের দুশ্চিন্তা পরিণত হইয়াছিল অবাক হওয়ায়। কী জন্য তবে জীবনটা ব্যর্থ হইয়া গিয়াছে তার? কত খুঁজিয়া সূর্যকান্তের মতো জামাই তারা সংগ্রহ করিয়াছে অমলার জন্য! পণই যে দিয়াছে ষোল শ টাকা! বাড়িসুদ্ধ লোক যদি বাড়িরই একটি মেয়ের জীবন ব্যর্থ হওয়ার মতো বৃহৎ ব্যাপার সম্বন্ধে ধাঁধায় পড়িয়া যায়, মেয়েটির বিপদের সীমা থাকে না। সকলের ব্যবহার চিন্তায় ফেলিয়া দেয় তাকে। তার মনে হয়, তবে কি সেই ভুল করিয়াছে? সত্যই কি তার আশা-আকাঙ্ক্ষা ও কল্পনাগুলো অকথ্য রকমের উদ্ভট মানসিক রোগ? 

অমলার প্রতিহত উন্মাদনা, পৃথিবীতে আকাশকুসুমের বাগান করার অপূর্ণ কামনা ও বিবাহিত জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতা—সূর্যকান্তের কাছ হইতে সরিয়া আসিবার কয়েক দিন পর হইতেই তার মনে কাজ করিতেছিল। তা ছাড়া, বইয়ের যদি প্রভাব থাকে বাস্তবতার ঘনিষ্ঠ সম্পর্কবঞ্চিত কল্পনাপ্রবণ মনে, বই যারা লেখে তাদের কি প্রভাব নাই? কাছে থাকিবার সময় স্বামীকে তার সাধারণ মানুষের মতো মনে হইত বলিয়া, স্বনামধন্য সাহিত্যিক বলিয়া চেনা যাইত না বলিয়া, যে আপসোস ছিল অমলার মনে, সাত দিন জ্বরে ভুগিবার সময় ছাড়া এখানে যেন সে আপসোস ধীরে ধীরে উপিয়া যাইতেছিল। মনে হইতেছিল, ওরকম সাধারণত্ব কি মানুষ মাত্রেরই থাকে না? ভুল দিকে সে স্বামীর অসাধারণত্ব খুঁজিয়া মরিয়াছিল। অনেক বিষয়ে অসামান্য ছিল বইকি সূর্যকান্ত! তীক্ষ্ণবুদ্ধি, অসীম জ্ঞান, উদ্দেশ্য বুঝিয়া মানুষের ভালোমন্দ কাজের বিচার করা, কোলাহলভরা সংসারের বাস্তবতার মধ্যে থাকিয়াও অমন সুন্দর সব গল্প-উপন্যাস রচনা করা, এসব কি অসাধারণত্ব নয়? সারা দিন আপিস করিয়া রাত্রি দশটা এগারটা পর্যন্ত লেখার পর এক-একদিন কি বড় শান্ত মনে হইত না সূর্যকান্তকে? সেই শ্রান্তিকেই কোনোদিন অবহেলা, কোনোদিন সংসারের চিন্তা, কোনোদিন মানুষটার নির্জীবতা মনে করিয়া সে কি নিজের রাগ দুঃখ অভিমানের পাহাড় সৃষ্টি করিত না, রোমাঞ্চকর ভালবাসার খেলা চাহিয়া শেষে মনোবেদনায় শুরু করিত না কান্না? রামধনুর অপর্ণার মতো লাখ লাখ মেয়েকেও সে সৃষ্টি করে ওরকম শ্রান্ত ক্লান্ত অবস্থায়—সেও কি ফুটফুটে জ্যোৎস্না উঠিয়াছে বলিয়া বউয়ের সঙ্গে ছাদে গিয়া মুগ্ধ ও বিহ্বল হইতে পারে? ঘুমানোর সুযোগ দেওয়ার বদলে কথা বলিয়া অভিমান করিয়া কাঁদিয়া রাত দুটো পর্যন্ত সে তাকে জাগাইয়া রাখিত! 

এই ধরনের অনেক কথা ভাবিয়াছিল অমলা এক মাস ধরিয়া—সূর্যকান্তের ব্যক্তিত্ব, সহজ স্বাভাবিক ব্যবহার ও উপদেশগুলো তলে তলে কাজ করিতেছিল এবং জ্বরের টনিক একটু শান্ত করিয়া দিয়াছিল অমলাকে। জ্বরের পর কিছু দিন একটু চুপচাপ শান্তিতে থাকিতে কে না চায়? তাই শুধু রোগা হইয়াই নয়, একটু বদলাইয়া অমলা এবার স্বামীগৃহে ফিরিয়া আসিল। 

সূর্যকান্ত বলিল, এমন রোগা হয়ে গেছ! 

জ্বরে ভুগলাম যে? 

জবাবটা খাপছাড়া যেমন হইল সূর্যকান্তের।’রোগা হব না? এক মাস তোমাকে ছেড়ে—’ এরকম একটা জবাব সে প্রত্যাশা করিতেছিল। যাই হোক, সোজা কথার সোজা জবাব দিতে যদি অমলা শিখিয়া থাকে, ভালোই। তাতে ক্ষুণ্ণ হওয়ার কিছু নাই। 

অমলা বলিল, তুমিও রোগা হয়ে গেছ। 

সূর্যকান্ত বলিল, হব না? এক মাস তোমাকে ছেড়ে থেকেছি একা একা 

এ জবাবটা খাপছাড়া মনে হইল অমলার।’রোগা হয়েছি? ক’দিন যা খাটতে হয়েছে অমলা—’ এই রকম একটা জবাব সে প্রত্যাশা করিতেছিল। যাই হোক, সাধারণ কথার মিষ্টি জবাব দিতে যদি সূর্যকান্ত শিখিয়া থাকে, ভালোই। তাতে পুলকিত হওয়ার কিছু নাই। 

এই হইল তাদের প্রথম দেখা, অপরাহ্নে এবং অল্পক্ষণের জন্য। রাত্রে যখন আবার দেখা হইল, চাঁদটা পৃথিবীর অপর পিঠে জ্যোৎস্না ঢালিতেছিল। একটু অস্থির ও উন্মনাভাবে সূর্যকান্ত ঘরে পায়চারি করিতেছিল। আকাশ—ঢাকা মেঘগুলো এমন গুমোট রচনা করিয়াছে যে ফ্যানটা প্রাণপণে ঘুরিয়াও ভালোমতো বাতাস সৃষ্টি করিতে পাারিতেছিল না। শুধু টেবিলে খোলা প্যাডটার পাতাগুলোকে অস্থির করিয়া তুলিয়াছিল। 

অমলা নালিশ করিল, সন্ধে থেকে মেঘ করেছে, এখনো বিষ্টি নামল না, নামলে বাঁচি। 

মেঘ করেছে নাকি? 

টের পাও নি? ক’বার যে বিদ্যুৎ চমকাল, মেঘ ডাকল? 

সূর্যকান্ত এক নতুন দৃষ্টিতে অমলাকে দেখিতেছিল, পরীক্ষার সময় ছেলেদের প্রথম প্রশ্নপত্র দেখার মতো। তারপর একটা প্রশ্নেরও জবাব-না-জানা ছেলের মতো সে বলিল, সন্ধ্যা থেকে গল্প লিখবার চেষ্টা করছিলাম অমল। 

সত্যি? নতুন গল্প! দেখি তো কতটা লিখলে?—অমলা তাড়াতাড়ি টেবিলের কাছে গেল, কাগজ-চাপাটার তলে একটিও লেখা কাগজ না দেখিয়া সে আশ্চর্য হইয়া গেল। প্যাডটার প্রথম পাতায় শুধু হেডিং, সূর্যকান্তের নাম আর পাঁচ-ছ লাইন লেখা। 

সন্ধ্যা থেকে শুধু এইটুকু লিখেছ! 

সূর্যকান্ত ধপাস করিয়া বিছানায় বসিয়া বলিল, না, অনেক লিখেছি। ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটটাতে পাবে। 

অমলা সবিস্ময়ে বলিল, ওমা, ছেঁড়া কাগজে যে ভর্তি। সব আজকে লিখে লিখে ছিঁড়েছ? 

সায় দিয়া সূর্যকান্ত একটা হাই তুলিল। শ্রান্তি? অমলা তাড়াতাড়ি কাছে আসিয়া বলিল, ঘুম পেয়েছে? ঘুমোও তবে। দাঁড়াও বালিশটা ঠিক করে দি। 

সূর্যকান্ত বলিল, না, ঘুমোব না। এক মাসের মধ্যে এক লাইন লিখতে পারলাম না—ঘুমোব! শুধু আজ? কতদিন ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটটা এমনিভাবে ভর্তি করেছি তার ঠিক নেই। তুমি আমাকে কী করে দিয়ে গিয়েছ তুমিই জান, লিখতে বসতেও আর ইচ্ছে করে না, বসলেও মন বসে না, জোর করে যা লিখি সব ছিঁড়ে ফেলে দিই! উপন্যাসের ইনস্টলমেন্টটা পর্যন্ত লিখে দিতে পারি নি। 

সূর্যকান্তের বিষণ্ন মুখ দেখিলে কষ্ট হয়। অমলার বুকের মধ্যে টিপটিপ করিতেছিল, দু চোখ বড় বড় করিয়া সে চাহিয়া রহিল। বিবাহিত জীবনের এই পরিচিত আবেষ্টনীর মধ্যে ফিরিয়া আসিয়া বাপের বাড়ি হইতে সংগ্রহ করিয়া আনা সহজ ও শান্ত ভাবটুকু অমলার ঘুচিয়া যাইতেছিল। এ ঘরের আবহাওয়ায় সে একা যত বিদ্যুৎ ঠাসিয়া রাখিয়া গিয়াছিল তার দেহমন যেন আবার তাহা শুষিয়া লইতেছে। তবু এবার হয়তো একটু সংযত থাকিতে পারিত অমলা, হয়তো সূর্যকান্ত যেরকম চাহিয়াছিল সেই রকম হওয়ার জন্য চেষ্টা করিতে পারিত সূর্যকান্ত যদি এমন ভাব না দেখাইত আজ, এমনভাবে কথা না বলিত। তার সুদীর্ঘ কুমারী জীবনের শেষ ক’মাসের কল্পনার মতো হইয়া উঠিয়াছে যে সূর্যকান্ত আজ! আঙুল চালাইয়া চালাইয়া চুল এলোমেলো করিয়া দেওয়ায় কী বন্যই আজ তাকে দেখাইতেছে! চোখের চাহনিতে যেন বিপন্নতার সঙ্গে মিশিয়া আছে বিদ্রোহ, কথা বলিবার ভঙ্গিতে যেন শোনা যাইতেছে পরাজিত ক্ষুব্ধ আত্মার নালিশ, বসিবার ভঙ্গি দেখিয়া মনে হইতেছে হঠাৎ উঠিয়া ভয়ানক কিছু করিবার এটা ভূমিকা মাত্র। তা ছাড়া, তারই জন্য এক মাস সূর্যকান্ত কিছুই লিখিতে পারে নাই! প্রথম দীর্ঘ বিরহ আসিবামাত্র স্বামী তার বুঝিতে পারিয়াছে, কী ভয়ানক ভালোই সে বাসিয়া ফেলিয়াছে তার বউকে! অমলা শিহরিয়া ওঠে, তার রোমাঞ্চ হয়। 

গদগদ কণ্ঠে সে বলিল, আমার জন্য? আমার জন্য এক মাস তুমি লিখতে পার নি? 

সূর্যকান্ত তার হাত চাপিয়া ধরিল। এত জোরে ধরিল যে চুড়িগুলো প্রায় কাটিয়া বসিয়া গেল অমলার হাতে। গলা আবেগে কাঁপাইয়া সূর্যকান্ত বলিল, কার জন্য তবে? তুমি আমায় পাগল করে দিয়েছ অমল, আমার মাথা খারাপ করে দিয়েছ। কতবার ইচ্ছে হয়েছে ছুটে গিয়ে তোমাকে দেখে আসি। কেন যাই নি জান? বিরহের যাতনা কত তীব্র হতে পারে তাই দেখবার জন্য। আমার রামধনু বইয়ের অপর্ণাকে মনে আছে তোমার? ভালবাসা বাড়ানোর জন্য সে থেকে থেকে নিজেই বিরহ সৃষ্টি করে নিত। আমিও ভাবছিলাম—

একটি মুখর হিরো ও প্রায় নির্বাক হিরোইন—শুধু এই দুটি চরিত্র লইয়া নাটকের যেন অভিনয় চলিতে থাকে ঘরে,—রাত দুটা পর্যন্ত। প্ৰথম অঙ্ক শেষ হওয়ার আগেই অমলার সবটুকু উত্তেজনা নিস্তেজ হইয়া আসে, জাগে ভয়, মুখ হয় বিবর্ণ। এ কী ব্যাপার? সত্যসত্যই পাগল হইয়া গিয়াছে নাকি সূর্যকান্ত? এসব সে কী বলিতেছে, কী করিতেছে? ক্রমে ক্রমে শান্তি বোধ করে অমলা, তার ঘুম পায়। কিন্তু ঘুমানোর উপায় নাই। তার আট মাসের প্রতিহত উচ্ছ্বাস স্বামী আজ সুদে-আসলে ফিরাইয়া দিতেছে, গ্রহণ না করিয়া তার উপায় কী? কখনো প্রচণ্ড ও কঠিন, কখনো মৃদু ও কোমল ভালবাসার বন্যা আনিয়া দিতেছে স্বামী, যা সে চাহিয়া আসিয়াছে চিরকাল, আজ এ বন্যায় ভাসিয়া না গেলে কি চলে? মাগো, এমন হইল কেন সূর্যকান্ত, কীসে এমন পরিবর্তন আসিল তার? 

রাত দুটোর সময় বোধ হয় তার মুখ দেখিয়া দয়া হইল সূর্যকান্তের। হঠাৎ মোটরের ব্রেক কষার মতো, সে থামিয়া গেল। অমলা মরার মতো জিজ্ঞাসা করিল, আমি এসেছি, এবার তো লিখতে পারবে? 

সূর্যকান্ত আনমনে জবাব দিল, আমি ভাবছি অমলা, কথা কোয়ো না। তোমার কথা ভাবছি। পাশে শুয়ে আছ তুমি, তবু তুমি যেন কত দূরে, কত সমুদ্র, কত মরুভূমি পার হয়ে কুয়াশার আড়ালে তুমি যেন লুকিয়ে আছ, মনকে বাহন করে আমি তোমাকে খুঁজতে বেরিয়েছি। বাধা দিয়ো না, কথা কোয়ো না। 

.

বিষের ওষুধ নাকি বিষ। তবু, স্ত্রী প্রকৃতির অস্বাভাবিকতাটুকু স্বাভাবিক করিয়া আনার জন্য সূর্যকান্তের এই অভিনব চিকিৎসাকে সমর্থন করা যায় না। আসলে, দোষ তো তারও কম নয়। প্রথম বয়সে ভাবপ্রবণতা, কবিত্ব ও রোমান্সের পিপাসা, হৃদয়ে আবেগ ও উচ্ছ্বাসের বাহুল্য, অধিকাংশ ছেলেমেয়েরই কমবেশি থাকে। এদিকে সূর্যকান্ত হইয়া গিয়াছে বুড়া। বয়সে না হোক, মনের হিসাবে। শুধু নিজের জীবনে নয়, পরের সঙ্গে নিজেকে অভিন্ন করিয়া সে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করিয়াছে স্তুপাকার, লিখিতে বসিয়া শুধু পুরুষের নয়, মেয়েদেরও অসংখ্য বিভিন্ন অনুভূতি উপভোগ করিয়াছে বহুবার। ধরিতে গেলে ইতোপূর্বেই অনেকবার বিবাহ হইয়া গিয়াছে সূর্যকান্তের, কখনো সে হইয়াছে বউ, কখনো বর; সে একাই একজোড়া স্বামী-স্ত্রী সাজিয়া নানাভাবে নানারকম সংসার স্থাপন করিয়াছে। অমলা তার কোন পক্ষের বউ বলা যায় না! তবু অমলার কল্পনাকে পর্যন্ত স্তম্ভিত করিয়া দেওয়ার মতো ছেলেমানুষি অবান্তর কল্পনা, জীবনকে কাব্যময় ও নাটকীয় করিয়া তুলিবার পিপাসা—এক কথায়, অনুভূতির জগতে বৈশাখী ঝড় ও বাসন্তী বায়ুর বিপরীত বিপর্যয় ঘটাইবার কামনা আজো সূর্যকান্তের আছে—তবে সেই সঙ্গে আছে ওই পিপাসা বা কামনাকে গোপন করিয়া রাখার অভ্যাস ও কোনো জীবন্ত রক্তমাংসের রমণীর সঙ্গে ও সমস্তের আদান-প্রদানের অক্ষমতা। জীবনটা মানুষের যতখানি গল্প-উপন্যাস হওয়া দরকার, নিজের গল্প-উপন্যাসে সূর্যকান্তের তা বহুগুণ বেশি হয়। লেখার সময় ছাড়া সে তাই হইয়া থাকে ভোঁতা, চায় শান্তি ও সহজ স্বাভাবিক জীবন। প্রতিভাবান সাহিত্যিকরা এরকম হয় কিনা জানি না, তবে যে সব লেখকের বই পড়িয়া শুধু অমলার মতো মেয়েদের বুকটা ধড়ফড় করে, তারা অবিকল এই রকম বা এই ধরনের অন্যরকম হয়। 

বাস্তব জীবনের সাধারণ কাজগুলো সূর্যকান্ত সাধারণভাবেই করে, সাধারণ সমস্যার মীমাংসা করে সাধারণ বুদ্ধি খাটাইয়া, তাতে কাজও হয়, সমস্যাও মেটে। অমলার জ্বর হইলে সে ডাক্তার ডাকিত সন্দেহ নাই, কিন্তু জ্বর সাধারণ অসুখ। অমলার হৃদয়-মনের অস্বাভাবিক উত্তাপ তো জ্বর নয়। এই অসুখের চিকিৎসার ব্যবস্থা করিতে সূর্যকান্তের সাধারণ বুদ্ধি গুলাইয়া গেল। সে ভুলিয়া গেল যে বিষে যদিও বিষ ক্ষয় হয়, হিস্টিরিয়া হিস্টিরিয়ায় সারে না—কারণ হিস্টিরিয়া বিষ নয়। 

কয়েক দিনের মধ্যে অমলা শুকাইয়া গেল। এ তো আর বই পড়া নয়, কল্পনা করা নয়, স্বপ্ন দেখা নয়, নিজের হৃদয়োচ্ছ্বাসকে কোনো রকমে বাহির করিয়া দেওয়া নয়! অন্য একজনের হৃদয়কে বহিয়া বেড়ানো—প্রত্যেক দিন উত্তেজনার মদ খাইয়া নেশায় জ্ঞান হারানো। স্বামীর আক্রমণের আকস্মিকতায় প্রথম রাত্রে অমলা ভয় পাইয়া গিয়াছিল, এখন আর ভয় হয় না, বুকটা ফাটিয়া যাইতে চায়, মাথার মধ্যে একটা বিশৃঙ্খল আবর্তনের সৃষ্টি হয়, চোখের সামনে সমস্ত ঝাপসা হইয়া আসে। এক-একসময় চিৎকার করিয়া হাসিয়া অথবা কাঁদিয়া উঠিতে ইচ্ছা হয়। এক-একসময় ঘরের জিনিসপত্র ভাঙিয়া ছারখার করিয়া দিবার অথবা সূর্যকান্তের বুকটা আঁচড়াইয়া ক্ষতবিক্ষত করিয়া দিবার অদম্য প্রেরণা জাগে। সূর্যকান্তের আদরে তার দম আটকাইয়া আসে, কথা শুনিতে শুনিতে দুই কানের মাঝে ঝমঝম আওয়াজ হয়, হঠাৎ কথা বন্ধ করিয়া সে চুপ করিলে চারদিকের স্তব্ধতা মনের মধ্যে আছড়াইতে থাকে। 

ফিসফিস করিয়া বলে, আলো নিভিয়ে দাও, আলো নিভিয়ে দাও!

সূর্যকান্ত বলে, আলো? কোথায় আলো অমলা? জ্যোৎস্নাকে আলো বোলো না।

একটু ঝিমায় অমলা।

লিখবে না আজ? 

লেখা? একটু হাসে সূর্যকান্ত, কার জন্য লিখব? মনের পাতায় লিখছি, মুখে তোমাকে শোনাচ্ছি। আর কী দরকার লিখে? 

মাথাটা কেমন ঘুরছে, কী রকম একটা কষ্ট হচ্ছে। 

এবার হঠাৎ যেন সূর্যকান্ত চোখের পলকে আগেকার সূর্যকান্ত হইয়া যায়। এক গ্লাস জল গড়াইয়া সে অমলাকে দেয়, ভিজা হাত বুলাইয়া দেয় তার কপালে ও ঘাড়ে। শুধু বলে শোও। তারপর আলো নিভাইয়া সেও আসিয়া শুইয়া পড়ে! বলে, কী কষ্ট হচ্ছে অমলা? 

কী জানি, বুঝতে পারছি না। 

কেবল কষ্ট নয়, অনেক কিছুই সে বুঝিতে পারে না! বারুদ-ফুরানো তুবড়ির মতো হঠাৎ সূর্যকান্ত নিভিয়া গেল কেন? রামধনুর মোহিতের মতো বিপুল দুর্বোধ্য প্রেম একমুহূর্তে কী করিয়া হইয়া গেল এমন মৃদু কোমল স্নেহ? গভীর বিষাদ ও অবসাদ বোধ করে অমলা, তার ঘুম আসে না। একসময় মৃদুস্বরে সূর্যকান্ত তাকে ডাকে। ঘুমের ভান করিয়া সে জবাব দেয় না। তামাশা? সূর্যকান্ত কি তামাশা জুড়িয়াছে তার সঙ্গে? এতদিন ধরিয়া এরকম তামাশা করিবার মানুষ তো সে নয়! তা ছাড়া, কারো তামাশা কি এমন উতলা করিয়া তুলিতে পারে একজনকে? প্রথম দু-এক দিন কেমন খাপছাড়া মনে হইয়াছিল স্বামীর এই অভিনব পরিবর্তন, এখনো মাঝে মাঝে সব যেন কেমন বেসুরো কৃত্রিম মনে হয়—কিন্তু বাকি সময়? তখন যে আশ্চর্য ব্যাকুলতা সে দেখায়, যে অভূতপূর্ব ভাব ফুটিয়া থাকে তার মুখে চোখে, তা কি কখনো বানানো হইতে পারে? কথা বলিতে বলিতে থামিয়া গিয়া সে যখন শুধু চাহিয়া থাকে; শুধু ভাবে, আর মোহগ্রস্ত বিহ্বল মানুষের মতো দুটি হাত বাড়াইয়া তাকে স্পর্শ করামাত্র চমকাইয়া ওঠে এবং ভীরু শিশুর মতো তাকে জড়াইয়া ধরে, তখনো সে অভিনয় করিতেছে এ কী ভাবা যায়! অথচ এদিকে তার একটা প্রকাণ্ড মিথ্যা অমলার কাছে ধরা পড়িয়া গিয়াছে। সূর্যকান্ত তাকে বলিয়াছিল সে বাপের বাড়ি যাওয়ার পর মাসিকের উপন্যাসটির ইনস্টলমেন্ট পর্যন্ত সে লিখিয়া দিতে পারে নাই। ক’দিন আগে, সে আপিস চলিয়া গেল বারোটার ডাকে মাসিকপত্রটি আসিয়াছিল; তাতে ছিল উপন্যাসটির দশ পাতা ইনস্টলমেন্ট! কৈফিয়ত অবশ্য সে একটা দিয়াছিল, সে নাকি এ মাসের কথা বলে নাই, বলিয়াছিল আগামী মাসের কথা। এ সংখ্যার লেখা তো সে কবে লিখিয়া দিয়াছে, অমলার বাপের বাড়ি যাওয়ার অনেক আগে। 

অন্তত দু মাস আগে লেখা দিতে হয় অমল, নইলে ওরা সময় পাবে কেন ছাপবার? 

তবু অমলার মনের খটকা যায় নাই। দু মাস আগে হোক চার মাস আগে হোক, পাঠাইয়া দেওয়ার আগে সূর্যকান্তের কোন লেখাটা সে পড়িয়া ফ্যালে নাই? এ লেখা সে লিখিল কখন? 

আপিসে লিখেছিলাম। দশ-বারো দিন একদম কাজ ছিল না, সেই সময় এডিটর তাগিদ দিচ্ছিল তাই আর তোমাকে পড়তে দিই নি 

তবু মিথ্যাটা এসব কৈফিয়তের খোলসে সম্পূর্ণ ঢাকা যায় নাই। অমলার মনের প্রতিবাদ এসব না মানিয়া একটা বিস্বাদ ব্যথায় পরিণত হইয়া আজো তার মনে বাসা বাঁধিয়া আছে। আছে গোপনে। সূর্যকান্তের এখনকার নতুন ধরনের ভালবাসারও সেখানে প্রবেশাধিকার নাই! 

লেখা সূর্যকান্ত ছাড়িয়া দিয়াছে। বাড়িতেও লেখে না, আপিসেও লেখে না। বাপের বাড়ি গিয়া নয়, এখানে আসিয়া অমলা তার লেখার ক্ষমতা হরণ করিয়াছে। অমলাকে অজস্র পরিমাণে দেওয়ার জন্য নিজের মধ্যে সে যে উচ্ছ্বাসের কারখানা বসাইয়াছে এবং কারখানা চালানোর জন্য মজুর ভাড়া করিয়াছে—বই লেখার 

লেখার কৃত্রিম খাদ্যে পরিতুষ্ট মনের চাপ পড়া পাগলামিগুলোকে, সেই কারখানাতে এখন সব সময় সে কর্তৃত্ব খাটাইতে পারে না। অমলাকে দেওয়ার জন্য ছাড়া অন্য কাজে খাটাইতে গেলে মজুররা ধর্মঘট করে, কারখানা বন্ধ করার কথা ভাবিলে আরম্ভ করে দাঙ্গা-হাঙ্গামা। বিশেষ প্রয়োজনে সাময়িকভাবে একটু একটু মদ খাইতে আরম্ভ করিয়া যারা নেশার দাস হইয়া পড়ে, তাদের মতো অবস্থা হইয়াছে সূর্যকান্তের। অমলার সঙ্গ ছাড়া আর কিছু তার ভালো লাগে না—আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, কর্তব্যপালন। শয়নঘরের বাহিরে সে আগের চেয়েও গম্ভীর হইয়া থাকে, মানুষের সঙ্গে তার ব্যবহারকে সে আরো সহজ ও সংক্ষিপ্ত করিয়া রাখে—মনে হয় সে যেন সব সময় প্রাণপণে নিজেকে সংযত করিয়া চলিতেছে আর বোধ করিতেছে দারুণ অস্বস্তি। সাহিত্যিক বন্ধুরা জানিতে চায় সে তার এক নম্বর এপিকটা লিখিতেছে কি না, সম্পাদকরা প্রকারান্তরে জানাইয়া দেয় এরকম অন্যায় ব্যবহার সহ্য করা কঠিন, সাধারণ বন্ধুরা উপদেশ দেয় চেঞ্জে যাওয়ার, বাড়ির লোকে চেষ্টা করে আদর যত্ন স্নেহ মমতা সহানুভূতি প্রভৃতির পরিমাণটা বাড়াইবার। বাইশ বছর বয়সে যা করা চলিত, ত্রিশ বছর বয়সে তাই করিতে চাহিয়া চারদিকে সূর্যকান্ত বিশৃঙ্খলা আনিয়া দেয়। ক্রমে ক্রমে তার মনে হয় অমলার চিকিৎসার জন্য নয়—ওই ছুতা করিয়া নিজের দাবাইয়া রাখা মানসিক বিকারগুলোকে সে সতেজে আত্মপ্রকাশ করিবার সুযোগ দিয়াছে। অমলার পাগলামি সারানো নয়, এ তার নিজেরই পাগল হওয়ার ইচ্ছা মেটানো। তা না হইলে, এসব অমলার সহ্য হইতেছে না দেখিয়াও সে কি থামিয়া যাইত না? সহজ ও স্বাভাবিক করিয়া আনিত না তাদের সঙ্গ? এভাবে সে তো ওকে নির্যাতন করিতে চায় নাই! ওকে শুধু সে বুঝাইয়া দিতে চাহিয়াছিল, ও যে নাটকীয় প্রেম চাহিত সেটা কত তুচ্ছ, কত হালকা, কতদূর হাস্যকর! সে তো শুধু থিয়েটার করিতে চাহিয়াছিল ক’দিন, তার নিজের গৃহের সিমেন্টের রঙ্গমঞ্চে সাধারণ বাস্তব জীবনের বিরুদ্ধে দৃশ্যপটের আবেষ্টনীতে অমলার উদ্ভ্রান্ত কল্পনা লইয়া রচিত একটা শিক্ষাপ্রদ নাটকের অভিনয়; এখন তার কাছেই সে অভিনয় এত বড় সত্য হইয়া উঠিয়াছে যে কোনোমতেই যবনিকা সে আর ফেলিতে পারিতেছে না। 

দিন কাটে। এক মাসের ছুটি নেয় সূর্যকান্ত, আপিস বিরক্তিকর। অমলার চোখের নিচেকার কালিমার ছাপ গাঢ় হইতে থাকে, কোনো কারণে কোনো দিকে চকিত দৃষ্টিতে চাহিলে মনে হয় চোখে যেন তার বিদ্যুৎ খেলিয়া গেল। সংসারের কাজ আছে, সকলের সঙ্গে মেলামেশা আছে, সংসারের দৈনন্দিন সুখদুঃখ হাসিকান্নার ভাগ নেওয়া আছে। শ্রান্ত, বিষণ্ণ ও অন্যমনস্কভাবে এসব সে করিয়া যায়। রান্নাঘরে রাঁধিবার সময়ও সে যেন থাকে তার নিজের ঘরে, কল চালাইয়া সেজো ননদের ছেলের জামা সেলাই করিবার সময় সে যেন কণ্ঠলগ্না হইয়া থাকে সূর্যকান্তের। শান্ত ও স্নিগ্ধ একটু রূপ ছিল অমলার আর ছিল তেলমাখা পাথরের বাটির মতো একটু ভোঁতা লাবণ্য, এখন তার রূপ হইয়াছে দৃষ্টিকে আকর্ষণ করা মুখভঙ্গির তীক্ষ্ণ তেজি মৌলিকতা, লাবণ্য হইয়াছে সদ্য শাণ দেওয়া সিসার ছুরির পালিশ। মেজাজ, বুদ্ধিবিবেচনা, আত্মসংযম, চিন্তা ও কল্পনা, সুনিদ্রা এসব বড় অবাধ্য হইয়া উঠিয়াছে অমলার। হঠাৎ সামান্য কারণে সে এত রাগিয়া যায় যে অন্তত আরো একটা বছরের পুরোনো বউ যদি সে হইত, না খাইয়া শুইয়া থাকার বদলে বাড়িঘর মাথায় না তুলিয়া কখনই ছাড়িত না। ভাবনাগুলো তার এমন এলোমেলো হইয়াছে যে সব সময় কী ভাবিতেছে তাও সে বুঝিতে পারে না; স্টিমারে চাপিয়া কবে সে একবার ঢাকা গিয়াছিল, আর কাল সেজো ননদ যে বড় জার ছেলের দুধটুকু নিজের ছেলেকে খাওয়াইয়া দিয়াছিল, আর পরশু রাত্রে সূর্যকান্ত যে তার উনিশ বছর বয়সের একটা ভুলের কাহিনী শোনাইয়াছিল, আর..! তবু এ সমস্ত খিচুড়ি পাকানো চিন্তার মধ্যে আসল চিন্তার খেইটা না হয় নাই খুঁজিয়া পাওয়া গেল, বাড়ির সে দাসীটা আঁচল পাতিয়া ঘুমাইয়া আছে ওর মাথায় এক ঘটি জল ঢালিয়া দিবার সাধটা কোন দেশী সাধ? আর আজ রাত্রে বিধবা বড় ননদের সঙ্গে শোয়ার সাধ? চুপিচুপি সদর দরজা খুলিয়া পালাইয়া যাওয়ার সাধ? কলের ছুঁচটার নিচে একটা আঙুল দিয়া নিজেকে কেন্দ্র করিয়া বাড়িতে একটা হইচই গণ্ডগোল সৃষ্টি করার সাধ? আচ্ছা, কাল যখন সিঁড়ি দিয়া নামার সময় পা পিছলাইয়া গিয়াছিল, রেলিং ধরিয়া সামলাইয়া না নিলে কী হইত? খুব কী লাগিত গড়াইয়া গড়াইয়া নিচে পড়িয়া গেলে, হাত ভাঙিত, মাথা ফাটিত, একেবারে সে অজ্ঞান হইয়া যাইত? কী করিত সকলে? সূর্যকান্ত কী করিত?—দ্যাখো! সেজো ননদের ছেলের জামার কোনখানটা সে সেলাই করিয়া ফেলিয়াছে। মরেও না সেজো ননদটা। 

এক মাস ছুটি নিয়াছে সূর্যকান্ত। কিন্তু দুপুরে অমলা ঘরে যায় না। সূর্যকান্তও তাকে ডাকে না। আপিস না করার আলস্য সে অমলা কাছে না থাকার মুক্তির সঙ্গে মিশাইয়া উপভোগ করে। বেশি বেলায় বেশি খাওয়ার জন্য একটু অম্বলের জ্বালাও সে ভোগ করে। চোখ দিয়া দ্যাখে কড়িকাঠ, কান দিয়া শোনে ওদিকের ঘরে অমলার কল চালানোর ক্ষীণ শব্দ, হৃদয় দিয়া অনুভব করে ভোঁতা একটা গ্লানি, আর মন দিয়া ভাবে আজই পোস্ট অফিস হইতে শ-তিনেক টাকা তুলিয়া বিকালের কোনো একটা গাড়িতে কোথাও বেড়াইতে গেলে কেমন হয়। বিকালের গাড়িতে, অন্তত রাত্রি ন’টার আগের কোনো গাড়িতে। অমলা ঘরে আসার আগেই যে গাড়িটা ছাড়িয়া যায়। কোন অমলা? তার মনের, না ও ঘরে কল চালাইয়া যে সেজো ননদের ছেলের জামা সেলাই করিতেছে, যে ঘরে আসিলে এতটুকু ঘরে কোটি বসন্ত আর কোটি প্রেমিক-প্রেমিকার মিলন মুহূর্তগুলো ঘনাইয়া আসিবে? ঠিক বুঝিতে পারে না সূর্যকান্ত। মনের অমলাকে সাথী করিয়া বিকালের গাড়িতে পালানো যায়, কিন্তু তাতে কি ও ঘরের অমলার জন্য মন কেমন করা কমিবে? 

ছুটি নেওয়ার চার-পাঁচ দিন পরে বিকাল বেলা সূর্যকান্ত একখানা চিঠি লিখিতেছিল, অর্ধেক লিখিয়া চিঠিখানা ছিঁড়িয়া ফেলিয়া দিয়া কার উপরে রাগ করিয়াই সে যেন উঠিয়া পড়িল। সহজ ভাষায় পরিষ্কার করিয়া কেবল দরকারি কথাগুলো লিখিয়া একখানা চিঠি লেখার ক্ষমতাও যদি তার লোপ পাইয়া থাকে, এবার তবে একটা ব্যবস্থা করা দরকার। জামা গায়ে দিতে দিতে সূর্যকান্তের রাগ কমিয়া আসিল। কার উপরে রাগ করিবে? চিঠি লিখিতে বসিয়া সে যদি ভাবিতে আরম্ভ করে যে আজ রাত্রে অমলার সঙ্গে প্রথমেই কীভাবে একটা নতুন ধরনের মধুর কলহ আরম্ভ করা সম্ভব, গুরুতর বিষয়ের বৈষয়িক চিঠি সে লিখিবে কী করিয়া? জুতা পায়ে দিয়া, কাপড় বদলাইয়া সূর্যকান্ত ঘরের বাহিরে আসিল। বারান্দায় স্টোভ জ্বালিয়া বৈকালিক চা-জলখাবারের আয়োজন হইতেছে। মেঘলা রঙের শাড়ি পরিয়া অমলা বেলিতেছে লুচি। শুধু বাড়ির মেয়েদের ও ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের মধ্যে অমলার স্বাভাবিক তুচ্ছ অসংযমটুকু কী রহস্যময়! একটু দাঁড়াইল সূর্যকান্ত। অমলার সেজো ননদ বলিল, বেরিয়ে যাচ্ছ নাকি দাদা? খেয়ে যাও, আগে চা করে দিচ্ছি তোমাকে। কেটলিতে জল আনো দিকি মেজো বউদি? যা লুচি ভাজা হয়েছে ওতেই দাদার হয়ে যাবে। 

সূর্যকান্ত বলিল, এখন কিছু খাব না। খিদে নেই। সময় নেই। 

তখন উঠিয়া আসিয়া অমলা ঘরে ঢুকিল। বক্তব্য আছে। এ বাড়িতে আধ- পুরোনো বউদের প্রথমে নিজে সকলের চোখের আড়ালে গিয়া—তারপর স্বামীকে ইশারায় কাছে ডাকিয়া কথা বলা নিয়ম। এখন ইশারার দরকার ছিল না। সূর্যকান্তও ঘরে গেল। 

অমলা বলিল, বাইরে থেকে চা খেয়ে এস না কিন্তু। আমিও এখন চা খাব না, তুমি ফিরে এলে নিজে চা করে দেব, তারপর এক পেয়ালা থেকে দুজনে একসঙ্গে চা খাব, কেমন? এমনি করে খাব 

এ মন্দ পরামর্শ নয়। গালে গাল ঠেকাইয়া একসঙ্গে দুজনে চায়ের কাপে চুমুক হয়তো তারা দিতে পারিবে। কিন্তু কেন? গালে গাল ঠেকানো আর চায়ের কাপে চুমুক দেওয়ার ব্যাপার দুটো পৃথক করিয়া রাখিলে দোষ কী? 

আজ আমি ফিরব না অমল। 

ফিরিবে না! রাত্রে বাড়ি ফিরিবে না! কোথায় থাকিবে সূর্যকান্ত সমস্ত রাত? কেন? বন্ধুর বাড়িতে রাত্রে থাকিবে কেন? নিমন্ত্রণ আছে, খাওয়া শেষ হইতে অনেক রাত্রি হইয়া যাইবে, তাই? হোক রাত্রি, ট্যাক্সি করিয়া যেন সে ফিরিয়া আসে। একদিন না হয় ট্যাক্সি ভাড়া বাবদ দেড় টাকা—দু টাকা খরচই হইবে! অমলার অস্বাভাবিক তীক্ষ্ণদৃষ্টি চোখে বিধিতে থাকে সূর্যকান্তের, মাথাটা যেন ঘুরিয়া ওঠে। 

তবে যাব না অমল। 

সেই ভালো। কী হবে নেমন্তন্ন খেতে গিয়ে? 

তাই তো বটে! তার চেয়ে অমলার সঙ্গে এক কাপে চা খাওয়া ঢের বেশি উপভোগ্য। কিন্তু কীভাবে ওর সঙ্গে আজ সে মধুর কলহটা আরম্ভ করিবে? কীভাবে আজ সে নতুন একটা বৈচিত্র্য আনিবে তাদের প্রেমাভিনয়ে? বেশি জটিল হইলে, বেশি আর্টিস্টিক হইলে অমলা আবার বুঝিতে পারে না, কাঁদিতে কাঁদিতে বলে যে সে তার উপযুক্ত বউ নয়, তার মরাই ভালো। ফেনা ভালবাসে অমলা, শুধু ফেনা। তার মতো সাধারণ অল্পশিক্ষিতা ঘরের কোনায় বাড়িয়া ওঠা মেয়ে যা কিছু বুঝিতে, অনুভব করিতে ও উপভোগ করিতে পারে তারই ফেনা। ওর জন্য জলকে সোডা ওয়াটারের মতো, সিদ্ধির শরবতকে মদের মতো ফেনিল করিয়া তুলিতে হয় তাকে। নতুবা তাদের নাটক জমে না। নাটক না জমিলে অমলার মতো তারও মনে হয় জীবনটা বৃথা হইয়া গেল, বাঁচিয়া থাকার কোনো মানে রহিল না। 

.

বন্ধুর বাড়িতে নিমন্ত্রণ খাইতে নয়, পরদিন থিয়েটার দেখিতে গেল সূর্যকান্ত। অমলা ও বাড়ির অন্য মেয়েরাও অবশ্য সঙ্গে গেল। থিয়েটারে তাই দুজনের মধ্যে দু-একবার দৃষ্টি বিনিময় ছাড়া কথাবার্তা কিছুই হইল না। রাত তিনটায় বাড়ি ফিরিয়া নিদ্রাতুর দুজনে দু-একটি কথা বলিয়াই ঘুমাইয়া পড়িল। পরদিন সূর্যকান্ত বাড়িতেই রহিল বটে কিন্তু আগের রাত্রে বাহিরের আসল নাটক দেখিয়া আসার জন্যই সম্ভবত সেদিন রাত্রে ঘরোয়া নাটক তাদের তেমন জমিল না, দারুণ অস্বস্তি মনে লইয়া দুজনে সে রাত্রে ঘুমাইল। পরদিন অমলার সেজো ননদকে স্বামীর কাছে রাখিয়া আসিতে সূর্যকান্ত চলিয়া গেল পাটনা। কাজটা অমলার দেবর করিতে পারিত—তাই ঠিক ছিল আগে, শুধু দিন তিনেক তার কলেজ কামাই হইত। তিন দিন তাকে ছাড়িয়া থাকার চেয়ে ভাইয়ের তিন দিন কলেজ কামাই হওয়াকে সূর্যকান্ত যে বড় মনে করিল এতে কী মর্মান্তিক আঘাতই অমলার মনে লাগিল! তাও, ভাগনের সঙ্গে যখন সেজো ননদকে পাঠানো চলিত, সেজো ননদের স্বামীকেও যখন লেখা চলিত যে, আসিয়া লইয়া যাও। ভাগনে অবশ্য খুব ছেলেমানুষ, সেজো ননদের স্বামী অবশ্য অনেক চেষ্টা করিয়াও ছুটি পায় নাই—তবু মনে আঘাত লাগা তো এসব যুক্তি মানে না! তারপর তিন দিন পরে যখন অমলার বদলে অমলার দেবরের নামে একখানা সংক্ষিপ্ত চিঠি আসিল সূর্যকান্তের যে, এখানে ওখানে, সে একটু বেড়াইবে এবং ফিরিতে তার দেরি হইবে, অমলার চোখে পৃথিবী অন্ধকার হইয়া গেল। সে বুঝিতে পারিল স্বামী তাকে ত্যাগ করিয়াছে। হঠাৎ তাকে বাপের বাড়ি পাঠাইয়া দিয়া একবার যেমন ত্যাগ করিয়াছিল, এবার নিজে বোনের শ্বশুরবাড়ি গিয়া আবার তেমনই ত্যাগ করিয়াছে। কেবল সেবার এখানে ফেরামাত্র স্বামীকে সে ফিরিয়া পাইয়াছিল, এবার স্বামী তার ফিরিয়া আসিলেও তাকে আর সে ফিরিয়া পাইবে না। অনুপযুক্তা বউটাকে জীবন হইতে ছাঁটিয়া ফেলিবার উদ্দেশ্য না থাকিলে এত লোক থাকিতে সে কেন যাচিয়া পাটনা যাইতে চাহিবে, তার সজল চোখের বারণ মানিবে না? হায়, একখানা চিঠিও যে সে লিখিল না অমলাকে! 

তিন-চার দিন পরেই আগ্রা হইতে চিঠি আসিল বটে, বেশ বড় চিঠি, ফুলস্ক্যাপ কাগজের প্রায় একপাতা। কাগজ দেখিয়া আর ‘কল্যাণীয়াসু’ সম্বোধন দেখিয়াই অমলা বুঝিতে পারিল এ চিঠি চিঠিই নয়, পরিত্যক্তা স্ত্রীর সঙ্গে এ শুধু সূর্যকান্তের ভদ্রতা। কী লিখিয়াছে সূর্যকান্ত? কিছুই নয়! অমলাকে সে একটা ভ্রমণ-কাহিনী পাঠাইয়া দিয়াছে। শুধু গোড়ায় একটা অর্থহীন কৈফিয়ত দিয়াছে হঠাৎ তার বেড়ানোর শখ জাগিল কেন এবং শেষে লিখিয়াছে অমলাকে সাবধানে থাকিতে, সময়মতো খাওয়া-দাওয়া করিতে, শরীরের দিকে নজর রাখিতে, বাড়ি ফিরিয়া সে যদি অমলাকে বেশ মোটাসোটা দ্যাখে তবে তার কত আনন্দ হইবে–এই কথা। তারপর ভালবাসা জানাইয়াই ইতি এবং সে যে শুধু অমলারই এই মিথ্যা ঘোষণা। 

ঘরে খিল দিয়া চিঠি পড়িয়াছিল অমলা, পাঁচ ঘণ্টা পরে সে খিল খুলিল। পাংশু বিবর্ণ তার মুখ, চোখ দুটি লাল। অসুখের কথা সকলে বিশ্বাস করিল, কেবল অমলার ছোট ননদ, যার বিবাহের বয়স হইয়াছে এবং সূর্যকান্তের মতো সাহিত্যিকদের উপন্যাস পড়িয়া যার আজকাল বুক ধরফড় করে, সে শুধু বলিল—বিরহ নাকি বউদি? চিঠি তো এল আজ। দাও না চিঠিখানা লক্ষ্মী বউদি ভাই, দেখি দাদা কী লিখেছে। সারা দিন ধরে পড়লে চিঠি, খেলে না দেলে না- 

বিরহ? ওসব তুচ্ছ মৃদু বেদনা বোধ করিবার শক্তি অমলার আর ছিল না। আর কী তার সন্দেহ আছে যে সূর্যকান্তের হঠাৎ পাটনা যাওয়া ও এত দেরি করিয়া বাড়ি ফেরা তাকে ত্যাগ করারই ভূমিকা? রামধনুর অপর্ণাকে তার সাধারণ অনুপযুক্ত স্বামী যে কারণে ত্যাগ করিয়াছিল, তার ঠিক উলটা কারণে। নিজের বিবাহিত জীবনকে ও বিবাহিত জীবনের বাছা বাছা ছোটবড় ঘটনাকে অমলা তার এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে খাপ খাওয়ায়। হঠাৎ ঝোঁকের মাথায় সূর্যকান্ত তাকে বিবাহ করিয়াছিল, তাই গতবার বাপের বাড়ি পাঠাইয়া দেওয়া পর্যন্ত তাকে সে ভালবাসে নাই, তার বুকে ভালবাসা জাগাইবার চেষ্টাও করে নাই, বরং বাধাই দিয়াছে। অমলার ভালবাসা তখন সে চাহিত না, আর একজনের স্মৃতি (উনিশ বছর বয়সে একটা ছেলেমানুষি ভুল করার কাহিনীতে সে যার নাম করিয়াছিল তারই স্মৃতি কি না কে জানে!) বুকে পুষিয়া রাখিয়াছিল, নিজেকে ধরা দেয় নাই। অথবা সে অপেক্ষা করিতেছিল যে তাকে জয় করিয়া অমলা নিজের উপযুক্ততার প্রমাণ দিবে : মাঝে মাঝে দেখা হইয়া নয়, দিবারাত্রি একসঙ্গে বাস করিয়াও যদি তার বুকে ভালবাসা না জাগাইতে পারে, কোন গুণে তবে সে তার মতো দেশবিখ্যাত সাহিত্যিকের বউ হইয়া থাকিবে? তারপর তাকে বাপের বাড়ি পাঠানোর নামে ত্যাগ করিয়া বুঝি একটু মায়া হইয়াছিল সূর্যকান্তের, ভাবিয়াছিল সবদিক দিয়া নিজেকে অমলার কাছে সঁপিয়া দিয়া একবার শেষ চেষ্টা করিয়া দেখিবে অমলা তাকে বাঁধিতে পারে কি না। তাও যখন সে পারিল না, তখন আর পাটনা যাওয়ার ছলে তাকে ত্যাগ করা ছাড়া কী উপায় ছিল সূর্যকান্তের। 

অন্য কোথাও পাঠাইয়া দিয়া ত্যাগ হয়তো সে করিবে না, এখানে থাকিতে দিবে। আগের মতো থাকিতে দিবে, গাম্ভীর্য ও সহজ ব্যবহারের ব্যবধান রচিয়া। মৃদু একটু স্নেহমমতা সে পাইবে, আর কিছুই নয়। এ জীবনে একটি রাত্রিও আর অমলার আসিবে না স্বামীর যখন সে নাগাল পাইবে, স্বামী যখন তাকে ভালবাসিবে। 

আগে, বাপের বাড়ি হইতে ফিরিয়া আসিবার আগে, অনুরূপ অবস্থায় পড়িলে এইসব কথা হয়তো অমলার মনে আসিত কিন্তু আসিত কল্পনার রথে। হাজার সে বিচলিত হোক তার নারী- মস্তিষ্কের স্বভাব ও অপরিবর্তনীয় হিসাব করার প্রবৃত্তি, যা বাস্তবতা ও বাস্তব লাভ-লোকসানের হিসাব ছাড়া আর কিছুই মানে না, তাকে কখনো ভুলিতে দিত না যে তার এই সব উদ্ভট বিশ্লেষণ সাংসারিক রীতিনীতির বিরুদ্ধ, এ তার পাগলামি, তার নারীজীবনের প্রকৃত সার্থকতাগুলোর একটাও এইসব কারণে আসিতে বাধা পাইবে না। বরং এই উপলক্ষে একটা নতুন ধরনের মান-অভিমানের পালা গাহিয়া আরো সে নিবিড়ভাবে বাঁধিতে পারিবে তার স্বামীকে। কিন্তু অস্বাভাবিক ও মারাত্মক ভাবপ্রবণতার বিরুদ্ধে তার আত্মরক্ষার এই স্বাভাবিক ব্রহ্মাস্ত্রটি সূর্যকান্ত অব্যবহার্য করিয়া রাখিয়া গিয়াছে। যা ছিল অমলার শুধু কল্পনা ও হৃদয়োচ্ছ্বাস, কয়েক বছরের মধ্যে সংসারের ঢের বেশি গুরুতর ও ঢের বেশি প্রিয়তর ভাবনাচিন্তার তলে যা কোথায় তলাইয়া যাইত, নিজের অপরিমেয় অস্থায়ী পাগলামি দিয়া সূর্যকান্ত তাকেই অমলার কাছে দিয়া গিয়াছে সত্য ও বাস্তবতার রূপ। জীবনে নভেলি আবহাওয়া থাকে না জানিত বলিয়াই নিজের জীবনকে একটু নভেলি করার জন্য অমলার অদম্য পিপাসা জাগিয়াছিল, বিশেষত সে যখন মনে করিয়াছিল যে সূর্যকান্তের মতো নামকরা সাহিত্যিকের সঙ্গে বিবাহ হওয়ায় জীবনটাকে ওরকম করার একটা দুষ্প্রাপ্য ও বিশিষ্ট সুযোগ পাইয়াছে। জীবনটা কাব্যময় করার সুযোগ, কাব্যকে জীবন করার নয়। অমলা তো সামান্য স্ত্রীলোক, কাব্য ও জীবনের এই পার্থক্য জানা থাকে বলিয়াই কবি পর্যন্ত এ জগতে বাঁচিয়া থাকিতে পারে। কিন্তু সূর্যকান্ত সব ভণ্ডুল করিয়া দিয়া গিয়াছে। কবিত্ব করিতে গিয়া স্বামীর কাছে প্রশ্রয় না পাইয়া আগে কাঁদিয়াও সে সুখ পাইত, কারণ তাও ছিল এক ধরনের কাব্য। বাহুল্য কল্পনা ব্যাহত হইয়া বাহুল্য ব্যথা আসিয়া জীবনকে অমলার করিয়া তুলিত রসালো। এখন বাহুল্য ঘুচিয়াছে, রস হইয়াছে বিষ। একটা বোঝাপড়া যদি করিয়া যাইত সূর্যকান্ত, ভাবিবার একটা নতুন খোরাক যদি সে দিয়া যাইত অমলাকে! শুধু এইটুকু যদি অমলা কোনো রকমে ভুলিতে পারিত যে ইদানীং সূর্যকান্ত যখন তাকে অজস্র পরিমাণে স্বর্গের সুধা আনিয়া দিতে আরম্ভ করিয়াছিল, তাকে সে সহ্য করিতে পারিত না, কাছে যাইতে ভয় করিত। হায় ভগবান! সাধে কী স্বামী তার হাল ছাড়িয়া পলাইয়া গিয়াছে। 

সময়ে স্নানাহার হয় না, রাত্রে ভালো ঘুম হয় না, জীবনের গোড়াটাই যেন আলগা হইয়া গিয়াছে অমলার। কথা বলিতে কষ্ট হয়। মানুষ কাছে থাকিলে বোধ হয় বিরক্তি। হোক। কেউ কিছু বলিতে সাহস পায় না, এ বিরহিনী উন্মাদিনীকে কে ঘাঁটাইবে? নিজের মনে থাকে অমলা, অনেকটা স্বাধীনভাবেই নিজের মনের বিকারকে ব্যবহার করে। মাঝে মাঝে বিভিন্ন শহর হইতে সূর্যকান্তের চিঠি আসে, কখনো অমলার নামে—কখনো বাড়ির অন্য কারো নামে। প্রত্যেকটি চিঠি অমলাকে আঘাত করে। অমলার বিকৃত জগতে যা কিছু দামি সেসব কোনো কথাই চিঠিতে থাকে না, শুধু বাজে অবান্তর কথা। সূর্যকান্তের কাছে অমলার তুচ্ছতাই শুধু প্রমাণ করে চিঠিগুলো, আত্মগ্লানির আলোড়ন তুলিয়া দেয় মনে। একদিন প্রায় সমস্ত রাত জাগিয়া অমলা একখানা চিঠি লেখে সূর্যকান্তকে, আর একবার সে তাকে সুযোগ দিক, আর একটিবার, এবার যদি অমলা তার উপযুক্ত জীবনসঙ্গিনী হইতে না পারে তবে বিষ খাইয়া হোক, গলায় দড়ি দিয়া হোক ইত্যাদি। দশ দিন পরে মাদ্রাজ হইতে এ চিঠির জবাব আসিল। অমলার চিঠি পাইয়া সূর্যকান্ত নাকি খুব খুশি হইয়াছে, তবে ওসব আবোলতাবোল কথা কী ভাবিতে আছে, ছি! অমলা যে তার উপযুক্ত জীবনসঙ্গিনী নয় এ ধারণা তার কোথা হইতে আসিল ভাবিয়া সেই মাদ্রাজের একটা হোটেলের ঘরে বসিয়া সূর্যকান্ত এমন অবাক হইয়া যাইতেছে যে— 

এদিকে আরো এক মাসের ছুটির দরখাস্ত করিয়াছে সূর্যকান্ত। আরো কিছুদিন বেড়াইয়া বাড়ি ফিরিবে। অমলা যেন খুব সাবধানে থাকে, কেমন? 

.

হাসিতে হাসিতে দম আটকাইয়া আসে অমলার, মুখ দিয়া ফেনা বাহির হয়, হাত-পা ছুঁড়িবার ভঙ্গি দেখিয়া ভয় হয় অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো বুঝি খসিয়া চারদিকে ছিটকাইয়া পড়িবে। পালিয়ে পালিয়ে কতকাল বেড়াবে ঠাকুরঝি বলে, আর ধনুকের মতো বাঁকা হইয়া অমলা হাসে। ব্লাউজের বোতামগুলো পটপট করিয়া ছিঁড়িয়া যায় বলিয়া রাগে অমলা ব্লাউজটাই ছিঁড়িয়া ফেলিয়া দেয়, গায়ে আঁচলটুকু পর্যন্ত রাখিতে চায় না। বড় জা চেঁচায়, ছোট ননদ কাঁদে, দেবর মাথায় ঘটি ঘটি জল ঢালে, ঠাকুর-দেবতার নাম করিয়া পিসি যে কী বলে বোঝা যায় না, বাকি সকলে যা করে অথবা বলে—তার কোনো মানে থাকে না। শেষে সকলে মিলিয়া চাপিয়া ধরে অমলাকে, অমলাও বড় জার হাতে কামড়াইয়া রক্ত বাহির করিয়া দেয়। অতি কষ্টে কামড় ছাড়াইয়া দিবার পর এত জোরে তার দাঁতে দাঁত লাগিয়া যায় যে শরীরের আর কোথাও বোধ হয় একটুও শক্তি অবশিষ্ট থাকে না, সমস্ত শরীর শিথিল হইয়া যায়। 

এই প্রথমবার। দ্বিতীয়বার হয়—জরুরি টেলিগ্রাম পাইয়া সূর্যকান্ত ফিরিয়া আসিবামাত্র। তবে এবার হাসি দিয়া আরম্ভ হয় না, আরম্ভ হয় কলহে। কার হুকুমে সূর্যকান্ত ফিরিয়া আসিল বলিয়া অমলা কলহ আরম্ভ করে, চিৎকার করিয়া গালাগালি দেয়, মুখে ফেনা তোলে, হাত-পা ছুঁড়িতে ছুঁড়িতে ধনুকের মতো বাঁকিয়া যায়, তারপর দাঁতে দাঁত লাগাইয়া হইয়া যায় শিথিল। 

এবার সকলে ব্যস্ত হয় কম। এমনকি অমলার মুখে জলের ঝাপটা দিতে দিতে তাকে এ বাড়িতে গছানোর জন্য বড় জা তার বাপ-দাদার নিন্দাও করে। সূর্যকান্ত বলে, তিন বছর বয়েস যখন ভাঁড়িয়েছিল, এ রোগের কথা গোপন করবে তা আর বেশি কী। অ্যাদ্দিন হয় নি কেন তাই আশ্চর্য 

কথাগুলো অমলা শুনিতে পায় না। রাত্রে সে তাই চুপিচুপি ব্যাকুলভাবে জিজ্ঞাসা করে, সত্যি বলছ তোমার মন কেমন করত? কেন তবে ফেলে পালিয়ে গেলে আমাকে? পাটনা থেকে কেন ফিরে এলে না? 

কিন্তু জিজ্ঞাসা করিলে কী হইবে? হিস্টিরিয়া ভাবপ্রবণতা নয়, ও একটা রোগ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *