রাজার বউ

রাজার বউ 

কুড়ি বছর বয়স হইতে যামিনী রানী I 

যামিনীর স্বামী ভূপতির রাজ্য কিন্তু একটা বড় জমিদারি মাত্র। বছরে লাখ দেড়েক টাকার বেশি আয় হয় না। ভূপতি রাজা শুধু উপাধির জোরে। যামিনীও সুতরাং অভিধান সম্মত আসল রাজার রানী নয়। উপাধির রানী। রাজার বউ। 

ভূপতিরা মোটে তিন পুরুষের রাজা। 

কলিকাতায় অনেকগুলো অপ্রশস্ত গলি আছে। তাদের একটার মধ্যে মাঝারি সাইজের দোতলা একটি লাল বাড়িতে ভবশঙ্কর রায় নামক এক ব্যক্তি মাসিক আড়াই শত টাকা উপার্জনে বৃহৎ পরিবারের ভরণপোষণ করিয়া বাস করে। সন্ধ্যার পর বন্ধুদের তাসের মজলিশে তার মুখে তার পূর্ব পুরুষদের প্রায় ভারতবর্ষেরই সমান একটি জমিদারির কথা শোনা যায়। গল্পের এই তাল জমিদারির তিলটি ভূপতির বর্তমান সাম্রাজ্য। 

ব্যাপারটা ঘটিয়াছিল ভূপতির প্রপিতামহ মহীপতির আমলে। মহীপতি ছিল ভবশঙ্করের শেষ জমিদার পূর্বপুরুষের প্রধান নায়েব। নিজেকে সে বলিত দেওয়ান কিন্তু কর্তা ডাকিতেন নায়েব মশাই বলিয়া! সেই রাগেই কিনা বলা যায় না তলে তলে কী ষড়যন্ত্রই যে মহীপতি করিল, জমিদারি অর্ধেক গেল বিক্রি হইয়া আর অর্ধেক আসিল তাহার কবলে। ভূপতির পিতামহ যদুপতির আমলে বিক্রীত অর্ধেকটা আবার ফিরিয়া আসিল, জমিদারির প্রচুর শ্রীবৃদ্ধি হইল এবং মরিবার তিন বছর আগে সে হইয়া গেল রাজা যদুপতি রায় চৌধুরি (সরকার), অবন্তীপুর রাজ-এস্টেট। 

তার ছেলে গণপতির শেষ বয়সে একটা সাধ জাগিল যে শুধু রাজা নয়, সে মহারাজ হইবে। বংশানুক্রমে অগ্রগতি প্রয়োজন এমনই একটা কর্তব্যবুদ্ধির প্রেরণা বোধ হয় তাহার আসিয়াছিল। জমিদারি হইতে তখন বেশ আয় হইত। 

মহারাজা হওয়ার ব্যর্থ চেষ্টায় গণপতি এত টাকা ঢালিয়া দিয়া গেল যে তাহাতে জমিদারি কিনিলে ছেলেকে হয়তো সে রাজার উপযুক্ত একটা ছোটখাটো রাজ্য দিয়া যাইতে পারিত। কিন্তু বাড়ানোর পরিবর্তে রাজ্যকে সে ছোটই করিয়া দিয়া গেল। 

তার ফলে মুশকিল হইয়াছে ভূপতির। জমিদারির আয়ে রাজা সাজিয়া থাকা সহজ ব্যাপার নয়। আয়ব্যয়ের সামঞ্জস্য রাখিয়া চলিতে বত্রিশ বছর বয়সেই ভূপতির মাথায় একটু টাক দেখা দিয়াছে। 

যামিনীর বিবাহের সময় টাকটা অবশ্য ছিল গণপতির মাথায়। ভূপতি তখন তেইশ বছরের যুবক। মাথা ভরা নিকষ কালো চুলে সে তখন চাকরের সাহায্যে সযত্নে সিঁথিই কাটিত। 

যামিনী রূপসী। রাজার বউ বলিয়া সে রূপসী নয়, রূপসী বলিয়া রাজার বউ। 

সকল রূপের মতো যামিনীর রূপও ঐতিহাসিক। রূপের ইতিহাস ব্যাপারটা এই রকম। চারপুরুষ আগে যে দরিদ্র বংশের প্রত্যেকটি নরনারীর গায়ের রঙ ছিল সাঁওতালদের মতো কালো এবং চেহারা ছিল চীনাদের মতো কুৎসিত, চারপুরুষ ধরিয়া সে বংশের সিন্দুক যদি টাকায় ভরা থাকে তবে দেখা যায় চার পুরুষেই বংশের কালিমা নিঃশেষে মুছিয়া গিয়া রূপ ও শ্রীর স্তূপ জমিয়া গিয়াছে। যামিনী রাজার মেয়ে নয় কিন্তু বনেদি ঘরের মেয়ে, অনেক পুরুষ ধরিয়া তাদের লোহার সিন্দুকে অনেক টাকা। অনেক পুরুষের জমা করা রূপ তাই যামিনীকে রূপকথার রাজকুমারীর বাস্তব প্রতিনিধির মতো সুন্দরী করিয়াছে। পার্থিব তিলোত্তমার মতো বহুকাল ধরিয়া বহু বিভিন্ন রূপসীর রূপ তার মধ্যে সঞ্চিত হইয়াছে। তার বঙ্কিম ভ্রু হইতে পায়ের গোলাপি নখর পর্যন্ত বিচিত্র রূপরেখা ও বিমিশ্র বর্ণ-লালিত্যের সমাবেশ। 

বিবাহের পূর্বে রানী হওয়ার আশীর্বাদ যামিনী অনেক শুনিয়াছিল। কিন্তু রানিত্ব মানুষের ঠিক কী ধরনের অস্তিত্ব সে বিষয়ে কোনো জ্ঞান না থাকায় রানী হওয়ার স্বপ্নও সে দেখিত না, একদিন যে তাকে সত্যসত্যই রানী হইতে হইবে এ ধারণাও রাখিত না। রাজবধূ হইয়া প্রথম বছরটা তার তাই একটু বিহ্বলতা ও ভয়ের মধ্যে কাটিয়া গিয়াছিল। 

ধরনধারণ চালচলন কিছুই তার শিখিতে বাকি ছিল না। বনেদি মুনশিয়ানার সঙ্গে জটিল জীবনকে ঠিকমতো বুনিয়া চলিবার শিক্ষা তাহার জন্মগত। কিন্তু হাজার বনেদি ঘরের মেয়ে হোক, রাজরাজড়ার বাড়িতে ঠিক রক্তমাংসের মানুষই থাকে কি না এ বিষয়ে তার মনে একটা সংশয় বরাবর থাকিয়া গিয়াছিল। তার কুমারী জীবনের রাজারা সকলেই ছিল উপকথা রামায়ণ মহাভারত ও ইতিহাসের অন্তর্গত। অবন্তীপুর রাজ এস্টেটের রাজপুত্রের সঙ্গে তার বিবাহের প্রস্তাব চলিতেছে এ কথা যেদিন সে শুনিয়াছিল সেদিন তার কল্পনায় ভাসিয়া আসিয়াছিল রহস্যস্তব্ধ মর্মর প্রাসাদ, ময়ূর ও হরিণভরা পুষ্পবন, চামর-সেবিত স্বর্ণ সিংহাসন, এবং একদল বিচিত্র উজ্জ্বল বেশধারী গম্ভীর সমুন্নত নরনারী। 

আর কোমরে তরোয়াল-ঝোলানো উষ্ণীষধারী অশ্বারোহী একজন রাজকুমার! 

অবন্তীপুরে পা দিয়া এক কল্পনাকে সে আবার তাহার মনের কল্পলোকে গুছাইয়া তুলিয়া রাখিল বটে, অল্প অল্প ভয় তবু তার মনে রহিয়া গেল। বউরানীর পদমর্যাদা কী, তাকে কী বলিতে ও কী করিতে হয়, কোথায় সরলতার সীমা টানিয়া তাকে কতখানি অভিনয় করিয়া চলিতে হয়—এসব জানা না থাকায় প্রথম বছরটা তার দুর্ভাবনার মধ্যে কাটিয়া গিয়াছিল। 

স্বামীকে সে বারবার জিজ্ঞাসা করিত,— দোষ করছি না তো? ভুল হচ্ছে না তো আমার? 

ভূপতি বলিত—না গো না, দোষও তোমার হচ্ছে না ভুলও তুমি করছ না। সবাই শতমুখে তোমার প্রশংসা করছে। 

ত্রুটি হলে বোলো। শুধরে দিয়ো। শিখিয়ে নিয়ো। 

তোমার কিছুই শেখাবার নেই, মিনি। 

যামিনী ভাবিত, তাই হবে। এ কথা হয়তো মিথ্যা নয়; আমি অনর্থক বিচলিত হই, ভাবি। রাত্রিটা সে বেশ আত্মপ্রসাদ উপভোগ করিয়া কাটাইয়া দিত। কিন্তু পরদিন চারদিকে জীবনের অরাজক সমারোহে আবার সে অস্বস্তি বোধ করিতে আরম্ভ করিত। 

তার এই অস্বস্তিকর ভীরুতার কিন্তু কোনোরকম কটু অভিব্যক্তি ছিল না। তার প্রকৃতির একটি অপরূপ নম্রতার মতোই ইহা প্রকাশ পাইত। পাড়ার এমনই একটি অ-বনেদি মেয়েদের আবেষ্টনীর মধ্যে যামিনীকে মানুষ হইতে হইয়াছিল যে নিজের অজ্ঞাতেই তার মধ্যে একটা অহংকার প্রশ্রয় পাইয়াছিল। না বুঝিয়া সে তার চেয়ে ছোটঘরের মেয়েদের মনে ব্যথা দিয়া বসিত। তাদের অভিমান আন্দাজ করিতে পারিলে মনে মনে হাসিয়া ভাবিত, ছোট মনে ছোট মানেটাই এসেছে আগে। আমি হলে এই নিয়ে রাগ করে নিজেকে ছোট করে ফেলতে লজ্জায় মরে যেতাম। তার কথার ব্যবহারে এই অহংকারটুকু বাড়ির লোক ছাড়া আর সকলেরই চোখে পড়িত। অবন্তীপুরে আসিয়া নববধূসুলভ লজ্জা ও সংকোচের তলে এটুকু চাপা পড়িয়া গিয়াছিল সত্য, কিন্তু গর্ব লয় পাইলেই স্বভাবের একটি মসৃণ ও মার্জিত মাধুর্য মানুষের সঞ্চিত হইয়া যায় না। কেবল এই সংস্কারটুকু হইলে তার রূপে সকলে অবাক হইয়া যাইত, তার গুণের প্রশংসা করিত এবং তার প্রাপ্য ভালবাসাও সে পাইত। তবে যেরকম পাইয়াছে সেরকম পাইত না। কিন্তু আপনার মৃদু ভীরুতায় সে এমনই মিষ্টি হইয়া উঠিল যে বিনা চেষ্টাতেই সে সকলের চিত্তকে সাধারণ জয় করার একস্তর ঊর্ধ্বে যে জয় করা আছে তাহাই করিয়া ফেলিল। তাদের চেয়ে সামান্য একটু বড় বাড়িতে তাদের চেয়ে সামান্য একটু বেশি বড়লোক পরিবারে আসিয়া শুধু একটি রাজা শব্দকে সমীহ করিয়াই নিজের জন্য পরের বুকে অনির্বচনীয় প্রীতি জাগাইবার দুর্লভ রমণীয়তা যামিনীর অভ্যাস হইয়া গেল। 

বিজিত চিত্তগুলোর মধ্যে সর্বাপেক্ষা অপরাজেয় ছিল গণপতির স্ত্রী নগেন্দ্রবালার চিত্ত। সে ছিল মোটা আর ঝাঁজালো, কুইন এলিজাবেথের মতো দুর্ধর্ষ। স্বামী পুত্রকে বশে রাখিতে সে ভালবাসিত। দাসদাসী ও আশ্রিত পরিজনের প্রতি শাসনের তাহার অন্ত ছিল না। নিজেকে কেন্দ্র করিয়া সমস্ত সংসারটাকে পাক খাওয়াইতে না পারিলে তাহার সুখ হইত না। অধিকারের সীমার মধ্যে নিজেকে সে এত বড় করিয়া রাখিত যে তার পায়ে তেল দিয়া দিয়া কোনোরকমে তাহার অনুমতি সংগ্রহ করিতে পারিলে বাড়ির যে কেহ যে কোনো অন্যায় করিতে পারিত। 

বউয়ের রূপ দেখিয়া নগেন্দ্রবালা প্রথমে একটু চটিয়াছিল। তাহার এই ঈর্ষাতুর রাগ প্রথম দিকে কিছু কিছু প্রকাশ করিতেও তাহার বাকি থাকে নাই। গোল বাধিত দেবপূজা উপলক্ষে। চিরদিন সকলের উপর প্রভুত্ব করিয়া একটি বৃহত্তর মহত্তর শক্তির কাছে মাথা নত করার জন্য নগেন্দ্রবালার নারী-হৃদয়ের চিরন্তন দুর্বলতা অতৃপ্ত থাকিয়া গিয়াছিল। বেশি বয়সে গৃহদেবতার প্রতি ভক্তি তার তাই উথলিয়া উঠিয়াছিল। দেবতার ভোগ ও আরতি তাহার জীবনে একটা মহা সমারোহের ব্যাপারে দাঁড়াইয়া গিয়াছিল। বাড়ির বউকেও সে এইদিকে টানিতে আরম্ভ করিয়া দিয়াছিল। যামিনীর ইহাতে মুশকিলের সীমা থাকে নাই। তার বাপের বাড়িতেও দোল দুর্গোৎসব হয়, কিন্তু নিত্যপূজার ব্যবস্থা সেখানে নাই। পূজাপার্বণের উৎসবের দিকটার সঙ্গেই তাহার পরিচয় ছিল বেশি, ঠাকুরপূজায় ফুল বেলপাতা কোশাকুশি আর নৈবেদ্য লাগে এবং কাঁসর ঘণ্টা বাজাইয়া মন্ত্র পড়িতে হয় এর বেশি জ্ঞান তাহার ছিল না। কিন্তু নগেন্দ্রবালার দাবি নিষ্করুণ। এ বাড়ির যে বধূ, ভবিষ্যতের রাজরানী, ঠাকুরপূজা যদি সে না শিখিয়া থাকে আর সব শিক্ষাই জীবনে তার ব্যর্থ হইয়া গিয়াছে। না, অবন্তীপুরের রাজপরিবারে নাস্তিকতা চলিবে না। 

সে কী বউমা, সে কী কথা? ঠাকুরসেবা না শিখলে মেয়েমানুষ স্বামীসেবার কী জানবে? আসনের কোনদিকে কোশাকুশি রাখতে হয় তাও কি তুমি শেখো নি বাছা? আর আতপচালের নৈবিদ্যি কি অমনি চ্যাপটা করে করতে হয়? 

নগেন্দ্রবালা এমনই করিয়া বলিত, আঘাত ও লজ্জা দিয়া। 

সে আরো বলিত, না, ভাড়া করা লোকের কাজ এসব নয়। দেবতার কাছে বড়লোকি চলবে না। পরকে দিয়ে স্বামীসেবা হয় না, ঠাকুরের সেবা হবে পরকে দিয়ে! সব করতে হবে নিজেকে। মেঝে ধোয়ার কাজ পর্যন্ত। 

যামিনীর হইত ভয়, চোখে আসিত জল। নগেন্দ্ৰবালা পাইত তৃপ্তি। 

কিন্তু রূপেগুণে যে বড়, তার নিরীহ আনুগত্য যদি আন্তরিক হয়, বকিয়া যদি তার চোখে জল আনিয়া দেওয়া যায়, নিজস্ব একটা দামি সম্পত্তির মতো ক্রমে ক্রমে তার প্রতি মায়া জন্মে। দেবসেবায় অনভিজ্ঞতা নগেন্দ্রবালার কাছে গুরুতর অপরাধ। কিন্তু নিজেকে শাশুড়ির ভীরু ও উৎসুক শিষ্যা করিয়া নিজের এ অপরাধকেও যামিনী লঘু করিয়া দিল। 

তাহাকে বকিবার ক্ষমতা নগেন্দ্রবালার আর রহিল না। বউকে সে ভালবাসিয়া ফেলিল। 

.

স্বামীর সঙ্গে যামিনীর যে সম্পর্কটি স্থাপিত হইল তাহা অতুলনীয়। যামিনীকে ভূপতি তাহার সুস্থ মনের নিবিড় কামনা দিয়া জড়াইয়া ধরিল। নারীকে ভালবাসিবার জন্য মানুষের দেহমনে যতগুলো ধর্ম আছে তার সবগুলো দিয়া অপ্রমেয় আবেগের সঙ্গে যামিনীকে সে ভালবাসিল। সে পড়া ছাড়িয়া দিল। মাসে এক বোতল মাত্র শ্যামপেন খাওয়াও সে ছাড়িয়াছে দেখিয়া গণপতি কিছু বলিল না। নগেন্দ্রবালা একটু ঈর্ষা বোধ করিয়াছিল, কিন্তু সেও বউয়ের জন্য ছেলের পড়া ছাড়িয়া দেওয়ায় বাধা দিল না। ভাবিল, তাই হোক, বউ নিয়ে মেতে এ বয়সটা ভালোয় ভালোয় পার হয়ে যাক। 

যামিনী প্রথম যেবার বেশিদিনের জন্য অবন্তীপুর আসিল তখন শরৎকাল। শুক্লপক্ষের কয়েকটা রাত্রিতে আকাশের ওই পুরোনো চাঁদটির কাছ হইতে এমন জ্যোৎস্নাই পৃথিবীতে ভাসিয়া আসে যে দেখিলে মানুষের মন কেমন করে। এমনই জ্যোৎস্না উঠিলে অনেক রাত্রে নিদ্রিত রাজপুরীর নিশীথ রহস্যকে অতিক্রম করিয়া ভূপতি আর যামিনী উঠিত ছাদে। আলিসা ঘেঁষিয়া দাঁড়াইয়া তাহারা পৃথিবীকে দেখিত। এদিকে আধাশহর আধাগ্রামখানি নিঃসাড়ে ঘুমাইয়া আছে। হয়তো শুধুই দেখা যায় একটি আধভেজানো জানালায় নিঃসঙ্গ একটি আলো। যামিনী ভাবিত, ওখানে হয়তো তাদেরই মতো ভালবাসার জাগরণ এখনো আলো জ্বালিয়া রাখিয়াছে। ওদিকে দিঘির জলে থাকিত সোনালি রঙের চমকিত চাঞ্চল্য। দিঘির ওই তীর দিয়া দু পাশে গাছের সারি বসানো নির্জন পথটি কোথায় কতদূরে চলিয়া গিয়াছে। 

যামিনী স্বামীর বুক ঘেঁষিয়া আসিত। ওই স্তব্ধ পথটি ধরিয়া পৃথিবী ছাড়িয়া গ্রহতারার কোনো একটা জগতে চলিয়া যাওয়া যায় এমনই একটা কথা ভাবিয়াই সে বোধ হয় ভূপতির দুটি হাত দিয়া নিজেকে বাঁধিয়া ফেলিত। 

বলিত—পৃথিবী কতকাল আগে সৃষ্টি হয়েছিল বল না। 

পৃথিবী কতকাল ধরিয়া এমন সুন্দর এমন অপার্থিব হইয়া আছে এই ছিল যামিনীর জিজ্ঞাসা। এমনই স্তিমিত জ্যোতির্ময়ী রাত্রে ভূপতির উদাত্ত প্রেমকে অনুভব করিতে করিতে সে প্রায়ই এই ধরনের প্রশ্ন করিত। ভূপতি ইহার জবাব দিত তাহার কানে কানে। বলিত—অনেক দিন আগে গো, অনেক দিন আগে। কোটি বছর আগে। প্রথমে সব অন্ধকার ছিল, তারপর ভগবান বললেন, আলো হোক, অমনই আলো হল। তিনি তারপর বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি করলেন। শুনিয়া নিজেকে যামিনীর এত বেশি ছেলেমানুষ মনে হইত যে সে অসহায়ের মতো প্রশ্ন করিত, আচ্ছা সত্যি ভগবান আছেন? 

বিকালে চাকর গালিচা রাখিয়া গিয়াছে। বিছাইয়া ভূপতি তাহাতে বসিত তাহার কোলে মাথা রাখিয়া শুইত যামিনী। যামিনীর মুখে পড়িত জ্যোৎস্না আর ভূপতির মুখের পিছনে থাকিত আকাশের পটভূমিকা। ব্যাকুল অন্বেষণের দৃষ্টিতে তাহারা পরস্পরের মুখের দিকে চাহিয়া থাকিত। পরস্পরের মুখের সঙ্গে তাহাদের পরিচয়ের যেন শেষ নাই, কোনো দিন এ রহস্য তারা যেন বুঝিবে না। যামিনী পাতা কাটিয়া চুল বাঁধিত, ভূপতি চুল সরাইয়া তাহার কপোলে আবৃত অংশটুকু আবিষ্কার করিত। যামিনী চিবুক ধরিয়া স্বামীর মুখ উঁচু করিয়া সে মুখে ফেলিত জ্যোৎস্না। যামিনীর ঘুম আসিলে তাহার অর্ধনিমীলিত চোখের গাঢ় অতল রহস্যকে ভূপতি চুম্বন করিত, যামিনী তাহার একখানি হাত চাপিয়া ধরিত বুকে! 

আঠার বছরের কচি মেয়ে সে, সে বলিত—জান আমি এখন মরে যেতে পারি। হালকা হাসি তামাশা তাদের বিশেষ ছিল না। তারা খেলা করিত কম। অতর্কিতে যামিনীর খোঁপা যে ভূপতি কখনো খুলিয়া দিত না এমন নয়, নিদ্রিত স্বামীর কপালে বড় করিয়া সিন্দূরের ফোঁটাও যে যামিনী আঁকিত না তাও নয়, কিন্তু ভূপতির টেরি নষ্ট না করিয়া খোঁপা খোলার প্রতিশোধ যামিনীর লওয়া হইত না। ঘুম ভাঙিয়া যামিনীর আঁচলে কপালের সিন্দূর ভূপতির মোছা হইত না। তাদের সহিত অকালমরণ ঘটিত। তারা বুঝিতেও পারিত না কখন তারা গভীর অলৌকিক ভাবাবেগে আচ্ছন্ন অভিভূত হইয়া গিয়াছে। যে বয়সে প্রেম বহির্বস্তুকেই আশ্রয় করিয়া থাকে বেশি, প্রেমকে লইয়া দু জন মানুষ যে বয়সে শিশুর মতো অর্থহীন খেলা খেলে, ধরা দেওয়ার চেয়ে পলাইয়া বেড়ানোই যখন বেশি মজার ব্যাপার, পূর্ণপরিণত বয়স্ক মানুষের মতো তখন তারা সাগরের মতো অতল উদ্‌বেলিত ভালবাসার বিপজ্জনক বস্তুর অভিনয় করিয়া চলিত। 

বিপজ্জনক এই জন্য। মনের পরিণতি তাদের কারো হয় নাই। মনেপ্রাণে ছেলেমানুষ ছাড়া তারা আর কিছুই ছিল না। যে অভিজ্ঞতার স্তূপ সারের মতো মানুষের মনকে উর্বরা করে, বৃহৎ আবেগকে ধারণক্ষম করে, সে অভিজ্ঞতা তাদের জোটে নাই। বেদনাদায়ক মর্মান্তিক প্রেমের আতিশয্যকে সহ্য করিবার জন্য মনের শক্ত হওয়া দরকার, শক্তি থাকা দরকার। এদের মন সেভাবে শক্ত হইবার সুযোগও পায় নাই, সেরকম শক্তিও তাদের ছিল না। অথচ তাদের একজন রাজার ছেলে আর একজন বনেদি সম্ভ্রান্ত ঘরের মেয়ে। ওই বয়সেই তারা গম্ভীর হইতে জানিত, জীবনকে একটা গুরুতর দায়িত্বপূর্ণ ব্যাপার বলিয়া মনে করিত, পাকা সাজিতে পারিত। 

খোলা ছাদে জ্যোৎস্নালোকে তাদের প্রেম যত অলৌলিক হোক সেটাও বয়সের নয়। কিন্তু তাদের উপায় ছিল না! জীবন তাদের হালকা হইতে শেখায় নাই, অথচ জীবনের কোনো গুরুভার আনন্দ ও বেদনাকে বহন করিবার উপযুক্তও করে নাই। পরস্পরের মুখে যখন তাদের হাসি ফুটাইয়া রাখা উচিত ছিল তখন তারা তাই স্তব্ধ বিস্ময়ে পরস্পরের ওষ্ঠে অনুচ্চারিত ভাষা শুনিত, যখন তাদের লুকোচুরি খেলার কথা তারা তখন আত্মহারা পুলকবেদনায় পরস্পরের আরো কাছে ঘেঁষিয়া আসিত। 

দুটি লিরিক কবিতা পরস্পরের আশ্রয়ে হইয়া উঠিত মহাকাব্য। জীবনকাব্যের ধরাবাঁধা ছন্দ ও নিয়মাধীন কাব্যরূপের হিসাবে যাহা অসঙ্গতি, যাহা অনিয়ম। 

.

যামিনীর বিবাহের তিন বছর পরে অবন্তীপুর রাজবাড়িতে দুটি বিশেষ ঘটনা ঘটিল, গণপতির মৃত্যু ও ভূপতির পুত্রলাভ। এক মাসের মধ্যে নগেন্দ্রবালা হইল রাজমাতা, ভূপতি হইল রাজা আর যামিনী হইল রানী ও ছেলের মা।

রানিত্ব যামিনী এমনিই পাইল, কিন্তু ছেলে তত সহজে মিলিল না। ব্যাপার এমনই দাঁড়াইয়াছিল যে তার এবং তার ছেলের বাঁচিবার কথা নয়। কলিকাতার তিন জন বড় বড় ডাক্তার কী এক অদ্ভুত উপায়ে তাদের দুজনকে বাঁচাইয়া দিলেন। কিন্তু সেই সঙ্গে কানের কাছে এ কথাও বলিয়া গেলেন যে এই প্রথম এবং এই শেষ। যামিনীর আর ছেলেমেয়ে হইবে না। 

না হোক রাজবংশটি রক্ষা পাইয়াছে। ছেলেটা শেষ পর্যন্ত বাঁচিয়া থাকিলে ভূপতির আর একবার বিবাহ না করিলেও চলিবে। 

বংশরক্ষা পাওয়ার সান্ত্বনাটি নগেন্দ্রবালার এবং অন্যান্য সকলের, ভূপতির আবার বিবাহ করিতে হইবে না এ আশ্বাস যামিনীর নিজস্ব, আর কারো নয়। 

ভূপতির মনোভাব সঠিক জানিবার উপায় ছিল না। রাজা হওয়ার আগেই সে একটু একটু করিয়া বদলাইয়া যাইতেছিল। রাজা হইয়া সে আরো বদলাইয়া গেল। 

না, শ্যামপেন অথবা নারী নয়। রাজা হইলেই যে ওসব আপদ আসিয়া জুটিবে এমন কোনো কথা নাই। ভূপতির পরিবর্তন কাব্যের প্রতিশোধ। 

কেবল অন্তরের আশ্রয় করিয়া মানুষ বাঁচিতে পারে না। যামিনীর সঙ্গে সীমাত্তোলিত ভালবাসার খেলা খেলিতে খেলিতে ভূপতি শান্ত হইয়া পড়িয়াছিল। সে বাহিরে আশ্রয় খুঁজিতেছিল। আশ্রয়ের অভাবও ছিল না তার, যামিনীর জন্য এতদিন বরং সে ইহাকে চলিতেছিল এড়াইয়া। যামিনীর মতো বউ পাইলে হৃদয়ের অনেক প্রয়োজন মিটিয়া যায়, কিন্তু জীবনের দাবি থামে না। ভূপতির কাছে সংসারের দাবি ছিল বিপুল। তার জন্ম মুহূর্তে রাজবাড়ির শতাধিক নরনারী ও দেড় লাখ টাকা আয়ের জমিদারির ভবিষ্যৎ ভার তাহাকেই বাহক বলিয়া দাবি করিয়াছিল। শৈশব হইতে জীবন তাহার বাহিরের সমারোহে ভারাক্রান্ত। তার কাব্যের কোনো দিন শেষ থাকে নাই। 

সন্তানের আবির্ভাবে যামিনী ও তাহার মধ্যে যে সাময়িক ছেদ পড়িল সেই সুযোগে ভূপতি তার নিজস্ব জগৎটি তৈরি করিয়া লইল। গণপতির মৃত্যুতে জমিদারির সমস্ত ভার লইতে হওয়ায় অপরিহার্য কর্তব্যের খাতিরে এই জগৎ তার কায়েমি হইয়া গেল। যামিনীর কাছে কোনো কৈফিয়ত দেওয়ারও প্রয়োজন রহিল না। 

অনাবশ্যক উৎসাহের সঙ্গে সে তার জমিদারি দেখিয়া বেড়াইতে লাগিল। আজ এই বন্ধুর সঙ্গে শিকারে গেল, কাল অমুক গ্রামে বসাইল মেলা, পরশু এক বড় রাজকর্মচারীর সম্মানে মস্ত একটা ভোজ দিল। গণপতির সে পরের যুগের মানুষ, ঘরে-বাহিরে অনেকগুলো সংস্কার সাধনেও তার খুব উৎসাহ দেখা গেল। 

মরিতে মরিতে বাঁচিয়া ওঠার ধাক্কায় আর এক ছেলে পাওয়ার আহ্লাদে যামিনী প্রথমটা বেশ ভুলিয়া রহিল। ভূপতির তখন কিছুকালের জন্য—তার প্রয়োজনও ছিল না, সুতরাং সে অভাবও বোধ করিল না। কাঁচা বুকে পাকা ভালবাসা পুষিয়া রাখিতে রাখিতে সেও হাঁপাইয়া উঠিয়াছিল, সেও অন্য আশ্রয় খুঁজিতেছিল। 

কিন্তু বেশি দিনের জন্য নয়। ছয় মাসের মধ্যেই তার শরীর সুস্থ হইয়া উঠিল। মাতৃত্ব লাভের অভিনবত্বও আসিল কমিয়া। ছেলে একরকম সেই আঁতুর হইতেই তার ছিল না। সে রাজার ছেলে রাজপুত্র। তার সুস্থ ও সবল দুধমা ও ঘুমপাড়ানো মাসিপিসি ভাড়া করা হইয়াছে। শখ করিয়া ছেলেকে কখনো যদি যামিনী কোলে নেয়, সেটা বাহুল্য মাত্র। প্রয়োজন নয়। 

.

তা হোক সে জন্য যামিনীর বিশেষ কোনো আপসোস ছিল না। সে কলম-পেষা কেরানির বউ নয় যে ছেলে মানুষ করার ঝামেলা তাহাকে সহিতে হইবে এবং সেই বিরক্তি দিয়াই আপনার স্বর্গ সৃষ্টি করিয়া লইবে। বড়লোকের ছেলেরা এমনিভাবেই মানুষ হয়। এ প্রথাকে যামিনী অনুমোদন করে। তা ছাড়া ছেলেকে লইয়া সারা দিন মাতিয়া থাকিলে তার যদি চলিত, এ যদি তার কাম্য হইত যে সন্তানের পিছনে নিজেকে সে ঢালিয়া দিবে, বাধা দিবার কেহ ছিল না। নগেন্দ্রবালা হয়তো একটু খুঁতখুঁত করিত, ভূপতি হয়তো একটু বিরক্ত হইত, কিন্তু বাঁচিয়া থাকিবার উপায়ের মতো ছেলেকে আঁকড়াইয়া ধরিবার প্রয়োজন হইলে এই সামান্য বাধা যামিনীকে ঠেকাইতে পারিত না। ছেলেকে সে অমন করিয়া চাহিল না। চাহিল ভূপতিকে। 

তার দিনগুলোকে একেবারে অচল করিয়া দিবার মতো দূরেই যে ভূপতি বসিয়া গিয়াছে এটা বুঝিতে যামিনীর সময় লাগিল। কিন্তু বুঝিল সে ভালো করিয়াই। কারণ যে অসহ্য প্রেমকে এড়াইয়া ভূপতি কাজ আর অকাজ দিয়া জীবনটা ভরিয়া রাখিতে পারিল, সেই প্রেম ছাড়া যামিনীর আর কোনো অবলম্বন ছিল না। 

ব্যাকুল উন্মাদনাময় ভালবাসা বহিয়া বহিয়া তার হৃদয় শ্রান্ত অবসন্ন হইয়া যাক, ভূপতির সান্নিধ্য সহিতে না পারিয়া মাঝে মাঝে তার ছুটিয়া পালাইতে ইচ্ছা হোক, কবিতা লিখিবার পর কবি যেমন মরিয়া যায় রাত্রি প্রভাতের পর সারা দিন সে তেমনিভাবে মরিয়া থাকে, ভূপতিকে সে চোখের আড়াল করিতে পারিবে না। সে নারী, সে বন্দিনী, তার মুক্তি নাই; তার কামনার বিবর্তন চিরদিনের জন্য অসম্ভব হইয়া গিয়াছে। 

সে একবার ভালবাসিয়াছে, প্রাণ বাহির হইয়া যাওয়া পর্যন্ত মুহূর্তের বিরাম না দিয়া সে ভালবাসিবে। 

অথচ সাধারণ হিসাবে ধরিলে ভূপতি যে তাকে বিশেষ অবহেলা করিতে আরম্ভ করিয়াছিল তা বলা যায় না। প্রাথমিক মিলনোচ্ছ্বাস কমিয়া আসিলে যে কোনো সুখী দম্পতির পরস্পরের প্রতি যে পরিমাণ স্বাভাবিক উদাসীনতা আসে, ভূপতির তার বেশি আসে নাই। বাড়ি থাকিলে এবং কাজ না থাকিলে যামিনীর সঙ্গই সে খুঁজিয়া লইত। বিদায় নেওয়ার সময় যামিনী তাকে আরো একটু থাকিতে বলিলে খুশি হইয়াই সে আর একটু তার কাছে থাকিত। যামিনী অনুরোধ করিলে মাঝে মাঝে প্রয়োজনীয় কর্তব্যকে অবহেলা করিতেও তাহার বাধিত না। বিনিদ্র যামিনীর সঙ্গে সমানে সে রাত জাগিত না বটে, কিন্তু রাত্রি দশটার মধ্যেই ঘরে আসিত, যামিনীর সঙ্গে গল্প করিত, তাকে আদর করিত, ভালবাসিত। শান্তিপ্রিয় সুখী দম্পতির শান্ত স্বামীর চেয়ে হয়তো এসব সে বেশিই করিত। 

কিন্তু গোড়াতে তাদের কিনা সুখী দম্পতির সম্পর্ক ছিল না, ভূপতিকে তাই যামিনীর আগাগোড়া স্তিমিত, অন্যমনস্ক, সুদূর মনে হইত। তার বুক করিত জ্বালা। তার চোখে আসিত জল। স্বামীর নিশ্বাসের শব্দটি কান পাতিয়া শুনিয়া শিহরিয়া সে নিজের মৃত্যু কামনা করিত। 

এবং এমনই অপরিবর্তনীয় এই পৃথিবী আর আকাশের গ্রহতারার বিবর্তন যে প্রতি পূর্ণিমা ও পূর্ণিমার আগে-পিছে কতগুলো রাত্রি জ্যোৎস্নায় আলো হইয়া থাকিত। অবন্তীপুর রাজ-এস্টেটের রাজার বউ তখন বিছানায় উঠিয়া বসিত। ব্যাকুল হইয়া ভাবিত, আমার সবই আছে, কিন্তু কী নাই? 

স্তরে স্তরে সাজানো তার জীবন, তার রাজ্য আছে, রাজা আছে, প্রেমিক আছে, ছেলে আছে, শতাধিক হৃদয়ের প্রীতি আছে, অতীত ভবিষ্যৎ সবই আছে, পরকাল পর্যন্ত। তবু কী চায় সে? স্বামীর ঘুম ভাঙাইয়া একবার ছাদে যাইতে চায়? শুধু এই কামনা তার? এইটুকু পাইলেই সে পরিতৃপ্ত হইয়া যাইবে। 

যামিনী স্বামীর গায়ে হাত রাখিত। কিন্তু তাকে ঠেলিয়া তুলিতে পারিত না। তার কান্না আসিত। তার সীমাহীন দুঃসহ প্রেমের মতো ক্রন্দনবেগে সে কাঁপিয়া কাঁপিয়া উঠিত। 

সকালে বলিত—কাল এমন সুন্দর জ্যোৎস্না উঠেছিল। 

ভূপতি বলিত—দেখেছি। রাত্রে একবার উঠেছিলাম। 

যামিনী তখন হাই তুলিয়া বলিত—জানো গো, কাল রাতে আমার ভালো ঘুম হয় নি। 

ভূপতি বলিত—আমায় ডাকলে না কেন? গল্প করে তোমায় ঘুম পাড়িয়ে দিতাম। 

 গল্প? হায় ভগবান, রাত জাগিয়া গল্প! যামিনীর মনের ভাবটা হইত এই রকম।

সংসারে রাজার বউকে কম কর্তব্য পালন করিতে হয় না। যামিনীরও অনেক কাজ ছিল। গণপতির মৃত্যুর পর নগেন্দ্রবালা অল্পে অল্পে রানিত্বের বোঝা বউয়ের কাঁধে নামাইয়া দিতেছিল। ইহলোকে কর্তৃত্ব করিবার সাধ বোধ হয় তার মিটিয়াছিল, এবার পরলোককে আয়ত্ত না করিলেই নয়। এই চেষ্টা করিতে করিতে বছর দুই পরে সে ওইখানে চলিয়া গেল। যামিনীর কাজের আর অন্ত রহিল না। 

বিচিত্র সে কাজ। ঠাকুরের নৈবেদ্য সাজানো ছাড়া নিজের হাতে কিছুই করিবার নাই, চারদিকে শুধু নজর রাখা, হুকুম দেওয়া, আর এর নালিশ, ওর তোষামোদ, তার প্রার্থনা শোনা। রাজ সিংহাসনের যেমন একদিনের জন্যও রাজহীন হওয়া চলে না, রাজ-অন্তঃপুরেরও তেমনই অহরহ কেন্দ্র চাই। যামিনীর কিছুই ভালো লাগিত না, কিন্তু সে ছিল নিরুপায়। তার ইচ্ছা-অনিচ্ছার দিকে চাহিয়া নয়, নিজের প্রয়োজনেই রাজ-সংসার তাকে ঘিরিয়া পাক খাইতে লাগিল। 

তারপর ছিল প্রসাধন। দুজন দাসীর সাহায্যেও প্রত্যেক দিন প্রসাধনে যামিনীর অনেক সময় লাগিয়া যাইত। গন্ধতেলে খোঁপা বাঁধিলেই শুধু চলিত না, চুলে তেল বেশি না পড়ে আবার কমও না হয় এটা খেয়াল রাখিয়া একটু একটু করিয়া অনেকক্ষণ ধরিয়া তেল মাখিতে হইত। চোখে অদৃশ্য কাজল পরানোর কাজটা এমন সূক্ষ্ম যে বিস্তারিত ভূমিকা না করিয়া দাসী তুলি তুলিতে সাহস পাইত না। দুধের সর-ভিজানো জলে চার-পাঁচ বার মুখ ভিজাইতে, বাহুতে চন্দন মাখাইয়া মুছিয়া তুলিতে, পায়ে আলতা পরিতে এবং এমনই সব আরো অনেক কিছু করিতে আকাশের কত উঁচুর সূর্যটি গাছের শিয়রে নামিয়া যাইত! 

এত পদ্ধতি নিয়ম, অভ্যাসও যামিনীর ছিল। কিন্তু এখন তার বিরক্তির সীমা থাকিত না। ভিতরে ভিতরে মানুষ যখন জ্বলিয়া পুড়িয়া মরিয়া যাইতেছে, বাহিরে তখন এত ঢং কেন? 

খোকা এখন একটু বড় হইয়াছিল। দুধমা ও মাসিপিসির ব্যূহ অনেকটা ভাঙিয়া গিয়াছিল। যামিনীর ছেলে আবার ক্রমে ক্রমে সরিয়া আসিতেছিল যামিনীরই কাছে। তার হাসিকান্নার মাকে তার প্রয়োজন হইতেছিল। রাশি রাশি পুতুল লইয়া একা সে খেলিবে না, যামিনীর যোগ দেওয়া চাই। খেলায় শান্তি আসিলে যামিনীর কোলে বসিয়াই সে গম্ভীর মুখে উদাসীন চোখে ছড়ানো পুতুলগুলোর দিকে চাহিয়া ঢুলিতে ঢুলিতে ঘুমাইয়া পড়িবে। মা চাহিয়া না দেখিলে বাগানে সে ছুটাছুটি করিবে না। মার পিঠ ছাড়া আর কারো পিঠে সে আচমকা ঝাঁপাইয়া পড়িবে না, মা তোষামোদ না করিলে দুধ তাকে কেহ খাওয়াইতে পারিবে না। দুপুর রাতে ঘুম ভাঙিয়া কাঁদিতে আরম্ভ করিলে যামিনী উঠিয়া তার কাছে না গেলে কান্না তার থামিবে না। শিশুর চেয়ে স্বার্থপর জীবন জগতে নাই। ওদের মানুষের মূল্য যাচাই নির্ভুল। এই বৃহৎ সংসারে কোন মানুষটার দাম সকলের চেয়ে বেশি কারো বলিয়া দিবার অপেক্ষা না রাখিয়া খোকা নিজেই তাহা স্থির করিয়া লইয়াছিল। 

যমিনীর মন্দ লাগিত না। আরো বেশি ভালো যাতে লাগে সেজন্য প্রাণপণ চেষ্টাও সে করিত। কিন্তু অনেক দেরি হইয়া গিয়াছে। স্বামীর উত্তাল ভালবাসার জন্য তীব্র অপূরণীয় ক্ষুধা তার অস্তিত্বের স্বতন্ত্র, বিচ্ছিন্ন ধর্মে পরিণত হইয়া গিয়াছে। এখন আর তাকে বদলানো যায় না, বিকৃত করা চলে না। স্বামীর অনায়ত্ত স্পর্শকে শুধু কল্পনায় অনুভব করিয়া তার চলিতে পারে কিন্তু তার বদলে খোকাকে বুকে চাপিয়া সাধ মেটানো যায় না। 

কল্পনাকে যামিনী বিস্ময়কর পটুতার সঙ্গে ব্যবহার করিতে আরম্ভ করিয়াছিল। নিজেকে সে যেন দুটি ভাগে ভাগ করিয়া ফেলিয়াছিল। এক ভাগ দিয়া সে তাহার সাধারণ জীবনটা যাপন করিয়া যাইত, রানী সাজিয়া থাকিত, স্ত্রী ও মাতার কর্তব্য পালন করিত, দৈনন্দিন জীবনের ছোটবড় সুখ-দুঃখের নিজস্ব অংশটি গ্রহণ করিত। অন্য ভাগ দিয়া সে করিত কল্পনা। নিয়মে বাঁধা সচল জীবনের আড়ালে অবসর রচনা করিয়া লইয়া আপনার অচল জীবনকে মনে মনে সে গতি দিত। তার সর্বাঙ্গ উত্তপ্ত হইয়া উঠিত, চোখে ফুটিয়া উঠিত উজ্জ্বল অপার্থিব জ্যোতি, একটা উত্তেজিত উল্লাসে তার রক্তের গতি চঞ্চল হইয়া উঠিত। কোথায় পড়িয়া থাকিত এই রাজবাড়ি আর রাজা আর রাজপুত্র, দিনের পর দিন ধরিয়া নিঃসঙ্গ বিরহী মুহূর্তগুলোতে তিল তিল করিয়া সৃজিত বাস্তবধর্মী কল্পলোকে যামিনীর বিবাহের প্রথম বৎসরটি বারংবার আবর্তন চলিত। 

জ্যোৎস্নারাতে যামিনী একাই উঠিত গিয়া ছাদে। 

প্রথমে আলিসা ঘেঁষিয়া সে নিঝুম হইয়া দাঁড়াইয়া থাকিত। হয়তো বা কোনো দিন প্রথমদিকে তার দু-চোখ জলে ভরিয়া আসিত। ঘুমন্ত স্বামীকে, নিস্তেজ বাস্তব জীবনকে সদ্য সদ্য পিছনে ফেলিয়া আসিয়া সহসা সে কল্পনাকে উদ্‌ভ্রান্ত করিয়া দিতে পারিত না। দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া আকাশপাতাল ভাবিত। তার বিরহবিধুর জগতে জাগিয়া থাকিত শুধু কাছের একটি নিঃসঙ্গ বটগাছ, দূরের একটি আলো, আকাশের একক চাঁদ। আজো দু-সারি গাছের মাঝখানে সেই জনহীন পথটি কোথায় চলিয়া গিয়াছে। কোনো কোনো দিন ওই পথটির সংকেতও যামিনীর কাছে ভাষার মতো সুস্পষ্ট হইয়া উঠিত। পথের গোড়া হইতে শুরু করিয়া ধীরে ধীরে সে দৃষ্টিকে লইয়া যাইত দূরের অস্পষ্টতায়, থামিত সেইখানে। শঙ্কিত সন্দেহে ওইখানে সে অনেকক্ষণ থামিয়া থাকিত। 

তারপর একসময় শুরু হইত তার কল্পনা। ভূপতির একটি অবিচ্ছিন্ন নিবিড় আলিঙ্গন তাকে ঘিরিয়া নামিয়া আসিত, তার শ্বাসরোধী প্রেমকে অনুভব করিয়া যামিনীর হৃদয় অধীর আগ্রহে স্পন্দিত হইতে থাকিত। 

এ কথা পূর্বেই বলা হইয়াছে যে বত্রিশ বছর বয়সে ভূপতির মাথায় একটু টাক দেখা দিয়াছিল। শুধু তাই নয়। মাথার মধ্যেও এই সময় তার অল্প অল্প যন্ত্রণা বোধ আরম্ভ হইল। ডাক্তার ছয় মাস দার্জিলিংয়ে বিশ্রামের পরামর্শ দিলেন। 

ভূপতি ঠাণ্ডা দেশ পছন্দ করে না। বাহির হইতে মৃদু উত্তাপ পাইতেই তার ভালো লাগে। দার্জিলিংয়ের বদলে সে বোম্বে যাওয়া ঠিক করিল। বোম্বে অনেক দূর। ভূপতি দূরেও যাইতে চায়। 

যামিনীকে তার সঙ্গে নেওয়ার ইচ্ছা ছিল না। 

ওকে সে এখনো ভয় করে। ওকে উপলক্ষ করিয়া তার সেই আদিম উন্মত্ততা ভূপতি এখনো ভোলো নাই। 

কিন্তু যামিনী বলিল—আমিও যাব। 

ভূপতি আপত্তি করিয়া বলিল-তুমি গিয়ে কী করবে? 

যামিনী সজল চোখে বলিল-তোমার কাছে থাকব। আমায় না নিয়ে গেলে আমি মরে যাব। 

শুনিয়া ভূপতি অবাক হইয়া গেল। জীবনের কী একটা বিস্তৃত রহস্য প্রভাতের কুয়াশা হইতে মধ্যাহ্নের আকাশে দেখা দিয়াছে। 

বোম্বে গিয়া অল্পদিনের মধ্যেই ভূপতির ভারী মাথা হালকা হইয়া গেল। দিনগুলো এখানে অলস, বৈচিত্র্যহীন। এখানে উকিল-মোক্তার নাই, রাজ্য বিস্তার নাই, প্রজাশাসন নাই। প্রভুত্ব হ্রস্ব, বিরক্তি স্বল্প, বৈচিত্র্য অপ্রতুল। সে আর যামিনীর মধ্যে এখানে আড়াল কম। খোকা যতদিন রহিল তাকে একরকম মাঝখানে খাড়া করিয়া রাখা গেল। কিন্তু সে এখন বড় হইয়াছে। নামকুমের স্কুলে সে বোর্ডিংয়ে থাকিয়া পড়ে। নিজেদের প্রয়োজনে শিক্ষায় ব্যাঘাত দিয়া তাকেও বেশিদিন আটকাইয়া রাখা গেল না। 

ভূপতি নিরাশ্রয় অসহায় হইয়া পড়িল। 

তাই একদিন সে যামিনীকে বলিল। তুমি এখনো তেমনই আছ মিনি, প্রায় তেমনই আছ। 

যামিনী বলিল-তাই কি কেউ থাকে? আমি কত বদলে গিয়েছি। 

তারা পরস্পরের চোখের দিকে চাহিল। কিন্তু পরস্পরকে তারা আর খুঁজিয়া পায় না। 

না শীত, না গ্রীষ্ম। বোম্বের আবহাওয়া ধর্মহীন, নিরপেক্ষ। বোম্বের পথ দিয়া জগতের যাবতীয় ধর্মের লোক চলাচল করে। বোম্বে শহর ঘুমায় এবং জাগে, বোম্বের আকাশে চাঁদ উঠিতে ছাড়ে না। অবন্তীপুরের রাজা জীবনের যে স্তরগুলো দেশে নামাইয়া রাখিয়া আসিয়াছে তার তলাকার স্তরগুলো ধীরে ধীরে প্রাণসঞ্চার করে, ইটের সমাধিমুক্ত মুমূর্ষু সাদা ঘাসের মতো। 

ভূপতির ভয় করে, ইচ্ছাশক্তির নিচে আবার সে এই প্ৰাণকামী কামনাগুলোকে চাপা দিতে চায়, অবন্তীপুরে ফিরিয়া যাওয়ার কথা ভাবে। কিন্তু মৃত্যুর চেয়ে বড় যার দাবি তাকে ঠেকানো যায় না। জাগরণকে একদিন হয়তো ঘুমের মধ্যে ডুবাইয়া দেওয়া যায়, কিন্তু ঘুম যখন ভাঙিতে থাকে জাগিয়া ওঠাকে তখন আর কিছুতেই এড়ানো যায় না। 

প্রথমে ভূপতি বুঝি ভাবিয়াছিল, যামিনী আজো তেমনই আছে। ভালো করিয়া চোখ মেলিয়া চাহিতে শিখিয়া এ ভুল তার ভাঙিয়া যায়। যামিনীকে এখনো চাহিলেই পাওয়া যায় সেই সঙ্গে কী যেন পাওয়া যায় না। স্বামীর বাহুবেষ্টনের মধ্যেও যামিনীর একদিন যেমন তাকে স্তিমিত, সুদূর অন্যমনস্ক মনে হইত এবং এখনো খেয়াল করিলে হয়, আজ যামিনীকেও ভূপতির তেমনই নিস্তেজ তেমনই ঘুমন্ত মনে হইতে থাকে। 

স্বামীর নবজাগ্রত প্রেমকে যামিনী গ্রহণ করিতে পারে না। সে তার কল্পনাকে লইয়া দিন কাটায়। তার অর্ধনিমীলিত চোখে ভূপতি যখন ব্যাকুল দৃষ্টিতে তার পূর্বপরিচিত অতল রহস্যকে সন্ধান করে যামিনী তখন অন্য একজন ভূপতির স্বপ্ন দ্যাখে, অন্য একজন ভূপতির দু চোখ ভরা ব্যগ্র উৎসুক প্রেমকে যাচিয়া লয়। 

নিশীথ রাত্রে ভূপতি বিনিদ্র চোখে বসিয়া থাকে বিছানায়। যামিনী মৃদু মৃদু নিশ্বাস ফেলিয়া ঘুমায়। 

সকালে ভূপতি বলে—-কাল ভালো ঘুম হয় নি মিনি। 

যামিনী বলে মাথা ধরেছিল? আমায় ডাক নি কেন? আজ আবার ওষুধটা তা হলে খাও। 

একদিন অপরাহ্ণে তারা ভেহার লেকে বেড়াইতে গিয়াছিল। এই লেক হইতে বোম্বে শহরের জলার্থীদের জল সরবরাহ করা হয়। দৃশ্য ভারি সুন্দর! অনেকে লেকের ধারে পিকনিক করিতে যায়। 

ভূপতির পাশে বসিয়া তাকে যামিনী ভুলিয়া গিয়াছিল। চারদিকে চাহিয়া দেখিতেই তার ভালো লাগিতেছে, ভূপতির সান্নিধ্য অনুভব করিবার তার অবসর ছিল না। চারদিকে কত গাছপালা, সবগুলির নামও সে জানে না। কাছের কতকগুলি পামগাছের গোড়া হইতে ডগা পর্যন্ত দেখা যায়, কিন্তু খানিক দূরে জলের কাছাকাছি এক স্তূপ সবুজ রহস্যের মধ্যে আট-দশটা গাছ প্রোথিত হইয়া আছে। ওই গাছগুলি আর তার মাঝখানে লেকের তীর নিচু, লেকের জল ভিতরের দিকে ঠেলিয়া আসিয়াছে। চার-পাঁচটি বোবা পশু ওখানে জল খাইতে নামিল। ওপারে এলায়িত পাহাড়। জল গোড়া ছুঁইয়া আছে। 

হঠাৎ ভূপতি যামিনীর একখানি হাত দু হাতের মুঠায় শক্ত করিয়া চাপিয়া ধরিল। এত জোরে ধরিল যে যামিনীর তাতে ব্যথা পাওয়ার কথা। 

যামিনী মুখ ফিরাইয়া অবাক হইয়া গেল। 

কী হয়েছে? হাতে লাগে যে আমার? 

কিন্তু সেদিন লাগিত না। 

ভূপতি তার হাত ছাড়িয়া দিল। তার মুখ দেখিয়া যামিনীর সবই বোঝা উচিত ছিল, কিন্তু কিছুই সে বুঝিল না। একটা সন্দেহ করিয়া পরম স্নেহে আবার জিজ্ঞাসা করিল—কী হয়েছে? অসুখ বোধ করছ? 

ভূপতি বলিল—না। অসুখ নয়। 

যামিনী তার দিকে আর একটু সরিয়া গিয়া নিজের ব্যথিত হাতখানা তার লজ্জিত হাতের উপর রাখিয়া ওপারের পাহাড়ের দিকে চাহিয়া রহিল। ভূপতি যাহা চায় তার মধ্যে তাহা আছে, তাহাদের সেই অনির্বচনীয় অতৃপ্ত প্রেম। কিন্তু তার নাগাল পাইতেছে না। একদিন হয়তো যামিনীর কল্পনা থামিয়া যাইবে, হয়তো আকুল হইয়া আজ রাত্রেই অন্ধকারে সে এই বাস্তব ভূপতিকে খুঁজিবে, কিন্তু ভূপতি তখন হয়তো জাগিয়া নাই। আবার কাল রাত্রে ভূপতি যখন আলো জ্বালিয়া অপলক চোখে তার মুখের দিকে চাহিয়া থাকিবে, সে হয়তো তখন ঘুমাইয়া আছে। একসঙ্গে তারা যে আজ পরস্পরকে দাবি করিবে তার বাধা অনেক। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *