জুয়াড়ির বউ

জুয়াড়ির বউ 

ধরিতে গেলে জুয়ার দিকে মাখনের ঝোঁক ছিল ছেলেবেলা হইতেই। তার অল্প বয়সের খেয়াল আর খেলাগুলির মধ্যে তার ভবিষ্যৎ জীবনের এমন জোরালো মানসিক বিকারের সূচনা অবশ্য কেউ কল্পনা করিতে পারিত না। বাজি ধরে না কে, লটারির টিকিট কেনে না কে, মেলায় গেলে নম্বর লেখা টেবিলে দু-চারটা পয়সা দিয়া ঘূর্ণমান চাকায় লেখা নম্বরের দিকে তীর ছোড়ে না কে? এসব তো খেলা—নিছক খেলা। তবে মাখনের একটু বাড়াবাড়ি ছিল। কথায় কথায় সকলের সঙ্গে বাজি ধরিত, লটারির টিকিট কেনার পয়সার জন্য বিরক্ত করিয়া করিয়া গুরুজনের মার খাইত, মেলায় গিয়া অন্য জিনিস কেনার পয়সা তীর ছুড়িবার খেলায় হারিয়া আসিত। এই তুচ্ছ ছেলেমানুষি পাগলামি যে একদিন একটা মারাত্মক নেশায় দাঁড়াইয়া যাইবে এ কথা কারো মনে আসে নাই। 

প্রকৃত জুয়া আরম্ভ হয় ঘোড়দৌড়ের মাঠে। মাখন তখন কলেজে গোটা দুই পরীক্ষা পাস করিয়াছে। নলিনীর দাদা সুরেশ ছিল তার প্রাণের বন্ধু, একদিন সে-ই ঘোড়দৌড়ের মাঠে নিয়া গেল। 

‘আজ একটু রেস খেলি চ’ মাখন।’ 

‘রেস? আমার কাছে মোটে দশটা টাকা আছে।’ 

‘আবার কত চাই? লাগে তো আমি দেবখন- আয়।’ 

সাত টাকা জিতিয়া দুজনের সেদিন কী ফুর্তি! সায়েবি হোটেলে সাতগুণ দাম দিয়া চিংড়ি মাছের মাথা আর মুরগির ঠ্যাং গিলিয়া বায়স্কোপ দেখিয়া সুরেশ বাড়ি গেল আর মাখন ফিরিল তার মেসে। তারপর আর দু-একবার রেস খেলিতে গিয়া কয়েকটা টাকা হারিয়াই সুরেশ যদি-বা বিরক্ত হইয়া মাঠে যাওয়া একরকম বন্ধ করিয়া দিল, একটা দিন যাইতে না পারিলে মাখনের মন করিতে লাগিল কেমন কেমন। সুরেশের কাছে প্রায়ই সে টাকা ধার করিতে লাগিল। 

আরেকটা পরীক্ষা কোনোরকমে পাস করিবার পর একদিন হিসাব করিয়া দেখা গেল সুরেশের কাছে মাখন অনেক টাকা ধারে। বন্ধুকে টাকা ধার দিতে দিতে সুরেশের নামে পোস্টাফিসে জমা টাকাগুলি প্রায় শেষ হইয়া আসিয়াছে। 

‘এবার বাড়ি গিয়ে তোর টাকা এনে দেব।’ 

ছেলেকে একেবারে এতগুলি টাকা দেওয়া মাখনের বাবার পক্ষে সহজ ব্যাপার ছিল না, তবু তিন-তিনটা পরীক্ষা পাস করা ছেলে চাকরির চেষ্টা করার আগে একজন বন্ধুর সঙ্গে ব্যবসা আরম্ভ করিয়া দেখিতে চায়, সুযোগ না পাইলে ভয়ানক কিছু করিয়া বসিবার মতো প্রচণ্ড আগ্রহের সঙ্গে দেখিতে চায়, টাকাটা তাকে না দিলেই বা চলে কেমন করিয়া? 

বন্ধুকে দেওয়ার জন্য টাকাগুলি সঙ্গে নিয়া মাখন কলিকাতায় পৌঁছিল শনিবার সকাল দশটার সময়। সমস্ত পথ সে ভাবিতে ভাবিতে আসিয়াছে, এতদিন অল্প টাকা নিয়া খেলার জন্য সে হারিয়াছে। বেশি টাকা নিয়া খেলিলে জিতিবার সম্ভাবনা বেশি। বন্ধুর সমস্ত ঋণ একেবারে শোধ করার কি দরকার আছে? আজ যদি কিছু বেশি টাকা টাইগার জাম্পের উপর ধরে—টাইগার জাম্প আজ নিশ্চয় জিতিবে, ঘোড়াটা ফেবারিট হইলেও তিনগুণ নিশ্চয় পাওয়া যাইবে! সুরেশকে দিয়া দেওয়ার আগে টাকাটা খাটাইয়া কিছু লাভ করিয়া নিলে দোষ কি আছে? সব টাকা নয়—অর্ধেক। হারুক বা জিতুক অর্ধেক টাকা সে স্পর্শ করিবে না, ঋণ পরিশোধের জন্য থাকিবে। 

সন্ধ্যার আগে শেষ ঘোড়দৌড়ের শেষে খালি পকেটে মাখন এনক্লোজারের ভিতর হইতে বাহির হইয়া আসিল। 

পরদিন অনেক বেলায় সে ম্লানমুখে সুরেশদের বাড়ি গেল। দরজা খুলিয়া দিল নলিনী। আগে হাসিমুখে অভ্যর্থনা করিত, আজ কিন্তু মুখখানা তার বড়ই গম্ভীর দেখাইতে লাগিল। 

‘ছাতে চুল শুকোচ্ছিলাম, আপনাকে আসতে দেখে নেমে এলাম।’ 

নলিনীর হাসির অভাবটা পূরণ করার জন্য মাখন নিজেই একটু হাসিবার চেষ্টা করিয়া বলিল, ‘বেশ করেছ। সুরেশ কই?’ 

‘দাদা আসছে। টাকা এনেছেন দাদার?’ 

মাখন থতমত খাইয়া বলিল, ‘টাকা? ও, টাকা। তুমি জানলে কী করে টাকার কথা?’ 

‘আমি কেন, সবাই জানে। বাবা রেগে আগুন হয়ে আছে। আনেন নি তো? তা আনবেন কেন!’—গম্ভীর মুখ অন্ধকার করিয়া নলিনী ভিতরে চলিয়া গেল। 

সুরেশ আসিলে টাকার কথাটা উঠিল বড়ই খাপছাড়া ভাবে। মাখন বলিল, ‘তোর টাকাটা দিতে পারব না সুরেশ। এক কাজ কর, ওই টাকাটা আমায় পণ দে, আমি নলিনীকে বিয়ে করব।’ 

.

কথা ছিল কথাটা গোপন থাকিবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা থাকিল না। বিনা পণে বন্ধুর বোনকে বিবাহ করার জন্য মনে মনে বাড়ির সকলেই একটু চটিয়াছিল— নলিনী তেমন রূপসীও নয়। কথাটার সমালোচনা হইত নানাভাবে—একটু কটুভাবেই। নলিনী যে কী করিয়া মাখনকে ভুলাইল ভাবিয়া সকলে অবাক হইয়া যাইত। আজকালকার মেয়ে, ফন্দিবাজ বাপের মেয়ে, ওদের পক্ষে সবই হয়তো সম্ভব। আচ্ছা, পয়সাকড়ি যখন দিল না, গয়না কিছু বেশি দেওয়া কি উচিত ছিল না নলিনীর বাপের? 

শুনিতে শুনিতে একদিন রাগে নলিনী দিশেহারা হইয়া গেল। বড় গুরুজন কেউ মন্তব্য করিলে রাগে দিশেহারা হইয়াও হয়তো সে চুপ করিয়াই থাকিত, কিন্তু সেদিন মন্তব্যটা করিয়াছিল ননদ বিধু। তার সঙ্গে ইতোমধ্যে কতকটা ভাব হইয়া যাওয়ায় সে বলিয়া ফেলিল, ‘পণ দেওয়া হয় নি মানে? পণ তো ওঁকে আগেই দেওয়া হয়েছে।’ 

তারপর সব জানাজানি হইয়া গেল। প্রথমটা কেউ বিশ্বাস করিতেই চায় না, কিন্তু সত্য কথায় বিশ্বাস না করিয়া উপায় কী! মাখনকে জিজ্ঞাসা করায় সেও স্বীকার করিয়া ফেলিল। 

রাত্রে মাখন বলিল, ‘টাকার ব্যাপারটা বলতে না তোমায় বারণ করেছিলাম? বললে কেন?’ 

নলিনী বলিল, ‘ব্যবসার নাম করে দাদাকে দেবার জন্য টাকা নিয়ে গিয়েছিলে আমায় বল নি কেন? আমার রাগ হয় না বুঝি?’ 

‘হুঁ, রাগ হলে তুমি বুঝি দশজনের কাছে আমার বদনাম করে শোধ তুলবে? তুমি তো কম শয়তান নও!’ 

বিশ্রী একটা কলহ হইয়া গেল, কথা বন্ধ রহিল তিন দিন। আবার কথা আরম্ভ হওয়ার দশ মিনিটের মধ্যে নলিনী জিজ্ঞাসা করিল, ‘আচ্ছা অতগুলো টাকা কী করলে? দাদার কাছ থেকে নিয়েছ, বাবার কাছ থেকে নিয়েছ, টাকা তো কম নয়!’ 

প্রথমে কৈফিয়তটা ভালো করিয়া নলিনীর মাথায় ঢুকিল না। চুপি চুপি কার সঙ্গে মাখন ব্যবসা করিতেছিল, সব টাকা লোকসান গিয়াছে। তারপর সে টের পাইল মাখন মিথ্যা বলিতেছে। মনটা তার খারাপ হইয়া গেল। স্বামীর মন তো তার ছোট নয়, টাকা-পয়সার ব্যাপারে সে বরং অতিমাত্রায় উদার। টাকা- পয়সার ব্যাপারেই তার কেন মিথ্যা বলার প্রয়োজন হইল? 

বাপ আর শ্বশুরের চেষ্টায় মাখনের একটা চাকরি জুটিয়া গেল ভালোই। বছর পাঁচেকের মধ্যে বেতন বাড়িয়া দাঁড়াইয়া গেল প্রায় তিন শ টাকায়। এতদিনে নলিনীর একটি ছেলে আর একটি মেয়ে হইয়াছে এবং কতকটা স্বামীর চাকরির জন্যই অতি দ্রুত প্রমোশন পাইয়া পাইয়া স্বামীর সংসারে প্রায় গিন্নির পদ পাইয়াছে। সংসারে বিশেষ অশান্তি নাই, রোগশোক নাই, অনটন নাই— নলিনীর মনেও জোরালো দুঃখ কিছু নাই। কেবল সেই যে তিন দিন কথা বন্ধ থাকার পর মাখনের মিথ্যা বলার জন্য মনটা তার খারাপ হইয়া গিয়াছিল, মৃদু আশঙ্কার মতো একটা স্থায়ী অস্বস্তির মধ্যে সেই মন খারাপ হওয়ারই কেমন যেন একটা অদ্ভুত খাপছাড়া জের চলিতেছে। কোনো পাপ করে নাই নলিনী তবু ভয়ে রূপান্তরিত পুরোনো পাপের মতোই কী যেন একটা দুর্বোধ্য ভার সব সময়েই তার মনকে বহন করিতে হইতেছে। 

মাখনের জুয়ার নেশা কাটিয়া যায় নাই, ভালবাসার নেশার মতোই প্রথম বয়সের উদ্দাম উচ্ছৃঙ্খলতা আর অসহ্য অধীরতার যুগটা পার হইয়া ধীরস্থির হিসাব করা নেশায় দাঁড়াইয়া গিয়াছে। পাকা প্রেমিকের অভ্যস্ত প্রেম করার মতো তার জুয়া খেলাটাও দাঁড়াইয়া গিয়াছে অনেকটা নিয়মিত। টাকা অবশ্য জমে না, অনেক সাধ অবশ্য মেটে না, মাঝে মাঝে বিশেষ প্রয়োজনের সময় টাকার জন্য সাময়িকভাবে রীতিমতো বিপদে পড়িতে হয়, তবু মোটামুটি সংসার চলিয়া যায়। মাখনের শ-খানেক টাকা বেতন হইলে যেমন চলিত তেমনিভাবে চলিয়া যায়। মাখনের বেতন শ-খানেক টাকা ধরিয়া নিলে অবশ্য অনেক হাঙ্গামাই মিটিয়া যাইত, এর চেয়ে অনেক কম বেতনেও জগতে অনেক লোক চাকরি করে, কিন্তু মুশকিল এই যে তিন শ টাকা যে বেতন পায় তার বেতনের দু শ টাকা কোনো কাজে না আসিলেও বেতন তার শ-খানেক টাকার বেশি নয় এটা ধরিয়া নেওয়া তার নিজের পক্ষেও অসম্ভব, আত্মীয় বন্ধুর পক্ষেও অসম্ভব। 

আত্মীয় বন্ধুর রাগ অভিমান বিরক্তি আর উপদেশ উপরোধ সমালোচনা এখনো চলিতে থাকিলেও নলিনী একরকম আর কিছুই বলে না। সে জানে এ রোগের ওষুধ নাই। এ কথাটাও সে জানে যে প্রয়োজন হইলে জুয়ার খরচটা মাখন কমাইয়া দিবে, কিন্তু সত্য সত্যই প্রয়োজন হওয়া চাই। পেট ভরানোর মতো, গা ঢাকা দেওয়ার মতো, রোগের সময় ডাক্তার টাকা ওষুধ কেনার মতো খাঁটি প্রয়োজন। এ রকম আসল প্রয়োজন মেটানোর দায়িত্ববোধের কাছেই কেবল তার জুয়ার নেশা হার মানে। 

কত কৃত্রিম প্রয়োজনই নলিনী দাঁড় করাইবার চেষ্টা করিয়াছে! কতবার কতভাবে স্বামীকে বুঝাইবার চেষ্টা করিয়াছে, সংসারে এটা চাই, ওটা চাই, সেটা চাই। মাখন শুধু বলিয়াছে, আচ্ছা আচ্ছা, হবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রায় কিছুই হয় নাই। 

বাড়ি বদলানোর জন্য নলিনী অনেকবার ঝগড়া করিয়াছে। বলিয়াছে, ‘এ বাড়িতে আমি থাকব না, একটা ভালো বাড়িতে চল।’ বলিয়া রাগ করিয়া বাপের বাড়িতে চলিয়াছে। তখন অবশ্য মাখন বেশি ভাড়ার একটা ভালো বাড়িতে উঠিয়া গিয়াছে, কিন্তু তার ফলটা নলিনীর পক্ষেই হইয়াছে মারাত্মক। কারণ, জুয়ার খরচ মাখন এক পয়সা কমায় নাই, টান পড়িয়াছে সংসারের খরচেই। আবার উঠিয়া যাইতে হইয়াছে কম ভাড়ার বাড়িতে। 

নলিনী বলিয়াছে, ‘আমি দুগাছা করে নতুন চুড়ি গড়াব।’ 

মাখন বলিয়াছে, ‘আচ্ছা।’ 

কিন্তু তারপর দুবছরের মধ্যে সস্তা একজোড়া দুলও নলিনীর গড়ানো হয় নাই। কারণ, চুড়িও নলিনীর আছে, দুলও আছে। 

.

কিন্তু নলিনী যেদিন বলিয়াছে, ‘একটা লাইফ ইনসিওর পর্যন্ত করবে না তুমি?’ তার এক মাসের মধ্যে মাখন দশ হাজার টাকার লাইফ ইনসিওরেন্স করিয়াছে এবং এখন পর্যন্ত নিয়মিত প্রিমিয়াম দিয়া আসিলেও বেশি ভাড়ার বাড়িতে উঠিয়া যাওয়ার ফলটা নলিনীকে ভোগ করিতে হয় নাই। 

ধরিতে গেলে টাকা-পয়সার ব্যাপারে স্বামীর সঙ্গে তার একটা বোঝাপড়াই হইয়া গিয়াছে। তবু সেই রহস্যময় মৃদু আতঙ্কের পীড়ন একটু শিথিল হয় নাই। কী যেন একটা বিপদ ঘটিবে—অল্পদিনের মধ্যেই ঘটিবে। কিন্তু কী ঘটিবে? মাখন একদিন জুয়ায় সর্বস্ব হারিয়া সর্বনাশ করিবে? কিন্তু মাখনের সর্বস্ব তো তার তিন শ টাকার চাকরি, উপার্জনের টাকা জুয়ার নেশায় নষ্ট করা সম্বন্ধে সে যতই অবিবেচক হোক, চাকরি নষ্ট করার মানুষ সে নয়। সে বিশ্বাস নলিনীর আছে। তবে? আরো অনেক বেশি আরামে ও সুখে বাঁচিয়া থাকার সুযোগ পাইয়াও স্বামীর দোষে কোনোরকমে খাইয়া পরিয়া অতি গরিবের মতো বাঁচিয়া থাকিতে হওয়ার যে জ্বালাভরা অভিযোগ, এটা কি তারই প্রতিক্রিয়া? 

কিন্তু কোথায় জ্বালাভরা অভিযোগ? রাজপ্রাসাদে রাজরানীর মতো সুখে ও আরামে থাকিবার ব্যবস্থা মাখন করিয়া দিক এটা সে চায়, মাখনের ভালবাসার প্রকাশ হিসাবে চায়, কিন্তু না-পাওয়ার জন্য বিশেষ ক্ষোভ তো তার নাই। 

নলিনী তাই কিছু বলে না। সব বিষয়েই সে একরকম হাল ছাড়িয়া দিয়াছে, মাখনের সহজ সাধারণ ভালবাসার মধ্যে একটু রোমাঞ্চ আনিবার চেষ্টায় পর্যন্ত। চেনা মানুষ স্বামী হইয়াছে, তার কাছে কি অচেনা মানুষের নাটকীয় ভালবাসা আশা করা যায়? এতদিন ছেলেমানুষ ছিল তাই চেষ্টা করিয়াছে, বিবাহের আগে বুদ্ধি কম ছিল তাই তখন ভাবিয়াছে, বিবাহ হইলে হয়তো মাখন বদলাইয়া যাইবে। কিন্তু জুয়ার নেশায় উত্তেজনা আর অবসাদের মধ্যে যার মনের জোয়ার ভাঁটা, বউয়ের কথা কি তার মনে পড়ে, বউয়ের জন্য একবার একটু পাগল হওয়ার সময় কি তার থাকে! 

ভাবিতে ভাবিতে নলিনীর সাধারণ ছোট ছোট চোখ দুটিতে অস্পষ্ট স্বপ্নের স্পষ্ট ছায়া এমন অদ্ভুত ভাবালুতার আবরণে ঘনাইয়া আসে যে জগতের সব ডাগর ডাগর চোখগুলিতেও তা সম্ভব মনে হয় না। হয়তো তখন দুপুরবেলায় আঁচল পাতিয়া মেঝেতে গড়ানোর অবসরটা পাওয়া গিয়াছে। ছেলেমেয়ের একজন খেলায় মত্ত, একজন ঘুমে অচেতন। চোখ বুজিলে কষ্ট বাড়িয়া যায়, নলিনী তাই চোখ মেলিয়া স্বপ্ন দেখে—তার কুমারী জীবনের স্বপ্ন : আত্মহারা আবেগের সঙ্গে তাকে ভালবাসিলে মাখন কী করিত। সম্ভব অসম্ভব কত কথাই নলিনী ভাবে। 

তারপর অল্প অল্প অস্বস্তির মধ্যে মৃদু ভয়ের পীড়নে স্বপ্ন শেষ হইয়া চোখ দুটি তার বড় সাধারণ দেখাইতে থাকে। দুটি সন্তান যার তার কেন আর এসব স্বপ্ন দেখা, আর কি এ স্বপ্ন সফল হয়! যদি-বা হয়, কোনো এক আশ্চর্য উপায়ে আংশিকভাবে সফল হয়, দুদিন পরে সেটুকু সম্ভাবনাও আর থাকিবে না। আবার ছেলে বা মেয়ে কোলে আসিবে নলিনীর, তারপর সব শেষ। উদাসীন মাখনের মধ্যে প্রেমের উদ্দীপনা জাগানোর কথা ভাবিতে তার নিজেরই কি লজ্জা করিবে না? কী দিয়াই বা সে উদ্দীপনা জাগাইবে? 

এখনো কেউ জানে না! দুদিন পরেই জানিবে। মাখন হয়তো খুশি হইয়া আদর-যত্ন বাড়াইয়া দিবে, বলিবে : ‘একটু দুধ খেয়ো। এ সময় দুধটুধ খেতে হয়।’ কিন্তু তারপর? আরো শান্ত হইয়া পড়িবে মাখন, আরো ঝিমাইয়া পড়িবে। মাথা কপাল খুঁড়িয়া মরিয়া গেলেও আর নলিনী তাকে জাগাইয়া তুলিতে পারিবে না। নলিনীর ভ্রূ কুঁচকাইয়া যায়, সঙ্কুচিত চোখ দুটিতে মরণের চেয়ে গভীর আতঙ্কের ছাপ পড়ে, শীতের দুপুরে কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা যায়। 

কোনো উপায় কি নাই? যে-কোনো একটা উপায়? ব্যর্থ হইলে যদি সৰ্বনাশ হওয়ার সম্ভাবনাও থাকে, তবু সার্থকতার যেটুকু সম্ভাবনা থাকিবে তারই লোভে সে একবার চেষ্টা করিয়া দেখিত। কিন্তু সেরকম উপায়ই বা কোথায় যাতে সমস্ত শেষ হইয়া যায়, নয় মাখনের ভালবাসা মেলে? 

ঠিক সেই সময় দুরুদুরু বুকে গভীর আগ্রহের সঙ্গে মাঠে রেলিং ঘেঁষিয়া এগারটি ঘোড়ার মধ্যে একটির অগ্রগতি লক্ষ করিতে করিতে ভাবিতেছিল, এবারো না জিতলে বিপদে পড়িবে বটে, কিন্তু যদি জেতে— 

সন্ধ্যার পর ঘোড়দৌড়ের মাঠ হইতে বন্ধু অবনীর সঙ্গে শ্রান্ত ক্লান্ত মাখন ফিরিয়া আসে। সুরেশের মতো অবনী এখন তার অন্তরঙ্গ বন্ধু। মানুষটা সে একটু বেঁটে, রোগা, লাজুক আর ভীরু। কথার জবাবে পারিলে কথা বলার বদলে মৃদু একটু হাসিয়াই কাজ সারে। কখনো কেউ তাকে উত্তেজিত হইতে দেখিয়াছে কি না সন্দেহ। ঘোড়া ছুটিবার সময় মাখন যখন আগ্রহ উত্তেজনায় বাঁ হাতের বুড়ো আঙুলটা কামড়াইতে থাকে, অবনী নির্বিকারভাবে বিড়ি টানিয়া যায়। জিতিলে মাখন ‘হুররে’ বলিয়া প্রচণ্ড একটা চিৎকার করিয়া লাফাইয়া ওঠে, হারিলে ঝিমাইয়া পড়ে। অবনী জিতিলেও মৃদু একটু হাসে, হারিলেও হাসে। 

.

নলিনীর সাজপোশাক দেখিয়া দুজনেই একটু অবাক হইয়া যায়। ফ্যাশন করিয়া শাড়ি পরিয়াছে, রঙিন ব্লাউজ গায়ে দিয়াছে, শুধু ঘষামাজায় খুশি না হইয়া গালে বোধ হয় একটু রঙের আর চোখে একটু কাজলের ছোঁয়াচ দিয়াছে। 

মাখন বলে, ‘কোথায় যাবে?’ 

নলিনী একগাল হাসিয়া বলে, ‘কোথায় আবার যাব?’ 

‘সেজেছ যে?’ 

সেজেছি? কী জ্বালা, কোথাও না গেলে বাড়িতে বুঝি ভূত সেজে থাকতে হবে?’ তারপর অবনীর কাছে গিয়া বলে, ‘সইকে বুঝি তালা বন্ধ করে রাখেন, আসে না কেন?’ 

অবনী নীরবে মৃদু একটু হাসে। 

‘চলুন সইয়ের সঙ্গে দেখা করে আসি।’ 

বলিয়া স্বামীর যে-বন্ধুর সঙ্গে তিন হাত তফাতে দাঁড়াইয়া নলিনী সংক্ষেপে কথা বলিত, রীতিমতো তার হাত ধরিয়া তাকে টানিয়া তোলে এবং মাখনের দিকে একনজর না চাহিয়াই বাহির হইয়া যায়। 

প্রাণপণে চেষ্টা করিয়াও নলিনী ভিতরের উত্তেজনা গোপন করিতে পারে না। অবনীর বউ বলে, ‘কী হয়েছে সই?’ 

‘কিছু না।’ 

কোমরে আঁচল জড়াইয়া অবনীর বউ রান্না করিতেছিল। নলিনীর চেয়ে সে বয়সে বড়, কিন্তু বড়ই তাকে ছেলেমানুষ দেখায়। মানুষটা সে সব সময়েই হাসিখুশি, কাজ করিতে করিতে গুনগুন করিয়া এখনো গান করে। তাকে দেখিলেই নলিনীর বড় হিংসা হয়, মনটা কেমন করিতে থাকে। ওর স্বামীও তো জুয়া খেলে, তার চেয়ে অনেক কষ্টেই ওকে সংসার চালাইতে হয়, দুটি ছেলের মধ্যে একটি ওর মরিয়া গিয়াছে, তবু সব সময় এমন ভাব দেখায় কেন, দুদিন আগে বিবাহ হইয়া আসিয়া স্বামীর আদরে মাটিতে যেন পা পড়িতেছে না! 

অবনীর বউ বলে, ‘এমন সেজেগুজে হঠাৎ? ‘ 

নলিনী বলে, ‘এমনি এলাম তোমায় দেখতে।’ 

‘কী ভাগ্যি আমার!’ ভাতের হাঁড়ি উনানে চাপাইয়া হাসিতে হাসিতে অবনীর বউ কাছে আসিয়া বসে। 

কথা আজ জমে না। রাত্রির সঙ্গে নলিনীর ভয় বাড়ে, ক্রমেই বেশি অন্যমনস্ক হইয়া যায়, তবু উঠিবার নাম করে না। যত রাত হইবে মাখন তত বেশি রাগ করিবে—তত বেশি নাড়া খাইবে মাখনের মন। একটুও কি পরিবর্তন আসিবে না? রাগটা যখন পড়িয়া যাইবে তখন? 

রান্না শেষ হয়, অবনীর খাওয়া হইয়া যায়, তখনো নলিনীকে বসিয়া থাকিতে দেখিয়া অবনীর বউ অস্বস্তি বোধ করিতে থাকে। হাসিখুশি ভাব মিলাইয়া গিয়া তারও মুখে যেন ভয়ের ছাপ পড়ে। 

‘আমায় কিছু বলবে সই?’ 

নলিনী মাথা নাড়িয়া বলে, ‘কী বলব? না, না, কিছু বলব না।’

‘তোমায় নিতে আসছে না যে।’ 

‘কে জানে। ওর কথা বাদ দাও।’ 

খানিক পরে অবনীর বউ বলে, ‘ওই তবে তোমায় দিয়ে আসুক আর রাত করে কাজ নেই। পুঁইচচ্চড়ি রেঁধেছি, মুখে দিয়ে যাবে সই?’ 

হোক আরেকটু রাত, মাখনের রাগ আরেকটু বাড়িবে। আরম্ভ যখন করিয়াছে, শেষ না দেখিয়া ছাড়িবে না। মরিয়া হইয়া নলিনী সখীর রান্না পুঁইচচ্চড়ি মুখে দিবার জন্য সখীর সঙ্গে একথালায় খাইতে বসে। দুজনে বেশ পেট ভরিয়া খায়, সকালের জন্য পান্তা না রাখাতেই ভাতে কম পড়ে না, আর ডাল ভাজা মাছ তরকারি যতটুকুই থাক, ভাগাভাগি করিয়া খাওয়ার সময় তো মেয়েদের কখনো কম পড়েই না। 

খাওয়ার পরে পান মুখে দিয়া অবনীর বউ স্বামীকে ডাকিয়া বলে, ‘ওগো শুনছ, একটু বেরিয়ে এসো ঘর থেকে। সইকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে এসো। বাবা, এগারটা বাজে!’ 

নলিনীর বুক কাঁপিয়া ওঠে। যেভাবে বাহির হইয়া আসিয়াছে, এতরাত্রে আবার অবনীর সঙ্গে একা ফিরিতে দেখিলে কী রাগটাই না জানি মাখন করিবে! করুক রাগ, রাগাইবার জন্যই তো সাজিয়া গুজিয়া এভাবে সে বাহির হইয়াছে, এখন সেজন্য ভয় পাইলে চলিবে কেন? নিজেকে নলিনী অনেক বুঝায় কিন্তু বুকের টিপ্‌ঢিপানি কিছুতেই কমে না। 

দু-বন্ধুর বাড়ি বেশি দূরে নয়। রিকশায় মিনিট দশেক লাগে। অবনীর বাড়ির কাছেই গলির মোড়ে রিকশা পাওয়া যায়। অবনী দুটি রিকশা ভাড়া করিতেছিল, নলিনী বারণ করিল, ‘মিছিমিছি কেন বেশি পয়সা দেবেন? একটাতেই হবে।’ 

‘না না, দুটোই নিই-’ 

নলিনীর গলার আওয়াজ বন্ধ হইয়া আসিতেছিল, এসব খাপছাড়া উত্তেজনা কী তার সহ্য হয়! তবু মরিয়া হইয়া সে বলিল, ‘আসুন না, একটাতে বসে গল্প করতে করতে যাওয়া যাবে।’ 

গল্প কিছুই হয় না, সমস্ত পথ দুজনেই যতটা সম্ভব পাশের দিকে হেলিয়া চুপচাপ বসিয়া থাকে। বাড়ির দরজার সামনে রিকশা থামামাত্র নলিনী তড়াক করিয়া নামিয়া যায়। অবনীকে বলে, ‘ওঁকে ডেকে দিয়ে আপনি এই রিকশাটা নিয়ে ফিরে যান।’ 

দরজা খুলিয়া দিতে আসিয়া মাখন দেখিতে পাইবে এতরাত্রে বউ তার এক রিকশায় অবনীর সঙ্গে পাশাপাশি বসিয়া বাড়ি ফিরিয়াছে, নলিনীর এই আশা বা আশঙ্কা পূর্ণ হইল না। দরজা খুলিয়া দিল চাকর। 

ঘরে গিয়া নলিনী দেখে কী, মেয়েটাকে কোলে নিয়া আনাড়ির মতো থাপড়াইয়া থাপড়াইয়া মাখন তাকে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করিতেছে। বউয়ের সাড়া পাইয়া মাখন ক্ষুণ্নকণ্ঠে বলিল, ‘কী আশ্চর্য বিবেচনা তোমার! দুজনকে ফেলে রেখে এত রাত পর্যন্ত বাইরে কাটিয়ে এলে? খুকিকে তো অন্তত নিয়ে যেতে পারতে সঙ্গে।’ 

মেয়েকে নামাইয়া দিয়া মাখন নিজের বিছানায় উঠিয়া শান্তভাবে চোখ বুজিয়া শুইয়া পড়িল। খুব যে রাগ করিয়াছে তার কোনো লক্ষণ দেখা গেল না। 

‘তুমি কাউকে পাঠালে না কেন? অবনীবাবুর সঙ্গে কথা কইতে কইতে—’

‘কাকে পাঠাব? শম্ভু এতক্ষণ খুকিকে রাখছিল।’

দুমিনিট আগে দরজা খুলতে যাওয়ার সময় শম্ভু তবে মেয়েকে মাখনের কোলে দিয়া গিয়াছিল, সন্ধ্যা হইতে মাখনকে মেয়ে রাখিতে হয় নাই! নলিনী জিজ্ঞাসা করিল না, মাখন নিজে কেন তাকে আনিতে যায় নাই। আর জিজ্ঞাসা করিয়া কী হইবে? নিজের চোখে বউ আর বন্ধুকে জড়াজড়ি করিতে দেখিলেও বোধ হয় তার রাগ হইবে না। এমন বদমেজাজি মানুষ, এক গ্লাস জল দিতে দেরি হওয়ায় আজ সকালেই শম্ভুকে মারিতে উঠিয়াছিল, শুধু বউকে তার এত অনুগ্রহ কেন? একদিন কি সে রাগের মাথায় বউয়ের গালে একটা চড় বসাইয়া দিতে পারে না, যাতে খানিক পরে ভালবাসার জন্য না হোক অন্তত অনুতাপের জন্যও অনেকগুলি চুমু দিয়া চড়ের দাগটা মুছিবার চেষ্টা করা চলে? 

বাহিরটা একবার তদারক করিয়া আসিয়া নলিনী ঘুমন্ত মেয়ের পাশে শুইয়া পড়ে। মাখন বলে, ‘খেলে না?’ 

নলিনী বলে, ‘ওদের বাড়ি থেকে খেয়ে এসেছি।’ 

খানিকক্ষণ চুপচাপ কাটিয়া যায়, তারপর মাখন যেন ভয়ে ভয়েই আস্তে আস্তে বলে, ‘আজ অনেকগুলি টাকা জিতেছি।’ 

নলিনী সাড়া দেয় না। 

‘প্রায় সাতশ।’ 

নলিনী তবু সাড়া দেয় না। 

‘তোমায় একটা গয়না গড়িয়ে দেব—যা চাও।’ 

নলিনী চুপ করিয়া থাকে। নিঃশব্দে কাঁদিতে কাঁদিতে ভাবে ‘কে শুনতে চায় তুমি হেরেছ কি জিতেছ, কে চায় তোমার গয়না, একবার কাছে ডাকতে পার না আমায়?’ 

অনেকক্ষণ অপেক্ষা করিয়া মাখন বলে, ‘রাগ করেছ? না না, ঘুমোও আর জ্বালাতন করব না।’ 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *