দোকানির বউ

দোকানির বউ 

সরলার পায়ে সব সময় মল থাকে। মল বাজাইয়া হাঁটে সরলা,—ঝমর ঝমর! চুপিচুপি নিঃশব্দে হাঁটিবার দরকার হইলেও মল সরলা খুলিয়া ফেলে না, উপরের দিকে ঠেলিয়া তুলিয়া শক্ত করিয়া পায়ের মাংসপেশিতে আটকাইয়া দেয়—মল আর বাজে না। প্রথম প্রথম শম্ভু এ খবর রাখিত না, ভাবিত বউ আশপাশে আসিয়া পৌঁছানোর আগে আসিবে মলের আওয়াজের সংকেত—পিছন হইতে মোটর আসিবার আগে যেমন হর্নের শব্দ আসে। ক’বার বিপদে পড়িয়া বউয়ের মলের উপর শম্ভুর নির্ভর টুটিয়া গিয়াছে। 

ঘোষপাড়ার প্রধানতম পথটার ধারে একখানা বড় টিনের ঘরের সামনের খানিকটা অংশে বাঁশের মাচার উপর শম্ভুর দোকান। মাটির হাঁড়ি, গামলা, কেরোসিন কাঠের তক্তার চৌকো চৌকো খোপ, ছোটবড় বারকোশ, চটের বস্তা ইত্যাদি আধারে রক্ষিত জিনিসপত্রের মাঝখানে শম্ভুর বসিবার ও পয়সা রাখিবার ছোট চৌকি; হাত ও লোহার হাতা বাড়াইয়া এখানে বসিয়াই শম্ভু অধিকাংশ জিনিসের নাগাল পায়। পিছনে প্রায় এক মানুষ উঁচু পাঁচ সারি কাঠের তাক। সাবু, বার্লি ও দানাদার চিনি রাখিবার জন্য এক পাশে কাচ বসানো হলদে রঙের টিন, এলাচ, লবঙ্গ প্রভৃতি দামি মশলার নানা আকারের পত্র, লণ্ঠনের চিমনি, দেশলাইয়ের প্যাকেট, কাপড় কাচা গায়ে মাখা সাবান, জুতার কালি, লজেনচুস এবং মুদিখানা ও মনিহারি দোকানের আরো অনেক বিক্রেয় পদার্থের সমাবেশে তাকগুলি ঠাসা। তাকের তিন হাত পিছনে শম্ভুর শয়নঘরের মাটিলেপা চাঁচের বেড়ার দেয়াল। তাক আর এই দেয়ালের সমান্তরাল রক্ষণাবেক্ষণে যে সরু আবছা অন্ধকার গলিটুকুর সৃষ্টি হইয়াছে, শম্ভুর সেটা অন্দরে যাতায়াত করার পথ। সরলা বউ মানুষ, অন্দরেই তার থাকার কথা, কিন্তু সরলা মাঝে মাঝে করে কী, পায়ের মল উপরে ঠেলিয়া দিয়া চুপিচুপি তাকের জিনিসের ফাঁকে চোখ পাতিয়া দাঁড়াইয়া থাকে, স্বামীর দোকানদারি দেখে এবং খদ্দেরের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা শোনে। বাড়িতে শম্ভু খুব নিরীহ শান্ত প্রকৃতির চুপচাপ মানুষ, কিন্তু দোকানে বসিয়া খদ্দেরের সঙ্গে তাকে কথা বলিতে ও হাসি-তামাশা করিতে দেখিয়া সরলা অবাক মানে। মানুষ বুঝিয়া এমন সব হাসির কথা বলে শম্ভু যে তাকের আড়ালে সরলার হাসি চাপিতে প্রাণ বাহির হইয়া যায়। ক্রেতারা যদি পুরুষ হয় তবেই শম্ভুর ব্যবহারে এরকম মজা লাগে সরলার। কিন্তু দুঃখের বিষয়, শম্ভুর দোকানে শুধু পুরুষেরাই জিনিস কিনিতে আসে না। 

বেচাকেনা শেষ হওয়া পর্যন্ত সরলা অপেক্ষা করে, তারপর পায়ের মলগুলি আলগা করিয়া দেয় এবং মাটিতে লাথি মারার মতো জোরে জোরে পা ফেলিয়া ঝমর ঝমর মল বাজাইয়া অন্দরে যায়। শম্ভুও ভিতরে আসে। একটু পরেই। দেখিতে পায় উনান নিবিয়া আছে, ভাত-ডালের হাঁড়ি গড়াগড়ি দিতেছে উঠানে, আর স্বয়ং সরলা গড়াইতেছে রোয়াকে। অন্য দুর্লক্ষণগুলি শম্ভু তেমন গুরুতর মনে করে না; ঘরে তিন পুরুষের পালঙ্কে প্রশস্ত সুখশয্যা থাকিতে রোয়াকে ছেঁড়া মাদুরে কালা, কানা, বোবা ও বিকৃতমুখী সরলাকে পড়িয়া থাকিতে দেখিয়াই সে কাবু হইয়া যায়। তারপর অনেকক্ষণ তাকে ওজন করিয়া কথা বলিতে ও সোহাগ জানাইতে হয়। একটা মানুষের একটু হাসা ও একটা মানুষকে একটু হাসানোর মধ্যে যে দোষের কিছুই নাই আর একটা মানুষ যে কেন তা বুঝিতে পারে না বলিয়া অনেক আপসোস করিতে হয়, আর অজস্র পরিমাণে খরচ করিতে হয় দোকানে বিক্রির জন্য রাখা লজেনচুস। সরলা একেবারে লজেনচুস খাওয়ার রাক্ষসী, তাও যদি কম দামি লজেনচুস খাইয়া তার সাধ মিটিত পয়সায় যে লজেনচুস শম্ভু দুটির বেশি বিক্রি করে না, কেউ চার পয়সার কিনিলেও একটি ফাউ দেয় না, সেইগুলি সরলার গোগ্রাসে গেলা চাই। 

তারপর সরলার কানাত্ব কালাত্ব ও বোবাত্ব ঘোচে এবং রাগের আগুন নিবিয়া যায়। তবে একটা উদাস-উদাস অবহেলার ভাব, কথায় কথায় অভিমান করিয়া কাঁদো কাঁদো হওয়া, এ সমস্তের ওষুধ হিসাবে দরকার হয় একখানা শাড়ি, দামি নয়, সাধারণ একখানা শাড়ি, ডুরে হইলেই ভালো। 

এক বছর মোটে দোকান করিয়াছে শম্ভু, এর মধ্যে এমনিভাবে এবং এই ধরনের অন্যভাবে সরলা সাতখানা শাড়ি আদায় করিয়াছে। সাধারণ কম দামি শাড়ি—ডুরে হইলেই ভালো। 

.

তবু, বছরের শেষাশেষি চৈত্র মাসের কয়েক তারিখে, অকারণে শম্ভু তাকে আর একখানা ডুরে শাড়ি কিনিয়া দিল। বলিল অবশ্য যে ভালবাসিয়া দিয়াছে, একটু বাড়াবাড়ি রকমের ব্যগ্রতার সঙ্গে বাড়াবাড়ি রকম স্পষ্ট করিয়াই বলিল, কিন্তু বিনা দোষে সাত বার জরিমানা আদায়কারিণী বউকে এরকম কেউ কি দেয়? যাই হোক, শাড়ি পাইয়া এত খুশি হইল সরলা যে আর এক দণ্ডও স্বামীর বাড়িতে থাকিতে পারিল না, বেড়ার ও পাশে শ্বশুরবাড়িতে গিয়া হাজির হইল। শম্ভুর বাড়িটা আসলে আস্ত একটা বাড়ি নয়, একটা বাড়ির এক টুকরা অংশ মাত্র,—তিন ভাগের এক ভাগ। দোকানঘর ও শয়নঘরে ভাগ করা বড় ঘরখানা, উত্তরের ভিটায় আর একখানা খুব ছোট ঘর, তার পাশে রান্নার একটি চালা আর শয়নঘরের কোণ হইতে রান্নার চালাটার কোণ পর্যন্ত মোটা শক্ত ডবল চাঁচের বেড়া দিয়া ভাগ করা তিনকোনা এক টুকরা উঠান। শম্ভুরা তিন ভাই কিনা, তাই বছরখানেক আগে এই রকমভাবে পৈতৃক বাড়িটা ভাগ করা হইয়াছে, বেড়ার এ পাশে শম্ভুর একভাগ এবং ও পাশে অন্য দু ভায়ের বাকি দু ভাগ। এ পাশে শম্ভু আর সরলা থাকে, ও পাশে একত্রে থাকে শম্ভুর দাদা দীননাথ ও ছোটভাই বৈদ্যনাথ, তাদের বউ আর ছেলেমেয়ে, শম্ভুর বিধবা মা আর মাসি এবং শম্ভুর দুটি বোন। এভাবে শুধু বউটিকে লইয়া বাড়ির উঠানে বেড়া দিয়া ভিন্ন হওয়ার জন্য শম্ভুকে ভয়ানক স্বার্থপর মনে হইলেও আসল কারণটা কিন্তু তা নয়। এক বছর আগে শম্ভু ছিল বেকার, সরলার দোকানদার বাবা বিষ্ণুচরণ তখন অবিকল এই রকমভাবে ভিন্ন হওয়ার শর্তে জামাইকে দোকান করার টাকা দিয়াছিল। সুতরাং বলিতে হয়, স্বামীকে ভেড়া বানাইয়া নয়, বর্তমান সুখ ও স্বাধীনতাটুকু সরলা তার বাপের টাকাতেই কিনিয়াছে! 

কী সুখ সরলার, কী স্বাধীনতা! বেড়ার ও পাশে যাদের কাছে সে ছিল একটা বেকার লোকের বউ, বেড়ার এ পাশে এখন তাদের শোনাইয়া ঝমর ঝমর মল বাজাইয়া হাঁটিতে তার কী গর্ব, কী গৌরব! দোকানটা ভালোই চলিতেছে শম্ভুর, ওদের টানাটানির সংসারের তুলনায় তার কী সচ্ছলতা! একটু মুখভার করিলে তার ডুরে শাড়ি আসে, না করিলেও আসে। 

সরলার পরনে নূতন ডুরে শাড়িখানা দেখিয়া বেড়ার ও পাশের অনেকে অনেক রকম মন্তব্য করিল। তার মধ্যে সবচেয়ে কড়া হইল ছেঁড়া ময়লা কাপড়-পরা বড় জা কালীর মন্তব্য। শীর্ণ মুখে ঈর্ষা বিকীর্ণ করিয়া বলিল, নাচনেউলি সেজে গুরুজনদের সামনে আসতে তোর লজ্জা করে না মেজো বউ? যা যা নাচ দেখিয়ে ভোলাগে যা স্বামীকে। 

ছোট জা ক্ষেন্তির মাথায় একটু ছিট আছে কিন্তু ঈর্ষা নাই। সে খিলখিল করিয়া হাসিয়া বলিল, ঝমঝম যা মল বাজে সারা দিন, মেজদি নিশ্চয় দিনরাত্তির নাচে, দিদি। পান খাবে মেজদি? 

হঠাৎ ভাসুরের আবির্ভাব ঘটায় লম্বা ঘোমটা টানিয়া সরলা একটু মাথা নাড়িল। দীননাথ গম্ভীর গলায় বলিল, মেজোবউ কেন এসেছে পুঁটি? 

বিবাহের তিন মাসের মধ্যে স্বামী কর্তৃক পরিত্যক্ত কাঠির মতো সরু পুঁটি বলিল, এমনি। 

এমনি আসবার দরকার!——বলিয়া দীননাথ সরিয়া গেল। সরলা ঘোমটা খুলিল এবং বৈদ্যনাথ আসিয়া পড়ায় ক্ষেন্তি টানিল ঘোমটা। বৈদ্যনাথ একটু রসিক মানুষ, শম্ভু কেবল দোকানে বসিয়া বাছা বাছা খদ্দেরের সঙ্গে রসিকতা করে, বৈদ্যনাথ সময়-অসময় মানুষ-অমানুষ বাছে না। সম্ভবত রাত্রে তার রসিকতায় চাপিয়া চাপিয়া হাসিতে হয় বলিয়া ক্ষেন্তির মাথায় যখন-তখন কারণে অকারণে খিলখিল করিয়া হাসিয়া ওঠার ছিট দেখা দিয়াছে। সে আসিয়াই বলিল, মেজো বউঠান যে সেজেগুজে! কী সৌভাগ্য! কী সৌভাগ্য! কার মুখ দেখে উঠেছিলাম, অ্যাঁ? ও পুঁটি, দে দে বসতে দে, ছুটে একটা দামি আসন নিয়ে আয় গে ছিনাথবাবুর বাড়ি থেকে। 

এই রকম করে সকলে সরলার সঙ্গে। কেবল শম্ভুর মা বড় ঘরের দাওয়ার কোণে বসিয়া নিঃশব্দে নির্বিকার চিত্তে মালা জপিয়া যায়; সরলা সামনে আসিয়া ঢিপ করিয়া প্রণাম করিলেও চাহিয়া দেখে না। সরলা পায়ে হাত দিতে গেলে শুধু বলে, নতুন কাপড় পরে ছুঁয়ো না বাছা। 

সরলার দাঁতগুলি একটু বড় বড়। সাধারণত কোনো সময়েই সেগুলি সম্পূর্ণ ঢাকা পড়ে না। কুড়ি মিনিট শ্বশুরবাড়ি কাটাইয়া বাড়ি ফেরার সময় দেখা গেল তার অধর ও ওষ্ঠে আজ নিবিড় মিলন হইয়াছে। 

.

ভিন্ন হওয়ার আগে ওরা সরলাকে ভয়ানক যন্ত্রণা দিত। উঠানে বেড়া ওঠার আগে সরলা ছিল ভারি রোগা ও দুর্বল, কাজ করিত বেশি, খাইত কম, বকুনি শুনিয়া শুনিয়া ঝালাপালা কান দুটিতে শম্ভুও কখনো মিষ্টি কথা ঢালিত না।

এক বছর একা থাকিয়া সরলার শরীরটি হইয়াছে নিটোল, মনটি ভরিয়া উঠিয়াছে সুখ ও শান্তিতে। রানীর মতো আছে সরলা, রান্না ছাড়া কোনো কাজই একরকম তাকে করিতে হয় না, পাড়ার একটি দুঃখী বিধবা কাজগুলি করিয়া দিয়া যায়। দোকান করার জন্য তার বাবা যত টাকা শম্ভুকে দিবে বলিয়াছিল, সব এখনো দেয় নাই, অল্পে অল্পে দিয়া দোকানের উন্নতি করার সাহায্য করিতেছে। মাসে একবার করিয়া আসিয়া দোকানের মজুত মালপত্র ও বেচাকেনার হিসাব দেখিয়া যায়। প্রত্যেকবার মেয়েকে জিজ্ঞাসা করে ইতোমধ্যে শম্ভুর পত্নীপ্রেমে সাময়িক ভাটাও কখনো পড়িয়াছিল কি না। বড় সন্দেহপ্রবণ লোকটা, বড় অবিশ্বাসী, নয় তো মেয়ের আহ্লাদে গদগদ ভাব আর ডুরে শাড়ির বহন দেখিবার পর ও কথাটা আর জিজ্ঞাসা করিয়া জানিবার চেষ্টা করিত না। 

দুঃখ যদি সরলার কিছু থাকে সেটা তার এই পরম কল্যাণকর একা থাকিবার দুঃখ। বেড়ার ও ধারে অশান্তি-ভরা মস্ত সংসারটির কলরব দিনরাত্রি তার কানে আসে, ছোটবড় ঘটনাগুলির ঘটিয়া চলা এ বাড়িতে বসিয়াই সে অনুসরণ করিতে পারে; ছেলেমেয়েগুলি কখনো কাঁদে ক্ষুধায় আর কখনো কাঁদে মার খাইয়া, বড় জা কখনো কারণে অকারণে চেঁচায়, ছোট জা কখনো খিলখিল করিয়া হাসিয়া উঠিয়া ধমক শোনে, ছোট দেবর কখনো কাকে খোঁচা দিয়া ঠাট্টা করে, কবে কে আত্মীয়স্বজন আসে যায়। বেড়ার এক প্রান্ত হইতে অন্যপ্রান্ত পর্যন্ত সরলা স্থানে স্থানে কয়েক জোড়া ফুটা করিয়াছে, সরিয়া সরিয়া এই ফুটাগুলিতে চোখ পাতিয়া সে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটাইয়া দেয়। ওই আবর্তের মধ্যে কিছুক্ষণ পাক খাইয়া আসিতে বড় ইচ্ছা হয় সরলার। 

নিজের বাড়ি আসিয়া সে ডুরে শাড়ি ছাড়িল না, রান্নার আয়োজন করিল না; একবার শম্ভুর দোকানদারি দেখিয়া আসিয়া ছটফট করিতে লাগিল। বিকালে তার বাবা আসিবে, বাপের সঙ্গে কিছুদিনের জন্য বাপের বাড়ি চলিয়া যাইবে কি না তাই ভাবিতে লাগিল সরলা। কত কথা মনে আসে, আলস্যের প্রশ্রয়ে অবাধ্য মনে। শম্ভু বেকার ছিল তাই আগে সকলে তাকে দিত যন্ত্রণা, ভিন্ন হইয়া আছে বলিয়া এখন সকলে তার সঙ্গে ব্যবহার করে খারাপ। বেড়াটা ভাঙিয়া আবার ভাঙা বাড়ি দুটাকে এক করিয়া দিলে ওরা কি তাকে খাতির করিবে না? তার স্বামী এখন রোজগার করে, ভবিষ্যতে আরো অনেক বেশি করিবে, এই সমস্ত ভাবিয়া? তবে মুশকিল এই, এখন যদি দোকানের আয়ে ওরা ভাগ বসায় দোকানের উন্নতি হইবে না, এমন একদিন কখনো আসিবে না যেদিন লোহার সিন্দুকে টাকা রাখিতে হইবে শম্ভুকে। যত ডুরে শাড়ি সে আদায় করুক আর লজেনচুস খাক, দোকানের আয়ব্যয়ের মোটামুটি হিসাব তো সরলা জানে। তিন পুরুষের পালঙ্কে গিয়া সে শুইয়া পড়ে। কত দিন পরে ও বাড়ির সকলের ভয় ভালবাসা ও সমীহ কিনিবার মতো অবস্থা তার হইবে হিসাব করিয়া উঠিতে না পারিয়া বড় কষ্ট হয় সরলার। 

অনেকক্ষণ পরে উঠিয়া গিয়া অভ্যাস মতো সরলা একবার বেড়ার মাঝখানের ফুটায় চোখ পাতিয়া দাঁড়াইল। দেখিল, ও বাড়িতে বড় ঘরের দাওয়ায় বসিয়া শম্ভু সকলের সঙ্গে কথা বলিতেছে। মাঝে মাঝে শম্ভুকে সে বেড়ার ওদিকে দেখিতে পায়। এতে সরলা আশ্চর্য হয় না, সে পরের মেয়ে সে যখন যায়, শম্ভুও মাঝে মাঝে যাইবে বইকি! সরলার কাছে বিস্ময়কর মনে হয় শম্ভুর সঙ্গে সকলের ব্যবহার। ভিন্ন হওয়ার জন্য রাগ করা দূরে থাক কেউ যেন একটু বিরক্ত পর্যন্ত হয় নাই শম্ভুর উপর। বেড়া ডিঙানো মাত্র ও পাশের মানুষগুলির সঙ্গে শম্ভু যেন এক হইয়া মিশিয়া যায়, এতটুকু বাধা পায় না। পুঁটি এক গ্লাস জল আনিয়া দিল শম্ভুকে। সকলের সঙ্গে কী আলোচনা শম্ভু করিতেছে সরলা বুঝিতে পারিল না; মন দিয়া সকলে তার কথা শুনিতে লাগিল আর খুশি হইয়া কী যেন বলাবলি করিতে লাগিল নিজেদের মধ্যে। শম্ভু উঠিয়া আসিবার পরেও ওদের মধ্যে আলোচনা চলিতে লাগিল। সরলা অবাক হইয়া ভাবিতে লাগিল যে, তার স্বামীর যোগ আছে অথচ তার জানা নাই এমন কী গুরুতর ব্যাপার থাকিতে পারে যে এত পরামর্শ দরকার হয়? জিজ্ঞাসা করিতে শম্ভু বলিল, ও কিছু না। জমিজমা ভাগবাটোয়ারার কথা হচ্ছিল। আমার ভাগটা বেচে ফেলব ভাবছি কি না। 

কেন, বেচবে কেন? 

শম্ভু মুখভার করিয়া বলিল, তুমি জান না, না? কবে থেকে বলছি তেল নুন বেচে লাভ নেই একদম, বাজারে একটা মনিহারি দোকান করব,—তাতে টাকা লাগবে না? কোথায় পাব টাকা, জমি না বেচলে? 

সরলা বলিল, জমির থেকেও আয় তো হচ্ছে? 

দোকানে বেশি হবে। 

সরলা চিন্তিত হইয়া বলিল, কবে খুলবে বাজারে দোকান? 

পয়লা বোশেখ খুলব ভাবছি, এখন আমার অদেষ্ট। 

প্রকাণ্ড একটা হাই তুলিয়া মুখের সামনে তুড়ি দিল শম্ভু, মাথা নাড়িল, বাঁকা হইয়া বসিল। বলিল, তোমার বাবা বলেছিল সবসুদ্ধ ছ শ টাকা দেবে দোকান করতে, দোকান খোলার জন্যে এক শ দিয়ে বাকি টাকা আটকে দিলে। এক বছরে আর মোটে দু শ দিয়েচে তারপর—এমনি করলে দোকান চালাতে পারে মানুষ? দোকান করতেও একসঙ্গে টাকা চাই। 

মনে মনে একটা জটিল হিসাব করিয়া সরলা বলিল, বাবা তো আসবে আজ, বাবাকে বলব? 

শম্ভু বিষণ্ণ মুখে বলিল, বলে কী হবে? বিশ-ত্রিশ টাকার বেশি একসঙ্গে দেবে না। 

আমি বললে নিয্যস দেবে, বলিয়া সরলা একগাল হাসিল। 

তারপর বউকে লজেনচুস দিল শম্ভু, কালো গালে অদৃশ্য রঙ আনিল আর ফিসফিস করিয়া নিজের গোপন মতলবের কথা বলিতে লাগিল। মার হাতে কিছু টাকা আছে শম্ভুর, সব ছেলের চেয়ে শম্ভুকেই তার মা বেশি ভালবাসে তা তো জানে সরলা, ওই টাকাটা বাগানোর ফিকিরে আছে শম্ভু, নয়তো এত বেশি ও বাড়িতে যাওয়ার তার কী দরকার! বাজারে মস্ত দোকান খুলিবে শম্ভু, এবার আর দোকানদারি নয়, রীতিমতো ব্যবসাদারি, বাবাকে বাকি টাকাটা একসঙ্গে দিবার কথা বলিতে সরলা যেন না ভোলে। দুর্গা দুর্গা। না, এ বেলা আর রাঁধিবার দরকার নাই। ফলার-টলার করিলেই চলিবে। আহা, গরমে সরলার রাঁধিতে কষ্ট হইবে যে। 

.

সরলা জানে হিসাবে ভুল হইতেছে, বাটখারা লাভের দিকে না-ঝুঁকিবার সম্ভাবনা আছে, তবু স্বামীর সঙ্গে আর বেশি দোকানদারি করা ভালো নয়। বাপের টাকায় স্বামীকে কিনিয়া রাখিয়াছে এক বছর, এবার তাকে মুক্তি দেওয়াই ভালো, তাতে যা হয় হইবে। একদিন তো নিজেকে কোনো রকম রক্ষাকবচ ছাড়াই স্বামীর হাতে সমর্পণ করিতে হইবে তার। তা ছাড়া এক বছর ধরিয়া স্বামী তাকে যেরকম ভালবাসিয়াছে সেটা শুধু নিজের মনের খুঁতখুঁতানির জন্য ফাঁকি মনে করা উচিত নয়। অবশ্য, পেটে যে সন্তানটা আসিয়াছে সেটা জন্মগ্রহণ করা পর্যন্ত অপেক্ষা করিলেই সবচেয়ে ভালো হইত, এতদিন একসঙ্গে বাস করিয়া সরলার কি আর জানিতে বাকি আছে নিজের ছেলের মুখ দেখিলে শম্ভুর পাকা শক্ত মনটা কীরকম কাঁচা আর নরম হইয়া যাইবে। তবে ছেলেটার জন্মিতে এখনো অনেক দেরি। তার আগে জমি বেচিয়া বাজারে মনিহারি দোকান খুলিয়া বসিলে শম্ভু ভাবিবে সব কীর্তি তার একার, কারো কাছে কৃতজ্ঞ হওয়ার কিছু নাই। আগেকার কথা মনে করিয়া সরলা অবশ্য ভাবিয়া উঠিতে পারে না কৃতজ্ঞতার কতখানি দাম আছে শম্ভুর কাছে। বাজারে মনিহারি দোকান খুলিয়া দু-এক বছরের মধ্যে এমন অবস্থা যদি হয় শম্ভুর যে মাঝখানের বেড়াটা ভাঙিয়া সরলা নির্ভয়ে এবং সুখে-শান্তিতে, একরকম বাড়ির কর্ত্রীর মতোই সকলের সঙ্গে বাস করিতে পারে, হয়তো অকৃতজ্ঞ পাষাণের মতো শম্ভু নিজেই তাকে দাবাইয়া রাখিবে। তবু, ভবিষ্যতেও সে তার বশে থাকিতে পারে এরকম একটু সম্ভাবনা যখন দেখা গিয়াছে এবারে হাল ছাড়িয়া দেখাই ভালো যে কী হয়। 

সরলার সন্দেহপ্রবণ অবিশ্বাসী বাবা মেয়ের অনুরোধ শুনিয়া প্রথমটা একটু ভড়কাইয়া গেল। একসঙ্গে তিন শ টাকা! জামাইকে আর একটি পয়সা না দিবার কথাই সে ভাবিতেছিল। দোকান যেমন চলিতেছে শম্ভুর, তাতে দুজন মানুষের খাইয়া পরিয়া থাকা চলে, বড়লোকের মতো না হোক গরিবের মতো চলে। জামাইকে বড়লোক করিয়া দিবার ভার তো সে গ্রহণ করে নাই। মোট ছ শ টাকা অবশ্য সে দিবে বলিয়াছিল, তবে সংসারে কত সময় মানুষ অমন কত কথা বলে, সব কি আর চোখকান বুজিয়া অক্ষরে অক্ষরে পালন করা উচিত, না তাই মানুষ পারে? অবস্থা বুঝিয়া করিতে হয় ব্যবস্থা। তা ছাড়া, বাজারে মনিহারি দোকান খোলার মতো দুর্বুদ্ধি যদি শম্ভু করিয়া থাকে— 

কাঁদিয়া-কাটিয়া সরলা অনর্থ করিতে থাকে, কত কষ্টে বাপের কাছ হইতে টাকাটা সে আদায় করিয়া দিতেছে, শম্ভুকে তা বোঝানোর জন্য যতটা দরকার ছিল তার চেয়ে বেশি কাঁদাকাটা করে। দেবে বলেছিলে এখন দেবে না বলছ বাবা?—বলিতে বলিতে দুঃখে অভিমানে বুকটাই যেন ফাটিয়া যাইবে সরলার। একসঙ্গে তিন শ টাকা দেওয়া সরলার বাবার পক্ষে সহজ নয়, তবু একবেলা মেয়ের আক্রমণ প্রতিরোধ করিয়া সে হার মানিল। ছেলে তার আছে তিনটা কিন্তু আর মেয়ে নাই। সরলা তার একমাত্র মা-মরা ছোট মেয়ে। কোথায় দোকান করিবে, কীরকম দোকান খুলিবে, কত টাকার জিনিস রাখিবে দোকানে আর কত টাকা পুঁজি রাখিবে হাতে, শম্ভুকে এসব অনেক কথা জিজ্ঞাসা করিয়া সরলার বাবা গম্ভীর চিন্তিত মুখে বিদায় হইয়া গেল। 

সরলা বলিল, দেখলে? 

শম্ভু যথোচিতভাবে কৃতজ্ঞতা জানাইল। স্বামীদের যেভাবে স্ত্রীকে কৃতজ্ঞতা জানানো উচিত ঠিক সে ভাবে নয়, নম্রভাবে, সবিনয়ে শ্রদ্ধার সঙ্গে। এই সময় বেড়ার ও পাশে হঠাৎ শোনা গেল, ছোটবউ ক্ষেন্তির খিলখিল হাসি। বেড়ার ফুটায় সে চোখ পাতিয়া ছিল নাকি এতক্ষণ, তাদের আলাপ শুনিতেছিল? রান্নার চালাটার পিছন দিয়া ঘুরিয়া সরলা চোখের নিমেষে ও বাড়িতে গিয়া হাজির হইল। বৈদ্যনাথ ক্ষেন্তি আর বাড়ির কুকুরটা ছাড়া উঠান নির্জন। উঠানের বেড়া আর ধানের মরাইটার মাঝখানে দাঁড়াইয়া রসিক বৈদ্যনাথ স্ত্রীর সঙ্গে রসিকতা করিতেছিল। 

সবাই কোথা গেছে লো ছোটবউ? 

কাছে আসিয়া ক্ষেন্তি ফিসফিস করিয়া বলিল, ঘরে। 

সেটা অসম্ভব। চৈত্রের দুপুরে ঘরের বাহিরে কড়া রোদ, গরম বাতাস। কিন্তু এদের দু জনের কি ঘর নাই? এখানে এরা কী করিতেছে এসময়? হাসাহাসি? নিজের বাড়িতে ফিরিয়া বারান্দা ছাড়িয়া এবার সরলা ও শম্ভু ঘরে গেল। তিন পুরুষের পুরোনো পালঙ্কে (ভিন্ন হওয়ার সময় ভাইদের কবল হইতে শম্ভু সেটা কী কৌশলে বাগাইয়াছিল আজো সরলা তাহা বুঝিতে পারে না) শুইয়া সরলা চোখ বুজিল, শম্ভু বসিয়া বসিয়া টানিতে লাগিল তামাক। নিজেই তামাক সাজে কিনা শম্ভু, এত বেশি তামাক দেয় যে তামাক শেষ হইতে হইতে দুপুরে এবং রাত্রে দু বেলাই সরলার ধৈর্যচ্যুতি ঘটে। আজ দেখা গেল সে ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। হয় বাপের সঙ্গে সমস্ত সকালবেলাটা লড়াই করিয়া না হয় বৈদ্যনাথ ও ক্ষেন্তিকে ধানের মরাইয়ের আড়ালে রোদে দাঁড়াইয়া হাসাহাসি করিতে দেখিয়া সরলা বোধ হয় শান্ত হইয়া পড়িয়াছিল। 

.

দিন সাতেক পরে শম্ভু সকালবেলা সরলার বাবার কাছ হইতে টাকা আনিবার জন্য রওনা হইয়া গেল। গেল ও বাড়ি হইয়া। দোকানে নতুন মাল আনা সে কিছুদিন আগেই বন্ধ করিয়াছিল, অনেক জিনিস ফুরাইয়া গিয়াছে, অনেক খদ্দের ফিরিয়া যায়। মনিহারি দোকানে যেসব জিনিস রাখা চলিবে না, চাল ডাল মশলাপাতি, সেসব শেষ হইয়া যাওয়াই ভালো। তাই আজকাল একটা দিনের জন্যও দোকানটা সে বন্ধ রাখিতে চায় না। বৈদ্যনাথ আসিয়া দোকানে বসিবে। বেকার রসিক বৈদ্যনাথ। শম্ভুর যে ছোট ভাই এবং যে দুপুর রোদে উঠানে ধানের মরাইয়ের আড়ালে দাঁড়াইয়া বউয়ের সঙ্গে হাসাহাসি করে। শম্ভু ও একদিন বেকার ছিল, বউও ছিল শম্ভুর ছ্যাকড়া গাড়ির ঘোড়ার মতো হাড্ডিসার হোক, বউ বউ। ক্ষেন্তিই বা এমন কী রূপসি পরীর মতো? ওর মাথায় বরং ছিট আছে, এক বছর আগেকার সরলার মতো কম খাইয়া বেশি খাটিতে খাটিতেও কারণের চেয়ে অকারণেও বেশি খিলখিল করিয়া হাসে। বেকার অবস্থায় একবারও নয়, দোকানদার হওয়ার পর শম্ভুকে কয়েকবার হাসাহাসি করিতে দেখিয়াছে সরলা, কিন্তু সে অন্য একজনের সঙ্গে। তারপর শম্ভু বউকে কিনিয়া দিয়াছে ডুরে শাড়ি। অন্য অনেকের সঙ্গেই বৈদ্যনাথ হাসাহাসি করে, ক্ষেন্তিকে কিন্তু কখনো কিছু কিনিয়া দেয় না। কী করিয়া দিবে? পয়সা নাই যে! দু ভায়ের মধ্যে প্রভেদটা কী আশ্চর্যজনক! নামে নামে পর্যন্ত শুধু ‘নাথ’-এর মিল, ওটা বাদ দিলে একজন শম্ভু অন্যজন বৈদ্য! 

মল না বাজাইয়া দোকানে তাকের আড়ালে দাঁড়াইয়া সরলা বৈদ্যনাথের অনভ্যস্ত দোকানদারি দেখে। মালপত্রের অভাবে কেমন ফাঁকা ফাঁকা লক্ষ্মীছাড়া মনে হয় দোকানটা। 

ক’দিন হইতে মনটা ভালো ছিল না সরলার, উঁচু দাঁত দুটি অনেক সময় ঢাকা পড়িয়া যাইতেছিল। পাকা দোকানির মেয়ে সে, কাঁচা দোকানির বউ, তার কেবল মনে হইতেছিল ভুল হইয়াছে, ভুল হইয়াছে, শুধু লোকসান নয়, একেবারে সে দেউলিয়া হইয়া যাইবে এবার। কিছুদিন হইতে কী রকম যেন হইয়া উঠিয়াছে পারিপার্শ্বিক অবস্থা তার; সে বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছে না, তবু চোখকান বুজিয়া এই সব না-বোঝা অবস্থা ও ঘটনাগুলিকে পরিণতির দিকে চলিতে সাহায্য করিতেছে। আজকাল শম্ভু ঘন ঘন ও বাড়িতে যাওয়া-আসা শুরু করিয়াছে, ভাইদের সঙ্গে পরামর্শ করিতেছে, সেটা না হয় জমিজমার ভাগবাটোয়ারার জন্যই হইল, শম্ভুর সঙ্গে ও বাড়ির সকলের ব্যবহার? ও বাড়িতে কি শুধু দেবদেবী বাস করে যে, এক বছর ধরিয়া এমনভাবে ভিন্ন হইয়া থাকিয়া জমিজমার ভাগবাটোয়ারা করিতে গেলেও শম্ভুর সঙ্গে ওরা সকলে পরমাত্মীয়ের মতো ব্যবহার করিবে? তা ছাড়া এখানকার দোকান তুলিয়া দিয়া বাজারে দোকান খুলিতেছে শম্ভু, সেজন্য ও বাড়িতে একটা উত্তেজনার প্রবাহ আসিবে কেন? ওদের কী আসিয়া যায়? বেড়ার ফুটায় চোখ রাখিয়া সরলা স্পষ্ট বুঝিতে পারে ও বাড়ির বয়স্ক মানুষগুলির কী যেন হইয়াছে, অদূরভবিষ্যতে বিবাহ উপনয়নের মতো বড় রকম একটা ঘটনা ঘটিবার সম্ভাবনা থাকিলে বাড়ির লোকগুলি যেমন করে, ওরাও করিতেছে অবিকল তেমনই। হইতে পারে শম্ভুর বাজারে দোকান খোলার একই সময়ে ওদের সংসারেও একটা বড়ো ব্যাপার ঘটিবার উপক্রম হইয়াছে, তবে সেটা যে কী ব্যাপার তা সরলা জানিতে পারিতেছে না কেন? বেড়ার ও পাশে যা ঘটিবে, সকলে গোপন না করিলে সরলার কাছে তা তো গোপন থাকার কথা নয়। আর, সরলার কাছে সকলে যা গোপন করিবে, তার পক্ষে সেটা কি কখনো শুভকর হইতে পারে? 

শুধু টাকা আদায়ের চেষ্টা করার বদলে বাপের সঙ্গে এসব বিষয়ে পরামর্শ না করার জন্য সরলার দুঃখ হয়। মেয়েমানুষ সে, এত লোকের ষড়যন্ত্র সে কি সামলাইয়া চলিতে পারে? চক্রান্তটা বুঝিতে পারিলেও বরং আত্মরক্ষার চেষ্টা করিয়া দেখিত, একটা বুদ্ধি খাটানো চলিত। সে যে অন্ধকারে হাতড়াইয়া মরিতেছে, স্রোতে গা ভাসাইয়া দিয়াছে। সে যে ঠিক করিয়াছে এবার হাল ছাড়িয়া দেওয়াই ভালো। মেয়েমানুষ সে, বউ মানুষ সে, তার কি উচিত এমন অবস্থার সৃষ্টি করিয়া রাখা যাহাতে তার বিরুদ্ধে সকলের চুপিচুপি চক্রান্ত করিতে হয়? 

দোকানে খদ্দের নাই দেখিয়া একসময় সে বৈদ্যনাথকে ভিতরে ডাকিল।

আচ্ছা ঠাকুরপো, ও তোমাদের বাড়ি গিয়ে কী সব বলত বল তো?

রসিক বৈদ্যনাথ বলিল, তা জান না মেজোবউঠান? তোমার নিন্দে করত—তুমি নাকি দাদার এক কান ধরে ওঠাও, আর এক কান ধরে বসাও। কানের ব্যথায়— 

সরলা রাগিয়া বলিল, চাষার মতোন কথাবার্তা হয়েছে তোমার বাপু, এদিকে এক পয়সা রোজগার নাই, কথা শুনলে গা জ্বলে মানুষের। বিক্রির পয়সা থেকে আজ কত গাপ করবে তুমিই জান! 

ক’দিন আগে ধানের মরাইয়ের আড়ালে বউয়ের সঙ্গে হাসাহাসি করার পুরস্কার পাইয়া বৈদ্যনাথ দোকানে গিয়া বসিল। সরলা গালে হাত দিয়া রোয়াকে বসিয়া ভাবিতে লাগিল ভবিষ্যতের কথা। বড় ভাই উকিলের মুহুরি, পাত্র নিজে একটা পাস দিবার দু ক্লাস নিচে পর্যন্ত পড়িয়া একটা আড়তে হিসাব লেখার কাজ করে, এত সব দেখিয়া তার বাবা শম্ভুর সঙ্গে তার বিবাহ দিয়াছিল, তার দাঁত-উঁচু কালো মেয়েকে। নাই বা দিত? পাশের গাঁয়ের জগৎ নামে যে লোকটি জমি চাষ করিয়া খায় তার সঙ্গে দিলেই হইত? সে লোকটা এমনিই বশে থাকিত সরলার, আর অদৃষ্টে থাকিলে তাহাকে দিয়া আস্তে আস্তে অবস্থার উন্নতি করিয়া এমন দিন হয়তো সে আনিতে পারিত যখন ডুরে শাড়িটি পরিয়া মল বাজাইয়া সে ঘুরিয়া বেড়াইত, না করিত সংসারের কাজ, না শুনিত কারো বকুনি। দোকানদারের দাঁত-উঁচু কালো মেয়ের মুখ্যু চাষা স্বামীই ভালো। লেখাপড়া শিখিয়া পরের আড়তে যে কাজ করে আর পরের টাকায় দোকানি হয়, তার মতো পাজি বজ্জাত লোক 

পরদিন অনেক বেলায় শম্ভু ফিরিয়া আসা মাত্র সরলা টের পাইল, যে লোকটা কাল বাড়ি ছাড়িয়া গিয়াছিল অবিকল সেই লোকটাই ফিরিয়া আসে নাই। গিয়াছিল দম আটকানো অবস্থায়, ফিরিয়া আসিয়াছে হাঁফ ছাড়িয়া। শম্ভু একবার একটা মামলায় পড়িয়াছিল, রায় প্রকাশের দিন সে যেমন অবস্থায় কোর্টে গিয়াছিল আর স্বপক্ষে রায় শুনিয়া যেমন অবস্থায় ফিরিয়া আসিয়াছিল, এবার শ্বশুরবাড়ি যাওয়া-আসা তার সঙ্গে মেলে। 

টাকা পেলে? সরলা জিজ্ঞাসা করিল। 

শম্ভু একগাল হাসিয়া বলিল, হাঁ পেয়েছি।

সব? 

সব। পাখাটা কই? বাতাস কর না একটু। 

সরলা হাত বাড়াইয়া দেখাইয়া দিল, ওই যে পাখা বেড়ার গায়ে। হ্যাঁগো, দাদা কিছু বলল না এই টাকার ব্যাপার নিয়ে? বিয়ের সময় তোমাকে চার শ টাকা পণ দেওয়া নিয়ে বাবার সঙ্গে যে কাণ্ডটা বেধেছিল দাদার! 

শম্ভুর মুখের হাসি মিলাইয়া গিয়াছিল, কড়াদৃষ্টিতে চাহিয়া সে বলিল, ঘেমে-টেমে এলাম এই রোদে, পাখাটা পর্যন্ত এনে দিতে পার না তুমি হাতে? অন্য কেউ হলে বাতাস করত নিজে থেকে, বলতেও হত না। 

সরলা হাসিয়া বলিল, ছোটবউ করে, ঠাকুরপো ওকে খুব হাসায় কিনা সেই জন্যে। 

পাখাটা আনিয়া সরলা স্বামীকে বাতাস করিতে লাগিল বটে, বাতাসে শম্ভু কিন্তু ঠাণ্ডা হইল না। ভিতরে ভিতরে সে যে গরম হইয়াই আছে সেটা বুঝা যাইতে লাগিল তার মুখের ভাবে ও তাকানোর রকমে। সরলা আনমনে বলিতে লাগিল, আহা, আমার মাথার যত চুল তত বচ্ছর পরমায়ু হোক ছোটবউয়ের! 

কেন? 

কাল রাত্তিরে দুঃস্বপন দেখলাম যে। হাসতে হাসতে ছোটবউটা যেন মরে গেছে বুক ফেটে। আগুন লাগুক আমার পোড়া স্বপন দেখায়! 

শম্ভু রাগিয়া বলিল, ইয়ার্কি জুড়েছ নাকি আমার সঙ্গে, অ্যাঁ? ভালো হবে না বলছি। ঘেমে-টেমে এলাম আমি— 

বকুনি শুনিয়া সরলা অভিমান করিয়া পাখা ফেলিয়া বোয়াকে গিয়া ছেঁড়া মাদুরে শুইয়া পড়িল। কিছুক্ষণ পরে বাহিরে আসিয়া তেল মাখিতে মাখিতে শম্ভু বলিল, রাগ হল নাকি? রাগবার মতো কী তোমাকে বলেছি শুনি? 

সরলা জবাব না দেওয়ায় গামছা কাঁধে সে স্নান করিতে চলিয়া গেল পুকুরে। চলন্ত স্বামীকে দেখিতে দেখিতে চৈত্রের রোদে চোখে যেন ধাঁধা লাগিয়া গেল সরলার! ডুরে শাড়ি নয়, লজেনচুস নয়, সোহাগ নয়, মিষ্টি কথা নয়, শুধু সে রাগ করিয়াছে নাকি জিজ্ঞাসা করিয়া স্নান করিতে চলিয়া যাওয়া! একদিনে এমন অধঃপতন হইয়াছে শম্ভুর? কে জানে স্নান করিয়া আসিয়া খাইতে বসিয়া ডাল পোড়া-লাগার জন্য সরলাকে হয়তো আজ সে গালাগালি পর্যন্ত দিয়া বসিবে! সব কথা খুলিয়া বলিয়া বাবার সঙ্গে পরামর্শ না করিয়া কী ভুলই সে করিয়াছে। 

ডাল পোড়া-লাগার জন্য শম্ভু কিছু বলিল না, বরং মুখভার করিয়া না থাকার জন্য একবার অনুরোধই করিল সরলাকে। সরলা সজল সুরে বলিল, বকলে কেন? শম্ভু বলিল, না বকি নি। ঘেমে—টেমে এলাম কিনা— 

খাওয়ার পর সরলাই আজ তাকে তামাক সাজিয়া দিল। সাজিয়া দিল, ফুঁ দিয়া তামাক ধরাইয়া দিল না। আয়নার সামনে সে অভিনয় করিয়া দেখিয়াছে যে ফুঁ দিবার সময় বড় বিশ্রী দেখায় তার মুখখানা। শম্ভু নিজেই তামাক ধরাইয়া পরম পরিতৃপ্তির সহিত টানিতে আরম্ভ করিল। সরলা বলিল, ঠাকুরপো যা বিক্রি-সিক্রি করেছে, হিসাব নিয়ো। 

শম্ভু বলিল, নেব। 

সরলা বলিল, রাখালবাবুর বাড়ি আধমন চাল নিয়েছে, ছিনাথ উকিলের বাড়ি আড়াই সের মুগের ডাল, আড়াই পো মিছরি আর গায়ে মাখা একটা সাবান, তা ছাড়া খুচরো জিনিস অনেক বিক্রি হয়েছে। ভাঁড়ে করে ঠাকুরপো অনেকটা তেল বাড়ি নিয়ে গেছে কাল, আর আজ নিয়ে গেছে কতগুলো লেবেঞ্চুস, আর কীসের যেন একটা কৌটো, অত নামটাম জানি না বাপু আমি, জিজ্ঞেস কোরো। 

শম্ভু বলিল, আচ্ছা, আচ্ছা, সে হবেখন। 

তারপর একসময় সে ঘুমাইয়া পড়িল। সরলা একবার ও বাড়িতে গেল। কেহ তাহাকে আসিতেও বলে না, বসিতেও বলে না, তবে এতদিনে এটা তার সহ্য হইয়া গিয়াছে। বড় জা কালী শুইয়া আছে, ক্ষেন্তি সেলাই করিতেছে কাঁথা, বৈদ্যনাথ ঘুমে অচেতন। শাশুড়ি উবু হইয়া বসিয়া মালা জপিয়া চলিয়াছে, কাছে চুপচাপ বসিয়া আছে পুঁটি। ভাশুর এসময় কাজে যায়, নামমাত্র ঘোমটা দিয়া অনেকটা স্বাধীনভাবেই সরলা খানিকক্ষণ এ ঘরে খানিকক্ষণ ও ঘরে বেড়াইয়া ফিরিয়া আসিল। ক্ষেন্তির কাছেই সে বসিল বেশিক্ষণ। ফিসফিস করিয়া আবোল-তাবোল কতকগুলি কথা বলিল ক্ষেন্তি, একবার খিলখিল করিয়া হাসিল, আসল কথা একটিও আদায় করা গেল না তার কাছে। বাড়ি আসিয়া পালঙ্কে উঠিয়া সরলা বসিয়া রহিল। টাঙানো বাঁশে সাজানো জামাকাপড়গুলি জোর বাতাসে দুলিতেছে, ওর মধ্যে সরলার ডুরে শাড়ি দু খানাই দৃষ্টি আকর্ষণ করে বেশি। আর দৃষ্টি আকর্ষণ করে শম্ভুর ঘাড়ের কাছে লোমভরা মস্ত জন্মচিহ্নটি। কাত হইয়া শুইয়া আছে শম্ভু, চওড়া পিঠে শয্যায় বিছানো পাটির ছাপ। সরলা বিছানায় উঠিবার পর সে পাশ ফিরিয়াছে, সরলার দিকে নয়, ওদিকে। কে জানে এটা তার ভাগ্যেরই ইঙ্গিত কি না! এরকম কত ইঙ্গিত ভাগ্য মানুষকে আগেভাগে করিয়া রাখে। শম্ভুর সঙ্গে সম্বন্ধ হওয়ার ঠিক আগে সোনারপুরে তার জন্য খুব ভালো একটি পাত্র দেখিতে বাহির হওয়ার সময় তার বাবা চৌকাঠে হোঁচট খাইয়াছিল, আগের বারের ছেলেটা তার পেটের মধ্যেই যেদিন মরিয়া গিয়াছিল তার আগের রাত্রে একটা প্যাচা ঘরের পিছনে আমগাছটায় ডাকিয়া ডাকিয়া ভয়ে তাহাকে আধমরা করিয়া দিয়াছিল। সরলা হঠাৎ শক্ত হইয়া যায়, লম্বাটে হইয়া যায় তার মুখখানা। বেড়ার গায়ে ঠিক এমনি সময় একটা টিকটিকিও যে ডাকিয়া উঠিল আজ? মাগো, না জানি কী আছে সরলার কপালে! 

বিকালে ঘুম ভাঙিয়া মুখ-হাত ধুইয়া আগের বারের সাজা তামাক টানার সুখটা মনে করিয়া শম্ভু বলিল, দাও না, এক ছিলিম তামাক সেজে দাও না। 

সরলা বলিল, তুমি সেজে নাও। 

শম্ভু গভীর উদারতা বোধ করিতেছিল, জেলখানার কয়েদি যেন নিজের বাড়িতে তিন পুরুষের পুরোনো পালঙ্কে প্রথম ঘুম দিয়া উঠিয়াছে। নিজেই তামাক সাজিয়ে সে গিয়া দোকান খুলিল, কাঠের ছোট চৌকিটিতে বসিয়া তামাক টানিতে লাগিল। পাড়ার দুঃখী মেয়েটি আসিয়া বাসন মাজিয়া রান্নাঘর লেপিয়া জল তুলিয়া দিয়া গেল। ও বাড়ির দুপুরের স্তব্ধতা ধীরে ধীরে ঘুচিয়া যাইতে লাগিল। বেলা পড়িয়া গেল, সন্ধ্যা হইয়া আসিল। সরলা গা ধুইল না, রান্নার আয়োজন করিল না, খানিকক্ষণ ছটফট করিতে লাগিল অন্দরে আর খানিকক্ষণ ফাঁকে চোখ রাখিয়া দাঁড়াইয়া থাকিতে লাগিল দোকানে তাকের আড়ালে। সন্ধ্যার পর দীননাথ কাজ হইতে ফিরিয়া বাড়ি ঢোকার আগে আসিল শম্ভুর দোকানে। উপস্থিত খদ্দেরটি চলিয়া গেলে জিজ্ঞাসা করিল, টাকা পেয়েছিস? 

হাঁ, বাড়ি যান আমি যাচ্ছি। 

এখানেই বসি না, বসে কথাবার্তা কই? 

না, না, এখানে নয়, আড়ালে দাঁড়িয়ে চুপিচুপি সব শোনে। 

দীননাথ এ বগলের নথিপত্র ও বগলে চালান করিয়া বলিল, বাড়িতে ছেলেপিলেগুলো বড্ড জ্বালায়। বউমা এলে মলের আওয়াজে—? 

সরলার মল যে সব সময় বাজে না এ কথা বুঝাইয়া বলিতে সে যে কেমন লোকের মেয়ে এ বিষয়ে একটা মন্তব্য করিয়া দীননাথ বাড়ি গেল। খানিক পরে দোকান বন্ধ করিয়া আলো নিবাইয়া শম্ভু গেল অন্দরে। ত্রিকোণ উঠানের এক কোণে এক বছর আগে সরলার স্বহস্তে রোপিত তুলসীগাছটার তলায় শুধু একটা প্রদীপ জ্বলিতেছে নিবুনিবু অবস্থায়, আর কোথাও আলো নাই। বেড়া ডিঙাইয়া ও বাড়ির আলো খানিকটা শোবার ঘরের চালে আসিয়া পড়িয়াছে! ঘরে গিয়া একটা দেশলাইয়ের কাঠি জ্বালিয়া সরলা যে খাটে শুইয়া আছে শম্ভু তাহাও দেখিয়া লইল, একটা বিড়িও ধরাইয়া লইল। তারপর সরলাকে একবার ডাকিয়া সাড়া না পাইয়া নিশ্চিন্ত মনে চলিয়া গেল ও বাড়িতে। 

তখন উঠিয়া বসিল সরলা। এ বাড়িতে এক বছর রানীর মতো যে মল বাজাইয়া সে হাঁটিয়া বেড়াইয়াছে আজ প্রথম সেই মলগুলি খুলিয়া ফেলিল। এমন হালকা মনে হইতে লাগিল পা দুটিকে সরলার! লঘুপদে সে নামিয়া গেল উঠানে। বেড়ার ফুটায় চোখ দিয়া বুঝিতে পারিল ও বাড়ির একমাত্র কালি-পড়া লণ্ঠনটি জ্বলিতেছে বড় ঘরে এবং ও ঘরেই আসর বসিয়াছে তিন ভাইয়ের, দরজার কাছে বসিয়া আছে কালী আর ভিতরে তার শাশুড়ির শরীরটা রহিয়াছে আড়ালে, শুধু দেখা যাইতেছে মালা-জপ-রত হাত। রান্নার চালাটার পিছন দিয়া ঘুরিয়াই বেড়ার ওপাশে ও বাড়ির উঠানের একটা প্রান্ত পাওয়া যায়। সরলা সেদিকে গেল না, একেবারে নামিয়া গেল ও বাড়ির রান্নাঘর ও তার লাগাও ক্ষেন্তির ঘরের পিছনে ঝোপঝাড়ের মধ্যে। কী অন্ধকার চারদিক। ভয়ে সরলার বুক ঢিপঢিপ করিতেছিল। ছিটাল পার হওয়ার সময়ে পায়ে একটা মাছের কাঁটা ফুটিল। কিন্তু কী করিবে সরলা? ভয় করা আর মাছের কাঁটা ফোটাকে গ্রাহ্য করিলে তার চলিবে কেন? একা মেয়েমানুষ সে, এতগুলি লোক তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র জুড়িয়াছে, রচনা করিতেছে ফাঁদ। কীসের ভয় এখন, কীসের কাঁটা ফোটা! আর যা হয় হোক, অন্ধকারে এভাবে বনে জঙ্গলে আর ছিটালে হাঁটার জন্য কিছু যেন তার নাগাল না পায়, পেটের ছেলেটা এবারো যেন তার মরিয়া না যায় জন্ম নেওয়ার আগেই। এলোচুলে সে ঘরের বাহির হয় নাই, একটি চুল ছিঁড়িয়া ফেলিয়া বাঁ হাতের কড়ে আঙুলের নখে কামড় দিয়া তবে উঠানে নামিয়াছে, এই যা ভরসা সরলার 

বড়ঘরের পিছনে কয়েকটা কলাগাছ আছে, ঘরের দুটো জানালাও আছে এদিকে। উঁচু ভিটার ঘর, জানালাগুলিও বেড়ার অনেক উঁচুতে। এত কষ্টে এখানে আসিয়া জানালার নাগাল না পাইয়া সরলার কান্না আসিতে লাগিল। তবে জানালার পাশে পাতা চৌকিতেই বোধ হয় তিন ভাই বসিয়াছে, ওদের কথাগুলি বেশ শোনা যায়, শুধু বোঝা যায় না পুঁটি কালী শাশুড়ি ওদের মন্তব্য। কান্না এবং ঘরের ভিতরের দৃশ্যটা দেখিবার প্রবল ইচ্ছা দমন করিয়া সরলা কান পাতিয়া শুনিতে লাগিল। 

শম্ভুর গলা : ক’বার তো বললাম, এই সোজা হিসেবটা তোর মাথায় ঢোকে না বদ্যি? আমার দোকানে যা মনিহারি জিনিস আছে তার দাম একশর বেশিই হবে, ধরলাম এক শ। মাল না কেনার জন্যে হাতে জমেছে এক শ দু-পাঁচ টাকা, ধরলাম এক শ। আর শ্বশুরমশায় দিয়েছে তিন শ। এই হল পাঁচ শ, আমার ভাগ। তুই আর দাদা পাঁচ শ করে দিলে হবে দেড় হাজার। হাজার টাকায় দোকান হবে; হাতে থাকবে পাঁচ শ। 

হাসি চাপিতে ক্ষেন্তির মুখের কাপড় গোঁজার আওয়াজ। দীননাথের গলা : বউমা! বেহায়াপনা কোরো না বউমা। 

কী জানিস শম্ভু, বড় বউয়ের সব গয়না বেচে আর কুড়িয়ে বাড়িয়ে আমি না হয় পাঁচ শ দিলাম, বদ্যি অত টাকা কোথা পাবে? ছোটবউমার গয়না বেচলে তো অত টাকা হবে না। 

বৈদ্যনাথের গলা : শ-তিনেক হয়তো ঢের। তবে আমার বিয়ের আংটি বেচলে— 

শম্ভুর গলা : থাম বাপু তুই, সব সময় খালি ফাজলামি তোর। 

দীননাথের গলা : যেমন স্বভাব হয়েছে তোর তেমনি স্বভাব হয়েছে ছোটবউমার। 

শম্ভুর গলা : যাক, যাক। কাজের কথা হোক। বদ্যি তবে আড়াই শ দিক, লাভের আমরা যা ভাগ পাব ও পাবে তার অদ্দেক। ভাগাভাগির কথা বলছি এই জন্যে, আগে থেকে এসব কথা ঠিক করে না রাখলে পরে আবার হয়তো গোল বাধবে। যে যত দেবে তার তত ভাগ, বাস, সোজা কথা; সব গণ্ডগোল মিটে গেল।

একটু স্তব্ধতা। তারপর দীননাথের গলা : তবে আমিও একটা পষ্ট কথা বলি তোকে শম্ভু। তুই যে পাঁচ শ টাকা দিবি- 

শম্ভুর গলা : পাঁচ শ নগদ নয়, এক শ টাকার জিনিস, চার শ নগদ।

দীননাথের গলা : বেশ। চার শই আমাদের একবার তুই দেখা। গয়নাগাঁটি বেচে ফেলবার পর শেষে যে তুই বলবি 

শম্ভুর গলা (ক্রুব্ধ) : আমাকে বুঝি বিশ্বাস হয় না আপনার? ভাবছেন আমি ভাঁওতা দিয়ে- 

চার-পাঁচটি গলার প্রতিবাদ। শম্ভুর গলা (আরো ক্রুদ্ধ) : সকলকে সমান সমান ভাগ দিতে চাচ্ছি কিনা তাই আমাকে অবিশ্বাস! আমি যেন একা গিয়ে দোকান করতে পারি না! পাঁচ শ টাকা নিয়ে যদি দোকান খুলি আমি, এক বছরে হাজার টাকা লাভ করব, না আসতে চাও তোমরা নাই আসবে! চাই না তোমাদের টাকা। 

কোলাহল, কলহ, কড়া কথা, মধ্যস্থের গোলমাল থামানোর চেষ্টা খানিকক্ষণ বাজে ব্যক্তিগত কথা। আবার ঝগড়া বাধিবার উপক্রম। 

তারপর শম্ভুর গলা : বেশ, কাল সকালে টাকা দেখাব। 

দীননাথের গলা : গজেন স্যাকরার সঙ্গে কথা কয়ে এসেছি, সাড়ে ঊনত্রিশ দর দেবে বলেছে। কাল কাজে না গিয়ে গয়নাগুলোর ব্যবস্থা করব। যা লোকসানটাই হবে! এমনি সোনা হয় আলাদা কথা, তৈরি গয়না বেচার মতো মহাপাপ আর নাই। বউমা বুঝি রাঁধে নি আজ? এখানেই তবে তুই খেয়ে যা শম্ভু। ও পুঁটি, ঠাঁই করে দে তো আমাদের। 

.

বাসে টাকাগুলি রাখিয়াছিল শম্ভু, কোথায় যে গেল সে টাকা! টাকার শোকে এবং ও বাড়ির সকলের কাছে লজ্জায় শম্ভু পাগলের মতো চুল ছিঁড়িতে লাগিল। 

সরলা সান্ত্বনা দিয়া বলিতে লাগিল, কী আর করবে বল? অদেষ্টের ওপর তো হাত নেই মানুষের! আমি ঘুমোচ্ছি, ঘরের দরজা খোলা, আর তুমি ও বাড়িতে গিয়ে বসে রইলে রাত দশটা পর্যন্ত! আর ওই তো বাকো! শাবলের এক চাড়েই হয় তো ভেঙে গেছে। আমারই বা কী ঘুম, একবার টের পেলাম না! 

দু চোখে সন্দেহ ভরিয়া চাহিয়া শম্ভু বলিল, টের পেয়েছ কি না পেয়েছ-

সরলা তাড়াতাড়ি বলিল, এমন কোরো না লক্ষ্মী। যেমন দোকান করছিলে তেমনি কর এখন, বাবাকে বলে আর কিছু টাকা— 

আর কী টাকা দেবে তোমার বাবা! 

সহজে কি দেবে? আমি কাঁদাকাটা করলে— 

ঝমর ঝমর মল বাজাইয়া গিয়া সরলা স্বামীকে এক বাটি মুড়ি ও খানিকটা গুড় আনিয়া দিল। সস্নেহে বলিল, খাও। না খেলে কি টাকা ফিরে পাবে? বাবা টাকা যদি নাই দেয়,—দেবে ঠিক, যদির কথা বলছি—আমি গয়না বেচে তোমায় টাকা দেব। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *