পূজারির বউ

পূজারির বউ 

বাহিরে অমাবস্যার গাঢ় অন্ধকারে অবলুপ্ত পৃথিবীকে এত রাত্রে শুধু কয়েকটি রহস্যময় শব্দের সাহায্যে চিনিতে হয়। কাদম্বিনীর চোখে ঘুম নাই। বিছানায় উঠিয়া বসিয়া কান পাতিয়া সে রাত্রির প্রত্যেকটি দুর্বোধ্য ভাষা শুনিতে থাকে। 

ঝিঁঝির শব্দ এমনই একটানা বিরামহীন যে থাকিয়া থাকিয়া আপনা হইতে তাহার শুনিবার অনুভূতি বিরাম নেয়। চেষ্টা করিয়াও আর যেন ডাক শোনা যায় না। ঘরের পিছনে নিমগাছটার পাতায় সহসা বাতাস দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া যায়, শুকনো আমপাতাগুলো উঠানের এক পাশ হইতে অন্য পাশে উড়িয়া যাওয়ার সময় যেন তাহারা প্রতিধ্বনি করে। দূরে শিয়াল ডাকিয়া ওঠে। তাদের আর্তকণ্ঠ নীরব হইবার পর বহুক্ষণ অবধি গ্রামের কুকুরগুলোর চিৎকার থামিতে চায় না। কাছেই কোথায় একটা প্যাচা বীভৎস চিৎকারে রাত্রিকে কয়েক মুহূর্তের জন্য কদর্য করিয়া তোলে। খানিক পরে অদূরে বড় রাস্তায় গোরুর গাড়ির চাকার ক্যাচক্যাচ শব্দ ওঠে, গোরুর গলার বাঁধা ঘণ্টার আওয়াজ শোনা যায়। 

এবং অতি অকস্মাৎ রাত্রির এইসব নিজস্ব শব্দকে ছাপাইয়া উঠিয়া, কাদম্বিনীর সর্বাঙ্গে রোমাঞ্চ তুলিয়া দিয়া, প্রতিবেশী রমেশ হাজরার কচি ছেলেটা কাঁদিয়া ওঠে। 

কাদম্বিনী থরথর করিয়া কাঁপিতে থাকে, তার বুকের মধ্যে ঢিপঢিপ করে, সর্বাঙ্গ ঘামে ভিজিয়া যায়। রমেশ হাজরার বউ ছেলেমানুষ, তার ঘুম ভাঙিতে দেরি হয়। ছেলেটা অনেকক্ষণ কাঁদে। শুনিতে শুনিতে কাদম্বিনীর মাথার মধ্যে তার চেতনা নির্ভরহীন হইয়া যায়। একটা অদ্ভুত সমতলতার অনুভূতি তরঙ্গায়িত হইয়া উঠিয়া তাকে একপাশে টলাইয়া ফেলিয়া দিতে চায়। কাদম্বিনী সভয়ে চৌকির প্রান্ত দুই হাতে প্রাণপণে চাপিয়া ধরে। 

প্রকৃতপক্ষে রমেশ হাজরার ছেলেটার কান্না শুনিবার আশঙ্কাতেই বাসন্তী অমাবস্যার রাত্রিটি কাদম্বিনীর কাছে বিনিদ্র ও শব্দময়ী হইয়া উঠিয়াছিল। রমেশের বউ ছেলে হওয়ার সময় এখানে ছিল না। বাপের বাড়ি গিয়াছিল। মাসখানেক আগে চার মাসের ছেলে কোলে সে ফিরিয়া আসিয়াছে। তার কয়েক দিন পরেই তার ছেলের কান্না কাদম্বিনী গভীর রাত্রে প্রথম শুনিতে পায়। 

আপনার অসহ্য মনোবেদনা নিয়া কাদম্বিনী সেদিন ঘরের বাহিরে রোয়াকে মাদুর পাতিয়া নিঝুম হইয়া পড়িয়াছিল। গুরুপদ অনেক বলিয়াও তাহাকে ঘরের মধ্যে নিতে পারে নাই। শেষে হাল ছাড়িয়া দিয়া খানিকক্ষণ তামাক টানিয়া কাদম্বিনীর পাশে বসিয়া ঝিমাইতে আরম্ভ করিয়া দিয়াছিল। 

এমন সময় রাত্রির স্তব্ধতার মধ্যে মাটির প্রাচীরের ওপাশে শোনা গিয়াছিল ক্ষীণকণ্ঠের কান্না। 

কাদম্বিনী ধড়মড় করিয়া উঠিয়া বসিয়া আতঙ্কে উত্তেজনায় দিশেহারার মতো স্বামীকে সজোরে জড়াইয়া ধরিয়াছিল। 

ওগো, খোকা কাঁদছে। শুনছ? ওগো তুমি শুনছ! 

গুরুপদ বলিয়াছিল, রমেশের ছেলে কাঁদছে কাদু। অমন কোরো না। ভয় কী। 

কাদম্বিনী অনেকক্ষণ তার কথা বিশ্বাস করিতে পারে নাই। বিস্ফারিত চোখে দু-বাড়ির মাঝখানে প্রাচীরটার পাশে আনারস গাছের ঝোপের দিকে চাহিয়া থাকিয়া বারবার শিহরিয়া উঠিয়া বলিয়াছিল, ওগো না, আমার খোকা কাঁদছে। আমি স্পষ্ট শুনছি আমার খোকার গলা, ওই ঝোপের মধ্যে কাঁদছে। ওই শোনো, শুনছ? আমার খোকার গলা নয়? 

তারপর হঠাৎ উন্মাদিনীর মতো উঠানে নামিয়া গিয়া সে আনারসের ঝোপটার দিকে ছুটিয়া যাইতেছিল। গুরুপদ তাকে ধরিয়া রাখে। সহজে কী তাকে আটকানো গিয়াছিল। নিরুদ্দেশের দেশ হইতে ফিরিয়া আসিয়া খোকা তার উঠানের পাশে ঝোপের মধ্যে কান্না আরম্ভ করিয়াছে মনে করিয়া শোকাতুরা শীর্ণা মেয়েটির দেহে কোথা হইতে বিস্ময়কর শক্তির সঞ্চার হইয়াছিল কে জানে। 

ছাড়ো, নিয়ে আসি। ওগো তোমার পায়ে পড়ি আমাকে ছেড়ে দাও। নদীর ধার থেকে খোকা আমার এতদূর এগিয়ে এসেছে, এইটুকু ও তো আসতে পারবে না। 

ছাড়া পাওয়ার জন্য বেশিক্ষণ স্বামীর সঙ্গে সে যুঝিতে পারে নাই। সহসা মূর্ছিতা হইয়া গুরুপদর বুকে এলাইয়া পড়িয়াছিল। সেই তার প্রথম মূর্ছা। শেষ রাত্রির আগে সে মূর্ছা আর ভাঙে নাই। 

রমেশ হাজরার বউকেই ছেলে কোলে উঠিয়া আসিয়া কাদম্বিনীর সেবা করিতে হইয়াছিল। অচৈতন্য স্ত্রীর শিয়রের কাছে বিছানায় পা গুটাইয়া বসিয়া ঘুমন্ত ছেলেকে কোলে শোয়াইয়া তাকে হাতের চুড়ি বাজাইয়া পাখা নাড়িতে দেখিয়া গুরুপদর কী মনে হইয়াছিল বলা কঠিন। ঘরের আলোটা যে শুধু তার চোখেই নিষ্প্রভ হইয়া গিয়াছিল এটা ঠিক। 

গ্রামের জমিদার মহীপতি বসাক। গুরুপদ তার পিতার আমলে প্রতিষ্ঠিত দেবমন্দিরের পূজারি। মন্দিরে রাধাশ্যামের মূর্তি আছে। মূর্তির সৌন্দর্য অপরূপ নিকষ কালো পাথর কুঁদিয়া এ মিলন মূর্তি কোন শিল্পী গড়িয়াছিল আজ তাহা জানা যায় না। কিন্তু তার প্রতিভা বিগ্রহের মধ্যে আজো বাঁচিয়া আছে। দিনের পর দিন পাথরের দেবতা গুরুপদর চিত্তহরণ করিতেছিল। মন্দিরে যথারীতি পূজা ও আরতি করিয়া, ভোগ দিয়া তার সাধ মিটিত না। মন্দিরের দুয়ার বন্ধ করিয়া যখন তার বাড়ি যাওয়ার অবকাশ, টাকার বিনিময়ে দেবসেবার সাময়িক বিরতি, তখনো অনেক সময় সে বহুক্ষণ ধরিয়া বিগ্রহের সামনে চুপচাপ বসিয়া থাকিত। হৃদয়ানন্দের বিনিময়ে দেবতাকে বিনামন্ত্রে বিনা গন্ধপুষ্পে বিনা ধূপ-চন্দনে পূজা করিত। 

পরদিন মন্দিরে যাইতে তার দেরি হইয়া গিয়াছিল। মহীপতির বিধবা বোন ভাবিনী একটু পূজা-পাগলা। জাতিতে তাঁতিনি বলিয়া বিগ্রহের কাছে ঘেঁষিবার অধিকার তার ছিল না। মন্দিরের একটা চাবি কিন্তু সে আঁচলে বাঁধিয়া নিয়া বেড়াইত। বিগ্রহকে সেও বোধ হয় ভালবাসিয়াছিল। কাছে না যাইতে পাক মধ্যে মধ্যে মন্দিরের দুয়ার খুলিয়া চুরি করিয়া দূর হইতে রাধাশ্যামকে দেখিবার সাধ সে দমন করিতে পারিত না। ভোরে মন্দিরে আসিয়া গুরুপদর প্রত্যাশায় বসিয়া থাকিতে থাকিতে সেদিন সে এমনই বিরক্ত ও ক্রুদ্ধ হইয়া উঠিয়াছিল যে দেরি হওয়ায় কৈফিয়তটা আগাগোড়া শুনিয়াও প্রথমে তার একবিন্দু সহানুভূতি হয় নাই। 

পূজা শেষ হইলে কিন্তু বলিয়াছিল, কথাটা ভালো নয় ঠাকুরমশায়, দুটো শোক মনে পুষে রেখেছে, তারপর ভারি মাসে মূর্ছাটা হল। শুনে থেকে মনটা কেমন করছে। আপনি এক কাজ করুন, কাদুদিদির নামে সংকল্প করে দুটো ফুল দেবতার পায়ে ছুঁইয়ে সঙ্গে নে যান। কাদুদিদির কপালে ঠেকিয়ে তুলে রাখবেন। 

কাদুর কোল শূন্য হইয়া যাওয়া বন্ধ করার জন্য, কাদুকে শান্তি দিবার জন্য, দেবতার সাহায্য গুরুপদ অনেকবারই চাহিয়াছিল। দেবতা তাহার কামনা পূর্ণ করেন নাই। তবু, ভাবিনীর কথায় গুরুপদ ব্যাকুল আগ্রহে পুনরায় মনের কামনা নিবেদন করিয়া দেবতার পায়ে ফুল ছোঁয়াইয়া নিয়া গিয়াছিল। 

মনে মনে কোনো দেবতাকেই কাদম্বিনী আর ভালবাসিত না। ঘর-খালি- করা, কোল-খালি-করা, বুক-খালি-করা শোক যাঁরা দেন তাদের কাদম্বিনী ভালবাসিবে কেমন করিয়া? তবু, ফুল পাইয়া তাহার উপকার কম হয় নাই। বিকালের দিকে উঠিয়া সে গুরুপদকে খাইতে দিয়াছিল, ও পাড়ার কানুর মার সঙ্গে আস্তে আস্তে অনেকক্ষণ গল্প করিয়াছিল। সন্ধ্যার সময় গা ধুইয়া কিছুক্ষণ আহ্নিক করিতেও বসিয়াছিল। রাত্রে সকাল সকাল শুইয়া সেই যে ঘুমাইয়াছিল, সমস্ত রাত্রি একবারও তার ঘুম ভাঙে নাই। 

তারপর কয়েক দিন তার নিস্তেজ শান্ত ভাবটি বজায় ছিল। পাশের গ্রামে গুরুপদর এক মাসি থাকিত, গুরুপদ নিজে গিয়া মাসিকে সঙ্গে নিয়া আসিয়াছিল। দু-বেলা রান্নার কাজকর্ম মাসিই করিত, কিন্তু গো-সেবা, স্বামী- সেবা আর ঘর দুয়ার সাফ করার কাজে কাদম্বিনী তাকে হাত দিতে দিত না। মাঝে মাঝে পুকুরঘাটে গিয়া সে বাসন মাজিত। কলসি ভরিয়া জলও আনিত। বাগান দিয়া যাওয়া আসার সময় চকিত সতৃষ্ণ দৃষ্টিতে দু পাশে চাহিয়া দেখিত। তার যেন মনে হইত বাড়ির আনাচেকানাচে, বাগানের গাছের আড়ালে তার হারানো ছেলে দুটিকে সে হঠাৎ একসময় দেখিতে পাইবে। 

মাসি বলিত—ভারী কাজ নাই বা করলে বউমা? পোড়া গতর নিয়ে আমি তবে রয়েছি কী জন্যে! টুকিটাকি কাজ করতে চাও করো আর নয় বসে বসে কাঁথা সেলাই করে যাও। কম কাঁথা চাই কি! শেষে দেখ কাঁথার জন্যে কত ভুগতে হয়। ক্ষেমির মেয়ে হবার আগে ওকে কত বললাম, বললাম, ও ক্ষেমি, শুয়ে বসে দিন কাটাসনে মা, এই বেলা যখানা পারিস সেলাই করে নে। তা মেয়ে কথা শুনলে না,—ওমা অমন হু হু করে কেঁদে উঠলে কেন বউমা? কেঁদো না বাছা, কেঁদো না, কাঁদতে নেই। অমঙ্গল হয়। 

কাদম্বিনী কাঁদিতে কাঁদিতে বলিয়াছিল, কাঁথা দিয়ে কী হবে মাসিমা? কাঁথায় কে শোবে? কাঁথা যে আমার একবারও পুরোনো হতে পেল না মাসিমা? 

মাসি অবশ্য তাঁকে যথারীতি আশ্বাস ও সান্ত্বনা দিয়াছিল, কিন্তু কাদম্বিনীর আশ্বাস পাওয়ার অবস্থা নয়। চোখের সামনে সূর্য ওঠে, চোখের সামনে অস্ত যায়। জগতের সর্বোত্তম বিষয় সূর্যের উদয়াস্তে মানুষ বিশ্বাস করে। দু-দুবার কাদম্বিনীর জীবনের সমস্ত অবলম্বন তারই মধ্যে কেন্দ্ৰীভূত হইয়া আসিয়াছে, আসিবার সম্ভাবনা পার হইয়া যাইবার পর, অনেক তৃষ্ণাতুর দিবারাত্রি যাপনের শেষে, অকালে। দুবারই তার চোখের সামনে জীবনের আনন্দ তার চোখের পলকে অস্ত গিয়াছে। উদয়াস্তের এই একত্র সমাবেশেই কাদম্বিনী বিশ্বাস করে। সে বুঝিয়াছে ছেলে তার বাঁচিবে না। ছেলের জন্যে তপস্যা করিয়া অসময়ে সে মাতৃত্বের বর পাইয়াছে। তার মাতৃত্ব আসিবে, সন্তান থাকিবে না, এ কী আর কাদম্বিনীর বুঝিতে বাকি আছে। 

তারপর একসময় রমেশের ছেলের একটানা কান্নার মাঝে মাঝে বিরাম পড়িতে লাগিল। খানিক পরে কান্না একেবারেই থামিয়া গেল। এতক্ষণে তার মায়ের ঘুম ভাঙিয়াছে। 

কাদম্বিনীর জগতে আর লেশমাত্র শব্দ রহিল না। আপনার চিন্তার মধ্যে ডুবিয়া যাওয়ার স্তব্ধতা তার চারদিকে ঘেরিয়া আসিল। মধ্যে মধ্যে কেবল গুরুপদর নিশ্বাস ফেলিবার শব্দ তাকে ক্ষণিকের জন্য সচেতন করিয়া দিতে লাগিল। 

বসন্তকালের জোরালো বাতাস এক জানালা দিয়া ঘরে ঢুকিয়া অন্য জানালা দিয়া বাহির হইয়া যাইতেছে। কাদম্বিনীর মনে হইল, অনেকক্ষণ ধরিয়া তার শীত করিতেছিল। আঁচিলটা সে ভালো করিয়া গায়ে জড়াইয়া নিল। রমেশ হাজরার ছেলে আজ রাত্রে আবার কখন কাঁদিয়া উঠিবে ঠিক নাই। কয়েক দিন আগে প্রায় সমস্ত রাত্রি জাগিয়া থাকিয়াও ছেলেটাকে কাদম্বিনী মধ্যরাত্রে একবারের বেশি কাঁদিতে শোনে নাই। তবু প্রতি মুহূর্তেই কাদম্বিনী তার কান্না শুনিবার প্রতীক্ষা করিতে লাগিল। 

ঘুমের ঘোরে গুরুপদ পাশ ফিরিয়া শুইল। বাহিরে নিমগাছের ডালে প্যাঁচাটা আবার কর্কশ স্বরে ডাকিয়া উঠিল। হঠাৎ স্বামীর উপর কাদম্বিনীর অভিমানের সীমা রহিল না। দুটি সন্তানকে বিসর্জন দিয়া প্রতিরাত্রে মানুষ কেমন করিয়া এমন শান্তভাবে ঘুমাইতে পারে সে ভাবিয়া পাইল না। তার মনে হইল, গুরুপদ হয়তো কোনো দিন দুঃস্বপ্নও দেখে না। হয়তো ওর ঘুমের দেশেও তার খোকারা আজ পর্যন্ত একদিনের জন্যও উঁকি দিয়া যায় নাই। হয়তো সোনার জ্যোতি ভরা সুখের স্বপ্ন ওর চোখে মুখে হাসি ফুটাইয়া রাখিয়াছে। 

কাদম্বিনীর বুকের মধ্যে জ্বালা করিতে লাগিল। এতকাল স্বামীকে সে দেবতার মতোই পূজা করিয়া আসিয়াছে। প্রত্যেকটি সজ্ঞান মুহূর্তে স্বামীর সুখসুবিধার চিন্তায় ব্যয় করিয়াছে। স্বামীর মুখের দিকে চাহিয়াই তার দুর্বিষহ মর্মবেদনা যেন নিমেষে লঘু হইয়া আসিয়াছে। ধার্মিক সংযত দেবপূজক স্বামীর ভালবাসা পাইয়া চিরদিন সে নিজেকে ধন্য মনে করিয়াছে। তার বারো বৎসরব্যাপী বিবাহিত জীবনে একদিনের জন্য স্বামীর প্রতি সমালোচনার ভাব তার মনে জাগে নাই। তবু আজ কাদম্বিনী সহসা তার প্রতি তীব্র বিদ্বেষ অনুভব করিল। তার কণ্টকশয্যার সুখনিদ্রায় নিদ্রিত মানুষটার উপর অশুদ্ধায় তার মন পূৰ্ণ হইয়া গেল। 

তার এই সংস্কার-বিরুদ্ধ অভূতপূর্ব মানসিক বিদ্রোহকে বাধা দিবার কোনো চেষ্টাই সে করিল না। দিনের আলোয় সুস্থ মনে যে চিন্তার ছায়াপাত হইলে সে শিহরিয়া উঠিত, এখন রাত্রির অন্ধকারে সেই চিন্তাকেই তার উদ্‌বেগমথিত মন সযত্নে পোষণ করিয়া রাখিল। গুরুপদকে তার মনে হইল নির্মম, স্বার্থপর। মনে হইল, যে দুঃখ ভগবানের দান বলিয়া এতদিন সে জানিয়া রাখিয়াছিল ভগবান তাহা দেন নাই, গুরুপদই তার জীবনে বারবার এই সর্বনাশ আনিয়া দিয়াছে। দু বার তাকে শেলাঘাত করিয়াও গুরুপদর সাধ মিটে নাই, পুনরায় সেই একই অভিনয়ের আয়োজন করিয়াছে। 

শয্যা ছাড়িয়া কাদম্বিনী মেঝেতে নামিয়া গেল। দু হাতের কনুই মেঝেতে স্থাপন করিয়া করতলে মুখ রাখিয়া সে যেন একটা শারীরিক যন্ত্রণাই সহ্য করিবার চেষ্টা করিতে লাগিল। এইখানে, এই কঠিন মেঝের উপরে বিছানা পাতিয়া তার ছেলে দুটিকে সে শোয়াইয়া রাখিত, চৌকিতে গুরুপদ করিত শাস্ত্রপাঠ। কাজে তার মন বসিত না, দশ মিনিট পরপর ঘুমন্ত ছেলেকে না দেখিয়া গিয়া সে স্থির থাকিতে পারিত না, ঘুম ভাঙিয়া কখন ছেলে তার কাঁদিয়া ওঠে শুনিবার জন্য সারাক্ষণ উৎকর্ণ হইয়া থাকিত। শাস্ত্র পাঠান্তে গুরুপদ যাইত মন্দিরে। মন্দির হইতে ফিরিয়া রমেশ হাজরার সঙ্গে বসিত দাবা খেলিতে। অনেক রাত অবধি হয় মন্দিরে বসিয়া থাকিয়া নয় কারো বাড়ি আড্ডা দিয়া বাড়ি আসিত। তার ছেলের প্রাপ্য সময় ব্যয় করিয়া যে খাদ্য সে প্রস্তুত করিয়া রাখিত তাই আহার করিয়া এমনই নিশ্চিন্ত গভীর নিদ্রায় রাত কাটাইয়া দিত। 

তার ছেলে মরিয়া গেলে তাকে সান্ত্বনা দিত গুরুপদ। নিজের দু-ফোঁটা লোক-দেখানো চোখের জল মুছিয়া ফেলিয়া তাকে বুঝাইত, উপদেশ দিত, তার চোখের জলও মুছিয়া দিবার চেষ্টা করিত। ছেলের মরণে এতটুকু দুঃখ হইলে এ কি গুরুপদ পারিত? 

এই স্মৃতিই কাদম্বিনীর চিত্তকে দহন করিতে লাগিল সবচেয়ে বেশি। তার মতো তার স্বামীও যদি পুত্রশোকে উন্মত্তপ্রায় হইয়া উঠিত, আজ যদি সে স্বামীর শোকাতুর মূর্তি কল্পনায় আনিতে পারিত, মনের জ্বালা বোধ হয় তার অনেকখানি জুড়াইয়া যাইত। কিন্তু সন্তানকে নদীতীরে বিসর্জন দিয়া আসিবার পরেও গুরুপদকে বারেকের তরে আত্মহারা হইতে দেখিয়াছিল বলিয়া কাদম্বিনী স্মরণ করিতে পারিল না। তার মনের মধ্যে গুরুপদ মায়ামমতাহীন অত্যাচারীর রূপ গ্রহণ করিয়া রহিল। 

কাদম্বিনী ধীরে ধীরে উঠিয়া বসিল। গুরুপদর ঘুমন্ত মুখখানি একবার দেখিবার ইচ্ছা সে দমন করিতে পারিতেছিল না। কুলুঙ্গির উপর দিয়াশলাই ছিল। কাদম্বিনী প্রদীপ জ্বালিল। 

আলো প্রথমে তার চোখে সহিল না। দু চোখ টনটন করিয়া উঠিল। সে চোখ বন্ধ করিয়া দিল। বাতাসে প্রদীপ নিভিয়া যাওয়ার উপক্রম করিতেছিল। কাদম্বিনীর রুদ্ধ চোখের পাতায় আলোর রক্তিম সংবাদ এমনই একটা বিরক্তিকর চাঞ্চল্য হইয়া রহিল যে, তার মনের জ্বালা আরো বাড়িয়া গেল। চোখ মেলিয়া স্বামীর বারো বছরের দেখা মুখে এই আলোতে যে কী দেখিতে কী দেখিবে ভাবিয়া তার একটু ভয়ও যেন করিতে লাগিল। 

চোখ মেলিয়া চাহিবার পরেও কিছুক্ষণ কাদম্বিনীর এ ভয় কাটিয়া গেল না। ঘরের চারদিকে সে তাকাইয়া দেখিল, কিন্তু যার মুখ দেখিবার জন্য প্রদীপ জ্বালিয়াছিল তার দিকে সহসা দৃষ্টিপাত করিতে পারিল না। ঘরের কোণে কাঠের সিন্দুকটার উপর কাদম্বিনী ছেলেকে দুধ খাওয়াইবার পিতলের ঝিনুকটি তুলিয়া রাখিয়াছিল। ব্যবহারের অভাবে ঝিনুকটি মলিন হইয়া গিয়াছে। শোকাচ্ছন্ন এই জড় বস্তুটিকে আজ যেন কাদম্বিনী প্রথম আবিষ্কার করিল এমনিভাবে অনেকক্ষণ সে ঝিনুকটির দিকে চাহিয়া রহিল। তার বুকের মধ্যে স্বামীর বিরুদ্ধে মর্মাহত অভিযোগ আবার যেন নতুন করিয়া উথলিয়া উঠিল। গুরুপদ এমনই পাষাণ যে ওই ঝিনুকটি ছাড়া তার খোকাদের একটি জিনিস ঘরে রাখিতে দেয় নাই। সে পাগলামি করে বলিয়া, খোকার কাঁথা, খোকার বিছানা-বালিশ বুকে চাপিয়া ভগবানের কাছে তারস্বরে মৃত্যু প্রার্থনা করে বলিয়া, সব গুরুপদ নদীতে ভাসাইয়া দিয়া আসিয়াছে। 

দুটি আরক্ত চোখে একটা অশুভ জ্যোতি নিয়া প্রদীপ উঁচু করিয়া ধরিয়া কাদম্বিনী সমালোচক শত্রুর মতো গুরুপদর মুখের দিকে চাহিয়া স্থাণুর মতো দাঁড়াইয়া রহিল। স্বামীর মুখ সে দেখিল না, দেখিল শুধু আপনার দৃষ্টির বিকার। তার মনে হইল, ঘুমন্ত মানুষটার মুখে রেখায় রেখায় তার স্বার্থপর অত্যাচারী প্রকৃতি রূপ নিয়াছে। তাকে নিয়া খেলা করিবার কৌতুককর সাধ মুখের ভাবে সুস্পষ্ট ফুটিয়া আছে। 

কাদম্বিনীর হাত হইতে প্রদীপটা পড়িয়া যাইবার উপক্রম করিল। প্রদীপের তেল চলকাইয়া তার হাত বাহিয়া বাহুমূল পর্যন্ত গড়াইয়া আসিল। স্বামীর মুখে আপনার বিভ্রান্ত চিত্তের আবিষ্কার তাহাকে মরণাধিক যন্ত্রণা দিতেছিল, তবু সে তেমনইভাবে দাঁড়াইয়া থাকিয়া পৃথিবীতে তার বাঁচিয়া থাকার একমাত্র অবলম্বনকে অন্ধ আবেগের সঙ্গে ভাঙিয়া দিতে লাগিল। 

বুঝিতে তাহার আর বাকি রহিল না যে, বাকি জীবনটা তাহার এমনিভাবে কাটিবে। এক মাসের মধ্যে শূন্য কোল তাহার আবার ভরিয়া উঠিবে, ছয় মাসের মধ্যে কোল খালি করিয়া ছেলেকে তাহার গুরুপদ নদীতীরে রাখিয়া আসিবে। মেঝেতে লুটাইয়া মনের সাধে ধুলা মাখিয়া কাঁদিবার অবসরও সে পাইবে না। তার চোখ মুছাইয়া তার গায়ের ধুলা ঝাড়িয়া গুরুপদ তাকে এই শয্যায় তুলিয়া লইবে। নদীতীরে পাঠাইয়া দেওয়ার জন্য তার খোকাদের প্রত্যাবর্তন সে রহিত করিতে পারিবে না। 

কাদম্বিনীর মনে তার সমগ্র ভবিষ্যৎ জীবনের এই ভয়ংকর ছবি ক্ৰমে ক্ৰমে এমনই স্পষ্ট হইয়া উঠিল যে গুরুপদর মুখ তার চোখের সম্মুখ হইতে মুছিয়া গেল। নিজেকে সে দেখিতে পাইল এই ঘরের মৃত্যুশীতল আবহাওয়ায় স্বামীর বক্ষলগ্না পুত্রহন্ত্রী রাক্ষসীর রূপে। শিশুর ক্রন্দনে মুখরিত রাত্রিতে সে এক একটি শিশুকে আহ্বান করিয়া আনিতেছে আর গলা টিপিয়া মারিয়া ফেলিতেছে। 

জীবনে আর তার কাজ নাই, উদ্দেশ্য নাই। কাদম্বিনী সরিয়া আসিয়া পিলসুজের উপর প্রদীপ নামাইয়া রাখিল। রমেশের ছেলের কান্নাকে উপলক্ষ করিয়া পরপর অনেকগুলো রাত্রি সে আপনার মৃত সন্তান দুটির সাহচর্যে কাটাইয়াছে, তবু বাঁচিবার একটা ক্ষীণ সাধ গতরাত্রিতেও তার মধ্যে ছিল। এবার ছেলেটি তার বাঁচিতেও পারে এ আশা সে একেবারে ছাড়িতে পারে নাই। আজ আর আশা করিবারও তার সাহস রহিল না। ছেলে হয়তো তার বাঁচিতেও পারে। ভগবানের রাজ্যে অনেক আশ্চর্য ব্যাপার ঘটিয়া থাকে। কিন্তু আর ভাগ্য পরীক্ষার শক্তি কাদম্বিনী নিজের মধ্যে খুঁজিয়া পাইতেছিল না। যদি না বাঁচে? পলকে পলকে হারানোর ভয় বুকে পুষিয়া ছ-মাস এক বছর মানুষ করার পর যদি মরিয়া যায়? বাঁচিয়া থাকিয়া কাদম্বিনী তাহা সহ্য করিবে কেমন করিয়া? 

সিন্দুকের উপর পিতলের ঝিনুকটির দিকে শেষবারের মতো তাকাইয়া লইয়া কাদম্বিনী ফুঁ দিয়া প্ৰদীপ নিভাইয়া দিল। গুরুপদর দিকে চাহিবার সাধ আর তাহার ছিল না। স্বামীর সান্নিধ্য তার কাছে মিথ্যা হইয়া গিয়াছে। তার বারো বছরের ঘরকন্না, তার বারো বছরের স্বামী-পূজা আর তার বারো বছরের সুখ-দুঃখের স্মৃতি-ভরা এই নীড় অতিক্রম করিয়া সে যেন কোনো সুদূরতম অর্ধচেতনার দেশে চলিয়া গিয়াছিল, যেখানে আপনার অসহায় একাকিত্বের অনুভূতি ছাড়া মানুষের আর কোনো জ্ঞানই থাকে না। পূর্ণ চেতনার বাস্তব জগতে বহুবার পরিত্যক্ত ইচ্ছায় মানুষ যেখানে চালিত হয়। 

মন্দিরের চাবি গুরুপদ কুলুঙ্গিতে তুলিয়া রাখিত। চাবিটি হাতে নিয়া দুয়ার খুলিয়া কাদম্বিনী বাহিরে চলিয়া গেল। উঠানে দাঁড়াইয়া একবার শুধু সে ক্ষণিকের জন্য থমকিয়া দাঁড়াইল। তারপর আগাইয়া গিয়া সদরের দরজা খুলিয়া রাস্তায় নামিয়া গেল। 

এ পাড়ায় মানুষ ভিড় করিয়া নীড় বাঁধিয়াছে। রাস্তার দু পাশে স্তব্ধ নিঝুম গৃহগুলো একটির পর একটি অতিক্রম করিয়া যাওয়ার সময় কাদম্বিনীর কান্না আসিতে লাগিল। এই সব গৃহের অধিবাসী প্রত্যেকটি পরিবারকে সে চেনে। কোনো বাড়িতে তার মতো অভিশপ্ত একটি নারীকে খুঁজিয়া বাহির করা যাইবে না। পুত্রশোক এ পাড়ায় অজ্ঞাত নয়, হয়তো কোনো বাড়ির অন্ধকার কক্ষে পুত্রশোকাতুরা জননী এখন অশ্রুপাত করিতেছে। কিন্তু তার ছেলের মতো অজ্ঞাত কারণে, ঈশ্বরের দুর্বোধ্য অভিশাপে কার ছেলে আজ পর্যন্ত মরিয়া গিয়াছে? গর্ভে সন্তান আসিলে ওদের মধ্যে তার মতো কোন অভাগিনী জানিতে পারিয়াছে, সুস্থ সবল সন্তান তাহার একদিন তারই কোলে সহসা শুকাইতে আরম্ভ করিয়া তিন দিনের মধ্যে ধনুকের মতো বাঁকিয়া মরিয়া যাইবে? 

মন্দিরের সামনে প্রকাণ্ড দিঘি। দিঘির জলে অমাবস্যা রাত্রির উজ্জ্বলতর তারাগুলো ঝিকঝিক করিতেছে। মন্দিরের সোপানে দাঁড়াইয়া কাদম্বিনী কিছুক্ষণ অভিভূতের মতো দিঘির বিস্তারিত শান্তির দিকে চাহিয়া রহিল। তার মনে হইল, মরিবার মতো প্রয়োজন ছাড়া এ দিঘিকে যেন ব্যবহার করিতে নাই। অপরাধ হয়। 

মন্দিরের দুয়ার খুলিয়া কাদম্বিনী ভিতরে প্রবেশ করিল। মন্দিরের কোথায় কোন বস্তু রাখা হয় কিছুই তার অজানা ছিল না। অন্ধকারে অল্প একটু হাতড়াইয়াই পিতলের সবচেয়ে বড় কলসিটি কাদম্বিনী আবিষ্কার করিতে পারিল। 

কলসিতে জল ভরা ছিল। কাত করিয়া কাদম্বিনী জল ঢালিয়া ফেলিল। কলসি কাঁখে তুলিয়া আন্দাজে রাধাশ্যামের মূর্তির দিকে মুখ করিয়া সে মনে মনে বলিল, তুমি আমার দুটি ছেলে চুরি করেছ। আমি শুধু তোমার একটি কলসি নিলাম। তোমার ক্ষমা চাই না। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *