উদারচরিতানামের বউ

উদারচরিতানামের বউ 

যতীনের মতো মজলিশি মিশুক মানুষ দেখা যায় না। বেঁটে গোলগাল মানুষটা, চিকন চামড়া ঢাকা একটু চ্যাপটা ধরনের মুখখানিতে হাসিখুশি ভাবটাই বেশি সময় বজায় থাকে, তবে সময়বিশেষে সমবেদনাভরা গাম্ভীর্য, সংশয়ভরা জিজ্ঞাসু আশঙ্কা, বিচারহীন নির্বিকার ক্ষমা, দুঃখ, ক্ষোভ, মায়ামোহ এসব ভাবও এমন পরিষ্কার ফুটিয়া থাকে যে পটের ছবিও তার চেয়ে স্পষ্ট নয়। গলার আওয়াজটা একটু মোটা। কিন্তু কথা শুনিয়া মনে হয় মিষ্টত্ব একটু বেশিরকম ঘন হইয়া পড়ার জন্যই বুঝি এটা হইয়াছে। কথা সে যে খুব বেশি বলে তা নয়, যা বলে তাতেই সকলের প্রাণ জুড়াইয়া যায়। ভালো, মন্দ, ধনী, দরিদ্র, মূর্খ, পণ্ডিত, বোকা, বুদ্ধিমান সকলেই ভাবে কী, উঁহু, লোকটা আমার চেয়ে একটুখানি অধম যদিবা হয় উত্তম একেবারেই নয়, সমানই বরং বলা চলে সব বিষয়ে, আমার আপনজনের মতো। 

যতীনের কয়েকটা দোষ সকলে অনুমোদন করে না, তার মধ্যে প্রধান মেলামেশা আর খাতির করায় বাছবিচারের অভাব। সমজ্ঞানী অবশ্য যতীন নয়। প্রতিবেশী বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ রামদাসকে মাঝে মাঝে অকারণেই ভক্তিভরে প্রণাম করে বলিয়া বাড়ির সামনে ফুটপাতে যে মুচিটি বসিয়া থাকে তাকে দিয়া জুতা সারাই করাইয়া নেওয়ার পরে যে পায়ের ধুলা মাথায় নেয় তা নয়, তবে যতক্ষণ সে জুতাটা সারাই করে হয়তো সামনে উবু হইয়া বসিয়া সুখদুঃখের গল্প জুড়িয়া দেয়। ব্যাঙ্কের টাকার পরিমাণে যে বড়লোক যতটা সম্মান চায় যতীন তাকে হয়তো বেশিই দেয় তার চেয়ে, আর যে গরিব মানুষটি উপযুক্ত পরিমাণে অবহেলা না পাইলে দারুণ অস্বস্তি বোধ করে তাকে, তাকেও যথেষ্ট পরিমাণে অবহেলা দিতেও তার বাধে না। তবু বড়লোক আর গরিব দুজনেরই মনে হয়, দুজনকেই যেন সে সমানভাবে আপন করিয়াছে : বাপ আর ছেলের সঙ্গে দু রকম ব্যবহার করিয়াও কুটুম্ব যেমন দুজনের সঙ্গেই সমান কুটুম্বিতা বজায় রাখে। এটা সকলের ভালো লাগে না, মৃদু ঈর্ষার জ্বালায় মনটা খুঁতখুঁত করে। 

বাড়িতে হরদম লোক আসে, বাপের আমলের মাঝারি আকারের বাড়িটিতে। ছুটির দিন হয়তো এত লোক আসিয়া হাজির হয় যে ছোটখাটো বসিবার ঘরটিতে জায়গা হয় না। 

যতীন বলে, চলুন দাদা, ওপরে যাই সবাই মিলে। 

কেউ কেউ আপত্তি করে, না না, থাক গে। মেয়েদের অসুবিধে হবে। 

অসুবিধে হবে? আহত বিস্ময়ে যতীন এমন করিয়া বক্তার মুখের দিকে তাকায় যে মনে হয় গালে চড় মারিয়াই যেন তাকে আহত আর বিস্মিত করিয়া দেওয়া হইয়াছে। তার বন্ধুরা বাড়ির ভিতরে গেলে মেয়েদের অসুবিধা হইবে! 

বিনা খবরে সদলবলে যতীন অন্তঃপুরে ঢুকিয়া পড়ে। মেয়েরা চটপট রান্নাঘরে, ভাঁড়ার ঘরে, শোয়ার ঘরে আর আনাচেকানাচে আশ্রয় নেয়। যতীনের বউ শতদলবাসিনী ভাতের হাঁড়ি নামাইয়া জলের ডেকচি উনানে চাপাইয়া দেয়—এখনই সকলকে চা দিতে হইবে। 

যতীন এক ফাঁকে চট করিয়া রান্নাঘরে আসে। —চা হল? শতদলবাসিনী বলে, জল চাপিয়েছি। আন্দাজ কত কাপ? এই ধর কাপ চল্লিশেক?—পান পাঠিয়ো কিন্তু 

ছুটির দিনের পান সাজার দায়িত্ব সেজো ননদ কৃষ্ণার, বিবাহ হইয়া যতদিন না পরের বাড়ি যায়। জল গরম হইতে হইতে পানের খবরটা আনিতে গিয়া শতদলবাসিনী দ্যাখে কী, পান সাজা হইয়াছে মোট পাঁচ-সাতটি, পান সাজার সরঞ্জাম সামনে নিয়া কৃষ্ণা মশগুল হইয়া পড়িতেছে চিঠি। হাতের লেখা চেনা, কার চিঠি তাও জানা। 

ঠাকুরঝি! 

কৃষ্ণা চমকায়, থতমত খায়, চিঠিখানা ব্লাউজের আড়ালে চালান করিয়া দেয়, ঢোক গেলে।—এই হয়ে গেল বউদি, এক্ষুনি সেজে দিচ্ছি। 

চুলোয় যাক তোমার সাজা, ফের আরম্ভ করেছ? দু দিন বাদে তোর বিয়ে, আর তুই—

লিখলে আমি কী করব? আমি তো লিখি না। 

লেখো না কীসের, জবাব না পেয়েও সে চিঠির পর চিঠি দিয়ে যাচ্ছে। এবার কিন্তু ওঁকে সব বলব আমি, আমার তো একটা দায়িত্ব আছে। একটা কিছু ঘটুক, আর সবাই আমায় দুষুক, জেনেও চুপ করে ছিলাম। 

টুকটুকে রাঙা রঙ শতদলবাসিনীর, রূপের আর সব খুঁত তাতে চাপা পড়িয়া গিয়াছে, চোখ দুটি যে একটু ছোটবড় প্রায় সে খুঁতটা পর্যন্ত। মুখ ভার করিয়া ট্যারা চোখে সে তাকায় তার সেজো ননদের দিকে ভর্ৎসনার দৃষ্টিতে, আর মুখ নিচু করিয়া কৃষ্ণা নীরবে পান সাজে। 

দেখি কী লিখেছে আবার। 

কৃষ্ণা কাতরভাবে বলে, দেখে আর কী করবে বউদি? বলেই যখন দেবে—

শতদলবাসিনী বলে, আচ্ছা, এবারকার মতো আর বলব না। কিন্তু ফের যদি তোমরা চিঠি লেখালেখি কর—তুই বুঝিস না ভাই দু দিন পরে তোর বিয়ে- 

গভীর আগ্রহে শতদলবাসিনী চিঠি পড়ে, কৃষ্ণার ঠোঁটে দেখা দেয় মুচকি হাসি আর এদিকে রান্নাঘরে উনানে চাপানো চায়ের জলের ডেকচি টগবগ শব্দে বাষ্প ছাড়িতে থাকে। চা দিতেও দেরি হয়, পান দিতেও দেরি হয়। 

রাগে আগুন হইয়া যতীন আবার আসিয়া প্রায় দাঁত কড়মড় করিতে করিতে বলে, তোমরা সবাই হনুমান—এক নম্বরের জাম্বুবান তোমরা সব। একটু চা আর দুটো পান দিতে কি বেলা কাবার করবে। চাউনি দ্যাখো একবার, মারবে নাকি? সলজ্জ হাসি হাসিয়া শতদলবাসিনী বলে, ওমা, ছি কী যে বল তুমি! মারব কী গো! গরম জলে হাতটা পুড়ে গেল কিনা- 

পুড়বে না, যা কাজের ছিরি। নাও নাও, চটপট বানাও চা। 

উপরে মজলিশে ফিরিয়া গিয়া যতীন প্রায় তার বউয়ের লজ্জা পাওয়া হাসিটাই নকল করিয়া বলে, দুধ ছিল না কিনা, একটু দেরি হয়ে গেল চায়ের। যাক, এইবার এসে পড়ছে। চা না হলে কি আলাপ জমে! 

আলাপ প্রচণ্ডভাবেই জমিয়াছিল, বর্ষাকালে মেঘের গলিয়া গলিয়া অবিরাম ধারাবর্ষণের মতো, যার ঝমঝম গুঞ্জনধ্বনি শুনিতে শুনিতে মনে হয় বিশ্বব্যাপীই বুঝি হইবে। ঘরখানা মস্ত, আগে যতীনের বাবার শয়ন ঘর ছিল, আসবাবে বোঝাই হইয়া থাকিত। এখন যতীন এ ঘরে শোয় বটে, ঘরে আসবাবপত্র একরকম কিছুই নাই। মেঝের প্রায় সবটা জুড়িয়াই শতরঞ্চি পাতা, এক কোণে দেয়াল ঘেঁষিয়া বিছানার তোশকপত্র গুটাইয়া রাখা হইয়াছে। বসিবার ঘরে সবদিন সকলের স্থান সংকুলান হয় না দেখিয়া যতীন এ ঘরখানা খালি করিয়া নিয়াছে। বসিবার জন্য দেয়াল দরকার হয় না তাই দেয়ালে অনেকগুলি ছবি আর ক্যালেন্ডার লটকানো। দক্ষিণের দেয়ালের মাঝামাঝি প্রকাণ্ড তৈলচিত্র—যে জানে না দেখিলেই তার মনে হইবে নিশ্চয় যতীনের পরলোকগত পিতার ছবি। জিজ্ঞাসা করিলে যতীন মাথা নাড়িয়া বলে, ওটা হল গিয়ে আমার এক বন্ধুর বাবার ছবি। বছর তিনেক আগে পাশের বাড়িতে এক ভাড়াটে আসিয়াছিল, বাপের একটি তৈলচিত্রের জন্য তার জোরালো সাধ ছিল। যতীন ‘ছবিটি আঁকাইবার ব্যবস্থা করিয়া দিয়া মাসখানেকের জন্য দেশে গিয়াছে, ফিরিয়া আসিয়া দ্যাখে, পাশের বাড়ির নতুন বন্ধুটি কোথায় যে গিয়াছে কেউ জানে না। ছেলের চিকিৎসার জন্য বাড়িটি যে তারা মোটে দু মাসের জন্য ভাড়া নিয়াছে তা কি যতীন জানিত! 

কারণ যাই হোক, পুবের দেয়ালে কয়েকজন বিভিন্ন মানুষের সাধারণ কয়েকটি ফটোর মধ্যে নিজের বাবার একটি ফটো টাঙাইয়া রাখিয়া কয়েকদিনের পরিচিত একজনের বাবার তৈলচিত্রকে এতখানি প্রাধান্য দিতে দেখিয়া সকলে অবাক হইয়া যায়, ভাবে, যতীনের মনটা সত্যই উদার বটে। 

এদিকে, যতীনের মা রান্নাঘরের দাওয়ায় বসিয়া মালা জপ করিতে করিতে জিজ্ঞাসা করে, ছেলে কী বলে গেল বউমা? 

যতীনের মা কানে একটু কম শোনে। শতদলবাসিনী এতখানি গলা চড়াইয়া তার প্রশ্নের জবাব দেয় যে উপরের ঘরে যতীন আর সমবেত সকলেই প্রত্যেকটি কথা শুনিতে পায় : কী আর বলবে, বলে গেল চায়ে দুধ-চিনি কম দিতে, চা খাইয়েই ফতুর হবে। 

এ ধরনের অপরাধের জন্য শতদলবাসিনী শাস্তি পায়। দিনের বেলা যতীন সময় পায় না, বাড়িতে অনেক লোক আসে, নিজেকে অনেক লোকের বাড়িতে যাইতে হয়। রাত্রে,–হয়তো অনেক রাত্রেই, কারণ বিপদ রোগ আর শোক যেন পৃথিবীর সমস্ত মানুষের ঘাড়ে সব সময় চাপিয়া থাকিতে ভালবাসে এবং তাদের মধ্যে দু-চার জনকে সাহায্য পরামর্শ সেবা আর সান্ত্বনা দিতেই যে কত সময় লাগে বলিবার নয়–বাড়ি ফিরিয়া যতীন বউকে ডাকিয়া তোলে। পাঁচ বছরের ছেলে আর দু বছরের মেয়েকে নিয়া শতদলবাসিনী এ ঘরের লাগাও ছোট ঘরটিতে শোয়, ছেলেমেয়ের কান্না আর নোংরামি যতীনের সহ্য হয় না। দুটি ঘরের মাঝে দরজা আছে, দরকার হইলে কখনো যতীন নিজেই ও ঘরে যায়, কখনো বউকে এ ঘরে ডাকিয়া আনে। 

শাস্তির রাত্রেও ডাক শুনিয়া প্রথমটা শতদলবাসিনী বুঝিতে পারে না শাস্তির জন্য তাকে ডাকা হইয়াছে, ঘুম ভাঙার বিরক্তি আর অজানা একটা অস্বস্তির মধ্যেও হঠাৎ উগ্র প্রত্যাশায় সর্বাঙ্গে তার বৈদ্যুতিক রোমাঞ্চ হয়। তারপর এ ঘরে আসিয়া যতীনের পাতা বিছানা তুলিয়া ঘর জোড়া শতরঞ্চি উঠাইয়া বাহিরে নিয়া গিয়া তাকে ঝাড়িতে হয়। ঘর ঝাঁট দিয়া আবার শতরঞ্চি বিছাইয়া পাতিতে হয় বিছানা। সমস্তক্ষণ যতীন নীরবে চুরুট টানিয়া যায়। 

বিছানা পাতা হইলে চিত হইয়া শুইয়া বলে, এক গ্লাস জল দাও তো। জল দেওয়া হইলে বলে, হেঁটে হেঁটে পা দুটো কেমন ব্যথা করছে। একটু টিপে দাও না? না, অপমান হবে? 

ওমা, অপমান হবে কী গো! কী যে বল তুমি! 

যতীন চোখ বুজিয়া পড়িয়া থাকে, ঘুমে ঢুলুঢুলু ট্যারা চোখ প্রাণপণে মেলিয়া রাখিয়া দু হাতে শতদলবাসিনী তার পা টিপিয়া দেয়, সে হাত দুটির রঙ তার হাতের সোনার চুড়ির রঙের সঙ্গে প্রায় মিশ খায়। 

কৃষ্ণার গোপন চিঠির অদ্ভুত খাপছাড়া লাইনগুলি হয়তো তার মনে পড়িয়া যায়, স্বামীর পা টেপার সময় ওসব লাইন কি মনে না পড়িয়া পারে, যে মেয়ের এখনো স্বামী হয় নাই তার কাছে একটা মাথা পাগলা ছেলের লেখা কাকুতিমিনতি হা-হুতাশ ভরা লাইন? মনে পড়িতে পড়িতে দুঃস্বপ্ন দেখিয়া জাগিয়া ওঠার মতো হঠাৎ তার ঘুম টুটিয়া যায় : পা টেপা শেষ হইলে? পা টেপার পুরস্কার স্বরূপ–? 

সন্তর্পণে গায়ে নাড়া দিয়া সে আধো-ঘুমন্ত যতীনকে চোখ চাওয়ায়, সলজ্জ একটু মৃদু হাসি মুখে আনিয়া বলে, এবার থাক? পরে আবার দেবখন, অ্যাঁ? 

দু মিনিট দিয়েই হয়ে গেল? বলছি ভয়ানক পা কামড়াচ্ছে। 

ঘরে আলো আছে, রাস্তার একটা আলোও জানালা দিয়া দেখা যায়—অসমান চোখ দুটি যতক্ষণ জলে ভরিয়া থাকে ততক্ষণ মুখ উঁচু করিয়া সে ঘরের আলোটা দ্যাখে, তারপর জল শুকাইয়া চোখ ঢুলুঢুলু হইয়া আসিলে তাকায় রাস্তার আলোর দিকে। ঘড়িতে সময় চলার টিকটিক আর যতীনের নিশ্বাস ফেলার স্ স্ শব্দের সঙ্গে মাঝরাত্রির আরো কত শব্দ সে শোনে, সব শব্দ হয়তো শব্দই নয়। 

তারপর একসময় মেয়েটা কান্না শুরু করে, তার কান্নায় জাগিয়া গিয়া ছেলেটাও সে কান্নায় যোগ দেয়। পা টেপা বন্ধ করিয়া শতদলবাসিনী বলে, ওগো শুনছ, ওরা জেগেছে, আমি গেলাম। 

না, এখন যেতে হবে না। 

ওরা যে কাঁদছে? 

কাঁদুক। 

আর পা টেপায় না, এবার যতীন তার আদরের বউকে আদর করিয়া করিয়া আলিঙ্গনে বাঁধিয়া ফেলে। ছেলেমেয়ের চিৎকার যত সপ্তমে ওঠে তার বাহুর বাঁধনও তত জোরালো। শাস্তিই বটে। এতক্ষণ এত করিয়াও যাকে শাস্তি পাওয়ানো যায় নাই এতক্ষণে যে তার শাস্তি শুরু হইয়াছে দুজনেই তা বুঝিতে পারে, যে শাস্তি দিতেছে সেও যে শাস্তি গ্রহণ করিতেছে সেও। 

গোড়া হইতেই শতদলবাসিনী সব জানে, সব বোঝে। তবু সে কিছুই জানিতে চায় না, কিছুই বুঝিতে চায় না, এখনো চেষ্টা করে জয়ের। 

এতক্ষণে রাগ পড়ল? 

রাগ আবার করলাম কখন? 

কথা বল নি কিনা এতক্ষণ, তাই মনে হচ্ছিল রাগ করেছ। আচ্ছা, আজ দাড়ি কামালে কখন বল তো? সারা দিন তো এক মিনিট সময় পাও নি। কী খাটতেই তুমি পার, বাব্বা!—অত খেটো না, লক্ষ্মীটি, শরীর ভেঙে পড়বে। মধুর হাসি হাসে শতদলবাসিনী, যতীন দাড়ি কামাইয়াছে কিনা গালে আঙুল বুলাইয়া বুলাইয়া তাই পরীক্ষা করে। হঠাৎ ভয়ানক বিরক্ত হইয়া বলে, আঃ, কী চিল্লানিটাই শুরু করেছে দুটোতে, জ্বালিয়ে মারল। মেঝেতে আছড়ে ফেলতে সাধ যায়। ছাড়ো তো দুটোকে শান্ত করে আসি, এখুনি আসব, দু মিনিটের মধ্যে। 

কাঁদুক না। ছেলেপিলের কাঁদা ভালো। দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে আসছি, দাঁড়াও। 

যতীন দু ঘরের মাঝখানের দরজাটা বন্ধ করিয়া দিতে উঠিয়া যায়। সঙ্গে সঙ্গে গিয়া শতদলবাসিনী পাশ কাটাইয়া চট করিয়া ও ঘরে চলিয়া যাওয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু স্বামীর বাহুর বন্ধনের সঙ্গে বউ কেন পারিয়া উঠিবে? 

দরজাটা বন্ধ করা হয়, কিন্তু ছেলেমেয়ের চিৎকারের শব্দ আটকানো যায় না। একটু পরেই ও ঘরের বারান্দার দিকের দরজায় দুমদুম করাঘাতের শব্দ পাওয়া যায়, কৃষ্ণার গলা শোনা যায়, বউদি, ও বউদি? কী ঘুম বাবা তোমার?—বউদি, ও বউদি? 

.

কৃষ্ণার বিবাহের মাস দুয়েক দেরি আছে। পাত্রটি তেমন সুবিধার নয়। বাড়ির অবস্থাও ভালো নয়, নিজের উপার্জনও বেশি নয়, বয়সটাও কম নয়। কৃষ্ণার পছন্দ-অপছন্দের অবশ্য প্রশ্নই ওঠে না, বাড়ির অন্য কারো পছন্দ হয় নাই। মা দিনরাত খুঁতখুঁত করে, বিবাহিতা বড় বোন দুটি আপসোস ভরা চিঠি লেখে, আত্মীয়স্বজনেরা জিজ্ঞাসা করে, এমন মেয়ের এমন পাত্র ঠিক করা কেন, বাজারে কি আর ছেলে নাই? 

যতীন বলে, কত লোক বোনের বিয়েই দিতে পারছে না, কানাখোঁড়ার হাতে দিতে হচ্ছে শেষ পর্যন্ত। আমার বোন বলে কি তার জন্য রাজপুত্তুর আনতে হবে? মন্দই বা কী ছেলেটি? স্বাস্থ্য ভালো, রোজগারপাতি করছে—আবার কী চাই? 

তা ছাড়া পাত্রটি সস্তা। 

এটাই যে একটা মস্ত বড় কারণ, শতদলবাসিনীর কাছেই সে কেবল তা স্বীকার করে। টাকাপয়সার টানাটানিটা তার সব সময় লাগিয়াই আছে। বাপের অবস্থা তার ভালোই ছিল, দেশে কিছু সম্পত্তি আছে, ব্যাঙ্কে কিছু টাকা ছিল, নিজেও মাসে মাসে বেতন পায় প্রায় তিন শ টাকা। তবু ধার দিয়া আর দান করিয়া টাকায় তার কুলায় না। ব্যাঙ্কের টাকাগুলি যতদিন ছিল ততদিন চেক কাটিয়া কাটিয়া চলিয়া গিয়াছে, এখন অসুবিধার সীমা নাই। দেশের সম্পত্তির আয়টা বছরে হাজার দুয়ের কাছাকাছি ওঠে নামে। এই আয়টা আছে বলিয়া রক্ষা, নয়তো কী যে হইত! 

বউয়ের সঙ্গে মাঝে মাঝে যতীন এ বিষয়ে আলোচনা করে। স্বামীর মুখে দুর্ভাবনার ছাপ দেখিয়া শতদলবাসিনী বলে, এমন করে টাকাগুলো যদি নষ্ট না কর 

নষ্ট মানে?— 

আহা, যাদের ধার দাও, তারা কেউ একটি পয়সা কখনো ফেরত দিয়েছে, না দেবে? যাদের এমনি টাকা দাও, তাদের আদ্দেকের বেশি মিথ্যে কাঁদুনি গেয়ে তোমায় ভোলায়। 

মিথ্যে কাঁদুনি গেয়ে ভোলায়? নাম কর তো একজনের কে ভুলিয়েছে? 

শতদলবাসিনী আর যতীনের বন্ধু ক’জনের নাম জানে, কাকে কী উপলক্ষে কখন ধার দিয়েছে বা দান করিয়াছে তাই বা সে কী জানে। সে সময় তো যতীন তার সঙ্গে পরামর্শ করিতে আসে না। অনেক ভাবিয়া একটি দৃষ্টান্তই কেবল তার মনে পড়ে। তিন-চার বছর আগের ঘটনা, যখন হইতে যতীনের দান করা রোগটা মারাত্মক হইয়া দাঁড়াইয়াছে। 

কেন, সেই যে সেবার শান্তির বিয়েতে সাতাশ শ টাকা দিলে? ওর বাবার মাইনে কম হোক, ওর দাদা তো সাত-আট শ টাকা মাইনে পায়। 

যতীন অসহিষ্ণু হইয়া বলে, সব দাদাই কি বেশি মাইনে পেলে বোনের বিয়েতে টাকা ঢালে? টাকা কম পড়ল, শান্তির দাদা দিতে চাইল না, তাই তো আমি দিলাম। আমি শেষ মুহূর্তে পাত্র বদলে দিলাম, বেশি টাকার দরকার হল, আমি না দিলে কে দেবে? আমার একটা দায়িত্ব নেই? 

শতদলবাসিনী জিজ্ঞাসা করে না যে পরের মেয়ের কোন পাত্রের সঙ্গে বিবাহ, সাতাশ শ টাকার খেসারত দিবার দায়িত্ব নিয়া সে বিষয়ে মাথা ঘামাইতে যাওয়ার কী দরকার পড়িয়াছিল, যতীনকে ও কথা জিজ্ঞাসা করা বৃথা। মৃদুস্বরে সে শুধু বলে, নাইবা বদল করতে পাত্র? বেশি ভালো পাত্ৰ এনে লাভ তো হয়েছে ভারি, মেয়ের চোখের জল শুকুচ্ছে না। তার চেয়ে আগের পাত্রের সঙ্গে বিয়ে হলে হয়তো- 

যতীন ব্যগ্রভাবে জিজ্ঞাসা করে, তুমি কী করে জানলে শান্তি দুঃখ পাচ্ছে? 

ওমা, তা জানব না? সেজদি যে ভাগলপুরে থাকে। ননদ সেজদি নয়, আমার সেজদি—সেই যে বিয়ের সময় যে তোমার টিকি কেটে নিয়েছিল না?—সে। 

টাকার আলোচনা বেশিক্ষণ তাদের মধ্যে চলে না, অল্পক্ষণের মধ্যেই ব্যক্তিগত সমালোচনায় দাঁড়াইয়া যায়। একতরফা সমালোচনা, যতীন বলিয়া যায় আর শতদলবাসিনী চুপ করিয়া শোনে। টাকা সম্বন্ধে শতদলবাসিনীর সংকীর্ণতা কত যে পীড়ন করে যতীনকে বলিবার নয়। ভালো কাজেই যদি না লাগে, টাকার তবে আর মূল্য কী? মানুষের চেয়ে টাকা কি বড়? এতই যদি টাকা ভালবাসে শতদলবাসিনী, বাপকে বলিয়া রক্তমাংসের একটা মানুষের বদলে টাকার একটা বস্তাকে বিবাহ করিলেই পারিত! 

আমি মরলেই হাজার বিশেক টাকা পাবে। একদিন বিষ-টিস খাইয়ে দিয়ো বরং। 

ওমা, বিষ খাওয়াব কী গো? কী যে বল তুমি! 

আলোচনাটা হইয়াছিল বর্ষাকালের এক সন্ধ্যাবেলায়। তিন দিন পরে অবিশ্রাম বর্ষণের মধ্যে যতীন ভাগলপুর চলিয়া গেল। 

শান্তির জন্য যাচ্ছ? 

হ্যাঁ। 

কী আশ্চর্য, সেজদি আন্দাজে কী লিখেছে না লিখেছে—

দেখেই আসি কেমন আছে। 

পাঁচ দিন পরে সে ফিরিয়া আসিল এবং আসিয়াই শান্তির শ্বশুরের নামে পাঠাইয়া দিল পুরা একটি হাজার টাকা। শতদলবাসিনী ব্যাপারটা জানিতে পারিল আরো দিন সাতেক পরে। 

টাকা পাঠালে কেন? 

যতীন হাই তুলিয়া বলিল, পণের সব টাকা দেওয়া হয় নি বলে ওরা শান্তিকে কষ্ট দিচ্ছিল কিনা, তাই পাঠিয়ে দিলাম। 

সহজ কৈফিয়ত, কিন্তু শতদলবাসিনীর ট্যারা চোখের সঙ্গে ভ্রু দুটি পর্যন্ত কুঁচকাইয়া গেল। টাকা পেলে কোথায়? 

তা দিয়ে তোমার দরকার কী? 

শতদলবাসিনী উদাসভাবে বলিল, না আমার আর দরকার কী। ধার করেছ কিনা তাই জিজ্ঞেস করছিলাম? 

তাই বা জিজ্ঞেস করবে কেন? 

যতীনের মেজাজ বিগড়াইয়া গিয়াছে বুঝিয়া শাস্তির ভয়ে শতদলবাসিনী আর কথাটি বলে না। টাকা সম্বন্ধে নিজের হীনতার চেয়ে স্বামীর উদারতাই তাকে বেশি কাবু করিয়া ফেলে এবং সেজন্য ক্ষণিকের গ্লানি বা অনুতাপ বোধ করিবার মতো উদারও সে নয়। নিজের বোনের বিবাহের বেলায় যার টাকা থাকে না, পরের মেয়ের জন্য সে হাজার হাজার টাকা খরচ করিতে পারে, নিজের না থাকিলে ধার করিয়া যোগাড় করে, এরকম পরোপকার আজ যেন হঠাৎ তার বড় বেশি রকমের খাপছাড়া মনে হয়। এবং দু-একটা দিন কাটিতে মনে হয়, শুধু খাপছাড়া নয়, এটা অন্যায়ও বটে। 

কৃষ্ণার জন্য সস্তায় অপাত্র কেনা হইতেছে বলিয়া শতদলবাসিনীর এতদিন বিশেষ আপসোস ছিল না। যে মেয়ে গোপনে পরের ছেলের সঙ্গে চিঠি লেখালেখি করে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব যেমনতেমন একজনের সঙ্গে তার বিয়ে হইয়া যাওয়াই ভালো। পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের রোগা লম্বা গোঁয়ার-গোবিন্দ এক ছোঁড়া যাকে ওরকম আবোলতাবোল কথা-ভরা চিঠি পাঠায়, একটু বেশি বয়সের মোটাসোটা একজনের সঙ্গেই তার বিবাহ হওয়া উচিত—শাসনে থাকিবে। কেন যতীনও তো তাকে বেশি বয়সেই বিবাহ করিয়াছে, বিবাহের সময় যতীনও তো কম গোলগাল ছিল না, কিন্তু তাতে কী আসিয়া গিয়াছে? স্বামীকে অপছন্দ করিয়া সে কি কোনো দিন গোপনে কারো সঙ্গে চিঠি লেখালেখি করিয়াছে? তার যদি এতেই মন উঠিয়া থাকে, কৃষ্ণার উঠিবে না কেন? রূপে বল, গুণে বল, কোন দিক দিয়া তার সঙ্গে কৃষ্ণার তুলনা চলে? এমন রঙ আছে কৃষ্ণার, এমন গড়ন, এমন মধুর স্বভাব? এইসব ভাবিতে আর অপাত্রটিকেই কৃষ্ণার উপযুক্ত পাত্র বলিয়া তার বিশ্বাস জন্মিয়া যাইত। এবার কিন্তু তার মনে হয়, রূপে গুণে যতই তুচ্ছ আর খারাপ মেয়ে হোক কৃষ্ণা, সে তো শান্তির চেয়ে তুচ্ছ নয়, খারাপ নয়? শান্তির জন্য যদি দফে দফে এত টাকা খরচ করা যাইতে পারে, কৃষ্ণার জন্য কেন যাইবে না? পরের মেয়ের জন্য যতটা করা হইয়াছে, ঘরের মেয়ের জন্য অন্তত ততটুকু করা উচিত! 

কিন্তু করিবে কে? যতীনের বড় টাকার টানাটানি। 

ভাবিতে ভাবিতে শতদলবাসিনীর সোনার মতো মুখের রঙ একটু বিবর্ণ হইয়া আসে, উনানের আঁচেও আর যেন তেমন রঙ খোলে না। সামনে দাঁড়াইয়া সে কৃষ্ণার কণ্ঠার হাড়ের কাছে জমানো ময়লা চাহিয়া দ্যাখে, পিছন হইতে দ্যাখে তার দোলনময় চলন। মমতায় কাতর হইয়া ভাবে, আহা, এই মেয়েকে টাকার জন্যে একটা ধেড়ে হনুমানের কাছে বলি দেওয়া হইবে, একটা পিপের মতো মোটা জাম্বুবান হইবে এই কচি মেয়েটার বর? 

মুখ তোমার শুকনো দেখাচ্ছে কেন ঠাকুরঝি?

কী জানি, জানি না তো? 

না ঠাকুরঝি, অত ভেব না তুমি। আমি সব ঠিক করে দেব। আর চিঠি লিখেছে? 

কৃষ্ণা বুঝিয়াও না বুঝিবার ভান করে কিনা সেই জানে, বলে, কে চিঠি লিখবে? 

আহা, তোমার সে গো—সে। রোজ পাঁচ-দশটা চিঠি লেখালেখি করছ, জান না কে? 

ও, সে? কৃষ্ণা হঠাৎ রাগিয়া যায়, তুমি কেমন ধারা ইয়ে বউদি, বলছি আজ পর্যন্ত আমি একটা চিঠির জবাব দিই নি, বিশ্বাস হয় না কেন তোমার? 

শতদলবাসিনীও রাগিয়া যায়, কেন দাও নি জবাব? কী এমন মহাপুরুষটা তুমি যে একটা চিঠির জবাব দিতে বেধেছে? মিছিমিছি মানুষের মনে কষ্ট দিতে বড্ড ভালো লাগে, না? মেয়েমানুষ জাতটাই এমনি। 

কৃষ্ণা যেন মেয়েমানুষ জাতটার সম্মান বাঁচানোর জন্যই বলে, একটা জবাব দিয়েছি। লিখে দিয়েছি, ফের আমার কাছে চিঠি লিখলে পুলিশে ধরিয়ে দেব। 

ওমা, পুলিশে ধরিয়ে দেবে কী গো? কী যে বল তুমি! 

সে বিব্রত হইয়া থাকে, অশান্তি বোধ করে। ভাদ্রের গরমটা যখনই অসহ্যবোধ হয় তখনই মনে পড়ে আশ্বিনের বেশি দেরি নাই। আশ্বিনের গোড়ায় কৃষ্ণার বিবাহ হইয়া যাইবে। তার নিজেরই যেন একটা বড় রকমের বিপদের দিন ঘনাইয়া আসিতেছে। চিঠি লিখিলে পুলিশে ধরাইয়া দিবে লিখিয়া দিয়াছে? তার আগে একখানা চিঠিরও জবাব দেয় নাই? এ আবার কী ব্যাপার! অমন আগ্রহের সঙ্গে কেন তবে সে চিঠিগুলি পড়িত, পড়িতে পড়িতে আত্মহারা হইয়া যাইত? ব্লাউজের আড়ালে চিঠি লুকাইয়া সারা দিন ঘুরিয়া বেড়াইত? বড় প্যাচালো কাণ্ড-কারখানা সংসারে, বড় গোলমেলে মানুষের চালচলন। 

তার এত দুর্ভাবনা কেন শতদলবাসিনী বুঝিয়া উঠিতে পারে না। শান্তির সঙ্গে কৃষ্ণার যেন একটা নেপথ্য সংগ্রাম চলিতেছে, কৃষ্ণার পরাজয়ের কথাটা সে ভাবিতেও পারে না। তাই যদি ঘটে, বাঁচিয়া থাকিয়া সুখ কী? কীসের ছেলেমেয়ে, কীসের স্বামী, কীসের সংসার, কীসের রাঁধাবাড়া! 

খাইতে বসিয়া যতীন চিৎকার করে, ডালে নুন পড়ে নি, মাছের ঝোল নুনকাটা, দিন দিন কী হচ্ছে শুনি? দূর করে দেব বাড়ি থেকে সব কটাকে লক্ষ্মীছাড়া বজ্জাত এসে জুটেছে কোথা থেকে, জ্বালিয়ে মারলে। 

মা যদিবা কানে কম শোনে, এ কথাগুলি শুনিতে পায়। ডাকিয়া বলে, বউমা, খারাপ শরীর নিয়ে কেন রাঁধতে গেলে বাছা? ভালো মানুষের এ গরম সয় না, খারাপ শরীরে— 

যতীন ধমকাইয়া ওঠে, তুমি থামো, খারাপ শরীর না তোমার মাথা। 

পাশের বাড়ির দোতলায় ছাদের একদিকের খানিকটা আলিসায় ঝুঁকিলে এ বাড়ির বারান্দা দেখা যায়। নাতির কাঁথা মেলিয়া দিতে দিতে পাশের বাড়ির গিন্নি আলিসায় ঝুঁকিয়া জিজ্ঞাসা করে, কী হয়েছে বাবা 

মুখ তুলিয়া চাহিয়া যতীন হাসিমুখে বলে, কিছু হয় নি পিসিমা। নন্দর চিঠি পেয়েছেন? 

যতীনের পাতানো পিসি সরিয়া গেলে শতদলবাসিনী একবাটি দুধ আনিয়া দেয়। আজ দুধ দিয়েই খাও। ক’দিন শান্তির রান্না খেয়ে এসে আমার রান্না মুখে রুচছে না, না? 

মুখের উপর ছুড়িয়া মারার জন্য ডালের বাটিটা তুলিয়া নিয়া দেখিতে পায় ও বাড়ির পাতানো পিসিমা আড়ালে সরিয়া গিয়াছে, কিন্তু চলিয়া যায় নাই। আলিসার আড়ালে লুকাইয়া একটা ফাঁক দিয়া এদিকেই চাহিয়া আছে। ডালের বাটিটা যতীন নামাইয়া রাখে। 

শতদলবাসিনী বুঝিতে পারে, শাস্তিটা রাত্রির জন্য তুলিয়া রাখা হইল। তা হোক, শাস্তির ভয় কে করে? সব শাস্তির শেষ আছে কিন্তু কতগুলি ব্যাপার যেন কিছুতেই শেষ হইতে চায় না। 

ননদের সঙ্গে খাইতে বসিয়া সে বলে, একখানা চিঠি লেখো না ঠাকুরঝি?

কাকে চিঠি লিখব? 

তোমার সেই তাকে? 

ও, তাকে? তুমিই লেখো না? 

শতদলবাসিনী মুখভার করিয়া নুনকাটা মাছের ঝোলমাখা ভাত খাইতে থাকে। অনেকক্ষণ পরে বলে, তুমি বড় বোকা ঠাকুরঝি, বড্ড বোকা। আমি হলে কী করতাম জান, পালিয়ে যেতাম। 

পালিয়ে গিয়ে কী খেতে? 

সেও একটা সমস্যা বটে। মেয়েমানুষ হইয়া এ সমস্যাটা না বুঝিয়া উপায় নাই। কৃষ্ণা তবে অনেক ভাবিয়াই পুলিশে ধরানোর ভয় দেখাইয়া চিঠি লিখিয়াছে। 

কৃষ্ণা খাওয়া বন্ধ করিয়াছিল। মুখের ভাবটা তার কাঁদো কাঁদো। 

তুমি যে বলেছিলে সব ঠিক করে দেবে, দাও না? দু-চার দিনের মধ্যে বিয়েটা ঘটিয়ে দাও না। 

দু-চার দিনের মধ্যে বিয়ে! কার সঙ্গে? 

যার সঙ্গে ঠিক হয়েছে, আবার কার সঙ্গে। 

এই ভাদ্র মাসে? 

হোক ভাদ্র মাস। 

কথা শুনিলে মনে হয় তামাশা করিতেছে, মুখ দেখিলে বিশ্বাস হয় না। শতদলবাসিনী তাই মাখা ভাত নাড়াচাড়া করিতে করিতে চুপ করিয়া থাকে। কৃষ্ণা অধীর হইয়া বলে, চোখ নেই তোমার? আমায় দেখে বুঝতে পার না? 

একটু একটু যেন বুঝতে পারি পারি করছিলাম ঠাকুরঝি, ভরসা পাই নি। চিঠির জবাব দিতে না বললে, অথচ—দেখা হত, না? 

হত। 

তারপর দুজনেই চুপচাপ। আর খাওয়া গেল না, মাছ-তরকারিও আজ অখাদ্য হইয়াছে। 

অনেকক্ষণ পরে বলিল, ভাদ্র মাসে তো বিয়ে হয় না ঠাকুরঝি, একটা মাস দেরি করতেই হবে। 

রাত্রে ছেলেমেয়েরা ঘুমাইয়া পড়িতে দেরি করিতে থাকে, একজন ঘুমায় তো আরেক জন জাগিয়া ওঠে। যতীন দশটা বাজার আগেই শুইয়া পড়িয়াছিল, ছেলেমেয়েদের ঘুম পাড়াইতে পাড়াইতে শতদলবাসিনী আহ্বানের প্রতীক্ষায় উৎকর্ণ হইয়া থাকে। আজ সে শাস্তি গ্রহণ করিবে না—যাই বলুক যাই করুক যতীন আজ সে বিদ্রোহ করিবেই। একবার এখন ডাকিলেই হয়। আজ যেন তার সাহস বাড়িয়া গিয়াছে, সমাজ সংস্কার নীতি ধর্ম সবকিছুর বিরুদ্ধে যাইতে কৃষ্ণার যত সাহস দরকার হইয়াছিল তার চেয়ে বেশি। যতীন ডাকিয়া যেই বলিবে, পা টেপো, মাথা উঁচু করিয়া জবাব দিবে পারব না, আমি তোমার পা টেপা দাসী? 

তারপর? তারপর যা হয় হইবে। কৃষ্ণা চোখ মেলিয়া ভবিষ্যতের কত গাঢ় অন্ধকারকে বরণ করিয়াছে, সে চোখ বুজিয়া গালে একটা চড় খাইতে পারিবে না? 

মনের মধ্যে সদিচ্ছার চিতা জ্বলিতে থাকে, বীরত্বের দীপ্তিতে আত্মসম্মান উদ্ভাসিত হইয়া ওঠে। নিজেকে শতদলবাসিনীর মনে হইতে থাকে অতি উত্তম, অতি মহৎএকেবারে অসাধারণ কিছু। কিন্তু হায়, ছেলেমেয়ে ঘুমাইয়া পড়ে, রাস্তার ওপাশের বাড়ি দুটির সব আলো নিভিয়া যায়, পাড়া নিঝুম হইয়া আসে কিন্তু বিদ্রোহ করার সুযোগ দিতে কেউ তো ডাকে না। 

তারপর যতীনের নাক ডাকার শব্দ কানে আসিলে মনটা খারাপ হইয়া যায়। শাস্তি দিতেঁ না ডাকিয়াই ঘুমাইয়া পড়িয়াছে? নিজেকে বড় অসহায়, বড় নিরুপায় মনে হইতে থাকে। 

কিছুক্ষণ পরে উঠিয়া গিয়া শতদলবাসিনী ঘুমন্ত স্বামীর পা টিপিতে আরম্ভ করে। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *